ভ্রমণকাহিনি
15% OFF * FREE SHIPPING
ভ্রমণকাহিনি
সামনে বেশ একটু দূরে দেখি একটা বাঘ আর দুটো ছোটো ছানা সামনের রাস্তা ধরে আমাদের জিপের দিকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। আর আমাদের অবস্থা? কেমন ফ্রিজ শট হয়ে গেছি, তাকিয়ে থাকা সমাধি—মন, বুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গেছে। চেতনা ফিরে এল গাইডের চাপা গলার কথায়। আমায় বলছে যে আমার কোমরে যে একটা লাল রঙের বেল্ট ব্যাগ আছে সেটা খুলে ফেলতে। আমি তাড়াতাড়ি বেল্ট ক্লিপ খুলে ব্যাগটা সিটের নীচে ফেলে দিলাম। লাল রঙ বাঘের আকর্ষণের কারণ হতে পারে, তাই এই সাবধানতা। ইতিমধ্যে বাঘ তার ছানাসহ অনেকটাই এগিয়ে এসেছে।
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী
তাড়োবা জাতীয় উদ্যান — চন্দ্রপুর, মহারাষ্ট্র।
২৪ মার্চ, ২০১৬, সকালবেলা।
২৫ মার্চ, ২০১৬, বিকেলবেলা।
এই দু-দিনে সকালে আর বিকেলে দুটো সাফারি করা হল। ভারতীয় গৌড় (ভারতীয় বাইসন বা বুনো মোষ), ঢোল (বুনো কুকুর), চিতল, সম্বর, বুনো শুয়োর, চৌশিংগা, হনুমান সব দেখা হয়েছে, ছবিও নিয়েছি বেশ কিছু। এ-জঙ্গলে স্লথ বিয়ার, ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিন, হায়না, বার্কিং ডিয়ার এসবও নাকি দেখা যায়। আমরা অবশ্য এদের কাউকেই দেখতে পেলাম না।
চারদিকে কত যে গাছগাছালি—কিছুই তো প্রায় চিনি না। সঞ্জয় কিছু কিছু দেখাল। শাল, সেগুন, অর্জুন, শিমুল, মহুয়া, তেন্ডু, বিভিতকি—আরও কত কী সব বলেছিল মনে নেই। হ্যাঁ, আর একটা ছিল, গাম কারায়া। এরা বলে ভুতিয়া গাছ (ghost tree)। অদ্ভুত সাদাটে গাছের কাণ্ডটা। আধা অন্ধকারে ভূতের মতনই লাগে দেখতে।
পাখিও যা দেখা হল প্রায় সবই আমার চেনাজানা—গাছে পাপিয়া (Common Hawk Cuckoo), দোয়েল (Oriental Magpie Robin), বামুনে কাঠশালিক (Brahminy Stirling), বাঁশপাতি (Green Bee-eater), নীলকান্ত (Indian Roller), ফিঙে (Black Drongo), বড়ো মাছমোরাল (Grey-headed Fish Eagle), জলার ধারে পানকৌড়ি (Cormorant), কোঁচ বক (Indian Pond Heron), ছোটো বক (Little Egret), সোনাজঙ্ঘা (Painted Stork), কালো কাস্তেবক (Black Ibis), শামুখখোল (Open-billed Stork), মাটিতে চুনো বট (Jungle Bush Quail)। এর মধ্যে কালো কাস্তেবকটা আগে চাক্ষুষ দেখিনি, অর্থাৎ যাকে পাখি দেখার ভাষায় বলা হয় ‘লাইফার’।
ও হ্যাঁ, আসল কথাই তো বলা হল না; বাঘ দেখেছি। বাঘ থাকার সম্ভাব্য স্পটগুলোতে ঢুঁ মারা হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না। জঙ্গলে বাঘ দেখতে পাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার। হঠাৎ আমাদের গাইড সঞ্জয় মুন্ডে মোবাইলে সতীর্থদের কাছে খবর নিয়ে জিপের সারথিকে মারাঠিতে কীসব বলল। সারথি-ভাই জিপ ঘুরিয়ে সাঁই সাঁই করে চলল কত নম্বর কে জানে এক ট্যাংকের কাছে। গিয়ে দেখি বেশ পাঁচ-ছ’টা জিপ এরই মধ্যে জলার ধার জুড়ে মালার মতন দাঁড়িয়ে আছে আর আরোহীদল হইহই করে আঙুল তুলে এ-ওকে দূরে কী দেখাচ্ছে। আমাদের জিপটা একটু পেছনে। সঞ্জয় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক একটু তাকিয়ে বলল জলার দূরে ওই পারে মাটিতে একটা গাছের গুঁড়ি পড়ে আছে, তার পাশে শুয়ে রয়েছে। আমরা দুজনে সঞ্জয়ের নেতাজির মতন আঙুল দেখানোর দিকে বরাবর দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি—চোখের ওপর হাত দিয়ে ঢেকে, ১০x৫০ বাইনাকুলার দিয়ে স্ক্যান করে, জুম ক্যামেরা প্যান করে—কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। বাঘ বাদে সবই দেখতে পাচ্ছি। সামনের জিপগুলোর ছেলেমেয়ে, পুরুষ-মহিলা, মায় আমাদের মতন বুড়োবুড়িরাও বাঘ দেখে ফেলল। তাও আবার একটা নয়, দু-দুটো। একটা জিপে আবার মাথায় টুপি, জংলা প্রিন্টের টি-শার্ট পরা দুই ফটোগ্রাফার তেপায়া স্ট্যান্ডে ফুট খানেক লম্বা লেন্সওয়ালা ক্যামেরা তাক করে ছবি তুলছে।
এর মধ্যে একটা জিপ বেরিয়ে চলে যাওয়াতে জলার সামনেটা ফাঁকা হল আর আমাদের ড্রাইভার সাঁই করে গাড়িটা ঘুরিয়ে ফাঁকা জায়গাটায় চালিয়ে নিয়ে সেট হয়ে গেল। এমন সময় সবার হইহই আর সঞ্জয়ের কথাতে বুঝলাম একটা নাকি উঠে দাঁড়িয়েছে। এবার খানিক কসরত করতেই দাঁড়ানো বাঘটা নজরে এল। ওই তো! ওই তো পেয়ে গেছি! গিন্নি তাড়াতাড়ি বাইনাকুলারটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে দেখতে আরম্ভ করল। আমি এবার ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলা শুরু করলাম। প্রায় অনেকটা জুমে গিয়ে ছবি নিতে হল। ইতিমধ্যে গাছের গুঁড়ি জাপটে শোওয়া বাঘটাকেও দেখতে পেলাম। এটা বড়ো বাঘ আর দাঁড়ানোটা ওর ছানা। কানে এল গিন্নির উল্লাস—‘পেয়েছি, পেয়েছি! দুটোই পেয়েছি!’ যাক, জঙ্গলে বাঘ তাহলে দেখা হল। ভাগ্য আমাদেরও ভালোই বলতে হবে।
প্রায় একঘণ্টা তো এখানেই কাটল। এবার ফিরতে হবে অনেকটা পথ। অন্য জিপগুলো সব এগিয়ে গেছে। সঞ্জয় আমাদের অন্য একটা ঘুরপথ দিয়ে নিয়ে চলল। ফাঁকা জঙ্গলের মাটির রাস্তা। লম্বা ঘন গাছের সারির মাথায় সূর্য ঢলতে আরম্ভ করেছে। আলোও অনেকটা কমে এসেছে। চারদিকে বেশ একটা ছমছমে পরিবেশ। এ-পাশে ও-পাশে মাঝেসাঝেই চিতল, সম্বর দু-একটা দেখা যাচ্ছে। ধুস, কে আর ওসব দেখে! পশ্চিম আকাশ লাল। সুজ্জিমামা পাটে বসতে চলেছেন। বিশাল এক জলার পাশ দিয়ে যাচ্ছি। দুজনেরই মন বেশ খুশি খুশি। সঞ্জয়ও খুশি—তার মক্কেলদের বাঘ দেখাতে পেরেছে। হঠাৎ ওর নির্দেশে ড্রাইভার জিপটাকে রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড় করাল। জলার ও-পাড়ে বাঘ এসেছে জল খেতে। একেই বলে মেঘ না চাইতে জল। এবার একবারেই দেখতে পেলাম। বাঘ বাহাদুর জল-টল খেয়ে জলার ধারে বিশ্রাম করতে বসল। ধীরেসুস্থে কয়েকটা ছবি নিলাম। তবে অনেকটা জুম আর কম আলো, মনপসন্দ ছবি হল না। যাক গে, আমি তো আর পেশাদার ফটোগ্রাফার নই, আমাদের পক্ষে এই ক্যামেরায় (Nicon Coolpix P610) এই যথেষ্ট।
পরদিনও সকালের সাফারিতে বাঘের দর্শন মিলল ওই প্রথম যেখানে দেখেছিলাম, সেই জলার ও-পাড়ে গাছের গুঁড়ির পাশে। বাঘ দেখাটা এখন জলভাত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ দেখে অন্য রুটে চলে গেলাম।
২৬ মার্চ, ২০১৬, সকালবেলা।
এটা তৃতীয় সাফারি—আমরা এসেছি মূল জঙ্গলের বাইরে, বাফার জোনে।
আজকের এই বাফার জোনটা মূল জঙ্গল এলাকার বাইরে। তাড়োবা মহারাষ্ট্রের সবচেয়ে বড়ো আর সবচেয়ে প্রাচীন জাতীয় উদ্যান। নাগপুর শহর থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরে চন্দ্রপুর জেলায় এর অবস্থান। ১৯৫৫ সালে ১১৬.৫৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে তাড়োবা জাতীয় উদ্যানের প্রতিষ্ঠা। ১৯৮৬ সালে এর সঙ্গে আরও ৫০৮.৮৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে Tadoba-Andhari Wild Life Sanctuary গড়ে তোলা হয়। ১৯৯৫-তে এর মধ্য থেকে ৬২৫.৪০ বর্গ কিলোমিটার Tadoba-Andhari Tiger Project-এর জন্য সংরক্ষিত হয়। এই এলাকার চতুর্দিকে প্রায় ১১৫০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা বাফার জোন হিসাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। স্থানীয় উপজাতিদের তাড়ু নামক এক দেবতার নাম থেকে তাড়োবা নামের উৎপত্তি আর আন্ধারি নাম হয়েছে স্থানীয় আন্ধারি নদীর নাম থেকে। যা হোক, আমরা জুনোনা বাফার জোনে সাফারির জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় জিপ নিয়ে প্রবেশ করলাম। আজকে আর সঞ্জয় থাকছে না। ওর এলাকা মূল জঙ্গলে। অবশ্য প্রয়োজনীয় সমস্তরকম ব্যবস্থা ও-ই করে দিল। ওরই চেনা বিশ্বস্ত ড্রাইভার আর গাইড। জঙ্গলে ঢুকতে প্রায় ছ’টা বেজে গেল। এই বাফার জোনেও নাকি মাঝে মাঝে বাঘ আসে। তবে আজ আর বাঘে ততটা আকর্ষণ নেই। দেখতে পেলে দেখব, এ পর্যন্ত। না পেলেও ক্ষতি নেই। দু-দিন যা দেখেছি—‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’।
আমার আজকের মূল আকর্ষণ পাখি। জিপটা আস্তে আস্তে চালাতে বলেছি। আমি ক্যামেরা নিয়ে এ-গাছ, সে-গাছ, এ-ডালে, সে-ডালে নজর ঘোরাচ্ছি। সাদাবুক মাছরাঙা (White-throated Kingfisher), নীলকণ্ঠ, ফিঙে, তিলেঘুঘু (Spotted Dove), হাট্টিটি (Red-wattled Lapwing) এদের সব ছবি তো আগে অনেক নিয়েছি। একটা জায়গায় জিপ এসে থামল। সামনে আর রাস্তা নেই, একটু দূরে বড়ো জলা। বাইনাকুলারে দেখলাম ডাহুক (White-breasted Waterhen), কায়েম (Purple Swamphen), জলপিপি (Bronze-winged Jacana)। গাছের ওপর পানকৌড়ি উড়ে এসে বসল। ছবি নিলাম বেশ কিছু, তবে কেন জানি না ভালো এল না। প্রায় ৫০x জুমের বেশি চলে যেতে হচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষণ থেকে অন্য পথে চললাম। গাইডটা ভালো, তবে সঞ্জয়ের মতো দক্ষ নয়। এক জায়গায় ডালে হঠাৎ ফিতে বুলবুল বা দুধরাজ (Asian Paradise-Flycatcher) দেখে রোক্কে, রোক্কে করে জিপ থামাতে বললাম। ক্যামেরা অন করে ছবি তুলতে যাব, ব্যাটা সাঁট করে উড়ে গিয়ে এমন যায়গায় বসল যে সামনে একটা ছোটো ডাল অনেকটাই আড়াল করে দিল। এখন আর এখান থেকে নড়ছি না। এই একটা ছবি তুলতে পারলেই তাড়োবা ভ্রমণ পুরো সার্থক। পাখিটা উড়ে উড়ে এ-ডালে সে-ডালে যাচ্ছে, কিন্তু এত পাতার আড়ালে যে ক্যামেরাতে ধরা যাচ্ছে না। প্রায় মিনিট পনেরো হয়ে গেল। এবার আবার পাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে উড়ে যে কোথায় গেল, আর দেখতে পেলাম না।
মনের দুঃখে এগোতে লাগলাম। এক জায়গায় মাটিতে দেখি দামা—পাতার ঝোপে পোকা খুঁজছে। দামা (Orange-headed Thrush) ভালো পাখি। মাটিতেই বেশি থাকে। ছটফট করে না। নানান অ্যাঙ্গেলে ছবি নেওয়া গেল। আবার সামনের ডালে একজোড়া বামুনি শালিক (Brahminy Starling)। ছবি নিয়ে আস্তে আস্তে এগোচ্ছি। আমরা বরাবরই জিপের সিটের ওপর দাঁড়িয়ে। আমি আবার পেছন ফিরে এদিক ওদিক এ-পাশ ও-পাশ দেখছি। হঠাৎ জিপটা থেমে গেল আর গাইড চাপা গলায় বলে উঠল, “বৈঠ যাইয়ে, বৈঠ যাইয়ে, একদম চুপ রহিয়ে।”
সামনে বেশ একটু দূরে দেখি একটা বাঘ আর দুটো ছোটো ছানা সামনের রাস্তা ধরে আমাদের জিপের দিকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। আর আমাদের অবস্থা? কেমন ফ্রিজ শট হয়ে গেছি, তাকিয়ে থাকা সমাধি—মন, বুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গেছে। চেতনা ফিরে এল গাইডের চাপা গলার কথায়। আমায় বলছে যে আমার কোমরে যে একটা লাল রঙের বেল্ট ব্যাগ আছে সেটা খুলে ফেলতে। আমি তাড়াতাড়ি বেল্ট ক্লিপ খুলে ব্যাগটা সিটের নীচে ফেলে দিলাম। লাল রঙ বাঘের আকর্ষণের কারণ হতে পারে, তাই এই সাবধানতা। ইতিমধ্যে বাঘ তার ছানাসহ অনেকটাই এগিয়ে এসেছে।
গাইডের কথায় জানলাম, ইনি বাঘ নন, বাঘিনী—নাম মাধুরী। দিন কয়েক ধরে একে বাফার জোনের এই অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে। গাইড আর ড্রাইভার দুজনেই এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞ। জানাল যে চুপচাপ থাকলে বাঘ কিছু করে না, আপন পথে যেমন আসছে তেমনই চলে যায়। এখন গাইড ও ড্রাইভার দুজনেরই বিশ্বাস, বাঘ কিছু করবে না। আমাদেরও ধারণা, বাঘ কিছু করবে না। কিন্তু ইনি আবার বাঘিনী—এর মনে কী আছে সেটা দেবা ন জানন্তি কুতো আমরা। গাইড আমাকে সাহস দিয়ে বলল ক্যামেরাতে ছবি নিয়ে যেতে। আমি হ্যাঁ হ্যাঁ করে তাড়াতাড়ি ক্যামেরা অন করে ফ্রেমিং করতে আরম্ভ করলাম। যা-তা সব ছবি হচ্ছে। ভিডিও মোডে ছবি নেবার কথা মাথাতেই এল না। হাত নড়ে যাচ্ছে। একবার তো শাটার টিপতে গিয়ে ক্যামেরার সুইচটাই অফ করে দিলাম। আবার অন করে ছবি নিতে গিয়ে দেখি আমাদের জিপ থেকে প্রায় পনেরো ফুট দূরে মাধুরীদেবী এসে গেছেন। এত কাছে বাঘ আগে এক চিড়িয়াখানায় দেখেছি খাঁচার গরাদের ও-পার থেকে। আর এটা সম্পূর্ণ খোলা জিপ। আশেপাশে একটি কাক-প্রাণীও নেই। একবার হালুম করলেই তো গেলুম। কিন্তু এই অনুভূতি তো সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের দুজনেরই অবস্থা সঙ্গিন। সঙ্গিনী আমার জ্যাকেটটা শক্ত মুঠিতে খামচে ধরে আছে। চোখের সামনে তিনটে হাঁড়িমুখ। একটা মোটা কেঁদো, আর দুটো বেশ গাবলু। আশ্চর্য, এখন আর আমাদের কোনও ভয় করছে না। কিছু ভাবছিও না। সজ্ঞানে আছি না অজ্ঞানে আছি জানি না। হঠাৎ মাধুরীদেবীর কী খেয়াল হল, ডাইনে মোচড় মেরে ছানা সমেত জঙ্গলের ভেতর ঢুকতে আরম্ভ করল। আমার আর আমার সঙ্গিনীর মুখ দিয়ে একসঙ্গে জোরে শ্বাস পড়ল। বুকের ধকধক শুনতে পাচ্ছি। তবে কি এতক্ষণ হৃদযন্ত্র বন্ধ ছিল? কে জানে খেয়াল তো করিনি। মাধুরী তো জঙ্গলে ঢুকে গেল আর আমরা পারি তো একেবারে জিপ থেকে নেমে ওকে খোঁজার জন্য জঙ্গলে ঢুকি আর কি। গুপী-বাঘার মতন এখন নাচতে ইচ্ছে করছে—বাঘা রে ভাগা রে, বাঘা রে ভাগা রে।
প্রায় মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। গাইড বলল যে বাঘিনী হয়তো ছানাদের নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে জলার দিকে যাবে জল খাওয়ার জন্য। কিন্তু না, মাধুরীদেবী আবার বেরিয়েছেন। আমাদের জিপের পেছনে প্রায় ২০-২৫ ফুট দূরে আবার রাস্তা ধরে রাজকীয় ভঙ্গিমায় চলেছেন, কিন্তু ছানা দুটো নেই। তাহলে বোধ হয় বনের ভেতর ছানাদের পাঠশালা আছে, সেখানে ওদের পৌঁছিয়ে দিয়ে মাধুরী হয়তো বাজারে বা পার্লার-টার্লারে যাবেন। যা হোক, একটু হাওয়া বুঝে আমাদের ড্রাইভার জিপ খুব সন্তর্পণে ঘুরিয়ে নিয়ে পেছনে পেছনে যেতে আরম্ভ করল। কিছুটা যাবার পর মাধুরী রাস্তার ধারে একটা গাছে ফেরোমোন ছেটাল। ইস, ছবিটা নিতে-নিতেই কাজ শেষ। এবার এগিয়ে ঘাড় ঘোরাল। আমরাও থেমে গেলাম। মাধুরী রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল। প্রায় মিনিট পনেরো অপেক্ষা করা হল। নাহ্, আর দেখা গেল না। এখন কী করব?
গাইড বলল যে এশিয়ার যেটা বর্তমানে সবচেয়ে আকারে বড়ো বাঘ, নাম ওয়াঘদো—সেটা এখানেই একটা জলের চৌবাচ্চায় সকালবেলাটা শুয়ে থাকে। চলো তাহলে দেখা যাক, যদি দেখতে পাওয়া যায়। গাড়ি চলল ১৭৫ নম্বর চৌবাচ্চার দিকে। জায়গা মতন পৌঁছে দেখি পাঁচ-ছ’টা জিপ বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে। তেপায়া স্ট্যান্ডে ইয়া লম্বা লম্বা লেন্সওয়ালা ক্যামেরা সব লাগানো রয়েছে। সাহেব-মেমও রয়েছে। যথারীতি আমাদের জিপ সবার পেছনে। ওয়াঘদো তার প্রিয় চৌবাচ্চায় শুয়ে আছে। আমরা অবশ্য দেখতে পাচ্ছি না। ড্রাইভার গাড়িটাকে এদিক ওদিক করে আরও পেছনে রাস্তার ধারে একটু উঁচু মতন যায়গায় সেট করে দিল। হ্যাঁ, এবারে বাইনাকুলার দিয়ে স্পষ্ট দেখা গেল। যদিও অনেকটা পেছন থেকে দেখছি—তবু ঠিক আছে। বাইনাকুলার আছে, জুম ক্যামেরা আছে, অসুবিধা তো হচ্ছে না। একেবারে বাঘের থুতনি নেড়ে দেখতে হবে কে বলেছে? বাপ রে বাপ, কী বিশাল! বাঘ বটে একখানা। তিনশো কুড়ি কিলোগ্রামেরও বেশি নাকি ওজন, আর নাকের ডগা থেকে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত এগারো না সাড়ে এগারো ফুট বলেছিল মনে নেই। তা, কে আর ওকে নিয়ে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করেছে বা ফিতে দিয়ে মেপেছে? সবই তো এস্টিমেট, নয়তো আন্দাজে যাকে বলে গেস্টিমেট। লঙ শট, ক্লোজ আপ, ভিডিও—কত ছবি নেবে নাও না।
বেশ কিছুক্ষণ থেকে এবার ফেরার পালা। ঘণ্টা খানেকের বেশি লাগবে এখান থেকে আমাদের রেসর্টে ফিরতে। এবারে জানা গেল আমাদের গাইড এবং ড্রাইভার এত বছর এ-কাজ করছে, কিন্তু এই প্রথম খোলাখুলি এত সামনে থেকে বাঘ দেখল। তাই মুখে বাঘ কিছু করবে না বলে আমাদের সাহস দিলেও ওরা নিজেরাও বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল। ও তাই, এবার মনে পড়ল, অল্পবয়সি গাইডটা কেমন মাথা নীচু করে সিটের নীচে সেঁধিয়ে গিয়েছিল। আর ড্রাইভার স্টিয়ারিং ধরে শক্ত হয়ে বসে ছিল। আমরা এবার তাড়োবা ভ্রমণের সার্থকতা নিয়ে মহা উৎসাহে আলোচনা করতে করতে ফিরে চললাম।
দুই ছানা সঙ্গে করে সাফারি গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে মাধুরী।
ছবি: লেখক
লেখকের অন্যান্য লেখা
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু