ছোটো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
ছোটো গল্প
আজ এই ২১২৩ সালে বিগত শতাব্দীর তুলনায় পৃথিবী যেন এক স্বপ্নের দেশ। মানুষকে আর সেই অর্থে জীবিকানির্বাহও করতে হয় না। রাষ্ট্রই তার সব প্রয়োজন মেটায়। প্রায় সব কাজই যন্ত্র করে। এমনকি প্রযুক্তিগত প্রাথমিক গবেষণাও যন্ত্র নিজেই করে। মানুষের কাজ এখন দুটি—সর্বোচ্চস্তরে এ.আই-কে দিকনির্দেশ করা এবং পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান বা দর্শনের মতো কিছু বিষয়ে মৌলিক গবেষণা করা।
বিশ্বদীপ সেনশর্মা
“The only way to predict the future is to create it.”
—Abraham Lincoln
(এক)
সায়ন ঘুম থেকে উঠে দেখল তার ঘরের দেওয়াল-জোড়া স্ক্রিনে একটা মেসেজ ফ্ল্যাশ করছে—‘কাইন্ডলি কল এফ.বি.আই।’
সায়ন একটু অবাক হল। এফ.বি.আই হল ফেডেরাল ব্যুরো অফ ইন্টেলিজেন্স। এরা খুব শক্তিশালী সংস্থা। আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের ক্ষেত্রে গোটা পৃথিবীর যাবতীয় গবেষণা, নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা এদের হাতে। সায়ন নিজে গবেষণার কাজে যুক্ত হলেও তার কাজ ঠিক আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স নিয়ে নয়।
সে কল-ব্যাক করল। একটু পরেই দেওয়ালের পর্দায় একটি অল্পবয়সি হাসিখুশি মেয়ের ছবি ভেসে উঠল। বলল, “গুড মর্নিং সায়ন, আমার নাম মারিয়া। আমরা কি পাঁচ মিনিট কথা বলতে পারি?”
সে বলল, “হ্যাঁ, বলুন।”
মেয়েটি বলল, আপনাদের একটা পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চাই। আপনি হয়তো জানেন আপনার প্রপিতামহ শ্রী রঞ্জন বসু সে-যুগের একজন বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক ছিলেন।”
রঞ্জন সায়নের জন্মের আগেই মারা যান। তবে তাদের ফ্যামিলির ডিজিটাল আর্কাইভে সায়ন এঁর সম্বন্ধে জেনেছে। এই আর্কাইভ প্রথা বহুবছর আগেই চালু হয়েছে—পরিবারের প্রতিটি সদস্যের ছবি, ব্যক্তিগত তথ্য, সংক্ষিপ্ত জীবনী, দিনলিপি এবং আরও যে-কোনো বা নির্দেশ এতে নথিবদ্ধ করা যায়। সরকার কঠোর সুরক্ষায় এর রক্ষণাবেক্ষণ করে। পরিবারের সদস্যরা অনেক প্রজন্ম পরেও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে পূর্বপুরুষদের সম্বন্ধে এখানে জানতে পারেন। রঞ্জনও এখানে নিজের কথা লিখে রেখে গেছেন।
সায়ন বলল, “হ্যাঁ, জানি। উনি ব্রেন-মেশিন ইন্টারফেস নিয়ে কাজ করতেন।”
মারিয়া হেসে বলল, ”ঠিকই বলেছেন। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমাদের ব্রেন আসলে অসংখ্য নিউরোন বা নার্ভ-সেল দিয়ে তৈরি। এরা পরস্পরের মধ্যে এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সিগন্যাল বিনিময় করে চলেছে। এগুলিই আমাদের চিন্তা, স্মৃতি, অনুভূতি, এমনকি চেতনার জন্যও দায়ী। এগুলি রেকর্ড করে মেশিনের সঙ্গে ইন্টারফেস করে অনেক ব্যবহারিক প্রয়োগ করা সম্ভব। যেমন, মাথায় একটি হেলমেট পরিয়ে আমরা মানুষের চিন্তা উদ্ধার করতে পারি এবং একে অন্যের সঙ্গে টেলিপ্যাথিতে কথা বলতে পারি। একইভাবে আমরা স্মৃতির পাঠোদ্ধার করতে পারি। উলটোদিকে আমাদের মস্তিষ্কে বিশেষ কিছু সিগন্যাল পাঠিয়ে আমরা আমাদের খারাপ স্মৃতি মুছে দিতে পারি। এরকম অনেক প্রযুক্তি নিয়ে অনেকদিন ধরেই কাজ চলছে। সময় লাগলেও এখন অনেকগুলিই আমাদের আয়ত্তাধীন—কিছু ইতিমধ্যেই বেরিয়ে গেছে, কিছু সম্ভাব্য অপব্যবহারের কথা চিন্তা করে সরকার এখনও অনুমোদন দেয়নি।”
সায়ন শুনছিল। এ সবই সে জানে। টেলিপ্যাথিক হেলমেট এখন বাজারে পাওয়া যায়, সে না কিনলেও ব্যবহার করে দেখেছে। কিন্তু একশো বছর আগে রঞ্জন যে কাজ করে গেছেন তা নিয়ে এদের আগ্রহ কেন?
সে প্রশ্নটা করল। মারিয়া হেসে বলল, “কারণ, উনি সমসাময়িক বৈজ্ঞানিকদের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন। আজকাল আমরা ব্রেন-ম্যাপিংয়ের জন্য যে প্রযুক্তি ব্যবহার করি, তার ভিত ওঁর হাতেই তৈরি। কিন্তু উনি প্রচারবিমুখ ছিলেন বলে ওঁর নাম বিজ্ঞানী মহলের বাইরে খুব বেশি লোকে জানত না। সম্প্রতি আমাদের নজরে আসে যে ওঁর সমসাময়িক কোনো-কোনো বিজ্ঞানী রঞ্জনের কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। আমরা আগ্রহী হয়ে ওঁর সম্বন্ধে আরও খোঁজখবর নিতে শুরু করি।”
সায়ন আগ্রহভরে শুনছিল। তার প্রপিতামহ যে এত বড়ো মাপের বৈজ্ঞানিক ছিলেন, এটা জেনে তার ভালো লাগছে।
মারিয়া বলল, “আমরা যেটা জানতে পেরেছি তা খুব ইন্টারেস্টিং। উনি জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে একটা খুব বড়ো কাজে হাত দিয়েছিলেন। এই কাজের কথা ওঁর এক সহবিজ্ঞানী ছাড়া কেউ জানত না। ঘটনাচক্রে তাঁর পারিবারিক সূত্রে ওঁর ডিজিটাল আর্কাইভ থেকে কিছু লেখা আমাদের হাতে এসেছে যাতে উনি লিখেছেন, ‘স্যারের এই কাজ সফল হলে প্রযুক্তির ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে।’ আরও অনেক পরে উনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে কাজ প্রায় শেষ হবার মুখে। দুর্ভাগ্যক্রমে এর পরেই তিনি মারা যান। রঞ্জন তাঁর কাজ শেষ করতে পেরেছিলেন কি না সে সম্বন্ধে আমরা আর কিছু জানি না। আমরা ভাবছিলাম এ-ব্যাপারে আপনি হয়তো আমাদের সাহায্য করতে পারেন।”
সায়ন বিস্মিত হয়ে বলল, “কীভাবে?”
মারিয়া বলল, “সেটা আপনাকেই ভাবতে হবে। উনি মারা গেছেন প্রায় চল্লিশ বছর আগে। পেন-ড্রাইভ বা হার্ড-ডিস্কের ব্যবহার তার অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছিল, তবে খুব ব্যক্তিগত তথ্য রাখার জন্য কেউ কেউ ব্যবহার করতেন। আপনার বা আপনার মায়ের কাছে ওঁর ব্যবহৃত কোনও জিনিসপত্র থাকলে সেখানে দেখতে পারেন। এছাড়া আপনাদের ফ্যামিলির ডিজিটাল আর্কাইভে দেখতে পারেন। আমাদের ধারণা, উনি এত বড়ো একটা কাজের ব্যাপারে কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই কিছু লিখে গেছেন।”
সায়ন হেসে বলল, “দুটোরই কোনোটাই নয়। প্রথমত, উনি যদি কিছু রেখে গিয়েও থাকেন, আমাদের প্রজন্ম অবধি পৌঁছায়নি, অনেকদিন আগেই হারিয়ে গেছে। আর ফ্যামিলি আর্কাইভে ওঁর লেখা আমি পড়েছি। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতিচারণা আছে, সেই সময়ের কিছু ছবি ও ভিডিও আছে, ওঁর কাজের ব্যাপারে কিছুই লেখা নেই। উনি কী নিয়ে কাজ করতেন সেটাও আমি আমার দাদুর লেখা থেকে জেনেছি।”
মারিয়া বলল, “তবু আমি অনুরোধ করব আপনি আর একবার সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখুন। আর উনি যদি কিছু রেখে গিয়ে থাকেন তার জন্য আলাদা পাসওয়ার্ড অবশ্যই থাকবে। আপনি কি পারিবারিক সূত্রে এরকম কিছু পেয়েছেন?”
সায়ন একটু ভাবল। তারপর বিদ্যুচ্চমকের মতো তার মনে পড়ল বহুবছর আগে বাবা তাকে দুটি পাসওয়ার্ড দিয়ে ফ্যামিলি আর্কাইভে ঢোকার জন্য প্রথমটি ইউজ করতে বলেছিলেন। অন্যটি কীসের জন্যে তিনি বলেলনি বা হয়তো সায়নের মনে পড়ছে না। সেটা কি রঞ্জনের দেওয়া কোনও পাসওয়ার্ড? একই সঙ্গে তার মনে হল, রঞ্জন কী নিয়ে কাজ করেছিলেন, তার তাৎপর্য কী—এসব না জেনে এই যন্ত্র-মানবীর সঙ্গে এখনই বেশি কথা বলা ঠিক হবে না।
সে বলল, “ঠিক আছে, আমি আবার দেখব।”
মেয়েটি অসম্ভব শার্প, মুখের পেশির সামান্যতম কম্পনও বুঝে যায়। সে বলল, “সায়ন, আর একটা কথা, এ-ব্যাপারে আপনি যা জানবেন সেই তথ্য আপনাদের পারিবারিক সম্পত্তি। সেটা আপনি অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার করবেন কি না সেটা আপনার সিদ্ধান্ত। তবে আমাদের ধারণা, সেরকম কিছু পাওয়া গেলে তা সমগ্র মানবজাতির পক্ষে কল্যাণকর হবে।”
সায়ন এবার হাসল। বলল, “ঠিক আছে, আমি কাল এই সময়ে যোগাযোগ করে নেব।”
মেয়েটি ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিল।
সায়ন আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নামল, হাত-পা খেলিয়ে নিল। তারপর জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তার ফ্ল্যাট অনেক উপরে, এখান থেকে নীচের রাস্তাকে ফিতের মতো দেখায়। পিঁপড়ের মতো কিছু গাড়ি চলছে। তার হঠাৎ মনে হল, রঞ্জনের সময় পৃথিবী ঠিক কেমন ছিল। সে ইতিহাসের বইতে পড়েছে, আজ থেকে মাত্র একশো বছর আগেও পৃথিবীতে তীব্র দারিদ্র্য ছিল। কোটি কোটি মানুষ ও শিশু খালি পেটে শুতে যেত। অনেক দেশের সরকার তাদের জন্য শিক্ষা, বাসস্থান বা চিকিৎসার মতো মৌলিক পরিষেবাও দিতে পারত না। শহরের মানুষও সুখী ছিল না; ভিড়ে ঠাসাঠাসি শহরগুলিতে দূষণ, যাতায়াতের সমস্যা, দুর্ঘটনা, নিরাপত্তার অভাব—এইসবের মধ্যে তারা কোনোরকমে টিকে থাকত। চিকিৎসা ব্যবস্থা এ-যুগের তুলনায় অনেক যোজন পিছিয়ে ছিল, অনেক অসুখই প্রাণঘাতী ছিল বা সারাজীবন মানুষকে পঙ্গু করে রাখত। অন্যদিকে সভ্যতার বিপুল চাহিদা মেটাতে অরণ্য, পাহাড়, নদী ধ্বংস করে নিত্যনতুন বসতি ও শিল্প স্থাপন করা হচ্ছিল। পৃথিবী বিপজ্জনকভাবে উষ্ণ হয়ে উঠছিল। সেই সঙ্গে ঘন ঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
পৃথিবী তখন অনেক ছোটো-বড়ো দেশে বিভক্ত ছিল, তাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। অনেক দেশই সামরিক খাতে বিপুল খরচ করত। আর কিছু শক্তিশালী দেশের একনায়কদের হাতে ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের বিপুল সম্ভার, মুহূর্তের প্ররোচনায় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারত। সেই সময় অনেকেই মনে করতেন, মানুষের ক্ষমতালিপ্সা, স্বার্থপরতা ও লোভের হাতে যুদ্ধ, উষ্ণায়ন বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সভ্যতা অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে।
কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভয়ংকর পরিণতির সম্মুখীন হয়ে মানুষ নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। কোথাও শান্তিপূর্ণভাবে, কোথাও-বা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতালিপ্সু ও দুর্নীতিগ্রস্ত একনায়কদের ধীরে ধীরে সরিয়ে দেওয়া হয়। গণতন্ত্র ফিরে আসে। তরুণ শিক্ষিত প্রজন্ম ক্ষমতায় আসে। তারা মানুষকে বোঝায়, এই গ্রহের সীমিত সম্পদ নিয়ে ভাষা, ধর্ম ও জাতির ভিত্তিতে লড়াই করে লাভ নেই, মিলেমিশে থাকাতেই মঙ্গল। ধীরে ধীরে প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল খরচ কমতে থাকে। সেই অর্থ জনকল্যাণমূলক প্রকল্প ও গবেষণায় ব্যবহার করা হয়। ততদিনে এ.আই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। তার সাহায্যে বৈজ্ঞানিকরা দ্রুত নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করছেন এবং জটিল পরিবেশগত, সামাজিক ও প্রশাসনিক সমস্যার সমাধান করছেন। ধীরে ধীরে পৃথিবীর চেহারা পালটাতে থাকে। ২০৬০ সালে এক সম্মেলনে কিছু দেশ মিলে গ্লোবাল গভর্নমেন্ট অর্থাৎ সারা পৃথিবীর জন্য এক সরকার ও প্রশাসনের প্রস্তাব রাখে। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ও ধাপে ধাপে এই প্রস্তাব গত শতাব্দীর শেষভাগে বাস্তবায়িত হয়।
আজ এই ২১২৩ সালে বিগত শতাব্দীর তুলনায় পৃথিবী যেন এক স্বপ্নের দেশ। মানুষকে আর সেই অর্থে জীবিকানির্বাহও করতে হয় না। রাষ্ট্রই তার সব প্রয়োজন মেটায়। প্রায় সব কাজই যন্ত্র করে। এমনকি প্রযুক্তিগত প্রাথমিক গবেষণাও যন্ত্র নিজেই করে। মানুষের কাজ এখন দুটি—সর্বোচ্চস্তরে এ.আই-কে দিকনির্দেশ করা এবং পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান বা দর্শনের মতো কিছু বিষয়ে মৌলিক গবেষণা করা। এ দুটি কাজেই মুষ্টিমেয় তীক্ষ্ম মেধাসম্পন্ন মানুষের প্রয়োজন হয়। সায়ন নিজে সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে একজন।
তার পরিচারিকা লিসা কফি নিয়ে এল। সায়ন ধন্যবাদ দিয়ে কফি হাতে নিল। এই মেয়েটি অনেকদিন ধরে তার কাছে আছে।
(দুই)
দিনটা কাজের মধ্য দিয়ে কেটে গেল।
বিকেলে সে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেল। মা অমিতা একটু দূরে একটা ফ্ল্যাটে একাই থাকেন। তাকে দেখে খুশি হলেন। অনেকক্ষণ গল্প করলেন। রাতে যাবার আগে খেয়ে যেতে বললেন। উনি এখনও নিজের হাতে রান্না করতে ভালোবাসেন।
কথায় কথায় সায়ন জিজ্ঞেস করল, “মা, তুমি বাবার দাদু রঞ্জনকে দেখেছ? ওঁর সম্বন্ধে কিছু জানো?”
অমিতা একটু অবাক হয়ে বললেন, “হ্যাঁ, উনি তো বড়ো বিজ্ঞানী ছিলেন। তবে আমার যখন বিয়ে হয় তখনই ওঁর আশি বছর বয়স। তোর জন্মের মাত্র কয়েক মাস আগে উনি মারা যান। ফ্যামিলি আর্কাইভেও ওঁর কথা আছে।”
সায়ন বলল, “হ্যাঁ, আমি পড়েছি। আমি আসলে যেটা জানতে চাইছি, ওঁর কাজের ব্যাপারে তুমি কিছু জানো? তোমাদের সঙ্গে কথা-টথা হত?”
অমিতা বললেন, “না, সেভাবে নয়। উনি কম কথার মানুষ ছিলেন। তবে তোর বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। ওর কাছে শুনেছি, শেষদিকে একটা বড়ো কাজে হাত দিয়েছিলেন।”
সায়ন উত্তেজিত হয়ে সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল, “সেটা কি শেষ করে যেতে পেরেছিলেন?”
অমিতা বললেন, “না, সেটা তোর বাবাকে অন্তত বলে যাননি। তবে ও বলত, শেষদিকে উনি কিছুটা চাপে ছিলেন। সেটা কাজের জন্যও হতে পারে।”
সায়ন দাঁত দিয়ে ঠোঁট চাপল। মনে মনে ভাবল, এফ.বি.আই-এর মেয়েটি ঠিকই বলেছিল। তবে কূলে এসে তরী ডুবল মনে হচ্ছে। কিন্তু পাসওয়ার্ডটা তাকে ভাবাচ্ছে। চাবি থাকলে সিন্দুকও থাকার কথা। সে ঠিক করল আজ রাতে আর্কাইভে রঞ্জনের লেখাগুলি সে আর একবার ভালো করে পড়বে।
খাওয়াদাওয়া সেরে একটু দেরি করে সে বাড়ি ফিরল। রাত-পোশাক পরে খাটে বসে সে তাদের ডিজিটাল আর্কাইভে লগ-ইন করল। ইউজার আই.ডি, পাসওয়ার্ডের ব্যবহার অনেকদিনই উঠে গেছে, তবু আর্কাইভে এখনও রয়ে গেছে। তার সামনে বিশাল দেওয়াল জুড়ে এখন তার পূর্বপুরুষদের ছবি ভাসছে। সবথেকে উপরে রঞ্জন। ছবিটা মনে হয় মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে তোলা। শান্ত সৌম্য চেহারা, চুলে রুপোলি রেখা, চোখে তখনকার দিনের মোটা কাচের চশমা। সায়ন অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ছবিটায় ক্লিক করল। ওঁর সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য ভেসে উঠল। পেশা লেখা রয়েছে বিজ্ঞানী। কিন্তু কাজের ব্যাপারে আর কিছু লেখা নেই। এমনকি ‘অ্যাচিভমেন্ট’ কলামটাও উনি ফাঁকা রেখেছেন। ওঁর ছবি, ভিডিও বা আরও কিছু পেজ সায়ন বহুবার দেখেছে। সে ডায়েরির পেজে গেল। দাদু ডায়েরি লিখতে শুরু করেন বোধ হয় পঞ্চাশ বছর বয়সে। খুবই কম লিখতেন। সাকুল্যে পঁচিশ-তিরিশটা এন্ট্রি আছে—সবই ব্যক্তিগত বা পারিবারিক স্মৃতিচারণা। সায়নের বাবার জন্মের কথা লিখেছেন। এক অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু চলে যাওয়ায় খুব আঘাত পেয়েছিলেন, সে-কথা লিখেছেন। শেষ এন্ট্রি ২০৮০ সালে। সায়নের জন্ম ও রঞ্জনের মৃত্যু-সন। উনি লিখেছেন, ‘পরিবারে নতুন মানুষ আসছে, আমার সঙ্গে দেখা হবে কি না জানি না।’
সায়ন শেষ চেষ্টা হিসাবে বাবা রজতাভর আর্কাইভে আর একবার গেল। রঞ্জন এই নাতিটিকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বাবা অনেকবার তাঁর কথা উল্লেখও করেছেন, উনি যে ব্রেন-মেশিন ইন্টারফেস নিয়ে কাজ করতেন তাও লিখেছেন। আর কিছু নয়। শুধু উনি যাবার বেশ কয়েক বছর পরে একদিন স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন, দাদু বড্ড কাজপাগল ছিলেন। কাজ কাজ করতে করতে যাবার আগে মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছিল। অমিতাও এই কথাই বলছিলেন।
সায়ন হতাশ হয়ে আর্কাইভ বন্ধ করল। তার মাথা আর কাজ করছে না। আলো নিভিয়ে দিয়ে সে শুয়ে পড়ল।
পরের দিন সকালে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে ও এক কাপ কফি খেয়ে সে মারিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করল। মেয়েটি এসে হাসিমুখে বলল, “গুড মর্নিং সায়ন! আমাদের জন্য কোনও খবর আছে?”
সায়ন অকপটে সব বলল। এমনকি সে যে পারিবারিক সূত্রে দুটি পাসওয়ার্ড পেয়েছে সেটাও বলল।
মারিয়া শুনে বলল, “আমাদেরও মনে হয় ওঁর কাজ-সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য উনি ফ্যামিলি আর্কাইভেই রেখে গেছেন। সম্ভবত বাড়তি নিরাপত্তার জন্য লিংকটা উনি লুকিয়ে বা হাইড করে গেছেন যার জন্য আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। আমরা কিছু স্টেপস পাঠাচ্ছি, আপনি একবার চেক করে দেখুন।”
সায়ন লগ-ইন করে দেখল রঞ্জনের ‘অ্যাচিভমেন্ট’ সেকশনের তলায় সত্যিই একটা লিংক লুকোনো ছিল। মেয়েটিকে বলতে সে বলল, “মনে হয় ওই লিংকে গেলে আপনার দ্বিতীয় পাসওয়ার্ড কাজে লাগবে। আপনি করে দেখুন। রঞ্জনের গবেষণার কোনও তথ্য যদি পাওয়া যায়, আপনি চাইলে আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। অল দ্য বেস্ট।”
মারিয়া চলে গেল। সায়ন লিংকটি ক্লিক করল। এবার যে স্ক্রিনটি এল সেখানে পাসওয়ার্ড চাইছে।
সায়নের হৃৎস্পন্দন দ্রুত হল। কিন্তু তার মনে হল রঞ্জনের কাজের ব্যাপারে পড়তে এবং বুঝতে সময় লাগবে। তার চেয়ে রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বসে ধীরেসুস্থে দেখবে। সে আর্কাইভ থেকে লগ-আউট করে নিজের কাজের জায়গায় ঢুকল।
সারাদিন কাজ ও হালকা বিশ্রামে কেটে গেল। মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা, মাঝে-মধ্যেই মনে হচ্ছে পাসওয়ার্ডটা কাজ করে কি না অন্তত দেখে নেয়, কিন্তু সে সামলে রইল। সন্ধ্যাবেলা বিল্ডিংয়ের সামনে জগিং ট্র্যাকে গিয়ে অনেকক্ষণ দৌড়েও এল।
রাতে হালকা ডিনার করে সে আর্কাইভে লগ-ইন করল। লিংকে ক্লিক করে সে দুরুদুরু বুকে রজতাভর কাছ থেকে পাওয়া দ্বিতীয় পাসওয়ার্ডটি দিল। এবারে নতুন একটি পেজ এল, অর্থাৎ পাসওয়ার্ড কাজ করেছে।
এই পেজে উপরে ডানদিকে রঞ্জনের ছবি দেওয়া আর মাঝে আন্ডারলাইন করে বড়ো ফন্টে লেখা—‘আমার কাজ সম্বন্ধে কিছু কথা ও তথ্য—শুধুমাত্র আমার উত্তরসূরিদের জন্য।’
নীচে একটু ছোটো ফন্টে গোটা স্ক্রিন জুড়ে অনেক কিছু লেখা। সায়ন রুদ্ধশ্বাসে পড়তে লাগল।
প্রথম দিকে মানুষের ব্রেন কীভাবে কাজ করে সে-সম্বন্ধে রঞ্জনের বর্ণনা। মানুষের স্মৃতি, চেতনা ও অনুভূতি ব্রেন কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সে-সম্বন্ধে কিছু তথ্য। সায়ন সবটা ভালো বুঝল না। তবে এরপর থেকে লেখা ক্রমশ সরল হয়ে এসেছে। রঞ্জন ধীরে ধীরে মূল বক্তব্যে এসেছেন। একেবারে শেষদিকে উত্তরসূরিদের জন্য কিছু নির্দেশ ও পরামর্শ। পুরো লেখাটা পড়তে সায়নের আধঘণ্টামতো লাগল।
শেষদিকটা সে আর একবার পড়ল। তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল।
তারপর সে চেয়ার থেকে উঠল। বেড-সাইড টেবিলে এক গ্লাস জল রাখা ছিল, ঢকঢক করে খেয়ে নিল। তারপর বিছানায় বসে দেওয়ালের স্ক্রিন অফ করে মাথা ঠান্ডা করে গোটা ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করল। রঞ্জন পরিষ্কার লিখেছেন, এ-ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার আগে তাঁর উত্তরসূরিরা যেন তাদের সময়ের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে নেন। এফ.বি.আই হয়তো ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করেছে। আর পাঁচকান না করে কিছুটা ঝুঁকি থাকলেও তাদের পরামর্শ নেওয়াই ভালো। তবে যন্ত্র-মানবীটিকে নয়।
সে মারিয়াকে কল করল। সে মুহূর্তের মধ্যে পর্দায় এসে হাসিমুখে বলল, “বলুন, সায়ন।”
সায়ন বলল, “আমি ওঁর আবিষ্কার সম্বন্ধে কিছু তথ্য পেয়েছি। কিন্তু ব্যাপারটা সেন্সিটিভ। আমি কি আপনাদের অধিকর্তার সঙ্গে কথা বলতে পারি?”
মারিয়া হেসে বলল, “অবশ্যই। আমি ওঁকে জানাচ্ছি।”
মেয়েটি চলে গেল।
মিনিট পাঁচেক পরে পর্দায় এক মাঝবয়সি ভদ্রলোকের মুখ ভেসে উঠল। সৌম্য, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। মুখটি পরিচিত, সম্ভবত সায়ন আগেও এঁর ছবি দেখেছে। এফ.বি.আই-র অধিকর্তা মানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন। এঁর নাম বিবস্বান।
শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর সায়ন সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলল। বিবস্বানের মুখে প্রথমে অকৃত্রিম বিস্ময় ফুটে উঠল। কয়েক মুহূর্ত পরে তিনি উচ্ছ্বসিতভাবে বললেন, “এ তো প্রায় অবিশ্বাস্য! যান্ত্রিক মস্তিষ্কের মধ্যে চেতনা আনার জন্য আমরা এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি। আর উনি অতদিন আগে সামান্য প্রযুক্তি নিয়ে এ-কাজ শেষ করে গেছেন! এই আবিষ্কার তো সভ্যতার চেহারা পালটে দেবে।”
সায়ন বলল, “কিন্তু যন্ত্র সচেতন হলে একদিন কি তা সভ্যতার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে না?”
ভদ্রলোক হেসে বললেন, “আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে বলি, একশো বছর আগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এ.আই যখন ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে তখনও অনেকে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু আজকে সভ্যতা যেখানে পৌঁছেছে, এ.আই ছাড়া সম্ভব হত না। আর সচেতনতার কথা যদি বলেন, যন্ত্র সচেতন হলেই দলে দলে রোবট পৃথিবী দখল করতে ঝাঁপিয়ে পড়বে—এই ধারণাটা ঠিক নয়। চেতনা থাকার অর্থ সে নিজেকে এবং বহির্জগতকে গভীরভাবে বুঝবে। মানুষের মতো তার কল্পনা ও উদ্ভাবনীশক্তি থাকবে। কিন্তু তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা ইচ্ছা থাকবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। সেটা তার নিয়ন্ত্রক অর্থাৎ মানুষই ঠিক করবে।”
বিবস্বান একটু থামলেন। তারপর বললেন, “এছাড়াও, এই প্রযুক্তি আমাদের হাতে এলেও তা কবে এবং কীভাবে ব্যবহার করা হবে সে-সিদ্ধান্ত সবদিক ভেবেচিন্তে আমাদের বোর্ডই নেবে। জিন-এডিটিং বা এরকম আরও কিছু প্রযুক্তি অনেকদিন আগেই আমরা আয়ত্ত করেছি, কিন্তু সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের কথা ভেবে আমরা সেগুলি ব্যবহারের অনুমোদন দিইনি।
“তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রযুক্তিকে আটকে না রাখার পক্ষপাতী। আমি চাইব আপনি ওঁর আবিষ্কার আমাদের হাতে তুলে দিন। সামাজিক ও নৈতিক দিকটা আমাদের উপর ছেড়ে দিন। এত বড়ো একটা আবিষ্কারকে হারিয়ে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না।”
সায়নের কথাগুলো যুক্তিপূর্ণ মনে হল। তবু সে চুপ করে রইল। ভদ্রলোক বললেন, “আপনি সময় নিন। এ বড়ো কঠিন সিদ্ধান্ত। তবে আমি বলব, আপনি রঞ্জনের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবার চেষ্টা করুন—উনি নিজে আজ থাকলে কী করতেন।”
ভদ্রলোক চলে গেলেন। সায়ন স্ক্রিন অফ করে দিয়ে বিছানায় এসে বসল। ভাবতে গিয়ে তার মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। এত বড়ো সিদ্ধান্ত রঞ্জন উত্তরপুরুষদের হাতে ছেড়ে দিয়ে গেলেন কেন? উনি নিজেও হয়তো নিশ্চিত ছিলেন না। তবে সে বাহক মাত্র। এই সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ঠিক হবে।
(তিন)
পরের দিন সকালে লিসা কফি নিয়ে এসে তাকে ডেকে তুলল। সে হাত-মুখ ধুয়ে এসে সোফায় বসে কফিতে চুমুক দিল। ভদ্রলোককে রঞ্জনের লিংকটা এখন পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে, ফেলে রেখে লাভ নেই।
এই সময় একটা চিন্তা বিদ্যুতের মতো মাথায় ঝলসে উঠে তাকে প্রায় অবশ করে দিল। তার হাত কেঁপে কফির কাপ থেকে বেশ কিছুটা কফি মেঝেতে চলকে পড়ল। লিজা দেখতে পেয়ে দ্রুত এসে সেটা মুছে দিল।
বিবস্বানকে কোথায় দেখেছে তার মনে পড়েছে। বেশ কিছুদিন আগে একটা নিউজ-ফিড এসেছিল। এফ.বি.আই-র অধিকর্তা বৈজ্ঞানিক বিবস্বান ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছেন। সে দ্রুত সার্চ করল। হ্যাঁ, ঠিক। এফ.বি.আই-র বর্তমান অধিকর্তার নাম ড্যানিয়েল। তা হলে বিবস্বানের সঙ্গে এফ.বি.আই-র সম্পর্ক কী? মেয়েটিই-বা তাঁকে ডাকল কেন?
বিস্ময় ও শঙ্কার মধ্যেই সায়নের মনে হল রঞ্জনের লিংকটা কোনও নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেলা উচিত। হয়তো তার পার্সনাল ড্রাইভে। সে দ্রুত উঠে গিয়ে স্ক্রিন অন করল। ছোটো দু-একটা কাজ সেরে তাদের ফ্যামিলি আর্কাইভে ঢুকল।
সে টের পেল না লিজা কখন নিঃশব্দে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভেগাস নার্ভে ধাতব আঙুলের স্পর্শ পেয়ে সে ঘুরে দেখতে চাইল, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
(চার)
তাকে চোখ খুলতে দেখে বিবস্বান হাসিমুখে বললেন, “এই তো জেগে উঠেছেন।”
কয়েকবার চোখের পাতা ফেলে সায়ন ধীরে ধীরে উঠে বসল।
ছোটো একটা ঘর। ঘর না বলে কিউবিকল বললেই ভালো হয়। তিনদিকের দেয়াল জুড়ে সোফা রাখা আছে। একটাতে বিবস্বান বসে আছেন, আর একটিতে মারিয়া।
বিবস্বান বললেন, “ঠিক লাগছে তো? দুঃখিত আপনাকে এভাবে কষ্ট দিতে হল। আসলে, সকাল সকাল উঠে আপনি যখন সার্চ করেন, আমাদের সন্দেহ হয় আপনি ব্যাপারটা বুঝে গিয়ে হয়তো লিংকটা সরিয়ে ফেলতে চাইবেন। তখন এছাড়া অন্য উপায় ছিল না।”
সায়ন চুপ করে শুনতে লাগল।
বিবস্বান বলে চললেন, “আপনার মনে অনেক প্রশ্ন আছে বুঝতে পারছি। আপনি ঠিকই দেখেছেন, আমি আর সরকারিভাবে এফ.বি.আই-র সঙ্গে যুক্ত নই। আমি অবসর নিয়ে নিজের মতো করে গবেষণা করি। তবে প্রাক্তন সহকর্মী হিসাবে এদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে।” তিনি মারিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
“সম্প্রতি রঞ্জনের কাজের ব্যাপারে আমরা জানতে পারি এবং এদের বলি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। গতকাল যখন আপনার কাছে খবরটা শুনি, তখনই ঠিক করি, এই প্রযুক্তি যে-কোনো মূল্যে আমার চাই। আমি এদের দিয়ে সহজেই পাসওয়ার্ড ক্র্যাক করাতে পারতাম, কিন্তু তাতে কিছু ঝুঁকি ছিল। তাই চেয়েছিলাম আপনাকে যদি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করানো যায়।”
সায়ন বিস্মিতভাবে বলল, “এতে ব্যক্তিগতভাবে আপনার কী লাভ? রঞ্জনের আবিষ্কারের জন্য কৃতিত্ব নিতেন?”
এটা বলে তার হঠাৎ খেয়াল হল, একজন অবসরপ্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক এফ.বি.আই-র যন্ত্র-মানুষদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন? লিসাই-বা তাঁর কথা শোনে কেন? তার হঠাৎ মনে হল, এসি চলা সত্ত্বেও ঘরটা যেন গরম হয়ে উঠেছে, কপালে গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম হচ্ছে।
বিবস্বান একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “আর্টিফিসিয়াল কনশাসনেস নিয়ে আমিও কিছুদিন থেকে কাজ করছি। এখনও সাফল্য আসেনি। রঞ্জন ওঁর সময়ের হিসাবে অসাধারণ কাজ করে গেছেন। তবে এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে আমিও কিছু অবদান রেখেছি। আমার কাজের পিছনে অবশ্য একটা উদ্দেশ্যও ছিল।
“আজ থেকে কয়েক বছর আগে আমি বুঝতে পারি যে সরকারি পদে থেকে নানারকম বিধিনিষেধের মধ্যে আমার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। আমি পদত্যাগ করে নিজের মতো করে গোপনে কাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে থাকি। আসার আগে আমি এফ.বি.আই-তে যেসব যন্ত্র-মানুষ গবেষণার কাজে সাহায্য করে তাদের ব্রেনে একটা ছোটো প্রোগ্রাম ঢুকিয়ে দিই যাতে তারা আমার কথা শুনে চলে। অধিকর্তা হিসাবে সেই ক্ষমতা আমার ছিল।
“আর এখন...” ভদ্রলোক একটু থেমে সামনে ঝুঁকে পড়লেন।—“এখন পৃথিবীর কয়েক লক্ষ রোবট আমার ইচ্ছাধীন। এরা এদের স্বাভাবিক কাজও করে যায়, কিন্তু আমার নির্দেশ এলে তৎক্ষণাৎ পালন করে।”
সায়ন স্তম্ভিত হয়ে গেল।
বিবস্বান বললেন, “তবু আমি এখনও এই ক্ষমতা ব্যবহার করিনি। কেন জানেন? কারণ গবেষণার কাজে আপনাদের মতো মুষ্টিমেয় বৈজ্ঞানিককে এখনও দরকার হয়। আমার রোবটরা সব পারে, কিন্তু মানুষের মতো মৌলিক চিন্তা করতে পারে না।
“এবার ভেবে দেখুন, রঞ্জনের প্রযুক্তি যদি এদের দেওয়া যায়, এরা মানুষের মতোই সচেতন ও চিন্তাশীল হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে যোগ হবে এদের অতি দ্রুত ও নির্ভুল চিন্তা ও গণনা করার ক্ষমতা। এদের অসাধ্য কিছুই থাকবে না।”
সায়নের গলা শুকিয়ে এসেছে। সে কোনোরকমে বলল, “আর মানুষরা?”
বিবস্বানের মুখ-চোখ মুহূর্তে পালটে গেল। সায়নের মনে হল তাঁর মুখ থেকে একটা পাতলা চামড়ার মুখোশ কেউ টেনে খুলে দিয়েছে। তিনি হিংস্র ক্রুর গলায় বললেন, “এই গ্রহের সম্পদ নষ্ট করা ছাড়া কোটি কোটি মানুষ আর কোনও কাজে আসে বলতে পারেন? তাদের ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।”
কয়েক মুহূর্ত পরে বিবস্বানের মুখ-চোখ আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। তিনি বললেন, “ইন্টেলিজেন্স এক্সপ্লোশন কথাটা হয়তো শুনে থাকবেন। অর্থাৎ, যন্ত্র নিজেই উন্নততর যন্ত্র উদ্ভাবন করবে, তারপর আরও উন্নত যন্ত্র। সেই কল্পনা এতদিন পরে সত্য হবে। এরা হয়তো বিজ্ঞানের এখনও অজানা সব তত্ত্ব বার করবে। এদের তৈরি মহাকাশযান গ্যালাক্সির সুদূরতম প্রান্তে পাড়ি দেবে। আর সেই বিপুল অবিশ্বাস্য ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করবে এই গ্রহের একজন মানুষ। এইভাবে হয়তো গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একদিন তার দখলে আসবে।”
সায়ন দেখল, বিবস্বান যেন একটা ঘোরের মধ্য থেকে কথা বলছেন। সে প্রাণপণে মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবার চেষ্টা করল। এই উন্মাদ বৈজ্ঞানিককে যে করে হোক আটকাতে হবে। কিন্তু কী করে?
বিবস্বান বললেন, “আমরা এখনও সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাবার জন্য প্রস্তুত নই। তাই আপনাকে অনুরোধ করব রঞ্জনের লিংকটা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে।”
সায়ন চুপ করে রইল। বিবস্বান বললেন, “মারিয়া কিন্তু অনায়াসে আপনার কাছ থেকে পাসওয়ার্ড বার করে নিতে পারে। ওর পদ্ধতি খুব সূক্ষ্ম। কিন্তু আপনার সে-অভিজ্ঞতা হোক আমি চাই না।”
এই সময় একটা অদ্ভুত কাণ্ড হল। দরজাটা মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। হাতে অস্ত্র নিয়ে কয়েকজন মানুষ ঢুকে এল। বিবস্বান একটা প্যানেলের মতো জিনিসের দিকে হাত বাড়ালেন। সায়নের বুক কেঁপে উঠল। কিন্তু তার আগেই একজন এগিয়ে গিয়ে তাঁর গলায় বন্দুক ঠেকিয়েছে। একটু পরে দেখা গেল তিনি বিবশ হয়ে সোফায় বসে পড়েছেন। বাকিরা ততক্ষণে মারিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে।
এবারে ধীর শান্ত পদক্ষেপে আর একজন ভদ্রলোক ঢুকলেন। বিবস্বানের বয়সিই হবেন। তিনি সায়নের কাছে গিয়ে বললেন, “আপনি ঠিক আছেন তো?”
সায়ন ঘাড় নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। আপনি বোধ হয় ড্যানিয়েল?”
ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, “হ্যাঁ। মেসেজটা ঠিক সময়ে পাঠিয়েছিলেন।”
সায়ন দীর্ঘ একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল। ড্যানিয়েল বললেন, “আমরা কিন্তু অনেকদিন থেকেই এঁর উপর নজর রাখছিলাম। সব জেনেও আমরা চট করে কিছু করতে পারছিলাম না কারণ, ব্যাপারটায় যথেষ্ট ঝুঁকি ছিল। আজ সকালে আপনার মেসেজ পেয়ে বুঝতে পারি, ঝুঁকি থাকলেও আর দেরি করা উচিত হবে না, তাহলে ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাবে।”
সায়ন বলল, “এবার কী করবেন?”
ড্যানিয়েল বললেন, “প্রথমত, ইনি যে কাণ্ড করে গেছেন সেটি শুধরাতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমাদের বোর্ডকে জানিয়ে সুরক্ষা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এ-ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।”
সায়ন বলল, “আর রঞ্জনের লিংকটা?”
ড্যানিয়েল হেসে বললেন, “ওটা আপাতত আপনার কাছেই থাক, আমাদের বোর্ড এ-ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।”
সায়ন বলল, “কিন্তু যন্ত্রকে সচেতন করার ব্যাপারে উনি যা বললেন তা কি ঠিক? তখনও কি তারা মানুষের কথা শুনবে?”
ড্যানিয়েল বললেন, “আপনার কথার সংক্ষেপে উত্তর হল, হ্যাঁ। সচেতন বা অচেতন—কোনও যন্ত্রই মানুষের শত্রু নয়। সেটা নির্ভর করবে যন্ত্রকে যারা নিয়ন্ত্রণ করবে তাদের উপর।”
সায়ন হেসে ফেলল। বলল, “আজকের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে সেটাই অনেক বড়ো ঝুঁকি৷”
ড্যানিয়েলও হাসলেন। বললেন, “ঠিক।” তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “আজ থেকে একশো বছর আগের পৃথিবীর ইতিহাস মনে আছে? কিছু ক্ষমতালোভী ও স্বৈরাচারী শাসক প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার করে পৃথিবীকে প্রায় ধ্বংসের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন। সেই টানা-পোড়েন এখনও চলছে। লড়াইটা আমাদের শুভ বুদ্ধির সঙ্গে আদিম প্রবৃত্তির, প্রযুক্তির নয়।”
তিনি একটু থামলেন। তারপর বললেন, “তবে মানুষ থামতে জানে না। কৌতূহল ও জানার নেশা, সেই সঙ্গে ঝুঁকি নেবার ক্ষমতাই তাকে এত দূর এনেছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে নিজের ভাগ্যকে শিকার করে ফেরাতেই তার আনন্দ। সে কত দূর যাবে, সময়ই বলবে।”
ড্যানিয়েল বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। সায়নও বেরিয়ে এল। বাইরে ইস্পাত ও কাচ দিয়ে মোড়া ঝকঝকে শহর। দু-একটি মানুষ ইতস্তত হেঁটে যাচ্ছে। তার হঠাৎ মনে হল, এই গ্রহে কিছু মানুষ বহুদিন ধরে মানুষের ভবিষ্যৎ রচনা করে আসছে। রঞ্জনও করে গেছেন। তবু তা যেন সম্ভাবনার পটে তুলির আঁচড় মাত্র। আরও অনেকে মিলে ছবিটা একদিন শেষ করবে।
ছবি: সুজাতা চ্যাটার্জী
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু