লোককাহিনি
15% OFF * FREE SHIPPING
লোককাহিনি
বিমর্ষ চার মন্ত্রী এক সকালে সাধারণ বেশে লোকচক্ষুর আড়ালে নগর ত্যাগ করলেন। উদ্দেশ্যহীনভাবে এ-ধার ও-ধার ঘুরে বেড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে তাঁরা এক বিশাল বটগাছের তলায় বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নিলেন। সূর্য তখন প্রায় মধ্য আকাশে। আবহাওয়া উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠেছে। তাঁরা দেখলেন, আশেপাশের মাটি কিছুটা ভেজা, কিছু স্থানে জলকাদা মিশে আছে। তার অর্থ কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়েছিল। বটবৃক্ষের চারপাশের জমিতে তাঁরা অনেক উটের পায়ের চিহ্ন দেখতে পেলেন।
সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায়
বিজাপুরের রাজা বীরসেন। রাজা বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান এবং দয়ালু। প্রজাবৎসল রাজা বলে তাঁর খ্যাতি। রাজ্যের প্রশাসন চালনা করেন মূলত চারজন অতি বিজ্ঞ মন্ত্রী। এই চার সদাশয় মন্ত্রীর বুদ্ধিমত্তার উপর রাজামশায়ের অগাধ আস্থা। আর এই চার মন্ত্রীর জীবনের ব্রত যেন প্রজাকল্যাণ। তবুও রাজরাজড়ার খেয়াল, মাঝে-সাঝে তাঁর কিছু সিদ্ধান্ত মন্ত্রীদের মনঃপূত হয় না। অন্তর থেকে মেনে না নিলেও সংঘাত এড়াতে তাঁরা আদেশের বিরোধ সর্বসমক্ষে করেন না।
এভাবেই দিন কাটছিল। রাজামশায়ের হঠাৎই একদিন মনে হল, এই রাজপ্রাসাদটি পুরোনো হয়ে গিয়েছে। তাঁর নামযশের সঙ্গে ঠিক সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই তিনি স্থির করলেন নতুন রাজপ্রাসাদ তৈরির। প্রয়োজন বিপুল অর্থের। সেই অর্থের জোগান দেওয়ার জন্য ধার্য করা হল নতুন প্রজাকর। এই চার মন্ত্রীর এতে বিন্দুমাত্র সায় ছিল না। তাঁরা প্রতিবাদ জানালেন। ফলে রাজদরবার থেকে বিতাড়িত হলেন তা শুধু নয়, তাঁদের বলা হল দিন পাঁচেকের মধ্যেই নগর ত্যাগ করতে।
বিমর্ষ চার মন্ত্রী এক সকালে সাধারণ বেশে লোকচক্ষুর আড়ালে নগর ত্যাগ করলেন। উদ্দেশ্যহীনভাবে এ-ধার ও-ধার ঘুরে বেড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে তাঁরা এক বিশাল বটগাছের তলায় বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নিলেন। সূর্য তখন প্রায় মধ্য আকাশে। আবহাওয়া উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠেছে। তাঁরা দেখলেন, আশেপাশের মাটি কিছুটা ভেজা, কিছু স্থানে জলকাদা মিশে আছে। তার অর্থ কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়েছিল। বটবৃক্ষের চারপাশের জমিতে তাঁরা অনেক উটের পায়ের চিহ্ন দেখতে পেলেন।
কিঞ্চিৎ আহারাদির পর তাঁদের বিশেষ কিছুই করার ছিল না। বাইরে সূর্যের তেজও বেশ কড়া। সুতরাং গন্তব্যের উদ্দেশ্যে এখনই রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত হল। কিন্তু ওই যে কথায় আছে, নেই কাজ তো খই ভাজ—তাঁরা উটের পায়ের ছাপ নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিলেন।
খানিক পরেই এক জোয়ান লোককে প্রায় ঝড়ের বেগে বটগাছের দিকে আসতে দেখা গেল। চারজনকে পথিক মনে করে সে জিজ্ঞেস করলে, যে কোনও উটকে তাঁরা আশেপাশে বা যাওয়ার পথে দেখেছেন কি না। বোঝা গেল, সে তার পোষা উটটিকে খুঁজে পাচ্ছে না।
উত্তর দেওয়ার বদলে প্রথম মন্ত্রী সেই লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, “ওহে, তোমার উটটি কি পিছনের পায়ে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে?”
লোকটির চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললে, “আপনি দেখেছেন? কোন দিকে গেল?”
তার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই দ্বিতীয় মন্ত্রীর মন্তব্য ভেসে এল—“তোমার উটটি কি কানা? এক চোখে দেখতে পায় না?”
উট মালিকের উদ্দীপনা আরও বেড়ে গেল।—“হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন।” প্রায় মিনতির স্বরে সে বললে, “বলুন না, কোথায় গেল আমার উটটি।”
তৃতীয় মন্ত্রী বললেন, “দ্যাখো বাপু, তোমার ওই লেজকাটা উটটিকে আমরা স্বচক্ষে দেখিনি। আমাদের তুমি ভুল বোঝো না।”
উটের মালিকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে শুরু করল। সে বলে উঠল, “এটাও ঠিক যে গত বছর এক দুর্ঘটনার ফলে উটটির লেজ কাটা গেছিল, কিন্তু তা আপনি কী করে জানলেন? তার মানে আপনি উটের খোঁজ জানেন। আর আপনারা সেটিকে লুকিয়ে রেখেছেন।”
চতুর্থ মন্ত্রীটি ধীরে ধীরে বললেন, “আমরা তোমার উটটিকে চোখেও দেখিনি। তুমি আমাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারো। তবে একটি কথাই বলতে পারি, তোমার উটটি রোগে ভুগছে, ওর চিকিৎসা দরকার।”
উটের মালিক ততক্ষণে ধরেই নিয়েছে যে এই চার বদমাইশ উটটিকে চুরি করে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। এবার সে বলতে শুরু করল, উট সে যদি ফেরত না পায় তাহলে রাজার কাছে নালিশ করবে।
প্রথম মন্ত্রী শান্ত স্বরে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে তাঁরা সজ্জন এবং উটটিকে দেখেননি পর্যন্ত। খামোখা তাঁদের সন্দেহ না করে, রাজার দরবারে ফালতু ছোটাছুটি না করে আশেপাশের গ্রামের দিকে খোঁজখবর করলে উটটিকে ফিরে পেলেও পেতে পারে।
উটের মালিক উলটো জবাব দিল যে, ভালো জামাকাপড় পরে মোলায়েম কথা বললেই কেউ ভালো মানুষ হয়ে যায় না। সে আরও বলল, এই চারজনের মতন ঠগ এবং প্রতারক সে জন্মেও দেখেনি। রাগে গজগজ করতে সে রাজার প্রাসাদের দিকে চলতে শুরু করল।
তার ভাগ্য ভালো যে কিছু দূর গিয়েই সে রাজামশায়ের দেখা পেয়ে গেল। রাজামশায়ের তখন মোসাহেবদের নিয়ে বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছেন। উটের মালিক সটান রাজামশায়ের পায়ে পড়ে ইনিয়ে বিনিয়ে তার দুর্দশার কথা বলতে থাকল এবং অন্তত বার দশেক রাজা যে প্রজাবৎসল, দুষ্ট লোকের দমন যে তাঁর ব্রত ইত্যাদি বলে মন ভেজানোর সবরকম কৌশল সে প্রয়োগ করলে।
তাতে অবশ্য কাজও হল। রাজামশায় তাঁর অনুচর, দেহরক্ষীদের বললেন, “চলো গিয়ে দেখা যাক কী ব্যাপার।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা সেই বটগাছের তলায় উপনীত হলেন। আর সেখানে সেই সদ্য বহিষ্কৃত মন্ত্রী চারজনাকে একসঙ্গে দেখে রাজামশায় যারপরনাই বিস্মিত হলেন।
মন্ত্রীরা তখন গাছের তলায় বিশ্রাম করছিলেন নিশ্চিন্ত মনে। যেন কিছুই হয়নি। রাজা বীরসেন ভালো মতনই জানতেন, তাঁর এই মন্ত্রীরা উট কেন, একটা লাঠিও চুরি করতে পারেন না। কিন্তু যাই হোক, অভিযোগ যখন এসেছে, তার যথাযথ তদন্ত আর বিচার আবশ্যক। অন্তত জনসমক্ষে।
প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রীগণের কাছ থেকে উত্তর এল—“চুরি করা দূরে থাক, কোনও উটকে আমাদের ত্রিসীমানায় আমরা দেখিনি।”
উটের মালিকটি কিছু বলতে যাচ্ছিল, বীরসেন তাকে ইশারায় চুপ করতে বললেন। তিনিই পরের প্রশ্নটি করলেন।—“তাহলে উটের সম্পর্কে এইরকম সঠিক বিবরণ আপনারা কী করে দিলেন? কী করে বুঝলেন যে তার পিছনের পায়ে আঘাত লেগেছে?”
মুচকি হেসে প্রথম মন্ত্রী বললেন, “খুবই সহজ ব্যাপার, রাজামশাই। আপনি যদি পায়ের ছাপ ভালো করে লক্ষ করেন, তাহলে দেখবেন, পিছনের ডান পায়ের ছাপটি হালকা। অর্থাৎ, উটটির ডান পায়ের জোর কম। সেই থেকেই আমার এই সিদ্ধান্ত, মহারাজ।”
রাজামশাই আর সঙ্গের লোকজন, এমনকি সেই উটওয়ালাও ভালো করে পায়ের ছাপগুলি আবার দেখে মন্ত্রীর সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত হলেন।
“ঠিক আছে, পায়ের ব্যাপারটা না-হয় বোঝা গেল। কিন্তু একবারও না দেখে কী করে আপনাদের সিদ্ধান্ত হল যে উটটির বাম চোখের দৃষ্টি নাই?” রাজামশায়ের পরের প্রশ্ন ধেয়ে এল।
দ্বিতীয় মন্ত্রীর সবিনয়ে জবাব এল—“যদি উটের গতিপথ ধরে আমরা দেখতে থাকি, তাহলে লক্ষ করবেন যে সে শুধুমাত্র ডানদিকের গাছপালা, ঘাস-পাতা খেয়েছে। তার মানে সে বামদিকের জিনিস দেখতে পায়নি। অথবা দেখতে গেলে মেহনত করতে হত। এই থেকেই আমাদের সিদ্ধান্ত যে উটটির বামদিকের চোখটি হয়তো-বা নেই।”
বলাই বাহুল্য, এই পর্যবেক্ষণ যে সঠিক, তাতে কারও কোনও দ্বিমত রইল না।
উটের মালিক এতক্ষণে সবকিছুই অবাক হয়ে দেখছিল। আর থাকতে না পেরে পরের প্রশ্ন সে নিজেই করে বসল—“আর লেজটি নেই, সেটি বুঝলেন কী করে?”
তার দিকে তাকিয়ে রাজামশাই অসন্তোষ প্রকাশ করলেন—“এইসব কথা আগে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল।”
তৃতীয় মন্ত্রী শান্তভাবে উত্তর দিলেন, “মহারাজ, লক্ষ করুন, এখনও হাজার হাজার মশা রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে বসে আছে। এত রক্ত চুষেছে যে উড়তে পর্যন্ত পারছে না। উটটির যদি লেজ থাকত তাহলে মশাগুলি এত সহজে রক্ত খেতে পারত না।”
যথারীতি সবাই মিলে দেখলে, সত্যিই প্রচুর মশা ফুলে ঢোল হয়ে যেখানে সেখানে বসে আছে।
উটওয়ালার মুখটি তখন দেখার মতন। বাকিরা তথৈবচ।
চতুর্থ মন্ত্রী নিজেই যেন শেষ প্রশ্নটির জবাব দিলেন, “হে উটপালক, তোমার এই উটটির বিষ্ঠার উৎকট গন্ধ প্রমাণ করছে যে সে অসুস্থ। কোনও রোগে ভুগছে। তার চিকিৎসা প্রয়োজন।”
উটওয়ালা এইসব শুনে বা দেখে হতভম্ব হয়ে পড়ল। সে একবার রাজামশায়ের কাছে গিয়ে প্রায় পায়ে পড়ে, পরক্ষণেই মন্ত্রীদের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চায়।
রাজামশায়ের বেশ অনুশোচনা হয়। তিনি তাঁর মন্ত্রীদের কাছে গিয়ে বললেন, “আমি আপনাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাব। আমার রাজ্যের, আমার প্রজাদের আপনাদের দরকার। আর আমি কথা দিচ্ছি যে, ওই অতিরিক্ত করের বোঝা আর প্রজাদের উপর চাপানো হবে না।”
(মহারাষ্ট্রের লোককাহিনি)
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু