লোককাহিনি
FREE SHIPPING IN INDIA
লোককাহিনি
আবুল কাসেমকে যাঁরা চেনেন না, তাঁরা কেউ কেউ বলতেই পারেন, পুরোনো জিনিসের মায়া কাটানো সত্যিই বড়ো কঠিন, তাই হয়তো আবুল কাসেম… না, ব্যাপারটাকে অত গভীরে গিয়ে দেখবার দরকার নেই মোটেই। সোজাসাপটা কথা হল, আবুল কাসেম বড্ড কিপটে। অবশ্য শুধু শুধু কিপটে বললে ভুলই বলা হবে, আবুল কাসেম আসলে হাড়কিপটে।
রাখি পুরকায়স্থ
জনাব আবু্ল কাসেম একজন বিরাট ধনী বণিক। কেবল তাঁর নিজের শহরের লোকজনই নয়, আশেপাশের দশ-দশটা গাঁয়ের মানুষ তাঁকে একডাকে চেনে। তবে মজার ব্যাপারটা হল, অমন গাদাগাদা টাকাকড়ির মালিক বলে নয়, আবুল কাসেম বিখ্যাত তাঁর ছেঁড়াখোঁড়া চটিজোড়ার জন্যে। চটি দুটি ইহকাল ত্যাগ করে পরকালের বাসিন্দা হয়েছে বহুদিন। কিন্তু তাতে কী, ও-দুটিকে প্রাণে ধরে কিছুতেই ফেলে দিতে পারেন না আবুল কাসেম। ধনসম্পত্তির পাহাড়ে বসেও সামান্য একজোড়া নতুন চটি কিনবার কথা তিনি কষ্ট কল্পনাতেও আনেন না। ভয় পান, পাছে মনের কোণে নতুন চটি কেনার ইচ্ছেরা সত্যি সত্যি দানা বাঁধে!
আবুল কাসেমকে যাঁরা চেনেন না, তাঁরা কেউ কেউ বলতেই পারেন, পুরোনো জিনিসের মায়া কাটানো সত্যিই বড়ো কঠিন, তাই হয়তো আবুল কাসেম… না, ব্যাপারটাকে অত গভীরে গিয়ে দেখবার দরকার নেই মোটেই। সোজাসাপটা কথা হল, আবুল কাসেম বড্ড কিপটে। অবশ্য শুধু শুধু কিপটে বললে ভুলই বলা হবে, আবুল কাসেম আসলে হাড়কিপটে।
এহেন আবুল কাসেম একদিন গণ-গোসলখানায় গিয়ে হাজির হলেন। এমনি-এমনিই কি আর গেলেন নাকি ওখানে! গরমে টিকতে না পেরে বাধ্য হলেন গাঁটের কড়ি খরচ করে গোসলখানায় যেতে। তা, অমন বিলাসবহুল গোসলখানায় এলাকার নামিদামি লোকেদেরই যে কেবল পদধূলি পড়বে, এ আর আশ্চর্য কী!
তা সে যা-ই হোক, আবুল কাসেম নিজের বিখ্যাত চটিজোড়া গোসলখানার বাইরে রেখে নিশ্চিন্তে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। কারণ যত বিখ্যাতই হোক না কেন, অমন চটি যে কোনও চোর ভুলেও চুরি করবে না, সে-বিষয়ে তিনি ছিলেন যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। খানিক বাদেই ওই শহরের মহামান্য কাজি সাহেব এলেন গোসলখানায়। নিজের নতুন চকচকে চটিজোড়া বাইরে রেখে তিনিও সেখানে প্রবেশ করলেন। যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী তিনিও, কারণ ও-দেশে কোন চোরের ঘাড়ে ক’টা মাথা যে কাজির চটি হাপিশ করবে!
এ-পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। গোল বাধল তখন, যখন আবুল কাসেম গোসলখানা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের বিখ্যাত চটিজোড়া খুঁজে পেলেন না। তার পরিবর্তে সামনে দেখতে পেলেন একজোড়া ঝকঝকে নতুন চটি। ও-দুটো গেল কোথায়? এ-দুটো এল কোত্থেকে? অনেক ভেবেও কূলকিনারা পেলেন না আবুল কাসেম। শেষমেশ বাধ্য হয়ে ধরেই নিলেন, ওঁর চটির জনপ্রিয়তা দেখে শুনে কেউ হয়তো হিংসায় জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে ওই পুরোনো চটিজোড়ার বদলে এই নতুন চটিজোড়া রেখে গিয়েছে। বাইরে মুখখানা বেজায় ব্যাজার করে রাখলেও, ভেতরে ভেতরে আবুল কাসেমের মনটা হঠাৎ ভীষণ ফুর্তিতে ভরে গেল। আসলে তিনি তো জানেন, যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়। বিশেষ করে যেখানে খরচপাতি বেঁচে যায়, সেখানে ভালোমন্দ নিয়ে মনে কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব রাখতেই নেই। তাই আর সময় নষ্ট না করে আবুল কাসেম নতুন চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে দ্রুত গন্তব্যের দিকে হাঁটা লাগালেন।
এদিকে মহামান্য কাজি সাহেব কিছুক্ষণ বাদে গোসল সেরে বেরিয়ে এসে দেখতে পেলেন তাঁর নতুন চটিজোড়া বেমালুম হাওয়া! রেগেমেগে তিনি নফরকে ডেকে বললেন, “কোথায় থাকিস তুই? এদিকে যে আমার শখের চটিজোড়া খোয়া গেল!”
আঁতিপাঁতি করে খুঁজল নফর। শেষে শূন্য হাতে ফিরে এসে বলল, “গোস্তাকি মাফ করবেন মালিক, আপনার চটিজোড়া খুঁজে পাচ্ছি না। তবে এখানে জনাব আবু্ল কাসেমের পুরোনো চটিজোড়া পড়ে আছে। নিশ্চয়ই তিনি আপনার চটি পরে চলে গিয়েছেন।”
মহামান্য কাজি সাহেবের আদেশে পেয়াদারা তক্ষুনি ছুটল আবুল কাসেমকে পাকড়াও করতে। ধরা পড়তেই দেখা গেল, ওঁর পায়ে কাজি সাহেবের চটি। পেয়াদারা তাঁকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এল আদালতে, কাজির সামনে। আবুল কাসেম আপ্রাণ বোঝাতে চেষ্টা করলেন, তাঁর কোনও দোষ নেই। কিন্তু কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করলে তো! কাজি সাহেব রেগেমেগে আবু্ল কাসেমকে মোটা অঙ্কের জরিমানা করলেন। নিরুপায় আবুল কাসেম চুপচাপ জরিমানা দিলেন, তারপর নিজের সেই পুরোনো চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে মাথা নীচু করে ফিরে গেলেন বাড়ি।
মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু আবুল কাসেম আসলে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলেন। তাঁর সব রাগ গিয়ে পড়েছিল নিজের ওই চটিজোড়ার ওপর। তাই বাড়ির পাশের একটি জলাধারে চটি দুটো ছুড়ে ফেলে দিলেন তিনি। কিন্তু চটি দুটো জল সরবরাহকারী নালার মুখে আটকে গিয়ে জলাধারে জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেল। খবর পেয়ে সেপাইরা সব পড়িমরি করে দৌড়ে এল। খানিক খোঁজাখুঁজি করতেই বেরিয়ে এল আবুল কাসেমের বিখ্যাত চটিজোড়া। এতে যা হবার তা-ই হল। আবু্ল কাসেমকে আবারও আদালতে পেশ করা হল এবং আবারও তাঁর ওপর বিপুল অঙ্কের জরিমানা আরোপ করা হল। নিরুপায় আবুল কাসেম চুপচাপ জরিমানা দিলেন, তারপর নিজের সেই পুরোনো চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন।
বাড়ি ফিরে আবুল কাসেম অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন, চটি দুটোকে পুড়িয়ে ফেলে ঝামেলা মেটাবেন। কিন্তু ভেজা চটিতে তো আগুন ধরবে না, তাই চটিজোড়া বাড়ির ছাদে রেখে দিলেন শুকানোর জন্য। ওদিকে পড়শির বেড়াল চটি দুটো পেয়ে আহ্লাদে গদগদ হয়ে খেলতে শুরু করল। ঠিক তক্ষুনি এক ফেরিওয়ালি মাথায় ভারী বোঝা নিয়ে আবুল কাসেমের বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। এমন সময় বেড়ালের পায়ের ধাক্কায় ছাদ থেকে চটি দুটো উড়ে এসে পড়ল ওই মহিলার ওপর। চমকে উঠে পড়ে গিয়ে কোমর ভাঙল মহিলার। খবর পেয়ে সেপাইরা দৌড়ে এল। অকুস্থলে পাওয়া গেল আবুল কাসেমের বিখ্যাত চটিজোড়া। এতে যা হবার তা-ই হল। আবুল কাসেমকে আবারও আদালতে পেশ করা হল এবং আবারও তাঁর ওপর বিপুল অঙ্কের জরিমানা আরোপ করা হল। নিরুপায় আবুল কাসেম চুপচাপ জরিমানা দিলেন, তারপর নিজের সেই পুরোনো চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে ফিরে গেলেন বাড়ি।
এবার আবুল কাসেম ঠিক করলেন চটি দুটোকে মাটিচাপা দেবেন। তাই বাড়ির বাগানে গর্ত খুঁড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাই দেখে তাঁর পড়শি ভাবল, নিশ্চয়ই আবুল কাসেম বাগানে গুপ্তধন পুঁতে রাখছেন। সেই দেশের আইন অনুসারে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর কর দেওয়া বাধ্যতামূলক, নইলে জরিমানা ধার্য হয়। পড়শি তড়িঘড়ি রাজস্ব দপ্তরকে সব জানিয়ে এল। সেপাইরা দৌড়ে এল। আবুল কাসেমকে আবারও আদালতে পেশ করা হল। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কাজি সাহেব এবার আবু্ল কাসেমের ওপর আরও বিরাট অঙ্কের জরিমানা আরোপ করলেন।
আবুল কাসেম কিন্তু এবারে আর মুখ বুজে থাকতে পারলেন না। কান্নায় ভেঙে পড়ে কাজি সাহেবের কাছে কাতর আর্জি জানালেন, “হুজুর-এ-আলা, আমি আমার চটিজোড়ার উৎপাতে ক্লান্ত। যতবারই পিছু ছাড়ানোর চেষ্টা করি, ততবারই চটি দুটো কীভাবে যেন আবার ফিরে আসে আমার কাছে। এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না, মাঝখান থেকে গাদাগাদা টাকাকড়ি গচ্চা দিতে হয় বার বার। তাই বলছি কী হুজুর, দয়া করে আমায় কয়েদখানায় ভরে দিন। তাহলে হয়তো ও-দুটির হাত থেকে রক্ষে পাব।”
বাইরে থেকে দেখে কাজি সাহেবকে যতই কড়া ধাতের রাশভারী মানুষ বলে মনে হোক না কেন, আসলে তিনি অত্যন্ত কোমল হৃদয় ব্যক্তি। আবুল কাসেমকে তিনি নরম গলায় বললেন, “দেখুন জনাব আবুল কাসেম, জীবনের চলার পথে নানান ভালো জিনিস অর্জন করবার সৌভাগ্য হয় আমাদের। তার জন্যে অবশ্যই মঙ্গলময় আল্লাহ্র কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তবে সত্যি কথাটা কী বলুন তো, কোনও জিনিসের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি ভালো নয়। দিন ফুরোলে ওই জিনিসকে ধরে রাখাটাও ভালো নয়। তাই তো সঠিক সময়ে পুরোনো ছেঁড়া চটিজোড়াকে ফেলে দিতে শিখতে হয়। নইলে সমূহ বিপদ।” তারপর হেসে বললেন, “নিশ্চিন্তে বাড়ি যান জনাব, আপনার জরিমানা মকুব করা হল।”
চোখের জল মুছে আবুল কাসেম চুপচাপ বাড়ি ফিরে গেলেন, পুরোনো চটিজোড়া পায়ে না গলিয়েই। আর হ্যাঁ, ফেরার পথে একজোড়া নতুন চকচকে চটি কিনে নিতে ভুললেন না।
(প্রাচীন লোককথা অবলম্বনে)
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস
হেরম্বপুর থানার দোর্দণ্ডপ্রতাপ দারোগা দিগম্বর দিকপতি। রগচটা, বদমেজাজি, কিন্তু কর্মনিষ্ঠ। যাঁর দাপটে অপরাধ-জগৎ কম্পমান! সেই দিকপতিকে তিষ্ঠোতে দেয় না ধুরন্ধর চোর সনাতন। নানান ভাবে, নানান ফিকিরে নাস্তানাবুদ করে তোলে দাপুটে এই বড়োবাবুকে। অকুতোভয় বড়োবাবু বাইরে প্রকাশ না করলেও মনে মনে সনাতনকে খুবই ভয় পান। কী জানি কখন কী করে ব্যাটাচ্ছেলে তাঁর মানসম্মান সব ধুলোয় মেশায়! সবসময়ই বাছাধনের মাথায় শুধু বুদ্ধির মারপ্যাঁচ! তাই সর্বদাই তাকে সমঝে চলতে হয়।
অপরদিকে সনাতনেরও দারোগাবাবুর ভয়ংকর বদমেজাজি রাগটাকে ভয়। কে জানে কবে তাকে মিথ্যে কেসে ফাঁসিয়ে যাবজ্জীবন সাজায় না জেলে পাঠান! সমস্ত বই জুড়ে শুধু এই দুই মহারথীর দ্বৈরথ।
কখনও সনাতন শেষ হাসি হাসলে কখনও দিকপতিও জয়ী হন। শুরু থেকে শেষ অবধি এই সংকলনের কুড়িটি গল্পে শুধু অত্যন্ত মজাদার এই দুই চরিত্রের অদম্য লড়াই। পাঠক হাসিতে লুটিয়ে পড়বেন কাহিনির বিন্যাসে। সঙ্গে সনাতনী সংলাপ আর দিগম্বরী প্রত্যাঘাত।
কুড়ি জন দিকপাল বিজ্ঞানীর অসাধারণ কর্মকাণ্ড আর জীবনের গল্প। যে বিজ্ঞানীদের হাত ধরে সভ্যতা এগিয়ে গিয়েছে, কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের ঢাকনা খুলে অনাবৃত হয়েছে বিজ্ঞানের সৌন্দর্য, যাঁদের আপসহীন জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানের জয়ধ্বজা উড়েছে, তাঁদের জীবনের অন্যান্য দিকগুলোও তুলে ধরা হয়েছে এই বইতে।