বড়ো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
বড়ো গল্প
একটা অদ্ভুত ধরনের গাছ ঈশানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অন্যরকম দেখতে ওই গাছগুলো অন্য ঝোপঝাড়ের থেকে আলাদাভাবে বেড়ে উঠেছে। গাছগুলো ঠিক যেন মাকড়শার মতো। মাঝখানটা ফাঁকা আর চারপাশে মাকড়শার লম্বা লম্বা পায়ের মতো লতানে ডাল মাটিতে ছড়িয়ে আছে। ডালের গায়ে আবার লম্বা লম্বা তীক্ষ্ণ কাঁটা। দেখলেই কেমন গা শিরশির করে উঠে। আচমকা পিছনে একটা খসখস আওয়াজ শুনে ফিরে তাকাল ঈশান। ভয়ে ওর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল।
শংকর লাল সরকার
চোখ খুলে ঈশান দেখল সে বালিয়াড়িতে পড়ে আছে। মাথার উপর জ্বলজ্বলে সূর্য। সমুদ্রের ঢেউ এসে গায়ে লাগছে। ও কি বেঁচে আছে? ঘাড় উঁচু করে চারপাশটা দেখবার চেষ্টা করে। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা, মাথাটাও ভীষণ ভারী হয়ে আছে।
বেনিন থেকে সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজে লেবাননের রাজধানী বেইরুটে যাচ্ছিল ঈশান। প্লেন মাটি ছেড়ে কিছু দূর উড়তে না উড়তেই প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। অজ্ঞান হবার আগে সে একটা প্রচণ্ড শব্দ শুনেছিল। মাথায় প্রচণ্ড একটা আঘাত লাগল, তারপর আর কিছু মনে নেই। অচেতন হবার মুহূর্তে মনে হয়েছিল প্লেনটা বুঝি টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে ভেঙে পড়ছে। সে যে বেঁচে আছে এটাই খুব আশ্চর্যের। বিমান দুর্ঘটনার পর এরকম অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যাওয়াকে মিরাকল ছাড়া কীই-বা বলা যায়।
হাঁটুতে ভর দিয়ে টলতে টলতে কোনোরকমে উঠে দাঁড়াল ঈশান। বিন্দুমাত্র শক্তি দেহে অবশিষ্ট নেই। একদিকে খাড়া পাহাড়, অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে প্লেনের কয়েকটা ভাঙা টুকরো। সমুদ্রতটের বালি ইতিমধ্যেই বেশ তেতে গিয়েছে। শরীরটাকে হিঁচড়োতে হিঁচড়োতে সে এগোতে থাকল। হাঁটু দুটো চলতে চাইছে না। পাহাড়ের ছায়ায় একটা পাথরের উপরে বসে পড়ল। রোদের তেজ দেখে মেনে হচ্ছে দুপুর। এটা একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, না কি কোনও দেশের উপকূল—কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এতক্ষণ কোনও মানুষজন চোখে পড়েনি। কাছাকাছি কোনও মনুষ্য বসতি থাকলে নিশ্চয়ই বোঝা যেত। ঈশান যে একটু ঘুরেফিরে দেখবে সেই শক্তি নেই। মাথা কাজ করছে না, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর। একটা পাথরের ওপরেই সে শুয়ে পড়ল।
নরম রোদ মুখে পড়তেই ঈশানের ঘুম ভেঙে গেল। কাল দুপুর থেকে সারারাত সে ঘুমিয়েছে। ধাতস্থ হতেই ওর কিছুটা সময় কেটে গেল। বুঝতে পারল প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। প্রায় দিন দু-এক পেটে কিছু পড়েনি। সমুদ্রের ধারে বেশ কয়েকটা নারকেল গাছ। ওর ভাগ্য ভালো নারকেল গাছগুলোর তলায় খোজাখুঁজি করতেই তলায় পড়ে থাকা কয়েকটা নারকেল পেয়ে গেল। নারকেল দিয়েই পেট ভরাতে হবে। নারকেলের ছাল ছাড়ানো বেশ সমস্যার। ভাগ্যক্রমে ঈশান ভেঙে পড়া বিমানের একটা লোহার টুকরো কুড়িয়ে পেয়েছিল। ধারালো লোহার টুকরোটার একটা দিক বেশ হাতলের মতো। ছুরির মতো কাজে লাগতে পারে ভেবে নিজের কাছে সে ওটা রেখে দিয়েছিল। এখন সেটাকেই হাতিয়ারের মতো ব্যবহার করে একটা নারকেল ভেঙে পুরো জলটা মুখে ঢেলে দিল। আহ্, শরীরটা এতক্ষণে ঠান্ডা হল। খান দু-এক নারকেল উদরস্থ করতে একটু চাঙ্গা হল।
যতদূর চোখ যায়, ডানদিকে খাড়া পাহাড়। সমুদ্র আর পাহাড় হাত ধরাধরি করে সেদিকে এগিয়ে গেছে। বামদিকের তটভূমি একটু দূর গিয়েই ধনুকের মতো বেঁকে গেছে। ও-পাশটা আর দেখা যচ্ছে না। ঈশান ঠিক করল সে বাঁদিক ধরেই এগোবে। ওদিককার পাহাড়টাও তত খাড়া নয়। তার ওপর বড়ো বড়ো পাথরগুলো এমনভাবে গায়ে গায়ে রয়েছে যে একটু চেষ্টা করলেই উপরে উঠা সম্ভব। ধীরে ধীরে ঈশান উপরে উঠতে লাগল। কিছুটা উপরে উঠলে চারপাশটা সম্পর্ক একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে। যত উপরে উঠতে লাগল, হালকা ঝোপঝাড় ক্রমশ ঘন জঙ্গলের চেহারা নিতে লাগল। লোহার টুকরোটাকে বাগিয়ে ধরে একটু একটু করে উপরে উঠতে লাগল। বড়ো গাছ একটাও নেই। কেবল লতাপাতা আর গুল্মশ্রেণির উদ্ভিদ প্রতিমুহূর্তে পথ অবরোধ করছে। কত নাম না জানা পাখির কিচিরমিচির। কলকাতার ছেলে ঈশান, চারপাশের রকমারি উদ্ভিদ বা পাখি কিছুই সে ভালোভাবে চেনে না, তবুও এই অজানা জনশূন্য দ্বীপের প্রকৃতি কেমন যেন একটা ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি করে।
একটা অদ্ভুত ধরনের গাছ ঈশানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অন্যরকম দেখতে ওই গাছগুলো অন্য ঝোপঝাড়ের থেকে আলাদাভাবে বেড়ে উঠেছে। গাছগুলো ঠিক যেন মাকড়শার মতো। মাঝখানটা ফাঁকা আর চারপাশে মাকড়শার লম্বা লম্বা পায়ের মতো লতানে ডাল মাটিতে ছড়িয়ে আছে। ডালের গায়ে আবার লম্বা লম্বা তীক্ষ্ণ কাঁটা। দেখলেই কেমন গা শিরশির করে উঠে। আচমকা পিছনে একটা খসখস আওয়াজ শুনে ফিরে তাকাল ঈশান। ভয়ে ওর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল। বিরাট কালো একটা ভল্লুক ঠিক ওর পিছনেই দাঁড়িয়ে। কলকাতার রাস্তায় এরকম ভল্লুকের নানারকম কসরত দেখেছে। মাদারির হাতের লাঠির ভয়ে সিটিয়ে থাকা, মুখে বকলস পরানো সেই অবোলা জীবকে দেখে কষ্টই হয়। কিন্তু মাত্র দশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাট আকৃতির সেই ভল্লুকটাকে দেখে ঈশানের হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেল। এই জনহীন পাহাড়ি এলাকায় এক বন্য ভল্লুকের সামনে নিজের অসহায়তার জন্য আজ নিজের প্রতিই করুণা হয়। লোহার টুকরোটাকে বাগিয়ে ধরে সে, যদিও জানে ওটা ভল্লুকটার কাছে এই পলকা অস্ত্রটা কিছুই নয়। তবুও মরার আগে না মরবার একটা অদম্য জেদ ওর মধ্যে কাজ করে। প্লেন দুর্ঘটনায় সে যখন আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গেছে তখন ভল্লুকটার মহড়া না নিয়ে সে কিছুতেই হার স্বীকার করবে না। মনে মনে ইষ্টদেবতার নাম করতে করতে ভল্লুকটার চোখে চোখে রেখে সে একটু একটু করে পিছোতে থাকে। এক পা এক পা করে ওটা এগিয়ে আসছে আর ইশান পিছোচ্ছে। সাক্ষাৎ যমরাজ যেন ওর সামনে হাজির। হাঁ-মুখের ভিতর ছুরির মতো সাদা দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে। ভয়ে ওর চোখ বুজে আসতে চাইছে, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য চোখ সরানো যাবে না। একমাত্র কোনও অলৌকিক ঘটনা ঘটলে তবেই ইশানের প্রাণ বাঁচতে পারে।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। মাটিতে লুটিয়ে থাকা মাকড়শার লম্বা লম্বা পায়ের মতো ডালগুলি সাঁৎ সাঁৎ করে খাড়া হয়ে চারদিক থেকে খাঁচা আটকানোর মতো করে বন্দি করে ফেলল ভল্লুকটাকে। ছিটকে সরে গেল ঈশান। সর্বনাশ, গাছগুলো জ্যান্ত! পতঙ্গভুক উদ্ভিদের এক দানবীয় সংস্করণ। চারপাশে এরকম আরও অনেক লতানে গাছ। মাঝখানের ফাঁকা জাযগায় পা দিলে মৃত্যু নিশ্চিত। লজ্জাবতী লতা যেমন স্পর্শমাত্রই নুয়ে পড়ে, এই দানব মাংসাশী উদ্ভিদের কাঁটাওয়ালা ভয়ংকর ডালগুলো তেমনি স্পর্শ পেলেই মরণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে শিকারকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভল্লুকটার গর্জন করুণ আর্তনাদে পরিণত হল। মনে মনে ঈশান বলল, যাক আবারও সে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল।
পাহাড়টার উপরে বেশ খানিকটা সমতল জায়গা আছে। একপাশ দিয়ে একটা ক্ষীণ জলধারা তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। সারাদিনে দুটো নারকেল ছাড়া আর কিছু পেটে পড়েনি। পাহাড়ের ঢালে জংলি আপেল গাছ। বুনো আপেল খেয়েই থাকতে হবে। শরীর আর চলছে না। পাহাড় ভাঙার পরিশ্রমে দেহের সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। ক্লান্ত শরীরে ঈশান একটা বড়ো পাথরের উপরেই শুয়ে পড়ল।
দুই
চিৎকার কোলাহল শুনে ঈশানের ঘুম ভেঙে গেল। তখনও ভালো করে সকালের আলো ফোটেনি। কয়েকজন আদিম লোক ওকে ঘিরে রয়েছে। হাতে লম্বা বর্শা। কোমরে পশুর চামড়ার লেংটি। কালো কালো স্বাস্থ্যবান লোকগুলোর সর্বাঙ্গ থেকে যেন হিংস্রতা ঠিকরে বার হচ্ছিল। গায়ে নানা রঙের বিচিত্র উল্কি ওদের আরও বীভৎস করে তুলেছিল। ঈশান চোখ খুলে তাকাতে ওরা হইচই করে চিৎকার করে উঠল। একজনের মাথায় পাখির পালকের টুপি। ও-ই বোধ হয় ওদের সর্দার। সর্দার ইশারায় ঈশানকে ওদের অনুসরণ করতে বলল। বর্শার খোঁচা ইতিমধ্যেই কয়েকবার গায়ে লেগেছিল তাই বিনা বাক্যব্যায়ে ঈশান ওদের সঙ্গে চলল। সর্দার গোছের লোকটি চলেছে সকলের আগে আগে। ঈশানের দু-পাশে দুজন আর পিছনে চার-পাঁচজন পাহারা দিয়ে চলেছে। পালাবার চেষ্টা করলেই বর্শায় এফোঁড়-ওঁফোড় হয়ে যেতে হবে।
হাঁটছে তো হাঁটছেই। ঈশানকে ওরা কোথায় নিয়ে চলেছে? প্রায় ঘণ্টা খানেক চলবার পর একটা ফাঁকা জায়গায় এল। একটা বেশ বড়ো চত্বর। তিনদিকে পাহাড় প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সেই পাহাড়ের গায়ে ছোটো ছোটো গুহা। এটাই ওদের আস্তানা। ঈশান মনে মনে ভাবল, তার মানে এরা গুহামানব। কুঠির তৈরি করতেও শেখেনি। এতক্ষণে ঈশানের খেয়াল হল, বর্শার ফলাগুলো তো পাথরের। হায়! কাদের পাল্লায় পড়ল সে? একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে গুহামানব আছে?
একটা গুহার ভিতরে ঈশানকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখল। লম্বা গুহার পিছনের দিকের দেওয়ালে একটা ছোটো গর্তের ভিতর দিয়ে আসা সূর্যালোকে ভিতরটা অস্পষ্ট দেখা যায়। এটা একটা প্রাকৃতিক গুহা। কিন্তু গুহার ভিতরে ওটা কী? অদ্ভুতদর্শন একটা পাথরের মূর্তি। মানুষের দেহের উপরে নেকড়ে বাঘের মুখ। মূর্তির গায়ে সিঁদুর লেপা। ওদের উপাস্য দেবতা বলে মনে হয়। প্রাচীন মিশরে এই ধরনের দেবতার পূজা প্রচলিত ছিল।
লতার দড়ি দিয়ে এমন শক্ত করে বেঁধেছে যে নড়াচড়ার উপায় নেই। নিজের সব ভাবনা অদৃষ্টের হাতে সঁপে দিয়ে ঈশান চুপ করে বসে ছিল। একটু পরে একজন লোক গুহায় প্রবেশ করল হাতে, পাথরের বাটিতে একটা ক্বাথের মতো জিনিস। খাবার ইশারা করছে। ঈশানের ক্ষুধাও পেয়েছে খুব। যা থাকে কপালে। ঈশান ইশারায় লোকটিকে হাতের বাঁধন খুলে দিতে বলল। বাঁধন আলগা করতে সে আঙুলে করে সামান্য একটু জেলির মতো খাবারটা মুখে তুলল। স্বাদ খারাপ নয়। মিষ্টি, অনেকটা হালুয়ার মতো। খাওয়ার পর জল খাওয়ার ইশারা করল ঈশান। লোকটি কী বুঝল কে জানে, গুহা থেকে বেরিয়ে গেল। ফিরে এল একটা বাঁশের চোঙ হাতে নিয়ে। এটাই ওদের জল খাওয়ার গ্লাস।
জংলি লোকগুলোর মতলব কী কিছু বোঝা যাচ্ছে না। দিন দু-এক কেটে গেল। ঈশানের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়েছে। সময়ে সময়ে খেতে দিচ্ছে। বেশ তোয়াজেই রেখেছে, কেবল গুহা থেকে বের হবার অনুমতি নেই। গুহার মুখটাতে দুজন সর্বক্ষণ পাহারা দিচ্ছে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেও একজন পাহারাদার বর্শা হাতে পিছু নিচ্ছে। গুহার ভিতরটা ঈশান খুঁটিয়ে দেখেছে। পাথরের মূর্তিটাকে ওরা পূজা করে নিশ্চিত, কিন্তু গত দুইদিন কেউ ওটার পূজা করেনি। গুহার ভিতরের দেওয়ালে কয়েকটা ছবি আঁকা আছে। শিকারের দৃশ্য বলেই মনে হয়। মানুষগুলো এখনও আদিম গুহামানবের স্তরেই রয়ে গেছে। গুহার পিছন দিকের দেওয়ালে আলো আসবার জন্য একটা গর্ত আছে। সেখান দিয়ে নীচের দিকে দেখা যায়। পাহাড়ের এদিকটা খাড়াই, দূরে সমুদ্রের আভাস। পালানো একেবারে অসম্ভব এটা বুঝেই ঈশান নিজেকে অদৃষ্টের হাতে সঁপে দিয়েছে।
তৃতীয় দিনেই ঈশানকে ধরে রাখার কারণটা স্পষ্ট হয়ে গেল। সেদিন ভোররাত থেকেই ওদের ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। সবাই ছুটোছুটি করে যেন কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। অন্ধকার গুহার ভিতর থেকে ঈশান বাইরে ওদের কোলাহল শুনতে পাচ্ছিল। দিনের আলো ফুটতেই ওরা ঈশানকে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। চত্বরের মাঝখানে বেশ বড়ো একটা খুঁটি পোঁতা আছে। খুঁটির চারদিকে গোল করে বয়স্ক পুরুষ মহিলা বাচ্চা—সকলে ভিড় করে বসেছে। খুঁটিটার সঙ্গে ওরা ঈশানকে বেশ শক্ত করে বাঁধল। একটুও নড়াচড়ার উপায় নেই।
পাথরের উঁচু একটা আসনে সর্দার বসে রয়েছে। সর্দারের পাশে আর একটা উঁচু পাথরের উপর একজন বীভৎস চেহারার লোক। ও কি মানুষ, নাকি পিশাচ? মানুষের চেহারার যে এত ভয়ংকর হতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ওরকম বীভৎস মুখ ঈশান স্বপ্নেও কখনও দেখেনি। মুখের একদিকটা পোড়া। গলার সঙ্গে সেদিককার চামড়া আটকানো। চোখের জায়গায় একটা কালো গর্ত। গলায় হাড়ের মালা। মাথায় পালক গোঁজা টুপি। দু-পাশে লালচে চুলের গোছা ঘোড়ার লেজের মতো ঝুলছে। একদৃষ্টে লোকটা ঈশানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওহ্! কী জিঘাংসাভরা দৃষ্টি।
হঠাৎ একজন মানুষের আর্ত চিৎকারে ঈশান চমকে উঠল। ঘাড় কাত করে দেখার চেষ্টা করে। একজন লোককে তিন-চারজন মিলে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার চেহারা ওদের থেকে অনেক ভালো। তিন-চারজন মিলে টেনে নিয়ে যেতেও ওদের যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। গায়ের রঙ কালো হলেও লোকটার চেহারা পেশিবহুল, পাথরের মূর্তির মতো। দেখলেই বোঝা যায় রীতিমতো বলশালী। আর একটা খুঁটির সঙ্গে লোকটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হল। কী ঘটতে চলেছে, ঈশান আন্দাজ করতে পারে। চত্বরের একধারে কাঠকুটো জোগাড় করে আগুন জ্বালানো হয়েছে।
এখনই হয়তো ঈশানদের বলি দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মাংস ভাগ করে দেওয়া হবে ভিড় করে থাকা লোকদের মধ্যে। হিংস্র নরখাদকদের কবলে পড়েছে। ঈশান আর ভাবতে পারে না। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। মনে পড়ে বাবা-মায়ের কথা—কলকাতার বাড়ি, বন্ধুদের কত স্মৃতি। আর আজ কত দূরে অসহায়ভাবে ওকে নরখাদকদের খাদ্যে পরিণত হতে হবে।
সর্দারের পাশে বসে থাকা পিশাচের মতো লোকটা নীচে নেমে এসেছে। হাতে পাথরের একটা বিশাল ভোজালির মতো অস্ত্র। উচ্চৈঃস্বরে দুর্বোধ্য ভাষায় কী একটা মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে পাশাপাশি বেঁধে রাখা ঈশান আর ওই লোকটার চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে আরম্ভ করল। ঈশান আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, পাশের খুঁটিতে বেঁধে রাখা লোকটির চোখে-মুখে কিন্তু মৃত্যুভয়ের কোনও ছাপ নেই। নির্ভীকভাবে সে তাকিয়ে রয়েছে নাচতে থাকা বীভৎস চেহারার নরপিশাচটার দিকে। নাচতে নাচতে একসময় থেমে যায় পিশাচটা। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যায় পাশের লোকটির দিকে। ওর উদ্যত ভোজালির দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারে না ঈশান। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। এবারে হয়তো ভোজালির এক কোপে যুবকটির মুণ্ড দেহচ্যুত হয়ে মাটিতে ছিটকে পড়বে।
ঠাক ঠাক—একটা বিজাতীয় আওয়াজে চমকে চোখ খুলে ঈশান দেখল পিশাচটার হাত থেকে ভোজালিটা ছিটকে পড়েছে। নরখাদক মানুষগুলো আতঙ্কে এদিক ওদিক ছুটোছুটি শুরু করেছে। ঝোপের ভিতর থেকে বন্দুক হাতে একজন সাহেব বেরিয়ে এলেন। দ্রুত পায়ে এসে তিনি ছুরি দিয়ে ঈশানের হাতের বাঁধন কেটে দিলেন। পাশের যুবকটিও নিজেকে মুক্ত করে ফেলেছে। তারপর জংলি লোকগুলোর ব্যূহ ভেদ করে তিনজনে ছুটতে লাগল জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। কয়েকজন ওদের পিছু নেবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বন্দুকের গুলিতে তাদের একজন ধরাশায়ী হতে অন্যরা আর সাহস দেখায়নি।
তিন
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বেশ খানিকটা এঁকে-বেঁকে ছোটবার পর ঈশানরা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ল। সামনে একটা ছোটো নদী বয়ে যাচ্ছে। সাহেব ইশারায় ওদের নদীর একধারে যেতে বললেন। ঝোপের আড়ালে একটা মোটর-লঞ্চ লুকানো ছিল, ওরা তিনজন তাতে চেপে ভেসে পড়ল। নদীর উজান বেয়ে কিছুক্ষণ চলবার পর একটা পাথরের খাঁজে জলযানটিকে লুকিয়ে রেখে নামতে যাচ্ছে, পিছন থেকে সেই বন্য যুবকটি ঈশানের হাত টেনে ধরল। ওর ইশারায় জলের দিকে তাকিয়ে ঈশান দেখল জলের উপরে কতকগুলো চোখ ভেসে বেড়াচ্ছে। ভালো করে তাকাতেই চোখে পড়ল এক-একটা বিশাল কুমির। পদে পদে মৃত্যু এখানে ওত পেতে রয়েছে। একটু অসাবধান হলেই আর নিস্তার নেই।
পাহাড়ের গায়ে একটা গুহার মধ্যে ঈশানরা প্রবেশ করল। সাহেবের নাম মার্শাল বাউসার্ড, ফরাসি। ঈশান আর উনি নিজের বুকে হাত দিয়ে নিজের নিজের নাম বলতে লাগলেন। ইশারায় কাজ হল। যুবকটি জানাল, ওর নাম থথ। এই পাহাড়ের ওপারে সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপে লিম্বা উপজাতির লোকরা বাস করে, সে তাদের লোক।
গুহাতে প্রবেশ করেই ঈশান বুঝতে পেরেছিল মার্শাল সাহেব এখানে বেশ কিছুদিন যাবৎ আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু এই বন্য নরখাদকদের এলাকায় এমনভাবে ডেরা বানানোর কারণ পরিষ্কার হল না ঈশানের কাছে। কিন্তু সারাদিনের অসহ্য আতঙ্ক আর পরিশ্রমের পর অন্য কিছু চিন্তার অবসর কোথায়? গুহার ভিতর মাদুর পাতা ছিল। শুকনো মাংস, টোস্ট আর চকোলেট দিয়ে খাওয়া সেরে তাতেই ঈশান শরীর ছেড়ে দিল।
পরদিন সকাল হতেই থথ রওনা হল তার নিজের বাড়ির দিকে। যাবার আগে ওদেরও ওর সঙ্গে যেতে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু ওরা যখন কিছুতেই রাজি হল না তখন একে একে ঈশান আর মার্শাল সাহেবের নাকে নাক ঘষে অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। তারপর পাহাড় পেরিয়ে চলে গেল দৃষ্টির আড়ালে।
থথ চলে যাবার পর মার্শাল সাহেব ঈশানের দিকে ফিরে বললেন, “আপনি বোধ হয় এরকম নরখাদকদের দেশে আমাকে দেখে খুব আশ্চর্য হচ্ছেন?”
ঈশান যে আশ্চর্য হয়েছে সে তো বলাই বাহুল্য। ঈশান কীভাবে ঘটনাচক্রে এখানে এসে পড়েছে তা মার্শাল সাহেবকে ইতিমধ্যেই বলেছে। মার্শাল সাহেব এবার ঈশানের পাশে বসে নিজের কাহিনি বলতে শুরু করলেন।
মার্শাল বাউসার্ডের ঠাকুরদার বাবা পিয়ের বাউসার্ড ছিলেন ফরাসি সৈন্যাধ্যক্ষ। নেপোলিয়ন যখন মিশর অধিকার করেন তখন লেফটেনান্ট পিয়ের তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন। পিয়ের বাউসার্ড সুবিখ্যাত ‘রসেটা পাথর’ আবিষ্কার করেছিলেন, যা মিশরের ইতিহাস রচনার জন্য এক অমূল্য সম্পদ। এছাড়া পিয়ের সাহেব আরও কিছু প্যাপিরাস পুথি আবিষ্কার করেছিলেন। পুথিগুলি এমনভাবে সুরক্ষিত ছিল যাতে তাঁর মনে হয় এগুলো কোনও বিশেষ নির্দেশবাহী। ওই পুথিগুলোকে তিনি ফরাসি সরকারের কাছে জমা না দিয়ে নিজের কাছেই রেখে দেন। বহু বছর বাদে মার্শাল সাহেব বাতিল হয়ে যাওয়া একটা সিন্দুকের মধ্যে ওগুলোকে পুনরাবিষ্কার করেন। পুথিগুলি সব হায়েরিটিক পদ্ধতিতে লিখিত।
এতক্ষণ একমনে শুনতে থাকা ঈশান বলল, “হায়েরেটিক, নাকি হায়রোগ্লিফ? প্রাচীন মিশরে হায়রোগ্লিফ বা চিত্রভাষা প্রচলিত ছিল।”
কথার মাঝখানে বাধা পড়ায় মার্শাল সাহেব বেশ অসন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হল। কিন্তু ঈশানের কৌতূহলী মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি ব্যাখা করতে লাগলেন—“প্রাচীন মিশরে তিনরকমের লিপি প্রচলিত ছিল। হায়রোগ্লিফ, হায়েরেটিক ও ডেমোটিক। হায়রোগ্লিফের একটানা ও অবিচ্ছিন্ন সংশোধিত রূপ হায়েরেটিক। এটিই সম্ভবত মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বপ্রথম সাধারণ হস্তলিপি। প্যাপিরাস পাতার উপরে নলখাগড়ার কলমে ডান থেকে বামদিকে এই লিপি লেখা হত।”
মার্শাল বাউসার্ড বলে চলেন, “অনেক পরিশ্রম করে আমি ওই লিপির পাঠোদ্ধার করেছি। মিশরের পঞ্চম রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা সাহুরা’র সময় পুথিগুলি লেখা হয়। পঞ্চম রাজবংশের এই রাজারা অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলেন। নিজেদের নামের শেষে তার ‘রা’ অর্থাৎ সূর্যপুত্র—এই অভিধা ব্যবহার করতেন। সাহুরা সর্বপ্রথম সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরি করান। ইতিহাসে সর্বপ্রাচীন নৌশক্তি বিকাশের মাধ্যমে এই রাজা মিশরের উন্নয়ন বজায় রাখেন। কিন্তু রাজার জীবনে এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। একমাত্র পুত্র নেফের সমুদ্রে অভিযানের সময় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। সমুদ্রের মধ্যে এক অজ্ঞাত দ্বীপে সাহুরা তাঁর পুত্র নেফেরের জন্য এক পিরামিড তৈরি করান। বিপুল ধনসম্পত্তি-সমেত নেফেরের মমিকৃত দেহ সেখানে সমাধিস্থ করা হয়েছে। মিশরের ফ্যারাওদের এইসব সমাধি সৌধের মধ্যে যে অতুল ঐশ্বর্য রক্ষিত থাকত তার প্রতি সেই প্রাচীন যুগের মিশরীয়রাও প্রলুব্ধ ছিল। সুউচ্চ পিরামিড, বিভ্রান্তিকর প্রবেশদ্বার, গোপন সমাধিগৃহ নির্মাণ সত্ত্বেও সমাধিস্থ হবার পরেই ফ্যারাওদের কবরে লুঠেরাদের হাত পড়ত। তাই সাহুরা চেয়েছিলেন তাঁর পুত্রের পিরামিড এমন এক জায়গায় নির্মিত হবে যেখানে লুঠেরারা পৌঁছতে পারবে না। প্যাপিরাসের পুথিতে সেই অজানা দ্বীপ সম্পর্কে কিছু সংকেত ছিল। সেটা যে এই দ্বীপই সে-ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।”
চার
মার্শাল বাউসার্ডের সঙ্গে বসে কথা বলছে, এমন সময় ঈশানের চোখে পড়ল দূর সমুদ্রের বুক থেকে কালো কালো দুটো বিন্দু ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছে। একটু কাছে আসতেই বোঝা গেল ও-দুটো ডিঙি নৌকা।
এই দ্বীপে সব হিংস্র নরখাদকদের বাস। বাইরের লোকদের পেলে ওরা কখনও ছাড়ে না। ঈশান আর মার্শাল সাহেব একটা ঘন ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে ওদের লক্ষ করতে লাগল। সাহেবের হাতে বন্দুক আর ঈশানের হাতে একটা বড়ো লাঠি।
তীরের দিকে এগিয়ে এল নৌকা দুটি। প্রথম নৌকাটাতে কয়েকজন পুরুষ, স্ত্রীলোক আর জনাকয়েক বাচ্চা রয়েছে। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজন হবে সবসুদ্ধ। পরের নৌকাটাতেও প্রায় সমসংখ্যক লোক রয়েছে, তবে তারা সকলেই পুরুষ। দেখে মনে হল দ্বিতীয় নৌকাটা প্রথম নৌকটাকে তাড়া করেছে। থথও রয়েছে প্রথম নৌকাটাতে।
প্রথম নৌকাটা তীরে ভেড়ামাত্র নৌকার যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে পাড়ে নেমে পড়ল। বাচ্চা কোলে কয়েকজন স্ত্রীলোক লুকিয়ে পড়ল আশেপাশের ঝোপের আড়ালে। পুরুষেরা দাঁড়িয়ে রইল লড়াই দেবার জন্য। ওদের হাতে রয়েছে গদার মতো একরকমের লাঠি, পাথরের বর্শা আর বড়ো বড়ো পাথরের টুকরো। থথকেই ওদের নেতা বলে মনে হল।
যুদ্ধই বটে—দ্বিতীয় নৌকাটা পাড়ের কাছাকাছি আসতেই থথ আর তার সঙ্গীরা ওদের দিকে পাথর ছুড়তে শুরু করল। দ্বিতীয় নৌকার লোকগুলো জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে পাড়ে চলে এল। এরপর দু-পক্ষের মধ্যে শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড মারপিট। বড়ো বড়ো গদার মতো লাঠি হাতে লড়াই করছে দু-দলই। দ্বিতীয় দলের সর্দারটার বিরাট চেহারা। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, মুখে লাল-সাদা রঙ মাখানো। সারা গায়ে উল্কি আঁকা। থথরাই লড়াইতে জিতছিল, আচমকা দ্বিতীয় দলের একজনের ছোড়া একটা পাথর এসে লাগল থথের মাথায়। ও ঘুরে মাটিতে আছড়ে পড়ল।
এখানেই লড়াইটা ঘুরে গেল। থথকে পড়ে যেতে দেখে ওর দলের লোকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। কিন্তু কেউ পালাতে পারল না। দ্বিতীয় দলের লোকরা সকলকে পাকড়াও করে হাত-পা বেঁধে ফেলল। তারপর একদল লোক ছুটে গেল ঝোপগুলোর দিকে। ওখান থেকে স্ত্রীলোক আর বাচ্চাদের ধরে আনল ওরা। ততক্ষণে কয়েকজন কাঠকুটো জোগাড় করে আগুন জ্বালিয়ে ফেলেছে।
চোখের সামনে দৃশ্যটা দেখতে দেখতে যেন আগুন জ্বলে উঠল ঈশানের মাথায়। লাঠিটা চেপে ধরে সে লাফ দিয়ে ঝোপ থেকে বের হতে গেল। মার্শাল সাহেব ওকে টেনে ধরে বসিয়ে দিলেন। ইশারায় চুপ করে থাকতে বললেন। ওদিকে ততক্ষণে একজন লাঠির ঘায়ে থেঁতলে দিয়েছে এক বন্দির মাথা। লোকটা কয়েকবার ছটফট করেই এলিয়ে পড়ল। আগুনের উপরে মৃতদেহটাকে ফেলে দিল নরখাদকরা। ও-পাশ থেকে একটা চিৎকার শুনে ঈশান মুখ ফিরিয়ে দেখল কয়েকজন লোক দুজন স্ত্রীলোক আর একটা বাচ্চাকে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। একজন স্ত্রীলোকের বয়স বেশ কম। পুরু ঠোঁট, চ্যাপ্টা নাক, রঙ মোটামুটি ফরসা ধরনের। দেখে মনে হয় মেয়েটি এদের গোষ্ঠীভুক্ত নয়। একজন বাচ্চাটাকে মেয়েটির কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সমুদ্রের দিকে ছুড়ে ফেলে দিল। তারপর সেই অল্পবয়সি মেয়েটাকে টানতে টানতে নিয়ে এল ওদের সর্দারের কাছে। ভাবগতিক দেখে মনে হল মেয়ে দুটিকেও মেরে ফেলবার মতলব করেছে ওরা। চোখের সামনে এই নৃশংস হত্যালীলা ঈশান সহ্য করতে পারল না।
একটা লোক লাঠি উঁচিয়ে আঘাত করতে যাচ্ছে সেই অল্পবয়সি মেয়েটার মাথায়, ঝোপের মধ্যে থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল ঈশান। আচমকা পিছন দিক থেকে লাঠির একটা প্রচণ্ড আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল লোকটা। আর উঠল না।
লাফ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে হানাদার বাহিনীর সর্দারকে আক্রমণ করল ঈশান। লোকটা চট করে সরে গিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নিল। পালটা আক্রমণের জন্য লাঠি তুলল সে। ওই মোটা গদার মতো লাঠি মাথায় পড়লে আর রক্ষা নেই। ঠিক সময়ে মার্শাল সাহেবের হাতের বন্দুক গর্জে উঠল। সর্দারের হাত থেকে লাঠিটা ছিটকে পড়েছে। হানাদার জংলিদের মধ্যে একজন সাহেবের দিকে লাঠি নিয়ে তেড়ে গেল। বন্দুকের ক্ষমতার কোনও আন্দাজ ছিল না তার। ঠাক করে প্রচণ্ড একটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল লোকটা। এবার ওরা রণে ভঙ্গ দিল। সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের নৌকায় উঠে ভেসে পড়ল। কোন এক ফাঁকে সর্দার তির-ধনুক হাতে তুলে নিয়েছিল, নৌকায় চেপেই সাহবকে লক্ষ্য করে তির ছুড়ে দিয়েছিল। সরে গিয়েও সাহেব পুরোপুরি আত্মরক্ষা করতে পারলেন না, তিরটা পায়ে বিঁধে গেল।
পাঁচ
হানাদাররা পালিয়ে যেতে ঈশান থথ আর তার দলের লোকদের হাতের বাঁধন খুলে দিল। মার্শাল সাহেব নিজেই তিরটা পা থেকে টেনে বার করলেন। ক্ষতস্থান থেকে গলগল করে রক্ত বার হচ্ছে। আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকে কিছু পাতা এনে থথ সাহেবের ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিল। সাহেব তখন ভালো করে চলতে পারছেন না। থথ ঈশান আর সাহেবকে ওদের সঙ্গে যাবার জন্য ইশারা করল। রাজি না হয়ে ওদের কোনও উপায় ছিল না। গুহার ভিতরে সবকিছু ফেলে রেখে বন্দুক, গুলি, বারুদ আর কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সঙ্গে নিয়ে ওরা থথদের সঙ্গে নৌকায় চেপে বসল।
থথ ইশারায় বলল, ওদের লিম্বা উপজাতির লোকদের সঙ্গে কিচুয়াদের ভয়ানক শত্রুতা। ওরাই থথকে একা পেয়ে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। মার্শাল সাহেব ওকে বাঁচাবার পর যখন সে নিজের এলাকায় ফিরে যাচ্ছিল, তখন দেখে ওদের গোষ্ঠীর কিছু লোককে কিচুয়ারা তাড়া করেছে। যে অল্পবয়সি মেয়েটিকে ঈশান বাঁচিয়েছে, তার নাম সুরিয়া। থথের দাদা রুরু লিম্বা গোষ্ঠীর সর্দার। সুরিয়ার সঙ্গে কিছুদিনের মধ্যেই থথের বিয়ে হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঈশানরা থথদের দ্বীপে পৌঁছে গেল। লিম্বারাও পাহাড়ের গুহাতে বাস করে। তবে তারা নারকেল গাছের পাতার ছাউনি দিয়ে কয়েকটা ঝুপড়িও বানিয়েছে। মার্শাল সাহেবের অবস্থা ততক্ষণে সঙ্গিন। ওঁকে ধরাধরি করে একটা গুহাতে নিয়ে যাওয়া হল। একজন বয়স্ক লোক নানারকমের শিকড়বাকড় বেটে ওঁর ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলেন। থথের দাদা রুরু সুরিয়াকে বাঁচানোর ঘটনা শুনে ঈশান আর মার্শাল সাহেবের উপরে দারুণ খুশি। সবার নাকে নাক ঘষে কৃতজ্ঞতা জানানো হল।
দু-দিন গুহার মধ্যে মার্শাল সাহেবের চিকিৎসা চলার পরেও অবস্থার কোনও উন্নতি হল না। দিন দিন সাহেবের অবস্থা খারাপের দিকে যেতে লাগল। হতাশায় লিম্বা সর্দারকে ঘাড় নাড়তে দেখে ঈশান জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, মার্শাল সাহেবের পায়ে যে তির লেগেছে তাতে তীব্র বিষ মাখানো ছিল। ওই বিষ রক্তের সঙ্গে মিশে গেলে দু-তিনদিন পর থেকেই শরীরে পচন ধরতে শুরু করে। তারপর ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় হতভাগ্য মানুষ। বাউসার্ডের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হল না। হতাশা ঈশানেরও কম নয়। এই বিজন দ্বীপে যাও-বা একজন সভ্য মানষের দেখা পেয়েছিল, সেও মৃত্যুপথযাত্রী। সাহেব ঈশানকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন, কিন্তু আজ ঈশানের কিছুই করবার নেই।
বাউসার্ড সাহেব নিজেও ওঁর পরিণতির কথা বুঝতে পেরেছিলেন। একদিন ঈশানকে আক্ষেপ করে বললেন যে উনি দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন দেখতেন এই দ্বীপে আসবার। কুড়ি বছরের দীর্ঘ চেষ্টার পর এখানে পৌঁছতে পেরেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও ওঁর স্বপ্ন পরিণতি পেল না। দূরের একটা ত্রিভুজাকার পাহাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ওটাই সম্ভবত নেফেরের পিরামিড। কাঁপা হাতে শার্টের পকেট থেকে ভাঁজ-করা একটা কাগজ বের করে উনি ঈশানের হাতে দিয়ে বললেন, “এই ম্যাপেই আছে কুবেরের ঐশ্বর্যের ঠিকানা।”
একনাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলবার পর উনি রীতিমতো হাঁপাতে লাগলেন। ক্ষতস্থান আবার রক্তে ভিজে উঠছে।
ঈশান বলল, “একটু শান্ত হোন।”
উনি বললেন, “কোনও লাভ নেই। আর বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব না। সময় ঘনিয়ে আসছে। মৃত্যুকালে আপনি আমার পাশে থেকেছেন, তাই আপনাকেই দিয়ে যাচ্ছি ওই সম্পত্তির উত্তরাধিকার। অনেক কষ্ট করে সুদূর ফ্রান্স থেকে উড়ে এসেছিলাম ওই সম্পদ উদ্ধর করতে, কিন্তু শেষরক্ষা হল না।”
মার্শাল বাউসার্ড বেশিদিন বাঁচলেন না। চার-পাঁচদিন পর থেকেই আর কথা বলতে পারতেন না। কেবল তাকিয়ে থাকতেন দূরের ওই ত্রিভুজাকার পাহাড়ের দিকে। দু-চোখে কেবল নিঃসীম হতাশা। সাহেবের মৃত্যুর পর ঈশান ওঁর ইচ্ছানুসারে দেহটাকে গুহার বাইরের ফাঁকা চত্বরে সমাধিস্থ করল। দুটো কাঠের টুকরো দিয়ে একটা ক্রশ তৈরি করে সমাধির উপরে পুঁতে দেওয়া হল।
ছয়
মার্শাল বাউসার্ডের মৃত্যুর পর ঈশান থথদের সঙ্গেই থাকতে লাগল। একটা উঁচু গুহাতে ওরা ওকে থাকতে দিয়েছিল। গুহার ভিতর দিয়েই ঝরনার একটা ধারা বয়ে যাচ্ছে। গুহার সামনে দাঁড়ালে পুরো এলাকাটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। সভ্য দুনিয়ার চোখে হিংস্র নরখাদক অসভ্য মানুষ হলেও সরল আন্তরিক মানুষদের আতিথেয়তায় বেশ আরামেই ঈশানের দিন কাটছিল। ইতিমধ্যে ঈশানের সমবয়সি কয়েকজন ছেলের সঙ্গে ওর বেশ ভাব জমে গেছে। আকার-ইঙ্গিতে সে ওদের ভাষা বেশ খানিকটা রপ্ত করে ফেলেছে। পুরোহিত পর্যাস কিন্তু প্রথম থেকেই ঈশানকে বেশ সন্দেহের চোখে দেখত। ঈশানের জন্য লিম্বা সর্দারের কাছে ওর কদর কমে গিয়েছিল।
কোথায় কলকাতা আর কোথায় আফ্রিকার আদিগন্ত সমুদ্রের মধ্যে কয়েকটা ছোটো দ্বীপ। বাড়ির লোকজন, মা, বাবা, বন্ধুবান্ধবদের কথা ঈশানের প্রায়ই মনে পড়ে। সবাই নিশ্চয়ই ভেবেছে প্লেন অ্যাকসিডেন্টে ঈশানের মৃত্যু হয়েছে।
একটা লম্বা পাহাড় পাঁচিলের মতো দ্বীপটাকে আড়াআড়ি দু-ভাগে ভাগ করেছে। লিম্বা উপজাতির লোকরা নৌকায় চেপে সমুদ্রপথে দ্বীপের অন্য ধারে যায়। মাঝের পাহাড়টা ওদের কাছে নিষিদ্ধ এলাকা। কেবল প্রধান পুরোহিত পর্যাস যেতে পারে ওই পাহাড়ে। কী আছে ওখানে? জিজ্ঞাসা করাতে রীতিমতো ভয় পেয়ে থথ একদিন বলেছিল, ওখানে এক নিষিদ্ধ গুহা আছে। সেখানে অপদেবতাদের বাস। পাহাড়টার মাঝামাঝি একটা ত্রিভুজাকার চূড়া। মার্শাল বাউসার্ড ওটাকেই নেফেরের পিরামিড বলে দেখিয়েছিলেন। পাহাড়টা সম্পর্কে ঈশান দারুণ কৌতূহলী হয়ে পড়েছিল। কী আছে ওখানে যার আকর্ষণ সুদূর ফ্রান্স থেকে মার্শাল সাহেবকে টেনে এনেছিল এরকম দুঃসাহসী এক একক অভিযানে?
একদিন রাত্রে ঈশানরা এক ভয়ংকর ঘটনার সম্মুখীন হল যার জন্য ওরা আদৌ প্রস্তুত ছিল না। পূর্ণিমার আলোয় মাদলের বাজনার তালে তালে লিম্বাদের সব পুরুষ-নারী নাচছিল। থথ আর সুরিয়াও ওদের মধ্যে ছিল। আগামী পূর্ণচন্দ্রের দিন ওদের বিয়ে হবে। তারই বাগদান উৎসব চলছে। মাঝখানে আগুন জ্বালানো হয়েছে, সেখানে শিকার করে আনা হরিণের মাংস পোড়াচ্ছিল কয়েকজন। ঈশান একদিকে চুপচাপ বসে ছিল। বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। দিনের সব হিসাব ওর গুলিয়ে গেছে। বাউসার্ডের সঙ্গে দেখা হবার পর মনে আশা জেগেছিল যে সভ্য জগতে ফিরে যেতে পারবে। মাঝে মাঝে একটা বিষণ্ণতা বোধ ঈশানের মনে চেপে বসে।
হঠাৎ গুহা বস্তির একদিকে প্রবল চিৎকার আর আর্তনাদের শব্দে সকলে চমকে উঠল। ঈশান উঠে দাঁড়াতে যাবে এমন সময়ে সাঁ করে একটা বর্শা এসে ঠক করে ওর ডানদিকের পাথরে লেগে ছিটকে পড়ল। থথ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, ছুটে এসে উত্তেজিত গলায় ঈশানকে বলল, “কিচুয়ারা আক্রমণ করেছে!”
আকস্মিক আক্রমণের প্রথম হতচকিত ভাবটা কেটে যেতেই ঈশান ছুটে গুহার ভিতর থেকে বাউসার্ডের বন্দুকটা নিয়ে এল। বিদ্যালয়ে এন.সি.সি করার সময় ওর বন্দুক চালানোর কিছুটা তালিম ছিল। কিচুয়াদের আক্রমণের মুখে প্রাণ বাঁচতে গেলে সেটাই এখন ভরসা। শূন্যে তাক করে সে একটা গুলি ছুড়ে দিল। বন্দুকের প্রবল আওয়াজে সকলেই ওর দিকে ভয় আর সম্ভ্রমের চোখে ঘুরে তাকিয়েছে। বন্দুকের শক্তি যে কত ভয়ানক হতে পারে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা কিচুয়াদের ছিল। লড়াই থামিয়ে কিচুয়ারা পিছন ফিরে পালাতে শুরু করল।
ঈশান দেখল রুরু ওর দিকে ছুটে আসছে আর চেঁচিয়ে কিছু বলছে। ইশারায় ঈশানকে দেখাল একজন কিচুয়া সুরিয়াকে কাঁধে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। ঘন জঙ্গলে ঢুকে গেলে ওদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাহসে ভর করে ঈশান পলায়নরত কিচুয়াটার পায়ের দিকে বন্দুক তাক করল। ঠাক! বন্দুকের প্রচণ্ড আওয়াজে থথ আর রুরু দুজনেই ভয় পেয়ে ছিটকে সরে গেল ঈশানের পাশ থেকে। না, গুলি ফসকেছে। আবার তাক করে বন্দুক চালাল ঈশান। এবার আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। ছুটতে ছুটতে হুমড়ি খেয়ে লোকটা পড়ে গেল মাটিতে। কাঁধ থেকে ছিটকে পড়েই সুরিয়া কোমরে আটকানো ভোজালিটা বার করে মুহূর্তের মধ্যেই আহত লোকটার মুণ্ড ধড় থেকে আলাদা করে দিল।
সাত
কিচুয়াদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার পর থেকে থথদের কাছে ঈশানের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। ওর সাহায্যের প্রতিদান দেবার জন্য রুরুও খুব ব্যগ্র হয়ে পড়েছিল। ঈশান ওই ত্রিভুজাকার পাহাড়ে যেতে চায় শুনে প্রথমটায় ওরা ভীষণ ভয় পেয়েছিল। একমাত্র পুরোহিত পর্যাস ছাড়া ওখানে আর কেউ যেতে পারে না। ওদের বিশ্বাস, পুরোহিত ছাড়া অন্য যে-ই ওই পাহাড়ে পা দেবে তার উপরেই দেবতার অভিশাপ নেমে আসবে। আজ পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় কেউ ওই পাহাড় থেকে ফিরে আসতে পারেনি। এসব শুনেও ঈশান দমল না। মার্শাল বাউসার্ড কী কারণে ফ্রান্স থেকে ছুটে এসেছিলেন তা ঈশানকে জানতেই হবে। ভাগ্যচক্রে ঈশান যখন দ্বীপে এসে পড়েছে তখন শেষ না দেখে সে ফিরবে না।
ত্রিভুজাকার পাহাড়ে যেতে ঈশান বদ্ধপরিকর এটা বুঝে বাধ্য হয়ে ওরা মত দিল। ঠিক হল পুরোহিত পর্যাস ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। থথ কিছুতেই ঈশানের সঙ্গ ছাড়তে রাজি হল না। রুরু যাবে লিম্বা উপজাতির সর্দার হিসাবে। ঈশান ওদের অতিথি, ওর যাতে কোনও ক্ষতি না হয় সেটা দেখা সর্দারের দায়িত্ব।
একদিন খুব ভোরবেলায় ওরা চারজন রওনা হল। তখনও রাতের অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি। ঘণ্টা খানেক পাহাড়ে চড়বার পর ওরা পৌঁছল ত্রিভুজাকার পাহাড়ের পাদদেশে। একটা সরু আঁকাবাঁকা পায়েচলা পথ পাহাড়ের উপর পর্যন্ত চলে গেছে। ধীরে ধীরে ওরা উপরে উঠতে লাগল। পথ গিয়ে শেষ হয়েছে একটা গুহামুখের সামনে। গুহার মুখে প্রাচীন মিশরীয় দেবতা অনুবিসের পাথুরে মূর্তি। হাজার হাজার বছরের পুরানো সেই পাথুরে মূর্তি দেখে ঈশান বুঝতে পারল যে এই গুহাতে প্রাচীন মিশরীয়দের আনাগোনা ছিল। একটা অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করছিল ঈশান। তবে কি বাউসার্ডের ধারণাই ঠিক? প্রাচীন মিশরীয় ফারাও নেফেরের এই পিরামিড তৈরি করেছিলেন?
লিম্বাদের কাছে অনুবিস মৃত্যুর দেবতা। অনুবিসের ভয়ানক মূর্তি দেখে থথ আর রুরু দুজনেই ভয় পেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। আতঙ্কে ওদের মুখ পাণ্ডুর।
ঈশান বলল, “পর্যাস, এবারে আমাদের ভিতরে নিয়ে চলো।”
“গুহার ভিতরে ঢুকতে কেউ ভয় পাবে না তো?” ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল পর্যাস।
রুরুকে বাইরে পাহারায় রেখে, একটা মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে থথ আর ঈশান পর্যাসের সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করল।
পর্যাস পথ দেখিয়ে আগে আগে চলেছে। মশালের আলোয় পথ দেখে ঈশান আর থথ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল। প্রায় পঞ্চাশ গজ সেই অন্ধকার সুঁড়িপথ দিয়ে এগোবার পর ওরা একটু থামল। ছাদের দিকের একটা ফাটলের ভিতর দিয়ে একচিলতে আলো ভিতরে আসছে। সেই আলোছায়ার রহস্যময় পরিবেশে ঈশান দেখল, বেশ বড়ো বড়ো কয়েকটা থাম উপরে গোলাকার ছাদটাকে ধরে রেখেছে। থামগুলোর গায়ে বিভিন্ন প্রাচীন মিশরীয় দেবদেবীর ছবি আঁকা।
গুহাটা এখানে বেশ প্রশস্ত। পর্যাসের পিছু পিছু থথ আর ঈশান এগিয়ে চলল। গুহার দেওয়ালের একজায়গায় দাঁড়িয়ে গেল পর্যাস। সামনে আর এগোনো উপায় নেই, নিরেট পাথরের দেওয়াল।
ফিসফিস করে পর্যাস বলল, “মৃত্যুগুহার ভিতরে ঢুকবে নাকি?”
দৃঢ় স্বরে ঈশান বলল, “নিশ্চয়ই।”
“ভয় পাবে না তো?” বলে থথের দিকে তাকাল পর্যাস।
থথ একটু ইতস্তত করছিল। ওর দোনোমনা ভাবটাকে কোনোরকম পাত্তা না দিয়ে ঈশান বলল, “এতদূর এলাম এই পাথরের বন্ধ দরজার সামনে থেকে ফিরে যাবার জন্য নয়।”
প্রায় নিভু নিভু মশালটাকে ঈশান যখন উসকে দিতে ব্যস্ত, সেই সুযোগে গুহার পাথরের দেওয়ালের একপাশের ঝুঁকে পড়ল পর্যাস। একটা গর্তের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা নাড়াচাড়া করতে গুড়গুড় করে একটা শব্দ হতে শুরু করল। চমকে থথ আর ঈশান কয়েক পা পিছিয়ে এল। আশ্চর্য হয়ে ওরা দেখল, পাথরের দেওয়াল ধীরে ধীরে উপর দিকে উঠে যাচ্ছে। কম করে কুড়ি থেকে ত্রিশ টন ওজনের সেই বিশাল পাথর কেমন তেল দেওয়া যন্ত্রের মতো আশ্চর্য মসৃণতায় উপরে উঠে যাচ্ছে। প্রাচীন মিশরের উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার নিদর্শন।
দারুণ উত্তেজনায় ঈশান থরথর করে কাঁপতে লাগল। বাউসার্ডের অনুমান যদি নির্ভুল হয় তবে সাহুরার পুত্র নেফেরের সমাধিগৃহের দ্বার এখন ওদের সামনে। পাহাড় খোদাই করে বানানো হয়েছে নেফেরের পিরামিড।
গুহার ভিতরটা বেশ প্রশস্ত। মাঝখানে রয়েছে একটা বিরাট কাঠের কফিন। সম্ভবত ওর মধ্যেই আছে নেফেরের মমিকৃত দেহ। একদিকে দেওয়ালে কতকগুলো বিশালাকার ক্যানেপিক বয়াম। মশালের আলোয় ঝলমল করছে তাদের সোনার দেহ। অন্যদিকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে প্রাচীন মিশরীয় যোদ্ধাদের প্রতিরূপ। কী জীবন্ত! এখনই যেন নড়ে উঠবে।
পর্যাস বলল, “যদি উজ্জ্বল পাথর চান তবে গুহার ভিতরের ওই অন্ধকার কোণটা দেখুন।”
পর্যাসের নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে ঈশান দেখল তিনটে কালো পাথরের সিন্দুক। একটা সিন্দুকের ডালা ঈষৎ সরানো। সরানো ঢাকনার ফাঁক দিয়ে সিন্দুকের ভিতরে তাকাতে ঈশানের চোখ ঝলসে গেল। হিরে-চুনি-পান্নায় সিন্দুকটা ভরতি। মশালের আলোয় ঝলমল করে উঠল বহুযুগের প্রাচীন রত্নভাণ্ডার। এত রত্ন!
থথ আর ঈশান সিন্দুকগুলো দেখতে এগিয়ে কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। পর্যাসের আচার-আচরণ প্রথম থেকেই ঈশানের সন্দেহজনক ঠেকেছিল। এতক্ষণ কড়া নজরে রেখেছিল পর্যাসকে। কিন্তু সিন্দুকের মধ্যেকার রত্নভাণ্ডার ওদের মনোযোগ কিছুক্ষণের জন্য টেনে নিয়েছিল। আর সেটাই হল মারাত্মক ভুল। পর্যাস কখন নিঃশব্দে বেরিয়ে গেছে গুহার ভিতর থেকে।
হঠাৎ থথের আর্ত চিৎকার ভেসে এল—“তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এসো, পাথর নেমে আসছে।”
ঈশান তাকিয়ে দেখল রত্নভাণ্ডারের মুখে থথ আর পর্যাস ধস্তাধস্তি করছে। যখন পাথরের চাঁইটা মেঝে থেকে আর মাত্র ফুট তিনেক উঁচুতে তখন পর্যাস গুহার মেঝের উপরে শুয়ে পড়ে সাপের মতো এঁকে-বেঁকে বাইরে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করল। কিন্তু না, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। ভারী পাথরের চাঁইটা এসে পড়ল ওর শুকনো দেহের উপরে। মড়মড় করে হাড় ভাঙার শব্দ চাপা দিয়ে দিল পর্যাসের মরণ আর্তনাদ। বিরাট দরজাটার চাপে পর্যাসের দেহটা পিষে শেষ হয়ে গেল।
ঈশান দেখল থথের অবস্থাও শোচনীয়। পর্যাস থথকে ছুরি মেরেছে, ওর সারা দেহ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। রত্নগুহায় অন্যদের প্রবেশ পর্যাসকে প্রতিহিংসা পরায়ণ করে তুলেছিল, তারই পরিণতি এই খুনোখুনি।
ঈশান থথের মাথাটা ওর কোলের উপরে তুলে নিল। এক অসহনীয় কষ্ট ওর বুকের কাছে দলা পাকিয়ে আছে। ক’দিনের এই বন্য জীবনে ঈশান থথকে ভালোবেসে ফেলেছিল। কোমরে বাঁধা কাপড়ের থলিটা থেকে ঈশান ওর মুখে একটু জল দিল।
“ঈশান, আমি আর বেশিক্ষণ বাঁচব না। চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। অন্ধকার! চারদিকে শুধুই অন্ধকার।”
থথের অবস্থা দেখে ঈশান নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। মাত্র ক’দিনের পরিচয়েও হৃদয়ের যোগাযোগ যে কত গভীর হতে পারে, ঈশান তা টের পেল। কয়েকবার কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল থথের দেহটা।
থথ মারা যেতে ঈশান নিজের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হল। বাইরে বের হবার কোনও আশা নেই। ভারী পাথরের দরজা খোলবার কোনও কৌশল ওর জানা নেই। পর্যাস নিজে মরল, ওদেরও মৃত্যুর মুখে রেখে গেল।
প্রচণ্ড একটা আতঙ্কে ঈশানের সমস্ত সত্ত্বা যেন ক্রমশ ডুবে যেতে লাগল। অন্ধকার গুহার মধ্যে ওর যেন জীবন্ত সমাধি হয়েছে। চারপাশে কত সম্পদ, কিন্তু এই সমস্ত সম্পদ ঈশান এখুনি ছেড়ে দিতে পারে কেবল বাইরে যাবার বিনিময়ে। সঙ্গের মশাল নিভু নিভু। এখনই চারদিক নিরন্ধ্র অন্ধকারে ডুবে যাবে। বেশ কয়েকবার সে জোরে জোরে চিৎকার করল। ক্ষীণ আশা, যদি গুহার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রুরু শুনতে পায়। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। অন্ধকারের মধ্যেই বোধ হয় একটা গোটা দিন কেটে গেল। সঙ্গে যেটুকু খাবার আর জল ছিল তাই খেয়ে কেটে গেল। ভয়ে, আতঙ্কে যখন ওর সমস্ত চেতনা ক্রমশ লুপ্ত হয়ে আসছে, তখনই একটা চিন্তা ওর মাথায় এল। এটা কীরকম হল? গুহার ভিতরের বাতাস তো বদ্ধ নয়। বেশ টাটকা তাজা বাতাস রয়েছে গুহার ভিতরে। এই বাতাস বন্ধ দরজার দিক থেকে আসতে পারে না। বাতাস আসছে অন্য কোনও দিক থেকে। একটা ক্ষীণ বাঁচার আশা ওর মধ্যে জেগে উঠল।
গুহার পাথরের দেওয়াল হাতড়ে বেড়াতে লাগল ঈশান। কোথা থেকে আসছে ঠান্ডা বাতাস? অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর একজায়গায় হাত রাখতে পেল মৃদু ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ। না, কোনও ভুল নেই, সেখানে মেঝেটাও ফাঁপা। মেঝের উপরে অন্ধের মতো হাত বোলাতে বোলাতে একটা ধাতব আংটার স্পর্শ পেল সে। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে আংটাটা মেঝেতে শক্ত হয়ে চেপে বসে আছে। ছুরি দিয়ে ঈশান আস্তে আস্তে আংটার চারপাশটা ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁচিয়ে পরিষ্কার করল। বেশ কিছুক্ষণ কসরত করার পর ওটার সঙ্গে লাগানো বড়ো একখানা চ্যাপ্টা পাথর উঠে এল। সেখান দিয়ে আসছে তাজা ঠান্ডা বাতাস। বুক ভরে নিশ্বাস নিল ঈশান। এই যাত্রায় আবার ঈশান অলৌকিকভাবে বেঁচে গেল।
একটা পাথরের সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে। ঈশান এক পা এক পা করে নীচে নামতে থাকে। পাথরের সিঁড়ি শেষ হয়েছে একটা সুড়ঙ্গের মুখে। অন্ধকারে আন্দাজে ভর করে ঈশান সুড়ঙ্গপথে এঁকে-বেঁকে এগিয়ে চলল। খানিকটা দূরে গিয়ে সুড়ঙ্গ দু-ভাগে ভাগ হয়ে আরও এগিয়ে গেছে। বাতাসের গতি অনুভব করে ঈশান এগোতে থাকে। কিছুটা এগোবার পর নিস্তব্ধ সুড়ঙ্গের ভিতরে মৃদু শব্দ পাওয়া গেল। জলস্রোতের কলকল আওয়াজ। শব্দ লক্ষ্য করে ঈশান চলতে লাগল। আচমকা পায়ের নীচে থেকে জমি হারিয়ে গেল, আর ঈশানের শরীরটা শূন্যে ছিটকে গেল। মাথায় কীসের আঘাত লাগল। ব্যস, আর কিছু মনে নেই।
শেষ
যখন জ্ঞান ফিরল, ঈশান দেখল রুরু আর সুরিয়া উদ্বিগ্ন মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সারা শরীরে একটা আড়ষ্ট ভাব। নদীতে ভেসে যেতে দেখে রুরু ওকে তুলে এনেছে। অভিযানের কথা শুনে রুরু পর্যাসের উপরে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিল। কিন্তু পর্যাস এখন সবকিছুর বাইরে। সুরিয়া বলল, “পর্যাসের মৃত্যু হওয়ায় লিম্বারা একটা অভিশাপ থেকে মুক্ত হল।”
থথের মৃত্যুসংবাদে সকলের মধ্যে বিষাদ নেমে এল।
কয়েকদিন পর ঈশান লিম্বা সর্দারের কাছে বিদায় চাইল। রুরু অশ্রুসজল চোখে বলল, “কেন তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে? আমরা কী অপরাধ করেছি?”
রুরুকে অনেক করে বোঝাল ঈশান। দেশের জন্য, আত্মীয়স্বজন, বাবা-মায়ের জন্য ওর মনখারাপ করছে।
ওদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া ছিল কুবই কষ্টকর। হিংস্র নরখাদক হলেও মানুষ হিসাবে ওরা কত দরদী। এক সম্পূর্ণ অন্য পৃথিবী থেকে আসা অজানা-অচেনা মানুষকে যে এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বন্ধনে জড়ানো যায়, তার তুলনা বোধ হয় সভ্য জগতে বিরল।
একদিন সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাউসার্ডের লঞ্চে চেপে বসল ঈশান। তারপর দু-দিন দু-রাত ক্রমাগত ভেসে চলল এক অনির্দিষ্ট পথে। চারদিকে সীমাহীন সমুদ্রের নীল জলরাশি। ছোট্ট লঞ্চটা কাগজের নৌকার মতো টলমল করতে করতে স্রোতের টানে ভেসে চলেছে।
তৃতীয় দিন সকালে দূরে একটা কালো বিন্দু দেখা গেল। প্রথমটাতে ওটাকে জাহাজ বলে ঈশান বুঝতে পারেনি। তারপর কিছুক্ষণ বাদে বুঝতে পারল সত্যই একখানা জাহাজ দক্ষিণ-পূর্বদিক থেকে ভেসে আসছে।
জাহাজে ঈশানের পরিচয় পেয়ে আর ওর আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা শুনে সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। নেফেরের পিরামিড আর রত্নভাণ্ডারের কথা কিন্তু ঈশান চেপে গেল। মিশরের পঞ্চম রাজবংশের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ফারাও সাহুরার প্রিয় পুত্র নেফেরের পিরামিড থাক না লোকচক্ষুর অন্তরালে, আদিম সরল মানুষগুলোর তত্ত্বাবধানে। সভ্য জগতের লোভী হাত কেবল পিরামিড কলুষিত করে নেফেরের পুত্রের আত্মার শান্তিভঙ্গই করবে না, লুণ্ঠন করবে তার সমস্ত রত্নভাণ্ডার। শুধু তাই নয়, অতিষ্ঠ করে তুলবে সরল বন্য মানুষগুলোর জীবন। ঈশান পকেটে করে কয়েকটা হীরা, চুনি, পান্না নিয়েছিল ওর আশ্চর্য অভিযানের স্মারক হিসাবে। জীবনদানকারী সমুদ্র দেবতাকে প্রণাম করে সেগুলোই ছুড়ে দিল প্রণামী হিসাবে।
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু
দু-হাজার তিনশো বছর আগে পাটলিপুত্র থেকে তক্ষশিলা পর্যন্ত বাণিজ্যদলের সংঘাতবহুল রোমাঞ্চকর যাত্রাপথ শেষে এক তরুণ পৌঁছল তক্ষশিলায়। সেই নগরীর রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন উত্তাল। একদিকে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার, অন্যদিকে আচার্য কৌটিল্যের অখণ্ড ভারতের স্বপ্নে মশগুল একদল যোদ্ধা। অসংখ্য চরিত্রের ঘনঘটা, ষড়যন্ত্র, কাপুরুষতা আর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে কিছু মানুষের আত্মমর্যাদা আর স্বাধীনতা রক্ষার সাহসী সংগ্রামের আখ্যান এই উপন্যাস।
বিশেষ মুহূর্তে মন্ত্রের মাধ্যমে উচ্চারিত নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের ধ্বনি, তরঙ্গের আকারে যে-কোনো প্রাণীর মস্তিষ্ককে জড়বস্তুতে পরিণত করতে পারে, তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা থেকে মস্তিষ্কের মধ্যে রক্তক্ষরণ বা দুরারোগ্য ব্যাধির মাধ্যমে তাকে হত্যা করা, দীর্ঘ সময়ের জন্য নিজের শরীরের বার্ধক্যজনিত পরিবর্তনগুলিকে আটকে দেওয়া, ভবিষ্যৎ দর্শন, এ সবই সম্ভব। শুরু হয়েছে সেই আদিম তন্ত্রের দেবতা 'কাবাক্রব্যাদ'কে জাগিয়ে তোলার খেলা। কে জিতবে সেই খেলায়? আদিম তন্ত্রগুরু, না আধুনিক বিজ্ঞান? একটি ছোট্ট মেয়ে কীভাবে হয়ে উঠল সেই যজ্ঞের আহুতি?
মানস সরোবরে যাওয়ার জন্য লিপুলা-পাস পেরিয়ে তিব্বতে প্রবেশ করলে প্রায় সবুজ বিহীন বিস্তীর্ণ রুক্ষ প্রান্তর পড়ে, যেটার গড় উচ্চতা প্রায় ১৪ হাজার ফিট। সেখান থেকে মানসের হ্রদ প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার উত্তরে। তার বাঁয়ে আছে 'ভয়াল রাক্ষসতাল'। স্থানীয় যাযাবরদের মতে রাক্ষসতালের নীচে থাকে সিরিঞ্জুরা। কারা এরা? এখনও কোনো প্রাণী বিজ্ঞানী নাকি এদের সনাক্ত করতে পারেননি। যারা নিজের চোখে দেখেছে, বেঁচে ফেরেনি। কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। অনেকে বলেন মানুষের অনেক আগে পৃথিবীর বাইরে থেকে এসেছে এরা। কিন্তু তারা কি এখনও আছে?