ছোটো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
ছোটো গল্প
মাছটা হাসল কেন? দিশেহারা উজির-এ-আজম এই হেঁয়ালির সমাধান করতে কোমর বেঁধে লেগে পড়লেন। পরবর্তী পাঁচ মাস ধরে তিনি শত শত জ্যোতিষী, ওঝা, ফকির, জাদুকরের দোরে দোরে ঘুরে বেড়ালেন। এমনকি জেলে, মাঝি-মাল্লা, জাহাজি, মেছুরে, কুমোর, কামার, ছুতোর, ভিস্তি, তাঁতি, ধোপা, নাপিত, চোর, ডাকাত—যাকে পেলেন তার সঙ্গেই শলা-পরামর্শ করলেন। অচেনা পথচলতি মানুষকে ধরে ধরে জেরা করতেও বাকি রাখলেন না। কিন্তু তাতে লাভের লাভ কিছুই হল না।
রাখি পুরকায়স্থ
সবে সকাল হয়েছে। প্রবল কুয়াশা আর ঠান্ডার দাপটে তখনও ভালোভাবে ঘুম ভাঙেনি রাজ্যবাসীর। চারদিক নিস্তব্ধ, যেন কেউ কোত্থাও নেই। বেগম সাহেবার অবশ্য ঘুম ভেঙে গিয়েছে অনেকক্ষণ। তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন জেনানা মহলের জানালায়। হঠাৎ দেখতে পেলেন, ঝাঁকা মাথায় এক জেলেনি চলেছে। দেখেই বেগম সাহেবার বড্ড ইচ্ছে হল মুলো দিয়ে ঝাল ঝাল মাছের ঝোল খাবেন। চিৎকার করে তিনি জেলেনিকে ডাকলেন, “এই যে ভালো মানুষের মেয়ে, এদিকে শোনো দিকি।”
হাসিমুখে তড়িঘড়ি এগিয়ে এল জেলেনি। মাথা থেকে ঝাঁকা মাটিতে নামিয়ে রেখে বলল, “আস-সালামু আলাইকুম বেগমজান!”
গম্ভীর মুখে বেগম সাহেবা বললেন, “ওয়া-আলাইকুমুস-সালাম।” তারপর কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “আজ কী কী মাছ এনেছ, দেখি।” এই বলে যেই না তিনি গলা বাড়িয়ে ঝুড়ির ভেতর উঁকি দিয়েছেন, অমনি একটা মাছ ঝুড়ির নীচ থেকে ওপরে লাফিয়ে উঠল।
“এটা কী মাছ? ছেলে মাছ, না মেয়ে মাছ?” ভ্রূ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন বেগম সাহেবা।—“আমি কিন্তু মেয়ে মাছ নেব। জানোই তো, জেনানা মহলে ছেলে মাছ ঢোকা বারণ।”
যেই না তিনি কথাটা শেষ করেছেন, অমনি বেগম সাহেবাকে অবাক করে দিয়ে সেই মাছটা আবারও ওপরে লাফিয়ে উঠে হো হো শব্দ করে জোরে হেসে উঠল। সেই শব্দে চমকে গিয়ে পাশের চিনার গাছ থেকে এক ঝাঁক চড়ুই কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে গেল আকাশে।
“গুস্তাখি মাফ বেগমজান, এটা ছেলে মাছ।” জেলেনি কাঁচুমাচু মুখে তাকাল বেগম সাহেবার মুখের দিকে। দেখল, বেগম সাহেবার চোখগুলো গোল গোল, চোয়াল খানিকটা ঝুলে গিয়ে মুখখানা হাঁ হয়ে গিয়েছে।
আহা, এমন তো হবারই কথা। মাছের হাসি শুনে বেগম সাহেবার মাথা যে তখন ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। জেলেনি আঁচ করতে পারল, বেগম সাহেবা আর মাছ কিনবার মতো মানসিক অবস্থায় নেই। কোথাও যেন একটা বড়োসড়ো গড়বড় ঘটে গিয়েছে। তাই দেরি না করে মাথায় ঝাঁকাটা তুলেই সে পা চালিয়ে রওনা দিল বাজারের দিকে। কয়েক পা এগিয়ে পেছন ফিরে দেখল, বেগম সাহেবার মুখখানা ফ্যাকাশে। পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
(দুই)
শাহি পালঙ্কে পা ঝুলিয়ে বসে পান চিবোচ্ছিলেন বেগম সাহেবা। তাঁর টকটকে লাল মুখখানা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ভেতরে ভেতরে তিনি তুমুল রাগে ফুঁসছেন। তা, রাগ হবে নাই-বা কেন! এত সাহস হয় কী করে! বেগম সাহেবার প্রশ্ন শুনে কিনা গলা ফাটিয়ে হাসি! তাও আবার হেসেছে সামান্য একটা মাছ! তাই সারাটা দিন এভাবেই গোমড়ামুখো হয়ে বসে রইলেন তিনি। ঠিকঠাকমতো খাওয়াদাওয়া পর্যন্ত করলেন না।
দরবার থেকে ফিরে এসে সুলতান বাহাদুর খেয়াল করলেন ব্যাপারটা—বেগম সাহেবার মুখ ভার। ঘর পোড়া গোরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়। সুলতান বাহাদুর তাই যারপরনাই শঙ্কিত হলেন। কালক্ষেপ না করে আগেভাগেই জিজ্ঞেস করে বসলেন, “বলো বিবিজান, কে সেই দুরাত্মা যে তোমার সরল মনে দুঃখ দিয়েছে?”
বেগম সাহেবা চোখ তুলে তাকালেন। দৃষ্টিতে আগুন।
রাজ্যবাসীর সামনে মুখে যতই লম্বাচওড়া বুলি কপচান না কেন, ওই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে সুলতান বাহাদুরের বুক অজানা আতঙ্কে ঢিপঢিপ করতে লাগল। হাঁটু দুটিতেও কেমন যেন দুর্বলতা বোধ করলেন। তবুও মুখে গাম্ভীর্য এঁটে বললেন, “শয়তানটার নাম একবার বলেই দেখো না বিবিজান, ব্যাটাকে আমি এক্ষুনি শূলে চড়াব।”
“আমার কথা শুনে গলা ছেড়ে হাসল—কী দুঃসাহস!” অবশেষে মুখ খুললেন বেগম সাহেবা। পিকদানে পিচিক করে পানের পিক ফেলে ফুল-নকশা তোলা সাদা রেশমি রুমালে ঠোঁট মুছলেন তিনি। তারপর দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন, “তাও আবার কিনা একটা…”
“বলো কী, এ-রাজ্যে কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে তোমার কথা শুনে হাসবে?” সুলতান বাহাদুর এবার সত্যিই অবাক হলেন। মনে মনে বললেন, ‘এ-রাজ্যের হর্তাকর্তাবিধাতা হওয়া সত্ত্বেও আমিই যেখানে তোমার সামনে হাসতে সাহস পাই না, সেখানে…’
“একটা মাছ!” সুলতান বাহাদুরের দিকে কটমট করে তাকালেন বেগম সাহেবা।
“কী বললে? একটা মাছ?” সুলতান বাহাদুর হতভম্ব।
রাগে ফেটে পড়লেন বেগম সাহেবা।—“আমার কি শখ-আহ্লাদ থাকতে নেই, হ্যাঁ? আজ সকালে একটু ইচ্ছে হল মাছ কিনব। আগে কোনোদিন মাছ কিনিনি বলে যে আজও কিনতে যাব না, এমন মাথার দিব্যি কিন্তু আমি কাউকে কক্ষনও দিইনি বলে দিলাম।”
“তা তো বটেই। তা তো বটেই।” কেন, কী বৃত্তান্ত কিছুই না বুঝে শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন সুলতান বাহাদুর।
বেগম সাহেবা এবার খেঁকিয়ে উঠলেন—“জেনানা মহলে মাছ ঢোকাতে হলে যে আগেভাগে জেনে নিতে হয় ওটা ছেলে মাছ না মেয়ে মাছ—সে-খেয়াল কি আছে তোমার? অবশ্য, তোমার যে কাণ্ডজ্ঞান বলতে কিছুই নেই তা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে।” বেগম সাহেবা বসে বসে আপন মনে গজগজ করতে লাগলেন।
সুলতান বাহাদুর আর কী করেন, বোকার মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। খানিকক্ষণ এইভাবে দাঁড়ানোর পর তাঁর কপালে বিনবিনে ঘাম দেখা দিল। পিঠটা কেমন যেন কুটকুট করতে লাগল। ঘরের ভেতর কেমন যেন দম আটকানো পরিবেশ। সবমিলিয়ে বেজায় অস্বস্তি।
শেষমেশ অনেক সাহস সঞ্চয় করে সুলতান বাহাদুর কিছু একটা বলবেন বলে মুখ খুলতেই বেগম সাহেবা তাড়াতাড়ি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, “সে যাক গে, আসল ঘটনা হল একটা মাছ দেখিয়ে যেই না জেলেনিকে জিজ্ঞেস করেছি ও-মাছ ছেলে না মেয়ে, অমনি ঝুড়ির ভেতর থেকে ওই বেয়াদব মাছটা বিচ্ছিরিভাবে হো হো করে হেসে উঠল! উফ্, কী অসভ্য মাছ রে বাবা!”
সুলতান বাহাদুরের খোলা মুখ আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেল, তা থেকে একটাও শব্দ বেরোল না। তিনি বোকার মতো তাকিয়ে রইলেন বেগম সাহেবার মুখের দিকে। আসল কথাটা হল, সুলতান বাহাদুর ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছিলেন না এমন জটিল পরিস্থিতিতে কেমন উত্তর লাগসই হবে। পাছে বিপদে পড়েন, সেই ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিলেন।
তা দেখে বেগম সাহেবা আবার ফোঁস করে উঠলেন—“একটা সামান্য মাছ যদি আমার সঙ্গে, এই রাজ্যের বেগম সাহেবার সঙ্গে বেয়াড়াপনা করবার সাহস পায়, তার মানে এই দাঁড়ায় যে, এ-রাজ্যের সুলতানকে কেউ পাত্তাই দেয় না। এর পরিণতি যে কী মারাত্মক হতে পারে তা বুঝবার ক্ষমতা কি আছে তোমার? অ্যাঁ?” এক শ্বাসে এতটুকু বলে শেষমেশ থামলেন বেগম সাহেবা, হয়তো-বা শ্বাস নেওয়ার জন্যেই।
উত্তেজনার বশে সুলতান বাহাদুরের মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল—“আজব ব্যাপার তো! মাছ যে হাসতে পারে এমন কথা তো বাপের জন্মেও শুনিনি! স্বপ্ন-টপ্ন দেখোনি তো বিবিজান?”
“নিজের চোখে মাছটাকে দেখেছি, নিজের কানে তার বিচ্ছিরি হাসিটাও শুনেছি। আমাকে কি তুমি বোকা পেয়েছ নাকি?” ধমকে উঠলেন বেগম সাহেবা।
ধমক খেয়ে সুলতান বাহাদুর নড়েচড়ে বসলেন। শশব্যস্ত হয়ে বললেন, “না না, তা কেন হবে বিবিজান? তা কেন হবে? আমি তো জানি, তুমি যা যা বলেছ তার প্রতিটা বর্ণ সত্যি। দেশের-দশের মঙ্গলের জন্য আমার অবশ্যই জানা দরকার—মাছটা হাসল কেন।”
আর কথা বাড়ালেন না সুলতান বাহাদুর। তৎক্ষণাৎ ডেকে পাঠালেন উজির-এ-আজমকে।
(তিন)
দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে চিন্তিত মুখে পায়চারি করছিলেন সুলতান বাহাদুর। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে সেখানে হাজির হলেন উজির-এ-আজম।
সুলতান বাহাদুরের চোখে-মুখে অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট। দেখে উজির-এ-আজমের বুক দুরুদুরু করতে লাগল। সুলতান বাহাদুর কি পাশের রাজ্যের সঙ্গে আবার যুদ্ধ বাধাবার পরিকল্পনা করছেন নাকি! হায় হায়, অযথা অমন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মাতলে যে রাজকোষের ভাঁড়ে মা ভবানী দশা হতে বেশি দেরি নেই!
অবশেষে সুলতান বাহাদুর নীরবতা ভঙ্গ করলেন। গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, “শুনুন উজির-এ-আজম, আপনাকে একটা জরুরি তদন্তের দায়িত্ব দিতে চলেছি। আপনি হয়তো জানেন না, বেগম সাহেবার কথা শুনে একটা মাছ আচমকা হো হো করে হেসেছে। এর পেছনে পড়শি রাজ্যের গভীর চক্রান্তের গন্ধ পাচ্ছি। তাই বুঝতেই পারছেন, দেশের সুরক্ষার স্বার্থে এটা জানা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে—মাছটা হাসল কেন।”
উজির-এ-আজম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন সুলতান বাহাদুরের মুখের দিকে। মাছের হাসি! চক্রান্তের গন্ধ! দেশের সুরক্ষা! জরুরি তদন্ত! এসব কথার অর্থ তিনি আকাশ-পাতাল এক করেও বুঝতে পারছিলেন না। মাথার ভেতর সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল।
উজির-এ-আজমের অমন হাবভাব দেখে সুলতান বাহাদুর যারপরনাই বিরক্ত হলেন। মুখখানা ব্যাজার করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “আপনাকে ছ’মাস সময় দিলাম। এর মধ্যে তদন্ত শেষ করতে পারলে করুন, নইলে আপনার গর্দান নেব—মনে থাকে যেন।”
বেচারা উজির-এ-আজম আর কীই-বা করতে পারেন, চুপচাপ মাথা নীচু করে বেরিয়ে এলেন শাহি মহল থেকে। সুলতান বাহাদুরের হুকুম বলে কথা! যেনতেন প্রকারেণ হুকুম তামিল করতেই হবে তাঁকে, উপায় কী?
(চার)
মাছটা হাসল কেন? দিশেহারা উজির-এ-আজম এই হেঁয়ালির সমাধান করতে কোমর বেঁধে লেগে পড়লেন। পরবর্তী পাঁচ মাস ধরে তিনি শত শত জ্যোতিষী, ওঝা, ফকির, জাদুকরের দোরে দোরে ঘুরে বেড়ালেন। এমনকি জেলে, মাঝি-মাল্লা, জাহাজি, মেছুরে, কুমোর, কামার, ছুতোর, ভিস্তি, তাঁতি, ধোপা, নাপিত, চোর, ডাকাত—যাকে পেলেন তার সঙ্গেই শলা-পরামর্শ করলেন। অচেনা পথচলতি মানুষকে ধরে ধরে জেরা করতেও বাকি রাখলেন না। কিন্তু তাতে লাভের লাভ কিছুই হল না। ওঁরা ও-সমস্যার সুরাহা করবেন কী, মাছ যে মানুষের মতন করে হাসতে পারে সে-কথাটাই তো তাঁরা কস্মিনকালে শোনেননি। শেষমেশ পণ্ডিত, মৌলবি আর গণকদের দ্বারস্থ হলেন উজির-এ-আজম। তবে দুঃখের কথা হল, রাজ্যের সমস্ত পণ্ডিত আর মৌলবিরা কাঁড়ি কাঁড়ি পুথিপত্র ঘেঁটে, সকল গণকেরা গাদা গাদা আঁক কষেও এই রহস্যের সমাধান করতে পারলেন না।
হতাশায় ডুবে গেলেন উজির-এ-আজম। বাড়িতে দোর দিয়ে চুপটি করে বসে রইলেন। হিসেব করে দেখলেন, আর একটি মাত্র মাস তাঁর হাতে রয়েছে। অথচ এ-সমস্যা সমাধান করবার আর কোনও পথ তাঁর জানা নেই। এমতাবস্থায় ভাগ্যের কাছে নতিস্বীকার করা ছাড়া আর কীই-বা উপায় আছে! তা ছাড়া সুলতান বাহাদুরকে তিনি ভালো করেই চেনেন। বড্ড কঠোর মানুষ তিনি। তাঁর কথার নড়চড় হবার নয়। তাই উজির-এ-আজম নিশ্চিত ছিলেন, ছ’মাসের মধ্যে মাছটা হাসল কেন জানতে না পারলে তাঁর গর্দান যাবেই যাবে, কেউ তাঁকে বাঁচাতে পারবে না। তবে নিজের বাঁচা-মরার চাইতেও যে-বিষয়টি তাঁকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল, তা হল তাঁর পরিবারের সুরক্ষা। তিনি আশঙ্কা করছিলেন, সুলতান বাহাদুরের রাগ গিয়ে পড়তে পারে তাঁর একমাত্র কিশোর পুত্রের ওপর। তাই তিনি পুত্রকে খুব শিগগির রাজধানী শহর থেকে বহুদূরে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন।
(পাঁচ)
পিতার পরামর্শ মেনে উজিরজাদা গভীর রাতে রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে গেল। সারারাত ধরে মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, খাল-বিল পেরিয়ে সে ছুটতে লাগল। কখনো-বা সে দৌড়চ্ছিল গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, কখনও আবার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠছিল নামছিল। কোথায়, কোন দিকে চলেছে জানা নেই তার। তবু ঊর্ধ্বশ্বাসে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে সে। এভাবে চলতে চলতে একসময় ভোরের আলো ফুটল। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে একটা পায়েচলা পথ ধরে হাঁটতে লাগল উজিরজাদা। এমন সময় সে দেখল, সামনে এক সুবেশী ভদ্রলোক ওই একই দিকে হেঁটে চলেছেন। উজিরজাদা পা চালিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
সঙ্গী পেয়ে খুশি হলেন দুজনেই, পাশাপাশি চলতে লাগলেন। আলাপ-পরিচয় হতেই জানা গেল, ভদ্রলোক একজন সম্পন্ন কৃষক। দূর গাঁয়ে বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলেন। সেখানে কয়েকদিন থেকে আবার নিজের গাঁয়ে ফিরছেন। ওখান থেকে প্রায় ছ’ক্রোশ দূরে তাঁর গাঁ। সেখানে নিজস্ব খামার বাড়ি, গোরু-ছাগল ও বিস্তর জমিজিরেত রয়েছে। উজিরজাদা অবশ্য নিজের আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখল। বলল, কাজের খোঁজে এদিকে এসেছে সে।
দুই অসম বয়সি পথিক এভাবেই গল্পগাছা করতে করতে এগোচ্ছিলেন। সূর্য ইতিমধ্যে মাঝ আকাশে উঠে তীব্র আগুন ছড়াচ্ছে। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। অনেকটা পথ তখনও বাকি। উজিরজাদা আচমকা কৃষককে বলল, “আচ্ছা, পালা করে একে অন্যকে বইলে কেমন হয়? এতে কিন্তু পথচলার আনন্দ দ্বিগুণ হবে।”
কৃষক অবাক হলেন। তিনি কিনা বইবেন এই ধেড়ে ছেলেকে! মনে মনে বললেন, ‘ছেলেটিকে দেখতে যেমন খাসা, কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছিল বুদ্ধিও তেমনই ধার। কিন্তু এখন তো উলটোটাই দেখছি—বড্ড বোকা ছেলেটা।’ তাই কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকাটাই সমীচীন মনে করলেন তিনি।
অল্প খানিকটা এগিয়ে যেতেই দেখা গেল পথের দু-পাশে দিগন্তবিস্তৃত শস্যক্ষেত। অমন সোনা ঝলমলে শস্যক্ষেত দেখে কার না প্রাণমন জুড়োয়! কিন্তু এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য সম্পর্কে কোনও মন্তব্যই করল না উজিরজাদা। উলটে কৃষককে চমকে দিয়ে প্রশ্ন করে বসল, “এগুলো কি খাওয়া হয়ে গিয়েছে, নাকি হয়নি?”
কৃষক ভাবলেন, চড়া রোদে একটানা ঘুরেফিরে ছেলেটার মাথায় বোধ হয় গোলমাল দেখা দিয়েছে। তিনি ভেবে পেলেন না ঠিক কী উত্তর দেবেন। শেষমেশ বিরক্ত গলায় বললেন, “মহা মুশকিল হল তো! ওসব আমি জানব কীভাবে?”
হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা একসময় এসে পৌঁছলেন এক বিশাল শহরে। সেখানকার বাজার-হাট ঘুরে ওঁরা একটা মসজিদের ফটকে এসে দাঁড়ালেন। তাঁরা আশা করেছিলেন কেউ তাদের ভেতরে ডাকবেন, জলখাবার এগিয়ে দিয়ে খানিক জিরোতে বলবেন। কিন্তু তাঁদের হতাশ হতে হল। আদর-আপ্যায়ন তো দূরের কথা, কেউ তাঁদের ডেকে দুটো ভালো কথা পর্যন্ত বলল না।
উজিরজাদা হঠাৎ বলে উঠল, “আশ্চর্য! কী বিরাট কবরখানা!”
কৃষক এবার বেশ মজা পেলেন। ভাবলেন, ছেলেটা বলে কী রে! জ্যান্ত মানুষ গিজগিজ করছে চারদিকে, আর এই ছেলে বলে কিনা এটা কবরখানা! হয় এ-ছেলে ডাহা বোকা, নয় বদ্ধ উন্মাদ।
শহরকে পেছনে ফেলে কিছুটা এগোতেই পথে সত্যিই একখানা কবরখানা পড়ল। সেখানে একদল লোক ক্লান্ত-ক্ষুধার্ত পথচারীদের খাবারদাবার বিলোচ্ছিলেন, তাঁদের প্রাণপ্রিয় মৃতজনেদের স্মরণে। কৃষক ও উজিরজাদার হাতেও অনেক খাবার তুলে দিলেন তাঁরা। সঙ্গে সঙ্গে উজিরজাদা উল্লসিত হয়ে বলল, “আহা, কী চমৎকার শহর!”
কৃষক এবার প্রচণ্ড আতঙ্কিত হলেন। বিড়বিড় করে বললেন, “ছেলেটা নির্ঘাত পাগল। এর পরে কী যে করে বসবে কে জানে!”
(ছয়)
কথাবার্তা শুনে সাময়িকভাবে উদ্বিগ্ন হলেও ছেলেটিকে মোটের ওপর বেশ ভালোই লেগেছিল কৃষকের। যতই আবোলতাবোল কথা বলুক না কেন, ছেলেটির চলাফেরা মার্জিত, ব্যবহার নম্র। দেখলে ভদ্র ঘরের ছেলে বলেই মনে হয়। তাই কৃষক যখন তাঁর গ্রামে পৌঁছলেন, তখন তিনি ছেলেটিকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন।
উজিরজাদা তাঁকে ধন্যবাদ জানাল। তারপর লজ্জিত মুখে জিজ্ঞেস করল, “এমন প্রশ্ন করাটা অভব্যতা জানি, তবু জিজ্ঞেস না করে পারছি না—আপনার বাড়ির কড়িবরগা শক্তপোক্ত তো?”
কৃষক প্রথমে বুঝতে পারছিলেন না—হাসবেন, না কাঁদবেন। অবশ্য এতক্ষণে ছেলেটার অমন এলোমেলো কথাবার্তায় তিনি খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। তাই সামান্য হেসে ছেলেটাকে বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসালেন। তারপর অন্দরে গেলেন খবর দিতে।
(সাত)
“ছেলেটা নিঃসন্দেহে ভদ্র ঘরের। তবু কেন যে অনবরত আবোলতাবোল বকে বুঝতে পারি না! হয় সে অত্যন্ত বোকা, নয়তো পুরোপুরি উন্মাদ। জানো, এখানে আসতে বলায় জিজ্ঞেস করছিল, এ-বাড়ির কড়িবরগা শক্তপোক্ত কি না। বোঝো কাণ্ড।” পরিবারের সদস্যদের মাঝে বসে হাসতে হাসতে বললেন কৃষক।
কৃষকের কিশোরী মেয়েটি খুব বুদ্ধিমতী। সে চটপট বলল, “বলো কী গো আব্বাজান! আবোলতাবোল হতে যাবে কেন? ওর প্রশ্নটা তো একটা ধাঁধা। তুমি সেটার অর্থই বুঝতে পারোনি। ছেলেটি আসলে জানতে চেয়েছিল, ওকে নেমন্তন্ন করে ভালোমন্দ খাওয়ানো তোমার পক্ষে সম্ভব হবে কি না।”
কৃষক বিলক্ষণ জানেন, তাঁর মেয়ে ধারালো বুদ্ধির। তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, “ওহ্, তাই নাকি? তবে তো মনে হচ্ছে তুই ওর অন্য ধাঁধাগুলিরও সমাধান করতে পারবি। আচ্ছা, বল দেখি, পথচলার আনন্দ বাড়াতে পালা করে একে ওপরকে বইবার কথা ও বলেছিল কেন?”
“ও বলতে চেয়েছিল, পালা করে একে অপরকে গল্প শোনালে যাত্রার একঘেয়েমি কেটে যাবে, সময়টা আনন্দে কাটবে।” মেয়ে মুচকি হেসে উত্তর দিল।
“সে কি রে! আমি তো ওভাবে ভেবেই দেখিনি। তা, একটা শস্যক্ষেতের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, ও কেন জিজ্ঞেস করল সেগুলো খাওয়া হয়ে গিয়েছে না হয়নি?”
“ওহ্-হো আব্বাজান, এটাও বোঝোনি? ও জানতে চেয়েছিল, ওই শস্যক্ষেতের মালিক ঋণগ্রস্ত কি না। তিনি যদি ঋণগ্রস্ত হন, তা হলে ওই ক্ষেতের সব শস্য তো আর তাঁর থাকল না, তাই না? ধরে নেওয়া যায়, প্রায় সবটুকুই যাবে মহাজনের গোলায়।”
“তাই তো! ঠিক বলেছিস তুই। আচ্ছা যাক গে, তারপর এক শহরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা, বুঝলি? দাঁড়ালাম একখানা মস্ত মসজিদের ফটকে। কী আর বলব তোকে, আদর-আপ্যায়ন তো দূরের কথা, অত বড়ো একখানা শহরে একটা মানুষও ফিরে তাকাল না আমাদের দিকে! শেষে হাঁটতে হাঁটতে শহরের বাইরে এসে পৌঁছলাম একখানা কবরখানার সামনে। দেখি, একদল লোক খাবার বিলোচ্ছে। আমাদেরও কতরকম যে খাবারদাবার দিল! আমরা পেট পুরে খেলাম। কিন্তু ওই ছেলে কী বলল জানিস? বলে, ওই শহরটা নাকি কবরস্থান, আর কবরস্থানটা নাকি শহর।”
“দেখো বাবা, যে-শহরের মানুষ অতিথিসেবা করতে জানে না, তাঁরা তো মানসিকভাবে মৃত। তাঁদের শহরটাও তো তা হলে একরকম কবরস্থানই হল, তাই না? অথচ দেখো, একটা কবরস্থান, যেখানে কিনা মৃতদেরই বাস, সেখানে একদল ভালো মানুষ তোমাদের ডেকে আদর করে খেতে দিল। সেই যুক্তিতে দেখলে এই কবরস্থানকেই একখানা প্রাণচঞ্চল মানবিক শহর বলা চলে।”
“তা বটে! তা বটে!” কৃষক ক্রমেই তাজ্জব বনে যাচ্ছিলেন। বললেন, “এখন বুঝতে পারছি, ছেলেটা মোটেই পাগল নয়, যথেষ্ট জ্ঞানবুদ্ধি আছে ওর।”
মেয়ে হেসে বলল, “আমি তো তোমায় আগেই বলেছি আব্বাজান। ছেলেটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ। আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
কৃষক খুশি হয়ে বললেন, “বেশ তো! ওকে এক্ষুনি অন্দরে নিয়ে আসছি।”
“আমি যতটুকু বুঝেছি আব্বাজান, তা থেকে এটুকু বলতে পারি, তুমি ডাকলেই যে ও সুড়সুড় করে এখানে চলে আসবে তা কিন্তু নয়। আমাদের বাড়ির কড়িবরগা যে সত্যিই শক্তপোক্ত, তার প্রমাণ না পেলে ও কিছুতেই অন্দরে আসতে রাজি হবে না।”
“বলছিস! তাহলে উপায় কী?” কৃষক অবাক হয়ে জানতে চাইলেন।
“আরে দেখোই না আমি কী ব্যবস্থা করি। তখন ও ঠিক বুঝতে পারবে, বাড়িতে অতিথি এলে আমাদের কোনও সমস্যা হয় না।” বলেই কৃষকের মেয়ে জোরে হেসে উঠল।
বাটিভরা পায়েস, বারোখানা চাপাটি আর গেলাসভরা দুধ থালায় সাজিয়ে মেয়েটি তাড়াতাড়ি একটি চাকরকে ডেকে পাঠাল। সে হাজির হতেই ওকে বুঝিয়ে বলল, “বৈঠকখানায় গিয়ে অতিথিকে বলবে, পূর্ণিমার পূর্ণচন্দ্র, বারো মাসে বছর আর ভরা কোটালের সাগর।”
বৈঠকখানায় খাবারদাবার নিয়ে যেতে যেতে চাকরটির বড্ড খিদে পেল। প্রায় সবটুকু পায়েস, একটা চাপাটি আর কিছুটা দুধ সে লুকিয়ে খেয়ে নিল। তারপর নির্বিকার মুখে বৈঠকখানায় উপস্থিত হয়ে অতিথির সামনে রেখে দিল খাবারের থালা। মালকিনের বার্তাটি পৌঁছে দিতেও ভুলল না।
উজিরজাদা হাসিমুখে বলল, “তোমার মালকিনকে আমার আদাব জানিও। তাঁর আন্তরিক আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ। তাঁকে বোলো, ঈদের নবচন্দ্র, এগারো মাসে বছর, আর মরা কোটালের সাগর।”
চাকরটির স্মতিশক্তি ভালো, তবে বুদ্ধিশুদ্ধি তেমন নেই। তাই অর্থ না বুঝে সে গড়গড় করে মালকিনের সামনে গিয়ে কথাগুলো আওড়াল। সঙ্গে সঙ্গে তার কুকীর্তি ধরা পড়ে গেল। মালকিনের কাছে প্রচণ্ড বকা খেল সে।
(আট)
কিছুক্ষণ বাদেই কৃষকের সঙ্গে অন্দরে হাজির হল উজিরজাদা। উষ্ণ অভ্যর্থনা পেল সে। গোলাপ ফুলের সুগন্ধী ছিটিয়ে দেওয়া হল তার গায়। দস্তরখান বিছিয়ে তার জন্য সাজিয়ে দেওয়া হল রকমারি খাবার ও পানীয়। কৃষক ও তাঁর পরিবার অবশ্য তখনও তার আসল পরিচয় জানতেন না। কথায় কথায় উজিরজাদা অবশেষে নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ করল। বেগম সাহেবার কথা শুনে মাছের হাসি, ছ’মাসের মধ্যে তার পিতা উজির-এ-আজমকে মাছের হাসির কারণ খুঁজে বের করবার নির্দেশ সুলতানের, অন্যথায় পিতাকে প্রাণদণ্ডের হুমকি, শত চেষ্টা সত্ত্বেও তদন্তে তার পিতার ব্যর্থতা, নিজের নির্বাসন—কিছুই বাদ দিল না সে।
শুনেই কৃষকের মেয়ে ফিকফিক করে হেসে বলল, “আমি কিন্তু জানি মাছটা কেন বেগম সাহেবার প্রশ্ন শুনে অমন করে হেসেছিল।”
উজিরজাদা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাই নাকি? কেন বলো তো?”
কৃষকের মেয়ে একচোট হেসে নিয়ে বলল, “এ আর এমন কী কঠিন ব্যাপার! মাছটা হেসেছে, কারণ এদিকে বেগম সাহেবা জেনানা মহলে ছেলে মাছ ঢোকাতে রাজি নন, অথচ ওদিকে সেই জেনানা মহলেই সকলের অজান্তে লুকিয়ে বসে আছে একটা অচেনা পুরুষ মানুষ।”
“ও বাবা! সেটা কীভাবে সম্ভব?” উজিরজাদা অবাক।
“কেন? মেয়েদের সাজে সেজে জেনানা মহলে লুকিয়ে থাকতেই তো পারে কোনও পুরুষ!” মেয়েটি ঝটপট বলে উঠল।
“দারুণ বলেছ তো!” উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠল উজিরজাদা। এক পলকে ওর কপালের চিন্তার ভাঁজ মুছে গিয়ে মুখখানা জ্বলজ্বল করতে লাগল। আঙুলে গুনে সে উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, “ছ’মাস পূরণ হতে আরও দু-দিন বাকি। তার মানে আশার আলো এখনও নিভে যায়নি। এই দু-দিনের মধ্যে রাজধানীতে ফিরে গেলেই আমার আব্বাজানকে এই অপমানজনক মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারব।”
(নয়)
কৃষক পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পরদিন খুব ভোরে উজিরজাদা ঘোড়ায় চেপে রওনা দিল রাজধানীর উদ্দেশ্যে। সঙ্গে চলল কৃষকের মেয়েও। রাজধানীতে পৌঁছেই উজিরজাদা দৌড়ল পিতার কাছে। বেচারা উজির তখন সবকিছু ছেড়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছেন। মাছটা হাসল কেন জানতে না পারায় মৃত্যুই তখন তাঁর জীবনের একমাত্র সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন সময় হঠাৎ তাঁর পুত্র এসে কানে কানে তাঁকে এই হেঁয়ালির উত্তরটা জানাল। শুনেই উজির-এ-আজম তড়িঘড়ি পালকি চেপে সুলতান বাহাদুরের কাছে গেলেন। পুত্র যা বলেছে, তা-ই বললেন।
“বলছেন কী, জেনানা মহলে অচেনা পুরুষ!” সুলতান বাহাদুরের চোখ কপালে উঠবার জোগাড়। তারপর গম্ভীর মুখে কীসব চিন্তাভাবনা করে তিনি বললেন, “না না, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। এরকম হতেই পারে না।”
চোখ নামিয়ে দু-হাত কচলাতে কচলাতে উজির-এ-আজম বললেন, “কিন্তু তা-ই হয়েছে জাহাঁপনা!”
“নিজের প্রাণ বাঁচাতে এসব গাঁজাখুরি গল্প ফাঁদছেন না তো?” সুলতান বাহাদুর ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন উজির-এ-আজমের দিকে। এত সহজে কিছুই মেনে নিতে রাজি নন তিনি।
উজির-এ-আজম জিভ কেটে কান মলে বললেন, “লাহোল বিলা কুবত জাহাঁপনা! আমি যা বলেছি তা সত্যি কি না পরখ করে নিয়ে তবেই বিশ্বাস করবেন।”
সুলতান বাহাদুরের গলার স্বর খানিকটা নরম হল। বললেন, “তবে আপনিই পরখ করবার উপায় বাতলে দিন।”
“ইনশা-আল্লাহ জাহাঁপনা। প্রথমে শাহি বাগে একটা বিশাল গর্ত খোঁড়াতে হবে। তারপর দাসীবাঁদী সহ জেনানা মহলের সকল মেয়েদের সেখানে তলব করা হোক। বলা হোক, এটা একটা খেলা। যে এক লাফে এই গর্ত পেরোতে পারবে তাকে একশত স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে। দেখবেন, সবাই লাফিয়ে গর্তটা পেরোতে চাইবে। তখন লাফানোর কায়দা দেখেই ব্যাটাচ্ছেলেকে পাকড়ানো যাবে।” পুত্রের পরামর্শমতো সুলতান বাহাদুরকে গুছিয়ে বললেন উজির-এ-আজম।
(দশ)
উজির-এ-আজমের কথাগুলো সুলতান বাহাদুরের বেশ মনঃপুত হল। তিনি আর সময় নষ্ট না করে শাহি বাগে একখানা বিশাল গর্ত খোঁড়ার নির্দেশ দিলেন। যথাসময়ে সে-গর্ত খোঁড়া শেষ হল। সুলতান বাহাদুরের হুকুমে জেনানা মহলের মেয়েরা সব দলবেঁধে এলেন। একশত স্বর্ণমুদ্রা পাওয়ার আশায় গর্তটা লাফিয়ে পেরোতে চেষ্টা করলেন সকলেই। তবে এত বিশাল গর্ত লাফিয়ে পেরোনো তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! তাই পেরোতে পারলেন কেবল একজন—এক বাঁদী, যাকে জেনানা মহলের কাজে সদ্য বহাল করা হয়েছে। বেশ লম্বাচওড়া চেহারা তার। অবশ্য মুখখানা দেখবার উপায় নেই, মোটা ওড়নায় ঢাকা।
তল্লাশি চালাতেই জানা গেল, সে মহিলা নয় মোটেই, সে এক পুরুষ মানুষ। তদন্তে ক্রমশ বেরিয়ে এল, ওই অঞ্চলের এক কুখ্যাত ডাকাত সে, যার মাথার দাম নাকি এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা! কেউ বুঝতেই পারেনি শাহি খাজানা লুটবার উদ্দেশ্যে সেই ডাকাত মেয়ে সেজে জেনানা মহলে লুকিয়ে ছিল এতদিন!
যাক, শেষমেশ বেগম সাহেবা জানতে পারলেন মাছটা হাসল কেন। মুখে গর্বের হাসি ফুটিয়ে একটা সুগন্ধী পানের খিলি মুখে ফেলে তিনি সুলতান বাহাদুরের দিকে তেরছা চোখে তাকালেন। ভাবখানা এমন, তাঁর জন্যেই এত বড়ো রহস্যের ওপর থেকে পর্দা সরানো সম্ভব হল।
মুখে কিছু না বললেও সুলতান বাহাদুরের হাবভাব দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, তাঁর ধড়ে অবশেষে প্রাণ ফিরে এসেছে। কপালের গভীর ভাঁজ মুছে গিয়ে মুখে তখন কান এঁটো করা হাসি।
উজির-এ-আজমও এ-যাত্রা রক্ষা পেলেন। মহানন্দে ঘরে ফিরলেন পৈতৃক প্রাণটি সঙ্গে নিয়ে।
তবে ভুলে গেলে চলবে না, সবকিছু ভালোয় ভালোয় মিটে গেল কিন্তু ওই উপস্থিত-বুদ্ধিসম্পন্ন কৃষকের মেয়ের জন্যেই।
আর সব যেখানে ভালো তার শেষ তো ভালো হতেই হবে। তাই অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই উজিরজাদার সঙ্গে মহা ধুমধাম করে কৃষকের মেয়ের শাদি হয়ে গেল। সুলতান বাহাদুর নিজে সেই বিয়েতে বিশাল আয়োজনের বন্দোবস্ত করেছিলেন। কতশত লোক যে সেই শাদিতে কবজি ডুবিয়ে খানাপিনা করেছিল তার ইয়ত্তা নেই! আজও নাকি ও-রাজ্যের লোকজন সেই এলাহি শাদির স্মৃতি আওড়ে বেড়ায়।
(প্রাচীন লোককথা অবলম্বনে)
ছবি: রাখি পুরকায়স্থ
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু
হেরম্বপুর থানার দোর্দণ্ডপ্রতাপ দারোগা দিগম্বর দিকপতি। রগচটা, বদমেজাজি, কিন্তু কর্মনিষ্ঠ। যাঁর দাপটে অপরাধ-জগৎ কম্পমান! সেই দিকপতিকে তিষ্ঠোতে দেয় না ধুরন্ধর চোর সনাতন। নানান ভাবে, নানান ফিকিরে নাস্তানাবুদ করে তোলে দাপুটে এই বড়োবাবুকে। অকুতোভয় বড়োবাবু বাইরে প্রকাশ না করলেও মনে মনে সনাতনকে খুবই ভয় পান। কী জানি কখন কী করে ব্যাটাচ্ছেলে তাঁর মানসম্মান সব ধুলোয় মেশায়! সবসময়ই বাছাধনের মাথায় শুধু বুদ্ধির মারপ্যাঁচ! তাই সর্বদাই তাকে সমঝে চলতে হয়।
অপরদিকে সনাতনেরও দারোগাবাবুর ভয়ংকর বদমেজাজি রাগটাকে ভয়। কে জানে কবে তাকে মিথ্যে কেসে ফাঁসিয়ে যাবজ্জীবন সাজায় না জেলে পাঠান! সমস্ত বই জুড়ে শুধু এই দুই মহারথীর দ্বৈরথ।
কখনও সনাতন শেষ হাসি হাসলে কখনও দিকপতিও জয়ী হন। শুরু থেকে শেষ অবধি এই সংকলনের কুড়িটি গল্পে শুধু অত্যন্ত মজাদার এই দুই চরিত্রের অদম্য লড়াই। পাঠক হাসিতে লুটিয়ে পড়বেন কাহিনির বিন্যাসে। সঙ্গে সনাতনী সংলাপ আর দিগম্বরী প্রত্যাঘাত।
কুড়ি জন দিকপাল বিজ্ঞানীর অসাধারণ কর্মকাণ্ড আর জীবনের গল্প। যে বিজ্ঞানীদের হাত ধরে সভ্যতা এগিয়ে গিয়েছে, কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের ঢাকনা খুলে অনাবৃত হয়েছে বিজ্ঞানের সৌন্দর্য, যাঁদের আপসহীন জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানের জয়ধ্বজা উড়েছে, তাঁদের জীবনের অন্যান্য দিকগুলোও তুলে ধরা হয়েছে এই বইতে।