উপন্যাস
15% OFF * FREE SHIPPING
উপন্যাস
সে-রাতে কি মায়ের স্বপ্ন দেখেছিল কাজল? সেই যে সেই ট্রেনের স্বপ্নটা?
যা টালমাটাল অবস্থা ওর মনের, তাতে তো দেখার কথাই। কিন্তু দেখেনি। দেখলে নিশ্চয়ই ডায়েরিতে লেখা থাকত। কারণ, ওই সময় থেকেই তো কাজলের ডায়েরি লেখার শুরু। ডায়েরিটা তাকে দিয়ে গেছিলেন রাধুবাবু। নীল রঙের। মসৃণ মলাট। কভার ওলটালেই রাধুবাবুর লেখা— সাদা মেঘের ডায়েরি। পাশে একটা টুকরো মেঘের ছবি। রাধুবাবুর আঁকা।
শাশ্বত কর
সদ্যচলমান ট্রেন থেকে ছেলেগুলো হইহই করতে করতে প্ল্যাটফর্মে নেমে যাচ্ছে। ওদের চালচলন, আচার আচরণ—কোনোটাই সেই অর্থে ভালো বলে মনে হয় না। গাড়িতে ভিড় মোটামুটি ভালোই। বড়ো-ছোটো কাউকেই কোনোরকম তোয়াক্কা না করে রীতিমতো ঠেলে গুঁতিয়ে অবোধ্য হইচই করতে করতে নেমে গেল ওরা। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বাদামি হাফ-প্যান্ট আর লাল গেঞ্জি পরা একটা ছেলে। ওদের সঙ্গেই তো উঠেছিল গোটা তিনেক স্টেশন আগে। ছেলেগুলোকে নেমে যেতে দেখে বাচ্চা ছেলেটা জানালার ধার থেকে ভিড়ের মধ্যেই পড়িমরি করে দরজার কাছে দৌড়ল। বাইরে ছেলেগুলো ততক্ষণে পিছিয়ে পড়েছে, বিকৃত অঙ্গভঙ্গি করে নাচছে। একজন আর-একজনের গায়ে গড়িয়ে পড়ে বিশ্রীভাবে হাসছে। বাচ্চা ছেলেটাকে একজন ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে টা টা করছে। ওদের অমন করতে দেখে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটা চলন্ত ট্রেনের দরজা দিয়ে নামতে গেল। ‘গেল, গেল’ চিৎকার রোলের মধ্যেই পিছন থেকে কে যেন কোমর ধরে তুলে নিল বাচ্চাটাকে। আছাড়িপিছাড়ি করে কোল থেকে নেমে পড়তে চাইছে বাচ্চাটা, কিছুতেই পারছে না। ট্রেনের বেগ বাড়তে বাড়তে প্ল্যাটফর্মটা পার হয়ে গেল। কামরার মানুষজনের হট্টগোল ছাপিয়ে কী এক অবোধ্য শব্দে চিৎকার কেঁদে উঠল বাচ্চাটা।
***
গায়ে ধাক্কা খেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল কাজল। ঘামে গা ভিজে গেছে। মাথাটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। গলা শুকিয়ে কাঠ।
“আবার সেই স্বপ্নটা দেখেছিস?” মেঝে থেকে জলের বোতলটা হাতে তুলে দিতে দিতে রাহুল প্রশ্ন করল।
দু-ঢোঁক জল খেয়ে বোতলের ছিপি আটকাতে আটকাতে ঘাড় নেড়ে সায় দিল কাজল।
ততক্ষণে ঘরের অনেকেরই ঘুম ভেঙে গেছে। একতলা, দোতলা, তিনতলা বিছানাগুলো থেকে গলা বাড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলো ঘুম-জড়ানো মুখ। নেতাই, বেন্দা, শুভ, মঙ্গল, নেপাল—সবাই গোল গোল চোখ করে আছে। হাতের ইশারায় সবাইকে আশ্বস্ত করে রাহুল ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, “সেই এক কেস। আবার স্বপ্ন দেখেছে। শুয়ে পড় সবাই।”
একতলা, দোতলা, তিনতলা বিছানার মুখগুলো একে একে অদৃশ্য হল। বিছানাগুলো থেকে ঘুমন্ত শরীর এ-পাশ ও-পাশ করার শব্দও ক্ষীণ হয়ে এল ধীরে ধীরে।
রাহুল বলল, “কী রে, ঠিক আছিস?”
কাজল ততক্ষণে খানিক সামলে উঠেছে। ঘাড় নাড়ল।
“তাহলে?”
এমন একটা স্বপ্নের ধকল মাথায় অনেকক্ষণ থেকে যায়। কাজলেরও তাই। রাহুলের প্রশ্নের উত্তরে ফের দু-দিকে ঘাড় নাড়ল কাজল।
“নে, তাহলে শুয়ে পড় আবার।”
নাহ্, আর শুতে ইচ্ছে করছে না কাজলের। এখন আর ঘুম আসবে না। বরং খানিকক্ষণ বসে হোম-ওয়ার্কগুলো করে নেবে ভাবল সে। হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে রাখা ব্যাগটা কাছে টানল।
“ও! তুই তো আবার বিদ্যাসাগর। কিন্তু এত রাতে আলো জ্বললে দাদা কিন্তু সকালে তুমুল ঝাড়বে বলে দিলাম।”
কাজল উত্তর দিল না।
রাহুল আর কথা না বলে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে কাজলের মাথার উপরের বিছানায় উঠে গেল। ওর শুয়ে পড়ার আওয়াজ স্তিমিত হলে কাজল ব্যাগ থেকে হোম-ওয়ার্কের খাতাটা খুলে বসল।
মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে। এই স্বপ্নটা এলেই এমন হয়। আসলে স্বপ্ন তো এটা নয়, কাজল জানে ঘটনাটা কতটা সত্যি। আজ অবধি কাউকে বলেনি। আসলে কেউ জিজ্ঞাসাই করেনি। জিজ্ঞাসা করলেও বলতে পারত কি না কে জানে। মাঝে-মাঝেই ও এমন ভয় পেয়ে ঘুমের মধ্যে ঘেমে যায়, বোবায় ধরার মতো শব্দ করে গোঙায়। কেউ এসে চোখে-মুখে জল দেয়, কেউ আবার খানিক মজা করে অঙ্গভঙ্গি করে খ্যাপায় কাজলকে। এখানে এমনটা লেগেই থাকে। যে যাকে পারে—কাজলকে বাদ দিয়ে এখানে সবাই সবাইকে খ্যাপায়।
গতকাল বিশ্বপরিবেশ দিবস ছিল। স্কুলে অনেকরকম অনুষ্ঠান হয়েছে। সেইসব নিয়ে বাংলায় একটা প্রতিবেদন লিখতে দিয়েছেন ম্যাডাম। সন্ধেবেলা কাজটা করা হয়নি। তাই সেটাই লিখে ফেলবে বলে প্রস্তুতি নিল কাজল।
সবে লেখা শুরু করবে, তক্ষুনি উলটোদিকের বেড থেকে বিপুলদার গলা পেল। ঘুম-জড়ানো গলায় একরাশ বিরক্তি—“আরে আলোটা জ্বেলে রেখেছিস কেন?” উঁকি মেরে দেখে একটু চুপ করে থেকে ফের বলে, “রাত আড়াইটের সময় হোম-ওয়ার্ক!”
এ-কথারও কোনও জবাব দিল না কাজল।
বিপুলদা উঠে বিরক্তিভরা মুখে একবার ওর বেডে উঁকি দিয়ে টয়লেটে চলে গেল। ফিরে এসে ব্যাগ ঘেঁটে একটা ছোটো টেবিল ল্যাম্প ব্যাগ থেকে বের করে দিয়ে বলল, “এটা জ্বেলে পড়। নিজের পাগলামির জন্য সবার ঘুম নষ্ট করিস না।”
শব্দ করে হাই তুলতে তুলতে বিপুলদা গিয়ে শুয়ে পড়ল।
কাজলের ক্লাসমেট সাত্যকি তো রাতেই পড়ে। ওকে কেউ এমন বলে না। বরং ওর মা নাকি মাঝে মাঝে এসে দেখে যায়, এটা ওটা খেতে দিয়ে যায়। অবশ্য সাত্যকি তো আর হোমে থাকে না।
কাজল টেবিল ল্যাম্পটা দেখল। নতুন। বিপুলদাকে কেউ দিয়েছে নিশ্চয়ই। বিপুলদা এখানে থাকলেও ওকে উপহার দেওয়ার অনেকেই আছে। কত আত্মীয়স্বজন দেখা করতে আসে। কাজলের মতো হতভাগা নয়।
টেবিল ল্যাম্পটা প্লাগে গুঁজে বড়ো আলোটা নিভিয়ে দিল কাজল।
টেবিল ল্যাম্পের সাদা আলোয় দেয়ালে তিনতলা বেডগুলোর অদ্ভুত অদ্ভুত ছায়া। কারো-কারো হাত-পা নড়ছে ঘুমের মধ্যেই। দূরত্ব অনুসারে নানান মাপের ছায়া তৈরি হচ্ছে। রাস্তা থেকে মাঝে মাঝে বড়ো গাড়ির চলে যাওয়ার শব্দ আসছে। খোলা জানালা দিয়ে গাড়ির আলো দেয়ালের এক পাশে দ্রুত আসছে আর চলে যাচ্ছে। নাইট-গার্ডের বাঁশি বাজছে।
আলো আর অন্ধকার। শব্দ আর নৈঃশব্দ্য। রহস্য। নিশুত রাতে এমন জেগে থাকা তো কাজলের এই প্রথম নয়, বরং রাত জাগতে ভালো লাগে ওর। কেউ জ্বালাতন করে না বলে পড়াশুনোয় খুব তাড়াতাড়ি মন বসে যায়। তাছাড়া ‘রাতে পড়ি’ বললে স্কুলে বন্ধুদের কাছে একটু আলাদা সম্ভ্রম তো মেলে। মুখে কিছু না বললেও ওই বাড়তি সম্ভ্রমটুকু বেশ উপভোগ করে সে।
আজ মন বসছে না কিছুতেই। জানালার বাইরে আবছা অন্ধকারে তাকিয়ে রয়েছে কাজল। ইলেকট্রিকের তারে কী যেন একটা পাখি বসে আছে। দেখতে যাবে কি? বিকট একটা ডাক ডেকে লম্বা ডানা ছড়িয়ে পাখিটা উড়ে গেল। বুকটা কেঁপে উঠল কাজলের। ওটা কি পেঁচা?
হঠাৎ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কাজলের মনে হল, ও এর আগে পেঁচা দেখেছে। সতেরো বছরের ছেলে পেঁচা অনেকবার যে দেখে থাকবে সে তো স্বাভাবিক, কিন্তু কাজলের মনে হল ও সেই ছোটোবেলায় পেঁচা দেখেছে।
কী যেন মনে করে চোখ বন্ধ করে ফেলল কাজল। চোখের সামনে সেই ছেলেটা। সেই ছোট্ট ছেলেটা। মায়ের হাত ধরে অন্ধকারে হিসু করতে বেরিয়েছে। আচ্ছা, বাড়িটা কেমন? দৃশ্যে খানিক পিছিয়ে দেখতে চায় কাজল—বাড়ি কোথায়—এ যেন মাঠ—না না, ওই তো একটু দূরে অন্ধকারে আবছা আবছা ঝুপসি ঝুপসি ঘর। ওই ঘর কি কাজলদের? দৃশ্য আপনা-আপনি ফরোয়ার্ড হয়ে গেল। মায়ের হাত ধরে বেরিয়েছে ছেলেটা—পায়ের নীচে ঘাস থেকে শিশির লাগছে—সড়সড় করে কী যেন সরে যাচ্ছে—ঝাঁকড়া গাছের মাথা থেকে ডানা মেলে উড়ে গেল কী একটা পাখি, বিকট তার ডাক—মা সাপটে দিচ্ছেন বুক পিঠ—বলছেন ‘উয়া কিছু না। পেঁচা।’ মায়ের মুখটা কি দেখা যায়? এত অন্ধকার কেন? মায়ের মুখটা ঝাপসা, ঝাপসা মুখের ছবিটা কাঁপছে।
“মা!”
জোরে ডেকে ফেলল কি? চারদিকটা দেখে নিল কাজল। যাক বাবা, কারও ঘুম ভাঙেনি।
কী যেন ভেবে উঠে গেল। দেয়ালে দাঁড় করানো সার সার লকার। নিজের লকারটা খুলে ভিতরে রাখা একটা চাবি নিল। বিছানার নীচে রাখা একটা ট্রাংক খুলে একটা ডায়েরি বের করে নিয়ে এসে বসল বিছানায়। লিখে রাখতে হবে ঘটনাটা। নইলে ভুলে যাবে হয়তো। সেদিনই লাইব্রেরিতে একটা বইয়ে পড়েছে, জীবনে যত নতুন ঘটনা ঘটতে থাকে তত নতুন স্মৃতি তৈরি হয়, আর যত নতুন স্মৃতি তৈরি হয় পুরোনো স্মৃতি একটা একটা করে মুছে যেতে থাকে। কাজলের তো ছোটোবেলা মানে কেবল টুকরো টুকরো স্মৃতি, তাও পুরোপুরি কিছু নেই, সব আবছা ফিকে স্মৃতি। তাই যখন যতটুকু দেখে, যতটুকু মনে পড়ে বলে মনে হয় এই ডায়েরিটায় ও লিখে রাখে। আবার কিছু কিছু ঘটনা সেইদিন অথবা তার কয়েকদিনের মধ্যেও লিখে রাখে। রাধুবাবু এই ডায়েরিটা ওকে দিয়েছিল।
রাধুবাবু কে? চলো এবার ওঁর কথা বলি। রাধুবাবুর কথা না জানলে কাজলের গল্পটা ভালো বোঝা নাও যেতে পারে।
২
রাধুবাবুর কথা খুব মনে আছে কাজলের।
রাধুবাবু যখন এল, কাজল তখন এই বোর্ডিং নয় ‘নিজের বাড়ি’ নামে অন্য একটা হোমে থাকে। কত আর বয়স তখন ওর, হয়তো চার-পাঁচ। যেখানে থাকে তা যতই ‘নিজের বাড়ি’ হোক, আদতে যে সেটি একটি অনাথ আশ্রম, সেটা সবার কাছে শুনে শুনে জেনে গেছিল ওই কচি ছেলেটা। ‘নিজের বাড়ি’-তে যারা থাকে তাদের যে বাবা নেই, মা নেই—জগতে আর কেউ কোত্থাও নেই, তাও যেন কীভাবে জেনে ফেলেছিল।
কীভাবে আবার খারাপ কথা শুনতে শুনতে জেনে ফেলেছিল।
খারাপ কথা কে বলত?
সবাই বলত। যে-ছেলেরা অনেকদিন আছে, তারা বলত। যারা দুপুরে, রাতে খাওয়ার ঘণ্টা বাজায়, যারা খেতে দেয়, যারা রাতে সবাই ঘুমোল কি না, সকালে উঠল কি না এইসব দেখে তারা বলত। আর যারা পান থেকে চুন খসলেই বেত মেরে গা-হাত-পা ফুলিয়ে দেয় তারা তো বলতই। ওদের কাছে শুনে-শুনেই তো কাজল জেনেছিল ওখানে যারা থাকে তারা হয় বাপে খ্যাদানো মায়ে তাড়ানো, নইলে বাপ-মা মরা অনাথ। কাজল যদিও এই দু-দলের কোনোটাতেই পড়ত না, সে-কথা কাগজে কলমে সবাই জানলেও সে-কথার বাইরে ল্যাদোস, দামড়া, হাবা এসব ছাড়া আর কোনও উল্লেখযোগ্য বিশেষণ আলাদা করে ওর জুটত না।
কাজলের ডায়েরিতে যে টুকরো টুকরো স্মৃতি লেখা আছে তাতে মায়ের কথাই বেশি। বোঝা যায়, কাজলের মা ট্রেনে চেপে কাজে যেতেন। বাবার কথা কিছু লেখা নেই। সকালে বেরিয়ে মা ফিরতেন সন্ধ্যা পেরোলে। মায়ের শাড়িতে কোনো-কোনোদিন রঙ লেগে থাকত।
তাহলে কি কাজলের মা রঙের কাজ করতেন?
সম্ভবত তাই। উনি রঙের কাজ করতেন কোথাও। অবশ্য শিল্পীদের পোশাকেও রঙ লেগে থাকে।
তবে কি কাজলের মা শিল্পী ছিলেন?
মনে হয় না। মায়ের কথা আর যতটুকু লেখা আছে তাতে মনে হয় শিল্পী তিনি ছিলেন না।
সে যা-ই লেখা থাক, এ-কথা কিন্তু ঠিক সব মায়েরাই আসলে শিল্পী, ভাস্কর। কেমন যত্ন করে মানুষ করে গড়ে তোলেন শিশুকে।
মায়ের মুখটা মনে না পড়লেও মা যে খুব হাসতেন সে-কথা বার বার মনে পড়ে। কষ্টে থাকলেও এত হাসি যে হাসা যায় সে-কথা ক’জন আর বিশ্বাস করবে?
আচ্ছা, কষ্টে থাকার কথা কেন উঠল?
উঠল, তার কারণ কাজলের স্মৃতিতে তাদের বাড়ির যা বর্ণনা আছে, মায়ের কাজকর্মের যতটুকু খোঁজ আছে আর একরাতের ভয়ংকর যে ঘটনার কথা আছে, তাতে এটা সত্যিই নিশ্চিত যে খুব আনন্দের আর সুখের সংসার ওদের ছিল না।
ওদের বাড়িটা ছিল গাঁ-ঘরে দেখতে পাওয়া একেবারে সাধারণ ঘর। ঝুপড়িও বলা চলে। পাশে ছিল এক সবুজ মাঠ। বাড়ির উঠোনে মাটির উনুন ছিল। বাড়িতে ছাগল ছিল। হাঁস ছিল। আর ছিল এক কুকুর। কুচকুচে কালো ইয়া এক কুকুর। তার নাম ভেঁপু নাকি আঁটি ঠিক করে মনে পড়ে না কাজলের। তার সঙ্গে খেলা জমত। অনেক গাছ ছিল। কী গাছ তা কি আর ওই একরত্তি ছেলে জেনে উঠতে পারে?
মা ওকে চান করিয়ে খাইয়ে-দাইয়ে কাজে যেত। ট্রেনে চড়ে। এ-কথা সে মায়ের কাছেই শুনেছে। ট্রেনে কত কী খাবার, কত কী খেলার জিনিস ওঠে—মা-ই তো সে-সব গল্প করত!
সে-বাড়িতে আর একজন বৃদ্ধা থাকত। সে ঠাকুমা নাকি দিদা সেও মনে করতে পারে না কাজল। তার কোমর ছিল পড়া। হাতে বাঁশের লাঠি নিয়ে সারাদিন চই চই করে হাঁস ডাকত আর মাঝে মাঝে আঁচলের গিঁট খুলে একটা কৌটো থেকে কী যেন সব গুঁড়ো বের করে মাড়িতে লাগাত। একটাও দাঁত ছিল না তার।
তা সে-বুড়ি খুবই ফরমায়েশ করত দুধের বাচ্চাটাকে। এটা করে দে, সেটা এনে দে, এমনকি পানও ছেঁচাত ছোট্ট এক হামানদিস্তায়। সেই একবার তো বাঁহাতের বুড়ো আঙুলটা প্রায় ছেঁচেই গেল বাচ্চাটার। এখনও বুড়ো আঙুলে সেই ব্যথার দাগ আছে। মা না থাকলে যা হয় আর কী!
কিন্তু মায়ের তো আর থাকার উপায় ছিল না। সবার খাওয়ার জোগাড় করতে তাকে বেরোতেই হত। আর সে বেরোলেই সেই বুড়ি ঠাকুমা নাকি দিদিমা, তার অন্য রূপ বেরিয়ে আসত। মা যেতেই বেড়ার খোঁদল থেকে বিড়ি বের করে তাতে টান দিত বুড়ি। তারপর হাঁস চরাত আর ফরমায়েশ দিত। তার সঙ্গে আরও দুজন ছিল। তারা পুরুষ নাকি নারী তাও মনে নেই কাজলের। তবে তারা মাকে খুব কষ্ট দিত। মাঝে মাঝে মারত। মা কাঁদত। হাউমাউ করে কাঁদত। কাজলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত।
একদিনের কথা লেখা আছে কাজলের ডায়েরিতে। সেদিন মা এসেছিল অনেক পরে। অন্ধকারে। ওদের ইলেকট্রিক ছিল না। মিশমিশে অন্ধকার। কুপির টিমটিমে একটা আলো যেন অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে তুলত। সেদিন মা আসার পর কিছু হয়েছিল, কী হয়েছিল কাজল জানে না। কিন্তু মায়ের কাপড়ে সে কী দাউ দাউ আগুন! কারা যেন এসে জল ছিটিয়ে নেভাল, তাদের নাম মনে পড়ে না কাজলের। কলাপাতা ঢাকা মা হাসপাতালে যাওয়ার আগেও কাজলের গা সাপটে অনেক আদর করেছিল। কথা বলেছিল কি কিছু? মনে নেই।
তারপর আর মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। সবাই বলত মা হাসপাতালে আছে। কেউ নিয়ে যেত না ওকে। ওকে কেউ খাইয়েও দিত না তখন। ভাঙা বাটিতে একমুঠো শুকনো মুড়ি আর দুটো বাতাসা ঢেলে দিত বুড়ি। খিদের জ্বালায় তাই খেত দু-বেলা কাজল।
তারপর যেদিন ওই ছেলেগুলো বলল যে মার কাছে নিয়ে যাবে, কাজল আর দেরি করেনি ওদের সঙ্গে যেতে।
ট্রেনে ওঠা পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু ট্রেন চলতে শুরু করার সঙ্গে-সঙ্গেই ওরা হাত-পা নেড়েচেড়ে কতভাবে যে ভয় দেখাতে শুরু করে! কখনও বলে ওর মা নাকি মরে গেছে। মরে যাওয়া যে কী তাই কি তখন সে কচি ছেলে জানে! কিন্তু সেটা যে ভালো কিছু নয়, ওদের বলার ধরনেই তা বুঝতে পেরে বুক কেঁপে উঠছিল কাজলের। কখনও বলছিল ওরা নাকি ছেলেধরার কাছে ওকে ধরিয়ে দেবে—এরকম কত কী!
এরকম বলতে-বলতেই একসময় ছেলেগুলো দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ ট্রেন থেকে নেমে চলে গেল। কাজলও ছুটে নামতে গেল, কিন্তু কে যেন ওকে পিছন থেকে জাপটে তুলে নিল আর ট্রেন ছুটে চলল হু হু করে।
তার অনেক পরে একটা বড়ো স্টেশন, অনেক লোক আর অনেক ট্রেন, সেখানে একটা ঘরে কাজলকে বসিয়ে রেখে সবাই চলে গেল। সেখানে সব পুলিশের লোক। এর আগে সে কখনও পুলিশ দেখেনি। কিন্তু এগুলো তো সব পরে টুকরো টুকরো স্বপ্নে দেখেছে কাজল। ততদিনে ও জানে পুলিশ কে আর তাদের পোশাক কী।
ওই দেখো, রাধুবাবুর কথা বলতে বসে কী বলছি। আসলে কাজল নামের এই ছেলেটার এইটুকু জীবনের এত কথা যে যা-ই বলতে বসি না কেন ওর কথা ফিরে ফিরে আসেই। বলব, রাধুবাবুর কথাই বলব, কিন্তু কাজলের কথা আর একটু বলে নিই, না হলে ওকে তো ভালো করে চিনেই উঠতে পারবে না।
সেই রেলস্টেশন থেকে কোথায় যে কাজলকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সে ঠিক করে বলা যায় না। তবে সে এমন এক জায়গা যেখানে অনেক মহিলা ছিলেন, বাচ্চারাও কিছু ছিল, আর ছিল সাদা পোশাক পরা মাথায় সাদা টুপির নার্সদিদিরা। সম্ভবত হাসপাতাল হবে।
সবাই ভালোবাসত ওকে। চান করিয়ে, খাইয়ে-দাইয়ে মুখ মুছিয়ে দিত মায়ের মতো। ভালো যে বাসত সে-কথা বলা যায়, কারণ ওকে সেখান থেকে যখন ‘নিজের বাড়ি’ নিয়ে যাওয়া হয়, তখন অনেকেই চোখ মুছছিল, কেউ কেউ ওকে খেলনাও দিয়েছিল। ওদেরই দেওয়া নতুন জামা পরে কাজল রওনা হয়েছিল মোটরগাড়ি চেপে। সঙ্গে ছিল একটা ব্যাগ। ব্যাগে ছিল—কী কী যে ছিল সে কি আর মনে পড়ে? মনে পড়ে কেবল একটা লাল-নীল গাড়ির কথা। সেটা নিয়ে অনেকদিন কাজল খেলেছে, যতদিন না সেটা কেড়ে নিয়েছিল ‘নিজের বাড়ি’-র নেড়ামাথা ছেলে দুটো। ওদের নামও আর মনে রাখেনি কাজল। কতই তো এরকম ঘটেছে জীবনে। ক’জনের নামই-বা ও মনে রাখবে!
মোটরগাড়ি এসে থেমেছিল একটা বড়ো লাল বাড়ির সামনে। সেখানে অনেক ঘর। ঘরে ঘরে চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ। কালো কোট পরা অনেক লোক। সেখানে একটা ঘরের বাইরের বেঞ্চে অনেকক্ষণ বসে ছিল কাজল। কিছু একটা হয়েছিল ভিতরে। বুকটা দুরদুর করছিল। কিন্তু কেউ ওকে কিছুই বলছিল না। তারপর সেখান থেকে ওরা রওনা হয়ে যখন পৌঁছেছিল গাছপালা-ঘেরা ‘নিজের বাড়ি’-তে, তখন সন্ধে গাঢ় হয়ে এসেছে।
ম্যাড়মেড়ে একটা খাতাপত্র ঠাসা ঘরে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একজন লোক হাসিমুখে ওর নাম জিজ্ঞেস করছিলেন। কাজল নাম বলেছিল। পদবি বলতে পারেনি। বাড়ির ঠিকানাও বলতে পারেনি। আর একজন গম্ভীর মোটা কালো চশমা পরা লোক পুলিশের দেওয়া কাগজ দেখে একটা মোটা খাতায় ওর নাম লিখে রাখছিলেন। লেখা হলে বলেছিলেন, “ওর নাম কাজল কুমার। বয়স সাড়ে সাত। হলধর, বড়ো ঘরে নিয়ে যাও একে।”
সেই ধুতি-পাঞ্জাবি পরা হাসিমুখের লোকটিই হলধর। হলধরই পরে একদিন বলেছিল, যাদের পদবি নেই, এখানে তাদের নামের শেষে কুমার লেখা হয়। পদবির মতন কাজলের জন্মদিনটাও বোধ হয় ওদেরই নির্ধারণ করা। নাও হতে পারে। কারণ নার্সদিদিরাও তো একটা কাগজ দিয়েছিল। সেখানেও ওর বয়স-টয়স কিছু লেখা থাকতে পারে।
কাজলের জায়গা হয়েছিল বড়ো ঘরে। ঘরে ঢুকেই ডানদিকে একদম কোণে জানালার পাশে একটা চৌকি দেখিয়ে হলধর বলেছিল, “আইজ তো রাত হইয়া গেছে, ক্যান্টিনে আর মিল পাবা না। দেহি তাও যা পাই তোমারে এহানে দিয়া যামু, খাইও। কাইল থেইক্যা অন্যদের মতো কিন্তু তোমারেও চইলতে হইব, না হইলে কিছুই পাবা না।”
হলধর যেতে না যেতেই হইহই করে সব ছেলেরা সেই ঘরে এসে ঢুকল। বিভিন্ন বয়সের ছেলেপুলে সব। খেতে গেছিল সবাই। ভেজা হাত থেকে জল ঝরছে তখনও কারো-কারো। অধিকাংশের খালি গা, কারো-কারো গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। কাজলকে দেখে প্রায় সবাই এসে ঘিরে ধরেছিল। ওর জামাকাপড়, ব্যাগ দেখছিল। কাজল জড়োসড়োভাবে আঁকড়ে ছিল ব্যাগটা।
কত প্রশ্ন তাদের!—কী নাম, কোত্থেকে এসেছে, বাড়ি আছে না নেই, বাবা-মা আছে নাকি নেই—এইরকম সব। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। ওদিকে সদ্য আসা ছোট্ট কাজল তো তখন ভয়ে এত্তটুকু হয়ে আছে। গলা দিয়ে একটুও স্বর বেরোচ্ছে না। আর ওর চুপ করে থাকা দেখে, মুখ-চোখ দেখে কেউ তালি বাজিয়ে হাসছে, কেউ কেউ আবার ঠোনা দিচ্ছে, কেউ কেউ অকারণে চিমটি কাটছে—ওকে নিয়ে সে কী তুমুল হুল্লোড়!
ছোটো ছেলেটার খুব কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু সে যে কাঁদতেও জানে না অন্যদের মতো! কেন জানে না? সে আর কেমন করে বলি? হাসপাতালের রিপোর্টে হয়তো কিছু লেখা থাকতে পারে। কিন্তু তা তো এখনও জানা নেই কাজলের। তাই আমাদেরও জানা নেই।
মা বলে চেঁচিয়ে উঠতে গেল কাজল। স্বর বেরোল না। তখন ফুঁপিয়ে কান্না উঠে এল ছেলেটার। তবুও কি তারা থামে? থামে না। বরং ব্যাগ ধরে টানে, জামা ধরে টানে!
হঠাৎ গম্ভীর গলায় কে যেন ধমকে ওঠেন, আর সেই ধমক শোনামাত্র কাজলকে ঘিরে থাকা ভিড়টা মুহূর্তের মধ্যে হালকা হয়ে যায়।
“ঘাড় ধরে বার করে দেব সবক’টাকে! বাঁদরামো হচ্ছে?”
কাজল সেই গলা শুনে আরও ভয় পেয়ে কেঁদে উঠল। সেই যে চশমা পরা গম্ভীর ভদ্রলোক কাজলের নাম লিখছিলেন, ইনি হলেন তিনি। কাজলকে কাঁদতে দেখে ভদ্রলোক দরজার দিকে তাকিয়ে জোরে ডাকলেন, “হলধর!”
অমনি কোত্থেকে হলধর হাজির হয়েই বলল, “ইয়েস ছার!”
“ছেলেটাকে শান্ত করো, কিছু খেতে দাও। আর তুমি দিন কয়েক এই ঘরেই ঘুমোও। না হলে বাঁদরগুলো ওকে থাকতে দেবে না এখানে।”
তারপর থেকে ভালোয় মন্দে দিনগুলো কাটছিল কাজলের। সকালে, দুপুরে, রাতে খাবার জুটছিল। হলধরই খাইয়ে দিত ওকে। হলধরের অনুপস্থিতিতে একা একা খেতে হত। অন্যদের সঙ্গে খেতে বসতে ভালো লাগত না কাজলের। তাই হলধর না থাকলে আদ্দেক দিন ও খেতই না।
নিত্যদিন খাওয়া না জুটলেও ‘নিজের বাড়ি’-র পুরোনো বাসিন্দাদের চোরাগোপ্তা মার একেবারে নিয়ম করে জুটছিল। খেলনাগুলো বেহাত তো হয়েই গেছিল। তবে এসব অত্যাচারে কাজল আর কাঁদত না। সবকিছুই তো সয়ে যায়। ছোটোবেলায় সয়ে যাওয়াটা তো আরও সহজ হয়। আর তাছাড়া যাদের উপায় অন্তর কিছু না থাকে, তাদের তো মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
রাশভারী গম্ভীর মানুষটি ভোরবেলা আর সন্ধেবেলা প্রার্থনা করাতেন। সবার মুখে শুনে শুনে প্রার্থনার গানটাও শিখে নিয়েছিল কাজল। দুপুরবেলাটায় ঘরে কেউ থাকত না। যে-যার মতো ইশকুল যেত। বাগানে আমগাছ, জামগাছ আর গোলাপবাগানের মধ্যে ছুটে বেড়ানো তুলতুলে খরগোশের সঙ্গে খেলতে খেলতে সেই গানটাই গাইত কাজল। গাইতে গাইতে কখন যে শুয়ে পড়ত উঠোনের ধুলোর মধ্যে, কখনো-বা বিচুলির গাদার উপর—বুঝতেও পারত না। খেলতে খেলতে তার মন থেকে মুছে যেত যে, গত রাতেই ধনা নামের ছেলেটা আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা ওকে বেত-পেটা করেছে, শাসিয়েছে যদি কাউকে বলে তাহলে আরও মারবে।
বছর চারেকের বাচ্চা যে কাজল, পিঠের কালশিটে আর কত জোরালো হতে পারে যে খেলাধুলো ভুলিয়ে রাখবে! হলধর এসে ওর গা থেকে ধুলো ঝেড়ে দিত থাবড়ে থাবড়ে। কখনো-বা কলাটা, পেয়ারাটা, নিদেন বড়াটা, নাড়ুটা খাইয়ে দিয়ে যেত। খেতে যে কাজল বড্ড ভালোবাসে, হলধর তো সেটা বুঝত। খাওয়াত আর বলত, “এই যে তুমারে দিলাম, আর যেন কাউরে খাইতে দেখলে হাঁ কইরা চাইয়া থাকবা না, নাল ফ্যালাবা না—বুঝলা?”
এভাবেই প্রার্থনা, খেলাধুলো, খাওয়া-দাওয়া আর মারধোরে অভ্যস্ত জীবন কেটে যাচ্ছিল কাজলের। কারও কাছে এ নিয়ে কোনও অভিযোগ তার ছিল না। নিজের মনেই কেটে যেত তার সময়। নিজের মনেই খুশি থাকতে জানত কাজল।
এইরকম সময়েই একদিন সেই রাশভারী মানুষটির কাছে এক দুপুরবেলা গেরুয়া ঝোলা কাঁধে জিন্স আর সাদা গেঞ্জি পরা এক লোক এলেন। মাথাভরা তার কাঁচাপাকা ঝাঁকড়া চুল। চোখে মোটা চশমা। ঝোলা থেকে সাদা সাদা রোল করা কাগজ বেরিয়ে। তাঁকে দেখেই সেই রাশভারী লোক টেবিল ছেড়ে ‘রাধু এলি! রাধু এলি!’ বলতে বলতে প্রায় ছুটে এলেন।
হলধর বাগানে গাঁদাফুলের চারা বসাচ্ছিল। খুরপি, শাবল সব ফেলে দুড়দাড় করে দৌড়ে এল।
বাগানে খেলতে খেলতে ছোট্ট কাজল এটুকু ভালোই বুঝল, লোকটিকে পেয়ে ‘নিজের বাড়ি’-র সবাই বেজায় খুশি।
খুশি হওয়ার কারণ তো কাজলও পরে বুঝেছিল। কী পারেন না সেই মানুষটি! বাঁশি বাজাতে জানেন, পাতা দিয়ে বাঁশি বানিয়ে তাতে সুর তোলেন; অদ্ভুত সুন্দর ছবি আঁকতে জানেন; কেবল যে কাগজে আঁকেন তাই নয়, কঞ্চি দিয়ে মাটিতে আঁচড় কেটে মুহূর্তে দাগ কেটে পাতা-নাতা, ফুল-খড় সব বিছিয়ে অদ্ভুত ছবি এঁকে ফেলেন; ফুটবল খেলেন, সাঁতার কাটেন, গাছে উঠে নারকেল পারেন, গান তো করেনই। তবে সবথেকে ভালো যেটা করেন, তা হল ম্যাজিক। কাজল তো ম্যাজিক কাকে বলে জানেই না, তবু সেই ভোজবাজির খেলা জানা মানুষটি দিন তিন-চারেকের মধ্যেই তার কাছে ভগবানতুল্য হয়ে উঠেছিলেন।
এই মানুষটিই আমাদের কাহিনির রাধুবাবু।
এক মুহূর্ত রাধুবাবুর কাছ থেকে সরতে চাইত না কাজল। ওদিকে ‘নিজের বাড়ি’-র সব বাচ্চারই পছন্দের মানুষ তিনি। কাজেই কাছে যাওয়ার জো কি আর এই নয়া বাসিন্দা কচি ছেলেটা পায়! ঢলঢলে প্যান্ট পরে আদুর গায়ে ঘাসের গোড়া দাঁতে কাটতে কাটতে ভিড়ের শেষে দাঁড়িয়ে কাজল তার ভগবানকে দেখত। দেখত কেমন করে তাঁর হাতে টুকরো কাগজ মুহূর্তেই হয়ে যায় টকটকে লাল জবার ফুল! ছেঁড়া কলাপাতার একটুকরো হাওয়ায় ছুড়ে দিতেই সেটা হয়ে যায় ভেঁপু! অমন করে ছুড়ে দেওয়া একটা ভেঁপু একদিন কাজল পেয়েছিল। পেয়েই দে ছুট! একছুটে পুকুরপাড়। ছোটার চোটে কোমর থেকে প্যান্ট নেমে গেছে। বাঁহাত দিয়ে সেটা টেনেটুনে উপর করতে করতে কাজল এসে দাঁড়ায় পুকুরপাড়ে হিজলগাছের তলে।
এই গাছটার নাম যে হিজল, সে-কথা তাকে বলেছে হলধর। কাজলের তো পড়াশুনোর বয়স হয়নি, হলধর যেখানে যেখানে কাজ করে, সে তার সঙ্গে ঘুরঘুর করে বেড়ায়। কাজেই সে জানে এই লম্বা লম্বা ডাঁটিতে ফুটে থাকা অজস্র ফুলের গাছের নাম হিজল। ওই ঝিরিঝিরি মিষ্টি গন্ধের ফুল ঝরানো ইয়া লম্বা গাছটার নাম কড়ুই। ঝাঁকড়া মাথা লম্বা লম্বা গাছগুলো তাল। কেটে গেলে ওষুধ হওয়া ঝোপের নাম বিশল্যকরণী। পুকুরে সাদা সাদা ঘণ্টার মতো ফুল ফোটানো লম্বা পাতাগুলোর নাম কলমি—এমন কত কী!
যা বলছিলাম। সেই জাদু ভেঁপু নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কাজল তো এসে দাঁড়াল হিজলগাছটার নীচে। আচ্ছা, তোমাদের মনে হচ্ছে না যে ভেঁপু আর কী এমন মহান বস্তু, যা পেলে অমন করে দৌড়তে হয়! ঠিকই তো! ভারি তো ছেঁড়া কলাপাতার পাকানো একটা রোল; ভারি তো ফুঁ দিলে ভোঁউউউ ভুঁউউউ করে বাজে! কিন্তু জানো কি, কাজলের মাও যে অমন করে ভেঁপু বানিয়ে দিত কাজলকে? তোমাদের মতো অতসব খেলনা তো ওর ছিল না। গরিব মা নিজেই কখনও সে-সব দেখেনি, দেখে থাকলেও ছেলেকে কিনে দেওয়ার সামর্থ্য কোথায়? তাই কাজে যাওয়ার আগে ঘটি ঘটি জল ঢেলে নাইয়ে, আঁচলে গা-মাথা মুছিয়ে, থালা থেকে জল ঢালা সাদা ভাত আর গাঁদাল পাতা, নইলে কুমড়ো ফুলের বড়া হাপুস-হুপুস করে খাইয়ে, ঝোপড়ার চালে মাথা নুইয়ে থাকা কলাগাছের পাতা ছিঁড়ে রোজ চারটে করে ভেঁপু বানিয়ে দিয়ে যেত কাজলকে। ভেঁপু বাজাতে গিয়ে ভেঁপু ভরে উঠত মুখের রসে। ভেঁপু বাজত কি বাজত না, কলাপাতার পাক যেত খুলে। পাক খুলে গেলে তো সে আর বাজবে না, তাই চারটে করে ভেঁপু।
এবার বলো, জাদু ভেঁপু হাতে পেলে কাজলের কি আর মায়ের কথা মনে পড়বে না? মনে পড়লে কি আর তার মনখারাপ করে কান্না উঠে আসবে না? সবার সামনে কি আর সবাই কাঁদতে পারে বলো? তাই সে দৌড়েছে। দৌড়ে হাজির হয়েছে হিজলগাছের তলে।
ভেঁপুটা হাতে নিয়ে সেই একলা পুকুরপাড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে ছোট্ট কাজল। কতদিন মাকে দেখে না। মায়ের আদর পায় না। একলা একলা ঘুমোতে ঘুমোতে মায়ের কথা কত মনে পড়ে কাজলের। মাকে আর পায় না। এতদিন পর মায়ের মতন এক ভেঁপু পেল। হাতে নিয়ে ফোঁপাতে লাগল কাজল। খড়ি-ওঠা আদুর গা তার কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল কান্নার দমকে।
এমন সময় কে যেন বলল, “উঁহু! কাঁদলে যে ভেঁপু বাজবে না কাজল।”
তাকিয়েই হাঁ! সামনে স্বয়ং ভগবান! দূরে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখল, মনে হল সেখানেও যেন রাধুবাবু খেলা দেখাচ্ছেন বাচ্চাদের। তাহলে ইনি এখানেও কেমন করে!
আচ্ছা, তা কি কখনও হয়? এক সময়ে কি আর দু-জায়গায় থাকা যায়? যদি না যায়, তাহলে রাধুবাবু আছেন কী করে? আচ্ছা, রাধুবাবু কি সত্যি দু-জায়গাতেই ছিলেন? শিশুমনের ভুল নয় তো?
“ও এমন কিছু নয়। চাইলে তুমিও পারবে। সব পারবে।” রাধুবাবু কাজলের গাল থেকে জল মুছিয়ে দেন।
কথাটুকুতে এমন আশ্বাসের সুর ছিল, আঙুলের ছোঁয়ায় এতটাই স্নেহ ছিল যে কাজলের স্থির বিশ্বাস হয়ে গেল যে সেও অন্যদের মতন সব করতে পারবে।
কিন্তু এই বিশ্বাসের ফল হল বেশ পীড়াদায়ক। যেমন ধনা নামের ভেঙচি-সর্বস্ব বখাটে ছেলেটিকে দেখলেই ও সাধারণত একটু গুটিয়ে যায়। সেই দেখে ধনারও সন্তুষ্টি হয়। কিন্তু আজ যখন খাওয়ার ঘরে হলধর না থাকতেও কাজল খেতে গেল আর নিয়মমাফিক ধনা কাজলের গালে ঠোনা দিয়ে ভেঙচি কেটে হাত মাথার উপরে তুলে ভয় দেখাল, কাজল আজ গুটিয়ে গেল না। বরং ঘাড় সোজা করে তাকিয়ে রইল। ফলস্বরূপ যখন পিঠে একটা দুটো তাল পড়তে শুরু করল, মুহূর্তে এক ঝটকায় ধনার হাত সরিয়ে দৌড়োল রাধুবাবুর কাছে নালিশ করতে। ধনা অ্যান্ড কোং-ও কিল বাগিয়ে ধাওয়া করল ওকে।
৩
তার পর থেকেই রাধুবাবুর একেবারে ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠল কাজল।
সেদিন দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে রাধুবাবুর হাত ধরে টেনে এনে ধনাকে দেখিয়ে দিয়েছিল সে। কান্নার দমকে আর দৌড়ের জন্য তখন হাঁপাচ্ছে সে। মুখ থেকে অবোধ্য কিছু শব্দ বার হচ্ছে কেবল। হলধর ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ধনাদের বলল, “এত জ্বালাস ক্যা রে অরে তোরা? দেহিস তো কথাডাও কইতে পারে না ছ্যাড়াডা!”
“আমাদের সঙ্গে ওকে খেতে দাও কেন? এই দামড়া ছেলে সারা মুখে খাবার মাখে, মাটি থেকে তুলে খায়, মুখ থেকে লালা পড়ে! ঘেন্না করে না আমাদের!” ধনার দল হাইমাই করে চেঁচিয়ে বলল।
“অর দ্যাহডাই যা তগো মতো বড়ো রে, মইনের বয়স অর দুইয়ের বেশি না! কতবার তো কইছি তগো, ক’!”
রাধুবাবু হলধরকে থামিয়ে সেদিন কাজলকে নিয়ে এলেন নিজের ঘরে। ধনাদের একটা কথাও বললেন না। তারপর হলধরকে ঘরে ডেকে বললেন, “আজ থেকে ও এই ঘরেই থাকবে। দাদাকে বলে দিও। ওর খাবারদাবার এখানেই দেবে।”
ঘাড় কাত করে সায় দিতে দিতে হলধর বোধ হয় গামছায় চোখ মুছতে মুছতে বলেছিল, “তুমি তো কত কিছু জানো দাবাবু, দ্যাহো তো এই বুবা হাবা ছেলিডার কিছু গতি করতি পারো কি না!”
“হলধর, তুমি যে বললে ওর মনের বয়স দুইয়ের বেশি নয়, সেটা তুমি কেমন করে জানলে?”
“ছারই তো কইছেন। ওরে এহানে আনার কাইলে হাসপাতালের কাগজ আনছিল না, তাইতেই ল্যাহা আছে।”
সেদিন আর কীসব কথা কাজলকে নিয়ে হলধর আর রাধুবাবুর মধ্যে হয়েছিল তা খানিক অনুমেয় হলেও আমরা আর সেদিকে যাচ্ছি না। বরং এখন থেকে সেই সময় থেকে এখনকার কাজল পর্যন্ত আমরা একটা সময়যাত্রা করব। পুরোটাই করব কিন্তু কাজলের ডায়েরিতে লেখা টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলোকে জোড়া দিয়ে আর খানিকটা কী হতে পারে সেইসব ভেবে নিয়ে, কেমন?
যাই হোক, সেদিনের পর থেকেই রাধুবাবুর একেবারে ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠল কাজল।
রাধুবাবুও যাকে বলে একেবারে উঠে পড়ে লাগলেন কাজলকে নিয়ে। নিয়ম করে শহরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন। ডাক্তারবাবুর কাছে কত ছেলেমেয়েরা আসত কথা বলা শিখতে। কতরকম উপায়ে যে কথা বলানোর চেষ্টা চলত! ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতেন রাধুবাবু। ডাক্তারবাবু বাড়িতে অনুশীলন করানোর উপায় বাতলে দিতেন রাধুবাবুকে।
হোমে তো প্রায় সারাদিন ওকে নিয়েই থাকতেন। কতরকম যে খেলা ছিল দুজনের, না দেখলে বোঝা যায় না। কখনও পুকুর থেকে ঘটি ঘটি জল তুলে বালতি ভরা, কখনো-বা বল নিয়ে লোফালুফি। কাজল তো ঘটি ধরতেই পারত না। হাত থেকে ঠং ঠং করে খসে পড়ত। বার বার। রাধুবাবুর কিন্তু তাতে রাগ নেই। বার বার করে দেখিয়ে দিতেন কেমন করে ঘটি বেড় দিয়ে দুই হাতে শক্ত করে ধরতে হয়। বল তো লুফতেই পারত না। রাধুবাবুও ওর দেখাদেখি ওর মতো করেই বল আসার আগেই হাত মুঠো করে ফেলতেন। দেখে সে কী হাসি কাজলের!
কাজলের হাত নিজের ঠোঁটে চেপে কত কী বলতেন রাধুবাবু। আস্তে আস্তে বার বার করে বলতেন, ‘কা-জ-ল—কা-জ-ল! বড়ো বড়ো করে চোখ করে শুনত ছেলেটা। কিছু বলার চেষ্টা করত কি? কে জানে!
বালি দিয়ে চৌকো একটা জায়গা ভরাট করে নিয়েছিলেন রাধুবাবু। যেন কুস্তির আখাড়া। কুস্তি তো বটেই, তবে কিনা দেহে দেহে কুস্তি নয়, মনে মনে। দুজনের জন্য নিয়েছিলেন দুটো কঞ্চি। ওই বালিতে দাগ কাটতেন দুজনে। কখনও সোজা দাগ। কখনও গোল। কখনও চৌকো। সেইসব দাগ দিয়ে কখনও এঁকে ফেলা হত একটা পাখি, কখনও কুঁড়েঘর। কাজলও এটা খুব ভালো পারত। যেই কোনও একটা ছবি এঁকে ফেলত কাজল, রাধুবাবু একটা না একটা ফল পকেট থেকে বের করে ওকে খেতে দিতেন। খেতে যে কাজল ভালোবাসে, হলধর না বললেও সে-কথা বেশ বুঝে গেছিলেন তিনি।
আর একটা খেলা ছিল ওদের। ভোরবেলায় উঠোনে ঘাসের বীজ ছড়িয়ে দিতেন রাধুবাবু। কত যে পাখি আসত! সবুজ, হলুদ, ধূসর, কালো, নীল—সব রঙের পাখি। দুজনের পকেট ভরতি থাকত তেঁতুলের বীজ! আর সামনে থাকত বাটি। একটা করে পাখি দেখলেই পকেট থেকে একটা তেঁতুলের বীজ নিয়ে বাটিতে রাখত ওরা। তারপর যখন পাখিরা চলে যেত, তখন গুনতে হতো। রাধুবাবুই গুনতেন—এক, দুই তিন, চার… কাজল হাঁ করে দেখত। রাধুবাবুর সুর করে গোনা ওর মনে দাগ কাটত। দিন কেটে যেত—এক, দুই, তিন, চার… রাধুবাবুরও কোনও তাড়া নেই, কাজলেরও আনন্দের শেষ নেই। গোনা শেষ হলে রোজদিনই যখন রাধুবাবুর থেকে ওর বাটিতে বেশি তেঁতুলের বীজ জমা হত, হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠত কাজল।
দিন কেটে যেত—এক, দুই, তিন, চার…
এক-একদিন ওকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে কোথায় কোথায় যে চলে যেতেন সকালের জলখাবার খেয়ে! কত কথা বলতেন, কত গল্পই না বলতেন সারাটা দিন।
একটা জায়গার কথা কাজলের খুব মনে পড়ে। সে একটা জাদুর মাঠ। ধু ধু মাঠ। সেই মাঠে একটাই গাছ। ঝাঁকড়া একটা গাছ। বটগাছ কি? ঝুরি দেখেছে বলে তো মনে পড়ে না কাজলের। মাঠের এক প্রান্তে সেই গাছ। গাছের তলায় একটা বাঁশের মাচান। মাচানে বসলে সামনে একটা বড়ো বিল দেখা যায়। হু হু করে বাতাস বয়। সরসর করে হাওয়ার শব্দ হয় বিলে। বিলে চিকন ঢেউ ফোটে। কখনও পাতি হাঁসের দল সাঁতার কাটে। মা হাঁস নাকি বাবা হাঁস সামনে, পিছনে ছানাপোনার দল, তারও পিছনে আবার মা হাঁস নয়তো বাবা হাঁস। কাজলের তো বাবার কথা মনেই পড়ে না। মাও আর আছে কি না সে জানে না।
বিলের মাঝামাঝি বাঁশের একটা মাচার উপর ছোট্ট একটা ঘর। ওই ঘরটা অনেকটা কাজলের মায়ের বাড়ির মতো। তাই কি? পুরোপুরি না হলেও খানিকটা ওরকমই। অন্তত কাজলের তো তেমনই মনে হয়। ওই বাড়িটায় একবার যেতে মন চায়। রাধুবাবুর জামা খামচে উঁ উঁ করে ইশারা করে কাজল। রাধুবাবু যেন বুঝেও বুঝতে পারেন না।
গুরু-শিষ্য ধু ধু মাঠে ঝাঁকড়া গাছের তলায় মাচা থেকে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। হাওয়ায় গাছের পাতা দোলে, হাঁসের পালক দোলে, জলের কোল দোলে। মাচা থেকে ঝুলন্ত চারটে পাও দোলে।
রাধুবাবু দরাজ গলায় গান ধরেন কোনো-কোনোদিন। মাথাটা রাধুবাবুর দিকে ঝুঁকিয়ে আড়চোখে দেখতে থাকে কাজল। একই গান বার বার করেন রাধুবাউ। কখনো-কখনো কাজলের ঠোঁটে কম্পন দেখা যায়। মনে মনে গায় কি কাজল? কে জানে! মনে গাওয়া গান ঠোঁটে উঠে আসবে কবে? কে জানে! তাড়া নেই কোনও। আশা আছে। ফুল ফুটতেও তো সময় লাগে নাকি!
দিন কেটে যায়—এক, দুই, তিন, চার…
একদিন যখন কাজল রাধুবাবুর জামা খামচে ইশারা করার সঙ্গে সঙ্গে অস্পষ্ট অথচ গোঙানির থেকে অনেক সুন্দর ‘উইযযি…উখানি…যাবে’ বলল, রাধুবাবু এক লাফে মাচা থেকে নেমে কাজলকে জাপটে কোলে তুলে নিলেন। তারপর হাততালি দিতেই জাদুর খেলায় কোত্থেকে হাজির হয়ে গেল মিশকালো আদুর গা, লাল নীল লুঙ্গি ভাঁজ করে পরা এক মাঝি, হাতে তার ইয়া এক লগি। বিলের কোল থেকে সে টেনে আনল এতটুকু এক ডোঙা। গুরু-শিষ্য গিয়ে বসল সে-খানায়। আর সেই মাঝিও গান গাইতে গাইতে ডোঙা দিল ছেড়ে।
হাওয়াও যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। তবে সেই হাওয়ায় কালবোশেখির মতো রাগ ক্ষোভ ছিল না। কচি বাচ্চার মতো চাঞ্চল্য ছিল। সেই হাওয়া কেটে ডোঙাখানা এগিয়ে চলল বিলের মাঝখানে জলটুঙিটার দিকে। একটা পানকৌড়িও ডুব দিয়ে ভেসে উঠে খেলতে খেলতে চলল ওদের সঙ্গে।
সেই ধু ধু মাঠের ঝাঁকড়া গাছের মাচায় তখন এসে বসল যেন একটা জমাট হাওয়া। হাওয়া, নাকি জমাট আলো? আলো, নাকি জমাট অন্ধকার? কী জানি! সে যাই হোক, একভাবে সে তাকিয়ে রইল যেন জলটুঙির দিকে এগিয়ে চলা ডোঙাটার দিকে। ধুলো এসে পাক খেল মাচার পায়ের কাছে। গাছ থেকে কয়েকটা পাতা উড়তে উড়তে এসে পড়ল যেন তার কাছে। জমাট বাঁধা আলো নাকি অন্ধকারের কাছে বাতাসটা কি খানিক আর্দ্র? বলি কীভাবে! হাওয়ায় হাওয়ায় ফিসফিসিয়ে কথা বলে কারা?
হাওয়ার ফিসফিসানিতে কে যেন কাকে আশ্বাস দিল—ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
ডোঙা এগিয়ে চলল। লগিতে ঢেউ কেটে কেটে ডোঙা এগিয়ে চলল।
কাল্পনিক তেঁতুলের বীজ হাতে গুনতে গুনতে কাজল মনে মনে বলতে থাকল—এক, দুই, তিন, চার..
অনাবিল আনন্দে উদ্ভাসিত চোখে রাধুবাবু তাকিয়ে রইলেন জলটুঙির দিকে। আরও কতবার জলটুঙি পৌঁছতে হবে ওদের! হার্ডল। বীজগণিতের সিঁড়িভাঙা অঙ্ক। তাড়াহুড়ো নয়। ধীরে ধীরে ধাপ পার হতে হতে উঠতে হবে—এক, দুই, তিন, চার…
দিন আর কী! সময়ের বেড়াজাল বই তো কিছু নয়। দিগন্তে সূর্যের ওঠানামার মতোই দিন ঠিক কেটে যাবে—এক, দুই, তিন, চার…
৪
কাজলের যে-কোনো রকমের উন্নতি—তা সে একটু হলেও কথা বলতে পারাই হোক, মাটি ছেড়ে খাতার পাতায় দাগ কাটতে পারাই হোক, বা চামচ ধরে একটাও না ফেলে মুড়ি খেতে পারাই হোক, কিংবা মুখ সরু করে শিস দিতে পারাই হোক—ওই ছিল রাধুবাবুর সঙ্গে সেই জলটুঙিটায় যেতে পারার টিকিট। কী যে ভালো লাগত ওর ওই বিলের মাঝখানের বাড়িটায়! চারপাশে খালি ছোটো ছোটো ঢেউয়ের ভেসে যাওয়া। শুধু পানকৌড়ির ডোবা-ভাসার শব্দ। কখনো-কখনো হাঁসের দলের যৎসামান্য হাঁক, কখনও দূর থেকে ভেসে আসা অচেনা কোনও পাখির ডাক। সবই অচেনা কি? একটা একটা ডাক খুব চেনা। যেন বাড়িতে শুনেছে। বাড়িটা যে কোথায়? সেখানে কি মা ফিরে এসেছে? এসে কি কাজলকে খুব করে খুঁজছে? ‘কাজলা কোথায়’, ‘কাজলা রে’, ‘কাজলা ধন রে আমার’—করে মাঠের ধারে গাছের ভিড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে মা? মা কি খুব কাঁদছে ওকে না পেয়ে?
এরকম কত কথাই যে কাজলের ছোট্ট মনটায় ভেসে উঠত এই জলটুঙিটায় আসতে পেলে! ঝিলের বুকে ছায়া পড়া মেঘের মতো গভীর চোখ দুটো থেকে জল পড়ে যেত বাচ্চাটার। রাধুবাবু সেদিকে একবার দেখে মুখটা ঘুরিয়ে তখন আকাশে নাকি দিগন্তবিস্তৃত ঝিলের জলে কী যেন দেখতেন। কী যেন ভাবতেন।
ওই জলটুঙিতে বসে বসে অনেক গল্প বলতেন রাধুবাবু। টুনটুনির গল্প, সুয়োরানির গল্প, দুয়োরানির গল্প, বুড়ো আঙলার গল্প, ক্ষীরের পুতুলের গল্প—কত কী! হাঁ করে শুনত কাজল। শুনতে শুনতে হারিয়ে যেত গল্পে। শুনতে শুনতে কখন যে সে হয়ে যেত দুঃখিনী দুয়োরানির বানরছানা, ডোঙাখানা হয়ে উঠত মধুকর, মনের মধ্যে কতবার যে বেজে উঠত ঢোল ডগর, কতবার যে সাধ হত বাতাসের চেয়ে চিকন শাড়িখানা, পায়রার ডিমের মতোন মুক্তার মালা নিয়ে দৌড়ে যায় মায়ের কাছে!
বিল পার হয়ে সাইকেলে চেপে হোমে ফেরার সময়ও কোনো-কোনোদিন তার সেই স্বপ্নবিচরণ চলত। তারপর যেই না হোমে ঢুকল, হইচই, বকাঝকা, ক্যারাংকিচির, হাঁকডাকে সব যেত হুস করে মিলিয়ে। রাধুবাবু মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, “যা, এবার খেয়ে নে। আর একদিন ফের যাব তো।”
সব গল্পের মধ্যে একটা বিশেষ বইয়ের গল্পগুলো শুনতে কাজলের সবচেয়ে ভালো লাগত। না না, কাজল নিজে নিজে তখনও পড়তে শেখেনি। সবে খেতে শিখেছে সবার সঙ্গে, বল ধরতে শিখেছে, চামচ ধরতে শিখেছে, পাঁচ-সাতবার ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভাতেও শিখেছে। মানে টুকটাক সাধারণ জিনিস যা সব্বাই পারে-টারে সেই সবগুলোই একটু আধটু শিখেছে আর কী! তাতেই তো আরও নতুন শেখার ইচ্ছেটা ওর মধ্যে ধীরে ধীরে জেগেছে। জেগেছে ওই বইটার গল্পগুলো শুনে।
সেই একদিন যখন জলটুঙিতে মায়ের জন্য মনকেমন করে চোখ ভিজে গেছিল কাজলের, সেই যে মার কাছে যাবে বলে একদিন আছাড়িপিছাড়ি করেছিল জলটুঙির মেঝেতে, সেদিন চোখ মুছিয়ে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাজলকে শান্ত করে রাধুবাবু সেই বইটা ঝুলি থেকে বার করেছিলেন।
সেই বইতে তিন রাজপুত্রের কথা আছে। কাজলের মতো তারাও নাকি অন্যদের থেকে আলাদা। কাজলের মতনই বোধ হয় একটু আলাদা করে বুঝত সবকিছু। আলাদা মানে অন্যদের তুলনায় খানিক দেরি করে আর কী। কিন্তু দেরি করে বুঝলে কাজলের না-হয় চলে, রাজপুত্রদের চলবে কেমন করে? তাদের তো বড়ো হয়ে রাজা হতে হবে। আর রাজা হওয়া কি আর যেমন তেমন কাজ? কত বুদ্ধি খাটাতে হয় রাজা হতে গেলে, কত কী বুঝে নিতে হয় রাজা হতে গেলে! কত যুদ্ধ করতে হয়, কত রাজ্য দখল করতে হয় রাজা হয়ে থাকতে গেলে! ওদিকে রাজপুত্ররা তো সে-সব কিছুই শেখে না। শিখতে পারে না। কত পণ্ডিত আসেন, দিস্তে দিস্তে পুথি আনেন, মন মন কালি খরচ হয়, রাজপুত্ররা তো সে-সব নীতি কানুন প্যাঁচগোচ কিছুই শিখতে পারেন না। রাজার কপালে ভাঁজ বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। এমন সময় খোঁজ মেলে সেই বিখ্যাত পণ্ডিতের যিনি কিনা পারলেও পারতে পারেন রাজপুত্রদের শেখাতে। পারলে একমাত্র নাকি তিনিই পারেন। রাজা ডাকলেন তাঁকে। তিনি এলেন। সব শুনলেন। রাজা তাঁকে একশো জমি অনুদান দিতে চাইলে তিনি সসম্মানে প্রাত্যাখ্যান করেন। তবে সম্মতিও দিলেন তিনি রাজপুত্রদের পাঠ দিতে। কিন্তু শর্ত দিলেন রাজপুত্রদের শিক্ষা হবে প্রাসাদে নয়, হবে তাঁর নিজের আশ্রমে, পর্ণকুটিরে। আর ছ’মাসের মধ্যে কেউ দেখা করতে পারবেন না রাজপুত্রদের সঙ্গে। রাজত্ব আর রাজপুত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত রাজা রাজি হলেন তাতেই। ওদিকে পণ্ডিত তো রাজপুত্রদের নিয়ে এলেন আশ্রমে। কিন্তু ছ’মাসের মধ্যে তাদের কীভাবে শেখাবেন সবকিছু? অনেক ভেবে ভেবে শেষে নিজেই লিখে ফেললেন এক পুথি। তাতে অনেক গল্প। সেই গল্প পড়ে নিজের অজান্তেই বুদ্ধি খুলে গেল রাজপুত্রদের।
রাধুবাবুও সেই বইটা থেকে এক-একদিন একটা একটা গল্প পড়েন, আর কাজল তার আধো আধো শব্দে বলে ‘রাজপুত্রদের কথা শুনবে’। রাজপুত্রদের যখন শেখা হয়েছিল, তেমন ওরও শেখা হবে এমন কিছু কি ভাবে কচি মনটা? ভাবলেই-বা। দোষ তো কিছু নেই, যা আছে তাতে আনন্দের ভাগই বেশি হওয়ার কথা।
এমন করে গল্প পড়তে পড়তে, শুনতে শুনতে বেশ চলে যাচ্ছিল দুজনের সময়।
অবশ্য আর একটা কাজও চলছিল দুজনের। সেটা হল ছবি আঁকা। আমরা তো আগেই বলেছি, রাধুবাবুর ছবি আঁকার হাত ছিল ভীষণ ভালো, হয়তো-বা আর্টিস্টই ছিলেন। কাজলের ছবি আঁকার হাতও কিন্তু দিন-কে-দিন খুলছিল। কাজলের সব কাজকর্মেই তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যে প্রশংসা করতেন রাধুবাবু। কিন্তু ছবি আঁকার ক্ষেত্রে কাজলের বাহবা পাওয়াটা ছিল যাকে বলে একেবারে প্রাপ্য বিষয়। যে ছেলেটা একটা চামচ ধরতে পারত না, কোন জাদুতে যে রাধুবাবু তার হাতে কঞ্চি তুলে দিলেন আর কোন জাদুবলে সে সেই কঞ্চি দিয়ে বালির বুকে তিনকোনা চারকোনা আঁকতে আঁকতে একদিন এঁকে ফেলল তার মনবাহন ডোঙাটাকে, এঁকে ফেলল বিলের মাঝের জলটুঙিটাকে—কে জানে! এখন তো কাজলের হাতে পেনসিল ধরিয়েছেন রাধুবাবু। এই বড়ো এক ড্রইং খাতায় পেন্সিল ঘষে ঘষে ছবি আঁকে কাজল। আর তার পাশে ক্যানভাসে চারকোল চলে রাধুবাবুর। গুরু-শিষ্যের মনের কথা ফুটে ওঠে ছবি হয়ে কার জাদুতে তাই-বা কে জানে!
আঁকা শেষ হলে একজন আর একজনের ছবি দেখেন। অভ্যেসমতো মাথাটা নামিয়ে আড়চোখে রাধুবাবুর ছবি দেখে কাজল। সাদা ক্যানভাসে রাধুবাবুর হাতের নড়াচড়া দেখে। দেখে আর শূন্যে অমন করে হাত নাড়ায়। কোনোদিন-বা ফের একটা সাদা পাতা খুলে বসে যায়।
আর যেদিন রাধুবাবুর আঁকা আগে শেষ হয়, জগতের সব মাধুর্য যেন তিনি খুঁজে পান কাজলের খাতায়। হাঁ করে দেখতে থাকেন।
কাজলের কি লজ্জা করে?
বোঝা যায় না।
আসলে ছবি আঁকার সময় যে রঙের দুনিয়ায় যাকে বলে একেবারে ডুবে থাকে সে। একটা একটা রঙের ঢেউ ওঠে কাজলের মনে, অমনি সেই রঙটাই বইয়ে দেয় খাতায়। ফলে গাছের রঙ হয়ে যায় কখনও গোলাপি তো কখনও লাল। পাহাড় হয়ে ওঠে গেরুয়া। বিস্কুটের কৌটোর মতো সূর্যটা মাঝে মধ্যেই বেগুনি নয়তো আকাশি হয়ে যায়। সূর্য থেকে রঙ যেন চুঁইয়ে নামে পাহাড় ছুঁয়ে নদীতে। নদী নয়, নদী নয়, নদীর মতো বিলে। বিলের হলুদ জলে সবুজ রঙের তিনকোনা এক ডোঙা।
রাধুবাবু ওর পিঠ চাপড়ে দেন। আস্তে আস্তে কথা বলতে শেখান। রাধুবাবু বলেন, “তোমার নাম কী?”
কাজল বলে, “তোমার নাম কী?”
রাধুবাবু কাজলকে দেখিয়ে বলেন, “আমার নাম কাজল।”
হাতের পাঁচটা আঙুল পাঁচদিকে ছড়িয়ে দুম করে নিজের বুক ছুঁয়ে কাজল বলে, “আমার নাম কাজল।”
৫
ইশকুল যে একটা সুন্দর জায়গা, সে-কথাটা তো আগে জানত না কাজল! না হলধর, না রাধুবাবু, না দাদু—কেউই তো আগে বলেনি কখনও। বললে কি আর ইশকুলে যেতে হবে শুনে ও অমন করে কাঁদত? নাকি অমন করে দুদ্দাড় করে দৌড়ে পালাত?
ও, দুটো কথা তো বলাই হয়নি। কাজল কিন্তু এখন আর সবার সঙ্গেই থাকে। রাধুবাবুর কথায় অন্যরাও কাজলকে এখন বলা যায় মোটামুটি ভালোই বাসে। অথবা রাধুবাবু আর হেডস্যারের নেকনজরে আছে বলে ঘাঁটায় না। ছেলেপুলে থেকে নাইট গার্ড, নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ঝগড়া, মারধোর একইরকম লেগে থাকলেও কাজলকে কেউই আর বকাঝকাও করে না। আর দ্বিতীয় ভালো কথাটা হল এই যে, কাজল কিন্তু এখন ভালোই কথা বলে। যাকে পছন্দ হয় তার সঙ্গে বলে। নইলে কিছুই বলে না। একটু হয়তো জড়োসড়ো ওর কথাগুলো, হয়তো খানিকটা অন্যরকম, কিন্তু বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না কারও।
অন্যরকম এই জন্যে বললাম, কারণ এখনও ওর কিন্তু সবকথাই প্রথম পুরুষে। যেমন ধরো, হলধর যখন জিজ্ঞেস করে, “খাবা নাকি এহন?”
কাজল বলে, “খাবে।”
“ঘুমাতে যাবা?”
“ঘুমাতে যাবে।”
“খেলা করবা?”
“খেলা করবে।”
যে-কথা শুরুতে বলছিলাম, কাজলের ইশকুলে যাওয়ার কথা। এই পর্বটা যাকে বাংলায় বলে একেবারে মেমোরেবল বিষয়! সে তো যাবেই না। যেদিনই যাওয়ার কথা হয়, দৌড়ে পালিয়ে যায়। রাধুবাবু গিয়ে বোঝান, ম্যাজিক দেখান, ফিরিয়ে আনেন। এমনি করেই চলে।
শেষ অবধি স্যার-দাদুর কথায় কেন কে জানে রাজি হল কাজল। ও, এটাও তো বলা হয়নি! ওই যে রাশভারী ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মানুষটি, যাঁকে হলধর ‘ছার’ বলে ডাকে, হোমের সবাই হেডস্যার নামেই চেনে, তাঁকে তো কাজল এখন স্যার-দাদু বলে! আর সেই ডাক শোনার পর থেকে তো তিনি যাকে বলে আনন্দে ডগমগ! কাজলের কথা মন দিয়ে শোনেন আর রাধুবাবুকে বলেন, “সত্যিই রাধু, ম্যাজিক জানো বটে!”
তো সেই দাদুর কথায় শেষ অবধি ইশকুল চলল কাজল।
কাজলের ইশকুল তাদের ‘নিজের বাড়ি’ থেকে অনেকটাই দূরে। বলা যায় শহরে। সেই যে ডাক্তারবাবুর কাছে যেত কাজল আর রাধুবাবু, আরে যিনি কিনা কথা বলতে শেখাতেন কাজলকে, তাঁর কথাতেই এই ইশকুলের খোঁজ পাওয়া। গাড়ি করে যেতে হয়। রাধুবাবুর গাড়িতে যায়। গাড়িতে রাধুবাবু আর হলধর থাকে কাজলের সঙ্গে। তবে সেও প্রথম কয়েকদিন। এখন কেবল হলধর গেলেই চলে।
ইশকুল যে এত সুন্দর জায়গার নাম সে জানলে কি আর অমন আছাড়িপিছাড়ি করে কাঁদত কাজল? ইশকুলের গায়ে কত ছবি আঁকা। ইশকুলের মাঠে দোলনা আছে, ঢেঁকি আছে। কত রঙের, কত সাইজের বল আছে। কত চেয়ার আছে। বাগানে কত ফুল! আর একটা ছোট্ট চিড়িয়াখানা। সেখানে অনেক লাল, নীল, হলুদ, সবুজ পাখি! সেখানে লাল চোখের তুলতুলে খরগোশ কুটকুট করে ঘাস খায় আর ছেলেমেয়েদের দেখে। সিমেন্ট বাঁধানো একটা চৌকো জায়গায় জলে হাঁস চরে। কাজল হাঁস দেখেছে। ‘নিজের বাড়ি’-তে দেখেছে, মায়ের বাড়িতেও দেখেছে। জলে মাথা ডুবিয়ে হাঁস মাটি থেকে গেঁড়ি খায়।
আরও কত ছেলেমেয়ে পড়ে সেখানে। কাজল যেমন ছবি আঁকতে ভালোবাসে, ওরাও এক-একজন এক এক কাজ করতে ভালোবাসে। এই ইশকুলে কোনও জোর করা নেই। যে যেটা চায় সে সেটাই করে। শুধু যখন প্রার্থনা হয়, তখন সবাইকে একসঙ্গে গাইতে হয়। তাও দিদিমণিরা পশে দাঁড়িয়ে বার বার করে শিখিয়ে দেন। ভালোবাসেন সবাই বাচ্চাদের। একটুও রাগেন না।
এখানে ক্লাসরুমে হরেকরকমের খেলনা। সে-সব নিয়ে খেলতে খেলতে ছড়া শেখে বাচ্চারা। গাইতে গাইতে ছড়া শেখান দিদিমণি। বার বার শেখান। একটুও রাগেন না। এখানে থেকে থেকেই তো ম্যাজিকের মতো কাজল লিখতে শিখে গেল!
সেদিন যে কী আনন্দ হয়েছিল! ফিরেই রাধুবাবুকে জড়িয়ে ধরেছিল কাজল। দুপুরে ইশকুল আর সন্ধেবেলায় রাধুবাবুর কাছে থেকে থেকে কাজল লিখতে শিখল, পড়তে শিখল, আগের থেকেও ভালো করে কথা বলতে শিখল। এখন তো ‘নিজের বাড়ি’-র অনেকের থেকে ভালো করে পড়তে পারে, লিখতে পারে সে। নাম লেখে। ঠিকানা লেখে। চার লাইনের ছড়া মুখস্থ লেখে। ইংরেজি ছড়া বলতে পারে। তেরোর ঘর অবধি নামতা বলতে পারে। আর কী চাই!
চাই তো। কাজলের তো কোনোদিনই কিছু চাওয়ার ছিল না। কিন্তু ওকে নিয়ে ওর রাধুবাবুর যে চাওয়া ছিল। তাই তো বছর খানেকের মধ্যে এই ইশকুলের পাট চুকিয়ে কাজলকে ভরতি করে দেওয়া হল অনেক বড়ো একটা ইশকুলে। সেখানে ইয়া মাঠ। ইয়া দালান। ইয়া ঘণ্টায় ঢং ঢং করে পেটায় একজন। ঘণ্টা বাজলেই নতুন নতুন বইখাতা নিয়ে বসে যেতে হয়। ওসবে অসুবিধে হয় না এখন কাজলের।
অসুবিধে বলতে তো একটাই। সবার সঙ্গে কথা বলতে মন চায় না। আর মন না চাইলে তো সে-কাজ করবেই না সে।
করবে না বললে কি আর চলে? খুব কড়া ইশকুল। কড়া কড়া সব মাস্টারমশাই। কাজেই নিয়মে তো পড়তেই হবে। অবশ্য সে আলাদা কথা যে, কাজলকে ওঁরাই নিয়মনীতি থেকে খানিকটা ছাড় দেন। এই তো প্রেয়ারের লাইনে দাঁড়ানো থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে ওকে। অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে গান গায় না, ঠোঁট নাড়ায়, হাসে—তাতেও চলে, কিন্তু কাজল দাঁড়িয়ে ওর মতো উচ্চারণে জোরে জোরে গায় বলে ওকে আর লাইনে দাঁড় করানো যায় না। সুরে সুরে মিলতেই হবে যে! কাজেই প্রার্থনা থেকে ছাড় মেলে খানিকটা। লাইনের শেষ ছেলেটার থেকেও বেশ খানিক দূরে ওর ঠাঁই হয়। আর কাজলও পারে বটে! এখান থেকেই চিৎকার করে গান গায় কোনো-কোনোদিন। কোনো-কোনোদিন আবার মাথা দোলাতে দোলাতে এ-পাশ ও-পাশ কী যেন দেখে আর হাসে।
হাসে ঠিক, কিন্তু ওই যে বললাম এ-পাশ ও-পাশ দেখে—আসলে দেখে কি?
ওর দৃষ্টিটা কিন্তু আর পাঁচজনের মতো নয়। অনেক সরল, অনেক ভাসা ভাসা। ভালো করে দেখলে মনে হয় ও যেন দেখছে, কিন্তু দেখছে না।
ক্লাসেও জনা চারেক সহপাঠী আর দুজন মাস্টারমশাই ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথা বলে না। চুপ করে থাকে। কাজ দিলে সবার আগে করে ফেলে। স্যার দেখতে চাইলে দেখায়, নইলে খাতা ব্যাগে পুরে রাখে। তারপর কী করবে ভেবে পায় না। খুব ইচ্ছে হয় মাঠে গিয়ে একবার বড়ো গাছটার নীচে গিয়ে মাঝের ডালটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আরে ওই ডালটাতেই তো একটা বাসা করেছে হলুদ-কালো পাখি। কাজল দেখেছে তো! ছোট্ট একটা ছানা ঠোঁট হাঁ করে আর ওর হলুদ-কালো পাখি মা মুখে খাবার ঢুকিয়ে দেয়। ওরা কেমন করে ডাকে—চিঁ চিঁ চিঁ চিঁ, নাকি চুঁ চুঁ চুঁ চুঁ?
গোটা ক্লাস হঠাৎ হো হো করে হাসে। নিজের অজান্তেই যে কাজল বেঞ্চে বসে বসেই লাফিয়ে লাফিয়ে অমন চিঁ চিঁ চিঁ চিঁ, চুঁ চুঁ চুঁ চুঁ করে ডেকে ফেলেছে!
মোবাইল ফোন থেকে দৃষ্টিটা একবার চারদিকে ঘুরিয়ে যন্ত্রটাকে আলগোছে টেবিলে নামিয়ে রেখে গম্ভীর কোনও কড়া স্যার প্রায় দিনই রীতিমতো দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে চিৎকার করে ওঠেন—“অ্যাই চোওপ!” কাজলকে ধমকে বলেন, “পাগলামি করলে ঘাড় ধরে বের করে দেব!”
বুকটা কেঁপে ওঠে কাজলের। ঘাড়টা দুলে যায় বার বার। নাকে-মুখে হাত চলে যায় অকারণে। এমন হলে কাজল ঢুকে যায় ওর মনের ভিতরে। ভুলে যায় চারপাশ। কখনও তো বেরিয়েও যায় ক্লাস থেকে। ঘুরে বেড়ায় করিডোরে—একতলায়, দোতলায়, তিনতলায়; সেখানে আবার হয়তো কোনও গম্ভীর মাস্টারমশাই তাকে ক্লাসে যেতে বলেন।
কখনো-কখনো উঁচু ক্লাসের ছেলেরা ধরে। এটা ওটা করতে বলে। কাজল কি আর সুকর্ম-দুষ্কর্মের ফারাক-টারাক বোঝে? যা করতে বলে তাই করে। হাসিতে ফেটে পড়ে তখন ওরা। হাসি দেখে কাজলের ঠোঁটটা কেন জানি কাঁপতে থাকে। একদিকে কাঁপতে থাকে। ফের চলে আসে নিজের ক্লাসে। সেখানে হয়তো তখন অন্য কেউ চেয়ারে বসে আছেন। ঢুকব কি না জিজ্ঞেস করতে ভয় লাগে। জিজ্ঞেস না করেই তাই ঢুকে পড়ে। স্যার হয়তো বলেন, “ক্লাসরুমে ঢোকার সময় জিজ্ঞেস করতে হয়।”
কাজল শোনে আর ভাবে, এসব তো সে জানে। বলতে ইচ্ছে না হলে কী করবে!
স্যার গলা তুলে বলেন, “কী হল, শুনতে পাচ্ছ না?”
কাজল চায় না বলতে, কিন্তু কীভাবে যেন অবিকল স্যারের মতোই বলে ওঠে, “কী হল, শুনতে পাচ্ছ না?” তারপরেই ভয়-টয় পেয়ে নিজের ব্যাগ টেনে নিয়ে বসে পড়ে। বই বের করে তাকিয়ে থাকে পাতায়। বইয়ের পাতাতেও যে রাধুবাবু আর তাঁর লাল-নীল ম্যাজিক। ভয়ের মাঝেও কীভাবে যেন হেসে ফেলে। বানানো হাসি নয়, নির্ভেজাল হাসি।
কী ভেবে হাসে? ম্যাজিকটা কি মজার?
কী করে জানব বলো তো? মনে ঢোকার কায়দা তো আর সবার জানা থাকে না! আমার তো বাপু নেই-ই।
৬
চিরদিন কারও একরকম যায় না। কাজলের যাবে কেমন করে?
একদিন ভোররাতে হোমে হুলুস্থুল! চোখ ডলতে ডলতে বাইরে এসে কাজল দেখে স্যার-দাদুর ঘরের বাইরে সব ছেলেরা দাঁড়িয়ে। তখনও ভালো মতো আলো ফোটেনি। বড়ো দাদারা ছোটাছুটি করছে। হলধরদা বার বার চোখ মুছছে। আর রাধুবাবু স্যার-দাদুর পা নিয়ে তালুটা ডলে দিচ্ছে। একবার এই পা তো আবার ওই পা। দেখে কাজলেরই খুব সুড়সুড়ি লাগল। ফিক করে হেসে ফেলল।
কে একজন বলল, “অ্যাই, এটাকে সরা তো!”
সেদিন একটা সাদা গাড়ি এসেছিল। স্যার-দাদুকে নিয়ে গেল। দাদু শুয়ে ছিল। তারপর আর একটা বড়ো কাচ-ঢাকা গাড়ি এসেছিল দুপুরে। সেখান থেকে দাদুকে নামাল সবাই ধরাধরি করে। দাদু এখনও শুয়ে আছে। শুধু বিছানাটা যেন বদলে গেছে। শুধু সময়টা যেন বদলে গেছে। সবাই কাঁদছে। অনেকদিন বাদে কাজলেরও খুব কান্না পেল।
কেন?
তা তো সে জানে না। কাঁদতে-কাঁদতেই ফের তার হাসি পেল। ফিক করে হেসেও ফেলল। অমনি রাধুবাবুর ঠান্ডা হাত তার কাঁধে আলতো চাপ দিল। ধরা গলায় রাধুবাবু বললেন, “কাজল, তোর স্যার-দাদু আর কখনও ফিরে আসবে না রে। প্রণাম করে নে বাবা।”
দাদুর পা কী ঠান্ডা! এমন ঠান্ডা গা কোনোদিন কারও দেখেনি ছেলেটা।
হলধরকে গিয়ে সে-কথা বলল কাজল। হলধর চোখ মুছতে মুছতে বলল, “মরা মাইনষের পা অমনিই ঠান্ডা হয়। ছার-দাদু তো আর নাই! অনার দ্যাহডা আছে।”
সকাল থেকে কী যে হচ্ছে! কেউ কি খেতে দেবে না আজ? খিদে পায় যে!
গাড়িটা দাদুকে নিয়ে যাচ্ছে। রাধুবাবু গাড়িতে ড্রাইভারের পাশের সিটে। কাজলকে দেখছেনও না। আর একটা গাড়ির উপর হোমের বড়োরা আছে। সব ছেলেরা নীচে দাঁড়িয়ে। সবাই কাঁদছে।
“কোথায় নিয়ে গেল স্যার-দাদুকে?” ঠোঁট চাটতে চাটতে জিজ্ঞেস করল কাজল।
কেউ উত্তর দিল না।
এদিক ওদিক তাকিয়ে হলধরকে দেখে তার কাছে গেল কাজল। হলধরের হাতটা ঝাঁকিয়ে প্রায় চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় নিয়ে গেল স্যার-দাদুকে?”
ওর মাথায় হাত বুলিয়ে হলধর বলল, “জায়গামতো লয়া গেল।”
“কোন জায়গামতো? দাদু কবে আসবে? আজকে আসবে না?”
“মইরা গেলে তো আর মাইনষে ফিরা আসে না!” বলতে বলতে ফের কেঁদে ফেলল হলধর।
তারপর অনেক পরে রাধুবাবু ফিরে এলেন। কিন্তু কাজলের সঙ্গে কথা বললেন না। কারও সঙ্গে কথা বললেন না। সেই যে দরজা দিলেন, আর খুললেন না। রাতে কাজল গিয়ে শুল সবার জন্য বরাদ্দ সেই ঘরে।
সেদিন থেকে কাজলের সেখানেই পুরোপুরি ঠাঁই হল। তাতে অবশ্য অসুবিধার কিছু নেই। দরকার হলেই মনে মনে তো সে রাধুবাবুর সঙ্গে কথা বলে নিত।
একদিন রাধুবাবুও চলে গেলেন। নিজে নিজে অবশ্য যাননি। যেতে হয়েছে। কাজলকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাজলকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি তাঁকে দেননি।
কে অনুমতি দেননি?
কে আবার, স্যার-দাদুর জায়গায় নতুন প্রধান হয়ে যিনি এলেন, সেই খিটখিটে লোকটাই! শুধু কি খিটখিটে? ভয় ধরানোর মতো তাগড়া জোয়ান লোকটা। না-হলেও সাড়ে ছ’ফুট হাইট, মাথাজোড়া টাক, এই মোটা গোঁফ, গালের নীচ অবধি চওড়া জুলফি, আর কুতকুতে দুটো চোখ। দুমদুম করে একটা লাল মোটর সাইকেল চালান। যেমন মোটর সাইকেলের আওয়াজ, তেমনি গলা! বাজখাঁই আওয়াজে চমকে পিলে একেবারে গলায় উঠে আসে। ওই লোকই তো বাইরের লোক থাকতে পারবে না বলে প্রথম রাধুবাবুকে তাড়ালেন।
রাধুবাবুর দোষ কী?
দোষ তো আছেই। উনি কেন নতুন প্রধানকে আটকেছিলেন?
কীসের থেকে আটকেছিলেন?
না, উনি যেদিন বাচ্চাদের বেত-পেটা করছিলেন, সেদিন রাধুবাবু তাঁকে আটকেছিলেন, দু-চারটে কথাও শুনিয়েছিলেন। এমনিতেই তো ওই দশাসই চেহারার সামনে বাচ্চাগুলো ইঁদুরছানার মতো, তার ওপর যদি অমন বেত-পেটা হয়, ওরা সইতে পারে?
ওরা তো পারেই না। রাধুবাবুই-বা সইতে পারেন কেমন করে? হুড়মুড় করে গিয়ে আটকালেন নতুন প্রধানকে। ব্যস! তার সাতদিনের মাথায় কীসব চিঠিপত্র এল আর রাধুবাবুকেও ‘নিজের বাড়ি’ ছেড়ে চলে যেতে হল!
ভাগ্যিস কাজল সবটা তক্ষুনি তক্ষুনি বোঝেনি। ভাগ্যিস কাজল দুঃখেও হাসতে পারে। নইলে তার রাধুবাবুকে চলে যেতে দেখে কি আর সে স্থির থাকতে পারত?
কিন্তু স্থির থাকতে কি পেরেছে?
থাকার মধ্যে সম্বল তো ওই এক ঝোলা ব্যাগ। সেটা কাঁধে তুলে যাওয়ার আগে কাজলকে তিনি অনেক রঙ, তুলি আর সাদা কাগজ দিয়েছেন। ড্রইং খাতা দিয়েছেন। আর দিয়েছেন একটা বাদামি রঙের ঝোলা ব্যাগ। ব্যাগে কাজলের পরিচয়সংক্রান্ত কাগজের ফাইল, আর কিছু টাকাভরা একটা পার্স। বলেছেন, “যেখানে জায়গা পাবি সেটাকেই ক্যানভাস ভাববি। মনে রাখিস পেনসিল, তুলি, রঙ, কলম ছাড়াও আঁকা যায়। ছবি আঁকা হয় আসলে মনে। বাইরেরটা তো আয়নায় ফোটা প্রতিবিম্ব।”
তারপর সেই ঝোলা নিয়ে যেই না রিকশায় উঠছেন, একছুটে কাজল গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছে। হলধর যখন ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসছে, ‘নিজের বাড়ি’-র সবাই তখন এক না দেখা দৃশ্যের স্বাক্ষী। রাধুবাবুর চোখে জল!
কাজল বিড়বিড় করে রাধুবাবুর শেখানো গান গাইছে—‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে…’
কাজলের তো মনখারাপ বেশিক্ষণ থাকে না। থাকলেও বোঝা যায় না তেমন। বোঝা যাক বা না যাক, কথা হচ্ছে, রাধুবাবু ছাড়া কাজল থাকতে পারবে তো?
পারতেও পারে। কারণ, আগে এসব নিয়ে কাজলকে যা যা বলার বলে দিয়েছেন রাধুবাবু। সেই বিলের মাঝের জলটুঙিতে বসে অনেকদিন অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু ছেলেটি তো কাজল। মনে রাখবে কি?
রাধুবাবু কাজলকে বুঝিয়েছেন যে, কেউ চিরকাল থাকে না। রাধুবাবুও কাজলের সঙ্গে চিরকাল থাকতে পারবেন না। থাকার চেষ্টা একটা তিনি করবেন, কিন্তু যদি না পারেন কাজল যেন বড়ো হওয়ার চেষ্টা না ছাড়ে। ছবি আঁকা যেন না ছাড়ে। আঁকতে হবে। আঁকলে মনে আলো আসে, রঙ আসে। খেতে হবে সময়মতো। পড়তে হবে। লিখতে হবে। সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তবে তো বড়ো হওয়া যাবে।
‘কেউ চিরকাল থাকে না—কেউ চিরকাল থাকে না…’
রাধুবাবুর কাছে শোনা কথাটা কাজল যখন বার বার বলছে, তখন আকাশে এক অদ্ভুত খেলা। উপরের আকাশে কয়েক পাঁজা সাদা মেঘ। আর বিলের জল ছুঁয়ে যে আকাশ, তাতে কালো মেঘে ‘দ’-এর মতো বিদ্যুৎ খেলছে। সেই দুই মেঘ দেখিয়ে রাধুবাবু বলেছিলেন, “সাদা মেঘে যখন অনেক জল জমে যায় তখন কালো হয়ে যায়। কালো মেঘেও যখন অনেক জল জমে যায় তখন তা থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ে। তারপর আর সেই মেঘকে তো পাওয়া যায় না।”
“মেঘকে পাওয়া যায় না… মেঘ কোথায় যায়?”
“কোথায় আবার যাবে? বৃষ্টি হয়ে গেল যে!”
“মেঘ বৃষ্টি হয়ে গেল যে… বৃষ্টি হয়ে গেল… আর মেঘ হবে না… মেঘ পাওয়া যাবে না।”
“হবে তো! ওই জল থেকেই তো আবার পরে নতুন মেঘ হবে। তারপর আবার বৃষ্টি, আবার মেঘ।”
কালো মেঘের বুক চিরে বিদ্যুতের আলো মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছিল, তবে সেদিন বজ্রপাতের কোনও শব্দ ছিল না। মেঘের ডাকে বেজায় ভয় কাজলের।
রাধুবাবু সেদিন ওকে বলেছিলেন, “মনে রাখিস কাজল, ভয় কিছুতে পাবি না। ভয় পাবি না, লজ্জা পাবি না। যাকে যা বলতে ইচ্ছে হবে বলবি। যখন ইচ্ছে হবে বলবি। এক মেঘ গেলে অন্য মেঘ হয় বললাম না তোকে?—এক রাধুবাবু চলে গেলে দেখবি আর এক রাধুবাবু আসবে। তার কাছে হয়তো আরও অন্য ম্যাজিক আছে। মনটাকে খোলা রাখবি। তুই তো আমার সুদ্ধ বুদ্ধ সাদা মেঘ রে কাজল। বিশুদ্ধ ধপধপে মুক্ত সাদা মেঘ।”
কখনও ওর দিকে তাকিয়ে, কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে কত কী যে বলছিলেন আরও রাধুবাবু, কাজলের মাথায় সে-সব ঢুকছিল না। ও কেবল দেখছিল সাদা মেঘে চুঁইয়ে ঢুকছে কালো মেঘ। নাকি সাদা মেঘ চুঁইয়ে নামছে কালো মেঘে, আর কালো মেঘ ঝাপসা করে ধেয়ে আসছে বৃষ্টি। যখন কাছে এসে পড়ল সেই বৃষ্টি, একেবারে বিলের জলে লাফিয়ে পড়ে বুদবুদে ভরিয়ে তুলল চারদিক—কী শব্দ তার!
বিলের জলে বৃষ্টির জলের বুদবুদ। বিলের বুকের জলটুঙিতে দুটো অসম বয়সের বুকে অজস্র কথার বুদবুদ। কালো মেঘে বিদ্যুৎ খেলছে। মেঘ ডাকার শব্দ হচ্ছে না। কথার বুদবুদ উঠছে। কথার শব্দ ফুটছে না।
সব কথার তাহলে বোধ হয় শব্দ হয়ও না।
৭
সে-রাতে কি মায়ের স্বপ্ন দেখেছিল কাজল? সেই যে সেই ট্রেনের স্বপ্নটা?
যা টালমাটাল অবস্থা ওর মনের, তাতে তো দেখার কথাই। কিন্তু দেখেনি। দেখলে নিশ্চয়ই ডায়েরিতে লেখা থাকত। কারণ, ওই সময় থেকেই তো কাজলের ডায়েরি লেখার শুরু। ডায়েরিটা তাকে দিয়ে গেছিলেন রাধুবাবু। নীল রঙের। মসৃণ মলাট। কভার ওলটালেই রাধুবাবুর লেখা— সাদা মেঘের ডায়েরি। পাশে একটা টুকরো মেঘের ছবি। রাধুবাবুর আঁকা।
সে-ডায়েরিতে প্রথম লেখা— রাধুবাবু চলে গেল। নীচে একটা অগোছালো হিজিবিজি ছবি। তাঁর নীচে গোটা গোটা করে লেখা— কাজল কুমার। তারিখ ১২ অক্টোবর, ২০১৪।
স্বপ্নের প্রথম বর্ণনা আরও কয়েক পাতা পরে। তার আগের কয়েক পাতায় টুকরো টুকরো যা লেখা তা থেকে কাজলের জীবনের একটা মোড় ঘোরার আভাস মেলে।
রাধুবাবু চলে যাওয়ার পরে ‘নিজের বাড়ি’ আর সেরকম ছিল না। সব কেমন কাঠ কাঠ ব্যাপার-স্যাপার। উপরে উপরে একটা কায়দাকানুনের কঠিন বেড়াজাল। অথচ ছেলেগুলোর দিকে তেমন নজর আর ছিল বলে তো মনে হয় না। হলধর নিজেও তেমন কথাই বলত।
এই কয়েক মাসে কাজলের রুটিনও বদলে গেছিল। সকালে উঠে মুখ ধুয়ে খেয়েদেয়ে পড়তে বসে, তারপর চান করে খেয়েদেয়ে সবার সঙ্গে ইশকুলে যায়। ওর ইশকুলটাও এর মধ্যে বদলে গেছে। দূরের ইশকুলে কে নিয়ে যাবে? রাধুবাবু নেই, কাজেই আর সবার সঙ্গেই তো যেতে হবে। তাই হোমের সবাই যেখানে পড়ে সেখানেই ওকে ভরতি করা হয়েছে। ইশকুল থেকে ফিরে এসে উঠোনে নিজের মতো খেলে। সন্ধ্যায় টিউশনের মাস্টারমশাই পড়াতে আসেন। পড়ে। পড়তে বসে ঢোলে। আনমনা হয়। কখনও আঁকিবুকি কাটে। বকা খায়। জুলপিতে টান পড়ে। চোখ-মুখ কুঁচকে জিভ বেরিয়ে যায় কাজলের। চমকে চমকে মাথা নুয়ে যায়। আর সবাই হাসে। কাজল চুপচাপ খাতায় লেখে।
রাতে ফাঁকা পেলে ডায়েরিতে লেখে।
রুটিন তো যাই হোক চলে যাওয়ার মতো। আসল সমস্যা তো অন্যখানে। বলতে গেলে মূর্তিমান সমস্যা তো নতুন প্রধান নিজে। সমস্যা তো তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ, হোমের লোকজন। স্যার-দাদু আর রাধুবাবু থাকায় এরা দমে ছিল। এখন তো একেবারে উঠতে বসতে ঠ্যাঙায়। পান থেকে চুন খসল কি খসল না—ব্যস! শুরু হয়ে গেল।
কাজলকে অবশ্য কেউ আজ অবধি মারে না। তার কারণও রাধুবাবু।
একদিন ইশকুলের জামায় ধুলো-কালি মেখে ফিরেছিল কাজল। এমন করে বাড়ি ফেরা তো নতুন কিছু নয়। প্রায়ই তো ইশকুলের উঠোনে, না-হলে করিডোরে শুয়ে পড়ত কাজল। কোনও মাস্টারমশাই অথবা উঁচু ক্লাসের ছেলেদের চোখে পড়লে ধুলো থেকে ওকে উঠিয়ে দিত। উলটোটাও ছিল অবশ্যই। হয়তো করিডোরে আপনমনে দাঁড়িয়ে দূরে দেখছে কাজল, উঁচু ক্লাসের দাদারা এসে ‘আরে তোর তো ছুটি হয়ে গেছে! যা ওইখানে গিয়ে শুয়ে থাক।’ বলে কোনোদিন কৃষ্ণচূড়া গাছের বেদি, কোনোদিন-বা উঠোনের দিকে দেখিয়ে দিত।
কাজল কি আর অতশত বোঝে? শুয়ে পড়ত গিয়ে। তারপর যা হয়, অধিকাংশ দিন বকাঝকা খেয়ে ক্লাসে ঢুকত। বাড়ি ফিরলে হলধর ময়লা জামা কেচে দিত।
রাধুবাবু ওকে নিজেকে কাচতে শিখিয়েছিলেন। কোনো-কোনোদিন তাই নিজেও কেচে নিত। কিন্তু সেদিন হোমে ফেরার পরেই অমন নোংরা পোশাক দেখে প্রধান তেলেবেগুনে চটে হাতের বেত দিয়ে কয়েক ঘা বসিয়েছিলেন। সঙ্গে অকথা কুকথা তো আছেই!
কাজল তো কিছুই বলতে পারেনি। কাঁদতেও পারেনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চমকে চমকে উঠছিল শুধু। রাধুবাবুকে কে খবর দিয়েছিল কাজল জানে না। কিন্তু রাধুবাবু এসেই খুব রেগে বেতটা কেড়ে নিয়ে ভেঙে দিয়েছিলেন। আলমারি থেকে কীসব কাগজ বার করে দেখিয়ে বলেছিলেন, “ফের কোনোদিন এই ছেলেকে মারলে আপনাকে হাজতবাস করাব।” তারপর কাজলকে নিয়ে চলে এসেছিলেন ঘরে।
কাজল শুনেছিল প্রধান সেদিন গজগজ করছেন—“আগে এই আগাছাটাকে তাড়াব, তারপর এটাকে।”
হয়তো-বা সেজন্যই কাজলকে এখনও মারেন না। তবে নিয়ম করে অকথা কুকথা বলে ধমকাতে ছাড়েন না অবশ্য। যা নয় তাই বলেন। মারেন না বটে, তবে তেড়ে আসেন। তেড়ে আসতে দেখেই চমকে ওঠে কাজল। যা বলেন তাই করে। প্রধান নিজের প্রধানত্বে খুশি হয়ে আশেপাশের সাঙ্গোপাঙ্গদের দিকে তাকান। ভাবখানা এমন—দেখলে তো, ঠেলার নাম কেমন বাবাজি!
অবশ্য ভয়েই হোক, ভক্তিতেই হোক অথবা নৈমিত্তিক জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াতেই হোক, বলতে নেই, কাজলও কিন্তু ইদানীং আর যেখানে সেখানে শুয়ে পড়ে না। নতুন ইশকুলে তো ‘নিজের বাড়ি’-র অনেকেই পড়ে । ফলে ওর বন্ধুর অভাবও সেরকম হয় না। যে-কোনো সমস্যায় ওরা স্যারদের বলে দেয় ওর কথা। তাছাড়া বাইরে বেরিয়ে গেলেই ‘নিজের বাড়ি’-র কাউকে না কাউকে পেয়েই যায় বাইরে। তার সঙ্গেই ঘুরে বেড়ায় গোটা ইশকুল।
কাজল ঘরে থাকলেও কেউ কিছু বলে না, ক্লাস চলতে চলতে বেরিয়ে গেলেও কোনও স্যার কিছু বলেন না। থেকেও যেন নেই হয়ে ইয়া বড়ো স্কুলে ঘুরে বেড়ায় কাজল।
অবশ্য রাধুবাবুর আশীর্বাদে অনেকের থেকে ভালো পড়তে, লিখতে, মনে রাখতে পারে কাজল। পরীক্ষার সময় নিজের খাতা ভরে যা লেখে, তা অনেকের থেকেই ভালো। ব্যস! ইশকুল আর ছাত্রের কাছ থেকে কী চায়? পরীক্ষায় পাশ করে যাচ্ছে তো। সে যদি প্রার্থনায় দাঁড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আপন মনে হাসে অথবা আপনমনে কথা বলে, যদি ক্লাসের সময় বেরিয়ে যায়, ঘুরে বেড়ায়, তাকে আলাদা করে দেখানোর শেখানোর অত সময় কোথায় সেই ইশকুলের!
দিন যায়, রাত যায়। ‘নিজের বাড়ি’-র পরিবেশ ক্রমশ অসহ্য হয়ে ওঠে। অত্যাচারের ঠেলায় ছোট্ট ছেলেটা ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠছিল। সবার সঙ্গে একসঙ্গে থেকে থেকে ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠছিল ছেলেটা। এখন আর খুব বেশি আপনমনে থাকে না কাজল। সবার সঙ্গেই খায়দায়, ঘুমোয়। কেবল মাঝে মাঝে রাত্তিরে চুপিচুপি ডায়েরিতে লেখে। জ্বালা-যন্ত্রণা আর সঙ্গীদের মোটা দাগের ঠাট্টা-তামাশার মোটা পরত মনের উপর জমে জমে ওর সংবেদন খানিক হয়তো কমিয়ে আর পাঁচজনের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছিল ওকে, সাদা বাংলায় যাকে আমরা বড়ো হওয়া বলি আর কী, তাই খানিক হচ্ছিল কাজল। এছাড়া তো আর কোনও বিকল্প ছিল না ওর। ওর কেন, ‘নিজের বাড়ি’-র আর কারোরই কোনও বিকল্প ছিল কি? বিকল্প না থাকলেও দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ অন্য কথা ভাবে। ছোটো মানুষও তো মানুষই। তারাই-বা ভাববে না কেন?
এইসব কারণেই হয়তো ‘নিজের বাড়ি’ থেকে দু-দুটো ছেলে পালিয়ে গেল একদিন। থানা থেকে পুলিশ এল। নতুন প্রধানের ঘরে চা খেল, সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করল। সবাই চুপ। তবে ঘরে ঘরে অনেক কথাই বলাবলি করল সবাই। সব শুনছিল কাজল। কিচ্ছু বলছিল না।
ছেলে দুটো আর ফিরল না।
এই দোলাচল থিতিয়ে যেতে বেশিদিন লাগল না। আবার আগের মতো ঠ্যাঙানি শুরু হতেও বেশিদিন লাগল না।
কিন্তু অত্যাচারের মাত্রাটা একদিন সহ্যের সীমা ছাড়াল।
সেদিন ইশকুল ছুটি। কাজল সকালে আরও তিনজনের সঙ্গে খেলতে বেরিয়ে ফিরেছিল অনেক দেরিতে। তাতেও যে খুব বড়ো একটা কিছু হত তা কিন্তু নয়। এইসব ছেলেদের বেরোনো, ফেরা, ভালমন্দ—এত কিছু দেখার লোক আর হলধর ছাড়া ‘নিজের বাড়ি’-তে তখন কেউ ছিল না। মুশকিলটা হল, সেদিন দেরিতে আসায় দুপুরের মিল গেছিল শেষ হয়ে। ওদিকে পেটে তো রাজ্যের খিদে!
ছেলেদের খাবার রাখার জায়গার পাশেই অফিসের লোকেদের মিটসেফ। একজন সেখানেই আবিষ্কার করল ভাত, ডাল, আলুভাজা আর চাকা চাকা মাছের ঝোল। ডাইনিংয়ে ডাইনিং তখন কেউ নেই। এত বেলায় অফিসের কারোরই নিশ্চয়ই খাওয়াও বাকি নেই। খিদের জ্বালায় পাত পেড়ে হাপুসহুপুস করে তাই খেয়ে নিয়েছিল ওরা। ওরা কি জানত সেইসব খাবারই নতুন প্রধানের? সেদিন স্নান-আহ্নিকে প্রধানের খানিক দেরি হয়েছিল। ওদিকে যদিও ওরা দেখেছিল যে ডাইনিং ফাঁকা, কিন্তু উঁকি দিয়ে যে নতুন প্রধানের গুপ্তচর তাদের দেখছিল, সে-সব তারা আর বোঝেনি।
ফলে ফল ফলতে বেশি সময় লাগল না। আহ্নিক সেরে নতুন প্রধান দুপুরের খাবার খেতে এলেন ডাইনিংয়ে। মাসি খাবার দিতে গিয়ে দেখলেন খাবার কম। ওদিকে সেই গুপ্তচরও তক্ষুনি গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে দিল সব লাগিয়ে! আর যায় কোথা? বেত হাতে সেই কালান্তক দশাসই প্রধানের প্রবেশ আর পাইকারি সপাসপ বেত্রাঘাত। চোখ তখন তার টকটকে লাল। মুখ দিয়ে হুমহাম শব্দ বেরোচ্ছে, থুতু ছিটছে চারদিকে। কাজলকে ছেড়ে সবাইকে একেবারে চোর ঠ্যাঙান ঠ্যাঙালেন। ওদের মার খেতে দেখে ভয়ে কাজল সিঁটিয়ে ছিল এককোণে। অন্যদের ঠ্যাঙাতে ঠ্যাঙাতে হাঁপিয়ে গিয়ে জিরিয়ে নিতে গিয়ে ওর দিকে চোখ পড়তেই হাউমাউ করে তেড়ে এসে চিৎকার করতে শুরু করে দিয়েছিলেন প্রধান।
দশাসই সেই প্রধানের গায়ে যে তাঁর ভয়ানক স্বভাবের উপযুক্ত একটা গন্ধ আছে, সেদিনই টের পেয়েছিল কাজল। গা তার গুলিয়ে উঠেছিল। মনের বয়স খানিক বাড়লেও অত রাখঢাক তো তখনও জানে না ও। নাকে হাতচাপা দিয়ে পিছিয়ে গিয়েছিল আরও।
“কী রে? কী রে?” বলে সুর চড়ান নতুন প্রধান।
“খুব গন্ধ, খুব গন্ধ।” বলে ফের নাকচাপা দেয় কাজল।
সদ্য মার খাওয়া ছেলেগুলোও খ্যা খ্যা করে হাসে।
মাথায় আগুন চড়ে যায় নতুন প্রধানের। চিৎকার করে বলতে থাকেন, “চোর কোথাকার! চুরি করবি? মেরে তোর হাড় আমি গুঁড়িয়ে দেব!” সপাসপ দুটো চারটে বাড়ি পড়ে হাতে।
সোজা দাঁড়িয়েই তারস্বরে কেঁদে ওঠে কাজল। সেই অদ্ভুত কান্নার আওয়াজেই বোধ হয় থমকে যান নতুন প্রধান। তারপর “তোকে তো আবার মারা যাবে না লাট বাহাদুর!” বলতে বলতে বেতখানা ছুড়ে ফেলে নিজের দুটো হাত এ-পাশ ও-পাশ করে নিজের দুই বাহুমূলে আবদ্ধ করে এগিয়ে আসতে থাকেন। ওই বড়ো চেহারার পিছনে হারিয়ে যেতে থাকে কাজল। পিছু হঠতে হঠতে দেয়ালের কোণে ঠেসে যায়। একেবারে তার সামনে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার করেন ‘নিজের বাড়ি’-র নতুন প্রধান, “দ্যাখ, তোকে আমি ছুঁচ্ছিও না, মারছিও না। বল কী বলছিস এবার। চুরি করেছিস কেন বল!”
“চলে যাও! চলে যাও!” বলতে বলতে হাঁপাতে হাঁপাতে কাঁদতে থাকে কাজল। তারপর হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে মাথা গুঁজে বসে পড়ে মাটিতে।
হলধর দৌড়ে আসে। নতুন প্রধানের দিকে একটা ঘৃণার দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে কাজলকে তোলে। হাত ডলে দেয়, পা ডলে দেয়। বুক-পিঠ সাপটে দেয়।
“খাইতে পাস নাই আমারে কইলি না ক্যান রে হতভাগা! তাইলে তো এমন চুর ঠ্যাঙ্গান…” গলা বুজে আসে ছত্রিশ বছর ধরে এই ‘নিজের বাড়ি’-তে কাজ করা হলধরের।
নতুন প্রধান গজগজ করে চলেন। হলধরকে উদ্দেশ করে বলেন, “পালের গোদাটাকে তাড়িয়েছি। তোকেও তাড়াব। পিটিয়ে সিধে করে দেব বেয়াড়াগুলোকে!” বলতে বলতে দুদ্দাড় করে বেরিয়ে যান ঘর থেকে।
এই ‘নিজের বাড়ি’ কাজলকে অনেক দিয়েছে। মাথার ছাত দিয়েছে। পেটে ভাত দিয়েছে। মুখে কথা দিয়েছে। হাতে কলম দিয়েছে। বলাই বাহুল্য, ভালোবাসাও দিয়েছে। তবুও সেই রাতেই চিরদিনের মতো সেই ‘নিজের বাড়ি’ ছেড়ে চলে গেল কাজল। যখন যায়, তখন সবে রাত ফিকে হতে শুরু করছে। ‘নিজের বাড়ি’-র উঠোনের ঘাসে তখন সারারাতের শিশির।
একবারও পিছনে না তাকিয়ে কাজলের ছায়া দৌড়ে বেরিয়ে গেল ‘নিজের বাড়ি’ থেকে। কাঁধের ইশকুল ব্যাগে ডায়েরি, ওর প্রিয় লাল রঙের জামা, রাধুবাবুর দেওয়া সেই বাদামি ঝোলা ব্যাগ, রঙ-তুলি, ড্রইং খাতা।
৮
আলো ফোটার আগেই যে তাকে চলে যেতে হবে অনেক দূর। কাজল তাই দৌড়চ্ছে। আর ফিরে আসবে না সে এখানে। কোথায় থাকবে, কেমন করে থাকবে—অতসব ভাবতেও সে পারে না। এখানে আর থাকবে না, কিছুতেই থাকবে না—কাজল তাই দৌড়চ্ছে। হাঁপ ধরে যাচ্ছে। যাক, হাঁপ ধরুক। হাপরের মতো বুকের পর্দা নামুক উঠুক, যা খুশি করুক, থামলে চলবে না।
গলির মোড় থেকে কুকুর তেড়ে আসছে। ভয়ে বুকের ভিতর দমাস দমাস করছে। চায়ের দোকান খুলছে। হোস্টেলে আলু দেয় রামদিন মিশির। চায়ের দোকান থেকে ওকে দেখতে পেয়েই ওর ফেলে আসা পথে সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাল। কাজল দেখল কি?
প্রাণপণে ছুটছে কাজল। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে দু-বার। হাঁটুর কাছে প্যান্ট ছিঁড়ে গেছে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে এত জোর লেগেছে যে চোখে জল এসে গেছে। তবু থামা যাবে না। আলো ফোটার আগে যে তাকে চলে যেতে হবে অনেক দূর।
ছুটতে ছুটতে ইশকুল পার হয়ে গেল। ইশকুল পার করে ধু ধু ক্ষেত। ক্ষেতের ধানে এখন সাদা দুধ জমা হবার সময়। এই মাঠে ইশকুলের দুষ্টু ছেলেরা পিট্টু খেলে। কাজলও খেলেছে। সবাই বল পেটা করত ওকে। অন্য সবার মতো হাতের জুতো দিয়ে বল ঠেকাতে পারত না। তবে ছুটতে পারত। কখনও আল ধরে, কখনও এবড়ো-খেবড়ো ক্ষেত ধরে ছুটতে ছুটতে অনেক দূর চলে যেত। আজও অনেক দূর চলে যাবে কাজল।
ছুটতে ছুটতে পরিচিত মাঠ পার হল। জঙ্গল পার হল। জঙ্গল পার করে উঁচু ঢাল। উঁচু ঢালে সুন্দর সব মাটির বাড়ি, কাজলের সহপাঠী রমেনের বাড়ি। রমেনের মা কাজলকে চেনে। ভোরবেলা উঠোন নিকোতে নিকোতে কাজলকে অমন প্রাণপণ দৌড়তে দেখে হাতের গোবর ন্যাতা থপাত করে ফেলে ছেলেকে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে ঘরে ঢুকল।
উঁচু ঢাল পার হয়ে কান্দার জোড়া বিল। বিলের উপরে জমাট বাঁধা কুয়াশা। জোড়া বিলের মাঝখান দিয়ে তালগাছ বেষ্টিত মাটির পথ। সেই পথ পার হলে আবার ধু ধু ক্ষেত। ক্ষেতের দিগন্তে সুতোর মতন বড়ো রাস্তা।
বড়ো রাস্তায় যখন এসে উঠল কাজল তখন আকাশের লাল রঙে নয়ানজুলিতে ছোটো-বড়ো রাঙা ঢেউ। পা আর চলছে না। বড়ো রাস্তার একপাশে একটা গাছের তলায় ধপ করে বসে পড়ল কাজল। হাঁপানির চোটে বুকটা নামছে উঠছে। মাথাটা ঝুঁকে আসছে বুকে। খুব তেষ্টা। কিন্তু জল যে সঙ্গে নেওয়া হয়নি।
ডান পায়ের চটিটায় ধুলোয় রক্তে মাখামাখি। বুড়ো আঙুলের আধখানা নখ ভেঙে কাত হয়ে আছে। ষাট করার মতো হাত দিয়ে আলতো করে বসিয়ে দিতে গেল কাজল। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। কেঁদে ফেলল। পাশ দিয়ে বড়ো বড়ো গাড়ি হুশ হুশ করে চলে যাচ্ছে। এই রাস্তায় কখনও তো আসেনি সে। এতদিন যে এখানে আছে, কোনোদিন আসেনি। এবার কী করবে ও?
ভাবতে-ভাবতেই চোখ পড়ল ফেলে আসা পথে। কে যেন লুকিয়ে পড়ল মনে হল না?
ও যে রমেন। সঙ্গে ওর মা।
আরও খানিক দূরে নতুন প্রধানের দুমদুমির মোটর বাইকে তিনি নিজে আর রামদিন মিশির। নতুন প্রধানের গায়ে তখনও রাতপোশাক।
ওঁদের দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ে ফের দৌড়ল কাজল। রমেন চিৎকার করছে—“কাজল দাঁড়া! বড়ো রাস্তায় ওভাবে দৌড়াস না!”
নতুন প্রধানের দুমদুমি মোটর বাইক বড়ো রাস্তায় উঠে পড়েছে। এগিয়ে আসছে কাজলের দিকে। এমন সময় চোখে পড়ল, সামনেই একটা বটগাছ তলায় একটা বড়ো সাদা গাড়িতে এক ভদ্রমহিলা জনা তিনেক ছেলেমেয়েদের নিয়ে উঠছেন। জায়গার নাম বলতে বলতে কন্ডাক্টর গাড়ির গা পেটাচ্ছে। কাজল গিয়ে সেটায় উঠে একটা সিটে বসে পড়ল। ভদ্রমহিলা আর তাঁর ছেলেপুলেরাও আশেপাশের সিটগুলোতে বসে পড়লেন। আর গাড়িটাও তক্ষুনি ছেড়ে দিল।
গাড়িটা কিন্তু আসলে একটা বাস। ওখানে ওরকম ছোটো বাস চলে। কন্ডাক্টর এসে টিকিট চাইতে ভদ্রমহিলা কোন এক আখের কল মোড়ের টিকিট নিলেন। কন্ডাক্টার টিকিট কেটে ওঁর হাতে দিয়ে চলে গেল। কাজলকে ওদের দলেরই একজন ভেবে নিয়েছে মনে হয়, নইলে টিকিট কাটল না তো ওর!
বাসে বসেও কি শান্তি আছে? কাজল মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে পিছনে দেখে। অনেকটা পিছনে পড়ে গেছে নতুন প্রধানের দুমদুমি মোটর সাইকেল। তবে আসছে এখনও।
বাসেরও স্পিড অনেকটাই বেশি। ভোরবেলার ফাঁকা হাই-রোডে যেমন হয় আর কী! চলতে চলতে অনেকগুলো জনপদ, ক্ষেত-খলিয়ান পার হয়ে গেল। ঘড়ি তো দেখা হয়নি, তবে তা প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট তো পেরোলই।
বাস থামল কাশের জঙ্গলে ঘেরা এক পেট্রোল পাম্পে। সবাই নামল। কাজলও নামল। বার বার রাস্তার ধারে গিয়ে তাকাচ্ছিল কাজল। নাহ্! আর তাঁদের দেখা নেই।
হাঁপ ছেড়ে এসে বসল পেট্রল পাম্প লাগোয়া খাবারের দোকানে পাতা বাঁশের বেঞ্চিতে। ভাগ্যিস ভোরবেলা, না বাসে, না রাস্তায়—কোথাওই তেমন লোকজন নেই। না-হলে কাজলের চালচলন দেখে যে-কারোরই মনে প্রশ্ন জাগার কথা। কোথা থেকে কার সঙ্গে এল এই ছেলে—যে-কারও মনে হতে পারে। লোকজন কম থাকায়, আর যে ক’জন আছে তাদের মধ্যে সন্দেহবাতিক, কৌতূহলী বড়োরা মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকায় কাজল পার পেয়ে গেল।
পুরোপুরি পার পেল কী?
কেন এমন বলছি?
বলি শোনো। ওখানে খানিকক্ষণ বসে সবে কাজল একবার বাথরুমে গেছে। বাথরুম থেকে বেরোতে গিয়েই দেখল বাসটার পাশেই জানালায় জানালায় উঁকি দিয়ে দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন নতুন প্রধান। আর রামদীন মিশির এগিয়ে যাচ্ছে খাবারের দোকানটার দিকে।
আচ্ছা, দোকানিটা যদি বলে দেয়? কাজল তো তাহলে ধরা পড়ে যাবে!
না, একবার বেরিয়েছে যখন, কিছুতেই ধরা পড়বে না কাজল। কোনোভাবেই না।
বাথরুমের পাশের দেয়াল টপকে কাজল এসে পড়ল একটা কাঁটাঝোপে। একে ডান পা জখম, এবার পায়ের নানান জায়গা ছিঁড়ে-ছড়ে গেল কাঁটায়। ভাগ্যিস ফুল প্যান্ট পরা ছিল। না-হলে এতক্ষণে কী যে হত!
কাঁটাঝোপ থেকে বেরিয়ে কাজল ঢুকে পড়ল সংলগ্ন শালের জঙ্গলে।
৯
‘রাস্তায় নেমে পড়লে পথই পথ চেনাবে। সবই আসলে অচেনা, বুঝলি? চেনা তো কেবল মুখগুলো হয়। মানুষ অচেনাই থাকে।’ রাধুবাবু বলতেন।
আচ্ছা, রাধুবাবু কি আঁচ করেছিলেন যে উনি না থাকলে কাজল একদিন ‘নিজের বাড়ি’ ছেড়ে বেরোবেই? নইলে কেনই-বা ওকে ওর পরিচয়ের নথিপত্রের ফাইল দেবেন, কেনই-বা টাকা দেবেন, কেনই-বা এরকম কথা বলবেন?
জানা নেই। জানা নেই যখন তখন আর সেদিকে হাঁটছি না, বরং হাঁটি এবার কাজলের সঙ্গে। সে তো আবার ভয় পেয়ে ঢুকে পড়েছে অচেনা সেই জঙ্গলে। অচেনা ঠিকই, তবে জঙ্গল বলতে যেমন ছবি মনে ফুটে ওঠে, এ-জঙ্গল তেমন ভয়ংকর কিছু নয়। শালগাছ সারি সারি। মাথাগুলো এখনও অনেক উঁচু হয়নি। গোড়ায় ঝরা শালপাতা স্তূপ হয়ে আছে। মরা শালপাতা ঠেলে পিঁপড়ের সারি উঠছে। কাঠবেড়ালিরা গাছের গোড়া থেকে, লম্বা গাছের গা থেকে ঘাড় নেড়ে নেড়ে নতুন এই ছেলেটাকে মাঝে মাঝে দেখছিল।
ঝোপঝাড়ও আছে বটে, তবে তার সঙ্গে চলার মতো একটা শুঁড়িপথও আছে। সেই পথে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা দূরে দূরে জমিতে বাঁধা আলপথ দেখতে পাচ্ছিল কাজল। ও বোঝেনি, কিন্তু মনে হয় এ হল শালবাগান। গাঁ-ঘরে এমন বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে শালবাগান খুব বেশি না থাকলেও, আছে। শালবাগান আছে যখন তখন কাছাকাছি সম্পন্ন গাঁও নিশ্চয়ই আছে।
কাজল কি আর অতশত বোঝে? সে হেঁটে চলেছে হারা উদ্দেশ্যে। হাঁটছে আর মাঝে মাঝে পিছনে দেখছে। নাহ্, এখনও কেউ নেই। খানিকটা যেন নিশ্চিন্তেই সে হাঁটতে শুরু করল।
অনেক লম্বা শালবন। লম্বা শালবনের আল পার হয়ে এসে পড়ল আর এক জঙ্গলে। এটিকেও নির্দ্বিধায় জঙ্গল বলাই যায়। আগাছায়, কাঁটাঝোপে একেবারে ভরতি। হাঁটতে গেলে পায়ে আটকে যায়। সেখান থেকে পিছিয়ে এসে ফের শালবনে ঢুকে পড়ল কাজল। যেদিক দিয়ে এসেছিল, তার এক্কেবারে সমকোণে হাঁটতে থাকল।
জঙ্গলই হোক, আর বাগানই হোক, এই সকালবেলায় তা এক্কেবারে ফাঁকা। নরম রোদ্দুর ইতিউতি চুঁইয়ে নামছে। কাজলের পক্ষে অবশ্য সেটা শাপে বর হয়েছে। মানুষের চোখ এড়িয়ে, কৌতূহল এড়িয়ে যতদূর চলে যাওয়া যায় ততই তার মঙ্গল।
চলতে চলতে কি খানিকটা আনমনা হয়ে পড়েছে কাজল?
পড়েছে বোধ হয়। না-হলে এই যে শুকনো পাতায় খচমচ খচমচ আওয়াজ তুলে হাত কয়েক দূরে গাছটার আড়াল থেকে উঁকি দিল একটা পাঁশুটে শেয়াল, কই কাজল তো দেখলও না। ওর পায়ে ধাক্কা খেয়ে একটা গিরগিটি যে ছিটকে নাকি লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল তিন হাত দূরে, সেও তো মালুম হল বলে মনে হল না।
সে অবশ্য একদিক থেকে ভালোই। আনমনে হাঁটলে হাঁটার কষ্ট থাকে না। ভবিষ্যতের ভাবনায় হাঁটা থেমেও যায় না। কাজেই শুকনো শালপাতায় মচমচ আওয়াজ তুলে ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে চলল কাজল।
তা প্রায় মিনিট কুড়ি বা আধঘণ্টা হাঁটার পর জঙ্গল পাতলা হয়ে এল। জঙ্গলের শেষ প্রান্তে ধু ধু মাঠের পারে লি-লি করছে রেলপথ। মাঠের বাঁদিক ঘেঁষে আড়াআড়ি এক সরলরেখায় ছাড়া ছাড়া অনেকগুলো গাছ। সেইদিকে যেতে শুরু করল যখন, তখন রোদের যা তেজ, সেই হিসাবে সকাল তা প্রায় সাড়ে ন’টা-দশটা হবে।
খুব খিদে পেয়েছে কাজলের। তেষ্টায় অস্থির লাগছে। সে-সব ভুলে এবড়ো-খেবড়ো ঢেলাভরা মাঠ ধরে সেই রেলপথের দিকেই এগিয়ে চলল কাজল।
মাঠের প্রায় মাঝখানে ওই যে বিন্দুবৎ বাচ্চা ছেলেটা, মানে আমাদের কাহিনির কাজল সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যেতে যেতে লাফিয়ে উঠে বাঁদিকে হঠাৎ সরে গেল, কেন বলো তো?
চলো দেখে আসা যাক।
কাজলের পায়ের ঠেলায় একটা ঢেলা কাত হতেই সেখান থেকে দু-দুটো কালো কুচকুচে সাপ ফণা তুলে দুলতে শুরু করায় এক লাফে ও সরে গেছে বামদিকে। সরে গেছে বলেই না এ-যাত্রায় বেঁচে গেছে! সরে গিয়েই বেজায় ভয় পেয়ে দৌড়োতে শুরু করেছে। সাপ দুটোও ফণা নামিয়ে যেদিকে কাজল গেল তার উলটোদিকে প্রায় এঁকে-বেঁকে চলতে শুরু করেছে।
কাজল ছুটছে ওই গাছগুলোর দিকে। আসলে ওই গাছগুলোর মাঝে ছোট্ট একটা পাতাঘেরা কুঁড়ে দেখতে পেয়েছে। অমন কুঁড়েঘর তো ওর চেনা। অমন কুঁড়েঘরেই যে থাকত ওর মা! অমন কুঁড়েঘরের মানুষজনও তো তাই ওর চেনা।
কুঁড়েঘরটার সামনে এসে একটা লম্বুগাছের তলায় ধপ করে বসে পড়ল কাজল। আর পারছে না। সেই কোন ভোর থেকে চলছে এই ছোটা। রাতে ঘুমোয়নি ভালো করে। রাতে খেতে পারেনি। সকাল থেকেও খাওয়া হয়নি কিছু। জলটুকুও না। কত পারে ওইটুকু ছেলে?
ব্যাগটা নামিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। শুয়ে-শুয়েই দেখতে লাগল কুঁড়েঘরটার দিকে। কুঁড়েঘরের দরজাটা বন্ধ। উঠোন ফাঁকা। উঠোনে দুটো ছাগল ঘাস খাচ্ছে। কাজলদের ছাগল ছিল। ছাগলের বাচ্চাগুলো তিড়িং বিড়িং করে লাফায়। কাজলও লাফিয়ে লাফিয়ে খেলত ওদের সঙ্গে। কী রঙ ছিল ওদের? সাদা? নাকি কালো? নাকি খয়েরি রঙের? খয়েরিই ছিল বোধ হয়।
ঘরটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখনও ছাগলের বাচ্চার কথা, কখনও মাটির উনুনের কথা, কখনও মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের পাতা নেমে এল, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত ছেলেটা বুঝতেও পারল না।
১০
সেই যে মাঠের মধ্যে ছোট্ট কুঁড়েঘর, সেই যে কুঁড়েঘরের সামনের লম্বুগাছের নীচে শুয়ে ছিল আমাদের কাহিনির সেই ছেলেটি, সেখানে থাকতেন এক থুত্থুড়ে বুড়ো। তিনকুলে তাঁর আর কেউ বেঁচে ছিল না। তিনি নিজেও অকৃতদার। পিতৃ-মাতৃবিয়োগের পর একত্রিশ বছর বয়স থেকে জীবনের ছেষট্টি বছর পর্যন্ত ছিলেন কাশিতে গুরুর আশ্রমে। বেদ-বেদান্ত পাঠ, শাস্ত্রাৎ আর গুরুসেবা ছাড়া জীবসেবাই ছিল তাঁর কাজ। তাই বলে কিন্তু ইয়া লম্বা দাড়ি আর তিলকে সিঁদুরে গম্ভীর গেরুয়াধারী কোনও সন্ন্যাসী ছিলেন না তিনি। সন্ন্যাসী তো ছিলেনই। তবে সাদা ধুতি আর ফতুয়া পরা হাসিমুখের সদানন্দ এক সন্ন্যাসী। নিয়মিত গোঁফ-দাড়ি কামাতেন। হোমিওপ্যাথির চর্চা করতেন। জ্যোতিষচর্চাও করতেন। অনেক মানুষ আসত তাঁর কাছে। একটি টাকা দক্ষিণাও তিনি নিতেন না এজন্য। নেবেনই-বা কেন? থাকা, খাওয়া দুই-ই তো গুরুকৃপায় গুরুর আশ্রয়েই তাঁর সম্পন্ন হচ্ছিল। গুরু যখন দেহ রাখলেন, তাঁর সেখানকার কাজও ফুরোল। গুরুভাইয়ের কথায় এসে উঠলেন এই নির্জন আস্তানায়। এই জমিটি তাঁর গুরুভাইয়ের। এখানেই থাকেন। একাহারী মানুষ। দুপুরে চারটি ফুটিয়ে খান। সন্ধে হলে আহ্নিক সেরে হ্যারিকেন জ্বেলে পড়াশুনো করেন।
আজ যখন শ্রান্ত কাজল এসে ঘুমিয়ে পড়ল তাঁর কুঁড়েঘরটির সামনে তখন তিনি গিয়েছিলেন গ্রামের বাজারে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে। ফিরে এসে দেখলেন ধুলোয় জর্জর একটি ছেলে একটা ব্যাগ জড়িয়ে কুঁকড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে গাছের নীচে শুকনো ঘাসের উপর। ছেলেটির পায়ের বুড়ো আঙুলে ক্ষত। পরনের প্যান্টটাও নীচের দিকে ছিঁড়ে গেছে এলোমেলোভাবে। অভিজ্ঞ মানুষ, স্পষ্ট বুঝলেন কোনও কারণে ছেলেটি পালাচ্ছিল কোথাও থেকে। শুয়ে থাকার ধরনে স্পষ্ট, ছেলেটি আতঙ্কে আছে।
ওকে না ডেকে আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকলেন। ঘর থেকে এক ঘটি জল এনে ওর পাশে দাঁড়ালেন। বয়স হয়েছে তো, চাইলেও ওর পাশে মাটিতে বসতে পারলেন না। মাথার কাছে একটু ঝুঁকে ভর দিয়ে চলার লাঠিটি দিয়ে আলতো করে কাজলের ডানহাতে নাড়া দিলেন। ডাকতে ডাকতে বলতে লাগলেন, “ওঠো। এসো, ভিতরে গিয়ে বিশ্রাম করবে চলো। এই ছেলে, ওঠো!”
দু-চারবার এরকম ডাকতেই হুড়মুড় করে উঠে বসল কাজল।
“উঁহু-হু, কোনও ভয় নেই, কোনও ভয় নেই ভাই। আমি একাই থাকি এখানে। বুড়ো মানুষ, ভয় নেই কোনও।”
হুড়মুড় করে ওঠাতেই বোধ হয় কাজল খানিক হতভম্ব হয়ে থাকবে। একটু পরে তাকিয়ে দেখল একজন বৃদ্ধ মানুষ নরম করে তাকে ডাকছেন, ওই কুটিরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বলছেন।
“একটু জল খাও ভাই।” কাঁপা কাঁপা হাতে ঘটিটা এগিয়ে দিলেন তিনি।
কাজল আর কথা না বাড়িয়ে ওঁর হাত থেকে ঘটিটা নিয়ে ঢকঢক করে সবটা জল খেয়ে নিল।
“এবার এসো আমার সঙ্গে। ভয় পেও না। এখানে আমি একাই থাকি। কেউ আসে না। তুমি নিশ্চিন্তে এখানে থাকবে চলো।”
বৃদ্ধের কথায় এতটাই শান্তি আর এতটাই আশ্বাস ছিল যে কাজল একটাও কথা না বলে তাঁকে অনুসরণ করল।
দাওয়ার কাছে গিয়ে বৃদ্ধ বললেন, “ওইখানে দেখো পাতকোর পাড়ে জল রাখা আছে। ভালো করে হাত-পা ধুয়ে এসো।”
কাজল যখন হাত-পা ধুচ্ছে, বৃদ্ধ তখন কুটিরের একপাশে উঠে যাওয়া লতাগাছ থেকে কিছু পাতানাতা ছিঁড়ে নিলেন।
হাত-পা ধুয়ে কাজল বৃদ্ধের সঙ্গে কুটিরের ভিতরে ঢুকল। বাইরে থেকে বোঝা যায়নি। ঘরটা বেশ বড়ো। ভিতরে একটা নীচু চৌকিতে শীতল পাটি পাতা। তার পাশে একজোড়া টেবিল-চেয়ার। টেবিলে কাঠের একটা ছোটো বাক্স, একটা কলমদান আর বেশ কিছু বই। বই রয়েছে মাটির মেঝেতে ইটের বেদির উপরে রাখা একটা ট্রাংকের উপরেও। আর একটা টেবিল আছে, সেখানে একটা স্টোভ। হ্যারিকেন, দেশলাই আর কয়েকটা স্টিলের ক্যান। ঘরের এককোণে আর একটা মাদুর।
বৃদ্ধ চেয়ারটা দেখিয়ে কাজলকে সেখানে বসতে বললেন। হাতের লাঠিটা কুটিরের দেয়ালের একটা খাঁজে দিলেন ঝুলিয়ে। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন টেবিলের দিকে।
বৃদ্ধের কোমর বেঁকে গেছে খানিকটা, একটু ঝুঁকে হাঁটেন। ঘাড়টাও ঈষৎ কাঁপে। বৃদ্ধ ফের একবার বেরোলেন। ফিরে ঢুকলেন যখন, হাতে তাঁর খানিক লতাপাতা। লতাপাতা থেকে বৃদ্ধের লম্বা আঙুল চুঁইয়ে টপটপ করে জল ঝরছে মাটির মেঝেয়। টেবিলের আর একপাশে আর একটি জলচৌকি। সেখান থেকে ছোটো একটা খল-নুড়ি নিয়ে টেবিলে এলেন বৃদ্ধ। নিপুণ হাতে পিষতে থাকলেন লতাপাতা। একসময় কাজলের দিকে ফিরে বললেন, “সঙ্গে আর কোনও জামাকাপড় আছে তোমার?”
কাজলকে চুপ করে থাকতে দেখে ট্রাংকটা দেখিয়ে বললেন, “ওটা খোলো। ওখান থেকে একটা কাপড় আর একটা ফতুয়া পরে নাও। তোমার একটু বড়ো হবে হয়তো, তবু পরে নাও।”
কাজল উঠছে না দেখে একটু হেসে বললেন, “লজ্জা কীসের? আমি তো তোমার দাদু গো বাছা! নিয়ে নাও।”
ধমাস করে উঠে ট্রাংকের উপর থেকে বইগুলো মাটিতে নামিয়ে ট্রাংক খুলে একটা ধুতি আর ফতুয়া বের করল কাজল। বৃদ্ধ ভদ্রলোক খল-নুড়িতে লতা পিষতে পিষতে ওর কাজের ধরন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর করছিলেন।
ধুতিটা নিয়ে খুলে ফেলল কাজল। কীভাবে পরতে হয় সে কি আর ও জানে? কিন্তু বলছেও না কিছু। বৃদ্ধ ভদ্রলোকও কিছু বলছেন না। কেবল নজর করছেন গতিবিধি। অনেকক্ষণ এদিক ওদিক করে চেষ্টা করার পরও যখন পারছে না, তখন জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে নিয়ে কাজল একবার আড়চোখে বৃদ্ধের দিকে তাকাল, কিছু বলল না। উনিও দেখলেন, কিছু বললেন না। ধুতিটা মাটিতে ফেলে দিল কাজল। গায়ের জামাটা খুলে ফতুয়াটা পরে নিল। ফতুয়াটা ঢলঢল করছে ওর গায়ে। তবে সে-সবে ওর কিছু যায় আসে না।
হাতের কাজ শেষ করে বৃদ্ধ ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। কাজলকে বললেন, “ভাই, ধুতিটা একটু আমার হাতে দেবে, আমি তো নীচু হতে পারি না।”
কাজল মেঝে থেকে ধুতিটা তার হাতে দিলে উনি কাজলকে দেখিয়ে দিলেন কেমন করে পরতে হয়। কাজল চেষ্টা করে পরল। উনিও যত্ন করে ওকে সাহায্য করলেন। তারপর হাত ধরে এনে চেয়ারে বসালেন। খল-নুড়ি থেকে থেঁতো করা খানিকটা লতাপাতা হাতে করে এনে ওর পায়ে চেপে ধরলেন। উহ্ করে উঠল কাজল। টেবিলের কাঠের বাক্স থেকে একটা সরু কাপড়ের টুকরো বার করে এনে বেঁধে দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বললেন, “সেরে যাবে।”
হাতেও নানা জায়গায় ছড়ে গেছে। খলটা ওর কাছে এগিয়ে দিয়েছিলেন বৃদ্ধ, বলেছিলেন যেখানে যেখানে কেটে গেছে লাগিয়ে নিতে। কাজল হাতে করে করে সেগুলো লাগাচ্ছিল।
বৃদ্ধ বললেন, “এবার তুমি একটু বিশ্রাম করো। আমি দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত করি।”
কুটিরের দাওয়ায় স্টোভে ভাত চাপিয়ে দিলেন। মুগডাল, কাঁচকলা, পটল, মিষ্টি কুমড়ো, রাঙা আলু—সব সিদ্ধ দিয়ে দিলেন ভাতে। চাটাইয়ে বসে ভাত রাঁধতে রাঁধতে ভাবতে থাকলেন, ছেলেটির আচরণ খুব স্বাভাবিক নয়, কিছু অসুবিধা আছে তো বটেই। এমন ছেলেদের কাশিতে থাকতে অনেক দেখেছেন। আশ্রমের একটা অংশে তারা থাকত। উনিই তাদের সব শেখাতেন। খাওয়া-পরা, কথা বলা সব শেখাতেন। আপাতদৃষ্টিতে এই ছেলেটির অবস্থা অবশ্য তাদের অনেকের থেকেই ভালো। তবে ওর যা মনের অবস্থা, তাতে এক্ষুনি কিছু জানতে চাওয়া ঠিক হবে না। কয়েকটা দিন আগে থাকুক এখানে, তারপর না-হয় জানতে চাওয়া যাবে।
দাওয়াতেই চাটাই পেতে দুজনে খেতে বসলেন দুপুরবেলা। দুজনের থালায় সেই সিদ্ধ ভাত, সঙ্গে খাঁটি গাওয়া ঘি। খাওয়ার আগে কাজলকে বলে দুজনে প্রার্থনা সারলেন। প্রার্থনা মানে যাঁদের জন্য এই আহার জুটছে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো, প্রার্থনা করা জগতের সবার যাতে আহার জোটে। যা বলতে বললেন, দেখলেন হাতজোড় করে দুলে দুলে জোরে জোরে কাজলও তাই বলল। তারপর দুজনে পাশাপাশি বসে খেয়ে নিলেন।
দুপুর গড়িয়ে রাত নেমে এল। কাজল এখনও ঘুমোচ্ছে। মাথার কাছে হ্যারিকেন জ্বেলে টেবিলে বই রেখে পড়ছেন বৃদ্ধ।
নির্জন প্রান্তরে তখন রাত্রি নিবিড়। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। শেয়াল ডাকছে। পেঁচার ডাক উঠছে থেকে থেকে। এমন নির্জন রাত্তিরে অজানা অচেনা এক পর্ণকুটিরে ঘুমের মধ্যেই মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে কাজল। অমনি একটা স্নেহের শীতল হাত তার বুক পিঠ সাপটে দিচ্ছে। ফের নিশ্চিন্ত ঘুমের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে কাজলের চেতনা।
আসুক, এমন নিদ্রাই তো পারে মন থেকে সবটুকু ভয়, সবটুকু সংশয় মুছে দিতে। বাটাভরা পান ওরা দিতে না পারুক, ঘুমপাড়ানি মাসিপিসিরা ঘন রাত্তিরের নৈঃশব্দ্যের মতো গাঢ় ঘুম আজ নিয়ে আসুক হতভাগ্য ছেলেটির চোখে।
১১
রাত গড়িয়ে দিন, দিন পেরিয়ে রাত। ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিন, আশ্বিন পেরিয়ে কার্তিক-পৌষ হয়ে মাঘ মাস। মাঘের শীতে বাঘ পালায়। কাজল কিন্তু পালায় না। সাদা ফতুয়ার উপরে দুটো সাদা ধুতি গায়ে জড়িয়ে থাকে। শীতের হাওয়া হু হু করে বয়ে যায় ফাঁকা মাঠে। গোরু চরে, ছাগল চরে, চেনা-অচেনা সব পাখির দল মাঠ থেকে দানা-কণা পোকামাকড় খুঁটে খায়। মাঠের বুকচেরা রেলপথ দিয়ে ধমধম ঝমঝম করে ট্রেন চলে যায়। খোলা প্রকৃতির কোলে পাখপাখালির মতোই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে বড়ো হয় কাজল। কখনও হারিয়ে যায় শালবনে, কখনও ছুট লাগায় চঞ্চল ছাগশাবকের পিছনে পিছনে। এই মাঠের সবকিছু এখন কাজলের চেনা। এ যেন এক রাজ্য। যে-রাজ্যে দুটো মাত্র মানুষ। একজন কাজল, আর একজন তার দাদু।
শুভ্র জ্যোৎস্নায় যখন মাঠ ভেসে যায়, দাদু আর কাজল এসে বসে কুটিরের সামনে বাঁশ আর কাঠের তক্তা দিয়ে নিজেদের হাতে বানানো বেঞ্চে। আকাশে পূর্ণ চাঁদ, ধপধপে। খোলা আকাশের নীচে অসম বয়সের দুটি মানুষ, ধপধপে। দাদু কাঁপা কাঁপা গলায় গান ধরেন—‘শুভ্র জ্যোৎস্না পুলকিত যামিনীম’। সুরে সুর মেলায় কাজল। উচ্চারণে এক ফোঁটা ত্রুটি হয় না, সুর এক পরত অন্য পথে হাঁটে না। দাদু-নাতির সম্মিলিত সুর সিক্ত করে বয়ে যায় শুকনো বাতাসে।
দাদু বলেন, “জীবনে একটাই অসত্য কথা বলতে হল রে ভাই।”
নাতি বলে, “অসত্য কেন? আমি তো তোমার নাতিই।”
এখান থেকে প্রায় মাইল দু-এক দূরের গ্রামের সবাই এতদিনে জানে মাঠে বাস করেন যে সাধু, তাঁর এক দূরসম্পর্কের নাতি হল কাজল। দাদুই বলেছেন। না-হলে কীই-বা বলতেন? সত্যি কথা তো কাজল তাঁকে বলেছে, তিনিও কাজলের ব্যাগ থেকে তার পরিচয় দেখেছেন। সেই যে অসুস্থ ছেলেটা এসে হাজির হল, সেই যে ধুম জ্বরে প্রায় বেহঁশ হয়ে থাকল দুটো দিন, নিজের হাতে তাকে ওষুধ দিতে দিতে, শুশ্রূষা করতে করতে কখন যে ফের মায়ার বাঁধনে বাঁধা পড়েছিলেন বৃদ্ধ নয়নজ্যোতি মিশ্র, তা নিজেই বুঝে উঠতে পারেননি। ভাবগতিক এমন হয়েছিল যে, গ্রামে জিনিসপত্র কিনতে গেলেও মন উচাটন হয়ে থাকত কাজলের জন্যে। ছেলেটা ফের পালাল না তো? খুঁজতে খুঁজতে কেউ এসে ওকে দেখে ফেলল না তো? উৎকণ্ঠা না সামলাতে পেরে শেষমেশ ওকে সঙ্গে নিয়েই গ্রামে যেতেন।
গ্রামে তাঁর ভক্ত তো নেহাত কম নয়। ‘ঠাকুর, সঙ্গে কে গা?’—এমন প্রশ্ন তো উঠতই। কাজলের আদত পরিচয়টুকু গোপন করে ওই পরিচয় দিতে শুরু করেন বৃদ্ধ। একান্তে হাতজোড় করে ক্ষমা চান পরম প্রেমময় ঈশ্বরের কাছে এই অসত্য ভাষণের জন্যে। জীবনের আর কতটুকুই-বা অবশিষ্ট আছে! যতটুকু প্রাণ আর অবশিষ্ট আছে সেইটুকু দিয়েই তিনি শিখিয়ে পড়িয়ে আরও একটু বড়ো করে তুলতে চান কাজলকে।
সাদা মেঘের মতো তুলতুলে মন ছেলেটার। বড়ো ভালো আধার। সেই আধারে মনুষ্যত্বের বীজ পুঁতে গেছেন কাজলের রাধুবাবু। চারাগাছটাকে যত্ন করতে চান বৃদ্ধ সর্বত্যাগী নয়নজ্যোতি মিশ্র। এজন্যই কাজলকে ব্রহ্মচর্যে অভ্যস্থ করছেন তিনি। এই নির্জন প্রান্তর সর্বতোভাবে তার সহায়তা করে চলেছে। চলমান দৌড়ঝাঁপের পৃথিবীর মাঝখানে এইটুকু যেন এক ব্যতিক্রমী আশ্রয়। সময় এখানে যেন এখনও থমকে আছে গুরু-শিষ্যের আশ্রমিক শিক্ষায়।
সারাদিন সারা রাত প্রকৃতির মাঝে শিক্ষা চলে কাজলের। কাজল নিজেও বোঝে না দাদুর সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করতে করতে কখন সে শিখে নিচ্ছে মাটির উপাদান, বীজের ঘুম ভাঙা, চারাগাছের বাড়বৃদ্ধি; পাতা দেখে চিনে নিচ্ছে গাছ-আগাছা। জেনে নিচ্ছে তাদের উপকার, অপকার। পাখি চিনছে। পাখির বাসা চিনছে। দিনমানে লাঠির ছায়া দেখে সময় বুঝতে শিখছে। অন্ধকার রাতে চিনে নিচ্ছে ধ্রুবতারা, লুব্ধক, কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল। গল্প শুনতে শুনতে জেনে যাচ্ছে ম্যাগেলানের কথা, আরিস্টটল গ্যালিলিও প্লেটোর কথা। কণাদের কথা শুনছে, আরুনির কথা জানছে। একলব্যের গল্প জানছে। রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাচ্ছে অঘোরে দাদুর পাশে। সন্ধেবেলা যত্ন করে দাদু তাকে লেখাচ্ছেন। বাংলার সঙ্গে-সঙ্গেই সংস্কৃত লেখাচ্ছেন, ইংরিজি লেখাচ্ছেন।
কাজল এখন নিজে নিজে বিষ্ণুশর্মার পঞ্চতন্ত্র পড়তে পারে। গল্পগুলো পড়তে পড়তে রাধুবাবুর কথা মনে পড়ে ওর। মনে পড়ে বিলের জলে সেই জলটুঙিটির কথা। বিলের জলে ভেসে যাওয়ার সেই ডোঙাটির কথা।
পড়তে পড়তে থামলে দাদু তাকে সেই প্রসঙ্গেই অন্য গল্প বলেন।
গল্প শুনতে কে না ভালোবাসে। গল্পের মধ্যেই যে লুকিয়ে থাকে শেখার উপাদান, সে-সব না জানলেও উপাদানটুকু ঠিক ছেনে নিতে পারে কাজলের মন। আচরণ বদলাতে থাকে কাজলের। তিনটে মাস মাত্র পেরিয়েছে। কিন্তু কতটা যে পরিণত হয়ে উঠেছে কাজল, না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না কেউ।
দাদু তাকে রান্না করতে শিখিয়েছেন। দিনে দাদু রান্না করেন, দুজনে খান। রাতে কাজল নিজের জন্যে রান্না করে স্টোভে। দাদু পাশে বসে দেখেন। কাজল খায়, খেতে খেতে গল্প শোনে। গল্প আর গল্প। গল্পের বাতাসে গাছের পাতা দোলে। বাগানের গাছ ফুলে ভরে ওঠে। মৌমাছি আসে, কালো ভোমরা ভনভনায়, রঙবেরঙের প্রজাপতি ওড়ে। দাদুর কাছে কাজল শোনে আর দেখে কেমন পায়ে ডানায় তাদের লেগে থাকে রেণু, কেমন করে রেণু এসে বসে যায় ফুলে, কেমন করে ফুল থেকে ফল আর ফল থেকে বীজ হয়, আর সেই বীজে ঘুমিয়ে থাকে শিশু গাছ। জল পেলে, আলো আর হাওয়া পেলে কেমন তার ঘুম ভেঙে বীজের বুক চিরে বেরিয়ে আসে নতুন গাছ।
রোদ্দুরের তাপ গায়ে নিতে বসেন দাদু আর নাতি। ফাঁকা মাঠের দিকে তাকিয়ে কত গল্প করেন। তাঁর ছোটোবেলার গল্প, মা-বাবার চলে যাওয়ার গল্প, ভারতবর্ষ দেখবেন বলে বের হয়ে যাওয়ার গল্প, কাশীতে গুরুদেবের জীবসেবা দেখে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর দেহত্যাগ পর্যন্ত সেখানে থাকার সময়ের কত গল্প। গল্প শেষই হতে চায় না।
গল্প করতে-করতেই জীবনের পাঠ দেন কাজলকে। এই পৃথিবীতে যে কেবল যাওয়া-আসার খেলা চলে। কুঁড়ি থেকে ফুল, তারপর সময় হলেই বকুলের মতো টুপটুপ ঝরে যাওয়া। মিলিয়ে যাওয়া হাওয়ায়, মিলিয়ে যাওয়া মাটিতে, রোদ্দুরে। তারপর আবার ফিরে আসা। অন্য কোনও রূপে। যেমন করে শক্তি ফিরে আসে রূপ বদলে।
শক্তিই তো, সবকিছু তো আদতে শক্তিই। আঙুল দিয়ে নিজের বুক, কাজলের বুক স্পর্শ করে বলেন, দাদু, “কাজল, গাছপালা, পাখপাখালি, আলো, হাওয়া, জোয়ারভাটা সব শক্তির খেলা, শক্তির রূপ বদলানোর ভোজবাজি।”
কাজল তার মতো করে প্রশ্ন করে, “দাদু, তুমি ম্যাজিক জানো?”
মৃদু হেসে ভিতরে গিয়ে কৌটো থেকে তেঁতুলের বীজ নিয়ে আসেন দাদু। একটা থেকে দুটো, দুটো থেকে চারটে করে দেখান। হাওয়ায় ছুড়ে তেঁতুল বীজ অদৃশ্য করে ফেলেন, তারপর কাজলের নাক টিপে বার করে আনেন।
হাততালি দিয়ে ওঠে কাজল। ‘নিজের বাড়ি’-তে একবার জাদু দেখিয়েছিল এক জাদুকর। তাসের জাদু।
“তুমি তাসের জাদু পারো দাদু?”
বৃদ্ধ নয়নজ্যোতি মিশ্রের বয়স আজ এই ছেলেটার সরল প্রশ্নে যেন অনেকটা কমে গেছে। সময়ের উলটো পথে হাঁটছে মন। সত্যি তো, কী ঝোঁকটাই না একসময় ছিল তাঁর! ধরে ধরে তাসের খেলা শিখেছিলেন।
ট্রাংক থেকে বহু পুরোনো এক প্যাকেট তাস বার করেন দাদু। কত যে খেলা দেখান তাস দিয়ে! কাজল আনন্দে হাতে হাতে তালি দেয়।
দাদু বলেন, “কী, ম্যাজিক শিখবে?”
নাছোড়বান্দার মতো কাজল বলতে থাকে, “শিখবে, শিখবে।”
দাদু হাসতে হাসতে বলেন, “ম্যাজিক শিখতে গেলে তো ভাই অনেক খাটতে হবে। আগে দৃষ্টি তৈরি করতে হবে, কান তৈরি করতে হবে, শরীরে মনে শক্তি বাড়াতে হবে, পড়তে হবে, জানতে হবে; তারপর অনুশীলন আর অনুশীলন—পারবে তো ধৈর্য রাখতে?”
মনের জিনিস শেখার উত্তেজনায় কাজল বলে চলে, “পারবে, পারবে।”
দাদু হাসেন। দাদু জানেন ছোটোদের মন। রাতে ঘুমোলেই সব হয়তো ভুলে যাবে। কিন্তু বৃদ্ধ নয়নজ্যোতি মিশ্রও হাসির মধ্যেই যেন আনমনা হয়ে যান। কোথাও কি তাঁর মনেও নিজের অধীত বিদ্যা কারও হাতে তুলে দেওয়ার ইচ্ছে জেগে ওঠে? কে বলতে পারে? মনের কথা কেই-বা জানে!
অবশ্য পরদিন থেকেই আরও নানান অনুশীলনের মধ্যে পালা করে চলে কাজলের দৃষ্টি আর শ্রবণশক্তি বাড়ানোর অনুশীলন। কতরকম টেকনিক সেই শিক্ষার। শিখতে কাজলের ভারি মজা লাগে। মাঝে-মাঝেই যখন একা খেলাধুলো করে, চোখ বন্ধ করে শুনতে চেষ্টা করে, অনুভব করতে চেষ্টা করে আশেপাশে কী আছে, কী ঘটছে সেইসব বোঝার। সত্যি বলতে কী, এখন চোখ বন্ধ করে অনেক কিছু বুঝতে পারে কাজল। চোখের পলক না ফেলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে।
দাদু এখন তাকে স্পর্শ শেখাচ্ছেন। দাদুর এক-একটা স্পর্শে মাঝে মাঝে কারেন্ট খাওয়ার মতো ঝিমঝিম করে উঠছে শরীর। দাদু যখন আঙুল নেড়ে ঘুমোতে বলে পিঠটা নীচ থেকে উপরের দিক সাপটে দিচ্ছেন, যেন রাজ্যের ঘুম নেমে আসছে চোখে, আবার এক তুড়িতেই যেন ঘুম উড়ে যাচ্ছে। দাদু বলেছেন একে একে তাকে সবরকম ‘পাস’ শিখিয়ে দেবেন। মানুষের উপকারে ইচ্ছে হলেই সেইসব শেখা কাজে লাগাতে পারবে কাজল। বলেছেন, শেখা হয়ে গেলে নিজের মধ্যেই এক অদ্ভুত শক্তির অনুভব হবে কাজলের। এমনিতেই ধ্যান করে মনঃসংযোগ বেড়ে গেছে কাজলের। স্মৃতিশক্তি বেড়েছে। দাদুর সঙ্গে কয়েকবার আবৃত্তি করলেই মনে থেকে যাচ্ছে কত মন্ত্র, কত স্তোত্র।
তবে একটা নিষেধ করে দিয়েছেন, অকারণে বাহবা পাওয়ার জন্য এই শেখাগুলো যেন কোনোদিন ব্যবহার না করে কাজল। খারাপ কাজে যে কাজল সেই বিদ্যা ব্যবহার করবে না, সে নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন বৃদ্ধ নয়নজ্যোতি মিশ্র।
১২
এমনি করেই দুজনের মনে জ্যোৎস্না ঢেলে গেল আরও আট-আটটা পূর্ণিমার চাঁদ।
এক বোশেখের তাতাপোড়া বিকেলে কালবোশেখি এল। আকাশের ঈশান কোণে মেঘ জমতে দেখেই বৃদ্ধ সতর্ক করলেন কাজলকে। দুজনে মিলে বইপত্র, ট্রাংক সবকিছু বেঁধে ফেলেছিলেন প্লাস্টিকের মোড়কে। তারপর এল ঝড়।
খোলা মাঠের ঝড় যে কতটা মারাত্মক তা যারা জানেন, তারা জানেন। রোদে পোড়া শুকনো মাটি থেকে ধুলো পাকিয়ে পাকিয়ে আকাশে উড়ল, তারপর এলোমেলো হাওয়ায় চোখে নাকে এসে বিঁধতে শুরু করল, পাখির দল একদিকে যেতে গিয়ে হাওয়ার ধাক্কায় অন্যদিকে গিয়ে পড়ল। শুকনো ডাল মটামট ভেঙে উড়ে গেল বাতাসে। খোলা মাঠে সে কী ভীষণ রূপ কালবোশেখির!
হাওয়ার বেগ যখন এমন বাড়ল যে বাইরে দাঁড়ানোই দায়। কাজলকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন বৃদ্ধ। আশ্বাস দিলেন—“ঝড়ে ভয় পেতে নেই দাদু, ঝড় উঠলে শান্ত থাকতে হয়।” বলতে বলতে চৌকির নীচে ঢুকিয়ে দিলেন কাজলকে, আর জলচৌকিটা টেনে এনে চৌকির কাছে ওর পাশে বসে আবৃত্তি করতে লাগলেন মিত্র-বরুণ স্তোত্র।
দাদুর আবৃত্তি শুনতে শুনতে কাজল ভুলে যাচ্ছিল ঝড়ের তাণ্ডব, দরজায় ক্রমাগত ঝড়ের আঘাত। ঝড়ের শেষ দিকে বিকট শব্দ করে কুটিরের চাল উড়ে গেল ঝড়ে। ঠকাঠক শব্দে ঘরে এসে পড়ছে শিল! টুকরো শিল ছিটকে আসছে কাজলের হাতের কাছে। কী ঠান্ডা! মুক্তোর মতো শিল পড়ছে অঝোরে। অথচ নির্বিকার বৃদ্ধ। শিলাবৃষ্টির শেষে মুষলধারা নামল চরাচর জুড়ে। হাওয়ার ঝাপটে সেই ধারা পথভ্রষ্ট পাখির মতোই উড়তে লাগল বাতাসে। এক হাতে চৌকির পায়া আর এক হাতে কাজলের হাত ধরে জলচৌকিতে বসে ভিজলেন বৃদ্ধ।
সব ঝড়ই তো থেমে যায় একসময়। ঝড় থামলেও সেদিন বৃষ্টি থামল না। টানা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দাদু আর নাতিতে মিলে কোনোরকমে মাথা গোঁজার মতো করে ফের চাল ছাইলেন।
জ্বরে পড়লেন বৃদ্ধ। নাতি কাজলকে ডেকে কাঠের বাক্সটি থেকে হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেলেন। জ্বর গায়েই স্টোভে দুজনের রান্না করলেন। রান্না সেরে বিছানায় শুয়ে-শুয়েই নিজে হাতে কাজলকে শিখিয়ে দিলেন কেমন করে জলপটি দিতে হয়। বাক্স থেকে গোটা তিনেক ওষুধের শিশি দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলেন কখন কোন ওষুধটা দিতে হবে।
সেবাও করল বটে ছেলেটা। দাদুকে খাইয়ে দেওয়া, জলপটি দেওয়া, ওষুধ দেওয়া সব করল। আচ্ছন্নের মতো জ্বরে কাতর ছিলেন বৃদ্ধ। জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে প্রলাপ বকেছেন। এই ছেলেটি কেবল জলপটি দিয়েছে আর দাদু দাদু করে কাতর স্বরে ডেকেছে। টানা দু-দিন পর তৃতীয় দিন ভোরের দিকে শেষ অবধি জ্বরটা নেমেওছে। বৃদ্ধ চোখ খুলে দেখেছেন কাজলের উৎকণ্ঠার চোখ তাকিয়ে রয়েছে তাঁর দিকে।
তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। এমনিতেই বৃদ্ধ হলে আর সমাজে দেওয়ার থাকলেও নেওয়ার কেউ থাকে না। তবু বৃদ্ধ নয়নজ্যোতির একটু মৃদু হাসি আর ক্ষীণ একটা ডাক যে কারও মুখে এত অনাবিল সরল শান্তি এনে দিতে পারে সে-কথা বৃদ্ধ না ভাবতে পেরেছেন না এত বয়সেও তা কখনও দেখেছেন। কাজলের সেই শান্তির হাসিটুকু মনের ভিতরে যে তৃপ্তি এনে দিল, সেই তৃপ্তির অনুভবও এত বছরের দীর্ঘ জীবনে আগে কখনও তিনি পাননি।
জ্বর থেকে সেরে উঠলেন বটে, কিন্তু দুর্বল হয়ে পড়লেন আগের থেকে। একটু চলাফেরাতেই এখন হাঁপ ধরে আসে। চিকিৎসাবিদ্যা চর্চা করা অভিজ্ঞ মানুষ তিনি, নাড়ি ধরে বেশ বুঝতে পারছিলেন সময় কমে আসছে। অথচ ছেলেটাকে যে কত কী শেখানোর বাকি থেকে গেল।
বিপদে অধীর হওয়ার মানুষ নন বৃদ্ধ নয়নজ্যোতি। কর্তব্য স্থির করে ওই দুর্বল শরীরেই কাজলকে দু-বেলা শেখাতে শুরু করলেন সেইসব শিক্ষা, যা সহজে এখনকার স্কুলে মেলে না। তাঁর শিক্ষায় কাজল আরও ধৈর্যশীল, আরও মনঃসংযোগী হয়ে উঠল। সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, মহাকাশবিদ্যা, ভূবিদ্যা, ইতিহাস—যতটা তাঁর মনে হয়েছিল কাজলের পক্ষে নেওয়া সম্ভব তার সবটাই তিনি দিলেন। সঙ্গে চলল আরও কিছু অনুশীলন, যা কাজলের পক্ষে আর কোথাও থেকে জানার উপায় ছিল না।
অবশ্য সমস্যা একটা তিনি দেখলেন বটে। এই শেখানোর মাঝেই নিজের কিছু কথা জানিয়ে একদিন তিনি চিঠি লিখেছিলেন তাঁর আশ্রয়দাতা গুরুভাইকে। যেদিন এলেন ভদ্রলোক, সেদিনই তিনি সমস্যাটা বুঝলেন। অপরিচিত গুরুভাইয়ের সঙ্গে একটাও কথা বলল না কাজল। যতক্ষণ উনি রইলেন নয়নজ্যোতির সঙ্গেও কথা বলল না। ঘরের এককোণে চুপ করে গোঁজ হয়ে রইল বসে।
বৃদ্ধ অনুভব করলেন, এই নির্জন নির্বান্ধব প্রান্তরে কাজলের শিক্ষা হয়তো ত্বরান্বিত হয়েছে, কিন্তু মানুষের সঙ্গে বাক্যালাপের অর্জিত ক্ষমতা গেছে কমে। তাছাড়া এর আগে ওর সঙ্গে যা ঘটেছে, তাতে নতুন কোনও মানুষকে সহজে গ্রহণ করা ওর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
কিছু নির্দেশ নিয়ে গুরুভাই সেদিনের মতো চলে গেলেন।
বৃদ্ধ নয়নজ্যোতি কাজলকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আমি কিছু মনে করিনি রে ভাই। আমি জানি তুই হলি আমার সাদা মেঘ। না জানিস কোনও ছলচাতুরি, না জানিস কারও মন রেখে চলা। জানিস কেবল আপন মনে ভাসতে। যাতে এমনটাই থাকতে পারিস, তার একটা বন্দোবস্ত করতে বলে দিলাম রে।”
এটুকু বলে কাজলকে আর একটু কাছে ডেকে গায়ে মাথায় হাত বুলোতে থাকলেন। তাতেই যেন তাঁর আরও অনেক না বলা কথা একে একে ঢুকে পড়তে থাকল কাজলের মনে।
সুস্থতায়, অসুস্থতায়, রোদে-মেঘে দিন কাটতে কাটতে আষাঢ় পেরিয়ে এল শ্রাবণ মাস। প্রায় দিনই এখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হয়। কুটিরের ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ে। বৃদ্ধ দেখেন কাজল বইগুলোকে জলের ছোঁয়া থেকে বাঁচাতে গোটা ঘরের একদিক থেকে আর একদিকে ট্রাংক আর টেবিলটাকে টেনে নিয়ে বেড়ায়। বৃদ্ধ মনে মনে হাসেন।
জলভরা কালো মেঘে আকাশ ছাইছে, দিন-কে-দিন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছেন বৃদ্ধ। হাঁপের টান এতটাই বেশি যে এখন আর শুতে পারেন না। চোখ কোটরাগত। চোখের নীচে কালি। অথচ মুখে হাসিটি লেগে আছে।
বৃদ্ধের কথামতো গুরুভাইকে শীঘ্র আসার অনুরোধ জানিয়ে একটা পত্র লিখে একদিন গ্রামে গিয়ে পোস্ট করে এল কাজল।
কাজল জানে বৃদ্ধ বৃষ্টি দেখতে ভালোবাসেন। গ্রাম থেকে পলিথিন এনে দাওয়ার চালে যেমন পেরেছে বিছিয়েছে কাজল। মুষলধারাতেও এখন আর দাওয়ায় তেমন জল ঝরে না।
সেদিন যখন বৃষ্টি নামল তখন প্রায় বিকেল। দুপুরের খাওয়া সারা হয়েছে তা প্রায় ঘণ্টা দুয়েক। হঠাৎ চারধার কালো করে প্রায় নিঃশব্দে বৃষ্টি এল। কাজলের সঙ্গে দাওয়ায় এলেন বৃদ্ধ। চেয়ার এনে দিল কাজল। চেয়ারে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখেতে কাজলের হাত ধরলেন বৃদ্ধ নয়নজ্যোতি। কাজল তাকিয়ে দেখল বৃদ্ধের দু-চোখ থেকে শ্রাবণের ধারার মতোই নিঃশব্দে জল ঝরছে। হাপরের মতো ওঠানামা করছে বুক। অস্পষ্ট ক্ষীণ স্বরে বৃদ্ধ বলছেন, “ভাই রে! কালো মেঘের এবার বিদায় নেবার পালা। সাদা ভাইটি আমার, মনটাকে মেঘের মতো হালকা রাখিস দাদা।”
বৃষ্টি ঝরছে। আলো কমে এসেছে কালো মেঘে। খোলা ধু ধু প্রান্তরে বৃষ্টির রসে গজিয়ে ওঠা আগাছার ঝোপঝাড় থেকে ব্যাঙ ডাকছে। কুটিরের পিছনের কলমি, কচু আর ভ্যারেন্ডার বন থেকে সজোরে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। গোটা চরাচরে বোধ হয় এইটুকুই শব্দ। আকাশ অঝোরে কাঁদছে। স্নেহের অঝোর ধারায় প্লাবিত হচ্ছে কাজল। বৃদ্ধ কাজলকে চেয়ারের পাশে বসিয়ে হঠাৎ যেন তীব্র দৃষ্টিতে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অনামিকা দিয়ে ছুঁয়ে দিলেন কপাল। বিদ্যুতের মতো কেঁপে উঠল কাজলের শরীর।
তারপর?
তারপর যখন কাজলের চোখ খুলল, তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। কাজল তাকিয়ে দেখল বৃদ্ধের অসাড় মাথা কাত হয়ে আছে বুকের কাছে। পশ্চিম আকাশে তখন শেষ বিকেলের রাঙা আলোয় কালো-সাদা মেঘ মিলেমিশে সে এক অনবদ্য নিস্তরঙ্গ ছবি হয়েছে। কী বুঝল ছেলেটা কে জানে, পাঁজাকোলা করে বৃদ্ধকে তুলে চৌকিতে শুইয়ে রেখেই পড়িমরি করে ছুটল গ্রামের দিকে।
তারপর?
তারপর যখন রাতের আঁধার ফিকে হয়ে সূর্য উঠছে, বৃদ্ধের দাহকাজ সেরে দাওয়ায় এসে উঠল কাজল। ততক্ষণে বৃদ্ধের গুরুভাইয়ের গাড়ি এসে উঠেছে সেখানে।
তারপর?
তারপর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হবার পর বৃদ্ধের শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী কাজল চলল সেই গুরুভাইয়ের সঙ্গে। সঙ্গে চলল কাজলের সেই ব্যাগ আর বৃদ্ধ নয়নজ্যোতির সেই ট্রাংক।
গাড়ির জানালা থেকে দাওয়ার খালি চেয়ারটাকে ক্রমশ ছোটো হতে হতে মিলিয়ে যেতে দেখে হু হু করে কেঁদে উঠল কাজল। গুরুভাই তাঁর মাথাটা টেনে নিলেন নিজের বুকে।
১৩
সেই গুরুভাইয়ের সঙ্গেই শহরের এই বোর্ডিংয়ে এসে ওঠা। দাদুর নির্দেশমতোই অনেক খুঁজেপেতে তিনি এই সংস্থাটিকে বেছে নিয়েছেন কাজলের বেড়ে ওঠার জন্য। আইনি যা-সব কাজকর্ম তার সবটুকু সেরে নিয়েছেন আগেই। কাজেই সে-রাতে সরাসরি কাজলকে নিয়ে এই হোমে উঠে আসতে তাঁর অসুবিধা হয়নি কোনও।
কাজলও তো খানিকটা জানত। দাদু তাকে তো বলেছিলেন খানিকটা। কাজেই সেও এখানে থাকতে কোনও আপত্তি জানাল না। আর আপত্তি জানিয়েই-বা হবেটা কী? মাকে হারানো, রাধুবাবুকে হারানো, দাদুকে হারানো—চলছেই তো পরপর। ছোটো একটা ছেলে, পরপর এত অস্থিরতা, এত চলে যাওয়া কত সহ্য করবে আর!
যাই হোক, এখানে এসেছে, থাকছে সেও তো প্রায় বছর তিনেক হল। একটু বেশি বয়সে হলেও নতুন ইশকুলে সিক্সেই ভরতি হয়েছিল। নতুন জায়গা, নতুন ইশকুল দুই-ই মানিয়ে নিয়েছে কাজল। মিশেও গেছে আর সবার সঙ্গে। অসুবিধে যে হয়নি তা তো নয়। যেভাবে ছিল সে দাদুর সঙ্গে, তার থেকে এই পরিবেশ তো অনেক আলাদা। তবে দাদুর শিক্ষাই তাকে যে অনেক পরিণত, অনেক সহনশীল করেছে। কাজেই অসুবিধেগুলোকে তেমন আমল না দিয়ে থেকে গেছে। আস্তে আস্তে সয়ে গেছে সব।
তবে এখনও কম কথা বলে কাজল। সবার সঙ্গে বলেও না। প্রয়োজনটুকু ঠিক মিটিয়ে নেয়। তবু কোনো-কোনো রাতে দুঃস্বপ্নটা ফিরে ফিরে আসে। আজ যেমন এসেছিল।
টেবিল ল্যাম্পের আলো-আঁধারিতে পুরোনো কথাগুলো যেন সিনেমার মতো দোল খাচ্ছিল মাথার মধ্যে। আসলে রাধুবাবুর, দাদুর দেওয়া শিক্ষাগুলো, অভ্যাসগুলো কাজলকে সোজাসাপটা মনে বড়ো করে তুলেছে।
এখনও ফাঁকা পেলেই নিজের মনে ছবি আঁকে কাজল। ভোররাতে ওঠে। বিছানায় বসেই প্রার্থনা সেরে নেয়। পড়ার আগে, খাওয়ার আগেও মনে মনে প্রার্থনা করে। দিনের কোনও একটা সময়, যেখানেই হোক ঠিক চোখ বন্ধ করে চারপাশের সবকিছু শোনার চেষ্টা করে। অবশ্য দাদুর শেখানো অন্য অন্য বিদ্যাগুলোর চর্চা হয় না। তবে অসুবিধা নেই, দাদু নিজেই বলেছেন, মন যদি তাজা থাকে, তাহলে একবার শিখলে এ-বিদ্যা ভোলবার নয়। বরং সবার সামনে অনুশীলন করলে যদি বাহবা পাওয়ার দিকে মন যায়!
সেইসব সাতপাঁচ ভেবেই কাজল সে-সব করে না। বরং পড়ে। মন দিয়ে বই পড়ে। এই বোর্ডিংয়ের লাইব্রেরিতে অনেক বই। ইশকুলের লাইব্রেরিতে অনেক বই। কত কী যে থাকে সে-সব বইয়ে! কাজল গোগ্রাসে সেইসব বই পড়ে। কাজলের মনে হয় যাঁরা সেইসব বইগুলো লেখেন তাঁরা সবাই ঠিক রাধুবাবু না-হলে দাদুর মতো মানুষ। অন্যেরা জানবে বলে সব উজাড় করে দিয়ে গেছেন সাদা পাতায়।
হোম-ওয়ার্কের প্রতিবেদনটা লিখতে শুরু করবে এবার কাজল। আস্তে আস্তে তার সমস্ত মন গিয়ে জড়ো হয় ইশকুলে কাটানো নানান কর্মসূচিতে। চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ যেন আবার প্রদর্শনীর ছবিগুলো, অনুষ্ঠানের বক্তব্যগুলো, গানগুলো, বৃক্ষরোপণের মুহূর্তগুলো মনে মনে দেখে নেয়। তারপর খাতাটা টেনে নিয়ে লিখতে থাকে।
লেখাটা যখন শেষের দিকে তখন ঘাড়ের কাছে একটা ফিসফিসানি শুনে চমকে ওঠে কাজল। নেতাই। ভুরু কুঁচকে তাকায় কাজল। ফিসফিস করেই নেতাই বলে, “ভয় পেয়েছিস নাকি রে?”
বিরক্তির একটা দৃষ্টি চোখে রেখে মাথাটা উপরের দিকে ঝাঁকায় কাজল, যার অর্থ—কেন?
“আরে! সাইকেলের ব্যাপারটায় ভয় পেলি কিনা।”
এবার কথা বলে কাজল, “সাইকেল?”
“ক্যাবলা! জানো না! আরে, যেটা হাঁটাতে হাঁটাতে নিয়ে তুই ইশকুল থেকে বেরোলি। কার সাইকেল নিয়েছিলি? নিলি কেন?”
“কেন? ওটা তো রৌনকের সাইকেল। নেপাল আমায় বাইরে আনতে বলল!”
“তারপর কী হল?”
“নেপাল সাইকেলটা নিয়ে দাঁড়াল, বলল রৌনক বেরোলে একসঙ্গে ফিরবে।”
“আর তুই কী করলি?”
“আমি তো হোমে চলে এলাম।”
“নেপাল? সে কী করল?”
কাজলের মনে পড়ল, নেপাল আজ সন্ধের অনেক পরে হোমে ঢুকেছে। কেন দেরি করল নেপাল?
কানের কাছে মুখ এনে একদম ফিসফিস করে নেতাই যা বলল, তার সারমর্ম দাঁড়ায়, কাজলের বের করে এনে দেওয়া সাইকেল নেপাল আর মঙ্গল মিলে নিয়ে পালায়। ওদিকে সাইকেল না পাওয়ায় রৌনক অফিসে এসে জানায়। সবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে অফিসের একজন নাকি বলেন কাজলকে নাকি ওরকম সাইকেল নিয়ে বেরোতে দেখেছেন। তারপর সিসিটিভিতেও নাকি দেখা যায় কাজল সাইকেল নিয়ে বেরোচ্ছে। তখন রৌনক নাকি জানায় যে কাজল নিয়ে গেছে যখন তখন ঠিক পেয়ে যাবে।
ব্যাপারটা কিন্তু ওখানেই মিটে যায়নি। নেপাল আর মঙ্গল সেই সাইকেল বেচে দিয়েছে কোন এক চোর বাজারে। ওরা মতলব ভেঁজেছে, যেই জিজ্ঞেস করুক কিছুতেই ওরা স্বীকার করবে না সাইকেল নিয়েছিল বলে। কাজেই সব দোষটাই এসে পড়বে কাজলের উপর।
ইনিয়ে বিনিয়ে কথাগুলো বলতেই থাকে নেতাই। কাজল হঠাৎ করে অধীর হয়ে ওঠে। তার অস্থিরতা দূর করতে পারে এমন কেউ তো নেই, আর নিজে-নিজেই যে সব সামলে নেবে তেমন তো সে হয়ে ওঠেনি এখনও। তাছাড়া নিজে নিজে কতই-বা সামলানো যায়?
কাজল অনেক কিছু জানে, কিন্তু ছল জানে না, চাতুরি জানে না, বোঝেও না। অস্থির চিত্তে তার খালি ঝড় ওঠে—সত্যিই তো, রৌনককে না বলে ওর সাইকেলটা বের করে তো ঠিক কাজ করেনি। নেপালের কথায় করলই-বা কেন? এবার সাইকেল না পেলে সবাই তো ওকেই বলবে। কী হবে এখন?
মনের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠছে, কানের কাছে ঝিঁঝিঁ পোকাগুলো ডেকেই চলেছে। তেষ্টা পাচ্ছে, ঘাম হচ্ছে, মাথাটা নাকটা খুব সুড়সুড় করছে হঠাৎ। বার বার করে নাক, মাথা, হাতের তেলোতে ঘষতে থাকল কাজল। এবার কী হবে? কী করবে সে!
নেতাইর কোনও কথা আর তার কানে ঢুকছে না। চোখ বন্ধ করে দাদুকে ডাকছে, রাধুবাবুকে ডাকছে। কী করবে ও এখন, বলে দাও, বলে দাও!
খাতা-বই সবকিছু ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল কাজল। হন্তদন্ত হয়ে ঘরময় পায়চারি করতে শুরু করে দিল। সাদা মেঘের মতো ছেলেটা একবারও দেখল না তার বিছানা থেকে নেতাই ঠিক কোনাকুনি দোতলার বিছানায় মুখ বাড়িয়ে থাকা নেপালের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল।
১৪
পরদিন কাজল কিছুতেই স্কুল যাবে না। যাবে না মানে সে যাবে না, কিছুতেই যাবে না। কেউ তাকে স্কুলে নিয়ে যেতে পারবে না। ধুন্ধুমার লেগে গেছে বোর্ডিংয়ে। ঘরের একদিক থেকে আর একদিকে অশান্ত কাজল ছুটে বেড়াচ্ছে। সে স্কুলে যাবে না। কিছুতেই যাবে না।
এই অশান্ত ছোটাছুটি যে শেষ রাত থেকেই শুরু হয়েছিল সে আমরা জানি। নেতাই জানে, নেপাল জানে। আরও কেউ জেনে থাকতে পারে, কিন্তু কেউ কিচ্ছু বলেনি। নিজের নিজের বিছানায় বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে অশান্ত কাজলের পায়চারি দেখে সারা শরীর কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে কেবল হেসেছে।
বোর্ডিংয়ের এই উইংয়ের দাদাদের কাছে খবর গেছে সকালে। তার আগে ওই রুমের বড়োরা কাজলকে শান্ত করার চেষ্টা করেছে। একজায়গায় বসিয়েছে, জল খাইয়েছে। তারপর যেই না ‘কী হয়েছে রে, বল না’ বলে কিছু জানতে চেয়েছে অমনি উঁচু গলায় ‘কিছু না! কিছু না! কিছু হয়নি। কিছু হয়নি।’ বলে জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করেছে ছেলেটা।
দাদারা যখন আসে তখন কিছুটা ক্লান্ত হয়েই যেন নিজের বিছানায় বসে নয়নজ্যোতির সেই ট্রাংকখানায় হাত রাখছিল কাজল। দাদাদের দেখেই ‘যাবে না, ইশকুল যাবে না’ জোরে জোরে বলতে বলতে ফের হাঁটতে শুরু করে দিল সে। দাদারাও অবাক! কাজলকে তো এমন তারা দেখেনি কখনও।
সেদিন কাজল ইশকুল গেল না। খোঁজ নিতে দাদারা ইশকুলে গেল। অবাক কাণ্ড, ইশকুল থেকে তো কোনও অভিযোগ তারা পেল না! এমন কিছুই নাকি হয়নি যার জন্য আসতে ভয় পাবে কাজল।
স্যার-ম্যাডামরাও শুনে অবাক। কাজল আসতে চাইছে না ইশকুলে! হ্যাঁ, ছেলেটা একটু অন্যদের থেকে আলাদা। হ্যাঁ, এ-কথাও ঠিক বেশিরভাগ ক্লাসে জানালার পাশে একটা কোণ ঘেঁষে বসে, না জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না। হ্যাঁ, এ-কথাও ঠিক হুড়োহুড়ি খেলায় সবার সঙ্গে মাতে না। কিন্তু এটাও তো ঠিক ক্লাসে সকলের চেয়ে ভালো রিডিং পড়তে পারে, অঙ্কে একটু কাঁচা তো কী, অদ্ভুত সুন্দর ছবি আঁকতে জানে, সবার সঙ্গে এক সুরে গান না গাইতে পারলেও পারকাশনের ঝুনঝুনিটা এক্কেবারে সঠিক তালে বাজায়, যা করে আনতে বলা হয় সব করে আনে। শরীর খারাপ ছাড়া ইশকুল কামাই তার নেই—সেই ছেলে ইশকুলে আসবে না! কেন? কেউ কি ওকে কিছু বলেছে? কেউ কি মেরেছে? ভয় দেখিয়েছে কেউ?
কোনও উত্তর মিলল না। কেউ জানে না। যারা জানে, যাদের মিথ্যে কথায় আজ ছেলেটার এই অবস্থা, তারা তো চুপ। সবাই বললেন, কয়েকদিন না-হয় থাক। তারপর ওকে স্কুলে পাঠান আবার। বাচ্চা তো, দেখবেন ভুলে যাবে।
কে ভুলবে? কাজল? ভোলার ছেলেটিই যেন সে! যে চুরির ভয়, অসম্মানের ভয় নেপাল আর নেতাই তার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে, কে পারে তাকে বার করতে?
কাজল আর ইশকুল গেল না। একমাস হয়ে গেল কাজল আর ইশকুল যায় না। ইশকুলের ইউনিফর্মটা কাছে আনলেই অস্থির হয়ে পড়ে। আর নেপাল, নেতাই, মঙ্গলরা ফাঁকা পেলেই সেই ইউনিফর্ম কাছে এনে সকাল হোক বা সন্ধে ‘চল ইশকুল যাই’ বলে ওকে ভয় দেখায়। একটা তরতাজা ছেলেকে শামুকের মতো গুটিয়ে যেতে দেখতে কী যে উল্লাস হয় ওদের কে জানে! ঘরের বড়োরা দেখলে ওদের ধমকায়।
এক দাদা একদিন রিকশা করে ইউনিফর্ম ছাড়াই ইশকুলে নিয়ে চলল ওকে। কিন্তু যেই না ইশকুলের কাছের মোড়টা ঘুরেছে, চলন্ত রিকশা থেকে লাফিয়ে নেমে যাওয়ার উপক্রম করল কাজল। ‘যাবে না, যাবে না, ইশকুল যাবে না’ বলে তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করল। তিতিবিরক্ত হয়ে সেই দাদা কাজলকে ফেরত নিয়ে চলে এল বোর্ডিংয়ে।
গরমের ছুটি চলে এল, শেষ দিনেও কাজল ইশকুল গেল না।
আচ্ছা কাজল কি আর পড়াশুনো করবে না তাহলে?
এই প্রশ্ন বোর্ডিংয়ের বড়োদের সবার মনে। এ নিয়ে অথরিটির সঙ্গে কথাও হয়ে গেছে। একজন সাইকোলজিস্ট ম্যাডাম এমনিতেই এই বোর্ডিংয়ে নিয়মমাফিক বাচ্চাদের মনের স্বাস্থ্য দেখেন। তিনি আলাদা করে গোটা তিনেক সিটিং দিয়েছেন কাজলের এই অবস্থার পরে। তাঁর মতামতও অথরিটিকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেছেন, সেরকম কোনও অসুবিধাই নাকি ওর নেই। আশ্চর্যরকমের ইন্টেলিজেন্ট নাকি কাজল, তবে তার ইন্টেলিজেন্স আর পাঁচটা ছেলেদের মতো নয়।—“আলাদা বলেই ওর আবেগ, ওর আবেগের অভিঘাত, ওর ভালোবাসা, ভাবনাচিন্তা সবটাই অন্তর্মুখী। খুশি থাকার জন্য ওর আর কাউকে দরকার হয় না। নিজের মনেই খুশি থাকতে পারে। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ওর ইশকুল যেতে ভয় হয়েছে। কেন ভয়, সে-কথা ও বলছে না। তবে ওকে যদি এখনও এই ট্রমা থেকে বের না করে যায়, ও কিন্তু ক্রমশ আরও আত্মমগ্ন হয়ে পড়বে।”
আরও একজন কাউন্সেলরের পরামর্শ নিয়েছে অথরিটি। ঠিক করেছে গরমের ছুটিতে এই অথরিটিরই আর একটা যে বোর্ডিং আছে পাহাড়ে, সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে ওকে। নতুন পরিবেশে হয়তো ওর মনটা ঘুরতেও পারে।
ছুটি পড়তে এখনও দিন পাঁচেক। পাহাড়ে যেতে আরও দিন সাতেক।
আজ রবীন্দ্রজয়ন্তী। বোর্ডিংয়ের ছাতে অনুষ্ঠান হচ্ছে। সবাই গান করছে। কবিতা বলছে। সাউন্ড-বক্স থেকে ভেসে আসছে তার আওয়াজ।
একা ঘরে বসে আছে কাজল। একলা ঘরে জানালা দিয়ে বাইরে চলমান শহরের দিকে তাকিয়ে আছে। খানিক আগেই একটা গান গেয়েছে বিপুলদা। সেই গানটার সুর মনে মনে গুনগুন করছে সে। গানটা রাধুবাবু প্রায়ই ওকে শোনাতেন—
‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান
সংকটের কল্পনাতে হয়ো না ম্রিয়মাণ’
১৫
কাকতালীয় কথাটা এই ঘটনাটার জন্য ঠিক শব্দবন্ধ নয়। ওতে বিষয়টা যেন একটু লঘু হয়। ব্যাপারটা তো লঘু নয়, গুরুতরই বলা যায়। আচ্ছা, এরকম আশ্চর্য ব্যাপারকে আর কী বলি, ঐশ্বরিক সমাপতন? নাকি প্যারাসাইকোলজির টার্মিনোলজি মেনে বলি টেলিপ্যাথি?
টেলিপ্যাথি কী তা হয়তো সবাই জানে। তবু কাহিনির খাতিরে একটু সরল করে বলি, টেলিপ্যাথিকে বলতে পারা যায় ভাবনা পাঠানোর অন্য একরকম উপায়। টেলিফোন অথবা চিঠি, অথবা এসএমএস, হোয়াটস্যাপ—এরা সব যা করে যন্ত্র দিয়ে, টেলিপ্যাথি প্রায় সেরকমটাই করে মন দিয়ে। এক মনের ভিতর থেকে আর এক মনে ভাবনার আদানপ্রদান। বার্তা পাঠানো অথবা গ্রহণে এক্ষেত্রে না আছে কোনও যন্ত্রের যন্ত্রণা, না আছে কোনও জ্ঞানেন্দ্রিয়ের তেমন ভূমিকা, ভূমিকা কেবল বুদ্ধেন্দ্রিয় মনের। মনের গভীর থেকে একমনে যা ভাবলাম, তাই যেন ঘটে গেল! যাকে ভাবলাম তাঁর সঙ্গে যেন দেখা হয়ে গেল। যা দেখতে চাইছিলাম, শুনতে চাইছিলাম, হঠাৎ করে তাই যেন দেখা হল, শোনা হল।
প্রসঙ্গটা একটু বিস্তারেই এবার বলা যাক।
পাহাড়ে এই প্রথম এল কাজল। আর প্রথম পাহাড় দেখা, প্রথম পাহাড় থেকে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখা, প্রথম পাহাড়ের গম্ভীরতা, দিনের বেলাও খাদের অরণ্য থেকে উঠে আসা ঝিঁঝিঁর শব্দ অনুভব করা—এ যে কী অবর্ণনীয় অনুভূতি, সে যে পেয়েছে সে-ই জানে।
পাহাড়ের কোল ঘেঁষা এক গ্রাম, দূরে দূরে ছোটো ছোটো ঘর। চারদিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ সব পাহাড়। জায়গায় জায়গায় শস্যক্ষেত তাদের নিজস্ব সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়েছে। পাহাড়ের মধ্য থেকে বয়ে আসা সরু এক নদীর শীতল চঞ্চল স্রোত ছোটো-বড়ো পাথর ছুঁয়ে শিশু হরিণের মতো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চলেছে। সরু নদী, তার চওড়া তট। তটময় ছোটো-বড়ো সাদা-হলুদ নুড়ি। ইয়া মোটা গাছে, বাড়িঘরের পাথরের দেয়ালে নাম না জানা লতার বিস্তার আর ফুলের সমারোহ। কাজলের যে কী আনন্দ হয়েছে!
এই গ্রামেই কাজলদের আর একটি বোর্ডিং। মূলত ছোটো বাচ্চারা থাকে ছবির মতো সাজানো এই বোর্ডিংয়ে। এখানেই আপাতত মাস খানেকের আশ্রয় কাজলের।
ওরা তিনজন এখানে এসেছে। শহরের বোর্ডিংয়ের তরফ থেকে হাউস গার্জিয়ান অলকেশদাদা, বিপুলদা আর কাজল এই দুজনকে নিয়ে এসেছেন।
আসা ইস্তক সকাল-বিকেল যেমন খুশি বোর্ডিংয়ের বাগানে ঘুরে বেড়ায় কাজল। এই বোর্ডিংয়ের প্রধান একজন জাপানি সাহেব। সাহেবের নাম তাঁর অফিসের বাইরে কাঠের ফলকে লেখা থাকলেও এখানকার সবাই তাঁকে ডায়মন্ড সাহেব বলেই ডাকে। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস তাঁর এক পোশাক—একটা হাঁটু পর্যন্ত খাঁকি রঙের প্যান্ট আর সাদা গেঞ্জি। পান থেকে চুন খসতে দেন না। সময়মতো সবকিছু হতে হবে। নইলে তাঁর মুখ ব্যাজার। তবে চেঁচামেচি করেন না। বরং তুম্বো মুখে যে-কাজ সময়ে হচ্ছে না, সে যে-কাজই হোক, নিজের হাতে করতে শুরু করে দেন। সেই লজ্জা পাওয়ার ভয়ে সবাই তটস্থ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট নিয়মে তাই এখানে সবকিছু হয়।
এখানে ভোর হয় একটু তাড়াতাড়িই। ঠিক ভোর পাঁচটার সময় নিজের হাতে পাখিদের খাবার দেন ডায়মন্ড সাহেব। কত যে পাহাড়ি টিয়াপাখি রোজ আসে খাবার খেতে। কাজল নিজেও তো ভোরেই ওঠে। আর এখানের এই খোলামেলা প্রকৃতির কোলে দাদুর কথা মনে হওয়াতে ভোরবেলা বাইরে এসেই চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করে।
ডায়মন্ড সাহেবের সঙ্গে কাজলের ভাব জমে গেছে। সাহেব এখন পাখি খাওয়াতে আসার আগে ‘ক্যাজৌল ক্যাজৌল’ করে সরু গলায় হাঁক ছাড়েন। কাজলও সেই ডাক শুনলেই যেখানেই থাকুক ঠিক দৌড়ে এসে হাজির হয়।
সাহেব যখন পাখিদের খাবার দেন, তাঁকে ঘিরে থাকে পাখিরা। পাখি আসে, কাঠবেড়ালিও আসে। ওদের খাবার দিয়ে বাগানের পাথুরে দেয়ালের উপরে রাখা জলের পাত্রে জল ভরে দেন। হাসতে হাসতে এসে বসেন কাজলের পাশে পাথুরে বেদিতে। এই সময় ওরা কেউ কথা বলে না। পাখপাখালি, কাঠবেড়ালির কাণ্ড দেখে।
পাখিরা সব উড়ে গেলে দুজনে হাঁটে। বাগানেই। অবশ্য কোনো-কোনোদিন গ্রামের পথ ধরে নদীর দিকে চলে যায়। কাজল সঙ্গে এলে এই সময় কত কথা বলেন ডায়মন্ড সাহেব। তাঁর নিজের দেশের কথা বলেন কাজলকে।
এইরকমই পাহাড় ঘেরা ছোট্ট এক জাপানি গাঁয়ে নাকি সাহেবের জন্ম। সেখানেই ছোটো এক ইশকুলে তাঁর পড়াশুনো। সেই ইশকুলের কত যে মজার সব গল্প। ইশকুলের লাইব্রেরির সানশেডে থাকা এক পেঁচার পরিবারের গল্প, পিছনের গার্ডেনের চেরিগাছে ফুল আসার গল্প, বন্ধুরা একসঙ্গে নদীর পাড়ে এক্সকারশনে যাওয়ার গল্প, সময়ে না পৌঁছতে পারলে টিচারের কাছে বকুনি খাওয়ার গল্প—কত যে দুষ্টুমির গল্প। কাজলকে সে-সব বলতে বলতে সাহেবের সরু গলা মাঝে মাঝে কেঁপে যায়।
সাহেব বলেন, বাবা যতদিন ছিলেন জীবন তাঁর একরকম ছিল। বাবা চলে যেতেই মায়ের হাত ধরে জেঠু, কাকু হয়ে শেষে শহরে মামাবাড়ি। তারপর কৈশোর না পেরোতে-পেরোতেই মাও চলে গেলেন। মার কথা বলতে গেলেই ডায়মন্ড সাহেব বলেন, তাঁর মা খুব সুন্দরী ছিলেন। সাহেবের মায়ের গল্প শুনতে শুনতে কাজল একবার আড়চোখে সাহেবকে দেখে আর পরক্ষণেই আকাশ দেখে। আকাশে তখন হয়তো ঘুরপাক খাচ্ছে এক পাখি। কাজলের মনেও কি তার মায়ের কথা তখন ঘুরপাক খায়? কে জানে!
এখানে ওরা এসেছে সপ্তাহ খানেক হল। বিপুলদা আর অলোকেশদাদা ফিরে গেছে। কাজল থেকে গেছে। এখানে এখনও ইশকুলে গরমের ছুটি পড়েনি। ছেলেমেয়েরা সবাই সকালে ইশকুলে চলে যায়। ডায়মন্ড সাহেব নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে টা টা করেন। তিনটে বড়ো গাড়িতে ওরা পাখিদের মতোই কলকল করতে করতে ইশকুল যায়।
ওরা চলে যাওয়ার পর যে-যার কাজে লাগেন। ব্রেকফাস্ট সেরে সাহেব নিজের অফিসে কাজ করেন। আশ্চর্য মানুষ এই ডায়মন্ড সাহেব। পৃথিবীর যে-সব দেশে থেকেছেন সেইসব দেশের ভাষায় পড়তে জানেন, লিখতে জানেন। অজস্র বই তাঁর অফিসের আলমারিতে। রবিঠাকুরের বই, অবনঠাকুরের বই আছে সেখানে।
কাজলের তো ছুটি। অনেকদিন থাকবে বলে সঙ্গে বই-খাতা এনেছে ও। তাই বলে কেউ পড়তে বসতে বলে এখানে জোরজার করে না। কাজলের ইচ্ছে করে না পড়তে। পড়তে বসে না। উঠোনের বেদিটায় গিয়ে বসে ছবি আঁকে। পাহাড়ের পরিবেশ তো, এই রোদ্দুর তো এই মেঘের ছায়া। হাওয়া, রোদ্দুর, ছায়া গায়ে মাখতে মাখতে এক মনে ছবি আঁকে কাজল। কেউ কি ওকে তখন দেখে? দেখে তো! বোর্ডিংয়ে যাঁরা কাজ করেন সবাই দেখে। অফিসের জানালা থেকে মাঝে-মাঝেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ডায়মন্ড সাহেব।
এখন কোনো-কোনোদিন সাহেবের সঙ্গে বিকেলেও বেড়াতে বেরোয় কাজল। সাহেবের হাতে তখন থাকে একটা ছড়ি। ছড়িটা কখনও কাজলের হাতে দিয়ে ওর আঙুলগুলো নিজের আঙুলে নিয়ে পাহাড়ি পথে হাঁটেন সাহেব। কখনও কথার বুদবুদ ফোটে, কখনো-বা চুপচাপ পথ হাঁটেন দুজন। সে যাই হোক, স্বীকার করতেই হবে, যে-ছবিটা তখন পাহাড়ের ওই প্রায় নির্জন পথে ফুটে ওঠে সে কোনও মহান শিল্পীরই আঁকা।
ডায়মন্ড সাহেবই প্রথম মানুষ যাঁকে কাজল নিজের ডায়েরিখানা এনে পড়তে দিয়েছে। সাহেবের অফিসের সামনে ডায়েরি হাতে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কাজল। মাথাটা নীচের দিকে, চোখ মাঝে মাঝে সাহবের দিকে, দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে আছে। সাহেব দেখেই, “হেই ক্যাজৌল, কাম ইন, কাম ইন! ভিত্তরে এসো!” বলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
কাজল তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে দরজায়। সাহেব কাছে আসতেই মাথাটা নীচু করে ডায়েরিটা বাড়িয়ে দেয়। বলে, “আমার ডাইরি। তুমি পড়বে?”
ডায়েরিটা হাতে নিয়ে একটা তৃপ্তির হাসি হেসে সাহেব বলেন, “উইথ প্লেজার মাই বয়!”
সাহেব দেখেন, সে এক নীল রঙের ডায়েরি। মসৃণ মলাট। ডায়েরির প্রথম পাতা খুলে দেখেন গোটা গোটা অক্ষরে সেখানে লেখা—সাদা মেঘের ডায়েরি। পাশে একটুকরো মেঘ।
“ইজ ইট ইওর হ্যান্ড-রাইটিং, ডিয়ার?”
“নো। ইট ওয়াজ মাই রাধুবাবু।” থেমে থেমে বলতে গিয়ে এই প্রথম নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল কাজল। চোখ দিয়ে জল নেমে এল পাহাড়ের ঝোরার মতো।
মাথায় হাত বুলিয়ে সাহেব বললেন, “আমি ডেফিনিটলি পড়ব। আজই পড়ব। এখনই পড়ব ডিয়ার! তুমি ততক্ষণ এইটা নাও।”
সাহেবের কাছ থেকে চকোলেট নিয়ে মুখে পুরে ঘরে এসে আজ খাতা-বই খুলে পড়তে বসেছে কাজল। কী করছে জানো? অঙ্কের বই খুলে পটাপট অঙ্ক করছে আমাদের কাজল। আশ্চর্য! অঙ্কগুলো মিলেও যাচ্ছে!
সেদিন বিকেলবেলায় একটু আগেই হাঁটতে বেরিয়েছে সাহবে আর কাজল। সাহেবের এক হাতে কাজলের ডায়েরি, আর এক হাতে কাজলের হাত। সাহেব বলেছেন আজকে ওকে ওঁর ফেভারিট প্লেসে নিয়ে যাবেন।
শেষ দুপুরের ফাঁকা রাস্তায় দুটো মানুষ তাই ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছেন সবুজ পাহাড়ের বুকে সরু এক পাহাড়িয়া গলিপথে। দুইদিকে ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে পাহাড়। সভ্য স্বাভাবিক পৃথিবীর কোলাহল এমনিতেই এখানে কম, তবু যতটুকু আছে তাও ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছে। ঘন সবুজের ছোঁয়া লাগছে দুজনের গায়ে। উপরে পাহাড়ের গা বেয়ে পাইনের বন। টুকরো টুকরো স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্ত রোদ্দুর লাগছে দুজনের গায়ে। আকাশের এককোণে একটুকরো কালো মেঘও ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ওদের দিকে।
আজ সে-সবে লক্ষ নেই সাহেবের। কাজলের ডায়েরি পড়ার পর থেকেই একটা ঘোর লেগেছে যেন তাঁর মনে। নিজের ছোটোবেলা দেখতে পেয়েছেন কি সাহেব? নিজের সেই ছোট্ট গ্রাম, সেই ইশকুল, বাবা, মা, তারপর ঠোক্কর খেতে খেতে শহর, বন্দর হয়ে মিশনারি দল। তারপর এ-দেশ ও-দেশ ঘুরে কাকে খুঁজেছেন তিনি? নিজেকে? নিজের মতো কাউকে? কাজলকে?
কাজলকেই তো!
আর এই যে কাজল, কাজল কুমার, সে কাকে খুঁজে চলেছে?
কাজলের হাত ধরে আছে সাহেবের শীতল আঙুল, কিন্তু মনে মনে সে খুঁজে চলেছে তার রাধুবাবুকে। সেই যেদিন সে পালিয়েছিল ‘নিজের বাড়ি’ থেকে, সেদিন থেকেই খুঁজে চলেছে মনে মনে। সাহেবের স্পর্শ তাকে রাধুবাবুর ভালোবাসা দেয়। সাহেবের আঙুল ছুঁয়ে অচেনা বনপথে সে চলেছে তার রাধুবাবুর সঙ্গে। মনে মনে।
হয়তো ভাবছ, এসব কথাই যদি বলব, তাহলে শুরুতে কেন ঐশ্বরিক সমাপতন অথবা টেলিপ্যাথির কথা বললাম!
তাই তো। ঐশ্বরিক সমাপতনই তো! টেলিপ্যাথিই তো!
নইলে সরু পথ যেখানে মিশল পাহাড়ের এক প্রান্তে, যেখান থেকে দেখা যায় চারদিকে শুধু পাহাড়ের চূড়া আর খোলা আকাশ, যেখানে পা ডুবে যায় পাহাড়িয়া ঘাসে আর মন ডুবে যায় প্রকৃতির গহিনে, সেখানে পৌঁছোনো মাত্রই কাজল অমন করে দৌড়োল কেন একেবারে শেষ প্রান্তে, যেখান থেকে আর এক পা বাড়ালেই পাহাড়ের অনন্ত সবুজ গ্রাস করে নেবে মনুষ্য জীবন?
কে দাঁড়িয়ে ওখানে? কাজলদের দিকে পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে কে ওখানে ক্যানভাসে ঢেলে দিচ্ছে কালো-সাদা মেঘলা রঙ? কার পায়ের কাছে পড়ে আছে গেরুয়া এক ঝোলা যা থেকে উঁকি দিচ্ছে অজস্র কাগজের রোল?
“রাধুবাবু! রাধুবাবু!” করে চিৎকার করতে করতে কাজল এক ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছে তার জীবনের গাছটিকে।
প্রৌঢ় ডায়মন্ড সাহেবও কোনোমতে দৌড়তে দৌড়তে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলছেন, “আর ইয়ু? আর ইয়ু মাই ক্যাজৌল’স রাধুবাবু?”
রাধুবাবু কী বলবেন! তাঁর গলা তো বুজে গেছে মেঘে। মেঘ থেকে জল নামল যেই চোখের সরোবর হয়ে, সাহেব জড়িয়ে ধরলেন দুজনকেই।
আর বিশ্বাস করো, ঠিক তক্ষুনি আকাশ থেকেও ঝরতে শুরু করল নিঃশব্দ জল। জল, অবিরল জল!
বৃষ্টি হচ্ছে। পাহাড়ের খামখেয়ালি বৃষ্টি হচ্ছে আকাশ ভেঙে। খোলা আকাশের নীচে জড়াজড়ি করে বৃষ্টিতে ভিজছে তিনটে মানুষ। নাকি তিন খণ্ড মেঘ? না, তিন খণ্ড কেন হবে, আসলে তো একটাই।
বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে ক্যানভাসের রঙ। ক্যানভাসের কালো মেঘ থেকে বৃষ্টির রঙ চুঁইয়ে আসছে সাদা ধপধপে মেঘে।
সাদা মেঘ—কালো মেঘ—বৃষ্টি, সাদা মেঘ—কালো মেঘ…
ছবি: প্রদীপ গোস্বামী
লেখকের অন্যান্য লেখা
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু
ছোট্ট এক পাহাড়ি কন্যে সুলুংটুং। তাকে ঘিরে থাকে স্বপ্নরাজ্যের তিন পাহাড়। ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মিথ। সুলুংটুংয়ের সেই তিন পাহাড়ে দুর্ধর্ষ অভিযানের কাহিনি পরিস্ফুট হয়েছে শাশ্বত করের দক্ষ কলমে।
ছোটোদের জন্যে লেখা আট খ্যাতনামা গল্পকারের প্রথম গল্পের সংকলন।
শেখর বসু, অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, জয়দীপ চক্রবর্তী, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, যশোধরা রায়চৌধুরী, সৈকত মুখোপাধ্যায়, চুমকি চট্টোপাধ্যায় ও দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী