উপন্যাস
15% OFF * FREE SHIPPING
উপন্যাস
বুকের মাঝখানে সজোরে একটা ধাক্কা এসে লাগে অনন্তর। সিঁড়ির শেষ ধাপে একটা পা রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি, আর একটা পা বাড়িয়ে ছিলেন নীচের উঠোনের দিকে। হাতের পাঞ্জার তলার দিকটা দিয়ে অনন্তর বুক লক্ষ্য করে একটা ধাক্কা মারে ছায়ামূর্তি। পা আর উঠোনে নামানো হয় না বৃদ্ধের। আজীবনের চেনা চণ্ডীতলা, মস্ত নিমগাছটা, দূরে বালিয়ালদের বসত ভিটা যেন চোখের সামনে দুলে ওঠে। টাল সামলাতে না পেরে আছড়ে পড়েন অনন্ত আচার্য।
বুমা ব্যানার্জী দাস
সেপ্টেম্বর, ২০১৭।
কাঁকরোল গ্রাম, আমতা, হাওড়া।
শেষরাত। গ্রাম একেবারে নিঝুম। হালকা ঠান্ডা একটা হাওয়া সারা গ্রামটাকে যেন আরামের চাদরে ঢেকে রেখেছে। মা আসছেন, তাই বোধ হয় সবাই এমন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। গত কয়েক মাস চণ্ডীতলায় কুপি জ্বেলে এই ভোররাতেও কাজে লেগে থাকতেন আচার্যি মশাই। গ্রামে বিজলি বাতি অনেকদিন হল এসেছে, কিন্তু এই ভোররাতের দিকে কোনোদিন বিদ্যুৎ থাকে না। গতকাল মায়ের চক্ষুদান হয়ে যাওয়ার পর আজ বড়ো শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন মানুষটা। বয়স তো কম হল না, আশি ছুঁইছুঁই। নেহাত বালিয়াল পরিবারের কর্তা আর কারও হাতে মায়ের মূর্তির ভার দিতে নারাজ, তাই কাঁপা কাঁপা হাতে আজও মায়ের রূপটি ধীরে ধীরে ফুটিয়ে তোলেন অনন্ত আচার্য। তবে নাতি তাঁর তৈরি হয়ে গেছে, হয়তো পরের বছর থেকে সে একাই করতে পারবে সব। আচার্যি মশাইয়ের ছেলে বংশের ধারা বজায় রাখেনি, কলকাতায় কী যেন কাজ করে। গ্রামে আসেও না বড়ো একটা। তবে নাতিটাকে মনের মতো করে তৈরি করেছেন আচার্যি মশাই। তাঁরা কিন্তু কুমোর নন, জাতিতে ব্রাহ্মণ। তাও বংশপরম্পরায় মূর্তি গড়ার কাজ করে আসছেন আজ কত বছর ধরে তা ভালো মনেও নেই অনন্ত আচার্যের। বাপ-পিতামহের মুখে শুনেছিলেন, তাঁরা নাকি আসলে এই প্রদেশের লোক নন।
ঘুমের ঘোরে পাশ ফেরেন অনন্ত আচার্য। ঘুমটা পাতলা হয়ে আসছে। দশমী পর্যন্ত এই চণ্ডীতলাই তাঁর বাসস্থান হয়ে দাঁড়ায় বরাবর। দশমীর দিন মাকে রওনা করিয়ে দিয়ে তবে বাড়ি ফেরেন তিনি। বালিয়াল পরিবারে এই ক’টা দিন মা দশভুজার পুজোর পাশাপাশি এই গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা জয়চণ্ডীরও পুজো ধুমধাম করে হয়। এই চণ্ডীতলা তিনশো বছরেরও বেশি পুরানো। অবিশ্যি আগের জৌলুস কোথায় আর। এককালে আশেপাশের কিছু না হোক পাঁচটা গ্রামের লোক পাত পেড়ে খেত ক’টা দিন। কলকাতা থেকে যাত্রাদল আসত। যুবক অনন্তর নিজের চোখে দেখা এসব। আজকাল আর অতটা হয় না। তবু নেই নেই করেও যা হয়, সারা গ্রাম তা নিয়ে মেতে ওঠে ক’টা দিন। এই চণ্ডীতলা নিজের হাতে সাজান তিনি। পিতলের বড়ো বড়ো পিলসুজ বেরোয়, আর বেরোয় সেই বিশেষ জিনিসটা বা জিনিসগুলো। আজ চারশো বছর বাদেও একটুও মলিন হয়নি। বছরে এই একবারই বের করে সে-সব নিজের হাতে পালিশ করেন আচার্যি মশাই। যেমন করতেন তাঁর পিতাঠাকুর, তারও আগে তাঁর ঠাকুরদাদা। তাঁদেরই এক পূর্বপুরুষের নিজের হাতে তৈরি ওগুলো। বংশপরম্পরায় তাঁদের কাছেই গচ্ছিত থেকে গেছে। আর থেকে গেছে সেই অদ্ভুত শিহরন জাগানো কাহিনি, আর…
কী একটা আওয়াজে ঘুমের চটকাটা একেবারেই ভেঙে যায় অনন্ত আচার্যের। চণ্ডীতলার পেছনের দিকে ধুপ করে কী একটা পড়ল না! এ-গ্রামে চোরের উপদ্রব নেই। তবে বলা তো যায় না। দাওয়ায় উঠে বসেন অনন্ত। দাওয়ার ডানদিকে মা জয়চণ্ডীর বেদি। সেখানে এখনও অন্ধকার জমে রয়েছে। বাঁদিকে মা দশভুজার প্রায় শেষ হয়ে আসা একচালা মূর্তি। সেখানে টিমটিম করে একটা মঙ্গল প্রদীপ জ্বলছে। সামান্য একটু আলো ছড়িয়ে চারদিকের অন্ধকার যেন আরও ঘন করে তুলেছে সেটা। আকাশ আবছা হয়েছে হয়তো একটু, কিন্তু দেখার জন্য তা যথেষ্ট নয়। বৃদ্ধের ক্ষীণ দৃষ্টি এই অন্ধকার কিছুমাত্র ভেদ করতে পারে না। ওই আবার যেন আওয়াজটা হল।
“সমু, ও সমু!”
শুকনো গলায় নাতি সুমন্তকে ডেকেই ভুলটা বুঝতে পারেন অনন্ত। সমুকে কাল রাতে নিজেই বাড়ি পাঠিয়েছেন তিনি। সমুর মা, তাঁর পুত্রবধূ গত হয়েছে বছর দু-এক আগে। ছেলে তো থেকেও নেই। আগে তাও আসত মাঝে মাঝে, বউটা চলে যাওয়ার পর থেকে আর একবারও আসেনি। এই বুড়ো আর কচি ছেলেটার সংসার তাদের। তাই মাঝে মাঝে সমু গিয়ে উঠোন ঝাঁট দিয়ে গাছ ক’টাতে একটু জল-টল দিয়ে আসে আর কি। চারটে বাড়ি পরেই তাঁদের আস্তানা।
আবার চমকে ওঠেন অনন্ত। একেবারে পাশেই যেন পায়ের শব্দ হল কার। কর্তাবাবুকে ডাকবেন নাকি একবার? কিন্তু এই ভোররাতের গভীর ঘুম কি আর তাঁর এই দুর্বল ডাকে ভাঙবে? মূল বাড়িটা চণ্ডীতলা থেকে আলাদা, এখনও অন্ধকারে ডুবে আছে। হঠাৎ খুব অসহায় লাগে বৃদ্ধের। মা জয়চণ্ডীর গলার বারোমেসে সোনার হারটা নিতে চোর আসেনি তো? এই গ্রামের কারোর এত সাহস হবে কি?
“কে? কে ওখানে? সামনে এসো বলছি!”
অনন্ত এবার উঠে দাঁড়ান। চণ্ডীতলার বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকেন। শেষ ধাপটাতে পা রাখতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে অনন্তের। তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে খুব কাছে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।
“কে?”
ভয়টা কাটাবার চেষ্টা করতে করতে বলেন অনন্ত। আজ যেন অন্ধকারটা বড্ড বেশি। তাও সামনের নিমগাছটার নীচে কিছু একটা নড়ছে বলে মনে হল।
আচমকা গলার কাছে ঠান্ডা, ধারালো কিছুর ছোঁয়া লাগে। শিউরে ওঠেন তিনি।
“জিনিসটা কোথায়?”
সাপের মতো হিসহিসে একটা স্বর কানের কাছে বলে ওঠে। চোখের কোণ দিয়ে আবছা একটা চেহারা চোখে পড়ে অনন্তর। মুখ মনে হয় কালো কাপড়ে ঢাকা। বুকের ভিতরে যেন ঢেঁকির পাড় পড়তে থাকে তাঁর। চণ্ডীতলার দাওয়ার প্রান্ত থেকে আসা অতি ক্ষীণ প্রদীপের আলোয় এর থেকে বেশি কিছু দেখা সম্ভব নয়।
“ক-ক-কীসের কথা বলছ? কে তুমি? আমি চেঁচিয়ে কর্তাবাবুকে ড-ড-ডাকব কিন্তু!”
অনন্ত টের পান, তাঁর হাঁটু দুটো কাঁপছে।
“চালাকির চেষ্টা করবি না একদম। ভালোয় ভালোয় বলবি, না তোর আদরের নাতিকে ধরে আনব?”
চিবিয়ে চিবিয়ে কর্কশ গলায় বলে ছায়ামূর্তি। অনন্ত তাঁর ডানহাতের কব্জির কাছে একটা চাপ অনুভব করেন। খসখসে একটা হাত তাঁর কব্জিটা ধরেছে, ধীরে ধীরে উলটোদিকে মুচড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অনন্ত বোঝেন, এর সঙ্গে গায়ের জোরে কোনোভাবেই তিনি পারবেন না।
“আমার নাতিকে এর মধ্যে টানছ কেন, সে কিছুই জানে না।”
গলা স্থির রাখার চেষ্টা করলেও চোখের কোণ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে আসে অনন্তের। এ কোন বিপদে ফেললেন তাঁকে মা জয়চণ্ডী!
“তবে দেয়ালা না করে আসল কথা বল ঘাটের মড়া।”
বুকের মাঝখানে সজোরে একটা ধাক্কা এসে লাগে অনন্তর। সিঁড়ির শেষ ধাপে একটা পা রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি, আর একটা পা বাড়িয়ে ছিলেন নীচের উঠোনের দিকে। হাতের পাঞ্জার তলার দিকটা দিয়ে অনন্তর বুক লক্ষ্য করে একটা ধাক্কা মারে ছায়ামূর্তি। পা আর উঠোনে নামানো হয় না বৃদ্ধের। আজীবনের চেনা চণ্ডীতলা, মস্ত নিমগাছটা, দূরে বালিয়ালদের বসত ভিটা যেন চোখের সামনে দুলে ওঠে। টাল সামলাতে না পেরে আছড়ে পড়েন অনন্ত আচার্য। কাঁধটা গিয়ে পড়ে সিঁড়ির পাশে রাখা পিতলের বিশাল মঙ্গল কলসের উপর। তার পাশে ডাঁই করে রাখা ছিল একরাশ পুজোর বাসন। সেখান থেকে সম্ভবত একটা কাঁসার বাটি ছিটকে গিয়ে পড়ে কলতলার শান বাঁধানো জমিতে। উৎকট ঠং ঠং আওয়াজে কেঁপে ওঠে ভোররাতের নিস্তব্ধতা। সিঁড়ির শেষ ধাপে মাথাটা সজোরে ঠুকে যায় অনন্তর। ছড়িয়ে থাকা পা দুটো শেষবারের মতো একবার জমি আঁকড়ে ধরতে চায় যেন। মঙ্গল কলস থেকে গুবগুব করে জল বেরিয়ে উঠোন ভেজাতে থাকে। আর তার সঙ্গে মিশে যায় ক্ষীণ একটা রক্তের ধারা। ছায়ামূর্তি একটা হতাশার ভঙ্গি করে আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। কালো ঢাকার আড়ালে তার মুখে ফুটে ওঠে চরম আক্রোশ।
বালিয়াল পরিবারের বর্তমান কর্তা শিশির বালিয়াল। ষাট পেরিয়েছেন এই কয়েক বছর আগে। তবে স্বাস্থ্য এখনও অটুট। এই পুজোর সময়ে তো দশটা মানুষের কাজ একাই সামলে দেন। গ্রামের বসত ভিটায় থাকেই-বা আর কয়জন। তিনি, তাঁর স্ত্রী শিবানীদেবী আর দূরসম্পর্কের কিছু আত্মীয়স্বজন। তাঁর দুই ছেলে চাকরিসূত্রে কলকাতায়। বছর দু-এক হল মেয়ে বীথিকার বিয়ে হয়েছে ওড়িশায়। শিশিরবাবুরা দুই ভাই। তিনিই বড়ো। ছোটো ভাই মনোজ সংসার করেননি, কাঁকরোল ছেড়ে বহুদিন আগে চলে গেছেন। তাঁর নাকি একজায়গায় মন টেকে না। কোনো-কোনো বছর পুজোর সময় কাঁকরোলে উপস্থিত হন। খুব ছোটো বয়সে বাবাকে হারিয়ে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব শিশিরবাবুর উপরে এসে পড়েছিল। মা তাঁর উপরেই সম্পূর্ণ নির্ভর করতেন। তিনিও গত হয়েছেন বছর পাঁচেক আগে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে অন্য রাজ্যে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না শিশিরবাবুর। অবিশ্যি জামাতা অভিজিৎ খুবই ভালো। আগের বছর পুজোয় এসে খুব খানিকটা হইহই করে গিয়েছিল। শিশিরবাবুর দুই পুত্র, পুত্রবধূ, তাদের দুজনের গুটি পাঁচেক ছেলেমেয়ে, বীথিকা-অভিজিৎ—সবাই মিলে জমজমাট করে রাখে পুজোর ক’টা দিন। তাছাড়া জ্ঞাতিরাও কেউ কেউ আসেন। পঞ্চমী থেকে এক এক করে শুরু হবে লোকজন আসা। পুজোর পাশাপাশি তাঁদের সবার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার গুরুদায়িত্বও বালিয়াল কর্তার উপর। যদিও খুব আনন্দের সঙ্গেই এ-দায়িত্ব পালন করেন তিনি, তাও এই ক’টা দিন পরিশ্রম হয় খুবই। যত ছোটো করেই হোক না কেন, দুর্গাপূজা মুখের কথা নয়। ‘উনকুটি’ চৌষট্টি রকম জিনিস লাগে। তার উপর অষ্টমীর দিন সারা গ্রাম পাত পেড়ে ভোগ খায়। আগে অবশ্য পুজোর সব ক’টা দিনই সারা গ্রামের লোককে পেট ভরে খাওয়াতেন তাঁরা, আজকাল আর পেরে ওঠেন না। সে রমরমা আর নেই। এই বছর একশো আঠারো বছরে পা দেবে বালিয়াল বাড়ির পূজা।
এমনিতেই বরাবর বেশ ভোরবেলায় ঘুম ভাঙে শিশিরবাবুর। পুজোর আগের ক’টা দিন নানা চিন্তায় ঘুম প্রায় হয়ই না। আজও হালকা তন্দ্রার মধ্যে কতরকম চিন্তা ঘুরছিল মাথায়। নাতিনাতনিদের অনেকদিন পর দেখবেন। স্ত্রী শিবানীদেবীর অনেক দিনের ইচ্ছা পুজোর সময় গ্রামে যাত্রা হোক, কলকাতার নামি কোনও দল আসুক। এবারেও পূরণ করতে পারলেন না সেটা। নানা চিন্তার মধ্যে ঘুমটা পাতলা হয়েই আসছিল, হঠাৎ বিশ্রী একটা ঠং-ঠং-ঠঙাৎ আওয়াজে শিশিরবাবু চমকে উঠলেন। চাপা আর্তনাদ করে শিবানীদেবীও উঠে বসেছেন পাশে।
“চণ্ডীতলার দিক থেকে এল না আওয়াজটা?” শিবানীদেবীর মন হঠাৎ ভয়ানক কু ডেকে ওঠে।
“আরে আচার্যি মশাই আছেন তো! বুড়ো হাড়ে এখনও অনেক জোর। একশো পার করবেন হেসে-খেলে দেখে নিও।” আশ্বাস দেন শিশিরবাবু।
“তা হোক। তুমি একবারটি যাও।” অনুনয় করেন শিবানীদেবী।
চণ্ডীতলায় এখনও বেশ অন্ধকার। দূর থেকে টিমটিম করে জ্বলা মঙ্গল-প্রদীপটা চোখে পড়ে শিশিরবাবুর। ভোরের আবছা আলো ঝাঁকড়া বকুলগাছটা ভেদ করে খুব ক্ষীণভাবে এসে পড়েছে চণ্ডীতলার দাওয়ার নীচে। কী যেন একটা পড়ে আছে না ওখানে? ওটা কোনও মানুষের আকার কি? একরকম দৌড়ে পৌঁছে যান শিশিরবাবু। হা ঈশ্বর, এ যে আচার্যি মশাই! সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গেছেন নাকি? হাঁপাতে হাঁপাতে অনন্ত আচার্যের মাথাটা দুই হাতে তুলে ধরার চেষ্টা করেন শিশিরবাবু। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে, মঙ্গল কলস থেকে গড়িয়ে পড়া জল আর রক্ত মিশে ছড়িয়ে পড়ছে উঠোন জুড়ে। চোখ বন্ধ অনন্তের। তবে প্রাণ এখনও ধুকধুক করছে বোঝা যায়।
“আচার্যি মশাই, কিচ্ছু হবে না আপনার। আমি এসে গেছি।” গলা কাঁপতে থাকে শিশির বালিয়ালের।
অস্ফুটে কিছু একটা বলেন অনন্ত। এত ক্ষীণ, কিছু শোনা যায় না।
“কিছু বলছেন আচার্যি মশাই?”
একেবারে তাঁর মুখের কাছে কান নিয়ে যান শিশিরবাবু। শরীরের অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে বাঁহাতটি তুলে ধরেন অনন্ত। দাওয়ার একদিকে দেখান। শিশিরবাবু মুখ তুলে দেখেন, সেখানে দাঁড় করানো তাঁদের পরিবারের বিশেষ প্রদীপের সারি। ওগুলো এখনো সাজানো হয়নি—তাই কি বলতে চাইছেন আচার্যি মশাই?
আবার অস্ফুটে কিছু বলেন অনন্ত আচার্য।
“কী, বলুন?” কান আরও কাছে নিয়ে যান শিশিরবাবু। টেনে টেনে বলা শব্দগুলো বুঝতে চেষ্টা করেন।
“শুদ্ধ অনন্ত আমার সাথে
হরি নিরাকার হয়,
হরিকে দেখিয়া হরি
হরিতে লুকায়।”
মাথাটা একদিকে ঢলে পড়ে অনন্ত আচার্যের। ভোরের আলো অবশেষে এসে পড়ে বালিয়ালদের চণ্ডীতলার দাওয়ার উপর।
***
১৬০০ খ্রিস্টাব্দ, গোয়া।
সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। হঠাৎ দেখলে মনে হয় ঝড় বা বড়ো ধরনের কোনও বিপর্যয়ে গোটা পাড়াটা তছনছ হয়ে গেছে। ধনী পাড়া না হলেও মোটামুটি সচ্ছল পাড়া, তাতে সন্দেহ নেই। এখন ভেঙে পড়া দেওয়াল, ছড়ানো-ছিটানো গৃহস্থালির জিনিসপত্রের মাঝে হতভম্ব হয়ে বসে আছে কিছু পরিবার। কেউ আলো জ্বালেনি আজ। আলো জ্বেলে দেখবেটাই-বা কী। পাকশালার চুলা পর্যন্ত আস্ত রাখেনি অত্যাচারী ভিনদেশিরা। বাচ্চাগুলোকে কোনোক্রমে এক মুঠো করে চিঁড়ে ভিজিয়ে খাওয়ানো হয়েছে। গলা ছেড়ে কাঁদতেও যেন সাহস নেই কারও। তাদের এই শান্তিপূর্ণ পাড়ায় এরকম বিপদ কোনোদিন আসেনি। যে-যার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে চিরটা কাল।
হঠাৎ ভেজা চোখ দুটো মুছে উঠে দাঁড়ায় একজন। খাড়া শক্ত চেহারাটা অপমানে, দুঃখে যেন ঝলসে গেছে।—”চলো খুড়ো, এ-দেশে আর থাকা নয়।”
পাশে মাথা নুইয়ে বসে থাকা বৃদ্ধ ক্লান্ত চোখ দুটি তুলে তাকায়। আবছা অন্ধকারে সে-চোখের দৃষ্টি যেন আরও অন্ধকার ছড়িয়ে দেয়। ফিসফিসে গলায় বলে, “কোথায়-বা যাবি বিরূপাক্ষ?”
“যেদিকে দু-চোখ যায়। যতদিন এই হাত দুটো আছে, খাটার শক্তি আছে—ততদিন চিন্তা কীসের? এখানে থেকে কী হবে খুড়ো? ওই ভিনদেশিরা আমাদের দেশে এসে আমাদেরই অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। নিজেদের ধর্মাচার পালন করার অধিকার পর্যন্ত নেই আমাদের। জোর করে ধর্মান্তরিত করছে, তাও চুপ থেকেছি আমরা। গোপনে নজর রাখছে আমরা ঘরের ভিতর ওদের লুকিয়ে নিজেদের ধর্মের কোনও আচার পালন করছি কি না।”
গলা চড়ে গেছিল বিরূপাক্ষের। বৃদ্ধ কাঁপা হাতে তার কাঁধের কাছটা আঁকড়ে ধরে বলে, “এভাবে বিপদ ডেকে আনিস না। ওদের শক্তি বেশি। শুনেছি অনেক গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে ওই পর্তুগিজ মিশনারিরা। গ্রামের শিশু আর নারীদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে। মা-বাপকে বেঁধে রেখে তাদের সামনে সন্তানকে পুড়িয়ে মেরেছে। ওরা পারে না এমন কাজ নেই। আমরাও ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি বিরূপাক্ষ।” দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা নামে বৃদ্ধের।
“তুমি কি ভাবছ চুপচাপ মেনে নিলে ওদের অত্যাচার কমে যাবে খুড়ো? পর্তুগিজরা আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি সমস্ত তিল তিল করে ধ্বংস করে দিতে চাইছে বুঝতে পারছ না? পিতার সম্পত্তিতে অধিকার নাকি নেই আমাদের, ধর্মান্তরিত না হলে আমরা কাজ পাব না কোনও। চেয়ে দেখো তোমার চারপাশে খুড়ো, আমরা কত পুরুষ ধরে বংশানুক্রমে দীপ বানাই, মূর্তি গড়ি। এমন আকাশদীপ আর কোথাও বানানো হয় না এই দেশের। সারাদেশের কত মন্দির সেজে ওঠে এই দীপে। আর আজ তার চুরমার হওয়া টুকরোগুলো আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। আমরা তো আর কোনও কাজ শিখিনি খুড়ো। আমাদেরই দেশে এসে আমাদের সঙ্গে এই ঘৃণ্য আচরণ আর কতদিন মেনে নেব বলো তো? বলছ ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করো—পারবে রক্ষা করতে তাদের?” ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে বিরূপাক্ষ। ক্রোধে তার মুখ রক্তবর্ণ।
দুই হাতে মুখ ঢেকে অনেকক্ষণ বসে থাকে বৃদ্ধ। তারপর বলে, “আমার এই শরীর আর চলছে না রে। তবে তোকে আর আটকাব না। তুই যা, যদি কোথাও গিয়ে বাঁচতে পারিস ভালোভাবে—যা। তোর সঙ্গে যারা যেতে চায় নিয়ে যা তাদের।”
বৃদ্ধকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বিরূপাক্ষ। সে সংসার পাতেনি এখনও, বাপ-মা বহুদিন হল নেই। এই খুড়োই তাকে মানুষ করেছে, নিজের বলতে আর কেউ নেই তার। তবু সে যাবে। এখানে কীটপতঙ্গের জীবন সে কাটাতে পারবে না। যদি কোথাও পায়ের নীচে শক্ত জমি পায় আবার, তখন খুড়োকে এসে নিয়ে যাবে তার কাছে। সঙ্গে কিছু নিয়ে যাওয়ারও নেই। যেটুকু ছিল, পর্তুগিজরা তার কিছুই বাকি রাখেনি।
***
১৬০১ খ্রিস্টাব্দ, রাজবলহাট, হুগলী।
কতদিন ধরে হাঁটছে বিরূপাক্ষ সে নিজেও জানে না আর। কত শহর, নদী, গ্রাম পার হয়ে এল। কোথাও যেন মন টিকল না তার। মাঝে মাঝে কোথাও থেমেছে, থেকেছে হয়তো কয়েক মাস। মূর্তি বানিয়ে, মন্দিরের দীপ বানিয়ে পেট চালিয়েছে; আবার পথে বেরিয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও বাংলা ভাষা জানা মানুষের সঙ্গেও দেখা হয়েছে—মনে হয়েছে তাহলে এটাই শেষ, এখানেই থেকে যাওয়া যাক। কিন্তু কীসের টানে যেন থাকতে পারেনি বেশিদিন। একেই কি পথের নেশা বলে, না জন্মভূমি ছেড়ে এসে কোথাও আর সেই টানটা ঠিক পাওয়া যায় না। তার সঙ্গে যে ক’জন দেশ ছেড়েছিল, তারা সবাই কোথাও না কোথাও নতুন করে সংসার পেতে বসে গেছে আবার। শুধু সে এখনও যাযাবর। বিপদেও পড়েছে নানারকম। কখনও খাবারদাবার, জমানো টাকাপয়সা যা ছিল সর্বস্ব চুরি গেছে; কখনও দিনের পর দিন হয়তো খাওয়া জোটেনি, মাথার উপর খোলা আকাশ নিয়ে পড়ে থেকেছে গাছতলায়। কখনও জ্বরে গা পুড়ে গেছে, তবু আশ্রয় মেলেনি।
মাঝে মাঝে খুড়োকে মনে পড়ে তার। সে-বুড়ো এখনও বেঁচে আছে কি না কে জানে। রাস্তা খুঁজে সেখানে কি আর কোনোদিন ফিরতে পারবে সে? তাদের কেউ এখন তাকে দেখলে মনে হয় চিনতে পারবে না আর। মাথায় জটা পড়েছে, গায়ের রঙে অন্তত তিন পোঁচ কালি। চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। সে বিরূপাক্ষ আচার্য, ব্রাহ্মণ হয়েও মূর্তি গড়ে, আকাশপ্রদীপ বানায়, মন্দিরে লাগানোর নানাধরনের দীপ বানায় শুনে কেউ কেউ অবাক হয়েছে। বিরূপাক্ষ হেসেছে শুনে। ও আবার কী কথা? সে যা করতে শিখেছে, তাই করে।
আজ প্রায় দিন তিনেক খাওয়াদাওয়া জোটেনি কিছু। পা আর চলছে না যেন। অনেকক্ষণ কোনও মানুষের দেখাও পায়নি। এই জঙ্গুলে জায়গাটা পার না হলে মনে হয় না মানুষের চিহ্ন পাবে বলে। এই জঙ্গলে যদি সে পড়ে যায় জ্ঞান হারিয়ে তবে কেউ জানতেও পারবে না। দিন-মাস-বছরের হিসেব গুলিয়ে গেছে তার। কতদিন এভাবে হাঁটছে সে? ছয় মাস? নাকি বছর ঘুরে গেছে? তেষ্টায় গলা কাঠ হয়ে গেছে, সেই ভোরবেলা রাস্তায় নদী পেয়েছিল একটা। এখন বিকেল। মাথার মধ্যে কেমন ঘোর লাগে তার, পা দুটো অবশ হয়ে আসে।
দূরে কি একটা ঘণ্টার শব্দ হচ্ছে ? নাকি মনের ভুল? জঙ্গলটা হঠাৎ পাতলা হয়ে আসে। ওই দূরে একটা মন্দির মনে হচ্ছে, সামনে বেশ ভিড়। দাঁড়িয়ে পড়ে বিরূপাক্ষ। না জেনে এগোনো ঠিক হবে না বোধ হয়, যদি ভিখারি ভেবে তাড়িয়ে দেয়। কম অভিজ্ঞতা তো হল না তার। একটা বাচ্চা হঠাৎ তার পাশ দিয়ে ছুটে যায়, বোধ হয় মন্দিরের দিকেই যাচ্ছে। তাকেই কোনোক্রমে ডাক দেয় সে। ইশারায় মন্দিরের দিকে দেখায়—ভাষা যদি না বোঝে। তাকে অবাক করে দিয়ে বাচ্চাটা বাংলায় বলে ওঠে, “আজ দেবী রাজবল্লভীর পুজোর উৎসব। মন্দিরে যাবে তো যাও না। সবাই প্রাসাদ পাবে আজ।” সে ছুট লাগায় মন্দিরের দিকে।
মাথাটা ঘুরে যায় এবার বিরূপাক্ষের। আর কয়েক পা। শেষরক্ষা হয় না তবু। মন্দিরের চাতালের কাছে এসে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে সে। সম্পূর্ণ জ্ঞান লুপ্ত হওয়ার আগের মুহূর্তে একবারের জন্য চোখে পড়ে এক অপরূপ নারীমূর্তি। দীর্ঘাঙ্গী, চুলগুলো চূড়া করে মাথার উপরে বাঁধা। সাদা রেশমের শাড়ির আঁচল হাওয়ায় উড়ছে। কোমরে ওটা তলোয়ার নাকি? বুঝি অস্ফুটে কাতরোক্তি করে উঠেছিল বিরূপাক্ষ, তাই মাথাটা ঈষৎ তার দিকে ফেরানো। সূর্যাস্তের আভাতে ঝিকিয়ে উঠেছিল হাতের বহুমূল্য কঙ্কন। পড়ে যাওয়ার আগে চোখ দুটো একবার দেখতে পেয়েছিল সে। আহা, মানুষের চোখ কি এমন হয়—এমন দীপ্তি আর করুণায় মাখামাখি! চোখে অন্ধকার নামার আগে একটা শব্দ অস্ফুটে বলে ওঠে বিরূপাক্ষ, “মা।”
***
জুলাই, ২০১৭।
মধ্য কলকাতার একটা নামি স্কুল। গেটের বাইরে দুটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একজন শান্ত, একজন অস্থির।
“উফ্, এত দেরি করছে কেন রে রাকাটা! ব্যাগটা আজ আবার তেমন ভারী। ইন-অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রির বইটা বের করে স্রেফ ফেলে দেব ভাবছি।” হাত-পা ছুড়তে থাকে টিয়া।
“এত খারাপ লাগে যখন কেমিস্ট্রি নিলি কেন তুই?” শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে মিঠু।
“আরে আগে তো ভালোই লাগত।” হতাশ গলায় বলে টিয়া। তারপর কব্জি উলটে ঘড়ি দেখে আবার লাফাতে থাকে—“পাঁচ মিনিটে বেল পড়বে, আজ নির্ঘাত লেট হব। নন্দু না-হয় লাইব্রেরি হয়ে আসবে, ওর বোধ হয় ফার্স্ট পিরিয়ডে ক্লাসও নেই আজ, কিন্তু রাকা যে…”
“ওই দেখ আসছে।” আঙুল তুলে দেখায় মিঠু।
প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছে রাকা। চুলগুলো এলোমেলো, চোখ চকচকে। গেটের কাছে আসতেই প্রায় ধাক্কা দিয়ে ওকে গেটের ভিতর ঢুকিয়ে দেয় টিয়া। তার মধ্যেই চেঁচায় রাকা—“জম্পেশ খবর আছে ফ্রেন্ডস, রোমানস, কনট্রিমেন থুড়ি উইমেন।”
“এখুনি বেল পড়বে। তুই রয়টারের কাজটা ব্রেকে করিস, নন্দুটাও এসে যাবে তখন।” ঠেলতে ঠেলতে ক্লাসের দিকে ওকে নিয়ে যায় টিয়া।
মিঠুর ক্লাস করিডোরের অন্য প্রান্তে। হাত নেড়ে সেও দৌড় লাগায়। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে ওরা চারজন বন্ধু। এক স্কুলে পড়ে এসেছে সব্বাই। এখন ক্লাস টুয়েলভে। ক্লাস ইলেভেন থেকে স্ট্রিম আলাদা হলেও স্কুল একই আছে। একদিনও একে অন্যকে না দেখে থাকতে পারে না রাকা, টিয়া, মিঠু আর নন্দিনী। তাই যতই দেরি হোক ওদের মধ্যে কারও, তাকে ফেলে বাকিদের ক্লাসে ঢুকে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
ইজিপশিয়ান মিথলজির একটা গোবদা বইয়ের আড়ালে মুখটা ঢাকা। সামনে রাখা বন্ধ টিফিন-বক্স। সবাই না আসা পর্যন্ত বন্ধই থাকবে। হঠাৎ পেছন থেকে দু-দিক দিয়ে দুটো হাত এসে চেপে ধরে তার দুই হাত, আর অন্য একটা হাত কেড়ে নেয় বইটা। একটুও না চমকে নন্দিনী বলে, “আরে সাবধান, বইটা ছিঁড়িস না।”
“বায়োলজিতে ইজিপশিয়ান মিথলজি কোন কম্মে লাগবে রে? তোদের কি আজকাল মিথলজিক্যাল প্রাণী ডাইসেক্ট করাচ্ছে?” বইটা সাবধানে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলে টিয়া।
“তোরা থামবি? তখন থেকে বলছি দারুণ খবর আছে!” বেজায় ভ্রূ কুঁচকে রাকা চেঁচায়।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, বল বল।” সবাই গুছিয়ে বসে এবার। ক্যান্টিনে এই টেবিলটা তাদের, অন্য কেউ বসে না।
“চুপ করে শোন। আমার মায়ের বন্ধু সুতপামাসিকে তো তোরা চিনিস।” রাকার মুখে চাপা উত্তেজনা।
“কল্পলতা পত্রিকার চিফ এডিটর?” নন্দিনী একবার কিছু শুনলে ভোলে না।
“হ্যাঁ। এবার মন দিয়ে শোন। পুজোর সময় নানারকম পুরস্কার দেওয়া হয় না—ওই সেরা পুজো, সেরা মণ্ডপ, সেরা পরিবেশ ইত্যাদি?”
“সে তো রাশি রাশি নানারকম পুরস্কার দেয়। প্রত্যেক বছর বেড়েই যাচ্ছে দেখছি। এশিয়ান পেইন্টস শারদ সম্মানটা খেয়াল রাখি, বাকি আর ট্র্যাক রাখতে পারি না।” টিফিন বক্স খুলে লুচির মধ্যে আলুভাজা পুরে মুখে ঢোকাতে ঢোকাতে মিঠু বলে।
“সেরকম এই কল্পলতা পত্রিকাও এ-বছর একটা পুরস্কার ঘোষণা করেছে—সেরা অন্য ধারার প্রাচীন পুজো। যেসব বাড়ির পুজো একশোরও বেশি বছর ধরে হচ্ছে, তাদের মধ্যে সেরা বাছতে হবে। দেখ, পুজোর আবার সেরা কী, সেটা আমারও ঠিক লাগে না, কিন্তু একটু অন্য ধারার প্রাচীন পুজো ওরা তুলে ধরতে চাইছে আর কি।” রাকা যে কেন এত উত্তেজিত সেটা এখনও কেউ বুঝতে পারেনি।
“তাতে তোর এত আনন্দ কেন?” প্রশ্নটা করেই ফেলে মিঠু।
“ইয়ে মানে,” চোখ পিটপিট করে রাকা, “স্কুল-কলেজ সব লেভেল থেকেই জাজ বাছছে ওরা, তো আমি…”
“আমাদের নাম দিয়ে দিয়েছিস নাকি?” চশমার পিছনে নন্দিনীর চোখ গোল হয়ে যায়।
“আমাদের সিলেক্ট করেও নিয়েছে।” ফিসফিস করে বলে রাকা। খুব উৎসাহের সঙ্গে নাম দিয়ে এসেছিল সুতপামাসিকে, এখন বন্ধুদের কী প্রতিক্রিয়া হবে ভালো বুঝতে পারছে না।
প্রায় তিরিশ সেকেন্ডের পিনপতন নিস্তব্ধতা। তারপর সবাই একসঙ্গে হইহই করে ওঠে। টিয়া লাফ দিয়ে উঠে বলে, “আমার কতদিনের ইচ্ছা ব্যাজ পরে মণ্ডপে ঢুকব। গম্ভীর মুখে চারদিকে দেখব, পুজো কমিটির লোকজন এসে খাতির করবে…”
মিঠু ফুট কাটে—“ভালো খাওয়ায় শুনেছি, ওই জন্যই নির্ঘাত রাকার এত উৎসাহ।”
“আরে দাঁড়া, এখনই অত লাফাস না। শুনছিস তো অন্য ধারার প্রাচীন পুজো। গ্রামে যেতে হবে হয়তো। সেখানে ব্যাজ পরে মণ্ডপে ঢোকার ব্যাপার থাকবে না। তবে খাওয়াদাওয়া ভালো হতেই পারে। খুব দূরে হলে আবার বাড়ি থেকে ছাড়বে কি না সেটাও একটা ব্যাপার।” নন্দিনী ইজিপশিয়ান মিথলজিকে আপাতত ব্যাগে ঢোকায়। গত বছর টিয়াদের সাবেকি বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে এক দারুণ রহস্যের সমাধান করেছিল ওরা। সেরকম আবার হলে মন্দ হয় না। সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে ভাবে নন্দিনী।
“এই রাকা, কোথায় পাঠাবে আমাদের জানিস কিছু?” টিফিন শেষ করে জলের বোতলের দিকে হাত বাড়ায় টিয়া।
উপরে নীচে মাথা নাড়ায় রাকা।
“কোথায়?” একসঙ্গে চারজনে চেঁচিয়ে ওঠে।
“আমতার একটা গ্রাম—নাম কাঁকরোল।”
“নামটা কেমন যেন শোনাচ্ছে রে।” টিয়ার গলায় কোনও উৎসাহ ফোটে না। মিঠুও চুপ।
“এই পুজোটার কথা আমি পড়েছি কোথাও। বালিয়াল পরিবারের পুজো কি? একটা স্পেশাল ব্যাপার আছে ওদের পুজোয়।” নন্দিনী থেমে যায়।
“ওরে নন্দুপিডিয়া, থামলি কেন, বলে ফেল।” তিনজনে একসঙ্গে বলে ওঠে। ওদের মতে উইকিপিডিয়ার পরেই নন্দুপিডিয়া।
“বালিয়াল পরিবারে পুজোর ক’টা দিন একসারি অদ্ভুত দেখতে ল্যাম্প ব্যবহার করে। প্রদীপ নয় কিন্তু। তাই কী বলব বুঝতে না পেরে জেনেরিক ল্যাম্প বলছি। দীপ বা আকাশ প্রদীপও বলতে পারিস। আকাশ প্রদীপের গায়ে নানারকম নকশা কাটা থাকে জানিস তো? এগুলোরও তাই। জিনিসগুলো ধাতুর তৈরি, আর নকশা বলতে শ্রীকৃষ্ণের জীবনের নানা কাহিনি খোদাই করা আছে তার গায়ে। একটা ছবিও দেখেছিলাম যতদূর মনে পড়ছে। চৌকো একটা মেটালিক খোপ, আর গায়ের ধাতুটা কেটে কেটে কালিয়দমন না এরকম কী একটা খোদাই করা ছিল। ভিতরে আলো জ্বালালে নকশার ফাঁকগুলো দিয়ে বাইরে আলো এসে পড়ে। আলোটা কীভাবে জ্বলে সেটা অবিশ্যি জানি না, হয়তো তেল-পলতের ব্যবস্থা কিছু আছে খোপটার ভিতরে। সবথেকে বড়ো ব্যাপার হল, এই দীপগুলো অনেক পুরানো নাকি—কত বছর সেটা লিখেছিল, কিন্তু এখুনি মনে পড়ছে না।” নন্দিনীর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। আর্টিকেলটা পড়ে ওর দীপগুলো দেখার ইচ্ছা হয়েছিল বলাই বাহুল্য।
ওরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল। এই জন্যই ওকে ওরা নন্দুপিডিয়া বলে। খ্যাপানোর জন্য হলেও ও যে একটু আলাদা, সেটা ওরা বিনা দ্বিধায় মেনে নেয়।
“তাহলে সুতপামাসিকে কনফার্ম করে দিই? যাতায়াতের ব্যবস্থা ওরাই করবে, তাই বাড়িতে আপত্তি করার কারণ দেখছি না।” রাকা হাত-পা ছড়ায় এবার।
“পুজো এবার কোন মাসে রে?” খোদ নন্দুপিডিয়াই জিজ্ঞেস করে।
“সেপ্টেম্বর।” বোঝাই যাচ্ছে রাকা তৈরি একেবারে।
চারজনে একে অন্যের মুখের দিকে তাকায়, তারপর মুঠো পাকিয়ে হাত শূন্যে ছোড়ে—ইয়ে-এ-এ-এ।
***
১৬০১ খ্রিস্টাব্দ, দামোদর রাজপ্রাসাদ, ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য।
পুবমুখো এই খিড়কিটা বড়ো প্রিয় তাঁর। ভোর হতে এখনও কিছু দেরি আছে। তারপর সামনের ওই গড়ের উঁচু পাঁচিলের কালো হয়ে থাকা রেখাগুলো স্পষ্ট হবে ভোরের আলোয়; সে-আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়বে দিঘির জলে। সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভেঙে যায় তাঁর রোজ। সূর্যোদয়ের সঙ্গে দিনের কাজ শুরু হয়। অন্তত তাই হত এতদিন। আজকাল মন আর সায় দেয় না। কিন্তু উপায় কী, তাঁর কাজ যে সত্যি এখনও শেষ হয়নি। কার হাতেই-বা দিয়ে যাবেন এই রাজ্যভার? প্রতাপ এখনও শিশু। তাঁর উপর সম্পূর্ণ ভরসা করতেন মহারাজ, তাঁর প্রত্যেকটি মতামতের পূর্ণ মর্যাদা দিতেন। সেই বিশ্বাসকে যে যথোচিত সম্মান দিতেই হবে। আবার দুই চোখ জলে ভরে আসে তাঁর। গড়ের দিকে তাকিয়ে মন চলে যায় অতীতে।
গড় ভবানীপুরের দুই পাশের জঙ্গল রীতিমতো ঘন। বাঘ বা হাতির মতো বড়ো জানোয়ার না থাকলেও অসংখ্য হরিণের বাস এখানে। আর আছে বুনো মোষ। এদের সামনে পড়ে গেলে রক্ষা পাওয়া মুশকিল, অত্যন্ত হিংস্র এরা। বুনো মোষের ভয়েই একা কেউ শিকারে আসে না এদিকে। বহুদিন পর ভুরীশ্রেষ্ঠাধিপতি মহারাজ রুদ্রনারায়ণ দলবল নিয়ে মৃগয়ায় চলেছেন। বসন্ত সমাগমে জঙ্গল পাখিদের কাকলিতে মুখরিত। পত্রে, পুষ্পে জঙ্গল অপরূপ হয়ে উঠেছে। কোথাও-বা বৃক্ষশাখা ফলের ভারে অবনত। চারদিকের মনোহর শোভা দেখতে দেখতে চলেছেন রাজন। হঠাৎ তাঁর মনে হল কিঞ্চিৎ দূরত্ব বজায় রেখে আরও একজন অশ্বারোহী যেন চলেছে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। মুহূর্তে সজাগ হয়ে ওঠেন রুদ্রনারায়ণ। সবার অলক্ষে ইশারায় মন্ত্রী তথা প্রিয় বয়স্যকে ব্যাপারটা জানিয়ে নিজের দল থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। অন্য রাজ্যের গুপ্তচর হলে এখুনি তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। সন্তর্পণে তিনি পিছু নেন সেই রহস্যময় অশ্বারোহীর।
একাকী এই জঙ্গলে প্রবেশ করতে রীতিমতো সাহসের প্রয়োজন হয়। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে রুদ্রনারায়ণ নজর রাখতে থাকেন অশ্বারোহীর উপর। অবশ্য তার নিশ্চিন্ত ও অনুদ্বিগ্ন চলন দেখে তাকে গুপ্তচর অন্তত মনে হয় না। অশ্বারোহীর মুখ স্পষ্ট দেখতে পাননি রাজা। মাথায় একটা রেশমের রঙিন পাগড়ি পরে রয়েছে সে। পাগড়ির তলার অংশটি দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। চোখে পড়ছে সুডৌল ললাটের অংশ। অশ্বারোহীর কাঁধে ধনুক আর কোমরে অসি। সহসা কাঁধ থেকে ধনুক নামিয়ে তাতে শর যোজনা করে সে। সম্ভবত কোনও শিকার দৃষ্টিগোচর হয়েছে তার। নিখুঁত ভঙ্গিতে শর নিক্ষেপ করতে যাবে, এমন সময় তীব্র খুরধ্বনিতে জঙ্গল মুখরিত হয়ে ওঠে। সচকিত হয়ে ওঠেন মহারাজ। এই শব্দের অর্থ একটাই। বুনো মহিষের দল আসছে এদিকে। দ্বিধায় পড়েন তিনি, রাজা হিসেবে এই রাজ্যের প্রত্যেক প্রজাকে রক্ষা করা তাঁর কর্তব্য। এই অশ্বারোহী তাঁর প্রজাও হতে পারে, অথবা এই রাজ্যের অতিথিও হতে পারে। দুটি ক্ষেত্রেই তাকে বিপদ থেকে মুক্ত করা রাজকর্তব্য। কিন্তু তিনি একা বুনো মহিষের দলের সঙ্গে পেরে উঠবেন কি? তাঁর প্রিয় ঘোড়াকেও বিপদে ফেলা হবে। তিনি অবশ্য নিজের ঘোড়াকে মুক্ত করে দিয়ে সামনের বিশাল বৃক্ষের কোনও একটাতে উঠে পড়তে পারেন। সুশিক্ষিত ঘোড়া রাস্তা চিনে বাকিদের কাছে অথবা প্রাসাদে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু প্রভুভক্ত শ্বেতকমল এই বিপদে তার প্রভুকে ফেলে কখনোই যাবে না। বুনো মহিষের গন্ধ পেয়ে শ্বেতকমল ইতিমধ্যে চঞ্চল হয়ে উঠেছে, নাক দিয়ে মৃদু শব্দ করছে।
খুরধ্বনি আরও স্পষ্ট হয়, ওই এসে পড়েছে ওরা। অজ্ঞাত অশ্বারোহীও সচেতন হয়ে ওঠে, টানটান হয়ে যায় তার শরীর। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তার হাতে ঝিকিয়ে ওঠে তরবারি। মুগ্ধ বিস্ময়ে রুদ্রনারায়ণ দেখলেন, তরবারি ঘুরিয়ে নির্ভীক অশ্বারোহী ঝড়ের বেগে আক্রমণ করছে বুনো মোষের দলকে। তিনটি মোষ তিনদিক থেকে ঘিরে ধরেছে তাকে। তাদের মুখ দিয়ে ফেনা ঝরছে, অক্ষিগোলক টকটকে লাল। লেজ আছড়ে বাঁদিক থেকে একটি মোষ অন্ধ আক্রোশে লাফিয়ে পড়ে অশ্বারোহীর উপর। অদ্ভুত কায়দায় তার ঘোড়া লাফ দিয়ে সরে যায় মোষটির রাস্তা থেকে। ঘুরে সামনে ফিরে আসতে-আসতেই অশ্বারোহী তার তরবারি আমূল বিধিয়ে দেয় মোষের বুকে। একবারও না থেমে পরমুহূর্তেই দ্বিতীয় মোষটির বুক লক্ষ্য করে শরসন্ধান করে সে। নিখুঁত লক্ষ্যে তিরটি বিঁধে যায়। দলের দুটিকে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে দেখে তৃতীয় মোষটি এক মুহূর্ত থেমে উলটোদিকে ঘুরে জঙ্গলে মিলিয়ে যায়। ক্লান্তভাবে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে আসে অশ্বারোহী।
মহারাজ এতক্ষণ প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে ছিলেন, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি। এ তো পরিপূর্ণ যোদ্ধা! এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে যান অজ্ঞাত সাহসী যোদ্ধার দিকে। নিজের ঘোড়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে। মাথা থেকে পাগড়ি সরিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় এবার। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ কুঞ্চিত কেশ ঝরনার মতো কাঁধ বেয়ে নেমে আসে তার। অস্ফুট বিস্ময়ের শব্দ বেরিয়ে আসে রুদ্রনারায়ণের কণ্ঠ থেকে। এ তো পুরুষ নয়! অশ্বারোহীও এবার মহারাজের উপস্থিতি টের পায়। চকিত হয়ে মুখ ফেরায় তাঁর দিকে।
“কন্যা, তোমার পরিচয়?” বিস্মিত মহারাজ জিজ্ঞাসা করেন।
“গড় ভবানীপুর দুর্গের রক্ষক দীননাথ চৌধুরী আমার পিতা।” নতমস্তকেই উত্তর দেয় বীরাঙ্গনা। কণ্ঠ বীণার মতো গম্ভীর ও মিষ্ট।
রুদ্রনারায়ণ আবার প্রশ্ন করেন, “ভদ্রে, তোমার নাম?”
“আমার নাম ভবশঙ্করী।”
“মা! ও মা!”
সহসা আঁচলে টান পড়ে তাঁর। চমকে উঠে জানালার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরান ভিতরে। অতীতে হারিয়ে গেছিলেন কিছুক্ষণের জন্য, এখনও যেন মনে হচ্ছে সেই দিনগুলোতেই তিনি ফিরে গেছেন। সেই মহারাজের সঙ্গে দেখা হওয়া, তারপর স্বয়ং মহারাজ তাঁদের ক্ষুদ্র গৃহে পদার্পণ করেছিলেন। পিতা দীননাথ চৌধুরীর কাছে কন্যা ভবশঙ্করীর পাণিপ্রার্থনা করেছিলেন। আবার টানা টানা চোখ দুটি জলে ভরে ওঠে তাঁর। এভাবে মহারাজ চলে যাবেন তিনি ভাবতে পারেননি কখনও।
কচি দুটি হাত পেছন থেকে এবার জড়িয়ে ধরে তাঁকে। চোখ মুছে হাত বাড়িয়ে সদ্য পিতৃহারা পঞ্চমবর্ষীয় বালক প্রতাপ নারায়ণকে বুকে টেনে নেন রানি ভবশঙ্করী। মহারাজের মৃত্যুর পর তিনি সাম্রাজ্য ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। মানসিক অস্থিরতায় প্রাণত্যাগ করার কথাও ভেবেছিলেন। কুলপুরোহিত তাঁকে বাধা দিয়ে বলেছিলেন, “মা, যুবরাজ এখনও শিশু। আজ যদি সে সম্পূর্ণ অনাথ হয়ে যায়, তাহলে এই ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসার শক্তি সে কোথা থেকে পাবে? কে শেখাবে তাকে রাজ্য পরিচালনা? রাজ্য বিনষ্ট হবে যে মা। মহারাজ সর্ব বিষয়ে আপনার উপর ভরসা রাখতেন, আজ সে-ভরসার মান রাখতে হবে বইকি।”
ঠিকই পরামর্শ দিয়েছিলেন বৃদ্ধ। বর্তমান ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য হাওড়া ও হুগলী ছাড়িয়ে পূর্ব বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বৃহদাংশ জুড়ে বিস্তৃত। এই রাজ্য ধরে রাখতে গেলে, উপযুক্ত শাসক হতে গেলে প্রতাপকে তৈরি হতে হবে। সেই সময় না আসা পর্যন্ত তাঁর কাজ শেষ হতে পারে না। বিশেষ করে পাঠান শাসকরা সুযোগ পেলেই এই রাজ্য দখল করবে।
কিছুকাল আগে পর্যন্ত পাঠান দাউদ খাঁর সেনাপতি কুতলু খাঁর সেনাবাহিনী বহুবার ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে লুঠপাট চালিয়েছে। বাংলার আধিপত্য তাদের লক্ষ্য। মহারাজ তখনও জীবিত। এমনকি মুঘলদের পরাজিত করার জন্য দাউদ খাঁ মহারাজ রুদ্রনারায়ণের সাহায্য চেয়েছিল। রুদ্রনারায়ণ সম্মত না হওয়াতে কুতলু খাঁ তাঁদের রাজ্য আক্রমণ করে। সেই যুদ্ধে মহারাজের পাশাপাশি তিনিও সমান তালে লড়াই করেছিলেন। সে-কথা মনে পড়ে এত কষ্টের মাঝেও ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে ভবশঙ্করীর ওষ্ঠাধরে। বড়ো সুন্দর, বড়ো রোমাঞ্চকর ছিল সেইসব দিন। তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে মহারাজকে রাজ্য শাসনে সহায়তা করতেন। খানাকুল, ছাউনপুর, তমলুক, আমতা, উলুবেড়িয়া, নস্করডাঙ্গাতে তাঁর পরামর্শে সামরিক দুর্গ তৈরি হয়। এই রাজ্য যতখানি মহারাজ রুদ্রনারায়ণের, ঠিক ততখানি মহারানি ভবশঙ্করীরও। শুধু এবার দীর্ঘ রাস্তা তাঁকে একা চলতে হবে। রুদ্রনারায়ণ বড়ো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।
মায়ের আলিঙ্গনে বন্দি শিশুপুত্র এবার ছটফট করে ওঠে।—“মা, তলোয়ার চালাতে যাবি না? চল!”
কচি মিষ্টি স্বরে আবার বাস্তবে ফিরে আসেন ভবশঙ্করী। সরল শিশুমন এখনও বোঝে না কী ঝড় নেমে এল তার জীবনে। পুত্রের মুখের আদলে মহারাজকে দেখতে পান তিনি। প্রতাপের অস্ত্রশিক্ষার ভার নিজের হাতেই তুলে নিয়েছিলেন ভবশঙ্করী। মহারাজ গত হওয়ার পর সে-দায়িত্বপালনে বড়ো অবহেলা করেছেন। নাহ্, সব ভুলে পুত্রের মঙ্গলের জন্য তাঁকে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তেই হবে। পুত্রের মুখ চুম্বন করে তিনি বলেন, “নিশ্চয়ই যাব মানিক, আজ থেকে আবার যাব।”
“মহারানি।”
কক্ষের দ্বারের কাছ থেকে আওয়াজ আসে। অনুমতি নিয়ে যোদ্ধার বেশে সজ্জিত একটি মেয়ে অন্দরে প্রবেশ করে। তার চেহারায় জড়তার লেশমাত্র নেই। দৃপ্ত পদক্ষেপে রানির সম্মুখে গিয়ে অভিবাদন জানায় সেই কন্যা। তার গাত্রবর্ণ কৃষ্ণ, টানা টানা নির্ভীক দুই চোখ। ওর নাম কুঞ্জরী। ভবশঙ্করী রাজ্যের বেশ কিছু মেয়েদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এমন ঘটনা সেই প্রথম। এদের মধ্যে বেশ কিছু কন্যা সেনাবাহিনীতেও যোগদান করেছে। কুঞ্জরী তাঁকে বড়ো ভালোবাসে। সে স্বেচ্ছায় তাঁর দেহরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছে। তিনিও স্নেহ করেন তাকে। এই অসময়ে তাকে দেখে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকান ভবশঙ্করী।
“রাজকুলপুরোহিত আপনার দর্শনপ্রার্থী।” কুঞ্জরীর গলায় সম্ভ্রমের ছোঁয়া।
কুলপুরোহিত গোলক চট্টোপাধ্যায় সকলের শ্রদ্ধাভাজন। তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ান ভবশঙ্করী।
মুহূর্তকাল পরে কক্ষে প্রবেশ করেন কুলপুরোহিত। বয়স হলেও দীর্ঘ উন্নত দেহে বার্ধক্যের চিহ্নমাত্র নেই। তবে মুখমণ্ডলে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। রানিকে আশীর্বাদ করে গম্ভীর স্বরে বললেন, “মা, সিংহাসন শূন্য থাকা রাজ্যের পক্ষে অমঙ্গলজনক। বহিঃশত্রুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ-সিংহাসন অবশ্যই কুমার প্রতাপ নারায়ণের। কিন্তু সে যতদিন না উপযুক্ত হচ্ছে, ততদিন এই দায়িত্ব গ্রহণ তোমাকেই করতে হবে। রাজ্যাভিষেকের আয়োজন করা প্রয়োজন।”
চমকে ওঠেন ভবশঙ্করী। তাই তো! এই কথা তো ভাবেননি তিনি। খানিক চুপ থেকে অস্ফুটে বলেন, “আমাকে একটু মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে সময় দিন। এই ভার গ্রহণের আগে আমি প্রতাপকে নিয়ে একবার কাস্তাসনগড়ে যেতে চাই। সেখানে মহাদেবের মন্দিরে পূজা প্রদান করে, মহাদেবের আশীর্বাদ নিয়ে ফেরার পর হবে রাজ্যাভিষেক। মহারাজ কোনও নতুন দায়িত্ব গ্রহণের আগে তাই করতেন।”
“তবে তাই হোক মা। তবে তোমার অনুপস্থিতিতে রাজ্যের ভার কে নেবে?”
“সেনাপতি চতুর্ভুজ চক্রবর্তী ও রাজস্ব মন্ত্রী দুর্লভ দত্ত এই দায়িত্বভার গ্রহণ করার পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত।” শান্ত স্বরে বলেন ভবশঙ্করী।
মুহূর্তে ভ্রূকুটি দেখা যায় কুলপুরোহিতের ললাটে। ভবশঙ্করীর দৃষ্টি এড়ায় না সেটা। তিনি যে চতুর্ভুজকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না সেটা ভবশঙ্করী পূর্বেও দেখেছেন। কিন্তু চতুর্ভুজ অত্যন্ত দক্ষ। সাম্রাজ্য সামলানোর দায়িত্ব তিনি নিতে পারবেন।
দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করে গোলক চট্টোপাধ্যায় বলেন, “কিন্তু মা, তোমার নিজের সুরক্ষার বিষয়টি নিয়েও ভাবা প্রয়োজন। বিশেষ করে, পাঠানদের পক্ষ থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা খুবই প্রবল। ময়মনসিংহ-সিলেট অধিপতি খাজা ওসমান খাঁর নজর যে বাংলার এই অংশে পড়েছে তা সর্বজনবিদিত। স্বয়ং সম্রাট আকবরের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ওসমান খাঁ। এমতাবস্থায় সপুত্র আপনার সুরক্ষার বিষয়টি…”
উদ্বিগ্নভাবে থেমে যান কুলপুরোহিত।
স্মিতহাস্যে সহসা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ভবশঙ্করীর মুখ। দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “আমার বিশ্বস্ত ও সুশিক্ষিত কন্যাবাহিনী আমার সঙ্গে থাকবে। তারা থাকলে আমি নিশ্চিন্ত থাকব।”
মৃদু মস্তক সঞ্চালন করেন গোলক চট্টোপাধ্যায়। তবে তাঁর মুখ থেকে দুশ্চিন্তার ভার কাটে না। বোঝা যায় তিনি রাজি হলেও নিশ্চিন্ত হননি। বেরিয়ে যেতে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ান।—“কতদিনে ফিরবে মা?”
কুলপুরোহিতের সস্নেহ কণ্ঠ আবার অশ্রুরুদ্ধ করে ভবশঙ্করীকে। সামলে নিয়ে বলেন, “এই ধরুন মাস তিনেক।”
সন্ধের অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে প্রাসাদের কোণে কোণে। এমনিতেই মহারাজ গত হওয়ার পর থেকে প্রাসাদে আলোর রোশনাই নামমাত্র। তার উপর কাল প্রত্যুষে মহারানিও যাত্রা করবেন। সে-সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই দলে দলে প্রজা তাদের মহারানিকে দর্শন করার জন্য সারাদিন প্রাসাদে আসাযাওয়া করেছে। এই অধিকার তাদের বরাবরই আছে। জাত-ধর্ম নির্বিশেষে প্রাসাদে প্রবেশ করার অবাধ অধিকার সকল প্রজার। সারাদিন ধরে তারা ভবশঙ্করীকে প্রণাম জানিয়ে গেছে একে একে এসে। সবার সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি, আশ্বাস দিয়েছেন। সমস্ত দিন ধরে সবরকম সামগ্রী গোছগাছ করে তুলেছে দাসদাসীরা। তিন মাসের জন্য কাস্তাসনগড়ে বাস করবেন রানি, সঙ্গে দাসদাসী, পাচক, তাঁর শতাধিক নারীবাহিনী—কম কথা নয়। সব প্রস্তুতি শেষ একরকম। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা শুরু হবে।
প্রাসাদের ছাদে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন ভবশঙ্করী। মহারাজ মহাদেবের উপাসক হলেও তিনি নিজে মা চণ্ডীর পূজা করেছেন আশৈশব। বিবাহের পরেই প্রাসাদের পাশে দেবীর মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। আজও প্রতিদিন নিজের হাতে পূজা দেন সেই মন্দিরে। তাছাড়া রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে চণ্ডী মায়ের বেশ কিছু মন্দির নির্মিত হয়েছে। কোথাও দেবীর নাম বেতাই চণ্ডী, কোথাও মেলাই চণ্ডী, কোথাও-বা জয়চণ্ডী।
কুঞ্জরী এসে দাঁড়ায়। আবার বোধ হয় কেউ সাক্ষাৎ প্রার্থনা করছে। প্রজাকে ফিরিয়ে দেবার কথা মনেও আসে না ভবশঙ্করীর। ইশারায় কুঞ্জরীকে এই প্রাসাদের ছাদেই নিয়ে আসতে বলেন তাকে। কুঞ্জরীর পিছু পিছু যে আসে তাকে প্রথমে চিনতে পারেননি ভবশঙ্করী। কোথাও কি দেখেছেন একে? সতেজ বলিষ্ঠ চেহারা, আচরণে শ্রদ্ধা থাকলেও অনাবশ্যক কৃতার্থ ভাব নেই। আভূমি প্রণাম জানিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে, “মা, একটি নিবেদন আছে।”
ওই মা ডাকটা শুনেই মুহূর্তে চিনতে পারেন একে ভবশঙ্করী। এই লোকটাই সেদিন রাজবলহাটের মন্দির প্রাঙ্গণে কোথা থেকে হঠাৎ করে এসে অচেতন হয়ে পড়ে গেছিল। নানা চিন্তায় এর কথা ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি। ভিনদেশি—কোথা থেকে এসেছে, উদ্দেশ্য কী—কিছুই জানা হয়নি। ভালো করে তাকান তিনি লোকটির দিকে। প্রশস্ত ললাট, নিঃসংকোচ অথচ সসম্ভ্রম দৃষ্টি। চক্ষু-তারকা উজ্জ্বল। প্রসন্ন হলেন ভবশঙ্করী। সস্নেহে বললেন, “বলো। তার আগে তোমার পরিচয় দাও। তোমার দেশ কোথায়? নাম কী?”
“মা, সেবকের নাম বিরূপাক্ষ আচার্য। দেশ বহুদূর, গোয়া।”
এই প্রদেশের নাম সম্প্রতি শুনেছেন ভবশঙ্করী। সেখানে ভিনদেশি পর্তুগিজদের আধিপত্য। এই গোয়া নামও তাদেরই দেওয়া।
“নিজভূমি পরিত্যাগের কারণ কি ভিনদেশিদের অত্যাচার?”
“মা, আপনার বিচক্ষণতার কথা শুনেছি সবার মুখে। আপনি যথার্থ অনুমান করেছেন।”
বিরূপাক্ষের মার্জিত কথাবার্তা ভালো লাগে ভবশঙ্করীর।
“তোমার কী নিবেদন আছে শুনি এবার। পরে পর্তুগিজদের বিষয়ে আলোচনা করব তোমার সঙ্গে।”
বিরূপাক্ষ এবার কোমরে বাঁধা একটা পোঁটলা খুলে আনে। নতমস্তকে বাড়িয়ে ধরে ভবশঙ্করীর দিকে।—“আপনি নিজের সাম্রাজ্যে আমাকে স্থান দিয়েছেন। কাস্তাসনগড়ের মন্দিরের জন্য আমার এই সামান্য নিবেদন। মহারানি এটি গ্রহণ করলে আমি ধন্য মনে করব নিজেকে।”
কৌতূহল হয় ভবশঙ্করীর। পোঁটলা খুলে যা বেরোল, তেমন বস্তু তিনি আগে দেখেননি। বিঘত খানেক উচ্চতার চৌকো একটা ধাতব খোপের চতুর্দিকে নানারকম দৃশ্য খোদাই করা। ধ্যানরত মহেশ্বর ও নটরাজরূপী মহাদেব। খোদাই করার পদ্ধতিটি অভূতপূর্ব। পুরো ছবিটা জায়গা বিশেষে জাল বা জাফরির আকার দিয়েছে ধাতব পাতটিকে। অখোদিত জায়গায় কিন্তু জমাট পাত। চৌকো খোপটার একদিকের অংশে ছোট্ট একটি মটরদানার মতো কিছু উঠে আছে।
অবাক হয়ে ভবশঙ্করী বস্তুটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকেন।—“অপূর্ব শিল্পকৌশল। কিন্তু এর ব্যবহার?”
স্মিত হাসে বিরূপাক্ষ নামের লোকটি। হাত বাড়িয়ে ফেরত নেয় জিনিসটা। তারপর ওই মটরদানার মতো অংশটি ধরে হালকাভাবে টান দেয়। সেটা অনেকটা দরজার হাতলের মতো কাজ করে আর খোপের সেইদিকের অংশটি দরজার মতো করে খুলে আসে। দেখা যায়, তার ভিতরের দিকের গায়ের সঙ্গে লাগানো ছোট্ট একটি শোওয়ানো চ্যাপ্টা অংশ ও তার শেষে একটি প্রদীপ। নিজের পোঁটলা থেকে বিরূপাক্ষ এবার বের করে আনে ছোটো একটি তৈলাধার, পাকানো পলতে ও চকমকি পাথর। প্রদীপের বাটির মতো অংশে তেলটুকু ঢেলে দিয়ে তার উপর পলতেটা বসিয়ে দেয় সে। জিনিসটা নামিয়ে রেখে চকমকি ঠুকে ধরিয়ে দেয় পলতেটা, তারপর আবার বের হওয়া অংশটা দরজার মতো করে বন্ধ করে দেয়। ফলে একটা বাক্সের ভিতর প্রদীপের মতো হয়ে গেল বস্তুটি। এবার খোদাই করা জালের মতো অংশ দিয়ে আলো নির্গত হয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ছবিটা। অপূর্ব সেই শোভার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন ভবশঙ্করী। এমন অসাধারণ প্রদীপ তিনি আগে দেখেননি।
“এ আমাদের এলাকার দীপ মা, ও-দেশে একে বলে কান্ডিল। তিন পুরুষ ধরে এই কান্ডিল বানানোই আমাদের আচার্য পরিবারের পেশা।”
“অপূর্ব! কাস্তাসনগড়ের মন্দিরের শোভা বৃদ্ধি করবে তোমার এই কান্ডিল।”
“মা, আর একটি প্রার্থনা আছে। যদি আমাকে আপনার সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দেন। আপনার সেবায় যদি কোনোভাবে লাগতে পারি।” মাথা নীচু করে বিরূপাক্ষ।
স্মিত হাস্যে অনুমতি দেন ভবশঙ্করী।
***
সেপ্টেম্বর ২০১৭।
‘নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা’—জানালার দিকে তাকিয়ে উদাসভাবে গেয়ে যাচ্ছে টিয়া। সপ্তমীর সকাল। সকাল সাড়ে সাতটায় কল্পলতার পুরানো একটা ইনোভা চেপে রওনা হয়েছে ওরা চারজন। এখন ন’টা পেরিয়ে গেছে। পৌঁছে যেত এতক্ষণে, কিন্তু সাঁতরাগাছির কাছাকাছি এসে রাকা চা আর কচুরি না খেয়ে আর এক পা এগোতে রাজি হল না। অগত্যা গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছে এখনও আরও মিনিট কুড়ি বাকি।
ড্রাইভারের পাশে বসে আছেন কল্পলতার ‘সেরা অন্য ধারার প্রাচীন পুজো শারদ সম্মান’-এর উদ্যোক্তা সুশোভন শাসমল। সারাদিন ওদের নিয়ে কাঁকরোলে কাটিয়ে রাতে যার যার বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়ে তবে ভদ্রলোক মুক্তি পাবেন।
টিয়ার পাশে বসেছে রাকা। তার পেছনে নন্দিনী আর মিঠু। চারজনেই শাড়ি পরেছে আজ। গাঢ় নীল সিল্ক আর মুক্তোর সেটে টিয়াকে শরতের আকাশের মতোই লাগছে। তার পাশে কচি কলাপাতা শিফন পরা রাকা এবার চিমটি কেটে টিয়াকে খ্যাপায়—“তুই গত দেড় ঘণ্টা ধরে মেঘের ভেলা ভাসাচ্ছিস।”
“কী করব, আর কোনও শরতের গান আমি জানি না।” নিপাট ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলে টিয়া।
“আমার বেশ অদ্ভুত লাগছে কিন্তু জানিস—এত পুরানো বাড়ি, গ্রামের পুজো—দারুণ অন্যরকম একটা ব্যাপার হবে বল।” জমকালো একটা লাল আর সোনালি কেরালা কটন শাড়িতে মিঠু নিজেই আজ একেবারে অন্যরকম।
“এই বালিয়াল বাড়ির পুজো কিন্তু ওই বাড়িরই একজন লেডি শুরু করেছিলেন, জানিস?” নন্দিনীর খোলা কোঁকড়া চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। লাল-কালো বুটিদার একটা তাঁতে অন্যদিনের থেকেও গম্ভীর অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে ওকে। কানের রুপোর ঝুমকো দুটো মাথা নেড়ে কথা বলার তালে দুলছে। চশমার পেছনে উজ্জ্বল চোখ দুটোতে আজ হালকা কাজলের ছোঁয়া। কপালের বাদামি টিপটার উপর ছোট্ট একটা পাথর বসানো।
“ভাব একবার, একশোরও বেশি বছর আগে, তখন তো এদিকে অজ গাঁ যাকে বলে। এলোকেশীদেবী নামে একজন এই পুজো শুরু করেন।” নন্দিনী বলে চলে।
“তুই কোথা থেকে জানলি?” রাকা কথাটা বলেই হেসে ফেলে। নন্দুপিডিয়া জানবে না তো কে জানবে?
অবশেষে পৌঁছায় ওরা কাঁকরোল গ্রামে। চারদিকের সবুজ থেকে যেন আলো ঝরছে। তবে রাস্তায় খুব ধুলো। বালিয়ালদের বাড়ির সামনে যখন গাড়ি থামল, ওদের মেরুন ইনোভা ততক্ষণে ধূসর হয়ে গেছে। বাড়ির ভিতর থেকে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বোঝা গেল তিনি সুশোভনবাবুর পূর্বপরিচিত। ওদের সবার সঙ্গে আলাপ করে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলেন বালিয়াল বাড়ির কর্তা শিশির বালিয়াল।
“একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস?” মিঠুর হাত ধরে হালকা টান দেয় নন্দিনী। কানের কাছে মুখ এনে বলে, “ভদ্রলোকের চোখ-মুখে কেমন একটা দুঃখের ছাপ?”
“হয়তো পুজোর ব্যস্ততার মধ্যে বাইরের এতগুলো লোক এসে পড়ায় বিব্রত।” মিঠু পালটা ফিসফিস করে।
টিয়া, রাকা এগিয়ে গেছিল খানিকটা। ওরাও পা চালায় এবার। ঢাকের শব্দে চারদিক মেতে উঠছে।
পুজোর জায়গার সামনে এসে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ওরা। মূল বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে চণ্ডীমণ্ডপ। মণ্ডপের বাঁদিকে একচালা দুর্গা প্রতিমা। ছোটো, কিন্তু অপূর্ব সুন্দর মাতৃমূর্তি। দশভুজার সামনে পুরোহিতমশাই পূজায় মগ্ন। চণ্ডীমণ্ডপের সিঁড়িতে শুকনো মুখে বসে আছে এক কিশোর। চণ্ডীমণ্ডপের বারান্দায় একটা জটলা। সম্ভবত গ্রামের বেশ কিছু লোক উঠোনে বসে আছে। কয়েকটা বাচ্চাও খেলা করে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। ওদের দেখে একজন ভদ্রমহিলা চণ্ডীমণ্ডপের বারান্দা থেকে নেমে এলেন। ভারি আভিজাত্যপূর্ণ তাঁর চেহারা, লাল পাড় গরদের শাড়িতে সুন্দর মানিয়েছে। ইনি যে গৃহকর্ত্রী তাতে কারও সন্দেহ রইল না।
“আরে নির্ঘাত মরণকালে বুদ্ধিনাশ হয়েছিল বুড়োর। কী বলতে কী বলেছে সেই নিয়ে তোরা মাথা খারাপ করছিস। সিম্পল হরিনাম করেছে মরার আগে। সেটা তো হতেই পারে, নাকি?” লম্বা, ফর্সা লোকটি পাশে বসা শিশিরবাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র মনোময় বালিয়ালের পিঠে একটা চাপড় মেরে জোরের সঙ্গে বলে উঠল।
“কিন্তু অভিজিৎদা, আচার্যি মশাই আবোল-তাবোল কথা বলার লোক ছিলেন না।” মনোময়ের ভাই, অরুময় বালিয়াল বলে।
“মাথায় আঘাত লেগেছিল, বয়স হয়েছিল, সেটা ভাব। উনি যেটা বলতে চেয়েছিলেন সেগুলো তো বেশ বিখ্যাত লাইন। জানিস নিশ্চয়ই। হরির উপরে হরি/ হরি শোভা পায়/ হরিকে দেখিয়া হরি/ হরিতে লুকায়। সেটাই হয়তো মরণকালে বলতে চেয়েছিলেন। মাথা স্থির ছিল না, এলোমেলো বলে ফেলেছিলেন।”
“এমন একটা ছড়া শেষ সময় উনি কেন বলতে চাইবেন? মানেই-বা কী এর?” বীথিকা বলে ওঠে।
তার সঙ্গে নন্দিনীদের বেশ আলাপ হয়ে গেছে। ফল-মিষ্টি প্রসাদের থালা হাতে উঠোনের বিশাল বকুলগাছের তলায় শতরঞ্জি বিছিয়ে বসে আড্ডা চলছে। পায়েসের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে উঠোন জুড়ে। চণ্ডীমণ্ডপের পিছনে পুজোর ভোগ রান্না চলছে। আজ নিরামিষ খাওয়া শুনে রাকা একটু হতাশ হয়ে পড়েছিল ঠিকই, বিশাল একটা কড়াপাকের সন্দেশ খেয়ে সেই দুঃখ মনে হয় ভুলেছে। মহালয়ার পরদিন এই বাড়ির প্রতিমা যিনি গড়েন, সেই বৃদ্ধ অনন্ত আচার্য চণ্ডীমণ্ডপের সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে পড়ে যান। মাথায় আঘাত লেগে মৃত্যু হয় তাঁর। মারা যাওয়ার আগে কিছু অদ্ভুত কথা বলে যান তিনি। সেই ঘটনাই বার বার আলোচনায় ফিরে আসছে। টিয়া অবাক হয়ে তাকাচ্ছিল চণ্ডীমণ্ডপটার দিকে। এখন যেখানে পুজোর আনন্দ, হুড়োহুড়ি, সেখানেই কয়েকদিন আগে একজনের মৃত্যু হয়েছে। চণ্ডীমণ্ডপের—এঁরা অবশ্য চণ্ডীতলা বলেন, অন্যদিকে পরিবারের অধিষ্ঠাত্রী দেবী জয়চণ্ডীরও পুজো চলছে দুর্গাপুজোর পাশাপাশি। চণ্ডীতলার সিঁড়িতে বসা সেই কিশোর নাকি অনন্ত আচার্যের নাতি সুমন্ত। দাদুর অনুপস্থিতিতে প্রতিমার সাজসজ্জার কাজ সে শেষ করেছে।
“মানে হল, হরি আলাদা কোনও অস্তিত্ব নন। অস্তিত্ববান সবকিছুর মধ্যেই তিনি আছেন। জলের উপর পদ্মপাতা। সেই পাতার উপর ব্যাঙ। সাপ দেখে ব্যাঙটি জলে ঝাঁপ দিয়ে লুকাল। এই দেখেই ভক্ত এই কথা বলছেন। এ অতি প্রাচীন প্রবচন।” মাটির গ্লাসে করে সবাইকে ডাবের জল দিতে দিতে বীথিকার প্রশ্নের উত্তর দেয় অমিতা, মনোময়ের স্ত্রী। বাড়িতে পুজো, তার উপর অতিথি। বসার সময় তার নেই। গ্লাসগুলো নামিয়ে রেখেই আবার দৌড়ায় কাজে।
“তুমি তাহলে বলছ আচার্যি মশাইয়ের কথাগুলোর মধ্যে কোনও রহস্য নেই, স্রেফ ভুল?” অরুময়ের গলায় দ্বিধা যেন।
“না তো কী? তুই কি ভাবলি গুপ্তধনের সন্ধান?” অভিজিৎ জোরের সঙ্গে বলে।
আড়চোখে নন্দিনীর দিকে তাকায় রাকা। অনেকক্ষণ ধরেই তাদের নন্দুপিডিয়া বেশ চুপচাপ। কোঁচকানো কপাল আর চোখে ফুটে ওঠা জিজ্ঞাসাটা দৃষ্টি এড়ায় না রাকা, মিঠু আর টিয়ার। সত্যিই কি এক বৃদ্ধের মনের ভুল, না কোনও ধাঁধা? আবার কোনও রহস্যে জড়াচ্ছে নাকি তারা?
***
১৬০৩ খ্রিস্টাব্দ, খানাকুল দুর্গ, ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য।
অমাবস্যার মাঝরাত। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে দুর্গের অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আসে কালো একটি ঘোড়া। তার পৃষ্ঠে কালো বস্ত্র পরিহিত এক ছায়ামূর্তি, ভঙ্গিতে চূড়ান্ত সাবধানতা। দুর্গ থেকে বেশ কিছুটা দূরে পৌঁছানোর পর তবেই সে পূর্ণ গতিতে অশ্বচালনা করে। খানাকুল এলাকার শেষ প্রান্ত জঙ্গলাকীর্ণ। সেখানে পৌঁছে রাতচরা পাখির মতো তীক্ষ্ম শব্দ করে অশ্বারোহী। কয়েক মুহূর্ত পর জঙ্গলের ভিতর থেকে আর এক বিশালদেহী ছায়ামূর্তি বেরিয়ে আসে। তার শরীরও কালো বস্ত্রে আচ্ছাদিত। প্রথম ব্যক্তি অশ্ব থেকে নেমে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায়।
“রানি বাঁশুরি গ্রামে যাত্রা করবেন তিনদিন পর। সঙ্গে থাকবে যুবরাজ। সেনাপতি ভূপতিকৃষ্ণ রায় তমলুকে। তার এখন ফেরার কোনও সম্ভাবনা নেই।” প্রায় ফিসফিস করে জানায় প্রথম ছায়ামূর্তি।
“আমার সঙ্গে এখন তিন হাজার সেনা আছে। তোমাদের রানি অত্যন্ত সাহসী ও সুদক্ষ যোদ্ধা। আমার সঙ্গে থাকা সৈন্য কি যথেষ্ট হবে?” বিশালদেহীর কণ্ঠ জলদগম্ভীর। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে স্পষ্ট বোঝা যায় সে যোদ্ধা ও অত্যন্ত শক্তিশালী।
“খানাকুল দুর্গে আমার অনুগত সেনা আছে কিছু। আপনি বাঁশুরির পথে রওয়ানা দিন, আমিও তাদের নিয়ে পৌঁছে যাব।” প্রথম ছায়ামূর্তি আশ্বাসের স্বরে বলে।
“আর রানির সৈন্যসংখ্যা?”
“রানি সীমান্ত বরাবর সৈন্য ছড়িয়ে রাখেন সবসময়। তাই রাজধানীতে কখনই বেশি সংখ্যক সৈন্য থাকে না, যদিও প্রতিটি দুর্গে অশ্বারোহী, হস্তীবাহিনী ও পদাতিক সৈন্য আছে। বাঁশুরি গ্রামের কাছাকাছি তিনটে দুর্গ আছে ঠিকই—ছাউনাপুর, বাঁশডিঙ্গাগড় আর লস্করডাঙ্গা। কিন্তু বাঁশুরিতে যাওয়ার সময় রানির সঙ্গে দেহরক্ষী ছাড়া বিশেষ সৈন্য থাকবে না। অতর্কিতে আক্রমণ করতে পারলে দুর্গ থেকে সেনাবাহিনী এসে পৌঁছাতে সময় পাবে না।”
হঠাৎ বিশালদেহী ছায়ামূর্তির কণ্ঠস্বরে সম্ভ্রম ফুটে ওঠে।—“রানির দেহরক্ষীরা কি যথেষ্ট নয়? কাস্তাসনগড়ের মন্দির আক্রমণের সময় তাদের বীরত্বের পরিচয় আমি পেয়েছি। কত গোপনে আমার সেনারা ব্যবসায়ী, পর্যটক, ফকির, সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্যে প্রবেশ করেছিল। তা সত্ত্বেও রানি প্রস্তুত ছিলেন।”
“রানীর গুপ্তচররা টের পেয়ে গেছিল, সময়মতো রানির কাছে এই গুপ্ত আক্রমণের সংবাদ পৌঁছে যায়। তিনি প্রস্তুত হওয়ার সময় পেয়েছিলেন। কিন্তু এবারে সে-সুযোগ রানি পাবেন না। আপনি বাঁশুরি আক্রমণের প্রস্তুতি নিন।”
“কিন্তু রানি তোমাকে সেনাপতির পদ থেকে সরালেন কেন? তিনি কি তোমাকে সন্দেহ করছেন?”
“তা নয়। খনাকুল দুর্গের দায়িত্ব কি তাহলে দিতেন আমাকে? তবে সম্ভবত ওই কুলপুরোহিত রানির মন বিষিয়ে তুলেছে আমার বিরুদ্ধে। একবার এই সাম্রাজ্য আমার হাতে আসুক, ওই বুড়ো শকুনকে আমি দেখে নেব।”
“দেখো চতুর্ভুজ, এবারে আর ভুল না হয়। সুবেদার মানসিংহকে সরিয়ে এই সুবে বাংলার আধিপত্য আমার চাই।”
“আর এই ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সিংহাসনটি আমার চাই মহামান্য ওসমান খাঁ। দুজনের স্বপ্নপূরণের বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রানি ভবশঙ্করী।”
এতদিনে বুঝি বিরূপাক্ষের ছন্নছাড়া জীবন শেষ হতে চলেছে। মা বলেছেন তাঁর কুঞ্জরীর সঙ্গে বিরূপাক্ষের বিবাহ দেবেন। আজ খুড়োর কথা বার বার মনে পড়ছে বিরূপাক্ষের। সে-বুড়ো থাকলে আজ কতই না খুশি হত।
জঙ্গলের ভিতরের পথ দিয়ে খানকুল থেকে বাঁশুরির পথে রওয়ানা দিয়েছে বিরূপাক্ষ। মা গতকাল যাত্রা শুরু করেছেন যুবরাজকে নিয়ে। আগে হলে বিরূপাক্ষ সেই দলের সঙ্গেই যেত, কিন্তু কুঞ্জরীও থাকবে সেখানে। তার সঙ্গে বিবাহ ঠিক হওয়ার পর থেকে কেমন লজ্জা করে বিরূপাক্ষের।
অন্যমনস্ক বিরূপাক্ষ প্রথমে মধুমঙ্গলকে খেয়ালই করেনি। একটা বড়ো গাছের আড়ালে তাকে বসে থাকতে দেখে খুশি হয়ে হাঁক পাড়ে—“মধুকত্তা যে! সকাল সকাল শিকারের সন্ধানে বুঝি?”
মধুমঙ্গল এই তল্লাটের সেরা ব্যাধ।
“দুর্গে গেছিলাম গো, চতুর্ভুজ চক্কোত্তির নিকট।” মধুমঙ্গলকে বেশ বেজার দেখায়।
“কেন গো, চক্কোত্তি মশাই হরিণের মাংস চেয়ে পাঠিয়েছিলেন নাকি?”
“আর বোলো না কারিগর, ওনারে গিয়ে বললাম, জঙ্গলে পাঠান সেনা দেখেছি, বলে কিনা ভুল দেখেছি। আমার শিকারির চোখ, আমি ভুল দেখব?”
নিজের বানানো মূর্তির মতোই স্থির হয়ে যায় বিরূপাক্ষ। তারপর মধুমঙ্গলের কাঁধ দুটো ধরে ব্যস্তভাবে বলে, “জঙ্গলে পাঠান সেনা দেখেছ?”
“তবে আর বলছি কী? লুকিয়ে ছিল ব্যাটারা। কিন্তু আমার চোখকে…”
তাকে শেষ করতে না দিয়ে বিরূপাক্ষ বলে ওঠে, “শিগগির বাগদি আর চণ্ডাল পাড়ায় খবর দাও। ওদের রণপা আছে। আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাঁশুরি পৌঁছতে হবে। ওদের বলো, মায়ের বড়ো বিপদ। খবরদার, কেউ যেন ঘুণাক্ষরে টের না পায়। আমি বাঁশুরি চললাম।”
পরনের ধুতি ভাঁজ করে হাঁটুর উপরে তুলে নেয় বিরূপাক্ষ। তারপর হরিণের গতিতে দৌড় দেয়। বাগদি আর চণ্ডালেরা তির ছোড়া, তলোয়ার চালানোয় বিশেষ দক্ষ। ভবশঙ্করী তাঁর রাজ্যের প্রত্যেক পরিবারের অন্তত একজনের যুদ্ধশিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিলেন, তাই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রজার অভাব নেই। তারা মূল সেনাবাহিনীতে না থাকলেও প্রয়োজনে তাদের রানিমার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত।
***
সেপ্টেম্বর ২০১৭, কাঁকরোল গ্রাম।
চণ্ডীতলার দাওয়ার উপর রাখা এক সারি দীপ। এমন দীপ ওরা কেউ দেখেনি আগে।
“কিছুটা ক্রিস্টমাস ট্রিতে ঝোলানো ল্যাম্পগুলোর মতো, না রে?” টিয়া বলে।—“তবে অবশ্যই ওগুলোর গায়ে এরকম কাজ থাকে না, বড়োজোর রেনডিয়ার বা স্নোম্যান, আর ভিতরে এমন তেল-পলতের ব্যবস্থাও থাকে না।”
গৃহকর্ত্রী শিবানীদেবী তাঁর দুই পুত্রবধূকে নিয়ে দীপগুলোতে আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা করছেন। চৌকো খোপের গায়ে শ্রীকৃষ্ণের জীবনের নানা কাহিনি খোদাই করা। অসাধারণ সূক্ষ্ম কাজ, যেন দীপের ধাতব খোপের গায়ে জালের মতো লেগে রয়েছে। খোপের একদিক দরজার মতো খুলে যায়, তার গায়ে ছোটো চ্যাপ্টা একটা শোওয়ানো ফলকের শেষটা প্রদীপের মতো। সেখানেই তেল ঢেলে পলতে লাগানো যায়। আলো জ্বালিয়ে দরজার মতো অংশটা আবার বন্ধ করে দিলেই হল।
ওদের তাকিয়ে থাকতে দেখে শিশিরবাবু এগিয়ে আসেন।—“এগুলো কিন্তু অনেক পুরানো। চারশো বছর তো হবেই। এদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারি সুন্দর একটা গল্প।”
দুপুরের খিচুড়ি, পাঁচরকম ভাজা, লাবড়া, পায়েস আর অসাধারণ রাজভোগ খেয়ে ওঠা হয়েছে এই খানিক আগে। গ্রাম ঘুরে দেখার একটা কথা উঠেছিল, কিন্তু কল্পলতার সুশোভনবাবুর আপত্তিতে সেটা আর হয়নি। মেয়ে চারটিকে ভালোয় ভালোয় বাড়ি পৌঁছে দিতে পারলে তিনি বাঁচেন। যতদূর বুঝেছেন এদের সামলে রাখা তাঁর কম্ম নয়। অতএব গল্পের গন্ধ পেয়ে সবাই হইহই করে উঠল। দাওয়ার উপর শিশিরবাবুকে ঘিরে সবাই বসে পড়ে। উঠোন এখন মোটামুটি ফাঁকা। গ্রামের লোকজন আবার সন্ধ্যার আরতির সময় আসবে। বালিয়াল পরিবারের সদস্যরাও বসে যায়, মেয়েগুলোকে ভালো লেগেছে তাদের।
“এসব এলাকা চারশো-সাড়ে চারশো বছর আগে ভুরীশ্রেষ্ঠ বা ভুরশুট সাম্রাজ্যের অংশ ছিল।” গল্পের মেজাজ এসে গেছে শিশিরবাবুর।—“সুবে বাংলা মানে অবিভক্ত বাংলা,বিহার ও ওড়িশার সুবেদার তখন মানসিংহ। ময়মনসিংহ, সিলেটের দিকে আধিপত্য ছিল পাঠানদের। কিন্তু সুবে বাংলার উপরও নজর ছিল তাদের। ভুরশুটের রানি তখন ভবশঙ্করী রায়মুখুটি। ঝাঁসির রানির চেয়ে তাঁর সাহস, যুদ্ধকৌশল কোনও অংশে কম ছিল না। তিনি পাঠানদের একাধিকবার পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেনাপতি চতুর্ভুজ চক্রবর্তী ছিল বিশ্বাসঘাতক। পাঠানদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল সে। সন্দেহ হওয়াতে সেনাপতির পদ থেকে তাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন রানি, কিন্তু চতুর্ভুজের লক্ষ্য ছিল ভুরশুটের সিংহাসন। তাই একবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েও আবার পাঠান ওসমান খাঁর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সে। বাঁশুরি নামে একটা গ্রামে তাদের মিলিত সেনাবাহিনী আক্রমণ করে রানিকে।”
“তারপর?” রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করে মিঠু।
“রানির কাছে খবর পৌঁছে গেছিল সময়মতো। তবে দুর্গ থেকে মূল সেনাবাহিনী আনার সময় তখন ছিল না। রানির সঙ্গে ছিল তাঁর সুশিক্ষিত নারীবাহিনী আর বাগদি-চণ্ডাল প্রজার বড়ো একটা দল। তারা সকলেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তুমুল যুদ্ধ বাধে। রানি হাতির পিঠে চেপে সেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে কচুকাটা হয় পাঠান সেনারা। শোনা যায়, ওসমান খাঁ ফকিরের ছদ্মবেশে ওড়িশায় পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়।”
“আর বিশ্বাসঘাতক ওই চতুর্ভুজ?” রাকা চেঁচিয়ে ওঠে।
“সেও সম্ভবত ওসমানের সঙ্গেই ওড়িশা পালায়। রানির বীরত্বের কাহিনী স্বয়ং সম্রাট আকবরের কানে পৌঁছায়। পাঠানরা মুঘলদেরও যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ ঘটিয়েছিল, তাই ওসমান খাঁকে তাড়িয়ে রানি সম্রাটেরও উপকার করেন। মানসিংহ ভুরশুটে এসে রানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। মুঘল সম্রাট ভুরশুট সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব মেনে নেন। শুধু তাই নয়, সম্রাট রানিকে তাঁর নামাঙ্কিত আকবরি মোহর প্রদান করে এক উপাধিতে ভূষিত করেন।”
“রায়বাঘিনী।” খুব আস্তে, প্রায় ফিসফিস করে নন্দিনী কথাটা বললেও কানে যায় শিশিরবাবুর।
“তুমি জানো এটা? বাহ্।”
“ও নন্দুপিডিয়া, ও সব জানে।” নন্দিনী চিমটি কেটে থামানোর আগেই টিয়ার ফোড়ন দেওয়া শেষ।
“সে আবার কী?” শিশিরবাবু আর শিবানীদেবী অবাক। মনোময়, অরুময়, অমিতা, অরুময়ের স্ত্রী জয়তী—সবাই বুঝতে পেরে হাসছে।
“কিন্তু তার সঙ্গে ওই অদ্ভুত প্রদীপগুলোর কী সম্পর্ক?” নন্দিনী তাড়াতাড়ি কথা ঘোরায়।
“সে আরও আশ্চর্য কাহিনি। যে বিশ্বস্ত প্রজার জন্য রানির কাছে পাঠানদের পরিকল্পনার খবর সময়মতো পৌঁছায়, তিনি ছিলেন আমাদের মূর্তিকার ওই আচার্য মশাইয়ের কোনও পূর্বপুরুষ। এই প্রদীপ তাঁরই বানানো। যুদ্ধবিজয়ের পর রানি তাঁকে এই গ্রামে জমিজায়গা প্রদান করেন। তখন আমাদেরও মস্ত জমিদারি ছিল এখানে। রানি ভবশঙ্করী ছিলেন মা চণ্ডীর পূজারি। এই গ্রামে তখন জয়চণ্ডী দেবীর মন্দির ছিল। সেই মন্দিরের জন্যই এই প্রদীপগুলো বানিয়েছিলেন আচার্যি মশাইয়ের সেই পূর্বপুরুষ। সে-মন্দির পরে বিনষ্ট হয়। তখন জমিদারবাড়িতে মানে আমাদের এই বাড়িতে চণ্ডীতলা বানিয়ে প্রদীপগুলো এখানে নিয়ে আসা হয়। তবে সারাবছর ওগুলো আচার্যদের কাছেই থাকত।”
“আর সেই মোহরটা কোথায় এখন? কোনও মিউজিয়ামে?” এত সুন্দর কাহিনি শুনেও নন্দিনীর ভুরু কুঁচকে আছে কেন কে জানে।
“তা তো জানি না রে মা। সে কোথায় হারিয়েছে কে জানে।”
তবু নন্দিনীর ভুরু কুঁচকে আছে দেখে টিয়া ফিসফিস করে বলে, “তুই কি এবার হারানো মোহরের সন্ধানে লেগে পড়বি ভাবছিস?”
“নাহ্। আমি ভাবছি বার বার ওড়িশা চলে আসছে কেন।” নন্দিনীও পালটা ফিসফিস করে।
“মানে?” টিয়া এটা মোটেও আশা করেনি।
“ও কিছু না, এমনি।” নন্দিনী ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে চুপ করার ভঙ্গি করে।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আর কিছুক্ষণ বাদেই ফেরার পালা টিয়াদের। এমন একটা রহস্যে ঘেরা বাড়ি, চারজনেরই মনে হয় আজ রাতটা যেন থাকতে পারলে ভালো হত। আরতির প্রস্তুতি চলছে। নন্দিনীর চোখে পড়ে, এখনও চণ্ডীতলার দাওয়ার একপাশে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে সেই কিশোর বসে আছে। তাকে সারাদিনে একটাও কথা বলতে দেখেনি নন্দিনী। কী হবে ছেলেটার এরপর? তবে এঁরা খুব ভালো মানুষ, নিশ্চয়ই ওকে দেখবেন।
শিবানীদেবী, অমিতা আর জয়তী মিলে একে একে দীপগুলো জ্বালাতে থাকে। দীপগুলো একে অন্যের সঙ্গে সুদৃশ্য রেশমের মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। প্রত্যেক দীপের মাথায় একটা গোল আংটা, দড়িটা তার ভিতর দিয়ে গেছে। আংটার মুখে চাপ দিলে একটা ফাঁক তৈরি হয়। ফলে যে-কোনো নির্দিষ্ট একটা দীপ সহজেই সারি থেকে আলাদা করা যায়। চণ্ডীতলার দুইদিকের থামে দড়ির দুই প্রান্ত বাঁধার জন্য আরও দুটো আংটা আছে। অন্ধকার যত ঘন হতে থাকে, দীপগুলোর গায়ের সূক্ষ্ম কাজ তত ফুটে ওঠে।
ঘনায়মান সন্ধ্যায় বারোটা দীপ বারোটা ছবি হয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকল অবশেষে। শ্রীকৃষ্ণের জীবনের বারোটি কাহিনি। কালিয়দমন, ননী চুরির দৃশ্য, এমনকি বৃন্দাবনের দোলযাত্রাও বাদ যায়নি।
কলকাতার সপ্তমীর সন্ধেতে আজ কত ঝলমলে আলোর মেলা, কত লোকের ভিড়। আর এই শান্ত সুন্দর গ্রামে প্রাচীন কয়েকটা অদ্ভুত দীপের সামনে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল চারটি সপ্তদশী। গ্রামের লোকজন এখনও আসতে শুরু করেনি। চণ্ডীতলার সিঁড়িতে সুন্দর আলপনা আঁকা। ওই সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে একটি মৃত্যুও ঘটে গেছে এই সেদিন। আশি বছরের এক বৃদ্ধ মারা যাওয়ার আগে এক অদ্ভুত ছড়া বলে গেলেন। কেন?
“অনন্ত মানে কী বল তো?” আচমকা নীচু গলায় নন্দিনী জিজ্ঞেস করে।
“যার শেষ নেই! এ আবার কেমন প্রশ্ন?” টিয়া ভুরু দুটো কপালে তোলে।
“আর শুদ্ধ অনন্ত আমার?” প্রায় বিড়বিড় করে নন্দিনী।
“এই রে, নন্দু তুই সেই অদ্ভুত শ্লোকটা নিয়ে পড়লি নাকি? আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা ফিরে যাব, আর হয়তো কোনোদিনই আসা হবে না—ওসব নিয়ে ভেবে কোনও লাভ আছে? তাছাড়া কী বলতে বুড়ো কী বলেছে…” রাকা হড়বড় করে বলতে থাকে।
“নিরাকার হরি মানে কী?” রাকার কথা নন্দিনীর কানেই ঢোকেনি।
“আকারহীন হরি, মানে ঈশ্বরকে কোনও নির্দিষ্ট আকারে ধরা যায় না ইত্যাদি। এ তো সবসময়ই বলে লোকে।” টিয়া ঘাড় বাড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে আলোচনায়। তার হঠাৎ বুক দুরদুর করতে থাকে। নন্দিনী কোন দিকে এগোচ্ছে?
“হরিতে এমনিতেও আ-কার নেই, ই-কার আছে।” চোখ পিটপিট করে নিপাট ভালোমানুষের মতো বলে রাকা। কিন্তু তার মজা করে বলা কথাটার যে এমন ফল হবে সে ভাবতেও পারেনি। আচমকা চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে নন্দিনী। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে, নিশ্বাস পড়ছে দ্রুতবেগে।
“হল কী তোর?” সবার চোখ নন্দিনীর দিকে।
কোনও সমস্যা হয়েছে ভেবে দাওয়া থেকে নেমে আসেন শিশিরবাবু।
“থ্যাংক ইউ রাকা! তুই কথাটা না বললে আরও অনেক সময় নষ্ট হত। শুদ্ধ অনন্ত আমার সাথে/ হরি নিরাকার হয়। আপনাদের আচার্য মশাই ভুল বকেননি মৃত্যুর আগে।”
“তাহলে?” শিশিরবাবু চমকে ওঠেন। মেয়েটার হল কী? বালিয়াল পরিবারের বাকি সদস্যরাও একে একে এগিয়ে আসে নন্দিনীর দিকে।
“শুদ্ধ অনন্ত আমার—শুদ্ধ বা সাধু ভাষায় আমার হল মোর। তাকে অনন্ত মানে শেষ নেই করে দিলে দাঁড়ায় মো।” নন্দিনীর গলা ঈষৎ কাঁপছে।
রাকা-টিয়ার গলা শুকিয়ে কাঠ। মিঠুর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই তার ভিতরে কী চলছে।
“সাথে হরি নিরাকার হয়—হরি নিরাকার মানে আকারহীন বা কোনোরকম কারহীন হলে দাঁড়ায় হর। এবার দুটোকে একসঙ্গে করলে?” নন্দিনীর গলা ধরে আসে উত্তেজনায়।
“মোহর!” একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে সবাই।
ধপ করে উঠোনে রাখা চেয়ারগুলোর একটাতে বসে পড়েন শিশিরবাবু।—“আচার্যি মশাই মোহরের সন্ধান দিয়েছিলেন? মোহর কোথা থেকে এল? সেটা আছেই-বা কোথায়?”
“সেটা পরের দুটো লাইনে বলা আছে।” নন্দিনী এগিয়ে গিয়ে ঝুলন্ত দীপগুলোর নীচে দাঁড়ায়। খোদাই করা অংশের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা আলো ওর মুখে মাথায় অদ্ভুত নকশা তৈরি করে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাকি তিনজনও এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ায়। এবার কী করতে চলেছে নন্দিনী? শিশিরবাবু ও শিবানীদেবীও এগিয়ে যান ওর দিকে। মনোময় ও অরুময়ের মুখে ফুটে উঠেছে অবিশ্বাস। অমিতা, জয়তী আর বীথিকা কী করবে বুঝতে না পেরে একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
“হরিকে দেখিয়া হরি হরিতে লুকায়।” দীপগুলোর দিকে দেখিয়ে নন্দিনী বলে।
“ওই ল্যাম্পগুলো? ওখানে কী? ওখানে তো সবই হরি, মানে সবই শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক ব্যাপার।”
মৃদু হাসে নন্দিনী। এলোমেলো হয়ে থাকা কোঁকড়া চুলে একবার হাত চালিয়ে বলে, “ওরকম সময়েও কেমন শব্দ নিয়ে খেলেছিলেন আপনাদের আচার্যি মশাই। সব দৃশ্যেই হরি ঠিকই, কিন্তু একটা দীপে হ-এ ও-কার র-এ হ্রস্ব-ই অর্থাৎ হোরি বা হোলি। দোল উৎসব।”
পিনপতন নিস্তব্ধতা উঠোন জুড়ে। শিশিরবাবু কী যেন একটা বলার চেষ্টা করেন। সবার চোখ জ্বলতে থাকা দীপগুলোর উপর। সারির দশ নম্বর দীপে বৃন্দাবনে দোল খেলছেন শ্রীহরি।
ধরা গলায় রাকা বলে, “এবার?”
“এবারে যা করার আমিই করতে পারব।”
ঠান্ডা ক্রূর একটা গলা সবাইকে চমকে দেয় হঠাৎ। সবার অলক্ষে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে নন্দিনীর ঠিক পিছনে। নন্দিনী কানের পাশে ঠান্ডা ধাতব একটা কিছু অনুভব করে।
“উঁহু, একদম নড়বে না কেউ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ খুকুমণি, ধাঁধার সমাধান করার জন্য। বুড়ো অনন্ত আচার্য যদি ভালোয় ভালোয় বলে দিত কথাটা, তাহলে মরতে হত না।”
দাওয়ার উপর থেকে বীথিকা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। শিশিরবাবুও সংবিৎ ফিরে পান সেই আওয়াজে। চিৎকার করে ওঠেন, “এ কী ব্যাপার অভিজিৎ? এসব কী বলছ তুমি? তোমার হাতে বন্দুক কেন?”
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে অভিজিৎ চক্রবর্তী। রাকার দিকে আঙুল তুলে কর্কশ গলায় বলে, “তুমিই জিজ্ঞেস করছিলে না চতুর্ভুজ চক্রবর্তীর কী হল? হ্যাঁ, তিনি ওড়িশায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। ওই ভবশঙ্করী তাঁকে সর্বসমক্ষে বিশ্বাসঘাতক বলে ঘোষণা করেছিল। সেই অপমানে জর্জরিত হয়ে তিনি অসুস্থ অবস্থায় নিঃসীম দারিদ্র্যে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর অপমানের কথা লিখে যান, আর লিখে যান এক অমূল্য সম্পদের কথা। তাঁর অপমানের প্রতিশোধ না নিলে তাঁর আত্মার শান্তি হবে না কোনোদিন। তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে এটা করা আমার কর্তব্য।”
“যা ব্বাবা, বিশ্বাসঘাতককে বিশ্বাসঘাতক বলা যাবে না?” টিয়া এরকম অবস্থাতেও আচমকা বলে ফেলে।
“চুপ!” প্রায় আকাশ ফাটিয়ে বিকট চিৎকার করে ওঠে অভিজিৎ।—“কীসের বিশ্বাসঘাতকতা, অ্যাঁ? রুদ্রনারায়ণ মারা যাওয়ার পর ভুরশুটের সিংহাসনে বসার উপযুক্ত ছিলেন একমাত্র চতুর্ভুজ চক্রবর্তী। ওই রানি তাঁকে সেই সুযোগ কোনোদিন দেয়নি।” অভিজিতের মুখ হিংস্র হয়ে ওঠে, তার চোখগুলো উন্মাদের মতো লাগছে।—“এক সামান্য মূর্তিকারের জন্য বাঁশুরির যুদ্ধে হেরে যান ওসমান খাঁ আর চতুর্ভুজ। না-হলে সেদিনই ভবশঙ্করীর ভবলীলা সাঙ্গ হত। সেদিনের কেউ আজ আর নেই, কিন্তু সেই অমূল্য মোহর তো আছে।”
ডুকরে কেঁদে ওঠে বীথিকা।—“এসব কী বলছ তুমি! এরকম অন্যায় করে তুমি পার পাবে না। এর জন্যই তুমি মহালয়ার দিন অফিসের কাজ আছে বলে বেরিয়ে দুই দিন পর বাড়ি ফিরেছিলে?”
“শুধু এই কারণেই কলেজে তোমার সঙ্গে আলাপ করেছিলাম বীথিকা। কত খুঁজতে হয়েছে তোমাদের পরিবারকে কোনও ধারণা আছে তোমার?” খিঁচিয়ে ওঠে অভিজিৎ।
কথাবার্তার ফাঁকে মনোময় আস্তে আস্তে এগোনোর চেষ্টা করছিল অভিজিতের দিকে, কিন্তু শেষরক্ষা হল না। শক্ত গলায় অভিজিৎ বলে, “এই মেয়েটির কানের কাছে যে কোল্টটি ঠেকানো আছে সেটা কিন্তু লোডেড।”
রাকা আর টিয়া খেয়াল করে, তাদের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নামছে। মিঠুর মুখ লাল। নন্দুর মুখ ওরা দেখতে পাচ্ছে না। হঠাৎ যেন সবাই বুঝতে পারে কত বড়ো বিপদের মুখে ওরা দাঁড়িয়ে আছে।
শিশিরবাবু বুকের মধ্যে কেমন একটা চাপ অনুভব করেন। আচার্যি মশাইয়ের মৃত্যুর কারণ তাঁর নিজের জামাতা? চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পান শিবানীদেবী ধীরে ধীরে বসে পড়ছেন দাওয়ার উপর। এ কী সংকটে পড়লেন তিনি। মোহর আছে কি নেই তিনি জানেন না, জানতে চানও না, শুধু তাঁর অতিথিদের যেন কোনও ক্ষতি না হয়। তাহলে তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না কখনও।
একটু দূরে কল্পলতার শাসমলবাবু পাথরের মতো বসে আছেন। শিশিরবাবু নিজের সর্বশেষ শক্তি একত্র করে বলেন, “অভিজিৎ, তুমি এখান থেকে মোহর নিয়ে বেরোতে পারবে না। এখুনি গ্রামের লোকজন আসতে শুরু করবে, পুলিশে খবর দেবেই কেউ না কেউ। এই ভুল কোরো না তুমি।”
“তাই নাকি?” চিবিয়ে চিবিয়ে বলে অভিজিৎ। তারপর নন্দিনীকে রিভলভারের নল দিয়ে ধাক্কা মেরে বলে, “এই মেয়েটিকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব। কিছু মনে করবেন না শাসমলবাবু, আপনাদের গাড়িটা একটু ধার নিচ্ছি। পুলিশে কেউ খবর দিলে, বা আমার পিছু নিলে এই মেয়েটি আর বাঁচবে না। কলকাতার মহামান্য অতিথিকে নিয়ে এত বড়ো রিস্ক কি আপনারা কেউ নেবেন? যতক্ষণে পুলিশ মেয়েটির সন্ধান পাবে, ততক্ষণে আমি বহুদূর—আমার টিকিটিও কেউ ছুঁতে পারবে না।”
বীথিকা হঠাৎ দাওয়ায় বসে পড়ে মাথা ঠুকতে থাকে। অমিতা আর জয়তী জড়িয়ে ধরে তাকে।
“এই যে তুমি, ল্যাম্পটা খুলে আমাকে দাও।” রাকার দিকে তাকিয়ে অভিজিৎ বলে।
আবার নলের খোঁচা লাগে নন্দিনীর কানের পেছনে। দাওয়ায় ওঠে রাকা। বুঝতে পারে, তার হাঁটু কাঁপছে। দীপটা গরম হয়ে আছে। নিজের তোয়ালে রুমালে জড়িয়ে মাথার আংটায় চাপ দিয়ে ফাঁক করে দীপটা খুলে এনে অভিজিৎকে দেয়। কেন মরতে এখানে এল তারা? অভিজিৎ ভিতরের প্রদীপটা নিভিয়ে দেয়।
“এগোও।”
আবার ঠেলা খায় নন্দিনী। পায়ে পায়ে এগোতে থাকে উঠোন ধরে। সামনে টিয়া—দু-চোখ দিয়ে জল পড়ছে অঝোরে, ঠোঁট কাঁপছে। ওর পেছনে মিঠু। মিঠুর সঙ্গে চোখাচোখি হয় একবার। মিঠুর সামনে এসে বিদ্যুৎবেগে নীচু হয়ে বসে পড়ে নন্দিনী। কী হচ্ছে বোঝার আগেই মিঠুর দুরন্ত একটা সাইড কিক সজোরে এসে লাগে অভিজিতের চোয়ালে। হাত থেকে খসে পড়া রুমাল মোড়া দীপটা লুফে নেয় টিয়া। পা নামিয়েই শাড়িতে জড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল মিঠু, সামলে নিয়ে পাঞ্চ তুলতেই দেখে সামনে রিভলভার।
চোয়ালে প্রচণ্ড লেগেছে অভিজিতের। তবু শয়তানি হাসিটা ছড়িয়ে পড়ে মুখ জুড়ে। রিভলভার ধরা হাতটা উঠতে থাকে মিঠুর মাথা লক্ষ্য করে। চোখ বন্ধ করে ফেলে নন্দিনী, এই প্রথম বোধ হয় সে ভয় পেয়েছে।
ডং করে একটা শব্দের সঙ্গে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখটা খুলেও যায় তার। অবাক হয়ে দেখে, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে অভিজিৎ, মাথায় ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। পেছনে মস্ত একটা পিলসুজ হাতে হাঁপাচ্ছে সুমন্ত। তারপর হাত থেকে পিলসুজটা ফেলে দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে সেও।
এতক্ষণে কথা ফোটে মিঠুর। গভীর ক্ষোভে বলে, “ঠিক এই কারণেই আমি শাড়ি পরতে চাই না।”
চুপচাপ শান্ত মিঠু যে জিৎকুনদোতে ব্লু-বেল্ট, সেটা অভিজিতের জানার কথা নয়।
রাকা এগিয়ে এসে বলে, “বিশ্বাসঘাতকতা যে হেরেডিটারি তা জানতাম না।”
আরতি শেষ। গ্রামের লোকজন প্রসাদ নিয়ে ফিরে গেছে। ঘড়িতে প্রায় ন’টা। সবার বাড়িতে ফোন করে বলে দেওয়া হয়েছে ফিরতে দেরি হবে একটু, অবিশ্যি আসল কারণ জানানো হয়নি। পুলিশ খানিক আগে এসে অভিজিৎকে নিয়ে গেছে।
চণ্ডীতলার দাওয়ায় ওরা চারজন, সুমন্ত আর বালিয়াল পরিবার। আরতি দেখতে এসে বীথিকাকে হালকা ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেছেন গ্রামের ডাক্তার।
“তুমিই কাজটা শেষ করো মা।” শিশিরবাবু নন্দিনীর দিকে বাড়িয়ে ধরেন দীপটা।
মটরদানার মতো অংশটা ধরে সামনের দিকটা খুলে ফেলে নন্দিনী। এবার তার বেশ লজ্জা করছে। নীচু গলায় বলে, “শেষ লাইন—হরিতে লুকায়। দেখুন সামনের অংশে শ্রীকৃষ্ণকে খোদাই করেননি শিল্পী। করেছেন খোপটার পাশের অংশে।”
খোপের ভিতরের প্রদীপের গোল অংশের পাশ দিয়ে আঙুল ঢোকায় নন্দিনী। খোপের পাশের অংশের ভিতরের দিকের দেওয়ালে কী খুঁজতে থাকে। খুট করে একটা আওয়াজ হয় হঠাৎ। উত্তেজিত গলায় নন্দিনী বলে, “এই দেখুন, একটা সামান্য উঁচুমতো কিছু আছে এখানে।”
চাপ দিতে খুট করে সরে একটা লুকানো ছোট্ট তাক বেরিয়ে এল। সবাই ঝুঁকে পড়ে সেদিকে। হালকা করে ঝাঁকিয়ে হাতের তালুর উপর গোলাকার একটা জিনিস বের করে আনে নন্দিনী। মখমলে মোড়া কিছু একটা। এতদিনের প্রদীপের উত্তাপ সয়ে মখমলের রং ফ্যাকাশে। আস্তরণ সরাতেই আলো পড়ে ঝলমল করে ওঠে চারশো বছরের পুরানো আকবরি মোহর। একদিকে ফার্সিতে সম্ভবত সম্রাট আকবরের নাম, অন্যদিকে বাংলা হরফে লেখা—‘রায়বাঘিনী’।
বাড়ির পথে ফিরছে ওরা। সবাই চুপচাপ। শাসমলবাবু ফিরে গঙ্গাস্নান করবেন ঠিক করেছেন। বাবা রে, সপ্তমীতেই অসুরবধ দেখলেন এবার।
গাড়িতে ওঠার আগে শিশিরবাবু বলেছেন, “এই মোহর সুমন্তর পারিবারিক সম্পত্তি হলেও এ মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাছাড়া এটা দেশের সম্পদ এখন। আমি ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে কথা বলে ওদের দিয়ে দেব। সবাই জানুক এক বীর রানির কথা, আমাদের ইতিহাস তো এসব পড়ায় না। সুমন্তর মোহর না হলেও চলবে, ওর পড়াশোনার ভার আমার।”
শিবানীদেবী ওদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছেন, “পরের পুজোয় এসো কিন্তু।” তাঁর চোখ চিকচিক করছিল জলে।
টিয়া বলল হঠাৎ, “মোহরটা আচার্য পরিবারে এল কী করে সেটাই একমাত্র জানা গেল না।”
নন্দিনী টিয়ার চুলে এক টান দিয়ে বলল, “আমার ধারণা রানি আচার্যদের সেই পূর্বপুরুষকে তাঁর বিবাহের যৌতুক হিসেবে ওটা দিয়েছিলেন।”
তিনজনে একসঙ্গে বলে ওঠে, “থ্রি চিয়ার্স ফর নন্দুপিডিয়া! হিপ হিপ হুররে!”
১৬০৩ খ্রিস্টাব্দ, বাঁশুরি গ্রাম, ভুরীশ্রেষ্ঠ সম্রাজ্য।
“মা, আমি কি এর যোগ্য?”
ভবশঙ্করীর পায়ের কাছে বসে বিরূপাক্ষ ও কুঞ্জরী। কুঞ্জরীর মাথায় সিঁদুর।
সস্নেহে হাসেন রায়বাঘিনী। চোখ দিয়ে যেন আলো ঝরে পড়ে।
“মা, তোমার নাম লেখা আছে এটাতে। এটাই পুজো করব আমরা আজ থেকে। তুমিই আমাদের মা চণ্ডী।”
বেরিয়ে যায় ওরা। নতুন সংসার পাতবে—সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি।
বসে থাকেন রানী ভবশঙ্করী। রুদ্রনারায়ণ কি জানতে পেরেছেন তাঁর ভবশঙ্করী হেরে যায়নি? কত কাজ বাকি এখনও।
ধীরে ধীরে ইতিহাসের ধূলিমলিন জাল আচ্ছন্ন করে তোলে তাঁকে।
*আমতার বালিয়াল পরিবার ও তাদের পারিবারিক দুর্গাপূজা বাস্তব হলেও এই গল্পে বর্ণিত বালিয়াল পরিবারের চরিত্ররা সবাই কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে মিল থেকে থাকলে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ও কাকতালীয়।
ছবি: সুকান্ত মণ্ডল
লেখিকার অন্যান্য লেখা
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু
দু-হাজার তিনশো বছর আগে পাটলিপুত্র থেকে তক্ষশিলা পর্যন্ত বাণিজ্যদলের সংঘাতবহুল রোমাঞ্চকর যাত্রাপথ শেষে এক তরুণ পৌঁছল তক্ষশিলায়। সেই নগরীর রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন উত্তাল। একদিকে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার, অন্যদিকে আচার্য কৌটিল্যের অখণ্ড ভারতের স্বপ্নে মশগুল একদল যোদ্ধা। অসংখ্য চরিত্রের ঘনঘটা, ষড়যন্ত্র, কাপুরুষতা আর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে কিছু মানুষের আত্মমর্যাদা আর স্বাধীনতা রক্ষার সাহসী সংগ্রামের আখ্যান এই উপন্যাস।
উত্তরমেরুর দুর্গম তুষার-মরুতে জীবন যুদ্ধে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লোকমুখে গড়ে উঠেছিল নানা রূপকথা। মেরু অঞ্চলের অধিবাসীরা পৃথিবীর বাকি অংশ থেকে ছিল বিচ্ছিন্ন। সম্পূর্ণ অচেনা সেই দেশের লোকসংস্কৃতি, আচার ব্যবহার, মনস্তত্ত্বের সাক্ষ্য রেখে গেছে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বাহিত গল্প-গাথা, যার রূপরেখা ফুটে উঠেছে কুড়িটি লোককাহিনির সংকলন 'তুষারদেশের রূপকথারা' বইটিতে।