লোককাহিনি
FREE SHIPPING IN INDIA
লোককাহিনি
সেদিন রাত নিশুত হলে সবাই যখন ঘুমিয়ে কাদা, সেই গুল্মটি অপরূপ এক সুন্দরী নারীর রূপ ধারণ করল ধীরে ধীরে। ঘর ভরে উঠল দোলনচাঁপার মিষ্টি সুগন্ধিতে। গুল্মকুমারী ঘরদোর নিকিয়ে, এঁটো থালাবাসন ধুয়ে, ভাত আর পঞ্চব্যঞ্জন রেঁধে ফেলল চোখের পলকে। তারপর পানের বাটা টেনে নিয়ে বসল পান সাজাতে। এক খিলি নিজের গালে পুরে আবার গুল্ম হয়ে পড়ে রইল মাচার ওপর, যেমনটি ছিল।
রাজীবকুমার সাহা
ছোট্ট এক গাঁ। তাতে সাত ভাইয়ের বাস। সবাই গেরস্ত, জুমচাষি। ঘরে সাত বউ। রোজ জুমে গিয়ে তারা চাষবাস করে।
ভাইদের মধ্যে সবার ছোটোটির নাম লকই। একদিন জুমে কাজ করতে করতে একটা গুল্ম কুড়িয়ে পেল সে। সাধারণ কোনও লতাপাতা নয়, দেখতে গোল এবং দারুণ সুগন্ধ তার। তক্ষুনি বড়ো ভাই আর বউদের ডেকে দেখাল সে। তারপর কোমরে গুঁজে রাখল সেই গুল্ম। জুম থেকে ফেরার সময় নিয়ে এল বাড়িতে। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে অবধি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গুল্মটা দেখতে লাগল লকই, দেখে আর আশ মেটে না। শেষে এক মাচার ওপর যত্ন করে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল সে। স্ত্রী-সহ বাড়ির সব্বাইকে নিষেধ করে দিল ওই গুল্মে যেন হাত না দেয় কেউ।
ছোটো বউয়ের নাম ছিলাইকুমারী। অত্যন্ত নোংরা প্রকৃতির মেয়ে সে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ না ধুয়েই যা পায় তাই খায়। ঘরদোর ঝাঁট দেয় না, সংসারের কাজকর্ম করে না, জুমেও যায় না। নিজেও অপরিষ্কার থাকে, চুলে চিরুনি দেয় না। দেখতে-শুনতেও যেন রাক্ষুসিটি।
সেদিন রাত নিশুত হলে সবাই যখন ঘুমিয়ে কাদা, সেই গুল্মটি অপরূপ এক সুন্দরী নারীর রূপ ধারণ করল ধীরে ধীরে। ঘর ভরে উঠল দোলনচাঁপার মিষ্টি সুগন্ধিতে। গুল্মকুমারী ঘরদোর নিকিয়ে, এঁটো থালাবাসন ধুয়ে, ভাত আর পঞ্চব্যঞ্জন রেঁধে ফেলল চোখের পলকে। তারপর পানের বাটা টেনে নিয়ে বসল পান সাজাতে। এক খিলি নিজের গালে পুরে আবার গুল্ম হয়ে পড়ে রইল মাচার ওপর, যেমনটি ছিল।
ভোরে ঘুম ভেঙে উঠেই সব দেখেশুনে ছিলাইকুমারী যেন আকাশ থেকে পড়ল। তাড়াতাড়ি ঠেলে তুলল স্বামীকে। বলে, “লকই, অ লকই, ওঠ। কাজে যাবি না?”
লকই উঠে দেখে ঘরদোর আজ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। রাঁধাবাড়াও শেষ। চারদিকে একটা মিষ্টি সুবাস। সে আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে রইল ছিলাইকুমারীর মুখে। ছিলাইকুমারী কিছু ভাঙল না।
এমনি করে দিন যায়। রোজই গুল্মকুমারী মাঝরাতে রেঁধেবেড়ে রাখে। ছিলাইকুমারীইও এমন ভাব করে যেন সে-ই করে সব। লকইও রোজ জুমে যাবার সময় বউকে শাসিয়ে যায় তার সেই গুল্মে যেন হাত না দেয়। সন্ধেতে ফিরে এসেই প্রথম পরখ করে গুল্মটাকে। লকই মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে সেটাকে। বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণই সে বসে থাকে হাতে নিয়ে। এই না দেখে ছিলাইকুমারী তো রেগে আগুন। মনে মনে ফন্দি আঁটে, স্বামী যখন তার চেয়ে ওই গুল্মটাকেই বেশি ভালোবাসে তখন এর একটা বিহিত করতেই হবে।
একদিন লকই জুমে যাবার পর গুল্মটাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে এল ছিলাইকুমারী। লকই ফিরে এসে খুব রাগারাগি করল। ফল কিছুই হল না। সেই থেকে তার মনখারাপ। চাষে যায় না, খায়-দায় না; সারাদিন উদাস মুখে বসে থাকে উঠোনের পাশের শিমুলতলায়। ওদিকে ঘরদোর নোংরা, রান্নাবান্নাও হয় না আর আগের মতো।
একদিন সেই আস্তাকুঁড়েতে এক লেবু গাছ জন্মাল। দু-তিনমাসের মধ্যেই একটা লেবু ধরল তাতে। যে-সে লেবু নয়, দারুণ দেখতে। লকই দেখতে পেয়ে তুলে এনে মাচায় রেখে দিল। বউকে সাবধান করে দিল তাতে হাত না দিতে। নইলে এইবারে সে ছেড়ে কথা কইবে না।
সেদিন থেকে আবার সুগন্ধে ভরে উঠল সেই ঘর। রাঁধাবাড়া, সংসারকর্ম সব নিমেষেই হয়ে যেতে লাগল। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে লেবু সব কাজ সেরে রাখে। পান সাজে। তারপর এক খিলি পান মুখে দিয়ে লকইয়ের কাপড়ের কোণে পিকের দাগ রেখে যায় রোজ। লকই ছাড়া আর কেউ কিছু বুঝতে পারে না। লকই আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়, মনমেজাজে ফুর্তি ফিরে আসে। গুল্মের মতোই লেবুটিকে ভালোবাসে সে। তবে আজকাল কথা বলে খুব কম। বউয়ের সঙ্গে তো নয়ই। যখন তখন ধমকায়। দিনে দিনে ছিলাইকুমারীর অসহ্য ঠেকে। সে টের পায় ওই লেবুটিই হচ্ছে তার লাঞ্ছনার মূল।
একদিন লকই জুমে গেলে লেবুটি কেটে খেয়ে ফেলে ছিলাইকুমারী। তার বিচি আর খোসা ছুড়ে ফেলে এল দূরে। বাড়ি ফিরে লেবুটিকে দেখতে না পেয়ে অস্থির হল লকই। জেরার মুখে ছিলাইকুমারী স্বীকার করল যে সে খেয়ে ফেলেছে সেটি। রাগে অগ্নিশর্মা হল লকই।
দু-দিন পর সেই লেবুর বিচি থেকে গজিয়ে উঠল এক লাউ গাছ। সে এক আশ্চর্য জিনিস। ইয়া লম্বা বাঁশের মতো সব তার লতাপাতা। বাইতে বাইতে কখন এসে উঠেছে বাড়িতে। লকই উঠোনের এক পাশে বাঁশ বেঁধে মাচা করে দিয়েছে। সারা উঠোন জুড়ে ছড়িয়েছে সেই গাছ। কিন্তু তাতে লাউ ধরল মাত্র একটি। যেমন বড়ো তেমনি সুন্দর দেখতে। একদিন ছিলাইকুমারী স্বামীর তাড়নায় উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে, এমনি সময় লাউয়ের ভেতর থেকে কে একটি মেয়ে বেরিয়ে এসে এক লাথি কষিয়ে মুহূর্তে ঢুকে গেল তাতে। ছিলাইকুমারী আচমকা লাথি খেয়ে মাটিতে পড়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সেদিন থেকে রোজই একটা করে লাথি খায় সে। কিন্তু ফিরে আর কাউকে দেখতে পায় না।
লকইয়ের বারণ আছে জেনেও ছিলাইকুমারী একদিন বলে, “এই আপদ লাউ গাছের জন্যে তো উঠোনটা ঝাঁট দেওয়া যায় না ভালো করে। লাউটা খেয়ে গাছটা কেটে ফেললে হয় না?”
লকই লাঠি নিয়ে তেড়ে এল এ-কথা শুনে। শেষে পোক্ত হলে লাউটা এনে ঘরে তুলে রাখল সে একদিন। আবার সেই আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। লকইর মনে আনন্দ ফিরে এসেছে। সংসারের কাজকর্মও নিমেষেই হয়ে যাচ্ছে। ছিলাইকুমারীর ঈর্ষাও বেড়েছে। সে জানে, এই লাউই এর মূল। সেই আক্রোশে লাউটা একদিন কেটেকুটে রেঁধে ফেলল সে। কিন্তু শক্ত পাকা লাউয়ের সেই তরকারি আর খেতে পারল না। ছড়াতে ফেলে দিয়ে এল। যথারীতি লকই ফিরে এসে লাউ খুঁজে না পেয়ে অনেকক্ষণ রাগারাগি করে শেষে মনমরা হয়ে পড়ল।
লাউ জলে পড়ে এইবারে হল এক ল্যাটা মাছ। ছিলাইকুমারী জল আনতে গেলে সেই জল সে ঘোলা করে দেয়। হয়রানির একশেষ। বাড়ি এসে সে কান ভাঙাল স্বামীর। লকইও ধারণা করতে পারেনি সেই ল্যাটা মাছ আসলে কে। সেও রেগেমেগে মাছ ধরে আনল। ছিলাইকুমারী কেটেকুটে রান্না করল। কিন্তু খেতে বসে গলায় কাঁটা ফুটে মরবার উপক্রম। ফলে মাছ আর খাওয়া হল না, ফেলেই দিতে হল।
সেই জায়গায় মাটি ফুঁড়ে উঠল এল নারকোল গাছ। তাতে নারকোলও ধরল মাত্র একটা। লকই সেই নারকোল পেড়ে এনে ঘরে রাখল। আর তার পরেই মন্ত্রের মতো আপনাআপনি হয়ে যেতে লাগল সমস্ত সংসারকর্ম। লকইয়ের খুব ভাবনা হল। ব্যাপারখানা তবে কী?
সেই দেখে লকইয়ের বন্ধুরা মিলে চেপে ধরল একদিন। বলে, “কী রে, দিনদিন অমন রোগা হয়ে যাচ্ছিস কেন তুই?”
লকই সব খুলে বলল বন্ধুদের। তারা বুদ্ধি দিল—“কিছু একটা রহস্য তো আছেই। তুই বরং রাত জেগে পাহারা দিয়ে দেখ না দু-দিন।”
লকই ভাবনায় পড়ে যায়।—“সারাদিন জুমে খাটি। সন্ধের পর শরীর আর দেয় না। রাত জাগব কী করে বল?”
“চিন্তার কিছু নেই। তুই বরং কড়ে আঙুল একটা কেটে রাখিস। যন্ত্রণায় ঘুম আসবে না।”
লকইয়ের বিশ্বাস হয় না। বলে, “যদি চোখ লেগে যায় তারপরও?”
“তাহলে মাঝে মাঝে নুন লাগিয়ে দিবি কাটা জায়গায়। বাপ বাপ করে ঘুম পালাবে।”
তাই হল। আর সেদিন রাতেই লকই দেখে সেই নারকোল থেকে অপূর্ব এক সুন্দরী মেয়ে বেরিয়ে এসেছে। তারপর চারদিকে তাকিয়ে থুতু ফেলে বলে, “ছি ছি, ছিলাইকুমারীটা মানুষ, না পেত্নী! কী ছিরি করে রেখেছে দেখো ঘরের! এ যে গোয়ালঘর।”
এই বলে ঘরদোর পরিষ্কার করতে লেগে পড়ল সে চটপট। তারপর ভাত-তরকারি রেঁধে, বাসনকোসন ধুয়ে পান সাজতে বসল। এক খিলি পান মুখে দিয়ে উঠতে যাবে এমন সময় লকই এক ঝটকায় উঠে এসে জাপটে ধরল সেই মেয়েকে। মেয়েটি আপ্রাণ চেষ্টা করল নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে, কিন্তু পারল না। লকই একে লুকিয়ে রেখে এল অন্য ঘরে।
তারপর রাত থাকতেই গভীর বনে দুই মানুষ সমান এক গর্ত খুঁড়ে তাতে কাঁটা বিছিয়ে এল সে। ছিলাইকুমারীকে নিয়ে গেল সেখানে। এক ধাক্কায় তাকে গর্তে ফেলে দিয়ে দ্রুত মাটিচাপা দিল। শেষে বাড়ি ফিরে সেই গুল্মকুমারীকে বিয়ে করে সুখে সংসার করতে লাগল লকই।
(ত্রিপুরদেশের লোককাহিনি)
ছবি: অঙ্কিতা মণ্ডল
লেখকের অন্যান্য লেখা
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু