ছোটো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
ছোটো গল্প
বনে শেয়ালের ডাক কানে আসে। বিলাসের ঘুম নামে না চোখে। ঘুম পাড়ানোর জন্য ছেলেকে মজার মজার গল্পও বলে। এক রাতে মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে মধুসূদনদাদার গল্প শোনে বিলাস। গল্পটা তার বেজায় ভালো লাগে। সে ভাবে, মধুসূদনদাদার দেখা পেলে সেও তার দরকারি জিনিস চেয়ে নেবে।
অমিয় আদক
বিলাসদের বাড়ি জয়পুর জঙ্গলে। আসলে তাদের গাঁটাই জঙ্গলের মাঝে। বাড়ি বলতে যা বোঝায়, বিলাসদের তা নেই। সামান্য দোচালা খড়ের ছাউনি। ছিটে বেড়ার দেওয়ালঘেরা একটা কুঁড়েঘর। পাশেই পলিশিটের ছাউনি দেওয়া রান্না-চালা। জয়পুর জঙ্গলের মধ্যে বেশ কয়েকটা দরিদ্র আদিবাসী পাড়া। সেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পাড়াগুলোর মাঝেও পাতলা জঙ্গল। তেমন এক ছোট্ট পাড়ায় তিন পরিবারের বাস। সেই তিনটি পরিবারের মধ্যে বিলাস একমাত্র ছোটো ছেলে। তার কোনও খেলার সঙ্গী নেই। এটাই তার আপশোশ। সে খেলার জন্য দূরের পাড়ায় যেতে বাধ্য। তাই সবদিন খেলা তার বরাতে জোটে না। ইস্কুলটাও বেশ দূরে। স্কুলের পথে একাই যায়। বেশ ভয় লাগে। মাঝে-মাঝেই জংলি শেয়াল পাশ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। জঙ্গলে হরিণদেরও মাঝে মাঝে নজরে আসে। তারাও ভয়ে শুকনো পাতা মাড়িয়ে অন্যদিকে দৌড় লাগায়।
বিলাসের বয়স মাত্র ন’বছর। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। গায়ের রঙ মাজা কালো। মুখটা বেশ কেষ্ট ঠাকুরের মতো। একমাথা ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল। সেগুলোর ডগায় হালকা বাদামি আভা। ডাগর চোখ দুটো। জোড়া চওড়া ভ্রূ। আয়ত চোখ দুটো উজ্জ্বল। কথা বলে ধীরে ধীরে। ইস্কুলের দেওয়া পোশাকে তাকে ভালোই মানায়। তার বাড়িতে আলাদা পোশাক সামান্যই। তাকে ইস্কুলের পোশাকেই বেশি দেখা যায়।
ছেলেটার বাবা-মা পরের জমিতে মুনিশের কাজ করে। শুধু তারা নয়, প্রতিবেশী দুটো পরিবারও বেশ গরিব। বিলাসের মা সামান্য লেখাপড়া জানে। চার কেলাস পাশ করার পর তার মা দূরের স্কুলে আর পড়তে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। যতটুকু জানে সেইমতোই ছেলেকে সন্ধ্যায় পড়িয়ে দেয়। সব বিষয় পড়াতে না পারলেও ছেলের পড়ার সময় পাশেই থাকে। রাতে খাওয়ার পর শোয় বিলাসকে কাছে নিয়ে। বনে শেয়ালের ডাক কানে আসে। বিলাসের ঘুম নামে না চোখে। ঘুম পাড়ানোর জন্য ছেলেকে মজার মজার গল্পও বলে। এক রাতে মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে মধুসূদনদাদার গল্প শোনে বিলাস। গল্পটা তার বেজায় ভালো লাগে। সে ভাবে, মধুসূদনদাদার দেখা পেলে সেও তার দরকারি জিনিস চেয়ে নেবে। তাই মাকে প্রশ্ন করে, ‘মা, মধুসূদনদাদাকে ডাকলে তার দেখা মেলে?”
তার মায়ের উত্তর—“আমি গল্প হিসাবেই শুনেছি। ওই ছেলেটা তার মধুসূদনদাদাকে মন দিয়েই ডেকেছিল। তাই সে দেখা পেয়েছিল। ছেলেটার হয়তো ভাগ্যি ভালো। তোর বরাত ভালো হলে, তুইও ডাকলে মধুসূদনদাদার দেখা পাবি। তবে খুব আকুল হয়ে মনে মনে ডাকতে হয় তাকে। তবেই দেখা মিলতে পারে।”
মায়ের কথাটা পুরোপুরি বুঝতে পারে না বিলাস। আকুল হয়ে ডাকা কেমন, সেটাও জানে না। তবুও মায়ের উত্তরটা তার মনে ধরে। সে ভাবে, মধুসূদনদাদা সত্যিই খুব ভালো। তার বয়সি ছেলেমেয়েদের কথা শোনে। তাদের সাহায্য করে। সেও ডাকবে সেই মধুসূদনদাদাকে। সেও একদিন দেখা পাবে তার কল্পনার মধুসূদনদাদার।
বিলাস ইস্কুল যাওয়ার সময় মধুসূদনদাদাকে ডাকার কথা ভাবে না। তাড়াতাড়ি পৌঁছলে অন্যদের সঙ্গে খানিক খেলার সুযোগ থাকে। তাই তাড়াতাড়ি পা চালায়। স্কুল শুরুর আগে ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে খেলে। স্কুলের ক্লাসে সে মন দিয়েই পড়া শোনে। স্যার-ম্যাডামরা প্রশ্ন করেন। সে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। সবদিন এক্কেবারে সঠিক উত্তর দিতে পারে না। তার ইংরাজি-অঙ্কটাই কঠিন লাগে। ওই দুটো বিষয় ক্লাসেও তেমন বুঝতে পারে না। তার মাও ঠিকমতো পড়িয়ে দিতে পারে না। মধুসূদনদাদার সঙ্গে দেখা হলে তাকেই পড়িয়ে দেওয়ার কথা বলবে। এমনটাই সে ভেবে রাখে। তাই স্কুল ফিরতি পথে মনে মনে মধুসূদনদাদাকে ডাকে। সেই ডাকে আকুলতা, আন্তরিকতার অভাব থাকে না। তার সঙ্গে সে বনের রাস্তার দু-পাশে তার সন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে চলে। মধুসূদনদাদাকে দেখার জন্য। কিন্তু কোনোভাবেই তার মধুসূদনদাদার দেখা মেলে না।
পাশের গ্রামের সৌরীন কলেজে পড়ে। বাস-স্ট্যান্ডে সাইকেল রাখে। প্রায় প্রতিদিন জঙ্গলের রাস্তায় সাইকেল চড়ে বাড়ি ফেরে। সেও তার কলেজ ফিরতি পথে বিলাসকে দেখে। বিলাসের হাঁটার সঙ্গে দু-দিকের বনজঙ্গল দেখাটাকে সৌরীন খেয়াল করে। একদিন সে বিলাসের সামনেই সাইকেল থেকে নামে। তার নাম-পরিচয় জানার চেষ্টা করে। বিলাস দ্বিধা না করেই উত্তর দেয়। তারপর থেকে সৌরীন চালু সাইকেলের গতি কমিয়ে ‘আসছি রে বিলাস’ বলেই বেরিয়ে যায়। এমনিভাবেই তাদের সামান্য পরিচয়। তার মধ্যেই একটা অগোছালো এবং অজ্ঞাত পলকা সম্পর্কের টান গড়ে ওঠে।
একদিন সৌরীন জিজ্ঞাসা করে, “হ্যাঁ রে বিলাস, তুই রাস্তায় যেতে যেতে কার কথা ভাবিস বল তো?”
“আমি রোজ মধুসূদনদাদার কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরি। তাকে ডেকে পেতেই হবে। নইলে আমার লেখাপড়া ভালো হবেনি দাদা।”
“তা মধুসূদনদাদা তোর ক্যামন সম্পর্কের দাদা?”
“মা গল্প বলেছিল মধুসূদনদাদার। আমি সেই মধুসূদনদাদাকেই খুঁজি বটে।”
“শোন বিলাস, সেই মধুসূদনদাদার যুগ কবেই ফুরিয়েছে। মন দিয়ে হাজার ডাকলেও তার সাড়া পাবি না। তা তোর মধুসূদনদাদার কাছে কী চাওয়ার আছে সেটা না হয় আমাকেই খুলে বল।”
“জানো, আমি ভালো অঙ্ক শিখতে পারিনি। তার সঙ্গে ইংরেজি। যদি মধুসূদনদাদার দেখা পাই তাইলে অঙ্ক, ইংরেজি শিখিয়ে দিতে বলব।”
“তাহলে তোর আর অঙ্ক, ইংরেজি শেখা হবে না।”
“কেন হবেনি?”
“ওরে বোকা, সেই মধুসূদনদাদার দেখা পাওয়া একান্তই অসম্ভব। তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।”
“তাহলে তার দেখা মিলবেনি তুমি বলছ? কিন্তু মা তো বুলেছিলো…”
“যাক গে, শোন। তোর সঙ্গে আমার তো প্রায়ই দেখা হয়। আমি যদি ইংরেজি-অঙ্ক শিখিয়ে দিই? তোর আপত্তি আছে?”
“কেন আপুত্তি থাগবে? তাইলে কবে থেনে অঙ্ক-ইংরেজি শিকাবে?”
“বলিস তো আজ থেকেই শেখাতে পারি।”
“আজ থিকেই!” বিস্ময়ে বিলাসের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
“অবাক হওয়ার কিছু নেই। চল বিলাস, ওই পাশে আশুদগাছটার তলায় বসি। ওখানে বসেই তোকে শেখাব।”
দুজনা বসে গাছের তলায়। মিনিট পঁচিশ সময় ধরে সেদিন ক’টা অঙ্কের নিয়ম শেখায় সৌরীন। তারপর দুজনাই যে-যার বাড়ি যায়। এমনিভাবেই সৌরীন প্রতিদিন প্রায় আধঘণ্টা সময় খরচ করে বিলাসের জন্য। একদিন অঙ্ক, পরের দিন ইংরেজি পড়ায় সৌরীন। বিলাসের মা সামান্য দেরিতে ফেরার জন্য ছেলের কাছে কোনও কৈফিয়ত চায় না।
মাঝে সৌরীন বিলাসকে জিজ্ঞাসা করে, “কী রে, বাড়িতে আমার কথা বলেছিস নাকি?”
“এখনও মাকে বলিনি।’
“বাড়ি ফিরতে দেরি হলে, মা জিজ্ঞাসা করলে মিথ্যে বলবি না। তবে তোর মাকে জানাতে পারিস। আমার আপত্তি নেই।”
এমনি করেই সৌরীনের সাহায্য চলতে থাকে। বিলাস নিজেকে লেখাপড়ায় স্বচ্ছন্দ বোধ করে। সব বিষয় পড়ায় তার আগ্রহের মাত্রা বাড়ে। স্কুলের সাময়িক মূল্যায়নপত্র বেরোয়। তার লেখাপড়ার উন্নতিতে স্কুলের স্যার-ম্যাডামরাও খুশি। ক্লাসে বিলাস তাঁদের প্রশংসাও পায়।”
সামনে বাৎসরিক মূল্যায়ন। বিলাসের জেদ বাড়ে। একটু বেশি সময় পড়াশোনা করে।
সার্বিক মূল্যায়ন শেষ। সেদিন বিলাসের ভাষায় ‘রেজাল আউট’। মূল্যায়নের কাগজ দেখে বিলাসের মা। তার চোখে-মুখে খুশি উপচে পড়ে। ছেলেকে জিজ্ঞাসা করে, “অ্যাত্তো ভালো নম্বর কী করে পেলি বিলাস? আমি তো স্বপনেও ভাবি নাই।”
“মা, তোমাকে আমি বলি নাই একজনের কতা। তার কতা তোমায় লুকাইছিলাম।”
“কার কতা রে বাপ?”
“সে হল গে আমার সৌরীনদাদা। তুমি তারে চিনবেনি। সেই সৌরীনদাদা রোজ তারিক আমারে পড়ায়ে দিত। ইস্কুল থিকে ফিরার রাস্তায়। খালের পাশে, আশুদগাছের তলে। আমারে অঙ্ক আর ইংরেজি শিখাই দিত।”
“আমারে তবে তার কতা বলিসনি ক্যানে?”
“ওই যে ইংরিজি কতাটা—সারপ্রাইজ, তার মানে জানো?”
“জানি না বাছা। বল না ক্যানে, মানেটো কী?”
“অবাক করি দেওয়া। তোমারে অবাক করার লেগ্যেই তো বলি নাই।”
“তোর সৌরীনদাদার সাতে জানাচেনা কী করে হল?”
“আমি তো রোজ মধুসূদনদাদার কতা ভাবতে ভাবতে ইস্কুল থিকে ফিরতাম। একদিন সৌরীনদাদা কইল, কী অত ভাবতে ভাবতে যাস রে? আমি মিছা কই নাই। আমি বলি, মধুসূদনদাদার কতা ভাবি। আমারে জিগাইল, কোন মধুসূদনদাদা? আমি তুমার কওয়া গল্পটা বলি। ওই দাদা কয়, আজকের দিনে মধুসূদনদাদকে ডেকে পাবি না। আমি তোকে পড়াই দিব। সেই থিকে রোজ অঙ্ক, ইংরেজি পড়াই দিত। তাই তো…”
“শোন বাছা, তুই মন দিয়ে ডাকলি তাই তুয়ার ওই দাদার মধ্যে দিয়েই আসল মধুসূদনদাদা তোরে অঙ্ক-ইংরাজি শিখাই দিল।”
মায়ের কাছে পাওয়া উত্তরটা তাকে অবাক করে। বিলাসের মনে খানিক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল।
ছবি: সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু