ছোটো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
ছোটো গল্প
কফির কাপটা হাতে নিয়ে ডরোথি বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে এসে বসলেন। বৃষ্টিটা কমে এসেছে। কিন্তু হাওয়ার তেজ একটুও কমেনি। গোটা বাগান জুড়ে গাছপালাগুলো নার্সারির শিশুদের মতো দুলে দুলে খেলা করছে। ডরোথি অবাক বিস্ময়ে সেইদিকে তাকিয়ে থাকলেন। বারান্দার রেলিংয়ের সেই লতানো গাছটির একটা শাখা ডরোথির পায়ের কাছে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। ডরোথি পরম মমতায় সেই শাখাটি হাতে তুলে নিলেন। তারপর মায়েরা যেমন শিশুদের আদর করে, সেইভাবে তার গায়ে হাত বোলাতে থাকলেন। গাছটিও যেন আদর পেয়ে আনন্দে খিলখিলিয়ে উঠল।
প্রদীপ কুমার দাস
শুক্রবারের প্রার্থনা শেষ করে গির্জা থেকে বেরিয়ে ডরোথি উইলি আবার লোকটাকে দেখলেন। মাঝারি উচ্চতা, বলিষ্ঠ চেহারা, গায়ের রঙ কালো, মুখে বসন্তের দাগ। বয়স তিরিশের কোঠায়। গির্জার কম্পাউন্ডের বাইরে একটা গুলমোহর গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। নজর এই গির্জার দিকেই। লোকটাকে ডরোথি এর আগে আরও দু-বার দেখেছেন। একবার বাজারে যখন সবজি কিনতে গিয়েছিলেন, আর একবার সেমেট্রিতে ডেভিডের সমাধিতে ফুল দিতে গিয়ে। সত্তর বছর বয়সেও ডরোথির দৃষ্টিশক্তি এখনও যথেষ্ট ভালো। লোকটা যে তাঁর দিকে নজর রাখছে এটা বুঝতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। লোকটাও অবশ্য নিজেকে গোপন রাখার খুব একটা চেষ্টা করেনি। কিন্তু ডরোথি বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে লোকটা কেন তাঁকে নজরে রাখছে।
আকাশে মেঘ করেছিল। এখন টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ডরোথি হাতের ছাতাটা খুলে মাথায় ধরলেন। মিস্টার এবং মিসেস জর্জ এগিয়ে এসে অভিবাদন জানালেন।—“গুড মর্নিং, ডরোথি। কেমন আছো? তোমার হাঁটুর ব্যথা কেমন আছে?”
“গুড মর্নিং এমি, গুড মর্নিং পিটার। আমি এখন ভালো আছি, ধন্যবাদ।”
এমি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কী ডিসিশন নিলে? এখানেই থাকবে, না অস্ট্রেলিয়ায় টিমোথির কাছে চলে যাবে?”
প্রশ্নটা শুনে ডরোথি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর হাতে ধরা রুমালটা দিয়ে মুখের কোনাটা একবার মুছে নিয়ে বললেন, “তুমি তো জানো এমি, আমার জীবনের সত্তরটা বসন্ত আমি এই দেশে এই শহরে কাটিয়েছি। হ্যাঁ, ডেভিডের সঙ্গে আমি বহুবার বহু দেশে গিয়েছি। কিন্তু দু-এক মাস কাটাবার পর আমার এই শহরে ফিরে আসার জন্য মনকেমন করত। কোনোদিনই আমি নিজেকে এই দেশের নাগরিক ভিন্ন অন্য কিছু ভাবিনি। এই দেশই আমার মাতৃভূমি।”
ডরোথি নিজের আবেগ সংবরণ করার জন্য একটু থামলেন। তারপর বললেন, “তাছাড়া এখানে আমার প্রিয় ডেভিড চিরনিদ্রায় শুয়ে রয়েছে। তাকে ছেড়ে আমি কোথাও গিয়ে শান্তি পাব না। না এমি, টিমোথি যতই আমার নিজের বোন হোক, আমাকে যতই তার কাছে গিয়ে থাকতে বলুক, এ-দেশ ছেড়ে আমি যাব না।”
মিসেস এমি জর্জ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ডরোথির কাঁধে হাত রাখলেন।—“ইটস অলরাইট ডরোথি। আমরা তোমার সেন্টিমেন্ট বুঝতে পারছি এবং তাকে সম্মান করি। তুমি যা ডিসিশন নিয়েছ তা একদম ঠিক। কিন্তু অত বড়ো বাড়িতে তুমি একা থাকো। আমাদের সবসময় তোমাকে নিয়ে চিন্তা হয়। আমাদের সবারই তো বয়স হচ্ছে। কখন কী হয়ে যায় তা কি বলা যায়? তাছাড়া…”
কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে মিসেস এমি জর্জ চুপ করলেন।
ডরোথি জিজ্ঞেস করলেন, “তাছাড়া কী, এমি?”
এমি কোনও উত্তর না দিয়ে তাঁর স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন। মিস্টার জর্জ তাঁর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বললেন, “আর কিছু নয় ডরোথি, আমরা আসলে সে-বারের ওই অ্যাটাকটার পর খুবই চিন্তিত আছি। রাতবিরেতে কোনও হুলিগান যদি বাড়িতে হামলা করে তাহলে তো খুবই চিন্তার বিষয়। তোমার ভাগ্য ভালো সে-রাতে সেই দুষ্কৃতীটা তোমার ঘরে ঢুকতে পারেনি। হয়তো দরজা খুলতে পারেনি। কিন্তু আবার যদি অ্যাটাক হয় তাহলে কী হবে?”
ডরোথি একটু হেসে বললেন, “আপনারা অকারণে চিন্তিত হচ্ছেন। পুলিশ তো বলেছে ওটা কোনও ছিঁচকে চোরের কাজ। আমার ক্ষতিসাধন তার উদ্দেশ্য ছিল না। তাছাড়া এখন রাতের দিকে একটা পুলিশের গাড়ি এ-পাশে টহল দিয়ে যায়, আমি লক্ষ করেছি। আমার মনে হয় না আর কোনও উৎপাত হবে।”
“তবু…” মিস্টার জর্জের গলায় সংশয়ের সুর—“যবে থেকে আমাদের এই এরিয়ায় ওই অ্যাপার্টমেন্টগুলো তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে সেদিন থেকে আমাদের শান্তি নষ্ট হয়েছে। একে একে অনেকেই তো তাদের প্রপার্টি বিক্রি করে চলে গেল। শুধু তোমার আমার মতো কিছু পুরোনো লোক তাদের সেকেলে সেন্টিমেন্ট নিয়ে এখনও এই জায়গাটা আঁকড়ে পড়ে রয়েছি।”
একটু থেমে মিস্টার জর্জ জিজ্ঞেস করলেন, “ওই আগরওয়াল বলে লোকটা তোমার কাছে এসেছিল না?”
“হ্যাঁ।” ডরোথি বললেন, “অনেক টাকা অফার করেছিল। কিন্তু আমি তার মুখের উপর না বলে দিয়েছি।”
ডরোথি একটু থেমে হেসে বললেন, “কিন্তু সে যত টাকার লোভই দেখাক না কেন, আমি এ-জায়গা ছেড়ে কোথাও নড়ছি না।”
কথা বলতে বলতে তাঁরা গির্জার গেটের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। মিস্টার জর্জ বললেন, “ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি যেন আর কোনও গোলমাল না হয়। তবে আবার যদি ওই আগরওয়াল তোমাকে বিরক্ত করে, আমাকে খবর দেবে। এখনও এই শহরে আমাদের কমিউনিটি যথেষ্ট স্ট্রং। আমি পুলিশ প্রশাসনকে বলে ব্যবস্থা নেব।”
“ধন্যবাদ, পিটার। কিন্তু আমার ধারণা, তার দরকার পড়বে না।”
এমি বললেন, “তবু যদি কখনও কোনও প্রয়োজন হয় আমাদের খবর দেবে। যাই হোক, আজ সন্ধেবেলা রেবেকার পার্টিতে যাবে তো?”
“ইচ্ছে তো আছে, কিন্তু যা বৃষ্টি…”
“চিন্তা কোরো না, আমরা যাওয়ার সময় তোমাকে তুলে নেব।”
“তাহলে তো ভালোই হয়।”
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরে ডরোথিকে বিদায় জানিয়ে জর্জ-দম্পতি বিদায় নিলেন।
বৃষ্টির তেজ সামান্য বেড়েছে। বেশ জোরে হাওয়া দিচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়ে ছিটকে এসে ডরোথির স্কার্টের প্রান্ত ভিজিয়ে দিচ্ছিল। ডরোথি মনে মনে বিরক্ত হলেন। আজ আর সেমেট্রিতে যাওয়া যাবে না। আকাশের যা মতিগতি তাতে মনে হচ্ছে সারাদিন আজ এরকমই চলবে। হাওয়া অফিস থেকেও নিম্নচাপের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
ডরোথি গির্জার বাইরে গুলমোহর গাছটার দিকে তাকালেন। লোকটা আর এখন ওখানে নেই। এদিক ওদিক খুঁজেও তিনি লোকটাকে দেখতে পেলেন না। ডরোথি ভাবলেন, এবার লোকটাকে দেখতে পেলে তিনি সরাসরি চার্জ করবেন। সর্বক্ষণ কোনও লোক যদি নজরে রাখে, সেটা খুবই অস্বস্তিকর। ছাতাটা ভালো করে ধরে তিনি বাড়ির রাস্তা ধরলেন।
গির্জা থেকে তাঁর বাড়ি ‘উইলি লজ’ প্রায় হাফ কিলোমিটার রাস্তা। এমনিতেই এই স্পিন্সার গার্ডেন অঞ্চলটা ফাঁকা ফাঁকা। তার উপর উইলি লজ একদম শহরের শেষ প্রান্তে। ফুট ছয়েক চওড়া পিচ রাস্তা, যার নাম ক্রিসেন্ট রো, তার দু-পাশে অনেকখানি করে ফাঁকা জমি। সেখানে পরপর ইউক্যালিপটাস গাছের সারি। তারপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনেকখানি বাগানঘেরা কিছু বাংলো। একটা সময় এই জায়গাটা মানুষজনে গমগম করত। এখন অধিকাংশ বাংলো ফাঁকা পড়ে রয়েছে। বেশিরভাগ অধিবাসী হয় ইংল্যান্ডে অথবা অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। যারা আছে তারাও বছরের বেশিরভাগ সময়টা কলকাতায় কাটায়। সাধারণত ক্রিসমাসের সময় তারা এখানে আসে। একমাত্র সেই সময়ই জায়গাটা যা কিছু প্রাণের ছোঁয়া পায়। বছরের বাকি সময়টা পরিত্যক্ত হানাবাড়ির মতো জায়গাটা খাঁ খাঁ করে।
আজ থেকে ঠিক একমাস আগে শহরের সবচেয়ে বড়ো প্রোমোটার মিস্টার সূরয আগরওয়াল তাঁর কাছে এসেছিলেন। তিনি এই গোটা এরিয়াটা কিনে নিয়ে একটা অত্যাধুনিক ভিলেজ বানাতে চান। এমনিতে এই ড্যানিয়েলগঞ্জের স্বাস্থ্যকর জায়গা বলে সুখ্যাতি আছে। বছরভর ট্যুরিস্টদের আনাগোনা লেগে থাকে। বিশেষ করে শীতকালে শহরের হোটেলগুলো পুরোপুরি ভরতি হয়ে যায়। সূরয আগরওয়ালের ইচ্ছা এই বাংলোগুলোকে সংস্কার করে ভাড়া দেবেন। তার সঙ্গে সুইমিং পুল, গেম জোন, শপিং হাব ইত্যাদি আধুনিক ব্যবস্থাপনাও থাকবে।
“দেখুন ম্যাডাম,” সূরয আগরওয়াল হিন্দি ও ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলেছিলেন, “আমি এখানে সব হি প্রপার্টি ওনারদের সঙ্গে কন্টাক্ট করেছি। এই ক্রিসেন্ট রোতে কুলমিলাকে দশটা বাংলো আছে। আপনি ছাড়া বাকি সবাই তাদের প্রপার্টি আমাকে সেল করতে রাজি আছেন। কিন্তু সবসে জ্যাদা প্রপার্টি আপনার আছে। এটা না পেলে আমি আমার প্রজেক্ট শুরু করতে পারছি না। আমি আপনাকে মোর দেন এনাফ মানি দিবো। আপনি এ-প্রপার্টি আমাকে বেচে দিন।”
ডরোথি বলেছিলেন, “সরি মিস্টার আগরওয়াল, আমি আপনার ম্যানেজারকে আগেও বলেছি, এখন আপনাকে বলছি, এ-জায়গা ছেড়ে আমি যাব না। আপনি ভিলেজ বানাতে চান, আমার প্রপার্টি ছেড়ে সেটা করতে হবে।”
“কিন্তু আপনি এখানে পড়ে থাকবেন কেন? আমি খোঁজ নিয়েছি, আপনার হাজব্যান্ড দু-বছর হল মারা গেছেন। আপনার নিজের কোনও ইস্যু নেই। ইন্ডিয়াতে আপনার কোনও নিয়ার রিলেটিভও নেই। আপনি এখানে না থেকে অস্ট্রেলিয়া চলে যান আপনার রিলেটিভদের কাছে। সেটাই আপনার পক্ষে বেটার হবে।”
ডরোথি তখন কঠোর গলায় বলেছিলেন, “লুক মিস্টার আগরওয়াল, আমার কীসে ভালো হবে সেটা আমি বুঝব। আপনি জেনে রাখুন, এই বাংলো ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। ইউ মে গো নাও।”
সূরয আগরওয়াল উঠতে উঠতে বলেছিলেন, “কাজটা আপনি ভালো করছেন না ম্যাডাম। প্রপার্টিটা আমি ঠিকই দখল করব। আপনি আটকাতে পারবেন না।”
এইসব কথাবার্তা ভাবতে ভাবতে ডরোথি উইলি লজের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। চেরা কাঠের দরজাটা খুলে কম্পাউন্ডে প্রবেশ করলেন। দরজা থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে তাঁদের একতলা বিলিতি প্যাটার্নে তৈরি বাংলো। বাংলোকে ঘিরে বিশাল বাগান। সেখানে বেশিরভাগই ডেভিডের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসা গাছপালায় ভরতি। গাছপালার খুব শখ ছিল ডেভিডের। যখনই জাহাজ নিয়ে কোনও নতুন দেশে যেতেন, সেখানকার অচেনা অজানা গাছপালার খোঁজ করতেন। যখন দেশে ফিরতেন তখন সঙ্গে অন্য কোনও উপহার নয়, থাকত একগুচ্ছ গাছ। যতদিন এখানে থাকতেন, খুব যত্ন নিয়ে সেই গাছপালা রোপণ করে তাদের পরিচর্যা করতেন। নতুন দেশে নতুন পরিবেশে বেশিরভাগ গাছই বাঁচত না। আবার অনেক গাছই বেঁচে যেত। এইভাবে বছরের পর বছর ধরে গড়ে উঠেছিল এই বাগান। ডেভিড যখন থাকতেন না তখন ডরোথি গাছপালার দেখাশোনা করতেন। দুজন মালি রেখেছিলেন। ডরোথির নির্দেশে তারা মাটি কোপাত, গাছের গোড়ায় জল দিত, আগাছা উপড়ে ফেলত, ডালপালা ছেঁটে দিত। এই বাগান তাদের দুজনেরই খুব প্রিয় ছিল। গাছপালা ছিল তাঁদের কাছে সন্তানতুল্য। ডেভিড বলতেন, ‘গাছপালা সবার হাতে বাঁচে না। যারা মন থেকে ভালো হয়, তাদের হাতেই গাছপালা বেড়ে ওঠে। আমরা যেদিন থাকব না, সেদিনও এই উইলি লজ এবং আমাদের লাগানো এই গাছপালা আমাদের স্মৃতি বহন করবে।’
বড্ড রোমান্টিক ছিলেন ডেভিড। কার্গো শিপের ক্যাপ্টেনের মতো একটা দায়িত্বপূর্ণ কাজ করলেও তাঁর মনটা ছিল ছেলেমানুষিতে ভরা। বছর পাঁচেক আগে ডেভিডের প্রথম স্ট্রোক হওয়ার পর থেকেই বাগানের যত্ন-আত্তি কমে এসেছিল। মালি দুজন যেটুকু পারত করত। পক্ষাঘাতগ্রস্ত ডেভিডের সেবা-শুশ্রূষা করার পর ডরোথি আর বাগানের দেখাশোনা করার সময় পেতেন না। ডেভিডের মৃত্যুর পর ডরোথির মন ভেঙে গিয়েছিল। মালি দুজনকেও ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন থেকে বাগানটা অযত্নে পড়ে রয়েছে। বৃষ্টির জল পেয়ে সব গাছই এখন তরতর করে বেড়ে উঠেছে। চারপাশে প্লুমেরিয়া, রাসেলিয়া, ভেনুস্টা, অ্যালামন্ডার ঝাড়। তারই মধ্যে মধ্যে কম্পাউন্ডের গা ঘেঁষে উইলো, চিনার, পাইন, জুনিপার এইসব বড়ো বড়ো গাছ। এছাড়াও আরও অনেক অচেনা গাছ এই বাগানে রয়েছে। ডরোথি তাদের সবার নামও জানেন না। নুড়ি-ফেলা পথটুকু পেরোতে পেরোতে চারপাশে তাকিয়ে ডরোথি ভাবলেন, বর্ষাটা পেরোলে লোক ডাকিয়ে বাগানটা পরিষ্কার করাতে হবে।
বাংলোটা একতলা, তাতে সাকুল্যে তিনটে শোবার ঘর আর একটা বড়ো বসার ঘর। বাংলোর তিনদিক ঘিরে রেলিং দেওয়া বারান্দা। বারান্দার উপরে অ্যাসবেসটসের ঢালু ছাদ। বারান্দার ধার ঘেঁষে উঠে যাওয়া ঢালাই লোহার সারি সারি থাম সেই ছাদকে ধরে রেখেছে। বাগান থেকে তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় ওঠা যায়। বাংলোর সামনের দিকের সিঁড়ির দু-পাশে রেলিং জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে একটা লতানো গাছ। বুগেনভেলিয়া গাছ যেমন রেলিং বেয়ে বেড়ে ওঠে, এই গাছটাও তেমনি গোটা বারান্দার রেলিংয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন না কাটার ফলে গাছের অনেক শাখা-প্রশাখা বারান্দাতেও নেমে এসেছে। বুগেনভেলিয়ার মতো হলেও এই গাছের ডাল আরও মোটা আর শক্তপোক্ত। বছর দশেক আগে প্রশান্ত মহাসাগরের কোন এক দ্বীপে নোঙর ফেলেছিল ডেভিড উইলির জাহাজ ‘ডায়মন্ড স্টার’। সেখান থেকে ডেভিড এই গাছের চারা নিয়ে এসেছিলেন। এ-দেশের মাটিতে সেই গাছ দিব্যি বেড়ে উঠে এখন গোটা বারান্দার রেলিংটা ছেয়ে ফেলেছে।
ছোট্ট চারাগাছে যেদিন প্রথম নতুন কচি সবুজ রঙের পাতা বেরিয়েছিল, সেদিন ডেভিডের সেই উল্লাস এখনও ডরোথির মনে আছে। ডরোথি তখন কিচেনে ডেভিডের প্রিয় ক্যারামেল কাস্টার্ড বানাতে ব্যস্ত। হাতে খুরপি নিয়ে গার্ডেনিং অ্যাপ্রন পরেই ডেভিড লাফাতে লাফাতে কিচেনে চলে এসেছিলেন। ডরোথির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিলেন বাংলোর সামনে যেখানে গাছটা তার প্রথম পাতা ছেড়েছে। সোৎসাহে বলেছিলেন, “দ্যাখো ডোরি, কেমন সুন্দর দেখতে হয়েছে আমাদের এই সন্তান!”
ডরোথি স্বামীর কথায় হেসে বলেছিলেন, “হ্যাঁ, ঠিক তোমার মতো।”
বাইরের পোশাক ছেড়ে ঘরোয়া গাউনটা পরতে পরতে কথাগুলো মনে পড়ে ডরোথির চোখ জলে ভরে এল। তিনি চোখ মুছে ফায়ার-প্লেসের ওপরে রাখা ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মূর্তিটার সামনে এসে দাঁড়ালেন। মনটা আজ শুধু বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বাতাসের আর্দ্রতার মতো তাঁর মনটাও আজ ভিজে ভিজে।
ডরোথি কিছুক্ষণ চোখ বুজে প্রভু যিশুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আস্তে আস্তে মনটা শান্ত হয়ে এল। ধীর পায়ে তিনি কিচেনের দিকে এগোলেন। এক কাপ গরম কফির এখন খুবই প্রয়োজন।
কফির কাপটা হাতে নিয়ে ডরোথি বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে এসে বসলেন। বৃষ্টিটা কমে এসেছে। কিন্তু হাওয়ার তেজ একটুও কমেনি। গোটা বাগান জুড়ে গাছপালাগুলো নার্সারির শিশুদের মতো দুলে দুলে খেলা করছে। ডরোথি অবাক বিস্ময়ে সেইদিকে তাকিয়ে থাকলেন। বারান্দার রেলিংয়ের সেই লতানো গাছটির একটা শাখা ডরোথির পায়ের কাছে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। ডরোথি পরম মমতায় সেই শাখাটি হাতে তুলে নিলেন। তারপর মায়েরা যেমন শিশুদের আদর করে, সেইভাবে তার গায়ে হাত বোলাতে থাকলেন। গাছটিও যেন আদর পেয়ে আনন্দে খিলখিলিয়ে উঠল।
ডেভিড বলেছিলেন এই গাছটার বিশেষত্বের কথা। যে-দ্বীপ থেকে তিনি এই গাছটা সংগ্রহ করেছিলেন, সেখানকার আদিবাসীরা এ-গাছকে বলে ‘বন্ধু গাছ’ বা ‘প্যাল ট্রি’। এই গাছ মানুষের অনুভূতি বুঝতে পারে এবং তাতে সাড়া দেয়। কোনও মানুষ যদি ভালো মনে এদের স্পর্শ করে তাহলে তারা তার দিকে এগিয়ে আসে। আবার কেউ যদি মনে ক্রোধ বা হিংসা নিয়ে এর কাছে আসে তাহলে এরা বিকর্ষিত হয়। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, এরা মানুষকে মনে রাখে। যাকে এরা ভালোবাসে তার আনন্দে আনন্দিত হয় এবং দুঃখে দুঃখিত হয়। ডরোথির মনে আছে, ডেভিডের মৃত্যুর পর প্রায় একমাস এই গাছের ডালপালা কেমন নেতিয়ে ছিল। ডরোথি ভয় পেয়েছিলেন যে গাছটাকে হয়তো আর বাঁচানো যাবে না। কিন্তু আস্তে আস্তে সে আবার উঠে দাঁড়িয়েছিল। ডরোথি মানুষের মতোই তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। তারপর গত দু-বছরে ডরোথির একাকিত্বে এই গাছটাই তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছে। এখন ডরোথি এর সঙ্গে কথাও বলেন। এ-বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ড মোনালিসা নামের আদিবাসী মেয়েটি তাঁকে দু-একবার গাছটার সঙ্গে কথা বলতে দেখে ফেলেছিল। সেই কথা বাইরের লোকজনের কাছেও ছড়িয়ে পড়েছিল। স্বভাবতই ডরোথির মানসিক সুস্থতা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। ডরোথি সেটা জানেন এবং এখন তাই সতর্ক হয়ে গেছেন। বাইরের লোকের সামনে তিনি গাছটার কাছে আসেন না। গাছটাও বোধ হয় তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে। মোনালিসা যতক্ষণ বাংলোয় কাজ করে ততক্ষণ সে সুবোধ বালকের মতো চুপ করে বসে থাকে। তবু মোনালিসা রোজ বিদায় নেওয়ার সময় একবার সন্দেহের চোখে গাছটার দিকে তাকিয়ে যায়।
আজ আর মোনালিসা আসবে না। অগত্যা দুপুরের লাঞ্চ নিজেকেই বানাতে হবে। কফিটা শেষ করে গাছের শাখাটা সযত্নে মেঝেতে নামিয়ে রেখে ডরোথি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।
দুপুরের পরে বৃষ্টিটা বেড়ে গেল। খুব তাড়াতাড়ি বিকেলের আলো মরে এল। ডরোথি একবার ভাবলেন রেবেকাকে ফোন করে তিনি যেতে পারছেন না সেটা জানিয়ে দেবেন। কিন্তু রেবেকা প্রায় বছর দু-এক পর ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছে। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার জন্য সে আজকের পার্টিটা অ্যারেঞ্জ করেছে। তাঁদের কমিউনিটিতে বর্তমানে যে ক’জন রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ এমনিতেই কম। অনেকটা সেই কারণেই এইসব পার্টিগুলো অ্যারেঞ্জ করা হয়। তিনি না গেলে সেটা ভালো দেখাবে না।
এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সন্ধে নেমে এল। কিছুক্ষণ পরেই তিনি বাংলোর বাইরে গাড়ির হর্নের আওয়াজ পেলেন। এমিরা এসে গেছে। বাড়ির বাতিগুলো নিভিয়ে যিশুর মূর্তিটার সামনে একটা বড়ো মোমবাতি জ্বালিয়ে ডরোথি বাইরে বেরোলেন। বৃষ্টিটা বোধ হয় নতুন উদ্যমে নামার জন্য দম নিচ্ছে। দরজাটা টেনে দিতেই ইয়েল লকটা বন্ধ হয়ে গেল। ভিতর থেকে খোলা গেলেও চাবি ছাড়া এবার বাইরে থেকে আর দরজা খোলা যাবে না। বারান্দায় এসে পড়া লতানো গাছটার ডালটাকে হাতে তুলে তিনি বললেন, “গুড নাইট, মাই চাইল্ড। আই উইল বি ব্যাক ইন দ্য মর্নিং। কিপ ওয়াচ অফ দ্য লজ ফর মি।”
গাছের ডালটা ডরোথির হাতে একটু শক্ত হয়ে উঠে আবার খুলে গেল। যেন তাঁকে আশ্বস্ত করল। ডরোথি ছাতাটা খুলে বাগানের রাস্তায় পা রাখলেন।
গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত বারোটার ঘণ্টা বাজতেই পূরণ তার ডেরা থেকে বেরিয়ে পড়ল। এটা আগরওয়াল সাহেবেরই একটা অসমাপ্ত অ্যাপার্টমেন্ট। কিছু আইনি জটিলতায় কাজ বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। গা ঢাকা দিয়ে থাকার পক্ষে আদর্শ। গত তিনদিন যাবৎ পূরণ এখানেই আস্তানা গেড়েছে। এই তিনদিনে এখানকার রাস্তাঘাটগুলো মনের মানচিত্রে এঁকে নিয়েছে। এই বৃষ্টিমুখর অন্ধকার রাতেও কোনও আলো ছাড়াই পথ চলতে তার অসুবিধা হবে না। এখান থেকে ঠিক কতগুলো মোড় পেরোলে উইলি লজ পৌঁছবে তা পূরণের মুখস্থ। কাজ সেরে ফিরে আসতে ঘণ্টা দু-একের বেশি সময় লাগার কথা নয়। অবশ্য কাজ শেষ করে সে আর এখানে থাকবে না। রাতের অন্ধকারেই সরে পড়বে। আগরওয়াল সাহেব তার ব্যবস্থাও করে রেখেছেন।
পূরণ পেশাদার খুনি। আগরওয়াল সাহেবের হয়ে এর আগেও সে কিছু কাজ করেছে। তার সবচেয়ে বড়ো গুণ দুর্দম সাহস আর বরফের মতো ঠান্ডা মাথা। তাই তো আগরওয়াল সাহেব এই ছোট্ট কাজটুকুর জন্যেও তাকেই ডেকে এনেছেন। একজন একাকী সত্তর বছরের বৃদ্ধাকে সরাবার জন্য তাকে ডাকায় পূরণ প্রথমে অবাকই হয়েছিল। এসব ছোটোখাটো কাজ সাধারণত তার সাগরেদরাই করে। কিন্তু আগরওয়াল সাহেব বলেছিলেন, ‘নহি পূরণ। মুঝে তুম হি চাহিয়ে। তুরন্ত আ যাও।’
এখানে এসে পূরণ তার কারণটা বুঝতে পেরেছে। আগরওয়াল সাহেব কাজটা করার জন্য একজন আনাড়িকে ইতিমধ্যে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে বাংলোর ভিতরে পর্যন্ত ঢুকতে পারেনি। কোনও অজ্ঞাত কারণে ভয় পেয়ে কেলেঙ্কারি করে ফেলেছিল। আগরওয়াল সাহেবকে সে বলেছিল, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। অশরীরীরা ওই বাংলো পাহারা দেয়। না-হলে কোথাও কেউ নেই, বাংলোর বারান্দায় উঠতেই পিঠে বেতের বাড়ি এসে পড়বে কেন? আর সেই অদ্ভুত গন্ধ! দেহ-মন অবশ করে দেয়। না না স্যার, আমি আর যেতে পারব না।’
পূরণ মনে মনে হাসল। ডরপোক কাহাঁকা। নিজের অভিজ্ঞতায় সে জানে এরকম হয়। যতই শক্তিশালী মানুষ হোক না কেন, কাউকে প্রাণে মারতে গেলে মনের ভিতর একটা ভয় কাজ করে। সেই ভয়কে যে অতিক্রম করতে পারে সে-ই কাজটা করতে পারে। না-হলে সেই ভয় তাকেই গ্রাস করে নেয়। লোকটার হয়তো তাই হয়েছিল। নিজের মনের ভয় বাইরে অশরীরীরূপে তাকে আক্রমণ করেছিল।
ক্ষিপ্র চিতার মতো লঘু পায়ে পূরণ উইলি লজে পৌঁছে গেল। বৃষ্টির কোনও বিরাম নেই। তার সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। বাগানের গাছগুলো উন্মাদের মতো দুলছে। গাছের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়া শো শো আওয়াজ করছে। বিশ্বচরাচর অন্ধকারে নিমজ্জিত। পূরণের মতো বিড়ালের চোখ না থাকলে এই অন্ধকারে এক পাও চলা অসম্ভব। বাংলোটা অবশ্য পুরোপুরি অন্ধকার নয়। বসার ঘর থেকে একটা মৃদু হলদেটে আলো কাচের জানালা দিয়ে বাইরে এসে পড়ছে। আলোটা মোমবাতির। মেমসাহেব নিশ্চয়ই মোমবাতি জ্বালিয়ে শুয়ে পড়েছে। তবু সাবধানের মার নেই। পূরণ বাগানের পথ না ধরে বাড়ির পিছন দিকে চলে গেল। তারপর অতি সন্তর্পণে বেড়া টপকে বাগানে ঢুকল। তার সন্ধানী চোখ খুঁজে নিল অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার একটা সরু রেখার মতো পায়েচলা পথ। এটুকুই যথেষ্ট। বাংলোর পিছনের জানালার কাছে পৌঁছতে তার সময় লাগল না। জানালার কাচ দিয়ে সে ভিতরে চোখ ফেলে রাখল। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও ঘরে কোনও নড়াচড়া সে অনুভব করল না। তখন নিঃশব্দে জানালাটা উপরে তুলে সে ঢুকে পড়ল। তখন তার হাতে চলে এসেছে প্রিয় ড্যাগারটা। বসার ঘরটায় একবার চকিতে সে চোখ বুলিয়ে নিল। না, কেউ নেই। ফায়ার-প্লেসের উপরে জ্বলা মোমবাতিটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পূরণ শুনেছে, এই বাংলোয় তিনটে শোবার ঘর। সে অতি দ্রুত বসার ঘরটা পেরিয়ে শোবার ঘর তিনটে খুঁজে নিল। কিন্তু একি! মেমসাহেব কোথায়? কোনও ঘরেই সে মেমসাহেবের চিহ্ন খুঁজে পেল না। এরকম তো হবার কথা নয়। এই বৃষ্টি-বাদলার রাতে মেমসাহেব যাবে কোথায়? তবে কি সে ভুল করল? বিকেল পর্যন্ত সে বাংলোর দিকে নজর রেখেছিল। কিন্তু সন্ধে নামার মুখে বৃষ্টিটা যখন আরও জোরে নেমেছিল তখন সে নিশ্চিন্ত হয়ে রাতের অভিযানের জন্য তৈরি হতে নিজের ডেরায় ফিরে গিয়েছিল। তারপর কি মেমসাহেব বাংলা ছেড়ে চলে গেছে? হঠাৎ একটা দুশ্চিন্তা পূরণকে বিচলিত করে তুলল। সে কোনও ফাঁদে পা দিচ্ছে না তো? মেমসাহেব তাকে দু-তিনবার দেখে ফেলেছে। যদি কিছু সন্দেহ করে থাকে! হয়তো এই বৃষ্টির রাতে সে যে আসবে সেটা মেমসাহেব আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল এবং তার জন্যেই হয়তো বাংলো ছেড়ে কোথাও চলে গেছে। শুধু কি তাই? নিশ্চয়ই পুলিশকেও সব কথা জানিয়ে গেছে! পূরণের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকাও নিরাপদ নয়। সে তড়িঘড়ি বসার ঘরের জানালার কাছে এগিয়ে গেল। কিন্তু একি, জানালাটা বন্ধ করল কে? হয়তো হাওয়ায় পাল্লাটা নীচে পড়ে গেছে। পূরণ পাল্লাটাকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু পাল্লাটা উঠল না। মোমের আলোটা নেভার আগে হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সেই আলোয় পূরণ দেখতে পেল, জানালার বাইরে একটা গাছের ডাল কোথা থেকে এগিয়ে এসে জানালাটাকে এঁটে ধরেছে। হয়তো ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। ঠিক সেই সময় মোমবাতিটা দপ করে নিভে গেল। অন্ধকার বসার ঘরটা হঠাৎ পূরণের কাছে শয়তানের গুহা বলে মনে হল। সে ছুটে গেল বাইরের বেরোনোর দরজাটার দিকে। ল্যাচ ধরে ঘোরাতেই দরজাটা খুলে গেল। আহ্! একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সে। তারপর সন্তর্পণে বারান্দায় পা রাখল। তক্ষুনি নাকে এসে ধাক্কা দিল একটা তীব্র মিষ্টি গন্ধ। এরকম গন্ধ পূরণ আগে কখনও পায়নি। মাথাটা একটু ঘুরে গেল তার। হঠাৎ শরীরে সে একটা মৃদু কম্পন অনুভব করল। বুঝতে পারল, শরীরটা অবশ হয়ে আসছে। বিদ্যুৎ-চমকের মতো গতবারের লোকটার কথা তার মনে পড়ে গেল—এই বাংলোকে পাহারা দেয় কোনও অশরীরী শক্তি! এই গন্ধটার কথাও লোকটা বলেছিল। পূরণের ইস্পাতের মতো কঠিন শরীরটা এবার কেঁপে উঠল। জীবনে এই প্রথমবার সে ভয় পেয়েছে। এক ছুটে বারান্দাটা পেরিয়ে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নীচে নামতে গিয়ে কিছুতে পা জড়িয়ে সে বাগানের রাস্তায় আছড়ে পড়ল। পায়ে দড়ির মতো কিছু একটা জড়িয়ে গেছে। পূরণ হাত বাড়িয়ে দড়িটা খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু একি! দড়িটা ক্রমশ দৈর্ঘ্যে বাড়তে বাড়তে তার হাতটাকেও জড়িয়ে ফেলতে লাগল। ঠিক সেই সময় চরাচর আলোকিত করে বাজ পড়ল একটা। সেই ক্ষণিকের আলোয় পূরণ আতঙ্কিত বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখতে পেল, অনেকগুলো লিকলিকে সাপের মতো দড়ি তার দিকে এগিয়ে আসছে। না, দড়ি নয়, ওটা একটা গাছ। বারান্দার রেলিংয়ে যে লতানে গাছটা আছে, সেটাই ডালপালা মেলে তার দিকে এগিয়ে আসছে। পূরণ আর এক হাতে ধরা ড্যাগারটাকে পাগলের মতো ঘোরাতে শুরু করল। কিন্তু বেশিক্ষণ সেটাও করা গেল না। একসঙ্গে অনেকগুলো ডাল এসে তার হাত-পাগুলো প্যাঁচাতে শুরু করল। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল পূরণ। কিন্তু সেই অমানুষিক শক্তির কাছে তার নিজেকে অসহায় মনে হল। পূরণ বুঝতে পারল তার দম ফুরিয়ে আসছে। গন্ধটা তীব্র হতে হতে চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। তার হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। হঠাৎ গলার কাছে সে একটা শীতল স্পর্শ পেল। ঠিক যেন একটা সাপ তার গলাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। একটা, দুটো, তিনটে—পাকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকল আর তার বাঁধন শক্ত হতে থাকল। কিছুক্ষণ কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে করতে পূরণের শরীরটা ক্রমশ স্থির হয়ে এল।
পরদিন সকালে বাংলোয় ফিরে ডরোথি মৃতদেহটা দেখতে পেলেন। ডালপালায় জড়িয়ে গলায় ফাঁস খেয়ে দেহটা রেলিং থেকে ঝুলছে। রেলিংয়ের ধার ঘেঁষে পড়ে রয়েছে গাছটার কাটা ডালপালা। আর সেই ডালপালা থেকে যে জিনিসটা বেরিয়ে এসে বারান্দার মেঝেতে শুকিয়ে দাগ ফেলেছে, সেটার রঙ রক্তের মতো লাল!
ছবি: মৌসুমী রায়
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু