ছোটো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
ছোটো গল্প
আজ ইঞ্জিন সাজাবার দিন। বুড়োদাদাও যাবে ওর বাবার ছবি ফুল দিয়ে সাজাতে। আজকের দিনেই চিতাবাঘের থাবায় সাহেব আর ড্রাইভার মরে গিয়েছিল। তার নাম ছিল ইন্দ্রবাহাদুর থাপা। তার ছেলে পূরণবাহাদুরকে আরও একটা আদমখোর বাঘে মারে। সাহেবের ছেলে আর কোম্পানি চালাতে চায়নি। স্টেশন সেই থেকে পড়ে আছে যেমন-কে-তেমন। শুধু ইন্দ্রবাহাদুরের বাড়ির লোক এখনও আছে পাহাড়টায়। এখান থেকে একটা লোহার টুকরোতেও হাত দেবার উপায় নেই কারও।
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য
স্টেশনটার নাম নেই। নাম একটা ছিল হয়তো, এখন তার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের মাঝে কোথাও কোথাও রেললাইন থেকে গেছে। হয়তো লাইন তুলে নীচে নামিয়ে নেওয়ার খরচ পোষায়নি বলে। অনেক জায়গায় ধ্বস নেমে লাইন চলে গেছে মাটি আর পাথরের তলায়। একটা আধভাঙা গুমটি আর তিন-চারটে ছোটো মাপের কামরা আর খুদে ইঞ্জিন লতাপাতা জড়িয়ে আছে গুমটির ভাঙা চালার তলায়। দুশো বছর আগে সাহেবরা বসিয়েছিল লাইনটা। একশো বছর হল স্টেশন বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। ইঞ্জিনের গায়ে লেখা আছে কনডেমড। স্টেশন আর গাড়িগুলোর গায়েও তাই। চার্চের ফাদার বলেন, ইঞ্জিন খারাপ হয়নি। তেল-টেল দিলে চলতে পারে এখনও।
সাহেবরা এখানে স্টেশন বসাতে গেল কেন? রেললাইন বসানোর কত খরচ! তার ওপর ওই রেলগাড়ি, ইঞ্জিন? চলেই-বা গেল কেন? হাত দশেক লম্বা একটা সিমেন্টের ব্রিজও আছে পাহাড়ি নালার ওপর। সেখানেও লাইন বসানো। অত গভীর নালার ওপর ব্রিজ বানায় যারা, তারা তো এমনি এমনি বসাবে না!
এসব কথা মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় ভুনা-মুনা দুই বোনের। বড্ড ছোটো বলে গুছিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারে না কাউকে। ছোট্ট হলেও খুব বুদ্ধি ওদের। যমজ বোন বলে নিজেদের মধ্যে কতরকম কথাবার্তা হয় ওদের। নিজেরাই উত্তর খুঁজে নেয়। দাদা থাকলে ও নিজের জানাটুকু বলে। দাদা পাহাড়ের নীচে বোর্ডিংয়ে থেকে ইস্কুলে পড়ে। শনি-রবি ঘরে ফিরলে ওর সঙ্গেও কথা হয়। দাদা মনবাহাদুর ওদের থেকে তিন বছরের বড়ো, ও জানে অনেক। ফোর ক্লাসে পড়ে। সাহেবদের কথা ওর কাছেই শোনা। সাহেবরা নাকি আকাশে উড়তেও পারে, দাদা বলেছে। ওদের বুঝি ডানা আছে? পাহাড়ে যারা রেলগাড়ি চালাতে পারে তাদের ডানা থাকতেও পারে!
ক’দিন আগে ওদের একটা ভাই হয়েছে। খুব শীত বলে ওকে গরম কাপড়ে জড়িয়ে দোলনায় রেখে মা দুই বোনকে পাহারায় বসিয়ে কাঠ কুড়োতে যায়। ভাইটা শুয়ে শুয়ে হাত-পা নাড়ে, কাঁদে না। ওর থুল্পু থুল্পু শরীর উপুড় হতে শেখেনি। গোলাপি গাল ফুলিয়ে বুবুবুবু করে কত কথা বলে; পাখির মতো সরু শব্দ করলে মা বোঝে ওর খিদে পেয়েছে। বেশি দূরে যায় না মা, শব্দ কানে গেলেই চট করে এসে দুধ খাইয়ে যায়। দুই বোনও খায় শখ করে। তিনটেকেই নিয়ে বসে মা।
অনেক নীচে চোরবাটুর বাঁকে দুটো রঙিন বিন্দু দেখা যায়। দুই বোন দেখতে পেয়ে হাত নাড়ে। মনবাহাদুরকে নিয়ে ওদের বাবা আসছে ঘরে। ইস্কুল ছুটি দশদিন। একাই আসতে পারে মন, শুধু পাইনবনের দিকে তাকালে গা ছমছম করে বলে বাবাকে আনতে যেতে হয়। ওখানে সাহেবের কবর। কোন সাহেবের কে জানে, সবাই জানে সাহেবের কবর। কবে মারা গেছিল তাও জানা নেই। বড়দিনের ছুটি বলে বাড়ি আসছে মনবাহাদুর। পিঠের ওপর একটা বোঝা এতদূর থেকেও বোঝা যায়। ওর বইয়ের বোঝা বাবা নরবাহাদুরের কাঁধে। কী আনছে বাবা? কাছে না এলে বোঝা যাচ্ছে না।
মাচাঘর থেকে বুড়োদাদা নেমে আসছে। পিছু পিছু দাদি। চা খেতে বসার পর দুই বোন ওদের বোতল নিয়ে ঝরনার দিকে গেল খাওয়ার জল ভরে আনতে। বুড়োদাদা ওই ঝরনার জল ছাড়া খেতে চায় না। বনে অনেক ফুল ফুটেছে। মাটির কাছের ফুলগুলো তুলে আনা যায়। রডোডেনড্রনের ফুলের গোছা অনেক উঁচুতে বলে ওরা তলা থেকে ঝরে পড়া পাপড়ি কুড়োয়। রোজ জল নিয়ে আসার সময় ফুল নিয়ে আসে ওরা। গুমটিতে বুড়োদাদার বাবার ছবি আছে, ওখানে সাজিয়ে দেয় রোজ। ছবির তলার লেখা ওরা পড়তে পারে না। দাদাকে দিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। তবে তার নাম ছিল পূরণবাহাদুর।
আজ সকাল থেকে দূরের পাহাড়-বন সব কুয়াশায় সাদা হয়ে ছিল। অনেক ফুল পেল ওরা। পাইনবনের মাথায় রোদ এল এতক্ষণে। ওরা ঘরে আসতে আসতে মনদাদা আর বাবা এসে পৌঁছে গেল। হাত ধুয়ে খেতে বসার পর দাদা কানে কানে বলল, “সাহেবের কবরের কাছে একজনকে দেখলাম রে! চেনা নয়। মনে হল সাহেব। ভালো করে দেখতে পাইনি কুয়াশায়।”
ভুনা দাদার পাশে ঘেঁষে বসল। ভয় পেয়েছে। “ভূত-টুত না তো?”
“সকালবেলা ভূত দেখা যায় না।” মাথা নাড়ল মনদাদা।
ঢক করে বাটির দুধটুকু গিলে উঠে দাঁড়াল মুনা। “চল দাদা, উঁচু গাছের ফুলগুলো পেড়ে দিবি। অনেক হয়ে আছে।”
ছোট্ট ভাইটা ঘাড় কাত করে ওদের দিকে দেখছে। পারলে এখুনি যায় ওদের পিছু পিছু। ওকে আদর করে ছুট দিল ওরা।
আজ ইঞ্জিন সাজাবার দিন। বুড়োদাদাও যাবে ওর বাবার ছবি ফুল দিয়ে সাজাতে। আজকের দিনেই চিতাবাঘের থাবায় সাহেব আর ড্রাইভার মরে গিয়েছিল। তার নাম ছিল ইন্দ্রবাহাদুর থাপা। তার ছেলে পূরণবাহাদুরকে আরও একটা আদমখোর বাঘে মারে। সাহেবের ছেলে আর কোম্পানি চালাতে চায়নি। স্টেশন সেই থেকে পড়ে আছে যেমন-কে-তেমন। শুধু ইন্দ্রবাহাদুরের বাড়ির লোক এখনও আছে পাহাড়টায়। এখান থেকে একটা লোহার টুকরোতেও হাত দেবার উপায় নেই কারও। পুরোনো কাগজে সেরকমই লেখা আছে। মাইনেও আসে মাসে মাসে কোম্পানি উঠে গেলেও। পাহাড়তলির চার্চ থেকে নিয়ে আসে ওদের বাবা প্রত্যেক মাসে। নাকি জমানো টাকার সুদ থেকে মাইনে হয় দেড়শো বছর ধরে। এসব বলেছে সাংবীরদাদা। পড়িলিখি লোক, একশো বছর বয়েস তার। এখনও খুরখুর করে হাঁটে। অনেক দূর পাহাড়তলির গ্রাম থেকে উঠে আসে ওদের সঙ্গে দেখা করতে। ওরাও যায় পাল-পার্বণে। এখানে আর কেউ আসে না। আজ বুড়ো আসবে।
এই পাহাড়ে জঙ্গল পার হয়ে আসবে কেন কেউ? সাপখোপ আছে, জংলি জানোয়ার আছে। আগে নাকি হাতি উঠে আসত বাঁশের গোড়ার লোভে। এখন আর আসে না অনেকদিন। এখন আছে পাহাড়ি ছোটো শেয়াল, লাল পাণ্ডা আর চিতাবাঘ। পাহাড়ি মানুষকে ওরা কিচ্ছু বলে না। এড়িয়ে চলে। অবশ্য পোষা মুরগি মারবার লোভে বাড়ির আনাচে-কানাচে আসে মাঝে মাঝে। আসে রাতের অন্ধকারে গা লুকিয়ে, চুপিচুপি। মানুষ মারে না।
তবে যদি বলো সাহেব আর ইন্দ্রবাহাদুর চিতার থাবায় মরল কেন? বলতে হয়, সাহেব বন্দুক ছুড়ে ঘায়েল করল কেন? সাহেব মরল। তাকে বাঁচাতে গিয়ে মরে গেল ড্রাইভার ইন্দ্রবাহাদুর। রেখে গেল কোম্পানির চাকরি আর দুটো কুকরি। জঙ্গলের মাঝে রেললাইন, ইঞ্জিন আর আস্ত একটা ইস্টিশন রেখে সাহেবের ছেলে কোম্পানি তুলে দিয়ে কোথায় চলে গেল কেউ জানে না। সেই সাহেবেরই কবর নীচেয় পাইনবনে।
“এখানে রেলগাড়ি কেন হল বুড়োদাদা?” মনবাহাদুর জিজ্ঞেস করে।
বুড়োদাদা আর বুড়োদিদাও এসে গেছে ফুল সাজানো দেখতে। নাতির কথার জবাব দিতে যত না কথা বেরোয় বুড়োর মুখ থেকে, হাঁপায় তার চেয়ে বেশি। বুড়ি চুপ করে শোনে।
“জঙ্গল কেটে কফি আর সিঙ্কোনার চাষ করল তো সাহেব। আর হল চা বাগান। কয়লাখনি হল। ছোটো গাড়ি ইঞ্জিন হল। এত ছোটো ডিব্বায় মানুষ যায় না তো, মাল বওয়া হয় শুধু। আমার পরদাদা হল ডেরাইভার।”
“বাঘের কথাটা বলো।”
“কতবার বলব! কম লোকে কাজ চলত কোম্পানির। বাগান খুব বড়ো নয় বলে ওতেই কাজ চালাত সাহেব। নিজেও খাটত খুব। আড়কাঠিরা লোক আনতে চেষ্টা করলেও তারা আসত না।”
“কেন আসত না?”
“এখানে আসতে কম পরিশানি! নীচে তো তখন শহর বসেনি। ঘন জঙ্গল, বড়ো বড়ো জানোয়ার। মরার ডর নেই লোকের? তার ওপর পায়ে হেঁটে আসতে হত পুরো পথ। নীচে তখন রেল কম চলত। নদীতে নৌকো করে আর পায়ে হেঁটে আসতে হত লোককে।”
“ঘোড়া ছিল না?”
মনবাহাদুরের কথায় খুব খুশি বুড়োদাদা। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বুদ্ধি আছে ছেলেটার। “ঠিক বলেছিস। বড়োলোকদের ঘোড়া ছিল। ঘোড়া নয়, খচ্চর। গরিবদের হাঁটতে হত। অত খাটনি করতে চাইত না কুলিরা। কম লোকেও ভালো চলছিল কোম্পানির কাজ।”
“বাঘের কথাটা বলবে তো!”
“সাহেব খচ্চরের পিঠে চড়ে কাজ দেখে বেড়াত। মাঝে মাঝে শিকার করত। বড়ো কিছু না, হরিণ, বন ছাগল, পাখি এসব। মাংসের জন্যে শিকার। একদিন একটা চিতার গায়ে গুলি করে বিপদ হল। বাঘটা মরল না, ঘায়েল হয়ে পালিয়ে গেল জঙ্গলে। কুলিরা বলল, একে মেরে ফ্যালো সাহেব। ও খতরনাক হয়ে গেছে। এবার মানুষ মারবে। সাহেব বাঘটাকে আর খুঁজেই পেল না। শেষে একদিন বনের পথে সাহেবকে বাঘে ধরল। আমার পরদাদা ওকে কুকরি মেরে শেষ করল বটে, তবে মরবার আগে থাবা মেরে শেষ করল তাকেও। সাহেব মরল তিনদিন পরে।”
ইঞ্জিনটাকে পরিষ্কার করে ধোয়ার পর ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ভাইবোনেরা সাজগোজ করে এসেছে। ওদের মা-বাবা ছোটো ভাইটাকে দোলনাসুদ্ধু নিয়ে এসেছে। ইঞ্জিনের ভেতর দোলনাটা টাঙানোর পর খুব খুশি সবাই। সাহেবের ফেলে যাওয়া একটা টুপি আর পরদাদার বাঘ মারা কুকরিটা খুব সুন্দর করে সাজানোর পর সবাই ইঞ্জিনটা ঘিরে বসল। এবার খাওয়াদাওয়া শুরু হবে। অনেক দূর থেকে আরও লোকজন আসছে মাথায় করে খাবার নিয়ে। ভুনা, মুনা আর মন নেচে নেচে নেপালি গান গাইছে, এমন সময় দুটো ঘোড়া এসে দাঁড়াল গুমটির পাশে।
“নরবাহাদুর কার নাম?”
ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়াল একজন। তার সাহেবি পোশাক হলেও মাথায় মাড়োয়ারি পাগড়ি। শহরে ওর বড়ো ব্যাবসা আছে। আর আছে চোরাই কারবার। নরবাহাদুরের কানে কানে বলল একজন।
অন্য ঘোড়া থেকে নেমে এল একজন পাক্কা সাহেব। সুন্দর চেহারার লোকটা মাথা থেকে টুপি খুলে হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল ইঞ্জিনের কাছে। পিছনে লেগে আছে দুই বোন। সাহেবের কোটের তলায় ডানা লুকোনো আছে কি না দেখবার ইচ্ছে। মনবাহাদুরও আছে সঙ্গে। এই সাহেবকেই দেখেছে আজ সকালে পাইনবনে মনে হচ্ছে ওর। সাহেবের কাঁধের ব্যাগে ক্যামেরা ছিল। ওটা বার করে ছবি তুলতে তুলতে ইঞ্জিনের মধ্যে উঠে পড়ল। মাড়োয়ারি লোকটা দু-হাত কোমরে দিয়ে ওকে দেখছে। ওর মুখের ভাব, ফোটো তুলে আর কী হবে। এখানে আসার পর সাহেব ওর সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। মুখ বুজে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। বাকিদের মুখেও কোনও কথা নেই। উৎসব থামিয়ে সবাই চুপচাপ। কথা বলল মাড়োয়ারি লোকটা। “তোমাদের ঘর এখানে?”
“হ্যাঁ, সাহেব।”
“কেন থাকো এখানে? কাজ কী করো?”
“কোম্পানির সব মাল পাহারা দিই। ইস্টিশন, ইঞ্জিন, লাইন সব। আর আছে সিঙ্কোনার বন, কফি আর চায়ের বাগান। দুশো বছর সব দেখে রাখি আমরা।”
“কোম্পানি বিক্রি হয়ে যাবে জানো?”
“না তো! ফাদার বলেনি তো কিছু! কে কিনবে?”
“আমি কিনব। সাহেব এখন মালিক। বিদেশ থেকে এসেছে সব কাগজ নিয়ে।”
“আমাদের কী হবে?”
“চলে যেতে হবে। বসবে আমার লোক।”
“কোথায় যাব আমরা?”
“তা আমি কী জানি! সাহেব কাগজে সই করলে সব আমার।”
চুপ করে আছে সবাই। এমন আজব কথা গত দুশো বছরে কেউ ভাবতে পারেনি, শোনা দূরের কথা। বাঁশবনে গা লুকিয়ে একটা ‘ডিড ইউ ডু ইট’ পাখি ডাকছে শুধু ‘টুইট টুইট’।
একটা সাদা বিন্দু উঠে আসছে নীচ থেকে। বুড়ো ফাদার আসছে। বড়দিনের উৎসব করাতে। আধঘণ্টা লেগে যাবে এখানে আসতে। কিছুই বুঝতে পারছে না কেউ। সাহেব শুধু ছবি তুলেই যাচ্ছে, কথা বলেনি একটাও। বললেও কি কেউ বুঝত? ইংরিজি জানে না কেউ।
মাড়োয়ারি লোকটা পান মুখে দিয়ে নরবাহাদুরের মুখোমুখি পাথরে বসল। “আমাকে চেনো তো? আমার চার পুরুষের ব্যাবসা শহরে। হোটেল আর প্রমোটারিও আছে। আমি চাই কোম্পানি কিনে ব্যাবসা বাড়াতে।”
“কোম্পানি কেনা হয়ে গেছে?”
“সাহেব সই করলেই কাজ শেষ। ও ঠিক বেচবে। বন্ধ কোম্পানি কেউ রাখে?”
“সাহেব তো কিছু বলছে না।”
“ও জানে কী যে বলবে? ওদের চা-কফি, সিঙ্কোনার ছাল, দারুচিনি সারাদেশে সাপ্লাই দিত আমার বাবা পরদাদা। ও শুধু সই দেবার আগে দেখতে এসেছে। শেষবারের মতো।”
“ঠিক আছে। ফাদার আসুক, কথা বলি।”
“আরে ফাদার কী বলবে? বুড়োর কথার দাম আছে? বলব তো আমি। তোমাদের উঠতে হবে। কিছু কিছু পয়সা পাবে।”
“যদি কেউ ছেড়ে না যেতে চায়?”
পানের পিক ফেলল মাড়োয়ারি। মুখে বাঁকা হাসি। “কথা শুনে চলে গেলে ভালো। আমি বেফালতু ঝামেলা চাই না। না গেলে ব্যবস্থা করতে হবে।”
ফাদার এসে হাসিমুখে সকলের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। “মেরি ক্রিসমাস বন্ধুরা। যিশু সবাইকে আনন্দে রাখুন। বাহ্, ইঞ্জিন-স্টেশন এত সুন্দর করে সাজাল কে? আমার কাছে এসো মন, ভুনা আর মুনা।”
ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিল ফাদার। সাহেব ক্যামেরায় তুলে রাখল ছবি। ফাদার ওকে কাছে ডাকল। নীচু গলায় কিছুক্ষণ কথা বলে সবাইকে কাছে ডেকে বসাল।
“ওর নাম হেনরি। ও দেখতে এসেছে ওর পূর্বপুরুষের জায়গা। তোমাদের কথা আমার কাছে শুনেছে ও। খুশি হয়েছে। ও এখানে থাকবে একমাস। তোমরা সঙ্গে থাকবে। একমাস পরে আবার আসব আমি। তখন জানা যাবে ও কী ঠিক করল। এখন আনন্দ করো। ওর দোভাষী এসে পৌঁছবে একটু পরে।”
“এই স্টেশনের নাম কী ফাদার?” বলল মনবাহাদুর।
“সে কি! জানো না? লেখা ছিল, উঠে গেছে। এর নাম ছিল মেরিল্যান্ড।” একটু দূরে মুখ বাঁকাল মাড়োয়ারি।
সবচেয়ে খুশি হল ফাদার ইঞ্জিনটা দেখে। সাবান জল দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে ছোট্ট ইঞ্জিনটাকে। ভেতরে গিয়ে আরও অবাক ফাদার। মনবাহাদুরের ছোট্ট ভাইটা দোলনায় শুয়ে মায়ের দুধ খাচ্ছে চোখ বুজে। চারদিকে শীতের কুয়াশা-মাখা রাঙা রোদে সদ্য ফোটা রডোডেনড্রন আর টাইগার লিলির সাজ। আজ বড়দিন। ফাদারের চোখে জল এল। বুকে ক্রস এঁকে চোখ বুজে রইল ফাদার গোমেজ কিছুক্ষণ। সাহেব চুপ করে বসে আছে ইঞ্জিনের ড্রাইভারের বসার সিটে। ওর মাথায় কী খেলছে কে জানে। মাড়োয়ারি ওর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আর একটা পান মুখে দিল। সাহেবের মন নেই যেন ওর দিকে। কানে কানে গুনগুন করে কত কথাই বলল লোকটা। সাহেবের মন যেন ইঞ্জিনের যন্ত্রপাতির দিকে। মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকিয়ে দেখল শুধু।
সাহেবের দোভাষী পৌঁছে যাওয়ার পর মাড়োয়ারি উঠে বসল ঘোড়ায়, একাই।
দোভাষী বিশাই টুডু জাতে সাঁওতাল। ফাদারের কাছে ছোটবেলা থেকে বড়ো হওয়ায় ইংরিজি জানে কাজ চালানোর মতো। কোম্পানির চা-কফি বাগানে ওর পূর্বপুরুষ কাজ করত। সাহেব বিশাইকে কাছে ডাকল। ও বেদির ওপর টুপি আর কুকরি দেখে ছবি তুলছে। বিশাই এসে দাঁড়াল। ফাদার তাকিয়ে আছে সেদিকেই, এবার উঠে দাঁড়াল।
“ওটা এখানকার সরল বিশ্বাসের সিম্বল মাই সন। ওই টুপি তোমার ফোরফাদারের। টুপির তলায় পাবে সেই বাঘটার দাঁত। কুকরির ঘায়ে বাঘটা মেরে মরেছিল বীর শহিদ ইন্দ্রবাহাদুর।”
সাহেব আস্তে আস্তে ছুঁল টুপিটা। তারপর ছুঁল কুকরিটাকে।
“ওরা মনে করে সাহেব আর ইন্দ্রের আত্মা থেকে গেছে এখানেই। মেরিল্যান্ড ছেড়ে কোথাও যায়নি। আর আছেন জেসাস।” পাশেই দোলনাটায় দোল দিয়ে হাসছে ফাদার। “এবার বলো, মাড়োয়ারির কথায় কোম্পানি বেচবে? নাকি আবার কাজ শুরু করবে? এক্ষুনি না বলে সময় নাও, একমাস পরে চার্চে জানিও কী করতে চাও।”
বিকেল হতে দেরি নেই। ঘোড়ায় উঠে রওনা দিল ফাদার। সঙ্গে গেল গ্রামের একজন।
সাহেবের তাঁবু খাটানো হল স্টেশনের পাশেই। তেলের বাতি জ্বেলে কাজে লেগে গেল সাহেব। রাতে কাজ বন্ধ হওয়া চলবে না। বিরাট একটা ম্যাপের ভাঁজ খুলে দোভাষীকে নিয়ে সেটা টাঙানো হল। রাত নেমে এল নির্জন গ্রামে। দূর থেকে যারা এসেছিল, ফিরে গেছে যে-যার ঘরে।
সাহেব কথা বলে খুব কম। বোঝাই যায় না ওর মনে কী চলছে। দোভাষীর কাছ থেকেও তেমন কিছু খবর বার করা যায়নি। গ্রামের মানুষ দম বন্ধ করে অপেক্ষায় আছে সাহেব কী করে। সেই থেকে গোটা জঙ্গল সারাদিন কাজে ব্যস্ত। পুরো এলাকাটা যেন যন্ত্রপাতি দিয়ে চষে ফেলছে ওরা। খুদে ইঞ্জিন আর স্টেশন সব ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে ফেলেছে। ওরা ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করছে নাকি? নইলে নরবাহাদুরের কাছে লাইন খুঁড়ে কাজ করাতে লোক চাইল কেন? মুছে যাওয়া মেরিল্যান্ড নামটা অমন নতুন করে লেখাই-বা কেন? কী করতে চায় সাহেব? হয়তো মাড়োয়ারির হাতে তুলে দেবার আগে জায়গাটা একটু পরিষ্কার চেহারায় আনতে চাইছে সাহেব। এতদিন বাদে নতুন করে কোথায় গিয়ে আশ্রয় পাওয়া যাবে ভাবতে গিয়ে কূল-ঠিকানা পায় না মানুষগুলো। শেষে ফাদার সকলকে ডেকে পাঠায় চার্চের মাঠে। সাহেব ইঞ্জিনের জন্য দোভাষীকে নিয়ে কাজে নেমে গেছিল, সেখান থেকে পৌঁছে গেল চার্চের সামনে।
সাহেব খুব কম কথার মানুষ। ফাদার যখন জিজ্ঞেস করল, কী ঠিক করলে বলো সবাইকে, সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “বড্ড ঠান্ডা পড়েছে। আপনারা আরও কাছাকাছি এসে দাঁড়ান।” এবার বলল, “আপনারা কী চান? কোম্পানি থাকবে, না বিক্রি হয়ে যাবে?”
মনবাহাদুরের আর দুই বোনের সরু গলা শোনা গেল, “থাকবে।”
সাহেব একগাল হেসে বলল, “আমিও তাই চাই। তবে এখন থেকে এই মেরিল্যান্ড আর আমার একার নয়, তোমরা সবাই এর মালিক। কফি, চা, সিঙ্কোনা বাগান চলবে আগের মতোই, রেলগাড়িও চলবে আবার। আমরা সবাই এর অংশীদার। কাগজপত্র সব রইল ফাদারের কাছে, তোমরা সবাই টিপসই দাও।”
মাড়োয়ারি লোকটা আজও এসে দাঁড়িয়ে ছিল সবার পেছনে। ঘোড়ার পিঠে নেমে গেল শহরের দিকে। পাহাড়ের ওপর থেকে ইঞ্জিনের হুইসল ভেসে এল কুউউউ। সেরে ওঠা ইঞ্জিন চালিয়ে দিয়েছে বিশাই টুডু। ও এখন নতুন ড্রাইভার।
ছবি: বিজয় বোস
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্যের অসামান্য লেখায় ও আঁকায় কিশোর গল্প সংকলন।
গুণময় রায় বিজ্ঞানী মানুষ। নিজের পরিচয় দেন ‘ইনভেনটর’ বলে। বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও তুখোড়। আবার ভারতীয় পুরাণ, ইতিহাস এবং পুরাতাত্ত্বিক বিষয়েও তাঁর গভীর জ্ঞান। কখনও নিজের মনোজগত, কখনো-বা প্রজন্মবাহিত স্মৃতির সরণিতে অক্লেশে ঘুরে বেড়ান ‘গুণময় দ্য গ্রেট’, আর পাঠকেরাও সুযশ মিশ্রের জবানিতে স্বাদ পায় সেই অতুলনীয় অ্যাডভেঞ্চারগুলির।