প্রবন্ধ
15% OFF * FREE SHIPPING
প্রবন্ধ
কাশীপুরের রাজকন্যা ভদ্রেশ্বরীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু ভদ্রেশ্বরীর বর বিয়ে করতে আসার পথে ডাকাতদের কবলে পড়ে মারা যান। সেই শোকে ভাদু আত্মঘাতী হন।
সুদীপ ঘোষাল
‘ভাদু ওগো কী যুগ এল,
মাস্ক পরে নাচতে হল।’
কেতুগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে ভরা ভাদরে দূর থেকে ভেসে আসছে ভাদুগানের সুর। ছুটে গিয়ে দেখলাম জ্যোৎস্না রঙের শাড়ি জড়ানো বালিকা ভাদু বসে আছে। আর একটি পুরুষ, মেয়ের সাজে ঘুরে ঘুরে কোমর নাচিয়ে গান করছে—‘ভাদু আমার ছোটো ছেলে, কাপড় পরতে জানে না।’ অবাক হয়ে অসংখ্য অপু-দুর্গার বিস্মিত চোখ গিলে খায় এই নাচের দৃশ্য। এর পরে ঝাপানের সময় ঝাঁপি থেকে ফণা তোলা সাপ নাচিয়ে যায় চিরকালের চেনা সুরে স্বপনদাদা। স্বপনদাদা ঝাপান এলেই সাপ গলায় জড়িয়ে গান ধরে—‘আলে আলে যায় রে কেলে, জলকে করে ঘোলা। কী ক্ষণে কালীনাগ বাসরেতে ঢোকে রে, লখিন্দরের বিধি হল বাম।’
আমাদের এই গ্রাম্য সভ্যতার সুর ধরে চলে সুখদুঃখের বাঁকা নদী। ভাদু উৎসব ভাদ্র মাসের উৎসব। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিনে ভাদু পুজো হয়ে থাকে। ব্রতের ক্ষেত্রে ভাদ্র মাসের প্রারম্ভেই শুরু হয় মেয়েলি ব্রত। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এবং লাগোয়া বিহার, ঝাড়খণ্ডের দু-একটা জেলায় প্রধানত ভাদু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
আদিবাসী, সাঁওতালদের মধ্যে করম গান ও উৎসবে পালন করার রীতি রয়েছে বর্ষাকালে। তাও বিশেষভাবে ভাদ্র মাসে। কথিত আছে যে পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহদেবের কন্যা ছিলেন ভদ্রেশ্বরী। সেখান থেকেই ভাদ্রেশ্বরী। তা থেকেই ভাদু। লোকমুখে প্রচলিত গল্পটা এমনই—
কাশীপুরের রাজকন্যা ভদ্রেশ্বরীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু ভদ্রেশ্বরীর বর বিয়ে করতে আসার পথে ডাকাতদের কবলে পড়ে মারা যান। সেই শোকে ভাদু আত্মঘাতী হন।
ভাদুর স্মৃতিকে ধরে রাখতেই কাশীপুরের রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় রাজ্যবাসী এই ভাদু পুজো শুরু করেন। আবার কেউ বলেন, ভাদ্র মাসে পঞ্চকোট ও ছাতনার রাজার মধ্যে যুদ্ধে পঞ্চকোটের রাজা বিজয়ী হন। সেই স্মৃতিতেই এই গান ও উৎসবের শুরু। সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজদরবারে হারমোনিয়াম, পাখোয়াজ, তবলা, সানাই সহযোগে মার্গধর্মী উচ্চ সাহিত্যগুণ নির্ভর একধরনের ভাদু গাওয়া হত হয়। এই পরিবারের ধ্রুবেশ্বরলাল সিংদেও, প্রকৃতীশ্বরলাল সিংদেও এবং রাজেন্দ্রনারায়ণ সিংদেও দরবারি ভাদু নামক এই ঘরানার সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু অন্যান্য সকল ভাদু গীত লৌকিক সংগীত হিসেবেই জনপ্রিয় হয়েছে। লিখিত সাহিত্য না হওয়ায় এই গান লোকমুখেই প্রচারিত হয়ে এসেছে।
বিপরীতে ভাদু গানগুলিতে প্রেম এবং রাজনীতি সর্বতোভাবে বর্জিত। সাধারণত গৃহনারীদের জীবনের কাহিনি এই গানগুলির মূল উপজীব্য। পৌরাণিক ও সামাজিক ভাদু গানগুলি বিভিন্ন পাঁচালির সুরে গীত হয়। সাধারণত প্রেম পৌরাণিক গানগুলির এবং বারোমাস্যার কাহিনি সামাজিক গানগুলির বিষয় হয়ে থাকে। এছাড়া চার লাইনের ছড়া বা চুটকি জাতীয় ভাদু গানও বর্তমানে সামাজিক সচেতনামূলক প্রচারের জন্য গাওয়া হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ও বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমা এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচি ও হাজারিবাগ জেলার লৌকিক উৎসব। ভাদু উৎসব নিয়ে মানভূম অঞ্চলে বেশ কিছু লোককাহিনি প্রচলিত রয়েছে।
বীরভূম জেলায় ভদ্রাবতীকে হেতমপুরের রাজার কন্যা হিসেবেও কল্পনা করা হয়েছে। এই জেলায় প্রচলিত রয়েছে যে, ভদ্রাবতীর সঙ্গে বিবাহ স্থির হওয়ার পর ইলামবাজারের নিকটে অবস্থিত চৌপারির শালবনে ডাকাতদের আক্রমণে বর্ধমানের রাজপুত্রের মৃত্যু হলে ভদ্রাবতী তাঁর সঙ্গে সহমরণে যান।
পয়লা ভাদ্র কুমারী মেয়েরা গ্রামের কোনও বাড়ির কুলুঙ্গি বা প্রকোষ্ঠ পরিষ্কার করে ভাদু প্রতিষ্ঠা করেন। একটি পাত্রে ফুল রেখে ভাদুর বিমূর্ত রূপ কল্পনা করে তাঁরা সমবেত কণ্ঠে ভাদু গীত গেয়ে থাকেন।
ভাদ্র সংক্রান্তির সাতদিন আগে ভাদুর মূর্তি ঘরে নিয়ে আসা হয়। ভাদ্র সংক্রান্তির পূর্ব রাত্রকে ভাদুর জাগরণ পালিত হয়ে থাকে। এই রাত্রে রঙিন কাপড় বা কাগজের ঘর তৈরি করে এই মূর্তি স্থাপন করে তার সামনে মিষ্টান্ন সাজিয়ে রাখা হয়। এরপর রাত নয়টা বা দশটা থেকে ভাদু গীত গাওয়া হয়। কুমারী ও বিবাহিত মহিলারা গ্রামের প্রতিটি মঞ্চে গেলে তাঁদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় ও তাঁরা এইসব মঞ্চে ভাদু গীত পরিবেশন করে থাকেন। ভাদ্র সংক্রান্তির সকালে বা বিকালে দলবদ্ধভাবে মহিলারা ভাদু মূর্তির বিসর্জন করেন।
ভাদুর কোনও মূর্ত রূপ ছিল না। একটি পাত্রে ফুল রেখে বা গোবরের ওপর ধান ছড়িয়ে ভাদুর রূপ কল্পনা করে উৎসব পালন করা হত। পরবর্তীকালে বিভিন্নরকমের মূর্তির প্রচলন হয়েছে। মূর্তিগুলি সাধারণত হংস বা ময়ূরবাহিনী বা পদ্মের ওপর উপবিষ্টা। গায়ের রঙ হলুদ, মাথায় মুকুট, হাতে পদ্মফুক, গলায় পদ্মের মালা ও হাতের তলায় আলপনা থাকে। কখনও মূর্তির কোলে কৃষ্ণ বা রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি থাকে।
টুসু ও ঝুমুর গানের বিপরীতে ভাদু গানগুলিতে প্রেম এবং রাজনীতি সর্বোতভাবে বর্জিত। সাধারণত গৃহনারীদের জীবনের কাহিনি এই গানগুলির মূল উপজীব্য। পৌরাণিক ও সামাজিক ভাদু গানগুলি বিভিন্ন পাঁচালির সুরে গীত হয়। সাধারণত রামায়ণ, মহাভারত ও কৃষ্ণ-রাধার প্রেম পৌরাণিক গানগুলির এবং বারোমাস্যার কাহিনি সামাজিক গানগুলির বিষয় হয়ে থাকে। এছাড়া চার লাইনের ছড়া বা চুটকি জাতীয় ভাদু গানগুলিতে সমাজ জীবনের বিভিন্ন অসঙ্গতির চিত্র সরস ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তোলা হয়।
ভাদু উৎসবের তাৎপর্যই হল গানের সঙ্গে একটি ছোটো ছেলে বা মেয়ে ভাদু সেজে কোমরে ভাদুর পুতুল নিয়ে নাচে। সঙ্গে ঢোল, পাখোয়াজ, খঞ্জনি, হারমোনামের কোরাস গানে পরিবেশিত হয় ভাদু গান—‘ভাদু আমার ছোটো ছেলে, কাপড় পরতে জানে না।’
ভাদুর গান আসলে সমজের তৃণমূল স্তরের মেয়েদের মুখের কথা। গানের কথায় বোঝা যা তাদের সমাজ চেতনা। যেমন, ভাদু কাপড় ছেড়ে জিনস পরে, শাড়ি পরতে চায় না। ভাদুর এখন মাথায় ঘোমটা থাকে না।
অন্যান্য অঞ্চলের পালিত উৎসব থেকে বীরভূম জেলার ভাদু উৎসবের বৈশিষ্ট্য বহুলাংশে পৃথক। পয়লা ভাদ্র গ্রামের একজন ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে তার কোলে মাটির তৈরি ভাদু মূর্তি দিয়ে পুরুষদের একটি দল ভাদু গান গেয়ে ও নাচ করে বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে অর্থ আদায় করে। ভাদ্র সংক্রান্তিতে ভাদুর জাগরণ পালিত হয়। এই রাতে একটি জায়গাকে সজ্জিত করে ভাদু মূর্তি স্থাপন করা হয়। পরের দিন সকালবেলায় মূল গায়েনকে অনুসরণে পুরুষদের দল ঢোল, হারমোনিয়াম, তবলা, কাঁসি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে ভাদু গীত গাইতে গাইতে মূর্তি বিসর্জন করে। এই জেলায় মহিলারা এই গানে অংশগ্রহণ করেন না।
ভাদু শিল্পীদের মতে—‘ভাদু গান বর্তমানে পুরুলিয়া, বর্ধমান, বীরভূমের উল্লেখযোগ্য লোকগান। এই কৃষি উৎসবটি একদিন ভাদ্রের অভাবকে প্রতিহত করেছিল বাংলার লোকশিল্পীদের। তবে আজ তা আর নাই।’ আবেগ রুদ্ধ কথা দিয়েও আজ আর লেখা হয় না গান। তবে বর্তমান সরকার এঁদের দিয়ে কন্যাশ্রী, যুবশ্রীর গান বাঁধিয়ে প্রকল্পগুলি সফল করার চেষ্টা করছে। নিজ গ্রামে বা পার্শ্ববর্তী শহরে এসে বাড়ি বাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি ঘুরে ঘুরে গান শুনিয়ে কিছু অর্থ সংগ্রহও করেন।
লেখকের অন্যান্য লেখা
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু