লোককাহিনি
15% OFF * FREE SHIPPING
লোককাহিনি
প্রতিদিনের মতো পরদিনও সে আবার চলে গেল ভেড়া নিয়ে চরাতে নদীর ধারে। পেমা তখন উৎসাহ নিয়ে দেখতে গেল বাগানের সেই জায়গাটা যেখানে তেনজিং রাক্ষসটাকে পুঁতে রেখেছিল। কৌতূহলের বশে মাটি সামান্য সরাতেই বেরিয়ে এল রাক্ষসের কাটা মাথাটা।
অরিন্দম ঘোষ
ভুটানের এক প্রান্তে ছিল জঙ্গলঘেরা এক ছোট্ট গ্রাম। সেখানে বাস করত তেনজিং আর পেমা নামে দুই ভাইবোন। কী এক কঠিন অসুখে তাদের বাবা-মা দুজনেই মারা যান। তারা তখন অনেকটাই ছোটো। ভাইবোন হলে কী হবে, পেমা কিন্তু ভাইকে একদম ভালোবাসত না, বরং খুব হিংসা করত। তাদের ছিল একপাল ভেড়া, আর একটা ছোটো সবজি ক্ষেত। পেমা করত মাঠে সবজি ফলানোর কাজ, আর তেনজিং ভেড়ার পালকে নিয়ে চলে যেত নদীর ধারে তাদের চরাতে।
নদীটা ছিল বিশাল চওড়া আর তেমনই উত্তাল। পারাপার করার জন্য কাছেপিঠে কোনও সাঁকো ছিল না। তাছাড়া সবসময় ঘন কুয়াশা জমে থাকত নদীর উপর। ও-পাড়ে গভীর জঙ্গল আছে বোঝা যেত, কিন্তু স্পষ্ট করে দেখা যেত না কিছুই। তেনজিং ভেড়ার পালকে চরতে দিয়ে পাথরের উপর বসে বাঁশি বাজাত রোজ। তার বাঁশির সুর হাওয়ায় ভেসে নদী পেরিয়ে চলে যেত অপর পাড়ে।
একদিন ভেড়াগুলো জল খেতে ঢালু পাড় বেয়ে নদীর ধারে নামল। তেনজিংও গেল তাদের পিছু পিছু। হঠাৎ নদীর ও-পাড় থেকে কার যেন গলার আওয়াজ শোনা গেল।—“কে আছে ও-পাড়ে? আমি কি ও-পাড়ে যেতে পারি?”
চমকে উঠে তেনজিং ভালো করে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল একবার। কুয়াশা ভেদ করে যেন একটা আবছা মানুষের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে নদীর ও-পাড়ে। সে ভাবল ও-পাড়ে মানুষের বাস আছে তা তো জানা ছিল না। সেই সঙ্গে তার তখন বেশ ভয়-ভয়ও করতে লাগল। তাই তেনজিং জবাব না দিয়ে সেখান থেকে ফিরে আসাটাই ঠিক হবে ভেবে তাড়াতাড়ি ফিরে চলে এল। ঘটনাটা মন থেকে ভুলতে না পারলেও পেমাকে এ বিষয়ে সে কিছু জানাল না।
কিন্তু ঘটনাটা ঘটতেই লাগল। প্রতিদিন তেনজিং সেই আওয়াজ শুনতে পায়, সেই আবছায়া মূর্তি দেখতে পায়, কিন্তু জবাব দেয় না। বলব না বলব না করেও একদিন সে দিদির কাছে কথাটা বলেই ফেলল।
পেমা সব শুনে বলল, “লোকটাকে আসতে বল বরং। এখানে আমাদের কাছে থাকবে, আর ক্ষেতের কাজে-কর্মে লেগে যাবে।”
তেনজিং রাজি হল।
পরদিন ভেড়া নিয়ে নদীর ধারে গিয়ে একটু অপেক্ষা করতেই সেই গলা ভেসে এল।—“নদীর ও-পাড়ে কে রয়েছে? আমি কি যেতে পারি ওদিকে?”
তেনজিং জবাব দিল, “আমি দিদিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি আসতে পারো।”
“ঠিক আছে। আজ রাতে আমি পৌঁছে যাব তোমাদের কাছে।” ও-পাড় থেকে উত্তর শোনা গেল।
সন্ধ্যা থেকে ভাইবোন অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু কেউ আসে না। রাত হয়। অবশেষে দুজন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। মাঝরাতে হঠাৎ একটা শব্দে দুজনের ঘুম ভেঙে যায়। কী প্রচণ্ডভাবে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে কেউ! তেনজিং আর পেমা একে অপরের দিকে তাকায়। দরজা খুলতে যাবার সাহস কারও হয় না। দরজার বাইরে থেকে এবার শোনা যায়—“দরজা খোলো। তোমরা বলেছিলে বলেই আমি এসেছি। দরজা খোলো, না-হলে আমি দুজনকেই মেরে খেয়ে ফেলব।”
এবার দুজনেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। জানালা দিয়ে পালিয়ে যাবার জন্য তারা প্রস্তুত হয়ে থাকে। দরজা ঠেলতে ঠেলতে যে-মুহূর্তে ছিটকিনি ভেঙে দরজাটা খুলে যায়, তক্ষুনি দুজনে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে বাইরে। আর ছুটতে থাকে প্রাণপণে।
ছুটতে ছুটতে বেশ কিছুদূর এসে গেছে, এমন সময় দেখে এক লামা ধ্যানে বসে রয়েছেন। ওদের ওভাবে ছুটতে দেখে লামা চোখ খুলে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? তোমরা এভাবে দৌড়োচ্ছ কেন?”
দুজনে হাঁপাতে হাঁপাতে লামাকে সব কথা খুলে বলে। লামা তখন বললেন, “ভয় পেও না। আমি তোমাদের একটা মন্ত্রপূত তরোয়াল দিলাম। এটা নিয়ে তোমরা ফিরে যাও আর সাহসের সঙ্গে রাক্ষসটার মোকাবিলা করো।”
লামার কাছ থেকে ভরসা পেয়ে তেনজিং আর পেমা বাড়ি ফিরে আসে। ভীষণদর্শন রাক্ষসটা তখনও ওদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু তেনজিং ভয় পেল না। রাক্ষসটা ঝাঁপিয়ে পড়লেও সামান্য চেষ্টাতেই সেই মন্ত্রপূত তরোয়াল দিয়ে তেনজিং তাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলল। তারপর ওই তরোয়াল দিয়েই মাটি খুঁড়ে টুকরোগুলোকে পুঁতে ফেলল বাগানের মাটির নীচে।
প্রতিদিনের মতো পরদিনও সে আবার চলে গেল ভেড়া নিয়ে চরাতে নদীর ধারে। পেমা তখন উৎসাহ নিয়ে দেখতে গেল বাগানের সেই জায়গাটা যেখানে তেনজিং রাক্ষসটাকে পুঁতে রেখেছিল। কৌতূহলের বশে মাটি সামান্য সরাতেই বেরিয়ে এল রাক্ষসের কাটা মাথাটা। অবাক বিস্ময়ে পেমা লক্ষ করল, মাথাটা তাকে বলছে, “তোমার ভাই একটা শয়তান। আমি এসেছি ওকে খতম করে তোমাকে রক্ষা করতে। তুমি আমায় মাটির নীচ থেকে বার করে দাও। আমি তোমার ভাইকে মেরে তোমাকে বিয়ে করব আর অনেক সুখে রাখব।”
রাক্ষসটার মিষ্টি কথায় ভুলে গিয়ে পেমা তার শরীরের টুকরোগুলো এক করে রাখতেই রাক্ষসটা উঠে বসল। বলল, “আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখো। আমি সময়মতো তোমার ভাইকে খতম করে দেব।”
রাক্ষসের শরীরটা আস্ত হয়ে গেলেও সে তখনও খুবই দুর্বল।
রাক্ষসটা নিশ্চয়ই পেমাকে জাদু করেছিল। তাই সে বাড়ির একটা চিলেকোঠার ঘরে রাক্ষসটাকে লুকিয়ে রাখল আর নিজে অসুস্থ হবার ভান করে বিছানায় শুয়ে রইল। বিকালে তেনজিং বাড়িতে ফিরে এসে দেখল দিদি অসুস্থ। পেমা তখন তাকে বলল, “আমার শরীরটা ভালো লাগছে না ভাই। তুই আমাকে যদি বানরের দুধ এনে দিতে পারিস সেটা খেয়ে আমি মনে হয় সুস্থ হয়ে উঠব।”
তেনজিং তখনই বেরিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে বানরের দুধের সন্ধানে। কিছুদূর গিয়ে দেখে একটা বানরের দল বসে রয়েছে। সে তাদের কাছে গিয়ে অনুরোধ করল—“আমার দিদির শরীর খুব খারাপ। বানরের দুধ খেলে সে সুস্থ হয়ে উঠবে। তোমরা কি আমায় একটু দুধ দিতে পারবে?”
বানররা তখন তাকে বলল, “এমনি এমনি তো দুধ দেব না। আমাদের আগে কোনোভাবে খুশি করো।”
তেনজিং তখন তার বাঁশি বাজাতে শুরু করল। সব বানর তার বাঁশি শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল। একজন মা বানর তখন তাকে দুধ দিতে রাজি হল এবং সেই সঙ্গে বলল, “তুমি এই বাচ্চা বানরটিকেও সঙ্গে নিয়ে যাও। একে লুকিয়ে রাখো তোমার বাড়ির মধ্যে। হয়তো এ কোনোদিন তোমার খুব কাজে আসবে।”
তেনজিং বানরটাকে লুকিয়ে রাখল বাড়ির এক গুদামঘরে আর দুধটা এনে দিল দিদিকে। চালাকি করে এক ফাঁকে পেমা সেই দুধ খাইয়ে দিল রাক্ষসটাকে। দুর্বল রাক্ষসটা দুধ খেয়ে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করল।
পরদিন আবার একই কাণ্ড। পেমা অসুস্থ হবার ভান করে শুয়ে রইল আর এবার তেনজিংকে বলল ভালুকের দুধ নিয়ে আসতে। বাঁশি বাজাতে বাজাতে তেনজিং ঢুকল জঙ্গলে ভালুকের দুধের সন্ধানে। কিছুদূর যাওয়ার পর সে দেখে একদল ভালুক বসে রয়েছে। তার বাঁশিতে মুগ্ধ হয়ে ভালুক সর্দার বলল, “তুমি কে? এত সুন্দর বাঁশি বাজাও! এই জঙ্গলে কী চাও?”
তখন তাকে সে বোনের অসুখের কথা জানাল। সব শুনে ভালুক সর্দার তাকে ভালুকের দুধের ব্যবস্থা করে দিল এবং সেই সঙ্গে একটি ভালুক বাচ্চা দিয়ে বলল, “একে নিয়ে যাও। তোমার কাছে রাখো। একদিন না একদিন এ অবশ্যই তোমাকে অনেক সাহায্য করবে।”
পেমা ভালুকের কথা কিছু জানল না, কিন্তু দুধটা রাক্ষসকে খাইয়ে তাকে আরও সুস্থ করে তুলল।
পরদিন পেমা আরও অসুস্থ হবার ভান করে রইল এবং তেনজিংকে অনুরোধ করল বাঘের দুধ আনার জন্য। তেনজিং আবার জঙ্গলে গেল বাঘের দুধ নিয়ে আসতে। তার বাঁশি শুনে বাঘের দল খুব খুশি হল। তেনজিংয়ের অনুরোধে বাঘেরাও তাকে দুধ এনে দিল এবং সঙ্গে দিল একটি বাঘের বাচ্চা।
বাঘের দুধ খাওয়ার পর রাক্ষসটা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল এবং নিজের শক্তি ফিরে পেল।
সেদিন সন্ধ্যায় পেমা খুব খুশি হয়ে বলল, “ভাই, আমি একদম সুস্থ হয়ে গেছি। আয় দুজনে একটু খেলা করি।”
এবার সে খেলাচ্ছলে দড়ি দিয়ে তেনজিংয়ের হাত-পা বেঁধে ফেলল। তেনজিং ভাবল এটা খেলাই হচ্ছে। তাই তা নিয়ে কোনও চিন্তা করল না। পেমা তখন চিলেকোঠার ঘর থেকে রাক্ষসটাকে ডাকল আর বলল, “আমার শয়তান ভাইটাকে বেঁধে রাখা আছে। তুমি সহজেই একে মেরে ফেলতে পারবে। তারপর আমরা বিয়ে করে সুখে থাকব।”
রাক্ষসটা সবে তেনজিংকে মারার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এমন সময় তেনজিংয়ের আনা তিনটে জন্তু একসঙ্গে সেই ঘরে লাফিয়ে পড়ল। বানরটা পেমাকে জাপটে ধরে আটকে রাখল। আর সেই সুযোগে ভালুক ও বাঘ একসঙ্গে আক্রমণ করল রাক্ষসটাকে।
রাক্ষসটাকে মারার পর বাঘ আর ভালুক পেমাকেও মেরে ফেলতে চাইল। কিন্তু তেনজিং তখনও দিদিকে যথেষ্ট ভালোবাসত। সে অনুরোধ করল পেমাকে প্রাণে না মেরে ওরা যেন তাকে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসে। তেনজিংয়ের কথা শুনে জন্তুরা সেটাই করল আর তারপর থেকে বানর, বাঘ আর ভালুক রয়ে গেল তেনজিংয়ের সঙ্গেই।
(ভুটানের উপকথা)
লেখকের অন্যান্য লেখা
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু