উপন্যাস
15% OFF * FREE SHIPPING
উপন্যাস
কুদোডাঙার পশ্চিমে একগাদা ঝোপঝাড় আর বিশাল একটা ঝিল। সেই ঝিলের পাশেই সাহেবদের দেড়শো বছরের পুরোনো দোতলা বাড়ি। সেকেলে চুন-সুরকির বাড়ি বলে এখনও টিকে আছে। এককালে চারদিকে উঁচু বাউন্ডারি ছিল। এখন এদিক-ওদিকে ধ্বসে পড়েছে। শেয়াল-কুকুরের নিত্য যাতায়াত। সাপখোপও আছে প্রচুর। বাউন্ডারির ভিতরে আগাছা আর বড়ো বড়ো গাছ। চড়রা গাছের বীজ বসন্তকালের শেষে উড়ে উড়ে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ছাড়িয়ে নিলে খেতে একেবারে ছোট্ট বাদামের মতো। কতগুলো শ্বেতপাথরের মূর্তি এদিক-ওদিক ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে।
রঞ্জন দাশগুপ্ত
ভোর হল।
সূর্যকে দেখা যাচ্ছে না এখনও। আকাশ জুড়ে ভারি মিষ্টি আর নরম একটা আলো। মন ভালো করে দেওয়া বাতাস বইছে। তাতে অল্প অল্প ঠান্ডা ভাব। জানান দিচ্ছে, আর ক’টা মাস পরেই শীতকাল আসতে চলেছে।
সাতকড়ি নন্দী তার বাড়ির পিছনের বাঁধানো উঠোনে কুয়োতলার পাশে দাঁড়িয়ে বিকট শব্দ করে জিভ ছুলছেন। কেউ যদি সেরকম মনোযোগ দিয়ে দাঁড়িয়ে শোনে, ভাববে এই বুঝি লোকটা বমি করে ফেলবে!
সাতকড়িবাবুর নাতির নাম নন্তু। দারুণ ভালো ফুটবল খেলে। গুলি-ডাণ্ডার হাত চমৎকার। অনেকক্ষণ ডুবসাঁতার দিতে পারে। যে-কোনো গাছের মগডালে মুহূর্তের মধ্যে চড়ে বসা তার কাছে কোনও ব্যাপারই নয়।
তবে মুশকিল হল যার এত গুণ আছে তার যে দু-একটা বদগুণও থাকবে সেটা একেবারে নির্জলা সত্যি কথা। ভগবান সবকিছুর দিকেই খেয়াল রাখেন কিনা! তাই নন্তু পড়াশোনাতে একটু দুর্বল। অঙ্ক কষার সময় প্রশ্নকর্তা যে আসলে কী চাইছেন, সেটা সে প্রায়ই বুঝতে পারে না। ইতিহাসে গুচ্ছের রাজরাজড়া এসে ভিড় জমানোতে সে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। ভূগোল পড়ার সময় কেন যেন তার মনে হয় দেওয়াল ঘড়িটার ব্যাটারিটা শেষ হয়ে গেছে। ইংরেজি বইয়ে যাঁরা শক্ত শক্ত কথাগুলো লিখে গেছেন, তাঁদের প্রতিও তাকে দাঁত কিড়মিড় করতে দেখা গেছে।
এইসব কারণে তার বাবা পাঁচকড়িবাবু বিষয় ধরে ধরে তার পিছনে একগাদা মাস্টারমশাইকে লাগিয়ে দিয়েছেন। এই ছুটির সকালেও যেমন তাকে পড়াতে এসেছেন স্থানীয় ৺গিরিজাবালা দাসী স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গোপালকৃষ্ণবাবু। বাংলা আর ইংরেজিটা তিনি দেখিয়ে যান।
গোপালকৃষ্ণবাবুর পড়ানোর একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে। প্রতিবারই পড়ানো শুরু করার আগে বাংলা বা ইংরেজিতে কেন খুবই দখল রাখা উচিত সে-বিষয়ে সংক্ষিপ্ত একটি বক্তব্য রেখে তারপর পড়ানো শুরু করেন তিনি।
আজই যেমন বাংলা ভাষা নিয়ে বলছিলেন, “মাতৃভাষা আর মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে আর কিছুরই তুলনা চলে না। এরা অমূল্য। নিজের ভাষাকে যে ভালো করে জানে না, অন্য ভাষাতেও তার ব্যুৎপত্তি জন্মায় না। একমাত্র আমাদের দেশেই বিজাতীয় ভাষার উপরে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ জাপান, চিন, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া—সব দেশের ছেলেমেয়েরা নিজেদের মাতৃভাষাতেই পড়াশোনা করে বড়ো হয়। তাই তারা আজ এত উন্নত। এমনকি আর্জেন্টিনা বা কলুম্বিয়ার মতো পুঁচকে দেশেও আর্জেন্টিনীয় বা কলুম্বিয়ান ভাষার বই-ই পড়ানো হয়!
“এই যে আমাদের মহান ভাষা বাংলা, তা কিন্তু আসলে সংস্কৃত ভাষারই এক সন্তান। প্রাচীন কালে আর্যরা যে-ভাষায় কথা বলতেন, সে সংস্কৃত ভাষা থেকেই বাংলা ভাষার উদ্ভব। তাই সংস্কৃতকে যদি দেবভাষা বলা হয়, তাহলে বাংলাকে দেবভাষার কন্যা বললে অত্যুক্তি করা হবে না।” এরপরই নাক-মুখ কুঁচকে গোপালকৃষ্ণবাবু বললেন, “ছ্যা, ছ্যা! কীসের গন্ধ আসছে রে? একেবারে নাকে এসে গোঁত্তা মারছে!”
নন্তু মাথা নীচু করে সব শুনছিল। যদিও সে আসলে কিছুই শুনছিল না। রোজই তাই হয়। তবে স্যারের বলা শেষ কথাটা ফিল্টার করে শুনতে পেল। সে মাথা সোজা করে বলল, “ছাতিম ফুলের গন্ধ মাস্টারমশাই।”
“রাম, রাম! সকালবেলায় ছাতিম গাছের মুখ দেখাও পাপ। খুব অপয়া। বন্ধ কর জানালাটা।”
নন্তু জানালাটা বন্ধ করার জন্য উঠতে উঠতে বলল, “ছাতিমের সংস্কৃত কী মাস্টারমশাই?”
নেহাতই টাইম পাস করার জন্য প্রশ্নটা করেছিল নন্তু। কিন্তু গোপালকৃষ্ণবাবু খুব অসুবিধায় পড়ে গেলেন। কপালে বিকট ভাঁজ ফেলে, নাক মুখ ভীষণ কুঁচকে বললেন, “সে হল গিয়ে ইয়ে! ইস্! পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছে না।”
“সপ্তপর্ণী, সপ্তপর্ণী!”
জানালার বাইরে থেকে গমগমে গলাটা কানে আসতেই নন্তুর মুখে হাসি খেলে গেল। যদিও গোপালকৃষ্ণবাবু খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপরই জানালা দিয়ে খোঁচা খোঁচা গোঁফ-দাড়ি আর একমাথা এলোমেলো চুল সমেত রোদে পুড়ে তামাটে, রোগা আর লম্বাটে একটা মুখ উঁকি দিল। মুখটা নন্তুর দিকে ঘুরে আগের মতোই গমগমে গলায় বলল, “নন্তুভাই, একটু জল খাওয়াতে পারবে?”
নন্তু উঠে গেলে সে তার ভাসা ভাসা কাচের মতো চোখগুলি গোপালকৃষ্ণবাবুর দিকে ঘুরিয়ে বলল, “বাইরে থেকে শুনছিলাম মাস্টারমশাই। ভারি ভালো পড়ান আপনি। তবে কিনা ছাত্রের সামনে কখনও গুরুনিন্দা করতে নেই, তাই আড়ালেই বলছি। কলুম্বিয়ান আর আর্জেন্টিনীয় বলে কিন্তু কোনও ভাষা নেই মাস্টারমশাই, ওই দেশগুলিতে বেশি চলে আপনার স্প্যানিশ।”
গোপালকৃষ্ণবাবু একটু কাশলেন। এ হল কুদোডাঙার সাহেব। যদিও বংশপরম্পরায় এখানে থাকার সুবাদে তরতরে বাংলা বলে। তাই তাকে সবাই বাঙালি সাহেব বলেই ডাকে। চোখ ছাড়া আর অন্য কিছু দেখে সাহেব বলে বোঝাও ভার। একেবারে বিষ পিঁপড়ে! ব্যাটার মতলব বোঝা দায়। ক’দিন আগেই হাট থেকে ফেরার পথে সে গোপালকৃষ্ণবাবুকে মাঝ-রাস্তায় আটকেছিল। জিজ্ঞাসা করেছিল, “আচ্ছা মাস্টারমশাই, দ্বিরদ মানে কী?”
খুবই সহজ প্রশ্ন। গোপালকৃষ্ণবাবু বুক চিতিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, “দ্বিরদ মানে যার দুটো দাঁত! মানে হাতি।”
“আচ্ছা! তাহলে যে-বাচ্চার মাত্র দুটোই দাঁত বেরিয়েছে তাকেও কি দ্বিরদ বলা যাবে? কিংবা ধরুন কোনও হাতির যদি একটা দাঁত ভেঙে যায়, সে কি আর দ্বিরদ থাকবে না?”
তাই তো! খুবই মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলেন গোপালকৃষ্ণবাবু। মাথা-টাথা চুলকেও কোনও উত্তর দিতে পারেননি।
তাঁর হেনস্থার খবর গোপন থাকেনি। এলাকার আর এক প্রখ্যাত গ্রামীণ কবি মানবেন্দ্র ভট্টাচার্য গোটা ঘটনাটি নিজের চোখে দেখেছিলেন, নিজের কানে শুনেছিলেন। তিনি প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে কথায় কথায় খবরটি দিয়ে এলেন। এমনকি ‘মাটির গান’ পত্রিকার সম্পাদক মশাইকেও গিয়ে বলে এসেছিলেন, সাহেব একটা সহজ প্রশ্ন করেছিল, বাংলার শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও গোপালকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্নটির জবাব দিতে পারেননি।
তাই গোপালকৃষ্ণবাবু আর কথা বাড়ালেন না। সাহেব অবশ্য যায়নি। সে জানালার উলটোদিকে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই বলল, “তবে মাস্টারমশাই, বাংলা কিন্তু ঠিক সংস্কৃত থেকে আসেনি। বিভিন্ন উপজাতির ভাষা, গ্রিক, ফারসি, সংস্কৃত—নানা ভাষা থেকে শব্দ এসেছে বাংলায়।”
গোপালকৃষ্ণবাবুর আর সহ্য হল না। ঝংকার দিয়ে বলে উঠলেন, “তুমি তার জানো কী! তুমি তো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। ইউরোপের সঙ্গেই তোমার বেশি যোগ।”
সাহেব মোটেই রেগে গেল না। জলের গ্লাস হাতে ঘরে ঢোকা নন্তুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “আপনি ঠিকই বলেছেন মাস্টারমশাই। তবে কিনা, যে ব্রাহ্মী লিপি থেকে বাংলা লিপি এসেছে বলে অনেকে মনে করেন, তা সফলভাবে চিহ্নিত করেছিলেন কিন্তু এক ইউরোপিয়ান। জেমস প্রিন্সেপ। এমনকি আজ আমাদের বাংলা ভাষায় যতটুকু পড়াশোনা, তাও আর এক ইউরোপিয়ানের জন্যই। উইলিয়াম কেরি।”
জলটুকু খেয়ে নিয়ে সাহেব বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। সময় নেই তার। রোজ ভোর হতে না হতেই সে গ্রামের পথে বেরিয়ে পড়ে। মর্নিং ওয়াক-কে-মর্নিং ওয়াক। আবার গ্রামের লোকজনের খোঁজখবরটাও নেওয়া হয়।
ফুলি এই সাতসকালে রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে বসেছিল। কিন্তু ধোওয়া-মোছা তকতকে আকাশ, স্নিগ্ধ আলো আর নরম বাতাস তাকে ভারি অন্যমনস্ক করে দেয়। তাই গলা ভালো হলেও আজ কিছুতেই তার সুর লাগছিল না। সাহেব বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কান খাড়া করে শুনল। তারপর চেঁচিয়ে বলল, “হচ্ছে না! হচ্ছে না ফুলি। ‘সকালবেলার কুঁড়ি আমার বিকালে যায় টুটে’, এখানে ‘আমার’-টাতে ফলসেটো দে।”
বেলা বাড়ছে আস্তে আস্তে।
কুদোডাঙার উত্তরে একটা রাস্তা ঢালু হয়ে নীচের দিকে চলে গেছে। আসলে এই জায়গাটা আশেপাশের জমি থেকে একটু উঁচুতে, তাই। অবশ্য দক্ষিণদিকে আরও উঁচু একটা টিলা আছে। এখানকার লোকে বলে পাহাড়।
নীচের দিকে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া রাস্তাটা সোজা চলে গেছে সাহেবপাড়ার দিকে। অনেক পুরোনো রাস্তা। আগে চওড়া সাদা সাদা পাথর বসানো ছিল। ব্রিটিশ আমলের ব্যবস্থা। সে-পাথর অনেক জায়গায় উঠে গিয়েছিল, ভেঙে গিয়েছিল। তাই বছর দুয়েক আগে এখানে সরু একটা পিচের রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে। অর্ধেকটা অবশ্য। তা সেই রাস্তার খোয়া এই দু-বছরেই উঠে গিয়ে এদিক-ওদিক গর্ত।
যেখান থেকে ঢালু হয়ে রাস্তাটা নীচে নেমে গেছে, তার আশেপাশে প্রচুর জঙ্গল। ঝোপঝাড়। আর পিছন দিকে একটা ঝুপড়ি। ওটাই কুন্তীবুড়ির আস্তানা। প্রচুর বয়স তার। মুখে অজস্র ভাঁজ। চোখে ছানি। তবে এখনও চলাফেরা করতে পারে।
ঢালু জায়গাটার পাশে মস্ত বড়ো একটা বটগাছের নীচে কুন্তীবুড়ি বসে ছিল। দূর থেকেই তাকে দেখতে পেয়েছিল সাহেব।
“আজ কী রান্না হচ্ছে গো দিদা?” হাঁক দিল সাহেব।
বুড়ি গলা চিনতে পেরে ফোকলা মুখে হাসে। চোখের উপরে আড়াআড়ি হাত রেখে তার দিকে দেখবার চেষ্টা করে।
“অ, সাহেব! এলি বাবা! কোথায় যাবি? ইস্কুলে?”
“হ্যাঁ গো দিদা। রান্না করেছ আজ?”
“করলুম তো! মাঠ থেকে ক’টা মেটে আলু পেয়েছিলুম। আর নবীন এসে কাঁচা লংকা দিয়ে গেল। ভাতের সঙ্গে আলুসেদ্ধ করতে দিয়েছি। কাঁচা লংকা দিয়ে মেখে দেব। খাবি ভাই?”
“খাবো গো, খাবো। আগে স্কুল থেকে ঘুরে আসি।”
“আয় ভাই। তা আমাকে একটু ঘর অবধি ছেড়ে দিবি নাকি? খুব ব্যথা কোমরটায়।”
একটি মাত্র ঘর। গোটা ছয়েক বাঁশের খুঁটির উপর খেজুরপাতার ছাউনি। কাঠকুটোর মধ্যে খেজুরপাতা গুঁজে দেওয়াল। গোবর দিয়ে নিকোনো মাটির মেঝে। তকতক করছে একদম। একপাশে ক’টা ইট দিয়ে তৈরি উনুন। সেখানে কাঠের জ্বালে মাটির হাঁড়িতে ভাত ফুটছে। সাহেব ঘর অবধি ধরে ধরে পৌঁছে দিল তাকে।
আগে কুন্তীবুড়ি সাত গাঁ ঘুরে ভিক্ষা করত। এখন শরীরে জোর নেই। গ্রামের মানুষেরাই চালটা, আলুটা, কাঁচকলাটা দিয়ে যায়। পাঁচমেশালি চালের ভাতের ভারি সুন্দর গন্ধ উঠছে।
সব দেখেশুনে সাহেব বলল, “দিদা, শীতকাল আসছে। তোমার খুব ঠান্ডা লাগবে।”
“কী করব ভাই! কে আছে ঘর সারিয়ে দেয়। গেল বছর বর্ষাতে খুব কষ্ট পেলুম।”
“আমি এসে যে পলিথিন টাঙিয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম? আমার সঙ্গে যেতেও বলেছিলাম। গেলে না। আর গেল বছর কই! এ-বছরই বর্ষার সময়ে তো।”
বুড়ি কপালটা আরও কুঁচকে কী যেন চিন্তা করে। শুকনো ঠোঁট আস্তে আস্তে চেটে নিয়ে বলে, “তা হবে। আজকাল কি আর মনে থাকে কিছু!”
“কোনও চিন্তা কোরো না। ফের সারিয়ে দেব তোমার ঘর।”
সাহেবপাড়া নামেই পাড়া। প্রত্যন্ত অঞ্চল আসলে। চারদিকে জঙ্গল। তার মাঝে ইতিউতি দু-চারটে দেড়-দুশো বছরের পুরোনো চুন-সুরকির ভাঙাচোরা বাড়ি মাথা উঁচু করে আছে। এককালে সত্যি সত্যি সাহেবরা থাকত।
তবে গির্জাটা এখনও আছে। আর আছে অনাথ ছেলেদের থাকার জায়গা। বড়ো বড়ো গাছের মাঝে বিঘা দু-এক জমি পরিষ্কার করে ফুল আর সবজি বাগান। তার একদিকে লাল রঙের একটা দোতলা বাড়ি। উপর-নীচ মিলে গোটা ছয়েক ঘর। তার পাশে লাল টালিতে ছাওয়া সুন্দর তিনটি একতলা ঘর। একটির উপরে ক্রুশ। সেটি গির্জাঘর। অন্যটি ফাদারের অফিস। দোতলা বাড়িটায় অনাথ ছেলেদের স্কুল চলে।
অনেকদিন আগে এখানে বড়ো একটা গির্জাঘর ছিল। রঙবেরঙের কাচ বসানো আবলুস কাঠের মস্ত দরজা। তখন অনেক ইউরোপিয়ানের বসবাস ছিল এখানে। নীল-চাষের সূত্রে তাঁরা এখানে থাকতেন। পরে অনেকে মারা গিয়েছিলেন। বাকিরা চলে গিয়েছিলেন বিদেশে নিজেদের আসল বাড়িতে। সেও অনেকদিন হল।
এখন সেই গির্জা ধ্বসে গেছে। জঙ্গলের মধ্যে অনেক কবর দেখা যায় এখনও।
রেক্টর বাঙালি খ্রিস্টান। অফিস-ঘরের লাগোয়া ছোট্ট ঘরটাতে থাকেন। এখন তিনি অফিসেই একটা টেবিলের পিছনে কাঠের চেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে ছিলেন। সাহেব প্রথমে গিয়ে সেখানেই মাথা নীচু করে দাঁড়াল। বলল, “গুড মর্নিং, রেক্টর।”
রেক্টর অন্যদিকে তাকিয়ে সাহেবের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছিলেন। ভীষণ রেগে আছেন তিনি। দেওয়াল ঘড়িটা টিকটিক করছিল পিছনে।
কিছুক্ষণ এরকম চলল। তারপর তিনি ভুরু কুঁচকে সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার রজার? কতবার ডেকে পাঠালাম। প্রার্থনাতেও আসো না, স্কুলেও আসো না! আজ কী মনে করে?”
সাহেব লাজুক মুখে ঘাড়টা চুলকে নিল একটু। তারপর বলল, “ক’দিন একটু ব্যস্ত ছিলাম রেক্টর। তাই আসতে পারিনি। আই অ্যাম রিয়্যালি ভেরি সরি।”
“ব্যস্ত ছিলে? কীরকম ব্যস্ত ছিলে শুনি? আমি তো শুনলাম তুমি সারাদিন টো টো করে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে বেড়াও। কোনও কাজকর্মও করো না, স্কুলে মিউজিক শেখাতেও আসো না। আমি খুব ভালোমানুষ, তাই আগের মাস পর্যন্ত তোমার বেতন কাটিনি। কিন্তু আমার ভালোমানুষির কী প্রতিদান দিচ্ছ তুমি? আমাকেও তো কোথাও জবাব দিতে হয়!”
সাহেব মাথা নীচু করেই দাঁড়িয়ে রইল। কোনও জবাব দিল না। রেক্টর কিছুক্ষণ তার উত্তরের প্রত্যাশা করলেন। কড়া কথা বলার জন্য হয়তো তাঁর একটু অনুতাপ হল। নরম সুরে বললেন, “আমার কথায় কিছু মনে কোরো না রজার। ভালোবাসি, তাই বলি তোমাকে।”
“জানি রেক্টর। আপনিই বড়ো করেছেন আমাকে। এই চাকরিটাও আমাকে আপনিই জোগাড় করে দিয়েছিলেন যাতে পেটটা চলে আমার। আমিই বরং আপনার বিশ্বাস রাখতে পারিনি। কী করব! বাঁধাধরা কিছু করতে আমার ভালো লাগে না। চাকরিটা আমি ছেড়ে দেব।”
“সে কি!” রেক্টর দাস অবাক হলেন।—“তাহলে তোমার চলবে কী করে!”
সাহেব কিছু বলল না। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। রেক্টর একটু ইতস্তত করলেন, তারপর বললেন, “ঠিক আছে। তোমায় চাকরি ছাড়তে হবে না। যেদিন ইচ্ছে করবে, এসে বাচ্চাদের শিখিয়ে যেও। তবে ওরা তো অরফান। আর একটু স্নেহ-ভালোবাসার প্রয়োজন ওদের। সেটা তোমার কাছে আশা করি। আর একটু বেশি ডিসিপ্লিনও। ঠিক আছে, এখন যাও। বাচ্চারা অনেকদিন দেখেনি তোমায়। ওদের সঙ্গে একটু কথা বলে যেও। প্রার্থনাতেও এসো মাঝে মাঝে।”
বাইরে বেরিয়ে এসে হাঁফ ছাড়ল সাহেব। রেক্টরের অবদান তার জীবনে অনেকখানি। খুব কম বয়সে তার মা মারা যান। তারপর বাবাও। গ্রামের লোকেরা আর তিনি না থাকলে… আসলে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চাকরি করতে একেবারেই ভালো লাগে না তার।
বাইরে চমৎকার রোদ উঠেছে আজ। হোস্টেলের জনা পনেরো ছেলে মিলে এই ছুটির দিনে গির্জা লাগোয়া জমিতে লাগানো ফুল আর সবজির যত্ন করছিল। বাড়তি ঘাস তুলে ফেলছিল। কোনো-কোনো গাছের নীচের জমি খুরপি দিয়ে খুঁড়ে নরম করে দিচ্ছিল। হোস্টেলের রান্নাঘরে যেটুকু সবজি লাগে তার ব্যবস্থা এখান থেকেই হয়ে যায়। ওরা ভীষণ ভালোবাসে সাহেবকে। সাহেবও ওদের ভালোবাসে অবশ্য।
সাহেবকে অফিস-ঘরে ঢুকতে দেখেছিল ওরা। ধমক খাবে তাও জানত। কিছু না বলে তারা চুপ করে নিজের নিজের কাজ করে যাচ্ছিল। কানগুলো অবশ্য এদিকেই পড়ে ছিল। সাহেব বাইরে বেরিয়ে আসতে ‘উ-উ-উ-উ’ গুঞ্জন উঠল একটা। সে ওদের দিকে ঝকঝকে চোখে তাকিয়ে হাসল।
অ্যালবার্টের বয়স সতেরো। সামনের বছর সি.বি.এস.ই দেবে। এক কোণের জমিটা কুপিয়ে নরম করে তুলছিল সে। তার কষ্টিপাথরের মতো কালো সুগঠিত শরীর এতক্ষণের পরিশ্রমের ফলে ঘামে ভিজে চকচক করছিল। খুব ভালো স্পোর্টসম্যান অ্যালবার্ট।
সাহেব কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ানোতে একগাল হাসল অ্যালবার্ট।—“গুড মর্নিং স্যার!”
“কী করছিস ভাই?”
“আলু লাগাব স্যার। রান্নাঘরে দেখলাম আলুর গায়ে কলি বেরোচ্ছে। সেগুলো লাগিয়ে দেব। মাটি নরম না হলে জমির ভিতরে আলু বাড়বে না।”
“আর ওইদিকে?”
“টমেটো গাছে সবে জালি এসেছে স্যার। বেগুনও ধরেছে।”
বেগুন! কান চুলকোতে চুলকোতে সাহেবের মনে পড়ে গেল, ফ্যানাভাতের সঙ্গে বেগুনপোড়া দারুণ লাগে।
“ইয়ে, দুটো বেগুন দিবি আমাকে?”
বাকি কয়েকজনও এসে জড়ো হয়েছিল। তাদের তো বাবা-মা নেই। সাহেবই আপনজন। সাহেবও ওদের সঙ্গে ঠিক স্যারের মতো মেশে না। আর স্কুলে না এলেও খোঁজখবর রাখে সবার।
ঋষি বলে একটি বছর দশেকের ছেলে সাহেবের কথা শুনেই দৌড় লাগাল বাগানের দিকে। যখন ফিরে এল, ওর হাতে গোটা চারেক বেগুন, খুব ছোটো ছোটো কয়েকটা টমেটো আর কিছু ধনেপাতা।
“ইস! এত ছোট্ট সব টমেটো। নষ্ট করলি?”
“কিছু হবে না স্যার। এ-বছর যা জালি এসেছে এখানে খেয়ে আর বাইরে বিক্রি করেও থাকবে অনেক।”
লালুর বয়স বছর ছয়েক। একেবারে টকটকে লাল গায়ের রঙ। তাই লালু নামটা সাহেবই দিয়েছে। সাহেবের খুব আদরের। সে এগিয়ে এসে তার কচি হাত দিয়ে সাহেবের হাতটা ধরল। ভাসা ভাসা চোখ দুটি সাহেবের দিকে তুলে বলল, “স্যার, একটা গান বাজাবেন?”
“গান!” সাহেব ভাবল একটু। তারপর বলল, “যা। তোদের ঘর থেকে বেহালাটা নিয়ে আয়।”
ঝকঝকে রোদ। চারদিক নানা রঙের ফুল আর পাতার সবুজ উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে। হোস্টেলের সিঁড়ির ছায়াতে সার সার বসে গেল সব। সাহেব হাতের বেহালার ছড়টা টানল একটু। এলোমেলো দু-একটা টান। তারপর বড়ো করুণ একটা সুর বেজে উঠল। আত্মীয়-পরিজনহীন একপাল ছেলে সে-গানের কথাগুলি জানে না। তবু কী একটা দুঃখে যেন গলার কাছটায় দলা পাকিয়ে উঠছিল তাদের।
অফিস-ঘরে বসে রেক্টরও হাতের পেনটা নামিয়ে রাখলেন নীচে। উৎকর্ণ হয়ে শুনলেন কিছুক্ষণ। তারপর বড়ো করে শ্বাস ফেলে চেয়ার থেকে উঠে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন।
চোখ বন্ধ করে একমনে বাজাচ্ছে সাহেব। পাশে গালে হাত দিয়ে মাথা নীচু করে বসে আরও কয়েকজন। তাদের অনেকেরই চোখ এখন জলে টলটল করছে। সুরটুকু যেন ধূপের ধোঁয়ার মতো মিশে যাচ্ছে বাতাসে।—
‘সামার হ্যাজ কাম অ্যান্ড পাসড
দ্য ইনোসেন্ট ক্যান নেভার লাস্ট
ওয়েক মি আপ হোয়েন সেপ্টেম্বর এন্ডস।
লাইক মাই ফাদারস কাম টু পাস
সেভেন ইয়ারস হ্যাজ গন সো ফাস্ট
ওয়েক মি আপ হোয়েন সেপ্টেম্বর এন্ডস।
হিয়ার কামস দ্য রেন এগেইন
ফলিং ফ্রম দ্য স্টারস
ড্রেঞ্চড ইন মাই পেন এগেইন
বিকামিং হু উই আর।
অ্যাজ মাই মেমোরি রিসেটস
বাট নেভার ফরগেটস হোয়াট আই লস্ট
ওয়েক মি আপ হোয়েন সেপ্টেম্বর এন্ডস।’
নীল আকাশের নীচে এক ঝাঁক ধূসর পাখি উড়তে উড়তে দিগন্তে মিলিয়ে গেল। রেক্টর তাঁর চোখের কোনা থেকে এক ফোঁটা জল মুছে ফেললেন। তাঁকে শক্ত হতে হয়। না-হলে অন্যেরা ভরসা পাবে কী করে।
(২)
দুর্গাপুজো পেরোল সদ্য সদ্য। আগামীকাল লক্ষ্মীপুজো।
একাদশীর দিন দুপুরে দুর্গাঠাকুর বিসর্জন হয়েছে। সেদিনও আধঘণ্টা একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়েছিল। ভিজে-ভিজেই বিসর্জন করতে হল।
তবে আজ কিন্তু ভারি সুন্দর একটা রোদ দিয়েছে। এখানের আকাশে এমনিতেও গাঢ় নীল। তার বুকে ধবধবে সাদা ছানা ছানা মেঘ। পাহাড়ের লাগোয়া মাঠের ঘাসের উপরে উড়ছে ফড়িং। বহুদূর অবধি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একজোড়া হলুদ প্রজাপতি জোট বেঁধে মাটির কাছে নেমে আসছে। আবার যেন মাটিতে চুমু খেয়ে উঠে যাচ্ছে উপরে।
লক্ষ্মীপুজোর পরদিন শনিবার। তারপর রবিবার। আর সোমবারেই খুলে যাচ্ছে স্কুল। কিংশুকের তাই খুব মনখারাপ। নবমী থেকেই অবশ্য মনটা দুচ্ছাই দুচ্ছাই করছিল। নেহাত কাল লক্ষ্মীপুজোটা আছে, তাই বাঁচোয়া।
সকালবেলাতেই লুচি, মিষ্টি কুমড়োর তরকারি আর নারকেল নাড়ু দিয়ে জলখাবার খাওয়া হয়ে গেছে কিংশুকের। মা এবার দুপুরের রান্না শুরু করবেন। ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, “দূর হ! ঘরে থাকলেই তো জ্বালাবি।”
কিংশুক তখনই শুকরুর ঘরের দিকে রওনা দিয়েছিল। শুকরুর ভালো নাম হল শুক্রদেব মারান্ডি। অত বড়ো নামে কে ডাকে!
তিন বছর বয়স থেকে ওরা বন্ধু। আর শুকরুর গায়ে সাংঘাতিক জোর। আর মনে খুউব সাহস। তবে পড়াশোনায় খুব কাঁচা। তাই কিংশুক মাঝে মাঝে ওকে পড়া দেখিয়ে দেয়। আর ও কিংশুককে সরু বাঁশ কেটে মাছ ধরার ছিপ, লাটাই আর কাগজ কেটে ঘুড়ি বানিয়ে দেয়।
কিংশুক মাঝে বলেছিল, ‘খালি খালি তুই এসব বানিয়ে দিস কেন বল তো! তুই তো আমার বন্ধু। বদলে কি কিছু দিতেই হবে?’
শুকরু কিছু বলে না। হাসে খালি। ফের জিনিস বানিয়ে দেয়।
শুকরুদের বাড়িটা গ্রামের একেবারে শেষে। পিছনে খাদের মতো নীচু জমি। ওপারে এলোমেলো জঙ্গল।
মাটির বাড়ি। খড়ের চাল। মাটির দেওয়ালে সাদা রঙ দিয়ে ফুল, লতা, পাতা আঁকা। সামনে উঠোন। সেখানে শুকরুর মা রোদে কচু শুকিয়ে রাখছেন। কিংশুক কচি গলায় হাঁক দিতে মিষ্টি করে হেসে বললেন, “শুকরু তো নাই! বসনকুমারীকে লিয়ে পাহাড়ের দিকে গেলেক।”
কী আর করা যায়। কিংশুক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তারপর পাহাড়ের দিকে হাঁটা দিল। যেতে-যেতেই নজরে এল, শুকরুদের পাড়ার এককোণে কারা যেন রাংচিতার মতো দেখতে সেই পিছল পিছল শাকটা লাগিয়েছে। কী যেন নাম! পুঁইশাক।
এই শাকটা খেতে একেবারে খারাপ। যদিও ওর বাবার যতসব আজেবাজে জিনিসের মতো এটা খেতেও নাকি ভালো লাগে। কুমড়ো আর কচু দিয়ে। মাগো! তবে গাছটা বড়ো হলে ছোটো ছোটো গোল গোল একরকমের ফল হয়। পাকলে লাল। ভূষণদাদু সেই ফল চটকে বেগুনি রঙ বানান। অপরাজিতা ফুল থেকে নীল, গাঁদা থেকে হলুদ। তারপর শিশিতে ভরে বিক্রি করেন। নাকি বিদেশেও যায়। কোনও রাসায়নিক নেই বলে সেখানে এই রঙের খুব কদর। এ-পাড়াতে কেবলমাত্র ভূষণদাদুদের বাড়িটাই পাকা। সাদা রঙের একতলা। দেওয়ালে চিত্তিরবিত্তির করা আছে।
মাঠের উপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে কিংশুক একবার অবাক হয়ে থেমে গিয়ে দেখল, পাহাড়ের ওদিক থেকে হালকা কালো রঙের একটা মেঘ ভাসতে ভাসতে এদিকেই আসছে। তার ছায়াতে মাঠের একদিকটা কালো আর অন্যদিকটা সাদা। ওর মুখে ছায়াটা পড়ল একটু। তারপর উড়তে উড়তে চলে গেল দূরে।
মাঠের ওদিকে পাহাড়। আর নদী।
অবশ্য যাকে পাহাড় বলা হচ্ছে সেটা আসলে পাহাড় নয়। বাদামি রঙের মস্ত উঁচু একটা টিলার মতো। তার পাশে আর একটা টিলা। মাঝে একটা ফাঁক। টিলাগুলোর গায়ে এদিক-ওদিক আরও অনেকগুলো ছোটো-বড়ো পাথর। অনেক পাথরের গায়ে গর্ত। সেখানে বৃষ্টির জল জমে থাকে। এখানে-ওখানে ঘাস আর কচি কচি গাছের চারা। পাখিরা ফল খেয়ে বীজ ফেলে, সে-সব থেকে হয়।
মাঝের ফাঁকটা দিয়ে পেরিয়ে কিছুটা ঘাসজমি। তার ওদিকে তিরতিরে একটা নালার মতো। এখানের লোকে অবশ্য নদীই বলে। তার নাম সোনাঝুরি। বাবা বলেছেন, ওই নামে একটা গাছও আছে নাকি। বৃষ্টির জলের নালা, তাই এখন বেশ জল আছে।
একফালি ঘাসজমির উপরে মস্ত এক হরিতকি গাছ। তার তলায় বসে আছে শুকরু। একটু দূরে বসন্তকুমারী ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে আসলে একটা মেয়ে ছাগল। যখন ছোটো ছিল তখন তার ধবধবে সাদা রঙ আর টানা টানা খয়েরি চোখ দেখে খেপুকাকা ওই নাম দিয়েছিল।
শুকরু দু-দিকের পাথরের দেওয়ালের মাঝের ফাঁকটা দিয়ে কিংশুককে ঢুকতে দেখেছিল। একগাল হাসল। হাত তুলে বলল, “আয়!”
কিংশুক গিয়ে ওর পাশে বসে পড়ল। নদীর উলটোদিকের ধোঁয়া ধোঁয়া গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোদের ঘরে গিয়েছিলাম।”
“তাই!”
“আমাকে বলে আসিসনি কেন রে?”
“তোদের ঘরে গিয়েছিলাম তো। জানালা দিয়ে দেখলাম, তুই খাটের উপরে বসে অঙ্ক-খাতা খুলে ঘামছিস। কাকু সামনে একটা চেয়ারে বসে তোর দিকে তাকিয়ে ঠ্যাং নাচাচ্ছে।”
“ঠ্যাং বলতে নেই। পা বলতে হয়।”
“জানি। বড়োদের পাকে বলে শ্রীচরণ। খুব বকা খেলি আজ?”
কিংশুক নড়েচড়ে বসল। উদাসভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “দুচ্ছাই! বাবার অফিস কিছুতেই খোলে না। আমাদের যখন ছুটি, তখন বাবারও ছুটি। সকাল-বিকেল সবাইকে পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। মাও বলেন, বন্যেরা বনে সুন্দর। আর তোর বাবা নিজের অফিসে।”
“তাও তো চাকরি করে। আমার বাবা সকাল থেকে খেটে খেটে পাগল হয়ে যায়।”
দুজনে পাশাপাশি চুপ করে বসে থাকল।
খুব মিষ্টি একটা ঠান্ডা আর জোলো হাওয়া দিচ্ছিল। এ-সময় বেশিক্ষণ মনখারাপ করে থাকা যায় না।
“কিংশুক ফুল হিংসুক ভারি, আজ করে ভাব, কাল করে আড়ি।”
ভারী গলাটা শুনে দুজনেই চমকে গেল। তাকিয়ে দেখে, একটা রোগা লম্বা শরীর পিছনের কুলগাছগুলোর আড়াল থেকে কাঁটা বাঁচিয়ে বেরিয়ে আসছে। পরনে রঙচটা জিনস আর হলদে একটা তেলচিটে টি-শার্ট। বগলে মস্ত একটা খাতা।
“খে... রজারকাকা!” দুজনেই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল।
সাহেব ওদের কাছে এসে চোখে মিটমিট করে হেসে বলল, “তোরা আমাকে আড়ালে খেপুকাকা বলিস সেটা আমি জানি। রজারের সঙ্গে কাকাটা ঠিক মানায় না। খেপুকাকাই বলিস বরং।”
কিংশুক আর শুকরু চোখাচোখি করল। তারপর কথা ঘোরানোর জন্য কিংশুক জিজ্ঞাসা করল, “তোমার বগলে ওটা কীসের খাতা?”
সাহেব ধপ করে ওদের পাশে বসে পড়ল। তারপর পা দুটো টানটান করে ছড়িয়ে দিয়ে বলল, “ইতিহাস লিখছি।”
“ইতিহাস! সে তো বুড়োরা লেখে!” ঢোঁক গিলল কিংশুক।—“কীসের ইতিহাস লিখছ?”
নিজের মাথার চুলে দু-বার আঙুল চালিয়ে সাহেব বলল, “কুদোডাঙার ইতিহাস। তোরা জানিস, এই জায়গাটার নাম কুদোডাঙা কেন?”
দুজনেই ঘাড় নাড়ল।
“আগে এখানে কেবল আদিবাসীদের বসতি ছিল। তারপর আমার বাবার বাবার বাবার বাবার বাবার বাবার বাবা, ইয়ে বুঝলি তো, অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহের পিতামহ অগাস্টিন কিওয়ার্ড এখানে আসেন। আমাদের সারনেম থেকেই মুখে মুখে এই জায়গাটার নাম হয়ে গেল কুদোডাঙা।”
(৩)
ওকে খেপুকাকা এমনিই বলে না ওরা। কানের পাশে আবার একগোছা লাল রঙের কীসব ফুল গুঁজেছে সে। কিংশুক ফিক করে হেসে বলল, “কী ফুল গো তোমার কানে?”
সাহেব খুব গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “অশোক ফুল। নাম শুনেছিস?”
শুকরু নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল। একটা লোক এসে নদীকে প্রণাম করল হাতজোড় করে। তপনজেঠু! অনেক বয়স। মাথার চুল আর দাড়ি তো বটেই, বুকের চুলগুলো পর্যন্ত সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু দাদু বললে রেগে যায়। রোজ এই সময়ে আসে। নদীকে প্রণাম করে, তারপর জলে ডুবে ডুবে কী যেন খোঁজে।
বাবার মুখে শুনেছে, অনেকদিন আগে, শুকরু হয়নি তখনও, এই নদীর ধারেই ঘর ছিল তপনজেঠুদের। হোই পশ্চিমদিকে। একবার সাতদিন, সাত রাত একইরকম বৃষ্টি পড়ল। এই ছোট্ট নদীটা ভয়ংকর হয়ে উঠল। তপনজেঠুর তখন শুকরুদের মতো বয়স। জলে সব ডুবে গেল। বাড়ি ধুয়ে গেল। তপনজেঠুর বাবা, মা, একটা ছোট্ট বোন—সবাই ডুবে মারা গিয়েছিল। তখন থেকে জেঠুর মাথা খারাপ।
শুকরু মাথা ঘুরিয়ে সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, “না, শুনিনি। ফুল দেখেছি। জঙ্গলে হয়। একটাই গাছ আছে।”
“সেই তো!” কী যেন ভাবল সাহেব। তারপর বলল, “এই ফুল আসলে হেমন্তকালে হয়। বেশি পাওয়াও যায় না। সংস্কৃত নাম হল অপশোক। মানে যে-ফুল দেখলে শোক-দুঃখ দূর হয়ে যায়। কিন্তু হেমন্তকালের ফুল এই সময় ফুটছে সেটা ভালো কথা নয়। কিংশুক মানে জানিস?”
কিংশুক গম্ভীর মুখে বলল, “জানি। পলাশ ফুল বা গাছ। ছাতিমের সংস্কৃত নামও জানি।”
সাহেব চোখ কুঁচকে একদৃষ্টিতে কিংশুকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। বলল, “ফুলটা যেমন অসময়ের, তোরাও তেমনই অকালে পেকে গেছিস। নন্তুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তাই না?”
কিংশুক ফিক করে হেসে বলল, “হুঁ! তুমি নাকি স্যারকে একেবারে...”
“ছিঃ! অমনি বলতে নেই।” ভর্ৎসনার ভঙ্গিতে বলল সাহেব। তারপর নদীর দিকে তাকিয়ে বলল, “কী অদ্ভুত সৃষ্টি ভগবানের। এই পাথর, গাছ, নদী, ফুল—কী অসাধারণ সুন্দর!”
“তাহলে দুঃখ দেয় কেন?” শুকরু নড়েচড়ে বসল।
“দুঃখ না পেলে মানুষ হবি কী করে? অন্যের দুঃখ বুঝবি কী করে?”
“ভাত কেন জোটে না?”
“ঘরে বসে ভাত জুটলে মাঠে খেটে ফসল ফলাবি? পাথর কেটে রাস্তা বানাবি? নদীর জল ঘেঁটে মাছ ধরবি? কষ্ট করবি তবে না! তাছাড়া সব দুঃখ কেটে যায় একদিন।”
আবার একটা নরম কালো মেঘ উড়ে গেল উপর দিয়ে। কিছুক্ষণের জন্য নদীর জল ধূসর হয়ে গেল। গাছের আড়াল থেকে একটা পাখি মিষ্টি শিস দিল একবার। সামনের উজ্জ্বল সবুজ জমিটা কিছুক্ষণের জন্য বাদামি হয়ে আবার সবুজে ফিরল। কিংশুক তাকিয়ে দেখল, তপনজেঠু নদীতে নেমে পড়েছে। জলের ভিতরে হাতড়াচ্ছে। সে আনমনা হয়ে বলল, “খালি অঙ্কটা খুব বাজে।”
সাহেব ভুরু কুঁচকে বলল, “কেন? অঙ্ক খারাপ কীসে? অঙ্ক তো ধাঁধা। মজা।”
“মজা না ছাই! শাস্তি খালি।” কিংশুক বলল।
“শাস্তি কেন?”
“যারা বই লিখেছে তারা নিজেরাই জানে না।”
“যেমন? এরকম মনে হয় কেন?”
“যেমন ধরো...” কিছুক্ষণ ভাবল কিংশুক। তারপর ঠোঁট চেটে বলল, “বইয়ে বলা আছে কোনও সংখ্যার শেষে জোড় সংখ্যা থাকলে দুই দিয়ে ভাগ যায়। শেষে পাঁচ বা শূন্য থাকলে পাঁচ দিয়ে ভাগ যায়। সব পাশাপাশি সংখ্যা যোগ করে যদি তিন দিয়ে ভাগ করা যায়, তাহলে গোটা সংখ্যাটাই তিন দিয়ে ভাগ করা যাবে। কিন্তু সাত, এগারো আর তেরো দিয়ে ভাগ করা যায় কি না তার কোনও উপায় বলা নেই। অথচ ‘সরল করো’-তে ওসবই বেশি বেশি থাকে।”
সাহেব মুচকি হেসে বলল, “তারও উপায় আছে। কিন্তু সব বলে দিলে তোরা ভালো করে নামতা শিখবি না। খালি শর্টকাটে সারার চেষ্টা করবি।”
“বলো না প্লিজ। আমাদের গাছের নারকেল খাওয়াব তোমাকে।” আকুল হয়ে বলল কিংশুক।
“ঘুষ দিচ্ছিস!”
“আমার নতুন ব্যাটটাতে তোমাকে খেলতে দেব। বলো না!”
“নারকেলও খাওয়াতে হবে না। ব্যাটটাও দিতে হবে না। মন দিয়ে পড়াশোনা কর।”
কিংশুক উঠে পড়ল।—“না বললে ভীষণ কাতুকুতু দেব তোমাকে। এই শুকরু, ধর তো!”
“আরে আরে, করিস কী! ছাড় ছাড়! আচ্ছা বলছি, বলছি!”
সাহেব হাসতে হাসতে বিষম খেল। ভীষণ কাতুকুতু ওর। হাঁফাল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “কোনও সংখ্যার প্রথম থেকে একটা করে সংখ্যা বাদ দিয়ে দিয়ে যোগ করবি। দ্বিতীয় সংখ্যাটা থেকেও একটা করে সংখ্যা বাদ দিয়ে দিয়ে যোগ করবি। দুটো যোগফল থেকে পরস্পরকে বিয়োগ করলে যদি বিয়োগফল শূন্য হয় বা এমন একটা সংখ্যা হয় যেটা এগারো দিয়ে বিভাজ্য, তাহলে গোটা সংখ্যাটাই এগারো দিয়ে ভাগ করা যাবে।”
“কিচ্ছু বুঝলাম না।” অসহায়ভাবে বলল শুকরু।
“ধুর বোকা! আচ্ছা ধর যে-কোনো একটা সংখ্যা, যেমন ৩৪৩৪—প্রথম সংখ্যা ৩, তার সঙ্গে তৃতীয় সংখ্যা ৩ যোগ করলি। আবার দ্বিতীয় সংখ্যা ৪, তার সঙ্গে মাঝের সংখ্যাটা বাদ দিয়ে চতুর্থ সংখ্যা ৪ যোগ করলি। ৩ + ৩ = ৬, ৪ + ৪ = ৮। তাহলে ৮ - ৬ করে দেখলি ২। শূন্যও নয়। এগারো দিয়ে ভাগও করা যায় না দুইকে। তাই ৩৪৩৪-কে ১১ দিয়ে ভাগ করা যাবে না। আবার ৩৭৭৩০। এখানে প্রথম তৃতীয় আর পঞ্চম সংখ্যা যোগ করে ৩ + ৭ + ০ = ১০। দ্বিতীয় আর চতুর্থ সংখ্যা যোগ করে ৭ + ৩ = ১০। ১০ - ১০ = ০। তাহলে ৩৭৭৩০-কে ১১ দিয়ে ভাগ করা যাবে।”
“দারুণ, দারুণ!” হাততালি দিয়ে উঠল শুকরু আর কিংশুক।—“এবার সাতের নিয়ম বলো।”
“কোনও সংখ্যার শেষ রাশিটাকে দুই দিয়ে গুণ করে বাকি সংখ্যা থেকে বিয়োগ করলে যদি বিয়োগফল শূন্য হয় বা সাত দিয়ে বিভাজ্য হয়, তাহলে গোটা সংখ্যাটাই সাত দিয়ে ভাগ করা যাবে। যেমন ২০৩। ২০ - (৩ x ২) = ১৪। ১৪ কে ৭ দিয়ে ভাগ করা যায়। তাই ২০৩ কেও ৭ দিয়ে ভাগ করা যাবে। আবার ৪২ এর ক্ষেত্রে ৪ - (২ x ২) = ০। তাহলে ৪২-কেও ৭ দিয়ে ভাগ করা যাবে। কোনও বড়ো সংখ্যা, যেমন ধর ২৬৭৮—এর ক্ষেত্রে ২৬৭ - (৮ x ২) = ২৫১। এখন ২৫ - (১ x ২) = ২৩-কে ৭ দিয়ে ভাগ করা যায় না। তাহলে ২৫১-কে যেহেতু ৭ দিয়ে ভাগ করা যায় না, তাই বড়ো করে ধরলে ২৬৭৮-কেও ৭ দিয়ে ভাগ করা যাবে না।”
“দারুণ ব্যাপার!”
দুজনের হাততালির শব্দ টিলাটার গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। ছোটো ছোটো একঝাঁক পাখি ভয় খেয়ে উড়ে গেল পিছন থেকে। তপনজেঠুও নিশ্চয়ই সেই শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। একবুক জল থেকে তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে এদিকে তাকালেন। তারপর আবার জলে ডুব দিলেন।
“তপনজেঠু রোজ জলে কী খোঁজে সাহেবকাকা?” শুকরু জিজ্ঞাসা করল।
“অতীত। নিজের অতীতকে খোঁজে।” বড়ো করে একটা শ্বাস নিয়ে জবাব দিল সাহেব।
“মানে?” অবাক হয় শুকরু।
“ওইদিকে ঘর ছিল ওদের।” নদীর ঢালের দিকে হাত দেখায় সাহেব।—“সেখানে ওর বাবা ছিল। মা ছিল। ছোট্ট একটা বোন। তারপর বৃষ্টি পড়ল খুব। জলে ভেসে গেল চারদিক। একটু উঁচুতে ছিল বলে তখনও টিকে ছিল ওদের ঘরটা। তপনকাকুর বাবা একটা হাসপাতালে চাকরি করতেন তখন। এক রাতে বৃষ্টি সাংঘাতিক বেড়ে গেল। এই নদীতে হড়পা বান ডাকল। জলে ধুয়ে নিয়ে গেল ওদের বাড়িটাও। সব্বাই ডুবে গেল। খালি কী করে যেন তপনকাকু বেঁচে গিয়েছিল। তারপর থেকে মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল ওর। জলে ডুব দিয়ে দিয়ে দেখে, যদি কিছু ফিরে পাওয়া যায়। অনেক সময় উপরে বসে নদীর জলে ঢিলও মারে।”
“তুমি দেখেছ ঘটনাটা?”
“ধুর! তখন আমার জন্মই হয়নি। ১৯৭৮ সালের ঘটনা। আমি আমার বাবার ডায়েরিতে পড়েছি। আমাদের বাড়িতে চামড়ায় বাঁধানো অনেকগুলো পুরোনো ডায়েরি আছে। তাতে অনেক ঘটনার কথা লেখা আছে।”
“তোমার ঘরে তো তোমার কোনও আত্মীয়স্বজনকে আসতে দেখি না। কোথায় আছেন তাঁরা?” কিংশুক জিজ্ঞাসা করল।
“কেউ আছে ইউকে-তে, কেউ-বা ইউরোপের অন্য কোথাও বা ইউএসএ-র কোনও জায়গায়। সব্বাই তো চলে গিয়েছিল এখান থেকে। খালি আমার ঠাকুরদা, বাবা আর মা যাননি। এখন তোরাই আমার আত্মীয়স্বজন।”
“তুমিও কি একদিন চলে যাবে সাহেবকাকা?” শুকরু সাহেবের হাতের উপর নিজের হাত রেখে একটা ঢোঁক গিলে বলল।
“পারছি না যে! এখানের রাস্তা, পাহাড়, গাছ, জল, মাটি, আকাশ, মানুষজন—সব যে আমার আপন! কুন্তীদিদা, তোরা, তপনকাকু। তাছাড়া হোস্টেলের বাচ্চাগুলো। তাছাড়া আর একটা ব্যাপার আছে।”
“কী?” প্রশ্ন করল কিংশুক। ওর মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল।
“আর একজনের কথা লেখা আছে ডায়েরিতে। তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। তাকে ভালোবাসতে হবে আমায়।”
“কে?”
“তাকেই তো খুঁজছি! কিছুতেই পাচ্ছি না।”
“পেয়েছি! খুঁজে পেয়েছি!”
চিৎকারটা শুনে প্রথমে চমকে গিয়েছিল ওরা। যদিও তেমন কোনও গুরুতর ব্যাপার নয়। তপনজেঠু মাঝে-মধ্যেই নানা জিনিস নদীর বুক থেকে তুলে আনে। যত্ত ফালতু জিনিস। তারপর ওইরকম চিৎকার করে। এখন তার উঁচু করে ধরে থাকা হাতে একটা আধলা ইট। জলের তলায় ছিল নিশ্চয়ই।
“এখানে বাঘ থাকত আগে। কালো বাঘ।” গম্ভীর মুখে বলল সাহেব।
(৪)
কুদোডাঙার পশ্চিমে একগাদা ঝোপঝাড় আর বিশাল একটা ঝিল। সেই ঝিলের পাশেই সাহেবদের দেড়শো বছরের পুরোনো দোতলা বাড়ি। সেকেলে চুন-সুরকির বাড়ি বলে এখনও টিকে আছে। এককালে চারদিকে উঁচু বাউন্ডারি ছিল। এখন এদিক-ওদিকে ধ্বসে পড়েছে। শেয়াল-কুকুরের নিত্য যাতায়াত। সাপখোপও আছে প্রচুর। বাউন্ডারির ভিতরে আগাছা আর বড়ো বড়ো গাছ। চড়রা গাছের বীজ বসন্তকালের শেষে উড়ে উড়ে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ছাড়িয়ে নিলে খেতে একেবারে ছোট্ট বাদামের মতো। কতগুলো শ্বেতপাথরের মূর্তি এদিক-ওদিক ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে।
দোতলাতে টানা বারান্দা। উপর থেকে কাঠের জালি দেওয়া। অনেক জায়গায় পচে খসে পড়েছে। দেওয়ালে বট আর অশ্বত্থ গাছ। ডুমুর গাছ। প্লাস্টার ঝরে গেছে এখানে-ওখানে।
একতলাতেও অনেকগুলো ঘর। তবে রোদ তেমন ঢোকে না। স্যাঁতস্যাঁতে ভাব একটা। প্রায়ই দেওয়াল থেকে চাপড়া খসে পড়ে।
একতলার এককোণে অন্ধকার লাইব্রেরি ঘরে মস্ত একটা আবলুস কাঠের টেবিলে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে বসে পড়ছিল সাহেব। বই নয়, পূর্বপুরুষদের ডায়েরি।
সাহেবের পূর্বপুরুষেরা ইংল্যান্ড থেকে এখানে এসেছিলেন অনেক বছর আগে। সম্ভবত ১৯১০ সাল নাগাদ সবাই চলে যান। পড়ে থাকেন কেবল মাত্র তার ঠাকুরদার বাবা আর তাঁর বাবা আর মা। মানে সাহেবের বৃদ্ধ প্রপিতামহ আর বৃদ্ধ প্রপিতামহী। ততদিনে নীল-চাষ বন্ধ হয়ে গেছে। দূরের শহরে গাড়ির ব্যাবসা ছিল তাঁদের।
১৯৬২ সালে সাহেবের প্রপিতামহ আর প্রপিতামহী পরপর মারা যান। তার আগের বছরেই এক বাঙালি মহিলার সাথে ঠাকুরদার বিয়ে হয়েছে।
ঠাকুরদাকে সাহেব দেখেনি। সাহেবের জন্মের সময় তার মাও মারা যান। তিনি ছিলেন উত্তর ভারতীয় খ্রিস্টান। মা চলে যাবার আরও কয়েক বছর পর মারা যান তার বাবা। তারপর থেকে ফাদার, রেক্টর আর গ্রামের লোকজনের দেখভালেই বড়ো হয়েছে সে।
সাহেবের চোখের মণি ছাড়া আর কিছু দেখে সে যে জন্মসূত্রে বাঙালি নয় তা বোঝা যায় না। তার বাংলাতেও কোনও টান নেই। আশ্চর্যের কিছু নেই অবশ্য। এ-বাড়ির কিছু কিছু খবর রাখতেন পালদাদু। তিনি দু-বছর আগে একশো দুই বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি নাকি নিজের চোখে সাহেবের বাবাকে ডাইনিং টেবিলে বসে রুপোর জামবাটিতে রুপোর চামচে কাঁচা লংকা আর পেঁয়াজ দিয়ে পান্তাভাত খেতে দেখেছিলেন।
সেই দাপট, সেই রুপোর বাটি-চামচ, গাড়ির ব্যাবসা, টাকাকড়ি কিছুই নেই আজ। আছে কেবল পুরোনো কিছু আসবাব, অকেজো দলিল আর এই ডায়েরিগুলো। তাছাড়া কয়েকটা পুরোনো চাবি। যাদের তালা পাওয়া যায় না। ছিল কোনও কালে নিশ্চয়ই।
বড়ো করে একটা শ্বাস ফেলল সাহেব। চারদিকে চোখ বোলাল। সাহেব ছাড়া দ্বিতীয় জনপ্রাণী নেই এ-বাড়িটাতে। তবুও কারা যেন থাকে এখানে! হঠাৎ হঠাৎ কার পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। কারা যেন শ্বাস ফেলে।
ক’দিন আগেই এক রাতে হাতে একটা টর্চ নিয়ে পিছনের দরজা খুলে বাগানে নামতে যাচ্ছিল সাহেব। ওদিকেই ঝিলটা। দরজা খোলার ঠিক আগের মুহূর্তে স্পষ্ট শুনতে পেল কে যেন গম্ভীর গলায় বলল, “ডোন্ট ডেয়ার!”
সাহেব অবাক হয়ে গিয়েছিল বটে। তবে দরজা খুলে আর বাইরেও গেল না। তার একটু পরেই দোতলার দেওয়ালের বেশ কিছুটা ধ্বসে পড়ে গেল। ঠিক সে-সময় সে যদি বাগান থেকে আবার ঘরে ঢুকতে যেত, কে বলতে পারে, ওর মাথাতেই হয়তো পড়ত দেওয়ালের চাঙড়!
এর আগেও অনেকবার এরকম ব্যাপার ঘটেছে। বছর দু-এক আগে নীচের তলার একটা ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল সাহেব। ঘরটা বন্ধই থাকে। বাইরে মস্ত একটা পিতলের তালা। তারই ওজন হবে কেজি দু-এক। চাবিটাও অনেক বড়ো। তবে সে-আমলের বলেই হয়তো কখনও এ-ঘরের কোনও তালার চাবি খুলতে দু-বার চেষ্টা করতে হয় না। সেদিন কিন্তু তালাটা কিছুতেই খুলছিল না।
বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর ব্যর্থ হয়ে কপালের ঘাম মুছে সাহেব সরে দাঁড়াল। আর তখনই দরজার তলা দিয়ে বেরিয়ে এল মস্ত একটা কালো খরিশ! সাপটা বাইরে এসে তার বিশাল ফণাটা মেলে লেজে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। সাহেব পাথরের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে। সাপটা তার মস্ত ফণাটা ডাইনে বাঁয়ে দোলাচ্ছিল। এভাবেই কাটল মিনিট পাঁচেক। পাগুলো ভারী হয়ে উঠছিল সাহেবের। হঠাৎই অদৃশ্য কোনও হাত এসে যেন সাপটার লেজ ধরে শূন্যে ছুড়ে ফেলল তাকে। সাহেবের থেকে অনেক দূরে।
কারা বা কিছু আছে এই বাড়িতে।
সাহেবের বাবা যখন মারা যান তখন সাহেবের বয়স মাত্রই চার। মস্ত একটা খাটে শুয়ে ছিলেন তিনি। অত বড়ো শরীরটা তখন বিছানায় মিশে গেছে প্রায়। চারদিকে দুনিয়ার লোকজন। ডাক্তারবাবু, ফাদার, গ্রামের লোক। বাবা চোখ বুজে পড়ে আছেন বিছানাতে।
কী কারণে যেন ঘরটা একবার ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু সাহেব খাটটা ছুঁয়ে অবাক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। ওঁর ঠিক কী হয়েছে সেটা তার ছোট্ট মাথায় ঢুকছিল না। হঠাৎই বাবা চোখ মেলে তাকালেন। তাঁর শীর্ণ মুখে হাসি খেলে গেল একটা। ইশারায় সাহেবকে কাছে ডাকলেন তিনি।
কত ছোটো তখন সাহেব! কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না সে। কেবল মনে হচ্ছিল, বাবাকে আর সে দেখতে পাবে না। চোখে জল আসছিল তার। সেই অবস্থাতেই খাটে উঠে বাবার কাছে গেল সে।
বাবা নীচু কিন্তু অত্যন্ত স্পষ্ট গলায় তাকে বললেন, “চিন্তা করিস না। আমরা সবাই তোর আশেপাশেই থাকব। আর, আর ডায়েরিতে সব লুকিয়ে আছে। সব! বলে যাচ্ছি। তাকে দিয়ে দিবি, যে…”
কিন্তু এরপর আর কিছু বলতে পারেননি তিনি। চোখ বুজলেন। আর খুললেন না। মা আগেই গিয়েছিলেন। এবার সাহেব একেবারে একা হয়ে গেল।
নিজের দশ বছর বয়সে বাবার এক মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর ফোটোর সামনে মোমবাতি জ্বালাতে গিয়ে ঘটনাটা হঠাৎ তার মনে পড়ে যায়। সেদিনই লাইব্রেরিতে গিয়ে ঘুণ ধরা কাঠের আলমারি খুলে ডায়েরিগুলো বার করে সে। পড়া শুরু করে।
বেশ কয়েকজন পূর্বপুরুষের ডায়েরি আছে এখানে। প্রথমটা অগাস্টিন কিওয়ার্ডের। সন ১৮০৩। ব্রিটিশ সৈন্যদলের হয়ে এখানে আসেন। কোনও এক গ্রাম লুঠ করে প্রচুর ধন-সম্পত্তির মালিক হন তিনি। তারপর এখানে এসে নীল-চাষ করতে শুরু করেন। তখন এদিকে প্রচুর জঙ্গল। কয়েকটা মাত্র আদিবাসী পরিবার ছাড়া কেউ থাকত না। অগাস্টিনের সঙ্গে সঙ্গে এখানে আরও কয়েকজন ইংরেজ আসেন। পিছন পিছন এ-দেশের কিছু মানুষ, বিশেষত কয়েক ঘর বাঙালি। নীলকুঠি গড়ে ওঠে। বন কেটে বসতি হয়। রাস্তা হয়। গির্জা আর স্কুল হয়। পুকুর খোঁড়া হয় আর শ্রমিকদের জন্য কোয়ার্টার।
তাঁর লেখা শেষ হচ্ছে ১৮৩৩ সালে। সে-সময় নীল-চাষ কোম্পানির হাত থেকে যায় ব্যক্তির হাতে। কীসব আইনি জটিলতার পর অগাস্টিনের ছেলে মার্ক দায়িত্ব নেন।
ডায়েরি থেকে জানা যায়, এখানে ১৮৬০ সালে নীল-চাষ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার আগে অনেক অত্যাচার, খুন, বিদ্রোহের ঘটনা লেখা আছে। এলাকার মানুষজন, গাছপালা, জমি—সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে। এখানের অনেকের বংশপঞ্জিও খুঁজলে পাওয়া যাবে। আছে কিছু পুরোনো ম্যাপ।
নীল-চাষ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিওয়ার্ড ফ্যামিলি আস্তে আস্তে অন্য ব্যাবসায় মন দেয়।
সে-আমলে সাহেবের পূর্বপুরুষেরা এলাকার মানুষের উপর যে ভীষণ অত্যাচার করেছেন, সে-সব পড়লে মনখারাপ হয়ে যায়। তবে অদ্ভুত কিছু তথ্যও আছে।
১৮৩১ সালের ১৫ জুন অগাস্টিন লিখছেন—
‘খুব বৃষ্টি পড়ছিল। চারদিক জলে ভেসে গেছে। এই জায়গাটা উঁচুতে বলে কোনোরকমে বেঁচে আছি। তবে বাইরে যাবার পথ বন্ধ। নদী থেকে উথলে পড়ছে ঘোলাটে জল। গোটা পঞ্চাশেক বাড়িকে গ্রাস করেছে সে। বৃষ্টি থামার আর নাম নেই।
অবিরাম বৃষ্টির মধ্যে আজ সন্ধেতে কে যেন দরজা খটখট করছিল। এমিলির শরীর খারাপ। সে শুয়ে ছিল। আর্দালি এসে খবর দিল, সে এসেছে।
ড্রয়িংরুমে গিয়ে মোমবাতির কেঁপে যাওয়া আলোতে দেখলাম তার কুচকুচে কালো শরীর থেকে জল ঝরছে। আর কালো রঙের বাঘটা হিংস্রভাবে যেন ঝাঁপানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমি একদৃষ্টিতে বাঘটার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।
সে আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “সাহেব, আমাদের পেটে খাবার নেই, গায়ে কাপড় নেই। আমাদের জমি তোমরা কেড়ে নিয়েছ। আর আমরা নীল-চাষ করতে পারব না। বাইরে থেকে এসে কেন তোমরা আমাদের উপর ছড়ি ঘোরাবে!”
আমি দেওয়াল থেকে চাবুকটা পাড়লাম…’
এরপর আর কিছু পড়া যায় না। পুরোনো আমলের মোটা, চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরি। উপরে সোনার জলে নাম লেখা। কিন্তু এখান-ওখানের পাতা ঝুরঝুরে হয়ে খসে পড়েছে।
যেটুকু পড়া যায়, তার বেশিরভাগটাই এ-দেশের মানুষের উপর অত্যাচারের কথা। লোভের কথা। তবে বিভিন্ন ডায়েরিতে কালো বাঘের উল্লেখ আরও দু-বার আছে। কিছু প্রাপ্তি আর কোনও একজন মানুষের কথাও আছে।
১১ আগস্ট ১৮৬৩-তে মার্ক লিখছেন—
‘আজ সকালে দীনবন্ধুর কাছ থেকে খবরটা পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে পৌঁছেছি।
জমিতে কাজ করার সময় যে অদ্ভুত প্রাপ্তি তার হয়েছে তা দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। অবিশ্বাস্য! এসব জিনিস ওর কাছে থাকার কোনও মানেই হয় না। ওকে বমাল তুলে এনে আমার পূর্বপুরুষদের বহু ব্যবহৃত চাবুকটা হাতে তুলে নিয়েছি।
হ্যাঁ কেড়ে নিয়েছি। ও এসব নিয়ে কী করবে! বরং লন্ডনে এটার ভালো দাম পাওয়া যাবে।
অচেতন হয়ে ও যখন মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল তখন তাকিয়ে দেখি কালো বাঘটা নিজের শরীরটা কুঁচকে যেন আমার উপরে লাফিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওটাকে দেখলেই আমার মনে আতঙ্ক তৈরি হয়। বড়োই হিংস্র।’
কালো বাঘের উল্লেখ আবার আছে সাহেবের বাবা উইলিয়ামের লেখায়।
২৭ জুন ১৯৮৭-তে তিনি লিখছেন—
‘মৃত্যুশয্যায় বাবা বলে গিয়েছিলেন, এর কিছুই আমাদের নয়। আমাদের সুখ, সমৃদ্ধি—সবই তার। সে যখন আসে, তার সঙ্গে আসে একটা কালো বাঘ। জিনিসটা তাকে ফেরত দিতে হবে।
আমি বাবার কথা থেকে কিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু আজ জিনিসটা দেখতে পেলাম। ওহ্! চোখ ধাঁধিয়ে যায়!
ডায়েরিতেই লুকিয়ে আছে সব। আগে বুঝিনি। এখন জানি। জিনিসটার উপর আমাদের অধিকার নেই বলেই হয়তো ওটা বিক্রি করা যায়নি। ভালোই হয়েছে।
বাবা অসুখে শয্যাশায়ী হবার ঠিক তিনদিন আগে ২০ জুলাই ১৯৯৭ সালে ডায়রিতে লিখেছেন—
বাঘটা আজ দেখতে পেলাম! যুগের পরিবর্তন হয়েছে। আগে যেটাকে সবসময় দেখা যেত, সেটা এখন গ্রীষ্মকাল ছাড়া দেখার উপায় নেই। অদ্ভুত একটা আনন্দ হচ্ছে আজ।
বাবা সুস্থ হয়ে উঠলে হয়তো সাহেবকে বলে যেতেন।
সব পড়ে যেটা সাহেব বুঝেছে, কোনও ব্যক্তি মাটি খুঁড়ে খুব দামি কোনও জিনিস পেয়েছিল। কিন্তু সাহেবের পূর্বপুরুষেরা সেটা তার কাছ থেকে কেড়ে নেন। তার ঠাকুরদা আর বাবা লোকটার হাতে জিনিসটা ফেরত দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি।
মুশকিল করেছে কালো বাঘটা। এই এলাকায় এককালে অনেক জঙ্গল ছিল। বাঘও হয়তো ছিল। কিন্তু কালো রঙের বাঘ! ভারতের মাইসোরে নাকি কালো রঙের লেপার্ড আছে। মায়ানমার আর আফ্রিকাতেও। কালো জাগুয়ার আছে দক্ষিণ আমেরিকাতে। কিন্তু সে এখানে কী করে আসবে? তবে শুনেছে, এখানে ষাট-সত্তর বছর আগেও চিতাবাঘ পাওয়া যেত। ঘর থেকে ছাগল, মুরগি তুলে নিয়ে যেত তারা। একবার নাকি কার বাচ্চাও তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
এটাও নিশ্চিত, বাঘ একটা নয়। একাধিক। বংশপরম্পরায় তারা এসেছে। না-হলে অতজন পূর্বপুরুষ সেটার কথা লিখে যেতেন না।
এদিক-ওদিক, ঘরের আনাচে-কানাচে খুঁজেও সেই দামি জিনিসটার খোঁজ পায়নি সাহেব। ডায়েরিতে কিছুই খোলসা করে বলা নেই।
একটা কথা তো বলাই হয়নি। সাহেবের অবস্থা এখন পড়ে গেছে বটে, তবে তাদের ঘরে পুরোনো, বহু পুরোনো একটা গাড়ি আছে। ওল্ডস মোবাইল কার্ভড ড্যাশ। কার আর ছ্যাকড়া গাড়ির মাঝামাঝি চেহারা। যদিও চাকা চারটেই। ১৯০২ সালে তার ঠাকুরদার বাবা গাড়িটা বিদেশ থেকে আনিয়েছিলেন। তবে চলেনি বিশেষ। পিছনের বাগানে ভাঙাচোরা গ্যারাজের মধ্যে জং-ধরা গাড়িটা রয়ে গেছে আজও। টায়ারগুলোর কিছু অবশিষ্ট নেই এখন।
ঘ্রুউউউম করে আওয়াজ এল একটা। গাড়িটারই কি? হতেও পারে। এই ঘরের সবই অদ্ভুত। বাবা মারা যাওয়ার পর বহুদিন শোবার ঘরের খাটটাতে শুলে দুলুনি আসত একটা। যেন খাটটাই তাকে দুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে।
একটা শ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠল সাহেব। ইউরোপীয় জিনের কিছুটা গুণ এখনও রয়ে গেছে সাহেবের মধ্যে। শুধু পুথিগত বিদ্যার উপর নির্ভরশীল নয় সে। গাড়ি সারানোর কিছু কাজ জানে। নানা লাইফ হ্যাকস। লেবু দিয়ে লাইট জ্বালাতে পারে, ব্যাটারি আর তার দিয়ে কম্পাস বানাতে পারে। মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য সে নিজের হাতে একটা মসকুইটো ট্র্যাপ বানিয়েছে। খুবই সহজ। যে-কেউ বানাতে পারে।
টর্চটা নিয়ে পিছনে গিয়ে গ্যারাজের দরজাটা বহুদিন পরে খুলল সাহেব। অনেকদিন বন্ধ হয়ে থাকায় খুলতে চাইছিল না প্রথমে। শব্দও হল খুব।
গাড়িটার এখানে ওখানে মরচে ধরেছে। পুরু ধুলো বসেছে গায়ে। খুব নরম হাতে লেদারের ছিঁড়ে যাওয়া সিটটার গায়ে হাত বোলাল সে। ফিসফিস করে বলল, “হাতে একটু টাকা আসুক। তোমাকে সারিয়ে তুলব।”
শোনার ভুলও হতে পারে, গাড়িটাও যেন ফিসফিস করে বলল, “থ্যাংক ইউ!”
(৫)
আগের থেকেই জানা ছিল, তবে বিপদ একেবারে ঘাড়ে এসে না পড়লে তো আর বোঝা যায় না! সকালে উঠে হাড়ে হাড়ে টের পেল সাহেব।
ব্রেকফাস্ট করার মতো কিছু নেই ঘরে। চালের পাত্র শূন্য। পাউরুটি নেই। এমনকি সামান্য চায়ের গুঁড়ো পড়ে থাকলেও চিনি বা দুধ নেই। বড়ো করে একটা শ্বাস ফেলল সাহেব। কী করা যায়!
মুশকিল হল, ঘরে খাবার না থাকলে বেশি বেশি খিদে পায়। অথচ দোকান থেকে কিছু কেনার উপায় নেই। টাকা বাড়ন্ত। চেয়েও খাওয়া যায় না। পায়ে পায়ে বাইরে বেরোল সাহেব।
ঝোপঝাড়ের মাঝে সরু পায়ে চলা রাস্তা। তারপর কিছুটা মেঠো পথ। তারপর গ্রামের মূল রাস্তা।
গ্রামের লোকেরা সকালে খুব তাড়াতাড়িই উঠে পড়ে। তবে রাস্তাতে এত সকালে লোকজন তেমন নেই। যতীনদাদার কামারশালা খুলে গেছে। গোলককাকুর গোলদারি দোকান আর গ্রামের একমাত্র তাঁতঘরটা খোলেনি এখনও।
গণেশ অবশ্য বেরিয়ে পড়েছে। হাতে পাচনবাড়ি। পিছনে গোটা চল্লিশেক গোরু। গ্রামের সব গেরস্থের গাই-গোরু গণেশেরই ‘আন্ডারে’। ঘর থেকে চরাতে নিয়ে যায়। বিকেলে ফেরত দিয়ে যায়। গোরু প্রতি চল্লিশটা টাকা পায় মাসে মাসে। গণেশের বউ লোকের বাড়িতে বাসন-টাসন মেজে দেয়। ছেলেপুলে নেই বলে বেশ চলে যায় ওদের।
গ্রামের রাস্তাটা সাদাটে শক্ত পাথুরে। মিহি বালির মতো গুঁড়ো ছড়ানো। বাঁদিকের তেঁতুল গাছটার উপরের পাতা নড়ছে সকালের হাওয়ায়। নীচের দিকটা স্থির। অনেক দূরে ক্ষেত দেখা যাচ্ছে। এই এলাকাতে ধান চাষ বেশি হয় না। সবজি চাষটাই বেশি। সার বেঁধে লাগানো ফুলকপি নজরে আসছে এখান থেকে। আর তারও পিছনে মাটির একটু উপরে থম মেরে আছে ভিজে ধোঁয়া।
ডানহাতে গোলমাথার কালীমন্দিরটা রেখে, পরপর দু-বার বাঁদিকে বেঁকেই রাস্তার পাশে কিংশুকদের লাল রঙের দোতলা বাড়ি। বাউন্ডারির উপর দিয়ে উঁকি মারছে লেবু গাছের পাতা আর শিউলি গাছটা। উলটোদিকে গৌতমবাবুদের হলুদ রঙের একতলা।
কিংশুকদের বাড়ির সামনে এসে কিছুক্ষণ ভাবল সাহেব। তারপর গলা উঁচু করে ডাকল, “কিংশুক! এই কিংশুক!”
কিংশুকের বাবা শহরে সরকারি অফিসে চাকরি করেন। এখন তাঁর ছুটি। দোতলার বারান্দার রেলিংয়ে কিংশুকের মাথাটা উঁকি দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই নীচের তলার দরজা খুলে কিংশুকের বাবা পারিজাতবাবু বেরিয়ে এলেন। খুব রাশভারী মানুষ। পরনে সাদা লুঙ্গি আর সাদা রঙেরই পাঞ্জাবি। চশমার নীচ দিয়ে সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এসো সাহেব।”
বাইরের ঘরে লাল মেঝের উপর কয়েকটা বেতের চেয়ার। কাচ লাগানো বড়ো বেতের টেবিল। দেওয়াল ঘেঁষে বইয়ের আলমারি আর তার উপরে একটা দেওয়াল ঘড়ি। বাইরের ঘর আর ভেতরের ঘরের মাঝের দরজাটার পর্দার পিছনে দাঁড়িয়ে কিংশুক উশখুশ করছিল। বাবা আছেন যে ঘরে!
পারিজাতবাবু চেয়ারে বসে সাহেবের দিকে তাকিয়ে একবার গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “অনেকদিন পরে এলে। সব ভালো তো? কিছু বলছিলে?”
সাহেব কিংশুকের দিকে না তাকিয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি একবার বলেছিলেন কিংশুককে যদি আমি অঙ্কটা...”
পারিজাতবাবু সামনে একটু ঝুঁকে গিয়ে চশমাটা নাকের উপরে ঠেলে তুলে অবাক হয়ে বললেন, “হ্যাঁ। তাই তো!”
“ও-ও বলছিল ওর একটু অসুবিধা...”
“বেশ তো! বেশ তো! খুব ভালো হয় তাহলে। তুমি কি কাল থেকেই...”
“না, না!” সাহেব হাত তুলে পারিজাতবাবুকে থামিয়ে বলল, “রোজ কি আর আমি আসতে পারব? আজ একটু সময় ছিল হাতে।”
“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।” পারিজাতবাবু ব্যস্তভাবে পিছন ঘুরে কিংশুকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাহলে কিংশুক, তোরা বরং উপরের ঘরে...”
কিংশুকের মা আর ঠাকুমা রান্নাঘরে কীসব কাজ করছিলেন। কিংশুকের বাবা ঘরে থাকা মানেই জ্বালা। কাপের পর কাপ চা চাই। তার উপর রোজ গুচ্ছের শাকপাতা এনে হাজির করেন। কিনতে হয় না। পিছনের বিঘে দেড়েক জমিতে সবজি চাষ হয়। দেখাশোনার জন্য লোক রাখা আছে।
পারিজাতবাবু পারতপক্ষে রান্নাঘর মাড়ান না। তাঁকে দেখলেই কিংশুকের মা আর ঠাকুমা বিরক্তির চোখে তাকান আর নিজেদের মধ্যে বিড়বিড় করে কীসব বলাবলি করেন। শাশুড়ি আর বউমাতে খুব ভাব আর দুজনেই তাঁর বিপক্ষে।
পারিজাতবাবুকে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াতে দেখে কিংশুকের মা চোখ পাকিয়ে বললেন, “আবার কী চাই?”
পারিজাতবাবু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “ওগো, সাহেব এসেছে কিংশুককে পড়াতে। একটু চা-বিস্কুট...”
কিংশুকের ঠাকুমা একবার তাঁর দিকে তাকিয়ে আবার একমনে কুটনো কুটতে লাগলেন। পারিজাতবাবু আর তাঁর স্ত্রীর মধ্যে চোখে চোখে কী কথা হল কে জানে। উনি চলে গেলে কিংশুকের মা তাঁর শাশুড়িকে বললেন, “মা, সাহেব এসেছে।”
ঠাকুমা শান্ত গলায় বললেন, “জানি বাছা। দুটো লুচি ভেজে দাও। আর দু-মুঠো চাল আজ বেশি দিও। ওকে বলে দিও দুপুরে এখানেই দুটি খেয়ে যেতে।”
একটু পরে আলুর সাদা তরকারি দিয়ে একটা গরম লুচি মুখে পুরে হুসহাস করতে করতে সাহেব বলল, “কাকিমার যে এসব করার কী দরকার!”
“কাল লক্ষ্মীপুজো কাকা!”
“হুঁ। তোদের ঘরে খিচুড়ি, পায়েস—এসব হচ্ছে তো?”
“হ্যাঁ। তোমার তো নেমন্তন্ন। আর তুমি যে বলেছিলে কুদোডাঙার গল্প বলবে!”
“দাঁড়া না। কাল রাতে ক্লাবের সামনে আসিস সবাই। তুই, শুকরু, ফুলি, সাগর, অঙ্কিতা। চাঁদের তলায় বসে বলে দেব।”
“অ্যালবার্টদাদা, লালু—ওরা আসবে না?”
বাটিতে লেগে থাকা তরকারির শেষটা চাটতে চাটতে সাহেব ঘাড় নেড়ে বলল, “উঁহু! রাত্তির বেলায় আসতে দেবেন না রেক্টর।”
“তাহলে তোমার সঙ্গে গিয়ে পরদিন প্রসাদ দিয়ে আসব ওদের। তারপরেই তো স্কুল খুলে যাবে।”
লক্ষ্মীপুজোর সন্ধেতে সত্যিই ওদের বিরাট আসর বসল ক্লাবের সামনের মাঠটায়।
বিকেলবেলায় যখন ছেলেরা সাহেবপাড়া পেরিয়ে নতুনগঞ্জের হাট থেকে ফল-টল সব কিনে কুদোডাঙার দিকে আসছিল, তখন পুব দিগন্তের কাছে কালচে সবুজ গাছপালা আর ধোঁয়াটে পাহাড়ের উপরে বিশাল আকারের কাচের তৈরি চাঁদটাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন কুদোডাঙার মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আর এখন তার আকার যেন অনেকটা ছোটো। কিন্তু খুব উজ্জ্বল। যেন ঝকঝকে করে মাজা একটা বিরাট কাঁসার থালা।
ক্লাব বলতে অবশ্য বিশাল কিছু ব্যাপার নয়। চুনকাম করা ইটের দেওয়ালের উপরে লাল টালি দেওয়া। দুটো মাত্র ঘর। সামনে লোহা দিয়ে ঢালাই করা একটা শেড। ওখানেই দুর্গাপূজা হয়। আর তার সামনে বেশ বড়ো একটা মাঠ। দূরে দূরে কালচে, ঝাপসা গাছপালা। ক্লাবের দিক থেকে ধূপের গন্ধ ভেসে আসছে। উজ্জ্বল চাঁদের জ্যোৎস্না, ক্লাবের সামনে লাগানো পাঁচশো ওয়াটের বাল্ব আর দূরের ঘরগুলো থেকে আসা ম্লান আলো মিলে একটা মায়াময় জগৎ সৃষ্টি হয়েছে যেন। ঝিরঝির করে ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। গাছের কালো কালো পাতারা অল্প অল্প নড়ছে। ঠিক এই সময়টা আর আসবে না জীবনে। সময় আর ফিরে আসে না।
ক্লাবের ভিতরে ভটচাজ মশাইয়ের সঙ্গে মা-কাকিমারা সবাই আছেন। শেডের তলায় বসে বাবারা। আর মাঠের মাঝখানে গোল করে বসে আছে সাহেব, শুকরু, কিংশুক, ফুলি, রুমুমাসি, অনুপকাকা। আরও অন্য সকলে। ফুলির বোন ঝিলিমিলি সাহেবের কোলে। ঝকঝকে চাঁদের আলোতে বোঝা যাচ্ছে সবুজ ঘাসের জমিটি।
সাহেব শুরু করল—
“অগাস্টিন ছিলেন খুব পণ্ডিত মানুষ। এখানে সেনাদলের হয়ে কাজ করতে এলেও তিনি সার্ভের কাজও করতেন। শিকারিও ছিলেন। এখানে তখন দু-এক ঘর আদিবাসীরাই থাকতেন কেবল। একটা বাঘ খুব অত্যাচার করছিল তাদের উপর। ঘর থেকে বাচ্চা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল; জল আনতে যাওয়া মহিলাদের উপর আক্রমণ করছিল। তখন সেটাকে মারতে এখানে এলেন অগাস্টিন কিওয়ার্ড। একটা সাদা রঙের ঘোড়াতে চড়ে। সঙ্গে ফস্টার বলে একজন সঙ্গী।
“ছাগলের টোপ দিয়ে বাঘটাকে তো মারা হল, কিন্তু ফেরার পথে অন্ধকার নামল। গ্রামের শেষে যেখানে এখন ভৈরবমন্দির, সেখানে এসে দেখলেন মাথার উপরে চাঁদ। জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করছে চারদিক। সাদা মাটিতে চাঁদের আলো। আবছায়া গাছপালাতে চারদিক ঘেরা। দূরে, অনেক নীচে বয়ে যাওয়া নদীটা রুপোর ফিতের মতো পড়ে আছে। উনি তখন ফস্টারকে বললেন, এত সুন্দর একটা জায়গা, ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। এখানে কিছু করা যায় না?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করল সাহেব। তারপর নীচু গলায় বলল, “বাকিটা পরে বলে দেব।”
রুমুমাসি নড়ে বসে চাঁদের দিকে মুখটা তুলল একবার। তারপর নিজের মনেই বলল, “কী সুন্দর!”
মাথাটা নামিয়ে সাহেবের দিকে তাকাল একবার।—“এবারে সমুদ্র মন্থনের গল্পটা বলে দে একবার।”
“আরে সে তো তোরা জানিস!”
“ভালো করে মনে নেই। একবার বল না প্লিজ!”
ঝিলিমিলি নিজের ছোট্ট হাতটা দিয়ে সাহেবের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে আধো আধো ভাষায় বলল, “লোখখির গলপো! ও থায়েব!”
কিংশুক, শুকরু, ফুলি সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সাহেবকাকা, লক্ষ্মীর গল্প বলো।”
“আরে ওটাই তো সমুদ্র মন্থনের গল্প!” রুমুমাসি বলল।
“বেশ! শোন তবে।” গলাটা পরিষ্কার করে নিল সাহেব।—
“আগে মা লক্ষ্মী থাকতেন দেবতাদের কাছে। তাঁর আর এক নাম শ্রী। তিনি সঙ্গে থাকাতে দেবতাদের খুব ধনসম্পদ আর শক্তি হল। দেখবি তোরা এখনও নামের আগে শ্রী বা শ্রীমতী বসাস। তবে গল্প শুনে বোঝা যায় শ্রী আসলে এই দেশের আদি অধিবাসীদের সম্পদের দেবী ছিলেন। সম্ভবত বাইরে থেকে আসা মানুষেরা পরে তাঁকে দেবী বলে মেনে নিয়ে পুজো শুরু করেন।
“যাই হোক। দুর্বাসা মুনি বলে একজন খুব রাগী মানুষ ছিলেন। তিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে একটা মালা দিয়েছিলেন। ইন্দ্র আবার সেই মালাটা নিজের হাতির মাথায় রাখেন। হাতির তো অত বুদ্ধি নেই! সে মাথা নাড়িয়ে মালাটা নীচে ফেলে দিল। সেটা আবার দুর্বাসা দেখতে পেলেন। খুব রেগে গিয়ে তিনি অভিশাপ দিলেন, শ্রী দেবতাদের ছেড়ে সমুদ্রে বরুণের কাছে চলে যাবেন।
“তাঁর কথা বিফল হবার উপায় নেই। শ্রী চলে গেলেন। আর তখন অসুরেরা দেবতাদের মেরে মেরে সাবাড় করে আনল।
“তখনকার দিনে বিপদ বুঝলেই দেবতারা ব্রহ্মা বিষ্ণু—মানে নারায়ণ আর শিবের কাছে গিয়ে কাঁদতেন। এবার গেলেন নারায়ণের কাছে। তিনি বুদ্ধি দিলেন—সবাই মিলে সমুদ্র মন্থন করলে শ্রীকে তো ফেরত পাওয়া যাবেই, তার সঙ্গে অনেক সম্পদ আর অমৃতও পাওয়া যাবে। অমৃত খেলে কেউ আর মরবে না।
“দুধের মাঠা তোলা দেখেছিস তো! একটা লাঠিকে দুধের মধ্যে রেখে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে ননী তোলা হয়। এটাও অনেকটা সেরকমই ব্যাপার। এখানে মন্দার পর্বত হলেন লাঠি আর বাসুকি নাগ হলেন দড়ি।
“সমুদ্ররাজ এসে দেবতাদের বললেন, ‘তোমরা আমার জল তোলপাড় করবে, কত প্রাণী মারা যাবে, অমৃতের ভাগ কিন্তু আমার চাই! বলে রাখলুম। আর ওসব পর্বত-টর্বতের ওজন আমি নিতে পারব না সেও বলে রাখছি। অন্য ব্যবস্থা দেখ বাপু।’
“তখন মন্দার পর্বতের নীচে রাখা হল বিশাল একটা কচ্ছপকে। তিনি আসলে বিষ্ণুরই কূর্ম অবতার। সমুদ্রেই থাকতেন। প্রথমে কচ্ছপের পিঠে পর্বতটা ঠিক ফিট করছিল না। ইন্দ্র বজ্র দিয়ে মন্দার পর্বতের নীচটা সমান করে দিতে সেই কচ্ছপ তার ভার নিলেন।
“দেবতাদের গায়ে অত জোর ছিল না। তাই চালাকি করে অসুরদেরও সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল। তাদের গায়ে ভীষণ জোর। তাদেরকে প্রথমে বাসুকির লেজের দিকটা ধরতে বলা হয়েছিল। দেবতারা জানতেন তারা আপত্তি করবে। হলও তাই। তারা বলল, ‘রামোঃ! আমরা লেজের দিক ধরব কেন? ওদিক দিয়ে তো বাসুকি নাগ ইয়ে করে! আমরা মুখের দিকটা ধরব।’
“ঘষা খেয়ে বাসুকির মুখ দিয়ে আগুন বেরোতে লাগল। তাতে অসুরদের কয়েকজন মারা গেল। সেই আগুন থেকে গাছপালাতে আগুন লেগে গেল। সমুদ্রের জল বাষ্প হয়ে আকাশে মেঘ হয়ে জমল। পরে দেবতাদের প্রার্থনায় তা আবার বৃষ্টি হয়ে নীচে নেমে এল। আগুন নিভে গেল।
“সমুদ্র মন্থনে উঠে এল অপ্সরা। তারা খুব ভালো নাচতে গাইতে পারত। তাই দেবতারা তাদের নিয়ে নিলেন।
“কামধেনু বলে এক গাই উঠে এল। ঐরাবত নামে এক হাতি—তাকে দেবরাজ ইন্দ্র নিয়ে নিলেন। উচ্চৈঃশ্রবা নামে ঘোড়া পাওয়া গেল। কৌস্তুভ মণি, পারিজাত ফুল, চন্দ্র, কল্পবৃক্ষ উঠে এল। অশ্বিনীকুমারদ্বয় উঠে এলেন। তাঁরা দেবতাদের চিকিৎসা করতেন। অমৃতের কলশি নিয়ে উঠে এলেন ধন্বন্তরি। আর লক্ষ্মীও উঠে এলেন। চতুর্ভুজা, পদ্মাসনা, মাথায় সাপের ফণার ছাতা। চারটি বিশাল হাতি তাঁকে স্নান করাতে লাগল। চারদিক আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বিদ্যুতের মতো ঝকঝকে গয়না তাঁর শরীরে...”
গল্প বেশ জমাটি জায়গাতে চলে গিয়েছিল বটে, তবে শ্রোতারা কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ করছিল। তার কারণ দূর থেকে একটা গাড়ির আওয়াজ আর আলো অনেকক্ষণ ধরেই তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছিল। এবার সেটা হেড-লাইট জ্বালানো অবস্থাতেই এসে দাঁড়াল মাঠের পাশে।
এ সময়ে কে এল আবার! ওরা সবাই অবাক হয়ে সেদিকেই তাকাল।
“রজা খেওয়ার্ড!”
একেবারে খাস বিলিতি উচ্চারণ। গলাটি কোনও মহিলার। তবে সে-গলার দানা আলাদা। আওয়াজটা ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে দূরের টিলার গায়ে গমগম করতে করতে হারিয়ে গেল।
উঠে দাঁড়াল সাহেব।
গাড়ির লাইটটাকে পিছনে রেখে বেশ কয়েকটা শরীর তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। একটু পরে সামনে এসে দাঁড়াতে বোঝা গেল, থানার ওসি এসেছেন। অবশ্য তাঁর দিকে কারোর নজর ছিল না। কারণ, তাঁর পাশের একটি অল্পবয়সি মেয়ে। পরনে লাল শাড়ি আর ধুকধুকিতে জ্বলজ্বল করছে গাঢ় সবুজ পান্না। আলো-আঁধারিতেও বোঝা যাচ্ছিল সেটা। জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করছে তার পাকা গমের দানার মতো গায়ের রঙ।
“এই বুঝি মা লোখখি?” ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল ঝিলিমিলি।
(৬)
“হোয়াট ওয়জ দ্য নেম ইউ টোল্ড?” ভায়োলেট জিজ্ঞাসা করল।
সাহেব চায়ের জায়গায় নতুন ধরনের কোনও পানীয় বানানোর চেষ্টা করছিল। যাতে সম্মানটাও বাঁচে, দুধ বা চিনিরও প্রয়োজন না হয়। গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, “খিচুড়ি।”
“কিচড়ি, কিচড়ি।” বিড়বিড় করে নামটা মুখস্থ করার চেষ্টা করল ভায়োলেট। এখানে সকালবেলাতে বেশ ঠান্ডা। তাও তার কপালে ঘাম। কপাল থেকে নাকের ডগা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘামের ফোঁটা। জগিং সেরে ফিরছে। কালকের বাঙালি সাজ আর নেই। পরনের ট্র্যাক-স্যুট, টি-শার্ট সব ভেজা। কী একটা ভেবে সে বলল, “দ্যাট ওয়জ রিয়্যালি টেস্টি। বাট ভেরি স্পাইসি অ্যান্ড হট। মাই স্টোম্যাক গট আপসেট।”
“দিস ড্রিংক উইল কিউর। পিওরলি ইন্ডিয়ান।”
“রিয়্যালি! দ্যাটস ব্রিল।” ভায়োলেট সাহেবের হাতে ধরা কাচের গ্লাসটার দিকে হাত বাড়াল। ফিনফিনে এই গ্লাসগুলো কোনও এককালে সাহেবের পূর্বপুরুষেরা ইউরোপের কোনও দেশ থেকে আনিয়েছিলেন। দু-তিনটেই অবশিষ্ট আছে আর।
গ্লাসটা হাতে নিয়ে মিষ্টি করে হেসে ভায়োলেট বলল, “থ্যাংকস!” কিন্তু চুমুক দিতেই মুখটা বিকৃত হয়ে গেল তার।
সাহেব অন্যদিকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামছিল। কী জিনিস তৈরি হয়েছে কে জানে! সম্পূর্ণ নিজের আইডিয়াতে সে এই কিম্ভূত জিনিসটি বানিয়েছে। উপাদানগুলি অবশ্য ভারতীয় শাস্ত্র অনুযায়ী উপকারী ভেষজ। থানকুনি পাতা, পেঁপে পাতা, তুলসি, গাঁদালপাতা আর জামপাতা থেঁতো করে, গরম জলে তার রস দিয়ে, সঙ্গে জারে পড়ে থাকা সামান্য চায়ের গুঁড়ো আর আদার রস দিয়ে তৈরি। লবঙ্গ দিয়ে ফোটানো হয়েছে কিছুক্ষণ। এখন মুশকিল হল ব্রেকফাস্টে কী দেওয়া যায় সম্মাননীয় অতিথি দুজনকে।
একটু পরেই অবশ্য ভায়োলেটের এক মুখ হাসি। গালে টোল ফেলে সে সাহেবকে বলল, “অ্যাম অলরেডি ফিলিং ওয়েল। থ্যাংকস রজার।”
কাল আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল সাহেবের জীবনে। যাকে বলে লক্ষ্মীপুজোর রাতে লক্ষ্মীলাভ।
বেশ কয়েকটা পরিচ্ছেদে কুদোডাঙা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিল সাহেব। তাতে অগাস্টিন সাহেবের শিকারের অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে নীল-চাষ, গরিব দেশীয় মানুষদের উপরে অত্যাচার থেকে শুরু করে নীল-চাষ বন্ধ হয়ে যাওয়া সবই ছিল। এখানের বিবরণ, সাহেবের পরিবারের কোলচেস্টার শহরে চলে যাওয়া—সব লিখে-টিখে নিজের তোলা আর পুরোনো কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবির স্ক্যানড কপি সমেত পাঠিয়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘অ্যাপ্রোচ’-এ। কে জানত যে সেটা ভীষণ পছন্দ হবে ওদের! গত বেশ কিছুদিন ধরে ওরা সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু বিল শোধ না করায় মাস খানেক হল সাহেবের ঘরের ইলেক্ট্রিসিটি কানেকশন কাটা। সাহেব কিছু হ্যাকস ব্যবহার করে ঘরে লাইট জ্বালানোর ব্যবস্থা করেছে বটে, কিন্তু ল্যাপটপ আর মোবাইলটা দশ-বারোদিন হল চার্জ দেওয়া হয়নি। ফলে ওরা সাহেবের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করতে পারেনি।
ভায়োলেট হল ‘অ্যাপ্রোচ’-এর সাব-এডিটর। ভীষণ জেদি। হাল ছাড়বার পাত্রী নয়। ঠিক খুঁজে খুঁজে অ্যাম্বারকে বার করেছে। সে হল সাহেবের কাজিন। কোনও যোগাযোগই ছিল না তাদের। ভায়োলেট প্রথমে ইংল্যান্ডে সাহেবের পরিবারের খোঁজ করে। তারপর পায় অ্যাম্বারকে। সাহেবের সঙ্গেও শেষ পর্যন্ত দেখা হয়ে গেল তার নিজের পরিবারের একজনের। সেও এসেছে সঙ্গে।
ওরা পরশু এসে নেমেছে কলকাতায়। মাঝে মুম্বইয়ে নেমে ঘুরেছে একটু। কলকাতায় এয়ারপোর্ট লাগোয়া রিটায়ারিং রুমে বিশ্রাম নিয়েছে। তারপর সেখান থেকে একটা ক্যাব ভাড়া নিয়ে ওরা খুঁজে খুঁজে প্রথমে নতুনহাট থানাতে যায়। ভাগ্য ভালো এখানে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান আর কেউ নেই। তাই থানার ওসি সহজেই আন্দাজ করেছিলেন সাহেবের কথা।
দিন খুব তাড়াতাড়ি বদলে যায়। কাল পর্যন্ত সাহেবের হাতে একটা টাকাও ছিল না। অ্যাকাউন্টে মিনিমাম ব্যালান্সটুকু পড়ে ছিল কেবল। আর আজ তার কাছে বেশ মোটা অঙ্কের একটা ফরেন কারেন্সি ড্রাফট। তবে ড্রাফট তো আর টাকা নয়! ব্যাংকে ফেলতে হবে আগে। ক্লিয়ারেন্সের পর টাকা হয়ে অ্যাকাউন্টে ফিরবে সেটা।
কিওয়ার্ড পরিবারের এখনকার জেনারেশন বোধ হয় একটু অগোছালো। সাহেব যেমন। ওর কাজিন অ্যাম্বারও কম যায় না। তার বয়সের অন্যান্য ব্রিটিশ মেয়েরা অনেক বেশি শরীর সচেতন। ভায়োলেটের মতো। কিন্তু সে এখনও বিছানা ছাড়েনি। অবশ্য ওরা কাল অনেক রাত অবধি গল্প করেছে। ওদের সঙ্গে থানার ওসি ছিলেন। গ্রামের সব লোকজনও ছিল। সবাই কিংশুকদের ঘরে খিচুড়ি, সবজি আর পায়েস খেয়েছেন।
এখন তাহলে কী ব্যবস্থা হবে ব্রেকফাস্টের! এই কথাটাই ঘুরপাক খাচ্ছিল সাহেবের মাথায়। গোলদারি দোকানটাও খোলেনি নিশ্চয়ই এখনও। না-হলে পাউরুটি আর ডিম ধার নেওয়া যেত। মানে নিতেই হত।
বাঁচাল কিংশুক।
দরজায় নক করার আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকিয়েই যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল সাহেবের। কিংশুক হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। হাতে ঝোলা। তার ভিতর থেকে টিফিন ক্যারিয়ার আর ফ্লাস্ক উঁকি মারছে। এক ঝলক ভায়োলেটের দিকে তাকাল সে। তারপর সাহেবের দিকে ঘুরে বলল, “আজ দুপুরেও তোমাদের সবাই আমাদের ঘরে খাবে কাকা। বাবা বলে দিয়েছেন।”
থলেটা নিতে নিতে সাহেবের চোখ ছলছল করে উঠল একটু। মৃদু স্বরে বলল, “তোরা না থাকলে যে কী হত আমার!”
“ধুর! ছাড়ো না। আর আজ যে আমাদের হস্টেল যাবার কথা ছিল?”
“দাঁড়া। খেয়ে নিই আগে।”
“আর একটা দিদি কই?”
“আমি কাকা হলে ওরা কিন্তু পিসি হবে। তবে দয়া করে পিসিমা বলিস না আবার! কানে লাগবে।”
“পিসি ডাকলে যদি রেগে যায়! অবশ্য আমার একটা পিসি আছে তোমার বয়সি। তাকে পিসি ডাকলে রেগে যায়। তার কাছে কিছু চাইবার হলে আমি বলি, না দিলে কিন্তু বাইরের লোকের সামনে পিসিমা বলে ডাকব! রুমুমাসিও মাসি বললে রেগে যায়।”
“তাহলে নাম ধরে ডাকবি।”
“বলো কী! অত বড়ো বড়ো মেয়ে! মা কান ছিঁড়ে নেবে জানতে পারলে। খুব জোর মায়ের হাতে। বাবার থেকেও।”
“আরে ওদের দেশে তো নাম ধরেই ডাকে। দাঁড়া, খেয়ে নিই। বকবক করে খিদে পেয়ে গেল।”
ভায়োলেট একপাশে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে তাদের মধ্যে কী কথা হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করছিল। এবার এগিয়ে এসে বলল, “ব্যাড ম্যানারস। লেট মি নো হোয়াট আর ইউ টকিং অ্যাবাউট। হু ইজ দ্য বয়?”
“হি ইজ কিংশুক।” সাহেব বলল।
“খিংসু!”
“কিংশুক! কিং শুক।” ভেঙে ভেঙে বলল সাহেব। তারপর ইংরেজিতেই ওকে বলল, “সরি। আসলে ও ইংরেজিতে তেমন সড়গড় নয়। খুব ভালো ছেলে। কাল রাতে তো ওদের বাড়িতেই গিয়েছিলাম আমরা! এখন আমাদের জন্য ব্রেকফাস্ট এনেছে। আবার আজ দুপুরেও আমাদের তিনজনকে খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছে।”
“রিয়ালি! গুড মর্নিং খিংসু! থ্যাংক ইউ সোওও মাচ!”
কিংশুক হাসল ভায়োলেটের দিকে তাকিয়ে।
অ্যাম্বারকে ঘুম থেকে ওঠাতে খুব বেগ পেতে হল। তার নাকি শেষ রাতের দিকে ঘুম এসেছিল। চোখগুলো লাল হয়ে আছে। উঠে অনেকক্ষণ বিছানাতেই গড়াগড়ি খেল। তারপর হাই তুলতে তুলতে ডাইনিংয়ে এসে কিংশুককে দেখে ইংরেজিতে বলল, “আরে! এদের ঘরেই তো কাল রাতে গিয়েছিলাম আমরা। গুড মর্নিং। কী যেন তোমার নামটা?”
“খিংসু।” জানাল ভায়োলেট। ইতিমধ্যে তার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে কিংশুকের। আকার-ইঙ্গিতে আর ছোটো ছোটো বাক্য ব্যবহার করে কথাবার্তাও হয়েছে। দু-একটা বাংলা কথাও শিখে ফেলেছে ভায়োলেট। কিংশুকের অবশ্য ওর উচ্চারণ শুনে খুব হাসি পাচ্ছে। ‘ক’ বলতে পারে না। ‘ট’-ও উচ্চারণ হয় না ওদের জিভে। ‘খ’ আর ‘ঠ’ বলে। বাক্যের শেষের ‘র’ বলে না। যেমন ফুড-কে বাংলায় কী বলে শিখে নিয়েও লাগাতার ‘খাবা’ বলে গেল।
কিংশুক কিছুতেই ওদের সঙ্গে খেল না। সে ঘরে খেয়ে এসেছে। খাওয়ার টেবিলেই ঠিক হল প্রথমে ওরা গ্রামে একটু ঘুরবে। তারপর কুন্তীদিদার সঙ্গে দেখা করে গির্জা আর হস্টেলে ঘুরতে যাবে। তারপর এসে কিংশুকদের বাড়িতে খাবে। যদিও ওদের নাকি দুপুরে ভারী খাবার খাওয়ার অভ্যাস নেই।
“শুকরুকে ডেকে নেব কাকা?” কিংশুক বলল।
“বেশ তো! ডেকে নে।”
“ওদের জলেবিয়া ঝিল দেখাবে না?”
সাহেব চোখ বড়ো করে বলল, “ঠিক বলেছিস তো! তবে আজ আর সময় হবে না। বিকেলে একবার চেষ্টা করে দেখব যদিও।”
কিংশুকের মা জানেন না এরা ব্রেকফাস্টে কী খায়। তবে বুদ্ধি করে তিনি কিছু ফল, পাউরুটির টোস্ট, পোচড এগ এসব পাঠিয়েছেন। চামচে করে একটু ডিম মুখে দিয়ে অ্যাম্বার নাক সিঁটকে বলল, “এই রজার, তোমরা আমাদের সামনে ওই ভাষায় কথা বলবে না। আর বললেও কী কথা হচ্ছে তা আমাদের বুঝিয়ে দেবে।”
“ওকে। আসলে তোমাদের নিয়ে ঘুরতে যাবার প্ল্যান ফিক্স করছিলাম। জলেবিয়া ঝিল ঘুরতে যাব আমরা। ভেরি নাইস প্লেস। মস্ত একটা জলাশয় আছে। সেখানে বাইরে থেকে অনেক পাখি-টাখি আসে।”
কুন্তীবুড়ি বাইরে রোদে বসে কাঁপছিল। সাহেবের গলা শুনে তার কোঁচকানো গাল কেঁপে গেল একটু। চোখে পিঁচুটি জমে আছে। জল পড়ে।
“অ সাহেব, এলি!”
“এলাম দিদা। কেমন আছ?”
“বড়ো জাড়া লাগে বাপ। ঘুম হয় না।”
তার কাছে হাঁটু গেড়ে বসল সাহেব। সে পাঞ্জাবির উপরেই একটা ছেঁড়া ব্লেজার পরেছিল। সেটা খুলে কুন্তীবুড়ির গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল, “তোমার ঘর সেরে দেব দিদা। দেখবে আর হাওয়া ঢুকবে না।”
“বড়ো ভালো ছেলে তুই। তা হ্যাঁ রে! কিছু খাবার আছে বাপ? আজ চুলা ধরাতে পারিনি। হাত-পা চলে না।”
পকেট থেকে দুটো কলা বার করে বুড়ির হাতে দিল সাহেব। কিংশুকের মায়ের দেওয়া খাবারের মধ্যে ছিল। বলল, “এখন এই খেয়ে নাও দিদা। দুপুরে তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসব।”
ভায়োলেটের হাতে একটা দামি ক্যামেরা। সেটা দিয়ে সে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে আশেপাশের আর কুন্তীবুড়ির ছবি তুলছিল। অ্যাম্বার আবার খুব ছটফটে। একজায়গায় স্থির থাকতে পারে না। পায়ের হাঁটু ভাঁজ করতে করতে সে জিজ্ঞাসা করল, “এটা কে রজার? এই লেডি?”
“গ্রামের লোক। আমার আত্মীয়।” জবাব দিল সাহেব।
কথাবার্তা ইংরেজিতেই হচ্ছিল। অ্যাম্বার অবাক হয়ে বলল, “রিলেটিভ? তার মানে তো আমারও রিলেটিভ! উনি কি কিওয়ার্ড ফ্যামিলিরই লোক?”
সাহেব হেসে ফেলল। হাসতে-হাসতেই বলল, “তোমরা বলো রিলেটিভস। বাংলাতে খুব সুন্দর একটা শব্দ আছে—আত্মীয়। মানে হল ‘সোলমেট’। যার সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক আছে সেই হল আত্মীয়। কুদোডাঙার সকলেই আমার আত্মীয়।”
অ্যাম্বার বড়ো করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আমার গ্র্যান্ডপা তাঁর বাবার কাছ থেকে ইন্ডিয়ার কথা শুনেছিলেন। খুব সম্ভবত নিজের ছোটোবেলায় এসেও ছিলেন একবার। শেষ বয়সে বার বার বলতেন, ইন্ডিয়া একেবারে অন্যরকম একটা দেশ। এখানে আসতেও চাইতেন খুব। পারলেন না।”
কুন্তীবুড়ি শুনতে পাচ্ছিল সব। বলল, “অ সাহেব! কে এয়েছে রে? গটরমটর করে কথা কইছিস!”
সাহেব হেসে বলল, “বিলেত থেকে তোমার দুই নাতনি এসেছে গো দিদা!”
“অ! বড়ো মন হয় নাতনিদের মুখ দেখি। চোখে দেখতে পাই না আজকাল। ওসব গটরমটর কথাবার্তা বুঝতেও পারি না।”
হোস্টেলের ছেলেদের আজ ছুটি। সোমবার থেকে ক্লাস। কেউ বাগানের কাজ করছিল, কেউ আবার ফুটবল খেলছিল। ওদের দেখে দৌড়ে এল সব। কিংশুকদের হাত থেকে প্রসাদ পেয়ে ভীষণ খুশি। বিশেষ করে পেঁড়া আর নারকেল খেতে খুব পছন্দ করে ওরা। অ্যাম্বার আর ভায়োলেটকে দেখে একটু লজ্জাও হয়েছিল অবশ্য ওদের। সাহেব আলাপ করিয়ে দিল।
“গির্জাটা ছোটো, কিন্তু অনেক পুরোনো। আগেকার বড়ো গির্জাটা নেই এখন। তবে আমাদের পরিবারের অনেকেরই জন্মপঞ্জি এখনও আছে এখানে।” সাহেব অ্যাম্বারকে বলল।
ওরা দুজন যখন রেক্টরের সঙ্গে কথা বলছে, সাহেব তখন অ্যালবার্টকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, “কুন্তীদিদার ঘরটা সারিয়ে দিতে হবে ভাই। এই রবিবার প্রার্থনার পর আমার সঙ্গে একটু হাত লাগাবি। রেক্টর আর ফাদারকে আমি বলে রাখব।”
“হয়ে যাবে স্যার।” হাসিমুখে বলল অ্যালবার্ট।
“তোদের গুদামে অনেকগুলো মোটা পলিথিন আছে না? ওগুলো নিয়ে যেতে হবে।”
(৭)
আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল অনেকক্ষণ থেকেই। সামনে উঁচু জায়গাটায়, যেখানে অনেকগুলো গাছ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানটা পেরিয়েই অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখা গেল।
আদিগন্ত ফাঁকা জমি চিরে ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো বাঁকানো এক জলাভূমি। কোথাও তার রঙ গাঢ় বাদামি, কোথাও সাদা, কোথাও নীল বা কোথাও সবুজ। অনেকটা দূরে গিয়ে আবার বাঁক নিয়েছে সে। আর তার কোমরের বাঁকে বাঁকে সবুজের নানা শেডস। একদিকে এ-বছরের মতো মরে যাওয়া কাশের শুকনো ডাঁটিগুলো দাঁড়িয়ে আছে।
জলের মাঝখানে অপার্থিব আল্পনার মতো সাদা-কালো আর কমলা রঙের জলছবি সাজিয়ে বসে আছে ঝুঁটি হাঁস, সারস। নির্দিষ্ট আকারে মাঝে মাঝে দল বেঁধে উড়ে যাচ্ছে তারা। আবার এসে বসছে।
“অসাধারণ!” নিজের ছাইরঙা চোখ দুটি ঝিলের দিকে মেলে দিয়ে বলল অ্যাম্বার। গলায় একরাশ মুগ্ধতা। বিশেষ একদিকে হাত দেখিয়ে প্রশ্ন করল, “ওই পাখিগুলোর নাম কী রজার?”
“ওগুলো হল ঝুঁটি হাঁস। তোমাদের ভাষায় টাফটেড ডাক।”
“আর ছোটো ছোটো ওই পাখিগুলো—যেগুলোর লাল রঙের মাথা, ঝিলের ধারে বসে?”
“ওগুলোকে বলে আবাবিল। ইংরেজি নাম ওয়্যার টেলড সোয়ালো। তারের উপরে বসে থাকে ওরা। আর ওই যে ছোট্ট দুটো পাখি ধূসরের সঙ্গে মেটে রঙ মেশানো, ওরা হল ডাস্কি ক্র্যাগ মার্টিন-এর জুটি। অজয় হোম নামে এক বিখ্যাত বাঙালি পক্ষীবিদ ওগুলোর নাম দিয়েছিলেন পাথুরে চটি। খুব রেয়ার স্পিসিস। আর নিজেদের মধ্যে খুব ভালোবাসা ওদের।”
ভায়োলেট তার ক্যামেরার লেন্সে মুহূর্তগুলি ধরে রাখছিল। মুখ ফিরিয়ে বলল, “তুমি অনেক জানো রজার।”
সাহেব মৃদু হাসল।—“খুব ছোটোবেলায় ফাদারের হাত ধরে এখানে ঘুরতে আসতাম। তিনি চিনিয়ে দিতেন পাখিদের নাম। বক আর সারসের পার্থক্য। গাছের নাম।
“এখানে যে গাছগুলো দেখতে পাচ্ছ তার অনেকগুলোই আস্তে আস্তে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে। ওইদিকে দেখো, পরপর মহুয়া, কেন্দ, ভিলাওয়া। আর তার পাশে শিমূল। ওর বীজ উড়ে উড়ে বেড়ায়। আর গায়ের আঁশগুলো থেকে তৈরি হয় সুতো। কোনোদিন যদি গ্রীষ্মকালে আসো, দেখতে পাবে লাল ফুলে ভরে গেছে গাছটা। ওই যে ভিলাওয়া, ওর বাদামের মতো ফলের বীজ খাওয়া যায়, ওষুধ হয়। আবার বীজটা টেলররা ব্যবহার করেন কাপড়ে দাগ দিতে। আমরা ভারতীয়রা গাছের মূল্যই বুঝি না! নিজেদের অনিষ্ট নিজেই করি। ক্রমাগত গাছ কেটে যাচ্ছি। একটা গাছ বড়ো হতে কত সময় লাগে বলো তো! অথচ কাটতে দশটা মিনিটও লাগে না। রাস্তা, বাড়ি তৈরি করার জন্য না ভেবেই গাছ কেটে ফেলি। অথচ সেই নির্মাণগুলো অন্য জায়গাতেও করা যেত। নেহাত এই এলাকার কাছাকাছি বড়ো শহর নেই কোনও, তাই এগুলো বেঁচে আছে। আমি সব গাছের বীজ শুকনো করে একটা কৌটোতে ভরে রেখে দিই, যাতে ভবিষ্যতে সেগুলো থেকে গাছ করা যায়। গির্জার আশেপাশে অনেক নতুন গাছ বানিয়েছি আমরা ওগুলো থেকে। সবগুলোই এমন গাছ যেগুলো আজকাল আর সচরাচর দেখা যায় না। অবশ্য বড়ো গাছই কি সব! ছোটো ছোটো কত গাছ আমরা আগাছা বলে কেটে ফেলি, অথচ তাদের মধ্যে আছে কত ঔষধি গুণ।”
কিংশুক আর শুকরু এর মধ্যে ঝিলের জলে নেমে গেছে। দুজনেই সাঁতার জানে। নিজেদের পাগুলো ভেজাচ্ছিল তারা। ভায়োলেট গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। একটু পরেই শুরু হল হাসি, চিৎকার, পরস্পরের দিকে জল ছোড়াছুড়ি। ভয় পেয়ে পাখির দল উড়ে গেল আকাশের দিকে। আবার ফিরে এল।
অ্যাম্বার ধপ করে বসে পড়ল সাহেবের পাশে। ঝিলের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ স্বরে বলল, “কী সুন্দর! রজার, খুব অবাক লাগে, আমি আর তুমি কাজিনস। অথচ এতদিন কোনও যোগাযোগই ছিল না। বাবাকে আমি মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতাম, আমাদের কেউ কি রয়ে গেছে ইন্ডিয়ায়! আজ তোমাকে প্রশ্ন করছি। তুমি আমাদের সঙ্গে ফিরে যাবে রজার? আমাদের পরিবারের বেশ প্রভাব আছে। তোমার নাগরিকত্বের বিষয়ে সাহায্য করব আমি।”
সাহেব আনমনে তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে। এবার মাথাটা আলতো করে নাড়িয়ে বলল, “না অ্যাম্বার! এখানের মানুষ, গাছপালা, নদী, আকাশ সব আমার রক্তে মিশে আছে। এদের ছেড়ে কোথাও গিয়ে শান্তি পাব না আমি।”
বড়ো করে একটা শ্বাস ফেলল অ্যাম্বার। মৃদু গলায় বলল, “তোমার অনুভূতিকে আমি সম্মান করি। তবু যদি কোনোদিন মনে হয়, তাহলে যোগাযোগ কোরো।”
“অ্যাম্বার, অ্যাম্বার! এদিকে এসো।” ওদিক থেকে উঁচু গলায় ডাক দিল ভায়োলেট। তার মুখ আর মাথা জল ছোড়াছুড়িতে ভিজে গেছে একেবারে। কিংশুক নিজের ভেজা জামা খুলে হাতে নিয়েছে। আর শুকরু একটু দূরে জলে পা ডুবিয়ে বসে। ও ভীষণ লাজুক। কিছুতেই অন্যদের সামনে জামা খুলবে না।
রজারের হাত ধরল অ্যাম্বার। ওদের দিকে যেতে যেতে নীচু গলায় বলল, “লন্ডনের মিউজিয়ামে আমাদের পরিবারের দেওয়া প্রচুর দামি মূর্তি, কয়েন আর অস্ত্র আছে।”
“সব এখানের মানুষদের কাছ থেকে লুঠ করা।” বলল সাহেব।
“জানি। আমার লজ্জা হয় রজার।”
“স্বাভাবিক। তাই ভাবি এখানের মানুষের পাশে থেকে কিছুটা যদি দোষ স্খালন করতে পারি।”
“গ্র্যান্ডপা বলতেন আর একটা কী যেন খুব দামি জিনিস এখানেই রয়ে গেছে। উনি নিজের বাবার মুখে শুনেছিলেন। তুমি যে-বাড়িটাতে থাকো সেটাই তো আমাদের পুরোনো বাড়ি। ওখানেই আছে কি? তার নাকি কয়েক মিলিয়ন পাউন্ড দাম। সত্যি বলতে কি, ভায়োলেট যেদিন প্রথম খুঁজে খুঁজে আমাদের বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে বলল ও ইন্ডিয়া যেতে চায়, তখনই আমার মনে পড়ল ব্যাপারটা। মনে হল যদি ওটা খুঁজে পাই! না না, আমি ওটা নিয়ে যেতে চাই না রজার। খালি একবার দেখতে চাই ব্যাপারটা সত্যি ছিল কি না। আর যদি সত্যি হয়, তাহলে কী জিনিস ওটা।”
সাহেব হাসল।—“আমিও শুনেছি কথাটা। ডায়েরিতে নাকি ইঙ্গিতও আছে ওটা কোথায় লুকোনো সে-ব্যাপারে। আমি খুঁজে পাইনি। ডায়েরিতেই লেখা আছে ওটার মালিক অন্য কেউ। যদি কোনোদিন আমি ওটা খুঁজে পাই, তবে যার জিনিস তাকে ফেরত দিয়ে দেব।”
“কে সেই মানুষ?”
“সেটাও লেখা নেই। তাকেও খুঁজে বার করতে হবে।”
“আমি সাহায্য করব তোমাকে।” হাসল অ্যাম্বার। তারপর এসে সাহেবের হাত ধরল।
একই পরিবারের তারা। অথচ এতকাল কোনও যোগাযোগই ছিল না। ভাবলেও অবাক লাগে। বিশেষ করে সাহেব তো একেবারে একা। এতদিন পরে নিজের বোনকে পেয়ে খুব আনন্দ হচ্ছিল তার।
ভায়োলেট আর কিংশুক ওদিকে জলে হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়ে কিংশুকের একটা জামাকে ছাঁকনি বানিয়ে জল থেকে ছোটো ছোটো মাছ ছেঁকে তুলছে। আবার জলে ছেড়ে দিচ্ছে। এই মাছগুলো পোকার মতো ছোট্ট। শুকরু একটু দূরে লজ্জা লজ্জা মুখে দাঁড়িয়ে। ওরা পরস্পরের ভাষা ভালো করে বোঝে না। তাতে দুষ্টুমি আটকায়নি। তার সঙ্গে চলছে খিলখিল হাসি।
অনেক দূরে নীল আকাশের বুকে দাঁড়িয়ে আছে গাঢ় রঙের একটা পাহাড়।
“আজ এখানে আছি। অথচ এক সপ্তাহ আগেই এই সময়ে আমি ছিলাম অন্য দেশে। কিছুদিন আগেও এই জায়গাটার নাম জানতাম না, তোমাদেরও চিনতাম না। সময় কত দ্রুত বদলে যায়, তাই না রজার?” বলল অ্যাম্বার।
সাহেব আনমনা হয়ে জলের দিকে তাকিয়ে ছিল। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, “এই ঝিলটার নাম জলেবিয়া ঝিল কেন জানো? জলেবি বা জিলিপি হল একটা বিখ্যাত মিষ্টি। দেখতে প্যাঁচালো প্যাঁচালো। তার মতো পাক খাওয়া এই ঝিলটা। তাই এই নাম।”
“হে ও-ও-ও!”
বহুদূরে উঁচু জায়গাটা থেকে কে যেন হাঁক দিচ্ছিল। ওরা সবাই সেদিকেই তাকাল। পিছনে নীল আকাশের ছবিটি রেখে দু-তিনটি শরীরের নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে সেখানে। পুলিশ কি?
(৮)
সারাদিন ঘুরে ঘরে ফিরেই অ্যাম্বার বিরক্তির সুরে বলল, “রজার, আমার সেলফোনটা চার্জ দেব কী করে! অদ্ভুত ব্যাপার করে রেখেছ তুমি। এখানে কারও বাড়িতে চার্জ দেওয়া যায় না?”
নিজের তৈরি দুটো এমারজেন্সি সোলার লাইট এনে রাখতে রাখতে সাহেব তার দিকে অপরাধীর চোখে তাকাল। মৃদু গলায় বলল, “সরি অ্যাম্বার! টাকা দেওয়া হয়নি বলে লাইন কেটে দিয়েছে। ওসি বললেন কাল ইলেক্ট্রিসিটি চলে আসবে। দেখছি কিছু করা যায় কি না।”
ভায়োলেট চেয়ারের উপরে বসে ল্যাপটপে তার দিনভর তোলা ছবিগুলো আপলোড করছিল। শুনতে পেয়ে সেখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল, “এখানেও একই ব্যাপার! সেলফোনে চার্জ নেই। ল্যাপটপটার চার্জও খুব বেশি হলে ঘণ্টা দু-এক টানতে পারবে।”
অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেল আজকে। সকালবেলাতেই ওসি সাহেব এসেছিলেন। ঘরে ওদের না দেখতে পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে জলেবিয়া ঝিল পর্যন্ত চলে যান। যতই হোক, দুজন ভিনদেশের নাগরিক আছে এখানে! তাদের নিরাপত্তার ব্যাপার আছে।
কুদোডাঙা এমনিতে খুবই নিরাপদ জায়গা। এখানে চুরি-ডাকাতির খবর একদম শোনা যায় না। কিন্তু ভিনদেশের নাগরিক এলে প্রশাসনের চিন্তার কারণ থাকেই। ওসির উপরেও তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপ আছে। তিনি যখন শুনলেন সাহেবের ঘরে ইলেক্ট্রিসিটি লাইন কাটা, তখন ভয়ংকর রেগে গিয়েছিলেন। সাহেবকেও যা নয় তাই বললেন। আপাতত তিনি সাহেবদের ঘরের বাইরে একজন আর্মড ফোর্স দিয়ে গেছেন। আইসি মাঝে মাঝে এসে দেখে যাবেন। আর ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই অফিসেও কথা বললেন। কাল তারা এসে লাইন জুড়ে যাবে। সাহেবও কথা দিয়েছে অবশ্য, ড্রাফটটা ক্যাশ হলেই সে নিজের বকেয়া টাকাটা শোধ করে দেবে।
গ্রামের কিছু কিছু লোকও এসেছিল। দুটি মেয়ে এইভাবে গ্রামের শেষ প্রান্তে সাহেবদের ভূতের মতো বাড়িটাতে থাকবে, সেটা তাদের পছন্দ হয়নি। যাই হোক, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠানো গেছে তাদের।
এতক্ষণ ধরে তিনজনে মিলে অনেক গল্প করছিল। বাইরে বসা কনস্টেবলবাবু এত হট্টগোল শুনে ব্যস্ত হয়ে উঁকি মেরে দেখে গেলেন দু-বার। তারপর গোঁফের আড়ালে গম্ভীর হয়ে আবার বাইরে চলে গেলেন। তাঁকে অনেকবার ভিতরেই বসতে বলা হয়েছে। কিছুতেই রাজি হলেন না। সাহেবের ঘরের বাগানের বাইরের গেটটার কাছে একটা গাছের নীচে চেয়ার নিয়ে বসে আছেন।
গাছের পাতা নড়ছে। হাওয়া বইছে আর ঠান্ডাও পড়েছে একটু একটু। গেটের পাশে বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা সোলার প্যানেল। তার নীচে পাঁচ ওয়াটের বাল্ব। এটাও সাহেবের ব্যবস্থা। একটু দূরে নীলচে কুয়াশা পাক খাচ্ছে। এ-সময় হিম পড়ে মাথায়। তবু পুলিশ ভদ্রলোককে ঘরের ভিতরে বসতে রাজি করানো গেল না। তাহলে নাকি ওসি সাহেব বকবেন।
ঘরের বাইরে বড়ো বারান্দাটা ধরে সাহেব হেঁটে গেল একবার। চাঁদের আলো এসে পড়ছে চৌখুপি কাটা বারান্দায়। শীত যে আসছে ক’দিন পরেই তা বোঝা যাচ্ছে বেশ। ঝিলের ধার থেকে ভেসে আসছে ভেজা একটা ঠান্ডা বাতাস। কে যেন গম্ভীর গলায় সাহেবকে বলল, “স্টে ইনসাইড! ডোন্ট ক্যাচ কোল্ড।”
ভিতরে এল সাহেব। অত বড়ো লিভিং রুমটার মধ্যে দুটো পাঁচ ওয়াটের লাইটে অন্ধকার বিশেষ দূর হয়নি। বরং একটা আলো-আঁধারি পরিবেশ।
ঠিক দুটো সাদা পাথরের মূর্তির মতো ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল অ্যাম্বার আর ভায়োলেট। অদ্ভুত লাগছিল সাহেবের।
“তোমরা কিছু শুনতে পেলে অ্যাম্বার?” সাহেব জিজ্ঞাসা করল।
“কী শুনব?”
“কারও গলা?”
“না তো!” ভায়োলেট অবাক হল।
অ্যাম্বার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার দেখল সাহেবকে। তারপর নীচু গলায় বলল, “আই ক্যান ফিল রজার। দিস হাউস হ্যাজ সেন্সেস!”
“ভূত! তোমরা কি ভূতের কথা বলছ? ওরে বাবা! আমার ভীষণ ভূতের ভয়!” ভায়োলেট প্রায় লাফ দিয়ে সাহেবের কাছে চলে এল।—“এই জায়গাটাও যেন কীরকম—জঙ্গল, ঝিল, ফাঁকা জায়গা। তার উপর আবার এই বাড়িটা ভীষণ বড়ো আর পুরোনো।”
ভায়োলেটের মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গিয়েছিল। সাহেব ওর দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল।—“ভয় পেও না ভায়োলেট। আমি তো জন্ম থেকেই আছি এখানে। যিনি বা যাঁরাই থাকুন এই বাড়িতে, তিনি বা তাঁরা খুব কেয়ারিং। কোনও অনিষ্ট করবেন না তোমাদের। চলো, এবার তোমাদের লাইব্রেরিটা দেখাই।”
এই আবছায়াতে লাইব্রেরির ভিতরটা আরও অদ্ভুত লাগছিল। মনে হচ্ছিল যেন টেবিল, চেয়ার আর মস্ত মস্ত সব আলমারির আনাচ-কানাচ থেকে কারা উঁকি মেরে ওদের দেখছে। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। ভায়োলেট সাহেবের হাতটা চেপে ধরল। অ্যাম্বারও তার গা ঘেঁষে এল।
এমারজেন্সি লাইটগুলো দরজার কাছে রাখা ছিল। চারদিক আলমারি দিয়ে ঘেরা ঘরটার মাঝে একটা মস্ত টেবিল। তার উপরে মোমদানিতে রাখা দুটো মোটা মোটা মোমবাতি জ্বলছে।
অ্যাম্বার চামড়ায় মোড়া দুটো ডায়েরি নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, “তোমাকে আংকল উইলিয়াম বলেছিলেন ডায়েরিতে সেই জিনিসটার ইঙ্গিত দেওয়া আছে। তাই তো?”
“হ্যাঁ। তাই বলে গিয়েছিলেন।”
“তুমি তো অনেকবার এগুলো পড়েছ। তাও কিছু খুঁজে পাওনি?”
সাহেব হতাশার সুরে বলল, “না অ্যাম্বার, কিচ্ছু খুঁজে পাইনি। তাই তোমাদের দেখাচ্ছি। নিজের বুদ্ধির উপরে আর আমার ভরসা নেই।”
“আচ্ছা...” ভুরু কুঁচকে কী যেন চিন্তা করতে করতে ভায়োলেট বলল, “কোনও অঙ্ক, ধাঁধা বা সেরকম কিছুই নেই ডায়েরিতে? ভালো করে দেখেছ? বা এমন কোনও বাক্য বা শব্দ যা বার বার ব্যবহার হয়েছে?”
“অঙ্ক বলতে পুরোনো আমলের কিছু হিসেব, জিনিসপত্রের দাম—এসব আছে। কিন্তু ওগুলো থেকে কোনও সংকেত খুঁজে পাইনি। দু-একটা বাক্য অবশ্য অনেকবার ব্যবহার হয়েছে, তবে তা নিতান্তই সাধারণ।”
“যেমন?” টেবিলের উপর কনুইয়ের ভর দিয়ে সামনে একটু ঝুঁকে বলল ভায়োলেট।
“যেমন ধরো, ‘গড ব্লেস মি’ বা ‘এভরিথিং উইল বি অলরাইট’। এই ধরনের সাধারণ শব্দ। কিন্তু তার মধ্যে কি কোনও সূত্র লুকিয়ে থাকতে পারে? আমি বুঝতে পারছি না। বাবা বলে গিয়েছিলেন এই বাড়িতে নাকি আমার শুভানুধ্যায়ীরা আছেন। তাঁরা সবসময় আমাকে ঘিরে থাকবেন। কিন্তু এই ব্যাপারে তাঁদের কোনও সাহায্য কখনও পাইনি আমি।”
“এভরিথিং ইজ দেয়ার, ফাইন্ড ইন দ্য ডায়েরি।” খুব নীচু আর গম্ভীর পুরুষালি গলায় কে যেন ডানদিকের আলমারিটার পিছন থেকে বলে উঠল।
“হ্যাঁ! এটাও লেখা আছে। কোনও বিশেষ ডায়েরির কথা বলা হচ্ছে কি?” বলে উঠল সাহেব। আর তারপরেই চমকে উঠে অ্যাম্বার আর ভায়োলেটের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলল, “শুনলে? তোমরা শুনলে?”
ওদের দুজনের মুখ ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। মোমবাতির ম্লান হলুদ আলো এসে পড়ছে তাদের উজ্জ্বল নাকের ডগায়।
(৯)
এই রবিবার চ্যাপেলে ভালোই ভিড় হয়েছিল। দুই বিদেশিনীর আগমনের খবর শহর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। তাই অনেক মানুষ জমা হয়েছিলেন। শহরের বড়ো গির্জার ফাদার এসেছিলেন, ডক্টর লাকড়া ও অন্যান্য বিশিষ্ট মানুষজনও এসেছিলেন। প্রথমে ঠিক হয়েছিল অ্যাম্বার আর ভায়োলেটের সম্মানার্থে একটা ভোজসভাও হবে। কিন্তু ওরা দুজনেই রাজি হয়নি। মাঝে বেশ ক’দিন কেটে গেল। ওদের হাতে একেবারে সময় নেই। দু-একদিনের মধ্যেই চলে যাবে। সময় মাপা। কাজের তালিকাও তৈরি। অন্য কিছু করতে গেলে শিডিউল ভেঙে যাবে।
কাল সারাদিন কেটেছে কুন্তীবুড়ির ঘর সারানোতে। অ্যাম্বার, ভায়োলেট আর সাহেব তো ছিলই, লালু, ঋষি, অ্যালবার্টও সকলে মিলে কাজ করেছে। প্রথমে ঘরের চারদিকে বাঁশ পুঁতে, বাতিল বস্তা দিয়ে শক্তপোক্ত কাঠামো তৈরি করে করেছে অ্যালবার্টরা। তারপর অ্যাম্বার, ভায়োলেট, নন্তু, শুকরু আর কিংশুক মিলে তাতে নিজের হাতে গোবর আর মাটির প্রলেপ দিয়েছে। তার পরে ঝোপড়ার মাথায় আর চারদিকে দেওয়া হয়েছে মোটা তেরপলের চাদর। স্কুলের হোস্টেলে ছিল বাতিল তেরপলগুলো। সব হয়ে যাবার পর দেখা গেল ঘরটা ভীষণ আরামদায়ক।
অ্যাম্বার প্রথমে গোবরের গন্ধে প্রায় বমি করে আর কি! সাহেব ওর নাকের কাছে লেবুপাতা কচলে ধরে থাকল অনেকক্ষণ। তারপরে সে কী হাসি! ছবিও উঠেছে অনেক।
শুকরু অ্যাম্বার আর ভায়োলেটকে নিজের ঘর থেকে মহুয়া ফুলের নাড়ু এনে খাইয়েছে। মহুয়া গাছ থেকে ফুল ঝরে পড়ে। তাকে শুকিয়ে গমের দানার সঙ্গে শুকনো খোলাতে নেড়ে, তারপর গুঁড়ো করে নাড়ু বানানো হয়। ঘরে কেউ এলে জলের সঙ্গে দেয় শুকরুর মা। রোদের তাত লাগে না তাহলে। দুটোই মাত্র পড়ে ছিল।
শুকরু, নন্তু আর কিংশুকের স্কুল তো কালই শুরু হয়ে যাবে। ওদের ভীষণ মনখারাপ। বাড়ির লোক আজ পর্যন্তই ছাড় দিয়েছেন।
প্ল্যান করাই ছিল। হস্টেলের ছেলেরা রাতে ছাড় পাবে না, তাই আজ দিনের বেলাতে সোনাঝুরির ধারে পিকনিক। সেজন্যই বিশেষ করে ওরা বড়োদের ভোজসভাতে রাজি হল না।
গির্জা আর স্কুলের উত্তরদিকে গোল করে ভারি চমৎকার ফুলের বাগান করেছে অ্যালবার্টরা। তার চারদিকে বট, মহুয়া, সেগুন, নিম এইসব গাছ লাগানো। তারই একটার তলায় দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল।
ফাদার ডিকস্টার টকটকে লাল গায়ের রঙ। লম্বা মানুষটির চুল-দাড়ি সব ধবধবে সাদা। তিনি সোনালি ফ্রেমের চশমাটা নাকের উপরে তুলে সাহেবকে বললেন, “রজার, তোমার লেখার কথা শুনে ভারি খুশি হলাম। তোমার এই গুণটার কথা তো জানতাম না!”
“আপাতত ওটা আমাদের ম্যাগাজিনে প্রতি মাসে বেরোবে। এডিটরের ইচ্ছা আছে পরবর্তীকালে বই হিসেবে প্রকাশ করার। আমি বর্তমানের কুদোডাঙার কিছু ফোটোগ্রাফও তুলে নিয়েছি সেই উদ্দেশ্যে। আশা করি লেখাটা পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলে দেবে একেবারে।” ভায়োলেট তাড়াতাড়ি উত্তর দিল।
রেক্টর দাসের মুখে অমলিন হাসি। সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কনগ্র্যাচুলেশনস রজার!” তারপর মুচকি হেসে ফাদার ডিকস্টার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি কিন্তু কথা দিয়েছিলেন ওকে একটু বকেও দেবেন।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাই তো!” ফাদার ডিকস্টা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মাথার চুলে একটু হাত বুলিয়ে বললেন, “রজার, সম্মাননীয় অতিথিদের সামনে বলতে আমি কুণ্ঠা বোধ করছি। তবে তোমাকে স্কুলের বাচ্চাদের দিকে একটু বাড়তি নজর দিতে হবে।” তারপর ভায়োলেটের দিকে ঘুরে বললেন, “আমি কি সম্মাননীয় অতিথিদের অনুরোধ করতে পারি, যাতে তাঁরা তাঁদের অমূল্য সময় থেকে একটু ব্যয় করে আগামীকাল স্কুলের ছেলেদের সামনে একটু উৎসাহব্যঞ্জক কথাবার্তা বলেন?”
“নিশ্চয়ই ফাদার। আমি আর অ্যাম্বার কাল সকালেই রজারের সঙ্গে স্কুলে হাজির থাকব।” ভায়োলেট বলল।
লালু এতক্ষণ সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। এবার তার হাত ধরে একটু টান দিতে সাহেব একটু ঝুঁকে নিজের কান লালুর মুখের কাছে নিয়ে যেতে সে ফিসফিস করে বলল, “স্যার, বড়ো ফাদার অনেকক্ষণ ধরে কথাবার্তা বলেন! আমরা কি আজ নদীর ধারে পিকনিক করব না?”
“ছি!” সাহেবও ফিসফিস করে বলল, “ফাদারদের সম্পর্কে অমন কথা বলতে নেই।”
“দেরি হয়ে যাচ্ছে যে!” লালু ঠোঁট ফুলিয়ে তার হতাশা ব্যক্ত করল।
বিষয়টি রেক্টর দাসের নজর এড়ায়নি। তিনি চোখ দিয়ে হেসে গম্ভীর মুখে ফাদার ডিকস্টাকে বললেন, “সম্ভবত আমাদের ছোট্ট বাচ্চারা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। ওদের এবার যেতে বলি?”
“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! ওরা তাহলে বেরিয়ে পড়ুক। সানসেটের আগেই অবশ্য ফিরে আসতে হবে। আমরা বরং ততক্ষণ সম্মাননীয় অতিথিদের সঙ্গে একটু...”
“না, না! আমরাও পিকনিকে...” বলে ফেলেই জিভ কাটল অ্যাম্বার। সেও অনেকক্ষণ থেকে ছটফট করছে।
আপনভোলা ডিকস্টার পরিস্থিতি বুঝতে একটু সময় লাগল। তারপরেই ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, “বেশ, বেশ! আমরা বরং পরেই...”
সাহেবের হাত ধরে বাইরে এসেই তিড়িং করে এক লাফ মারল লালু। অ্যাম্বার আর ভায়োলেট হেসে ফেলল।
ওসি মিশ্রাজির গাড়িতে অ্যালবার্ট আর তার দলবল কিছুক্ষণের মধ্যেই চাল, ডাল, আলু, ডিম, নতুন ওঠা ফুলকপি, বেগুন এসব তুলে ফেলল। তেল-মশলা আর জলের জ্যারিকেন ওসি সাহেব আগেই কিনে গাড়িতে তুলে দিয়েছেন। সকলে মিলে চড়ে বসতেই এই গাড়িটা আর পুলিশের আর একটা গাড়ি রওনা দিল কুদোডাঙার দিকে। সেখান থেকে গাড়িতে উঠল রুমু আর নন্তু। তারপর মাঠ পেরিয়ে যাত্রা।
চমৎকার আবহাওয়া চারদিকে। ঝকঝকে রোদ উঠেছে। খোলা প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে বেশ কিছুটা গিয়ে টিলার ফাঁক দিয়ে গাড়ি ঢোকানো হল। শতরঞ্জি পেতে দেওয়া হল ছায়া ঘেঁষে। অ্যাম্বার আর ভায়োলেটের চামড়া খুব ফর্সা। একটুতেই সানবার্ন হয়ে যায় ওদের।
শতরঞ্জির উপরে পা ছড়িয়ে বসা হল। তার পরে যে কনস্টেবলবাবু এখন সাহেবদের নিত্যদিনের সঙ্গী, সেই কল্যাণ মণ্ডল আর রুমু মিলে সকলকে টিফিনের প্যাকেট বিলি করলেন। সঙ্গে একটা করে জলের বোতল। হালকা টিফিন—কেক, কলা আর মিষ্টি। সকালে অবশ্য সাহেবরা খেয়েই বেরিয়েছিল। তবে আর একবার খেতে কারও আপত্তি হল না।
ওসি সাহেব চলে গেলেন। এবার ফিরবেন বেলা তিনটের পর। কল্যাণবাবু অবশ্য রয়ে গেলেন। আর ওসি সাহেব চলে যেতেই বাচ্চারা নিজের মূর্তি ধরল। কেউ পাথরের উপরে চড়ে বসল। কেউ ছোটাছুটি করতে লাগল, কেউ-বা জলে ঝাঁপ দিল। এখন অবশ্য সোনাঝুরিতে জল বুক পর্যন্ত।
স্কুল খোলার আগে শেষ ছুটি আজ।
সবজি কাটা হল। ডিম আর আলু সেদ্ধ হয়ে নেমে গেছে। গ্যাস স্টোভে ভাত চেপে যেতেই অ্যাম্বার, ভায়োলেট আর রুমু নদীর ধারে ধারে হাঁটতে শুরু করল। সাহেব তার হাতঘড়িতে দেখল পৌনে বারোটা বাজছে।
সোনাঝুরির পাশে পাশে ঘাসে মোড়া সবুজ জমি এঁকে-বেঁকে চলে গেছে বহুদূর। পাশে কালো রঙের টিলাটা উঁচু-নীচু হয়ে চলেছে। রুমু ধরে আছে অ্যাম্বারের হাত। ওদের পিছনে হাঁটছে ভায়োলেট আর সাহেব।
রুমু পিছন ঘুরে সাহেবকে বলল, “তুই এবার নিজের দেশে চলে যাবি সাহেব? শুনলাম যেন কার মুখে!”
সাহেব মাথা তুলল। হেসে বলল, “কোথায় যাব?”
“তোর দেশে?”
“এটাই তো আমার দেশ।”
“তুই তাহলে চলে যাবি না তো অন্য কোথাও?”
“তোদের ফেলে কোথায় যাব রুমা!”
রুমুর চোখ ছলছল করছিল। অ্যাম্বারের হাত ছেড়ে দু-পা পিছিয়ে এল সে।—“সেদিন থেকে কেবল ভাবছি, তোর বোন এসেছে, এবার তুই হয়তো চলে যাবি ওদের সঙ্গে। অনেক দূরে।”
সাহেব ম্লান হেসে বলল, “যদি চলে যাই! তোর মনখারাপ করবে রুমা?”
রুমু আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা ঢোঁক গিলল। তারপর মাথা নামিয়ে সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী জানি! আমার হয়তো আর ক’মাস পরেই বিয়ে হয়ে যাবে। তারপর আবার যখন এখানে আসব, তখন এই গাছ, নদী আর পাহাড়ের মাঝে তোকে না দেখলে বড্ড মিস করব রে! মনে হবে কী যেন একটা ফাঁকা হয়ে গেল।”
দুজনেই বড়ো করে শ্বাস ফেলে মাথা নীচু করল। হাঁটতে লাগল সামনের দিকে। ভায়োলেট নীচু গলায় সাহেবকে জিজ্ঞাসা করল, “হোয়াট ডিড শি সে?”
“ও জিজ্ঞাসা করছে আমি তোমাদের সঙ্গে চলে যাব কি না।”
“তুমি কী বললে?”
“আমি বললাম, আমি ওদের ছেড়ে কোথাও যাব না।”
ভায়োলেট চুপ করে হাঁটল একটু। তারপর বলল, “যখন প্রথম তোমার লেখা পড়ি, তখনই ভালোবেসে ফেলি এই জায়গাটাকে। না দেখেই। তারপর তোমার দেওয়া তথ্য থেকে নেটে সার্চ করে তোমার আংকলের খোঁজ শুরু করি। এক লাইব্রেরিয়ানের সাহায্যে ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হল। অ্যাম্বারের সঙ্গে আলাপ হল। আমরা ঠিক করলাম এখানে এসে নিজের চোখে সব দেখব।”
“এখানে তোমাদের কেমন লাগছে ভায়োলেট?”
“ভারি সুন্দর। অদ্ভুত একটা মায়া আছে এখানে। তোমার বাড়িটা, এই পাহাড়, ছোট্ট নদী, ছোট্ট চার্চ, এই প্রাণবন্ত ছেলেরা। আর ওই ওল্ড লেডি। কী যেন তাঁর নাম?”
“কুন্তী। আমার কুন্তীদিদা।”
“হুঁ। সব ভালো লাগল রজার। তারপর ওই ঝিলটা। তোমার চিনিয়ে দেওয়া গাছ আর ভেষজ। তোমাকেও রজার। প্রচণ্ড কোলাহলের এক নগরী থেকে এখানে এসে দেখি সব মায়াময়। পৃথিবী যেন স্থির হয়ে আছে এখানে।”
“আবার আসবে তো?”
“বার বার আসব। এর পরের বার যখন আসব, তখন তোমার সঙ্গে সারা ভারতটা ঘুরে দেখব। তুমি দেখাবে তো?”
“আমার সৌভাগ্য।”
“এখানে বসব রজার?” সামনে থেকে চেঁচিয়ে বলল অ্যাম্বার।
কখন যেন জমিটা নদী থেকে অনেকটা উপরে উঠে গেছে। ঘাস নেই। কালো পাথরের গা ঘেঁষে নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। বহুদূরে দেখা যাচ্ছে বাচ্চারা হুটোপাটি করছে। লালু চেপেছে বুক সমান জলে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যালবার্টের কাঁধে। একটু আগে একটা বাঁকে আড়াল হয়ে গিয়েছিল ওরা। আবার দেখা যাচ্ছে। পাথরে উপরে পা ঝুলিয়ে বসল ওরা।
“অ্যাম্বার কী একটা গুপ্তধনের কথা বলছিল। কী রে?” ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল রুমু।
“জানি না। সেটা যে কী সেটাই তো খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি।” সাহেব জবাব দিল।
“আগে তো কখনও বলিসনি আমায়!” রুমুর গলায় অভিমান।
“আরে এসব মিথ। লোকে বলে। সত্যি কি না তাই জানি না।” বিব্রত বোধ করছিল সাহেব।
“পেলে আমাকে দেখাস। ভয় নেই, ভাগ চাইব না।” ঠোঁট ফুলিয়ে বলল রুমু।
সাহেব ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকাল অ্যাম্বারের দিকে। তার অবশ্য এদিকে খেয়ালই নেই। একমনে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করল, “ওই লোকটা কে রজার? জলে ডুবছে আর উঠছে?”
“তপনকাকু।”
“তিনি কে? ওরকম করছেন কেন? এটা কি এখানের কোনও প্রথা?”
সাহেব ঘাড় নাড়ল। আস্তে আস্তে বলল, “নাহ্, কোনও প্রথা নয়। জলে ডুবে ডুবে উনি জীবনের টুকরো খুঁজে বেড়াচ্ছেন।”
“কীসের টুকরো?” অবাক হয় ভায়োলেট।
“ওঁর জীবনে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। তারপর থেকে ইনি জলের মধ্যে ওঁর সুখের দিনের চিহ্ন খোঁজেন। পুরোনো বাড়ির একটা ইট বা অন্য কিছু। যদি পাওয়া যায়!”
(১০)
সময় খুব দ্রুতগামী। সে থামতে জানে না। জলের মতো বয়ে যায়। তাই মানুষ বড়ো তাড়াতাড়ি সব ভুলেও যায়। দুই বিদেশিনী মেয়ে এসে কুদোডাঙার নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুদিনের জন্য আলোড়ন তুলেছিল। যেদিন চলে গেল, রুমু আর কিংশুক খুব কেঁদেছিল। শুকরু কাঁদেনি। তবে ওর মুখটা গোমড়া হয়ে ছিল কয়েকদিন। ভাগ্যিস কিছুদিনের মধ্যে কালীপূজা চলে এল। তাই ওদের দুজনের স্মৃতি হালকা হয়ে গেল তাড়াতাড়ি।
আরও কতদিন কেটে গেল। গ্রীষ্মকাল চলে এল। কত কী বদলে গেল কুদোডাঙার। রুমুমাসি বিয়ে হয়ে চলে গেল। আর কুদোডাঙার একটু দূরে তৈরি হচ্ছে নতুন হাইওয়ে। ফাঁকা জায়গাটা আগে গাছ আর আগাছায় ঘেরা ছিল। মাঝে মাঝে সবুজ আর খয়েরি রঙের উদাস জমি। এখন দেখলে আগে কীরকম ছিল মনেই পড়ে না। কিংশুকও লম্বা হয়েছে খানিকটা। গালগুলো আগের মতো আর অত ফুলো ফুলো নেই। গলার স্বর ভাঙছে ওর।
এই ক’মাসেই কত কী ভুলে গেছে সবাই!
ওদেরও নতুন ক্লাস হল।
নতুন বই পাওয়ার পর ক’দিন খুব ভালো লাগে। তারপর বার বার পড়তে হয় বলে খারাপ লাগতে শুরু করে। আরও খারাপ লাগে শুকরুদের জন্য। ওরা যে বড্ড গরিব। শুকরু হয়তো বেশিদিন স্কুলে পড়বে না। একদিন নিজেই কিংশুককে বলছিল। তাই কিংশুকের খুব মনখারাপ।
ওর বাবা মোটেও পছন্দ করেন না কিংশুক সারাদিন খেলে বেড়াক। বড়ো হচ্ছে ও। পড়াতে আরও মনোযোগ দিতে হবে।
কিন্তু শুকরুর সুন্দর চকচকে কালো মুখটি দেখলে কেন কে জানে পারিজাতবাবুর মুখে হাসি ফোটে। ঠাকুমারও তাই। এখন আর বেশি নড়াচড়া করতে পারেন না। কিন্তু শুয়ে শুয়ে যদি শুকরুর গলা শুনতে পান, তবে ঘষা ঘষা গলায় ডাকেন, “অ কেষ্টঠাকুর! গুড়-বাদাম খাবে?”
গুড়কে গলিয়ে, তার উপরে বাদাম ফেলে ঠান্ডা করে, চৌকো করে কেটে গুড়-বাদাম তৈরি হয়। এখন আর ঠাকুমা পারেন না। তাঁর শরীর খারাপ হয়ে গেছে। তাই মা বানিয়ে দেন। ঠাকুমা কামড়ে খেতেও পারেন না। গুড়টুকু চুষে বাদামগুলো থু থু করে ফেলে দেন। মা অসুস্থ ঠাকুমাকে দেখে আড়ালে চোখ মোছেন।
সেই একবার পিকনিক হয়েছিল সোনাঝুরির ধারে। বছর দুয়েক আগেই তো। কিন্তু মনে হয় যেন কতদিন আগে। পিকনিক শেষ হলে খেপুকাকা একটা মস্ত টিফিন ক্যারিয়ারে বাড়তি ভাত, ফুলকপির তরকারি, বেগুনভাজা আর ডিমের খালি ঝোলটুকু ভরে শুকরুকে দিলেন। শুকরুর মুখটা চকচক করছিল হাসিতে।
শুকরু বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কী সুন্দর লাটাই বানায়। বাতিদান বানায়। ভিতরে মোমবাতি দিতে হয়। এঁটেল মাটি দিয়ে চমৎকার পুতুল। কিংশুক সে-সব কিচ্ছু পারে না।
কিন্তু তবু সবটুকু ভগবান শুকরুকে দেননি। ফাঁক রেখে দিয়েছেন। ওর বাবা অসুস্থ। মা লোকের বাড়ি কাজ করেন আর সামনের ছোট্ট জমিতে ফসল ফলাবার চেষ্টা করেন। তবু স্কুলের টিফিনবেলায় যখন কিংশুক আর শুকরু পাশাপাশি বসে ভাত আর সয়াবিনের তরকারি খায়, শুকরুর মুখ চকচক করে হাসিতে। কিংশুকের মা বলেছেন টিফিন না নিয়ে যেতে। শুকরুর পাশে বসে মিড-ডে মিল খেতে। নইলে ও লজ্জা পাবে।
খেপুকাকাও কত বদলে গেল।
এখন এখানে চড়া রোদ। কে বলবে কয়েক মাস আগেই কী সাংঘাতিক ঠান্ডা পড়েছিল! সেই ঠান্ডায় খেপুকাকার দেওয়া নতুন কম্বলের ওম নিতে নিতে এক রাতে মরে গেল কুন্তীদিদা। সকালে খবর শুনে ছুটতে ছুটতে গিয়েছিল কিংশুক। গিয়ে দেখে বাঁশের একটা দোলায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে কুন্তীদিদা। আর তার পায়ের কাছে চুপটি করে বসে খেপুকাকা।
খেপুকাকাই মুখাগ্নি করেছিল। কে যেন বলছিল, “ও তো সাহেব! ও কেন মুখাগ্নি করবে?”
গোপাল-স্যার তখন সামনে দাঁড়িয়ে সুপুরি চুষছিলেন। খ্যাঁক করে উঠলেন। বললেন, “সাহেব আবার কী রে! ও কি তোর থেকে কম বাঙালি নাকি? তোর থেকে অনেক ভালো বাংলা জানে। আর তাছাড়া এতদিন বুড়িকে আগলে রেখেছিল কে? জানিস না তবু সব বিষয়ে কথা বলা চাই!”
আর কেউ কিছু বলেনি। খেপুকাকা মুখাগ্নি করল। ওই দুর্ধর্ষ শীতে খালি গায়ে ধুতি পরে থাকল। দশদিনের দিন গোঁফ-দাড়ি কাটল। মাথা ন্যাড়া করল। তারপর থেকে একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল। রোজ নিয়ম করে মিশনারি স্কুলে পড়াতে যায়। সেখানে এখন ছাত্র আরও বেড়েছে। মাঝে মাঝে কিংশুককেও তাদের ঘরে পড়াতে আসে।
খেপুকাকা অবশ্য এখন বিখ্যাত লোক। কী যেন একটা লিখেছিল কোথায়। বিদেশের কোনও পত্রিকায়। তারপর কী পুরস্কার-টুরস্কার পেয়েছে। কলকাতা থেকে গাড়ি করে নিউজ চ্যানেলের লোক এসেছিল। টিভিতে দেখিয়েছে। খবরের কাগজেও নাম বেরিয়েছে।
আজ অবশ্য একটা বিশেষ দিন। ভীষণ মজা হবে আজ।
খেপুকাকার ঘরে একটা পুরোনো গাড়ি ছিল। কিংশুকেরা দেখেছে। নাকি একশো বছরেরও বেশি পুরোনো। চলত না। সেই গাড়িটা খেপুকাকা সারিয়েছে। কিংশুক, নন্তু আর শুকরুকে ডেকেছে চাপার জন্য। সকাল ন’টায়।
আজ রবিবার। এমনিতে চিন্তার কিছু নেই। তবে বাবা বার বার করে বলে দিলেন “খবরদার, বড়ো রাস্তার দিকে যাবে না! দূরে যাবার কোনও প্রয়োজন নেই। ওই গাড়ি কিছুতেই চলবে না। চললেও একটু পরেই বন্ধ হয়ে যাবে। তখন হেঁটে ফিরতে হবে। আর বারোটার মধ্যে ঘরে ফিরে আসা চাই-ই।”
খে… ইয়ে, সাহেবকাকা বাইরে দাঁড়িয়ে তাদেরই অপেক্ষায় ছিল। পাশে গাড়িটা। ওরা তিনজন যখন পৌঁছল, তখন সে একটা পরিষ্কার সাদা কাপড় দিয়ে গাড়িটা মুছছে। পুরোনো রঙচটা গাড়িটার কোন মন্ত্রে যেন ভোলবদল ঘটেছে। ঝকঝক করছে একেবারে। সাহেব সেটা সেরেছে। ইঞ্জিনও সারিয়েছে। নতুন চাকা। গ্যাসোলিনে চলা গাড়ি এটা। সেও অবশ্য পেট্রলই। তবে এখানের তেলে চলার জন্য কিছু বদল করতে হয়েছে।
অদ্ভুত দেখতে গাড়িটা। রিকশা, ফিটন আর গাড়ির মাঝামাঝি। চারটে চাকা। সামনে আর পিছনে আরামদায়ক সিট। উপরে অবশ্য ছাউনি নেই। সামনেটাতে এখনও ঝকঝক করছে ‘ওল্ডসমোবাইল’-এর লোগো।
সাহেব ওদের দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, “আয়। তোদের অপেক্ষাতেই ছিলাম।”
পিছনের সিটের মাঝে বসল কিংশুক। দু-দিকে নন্তু আর শুকরু। খুব হাসি হাসি মুখ। শুকরুর তো এত হাসি পেয়েছে যে লুকোতে পারছে না। আর ওর হাসি দেখে ওদের দুজনেরও পেট থেকে গুড়গুড়িয়ে বেরিয়ে আসছে হাসি। সাহেব ধমকে বলল, “খবরদার! দামি গাড়িতে চেপেছিস। ভদ্রলোকের মতো আচরণ করবি। নইলে খাবি গাঁট্টা।”
এই বলে সামনের সিটের কাছে বড়ো একটা বেতের ঝুড়ি রাখল। খাবার-দাবার আছে নিশ্চয়ই। দারুণ গন্ধ বেরোচ্ছে।
খেপুকাকা সেজেছে খুব আজ। ধবধবে সাদা প্যান্ট, কালো শার্ট আর উপরে এই গরমকালেও পোস্ত রঙের ব্লেজার। দু-দিকে উঁচু হয়ে থাকা লাইটের গায়ে মস্ত একটা গাঁদা ফুলের মালা টাঙাল। তারপর গম্ভীর মুখে ড্রাইভারের সিটে বসে পড়ল।
চাবি দিতে ‘সুঁইইই’ করে অদ্ভুত একটা আওয়াজ বেরোল। তারপরই অবাক কাণ্ড! গাড়িটা স্টার্ট নিল। কেঁপে উঠল তার শরীর। পিছন থেকে ‘ইয়ে-এ’ করে চিৎকার করে উঠল তিনজন। সাহেবের মুখেও হাসি তখন।
গাড়ি অত্যন্ত ধীর গতিতে চলতে শুরু করল। এখনও সেরকম বেলা হয়নি বলে রোদ চড়া নয়।
গ্রামের ভিতরে যখন গাড়িটা ঢুকল সব লোক বাইরে বেরিয়ে এল। সরু রাস্তার দু-দিকে ভিড়। শুকরুরা গাড়ির উপর থেকে হাত নাড়ছে। দারুণ মজা।
কিংশুকের বাবা ভিড়ের মধ্য থেকেই চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, “সাবধানে চালিও।”
গাড়ির ভিতর থেকেই ঘাড় নাড়ল সাহেব।
গুড়গুড় করে গ্রাম ছাড়িয়ে গাড়ি এগিয়ে গেল। গ্রামের একেবারে শেষে দু-দিকে ক্ষেত, তার মাঝের উঁচু-নীচু রাস্তা ধরে।
নন্তু একবার জিভের ঝোল টেনে জিজ্ঞাসা করল, “কী কী খাবার আছে সাহেবকাকা? খুব খিদে পেয়েছে।”
ঘাড় না ঘুরিয়েই সাহেব বলল, “পেটুক কোথাকার! এখন খেতে অনেক দেরি।”
“কী আছে বলো না!”
“মিষ্টি আছে। কলা। ডিমসেদ্ধ, মাটন চাপ, স্যালাড। ফ্লাস্কে আছে গরম কফি।”
“দারুণ! দারুণ!”
সূর্যদেব মাথার উপরে চড়ছেন এবার। গরম বাড়ছে। আর সরু রাস্তা শেষ করে ওরা পৌঁছে গেল নতুন হাইওয়েটার কাছে। কিংশুক বলে উঠল, “কাকা, বাবা তোমাকে বড়ো রাস্তাতে চাপতে বারণ করেছে। তুমি চালাতে জানো না।”
“চুপ কর।”
“অবশ্য যা স্পিডে গাড়ি চলছে তাতে বিপদের কোনও আশঙ্কাই নেই।” নন্তু বলল।
“ফের! বলছি না চুপ কর!” সাহেব গর্জে উঠল।
হাইওয়েটা এখনও সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। মাঝে মাঝে রাস্তা নেই। এখান ওখানে ছাই দিয়ে ভরাট করা। মাঝে মাঝে চকচকে পিচ। এখনও এই রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলছে না বিশেষ। সাহেব বাঁদিকটা ধরে অতি সাবধানে চালাতে থাকল।
দু-পাশে জনবসতি নেই এখনও। ওই দূরে খেজুর গাছ একলা দাঁড়িয়ে। ঝোপগুলো শুকিয়ে হলদে হয়ে আছে। তার পিছনে কালচে হয়ে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো সব গাছ। মাঝে মাঝে চাষ না হওয়া ক্ষেত। এবার নিশ্চয়ই আস্তে আস্তে দু-পাশে ঘরবাড়ি গড়ে উঠবে। দোকান, রেস্তোরাঁ। তখন এই মায়াময় জায়গাগুলো আর থাকবে না। বড়ো করে শ্বাস ফেলল কিংশুক।
“আমরা কতদূর যাব সাহেবকাকা?” নন্তু জিজ্ঞাসা করল।
“সামনের জোড়া আম-বট গাছ থেকে ঘুরে আসব।”
সে এক আশ্চর্য গাছ। কোনও বটগাছের উপরে কে যেন আমের আঁটি ফেলেছিল। বটগাছটাকে জড়িয়েই বড়ো হয়ে উঠল একটা আমগাছ। এখন আর তাদের আলাদা করে চেনা যায় না।
সাহেব পাশের উদাস জমিতে চোখ বোলাল একবার। তারপর বলল, “ওই জোড় গাছের মতো জোড় শব্দও আছে, জানিস? দুটোর মানে আলাদা। আবার দুটো মিলে একেবারে আলাদা একটা শব্দ।”
“জানি, জানি!” হাততালি দিয়ে উঠল শুকরু।—“তুমি বলে দিয়েছিলে। বেডরুম। আউটপুট।”
“গুড! প্যালিনড্রোম জানিস?”
“জানি। দু-দিক থেকে একই। এটাও তুমি বলে দিয়েছিলে। যেমন ‘রমাকান্ত কামার’। ইংরেজিতেও আছে—Was it a cat I saw! তুমি অ্যানাগ্রামও শিখিয়ে দিয়েছিলে। একই শব্দের অক্ষরগুলো দিয়ে আলাদা আলাদা শব্দ। যেমন D–A–I–R–Y দিয়ে Diary হয়। আবার Dairy-ও হয়!”
“ভেরি গুড! তুই একটা মাটন চাপ বেশি পাবি কিংশুক। মোট ন’টা আছে। আরে...”
গাড়িটা রাস্তার একধারে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল সাহেব। পিছনে এসে কিংশুককে কোলে তুলে নাচতে শুরু করে দিল। মুখে হাসি কিন্তু দু-চোখে জল। ওরা তো অবাক।
চোখ ছলছল করছে সাহেবের। ধরা গলায় কিংশুককে বলল, “তুই জানিস না কিংশুক, কী উপকারটাই না করলি!”
হঠাৎ সাহেবের কী হল কে জানে। সাহেব আর জোড়া গাছটা অবধি গেল না। ওরা আগে সাইকেল চালিয়ে ওখান অবধি গেছে। কিন্তু আজ আর যাওয়া হল না। সাহেব গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। সারা রাস্তা আর একটা কথাও বলল না। খাবারের ঝুড়িটা ওদের দিয়ে বলল, “নিয়ে চলে যা। ঘরে খেয়ে নিস। ভাগ করে খাস।”
মিনিট চল্লিশের মধ্যেই ঘরে ফিরে এল সাহেব। হতভম্ব কিংশুকরা চলে গেছে। গাড়িটা কোনোরকমে গ্যারাজে রাখল সাহেব। তারপর দৌড়ে এসে মোবাইল থেকে ছোট্ট একটা মেল করল অ্যাম্বারকে।—‘হ্যালো অ্যাম্বার! টেল মি ইফ বাই এনি চান্স উই হ্যাভ আ স্কটিশ ওরিজিন!’
মিনিট পনেরো পরে টুং করে একটা নোটিফিকেশন এল সাহেবের মোবাইলে—‘ওয়েট। লেট মি আস্ক মাই ড্যাড।’
(১১)
‘Find in the diary.’
এটাই লেখা ছিল ডায়েরিগুলোতে। সাহেব প্রথমে ভেবেছিল কোনও বিশেষ ডায়েরির কথা বলা হচ্ছে। প্রত্যেকটা ভালো করে উলটেপালটে দেখেছিল। মলাটগুলো পর্যন্ত ভালো করে খুঁজেছিল।
কী আশ্চর্য, মার্কের স্ত্রীর নামও ছিল অ্যানা! স্বাভাবিকভাবেই অ্যানাগ্রামের ব্যাপারটা তাঁর মাথাতে আসা আশ্চর্যের কিছু নয়।
D–I–A–R–Y হল ডায়েরি। D–A–I–R–Y হল ডেয়ারি। Y–A–I–R–D হল ইয়ার্ড। মানে এক গজও হয়। আবার উঠোনও হয়। এ অবশ্য স্কটিশ বানান। পরবর্তীতে তা বদলে যায় YARD-এ।
সাহেবের বাড়িটা একটেরেতে। গ্রামের বাইরে ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে। তবু মাঝে-মধ্যে লোকজন আসা-যাওয়া করে। তাই দিনের আলোটুকু নিভে আসার অপেক্ষা করল সাহেব।
এখন বেলা ঢলতে অনেক সময় লাগে। আলো থাকে বহুক্ষণ। অস্থির সাহেব বেশ কয়েকবার পিছনের বাগানে ঘুরে এল। দুপুরে মাছের ঝোল আর ভাত খেয়ে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করেছিল। ঘুম আসেনি। মাথাটা ধরে আছে। মনের ভিতরে চাপা উত্তেজনা। আর একটা ব্যাপার হল এখানে শীতকালে যেমন ঠান্ডা, গ্রীষ্মে দিনের বেলা তেমনই গরম। যদিও তার বাড়িটার দেওয়াল খুব পুরু। সিলিংও অনেক উঁচুতে। গাছপালাও আছে। তাই গরম একটু কম। তবু সেই উত্তেজনার বশেই তার আর ঘুম এল না।
আকাশে হলুদ-লাল-কমলা-গোলাপি আর ডিমের কুসুমের মতো নীলচে রঙের আবির ছড়িয়ে সূর্যদেব শেষ পর্যন্ত অস্ত গেলেন। সাহেব একটা টর্চ, কোদাল, শাবল আর কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে পিছনের বাগানে বেরিয়ে এল।
এখন বাউন্ডারি জায়গায় জায়গায় ভাঙা। ফাঁক দিয়ে বাইরের গাছপালা আর ঝিলটা দেখা যায়। আগাছার জঙ্গল আর ঝোপঝাড় ছড়িয়ে আছে ঝিলের পাড়ের কাদা পর্যন্ত। তারপর ধুতরো আর জলজ আগাছার জঙ্গল।
মাঝে একটুকু একটা জায়গায় বসার জন্য কাঠের একটা বেঞ্চ ছিল এককালে। ভেঙে গেছে। দুটো মার্বেলের পরির কোমর অবধি মূর্তি। ভেঙে কাত হয়ে আছে। একটার মুণ্ডু নেই।
আর আছে চৌকো একটা পাথর দিয়ে বাঁধানো জায়গা। বিসদৃশ হলেও এতকাল কোনও সন্দেহ হয়নি কারও। সাহেবের ছোটোবেলায় ওখানে পাথরেরই প্রচণ্ড ভারী টব থাকত। নড়ানো যেত না। টবে ছিল ফুলের গাছ। সে-সবও আর নেই।
জায়গাটার কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল সাহেব। বুকটা কাঁপছে। আর বেশি কিছু স্পষ্ট করে বলা নেই বটে, তবে সে নিশ্চিত, এখানেই লুকিয়ে থাকবে কিছু একটা। গোটা উঠোনটা নিশ্চয়ই খুঁড়তে হবে না।
বাঁধানো জায়গাটায় প্রচুর ধুলো জমে আছে। হাত বোলাল সাহেব। টর্চ মেরে দেখল। তারপর উঠে এক বালতি জল নিয়ে এসে জায়গাটা ধুলো ভালো করে। ছোট্ট, সরু একটা ফুটো সেখানে। খালি চোখে ভালো করে নজর না করলে দেখাই যায় না।
এত ছোটো ফুটোতে ঢোকানোর উপযুক্ত চাবি কি আছে ঘরে? হ্যাঁ, আছে। ওদের বাইরের ঘরে একটা গ্র্যান্ডফাদার ক্লক ছিল আগে। প্রতি সপ্তাহে দম দিতে হত। এখন খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু সেই চাবিটার সাথে একই আংটায় আর একটা সরু লম্বা চাবি ঝুলত। ওটা কীসের চাবি কেউ জানত না এতদিন। নিয়ে এল সাহেব।
সরু ফুটোটার মধ্য দিয়ে দিব্যি গলে গেল চাবিটা। ডানদিকে একটু চাপ দিতেই ঘুরে গেল। খুট করে একটা আওয়াজ হল একবার। তারপর পাথরের গোল ভারী ঢাকনাটা ঘুরে গেল একটু। দম বন্ধ করে কোনোমতে ওটা সরিয়ে দিল সাহেব।
ভিতরে ফুট খানেক ব্যাসের একটা গর্ত। গভীরতা দুই ফুটের মতো। আর তার মাঝখানে শুয়ে আছে পিতলের একটা ছোট্ট বাক্স!
বাক্সটাকে বাইরে বার করে আনল সাহেব। ঢাকনাটা আবার বন্ধ করল। তারপর জিনিসপত্র সমেত ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। লাইট জ্বালাল ।
বাক্সটাতেও তালা দেওয়া আছে। কিন্তু তার চাবি কোথায় জানা নেই। তাই একটা ভারী স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে চাড় মেরে ঢাকনাটা ভেঙে ফেলতে হল। ভিতরে কাপড়ে জড়ানো কোনও বস্তু। কাপড় পচে গেছে এতদিনে। হাতে নিয়েই সাহেব বুঝতে পারল এই ছোট্ট বাক্সটা এত ভারী লাগছিল এই জিনিসটার জন্যই।
কাপড়টা ছিঁড়ে ফেলতেই...
ইঞ্চি ছয়েকের একটা অদ্ভুতদর্শন মূর্তি ঝলমল করে উঠেছে। দেবী মূর্তি। কিন্তু কার মূর্তি জানা নেই। দেবীর চারটি হাত। চোখ তিনটি এবং সেগুলি মুখের তুলনায় যথেষ্ট বড়ো। চোখে স্পষ্ট ক্রোধের আভাস। চার হাতে অস্ত্র আর কোমরের কাছে অসংখ্য ছোটো ছোটো কুৎসিত দেখতে জীব উপরের দিকে মুখ করে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের। তারও নীচে অজানা লিপিতে কিছু লেখা খোদাই করা আছে।
আগাগোড়া সোনার তৈরি মূর্তিটি। দেখেই বোঝা যায় অনেকদিন আগের তৈরি। চোখ তিনটিতে নীল রঙের পাথর বসানো আছে। এত পুরোনো মূর্তি নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ ঢালাই করে তৈরি নয়! তাহলে যে এই ছোট্ট মূর্তিটিতে এত কারুকাজ করেছে সে কোন শিল্পী?
এটা কি নিজের কাছে রেখে দেবে সাহেব? লন্ডনে পাঠিয়ে দেবে? নাকি খুঁজবে তাকে, যে এটা আবিষ্কার করেছে?
নাহ্। সাহেব ভারতীয়। আর এ-দেশের আইন অনুযায়ী মূর্তিটি সরকারের সম্পত্তি। তাদের হাতেই এটা তুলে দেবে সাহেব। হয়তো কলকাতা জাদুঘরে ঠাঁই হবে এটির। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই মূর্তিটি পরীক্ষা করে হয়তো ভারতবর্ষের ইতিহাস নতুন করে লিখবেন।
বড়ো করে একটা শ্বাস ফেলল সাহেব। তার লোভ একটা ছিল। নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু তা গুপ্তধনের লোভ নয়। রহস্যভেদের লোভ। অজানাকে জানার লোভ।
দুটো রহস্য অবশ্য ভেদ হল না এখনও। কে এটা প্রথম খুঁজে পেয়েছিল, আর কালো বাঘের ব্যাপারটাই-বা কী!
(১২)
যখন পেটে খিদে থাকে তখনই খালি খালি যত খাবারের গন্ধ নাক দিয়ে ঢোকে। আর চোখের সামনে ভাসে ডিমসেদ্ধর ছবি।
সকালবেলায় শুকরু যখন বাইরে মহুয়া গাছটার নীচে বসল, কোথা থেকে একটা পুরোনো বইয়ের ছেঁড়া পাতা উড়ে ওর পায়ের কাছে এসে পড়ল। তুলে দেখে তাতে ডাল, ভাত, তরকারির ছবি দেওয়া। কোনও মানে হয়! কাগজটা একটু নেড়েচেড়ে ফেলে দিল শুকরু।
তাতেই কি রক্ষে আছে? একটু পরেই সুবলালদের ঘর থেকে ভেসে এল মাছ ভাজার গন্ধ। ঢোঁক গিলল শুকরু। আহা, ডিমসেদ্ধর কথাও মনে পড়ে গেল। তাজা তাজা ডিমসেদ্ধর খোলাটা যখন ছাড়ানো হয়, দারুণ একটা গন্ধ বেরোয়। দু-সপ্তাহ আগেই তো স্কুলে খেয়েছিল শুকরু। এখন গরমের ছুটি।
উঠে পড়ল ও। ঘরের এককোণে রাখা কলশিটা থেকে জল খেয়ে নিল কিছুটা। জল খেতেও ভালো লাগে না আজকাল। কলশিটা অনেক পুরোনো। জলটা গরম হয়ে থাকে। তা খেয়ে তেষ্টা মেটে না।
ভিতরে উঁকি দিল ও। বাবা সেখানে মেঝের উপরে পাতা ছেঁড়া শতরঞ্জিটার উপরে শুয়ে। পায়ে প্লাস্টার। গাল-ভরতি কাঁচা-পাকা দাড়ি। দু-চোখ ছলছল করছে। ওর দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকাল বাবা।
“শুকরু!”
“বলো বাবা।” দরজার কাছ থেকেই সাড়া দিল শুকরু।
“ভিতরে আয়। আমার কাছে বোস একটু।”
পায়ে পায়ে ভিতরে এল শুকরু। বাবার পাশে হাঁটু মুড়ে বসল।
“খুব খিদে পেয়েছে না রে, শুকরু?” নরম গলায় বলল বাবা।
“কই না তো!” ঢোঁক গিলল শুকরু। ফাঁকা পেট থেকে গুড়গুড় করে আওয়াজ এল একটা। খুব জোরে। বাবাও বোধ হয় শুনতে পেল। তার ডান চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
“কাঁদছ বাবা?” শুকরুর গলাটা কেঁপে গেল।
“না রে। কাঁদিনি। তবে আমি সারাদিন বিছানায় পড়ে আছি, তুই আর তোর মা খালি পেটে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। খুব কষ্ট হয় আমার।”
“সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা। সব ঠিক হয়ে যাবে।” বাবার মাথায় নিজের ছোট্ট হাতটা বোলাতে বোলাতে বলল শুকরু। ও বড়ো হয়ে যাচ্ছে। আরও তাড়াতাড়ি বড়ো হতে হবে ওকে।
“তোর ইস্কুল যাওয়াটাও বোধ হয় বন্ধ হয়ে গেল।” খুব নীচু সুরে বলল বাবা। হয়তো নিজেকেই শোনানোর জন্য।
শুকরুর বাবা শহরে বড়ো বড়ো ঘর বাড়ি তৈরি হয় যেখানে, সেখানে কাজ করত। উঁচু বাঁশের মাচা থেকে পড়ে হাত-পা ভেঙে গেছে। কিংশুকের বাবা আরও লোকজন নিয়ে এসে হাসপাতালে ভরতি করে দিয়েছিলেন। এখন বাড়ি ফিরে এসেছে বটে, কিন্তু অনেকদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। তাও পুরোপুরি সারবে কি না কে জানে। খুব ব্যথা ওঠে মাঝে মাঝে। বাবা যন্ত্রণায় কাতরায় তখন।
আবার বাইরে বেরিয়ে আসতেই গরম একটা হাওয়ার দমকা এসে লাগল ওর মুখে। আবার জলতেষ্টা পেল। খালি পেটে থাকলেই কেবল জলতেষ্টা পায়।
মা গেছে নতুনগঞ্জে। এতদিন মা লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করত। সামনের ছোট্ট জমিতে সবজি লাগাত। বাবা থাকত বাইরে। এই গ্রীষ্মকালের কড়া রোদে ওই জমিতে আর কী চাষ হবে? তাছাড়া ওই সামান্য টাকাতে হবেও না। বাবার জন্য অনেক টাকার ওষুধ লাগে। গ্রামের লোকজন সাহায্য করে। তবে তাতে পুরোপুরি হয় না।
মাও খালি পেটেই কাজের খোঁজে গেছে। কাল সেই সন্ধেবেলায় কয়েকটা শুকনো কচু আর এতটুকু চাল জলে ফুটিয়ে নেওয়া হয়েছিল। মা খায়নি। ফ্যান সমেত ওরা দুজনে খেয়েছিল। তারপর আর কিছু জোটেনি। আর মায়ের আসতে আসতে বিকেল হয়ে যাবে।
হাঁটতে লাগল শুকরু। অনেক দূরে পাথুরে এলাকা। রাস্তার দু-পাশে ঝোপ-জঙ্গল। সেদিকে খর নজর রেখে চলল সে।
সাহেবকাকা বলেছে, কখনও হতাশ হতে নেই। তিনি সব সমস্যার সমাধান করে রেখেছেন। কখনও তাঁর নাম ভগবান, কখনও গড, কখনও মারাংবুরু। যে-নামেই ডাকা হোক না কেন, তিনি সাড়া দেন। সবকিছু জুগিয়ে রেখেছেন তিনি, এই পৃথিবীতেই। তবে পেতে গেলে এই পৃথিবীকে ভালোবাসতে হবে।
বর্ষাতে নানা কন্দ, ছাতু (মাশরুম), শাক জন্মায় ভেজা মাটির উপরে। শুকরু চেনে। না-হলে উপায় নেই যে। ওর খিদে পায়। ওদের খিদে পায়। কিন্তু এই গরমে, কাঠখোট্টা রোদে জমি শুকিয়ে যায়। কিছু পাওয়া যায় না। তবু শুকরু খুঁজতে লাগল। একজায়গায় পেল শুকিয়ে আসা হলুদ। তুলে নিল।
হাঁটতে হাঁটতে কখন যে জলেবিয়া ঝিলের কাছে চলে এসেছে, খেয়াল করেনি। এবার দেখল হাওয়াতে কেমন একটা গুমোট ভাব। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। সূর্যের তেজ কমে এসেছে। মেঘলা হচ্ছে আকাশ। বৃষ্টি নামবে নাকি?
জলেবিয়া ঝিলের জলে ঠাকুর বিসর্জন হয়। আরও নানা নিয়ম পালন করতে লোকে আসে ওখানেই। এই মুহূর্তে জলের থেকে একটু দূরে মাটির কতগুলো হাঁড়ি পড়ে আছে। কয়েকটা ইট। ঠাকুরের খড়ের কাঠামো।
তিনটে ইট সাজিয়ে উনুনের মতো করল শুকরু। শুকনো কাঠ দেদার পড়ে আছে দূরে। নিয়ে এসে গুঁজে দিল। একটা মাটির ছোটো হাঁড়ি জলে ধুয়ে নিল। জল যদিও শুকিয়ে সরে গেছে অনেকটা। ধারে ধারে এঁটেল মাটি শুকিয়ে ফাটা ফাটা।
শুকরু জলের দিকে সরে এল। গোড়ালি ডুবল প্রথমে, তারপর হাঁটু।
এককোণে একটা সরু বাঁশের টুকরো ডোবানো ছিল। শুকরুই রেখে গেছে কাল বিকেলবেলায়। এখন ওটা ধরে টান মারতেই ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল। সরু সরু আঁকাবাঁকা ডালগুলোতে আটকে আছে অনেক গুগলি। শামুকের মতো প্রাণী। তবে আকারে অনেক ছোটো। খাওয়া যায়।
শুকনো কাঠে আগুন জ্বেলে, হাঁড়িটাতে জল ফুটতে দিয়ে গুগলি আর হলুদ ছেঁচে জলটার মধ্যে দিয়ে দিল শুকরু। ফুটতে ফুটতে ভিতরের পিছল জিনিস জলে বেরিয়ে আসে। নরম মাংস সেদ্ধ হয়ে যায়। জল ফেলে দিয়ে খোলটুকু খালি ছাড়িয়ে নেওয়া।
বাবাকে দিয়ে এল অনেকটা। নুন মাখিয়ে। বাকিটুকু নিজে খেল। পেটটা ভরল কিছুটা। আর পেট ভরতেই ঘুম নেমে এল দু-চোখ জুড়ে।
ঘুমটা ভাঙল মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দে। কালো হয়ে এসেছে চারদিক। প্রচণ্ড জোরে হাওয়া বইছিল। কালবৈশাখী আসছে।
বাবা বোধ হয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে। মুখে অল্প হাসি হাসি ভাব। জাগাল না শুকরু। মাথার কাছের জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে দড়ি বেঁধে দিল। তারপর বাইরের দরজাতেও একটা দড়ি বেঁধে ছুটে বাইরে বেরোল। সেই ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া রাস্তাটার দিকে। ওইদিক দিয়েই মা আসবে নতুনগঞ্জ থেকে। বৃষ্টিতে ভিজে যাবে না তো?
হু হু করে হাওয়া বইছে। খুব জোরে বাজ পড়ল কোথাও। তারপর শুরু হল প্রবল বৃষ্টি। অল্পক্ষণের মধ্যেই ভিজে একশা হয়ে গেল শুকরু। গায়ের ছেঁড়া গেঞ্জিটা খুলে নিয়ে ঢালু জায়গাটার পাশে একটা উঁচু হয়ে থাকা পাথরের নীচে উবু হয়ে বসে পড়ল। অন্ধকার আকাশ আর বৃষ্টির তোড়ে ভালো করে দেখা যায় না। তবুও চোখের উপরের জলটুকু চেঁছে নিয়ে ও নীচের গাছপালা ঘেরা সরু রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকল।
ঘনঘন বাজ পড়ছে। গাছের উপরেই বেশি পড়ে, তাই শুকরু কোনও গাছের তলায় দাঁড়ায়নি। একটু আগেই গরমে টেকা দায় হয়ে উঠেছিল। আর এখন ভেজা গায়ে ঠান্ডা বাতাসে শীত করছিল ওর।
আরে! ওই অনেক দূরে একটা ছাতা নিয়ে কারা যেন হেঁটে আসছে! ভালো করে দেখা যায় না। তবু শুকরু একমনে ওদিকেই তাকিয়ে থাকল। অনেক দূর থেকে আস্তে আস্তে কাছে আসছে তারা। ছাতাটা হাওয়ার তোড়ে উলটে যেতে চাইছে মাঝে মাঝে।
মা! সাহেবকাকা! ঠিক চিনতে পারল শুকরু। সাহেবকাকার হাতে শক্ত বাঁশের ছাতা। সেজন্যই ওটা এখনও টিকে আছে। আর পাশে পাশে হাঁটছে মা। পাথরের তলা থেকে বেরিয়ে এল শুকরু। চিৎকার করে হাত নাড়তে লাগল।
মাও ঠিক চিনতে পেরেছিল। ঢালু জমিটা দিয়ে পাথরের কাছটাতে উঠে এসেই বলল, “ঠিক ধরেছি! বড়ো বদ আমার ছেলেটা। নিশ্চয়ই আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে! তা হ্যাঁ রে বাঁদর, বুদ্ধি নেই এতটুকু? এই ঝড়জলের মধ্যে বাবাকে একা ঘরে রেখে ভিজে ভিজে বাইরে এসেছিস?”
শুকরু কাছে আসতেই তার হাত ধরে টেনে ছাতার তলায় ঢোকানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, “বাজ পড়ছে। এই সময় কেউ বাইরে আসে! ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে এসেছিস?”
“হ্যাঁ, মা।” খুব জোরে ধকধক করছিল শুকরুর বুকটা। আর কী যে আনন্দ হচ্ছিল।
মা শাড়ির কোমরের কাছ থেকে একটা প্লাস্টিকের থলি বার করে ওর হাতে ধরিয়ে বলল, “দেখ কী এনেছি। আজ একটা ভোজবাড়িতে কাজ ছিল। লুচি, মিষ্টি, মাংস। যত পারিস খাস।”
সাহেবকাকা মিটিমিটি হাসছিল ছাতার ভিতর থেকে। এবার শুকরুর দিকে হাত বাড়াতেই ও সেটা এড়িয়ে গিয়ে নাচতে নাচতে ছুটে একটু সামনে চলে গেল। ঠিক তখনই চিড়বিড় করে উঠল আলো আর ভয়ানক শব্দে বাজ পড়ল একটু দূরেই। দৌড়ে ফিরে এল শুকরু। বাপ রে! কানে তালা লেগে গেল।
সাহেবকাকার কী হল আবার! চোখ যেন ছলছল করে উঠেছে তার। এক হাতে ছাতার বাঁটটা ধরে অন্য হাতে শুকরুকে জড়িয়ে ধরল। ঝুঁকে কী যেন দেখল ওর কোমরের কাছে। তারপর মাকে জিজ্ঞাসা করল, “শুকরুর কোমরে কি জড়ুল নাকি ওটা, বউদিদি?”
“হ্যাঁ গো!” মা হাসল।—“ওর বাবারও আছে। ঠাকুরদারও ছিল। ঠিক যেন একটা বাঘের মতো। তাই না? ওর বাবা মজা করে বলে আমরা হলাম বাঘের বাচ্চা। যাই হোক ভাই, ভাগ্যিস রাস্তাতে তোমাকে পেয়ে গেলাম। না-হলে এতটা রাস্তা আসতাম কী করে কে জানে। যা বিপদে পড়েছি না! ঘরে এতটুকু একটা ছেলে, লোকটাও খোঁড়া হয়ে পড়ে আছে। কী যে চিন্তা হয়।”
মা একপাশে। অন্য পাশে সাহেবকাকা। মাঝে শুকরু। তার হাতে প্লাস্টিকের থলেতে খাবার। সাহেবকাকা এক হাতে ছাতা আর অন্য হাতে শুকরুকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আছে। যেন কোনোদিন ছাড়বেই না। এক মুখ হাসি তার। মা অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। আকাশে মাঝে-মাঝেই ভায়োলেট মাসির ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইটের মতো আলো জ্বলে উঠছিল। আর বৃষ্টি পড়ছিল খুব জোরে।
ছবি: প্রদীপ গোস্বামী
লেখকের অন্যান্য লেখা
প্রলয় সেন ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ রম্যাণী গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ তাপস মৌলিক ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ প্রদীপ কুমার দাস ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ দীপক দাস ▪ অমিয় আদক ▪ কল্যাণ সেনগুপ্ত
বদ্রীনাথ পাল ▪ দীনেশ সরকার ▪ রূপসা ব্যানার্জী ▪ শঙ্খশুভ্র পাত্র ▪ সৌরভ চাকী ▪ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪ শিবানী কুণ্ডু খাঁ ▪ সুব্রত দাস ▪ বসন্ত পরামানিক ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ তাপস বাগ ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ টুম্পা মিত্র সরকার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ যূথিকা আচার্য ▪ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ কেয়া চ্যাটার্জী ▪ ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ▪ সুদীপ ঘোষাল ▪ অনিন্দ্য পাল ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অরিন্দম ঘোষ ▪ সৌম্যপ্রতীক মুখোপাধ্যায় ▪ রাজীবকুমার সাহা
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী ▪ মলয় সরকার
অলংকরণ
প্রদীপ গোস্বামী ▪ মৌসুমী রায় ▪ অঙ্কিতা মণ্ডল ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ রাখি পুরকায়স্থ ▪ সুকান্ত মণ্ডল ▪ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪ প্রবাহনীল দাস ▪ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী ▪ রাজন্যা ব্যানার্জী ▪ সমৃদ্ধি ব্যানার্জী ▪ ঐশিক মণ্ডল ▪ বিজয় বোস ▪ দীপক কুণ্ডু
আমাদের আশেপাশে যেসব মানুষরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁদের সকলের সঙ্গে আমাদের আলাপ-পরিচয় হয় না। অথচ এঁদের মধ্যে অনেকেই অসাধারণ সব গুণের অধিকারী। গুণময় রায় এরকমেরই একজন মানুষ। তিনি একজন বিজ্ঞানী। নিজের পরিচয় দেন ‘ইনভেনটর’ বলে। বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও তুখোড়। আবার ভারতীয় পুরাণ, ইতিহাস এবং পুরাতাত্ত্বিক বিষয়েও তাঁর গভীর জ্ঞান।
এ-হেন মানুষটির সঙ্গে কয়েকজন স্কুল-ছাত্রের নিতান্ত আকস্মিকভাবেই আলাপ হয়ে যায়। তাদের কাছে গুণময় রায় খোলসা করেন তাঁর কয়েকটি আবিষ্কারের কথা। একে একে খুলে যায় আশ্চর্য সব জগতের দরজা, যার তুলনা আর কোথাও নেই। কখনও নিজের মনোজগত, কখনো-বা প্রজন্মবাহিত স্মৃতির সরণিতে অক্লেশে ঘুরে বেড়ান ‘গুণময় দ্য গ্রেট’, আর পাঠকেরাও সুযশ মিশ্রের জবানিতে স্বাদ পায় সেই অতুলনীয় অ্যাডভেঞ্চারগুলির। বিচিত্রতর যাত্রাপথে সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত থেকে শুরু করে যুদ্ধরত মহাদেব—কতজনের সঙ্গেই না দেখা হয়ে যায় তাদের।
দুই শতাব্দী। গোটা বিশ্ব চরম অস্থির। একের পর এক ঘটে চলেছে ঐতিহাসিক ঘটনা। তারই মাঝে সে নজরদারি করে চলেছে গোটা বিশ্ব। খিদিরপুর থেকে চিনের ক্যান্টন, সুদূর আফ্রিকার সাভো নদীর তট থেকে ইম্ফল, নিউ পাপুয়া গিনির রহস্যময় ভূগর্ভস্থ জগৎ - কোনও স্থানই তার দৃষ্টিপথের বাইরে নয়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পথ চলে তার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সে নির্দেশ অমোঘ, অলৌকিক। তা অমান্য করার সাধ্য কারও নেই। সে জিচোলা তাতু। রহস্য, রোমাঞ্চ, ভয়, অলৌকিক, যুদ্ধ আর ইতিহাস দিয়ে গেঁথে তোলা হয়েছে রুদ্ধশ্বাস দুই শতাব্দীর আখ্যান।