ছোটো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
ছোটো গল্প
কানা মামা মোটেও ভালো নয়। কানা মামা, বোবা মামা, ভাগনেকে যে মামা পাত্তা দেয় না—কোনও মামাই ভালো নয়। তুমি শূন্য গোয়ালই রাখো। দুষ্টু মামার চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।
তাপস মৌলিক
গজুমামার সঙ্গে আমার আড়ি হয়ে গেছে। মামাই আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করেছে, আমি করিনি। অথচ প্রথমে আমারই কথা বন্ধ করা উচিত ছিল। কেন বলছি? পুরো ঘটনাটা বললেই সবাই বুঝবে কেন!
গজুমামা থাকে দিল্লিতে। মামা কিন্তু হেঁজিপেঁজি লোক নয়। এককালে বড়ো বড়ো মন্ত্রীর সঙ্গে লাঞ্চ করত। হাই-কোর্ট না সুপ্রিম কোর্ট কোথাকার যেন জজ ছিল। যাকে-তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে পারত, দল-কে-দল ধরে জেলে পুরে দিতে পারত, নেহাত মনটা ভালো তাই করত না। বছর কয়েক আগে হঠাৎ মামা চাকরি ছেড়ে দিল। বলল, ‘দুত্তোর, সারাদিন খালি খুনে-ডাকাত আর চোরছ্যাঁচড়দের গুষ্টির পিণ্ডি চটকানো।’ এখন মামা বাড়িতেই থাকে, লম্বা লম্বা দাড়ি আর গোলগাল একখানা ভুঁড়ি রেখেছে; সারাদিন পড়াশুনো করে আর মোটা মোটা জ্ঞানের বই লেখে।
যাই হোক, আপাতত মামা কলকাতায়, আমাদের বাড়ি। লক্ষ্মীপুজোর পর মামা আসছে শুনে পুজোর আগে থেকেই আমার আর তর সইছিল না। দু-একদিনের জন্য নয়, একেবারে কালীপুজো কাটিয়ে মা’র কাছে ভাইফোঁটা নিয়ে তবে ফিরবে মামা, মানে প্রায় দু-সপ্তাহ। পুজোর মধ্যে ঠাকুর দেখতে-দেখতেও তাই মনে মনে সারাক্ষণ ভেবেছি, মামা এলে এই করব, ওই করব। কিন্তু প্রায় দিন সাতেক হতে চলল এসেছে মামা, সে-সবের কিছুই এখনও হয়ে উঠল না। কী এক ছাতার মাথা বই লিখছে মামা—‘যুক্তিতর্কের আলোয় বাংলার প্রবাদ প্রবচন’। তাই নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যস্ত। প্রায় দিনই হয় ন্যাশনাল লাইব্রেরি ছুটছে, নয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে আসছে। বাড়িতে যেটুকু থাকছে, সে-সময়ও সারাক্ষণ কতগুলো মোটা মোটা বই থেকে একটা জাবদা খাতায় কীসব টুকে চলেছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে হয় ‘অ্যাঁ’ ‘উঁ’ ছাড়া রা-ই কাড়ছে না, নয় কোনও না কোনও প্রবাদ প্রবচন নিয়ে উদ্ভট সব কথাবার্তা বলছে।
“দ্যাখো কাণ্ড! এখানে বলছে ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’, আবার আর একটা প্রবাদ হল ‘দুষ্ট গোরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’। দুটোর মানে যে পুরো উলটো! বইয়ে কোনটা রাখি বল তো ভাগনে?”
“কানা মামা মোটেও ভালো নয়। কানা মামা, বোবা মামা, ভাগনেকে যে মামা পাত্তা দেয় না—কোনও মামাই ভালো নয়। তুমি শূন্য গোয়ালই রাখো। দুষ্টু মামার চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।”
বইপত্র থেকে চোখ তোলে মামা।—“হুম, খুব খেপে আছিস দেখছি আমার ওপর!”
“খেপব না তো কী! সাতদিন হল এসেছ, সারাদিন ওইসব বিদঘুটে প্রবাদ নিয়েই পড়ে আছ! কোথাও নিয়েই গেলে না। গরমের ছুটির সময় যে বলেছিলে পুজোর পর এসে আমায় সাঁতার শিখিয়ে দেবে, তার কী হল? কতদিন ধরে বসে আছি তুমি এলে সাঁতার শিখব!”
“সাঁতার শিখবি তো বেশি বেশি করে জল খা। ‘জল না খেলে সাঁতার শেখা যায় না’—প্রবাদ আছে একটা।”
বোঝো! “সে তো জলে নেমে হাবুডুবু খেয়ে জল খাওয়ার কথা বলছে! এমনি গ্লাসে করে জল খেলেই কি সাঁতার শেখা যাবে নাকি?”
“কই, এখানে তো জলে নামার কথা বলেনি! আর জল খেলেই সাঁতার শেখা যায় তাও বলেনি, বলছে না খেলে শেখা যায় না। ঠিকই তো! এমন কোনও সাঁতারুর কথা তুই জানিস যে জল খায় না? আইনের চোখে দেখলে একদম সঠিক পর্যবেক্ষণ।”
“তাহলে বেশি বেশি জল খেতে বলছ কেন? খেলেই যখন শেখা যায় না! এমনি জল তো আমি রোজই খাই।”
“ঠিক। আমারই ভুল। তুই বরং এক কাজ কর। ফ্রিজের ভেতর দেখ সন্দেশ কিংবা কাঁচাগোল্লা আর আছে কি না, কিংবা জিলিপি।”
“আবার! এই তো একটু আগে ব্রেকফাস্টে লুচি-আলুর দমের সঙ্গে চারটে কাঁচাগোল্লা, দুটো সন্দেশ আর ছ’টা জিলিপি খেলে!”
“আরে দূর! আমার জন্য নয়। থাকলে একটা সন্দেশ কিংবা জিলিপি একটা প্লেটে করে ঘরের ওই কোনায় মেঝেতে রেখে দে।”
“তাতে কী হবে?”
“একটু পরে সন্দেশে পিঁপড়ে ধরবে, থিকথিক করবে পিঁপড়েতে—লাল পিঁপড়ে। তখন কয়েকটা পিঁপড়ে ধরে জলের গ্লাসে ফেলে জলটা খেয়ে নিবি। ‘পিঁপড়ে খেলে সাঁতার শেখে’—এরকম একটা কথা আছে, প্রবাদ প্রবচনের বইগুলোয় অবশ্য খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও। তোর ওপর ‘পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত’ হলে আমার বইয়ে নতুন প্রবাদ হিসেবে ঢুকিয়ে দেব।”
“ধুত্তোর! নিকুচি করেছে তোমার পরীক্ষার।” এই বলে রেগেমেগে বসার ঘরে গাঁক গাঁক করে টিভি চালিয়ে কার্টুন নেটওয়ার্ক দেখতে বসে গেলাম আমি।
গজুমামা নাকি কলেজে পড়ার সময় সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন ছিল। দিল্লিতে মামার ঘরে শো-কেসে সাজানো একটা রুপোর মেডেলও আছে, ফোর বাই ফিফটি মিটার রিলের। বিশুমামা অবশ্য মেডেলটা নিয়ে বলে, সে রিলে রেসে নাকি মাত্র দুটো টিমই ছিল, তিনটে টিম থাকলে ওটা ব্রোঞ্জ হয়ে যেত। গত গরমের ছুটিতে দিল্লি গেছিলাম, গজুমামাকে সে-কথা বলায় মামা রেগে একেবারে আগুন। বলল, “বিশু বলেছে এ-কথা? সে জানল কী করে? আমি যখন কলেজে পড়ি তখন তো সে হাফ প্যান্ট পরে! খালি গুল আর গুল, গুল মারায় সব ওস্তাদ!”
বললাম, “তাহলে আমায় সাঁতার শিখিয়ে দেবে? সাঁতার জানি না বলে জলে খুব ভয় আমার।”
“আলবাত শিখিয়ে দেব, একশোবার শিখিয়ে দেব। সাঁতার শেখা আর এমন কী! এক সপ্তাহের মামলা। ভাইফোঁটার সময় যখন যাব কলকাতায় তখন শিখিয়ে দেব তোকে।” মামা নিজের মুখেই বলেছিল এ-কথা। অথচ এখন সাঁতারের কথা পাড়লেই খালি এ-কথা সে-কথা বলে এড়িয়ে যাচ্ছে।
রাগ দেখিয়ে মুখ হাঁড়ি করে বসে বসে টিভি দেখছিলাম, ভেবেছিলাম একটু পরেই তোষামোদ করতে আসবে মামা। ও বাবা, কোথায় কী! দেখি রোজকার মতো সেজেগুজে বেরোনোর জন্য তৈরি!
মা বলল, “আজ আবার চললি কোথায়?”
“আজ আর কাল উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি যাব। হাজার হাজার বইয়ের রাজ্যে প্রবাদ প্রবচন খুঁজে চলেছি—‘খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা’ বলে একটা কথা আছে না!” বলল মামা।
তার মানে আজ আর কালও হবে না কিছু! আমিও অত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নই। আমার এক বন্ধু গাবু রোজ বিকেলে লেক টাউনের একটা সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে যায়। তাকে দিয়ে পুলে ভরতি হবার ফর্ম আনালাম একটা। মামা ফিরতেই ফর্মটা দেখিয়ে বললাম, “এই যে, সুইমিং পুলে ভরতি হবার ফর্ম আনিয়েছি। পরশু চলো আমার সঙ্গে, সাঁতার শেখাবে।”
মামা মুখ ভেটকে নাক কুঁচকে বলল, “সুইমিং পুল! ছোঃ, সুইমিং পুলে কেউ সাঁতার শেখে? ঢেউ নেই, স্রোত নেই, বদ্ধ জলা। সাঁতার শিখতে হয় নদীতে বা সমুদ্রে। নইলে ইংলিশ চ্যানেল পার হবি কী করে?”
ইংলিশ চ্যানেল! উরিব্বাস! বুলা চৌধুরী দু-দু’বার ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়েছেন। কুইজের বইতে পড়েছি। সাঁতার শিখলে আমিও পারব?
“কতদিন সাঁতার শিখলে ইংলিশ চ্যানেল পেরোনো যাবে?” জিজ্ঞেস করলাম মামাকে।
“এখন তো চ্যানেল পেরোনো জলভাত হয়ে গেছে। আগে হাঙর আর তিমি থিকথিক করত সমুদ্রে, জলে নামলেই কপাৎ করে গিলে ফেলত। এখন মানুষ সব মেরে সাফ করে দিয়েছে।”
“ইশ! এমন বলছ যেন তুমিও পেরিয়েছ ইংলিশ চ্যানেল।”
“পেরিয়েছি তো। না পেরোনোর কী আছে?”
“ইংলিশ চ্যানেল! তুমি! আর গুল মেরো না। আবার বলো বিশুমামা গুল মারে।”
“গুল মারব কেন? লন্ডন থেকে প্যারিস অবধি ইংলিশ চ্যানেলের তলা দিয়ে পাতাল রেল চলে। সেই ট্রেনে গেছি তো প্যারিস, যখন লন্ডনে পড়তে গেছিলাম। দিব্যি সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে ঝাঁ-চকচকে ট্রেন চলছে। হাঙর-তিমির চিহ্নও নেই।”
“ধুত্তোর! সাঁতরে পেরোনোর কথা বলছি। কিন্তু সমুদ্র এখানে পাব কোথায়? নদী অবশ্য আছে। কাল সকালে বাগবাজারের ঘাটে নিয়ে যাবে? গঙ্গায় সাঁতার শিখব।”
“কাল তো ফের উত্তরপাড়া যেতে হবে, জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরিতে। বেশ কিছু বই রেখে এসেছি বেছে, কাল গিয়ে সেগুলো থেকে নোট নিতে হবে।”
“আমিও যাব তোমার সঙ্গে। উত্তরপাড়াতেও তো গঙ্গা আছে, লাইব্রেরির পাশেই। ওখানেই শেখা শুরু করা যাক।”
কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে ভেবে মামা বলল, “সেটা হতে পারে, তবে তার আগে তোর কিছু শারীরিক পরীক্ষা নেওয়া দরকার। তোর দম কেমন? দম বন্ধ করে কতক্ষণ থাকতে পারিস দেখি। আমি ঘড়ি দেখছি, নে শুরু কর—ওয়ান, টু, থ্রি—স্টার্ট।”
দম বন্ধ করলাম। মামা ঘড়ি দেখে বলল, “হুম, ভালোই। এক মিনিটের ওপর। তোকে প্রথমে ডুব সাঁতার শেখাব আমি। ডুব সাঁতারে দম ধরে রাখতে হয়। ‘ডুবে ডুবে জল খাওয়া’ বলে একটা কথা আছে ঠিকই, কিন্তু ডুব সাঁতার দেবার সময় জল খেলেই কেলেঙ্কারি, নিজেই ডুবে যাবি। একশো মিটার দৌড়োতে কত সেকেন্ড লাগে তোর?”
“মাপিনি। হবে পনেরো-কুড়ি সেকেন্ড।”
“বাহ্, বাহ্। জলের নীচে নয় এক মিনিটই লাগবে ধরলাম। শোন, কাল উত্তরপাড়ার গঙ্গার ঘাটে গিয়ে একটা নৌকো ভাড়া করব আমরা। পাড় থেকে একশো মিটার দূরে গিয়ে তোকে জলে ফেলে দেব আমি। দম ধরে রাখবি। ডুবতে ডুবতে যেই পায়ের তলায় মাটি পাবি অমনি দৌড় লাগাবি পাড়ের দিকে। এক মিনিটের মধ্যে নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবি। আমি ততক্ষণে নৌকো নিয়ে পাড়ে চলে আসব, তারপর আবার। একদিনে ডুব সাঁতার শিখে যাবি।”
“ধুত্তোর। খালি ইয়ার্কি মারছে! শেখাতে হবে না সাঁতার, যাও। তোমার সঙ্গে উত্তরপাড়া যেতে বয়েই গেছে আমার।”
আরও তিন-চারদিন এভাবেই কেটে গেল। সাঁতার শেখানোর ব্যাপারে কোনও গরজই নেই মামার। দিন-রাত সেই বই লেখা নিয়েই ব্যস্ত।
কালীপুজোর আগের দিন কালনা থেকে বড়ো মাসি ফোন করল মামাকে, “আমাদের ভাইফোঁটা তো প্রতিপদে। পরশুদিন সক্কাল সক্কাল চলে আয়, ফোঁটা নিয়ে বিকেলেই ফিরে যাবি না-হয়, পরদিন কলকাতায় ঝুনুর কাছে ফোঁটা নিবি।”
মামা বলল, “কী ভাগনে, যাবি নাকি? কালনাতেও গঙ্গা আছে, সাঁতার শিখিয়ে দেব তোকে।”
মামার সঙ্গে কোথাও যাবার মজাই আলাদা। কালনা যাবার নাম শুনেই তো আমার মন আনন্দে নেচে উঠেছে। বড়ো মাসির বাড়ি—কত বড়ো বাগান বাড়িতে, উঠোন—মাসতুতো দাদা-দিদি বুবুদা আর বাবলিদিও আছে। মেসোমশাই লালজি তো দারুণ মজার মানুষ।
মা বলল, “যা না, ঘুরে আয়, ভাইফোঁটার পরেই তো স্কুল খুলে যাবে। বাবলিদির কাছে ফোঁটাও নিয়ে আসবি।”
আর একটা আকর্ষণ হল সাঁতার শেখার সুযোগ। কালনাতে গঙ্গা আছে বইকি, কিন্তু একদিনে কি শেখা যাবে সাঁতার? মামাকে জিজ্ঞেস করলাম।
“কেন যাবে না? আলবাত যাবে! একদিন কেন, এক ঘণ্টায় শিখিয়ে দেব। কে শেখাবে দেখতে হবে তো!”
সুতরাং কালীপুজোর পরদিন ভোরবেলা গজুমামা আর আমি হাওড়া স্টেশন থেকে কালনার ট্রেন ধরলাম। দশটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম বড়ো মাসির বাড়ি। পৌঁছেই দেখি লালজি, মানে মেসোমশাই বাজারে যাচ্ছেন ভাইফোঁটার মিষ্টি আনতে। গজুমামাও চলল লালজির সঙ্গে। আমি আর কী করি! মাসি আর বাবলিদি ভাইফোঁটার আয়োজনে ব্যস্ত। বুবুদার সঙ্গে ক্যারম খেললাম কিছুক্ষণ।
প্রায় দু-ঘণ্টা পর বারোটার সময় ফিরল গজুমামারা। ফিরে বসার ঘরে মৌজ করে চায়ের কাপ হাতে বসল দুজন। অধৈর্য হয়ে বললাম, “মামা, চলো, গঙ্গায় স্নান করতে যাবে না? সাঁতার শিখতে হবে তো!”
শুনে বড়ো মাসি রান্নাঘর থেকে বলল, “এখন এই ভরদুপুরে গঙ্গায় যাবি কী! অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি বাড়িতেই স্নান করে নে। আমার আয়োজন সব হয়ে গেছে। তোরা স্নান করে এলেই ফোঁটা দিয়ে দেব।”
“গঙ্গায় না গেলে সাঁতার কাটা শিখব কী করে? মামা আমায় শেখাবে বলেছে।” বললাম আমি।
মামা বলল, “শোন, সাঁতার কাটা শেখার জন্য গঙ্গায় যাওয়ার দরকার নেই। খাতা-পেনসিল নিয়ে আয় দেখি চটপট।”
“না, তোমার ফন্দি আমি জানি। লিখে বা ছবি এঁকে নয়, হাতে-কলমে শেখাতে হবে।”
“আহা, তাই শেখাব। তুই নিয়েই আয় না।”
আমার কাছে সবসময় একটা ছোটো ডায়েরি থাকে। যখন যা মনে হয় লিখি হাবিজাবি। ব্যাগ থেকে বার করে তাড়াতাড়ি পেন আর ডায়েরিটা নিয়ে এলাম।
“এনেছিস? বাহ্, এবার একটা ফাঁকা পৃষ্ঠা খোল।” বলল মামা।
“খুলেছি।”
“এবার পরিষ্কার করে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখ, ‘সাঁতার’।”
লিখলাম।
“লিখেছিস? এবারে পেন দিয়ে ঢ্যাঁড়া মেরে ‘সাঁতার’ লেখাটা কেটে দে। ব্যস, হয়ে গেল সাঁতার কাটা! হল কি না? কতক্ষণ লাগল? গঙ্গায় যাবার দরকার হল কি? একটা চক থাকলে মেঝেতেও সাঁতার কাটতে পারিস।”
লালজি, বুবুদা আর বাবলিদি হো হো করে হেসে উঠল। খুব অপমান হল আমার। ঘাড় গোঁজ করে বললাম, “এটা হাতে-কলমে হল কোথায়?”
“হল না? খাতায়-কলমে সাঁতার কাটা শেখালাম তোকে, আর খাতাটা তোর হাতে আছে, হাতে-কলমেই তো হল তাহলে! আর এই যে বুদ্ধিটা শিখিয়ে দিলাম, এই পদ্ধতিতে তুই যা খুশি তাই কাটতে পারবি এখন। খাল কাটতে পারবি, পুকুর কাটতে পারবি, মাছ তরকারি মুরগি পাঁঠা সব কাটতে পারবি। বড়ো হয়ে যদি চোর হতে চাস তখন তো সিঁদ কাটতে হবে। একটা কাগজে ‘সিঁদ’ লিখে কেটে দিবি, ব্যস কেল্লা ফতে।”
আবার হেসে উঠল সবাই। ওই ঘরে থাকতে আমার একটুও ইচ্ছে করছিল না। একা একা দোতলায় উঠে গেলাম। তখনই গজুমামার সঙ্গে কথা বন্ধ করা উচিত ছিল আমার। করিনি—ভাইফোঁটার দিন, মাসির বাড়ি এসেছি, সবাই বেশ উৎসবের মেজাজে আছে, এর মধ্যে রেগেমেগে কথা বন্ধ করে বসে থাকলে ভালো দেখায়?
যাই হোক, ভাইফোঁটা পর্ব তো মিটল। দুপুরে জম্পেশ পেটপুজো হল—লুচি আর পাঁঠার মাংস, পায়েস, নানারকম মিষ্টি। সকলের খাওয়াদাওয়া শেষ হতে না হতেই ফেরার সময় হয়ে এল আমাদের। বিকেল সাড়ে চারটেয় ট্রেন। রিকশা করে আমি আর মামা রওনা দিলাম স্টেশনের দিকে।
স্টেশনে পৌঁছে দেখি, সিগন্যাল হয়ে গেছে, ট্রেন ঢুকছে। তাড়াতাড়ি রিকশা থেকে নামতে নামতে একশো টাকার একটা নোট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মামা বলল, “ভাগনে, চটপট দুটো টিকিট কেটে আন—একটা ফুল, একটা হাফ। রিকশা-ভাড়া মিটিয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠে ছেনোর মুড়িমাখা কিনছি আমি।”
“উফ্! আবার মুড়িমাখা! এই যে একটু আগেই এত এত লুচি-মাংস খেলে?”
“আহা, এখন খাব না, নিয়ে নেব। ট্রেনে যেতে যেতে খিদে পেলে করবি কী শুনি? তাছাড়া, কালনা এলাম, আর ছেনোর বিখ্যাত মুড়িমাখা খেলাম না, তাই হয় নাকি?”
বলিহারি নোলা মামার!
মুড়িমাখা ঠোঙাবন্দি হতে না হতে ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়ল। খুব বেশি ভিড় নেই। গুপ্তিপাড়া পেরোনোর পরই বসার জায়গা পেয়ে গেলাম দুজনে। একই কামরায়—মামা জানালার ধারের একটা সিঙ্গল সিটে, আমি কোনাকুনি উলটোদিকে আর একটা জানালার পাশে।
এই কাটোয়া লাইনের ট্রেনে টিকিট চেকারের দেখা পাওয়া সুন্দরবনে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের দেখা পাওয়ার চেয়েও শক্ত। কিন্তু কথায় বলে, ভক্তিভরে ডাকলে নাকি ভগবানেরও দর্শন মেলে! মনেপ্রাণে চাইছিলাম, আজ টিকিট চেকার উঠুন ট্রেনে। নতুন শেখা বিদ্যেটা দেখিয়ে তাঁকে চমকে দেব একেবারে। ওমা! জিরাট স্টেশন থেকে গাড়ি ছাড়তে না ছাড়তে সত্যিই দেখি একজন কালো কোট টিকিট চেকার উঠেছেন আমাদের বগিতে। একটু পরে আমাদের কামরায় এসে প্রথমেই গজুমামার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “টিকিট?”
মামা জানালার ধারে হাওয়া খেতে খেতে ঝিমোচ্ছিল। তন্দ্রা ভেঙে চমকে উঠে ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “অ্যাঁ? ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, টিকিট। টিকিট আমার ওই ভাগনের কাছে। ভাগনে, টিকিট দুটো দেখা।”
টিকিট কেটেছি নাকি আমি! কাটতে গিয়েছিলাম ঠিকই, কাউন্টারে গিয়ে দেখি বিরাট লম্বা লাইন। সে-লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হলে আর ট্রেন পেতে হত না। তাই কাটিনি তখন। অত কষ্ট করে টিকিট কাটতে বয়েই গেছে আমার।
এদিকে টিকিট চেকার ভদ্রলোক আমার সামনে এসে হাত বাড়িয়ে বললেন, “টিকিট?”
তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে আমার ডায়েরি আর পেনটা বার করে বললাম, “হ্যাঁ, এই যে কাটছি।”
ডায়েরির একটা ফাঁকা পৃষ্ঠা খুলে পরিষ্কার করে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখলাম, ‘টিকিট’। তার নীচে একটু ছোটো করে আবার লিখলাম, ‘টিকিট’। তারপর পেন দিয়ে ঢ্যাঁড়া মেরে দুটো টিকিটই কেটে বললাম, “এই যে টিকিট কাটলাম। ওপরেরটা মামার; নীচেরটা আমার—হাফ টিকিট, বারো বছর হতে এখনও তিন মাস বাকি আমার।”
চেকার ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চোখ পাকিয়ে কটমট করে তাকিয়ে থেকে বললেন, “ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে! বেয়াদব ছোকরা!” তারপর ঘুরে মামার সামনে গিয়ে কড়া গলায় এক ধমক, “চালাকি করছেন? দেখে তো বেশ ভদ্র-সভ্যই মনে হচ্ছে। টিকিট দেখান তাড়াতাড়ি। না থাকলে জরিমানা দিন, দিতে না পারলে চলুন আমার সঙ্গে—গারদে পুরে দেব।”
তারপর যা যা হল, সে-সব আর বিশদে লিখছি না। মামার চোখে পড়লে মানহানির মোকদ্দমা ঠুকে দেবে আমার নামেই। গজুমামা, যে নাকি নিজেই একজন জজ ছিল, যাকে-তাকে জেলে পুরে দিতে পারত, তাকেই বলে কিনা ফাটকে পুরে দেবে! কী কেলেঙ্কারি!
এরপরই মামা আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিল। দিল্লি রওনা হওয়া অবধি আর একটা কথাও বলেনি। আমার কী দোষ? কথা তো আমারই আগে বন্ধ করা উচিত ছিল, নাকি?
ছবি: পুণ্ডরীক গুপ্ত
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু