ছোটো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
ছোটো গল্প
অনাদি চলে যাবার দু-মাস বাদে সুনন্দ মায়ের সঙ্গে বর্ধমানে মামার বাড়ি থেকে ফিরছে। ট্রেন আধঘণ্টা দেরি। প্ল্যাটফর্মে সুনন্দ মায়ের সঙ্গে বসে লোকজন দেখছে। লোক আসছে, যাচ্ছে। দূরে গোল করে অনেক যাত্রী স্টেশনের কোন এক গায়ককে ঘিরে ধরে গান শুনছে।
কল্যাণ সেনগুপ্ত
সুনন্দর কাকা একবার পুজোর ছুটিতে রানিগঞ্জের কোলিয়ারি থেকে অনাদিকে নিয়ে এল সঙ্গে করে। বাড়ি ঢুকে উঠোনে দাঁড়িয়েই হাঁক পাড়লে—“বড়ো বউদি, মেজো বউদি, এই যে তোমার সাহায্যকারী এনেছি। এইবার তোমাদের সারাদিনের উদয়াস্ত খাটা কমবে।”
কাজের লোকের কথা শুনে মা, জেঠিমা সবাই রান্নাঘর থেকে হাঁকপাক করে বেরিয়ে এল। সুনন্দ অঙ্কের মাস্টারকে বসিয়ে রেখে দৌড়ে ভিতরের বারান্দায় চলে এল। কাকার সঙ্গে কালো, রোগাপাতলা একটা ছেলে। বয়স মনে হয় বারো-তেরো। হাতে একটা পুঁটুলি। চুলগুলো কপাল ঢেকে রেখেছে। চুপ করে চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে।
সুনন্দর জেঠিমা বলল, “ঠাকুরপো, এ তো একদম বাচ্চা ছেলে। এ কী সাহায্য করবে?”
কাকা বলল, “পারবে, পারবে। কী রে, পারবি না?”
ছেলেটা একটা সরল চাহনি দিয়ে ঘাড় নেড়ে বললে, পারবে।
সুনন্দর বাবারা তিন ভাই। জ্যাঠামশাই উকিল, ওঁর ছেলে কলকাতায় কলেজে পড়ে। বাবা হাই-স্কুলের ইংরেজির মাস্টার। কাকার বিয়ে হয়নি, কোলিয়ারিতে চাকরি করে। ছুটি পেলেই বাড়ি চুঁচুড়ায় আসে। বাড়ির বড়ো ঠাকুমা এখানেই থাকে। মাঝে মাঝে কাকার কাছে যায়। তখন কাকার ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া হয়। আর আছে ছোটো পিসির ছেলে দেবুদা। সে বিশেষ কিছু করে না। এসেছিল পড়তে, কিন্তু পড়াশুনাতে মন নেই। গ্রামের উঠতি ছেলেদের নেতা। বিড়ি-সিগারেট খায়।
সিঁড়ি ঘরের নীচে একটা জলচৌকির ওপর যাবতীয় ভাঙা জিনিসপত্র সরিয়ে অনাদির জায়গা হল। বাবা জিজ্ঞেস করল, “পড়াশুনা কিছু শিখেছিস?”
অনাদি চুপ।
জ্যাঠামশাই বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “একেবারেই স্কুলমুখো হোসনি?”
এবার মুখ খুলল অনাদি—“ক্লাস ফাইভ।”
“তারপর?”
“বাবার সঙ্গে কয়লা ভাঙতাম।”
জেঠিমা আর দেবুদা জিজ্ঞেস করল, “কয়লা চুরি করে পালাতিস না?”
অনাদি এবার মুখ তুলে শক্তভাবে বলল, “আমি চুরি করি না।”
কাকা বলল বাবাকে, “ছোড়দা, ক’দিন থাকুক, দেখ কেমন হয়। সেরকম হলে স্কুলে ভরতি করা যাবে।”
অনাদির কাজ ঠিক হল সকালে উঠে উনুনে আঁচ দেবে। মা-জেঠিমাকে সকালের রান্নাতে সাহায্য করবে। দুপুরের রান্নার তরিতরকারি কেটে দেবে। মাছ কেটে দেবে। সুনন্দ একাই যায় স্কুলে। ওকে সাইকেলে বসিয়ে পৌঁছে দেবে। জামাকাপড় কাচবে। যদি না পারে তাহলে অন্য কিছু ভাবা হবে।
ঠাকুমা বলল, “আমার পুজোর ফুল তুলে এনে দিতে হবে।”
জেঠিমা বলল, “ওরে, মুদির দোকানে মাঝে মাঝে দৌড়ে যেতে হবে কিন্তু।”
অনাদি মাথা নাড়ল।
অনাদি রয়ে গেল। এতে অনেকেরই কাজ কমে গেল। পড়াশুনা জানে না তাই সুনন্দর ভালো ভালো গল্পের বই ও পড়তে পারে না। নতুন জায়গা তাই বেরোনো বারণ। খেলতে ডাকলে ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারে না। বাড়ির বাইরে রোয়াকে বসে থাকে।
সন্ধেবেলা ঠাকুমা ঠাকুরের আসনের সামনে বসে নাম জপে, ঠাকুরের বই পড়ে। গুনগুন করে গান করে। গুনগুন শুনে উঠে এল অনাদি। খুব উৎসাহ নিয়ে বলল, “ঠাকুমা, আমি গাইতে পারি। শুনবে?”
ঠাকুমা অবাক।—“কে গাইবে? তুই?”
উৎসাহ নিয়ে আসন করে বসে গেল অনাদি। চোখ বুজে দরাজ গলায় সুর বসালে—
‘ওর নীল যমুনার জল
বল রে ওরে বল, কোথায় ঘনশ্যাম,
আমার কৃষ্ণ ঘনশ্যাম।’
এ যেন ম্যাজিক। গান যখন শেষ হল তখন মা, জেঠিমা পিছনে মোহিত হয়ে দাঁড়িয়ে। ঠাকুমার চোখে জল। গানের সুর যেন বুকে মোচড় দিয়ে গেছে। ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
“কী গান শোনালি রে অনাদি!” বলে ঠাকুমা ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।
অনাদি হেসে বলল, “রোজ তোমায় সন্ধে হলে শোনাব।”
জেঠিমা জিজ্ঞাসা করল, “কোথায় শিখলি বাছা? ভারি মিঠে গলা তোর। যেমন গলা তেমনি ভাব।”
সে বলল, “বাড়ির সামনে ভরত বাউলের আখড়া। ওখানে গিয়ে বসে থেকে থেকে শিখেছি। কেউ শেখায়নি।”
গানের সুর ভাসতে লাগল বাড়িতে। কখনও ‘ব্রজবাসী খেলে হোলি’, কখনও ‘সখী সে হরি কেমন বল’।
একদিন সুনন্দ দেখল জেঠিমাও গুনগুন করছে—‘প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম।’
গানের সুরে ঠাকুমা, মা, জেঠিমাকে কয়দিনের মধ্যেই জয় করে নিল অনাদি।
সুনন্দর বাবা একদিন খেতে বসে বলল, “দাদা, মোবাইলগুলো অনাদির হাত থেকে দূরেই রেখো। আমি দেখেছি খালি ঘরে হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। খুটখাট কীসব করছে। হাতটান থাকতে পারে।”
দেবুদা বলল, “এসব ছেলেকে কোনও বিশ্বাস নেই।”
তারপর থেকে কারও কিছু না পাওয়া গেলেই প্রথম প্রশ্ন—অনাদি নেয়নি তো?
সুনন্দর বাবা আবার আর একদিন রাত্রে খেতে বসে বলল, “আমাদের খুব সাবধান হতে হবে। শহরে প্রচুর ছেলেধরা, চোর এসেছে।”
জ্যাঠামশাই খেতে খেতে বলল, “কীরকম? কিছু কি শুনলি?”
চারদিক তাকিয়ে বাবা নীচু স্বরে জানাল, “আমার স্কুলের অঙ্কের মাস্টার ভুবনবাবুর বাড়িতে নতুন কাজের লোক রেখেছিল। সে ক’দিন বাদেই রাত্রিবেলা বাইরের দরজা খুলে রেখে নিজেদের চোরের দলকে ডেকে আনে। রাতারাতি সব খালি করে নিয়ে গেছে। এরকম নাকি পোস্ট অফিসের বড়োবাবুরও হয়েছে।”
দেবুদা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “তাহলে তো অনাদিকে নিয়েও ভাবতে হয়।”
সুনন্দ দেখে বাবা একদিন মাকে বলছে, “আমার মানিব্যাগ থেকে তুমি টাকা নিয়েছ?”
মা অবাক।—“না তো। কেন, কম পাচ্ছ?”
বাবা বলল, “ইলেকট্রিক বিলের টাকাটা পাচ্ছি না। অনাদি সব ঘর ঝাড় দেয়। জিজ্ঞাসা করব?”
মা-ই জিজ্ঞাসা করল, “অনাদি, তুই মেজোবাবুর ব্যাগ থেকে টাকা নিয়েছিস?”
সে কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “টাকা আমি নিই না।”
দেবুদা জানাল, ওর ব্যাগেও টাকা কম পড়ছে। ক্রমশ অল্পস্বল্প টাকাপয়সা সবারই মাঝে মাঝে কমে যেতে লাগল।
ঠিক দুর্গাপূজার কিছুদিন আগে সকালে হইচই পড়ে গেল। জেঠিমা হাপুস নয়নে কেঁদে মাকে, ঠাকুমাকে বলল, “আসন থেকে সোনার গোপাল চুরি হয়ে গেছে।”
অনাদি উনুনে আগুন দিচ্ছিল। ওকে হ্যাঁচকা টানে তুলে রাগত গলায় হাত ধরে বলল, “বল কোথায় রেখেছিস আমার সোনার গোপাল? এখুনি বার কর, না-হলে পুলিশে দেব।”
জেঠিমার চিৎকারে সবাই দুদ্দাড় করে নেমে এল। জ্যাঠামশাই জিজ্ঞাসা করল, “কে নিয়েছে?”
জেঠিমা অবলীলায় বলে দিল, “আর কে নেবে? বাইরের লোক আর কে আছে অনাদি ছাড়া?”
ও চুপ। দেবুদা সটান কষিয়ে মারলে এক চড়। ঘুরে গিয়ে কিছুটা দূরে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল অনাদি। জ্যাঠামশাই ভীষণ রেগে দু-হাতে ঝাঁকিয়ে বললেন, “তুই বুঝতে পারছিস কী করেছিস? একে চুরি বলে! বার কর কোথায় রেখেছিস।”
মা বলল, “তোর হাত কাঁপল না? গোপালের গায়ে হাত দিলি? নরকে যাবি।”
কাকা অপরাধীর মতো দূরে দাঁড়িয়ে বলল, “বড়ো ভুল হয়ে গেছে আমার।”
ঠাকুমা পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “দিয়ে দে অনাদি। গোপালকে ফিরিয়ে দে। চাইলে টাকা নে। আমার শাশুড়ির গোপাল। দিয়ে দে।”
অনাদি মাথা নীচু করে রইল।
জ্যাঠামশাই এমন রেগে গেছে যে থানায় ফোন করতে যাচ্ছে। ঠাকুমা বলল, “ওকে একটু সময় দে। হয়তো বুঝতে পারেনি।”
ঠিক হল কাল অবধি ও সময় পাবে। না বললে সোজা থানায়।
দেবুদা বলল, “আমি বলেছিলাম না ছেলেটা সন্দেহজনক? দেখো।”
পরদিন সকাল থেকে অনাদিকে আর পাওয়া গেল না। সদর খোলা, অনাদি নেই।
সুনন্দর বাবা বলল, “দেখলে তো, চোর তাই পালিয়ে গেল।”
গল্পটা এই অবধি খুব চেনা ছিল। কিন্তু আবার কিছুদিন বাদে লোকজনের টাকাপয়সা ব্যাগ থেকে কমতে লাগল। তখনই পালটে গেল সব।
একদিন রাত্রিবেলা জ্যাঠামশাইয়ের বালিশের নীচ থেকে চাবি নিয়ে দেরাজ খুলতে গিয়ে দেবুদা ধরা পড়ে গেল। দেবুদা প্রথমে বলল কী একটা খুঁজতে এসেছিল। লজ্জার একশেষ। ছোটো পিসিকে ফোনে জানানো হল। বাবা, জ্যাঠামশাই দুজনেই খোঁজখবর নিয়ে জানল ইদানীং জুয়া খেলার ঝোঁক হয়েছিল দেবুদার। তাতেই অনেক টাকাপয়সার দরকার পড়ছিল। জ্যাঠামশাই মত দিল ওকে পিসির কাছেই ফেরত পাঠানোর। দেবুদা চলে গেল। সুনন্দরও মনখারাপ হয়ে গেল। সন্ধেবেলা ক্যারম, লুডো খেলার সাথী ছিল দেবুদা।
***
অনাদি চলে যাবার দু-মাস বাদে সুনন্দ মায়ের সঙ্গে বর্ধমানে মামার বাড়ি থেকে ফিরছে। ট্রেন আধঘণ্টা দেরি। প্ল্যাটফর্মে সুনন্দ মায়ের সঙ্গে বসে লোকজন দেখছে। লোক আসছে, যাচ্ছে। দূরে গোল করে অনেক যাত্রী স্টেশনের কোন এক গায়ককে ঘিরে ধরে গান শুনছে। সুনন্দ ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে অবাক। এ তো অনাদি গান গাইছে! সঙ্গে একজন অচেনা মানুষ হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে। অনাদির হাতে অ্যাসবেস্টসের কটকটি। সেটা বাজিয়ে দরাজ গলায় দাঁড়িয়ে গাইছে—‘এমন মানুষ পেলাম নারে যে আমায় ব্যথা দিল না।’ গায়ে মলিন জামা, একটা ময়লা প্যান্ট। আরও রোগা হয়ে গেছে অনাদি। আরও শুকিয়ে গেছে মুখটা।
গান শেষ হলে উঠে এল হাসিমুখে। কাঁধে হাত রেখে বলল, “ছোটো দাদাবাবু, তুমি এখানে?”
সুনন্দ অনেক করে বলল, “চলো, বাড়ি ফিরে চলো। তুমি জানো, দেবুদাও চলে গেছে? দেবুদা টাকা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে।”
ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।—“তাই? তাহলে এবার সিঁড়ি-ঘরটা খুঁজে দেখো।” বলে আর দাঁড়াল না। সঙ্গের লোকটিকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। যাবার আগে বলল, “আমি ভালো আছি ঠাকুমাকে বোলো।”
সুনন্দ বাড়ি ফিরেই দৌড়ল সিঁড়ির তলায়। যেখানে অনাদির বিছানা, ব্যাগ ছিল। তার সঙ্গে বাড়ির যাবতীয় ফেলে দেওয়া জিনিসের ছড়াছড়ি। হাত চালিয়ে তোশক, বালিশ, পুরোনো বইখাতার পিছনে হাত বাড়াতেই হাতে লাগল মূর্তিটা। উত্তেজনায় টানটান হয়ে বার করে আনল চকচকে ছোট্ট কৃষ্ণের মূর্তি। অনাদি নিয়েও যায়নি, বিক্রিও করেনি। গায়ে একটা কাগজ জড়ানো। সুনন্দ খুলে ফেলল কাগজটা। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা—‘চুরি বাঁচাতেই লুকানো।’ দাঁড়িয়ে পড়ল সুনন্দ। তাহলে কার হাত থেকে বাঁচাতে অনাদি এখানে রেখেছিল?
সবাই একে একে পালটে গেল। প্রথমে জ্যাঠামশাই বলল, “আমি প্রথম থেকেই বলেছি ও চোর নয়।”
ঠাকুমা বলল, “কৃষ্ণ কখনও নিজেকেই চুরি করতে পারে?”
বাবা বলল, “বুঝলাম না মা। কী রহস্য করো?”
“ওর নাম কী?”
জেঠিমা বলল, “অনাদি। কেন জিজ্ঞেস করছেন মা?”
“অনাদি মানে কী?”
জেঠিমা বলল, “এক মিনিট।” বলে মোবাইল নিয়ে গুগল হাতড়াতে থাকে।
ঠাকুমা বলল, “দেখার দরকার নেই। ওটা একশো আট নামের একটা।”
“ওহ্!” মোবাইল ঘাঁটা বন্ধ।—“হ্যাঁ, এখানেও তাই দেখাছে।”
মাস ছয়েক পর এক শীতের সকালে ভোরবেলা দরজা খটখট। নতুন কাজের মাসি ঠাকুমাকে ডাকল—“আপনাকে কেউ ডাকছে বাইরের দরজায়।”
ঠাকুমা প্রথমটা চিনতে পারেনি। বড়ো বড়ো চুল। মুখে একটু একটু দাড়ি। একটা হাফ প্যান্ট আর গায়ে একটা জীর্ণ চাদর। অনাদি দাঁড়িয়ে। সঙ্গে আরও একজন, সঙ্গে হারমোনিয়ম। ঠাকুমা চোখের জল মুছে হাত ধরে উঠোনে টুলে বসাল।—“তুই চলে গেলি। এখন কে আমার গোপালকে গান শোনাবে বল? গোপাল যে বড়ো গান ভালোবাসে।”
সবাই একে একে এসে দাঁড়াল চোখ মুছতে মুছতে।
বাবা প্রথম বলল, “কী রে, কী মনে করে?”
জ্যাঠামশাই বলল, “এতদিন পরে আসতে হয়? মা যে বড়ো ব্যাকুল হয়ে আছে তোর জন্য। বলেছিল ঠিক তুই আসবি একদিন।”
মা বলল, “কেমন আছিস? বড়ো শুকিয়ে গেছিস রে।”
ঠাকুমা বলল, “তুই চলে গেলি কেন? তুই তো চোর নোস। আমার গোপাল তো ফেরত পেয়েছি।”
অনাদি চুপ।
ঠাকুমা পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “রাগ করিস না। আমরা ভুল বুঝেছিলাম তোকে।”
জ্যাঠামশাই, বাবাও বলল, “তুই আমাদের কাছেই থাক।”
নীচু হয়ে উঠোনে হাতের সামনে রাখা কাঠি দিয়ে আঁকিবুকি কাটছিল অনাদি। ওর সঙ্গের হারমোনিয়ম বাজানোর মানুষটি বলল, “আসলে এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। ও বললে একবার দেখতে চায় বাড়িটা।” তারপর একটু থেমে বলল, “বাবুরা এত করে যখন বলছে তখন তুই থেকে যা অনাদি।”
সুনন্দর মা ততক্ষণে দু-প্লেট নিমকি আর জল নিয়ে এসেছে। বলছে পিঠে হাত দিয়ে, “এটা খেয়ে নে।”
দুজনে নিমকি আর জল খেল। উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমে ঠাকুমা, তারপর জ্যাঠামশাই, বাবা, কাকা সবাইকে প্রণাম করে অনাদি বলল, “ঠাকুমা, আমি বরং মাঝে মাঝে আসব। তোমাকে গান শুনিয়ে যাব। তবে আর থাকব না। একবার রোজগার করতে রাস্তায় নেমেছি, এই ভালো।”
জ্যাঠামশাই বলল, “তুই আমাদের ভুল বোঝাটা তাহলে মনে রেখে দিলি?”
কিছু বলল না অনাদি। ওরা রাস্তায় নামল। বাড়ির সবাই অনুতপ্ত চোখে তাকিয়ে রইল। উঠোন জুড়ে নীরবতা নেমে এল। কাকা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঠাকুমাকে বলল, “মা, এটা অনাদি ঠিকই করেছে। কাউকে চোর হিসেবে দাগিয়ে দিলে তাকে যে-পরিমাণ অপমানে কলুষিত হতে হয়, তার কাছে ক্ষমা চাইলেও অপমানে দগ্ধ হওয়ার জ্বালা তো ফেরত নেওয়া যায় না। এরা টাকার থেকে ইজ্জতকে বেশি বড়ো মনে করে। অথচ দেখো, এখনও পুরো পাড়া জানে ও চোর।”
অনাদি আর ফিরে আসেনি। একটা ছোট্ট ছেলের না ফিরে আসার ধাক্কা ছিল বহুদিন। বাবা, জ্যাঠামশাই কয়েকদিন চুপ করে গেছিল। হ্যাঁ, ওদের জন্যেই অনাদিকে ঘর ছেড়ে পথে নামতে হয়েছিল। আর কোনও ছেলেকে কাকা আর আনেনি কোলিয়ারি থেকে। ঠাকুমার নিষেধ ছিল বাচ্চা ছেলে কাজের জন্যে আনা।
অনেকদিন পরে কখনও কোনও লোকাল ট্রেনে মামার বাড়ি যাবার সময় ট্রেনে পাশের বগিতে বাউল গান শুনে সুনন্দ ছুটে গেছে—অনাদি নাকি? যদি হয় তবে একবার জড়িয়ে ধরবে। ছাড়বে না। না, অনাদিকে আর কেউ দেখেনি। ও বোধহয় অন্য দেশে বাসা বেঁধেছে। অন্য কোথাও গান শোনাচ্ছে। ওর গাওয়া সেই গানটা মাঝে মাঝে বাউলরা ট্রেনে গায়।—
তুমি ভেবেছ কি মনে এই ত্রিভুবনে
তুমি যাহা করে গেলে কেহ জানে না
বারে বারে আর আসা হবে না।
বড়ো উদাস লাগে তখন।
ছবি: সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু