শিকার কাহিনি
15% OFF * FREE SHIPPING
শিকার কাহিনি
হিমাংশু বন্দ্যোপাধ্যায়
আমার বহুদিনের শিকারি জীবনের সফলতা, বিফলতা ও বিপত্তির অভিজ্ঞতা পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বের সীমায় যখন এলাম তখন শিকারের শেষ অধ্যায় সম্বন্ধে ভাবা একটু জরুরি মনে হল। প্রত্যেক অভিজ্ঞ শিকারি বহুদিন শিকার করার পর আমার মতো শেষ অধ্যায়ের কথা যে ভাবেন তা আমি হলপ করে বলতে পারি। শিকারের শেষ অধ্যায় বলতে কী বোঝায় তার একটু ব্যঞ্জনা দরকার। যাঁরা আমার মতো বহুদিন শিকার করেছেন, তাঁদের এই শেষ অধ্যায়ের কথা জিজ্ঞাসা করলে একবাক্যে বলবেন দুটি ভীষণ, দুর্ধর্ষ ও অসম্ভব বুদ্ধিধারী হিংস্র জন্তু শিকারের কথা। একটি হল পাগলা হাতি ও অপরটি মানুষখেকো বাঘ। এই দুটো জন্তু যখন যেখানে উপদ্রব শুরু করে তখন সেখানকার প্রত্যেক লোকের আহার-নিদ্রা সবকিছু ঘোচাতে হয় এবং সেই সঙ্গে তাদের প্রাণ, ক্ষেতের ফসল, ঘরবাড়ি সবকিছু খোয়াতে হয়। এমন অনেক উপদ্রুত এলাকা দেখা গেছে, যেখানে মানুষ সবকিছু ফেলে তাদের প্রাণ নিয়ে বহুদিনের বাসস্থান ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। যাই হোক, শেষ অধ্যায়ে এসে এই দুটো জন্তুর কথা মনে হল সর্বাগ্রে। তখনও আমার হাতি শিকার হয়নি। কাজেই দুয়ের মধ্যে অগ্রাধিকার পেল পাগলা হাতি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—হাতি গুণ্ডা বা পাগলা হয় কেন? জন্তুজগতে যারা দলবদ্ধ হয়ে বাস করে যেমন হাতি, বন্য মহিষ, বাইসন, হরিণ ইত্যাদি তাদের মধ্যে দলীয় কয়েকটি নিয়মশৃঙ্খলা প্রচলিত আছে এবং দলের সকলেই সে-সব মেনে নিয়ে একসঙ্গে বাস করে। এরা একে অন্যের প্রতি খুব স্নেহশীল এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ হয়ে থাকে। সাধারণত দেখা যায় দলের বয়স্ক হস্তিনীই দলের মধ্যে নেতৃত্ব করে, কারণ, দেখা গিয়েছে হস্তিনীদেরই দায়িত্ব ও পরিচর্যা জ্ঞান পুরুষ হাতির চেয়ে অনেক বেশি হয়। আর একদিকে দেখা যায় দলের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী পুরুষ হাতিও সমস্ত দলের উপর সর্বাধিনায়করূপে নেতৃত্ব করে থাকে এবং সে-ই সমস্ত হস্তিনীদের হারেমের মালিক বলে গণ্য হয়। দলের কোনও বিপদে এই মদ্দা হাতি তার পালের সকল নিরাপত্তার ভার নিয়ে থাকে। বয়োজ্যেষ্ঠ মাদি হাতি তার দলের পরিবারটির সর্বপ্রকার দেখাশুনা ও দল প্রতিপালনের দায়িত্ব নেয়—আর মদ্দা নেতা প্রজননকার্যের ও দলের বিপদ-আপদ মোকাবিলা করবার ভার নেয়। এই দলপতি সবসময় ঠিক দলের মধ্যে থাকে না, দল থেকে কিছু তফাতে আপনমনে চলাফেরা করে কিন্তু দলনেত্রীর কাছ থেকে কোনও বিপদ-সংকেত পেলে তৎক্ষণাৎ দলের মধ্যে এসে সকলের নিরাপত্তার ভার নেয়।
চিরকাল একই মদ্দা হাতি দলের নেতৃত্ব করতে পারে না। দলের কোনো-কোনো যুবক হাতি বেশ শক্তিশালী হয়ে হারেমের মালিকানা ও দলের নেতৃত্ব লাভের জন্য তার দলপতির সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই বাধিয়ে দেয়। এইসব লড়াইয়ে যতদিন পর্যন্ত আগের নেতাই জয়লাভ কবে, ততদিন পর্যন্ত তার নেতৃত্ব বজায় থাকে। যদি কখনও এই হারাজিত-লড়াইয়ে দলপতি হেরে যায়, তবে সে দলছুট হয়ে মনে মনে পরাজয়ের গ্লানি ও আক্রোশ এবং শারীরিক জখম নিয়ে একটা মারমূর্তিতে একা একা আপনমনে ঘুরে বেড়ায়—যাকে ইংরেজিতে বলে ‘লোন বুল’। সেই সময় হাতিটার মনের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে থাকে এবং এতদিনের নেতৃত্ব থেকে বিতাড়িত এবং শারীরিক জখম নিয়ে সে অত্যন্ত বদমেজাজি হয়ে পড়ে। সেই সময় দেখা যায় মানুষ বা অন্য কোনও জন্তুজানোয়ার তার সামনে এলেই মারমূর্তি নিয়ে ছুটে যায় এবং তাদের মেরেও ফেলে। এই স্বভাব ক্রমশ অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়, তখন মানুষের ঘরবাড়ি ও ফসলের প্রচুর ক্ষতিসাধন করে। ওই ক্ষ্যাপা অবস্থায় দু-চারজন লোক মারতে আরম্ভ করলেই বন বিভাগের লোক তাকে ‘পাগলা হাতি’ বলে নির্দিষ্ট করে।
আরও এক কারণে হাতি গুণ্ডা বা পাগলা হয়ে ওঠে। মদ্দা হাতি বছরের কোনও সময়ে ‘মস্ত’ হয়ে যায়, তখন তার কপাল দিয়ে সবসময় একরকম আঠার মতো তেলজাতীয় স্বেদ বা ঘাম নির্গত হতে থাকে। সেই স্বেদের গন্ধে হাতির বিশেষ ধরনের স্নায়বিক চঞ্চলতার সৃষ্টি হয় এবং সেই স্বেদ বা ঘাম যতদিন থাকে ততদিন সে পাগলা হাতির মতো নানারকম উৎপাত আরম্ত করে দেয়। ওই সময় সে তার দলের হাতির সঙ্গেও অকারণ ঝগড়া বা লড়াই বাধিয়ে দেয় এবং তখন মানুষ ও জন্তুজানোয়ার মারতে দেখা যায়। স্বেদ নির্গমন বন্ধ হলে আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। গুণ্ডা বা পাগলা হাতির ওইসব উৎপাত বন্ধ করার জন্য সরকারের বন বিভাগের চিফ কনজারভেটর অব ফরেস্ট ও ডিসট্রিক্ট কমিশনারের যুগ্ম অনুমতিক্রমে সেই হাতিকে মেরে ফেলবার বিজ্ঞপ্তি সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হয়।
হাতি বা বাঘের এই ধরনের ক্ষ্যাপামির জন্য আমরা মানুষরাও অনেক অংশে দায়ী—যেমন, হাতিকে ভয় দেখিয়ে তাড়াবার জন্য ‘বারো বোর’-এর বন্দুক চালিয়ে অথবা বর্শা বা তির-ধনুক মেরে তাকে জখম করে দেওয়া হয়—ফলে সেই আহত জন্তুটির মানুষের উপর বিশেষ করে আক্রোশ জন্মায় এবং ওই অবস্থায় মানুষ দেখলেই সেইসব হাতির প্রবল ইচ্ছা হয় যে তার এই জাতীয় শক্রকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে আছড়ে মেরে চারটি গোদা গোদা পা দিয়ে পিষে ফেলতে। এই ধরনের বদমেজাজি হাতির মতো বাঘকেও ‘মানুষখেকো’ করে তোলার জন্য আংশিকভাবে মানুষই দায়ী। যদিও এসব কারণ ছাড়া আরও নানা কারণ আছে, যার জন্য বাঘ গ্রাম বসতিতে ঢুকে মানুষ বা গৃহপালিত পশু মেরে খাদ্য সংগ্রহ করে। ওই সকল কারণের মধ্যে বিশেষ একটি কারণ ‘Ecological Imbalance’ যার অর্থ বলা যেতে পারে—জীবজগৎ সংরক্ষণে প্রাকৃতিক ব্যবস্থার অবিন্যাস করা—যাতে করে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং এজন্য মানুষের সভ্যতাই দায়ী। সে যা হোক, উদ্দেশ্য আমার পাগলা হাতি শিকার।
শিকার চেষ্টা কী হবে তা তো ঠিক করা গেল, অতঃপর আমার প্রথম কাজ হল পাগলা হাতি সম্বন্ধে যতদূর সম্ভব খবরাখবর জোগাড় করা, প্রতিদিন কাগজে শ্যেনদৃষ্টি রাখা এবং আমার সব বন্ধুবান্ধবদের বলে রাখা, তাঁদের নজরে যদি কোনও খবর পড়ে তাহলে তাঁরা যেন দয়া করে আমাকে জানান।
১৯৬০ সাল থেকে আমার শিকারি জীবনের শেষ অধ্যায়ের অভিযান শুরু হল। আমাদের কাছাকাছি আসাম, ত্রিপুরা ও উড়িষ্যায় হাতি পাওয়া যায়। আমার কয়েকজন সুহৃদের মাধ্যমে আমি আসাম ও ত্রিপুরার সরকারি গেজেট জোগাড় করতে শুরু করলাম। হাতি বন বিভাগের সুরক্ষিত জন্তু; ১৮৭৯ সাল হতে পূর্বের ব্রিটিশ সরকার এই ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল সারা ভারতে। পুরাকালে হিন্দু রাজত্বে এবং পরে পাঠান-মোঘল আমলে হাতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। যদিও লিখিত আইন ছিল বলে জানা যায় না, কারণ হাতি রাজা-মহারাজা ও সম্রাটদের বাহন ছিল, যুদ্ধ এবং ভারবাহী হিসাবেও অত্যন্ত দরকারি প্রাণী ছিল। পূর্বেই বলা হয়েছে, প্রচুর প্রাণ ও সম্পত্তির ক্ষতি না করলে ‘পাগলা হাতি’ বলে ঘোষণা করা হয় না। হাতি পাগলা হলে বিভাগীয় কমিশনার ও চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্ট-এর যুগ্ম সম্মতিক্রমে তাকে পাগলা হাতি হিসাবে ঘোষণা করা হয় এবং তখনই ওই হাতিকে মারবার জন্য হুকুম দেওয়া হয়। বন বিভাগের লোক জমিতে সেই হাতির পায়ের ছাপ থেকে আন্দাজ করে তার উচ্চতা, দাঁতাল মদ্দা হাতি কি না, হস্তিনী কি মাখনা ইত্যাদি প্রত্যক্ষদর্শীর খবরাখবরের মাধ্যমে সনাক্তকারক চিহ্ন জোগাড় করে, পাগলা হাতিটি সুনির্দিষ্ট হয়। এইসবের বিস্তারিত বিবরণ এবং শিকারের জন্য কত পুরস্কার দেওয়া হবে—এই খবরগুলি সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়।
আমাদের দেশে হাতি তিনরকমের আছে; যথা প্রথম—দাঁতাল বা মদ্দা হাতি, দ্বিতীয়—হস্তিনী, এদের দাঁত থাকে না; তৃতীয়—মাখনা, দাঁতবিহীন মদ্দা হাতিকেই মাখনা বলা হয়। সাধারণত আমাদের দেশে হস্তিনী ও মাখনা হাতি উভয়েরই দাঁত হয় না, কিন্তু খুব বড়ো হলে কখনো-কখনো সরু সরু ছোটো দাঁত হতে দেখা যায়। মাখনা হাতি সম্পর্কে কেউ যদি ভাবেন যে এরা নপুংসক, তাহলে বিশেষ ভুল করা হবে—এদের সন্তান উৎপাদনের শক্তি যথেষ্ট আছে এবং এরা খুব শক্তিশালী হয়। অনেক সময় দেখা গেছে, দলীয় নেতৃত্বের জন্য মদ্দা দাঁতাল হাতির সঙ্গে মাখনা হাতির লড়াইয়ে মাখনা হাতি প্রচণ্ড শক্তিতে শুঁড় দিয়ে দাঁতাল হাতির দাঁত সবলে উপড়ে ফেলেছে। মাখনা হাতিকে ভগবান যেমন দাঁত দেননি, সেই ক্ষতিপূরণ কবেছেন তার ঘাড়ে ও শুঁড়ে প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে। দেখা যায়, মাখনা—দাঁতাল মদ্দা হাতির চেয়ে বলিষ্ঠ হয় ও উচ্চতাতেও কিছু বড়ো হয়, তাদের লড়াই করবার ক্ষমতাও সাধারণত বেশি হয়ে থাকে। হাতি মারার হুকুম সরকার দুই কারণে দিয়ে থাকে। প্রথম—হাতি পাগলা হলে, দ্বিতীয়—হাতির সংখ্যা খুবই বেড়ে গেলে। হাতির সংখ্যা খুব বেড়ে গেলে কিছু হাতি মেরে হাতির সংখ্যা কমানো হয়। একে ‘এলিফ্যান্ট পপুলেশন কন্ট্রোল’ বলা হয়। সেই সময় সরকার এলিফ্যান্ট কন্ট্রোল লাইসেন্স দিয়ে থাকে। এই লাইসেন্সে সাধারণত বন্য হাতি মারা হয়। আমাদের দেশে কোনো-কোনো প্রদেশে দাঁতাল মদ্দা হাতি মারার সঙ্গে তিনটে মাদি হাতি মারতে হবে এই নিয়ম প্রচলিত আছে। এগুলো সাধারণ জংলি হাতি; স্বভাবত ওরা নিরীহ ও ভীরু। পাগলা হাতির সঙ্গে ওদের স্বভাবের কোনও মিল নেই।
আমার পাগলা হাতি শিকারের প্রস্ততিপর্ব শুরু হল ১৯৬০ সালের গোড়ার দিকে এবং তা ক্রমশই গড়িয়ে চলল ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত। এই সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আমার নানা যোগাযোগ, আবেদন ও অনুরোধের পালা। আসাম ও ত্রিপুরার কমিশনার ও কনজারভেটর অফ ফরেস্টস—এঁদের সঙ্গে নানা যোগাযোগের ফলে আমার শিকার দরখাস্তের ফাইল ক্রমশ কেবল আয়তনেই বৃদ্ধিলাভ করল, কিন্তু কিছুতেই আর পাগলা হাতি শিকারের অনুমতি পেলাম না। ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে আমার কাকা স্বর্গীয় সত্যেন ব্যানার্জী, আই.সি.এস-এর ছোটো ছেলের বিবাহ উপলক্ষ্যে আমাকে কলকাতায় যেতে হয়। এই বিয়েতে উপস্থিত সুধীজনের মধ্যে আমার কাকার বিশেষ স্নেহের পাত্র, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বন বিভাগের সর্ব উচ্চপদস্থ অফিসার, শ্রীকনক লাহিড়ী মহাশয়ের উপস্থিতি এবং তাঁর সঙ্গে আলাপরত অবস্থায় শুসুংয়ের মহারাজা শ্রীভূপেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ মহাশয়কেও দেখি। মহারাজ খুবই অভিজ্ঞ শিকারি এবং শিকারি হিসাবে পেশাগত সাদৃশ্য থাকায় আমাকে খুবই স্নেহ করেন। তাঁদেরকে একযোগে আমার পাগলা হাতি শিকার করতে যাবার উদ্যমের কথা বলতে, মহারাজ আমাকে অনেক মূল্যবান উপদেশ দেন ও আশীর্বাদ করেন। লাহিড়ী মহাশয় আমার গত কয়েক বছরের নানা প্রচেষ্টার কথা শুনে এবং এ-বিষয়ে তাঁর সাহায্যপ্রার্থী হলে দয়াপরবশ হয়ে বলেন, যদি ত্রিপুরাতে পাগলা হাতি থাকে এবং সরকারি গেজেটে সেই খবর বার হয়ে থাকে, তাহলে তিনি আমাকে অনুমতির ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। আমার একান্ত অনুরোধে তিনি জানান যে, সপ্তাহকাল মধ্যে খবর নিয়ে তিনি আমাকে সমস্ত জানাবেন। দিন কয়েকের মধ্যেই লাহিড়ী মহাশয়ের কাছ থেকে ত্রিপুবার চিফ ফরেস্ট অফিসার শ্রী এন.সি. ভট্টাচার্য মহাশয়ের লেখা একটি চিঠি পাই। তিনি আমাকে ত্রিপুরার কমিশনারের কাছে একটা আবেদনপত্র পাঠাবার কথা এবং তাঁর কাছে আমার আবেদনপত্রের একটা অনুলিপিও পাঠাবার কথা বলেছেন। আমি তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী ত্রিপুরার কমিশনারের কাছে পাগলা হাতি মারার অনুমতির জন্যে আবেদনপত্র পাঠাই এবং তাঁকে তার একটা অনুলিপি পাঠাই। এইভাবে ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসের শেষ থেকে ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত আমাদের বহু চিঠিপত্রের আদানপ্রদান হয়। কিন্তু বন বিভাগের নিয়মকানুন অনুযায়ী যা-কিছু করার সমস্ত ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যবশত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কমিশনার সাহেবের দপ্তর থেকে কোনও অনুমতি পাওয়া গেল না। অনেক চিঠি লেখার পর ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ কমিশনার সাহেবের দপ্তর থেকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সই করা একটা চিঠি পেলাম। তিনি লিখেছেন—‘উপস্থিত ত্রিপুরাতে কোনও পাগলা হাতি নাই, অতএব আপনার আবেদনপত্র নাকচ হইয়া গেল।’ এই চিঠি পেয়ে আমি অত্যন্ত বিমর্ষ ও হতাশ হয়ে পড়লাম এবং সঙ্গে সঙ্গে লাহিড়ী মহাশয় ও ভট্টাচার্য মহাশয়ের কাছে খুব করুণস্বরে আমার মর্ম-যাতনার খবর দিয়ে চিঠি দিই। আশ্চর্য, ভট্টাচার্য মহাশয় কিন্তু আমার চিঠি পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই টেলিগ্রাম করে আমায় জানান যে, ১লা মার্চ নাগাদ আমি যেন আগরতলায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করি এবং তখনই তিনি পাগলা হাতি শিকারের যাবতীয় অনুমতিপত্র কমিশনার সাহেবের কাছ থেকে বার করে দেবেন। এই খবর পেয়ে শিকারের আশায় ও আকাঙ্ক্ষায় আমার প্রাণ ভরে গেল। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার শিকারি বন্ধু ভবানী গাঙ্গুলীর কাছে গেলাম এবং তাকে এই সুখবরও জানালাম। খবর শুনে সে আনন্দে অধীর হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল এবং কালবিলম্ব না করে আমরা যাত্রার প্রস্ততি করতে লাগলাম।
অতঃপর প্রস্ততি পর্ব। প্রথমে ঠিক হল জিপে করে যাওয়া হবে আগরতলা। রাস্তার নকশা দেখে কোন পথ দিয়ে যাওয়া হবে তা ঠিক করা হল। আগরতলা মোটর পথে যাওয়া অনেকটা ঢেঁকিশাল দিয়ে কটক যাবার মতন; অনেক ঘুরে প্রায় ১৫০০/১৫৫০ মাইলের মতন রাস্তা। ভবানী জিপ চালাতে অভ্যস্ত না হওয়ায়, আমার একার পক্ষে জিপ চালিয়ে গিয়ে শিকার করে ফিরে আসা একটু বিপদজনক মনে হল। তাই সন্ধানী হলাম তৃতীয় শিকারি বন্ধুর—পাওয়াও গেল কাছেই, আমাদের এখানকার একজন পুলিশ অফিসার শ্রী এন. সি. সেন। তিনি আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হলেন। কিন্তু কিছুদিন পরে তাঁর পক্ষে একনাগাড়ে এক মাসের ছুটি জোগাড় করা অসম্ভব বলে জানালেন। সেই সময়ে আমাদের এক বিশেষ বন্ধু, উপস্থিত আসামের এক উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার, শ্রী এম. দাস মহাশয় বার্ণপুরে আসেন। তাঁকে আমাদের হাতি শিকার উদ্যোগের সমস্ত খবর, বিশেষত জিপে করে ত্রিপুরায় যাচ্ছি বলাতে তিনি আমাদের জিপে করে ত্রিপুরায় যাবার জন্যে বিশেষভাবে মানা করেন। কারণ, সে-সময়ে শিলচর থেকে ত্রিপুরা যাবার পথে মিজোদের উপদ্রব খুব উগ্রভাবে চলছিল। তিনি আমাদের বিমানপথে যাবার কথা বলেন এবং আসামে ফিরে যাবার পথে কলকাতায় তিনি আমাদের জন্যে তিনখানা প্লেনের টিকিট কিনে রেখে যান। এতে আমাদের খুবই সুবিধে হয়। অন্যথায়, আমরা যথাকালে ত্রিপুরায় পৌঁছতে পারতাম না।
২৫শে ফেব্রুয়ারি রাত্রের গাড়িতে আমরা কলকাতা রওনা হলাম। ভোরে কলকাতায় পৌঁছে প্রথমেই সংগ্রহ করলাম প্লেনের টিকিটগুলি এবং পরে এয়ার ইন্ডিয়ার সেন্টাল বুকিং অফিসে গিয়ে মি. সেনের টিকিটটি ফেরত দিয়ে সোজা রওনা হলাম বিমানবন্দর অভিমুখে। সেখানে আমাদের আর এক বন্ধু শ্রী এ. কে. বিশ্বাসের বাড়িতে উঠলাম । উনি ‘এয়ার ইন্ডিয়া’-র আবহাওয়াবিদ। সেখানে আদরযত্ন ও খাওয়াদাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে, বন্ধুটির সাহায্যে আমাদের বন্দুক ইত্যাদি জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার যেসব বাধা ও নিয়মকানুন আছে, সেগুলোর ব্যবস্থা করে ফেললাম। আমরা দুপুর প্রায় তিনটের সময় আই.এ.সি-র ‘ফকার ফ্রেন্ডশিপ’ বিমানে চেপে, চারটের কিছু আগেই আগরতলায় পৌঁছলাম।
বিমানবন্দরে পৌঁছে ভাবছি এরপর কী করব—এই সময় একজন অল্প বয়সের যুবক এসে আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমার নাম শুনে জানালেন, তিনি বন বিভাগের অফিস থেকে এসেছেন আমাদের নিয়ে যাবার জন্যে এবং উপরমহলের নির্দেশমতো তিনি আগরতলার সার্কিট হাউসে আমাদের সে-রাত্রের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে এসেছেন। তাঁকে বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা কালবিলম্ব না করে বন বিভাগের জিপে মালপত্র তুলে সার্কিট হাউসের দিকে রওনা হলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই সার্কিট হাউসে পৌঁছে, যত শীঘ্র সম্ভব আমাদের মালপত্রগুলি নির্দিষ্ট কামরায় রেখে সেই জিপে করেই আমরা বন বিভাগের অফিসে গেলাম। আলাপ হল ভট্টাচার্য মহাশয়ের সঙ্গে, তিনি আমাদের প্রচুর খাতির-যত্ন করলেন। অসময়ে পৌঁছলেও তিনি নিজের চেষ্টায় আমার কাগজপত্র যদ্দুর সম্ভব তাড়াতাড়ি সমস্ত সরকারি নিয়মকানুন সেরে কমিশনার সাহেবের হুকুমনামাপত্র ইত্যাদি ঘণ্টা দু-একের মধ্যে আমাদের হাতে দিয়ে দিলেন।
শিকারের ফি, ট্রেজারিতে জমা করার চালান ও রসিদ আমরা পেয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে। নিজের তরফে তিনি খবর পাঠিয়ে দিলেন বন ও পুলিশ বিভাগের সবকটি দপ্তরে যে আমরা পাগলা হাতি শিকারের অনুমতি পেয়েছি এবং আমাদের নির্দেশ দিলেন আমরা যেন পরের দিন ভোরে রওনা হয়ে আগরতলা থেকে ৭৫ মাইল দূরে আগরতলা-কলকাতা রোডের ওপর মনুঘাটে যে বন বিশ্রামাগার আছে সেখানে গিয়ে পৌঁছাই। তিনি দুপুর তিনটের মধ্যে ওখানে আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন এবং ফরেস্ট অফিসার ও ফরেস্ট রেঞ্জারদের ডেকে একটা ছোটোখাটো বৈঠক বসিয়ে আমাদের হাতি শিকারের প্রকল্প ঠিক করে দেবেন। এই নির্দেশ পাবার পর আমাদের কয়েকটি সমস্যা দেখা দিল; যথা, প্রথমত—বিমানপথে আসার জন্যে আমাদের এক মাসের খাওয়াদাওয়ার রেশন ইত্যাদি আনা সম্ভব হয়নি; দ্বিতীয়ত—সঙ্গে আমরা কোনও পাচক নিয়ে যেতে পারিনি এবং তৃতীয়ত—রান্নার কোনও বাসনকোসনও আমরা নিয়ে যেতে পারিনি। একটু কিন্তু কিন্তু করে, সাহসে ভর করে আমি ভট্টাচার্য মহাশয়ের কাছে আমাদের সমস্যাগুলি পেশ করলাম। আশ্চর্য, তিনি প্রত্যেকটি সমস্যাই অতি অল্প সময়ের মধ্যে সমাধান করে দিলেন। যে ভদ্রলোকটি জিপ নিয়ে বিমানবন্দরে আমাদের আনবার জন্য গিয়েছিলেন, তাঁকে নির্দেশ দিলেন আগরতলা বাজারে আমাদের নিয়ে গিয়ে রেশন ও আনুষঙ্গিক জিনিস কিনতে সাহায্য করার জন্য। পাচক সম্বন্ধে তিনি বললেন, “এটা কোনও সমস্যাই নয়। কারণ, আপনাদের সঙ্গে আমাদের বন বিভাগের একজন ফরেস্ট গার্ড সবসময়ের জন্যই থাকবে, বন বিভাগের আইনকানুন ইত্যাদি ব্যাপারে আপনাদের সাহচর্যের জন্য। আপনাদের সুবিধার্থে আমরা এমন একটি লোক সঙ্গে দেব যে নিজের রান্নার সঙ্গে আপনাদের কিছু রেঁধে খাওয়াতে পারবে। বন বিভাগেরই যে তৈজসপত্র আছে, তাই থেকে কিছু কয়েকদিনের ব্যবহারের জন্য বার করে দেওয়া মোটেই শক্ত ব্যাপার নয়।”
আমরা অত্যন্ত খুশি হয়ে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আগরতলা বাজারের দিকে রওনা হলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের আবশ্যকীয় জিনিসপত্র কেনা হয়ে যাবার পর আমরা অতিকষ্টে ট্রেলার সমেত একটা জিপ ভাড়ার বন্দোবস্ত করলাম, যাতে করে ভোরে আগরতলা ছেড়ে আমরা মনুঘাটে পৌঁছতে পারি।
দূরত্বের তুলনায় ভাড়া কিছু বেশি, মাথা পিছু ৩০ টাকা করে। যদিও শুরুতে আমরা থাকব তিনজন—আমি, ভবানী ও ফরেস্ট গার্ড জিতেন, কিন্তু জিপওয়ালা আমাদের সঙ্গে চুক্তি করে নিল যে, পথে সে তার সুবিধা ও সুযোগমতো অন্য যাত্রীও ওঠাতে নামাতে পারবে। ওটাই ওখানকার দস্তুর হওয়ায় ওই ব্যবস্থায় রাজি হওয়া ছাড়া কোনও গত্যন্তর ছিল না।
ব্যবস্থা অনুযায়ী পরের দিন ভোর ছ’টায় জিপ এল সার্কিট হাউসে। আমরা ভোরবেলা থেকেই প্রস্তত হয়ে ছিলাম। জিপ আসার সঙ্গে সঙ্গে মালপত্র ট্রেলারে চাপিয়ে আমরা মনুঘাটের দিকে রওনা হলাম।
ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোরম। আগরতলা থেকে ১৫/২০ মাইল আসার পর শুরু হল বেশ ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। রাস্তায় অনেক জায়গায় লোক ওঠানো নামানো ইত্যাদি সেরে আমরা প্রায় দুপুর আড়াইটার সময় মনুঘাট বন বিশ্রামাগারের কাছে এলাম। মালপত্র বয়ে নিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখি ভট্টাচার্য মহাশয় আমাদের পৌঁছাবার আগেই এসে তাঁর কর্মচারীদের নিয়ে বৈঠক করে আমাদের পাগলা হাতি শিকারের প্রাথমিক খসড়া করে ফেলেছেন। আমরা যেতেই তিনি খুব উৎসাহের সঙ্গে জানালেন যে মনুঘাট থেকে ১৮/২০ মাইল তফাতে ছা-মনু বলে একটা ছোট্ট জায়গা আছে, সেখানে একটা পাগলা হাতি খুবই উপদ্রব করছে। ইতিমধ্যে হাতিটা ৬/৭ জনকে মেরে ফেলেছে—সর্বশেষ লোকটি মারা পড়ে মাত্র ৩/৪ দিন আগে। তাঁর অনুরোধ, আমরা যেন প্রথমেই ওই হাতিটি মারবার চেষ্টা করি এবং ইতিমধ্যে তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীরা অন্যান্য জায়গায় পাগলা হাতির খবর জোগাড় করে রাখবে। অতঃপর তিনি ছা-মনুর পাগলা হাতিটির যাবতীয় পরিচিতি আমাদের জানান। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল হাতিটির লেজটি কাটা। এই বিশেষ পরিচিতি মনে রাখার পক্ষেও খুব সহজ। এ-সত্ত্বেও তিনি বার বার করে বলে দিলেন, যে একেবারে নিশ্চয় না হয়ে আমরা যেন গুলি না চালাই। যদি ভুলক্রমে ওই হাতিটি না মেরে আমরা অন্য কোনও হাতি মারি তাহলে আমাদের অনেক ঝামেলায় পড়তে হবে। খুব বেশি টাকার জরিমানা সমেত জেলও হতে পারে। আমরা ভদ্রলোককে কথা দিলাম যে আমাদের তরফে নিয়ম লঙ্ঘন করার কোনোই সম্ভাবনা থাকবে না এবং আমরা যদি চিহ্নিত পাগলা হাতিটি খুঁজে বার না করতে পারি, তাহলে খালি হাতে ফিরে এসেই তাঁর সম্মান রাখার চেষ্টা করব। তিনি আমাদের ওই প্রতিশ্রুতি পেয়ে খুব খুশি মনে আমাদের বাকি ব্যবস্থার ভার মি. দাস বলে একজন বিভাগীয় ফরেস্ট অফিসারের উপর দিয়ে আগরতলায় ফিরে গেলেন।
তারপর শুরু হল মি. দাসের সঙ্গে আমাদের বৈঠক। কিন্তু প্রথম সমস্যা হল ছা-মনু যাওয়া। মি. দাস বললেন, ওই পথে তাঁর কিছু কাজ আছে এবং তাঁকে কাল যেতে হবে। আমরা ইচ্ছে করলে তাঁর সঙ্গে কিছুটা পথ যেতে পারি। আমরা তৎক্ষণাৎ সানন্দে রাজি হলাম।
পরের দিন সকালে চা ও বিস্কুট সহযোগে প্রাতরাশ সেরে আমরা মি. দাসের সঙ্গে জিপে চেপে বসলাম। ওই অঞ্চলের পথঘাট খুবই খারাপ। সামনেই সুবিশাল লংতরাই পাহাড় শ্রেণি। তারই কোল দিয়ে দিয়ে রাস্তা। মাঝে মাঝে চোখে পড়ল দু-একটা ছোটোখাটো পাহাড়ি বসতি। সবই বাঁশের খুঁটির উপর ৫/৬ ফুট উঁচুতে মাচানের উপরে বাঁশের ছাউনির ঘরবাড়ি, ওই বাঁশ দিয়েই ঘরের পাটাতন ও চার দেওয়াল তৈরি। চোখে পড়ল মেয়েদের গলায় নানা রঙের পুঁতির মালা এবং উপরের অঙ্গবস্ত্র কিছুই নেই। কোমর থেকে ছোটো বহরের নিজেদের হাতে বোনা মোটা রঙবেরঙের লুঙ্গি পরা; শিশুরা অধিকাংশই উলঙ্গ, তাদের স্বাস্থ্যের ছটা চোখে পড়ে; পুরুষরা বেশ স্বাস্থ্যবান, কোমরে এক ফালি কাপড়ের কপনি জড়ানো। সকলেই উজ্জল শ্যামবর্ণ। এই বসতিগুলি সাধারণত একটু উঁচু টিলার উপরেই দেখতে পেলাম।
এর মধ্যে দিয়ে প্রায় দু-ঘণ্টা চলার পর বেলা দশটা নাগাদ আমরা এমন একটা জায়গায় এলাম, যেখান থেকে জিপে আর একটুও এগোনো সম্ভব নয়। মি. দাস বললেন, ওখান থেকে প্রায় ৭/৮ মাইল হাঁটাপথে গেলে পাওয়া যাবে ছা-মনুর বিট অফিস এবং ওটাই হবে আমাদের বেস ক্যাম্প। ওখানে আমাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে পাগলা হাতি শিকারের অভিযান শুরু করতে হবে।
জিপ থেকে নেমে আমরা ভাবছি, আমাদের সব সাজসরঞ্জাম নিয়ে আমরা কী করে ৭/৮ মাইল পথ যাব। কাছেই জনকয়েক মজুর একটা পাহাড়ি নদীর ওপর বাঁশ দিয়ে একটা পুল মেরামত করছিল। আমরা প্রথমে দ্বারস্থ হলাম তাদের কাছে। কিন্তু পর্যাপ্ত বকশিসের বিনিময়েও তাদের রাজি করাতে পারলাম না। এই সময় প্রায় শ-খানেক গজ দূরে মাটির আল বেয়ে জন পনেরো লোককে ওপরে আসতে দেখলাম। ওদের দিকে মি. দাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে, তিনি বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে বললেন, “আপনাদের বরাত ভালো—ওই আলের অপর পারে বয়ে যাচ্ছে মনু নদী এবং ওই নদীপথে নৌকা করে এসেছে সদ্যবিবাহিত বর-কনে ও তাদের সহযাত্রীরা।”
মি. দাস আমায় বললেন, “বুঝলেন কেন বললাম আপনাদের বরাত ভালো?”
আমি তখনও ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারিনি তাই বোকার মতন তাঁর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তিনি বললেন, “ওই বর-কনে ও তাদের সহযাত্রীরা ছা-মনু থেকে নদীপথে ওখানে এসেছে। এবার ওদের নামিয়ে দিয়ে খালি নৌকা ছা-মনুর দিকে ফিরে যাবে। আপনারা ইচ্ছে করলে ওই খালি নৌকায় চেপে মালপত্র নিয়ে যেতে পারেন।”
বলেই তিনি পাঠালেন জিতেনকে নৌকার মাঝির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। অল্পক্ষণের মধ্যেই জিতেন ফিরে এল মাঝির সম্মতি নিয়ে। সময় নষ্ট না করে আমর মালপত্র ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে তুললাম নৌকায়। এমন সময় বেশ শক্তসমর্থ গোছের একটি পাহাড়ি লোক এসে হাজির হল নৌকার কাছে—বিদেশিদের দেখার সাধারণ কৌতুকবশত বোধ হয়। মি. দাস তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সে আমাদের সঙ্গে বন্দুকের বাক্স বয়ে ছা-মনু যেতে রাজি কি না। লোকটি রাজি হওয়ায় মি. দাস আমাদের বললেন, বন্দুকগুলি নিয়ে আমরা যদি হাঁটাপথে ছা-মনু যাই, তাহলে নৌকার অনেক আগেই ছা-মনু পৌঁছে বিশ্রাম করতে পারব, কারণ নৌকা অনেক ঘোরাপথে যাবে।
মালপত্র আগলে নৌকায় বসল জিতেন মাঝিদের সঙ্গে এবং শুরু হল যাত্রা। আমি ও ভবানী পাহাড়ি লোকটার মাথায় বন্দুকের বাক্স চাপিয়ে জুতো-মোজা খুলে প্যান্ট গুটিয়ে নদী পার হয়ে এগিয়ে চললুম। কারণ, মি. দাস বললেন নদীর যে-পাড়ে আমরা আছি সে-পাড়ের জঙ্গল এতই ঘন ও গভীর যে হাঁটাপথেও যাওয়া সম্ভব নয়, নদীর অপর পাড় দিয়ে একটা পাকদণ্ডি বা হাঁটাপথ আছে, সেই পথ ধরে গেলে অনায়াসেই আমরা ছা-মনু পৌঁছতে পারব। আমাদের বিদায় দেবার আগে মি. দাস ছা-মনুর বিট অফিসার মি. চক্রবর্তীর কাছে আমাদের পরিচিতি ও সাহায্যের জন্য একটা চিঠি দিলেন। আমরা তাঁকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।
প্রায় সাড়ে তিনটের সময় আমরা ছা-মনুর বন বিভাগের বিট অফিসে এসে পৌঁছলাম। অফিসটি একটা মনোরম জায়গায়—দু-পাশ দিয়ে পাহাড়ি নদী বয়ে যাচ্ছে আর যতদূর দৃষ্টি যায় পাহাড় আর ঘন জঙ্গল ছাড়া অন্য কিছুই দেখা যায় না। দেখতে পেলাম ওখানে কয়েকটি কোয়ার্টার আছে—একটি বিট অফিসার শ্রীঊষা চক্রবর্তীর আর একটি ফরেস্ট গার্ডের—তারা সেখানে রয়েছে সপরিবারে। আর তার পাশেই গেস্ট হাউস সমেত বিট অফিস। ফরেস্ট গার্ডের কাছে আমাদের অভিপ্রায় জানাতে এবং ঊষা চক্রবর্তীর খোঁজ করাতে, সে গেস্ট হাউস খুলে দিয়ে চলে গেল বাজারে ঊষা চক্রবর্তীর সন্ধানে। নজরে পড়ল নদীর অপর পাড়ে ছা-মনুর বাজার—নদী পারাপারের জন্য সংযোজক রয়েছে এক বাঁশের সেতু। গেস্ট হাউসটি হালফিলের তৈরি মনে হল—প্রচুর জানালা ও এক দরজাওয়ালা ছোট্ট পাকাঘর। ঘরের আসবাবের মধ্যে দুটো কাঠের চৌকি, একটি ছোটো টেবিল, দুটো চেয়ার ও একটা কাঠের আলনা। পরিবেশ খুব মনোরম নিঃসন্দেহে, কিন্তু সারাদিন প্রায় অভুক্ত অবস্থায় এতখানি পথ আসার পর আমাদের আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো মনের অবস্থা ছিল না।
বন্ধুবর ভবানীর খুব পেটা স্থাস্থ্য—কুস্তি ও ডন-বৈঠকের মাধ্যমে প্রচুর মেহনত করে সে তার শরীরটিকে তৈরি করেছে। কিন্তু সারাদিনে এক কাপ চা ও কয়েকটা বিস্কুটের রসদে এই দুর্গম পথ হেঁটে আসার পর দেখলুম তার কথা বলার কোনও উৎসাহ নেই এবং মেজাজও খুব খিটখিটে। শরীর ও মনের দিক দিয়ে শ্রান্ত আমিও, কিন্তু তখন আমার চিন্তা নৌকা কখন পৌঁছবে মালপত্র ও জিতেনকে নিয়ে। হঠাৎ বেশ গর্জন করে নাক ডাকার আওয়াজ এল। দেখি আমার কুস্তিগীর বন্ধু ভবানী চৌকির উপর লম্বা হয়ে শুয়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি অস্বস্তিতে সারা ঘর পায়চারি করতে লাগলাম।
অল্পক্ষণ মধ্যেই ঊষা চক্রবর্তী এলেন। দেখে বেশ অল্প বয়সের খুব উৎসাহী ছেলে বলে মনে হল। তাই শুরুতেই ‘তুমি’ সম্বোধনে নেমে গেলাম। তাকে আমাদের উদ্দেশ্যের কথা জানাতে এবং মি. দাসের চিঠি দেখাতে সে ব্যাপারটা সব বুঝতে পারল এবং অতি উৎসাহের সঙ্গে বলল যে, আমরা খুব ভালো দিনেই এসেছি। সে-দিনটি ছিল হাটের দিন। হাটের দিনে আশেপাশের পাহাড়ি এলাকায় যত আদিবাসী আছে, তারা আসে ছা-মনুর হাটে কেনা-বেচা করার জন্যে। ভদ্রলোক বলল, সে তক্ষুনি গিয়ে আদিবাসীদের মোড়ল ও কয়েকজন শিকারিকে ডেকে আনতে পারবে যারা পাগলা হাতিটার সঠিক খবরাখবর জানে। এদিকে সূর্য ঢলে আসছে দেখে আমি আর বিলম্ব না করে চক্রবর্তীকে ছা-মনুর হাটে পাঠিয়ে দিলাম আর শ্যেনদৃষ্টিতে পথে নজর রাখলাম মালপত্র নিয়ে জিতেন ফিরছে কি না।
চক্রবর্তী অল্পক্ষণের মধ্যে ফিরে এল জনচারেক পাহাড়ি আদিবাসীকে সঙ্গে নিয়ে; আলাপ করিয়ে দিল তাদের মোড়লের সঙ্গে। আমরা শুধুমাত্র সিগারেট দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করলুম এবং সবিনয়ে বললুম যে আমাদের মালপত্র এখনও রাস্তায়—নৌকাপথে আসছে, কাজেই ইচ্ছা থাকলেও অন্য কিছু দিয়ে আপ্যায়ন করার সামর্থ আমাদের আপাতত নেই। চক্রবর্তী কিন্তু তার আতিথেয়তায় কোনও ত্রুটি রাখেনি। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে তার বাসা থেকে গরম চা নিয়ে এসে আমাদের সবাইকে দিল।
ত্রিপুরার ওই পাহাড়তলিতে দু-রকম আদিবাসী বাস করে। এক জাতীয়দের বলে চাকমা ও অপর জাতীয়দের ত্রিপুরিয়ান আদিবাসী বলা হয়। চাকমারা বৌদ্ধধর্মীবলম্বী এবং ত্রিপুরিয়ানরা হিন্দু। চক্রবর্তী যাদেরকে আমাদের কাছে নিয়ে এল তারা সবাই ত্রিপুরিয়ান আদিবাসী, বাস করে লংতরাই পাহাড়ের কোলে। দুর্ভাগ্যক্রমে পাগলা হাতিটি ওই লংতরাই পাহাড়ের কোলে ওদেরই ছ’জনকে মেরেছে। কথাবার্তার মাধ্যমে বুঝলাম আমরা আসাতে ওরা খুব খুশি হয়েছে এবং ভরসা পাচ্ছে যে, আমরা সত্যিই তাদের বিপদমুক্ত করতে পারব। তারা অতি উৎসাহে আমাদের সবরকম সাহায্যে এগিয়ে আসবে এরকম প্রতিশ্রতিও দিল। সুযোগ বুঝে আমি মোড়লকে বললাম, “তাহলে আজ রাতটা তোমরা আমাদের এখানে থেকেই যাও, পরের দিন খুব ভোরেই আমরা বেরিয়ে পড়তে পারব হাতি শিকারে।”
মোড়ল কিন্তু এতে রাজি হল না। সে বললে, “সাহেব, আমি গ্রামের মোড়ল হয়ে কী করে গ্রাম ছেড়ে বাইরে থাকব, বিশেষত এই বিপদের দিনে? কথা দিচ্ছি, কাল ভোর ছ’টার মধ্যেই আমরা এসে আপনাদের নিয়ে যাব—মিথ্যে বলার দস্তুর নেই আমাদের।”
অতঃপর এ-প্রসঙ্গ তোলাই রইল, যদিও মনে মনে আমি তেমন খুশি হলুম না। দীর্ঘকাল শিকার করে আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, এইসব পাহাড়ি লোকেদের সময়জ্ঞান, দূরত্বজ্ঞান একেবারেই নেই। কিন্তু কোনও উপায় না থাকায় ওদের কথাতেই রাজি হতে হল। ওরা যাবার সময় বলল, “কোনও চিন্তা নেই—অভিজ্ঞ ট্র্যাকার, শিকারি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে আমরা হাতি শিকারে সাহায্য করব।”
সন্ধের মুখে প্রায় সাড়ে ছ’টা নাগাদ দেখি আমাদের জিতেন্দ্র ছা-মনুর ঢাল বেয়ে আস্তে আস্তে উঠে আসছে। মুখের চেহারা দেখে বুঝলাম সারাদিন অনাহারে ও নৌকায় রোদে পুড়ে তার অবস্থাও ভবানীর মতন সঙ্গিন। যাই হোক, নৌকা থেকে আমাদের যাবতীয় জিনিসপত্র—বাক্স, বিছানা, রেশন ইত্যাদি নিয়ে এসে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি আমাদের ঘরটাকে গুছিয়ে ফেললাম এবং জিতেনকে একটু চা বানাতে বললাম। দেখলাম জিতেনবাবু অত্যন্ত কাহিল হয়ে শুয়ে পড়েছেন। চা বানানোর কথায় শুয়ে-শুয়েই আমায় উত্তর দিলেন, “নৌকায় চাইপ্যা আমার গা গুলাইত্যাছে।”
বুঝলাম সে উপস্থিত কিচ্ছু আমার করতে পারবে না। তখন আমি নিজেই জনতা স্টোভ জ্বালিয়ে চা এবং পরে রাত্রের রান্না সেরে ফেললাম। তারপর খেয়েদেয়ে যে-যার বিছানায়। সারাদিনের ক্ষুধা, ক্লান্তি ও পথশ্রমের পর এই বিশ্রাম নিয়ে এল পরম আকাঙ্ক্ষিত গভীর ঘুম।
পরের দিন ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। চা ও বিস্কুট সহযোগে প্রাতরাশ সেরে আমরা তৈরি হয়ে নিলুম—সঙ্গে অসময়ের জন্য দু-এক প্যাকেট করে খেজুরও রাখলাম। আগরতলার বাজার থেকে কেনা প্রচুর আটা, ময়দা ও ঘি কোনও কাজেই লাগানো গেল না—রুটি বা পরোটা তৈরি করার ব্যাপারে; একমাত্র তাওয়ার অভাবে। রুটি সেঁকার তাওয়া যে কী অমূল্য বস্তু তার মূল্য বোঝা গেল এতদিনে। জানা গেল ও-অঞ্চলে তাওয়ার চলন নেই। সকালের খাওয়াটা একটু বেশি হওয়াই জরুরি ছিল, কারণ একবার শিকারে বেরোলে কখন ফেরত আসব তার কোনও ঠিক থাকে না। যাই হোক, যা সম্ভাব্য ও প্রাপ্তব্য ছিল তাইতেই খুশি হয়ে আমরা সেই আদিবাসীদের পথ তাকিয়ে বারান্দায় পায়চারি করতে লাগলাম।
দেখা গেল কথার দাম আছে আদিবাসীদের—ছ’টার মধ্যেই হাজির হল তারা। আমরা তাদের চা, বিস্কুট ও সিগারেট দিয়ে আপ্যায়ন করলাম। তারা নিজেদের আদিবাসী ভাষা ছাড়া ভাঙা ভাঙা পূর্ববঙ্গীয় ভাষাও বলতে ও বুঝতে পারে। তাতে ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা সহজ হল। বের হবার আগে আমাদের মালপত্র দেখাশুনা এবং আমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমাদের জন্য কোনও রান্না না করার কথা জিতেনকে বলে দিলাম।
পথে বেরিয়ে আমরা ওদের জিজ্ঞেস করলাম, যে-এলাকায় হাতি উপদ্রব করছে সে-এলাকা ওখান থেকে কত দূরে। তারা উৎসাহের সঙ্গে বলল, “বেশি দূর নয়, এই মাইল ৬/৭ হবে।”
কিন্তু মাইলের পর মাইল চলার পরও সে-পথ যেন ফুরোয় না। অনেক চড়াই-উতরাই, খানা-ডোবা পার হয়ে আমরা যখন আদিবাসীদের গ্রামে এসে পৌঁছলাম, তখন বেলা দশটা বেজে গেছে। সেদিন ১লা মার্চ—রোদের তেজ তখন প্রচণ্ড। আমার কাঁধে পার্ডির ‘৪৫০ ডবল ব্যারেল রাইফেল ও ভবানীর কাঁধে ওয়েবলি স্কটের ··৪৭০ সিঙ্গল শট রাইফেল। আমারটার ওজন প্রায় সাড়ে চৌদ্দ পাউন্ড এবং ভবানীরটা সিঙ্গল ব্যারেল হওয়ায় কিছু হালকা। এই মালভার ওই রোদে বয়ে নিয়ে আসতেই আমাদের দম শেষ হয়ে যাবার জোগাড়। যাই হোক, আমরা কোনোরকমে এগিয়ে চললাম মোড়লের মাচাবাড়ির দিকে। মোড়ল আমাদের ওপরে উঠে আসতে বলল। ওপরে ওঠার সিঁড়িও অভিনব, দেখলুম ৬/৭ ইঞ্চি মোটা একটা গাছের ডাল হেলানো অবস্থায় মাচার দেওয়ালে লাগানো এবং তাতে কিছু দূর অন্তর কুডুল বা কাটারি দিয়ে কেটে খাঁজ খাঁজ করা এবং পাশে একটা বাঁশের হাতলের মতন। আমরা অতি সাবধানে ওই খাঁজে পা দিয়ে বাঁশ ধরে ধরে মাচাবাড়ির ওপরে উঠলুম। মোড়লের বৌ আমাদের দু-ঘটি জল দিয়ে গেল। তাই দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এবং কিছু খেয়ে আমরা শান্ত হয়ে বসলুম। গ্রামের বহু লোক আমাদের দেখতে এল এবং শুরু হল আমাদের বৈঠক—কীভাবে অতঃপর এগোনো যায়। আমি মোড়লকে বললাম, “তুমি যে অভিজ্ঞ ট্র্যাকার, শিকারি ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করবে বলেছিল তারা কোথায়?”
মোড়ল বলল, “তারা খাওয়া সেরে এখুনি আসছে।”
কিছুক্ষণ পরেই জনতিনেক লোক নিয়ে একজন এগিয়ে এল। মোড়ল তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে বলল, “এ-ই এখানকার সবচেয়ে অভিজ্ঞ ট্র্যাকার, নাম তারুমণি ত্রিপুরা।”
মধ্যবয়সি সমর্থ মানুষ তারু। খুব ভালো লাগল ওর ছন্দময় নামটি শুনে। বাকি তিনজনও বেশ অল্পবয়সি। সবার সঙ্গে হাত মিলালুম আমরা। আর দেরি না করে মোড়ল ও বাকি গ্রামবাসীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে আমরা শুভকার্যে রওনা হলাম।
মাইল কয়েক হাঁটার পর আমারা পাহাড়ের কোলে এসে পৌঁছলাম। তারপর শুরু হল পাহাড়ে চড়ার দুর্গম পথ। আমরা শহর থেকে এসেছি। প্রথম দিনেই ভারী রাইফেল কাঁধে চাপিয়ে ১২/১৪ মাইল পথ হেঁটে আসার পর, এই দুর্গম পাহাড়ের চড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে আমাদের বুকের রক্ত প্রায় শুকিয়ে এল। কিন্তু নিরুৎসাহ হলে চলবে না, কারণ এই তো সবে শুরু। আমাদের মনের ও শরীরের সমস্ত শক্তি একসঙ্গে করে সেই আদিবাসী চারজনের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা পাহাড়ে উঠতে লাগলাম। প্রতি পদক্ষেপে আমাদের মনে হতে লাগল আমাদের ফুসফুল বোধ হয় এবার ফেটে যাবে। সময় সময় মনে হল যে আমরাই বোধ হয় প্রথম মানুষ যারা এই দুর্গম পাহাড় ও জঙ্গল ভেদ করে ওপরে ওঠবার চেষ্টা করছি।
প্রায় একশো গজ পাহাড়ে চড়ার পর আমরা যখন হাপরের মতন হাঁপাচ্ছি, তখন বোধ হয় কপালগুণে কিছুটা সমতল জায়গা পেলাম। কিস্তু সে-পথও বেশ দুর্গম এবং ঘন এলিফ্যান্ট গ্রাস দিয়ে ঢাকা। এলিফ্যান্ট গ্রাস লম্বায় ১৫/২০ ফুট এবং তাদের গোড়া আখের মতন মোটা। এর মধ্যে হাতির পাল স্বচ্ছন্দে লুকিয়ে থাকতে পারে বলেই বোধ হয় ওই নাম। স্বাভাবিকভাবে এই বিশেষ ধরনের ঘাস ভেদ করে যাওয়া অসম্ভব। শুধুমাত্র ওর মধ্য দিয়ে হাতি চলে গেলে যে-পথ তৈরি হয় সেই পথ ছাড়া আর কোনও রাস্তা পাওয়া যায় না। আমরা অতিকষ্টে ও সাবধানে সেই পথ ধরে হামাগুড়ি দিয়ে হাতির পায়ে দেবে যাওয়া গলিপথের মধ্য দিয়ে এগোতে লাগলাম।
এইভাবে ক্রমশ উঠতে উঠতে এবং কয়েকটা পাহাড় পেরিয়ে একটা পাহাড়ের মাথা বরাবর যখন এসে পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় তিনটে। আমাদের দুজনের অবস্থা দেখে আদিবাসীদের মনে হয়তো কিছুটা দয়ার সঞ্চার হল। তাই তারা আমাদের সেইখানে বসে একটু বিশ্রাম করার কথা বলল এবং তারা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে হাতির পাল দেখতে পায় কি না খবর নেবার জন্যে চারজন চারদিকে চলে গেল। আর আমরা দুই বীরপুরুষ অর্ধমৃতের মতন সেখানে বসে পড়ে হাপরের মতো হাঁপাতে লাগলাম।
আধঘণ্টা খানেক পরেই দেখি সেই আদিবাসী চারজন খুব উৎসাহের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে আমাদের কাছে এল এবং খুব নীচু গলায় আমায় বলল, “শিকারি সাহেব, আমরা মৈয়ুম দেখসি।”
হাতিকে ওখানকার আদিবাসীরা মৈয়ুম বলে। তারা আমাদের মৈয়ুম দেখাবার জন্য তাদের সঙ্গে যেতে অনুরোধ করল। আমরা আমাদের নির্জীব শরীর দুটোকে কোনোরকমে তুলে ধরে আবার সেই ভারী রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে তাদের অনুসরণ করলাম। কিছু দূর এগিয়ে দেখলাম, আমরা যে-পাহাড়ে আছি তার সামনের পাহাড়ের চুড়োর ওপর ২৫/৩০টি হাতি, মাদি ও বাচ্চা সমেত মনের আনন্দে খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু পাগলা হাতিটা সে-দলে নেই। প্রথম দিনেই এতগুলো হাতি দেখে মনে খানিক উৎসাহ পেলাম এবং হাতি দেখার ভান করে নিজেদের ক্লান্ত শরীর নিয়ে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে দিলাম। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, সূর্য ডুবতে আর বেশি দেরি নেই, প্রায় পাঁচটা বাজে। এই দুর্গম পথ বেয়ে আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে—এই কথা ভাবতেই বুকের রক্ত প্রায় জল হয়ে এল। যা হোক, ফিরতেই হবে যখন তখন আর ওসব চিন্তা ছেড়ে আমরা ওখানেই প্রথম দিনের অভিযান শেষ করে পাহাড়ের ওপর থেকে নামতে শুরু করলাম। আবার সেই ঘন জঙ্গল ও এলিফ্যান্ট গ্রাস ভেদ করে হাতিচলা রাস্তা ধরে অতি সাবধানে নামতে গিয়েও নিজেদের সামলানো প্রায়ই কঠিন হচ্ছিল। আমরা বেশ কয়েকবার পড়ে গিয়ে হাঁটুতে, হাতে ও গায়ে চোট খেলাম।
শেষ পর্যন্ত আমরা কোনোক্রমে যখন পাহাড়ের নীচে এসে পৌঁছলাম তখন গভীর অন্ধকার। এক হাত তফাতে কী আছে আমাদের নজরে পড়ছে না। তারু এক নালাপথ ধরে আমাদের নিয়ে চলল তাড়াতাড়ি গ্রামে পৌঁছাবার জন্য। নালাপথে কিছু জল ও ছোটো-বড়ো পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে আমরা প্রায় রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ ওদের গ্রামে এসে পৌঁছলাম। সকাল ছ’টায় আমরা চা ও কয়েকটা বিস্কুট খেয়ে বেরিয়েছিলাম, তারপর আর সারাদিন পেটে অন্য কিছু পড়েনি। তার ওপর এতখানি পথ ভারী রাইফেল ঝুলিয়ে হাঁটা ও পাহাড়ে ওঠানামা করার পর আমাদের শরীরে আর কিছু ছিল না। গ্রামের পথে চলার সময় ঘন ঘন কয়েকবার বিদ্যুৎ চমকাল; মনে হল বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা। শরীরটাকে কোনোরকমে টানতে টানতে পথ চলছি আর ভাবছি বন্ধুবর ভবানীর কথা। তাকে যদি সারাদিনের এই অমানুষিক পরিশ্রমের পর কিছু খেতে দিতে না পারি তাহলে হয়তো আমাকেই খেয়ে ফেলবে। গ্রাম থেকে ছা-মনু আরও ১২/১৪ মাইল পথ। সেখানে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমাদের খাওয়া বা শোওয়ার যে কী ব্যবস্থা হতে পারে তা আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। শরীরে কিন্তু আর বিন্দুমাত্র ক্ষমতা নেই ছা-মনু ফিরে যাবার।
এ-অবস্থায় আমরা মোড়লের মাচাবাড়ির নীচে এসে পৌঁছলাম। মোড়ল আমাদের মাচার উপর উঠে আসতে বলল। আমরা কোনোক্রমে মোড়লের মাচাবাড়ির বারান্দাতে উঠে ধপাস করে বসে পড়লাম। তখন কথা বলারও কোনও ক্ষমতা ছিল না। মোড়লের বৌ দু-ঘটি জল দিয়ে গেল—তাই দিয়ে আমরা হাত-মুখ ধুয়ে ও কিছুটা পান করে চুপ করে বসে রইলাম।
আকাশে বিদ্যুতের চমকানি তখন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মোড়ল আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজ আপনাগো ছা-মনু যাওয়া হবে না। আকাশের যা অবস্থা তাতে এখুনি জোর ঝড়-জল হবে।”
এই কথা বলতে না বলতেই ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি ও তার সঙ্গে এক-একটি টেনিস বলের মতন শিল পড়তে লাগল। মোড়ল আমাদের তার ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বাঁশের দরজা বন্ধ করে দিল। ঝড়ের দাপটে মাচাবাড়িটা দুলতে লাগল, ভয় হল উড়িয়ে না নিয়ে যায়। আমাদের গায়ে তখন উপর থেকে নরম ন্যাতার মতো অনবরত কিছু পড়ছে বলে মনে হল, কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখা গেল না। জল-ঝড় কমে গেলে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর বুঝতে পারা গেল কী বস্তু ফুল-চন্দনের মতো আমাদের মাথায় ও সর্বশরীরে পড়ে প্রায় ঢেকে ফেলেছে দুজনকে। দেখা গেল মাচাবাড়ির বাঁশের মেঝের উপরেই মাটির বেদি করা উনুন—ওদের রান্না করার ব্যবস্থা, তাও একটি চুলো নয়—দুই দুইটি; কারণ বাঁশের বেড়া দিয়ে একই ঘরকে দুই ভাগ করা এবং প্রত্যেক ভাগেই একটি রান্নার উনুন বানানো। ঘরেই রান্না করার দরুন বছরের পর বছর জমে উঠেছে মোটা পরতের ঝুল। ঝড়ের দাপটে সেগুলি খসে পড়ে আমাদের প্রায় কবরই দিয়ে ফেলেছিল। যা হোক, করার তো কিছু ছিল না। আমরা দুই বন্ধু শিকারের জাঙ্গল হ্যাট (Jungle Hat) দুটি সমস্ত মুখ ও নাকের উপরে টেনে দিয়ে প্রত্যেকেই দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে রইলাম। এদিকে বিদ্যুতের ঝিলিকে দেখা গেল বড়ো বড়ো শিলে মাচাবাড়ির বারান্দা ও আশেপাশে যত দূর দৃষ্টি যায় সব সাদা হয়ে গেছে। ৪০/৫০ মিনিট ধরে ভীষণ ঝড় হবার পর ঝড়ের বেগ একটু কমতে ভীষণ বৃষ্টি আরম্ভ হল এবং বৃষ্টির ফলে শিল গলতে শুরু করল আর ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বরফ গলার ঠান্ডা মিলে আমাদের হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল।
এইভাবে কাটালাম ঘণ্টা দেড়েক, ঝড়-জলও কমল। ইতিমধ্যে সেই অন্ধকার ঘরে কে যেন এসে কাঠ জেলে উনুনটা খুঁচিয়ে আগুন তুলতেই সেই আগুনের আভাতে আমাদের দেখে মোড়লের স্ত্রী খিলখিল করে হেসে উঠল আর আমরা দুই বন্ধু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বোঝবার চেষ্টা করলাম অত হাসির কারণ কী। আমরা দুজনে পরস্পরের দিকে তাকাতেই ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল—মোড়ল রমণীর হাসির অর্থ কী। প্রায় পোষা ভাল্লুকের মতো আমরা দুটি প্রাণী সর্বাঙ্গে কালো কালো ঝুলের চাপড়া দিয়ে ঢেকে বসে আছি, একে অপরকে চেনা ভার হয়ে উঠেছে। শিকারি সাহেবদের এ-অবস্থা দেখে না হেসে পারা যায়—এই বোধ হয় ছিল মোড়ল রমণীর মনের কথা। আমরা দুজনে অপ্রস্তত বোধ করে তাড়াতাড়ি ঝুল ঝেড়ে পরিষ্কার হবার জন্য বাইরে চলে গেলাম।
কিছুক্ষণ পরে ঘরে এসে দেখলাম তৈরি হয়েছে আমাদের জন্যে শয্যা—একটি ময়লা তোশক, দুটো বালিশ ও দুটো লেপ দিয়ে। তোশক ও লেপের অবস্থা দেখে মনে হল তিনপুরুষের তেলকালির ময়লা কোদাল দিয়ে চেঁছে নিলেও পরিষ্কার হয়ে উঠবে না। আমাদের দুজনের শরীরের তখন যা অবস্থা, ওই শয্যাই আমাদের কাছে রাজশয্যার থেকেও ভালো মনে হল। আমরা আমাদের অবসন্ন ক্লান্ত শরীর দুটি সেই রাজশয্যায় এলিয়ে দিতে মোটেই দেরি করলাম না। এমন সময় ভবানী আমায় বলল, “দাদা, শোবার ব্যবস্থা তো মোটামুটি একরকম হল, কিন্তু খিদেতে যে পেটের নাড়ি হজম হবার জোগাড় হয়েছে।”
আমি অতি নীচু গলায় তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে, মোড়ল ও তার স্ত্রী আমাদের অনেক যত্ন করছে। ওরা অত্যন্ত গরিব। খাওয়ার কথা কী করে বলা যায়? রাতটা কোনোরকমে ঘুমিয়ে কাটিয়ে নাও, তারপর সকালবেলায় যা-হোক কিছু করা যাবে। কথাটা যে তার খুব মনোমতো হল না তা তার মুখ দেখেই বোঝা গেল। কিন্তু আমি যে নাচার।
এরপর আমি তারুকে জিজ্ঞেস করলাম ওখানে মদ পাওয়া যায় কি না। সে বলল, পর্যাপ্ত। আমি তার হাতে দশটা টাকা দিয়ে বললাম কিছু মদ জোগাড় করতে। অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা এক হাঁড়ি মদ এনে আমাদের সামনে ধরল। আমরা অতিকষ্টে তাদের বোঝালাম যে, মদ আমরা খাই না—এ-ব্যবস্থা কেবল তাদের জন্যে। দু-চার গ্লাস পেটে পড়ার পর মদের ক্রিয়া শুরু হয়ে গেল ওদের মধ্যে। তার আমাকে বুড়ো শিকারি ও ভবানীকে জোয়ান শিকারি বলে ডেকে মদের ঘোরে বলতে লাগল যে, তারা এবং সমস্ত গ্রামবাসীরা আমাদের দুজনের ওপর খুব খুশি। যেভাবেই হোক তারা আমাদের গুণ্ডা মৈয়ুম পাইয়ে দেবার জন্যে সবরকম সাহায্য করবে। আমি আমার রাজশয্যায় শোওয়া অবস্থায় তাকে ভীরু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “এই ঝড়-জল ও বরফের মধ্যে কি হাতি এই এলাকায় থাকবে?”
তারা সকলেই একবাক্যে আমাকে বোঝাতে লাগল যে, আমাদের বরাত ভালো তাই এসময় ঝড়-জল ও বরফ পড়ছে। হাতি ঠান্ডা পেলে এই জঙ্গল ছেড়ে কোথাও যাবে না। কারণ, তারা এই আবহাওয়া খুব ভালোবাসে।
যা হোক, তারা আমাদের বিশ্রামের জন্য এই ঘর ছেড়ে পাশের ঘরে চলে গেল, আর আমরা শুয়ে শুয়ে পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা তাদের মদ খাওয়ার শোরগোল শুনতে পেলাম।
পরিশ্রান্ত অবস্থায় আমরা একটু ঘুমিয়েই পড়েছিলাম; হঠাৎ ঘুম ভাঙল মোড়লের ডাকে। জেগে দেখি মোড়ল-বৌ দুটো সানকিতে করে সামান্য কিছু ভাত, একটু জলের মতো পাতলা ডাল আর পাতায় মোড়া একটু নুন ও দু-ঘটি জল এনে আমাদের বিছানার পাশে রাখল। মোড়ল সবিনয়ে বলল যে, তারা গরিব লোক, এর বেশি তাদের আর কিছু নেই—আমরা যেন কষ্ট করে একটু খাই। আমরা রাজশয্যা তো আগেই পেয়েছিলাম, এবার রাজভোগের ব্যবস্থা দেখে অত্যন্ত খুশি হলাম এবং অযথা সময় নষ্ট না করে সেই রাজভোগের সদ্ব্যবহার করতে লেগে গেলাম। ভোর সাড়ে পাঁচটায় সামান্য চা-বিস্কুট খাওয়ার পর রাত প্রায় সাড়ে ন’টায় ওই সামান্য খাবারও কণামাত্র না ফেলে আমরা অতি তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়া শেষ করে জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
পরের দিন ভোরে আমরা বিছানা থেকে উঠে কাছাকাছি একটা পাহাড়ি ঝরনাতে গেলাম এবং হাত-মুখ ধুয়ে পেট ভরে জল খেলাম। ফিরে এসে মোড়লের মাচাবাড়ির বারান্দাতে বসে একটা ছোটোখাটো বৈঠক হল, কীভাবে আমাদের সেদিনের অভিযান শুরু হবে সেই ব্যাপার নিয়ে। আমি মোড়লকে আর তারুকে জিজ্ঞাসা করলাম তাদের জঙ্গলের কোনও দেবতা আছে কি না, কারণ আজ বেরোবার আগে আমরা সেখানে পুজো দিয়ে যেতে চাই৷ তারা একবাক্যে বলে উঠল, ‘লংতরাই বাবা’ যার নামে এই পাহাড়—খুব জাগ্রত দেবতা—তারা সবাই খুব মানে। আমি পুজোর ব্যবস্থা করার জন্য মোড়লকে টাকা দিলাম এবং শুনলাম পুজোতে একটা কালো মোরগ, নারকেল, চিনি, বাতাসা ও মোমবাতি লাগে। গ্রামের পূজারিকে সব জিনিস দিয়ে পুজো পাঠানো হল, আর আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম পূজারি ফিরে আসা পর্যন্ত।
ঘণ্টা দেড়েক পরে পূজারি খুব হাসিমুখে ফিরে এসে বলল, “লংতরাই বাবা আপনাদের ওপর খুবই খুশি হয়েছেন। আপনারা গুণ্ডা মৈয়ুমকে অবশ্যই মারতে পারবেন।”
মোড়ল পুজোর প্রসাদ নারকেল, চিনি-বাতাসা সকলের হাতে একটু একটু করে দিল এবং আমরা সেই প্রসাদ মুখে দিয়ে জল খেয়ে রওনা দিলাম।
গ্রাম থেকে ২/৩-শ গজ দূরে একটা জায়গায় এলাম, যেখানে 8৫ দিন আগে এক হতভাগ্য গ্রামবাসী প্রাণ হারিয়েছিল পাগলা হাতির পায়ের নীচে। তারু আমাদের সেই জায়গাটা দেখাল এবং বোঝাবার চেষ্টা করল, ওই হতভাগ্য লোকটির পরিবার একটুকরো হাড় বা মাংস কিছুই খুঁজে পায়নি তার সৎকার করার জন্য। আমরা দেখলাম সেখানকার মাটির খানিকটা জায়গার রঙ কিছুটা বদলে গেছে। তারু আমাদের বলল, “ওখান থেকে খানিকটা মাটি নিয়েই তার পরিবারের লোকেরা তার সৎকার করেছে।”
অতঃপর আমরা চললাম এগিয়ে। আমরা. আমাদের ভারী রাইফেল দুটো দুজন গাইড ছোকরার কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আসতে বললাম। এতে আমাদের পথশ্রম কিছুটা লাঘব হল এবং আমরা অক্লেশে পাহাড়ে ওঠা-নামা করতে লাগলাম। একই পথ ধরে আমরা এগিয়ে গিয়ে সেই পাহাড়ের চুড়োয় উঠে অনেক জংলি হাতির পাল দেখতে পেলাম; একসঙ্গে প্রায় ৩০/৪০টা হাতি; তার মধ্যে দু-একটা দাঁতাল এবং বেশিরভাগ মাদি ও বাচ্চা। পাগলা হাতি দলে থাকে না তা আমরা জানতাম। অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম পাগলা হাতির, কিন্তু নিরাশ হলাম। সারাদিন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে সন্ধের অন্ধকারে আবার আমরা মোড়লের বাড়ি ফিরে গেলাম।
সেদিনও আগের দিনের মতো আমরা মোড়লের মাচাবাড়ির বারান্দায় উঠে ধপাস করে বসে পড়লাম। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং পেটে কিছু না পড়ায় শরীর স্বভাবতই ক্লান্ত লাগছিল। কিন্তু তুলনামূলকভাবে আগের দিনের থেকে কষ্ট অনেকটা কম মনে হল। মোড়লের বৌয়ের দেওয়া জলে মুখ, হাত, পা ধুয়ে এবং মোড়লের হাতে ওদের মদ খাওয়ার জন্য দশ টাকা দিয়ে আমরা আমাদের রাজশয্যায় আশ্রয় নিলাম। আধশোয়া অবস্থাতেই বসালাম এক বৈঠক—উদ্দেশ্য, যদি আমরা সত্যি-সত্যিই পাগলা হাতি দূরে দেখতে পাই, তাহলে তাকে কী করে বন্দুকের নাগালের মধ্যে আনতে পারব। প্রশ্ন শুনে তারু ও তার তিন সঙ্গী উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠল, “বুড়া শিকারি সাহেব, আপনি কিছু ভাববেন না। আমরা অতি সহজ উপায়ে গুণ্ডা মৈয়ুমকে আপনার বন্দুকের সামনে এনে দেব।”
আমাদের হাতি শিকারের কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। পুথিগত বিদ্যা ছিল কিছু—‘জন হান্টার’, ‘টেলার’, ‘বেল’ প্রভৃতির লেখা আফ্রিকার জঙ্গলে হাতি শিকারের কাহিনি পড়ে। কিন্তু বলা বাহুল্য, তা পর্যাপ্ত নয়। তাই তারুকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তাদের হাতি তাড়িয়ে আনার সহজ উপায়টি কি? বাঘ বা হরিণ শিকারের বেলায় যেমন ‘বিট’ করার প্রথা আছে—যার মাধ্যমে বাঘ বা হরিণকে বন্দুকের নাগালে আনা যায়, তার বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার আছে, সেরকম কোনও উপায়ে একটা বিরাট পাগলা হাতিকে ‘বিট’ করে বন্দুকের সামনে আনা যায় কি না সেই প্রশ্নটা আমাদের মনে ছিল। তখনই তারু আমাকে বোঝাল যে, তারা বাঁশের কঞ্চি থেকে খুব তাড়াতাড়ি একরকমের বাঁশি তৈরি করে ফেলতে পারে। সেই বাঁশি বাজালেই যেদিক থেকে বাঁশির আওয়াজ আসছে, হাতি তার উলটোদিকে ছুটে পালাবে। হাতি ওই বাঁশির আওয়াজ একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তারা আমাকে বোঝাল যে, গুণ্ডাকে যখন আমরা দেখতে পাব, তখন আমরা বাঁশি বাজিয়ে গুণ্ডাকে লুকিয়ে জঙ্গলের মধ্যে এমন জায়গায় বাঁশির ‘রোখ’ রাখব যে সেই-সেই জায়গা থেকে বাঁশি বেজে উঠলেই হাতিকে একটা নির্দিষ্ট পথ দিয়ে তাড়িয়ে আনা যাবে। এই কঞ্চির বাঁশির আওয়াজ কিন্তু খুব জোর নয়—অনেকটা কলাপাতার ভেঁপুর মতো প্যাঁ প্যাঁ করে আওয়াজ হয়। জানিনা ত্রিপুরা ছাড়া আর কোথাও এই প্রথায় হাতি বিট করে কি না। আমি এটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি, কিন্তু ব্যাপারটা পরীক্ষাসাপেক্ষ বলে তখনকার মতো চুপ করে রইলাম। তারপর তারুকে আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন করলাম—উপস্থিত হাতিগুলো যে পাহাড়ে ঘুরছে তারা যদি তাড়া খায়, তাহলে তারা কোন রাস্তা দিয়ে কোথায় পালিয়ে যাবে? কারণ, বিট আরম্ভ করার আগে প্রত্যেক শিকারির জানা প্রয়োজন তাড়া খেলে জঙ্গলের জন্তুজানোয়ারেরা সাধারণত কোন দিকে পালায়। তারু উত্তরে বলল, “বুড়ো শিকারি সাহেব, তাড়া খেলে হাতিদের পালাবার পথ আছে মাত্র দুটো। একটা আমাদেরই গ্রামের মধ্য দিয়ে, অপরটি পাহাড় ও জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। হাতি দিনের বেলায় তাড়া খেলে গ্রামের পথে আসতে চায় না, তখন তারা ধরে জঙ্গলের পথ। আমরা তিনটি পাহাড় পেরিয়ে সবচেয়ে যে উঁচু পাহাড়ে গতকাল যাই, যেখান থেকে জংলি হাতির পাল আমবা দেখেছি, সেই পাহাড়ের চুড়ো পেরিয়ে তারা পরের পাহাড়শ্রেণিতে চলে যায়। পরের পাহাড়শ্রেণি পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) এলাকায়। একবার যদি হাতির পাল কোনও কারণে এই পাহাড় ছেড়ে পাশের পাহাড়শ্রেণিতে চলে যায় তাহলে তাদের ফিরে আসতে দেখা যায় এক থেকে দু-মাস পরে।”
এইসব নানা আলোচনা কবতে করতে রাত সাড়ে ন’টা বাজল এবং মোড়লের বৌ এনে হাজির করল আমাদের বরাদ্দ খাবার। আমরা হাসিমুখে তা খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লুম।
এইভাবেই প্রতিদিন আমাদের অভিযান চলতে থাকল—সকালে ‘রাজশয্যা’ থেকে উঠে ঝরনার জলে হাত-মুখ ধুয়ে একপেট জল খেয়ে সকাল আটটা-সাড়ে আটটা নাগাদ পাগলা হাতির সন্ধানে বের হওয়া। আর ফিরে যখন আসি তখন সন্ধের ঘন অন্ধকার। নিজেদের অভুক্ত এবং ক্লান্ত শরীর কোনোরকমে টেনে নিয়ে মোড়লের মাচাবাড়িতে ফিরে আসি এবং নিয়মিত দু-লোটা জল, যা মোড়লের বৌ বা আর কেউ আমাদেব জন্যে এগিয়ে দেয়, তাই দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এবং খেয়ে নির্দিষ্ট রাজশয্যাতে আমাদের ক্লান্ত শরীর দুটো এলিয়ে দিই। তারপর মোড়ল ও অন্যান্য গ্রামবাসীদের সঙ্গে শুরু হয় নানা গল্প ও হাসি-ঠাট্টা এবং প্রতিদিন না ভুলে মোড়লের হাতে তুলে দিই দশটা করে টাকা ওদের মদ খাওয়ার জন্য। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ মোড়লের বৌ নিয়ে আসে সানকিতে করে ভাত, ডাল আর নুন ও লোটায় করে জল।
আমরা এক বস্ত্রে ক’দিন ধরে আছি। অলিভ রঙের প্যান্ট ও বুশ কোট, গেঞ্জি, আন্ডারওয়ার এবং রুমালের যে অবস্থা তা ব্যবহার করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। পাহাড়ে যাতায়াতের পথে মার্চ মাসের দুর্ধর্ষ গরমে এবং রোদে আমরা প্রায় ভাজাভাজা হয়ে গিয়েছি—ঘামে জামা-প্যান্ট সব ভিজে গিয়েছে, আবার তারই মাঝে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে আমাদের প্রায় স্নান করিয়ে দিয়েছে। সেই জামাকাপড় আবার গায়েই শুকিয়েছে। এইভাবেই পার হতে থাকল দিনের পর দিন।
৯ই মার্চ ১৯৬৭ সাল বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমি ও ভবানী আমাদের সঙ্গীদের নিয়ে তিনটে পাহাড় পেরিয়ে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে কিছুটা নীচে একটা খাদের মধ্যে বসলাম হাঁপাতে হাঁপাতে, রোদ বাঁচিয়ে কিছুটা বিশ্রাম নেবার জন্য। আমাদের কারোর মুখে কোনও কথা নেই। কথা বলা বা কোনোরকম আওয়াজ করা শিকার শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। আমি আপনমনে ভাবছি, দৃষ্টি সামনের পাহাড়ের দিকে নিবদ্ধ। এইভাবে না খাওয়া, না চান করা, না কাপড়জামা বদলানো অবস্থায় আমরা কতদিন আর এই অভিযান চালিয়ে যেতে পারব। এখনও পর্যন্ত আমরা নির্দিষ্ট পাগলা হাতিটার দেখা পর্যন্ত পেলাম না। ভগবান কি আমাদের দিকে মুখ তুলে চাইবেন না? হঠাৎ নিজেকে যেন বড়ো অসহায় বলে মনে করতে লাগলাম। জানি না আমার এই অবস্থা দেখে ভগবানের দয়া হয়েছিল কি না—আমি উদাসভাবে সামনে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলাম ঠিক কতক্ষণ খেয়াল নেই। এমন সময় হঠাৎ আমার নজরে পড়ল, সামনের পাহাড়ে, বাঁদিকে একটা দাঁতাল হাতি। হাতিটার সারা গা ধুলো-মাটিতে ভরা—চলতে চলতে শুঁড়ে করে ধুলো-মাটি তুলে নিজের গায়ে ও পিঠের ওপর ছড়াচ্ছে। কেন যেন আমার মনে হল এই হাতিটাকে তো আমরা এর আগে কখনও দেখিনি। এই ক’দিনে আমরা ওই পাহাড়শ্রেণিতে যে-ক’টি জংলি হাতি ছিল তাদের প্রত্যেকটিকেই আমরা চিনে ফেলেছিলাম এবং সবক’টিরই চালচলন মায় ছোটো বাচ্চাগুলির স্বভাব জানা ও চেনা হয়ে গিয়েছিল। একান্ত মনোযোগ দিয়ে এবং সমস্ত দৃষ্টি দিয়ে হাতিটাকে তখন দেখতে লাগলাম। হাতিটা নিজের মনে এঁকে-বেঁকে, আস্তে আস্তে পাহাড়ের ওপর আরও উঁচুর দিকে উঠে যাচ্ছে, তখন হাতিটার সমস্ত বাঁদিকের শরীরটা লম্বালম্বিভাবে আমাদের নজরে এল—দেখতে পেলাম হাতি বেশ বড়োসড়ো ধরনের। এইভাবে আরও কিছুটা উপরের দিকে উঠে যাবার পর, হাতির সমস্ত পেছন দিকটা আমার নজরে পড়ল, তখন দেখলাম তার লেজটি ছয় থেকে আট ইঞ্চির মতো মাত্র শরীরে লেগে আছে, বাকিটা নেই। দলীয় কোনও প্রচণ্ড লড়াইয়ে, দলপতির আসন লাভের জন্য অন্য কোনও শক্তিশালী হাতি—এই হাতিটির লেজ ছিঁড়ে নিয়েছে এবং এরপর থেকেই দলছুট হয়ে গুণ্ডা হয়ে গিয়েছে হয়তো। তারু আমাদের খুব কাছেই বসে ছিল, তাকে ইশারায় ডেকে দেখালাম। তারু হাতিটাকে দেখেই আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে খুব নীচু গলায় আমায় জানাল, “বুড়া শিকারি সাহেব, এইডাই আমাগো গুণ্ডা-মৈয়ুম। এইডাই আমাগো গ্রামের পাঁচডি লোক মারছে।”
খানিক পরে হাতিটা আমাদের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। আমি তখন সেই পাহাড়ের খাদটা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। তারু এবং তার তিন সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এইটিই সত্যি কি তোমাদের লোক মেরেছে?”
তারা সকলেই একবাক্যে বলে উঠল, “কী বলতাছেন বুড়া শিকারি সাহেব, আমরা এই গুণ্ডাকে চিনি না!”
আমি শুনে বললাম, “তোমরা এই গুণ্ডাকে আমাদের দিকে তাড়িয়ে আনতে পারবে তো?”
আমার কথা শুনে তারু ও তার তিন সঙ্গী একটু মুচকি হেসে আমাকে বলল, “বুড়া শিকারি সাহেব, আপনার হুকুম হলেই কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা এই গুণ্ডা মৈয়ুমকে বাঁশি বাজিয়ে আপনার সামনে হাজির করে দেব।”
হঠাৎ মাটির দিকে তাকিয়ে আমার নজরে পড়ল, যে-জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা কথাবার্তা বলছিলাম সেটাও একটা হাতিচলা পথ। পথটি আমার বাঁদিক থেকে উঠে এসে আমরা যে-জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি সেই জায়গা দিয়ে ডানদিক চেপে, পাহাড়ের চুড়ো বেয়ে অপর পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। আমার সামনেই রাস্তার ধারে দেখলাম একটা বাজপড়া গাছ—গুঁড়িটা রয়েছে প্রায় পাঁচ ফুটের মতন মাটিতে লেগে এবং সেই গুঁড়িকে জড়িয়ে কিছু লতাপাতা জন্মেছে। সামনের দিকে আর একটু নজর করতেই দেখলাম ১৫/২০ হাত নীচে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, বাঁদিক থেকে আর একটা হাতিচলা রাস্তা ডানদিকে এগিয়ে গিয়ে পাহাড়ের চুড়ো পেরিয়ে গেছে। তখনই, আমাদের সান্ধ্য বৈঠকে তারুর বর্ণনা—যে-হাতি তাড়া খেলে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চুড়ো বেয়ে পাকিস্তানে চলে যায়, সে-রাস্তা যেন এইটেই বলে মনে হল।
সন্দেহ ভঞ্জনের জন্যে আমি তারুকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এইটেই কি হাতিদের এই এলাকার পাহাড় পেরিয়ে পাকিস্তান এলাকায় চলে যাবার রাস্তা?”
তারু সম্মতি জানিয়ে বলল, “হ্যাঁ বুড়া শিকারি সাহেব, এই রাস্তার কথাই তো কয়দিন সান্ধ্য বৈঠকে আপনাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি।”
আমি তখন আমার কর্তব্য ঠিক করে ফেলেছি। আমি তারুকে বললাম, “আমি এই বাজপড়া গাছের আড়ালে বন্দুক নিয়ে দাঁড়ালাম, যাতে দুটো রাস্তার যে-কোনোটা ধরে হাতি এলেও আমি তার মোকাবিলা করতে পারি।”
আমার কথা শুনে তারু এবং তার তিন সঙ্গী সমস্বরে বলে উঠল, “বুড়া শিকারি সাহেব, আপনি ক্ষ্যাপছেন—আপনারে মৈয়ুম মাইরা ফেলব। তার থেইকা আপনে একটা গাছে চইড়া বসেন।”
পাগলা হাতি এক ভীষণ ভয়াবহ জিনিস, মাটিতে দাঁড়িয়ে থেকে মোকাবিলা করা নেহাতই দুঃসাধ্য। তবুও আমি কিন্তু গাছে চড়তে একদম নারাজ। আমার কয়েক দিনের অভিজ্ঞতা—ত্রিপুরার সবক’টা পাহাড়ই বেশ কিছুটা মাটি দিয়ে ঢাকা; যদিও তার ওপর অনেক বড়ো বড়ো গাছ জন্মেছে, কিন্তু আমার ধারণা, সেগুলো হাতি যে-কোনো সময় সামান্য ধাক্কাতেই মাটিতে ফেলে দিতে পারে। এ-অবস্থায় গাছে চড়ে থাকলে সুবিধার চেয়ে অসুবিধেই বেশি হবার সম্ভাবনা। তখন ভবানী আমাকে খুব গম্ভীরভাবে বলল, “দাদা, গোঁয়ার্তুমি করবেন না। এরা যা বলছে, তা শুনুন। আপনি গাছে চড়েই হাতির অপেক্ষায় থাকুন।”
আমি ভবানীকে বললাম, “আমি আমার মন ঠিক করে ফেলেছি। আমি এইখানেই এই বাজপড়া গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকব। এতে হয় হাতি আমাকে মারবে, নয়তো আমি হাতিকে মারব—তুমি যদি গাছে চড়তে চাও, তাহলে নিজের পছন্দমতো একট গাছে চড়ে বসো। আর তারু ও তার তিন সঙ্গীকে নিয়ে যাও। তুমি গাছে চড়ে বসলে পর তারা বাঁশি বাজিয়ে বিটের ব্যবস্থা করবে।”
আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের কর্তব্য সম্বন্ধে আলোচনা করছিলাম, সেখান থেকে পাহাড়ের নীচটা কয়েকশো গজ নেমে গেছে। তারপর আবার পাহাড়টা ক্রমশ উঁচুর দিকে উঠে গেছে এবং ওর পরের পাহাড়েই আমরা কিছুক্ষণ আগে পাগলা হাতিটাকে দেখতে পেয়েছিলাম। সেই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার নজরে পড়ল, আমাদের ঠিক সামনাসামনি পাহাড়টার ওপর, মনে হল বেশ একটা মোটা গাছ এবং তার একটা মোটা ডাল মাটি থেকে ১৫/১০ হাত ওপরে ছড়িয়ে আছে। ভবানীকে সেই গাছ দেখিয়ে বললাম, ওই গাছ যদি পছন্দ হয় তাহলে সে যেন চড়ে বসে। তখন আর দেরি না কবে ভবানী, তারু ও তার তিন সঙ্গী পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে নেমে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ পরে ভবানী ও তারুদের কয়েকটা বিন্দুর মতন আস্তে আস্তে অপর পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে দেখলাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ভবানীকে একটা বিন্দুর মতন আস্তে আস্তে গাছে চড়তেও দেখলাম।
এতে কতক্ষণ সময় গেছে আমর খেয়াল নেই; বেশ কিছুক্ষণ পরে আমি সেই বাজপড়া গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আমার ‘৪৫০ দোনলা রাইফেলে দুটো গুলি ভরে নিয়ে মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম, যদি সত্যিই তারু ও তার সঙ্গীরা পাগলা হাতিকে তাড়িয়ে আনতে পারে, তাহলে আমি হাতির ঠিক জায়গায় গুলি করতে পারব কি না। আমার পুথিগত বিদ্যে—জন হান্টার, টেলার, বেল—প্রভৃতির লেখা থেকে। এঁরা হাতির কোন কোন জায়গায় গুলি করেছেন তা মনে মনে ঝালিয়ে নিলাম। প্রত্যেক অভিজ্ঞ হাতি শিকারিই বলেছেন, মারমুখী তেড়ে আসা হাতিকে রুখতে হলে গুলিকে তার মস্তিষ্ক ভেদ করে মগজে পৌঁছে দিতে হবে এবং তা যদি না পারা যায় তাহলে মারমুখী হাতির হাত থেকে শিকারির বাঁচার কোনোই সম্ভাবনা নেই। প্রত্যেক অভিজ্ঞ শিকারিই বলেছেন যে, হাতির মস্তিষ্কে গুলি পৌঁছাবার জায়গা মাত্র তিনটি—যথা, হাতির শুঁড় মাথার কাছে যেখানে শেষ হয়েছে সেই সংযোগস্থল থেকে ৪/৫ ইঞ্চি ওপরে গুলি করলে সোজা মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছায়। এটা সম্ভব যদি হাতি একেবারে সামনাসামনি এসে পড়ে। আর হাতি যদি পাশ থেকে আসে, তাহলে হাতির দু-ধারের কানের পাশে যে খাঁজের মতো আছে, সেই খাঁজের মধ্যে এমন একটা তির্যক কোণে গুলি লক্ষ্য করতে হবে যাতে সেটা মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছায়। হাতির মাথার ওপরে দুটি বড়ো রুটির মতন মাংস আছে, তার তলায় হাতির বয়স অনুযায়ী ৭ থেকে ৯ ইঞ্চি মোটা হাড় আছে; ঠিক সেই হাড়ের নীচে ছোটো একটি বানরুটির মাপের মস্তিষ্কটিই হওয়া উচিত একমাত্র লক্ষ্যস্থল—এ ছাড়া মারমুখী তেড়ে আসা হাতিকে রুখতে পারা অসম্ভব। অনেক অভিজ্ঞ শিকারির মতে হাতি মারতে হলে খুব ভারী দোনলা রাইফেল প্রয়োজন এবং যতদূর সম্ভব কাছ থেকে গুলি করাও দরকার। তাঁদের মতে ২০ পা দূর থেকে গুলিও দূরপাল্লা। অতএব, তাঁদের মত অনুযায়ী হাতিকে মারতে হলে ১০/১৫ হাতের মধ্যে এনে এক গুলিতে হাতি মারা উচিত। কী সাংঘাতিক ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা।
জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে মনে মনে এইসব আওড়াচ্ছি আর ভাগ্যের উপর ভর করে বন্দুক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি কতক্ষণ তার ঠিক নেই। বেশ কিছুক্ষণ যাবার পর হঠাৎ শুনতে পেলাম তারু ও তার তিন সঙ্গীর প্যাঁ প্যাঁ করে বাঁশির আওয়াজ। খানিক পরে মড়মড়, কড়কড় করে গাছপালা ভাঙার শব্দ শুনে বুঝলাম হাতি নীচে নামছে। সামনের পাহাড়ের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম, আমাদের সেই নির্দিষ্ট পাগলা হাতিটা আরও তিনটে মাদি হাতি নিয়ে বুলডোজারের মতন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গাছপালা, মাটি, পাথর ঠেলে নেমে আসছে। একটা জিনিস লক্ষ করলাম, হাতি যখন পাহাড় থেকে খুব জোরে নেমে আসে, তখন তাদের পেছনের পা দুটো ও সামনের পা দুটো এগিয়ে দিয়ে পেছনটা মাটিতে রেখে বরফে স্কেট করার মতন নামতে লাগল। চার-চারটে হাতির পরপর নেমে আসা দেখে আমার বুকটা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল কিছুক্ষণের জন্য—কিন্তু আমি তখন বেপরোয়া, তখন আমার মনের বা শরীরের যা অবস্থা, তাতে আমি পরমুহূর্তেই যে-কোনো চরম ঘটনার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিয়েছিলাম এবং মনে মনে ভাবলাম, যদি কপালগুণে হাতি কোনোরকমে আমার বন্দুকের নাগালে আসে, তাহলে হয়তো আমি হাতিকে মারব—নয় হাতিই আমাকে মারবে। এইভাবে মনঃস্থির করে আমি পাগলা হাতির আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
দেখলাম হাতি চারটি অপর পাহাড় থেকে মড়মড়, কড়কড় করে নামতে নামতে উপত্যকায় মিলিয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ সময় চলে গেল, কিন্তু হাতিগুলিকে আর দেখা যাচ্ছিল না। মনের মধ্যে নানা চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে—গুণ্ডা মৈয়ুম কি আমার বন্দুকের নাগালে আসবে না? লংতরাই বাবা কি আমায় দয়া করবেন না? এমন সময় আমার পঞ্চম চিন্তা—স্নায়ুতে যেন আভাস পেলাম—বিপদ আসছে। আমি আমার বাঁদিকের হাতিচলার রাস্তায় যেটা ক্রমশ নীচের উপত্যকা থেকে আমার দিকে উঠে পাহাড়ের চুড়ো পেরিয়ে গেছে, সেইদিকে আমার সমস্ত মন সংবদ্ধ করে শ্যেনদৃষ্টিতে হাতের রাইফেল শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম সেই বাজপড়া গাছটাকে আড়াল করে। যে-রাস্তার উপর আমি দাঁড়িয়ে আছি, তার ১৫/২০ হাত নীচে আর একটি রাস্তা; এই দুটি রাস্তা বাজপড়া গাছ থেকে আমার বাঁদিকে ৩০/৪০ হাত দূরে একজায়গায় মিলে গিয়ে পাহাড়ের ঢালের দিকে মিলিয়ে গেছে। আর নীচের রাস্তাটি আমার ডানদিক দিয়ে গিয়ে পাহাড়ের চুড়োয় মিলিয়ে গেছে। আমি আমার বাঁদিকে দুই রাস্তার সঙ্গমস্থলের দিকে তাকাচ্ছি আর মনে মনে প্রার্থনা করছি, যেন হাতি দুই রাস্তার সঙ্গমস্থল থেকে আমার দিকের রাস্তায় উঠে আসে, যাতে আমি সোজা মগজে গুলি করতে পারি।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর হঠাৎ সামান্য খসখস আওয়াজ শুনতে পেলাম এবং দেখলাম পাগলা হাতিটা তার শুঁড়টা আকাশের দিকে তুলে হনহন করে নীচে থেকে ওপরের দিকে উঠে আসছে এবং পেছনে আসছে মাদি হাতি তিনটে। ওই চারটি বিরাটকায় জানোয়ার এত নিঃশব্দে ও ত্রস্ত গতিতে উঠে আসছে দেখে আমি আশ্চর্য ও স্তম্তিত হয়ে গেলাম। বাজপড়া গাছের আড়ালে নিজেকে যতদূর সম্ভব লুকিয়ে, রাইফেল শক্ত করে ধরে ভগবানের কাছে বার বার কায়ননোবাক্যে প্রার্থনা জানাচ্ছি, হাতিটা যেন আমি যে-রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি ঠিক সেই রাস্তাতেই সোজা উঠে চলে আসে; তাহলে আমার পক্ষে তার শুঁড় ও মস্তিষ্কের সঙ্গমস্থলে গুলি বসিয়ে দেওয়া মোটেই কষ্টকর হবে না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নীচে দুই রাস্তার সঙ্গমস্থলে পাগলা হাতিটাকে শুঁড় মাথায় তুলে এগিয়ে আসতে দেখলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, হঠাৎ কেন জানি না পাগলা হাতিটা সঙ্গমস্থলে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেল এবং পরমূহূর্তে দেখলাম পেছনে যে তিনটি মাদি হাতি ছিল তার প্রথম বড়ো মাদিটা পাগলা হাতিকে পেরিয়ে নীচের রাস্তা ধরে হনহন করে এগোতে লাগল এবং সেই সঙ্গে দেখলাম পাগলা হাতিটাও মাদি হাতিটার পেছন নিয়েছে ও বাকি মাদি হাতি দুটো তাদের অনুসরণ করছে। এই অবস্থা দেখেই আমি বুঝতে পারলাম যে, ওপর থেকে নীচে গুলি করলে হয়তো আমার গুলি মস্তিষ্কেই পৌঁছবে না। অন্যথায় হাতি হয়তো আমাকেই মেরে ফেলবে। কিন্তু আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে, হয় হাতি আমাকে মারবে, না-হয় আমি হাতিকে মারব। এ-সুযোগ যদি আমি আজ হারাই, তাহলে আর কোনোদিন হয়তো সুযোগ নাও আসতে পারে।
মনের মধ্যে যখন এইসব চিন্তা তোলপাড় করতে লাগল, তখন দেখলাম প্রথম মাদি হাতিটা শুঁড় নামিয়ে ঠিক আমার নীচের রাস্তা দিয়ে আমাকে পেরিয়ে হনহন করে চলে যাচ্ছে। পাগলা হাতিটা কিন্তু দেখলাম সবসময় শুঁড় উপর দিকে তুলে বিপদের গন্ধ শোঁকবার চেষ্টা করছে। বাজপড়া গাছের লাইনের কাছাকাছি যখন পাগলা হাতিটা নীচে এসে পড়ল তখন সে আমার গন্ধ পায় এবং তৎক্ষণাৎ শুঁড় গুটিয়ে আমার দিকে লক্ষ্য করে বিকট একটা হৃদয়বিদারক চিৎকার করে পাহাড় বেয়ে নীচে থেকে ওপরে উঠে আসতে আরম্ভ করে—তখন আমার ও পাগলা হাতির ডানদিকের কপালটার দূরত্ব ৮/১০ হাতও নয়। হাতির চার্জের এই সাংঘাতিক চিৎকারে (যাকে ইংরাজিতে ট্রামপেট বলে) অনেক শিকারির স্নায়ু বিকল করে দেয় এবং সে-অবস্থায় সে সংবিৎ হারিয়ে ফেললে অনায়াসেই হাতি তখন শুঁড়ে পেঁচিয়ে মাটিতে আছাড় মেরে তার জীবন শেষ করে দেয়। বই পড়ে জেনেছি ও অভিজ্ঞ শিকারির কাছে শুনেছি, হাতির এই চার্জের সামনে পড়লে কারোরই নিস্তার নেই। তৎক্ষণাৎ যদি সমস্ত সাহসের সঙ্গে তার মোকাবিলা করে ঠিকমতো গুলি করে হাতিকে না মেরে ফেলা যায়, তবে মুহূর্তের মধ্যেই কি শিকারি কি অন্য লোকের দেহটা একটা তাল পাকিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হাতির সময় লাগে না—দৌড়ে পালাবার কোনও চেষ্টা করলেই নিশ্চিত মৃত্যু। আমি ওই অবস্থায়ই তখন পড়ে গেছি। সাক্ষাৎ যমের মতো তার এই ভীষণ মারমুখো মূর্তিতে সে আমার দিকে নীচ থেকে উঠে আসতে লাগল এবং সেই এক খণ্ড-মুহূর্তের মধ্যে আমাদের দুইটির জীবন ও মৃত্যু যেন বলে দিল এ সংকটে যে সফল হবে সে-ই জীবন নিয়ে ফিরতে পারবে। মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে আমি হাতিটার ডানদিকের কানের খাঁজের ওপর যথাযথ লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লাম এবং গুলি ছোড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই দেখলাম পাগলা হাতিটা পেছন মুড়ে বসে পড়ল। সবচেয়ে আশ্চর্য জিনিস দেখলাম যে, মাদি হাতিটা, যেটা সবচেয়ে আগে চলে যাচ্ছিল, আমার গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে সে লাট্টুর মতো ঘুরে এসে—বসে পড়া পাগলা হাতিটাকে শুঁড়ে করে তার পেছনটা একটু তুলে ধরে সাহায্য করল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাকী মাদি হাতি দুটোও একই প্রথায় গুলি খাওয়া পাগলা হাতিটাকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
সাধারণত পাগলা হাতির সঙ্গে অন্য কোনও হাতিকে দেখা যায় না, কিন্তু বিটের ফলে যখন সকলেই প্রাণভয়ে পালাতে চায়, তখন তাদের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ জ্ঞান থাকে না বলেই মনে হল। যখন হাতি চারটে গড়িয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে, দেখলাম পাগলা হাতিটার ডানদিগের রগ ও কানের কাছ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্তের ধারা বইছে। হাতিটা খুবই জখম হয়েছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু সে যে সম্পূর্ণ মরেনি সেটা আমি বেশ বুঝতে পারলাম। তাকে পুরোপুরি মারতে হলে এবং তাকে এই মৃত্যু-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে হলে আরও একটি গুলির দরকার, কিন্তু তখন আমি নিরুপায়। আমি আমার দোনলা রাইফেল থেকে একটি গুলি ছুড়ে অপরটি সংরক্ষণ করেছিলাম হাতির পালটা আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য।
নানা উত্তেজনায় এইসব ভাবতে ভাবতে দেখলাম হাতি চারটে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচের উপত্যকাতে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি তখন অতি করুণভাবে মনে মনে বললাম—ভগবান এ কী করলে? এত কষ্টের পর যদি-বা পাগলা হাতি পেলাম, তাকে এক গুলিতে মারতে পারলাম না? এই হাতি যদি গুলি খাওয়া অবস্থায় আমাদের নাগালের বাইরে চলে যায়, তাহলে এর নৃশংসতা যে আরও বাড়বে।
এমনিভাবে কতক্ষণ সময় গেছে জানি না, হঠাৎ আমার নজরে পড়ল চারটে কালো কালো বিন্দুর মতন, উপত্যকা থেকে অপর পাহাড়ে যেখানে ভবানী বসে আছে সেদিকে ওঠবার চেষ্টা করেছে। অনেকক্ষণ লক্ষ করার পর বুঝতে পারলাম মাদি হাতি তিনটে তাদের মাথা ও শুঁড় দিয়ে জখমি পাগলা হাতিটাকে অপর পাহাড়ে ঠেলে ওঠাবার অক্লান্ত চেষ্টা করেছে। আমি তখন একদৃষ্টিতে ভবানীর দিকে লক্ষ্য রেখে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম যে, জখমি পাগলা হাতিটা যেন ভবানীর বন্দুকের নাগালে এসে পড়ে এবং ভবানী এক গুলিতে তাকে যন্ত্রণা থেকে চিরতরে মুক্তি দিতে পারে। এই ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখলাম, ভবানী সেই গাছের ডালের ওপর একটু যেন নড়েচড়ে নীচের দিকে তার রাইফেল তুলে নিশানা নিচ্ছে। কয়েক মিনিট পরেই ভবানীর ‘৪৭০ রাইফেল গর্জে উঠল আর আমি ভগবানকে ডাকতে লাগলাম, হে ভগবান! ভবানীর গুলি যেন পাগলা হাতির মাথা ভেদ করে তার যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি ঘটায়।
খানিক পরে আমি আমার পাহাড় থেকে চিৎকার করে ভবানীকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে ঠিক পাগলা হাতিটাকেই মারতে পেরেছে কি না। ভবানী চিৎকার করে আমায় জবাব দিল, “হাতি মরেছে, ভাববার কিছু নেই—হাতি মরেছে—একটু পরে আস্তে আস্তে নেমে আসুন।”
আমি তার কথা শুনে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচের উপত্যকার দিকে নামতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমি ও ভবানী গিয়ে দেখলাম বিরাট জন্তুটি অতি অসহায়ভাবে, রক্তাক্ত কলেবরে মাটিতে পড়ে আছে। অল্প কিছুক্ষণ আগে যার ভীষণমূর্তি ছিল, যার ভয়ে আমাদের হৃৎকম্প হচ্ছিল, সেই বিরাট জন্তুটি এখন নিথর নিশ্চল হয়ে আমাদের সামনে মাটিতে লুটিয়ে আছে।
খানিকক্ষণের মধ্যেই তারু ও তার তিন সঙ্গী খুব খুশি মনে হাসতে হাসতে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াল। তখন বেল প্রায় দেড়টা হবে। ঘড়ির দিকে নজর পড়তেই আমি তারুকে বললাম যে, সময় নষ্ট না করে সে যেন তার দুই চ্যালাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয় কুড়ুল আনার জন্য। কারণ, দাঁত দুটো আমরা আজই খুলে নিতে চাই, না-হলে এগুলো চুরি যাবার সম্ভাবনা আছে। তারু আমার কথা শুনে তার সঙ্গীদের থেকে দুজনকে গ্রামে পাঠিয়ে দিল কুড়ুল আনবার জন্য।
আমরা প্রথমে হাতির গায়ে লাগা দুটি গুলির লক্ষ্যস্থল ও আঘাতের স্থান পরীক্ষায় ব্যস্ত হলাম। দেখলাম আমার গুলিটি হাতিটার কপালের ডানদিকের কানের সামনের খাঁজ ভেদ করে নীচের দিকে গিয়ে ভিতরের বাঁদিকের দাঁতের গোড়ায় লেগে (টাঙ্কের গোড়ায়) আবার উপরের দিকে উঠে কপাল ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে। যাকে বলে Ricocheted (রিকোসেটেড) শট বা গুলি। আর ভবানীর গুলি আমার গুলির কয়েক ইঞ্চি তফাত দিয়ে ঢুকে হাতিটার মগজে পৌঁছেছে।
যা হোক, আমরা একটা টিলার ওপরে বসে মরা হাতিটাকে পাহারা দিতে লাগলাম। হঠাৎ ভবানী আমার হাতটা ধরে ইশারা করে, বাঁদিকের বেশ কিছু দূরে একটা জায়গা দেখাল; সেখানে দেখি প্রায় ৩০/৪০টা হাতি—দাঁতাল, মাদি ও বাচ্চা মিলিয়ে সব এক লাইন ধরে, কান খাড়া করে আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের থেকে সেই হাতিগুলোর দূরত্ব ৩/৪শো গজের বেশি হবে না। ভবানী ভয় পেয়ে বলল, “দাদা, এদের মতলব কী? এরা আমাদের পালটা আক্রমণ করবে না তো?”
আমি কিন্তু হাতিগুলোর দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলাম কেন তারা এই উদগ্রীব নয়নে আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কারণ, আমার মনে হল এবং ভবানীকেও তাই বললাম যে আমরা হয়তো হাতিটা মেরে এই পাহাড়শ্রেণি থেকে অন্য পাহাড়শ্রেণিতে পালাবার রাস্তা রুখে দিয়েছি; যতক্ষণ না আমরা এখান থেকে সরে যাই, ততক্ষণ তারা এ-এলাকা ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তান এলাকায় চলে যাবার রাস্তা পাচ্ছে না। আরও বেশ কিছুক্ষণ হাতির পালের দিকে তাকিয়ে থাকার পর যখন দেখলাম যে, প্রত্যেকটি হাতি মায় বাচ্চাসমেত এক সারিতে উদগ্রীব নয়নে আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তখন আমার মনে হল এরা সকলে তাদেরই একজনের মৃত্যু হওয়াতে আন্তরিক শোক প্রকাশের জন্য পরপর লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইংরাজিতে যাকে বলে ‘মোর্নিং প্যারেড’। আশ্চর্য, একটা বাচ্চা হাতিকেও লাইন ভাঙতে দেখলাম না।
ইতিমধ্যে তারুর দুই চ্যালা গ্রাম থেকে কুড়ুল নিয়ে এসে দাঁত দুটি খুলে বার করতে করতে বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজিয়ে দিল। যাই হোক, আমরা আর সময় নষ্ট না করে হাতির দাঁত দুটো নিয়ে পাহাড় থেকে নামতে শুরু করলাম।
রাত্রে গ্রামে ফিরে এসে মোড়লকে দাঁত দুটি দেখাতে সে খুবই খুশি হল। আমরাও যে খুবই খুশি এটা জানাবার জন্য মোড়লকে বললাম, “আজ আমরা তোমাদের গ্রামের সব ছেলে মেয়ে বুড়ো যে যেখানে আছে সবাইকে মদ খাওয়াব; তার জন্য যা টাকা বা যা-কিছু আয়োজন দরকার হয় করো।”
এই বলেই মোড়লের হাতে তিনখানা দশ টাকার নোট গুঁজে দিলাম। তারপর আমরা যথারীতি হাত-মুখ ধুয়ে, জল খেয়ে আমাদের সেই রাজশয্যার পাশে দাঁত দুটোকে রেখে খুব নিশ্চিন্ত হয়ে আরামে বিশ্রাম করতে লাগলাম।
অনেক রাত পর্যন্ত আমি ও ভবানী শুয়ে শুয়ে পাগলা হাতির ভয়ংকর মূর্তিতে তেড়ে আসার কথা আলোচনা করছিলাম। আমার কিন্তু ওই বিরাট জানোয়ারটাকে গুলি করার পর তাকে প্রাণহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে খুবই খারাপ লাগছিল। হাতিটার উগ্রমূর্তিই যেন ভালো ছিল। প্রতি পদক্ষেপে ভীমদর্পে পাহাড় কাঁপিয়ে সামনের পাহাড় থেকে হাতিটা আমার পাহাড়ের দিকে যখন আসছিল, তখন তার সেই ভীষণ চেহারা দেখে, আমার বলতে বাধা নেই, হৃৎকম্প উঠেছিল মুহূর্তের জন্য। জানি না জীবনে আর কোনোদিন পাগলা হাতি মারার সুযোগ হবে কি না—আমার নিজের মতে একটাই যথেষ্ট। হাতিটা মারার পর তেজম্বী একটা প্রাণহানির জন্য আমার এমন কষ্ট হল যা বলে বোঝাতে পারব না। আমার নিজের ইচ্ছায় এ-জীবনে আর কোনও পাগলা হাতি মারতে যাব কি না তাতে বেশ সন্দেহ আছে। যতদিন পর্যন্ত পাগলা হাতি মারতে পারিনি ততদিন প্রতিমুহূর্তেই আমার মনে হত যে, শিকারি জীবনটাই বুঝি ব্যর্থ হয়ে গেল, কিন্তু এখন ঠিক তার বিপরীত।
ভবানী আমাকে বলল, “দাদা, ভোর চারটের সময় একটা লোক নিয়ে ছা-মনু রওনা হব। আমাদের ক্যামেরাটা আনা দরকার—পাগলা হাতির কয়েকটা ছবি আমাদের তুলতে হবে। আর হাতে তৈরি করে আনব কয়েকটা পরোটা যা দিয়ে আমরা বহুদিন পর আমাদের প্রাতরাশ করতে পারব।”
আমি বললুম, “পরোটার থেকেও বেশি জরুরি আমার চা ও চুরুট।”
আমি চা ও চুরুট খুবই ভালোবাসি। এই ৯/১০ দিন এক পেয়ালা চাও আমাদের পেটে পড়েনি। আর দেখতে পাইনি আমার প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় চুরুট। আমি অনেকদিন থেকে বর্মা চুরুট খাই—সবসময়েই আমার মুখে একট চুরুট লেগে থাকে। পকেটে চুরুটের বাক্সে চারটে চুরুট ও মুখে একটা নিয়ে গত ১লা মার্চ আমরা রওনা হয়েছিলাম হাতি শিকার অভিযানে। সব শেষ হয়ে গিয়েছিল সেদিনই; তারপর থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত আর রসদ পাইনি। অবশ্য তার অভাবও বোধ করিনি তেমন। কারণ, এ-ক’দিন আমাদের ধ্যানজ্ঞান ছিল পাগলা হাতি শিকার। আজ সে-পর্ব হয়েছে সমাধান, তাই অন্য নেশাগুলো চাড় দেবার অবকাশ পাচ্ছে।
ভবানী বলল, সে সবই ব্যবস্থা করে নিয়ে আসবে, এমনকি ঊষা চক্রবর্তীকেও।
ভবানী ঘুম থেকে উঠে পড়ল রাত তিনটের সময় এবং একটি লোক সঙ্গে নিয়ে সে ছা-মনুর পথে রওনা হল। যাবার সময় আমায় বলে গেল যে, সকাল আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে ফিরে আসবে সবকিছু নিয়ে। ভবানী চলে যাবার পর আমি আবার সেই রাজশয্যাতে পাশ ফিরে আর একটা ঘুমে বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দিলাম। পরের দিন সকালে আমার কোনও তাড়া নেই। ধীরে সুস্থে উঠে ঝরনার জলে হাত-মুখ ধুয়ে, মোড়লের মাচাবাড়ির বারান্দাতে বসে গ্রামবাসীদের সঙ্গে গল্প আরম্ত করলাম। সকালে গ্রামবাসীরা প্রত্যেকে ছেলেমেয়ে-বৌ নিয়ে আমার কাছে এল কৃতজ্ঞতা জানাতে যে ‘গুণ্ডা মৈয়ুম’ মেরে আমরা তাদের বিপদমুক্ত করেছি। মোড়লের কাছে শুনলাম, সমস্ত গ্রামের লোক দু-কারণে আমাদের উপর খুব খুশি। প্রথম, আমরা গুণ্ডা মৈয়ুম মেরেছি; দ্বিতীয়, এই সুযোগে তারা বহুদিন পরে হাতির মাংস খেতে পারবে। ওরা হাতির মাংস খেতে খুব ভালোবাসে। কিন্তু প্রচুর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ১২/১৪ বছরের মধ্যে তারা সে-সুযোগ পায়নি। কারণ, বন বিভাগের লোকেরা তাদের উপর খুব কড়া নজর রেখেছে—লুকিয়ে হাতি শিকার করে তার মাংস খাওয়া খুবই কঠিন।
সকাল আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে গ্রামে খুব একটা চাঞ্চল্য নজরে পড়ল। প্রত্যেকে কপাল থেকে পিঠে ঝোলানো অবস্থায় একটা বাঁশের ঝুড়ি নিয়ে কাটারি হাতে জঙ্গলের দিকে যেতে লাগল। আমি মোড়লকে জিজ্ঞেস করলাম, “এরা কোথায় যাচ্ছে? জঙ্গলে কাঠ কাটতে?”
মোড়ল একটু হেসে আমাকে জানাল, “বুড়া শিকারি সাহেব, ওরা সব হাতির মাংস কাটতে যাচ্ছে।”
আমি শুনে মোড়লকে বললাম, “ওদেরকে বলে দাও আমরা হাতির পা চারটে চাই। তাছাড়া জোয়ান শিকারি সাহেব হাতির ছবি তোলার জন্যে ক্যামেরা আনতে গেছে, সে-ছবি না তোলা পর্যন্ত ওরা হাতিটাকে যেন না কাটে।”
শুনে মোড়ল আমাকে বলল, “শুধু তো এই গ্রামের লোক মাংসের জন্য যাচ্ছে না—আশেপাশে যত গ্রাম আছে সেখানকার সবাই খবর পেয়ে চলে গেছে। যাই হোক, আমি খবর পাঠাচ্ছি।”
ইতিমধ্যে ভবানী বিট অফিসার ঊষা চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে এসে হাজির। ভবানীকে দূরে থেকে আসতে দেখে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “চা ও চুরুট এনেছ তো ক্যামেরার সঙ্গে?”
ভবানী হাসতে হাসতে বলল, “সবই এনেছি।”
ভবানীর সঙ্গে গ্রামের যে-লোক গিয়েছিল, তার কাঁধে একট হ্যাভার স্যাক ঝুলতে দেখলাম। ওরা সবাই মাচার উপরে উঠে এল। আমি মোড়লকে খুব তাড়াতাড়ি এক হাঁড়ি গরম জল করতে বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যে ভবানীর আনা চা ও চিনি নিয়ে এক হাঁড়ি চা বানানো হল। আমি একটা বড়ো লোটাতে করে এক লোটা চা খেলাম। ভবানী ঝোলা থেকে চারখানা আধ ইঞ্চির থেকেও মোটা মোটা পরোটা বার করল এবং সেই চারখানা পরোটা মাচার ওপরে যতজন লোক ছিল সবাই ভাগ করে খেলাম। প্রত্যেকের কপালে এক-একটি টফির মাপের টুকরো জুটল।
চা পর্ব শেষ করে ৯টার পর আমরা ক্যামেরা ও রাইফেল নিয়ে পাহাড়ের দিকে রওনা হলাম। প্রায় এগারোটা নাগাদ আমরা হাতির কাছে পৌঁছে দেখি ১২৮ জন লোক প্রত্যেকে এক-একটা করে ঝুড়ি নিয়ে উপস্থিত এবং তারা হাতির পেট ও পিঠ থেকে মাংস কাটতে শুরু করেছে। আমরা দেখে অবাক হলাম যে তাদের সঙ্গে কাটারি থাকা সত্ত্বেও তারা বাঁশ কেটে, এক হাত লম্বা ছুরির মতন করে, সেই ছুরি দিয়ে হাতির পুরু চামড়া ও মাংস কেটে কেটে বার করছে।
আমি মোড়লকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এদের সঙ্গে কাটারি থাকা সত্ত্বেও এরা কাটারি দিয়ে মাংস না কেটে বাঁশের ছুরি দিয়ে হাতির মাংস কাটছে কেন?”
মোড়ল একটু হেসে একটা বড়ো কাটারি নিয়ে হাতির মাংসের ওপর অনেকরকম কসরত করে চালিয়ে দেখাল কাটারি বা কুড়ুল দিয়ে মাংস কাটা বেশ কষ্টকর। তার থেকে অতি সহজ উপায় তারা বার করেছে—একটা বাঁশকে কাটারি দিয়ে দু-আধখানা করে, দু-পাশটা কাটারি দিয়ে ধার বানিয়ে, সেই দিয়ে মাংস কাটা সহজ। সত্যিই দেখলাম, প্রায় ক্ষুরের মতন ধার হচ্ছে ওই বাঁশের ছুরিতে এবং তাই দিয়ে হাতির পুরু চামড়া ও মাংস মাখনের মতো কেটে নামিয়ে ফেলতে তাদের এতটুকু পরিশ্রম হচ্ছে না। এক-একটা মাংসের চাঁই ৩/৪ ইঞ্চি মোটা, ১২ থেকে ১৪ ইঞ্চি চওড়া এবং প্রায় ২ ফুট করে লম্বা—যা তারা সহজেই বাঁশের ছুরির সাহায্যে কেটে বার করছে। আমরা পৌঁছবার আগেই মাংস কাটতে শুরু করার জন্য মোড়ল তাদের আদি ভাষাতে বেশ খানিক বকাবকি করল। তখন তারা হাতিটা ছেড়ে একটু পাশে সরে দাঁড়াল। আমি তখন কয়েকটা ছবি তুললাম। ভবানী আমাকে বেশি ছবি তুলতে বারণ করল কারণ, অনেকখানি মাংস কেটে বার করে নেবার পর হাতিটার চেহারা বিসদৃশ হয়ে পড়েছিল। আর তাছাড়া ওর ইচ্ছে, ফেরার পথে মনুঘাটে গিয়ে বিভাগীয় বন বিভাগের অফিসারের মাধ্যমে আমরা যদি আরও দু-একটা পাগলা হাতির সন্ধান পাই তাহলে তা শিকার করে তার ছবি তুলবে, তার জন্য কিছু ফিল্ম রেখে দেওয়া দরকার। ত্রিপুরার সরকারি গেজেট অনুযায়ী সে-বছর প্রায় ৭/৮টা হাতিকে পাগলা বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং আমাদের অনুমতি রয়েছে, সারা ত্রিপুরাতে যেখানে যত পাগলা হাতি আছে তা শিকার করার। যা হোক, আমাদের কপাল ভালো, হাতির পা চারটে তখনও অক্ষত ছিল। আমি তারু ও তার সঙ্গীদের বললাম হাটু থেকে হাতির পা চারটে কেটে ফেলতে এবং তার থেকে হাড়-মাংস সব বার করে নিতে। পা থেকে হাড়-মাংস বের করতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হল। বিকেল তিনটা-সাড়ে তিনটার মধ্যে আমরা পা চারটি থেকে যতদূর সম্ভব হাড়-মাংস বের করে ফেললাম আর ওদিকে ১২৮ জন অদিবাসী ওই অল্প সময়ের মধ্যে অত বড়ো হাতিটার সমস্ত মাংস মায় হাড় পর্যন্ত চেঁছে বার করে ফেলল। নিজের চোখে না দেখলে এ-দৃশ্য বিশ্বাস করা খুব মুশকিল। আগেই বলেছি, পাহাড়ের আশেপাশে এবং ওপরে জঙ্গলের গভীরতা খুবই বেশি। গাছগুলোর ঘনত্ব আমাকে আকর্ষণ করছিল খুব—তাই তার একটা ছবি তুলে স্মৃতি হিসেবে রাখলুম। তারপর আর দেরি না করে আমরা বেরিয়ে পড়লুম মোড়লের মাচাবাড়ি অভিমুখে।
বেলা ৫টা নাগাদ মোড়লের বাড়ি পৌঁছে মোড়লের বৌয়ের কাছে জমা রাখা হাতির দাঁত দুটি নিয়ে ওদের বাচ্চা দুটোকে মিষ্টি খাওয়ার টাকা দিয়ে, উপস্থিত গ্রামবাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে, তাদের অফুরন্ত আশীর্বাদ নিয়ে আমরা ছা-মনুর পথে রওনা হলাম।
ছা-মনু পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে সাতটা বাজল। ছা-মনুর বিট অফিসে থেকে আমাদের জিতেনচন্দ্র এ-ক’দিন খুব আরামে একা-একাই আমাদের রেশনের সদ্ব্যবহার করেছেন। আমরা পৌঁছেই তাকে দিয়ে একটু চা বানিয়ে খেয়ে সোজা কুয়াতলায় গেলাম। দুর্গন্ধময় জামাকাপড় ছেড়ে খুব ভালো করে স্নান করলাম প্রায় এগারো দিন পরে। স্নান করার পর নিজেদের বেশ পরিষ্কার ও ঝরঝরে মনে হতে লাগল। জিতেনকে জিজ্ঞেস করলাম, “জিতেন, আজ রাত্রে তুমি কী খাওয়াইবা?”
তার উত্তরে জিতেন বলল, “আজ্ঞে ডাইল চড়াইমু, ভাত করুম আর একটা আলু-পিঁয়াজের তরকারি করুম।”
স্নান করে ভবানী ও আমি আমাদের বিছানাতে লম্বা হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম, সারা গা-হাতে-পায়ে বেশ ব্যথা ও ক্লান্তি অনুভব করছিলাম। দুই বিছানাতে দুই বন্ধু শুয়ে বেশ কিছুক্ষণ এলোমেলো কথাবার্তা বলতে লাগলাম—যতক্ষণ না জিতেন তার পাকা হাতের ডাইল আর আলু-পিঁয়াজের তরকারি নিয়ে এল। তখন রাত সাড়ে নয়টা। আমরা পেট ভরে সেই ‘পরমান্ন’ খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
রাত্রে ভীষণ ঝড় ও জলে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। খোলা জানালা দিয়ে জল আসছিল; সেই জানালাগুলো ভালো করে বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লাম। পরের দিন কেবল খেলাম, ঘুমালাম আর গল্প করে কাটালাম ভবানী ও আমি। মাঝে মাঝে ঊষা চক্রবর্তীও এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছিল, অবশ্য একটা কাজ আমাদের করতে হচ্ছিল সময়ে সময়ে; তা হল হাতির পা চারটির তত্ত্বাবধান। হাতির পায়ের যেসব জায়গা থেকে মাংস ও হাড় বার করে নেওয়া হয়েছে সে-সব জায়গায় প্রচুর পরিমাণে নুন গুঁজে দেওয়া এবং হাত দিয়ে সে-নুন সব জায়গায় রগড়ে দেওয়া, তারপর কয়েক ঘণ্টা পরপর সেগুলো থেকে বেরোনো জল ফেলে দিয়ে আরও কিছু নুন দিয়ে পা চারটিকে বিনা রোদ্দুরে হাওয়ায় শুকিয়ে তোলার ব্যবস্থা করা।
১০ই মার্চ হাতি মেরে ছা-মনু ফিরে আসার পর ১৩ই মার্চ পর্যন্ত আমরা কেবল খাওয়া, ঘুম, আর বিশ্রাম করে কাটিয়ে দিলাম। ঊষা চক্রবর্তী এ-ক’দিন আমাদের খুব আদর-যত্ন করল। মুরগি, মাছ, মাংস রান্না করে আমাদের খাওয়াল কারণ, আমাদের জিতেনবাবুর রান্নার অভ্যাস নাই, তার পরিবারই রাঁধেন, তিনি কেবল খাইতেই জানেন—এ-কথা তিনি প্রথম দিনেই স্পষ্ট ভাষায় আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
১৩ই মার্চ রাত্রে ঊষা চক্রবর্তী খুব হন্তদন্ত হয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এল এবং খবর দিল যে, বিট অফিসের সামনে যে খাড়া পাহাড় আছে সেই পাহাড়ের ওপরে এক আদিবাসীদের ছোট্ট গ্রামে গতকাল একটা মস্ত বড়ো গণেশ হাতি খুব অত্যাচার করে গেছে। ওই গণেশ হাতিটাকে পাগলা হাতি বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং সরকারি গেজেটে তার সব বর্ণনা দেওয়া আছে। গণেশ হাতি বলে তাদের, যাদের একটামাত্র দাঁত গজায় এবং ওই এক-দাঁতওয়ালা হাতির দাঁতটি খুবই বড়ো হয়। এরা সাধারণ হাতির থেকে অনেক বেশি বুদ্ধি রাখে এবং কিংবদন্তি আছে যে ওরা দেবতার হাতি—কেউ ওদের মারতে পারে না।
ঊষা আমাদের বলল, ওই গ্রাম থেকে লোক এসে তার কাছে খবর দিয়ে গেছে যে, সে যদি শিকারিদের নিয়ে গিয়ে ওই হাতি মেরে দিতে পারে তাহলে গ্রামের লোক বেঁচে যায়। আমার চাইতে কিন্তু ভবানীর উৎসাহই খুব বেশি। সে আমাকে বলল, “দাদা, আজ ৩/৪ দিন আমরা খুব বিশ্রাম করেছি এখন আমরা আবার স্বচ্ছন্দে হাতি শিকারে যেতে পারি।”
ঊষা চক্রবর্তীকে ভবানী বলে দিল, কাল ভোরেই আমরা হাতি শিকারে রওনা হব।
পরের দিন ভোরে ভবানী জিতেনের সাহায্যে হাতে গড়া কয়েকটা পরোটা করে ফেলল; চায়ের সঙ্গে তাই খেয়ে আমরা ঊষা চক্রবর্তীর সঙ্গে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। খুব সাবধানে বাঁশের পুল পেরিয়ে আমরা নদীর অপর পাড়ে পৌঁছে ৩/৪ মাইল হাঁটার পর আমরা পাহাড়ে চড়তে লাগলাম। পাহাড়টা খাড়া এবং বেশ কয়েকশো গজ সোজা উপরে উঠে গেছে। কয়েকদিন বিশ্রামের পর আবার পাহাড়ে চড়তে আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমরা হাপরের মতন হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোরকমে নিজেদের নিয়ে পাহাড়ের চুড়োর ওপরে উঠে তারপর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কিছু দূর যাবার পর আমরা গ্রামে পৌঁছে একটা মাচাবাড়িতে উঠলাম। ঊষা চক্রবর্তীকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এইটাই কি গ্রামের মোড়লের বাড়ি?”
তার উত্তরে সে বলল, “হ্যাঁ, এটাই মোড়লের বাড়ি আর ওই বুড়ো লোকটি যে বাঁশের হুঁকো খাচ্ছে সে-ই এখানকার মোড়ল।”
আমরা ওখানে শিকার করতে যাওয়াতে মোড়লের তেমন উৎসাহ দেখলাম না। অগত্যা ঊষা চক্রবর্তীকেই জিজ্ঞাসা করলাম, “এ-গ্রামে আদিবাসীদের মধ্যে কোনও শিকারি আছে কি না, যে আমাদের হাতি দেখাতে পারবে এবং গণেশ হাতির কাছে আমাদের নিয়ে যেতে পারবে?”
তারই উৎসাহে কয়েকজন লোক জোগাড় হল এবং আমরা পাহাড় ভেঙে আবার বেরোলাম হাতির সন্ধানে। উপস্থিত আদিবাসীদের একজন আমাকে খবর দিল যে হাতির পাল খুব কাছেই যে ঝরনাটা রয়েছে সেইখানে আছে এবং এইমাত্র সে তাদের আওয়াজ শুনে আসছে। সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রমের পর অনেক পাহাড় চড়াই-উতরাই করে ও অনেক ঝরনা পার হয়ে আমরা একপাল হাতি দেখলাম বটে, কিন্তু গণেশ হাতির কোনও সন্ধান পেলুম না। বিকেলের দিকে গ্রামে ফিরে এসে মোড়লের সঙ্গে দেখা করলাম। মোড়ল তার বাঁশের হুঁকো থেকে একটু মুখ সরিয়ে, আমাদের দিকে তাকিয়ে, একটু হেসে বলল, সে অনেক শিকারি দেখেছে, কিন্তু ওই গণেশ হাতিটাকে কেউ মারতে পারেনি। ওর ধারণা, কেউ তা পারবে না। কারণ, ওটা দেবতার হাতি।
ওখানে আর বেশিক্ষণ না থেকে আমরা ছ-মনুর দিকে রওনা হলাম। ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে আটটা বেজে গেল। তারপর স্নান করে খাওয়াদাওয়া সারতে সারতে বেশ রাত হল। মাঝরাত থেকে ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হল।
পরের দিন ১৫ই মার্চ, সারাদিন রাত ঝড় ও জল চলল এক নাগাড়ে।
পরের দিন সকালবেলায় দেখি, বৃষ্টি একটু ধরেছে। আমাদের বিট অপিসের দু-পাশ দিয়ে যে পাহাড়ি নদী বয়ে যাচ্ছিল সেই নদীটা বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে, মনে হচ্ছে যেন বান ডাকবে—আর ওপরের আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা। চা-জলখাবার খেতে খেতে আমার মনে হল, এবার আমাদের এখান থেকে ফেরা দরকার। আকাশের চেহারা দেখে কেন জানি না আমার ধারণা হল, এই ঝড়-জল বেশ কিছুদিন ধরে চলবে এবং তাড়াতাড়ি যদি এখান থেকে না ফিরতে পারি, তাহলে আমরা হয়তো অনির্দিষ্টকালের জন্য এখানে আটকা পড়ব। ভবানীকে আমার মনের কথা জানাতে সেও সমর্থন করল। ইতিমধ্যে ঊষা চক্রবর্তী এসে হাজির—গল্প করার জন্য। আমরা তাকে আমাদের মনের কথা বললাম এবং সেও তা সমর্থন করল। অতঃপর সমস্যা হল, কী করে মনুঘাটে যাওয়া যায়। আসার সময় বন বিভাগীয় অফিসার মি. দাস জিপে করে অনেকদূর এগিয়ে দিয়েছিলেন, তারপর আমরা নৌকায় ও হেঁটে, মালপত্র ও নিজেদের নিয়ে ছা-মনুর বিট অফিলে পৌঁছেছিলাম। কিন্তু এবার? ঊষা চক্রবর্তীকে জিজ্ঞাসা করলাম—এই নদীতে অনেক নৌকা বাঁধা রয়েছে, ওই নৌকাতে চেপে আমরা মনুঘাট পর্যন্ত যেতে পারি কি না। মনুঘাটের ফরেস্ট বাংলোর পাশেই একটা পাহাড়ি নদী দেখেছিলাম; আমার যেন মনে হল এই নদীটাই মনুঘাটের বাংলোর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে।
ঊষা চক্রবতী বলল, আমার ধারণা ঠিকই। এই নদীপথে এখন মনুঘাট যাওয়া খুবই সহজ—স্রোতের টানে নৌকায় আমরা অল্প সময়ের মধ্যে সেখানে পৌঁছাতে পারব। সঙ্গে সঙ্গে আমরা মনঃস্থির করে ফেলে আমাদের জিনিসপত্র গোছাতে আরম্ভ করলাম এবং ঊষা চক্রবর্তীকে পাঠালাম একটা নৌকা ভাড়া করার জন্য। তখন আমি, ভবানী ও জিতেন মিলে আমাদের জিনিসপত্রগুলো খুব তাড়াতাড়ি বাঁধাছাঁদা করে ফেললাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঊষা চক্রবর্তী এসে আমাদের খবর দিল যে, একটা ছোটো নৌকা কয়েক বস্তা সরষে নিয়ে মনুঘাটের দিকে যাবে—তাতে করেই আমরা মনুঘাটে যেতে পারব তিরিশ টাকা ভাড়ায়। মাঝিরা খেতে বসেছে—খাওয়া হলেই তারা রওনা দেবে। অতএব আমরা তাড়াতাড়ি যেন আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে ঘাটে গিয়ে নৌকায় চড়ে বসি। আমরা আর কালবিলম্ব না করে তাই করে ফেললুম।
আমাদের কপালগুণে সেদিন সারাদিন মেঘ করে রইল এবং ভিজে ঠান্ডা হাওয়ায়, খোলা নৌকাতে চেপে, স্রোতে ভেসে, সকাল ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা-চারটার মধ্যে আমরা মনুঘাটে এসে পৌঁছালাম। নিজেরাই মালপত্র নামিয়ে কোনোরকমে বন বিশ্রামাগারে উঠলাম এবং বন বিভাগীয় অফিসার মি. দাস ও রেঞ্জারদের খবর পাঠালাম। তাঁরা আসতে ঊষা চক্রবর্তীর কাছ থেকে পাওয়া পাগলা হাতি মারার যাবতীয় বিবরণ ও চিহ্নগুলি দেখালাম। তাঁরা তাঁদের নিয়ম অনুযায়ী হাতির পা চারটির মাপজোক করলেন এবং দাঁত দুটির ওজনও মেপে নিয়ে বললেন যে হাতিটার বয়স অল্প। জানলুম, গড়পড়তা এদের আয়ু প্রায় ৭০/৮০ বছর। হাতিটার উচ্চটা ছিল প্রায় ৯ ফুট। ওঁরা আমায় জিজ্ঞেস করলেন, আমরা হাতিটার শরীরে কোনও পুরোনো জখমের দাগ বা জখম দেখতে পেয়েছিলাম কি না। আমরা হাতির ডানদিকের পায়ের কিছু ওপরে একটা ১২ বোরের বন্দুকের গুলির সিসে খুঁজে পেয়েছিলাম; সেটা আমাদেব সঙ্গেই ছিল—তাঁদের দেখালাম ও বুঝিয়ে বললাম যে, গুলির আঘাতটা সম্পূর্ণভাবে সেরে গিয়েছিল কিন্তু গুলিটা চামড়ার তলাতেই ছিল।
সে-রাত্রে ওঁদের সঙ্গে অনেক আলাপ-আলোচনা হল এবং এও জিজ্ঞেস করলাম যে, তাঁরা আর কোনও পাগলা হাতির খোঁজখবর পেয়েছেন কি না। তখন মি. দাস অতি উৎসাহে আমাদের বললেন, ওখান থেকে ৪০/৫০ মাইল দূরে, শিলচরের দিকে এগিয়ে গেলে ‘মাছমারী’ বলে একটা আদিবাসীদের গ্রাম আছে, সেখানে একটা খুব বড়ো গণেশ হাতি ভীষণ অত্যাচার করছে। আমরা যদি ইচ্ছে করি পরের দিন তিনি আমাদের সেখানে নিয়ে যেতে পারেন, কারণ পরের দিন তিনি জরুরি সরকারি কাজে সেখানে যাচ্ছেন। ভবানীর খুব ইচ্ছে আমরা ওখানে যাই। আমিও শেষ পর্যন্ত রাজি হতে বাধ্য হলুম।
পরের দিন ১৭ই মার্চ সকালবেলা চা ও জলখাবার খেয়ে আমরা মি. দাসের জিপে চড়ে, তার সঙ্গে রওনা হলাম মাছমারী অভিমুখে। সারা রাস্তায় বেশ ঝড়-বৃষ্টি পেলাম। পথে মি. দাস তাঁর সরকারি কাজের ব্যাপারে বেশ কয়েক জায়গায় নেমে অনেক সময় লাগালেন।
আমরা মাছমারীতে যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন সন্ধে হয়ে গেছে। সেখানকার রেঞ্জার ও বন বিভাগের অন্যান্য কর্মচারীদের কাছে গণেশ হাতির নানানরকম খবর সংগ্রহ করে পরের দিন আমরা গণেশ হাতির সন্ধানে বনে-জঙ্গলে এবং পাহাড়ে হেঁটে ঘুরলাম সারাদিন কিন্তু গণেশ হাতির দর্শনই পেলুম না। প্রত্যেক আদিবাসী আমাদের বলল, “আপনারা শিকারি হিসাবে এখানে আসাতে, গণেশ হাতি হাওয়ায় আপনাদের আসার খবর পেয়ে এ-এলাকা ছেড়ে অনেকদূরে চলে গেছে। কী করে জানি না, যখনই কোনও শিকারি আসে সে-খবর যেন সে হাওয়ায় পেয়ে থাকে।”
আমাদের কপালগুণে মি. দাসের সরকারি কাজ তখনও শেষ না হওয়ায় তাঁকে সেখানে থাকতে হয় এবং তাতে আমাদের ফিরে যাবার সুবিধে হল। আমি তখন আকাশের পরিস্থিতি ও গণেশ হাতির উধাও হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সবকিছু ভেবেচিন্তে মি. দাসের জিপেতেই ফিরে যাওয়া মনস্থ করলাম। ফেরার পথেও সারাক্ষণ ঝড় ও জলের বিরাম ছিল না৷ সে-রাত্রেও সারারাত মুষলধারে বৃষ্টি ও ঝড় চলতে লাগল।
১৯ তারিখ সকালে মনুঘাট বন বিশ্রামাগারে বসে আমি ঠিক করে ফেললাম আমরা ওখানেই হাতি শিকার পর্ব শেষ করে নিজেদের জায়গায় ফিরে যাব। মি. দাস আমাদের খুব আদর-যত্ন করলেন এবং সে-রাত্রে আমাদের খেতে বললেন। রাত্রে খাওয়ার সময় আমি তাঁকে বললাম যে, আমরা কালই আগরতলা ফিরে যেতে চাই—ফেরার যানবাহন ব্যাপারে তিনি কোনও সাহায্য করতে পারেন কি না। তিনি বললেন, আগামীকাল তাঁকে এক বিশেষ কাজে তেলমুচা যেতে হবে—তেলমুচা থেকে আগরতলা মাত্র ৩০/৩৫ মাইল দূরে। আমরা ইচ্ছে করলে তেলমুচা পর্ষস্ত তাঁর সঙ্গে যেতে পারি। আমরা তাই শুনে খুবই খুশি হয়ে তাঁকে বললাম যে তেলমুচায় পৌঁছে গেলে আমরা সেখান থেকে নিজেরাই কোনও ব্যবস্থা করে আগরতলা পৌঁছতে পারব।
পরের দিন ২০শে মার্চ ভোর থেকেই ভীষণ ঝড়, জল ও বজ্রপাত হতে লাগল। আমরা সকাল দশটা নাগাদ খাওয়াদাওয়া সেরে মালপত্র নিয়ে মি. দাসের জিপে রওনা হয়ে সারা রাস্তা বৃষ্টিতে ভিজে ঢোল হয়ে বেলা আড়াইটা নাগাদ তেলমুচায় এসে পৌঁছলাম। পৌঁছেই এক লরিওয়ালাকে পাওয়া গেল—তার খালি লরি আগরতলা ফিরে যাচ্ছে। তাইতেই আমরা আমাদের মালপত্র ও জিতেনকে তুলে দিলাম আর আমরা বসলাম ড্রাইভারের পাশে। মি. দাসকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা রওনা হলাম এবং আগরতলা বাজারে পৌঁছে গেলাম প্রায় চারটে নাগাদ। লরিওয়ালা সার্কিট হাউস পর্যন্ত আমাদের নিয়ে যেতে রাজি হল না। অগত্যা আমরা কয়েকটা সাইকেল রিকশা ভাড়া করে সার্কিট হাউসে গিয়ে পৌঁছলাম। এই ২০ দিন পরে শহরের আবহাওয়া, ইলেকট্রিক আলো, কলের জল ইত্যাদি দেখে আবার নিজেদের সভ্য জগতের মানুষ বলে মনে হতে লাগল। আমরা “সাফি সার্কিট হাউসে মালপত্র গুছিয়ে নিশ্চিন্ত আরামে বিশ্রাম করলাম।
পরের দিন সকালে আমরা বন বিভাগের অফিসে গেলাম ভট্টাচার্য সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য। তিনি আমাদের সফলতার খবর শুনে খুবই খুশি হলেন। তাঁর কাছে আমরা ছা-মনু ও মনুঘাটের অফিসারদের কাছ থেকে পাওয়া হাতি মারার নানা কাগজপত্রের সঙ্গে হাতির দাঁত দুটি ও পা চারটি পেশ করলাম। তিনি আমাদের বললেন যে ওই পাগলা হাতিটি মারার জন্যে ২০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল—আমরা সেই পুরস্কার নিতে ইচ্ছুক, না হাতির দাঁত দুটি। তাঁকে সবিনয়ে বললাম, “কোনও পুরস্কারের লোভে জীবনে কখনও শিকার করিনি; শুধু স্মৃতিরক্ষার্থে কিছু না কিছু নিদর্শন শিকার শেষে নিয়ে এসেছি, যেমন এ-যাত্রায় হাতির দাঁত দুটি ও পা চারটিই শুধু আমাদের কাম্য—এর জন্য আপনার অনুমোদন পেলে কৃতার্থ বোধ করব। এ-কথা শুনে তিনি খুব খুশি হলেন দেখলাম এবং নিদর্শনগুলি নিয়ে যাবার জন্য ট্রানজিট পারমিট ইত্যাদি কমিশনার সাহেবের দপ্তর থেকে করিয়ে দিলেন। তখন তিনি কথাচ্ছলে আমাদের বললেন যে, কেন তিনি বার বার আমাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন শিকারে যাবার সময়—ওই নির্দিষ্ট পাগলা হাতিটি ছাড়া অন্য কোনও হাতি না মারার জন্য। কারণ, তার আগের বছর কলকাতা পুলিশের একজন পদস্থ অফিসার ও তাঁর বন্ধু তিনটি নিরীহ মাদি হাতিকে বিনা অনুমতিতে মারেন এবং বন বিভাগের লোক তাঁদের অকুস্থলে ধরে ফেলে চালান করে দেয়। তা নিয়ে অনেক গণ্ডগোলের সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত অনেক ধরাধরির পর কমিশনার সাহেব তাঁদের ছেড়ে দেন। যদিও ভট্টাচার্য মশায় জানতেন যে, লাহিড়ী সাহেবের বন্ধু হিসেবে কোনোরকম বেআইনি কাজ আমরা নিশ্চয়ই করব না, তবুও শিকারের শুরুতে সাবধানবাণী জানানো তিনি কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন এবং তা আমরা যথারীতি মেনে এসেছি বলে তিনিই আমাদের অশেষ ধন্যবাদ জানালেন।
অতঃপর ফেরার পালা। ভট্টাচার্য মহাশয় ও তাঁর সহকর্মীদের অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে সেদিনই বিকেলের প্লেনে আমরা রওনা হলাম কলকাতা। এই শিকার অভিযানে সাফল্যের জন্য আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ পশ্চিমবঙ্গের বন বিভাগের সর্বোচ্চপদস্থ অফিসার শ্রীকনক লাহিড়ী মহাশয় ও ত্রিপুরার শ্রী এন. সি. ভট্টাচার্য মহাশয়ের কাছে। আর কৃতজ্ঞ—আমার শুভানুধ্যায়ী শিকারি বন্ধুদের কাছে, যাঁরা নানাভাবে আমার অভিযান সাফল্যে সহায়তা করেছেন।
এই শিকার অভিযান বর্ণনার শেষে আমার একটিমাত্র বক্তব্য যে, কোনোরকম বিশেষ শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে এটা লেখা হয়নি। কল্পনার কিছুমাত্র আশ্রয় না নিয়ে শুধুমাত্র বাস্তব ঘটনাকে সাধারণ পাঠকের সামনে তুলে ধরেছি—পড়ে তাঁরা যদি আনন্দ লাভ করেন তাহলেই আমার শ্রম সার্থক হবে।
ছবি: প্রদীপ গোস্বামী
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু