উপন্যাস
FREE SHIPPING IN INDIA
উপন্যাস
আরও আধঘণ্টার মতো থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমরা মার্গারিটা হাউস থেকে। ফেরার সময় বড়ো রাস্তা দিয়ে ঘুরে এলাম। তখনই দুর্ঘটনাটা ঘটল। আচমকা একটা বাইক খুব জোরে ছুটে এল পিছনে নলডাঙা রাজবাড়ির দিক থেকে। ফাঁকা রাস্তা। চোখের পলকে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল আমাদের গা ঘেঁষে। বাইকটা চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার পর খেয়াল হল গৌরাঙ্গবাবু আমাদের সঙ্গে নেই। পিছন ফিরে দেখি রাস্তার ধারে অর্ধেক শরীর ঝোপের ভিতরে, মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন।
পুষ্পেন মণ্ডল
১৯৪৩, বার্লিন।
তখন প্রায় মধ্যরাত। ফেব্রুয়ারির শুরুতে বরফে ঢাকা শুনশান রাস্তাঘাট। তিনটে জার্মান মিলিটারি জিপ এসে দাঁড়াল বার্লিন স্টেশনে। ভারী শীতের পোশাক পরা বেশ কয়েকজন মানুষ অন্ধকারে দ্রুত নেমে এলেন। তাড়াহুড়ো করে জিপ থেকে কিছু মালপত্র নামানো হল। আজ স্পেশাল একটা ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনে কোনও বিশেষ আরোহীর জন্য। দুজন নাৎসি সেনা আধিকারিক আলেকজান্ডার আর কেপলার পুরো ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন। ওঁরা লম্বা কোট আর হ্যাট পরা এক দীর্ঘদেহী মানুষকে এস্কর্ট করে নিয়ে এলেন ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবুজ সংকেত পেয়ে হুইসেল দিয়ে স্টেশন ছেড়ে দিল ট্রেন। অন্ধকার চিরে ছুটতে শুরু করল জার্মানির উত্তরে কিয়েল বন্দরের উদ্দেশ্যে। সেই বিশেষ মানুষটির সহযোগী সিটে বসে চাপা স্বরে জানতে চাইলেন, “আমরা কোথায় যাচ্ছি, নেতাজি?”
মৃদু হেসে নেতাজি ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন, “তোমার কী মনে হয় আবিদ, কোথায় যেতে পারি আমরা?”
“হজ করতে যে যাচ্ছি না, এটা তো পরিষ্কার।”
আসলে কিছুদিন আগেই নেতাজির বার্লিনের বাসায় আরও কয়েকজন সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আবিদ হাসানকে নিয়ে। সবাই সেখানে আবিদকে হজে পাঠানোর পরিকল্পনা করছিলেন। আবিদের কাজ হবে হজযাত্রী ভারতীয় মুসলিমদের ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত করা। এদিকে হঠাৎ হজে না পাঠিয়ে নেতাজি আবিদকে নিয়ে কোথায় চললেন সেটাই রহস্য।
রহস্য বজায় রেখে নেতাজি বললেন, “আর একটু ধৈর্য ধরো। এতদিনের প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে।”
নেতাজির চোখে অদ্ভুত একটা আশার আলো। আবিদ হাসানের মনে হল দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা, স্বপ্ন— সব কি তাহলে সত্যি হবে!
কোনও ছোটোখাটো স্টেশনে দাঁড়াচ্ছে না ট্রেনটা। এমনকি হামবুর্গের বড়ো সেন্ট্রাল স্টেশনও ছুঁয়ে ছুটে চলল উত্তরের দিকে। নিদ্রাহীন রাত্রি বসেই কাটল দুজনের। শেষ রাতে ট্রেন গিয়ে দাঁড়াল কিয়েন স্টেশনে। ভোরের আকাশ লাল হয়ে আসছে। বেশ কয়েকজন সামরিক ব্যক্তি কর্ডন করে নিয়ে চললেন নেতাজিকে। আবার একটা জিপে তোলা হল তাঁকে। কিছুদূর গিয়ে জিপ থেকে নেমে বন্দরের জেটিতে লাগানো রাবারের বোটে উঠলেন নেতাজি। আবিদ আনন্দে লাফিয়ে উঠে নেতাজিকে বললেন, “সাবমেরিন! সাবমেরিন!”
হ্যাঁ, ভোরের আলোয় নেতাজিও লক্ষ করেছেন বেশ কয়েকটা ডুবোজাহাজ বিশাল বড়ো কালো তিমির মতো ভাসছে নর্থ সি’র জলে। তার মধ্যে একটার গায়ে গিয়ে ভিড়ল নেতাজির বোট। ৮ ফেব্রুয়ারি কাকভোরে আলেকজান্ডার আর কেপলারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেতাজি আর আবিদ হাসান ডুবোজাহাজের ছোট্ট দরজার মধ্যে দিয়ে কোনোরকমে ঢুকে গেলেন ভিতরে।
ক্যাপ্টেন ওয়ার্নার মুসেনবার্গ এগিয়ে এসে নেতাজির সঙ্গে উষ্ণ করমর্দন করে স্বাগত জানালেন, “আসুন কমান্ডার বোস, আপনার থাকার জায়গা দেখিয়ে দিই।”
খুবই ছোট্ট একটা লোহার বাংকার আর একটা টেবিল। ডিজেলের উগ্র গন্ধে নাক ঝাঁ ঝাঁ করছে দুজনেরই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাপ্টেনের নির্দেশে চালু হয়ে গেল ইঞ্জিন। তার বিকট আওয়াজে ডুবোজাহাজের ভিতরে কান পাতা দায়।
প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে আবিদ জানতে চাইলেন, “আমরা কোথায় যাচ্ছি, নেতাজি?”
“জাপান।”
চোখ বড়ো বড়ো করে আবিদ আবার প্রশ্ন করলেন, “কতদিন লাগবে পৌঁছতে?”
“আনুমানিক তিন মাস।”
“এতদিন এই ছোট্ট ঘরের মধ্যে আমাদের আটকে থাকতে হবে! কী করে সময় কাটবে?”
নেতাজি সঙ্গে আনা একটি চামড়ার বাক্স খুলে বের করে আনলেন ছোট্ট এক জার্মান টাইপরাইটার। আবিদকে দিয়ে বললেন, “আমি বলব, তুমি টাইপ করবে।”
দিনের বেলায় ডুবোজাহাজটি জলের নীচে দিয়ে চললেও রাতের অন্ধকারে ভেসে ওঠে সমুদ্রের উপরে। চব্বিশ ঘণ্টা জলের নীচে দিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা এই ডুবোজাহাজের নেই। তাই রাত্রিবেলা উপর দিয়েই যেতে হয়। গ্রেট বেল্ট হয়ে ডেনমার্কের কোল ঘেঁষে নর্থ সি দিয়ে এগিয়ে চলল ডুবোজাহাজ। তারপর নরওয়ের সমুদ্রতটের ধার দিয়ে অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে মিশে গেল। পাশেই গ্রেট ব্রিটেন। শত্রুপক্ষের শ্যেনদৃষ্টি সবসময় চক্কর কাটছে সমুদ্রে ও আকাশে। মাঝে-মাঝেই জলবোমা নেমে আসছে উপর থেকে। কখনও সমুদ্রের অনেক গভীরে এসে ফাটছে সেগুলো। দক্ষ ক্যাপ্টেন মুসেনবার্গ খুব সাবধানে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন ডুবোজাহাজটিকে। অ্যাডলফ হিটলারের নির্দেশ, কমান্ডার বোসকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে হবে জাপানের সাবমেরিনে। রাতের অন্ধকারে জাহাজ উপরে ভেসে উঠলেই দেখা যায় জলের উপরে ভাসছে বড়ো বড়ো বরফের চাঁই। সেগুলো থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হচ্ছে সাবধানে।
বেশ কিছুদিন পর জাহাজ পৌঁছল ফ্রান্সের চেরবুর্গ বন্দরে। এখান থেকে ডিজেলের ট্যাংক পুনরায় ভরতি করা হল।
এতদিনে ডিজেলের গন্ধ দুজনেরই সয়ে গেছে। কিন্তু জার্মান খাবার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না নেতাজির পেটে। শেষে আবিদ নিজে রান্নাঘরে গিয়ে চাল-ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি তৈরি করে আনলেন। নুন ছাড়া সেই খিচুড়িই তখন অমৃত। নেতাজি তৃপ্তিভরে সেই খাবার খেতে খেতে ভাবছিলেন, বেশ কয়েক বছর আগে চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে জেলে বন্দি থাকাকালীন তিনি দেশবন্ধুর জন্য খিচুড়ি রান্না করে দিতেন।
ক্রমশ উত্তর অ্যাটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে ডুবোজাহাজ দক্ষিণ অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে পড়ল। ক্যাপ্টেন জানালেন, এদিকে শত্রুপক্ষের নজরদারি অনেকটা শিথিল। তাই জাহাজ দিনের বেলাতেও জলের উপর দিয়ে চলতে লাগল। এতে গতি অনেক বাড়ল।
এখন আবিদ হাসানের কাজ হচ্ছে নেতাজির কাছ থেকে ডিকটেশন নিয়ে টাইপ করা। ‘দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ বইটির পরবর্তী সংস্করণের কাজ ভালোই এগোচ্ছে। এর সঙ্গে শলাপরামর্শ চলছে আজাদ হিন্দ ফৌজের কমিটি গঠন, জাপানের রাষ্ট্রনায়ক তোজোর সঙ্গে কথোপকথনের খসড়া, অর্থসংস্থান, সিঙ্গাপুর থেকে বার্মা হয়ে মণিপুর দিয়ে ভারতে ঢোকার রুট প্ল্যান, বিভিন্ন ডিপ্লোম্যাটিক পরিকল্পনা, স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের শাসনব্যবস্থা ইত্যাদি আরও অনেক বিষয় নিয়ে। নেতাজি সারাদিন সিংহের মতো ছোট্ট বদ্ধ ঘরের মধ্যে পায়চারি করেন আর আবিদ হাসানের আঙুলের টোকায় জার্মান টাইপরাইটার থেকে সারাক্ষণ খটাখট আওয়াজ উঠতে থাকে।
প্রায় আড়াই মাস পরে আফ্রিকার দক্ষিণে উত্তমাশা অন্তরীপ পেরিয়ে ডুবোজাহাজ পৌঁছে গেল মাদাগাস্কার দ্বীপের কাছে মোজাম্বিক চ্যানেলে। এখানেই নির্দিষ্ট জায়গাতে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল জাপানি আই-২৯ ডুবোজাহাজটি। ২৬ এপ্রিল সকালে ক্যাপ্টেন মুসেনবার্গের কাছ থেকে বিদায় নিলেন নেতাজি। আবিদকে সঙ্গে নিয়ে একটা রাবারের বোটে করে ভেসে পড়লেন উত্তাল সমুদ্রে। রাবারের বোট ক্রমশ এগিয়ে চলল জাপানি ডুবোজাহাজের দিকে।
জাপানি ডুবোজাহাজটিতে প্রবেশ করে নেতাজি বুঝলেন এটি আগেরটার তুলনায় আকৃতিতে বেশ বড়ো। তাঁর জন্য এখানে একটু বড়ো একটা কেবিনের ব্যবস্থা করা ছিল। পড়াশোনা আর লেখালিখির জন্য টেবিল-চেয়ারগুলো অনেকটা আরামদায়ক। ক্যাপ্টেন মেসো তেরেকো খুব অমায়িক মানুষ। খাওয়াদাওয়া নিয়েও আর বিশেষ কোনও সমস্যা রইল না। বাঙালি আর জাপানিদের খাওয়ার রুচি অনেকটা একইরকম। ভারত মহাসাগর আর ফিলিপিন সাগর পেরিয়ে জাহাজ ছুটে চলল টোকিওর দিকে।
***
দু-বছর আগের ঘটনা।
দিনের শুরুটা সেদিন যে এরকম তাড়াহুড়ো করে হবে কে ভেবেছিল। কলেজের পরীক্ষা শেষ হয়েছে দু-দিন আগে। রবিবার সকালে কোথায় বেলা করে ঘুম থেকে উঠব তা নয়, তানিয়াদির ফোন পেয়ে তিন মিনিটে রেডি হয়ে ফ্ল্যাটের নীচে এসে দাঁড়তে হল। তার দু-মিনিটের মধ্যেই লাল মারুতি সুইফট এসে দাঁড়াল আমার সামনে। যথারীতি তানিয়াদি নিজেই ড্রাইভ করছে। পাশে বসে আছে ঝিন্টু। পিছনের সিটে উঠে পড়লাম আমি। এসি চলছে, গাড়ির ভিতরটা ঠান্ডা আর বরাবরের মতো জুঁইফুলের মিষ্টি গন্ধে ম ম করছে। সঙ্গে জাভেদ বসিরের ঠুমরী বাজছে স্টিরিওতে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর দক্ষিণ কলকাতা হয়ে গাড়ি যখন জেমস লং সরণিতে পড়ল, নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাচ্ছি?”
“ডায়মন্ডহারবার।”
“ও! শ্রী যাবে না?”
তানিয়াদি আর শ্রী সাধারণত ডেনড্রাইটের মতো সেঁটে থাকে। তাই এই প্রশ্নটা আপনা থেকেই বেরিয়ে গেল আমার মুখ থেকে।
“সে মাসির বাড়ি গেছে, কী অনুষ্ঠান আছে।” ঝিন্টু উত্তর দিল।
জোকা পেরিয়ে জ্যামটা একটু কমতে ফাঁকা রাস্তায় পড়ে তানিয়াদি জানাল, “ভদ্রলোকের নাম হরজিৎ সিং, প্রাক্তন সরকারি আমলা। রিটায়ারের পর ডায়মন্ডহারবারের কাছে একটা বড়ো বাগানবাড়ি করেছেন। এখন সেখানেই একা থাকেন। আদি বাড়ি পাঞ্জাবে। তবে দীর্ঘদিন বাংলায় পোস্টেড ছিলেন। ভালো বাংলা বলতে পারেন। সত্তরের কাছাকাছি বয়স। এইসব নিজেই আমাকে ফোনে জানালেন। এও বললেন, আসল সমস্যার কথাটা ফোনে বলা যাবে না। তারপরই ওঁর বাগানবাড়িতে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন আমাদের।”
“বেশ!” ঝিন্টু উপর-নীচে মাথা নেড়ে গম্ভীর গলায় মন্তব্য করল, “সকালে আমার কিন্তু তেমন ভালো কিছু খাওয়া হয়নি। তোমার ফোন পেয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি। দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা কি ওখানেই হবে?”
এই খাই খাই রোগটা ঝিন্টুর চিরকালের। আমাদের কাছে এসব গা সওয়া হয়ে গেছে।
যাই হোক, ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই ড্যাশ বোর্ডের জিপিএস ম্যাপ দেখে বুঝলাম আমরা পৌঁছে গেছি গন্তব্যস্থলের কাছাকাছি। ডায়মন্ডহারবার রোড ছেড়ে গাড়ির মুখ ঘুরে গেল বাঁদিকে। সরু রাস্তা দিয়ে মিনিট দশেক ভিতরে ঢুকে ডানহাতে পড়ল একটা লম্বা পাঁচিল। কিছুটা এগিয়ে পাঁচিলের গায়ে একটা বড়ো গেট পাওয়া গেল। গাড়ির হর্ন বাজাতে দারোয়ান বেরিয়ে নাম জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে ঢুকতে দিল ভিতরে। সোজা মোরাম বিছানো রাস্তা। চারপাশে গাছের মেলা। সত্যি বলতে কী, এত বিচিত্ররকমের গাছগাছালি একজায়গায় একসঙ্গে দেখে একটু অবাক হলাম। বেশিরভাগ গাছেদের নামই আমি জানি না। গাড়িটা একটা শেডের মধ্যে পার্ক করে আমরা এগোলাম বড়ো সাদা রঙের বাড়িটার দিকে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে মোজাইকের মেঝে। এই ধরনের ডিজাইন করা মেঝে এখন আর দেখা যায় না। এখানেও চারদিকে টবে টবে রঙবাহারি গাছেদের ভিড়। দূর থেকে কুকুরের ডাক কানে আসছে সমানে। কাঁচাপাকা বড়ো চুলদাড়ি, মাথায় পাগড়ি, লম্বাচওড়া চেহারা, হালকা সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পরা এক বয়স্ক মানুষ স্মিত হাসি টেনে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য।
“আসুন আসুন, আমার ডেরাটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি তো?”
তানিয়াদি ঠিকই বলেছিল। ভদ্রলোক ভালো বাংলা বলেন। তবে সেটা ঠিক আমাদের মতো বাংলা নয়। উত্তর ভারতীয় টান আছে তাতে।
“না না, কোনও অসুবিধা হয়েনি। এখন গুগল ম্যাপ থাকতে কোনও সমস্যা হওয়ার কথাই নয়।” তানিয়াদি হাসিমুখে হাত জড়ো করে জানাল।
ভিতরের ঘরে সোফায় বসতেই কাচের গ্লাসে ডাবের সরবত দিয়ে গেল একজন। পাতলা শাঁসওলা শরবতটা গলা দিয়ে নামতে প্রাণ ঠান্ডা হয়ে গেল একেবারে। আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল তানিয়াদি। তারপর সরাসরি প্রসঙ্গ উত্থাপন করে জানতে চাইল, “ফোনে আপনি বলছিলেন আপনার সমস্যার কথা সামনাসামনি বলবেন।”
মাথা নেড়ে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললেন, “চলুন, তার আগে আমার বাগানবাড়িটা আপনাদের ঘুরিয়ে দেখাই।”
আমরা উঠে পড়লাম। তানিয়াদি বলল, “আর একটা কথা, আমরা আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোটো, তাই তুমি বললে স্বস্তি পাব।”
“বেশ, তাই হবে।” ভদ্রলোকের গলার স্বর আর হাসি দুটোই খুব অমায়িক।
বাড়িটার ভিতর দিয়ে একটা রাস্তা আছে। চারপাশে কতরকমের সারি সারি গাছ। তিনি হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “নার্সারির ব্যাবসা আমার পনেরো বছর হল। বহু প্রজাতির দেশি-বিদেশি গাছের চাষ হয় এখানে। পঞ্চাশ জনের মতো লোক কাজ করে। প্রথমে শখে শুরু করলেও এখন ভালোই ইনকাম হয়। এসব বাহারি গাছের বিদেশে প্রচুর চাহিদা। এছাড়া ফার্মিংও আছে, গোরু আর মোষের দুধ থেকে ডেয়ারি প্রোডাক্ট তৈরি হয়। মৌমাছি থেকে উৎকৃষ্ট মানের মধু তৈরি হয়। বিভিন্ন প্রজাতীর মুরগি আছে আমার পোল্ট্রিতে। তাদের ডিম ও মাংস দুটোই সুস্বাদু।”
“বাহ!”
ইট বিছানো রাস্তায় কিছুটা গিয়ে একটা বড়ো পুকুর পড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এখানে মাছ ধরার ব্যবস্থাও আছে নাকি?”
সিংজি জানালেন, “দিশি মাছের চাষ করেছি পুকুরে। ছিপ ফেললেই পড়বে। তবে আগে থেকে টাকা জমা দিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়।”
প্রায় আধঘণ্টা সময় লাগল পুরো জায়গাটা হেঁটে ঘুরতে। বেশ ভালো লাগল। সব ঘুরে-টুরে আবার আমরা ফিরে এলাম বাংলোয়। এবার সিঁড়ি দিয়ে ওঁর সঙ্গে উঠে গেলাম দোতলায়। সিংজি বললেন, “এবার আসি আসল কথায়। মানে কেন তোমাকে এখানে ডাকলাম। এই ফার্মিং হল আমার একটা শখ। আমার আর একটা নেশা আছে। সেটা ভারি অদ্ভুত। পুরানো দিনের টাইপরাইটার সংগ্রহ করা। তবে যে-কোনো পুরানো টাইপরাইটার নয়। সেটা যদি কোনও বিখ্যাত মানুষের ব্যবহার করা হয় তবেই। কিংবা কোনও রেয়ার জিনিস যেটা বিশেষ কোনও কারণে বিখ্যাত।”
একটি ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। পকেট থেকে একটা চাবির থোকা বের করে তালা খুললেন। আলো জ্বেলে বললেন, “এসো, ভিতরে এসো।”
বেশ বড়ো ঘর। চারদিকে দেয়ালে ঘুরিয়ে কাঠের সুন্দর শো-কেস। তাতে ভরতি বই। বাংলা, হিন্দি, ইংরাজি— তিনরকম ভাষার বই লক্ষ করলাম। তবে ইংরাজি বই-ই বেশি। সামনে একটা লম্বা মেহগনি কাঠের পালিশ করা টেবিল। তাতে কিছুটা পরপর বসানো আছে বিভিন্ন আকৃতির টাইপরাইটার। ছোটো, বড়ো, চ্যাপ্টা, পোর্টেবল— কতরকমের সাইজ। আঙুল তুলে বললেন, “আসলে এই নেশার শুরু আমার চাকরি জীবনে। তখন আমার রাজস্থানে সাঞ্চোর জেলায় পোস্টিং। রাজা সমরজিৎ সিংকে আমি একটা কেসের ব্যাপারে খুব সাহায্য করেছিলাম। সেজন্য খুশি হয়ে আমাকে রাজবংশের একটা দামি টাইপরাইটার উপহার দিয়ে ছিলেন। এই যে কাচের বাক্সে রাখা আছে। সিলভার এবং গোল্ড প্লেটেড। এটা উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা। অস্টিন কোম্পানির তৈরি। তবে বাকিগুলো সবই ব্রিটিশ আধিকারিকদের ব্যবহার করা জিনিস। এই যেমন এইটা কলকাতা হাইকোর্টে ব্যবহৃত হত স্বাধীনতার আগে। ১৯৩১ সালে এই টাইপরাইটারেই দীনেশ গুপ্তর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ টাইপ করা হয়েছিল।”
তানিয়াদি সিংজিকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “দীনেশ গুপ্ত মানে রাইটার্স বিল্ডিং মামলা?”
মাঝের সোফাতে ইশারায় আমাদের বসতে বলে সিংজি নিজেও বসলেন উলটোদিকে। মাথা নেড়ে জানালেন, “হ্যাঁ, বিনয়-বাদল-দীনেশের সেই দীনেশ। ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর বিপ্লবী বিনয় বসুর নেতৃত্বে তিনি ও বাদল গুপ্ত কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং ভবনে অভিযান চালিয়ে অত্যাচারী ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসনকে হত্যা করেন। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের অলিন্দে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের খণ্ডযুদ্ধে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ ইউরোপিয়ান কর্মচারী গুরুতরভাবে আহতও হন। এরপর তাঁরা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। অপর দুই বিপ্লবী বিনয় ও বাদল আত্মহত্যায় সমর্থ হলেও মৃতপ্রায় দীনেশকে পুলিশ বাঁচিয়ে তুলতে সক্ষম হয়। বিচারে তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়।”
“বাবা! সেই টাইপরাইটার আপনি কোথায় পেলেন?”
“অকশনে। ডালহৌসি চত্বরেই বেশ কয়েকটা অকশন হাউস থেকে এই জিনিসগুলো পেয়েছি।” একটু থেমে তিনি আবার বললেন, “ওই যে প্রথম বড়ো বাক্সটা বসানো আছে, ওটাও একটা টাইপরাইটার। প্রথম টাইপরাইটার তৈরি হয়েছিল ইতালিতে, ১৫৭৫ সালে। একজন প্রেসের মালিক ফ্রান্সেস্কো রামপাজেত্তো কাগজে অক্ষর ছাপানোর জন্য একটি যন্ত্র, স্ক্রিটুরা ট্যাটিল উদ্ভাবন করেন। সেটা ছিল আকারে অনেক বড়ো। তার প্রায় দেড়শ বছর পর ১৭১৪ সালে ইংল্যান্ডে হেনরি মিল অনেক মাথা খাটিয়ে একটা মেশিন তৈরি করেছিলেন। যেটা আধুনিক টাইপরাইটারের কাছাকাছি ছিল। এরপর ১৮০২ সালে ইতালীয় অ্যাগোস্টিনো ফ্যান্টোনি তাঁর অন্ধ বোনকে লিখতে সক্ষম করার জন্য একটা নির্দিষ্ট ধরনের টাইপরাইটার বানালেন। ১৮২৯ সালে এক আমেরিকান, নাম উইলিয়াম অস্টিন বার্ট, টাইপোগ্রাফার নামে একটি মেশিনের পেটেন্ট করেন যা প্রথম টাইপরাইটার হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়। সামনে ওই কাচের বাক্সে যে টাইপরাইটারটি রাখা আছে সেটা উইলিয়াম অস্টিন বার্ট দ্বারা ১৮৩২ সালে তৈরি দ্বিতীয় এডিশন। এ-জিনিস গোটা পৃথিবীতে আর এক-দুটো খুঁজে পাওয়া যাবে হয়তো।”
“এর তো অনেক দাম নিশ্চয়ই!”
“প্রায় অমূল্য। কম্পিউটার বাজারে আসার পর থেকে টাইপরাইটারের বাজার পড়তে শুরু করে। এখন তো তৈরিই বন্ধ হয়ে গেছে। আমি নিজে লেখালিখির ক্ষেত্রে জাপানি একটা টাইপরাইটার ব্যবহার করতাম, মানে এখনও করি। তবে শুধু আমার কাছে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টাইপরাইটারের মিউজিয়াম রয়েছে।”
তানিয়াদি একটুকরো হেসে জানতে চাইল, “আমি কিন্তু এখনও বুঝতে পারলাম না আপনি আমাকে কেন ডেকেছেন।”
“বলছি।” একটু দম নিয়ে সিংজি সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে জানালেন, “আসলে এর থেকেও মূল্যবান একটা টাইপরাইটার কলকাতায় এসেছিল। সেটা ছিল নেতাজির টাইপরাইটার। জিনিসটা ১৯৪২ সালে জার্মানির উইলসন কোম্পানির তৈরি। অর্ডার দিয়ে বানানো বিশেষ একধরনের টাইপরাইটার। জিনিসটা একবারই কলকাতার বিখ্যাত একটি অকশন হাউসে দেখা গিয়েছিল ১৯৫০ সালে।”
তানিয়াদি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমাকে কি সেই টাইপরাইটার খুঁজে দিতে হবে?”
সিংজির মুখটা মুহূর্তের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।— “একদম ঠিক ধরেছ। এই জন্যই তোমাকে আমি ডেকেছি। আমার এক বন্ধু, হাইকোর্টের সিনিয়র উকিল রমাকান্ত মিশ্র তোমার বুদ্ধির খুব প্রশংসা করলেন। তা তুমি যদি আমাকে সেই টাইপরাইটার খুঁজে দিতে পারো তাহলে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাবে।”
পরিচারক এসে দাঁড়াতে সিংজি জানালেন, “বেলা অনেক হয়েছে। চলো এবার লাঞ্চটা সেরে নেওয়া যাক। তারপর আবার গল্প হবে।”
“সেই ভালো।” বলে প্রথমেই উঠে দাঁড়াল ঝিন্টু।
লাঞ্চ না বলে তাকে রাজকীয় ভোজ বলা ভালো। পিতলের থালা, গ্লাস, ছোটো ছোটো বাটিতে সাজিয়ে দশরকমের পদ পরিবেশন করা হল ডাইনিং টেবিলে। সরু চালের সাদা ভাত আর পোলাওর সঙ্গে মাটন, চিংড়ি, কাতলা, ভেটকি থেকে শুরু করে পাঁচরকম সবজি, চাটনি, দই, মিষ্টি— সব মিলিয়ে এলাহি আয়োজন। প্রতিটা পদেরই অসাধারণ স্বাদ। ভদ্রলোক দেখলাম শুধু সবজি সিদ্ধ দিয়ে অল্প ভাত খেলেন।
ঝিন্টু পাত পরিষ্কার করে একটা বড়ো ঢেঁকুর তুলে চাপা গলায় জানতে চাইল, “নেক্সট আবার এখানে কবে আসা হবে?”
মুখে একটা করে ঠান্ডা মিঠে পাতার পান পুরে আমরা আবার স্টাডি রুমে এসে বসলাম। তানিয়াদি বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমাদের জন্য এত এলাহি আয়োজন না করলেও চলত।”
“আমার কাছে অতিথি হলেন নারায়ণ। তোমরা এতদূর থেকে আমার ডাকে সাড়া দিয়ে এসেছ, আমি কৃতজ্ঞ।”
“আপনার কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামী আর বিপ্লবীদের উপর অনেক বইয়ের কালেকশন আছে দেখছি।”
“হ্যাঁ। এই বিষয়ে আমার আগ্রহ আর পড়াশোনা দুটোই অনেক বছরের। ইংরাজি ভাষায় ভারতের স্বাধীনতার অনেক অজানা তথ্য নিয়ে বেশ কয়েকটা বইও প্রকাশিত হয়েছে আমার লেখা।”
“বাহ! খুব ভালো। তার মানে আপনি তো লেখালিখি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, আপনার ব্যাবসা দেখে কে?”
“রমেন, আমার নার্সারির ম্যানেজার। ব্যাবসা ও-ই দেখে। মেদিনীপুরের ছেলে। এখন এখানেই থাকে।”
“আচ্ছা, তাঁর সঙ্গে কি একবার দেখা করা যায়?”
“না। ওর মায়ের শরীরটা ক’দিন হল খুব খারাপ। হসপিটালে ভরতি। ছেলেটি গ্রামে গেছে গতকাল।”
আরও কিছুক্ষণ গল্প করে আমরা যখন উঠে পড়লাম, ভদ্রলোক একটা খাম এগিয়ে দিলেন তানিয়াদির দিকে। তানিয়াদি খামটা খুলে অবাক গলায় জানাল, “অ্যাডভান্স আমার লাগবে না সিংজি। কেসটা নেব কি না এখনও ঠিক করিনি। তাছাড়া সেই টাইপরাইটার তো ন্যাশনাল ট্রেজার। তার ওপর, এতদিনের পুরোনো একটা জিনিস আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে কি না আমি নিশ্চিত নই।”
ফেরার পথে গাড়ি যখন আবার ডায়মন্ডহারবার রোডে পড়ল, আমি গলা ঝাড়া দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কত টাকার চেক ফেরত দিলে?”
“পঞ্চাশ হাজার।”
ঝিন্টু মন্তব্য করল, “পেন্নাম তোমাকে!”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এবার কী করবে?”
তানিয়াদি কোনও উত্তর না দিয়ে একটা চিরকুট আমার দিকে এগিয়ে দিল। দেখলাম ইংরাজিতে একটা ঠিকানা লেখা রয়েছে কাগজে। ‘সলোমন অ্যান্ড কোং, ৩নং অকল্যান্ড রোড, ক্যালকাটা।’
জানতে চাইলাম, “এটা কী?”
“একটা অকশন হাউস।”
“যেখানে ওই টাইপরাইটারটি শেষ দেখা গিয়েছিল?”
“ঠিক ধরেছিস। কাগজটা খামে ছিল।”
“কিন্তু সে-কোম্পানি তো নিশ্চয়ই অনেকদিন আগেই উঠে গেছে। খুঁজে পাবে কী করে?”
“কাজটা অবশ্যই সহজ নয়। না-হলে উনি আমাকে ডাকতেন না। ভুলে যাস না ডালহৌসি চত্বরে যত পুরোনো অকশন হাউস আছে, সেখানে ওঁর ভালোই জানাশোনা। তার মানে উনি নিজে অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জিনিসটা ওঁর দ্বারা খুঁজে বের করা অসম্ভব বুঝে আমাকে দায়িত্ব দিলেন।”
ঝিন্টু মন্তব্য করল, “এত বড়ো শহরে একশো বছরের পুরোনো একটা টাইপরাইটার খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার শামিল।”
“হুম! তবে ভদ্রলোক যে অনেক ভেবেচিন্তে আমাকে বেছে নিয়েছেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছে।”
“কেন?”
“টাইপরাইটার কোথায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সেটা জানিস আশা করি?”
“কোর্টে। ও বুঝেছি। তুমি তো হাইকোর্টের উকিল আবার গোয়েন্দাগিরিও করো। সেই জন্যই কি তোমাকে দায়িত্ব দিলেন?”
“একদম তাই।”
তানিয়াদির গাড়ি কলকাতাতে ঢোকার পর বাবুঘাট দিয়ে ডানদিক বেঁকে স্ট্র্যান্ড রোড হয়ে হাওড়া ব্রিজের দিকে এগোতে লাগল। তবে ব্রিজে ওঠার বেশ কিছুটা আগে গাড়ি আবার ডানদিক বেঁকে ঢুকে পড়ল ক্যানিং স্ট্রিটে। কিছুটা এগিয়ে জেডি মেশিনারিসের সামনে রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে তানিয়াদি জানাল, “আজ নেহাত রবিবার, তাই এখানে পার্কিং পেলাম। অন্যদিন আসলে দেখবি মুটিয়ারা দলে দলে মাথায় করে, ঘাড়ে করে, ঠেলা করে মালের গাঁটরি নিয়ে দৌড়াচ্ছে।”
“এখানে কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“হাইকোর্ট চত্বরে একজন বয়স্ক টাইপরাইটারের মিস্ত্রি বসতেন। কম্পিউটারের বাড়বাড়ন্ত হওয়ার পরে ইদানীং আর আসেন না। ওঁর ঠিকানাটা আমার মনে আছে, কারণ আমার বাবার একটা পুরোনো আন্ডারউড কোম্পানির টাইপরাইটার সারানোর জন্য বাড়িতে এসেছিলেন। তখনই কথা বলে বুঝেছিলাম উনি এই ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ। নাম হীরালাল যাদব। খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার বিষয়ে যদি কেউ সাহায্য করতে পারেন তো তিনিই একমাত্র ব্যক্তি।”
কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে সরু গলির মধ্যে ঢুকে পড়লাম আমরা। ‘জেনারেল ইঞ্জিনিয়ারিং স্টোর’-এর পাশ দিয়ে গিয়ে পুরোনো বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি। ইলেকট্রিকের তার, টেলিফোনের তার, কোম্পানির ক্যাবল জড়ামড়ি করে মাকড়সার মতো জাল বিস্তার করেছে। হোর্ডিংগুলো লক্ষ করলাম। পুরো বাড়িটাতেই হাজাররকম মেশিনারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং পার্টসের দোকান। আমরা উঠে এলাম সোজা ছ’তলার মাথায়। মানে একদম ছাদে। উপর থেকে হুগলি নদী আর হাওড়া ব্রিজ দেখা যাচ্ছে দূরে। বিশাল বড়ো ছাদে ছোটো ছোটো খুপরি কোয়ার্টার।
একজন অবাঙালি মহিলা নীচে বসে স্টোভ জ্বেলে রান্না করছেন। তানিয়াদি এগিয়ে গিয়ে তাঁকেই জিজ্ঞেস করল, “হীরালাল যাদবকা ঘর কহাঁ হ্যাঁয়?”
মহিলা মুখ তুলে অবাক চোখে তাকালেন। প্রশ্নটা আবার করতে আঙুল তুলে দেখালেন কোণের একটা ঘরের দিকে। আমরা এগিয়ে গেলাম। পাঁচ নম্বর দরজায় ধাক্কা দিতে একজন শীর্ণকায় শ্যামলা বয়স্ক মানুষ বেরিয়ে এসে আমাদের দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সাদা চুল, দু-সপ্তাহের না কাটা দাড়ি, কপালে বলিরেখা, পরনে ময়লা নীল চেক লুঙ্গি আর শতছিন্ন স্যান্ডো গেঞ্জি। বয়স আশির গোড়ায়। তানিয়াদি নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সলোমন অ্যান্ড কোং, ৩নং অকল্যান্ড রোড, অকশন হাউস, ১৯৪৯ সালে একটা নিলামে জার্মানির উইলসন কোম্পানির ১৯৪২-এ তৈরি একটা টাইপরাইটার তুলেছিল। এটা ছিল বিশেষ ধরনের একটা পোর্টেবেল টাইপরাইটার। জিনিসটা কে কিনেছিল বা কোথায় গেল, সেটা খোঁজ করতে হবে। আমার বিশ্বাস, কলকাতায় আপনিই একমাত্র এই কাজটা করতে পারবেন।”
কথাটা শুনে বসে পড়লেন তিনি।— “ফির একবার বোলিয়ে ম্যাডাম। অভি হমে সুনাই কম দেতা হ্যায়।”
তানিয়াদি কথাগুলো ধীরে ধীরে আবার বুঝিয়ে বলল। এবারে লোকটা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে জানাল, “অকল্যান্ড রোড এখন আর নেই। সলোমন কোম্পানিও বহুবছর আগে উঠে গেছে। এখন তাদের খুঁজে পাব কেমন করে? তখন তো আমার বাপ-ঠাকুরদাও কলকাতায় আসেনি।”
“জানি যাদববাবু। কাজটা সহজ নয়। সেই জন্যই তো আপনার কাছে আসা। এই টাকাটা আপনি রাখুন। কাজটা করে দিতে পারলে অনেক বেশি পাবেন।” বলে তানিয়াদি সাইড ব্যাগ থেকে কয়েকটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে গুঁজে দিল লোকটার হাতে।— “আর এই আমার কার্ড। খবর পেলে ফোন করবেন।”
এক সপ্তাহ পরে তানিয়াদিকে ফোন করতে ও জানাল, “দু-দিন আগে সন্ধ্যায় যাদব ফোন করে বলল, সলোমন অ্যান্ড কোম্পানির মালিক জে. ডি. সলোমন ছিলেন জাতে পর্তুগিজ। তাঁর ছিল এক্সপোর্ট ইম্পোর্টের ব্যাবসা। তিনি ১৯৫২ সালে ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন। ওই কোম্পানি বহু যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করেছে। তার মধ্যে টাইপরাইটারও ছিল। কিন্তু ওই বিশেষ টাইপরাইটার নিলামে কে কিনেছিলেন, এত বছর পর তার খোঁজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবুও উনি চেষ্টা করবেন খোঁজ নেওয়ার।”
বলা বাহুল্য, তানিয়াদির বেশ কিছু অমীমাংসিত রহস্যের মতো এটাও ধামাচাপা পড়ে গেল।
***
সিঙ্গাপুর, ১৯৪৩।
জাপান সরকারের আতিথেয়তায় কোনও ঘাটতি নেই। নেতাজিকে রাখা হয়েছে টোকিওর সবথেকে অভিজাত ইম্পিরিয়াল হোটেলের রাজকীয় স্যুইটে। রুমের জানালা দিয়ে দেখা যায় সামনে সুসজ্জিত হাবিয়া পার্ক এবং আর একটু ডানদিকে পরিখা দিয়ে ঘেরা সম্রাটের প্রাসাদ ও বাগান। তবুও নেতাজি রীতিমতো বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। জার্মানি থেকে তিন মাস ধরে এত কষ্ট করে ডুবোজাহাজে করে টোকিও এসে পৌঁছলেন, তারপর প্রায় পনেরো-কুড়ি দিন হতে চলল প্রধানমন্ত্রী তোজো নেতাজির সঙ্গে দেখা করার জন্য কিছুতেই সময় দিচ্ছেন না। নানান কারণ দেখিয়ে তোজো সাক্ষাতের দিন পিছিয়েই চলেছেন। এদিকে অপেক্ষা করতে করতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছেন নেতাজি। হোটেলের ঘরে বসে দিনের বেশ কিছুটা সময় আবিদ হাসান নেতাজির ডিকটেশন নিয়ে টাইপ করেন সেই জাপানি টাইপরাইটারে। বাকিটা শুয়ে, বসে, চিন্তা আর পায়চারি করে সময় কাটে।
একদিন সকালে আবিদ দৌড়ে নেতাজির রুমে এসে জানালেন, “রাসবিহারী বসু আসছেন!”
নেতাজি কথাটা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটে বসার ঘরে এসে দেখলেন তেষট্টি বছরে ঋজু চেহারার বীর বিপ্লবীকে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেতেই রাসবিহারী বসু নেতাজিকে দু-হাতে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। অনেকক্ষণ জড়িয়ে থাকার পর দেখা গেল দুজনের চোখেই আনন্দাশ্রু ঝরছে।
“এবার আমার মুক্তি সুভাষ, মুক্তি! তোমাকে দেখে আজ আমার যে কী পরিমাণ আনন্দ হচ্ছে তা বোঝাতে পারব না। এখন আমি তোমাকে সবকিছু সঁপে দিয়ে সন্ন্যাস নেব।”
“এত তাড়াতাড়ি আপনার সন্ন্যাস নেওয়া হচ্ছে না দাদা। আগে ভারত স্বাধীন হোক, লালকেল্লায় তেরঙ্গা ঝান্ডা উড়ুক, তারপর আপনাকে ছুটি দেব।”
দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলেন। রাসবিহারী বসু চেয়ারে বসে বললেন, “তুমি যদি আরও এক বছর আগে এদিকে আসতে পারতে, আমাদের অনেক সুবিধা হত সুভাষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে জার্মানি, ইতালি আর জাপানের মিলিত অক্ষশক্তি যেভাবে শত্রুপক্ষকে নাস্তানাবুদ করেছিল, সেই সময় যদি আমরা সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম তাহলে হয়তো এতদিনে লালকেল্লায় তেরঙ্গা উড়ত।”
রাসবিহারী বসু ছাড়াও টোকিওতে এসে নেতাজির সঙ্গে একে একে দেখা করলেন আনন্দমোহন সহায়, মণিভাই দোশি, এ. এম. নায়ার, মূর্তি, সাংবাদিক নারায়ণ, বিনায়ক সুপনেকার। এঁদের সবার সঙ্গে আলোচনা করে নেতাজি বুঝে নেবার চেষ্টা করছিলেন কীভাবে আজাদ হিন্দ বাহিনীকে পরিচালনা করবেন। জাপানে আসার প্রায় কুড়ি দিন পর প্রধানমন্ত্রী তোজো নেতাজিকে ডেকে পাঠালেন আলোচনার জন্য। এর আরও কিছুদিন পর ২৬ জুন নেতাজিকে তোজো আমন্ত্রণ জানালেন জাপানের সংসদ অধিবেশনে। এই প্রথম নেতাজি জনসমক্ষে এলেন। তোজো নেতাজিকে সঙ্গে নিয়ে ঘোষণা করলেন, ‘ভারত আমাদের বন্ধু দেশ। ভারতের স্বাধীনতার জন্য জাপান সরকার বিনা শর্তে আজাদ হিন্দ ফৌজকে সবরকম সাহায্য করবে।’ তোজোর এই একটা কথায় নেতাজির মনের সমস্ত কালো মেঘ কেটে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি টোকিও ছেড়ে সিঙ্গাপুরে এসে উপস্থিত হলেন। সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজের হেড-কোয়ার্টারে দাঁড়িয়ে কর্নেল ভোঁসলে আর নেতাজিকে সঙ্গে নিয়ে রাসবিহারী বসু ঘোষণা করলেন, ‘দীর্ঘ চল্লিশ বছরের চেষ্টায় গড়ে তোলা আজাদ হিন্দ ফৌজের সমস্ত দায়িত্ব আমি এখন থেকে সুভাষের হাতে তুলে দিলাম।’ উচ্ছ্বসিত করতালিতে ভরে গেল সভাগৃহ।
৬ জুলাই নেতাজি সিঙ্গাপুরের প্যাডং ময়দানে একটা মিটিং ডেকেছেন। কাতারে কাতারে মানুষ এসে ভিড় জমিয়েছে। মাঠে আর তিলধারণের জায়গা নেই। পূর্ব এশিয়ায় তিরিশ লক্ষ ভারতীয়ের বাস। অনেকেই নেতাজিকে একবার দেখার জন্য, একটু কথা শোনার জন্য সকাল থেকে এসে হাজির হয়েছে সিঙ্গাপুরে। এদিকে আকাশের মুখ ভার। যে-কোনো সময়ে ঝেঁপে বৃষ্টি নামতে পারে।
দেশপ্রেম নিয়ে কয়েকটা গানের পরে ফৌজি পোশাকে নেতাজি উঠে দাঁড়ালেন। লাখ লাখ মানুষের করতালিতে গর্জে উঠল প্যাডং ময়দান। মানুষের মনে চূড়ান্ত উদ্দীপনা। নেতাজি বলতে শুরু করলেন কেন তাঁকে দেশ ছাড়তে হল, কীভাবে তিনি এখানে এসে পৌঁছলেন। এরপর তিনি জনসমুদ্রের কাছে করজোড়ে আবেদন জানালেন, “দেশকে স্বাধীন করতে হলে ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে সম্মুখসমরই একমাত্র পথ। সেজন্য অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকার গড়ে তুলতে হবে। দলে দলে যোগ দিন আজাদ হিন্দ ফৌজে। আমি বীর সেনানীদের বলেছি, তোমরা আমায় রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। আজ আপনাদের বলছি, আপনারা আমাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করুন, আমি আপনাদের স্বাধীনতা এনে দেব।”
আচমকা প্রচণ্ড মেঘ গর্জে শুরু হল অঝোর বৃষ্টি। নেতাজি ভিজছেন, লাখ লাখ মানুষ খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে ভিজছে। নেতাজি বলে চলেছেন অনর্গল। নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবার পোশাক বৃষ্টিতে ভিজে জড়িয়ে গেছে শরীরের সঙ্গে। মায়ের কোলে বাচ্চারাও ভিজছে। টানা আড়াই ঘণ্টা বক্তব্য রেখে নেতাজি শান্ত হলেন। বৃষ্টিও ধরে এল। তারপর তিনি ভিতরে গিয়ে বসলেন। বাইরে বিশাল লাইন তৈরি হয়েছে। ধনী ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, সবাই দেশমাতৃকার জন্য নেতাজির তৈরি করা দানের ঝুলিতে নিজেদের সামর্থমতো কিছু দিতে চান। গৃহবধূরা এগিয়ে এসে নিজের শরীর থেকে সমস্ত সোনার গহনা খুলে ঢেলে দিচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা নোটের বান্ডিল রেখে যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ যথাসাধ্য দান করছেন নেতাজির চরণে। নেতাজিও নতমস্তকে সেই দান গ্রহণ করছেন।
দূরে দাঁড়িয়ে ময়লা কাপড় পরিহিতা এক তামিল বৃদ্ধা অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন নেতাজির দিকে। এরকম সৌম্য দেবতুল্য পুরুষ তিনি এর আগে কখনও দেখেননি। অনেক বছর আগে তিনি স্বামীর সঙ্গে দেশ ছেড়ে সিঙ্গাপুরে চলে এসেছিলেন কাজের খোঁজে। তাঁর স্বামী ইতোমধ্যে কলেরায় মারা গেছেন। এখন তিনি একা জনমজুরের কাজ করে দিন চালান। নেতাজির কথা এতক্ষণ ধরে শুনছিলেন তিনি মন দিয়ে। অনেক কিছুই বোধগম্য হয়নি তাঁর। কিন্তু একটা কথা বুঝেছেন, দেশকে ইংরেজ শাসকদের থেকে মুক্ত করতে হলে সবাইকে সাহায্য করতে হবে। তাঁরও ইচ্ছা তিনি নেতাজিকে কিছু দেন। কিন্তু তাঁর কাছে তো প্রায় কিছুই নেই। সারাজীবনের একমাত্র সঞ্চয় তিনটে টাকা। অনেক সংকোচের পর ধীর পায়ে তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন লাইনে। গুটি গুটি পায়ে সবার সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন নেতাজির সামনে। দেবদূতের সামনে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন নেতাজির মুখের দিকে তাকিয়ে। নেতাজি এক পা এগিয়ে এসে দু-হাত জড়ো করে দাঁড়ালেন দুঃখিনী মায়ের সামনে। বৃদ্ধা তাঁর সারাজীবনের সঞ্চয় তিনটি রূপোর কয়েন নেতাজির হাতে তুলে দিলেন। তিনি দেখলেন কিং এম্পেরর ষষ্ঠ জর্জের রূপোর তৈরি একটাকার কয়েন। নেতাজি বৃদ্ধা মাকে প্রণাম করে কয়েনগুলো দানপাত্রে না দিয়ে রেখে দিলেন নিজের কাছে।
***
হাওড়া স্টেশন।
রাত সাড়ে দশটা বাজার আগেই আমি আর ঝিন্টু পৌঁছে গেছি বড়ো ঘড়ির নীচে। মোকামা এক্সপ্রেস ছাড়বে রাত এগারোটা কুড়িতে। তাই হাতে অনেকটা সময় আছে এখনও। তানিয়াদি আমাদের এখানেই দাঁড়াতে বলেছে। শ্রী হোয়াটস-অ্যাপ করেছে, ওলাতে আসছে। মিনিট দশেকের মধ্যেই ঢুকবে। হাওড়া স্টেশনের পুরোনো প্ল্যাটফর্মে এই বড়ো ঘড়ি সবসময়ই সরগরম একটা জায়গা। যে-কোনো মানুষের সহজ মিটিং পয়েন্ট। সামনেই একটা বড়োসড়ো দল এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই নীল টুপি পরে সেলফি তুলছে মোবাইলে।
এর মধ্যেই একটা অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটল আমাদের সামনে। একটা বামন লোক, মানে ফুট তিনেক উচ্চতা হবে, হনহন করে হেঁটে যাচ্ছিল ভিড়ের মধ্যে দিয়ে। এদিকে ওই নীল টুপি পরা লোকগুলোর মধ্যে একজন সেলফি তোলার উত্তেজনায় পিছতে গিয়ে বামন লোকটার ঘাড়ে পড়ে গেছে। দুজনেই গড়াগড়ি। বামন লোকটা গালাগাল দিয়ে এই মারে তো সেই মারে। নীল টুপি পরা লোকটাও ছাড়ার পাত্র নয়। ঝামেলা দেখে রেল পুলিশ দৌড়ে এসে তাদের ছাড়াল। রাগে গরগর করতে করতে পিঠের ব্যাগটা তুলে নিয়ে বামন লোকটা চোখের নিমেষে মিশে গেল ভিড়ের মধ্যে।
একদল অচেনা লোকেদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরাও মজা দেখছিলাম। পিছন থেকে আওয়াজ শুনে ঘুরে দেখি শ্রী উপস্থিত।— “কী কেস? এত ভিড় কেন?”
“আর বলিস না, শুম্ভ-নিশুম্ভর মল্লযুদ্ধ দেখছিলাম। চল, তানিয়াদি আসার আগে ফুড প্লাজাতে ঘুরে আসি। রাতের জন্যও কিছু খাবার প্যাক করে নিতে হবে। মোকামা এক্সপ্রেসে প্যান্ট্রি কার নেই।” ঝিন্টুর মাথায় সবসময়েই খাবারের চিন্তা ঘোরে।
ঘড়ি দেখলাম। বড়ো কাঁটা এগারোটা ছুঁইছুঁই। ডিসপ্লে বোর্ডে ট্রেন দিয়ে দিয়েছে, পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্ম। আমরা তাড়াতাড়ি ডিনার থালি প্যাক করে দৌড় দিলাম এস-টু’র দিকে। তানিয়াদি মেসেজ করেছে, ওর গাড়ি জ্যামে আটকে আছে। তাই আসতে দেরি হচ্ছে।
“এই ট্রেনে এসি নেই?”
ঝিন্টুর প্রশ্নের জবাবে বললাম, “নো স্যার, পুরোটাই জেনারেল আর সেকেন্ড ক্লাস স্লিপার। আমাদের রিজার্ভেশন আছে। হাওড়া থেকে শিমুলতলা এটাই একমাত্র ট্রেন। নইলে অন্য স্টেশনে নামতে হবে, জোসিডি অথবা ঝাঁঝা। দু-জায়গা থেকেই শিমুলতলার দূরত্ব কমবেশি কুড়ি কিলোমিটার। তাই তানিয়াদি এই ট্রেনেই টিকিট কেটেছে।”
“কিন্তু তানিয়াদি কোথায়?”
শ্রীর প্রশ্নটা শেষ হওয়ার আগেই পিছন থেকে আওয়াজ এল, “চল চল, উঠে পড়।”
দেখি লেদার জ্যাকেট, পিঠে ব্যাগ আর ছোটো ট্রলি নিয়ে হাজির তানিয়াদি। সিট খুঁজে বসে দেখলাম বগি বেশ ফাঁকাই যাচ্ছে। ট্রেন ছেড়ে দিল ঠিক সময়েই। সবাই গুছিয়ে বসতে আমি জানতে চাইলাম, “এবার সব খুলে বলো তো! হঠাৎ করে শিমুলতলা কেন?”
রহস্যাবৃত মুখে তানিয়াদি উত্তর দিল, “একটা অরিজিনাল ভূতের বাড়ির খোঁজ পেয়েছি শিমুলতলায়। তোরা তো অনেকদিন ধরেই বলছিলি না ভূত দেখবি? এতদিন কত জায়গাতেই আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি, কিন্তু সত্যিকারের ভূতের বাড়ির দেখা একটাও পাইনি। এবারে মনে হচ্ছে সেই আশা পূরণ হবে।” কথাটা বলে নিজেই হেসে উঠল তানিয়াদি।
আমি বললাম, “বাজে কথা বলো না। তুমি তো নিজেই ভূতে বিশ্বাস করো না। অরিজিনাল তুমি কোনোদিনই দেখতে পাবে না। ঠাকুমা বলত, যারা ভূতে বিশ্বাস করে, ভূত শুধু তাদেরই দেখা দেয়।”
আমাকে গোঁত্তা মেরে ঝিন্টু উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করল, “বলো কী! সত্যিকারের ভূতের বাড়ি?”
“বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলো দেখি।”
সময়টা মাঘ মাসের শেষ। শীত এখনও পুরোপুরি যায়নি। ট্রেন যেই ফুল স্পিডে ছুটতে শুরু করেছে, জানালা আর গেটের ফাঁকফোকর দিয়ে ফুরফুর করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকতে শুরু করল। তানিয়াদি ব্যাগ থেকে একটা কালো শাল বের করে জ্যাকেটের উপর দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে সিটের উপর পা তুলে বসল। একটা ডায়েরি বের করে রাখল কোলের উপর। তারপর ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে দিল একে একে আমাদের সবার হাতে ধরা কাগজের কাপে।
ডায়েরির পাতা খুলে চোখ বুলিয়ে নিয়ে দুলন্ত ট্রেনের মধ্যে ধোঁয়া-ওঠা চায়ে সাবধানে চুমুক দিল তানিয়াদি। তারপর শুরু করল, “তখন সারা ভারতবর্ষ তথা বাংলায় স্বাধীনতার আগুন জ্বলছে। এর মধ্যেই কলকাতার বেশ কিছু বনেদি ব্যবসায়ী মুনাফার পাহাড় করে ফেলেছেন ইংরেজদের সঙ্গে ব্যাবসা করে। তাঁরা কখনোই চাইত না যে ভারত থেকে ইংরেজরা চলে যাক। তাহলে তাঁদের ব্যাবসার মস্ত ক্ষতি হবে। এমনই একজন বিত্তশালী মানুষ ছিলেন মন্মথনাথ ধর। জীবনের শুরুতে তিনি এক সাহেবের অপিসে সাধারণ কর্মচারী ছিলেন। সেই সাহেব ভারত থেকে চা, চিনি, মশলা, সুতির কাপড় এবং আরও হরেকমাল ইংল্যান্ড, আমেরিকা-সহ বিভিন্ন দেশে সাপ্লাই করতেন। আবার ওইসব দেশ থেকে প্রচুর জিনিস ভারতে নিয়ে আসতেন। সাহেব ছিলেন নিঃসন্তান। এদিকে মন্মথনাথ ছিলেন প্রচণ্ড কর্মঠ, বুদ্ধিমান আর চালাক মানুষ। সাহেবের পুরো ব্যাবসার হাল ধরতে বেশি সময় লাগল না তাঁর। মন্মথনাথ সেই ব্যাবসাকে তিন-চারগুণ বাড়িয়ে ফুলে-ফেঁপে বিশাল ধনী হয়ে উঠলেন কয়েক বছরের মধ্যে।”
চায়ের কাপ শেষ করে তানিয়াদি একটু দম নিল। ওর চোখটা মাঝে-মাঝেই চলে যাচ্ছে ডায়েরির পাতায়।— “সেই সময় স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য অনেকেই পশ্চিমে এসে কিছুদিন কাটিয়ে যেতেন। মধুপুর, গিরিডি, হাজারিবাগ, দেওঘর, শিমুলতলা ইত্যাদি জায়গাতে, মানে এই ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের খনিজ জল হজমের পক্ষে খুবই ভালো। সেজন্য পেটের রোগে ভোগা লোকেদের ডাক্তার পশ্চিমে চেঞ্জে পাঠাতেন। অবস্থাপন্ন পরিবারের মানুষ এসব জায়গাতে কম দামে জমি কিনে বাড়ি বানিয়ে রাখতেন, যাতে বছরে দু-তিনবার এখানে এসে থাকা যায়। সাহেব ওঁর স্ত্রীর স্মৃতিতে ‘মার্গারিটা হাউস’ নামে একটি বাড়ি বানিয়েছিলেন শিমুলতলায়। মন্মথনাথবাবুর জীবনের শেষ সময়টাও ওই বাড়িতেই কেটেছিল। ওখানেই মারা যান ১৯৫২-তে। সে-মৃত্যু নাকি স্বাভাবিক ছিল না। ওঁর দুই মেয়ে আর তিন ছেলে। তাঁরা কেউই পরবর্তী সময়ে ওই বাড়িতে খুব একটা যেতেন না। ১৯৬৫-তে বাড়িটা জলের দরে কিনে নেন রমাকান্ত দত্ত। তিনি ছিলেন কটক শহরের নামকরা ব্যারিস্টার। কিন্তু বাড়িটা কেনার কিছুদিনের মধ্যে তিনিও ওই বাড়িতেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। মৃত্যুর সময় ব্যারিস্টারের বয়স হয়েছিল বাষট্টি। ওই বয়সেও খুব শক্তসমর্থ এবং স্বাস্থ্যবান মানুষ ছিলেন। আচমকা হার্টফেল করে মারা যাওয়ার কোনও কারণ খুঁজে পাননি ওঁর পরিবারের লোকেরা। এরপর ওই মার্গারিটা হাউস টানা দশ বছরের বেশি সময় বন্ধ ছিল। এক কেয়ারটেকার ছিল দেখাশোনার জন্য। কিন্তু সেও মাসোহারা নিয়মিত পেত না আর বাড়িটা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মলিন হচ্ছিল। ১৯৭৭-এ তৃতীয়বার হাতবদল হয় ওই বাড়ির। কেনেন বাংলা সিনেমার এক নায়িকা অন্তরা গুহ। অন্তরাদেবীর তখন যৌবন শেষের দিকে। পঞ্চাশের কাছে বয়স। মাসি, পিসি, ঠাকুমার রোল ছাড়া কিছু জুটছে না টলিপাড়ায়। এদিকে পেটের সমস্যায় শরীরটাও সঙ্গ দিচ্ছে না। অতঃপর ডাক্তার পরামর্শ দিলেন চেঞ্জে যাওয়ার।”
শ্রী হঠাৎ তানিয়াদিকে থামিয়ে বলে উঠল, “অন্তরাদেবীর সিনেমা আমি দেখেছি। ‘রূপনগরী’। সেই ছবিটারও পশ্চিমে শুটিং হয়েছিল।”
“ঠিক। মধুপুর আর শিমুলতলাতে শুটিং হয়েছিল সেই সিনেমার। কিন্তু সেটা তো ছয়ের দশকের ছবি, তুই দেখলি কোথায়?”
শ্রী জানাল, “এখন সব পুরোনো সিনেমা ইউটিউবে পাওয়া যায়। দিদা এসে ক’দিন ছিল আমাদের কাছে। রোজ পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমা খুঁজে দিতে হত ইউটিউবে। তখনই কিছুটা দেখেছি ছবিটা।”
তানিয়াদি মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা। সেই রূপনগরীর নায়িকা অন্তরাদেবী যৎসামান্য মূল্যে শিমুলতলায় ওই বাড়িটা কিনলেন ব্যারিস্টারের পরিবারের কাছ থেকে। কিন্তু তাঁর ভাগ্যেও ওই বাড়ি ভোগ করা ছিল না। মার্গারিটা হাউসে আসার এক সপ্তাহের মধ্যে অন্তরাদেবী দোতলার ছাদ থেকে নীচে পড়ে মারা যান।”
“সে কি!”
“কেন?”
আমাদের সমবেত উৎসাহ দেখে তানিয়াদি আবার ডায়েরির পাতা ওলটাল।— “এত বছর পর আর বিস্তারিত জানার কোনও উপায় নেই। তবে সেই সময়ের এক ফিল্ম ম্যাগাজিনে অন্তরাদেবীর মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কিছুটা হুলুস্থুলুও হয়েছিল। আত্মহত্যা, না দুর্ঘটনা? তবে সে-রহস্যের কিনারা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। কিন্তু মার্গারিটা হাউসের দরজা সেই সময় থেকেই পাকাপাকিভাবে বন্ধ হল। কারণ, ভূতের ভয়। এলাকার মানুষ দিনের বেলাতেও ভয়ে পাঁচিলের ভিতর পা দিত না। ফলে আগাছা আর জঙ্গলে ভরে গেল পুরো পাঁচ একর এলাকা। পরপর তিনজন মালিকের রহস্যজনক মৃত্যু ঘটেছে। সেজন্য বাড়িটা এখনও পর্যন্ত আর বিক্রিও হয়নি। প্রায় সাতচল্লিশ বছর ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।”
তানিয়াদির কথা শুনে আমরা অনেকক্ষণ গুম খেয়ে বসে রইলাম। তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সে-সব তো অনেক পুরোনো ঘটনা। এত বছর পর হঠাৎ ভূতের প্রসঙ্গ উঠল কেন?”
“বলছি।” বলে তানিয়াদি বোতল থেকে কয়েক ঢোঁক জল খেয়ে বলল, “মাস খানেক আগে হাইকোর্টে আমার চেম্বারে একজন ভদ্রলোক এসে হাজির হয়েছিলেন। নাম গৌরাঙ্গ দাস। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তিনি নিজেকে অন্তরা গুহর আত্মীয় হিসেবে পরিচয় দিলেন। অন্তরাদেবীর নিজের কোনও সন্তান ছিল না। ওঁরা তিন বোন। তাঁদের ছেলেমেয়ে এবং পরের জেনারেশন এখন উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর সমস্ত প্রপার্টির মালিক। তাঁরাও সবাই দেশে বিভিন্ন শহরে এবং দেশের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছেন। গৌরাঙ্গ দাস পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি পেয়েছেন সম্পত্তি লিকুইড করার। সেই সূত্রে শিমুলতলার জায়গাটা জঙ্গল পরিষ্কার করে ভদ্রস্থ করেছেন সম্প্রতি। কিন্তু সেখানে আবার শুরু হয়েছে ভূতের উপদ্রব।”
“কীরকম?”
“বাড়ির শুদ্ধিকরণের জন্য গৌরাঙ্গবাবু সপ্তাহ খানেক আগে কলকাতা থেকে নামি তন্ত্রসাধককে নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে যজ্ঞ করার জন্য। কিন্তু একরাত থেকেই সেই তান্ত্রিক ভিরমি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। ভোরের আলো ফোটার আগেই শাগরেদ-সহ পাততাড়ি গুটিয়ে তিনি পালিয়ে গেছেন। এর মধ্যে কতটা গুজব, কতটা সত্যি, আদৌ সে-বাড়িতে কোনও ভূতুড়ে ব্যাপার আছে কি না সেটা দেখার জন্য গৌরাঙ্গবাবু আমাকে অনুরোধ করলেন।”
আমি ডিনারের প্লেটগুলো খুলে সবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মজা করে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, তুমি তাহলে ওকালতি আর গোয়েন্দাগিরির পাশাপাশি ভূত ধরার কাজও শুরু করলে?”
তানিয়াদি মজাও করে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, তা বলতে পারিস। এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি হিসেবে এটাও আমার প্রোফাইলে যোগ হল। হাতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেস কিছু নেই। ভাবলাম ভূতের অছিলায় তোদের নিয়ে গিয়ে দু-দিন ছুটিই কাটিয়ে আসি। সমস্ত খরচ তো গৌরাঙ্গবাবুই দিচ্ছেন।”
ঝিন্টু প্রশ্ন করল, “তোমার কী মনে হয়, ওই বাড়িতে সত্যিই ভূত আছে?”
উত্তর দেওয়ার বদলে তানিয়াদি বলল, “এখনকার দিনে ভূতে বিশ্বাস ব্যাপারটা হাসির খোরাক। আবার বিশ্বের সমস্ত রহস্য যে আমরা জেনে বসে আছি তেমনটাও নয়। মানুষের অবচেতন মনে অনেক কিছু বাসা বেঁধে থাকে। আমরা সচেতনভাবে সেটা জানতেই পারি না। সেজন্য কিছু কিছু মানুষের মনে হ্যালুসিনেশন হতে পারে। কিন্তু আমি ভাবছি, তান্ত্রিক অভয় শাস্ত্রী তো বেশ নামকরা ব্যক্তি। ওঁর ফিজও অনেক হাই। তিনি সে-রাতে একাও ছিলেন না। দুজন শাগরেদ ছিল সঙ্গে। উনি যেভাবে তাড়াহুড়ো করে পালিয়ে গেলেন, সেটা খুব একটা স্বাভাবিক নয়। ওখানকার পুলিশ তদন্তে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। শুনে মনে হল কেসটা ধামাচাপা দিতে পারলে বাঁচে।”
আমি মন্তব্য করলাম, “আচ্ছা, অন্য কেউ বাড়িটা দখল করতে চাইছে না তো?”
“হ্যাঁ, এই প্রশ্নটা আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম গৌরাঙ্গবাবুকে। উনি বললেন, স্থানীয় দালালদের সঙ্গে উনি কথা বলে বাড়ি-সমেত পাঁচ একর জায়গা একেবারে জলের দামে ছেড়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু তাতেও পাঁচিলের ভিতরে কেউ পা ফেলতে চাইছে না। সবার মনে দৃঢ় বিশ্বাস, ওই বাড়িতে অতৃপ্ত আত্মারা এখনও নাকি ঘুরে বেড়ায়। সে কাউকে ওখানে ঢুকতে দেবে না।”
এতক্ষণে গোটা কম্পার্টমেন্ট আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে। টিমটিমে বাতির নীচে আমরাই যেন চারজন জীবিত মানুষ। ট্রেন বর্ধমান স্টেশন ঢুকছে। ঘড়িতে দেড়টা বাজে। স্লিপিং ব্যাগ বের করে আমি উঠে গেলাম আপার বার্থে। ঘুমে চোখ টানছে।
***
পেনাং।
সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজের হেড অফিসে বড়ো টেবিলের উপর ছড়ানো বিশাল সামরিক মানচিত্র। নেতাজি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছেন আর স্কেল ফেলে সিঙ্গাপুর থেকে ইম্ফলের দূরত্ব মাপছেন। সঙ্গে রয়েছেন শাহনওয়াজ, প্রেম সায়গল আর ইয়েলাপ্পা। নেতাজি বললেন, “দেখো, এইটুকু জায়গার মধ্যে একদিকে ভিড় করেছে কত নদী, খাল-বিল, উঁচু পাহাড় আর একদিকে বিস্তীর্ণ সাগর। তবু এর বাস্তব দুর্গমতা মানচিত্রে বোঝা সম্ভব নয়। সেটা বুঝতে গেলে আমাকে একবার ওইসব জায়গায় নিজে গিয়ে ঘুরে আসতে হবে।”
সেনা আধিকারিক প্রেম সায়গল বিস্ময় প্রকাশ করলেন, “এই রাস্তা এখনও আপনার জন্য নিরাপদ নয় নেতাজি। বরং আমরা ক’জন গিয়ে ঘুরে এসে রিপোর্ট করছি আপনাকে।”
নেতাজি মাথা নেড়ে জানালেন, “না, আমাকে যেতেই হবে। সিঙ্গাপুরের পরে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড আর ব্রহ্মদেশ পেরিয়ে তবে ভারতের পূর্ব সীমান্ত। মালয়েশিয়ার পরে হয় সাগর পেরোতে হবে, নইলে থাইল্যান্ডের ঘন জঙ্গল। তারপর ব্রহ্মদেশ হয়ে ভারতে যেতে হলে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পেরোতে হবে চিন্দুইন, সালুইন আর ইরাবতীর মতো পাহাড়ি নদী। মাঝে পড়বে কাবোয়ার দুর্গম উপত্যকা। সবশেষে আমাদের বাহিনী পৌঁছাবে ঘন জঙ্গলে ঢাকা মণিপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে। যতটা সহজে আমরা পরিকল্পনা করছি, বাস্তবে বাহিনীকে এই রাস্তায় নিয়ে যেতে হলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। সেজন্য আমাদের প্ল্যান আরও নিখুঁত হওয়া চাই। আমি নিজেই যাব। তোমরা প্রস্তুতি নাও।”
মালয়েশিয়ার পূর্ব তীরে আন্দামান সাগরের কোলে পেনাং বন্দরের কাছে আজাদ হিন্দ ফৌজের ট্রেনিং ক্যাম্প চলেছে। সামনে নীল সমুদ্র আর পিছনে মালয়ের ঘন জঙ্গল। নেতাজি সিঙ্গাপুর থেকে জাপানি মিলিটারি এয়ারক্রাফটে শিবির পরিদর্শনে এসেছেন। দু-দিন এখানে থেকে সোজা চলে যাবেন রেঙ্গুনে। বার্মার উপর দিয়েই আজাদ হিন্দ ফৌজ মার্চ করবে আইজল আর ইম্ফলের উদ্দেশে। তার সবরকম প্রস্তুতি চলছে। তাই আগে থেকে রেঙ্গুনে গিয়ে সেখানকার সামরিক ঘাঁটির পদাধিকারীদের সঙ্গেও শলাপরামর্শ করতে হবে নেতাজিকে।
প্রতিদিন ভোর থেকে ফৌজি কসরত শুরু হয় শিবিরে। সেদিন কর্নেল ভোঁসলেকে সঙ্গে নিয়ে নেতাজি সবকিছু ঘুরে দেখছেন। টানা তিন ঘণ্টার কঠিন পরিশ্রমের পরে দুপুরের হালকা খাবার খেয়ে একটা বড়ো হল ঘরে বাহিনীর থিওরি ক্লাস শুরু হল। বড়ো সাদা কাপড় টাঙিয়ে প্রজেক্টরের মাধ্যমে বিভিন্ন বিদেশি যুদ্ধাস্ত্রের ছবি দেখানো হচ্ছে সেখানে। জাপানি সেনা অফিসাররা শেখাচ্ছেন কীভাবে শত্রুপক্ষের ট্যাংক, যুদ্ধজাহাজ, বোমারু বিমান ধ্বংস করতে হয়। নেতাজিও মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছেন সবকিছু। আচমকা হলের বাইরে একটা কোলাহল শোনা গেল। নেতাজি আর কর্নেল ভোঁসলে চেয়ার ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। সামরিক পোশাক পরা দুজন ব্যক্তিকে অন্য সেনা অফিসাররা ঘিরে ধরে ঘুসি, লাথি আর চাবুক দিয়ে বেদম প্রহার করছেন আর চেঁচিয়ে বলছেন, “বেইমান দেশদ্রোহী! বিশ্বাসঘাতক! বল কী জানিস ওদের বিষয়ে?”
লোক দুটো চিৎকার করতে করতে মার খেয়ে চলেছে। কিন্তু কিছুতেই মুখ খুলছে না। লোকগুলোর মধ্যে একজন মাঝবয়সি আর একজন অল্পবয়সি বেশ সুন্দর দেখতে একটা ছেলে। দুজনকেই মারধোর করে প্রায় আধমরা করে মাটিতে ফেলে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল সেপাইরা। ব্যাপারটা কী হচ্ছে দূর থেকে বুঝতে পেরে নেতাজি আর কর্নেল ভোঁসলে কাছে এগিয়ে গেলেন না। ফিরে এসে নিজেদের ঘরে যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। কিন্তু সন্ধ্যার পরে টেবিলে যখন সবাই একসঙ্গে খেতে বসলেন, রীতিমতো অবাক হয়ে গেলেন নেতাজি। তিনি দেখলেন, দুপুরের সেই বেদম মার খাওয়া লোকগুলো সারা গায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে ওঁদের সঙ্গেই টেবিলে খেতে বসেছে। নেতাজি ভাবলেন, সেই বেইমান দেশদ্রোহীগুলো সেনা অফিসারদের সঙ্গে এক টেবিলে খেতে বসার সাহস পেল কোথা থেকে? মেজর স্বামীর দিকে তাকিয়ে নেতাজি অবাক গলায় জানতে চাইলেন, “কী ব্যাপার! এদের না দুপুরে মেরে শিবির থেকে বের করে দেওয়া হল?”
মেজর স্বামী হো হো করে হেসে উঠে জানালেন, “এরকম রোজই দু-তিনজনকে মেরে বের করে দেওয়া হয় নেতাজি। আবার তারা ফিরে আসে।”
“মানে?”
“এটা আমাদের ট্রেনিংয়েরই অঙ্গ নেতাজি।”
অল্পবয়সি তরুণ ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “নেতাজি, আপনি যখন আমাদের ভারতে পাঠাবেন, তখন যদি দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়ি, তাহলে ব্যাপারটা এরকমই হবে, তাই না? তখন কি আমরা সবাই মারের চোটে সব কথা বলে দেব? সেটা যাতে না হয়, শরীরটাকে আগে থেকে সইয়ে নিতে হবে তো? জানেন তো, শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়।”
কথাটা শুনে আর একবার সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন। নেতাজি কিছুক্ষণ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন সেই তরুণের দিকে। তাঁর চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। জিজ্ঞেস করলেন, “কী নাম তোমার?”
“আজ্ঞে, আমার নাম অমরেন্দ্রনাথ হালদার।”
“ছেলেটা দু-বছর আগে ওকালতি ছেড়ে সিঙ্গাপুরে এসে রাসবিহারী বসুর পা জড়িয়ে ধরে বলল আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগ দিতে চায়। সেই থেকে রয়ে গেল আমাদের সঙ্গে।”
***
শিমুলতলা।
জায়গাটা এককথায় অপূর্ব সুন্দর। আমরা উঠেছি মুখার্জি ভিলাতে। স্টেশনে নেমে অটো করে মিনিট দশেক লাগল বাংলোটাতে পৌঁছতে। জঙ্গলে ঘেরা দুধসাদা বাংলোটাকে দেখেই মন ভালো হয়ে গেল আমাদের। বিশাল বড়ো বড়ো ঘর। কাঠের লম্বা লম্বা খড়খড়ি দেওয়া জানালা। লাল সিমেন্টের মেঝে। কুড়ি ফুট উঁচু কড়িবরগার ছাদ। সেখান থেকে ঝুলছে ইংরেজ আমলের পাখা। কালচে মেহগনি কাঠের খাট।
সবকিছু দেখেশুনে ঝিন্টু মন্তব্য করল, “নিজেকে জমিদার জমিদার মনে হচ্ছে রে।”
শ্রী বলল, “বাড়িটা তো খুব ভালো মেন্টেন করা হয়েছে। বাইরের রঙটাও একদম নতুন।”
চোখে কালো ফ্রেমের চশমা আর সাফারি সুট পরা এক ভদ্রলোক হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, “পথে কোনও অসুবিধা হয়নি তো ম্যাডাম?”
“একদম নয়। আমার সঙ্গে কয়েকজন জুনিয়র এসেছে। পরিচয় করিয়ে দিই, শ্রী, ঝিন্টু আর রণ। আর ইনি হলেন মি. গৌরাঙ্গ দাস।”
“নমস্কার!”
ভদ্রলোক কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “এরা তো নিতান্তই বাচ্চা ছেলেমেয়ে দেখছি। আপনি এদের সব খুলে বলেছেন তো?”
“ও নিয়ে আপনি ভাববেন না গৌরাঙ্গবাবু। আপনাদের মার্গারিটা হাউস কতদূর এখান থেকে?”
“মেন রোড দিয়ে ঘুরে গেলে মিনিট পনেরো। তবে এই ভিতর দিয়ে একটা সরু রাস্তা আছে। পাঁচ মিনিটে পৌঁছে যাবেন। ওখানে তো থাকার মতো পরিস্থিতি নেই, তাই আমি যখন আসি এখানেই থাকি।”
“বেশ। আমরা তাহলে একটু ফ্রেশ হয়ে ঘুরে আসব ওই বাড়িটাতে।”
ঝিন্টু জানতে চাইল, “টিফিনে কী আছে?”
“মুরারি আজ লুচি করেছে, সঙ্গে আলুর দম। আর গুড়ের জিলিপি এনেছি বাজার থেকে। এরপর আপনারা যেমন বলবেন বানিয়ে দেবে। ও এখানে দীর্ঘদিনের কেয়ারটেকার।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ফ্রেশ হয়ে টিফিন শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম মার্গারিটা হাউসের উদ্দেশে। যদিও সূর্যের আলো কটকট করছে মাথার উপর। বুকের মধ্যে একটা ঢিপঢিপ করে শব্দ শুনতে পাচ্ছি। অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ চারপাশে ঘিরে ধরেছে। মুখার্জি ভিলার পিছনের লোহার গেট পেরিয়ে ডানহাতে একটা সরু জঙ্গলের রাস্তা পড়ল। শালগাছের ভিড়। রাস্তায় পড়ে আছে রাশি রাশি শুকনো শালপাতা। তার উপর পা পড়তেই পাঁপড় ভাজার মতো মড়মড় করে আওয়াজ হচ্ছে।
রাস্তা কিছুটা গিয়ে ডানদিকে বেঁকে গেল। পড়ল বড়ো বড়ো আমগাছের বন। পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। কিছুটা এগিয়ে একটা লম্বা পাঁচিল। পলেস্তারা খসে পড়েছে। কয়েকটা জায়গা ধসে গেছে একেবারে। সেরকমই একটা ভাঙা জায়গা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম আমরা।
“এটা কি মার্গারিটা হাউসের বাউন্ডারি?”
“না, এটা কুমুদিনী ভবন। পরেরটা আমাদের।” জানালেন গৌরাঙ্গবাবু।
কুমুদিনী ভবনের বাড়িটা দূর থেকে চোখে পড়ল। এটারও ভগ্নদশা। বাইরের দিকে দরজা-জানালা সব ভেঙে পড়েছে। বাড়িটাকে ডানহাতে রেখে আমরা এগিয়ে গেলাম মার্গারিটা হাউসের দিকে। ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে লোহার সাত ফুট উঁচু গেটটাকে ভিতরে ঠেলতেই ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল। সামনে নুড়ি বিছানো রাস্তা সোজা চলে গেছে ভিতরে।
গৌরাঙ্গবাবু বললেন, “এই যে দু-দিকে ফাঁকা জমি দেখছেন, এখানে কিছুদিন আগেও আগাছার ঘন জঙ্গল ছিল। লোক লাগিয়ে সব পরিষ্কার করিয়েছি।”
ইউরোপিয়ান ধাঁচে তৈরি বাড়িটা জরাজীর্ণ, ভগ্নপ্রায়, ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। আমরা এগোচ্ছি। পায়ের নীচে শুকনো পাতাগুলো চূর্ণ হয়ে মচমচ করে শব্দ হচ্ছে। কেউ চাইলেও নিঃশব্দে এই রাস্তা পেরোতে পারবে না। যত বাড়িটার দিকে এগোচ্ছি তত মনের মধ্যে একটা উদ্বেগ বাড়ছে। একটা দমকা ঠান্ডা হাওয়া একরাশ পাতাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। সামনে ঝুলবারান্দার নীচে এসে দাঁড়ালাম আমরা। সর্বত্র নোনাধরা দেয়াল। পলেস্তারা খসে পড়েছে। কাঠের দরজা-জানলা সব ভিতর থেকে বন্ধ।
গৌরাঙ্গবাবু এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে একগোছা চাবি বের করলেন। সেটা থেকে খুঁজে একটা মোটা লোহার চাবি বড়ো তালাতে লাগিয়ে ঘোরাতে খুলে গেল সিংহদুয়ার। দরজা ঠেলতে ঘরঘর করে একটা শব্দ হল। তিনি বললেন, “মেন গেটের চাবিটা চিনে রাখুন। এরপর আপনাকেই খুলতে হবে। আমি আজ বিকালের ট্রেনেই কলকাতা ফিরছি।”
“সে কি! আমাদের ফেলে আপনি চলে যাচ্ছেন?”
“কী করব ম্যাডাম, কলকাতাতেও গুহ পরিবারের অনেকরকম ব্যাবসা আছে। সেগুলোও আমাকে দেখাশোনা করতে হয়।”
বাইরের রোদ থেকে ভিতর ঢুকতে চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে গেল। নাকে ধাক্কা মারল একটা চামসে গন্ধ। প্রথমে গৌরাঙ্গবাবু, তারপর তানিয়াদি, পিছনে আমি, শ্রী আর ঝিন্টু এক পা এক পা করে এগোলাম। অন্ধকারটা সয়ে এল কিছুক্ষণের মধ্যেই। ঘুলঘুলি আর কাঠের জানালার জাফরি দিয়ে যতটুকু আলো প্রবেশ করছে তাতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ভিতরে। আমরা অন্ধকার ঘরটা পেরিয়ে একটা চৌকো উঠোনে এসে উপস্থিত হলাম।
গৌরাঙ্গবাবু জানালেন, “এ-বাড়িতে ইলেকট্রিক নেই। রাতে মোমবাতি বা হ্যারিকেনে কাজ চালাতে হবে। হ্যারিকেন মুখার্জিবাড়ির কেয়ারটেকারের কাছে পেয়ে যাবেন।”
উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকালে আকাশ দেখা যায়। চারপাশ ঘিরে অনেকগুলি ঘর। কয়েকটার দরজা খোলা, কয়েকটার বন্ধ, কয়েকটা ভেঙে পড়েছে। উঠোনেও আগাছা ভরতি। মাঝে তুলসিমঞ্চ ছিল কোনও এক সময়। কিন্তু এখন সেটাকে বটগাছ দখল করে নিয়েছে। উঠোনেরই এককোণে লাল আবির দিয়ে আঁকিবুকি করা। কিছু সিঁদুরমাখা পাথর, শুকনো ফুলমালা পড়ে আছে। একটা যজ্ঞবেদি।
“তান্ত্রিক অভয় শাস্ত্রী কি এখানেই…”
“হ্যাঁ। সেদিন সন্ধেবেলা ওঁরা যজ্ঞ শুরু করার পর আমি মুখার্জি ভিলাতে চলে গেলাম। পরের দিন সকালে এসে দেখি কেউ নেই। পুজোর জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। যজ্ঞবেদি ভেঙে তছনছ। আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটু মুড়ে বসে যজ্ঞবেদিটা খুঁটিয়ে দেখল তানিয়াদি। তারপর উঠে হাত ঝেড়ে বলল, “চলুন, বাকি বাড়িটা একবার ঘুরে দেখে নিই দিনের আলোতে। রাতে থাকতে গেলে একটা জায়গা দেখে রাখতে হবে।”
দেখলাম দু-মহলার বাড়ি। পিছন দিকটায় কুয়ো, রান্নাঘর, বাথরুম, সার্ভেন্ট রুম। ওদিকটাই বেশি ভেঙে পড়েছে।
“আপনি নিশ্চিত, যে রাতে আপনারা এখানেই থাকবেন?” হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্নটা করলেন গৌরাঙ্গবাবু।
“সেইমতোই তো কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন আমাকে। রহস্যের সমাধান করতে গেলে রাতে তো থাকতেই হবে।”
“না মানে, রাতে এখানে না থেকে যদি রহস্যের সমাধান করা যায়, সেই চেষ্টা করে দেখুন। প্রাণের ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো।”
“ও নিয়ে আপনি কোনও চিন্তা করবেন না গৌরাঙ্গবাবু, আমরা ম্যানেজ করে নেব।”
আমি জানি তানিয়াদির কোল্ট পাইথন নামক বিশ্বস্ত আগ্নেয়াস্ত্রটি ওর সঙ্গেই আছে। গৌরাঙ্গবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কোনোদিন অদ্ভুত কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন এ-বাড়িতে?”
আমরা ততক্ষণে দোতলার ঘরগুলো ঘুরে সরু লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছি ছাদে। টানা হাওয়ায় গা’টা শিরশির করে উঠল। প্রশস্ত ছাদ। তবে জায়গায় জায়গায় চটা উঠে অবস্থা খুব সঙ্গিন। গৌরাঙ্গবাবু আমার প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিলেন, “সেদিনের কথা পরিষ্কার মনে আছে। শ্রাবণ মাসের শেষ সপ্তাহে দেওঘরে মহাদেবের পুজো দিয়ে শিমুলতলায় এসেছি। বর্ষা নামার আগেই লোক লাগিয়ে জঙ্গল সব পরিষ্কার করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এসে দেখলাম বৃষ্টির জলে চারদিক আবার আগাছায় ভরতি হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে সে-বার শ্যামল এসেছিল। ছোটবেলার বন্ধু। ও-ই বলল, তোর এত সুন্দর বাড়ি থাকতে হোটেলে থাকতে যাব কেন? নীচের একটা ঘর পরিষ্কার করে আমরা থেকে গেলাম। স্থানীয় ডেকোরেটরের কাছ থেকে বিছানা ভাড়া নিয়ে আর বাজার থেকে খাবার কিনে চলে এসেছি। রাতে খেয়ে শুয়ে পড়ব। সন্ধ্যা হওয়ার পর থেকে কেমন যেন অস্বস্তি হতে শুরু করল। গা ছমছমে পরিবেশ। ঘরের বাইরে পা রাখতে ভয় লাগছে। আসলে অনেক কিছু শুনেছিলাম এই বাড়িটা নিয়ে। হঠাৎ অদ্ভুত কিছু শব্দ শুরু হল। প্রথমে মনে হল দোতলার বারান্দা দিয়ে খড়ম পরে কেউ ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয় গায়ে। তখন বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। তার মধ্যে শুরু হল টুংটাং টুংটাং শব্দ। ভয়ে আমাদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে ততক্ষণে। তারপর শুরু হল টং টং করে একটা ধাতব আওয়াজ। মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে, কিছুক্ষণ পর আবার হচ্ছে। এরপর একটা শিস দেওয়ার মতো শব্দ শুরু হল। শ্যামল খুব সাহসী ছেলে। ও বলল, তুই বস, আমি একটু দেখে আসি। জিজ্ঞেস করলাম, অন্ধকারের মধ্যে কোথায় যাবি? শ্যামল বলল, এই শব্দটা মনে হচ্ছে দোতলার কোনও ঘর থেকে আসছে। আমি একবার দেখে আসি গিয়ে। চাবির থোকাটা নিয়ে ও সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে গেল। আমি চুপ করে বসে রইলাম নীচে। সময় যেন আর কাটতে চায় না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। অনেক্ষণ পর একটা আর্তনাদ কানে এল। তারপরেই ও দুড়দাড় করে নেমে দৌড়ে ঢুকল ঘরে। গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। পালা পালা, পিশাচ, পিশাচ আছে এখানে বলে দরজা খুলে দৌড় দিল শ্যামল। আমিও ওর পিছু নিলাম। মনে হল পিছন থেকে আমার চাদর কেউ টেনে ধরেছে। চাদরটা ছেড়েই আমি দৌড়ে প্রাণ বাঁচিয়ে পালালাম।”
একটু দম নিয়ে তিনি আবার বললেন, “বাইরে তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে তেড়ে জ্বর এল ভোরবেলা। শ্যামলের কাঁধে ভর করে পরের দিন সকালের ট্রেনেই পালিয়ে বাঁচলাম। তারপর তান্ত্রিক অভয় শাস্ত্রীর কাছে গিয়েছিলাম বেশ কয়েক মাস পর। তিনিও যখন পালিয়ে গেলেন, আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি একেবারে। আপনি নেহাত জেদ ধরে বললেন তাই এই মার্গারিটা হাউসের দরজা আবার খোলা হল। আমার কিন্তু খুব একটা সুবিধের ঠেকছে না।”
“দেখা যাক।” তানিয়াদি গম্ভীর গলায় শব্দ করল।
শ্রী বলল, “ছাদটা খুব সুন্দর। ওই দেখ, দূরে পাহাড়ের মাথা দেখা যাচ্ছে।”
গৌরাঙ্গবাবু চেনালেন, “ওইটা হল লাটু পাহাড়। হাঁটতে হাঁটতে সকালে ঘুরে আসবেন। লাটু পাহাড়ের বাঁদিকে একটা পুরোনো রাজবাড়ি আছে। অনেক সিনেমার শুটিং হয়েছে ওখানে।”
তানিয়াদি বলল, “তোরা এখানে গল্প কর, আমি দোতলার ঘরগুলো একবার দিনের আলো থাকতে থাকতে দেখে আসি।”
গৌরাঙ্গবাবু আমাদের এই বাড়ি সম্পর্কে অনেক কথা বললেন।— “আমি ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি এই ভূতুড়ে বাড়ির কথা। পিসি, মানে অন্তরাদেবী মারা যাবার পর এখানে কেউ আর আসতে চাইত না। আমি ছোটবেলায় দেওঘর এসেছিলাম। সেখান থেকে শিমুলতলাতে এসেও ঘুরে গেছি। কিন্তু এই বাড়িতে কখনও ঢুকিনি। মনের মধ্যে বিশ্বাস জন্মে গেছে ছোটো থেকে, সত্যিই হয়তো এখানে কোনও ভয়ংকর আত্মা বাসা বেঁধে আছে।”
কথাগুলো শুনতে শুনতে আমারও গা’টা কীরকম শিরশির করে উঠল। এত বছর ধরে এই ফাঁকা বাড়িটা পড়ে আছে। কিছু কী সত্যিই আছে এখানে? কে জানে? কিন্তু সেই অতৃপ্ত আত্মার প্রভাব যে এত তাড়াতাড়ি পড়বে আমাদের উপরে, সেটা বুঝতে পারিনি।
আরও আধঘণ্টার মতো থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমরা মার্গারিটা হাউস থেকে। ফেরার সময় বড়ো রাস্তা দিয়ে ঘুরে এলাম। তখনই দুর্ঘটনাটা ঘটল। আচমকা একটা বাইক খুব জোরে ছুটে এল পিছনে নলডাঙা রাজবাড়ির দিক থেকে। ফাঁকা রাস্তা। চোখের পলকে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল আমাদের গা ঘেঁষে। বাইকটা চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার পর খেয়াল হল গৌরাঙ্গবাবু আমাদের সঙ্গে নেই। পিছন ফিরে দেখি রাস্তার ধারে অর্ধেক শরীর ঝোপের ভিতরে, মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন। তানিয়াদির সঙ্গে আমরাও দৌড়ে গেলাম। একদম রক্তারক্তি কাণ্ড। মাথার পিছনে জোরে আঘাত লেগেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চুল। তানিয়াদি চিৎকার করে বলল, “একটা অটো ডেকে নিয়ে আয়। এই রাস্তায় দৌড়ে যা। হসপিটাল যেতে হবে।”
আমি আর ঝিন্টু দৌড়তে শুরু করলাম। কতক্ষণ সময় লাগল জানি না। মেন রাস্তায় পৌঁছে ডানদিকে বাঁকতেই একটা অটোর দেখা পেলাম ভাগ্যক্রমে। ফাঁকা আসছিল স্টেশনের দিক থেকে। হাঁপাতে হাঁপাতে মুখ দিয়ে শুধু বেরোল, “হাসপাতাল যানা হ্যায়।”
আরও মিনিট পনেরো লাগল ঝড়ের বেগে এসে অচৈতন্য গৌরাঙ্গবাবুকে অটোতে তুলে শিমুলতলা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে ভরতি করাতে। সরকারি ডাক্তার ছিলেন না। সিস্টাররা রক্ত বন্ধ করার জন্য ব্যান্ডেজ করে শুইয়ে দিলেন বেডে। তারপর ডাক্তার এসে ঘটনাটার কথা শুনে থানায় ফোন করে পুলিশ ডাকলেন। মিনিট দশেকের মধ্যে একটা বাইকে করে দুজন পুলিশ এসে হাজির হলেন হসপিটালের সামনে। নামলেন পেটমোটা এক মধ্যবয়স্ক অফিসার। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে পান চিবোতে চিবোতে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ক্যায়া হুয়া?”
তানিয়াদি আর আমাদের মুখে পুরো ঘটনা শুনে মন্তব্য করলেন, “আপলোগ উও হন্টেড হাউস মে কিঁউ ঘুসে থে? পুলিশের পারমিশন না নিয়ে ও-বাড়িতে আপনারা একদম ঘুসবেন না বলে দিলাম।”
“বাড়ির লিগ্যাল ওনার বাড়িতে ঢুকতে পারবে না? আমরা ওঁর সঙ্গে গিয়েছিলাম।”
অফিসার গলা উঁচিয়ে হুকুম ঝাড়লেন, “না। শিমুলতলায় হন্টেড হাউসে ঘুসতে গেলে পুলিশ পারমিশন লাগবে। আদারওয়াইস আপনাদের এগেন্সটে অ্যাকশন নেওয়া হবে। এর আগেও অনেক মিসহ্যাপ হয়েছে এখানে।”
তানিয়াদি নিজের ব্যাগ থেকে নেমকার্ডটা বের করে অফিসারকে দেখিয়ে বলল, “আমি কলকাতা হাইকোর্টের একজন ক্রিমিনাল লইয়ার। আইন আমিও জানি। ওই বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ার জন্য কোনও অর্ডার থাকলে কাগজ দেখান।”
অফিসারটি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “থানায় চলুন, কাগজ দেখাচ্ছি। এটা কলকাতা নয়।”
হাসপাতাল থেকে থানা মিনিট দু-একের হাঁটাপথ। অফিসার থানায় নিয়ে গিয়ে আমাদের আধঘণ্টা বসিয়ে রেখে ফোনে কার সঙ্গে কথা বললেন। তারপর রিপোর্ট লিখতে বসলেন এ.এস.আই. যোগিন্দর সিং। তানিয়াদি গম্ভীর গলায় জানাল, “এফ.আই.আর. হবে আইপিসি ৩০৭, ৫০৩ ধারায়।”
থানার কাজ মিটিয়ে বাংলোয় ফিরতে আমাদের দুপুর গড়িয়ে গেল। সাংঘাতিক খিদে পেয়েছে তখন। লাঞ্চ খেয়ে বাংলোর বাইরে পুরোনো শিমুলগাছের নীচে বসে শ্রী মন্তব্য করল, “পুলিশটার ব্যবহার খুব বাজে।”
“এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনও পয়সাওলা লোকের হাত আছে। তারই অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে এসব হচ্ছে।”
“আমরা আজ রাতে কি যাব ওই মার্গারিটা হাউসে?”
তানিয়াদি জানাল, “যোগিন্দর সিং যেভাবে ধমক দিল তাতে এই মুহূর্তে ও-বাড়িতে না যাওয়াই ভালো। বিপদের সম্ভাবনা আছে।”
“তাহলে এখন আমাদের করণীয়?”
“গৌরাঙ্গবাবুর বাড়িতে খবর পাঠিয়েছি। কাল সকালে ওঁর ভাই এসে পৌঁছবেন। কালকেই হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করে ওঁকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দিয়েছি।”
“তারপর?”
“আমি একটু চিন্তা করি। তবে এই বাংলো থেকে বেরোনো এই মুহূর্তে নিরাপদ নয়। নিরিবিলি শুনশান জায়গা। অতর্কিত আক্রমণের মুখে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।”
এদিকে আমরা যে একটু ফোন ঘাঁটব সে-গুড়ে বালি। এখানে টাওয়ার খুব লো। তানিয়াদির ফোন ছাড়া বাকিদের ইন্টারনেট নেই বললেই চলে। বিকালে বিছানায় গড়িয়ে নিলাম। তারপর মুখার্জি ভিলার ছাদে উঠে শাল-সেগুন গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে গিয়ে তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। শ্রী চমৎকার একটা গান শোনাল, ‘দোলে শাল পিয়ালের বন… যেন যায় হারিয়ে মন…’
তানিয়াদি চাদর মুড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ আগে কেয়ারটেকার মুরারিকে সঙ্গে নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ঘুরে এসেছে। জানাল, “গৌরাঙ্গবাবু আগের থেকে অনেকটা সুস্থ। মাথার পিছনে ব্যথা রয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক আর পেনকিলার চলছে স্যালাইনের সঙ্গে। আমাকে অনেক করে অনুরোধ করলেন ওই বাড়ি নিয়ে আর মাথা না ঘামাতে। ডাক্তার সদাশিব মুর্মুর সঙ্গে অনেক কথা হল।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কী ঠিক করলে?”
“আমি এর শেষ না দেখে ছাড়ব না।” তারপর ছাদের উপর আরও কিছুক্ষণ পায়চারি করে বলল, “একটা পোড়ো বাড়ি নিয়ে কিছু লোকের এত আগ্রহ কীসের? কী আছে এমন ওই বাড়িতে?”
ঝিন্টু মন্তব্য করল, “তার মানে ভূতের গল্প বানানো?”
“তা ছাড়া আবার কী! ভূতের ভয় দেখিয়ে তো সবাইকে তাড়ানো যাবে না। সেটা বুঝেই আক্রমণ করা হয়েছে আমাদের উপর। আর রডের বাড়িটা গৌরাঙ্গবাবুকে উদ্দেশ্য করে মারা হয়েছে, না টার্গেট আমরা ছিলাম?”
শ্রী প্রশ্ন করল, “তুমি তো দোতলার ঘরে ঢুকেছিলে সকালে। কিছু বুঝতে পারোনি?”
“তোদের বলার সুযোগ পাইনি। দুটো খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস খুঁজে পেয়েছি। বাড়ির পিছন থেকে ইলেকট্রিকের তারের টুকরো। এই দেখ।”
তানিয়াদি পকেট থেকে বের করে দেখাল প্রায় নতুন লাল আর নীল রঙের দুটো সরু ইলেকট্রিকের তারের টুকরো।— “ওই বাড়িতে ইলেকট্রিক নেই। তাহলে এই তারগুলো ওখানে এল কীভাবে? আর একটা কাগজ খুঁজে পেয়েছি। যদিও সেটা এই কেসের সঙ্গে জড়িত নাও হতে পারে।”
“কী কাগজ?”
“একটা চিঠি।”
“চিঠি?”
“হ্যাঁ। মার্গারিটা হাউসের দোতলার কোণের ঘরে একটা কাঠের আলমারিতে বেশ কিছু পুরোনো বই দেখলাম। বেশিরভাগই পোকায় খেয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। গীতা, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা বেশ কিছু বই, যেমন ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরানী’; শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’, রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’, সতীনাথ ভাদুড়ির ‘জাগরী’। বইগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে ‘আনন্দমঠ’-এর ভিতর থেকে এই চিঠিটা পেলাম।” বলে তানিয়াদি ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বের করল।
বাদামি রঙের ছোট্ট একটা কাগজ। ভাঁজটা খুলতে দেখা গেল ছোটো গোটা গোটা অক্ষরে কালো কালি দিয়ে বাংলায় লেখা।
‘বন্দেমাতরম -
প্রিয় অমর,
ঈশ্বরের কৃপায় আশা করি ভালো আছ।
যদি সম্ভব হয় পত্রপাঠ যথাশীঘ্র দেখা কোরো।
জরুরি দরকার।
ইতি – মালতী।
২রা মাঘ, ১৩৬৯’
“এটা কার চিঠি?”
“অমর নামক কোনও ব্যক্তিকে লেখা হয়েছে। লিখেছেন মালতীদেবী। চিঠির সঙ্গে একটা খাম ছিল। এই যে। ঠিকানা লেখা আছে - প্রযত্নে, শ্রীযুক্ত অমরেন্দ্রনাথ হালদার, বৈদ্যনাথ ধাম, শিবগঙ্গা, বিহার। ডাকঘরের স্ট্যাম্প রয়েছে খামের উপরে। তার মানে চিঠিটা অমরেন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন। তাহলে সেই চিঠি এখানে এল কী করে?”
আরও কিছুক্ষণ লাল সিমেন্টের মেঝেতে পায়চারি করতে করতে তানিয়াদি চাপা গলায় বলল, “বৈদ্যনাথ ধাম মানে দেওঘর। জায়গাটা খুব বেশি দূরে নয়। হয়তো অমরেন্দ্রনাথের সঙ্গে এই বাড়ির কোনও যোগাযোগ ছিল।”
তারপর সে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নীচে নেমে গেল।
চারপাশ ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে যেতে ঠান্ডাটা জাঁকিয়ে পড়তে শুরু করেছে। আমরাও নেমে এসে বৈঠকখানায় চাদর মুড়ি দিয়ে বসলাম। ঝিন্টু একটা নতুন কার্ডের গেম নিয়ে এসেছে সঙ্গে। নাম বলল, ‘উনো’। তাসের মতোই দেখতে। রঙ আর সংখ্যা মিলিয়ে খেলা। প্রথমে বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। খেলাটা আমাদের দুজনের কাছেই নতুন। তবে শিখে নিতে বেশ জমে গেল ব্যাপারটা।
সাতটা নাগাদ, তখন সবে গরম গরম পেঁয়াজি দিয়ে মুড়ি গালে পুরেছি, তানিয়াদি ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে বলল, “পাঁচ মিনিটের মধ্যে লাগেজ গুছিয়ে নাও। আমরা কলকাতা ফিরছি।”
“মানে?”
“অটোকে ফোন করেছিলাম। এখুনি আসছে। ঝাঁঝা স্টেশন পৌঁছতে একঘণ্টা সময় লাগবে। সেখান থেকে মিথিলা এক্সপ্রেস আছে রাত ন’টায়। অনলাইনে টিকিট কাটা হয়ে গেছে। হাওড়া পৌঁছব কাল ভোরে। অতএব সবাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। বাকি সব প্রশ্ন পরে হবে।”
যেমন ঢুকেছিল, কথাটা বলে তেমনি বেরিয়ে গেল তিরবেগে। আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। ঝিন্টু স্বগতোক্তির মতো মিনমিন করে বলল, “আমরা কি পালিয়ে যাচ্ছি?”
আমারও মনটা ভেঙে গেল তানিয়াদির কথা শুনে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের কথার উপর প্রশ্ন করা চলবে না। এতএব মিনিট পনেরোর মধ্যে আমরা মুখার্জি ভিলাকে টা টা করে আপাদমস্তক শীতের পোশাকে মুড়ে অটোতে উঠে পড়লাম। শ্রী অটোওলাকে চিনতে পেরে ফিসফিস করে বলল, “এই অটোতেই সকালে গৌরাঙ্গবাবুকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা।”
স্টেশনের উলটোদিকের সোজা চওড়া রাস্তা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুটা পর থেকে দু-দিকেই জঙ্গল। অটোর ইঞ্জিনের একটানা ভুটভুট আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না। সামনে হেডলাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে কিছুটা দূর পর্যন্ত। উলটোদিক থেকে গাড়ি আসছে মাঝে মাঝে। তাদের পাস দিতে গিয়ে গতি কমাতে হচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়ার চোটে মাফলারটা কানমুড়ি দিয়ে জড়িয়ে চুপচাপ বসে রইলাম।
আটটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম ঝাঁঝা স্টেশন। ইনকোয়ারিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল ট্রেন রাইট টাইমেই আসছে। এক নম্বরে দাঁড়াবে। আমরা ওভার-ব্রিজে উঠে লাইন ক্রস করার সময়ে তানিয়াদিকে লক্ষ করলাম বার বার আড়চোখে পিছনের দিকে দেখছে। দুজন ষণ্ডামার্কা লোক আসছে আমাদের পিছনে। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মেও তেমন লোকজন নেই। একটা চায়ের দোকানের সামনে আলো জ্বলছে। সেখানেই দাঁড়ালাম আমরা। লোক দুটো ওভার-ব্রিজ থেকে নেমে অন্ধকারে একটা গাছের নীচে দাঁড়াল। সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। ওরা কি আমাদের ফলো করে এসেছে শিমুলতলা থেকে? মনে পড়ল, অনেকটা দূরে একটা বাইক আসছিল অটোর পিছনে। এই শুনশান স্টেশনে আমাদের আক্রমণ করলে দুজনকে কীভাবে সামলাব চাপা গলায় আলোচনা করে নিলাম ঝিন্টুর সঙ্গে। যদিও শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু ঘটল না। বি-টুতে আমাদের সিট। ট্রেন ঢুকতে স্টেশনের পিছন দিকে যেতে হল। লোক দুটো আমাদের ফলো করে এগিয়ে এল কিছুটা। কানে ফোন লাগিয়ে কারোর সঙ্গে কথা বলছে। ট্রেন ছেড়ে দিল। ওরা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে লক্ষ করছে আমাদের।
নিজেদের সিট খুঁজে হাঁপ ছেড়ে বসে শ্রী জিজ্ঞেস করল, “কারা ওরা?”
তানিয়াদি বলল, “সম্ভবত গোরা সিংয়ের লোক।”
“গোরা সিং কে?”
“শিমুলতলার মাফিয়া বলতে পারিস। যত পুরোনো বেওয়ারিস বাড়ি আর প্রপার্টিগুলো একে একে দখল করে নিচ্ছে। স্থানীয় পুলিশ ওর হাতের পুতুল।”
“সকালের হামলাটা কি ও-ই করিয়েছিল?”
“সে-বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নই, হতেও পারে, আবার নাও পারে।”
আমার ভাবতে খারাপ লাগছে যে কিছু গুণ্ডা-বদমায়েশের ভয়ে আমরা রহস্যটার সমাধান না করে শিমুলতলা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছি। গৌরাঙ্গবাবুর আজ কলকাতায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি আহত হয়ে পড়ে আছেন শিমুলতলার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। গতকাল রাতে যখন হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছিলাম, মনের মধ্যে একটা দারুণ ফুর্তি ছিল। আর এখন আমাদের সবার মনের অবস্থাই করুণ। ট্রেনের জানালার মোটা কাচের মধ্যে দিয়ে বাইরে তাকালে ঘন অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবু আমরা সবাই বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছি। কারণ, নিজেদের চোখে চোখ রেখে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে।
ট্রেন হুইসেল দিয়ে স্পিড নিচ্ছে। হালকা এসি চলছে কম্পার্টমেন্টের ভিতরে। কেবিন বয় এসে রাতের কম্বল আর চাদরের প্যাকেট দিয়ে গেল। একটা থমথমে পরিবেশ। তানিয়াদি বলল, “ওগুলো যেমন দিয়েছে তেমনই রেখে দে। আমাদের কোনও কাজে লাগবে না।”
আমরা তিনজনে ঘুরে তাকালাম ওর দিকে। সবার চোখের মধ্যেই জিজ্ঞাসা চিহ্ন, “কেন?”
“পরের স্টেশন জোশিডিতে আমরা নামব।”
“আমরা কলকাতায় যাব না?”
“আজ্ঞে না। আমরা যাব দেওঘর।” তানিয়াদির মুখের হাসি অনেক কিছু বলে দিচ্ছে।
কথাটা শোনার পরেই আমাদের মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার মানে আমরা ময়দান ছেড়ে পালাইনি। মনের মধ্যে দ্বিগুণ উত্তেজনা অনুভব করলাম। মিনিট পনেরোর মধ্যেই ট্রেন জোশিডি স্টেশনে ঢুকে গেল। আমরাও হুড়মুড় করে নেমে গেলাম কম্পার্টমেন্ট থেকে। অন্ধকার স্টেশন। বেশ কিছু লোকজন নামল আমাদের সঙ্গে। স্টেশনের বাইরে এসে একটা অটোতে উঠে তানিয়াদি নির্দেশ দিল, “দেওঘর চলিয়ে।”
শুনশান রাস্তায় তিরবেগে ছুটল অটো। শহরে ঢুকতে আলোর দেখা পাওয়া গেল। রাস্তার দু-ধারে প্রচুর হোটেল, ধর্মশালা, গেস্ট হাউসের ছড়াছড়ি। তানিয়াদির নির্দেশ অনুযায়ী দেওঘরে হোটেল ইম্পেরিয়ালে পৌঁছতে মিনিট কুড়ি সময় লাগল। খাতায় এন্ট্রি করে একেবারে ডিনার সেরে রুমে ঢুকলাম আমরা। গত চব্বিশ ঘণ্টায় সাংঘাতিক দৌড়দৌড়ির ফলে শরীর নিস্তেজ হয়ে এসেছে একেবারে। তানিয়াদি আর শ্রী পাশের রুমে চলে গেল শুতে। পুরোটা সময় গুম হয়ে ছিল। কী যে চলছে ওর মাথার মধ্যে, বোঝা মুশকিল। কালকের প্রোগ্রাম কী, তাও আমাদের কিছুই বলেনি। নরম বিছানায় পড়তেই ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এল।
***
রেঙ্গুন।
৩০ জুলাই, ১৯৪৩। রেঙ্গুনে টাউন হলের মাঠ কানায় কানায় ভরতি। নেতাজির আহ্বানে লক্ষ লক্ষ প্রবাসী ভারতীয় হাজির হয়েছেন এই মাঠে। তাঁরা সবাই নেতাজির কথা শুনতে চান। আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে তাঁদের বাড়ির সন্তানরাও যোগ দিয়েছে। যথা সামর্থ তাঁরাও নেতাজির পায়ে উৎসর্গ করতে চান দেশমাতৃকার জন্য। নেতাজি সাবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলতে শুরু করলেন, “আমার দেশের ভাই ও বোনেরা, আমি আজ আপনাদের কাছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে এসেছি। আমাদের দেশ, আমাদের মা, তাঁকে কিছু বিদেশি লুটেরা শিকল দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে চাবুক মারছে। আমরা সেই মায়ের সন্তান হয়ে কি চুপ করে সব মেনে নেব? আমাদের শরীরের রক্ত উত্তপ্ত গলিত লোহার মতো দৌড়াবে না? মাত্র দেড়-দু’লাখ ইংরেজ আজ আটত্রিশ কোটি ভারতবাসীকে শাসন করছে। আমরা সবাই মিলে একজোট হয়ে যদি একসঙ্গে রুখে দাঁড়াই তাহলে ওই ইংরেজগুলো পালাতে পথ পাবে না। বন্ধুগণ, আজ আপনাদের কাছে সেই সুবর্ণসুযোগ এসেছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এই যুদ্ধে আপনাদের সবাইকে আমি সঙ্গে চাই। আপনারা একজোট হোন, আগুনের মতো জ্বলে উঠুন। আমি আপনাদের সবার সহযোগিতা চাই। সবাই বলুন, ‘চলো দিল্লি’।”
গোটা টাউন হলের মাঠ গর্জে উঠল, ‘চলো দিল্লি, চলো দিল্লি...’
নেতাজিকে স্বাগত জানানোর জন্য বার্মাবাসী বহু মানুষ, ছোটোবড়ো সংস্থা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান প্রচুর ফুলের স্তবক আর মালা নিয়ে এসেছেন। একে একে সবাই এগিয়ে এসে নেতাজির গলায় পরিয়ে গেলেন মালাগুলো, হাতে তুলে দিলেন ফুলের স্তবক। মঞ্চের একপাশে সেই ফুলগুলো জমা হতে হতে বিশাল স্তূপের আকার নিল। শেষে নেতাজি আবার এগিয়ে এলেন মাইকের সামনে। দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, “বন্ধুগণ, আমি অভিভূত আপনাদের এই অভ্যর্থনায়। কিন্তু এই ফুল যুদ্ধের সময়ে আমাদের কোনও কাজে আসবে না। আমি এর মধ্যে থেকে একটি ফুলের মালা বেছে নিয়ে নিলাম করব। দেখি এই মালার কে কত দাম দেন। যে অর্থ আপনারা দেবেন সেটা জমা পড়বে আজাদ হিন্দ ফৌজের তহবিলে।”
এবার ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘের জন থিবি নিলাম ডাকার জন্য প্রস্তুত হলেন। নেতাজির জন্য নিয়ে আসা সবথেকে সুন্দর মালাটি ফুলের স্তূপ থেকে তুলে নিয়ে দু-হাতে ধরে দেখিয়ে বললেন, “নেতাজির গলায় পরানো এই পবিত্র মালাটির জন্য আপনারা কে কে এগিয়ে আসতে চান? বলুন দেশমাতৃকার বীর সৈনিকের জন্য আপনারা কত টাকা দেবেন?”
বিশাল সভায় সবাই চুপ। মাঝখান থেকে এক পাঞ্জাবি উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন, “এক লাখ।”
সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ ভারতীয় এক মধ্যবয়স্ক লোক গলা উঁচিয়ে বললেন, “পাঁচ লাখ।”
সভার উত্তরদিক থেকে এক সিন্ধি ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এগারো লাখ।”
পাঞ্জাবি লোকটার রক্ত গরম হয়ে উঠেছে। তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, “একুশ লাখ।”
নেতাজি জন থিবিকে জিজ্ঞেস করলেন, “কে এই ব্যক্তি?”
“উনি নুর সিং। রেঙ্গুনের বিশাল বড়ো কাঠের ব্যবসায়ী। কাঠের অনেকগুলো গোলা আছে ওঁর। সঙ্গে আমদানি রপ্তানির বিরাট ব্যাবসা।”
এদিকে নুর সিং একুশ লাখ টাকা বলার পর বাকিরা সবাই চুপ করে গেছেন। অবস্থা বুঝে নেতাজি আবার মাইকের সামনে এগিয়ে এসে বললেন, “বন্ধুগণ, আজ যিনি আমার এই মালার সবথেকে বেশি দাম দেবেন, তাঁর গলায় আমি নিজে এই মালাটা পরিয়ে দেব। সামনের যুদ্ধে আমি যদি মারা যাই, তবু এই স্মৃতি আপনাদের সবার মনে থেকে যাবে। দেশের স্বাধীনতার জন্য আপনাদের অবদান মানুষ মনে রাখবে চিরকাল। তাহলে কে আছেন এই সভায়, যাঁর গলায় এটি আমি পরাতে পারব?”
কী জাদু ছিল সেই কথার মধ্যে! মুহূর্তের মধ্যে নিলামের অর্থ হু হু করে বাড়তে লাগল। একজন বলল পঞ্চাশ লাখ। আর একজন বলল ষাট লাখ। কেউ বলল আশি লাখ। শেষে নুর সিং এগিয়ে এলেন মঞ্চের উপরে। নেতাজিকে প্রণাম করে মাইকটা হাতে নিয়ে বললেন, “আমি জানি এখানে অনেক ধনী ব্যক্তি আছেন যাঁরা চাইলে আমার থেকেও বেশি মূল্য দিয়ে নেতাজির হাত থেকে এই মালা নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু আমি এই মালা আজ হাতছাড়া করব না। তাই আমার সারাজীবনের সমস্ত সঞ্চয় আজ নেতাজির হাতে তুলে দেব এই মালার জন্য।” বলে তিনি কোটের পকেট থেকে একটা চেক বই বের করে খসখস করে মূল্য লিখে সই করে তুলে দিলেন নেতাজির হাতে। নেতাজি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন সেই চেকের দিকে। সবাই জানতে চাইল, “কত নেতাজি? কত?”
নেতাজি মাইকের সামনে গিয়ে জানালেন, “এক কোটি চব্বিশ লক্ষ টাকা!”
গোটা টাউন হলের মাঠ করতালি আর সমবেত চিৎকারে ফেটে পড়ল, “জয় নেতাজি! জয় আজাদ হিন্দ ফৌজ! জয় নুর সিং!”
নেতাজি নুর সিংয়ের গলায় মালাটি পরিয়ে দিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন।
***
দেওঘর।
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে আমাদের। শ্রী ফোন করে বলল, “তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে ডাইনিং হলে চলে আয়। তানিয়াদি অপেক্ষা করছে। ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোব।”
কচুরি, আলুর তরকারি আর ছানার মুড়কি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে তানিয়াদি বলল, “আমার মামার বাড়ির দাদুর এক ছোটবেলার বন্ধু দেওঘরে থাকেন। অ্যাডভোকেট উত্তরণ বাগচি। দেওঘর সিভিল কোর্টে বহুবছর প্র্যাকটিস করেছেন। এখন রিটায়ার্ড। গতকাল রাতে মামাকে হোয়াটস-অ্যাপ করেছিলাম। বাগচিদাদু ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব।”
নীচে নেমে আমরা দুটো রিকশা নিলাম। এমনিতে অচেনা শহর বা জায়গাতে এলে তানিয়াদি পায়ে হেঁটেই ঘুরতে ভালোবাসে। বলে, তাতে জায়গাটাকে ভালো করে চেনা যায়। কিন্তু আজ রিকশা নেওয়ার পিছনে নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। ঝিন্টু বলল, “মনে হচ্ছে, আমরা যে দেওঘরে আছি সেটা ও বেশি লোককে জানাতে চায় না।”
প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ করে রিকশা ছুটেছে। রাস্তার দু-ধারেই বাজার। বড়ো বড়ো বিল্ডিংয়ে হাজারো দোকান। বিজ্ঞাপনী হোর্ডিংয়ে আকাশ ঢেকে গেছে। ক্লক টাওয়ার বা ঘণ্টাঘরের পাশ দিয়ে বাঁদিকে বেঁকে ভি.আই.পি. চক। সেখানে ডানহাতে ঘুরে গলির মধ্যে একটা রেসিডেন্সিয়াল ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে রিকশা আমাদের নামিয়ে দিল। একটা লম্বা গেট পেরিয়ে ঢুকে গেলাম আমরা। সুন্দর সাজানো গোছানো পরিবেশ। দারোয়ান নামধাম জিজ্ঞাসা করে লিফটের দরজা দেখিয়ে দিল। পাঁচতলায় অ্যাডভোকেট উত্তরণ বাগচির ফ্ল্যাট। নেমপ্লেটে নাম দেখে তানিয়াদি কলিং-বেলের সুইচ টিপল। একজন পরিচারিকা দরজা খুলে আমাদের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বৈঠকখানায় বসালেন। গোটা ঘরে চারপাশে দেয়াল ঘিরে শুধু বইয়ের তাক। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে আইনের বই ছাড়াও অনেকরকম বিষয় রয়েছে সেখানে। গৌরবর্ণ, পাঞ্জাবি পরা এক বয়স্ক, লম্বা ভদ্রলোক এগিয়ে এসে তানিয়াদিকে দেখে কানজোড়া হাসি দিয়ে বললেন, “বিশ্বাসই হচ্ছে না, সেই ছোট্ট তানু এত্ত বড়ো হয়ে গেছে! কেমন আছিস বল?”
আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর কিছুক্ষণ ব্যক্তিগত কথাবার্তা হল। একপ্রস্থ চা পানের পর তানিয়াদি মূল বিষয় উত্থাপন করল। মার্গারিটা হাউস থেকে পাওয়া সেই চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে জানতে চাইল, “আপনি বহুবছর এখানে প্র্যাকটিস করছেন। অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় আছে। দেখুন তো এই নামগুলো চেনেন কি না।”
চিঠিটা হাতে নিয়ে তিনি মোটা কাচের চশমাটা গলিয়ে নিলেন। চোখের কাছে নিয়ে এসে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে এল। চোখের কোণ দিয়ে জল গড়াতে শুরু করল। আমরা হতবাক! মানুষটা আস্তে আস্তে কুঁজো হয়ে গেলেন।
তানিয়াদি আবার শব্দ করল, “আপনি ঠিক আছেন?”
তিনি চোখের জল মুছে একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, “এই চিঠিটা ১৯৬২ সালে লেখা। অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল বুঝলে! তাই নিজেকে সামলাতে পারলাম না।”
“কী কথা?”
তিনি শুরু করলেন, “অমরেন্দ্রনাথ হালদারকে আগে আমি চিনতাম না। ১৯৯৫ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন তিনি। এখানে অনেক বাঙালিই তাঁকে চেনে না। কেউ তাঁর খোঁজ করেনি কোনোদিন। তিনিও কাউকে নিজের পরিচয় দিতেন না। শুনেছি শেষ বয়সে অ্যালঝাইমার রোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত একজন অগ্নিযুগের সৈনিক।” কিছুক্ষণ থেমে তিনি আবার বললেন, “অমরেন্দ্রনাথ ছিলেন কলকাতার এক অভিজাত বাড়ির ছেলে। বাবা ছিলেন মস্ত বড়ো ব্যারিস্টার শঙ্করনাথ হালদার। আইন পাশ করার পরে অমরেন্দ্রনাথ কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করলেন ১৯৩০ সালে। তখন কলকাতা হাইকোর্টে রাইটার্স বিল্ডিং হত্যা মামলা চলছে। দীনেশের বিচার শুরু হয়েছে হাইকোর্টে। অমরেন্দ্রনাথ তখন জুনিয়র উকিল। ১৯৩১ সালে ফাঁসির নিদান হল দীনেশের। সেখানেই এজলাসে অমরেন্দ্রনাথ পরিচয় হল মালতী বিশ্বাসের সঙ্গে। এই মালতীদেবী ছিলেন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের নারী বাহিনীর সদস্য। তিনি ১৯৩০-এ শোভারানিদেবী এবং মাতা লাবণ্যপ্রভা দত্তের সঙ্গে কলকাতায় ‘আনন্দমঠ’ প্রতিষ্ঠা করেন। নারী সত্যাগ্রহ সমিতির কর্মীরূপে আইন অমান্য আন্দোলনেও যোগ দেন। ওঁরা পলাতক বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন ও নানাভাবে সাহায্য করতেন। মালতীদেবীর হাত ধরে অমরেন্দ্র বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের সদস্য হয়েছিলেন। খুব গোপনে তিনিও বিপ্লবীদের সাহায্য করে যাচ্ছিলেন। এর বেশ কয়েক বছর পর হঠাৎ একদিন অমরেন্দ্রনাথ বাড়ির লোককে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিলেন, ‘হিমালয়ে চললাম সাধু হয়ে।’ কিন্তু আসলে মালতীদেবীর সঙ্গে জাহাজে করে পাড়ি দিলেন প্রথমে বার্মা, তারপর সিঙ্গাপুর। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সঙ্গে দেখা করলেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের স্বাধীনতার জন্য অর্থ সংগ্রহের ভার পড়ল তাঁদের উপর। মালয়, জাভা, সুমাত্রা, বার্মা, সিঙ্গাপুর, টোকিও-সহ বিভিন্ন জায়গায় বসবাসকারী ধনী ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা, ব্রিটিশ সরকারের তহবিল ও বাণিজ্যতরী থেকে ডাকাতি করে অর্থ জোগাড় করা, সবই করেছেন তাঁরা। কখনও শিখ, কখনও মৌলবি, কখনও বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সেজে অপারেশন করেছেন একের পর এক। এরপর ১৯৪৩ সালে যখন নেতাজি আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার হলেন, অমরেন্দ্রনাথ আর মালতীদেবী যোগ দিলেন বাহিনীতে। সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে বার্মা হয়ে ইম্ফল পর্যন্ত যুদ্ধ করলেন। একদিকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে সাংঘাতিক বৃষ্টি আর আকাশ থেকে ব্রিটিশ বোমারু বিমানের ক্রমাগত বোমাবর্ষণ। তারপর ১৯৪৫-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের পর বাহিনীর রসদে টান পড়ল। যুদ্ধে মারত্মক আহত হয়ে অমরেন্দ্রনাথ ধরা পড়লেন ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে। মালতীদেবী আত্মগোপন করলেন।”
তানিয়াদি জানতে চাইল, “আপনি এতকিছু জানলেন কীভাবে? তাঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল?”
বাগচিমশাই মাথা নেড়ে জানালেন, “অমরেন্দ্রনাথ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাড়া পেয়ে বহুবছর এই দেওঘরেই ছিলেন। এখানে কিছু গরিব বাচ্চাদের বিনা পয়সায় পড়াতেন। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে সেই মহান বিপ্লবীর সঙ্গে আমার সামনাসামনি পরিচয় হয়নি। তিনি মারা যাবার পর আমি খবর পেলাম, বাড়ির মালিক ঘর খালি করার সময় প্রচুর বইপত্র বের করছে। বেশ কিছু বই লাইব্রেরিকে দান করা হয়, আর কিছু বই আমি নিয়ে আসি। তার মধ্যে একটা ডায়েরিতে অমরেন্দ্রনাথ অনেক কথা লিখে গিয়েছিলেন। বেশিরভাগই সাংকেতিক ভাষায়। সঙ্গে আরও অন্যান্য বইয়ের রেফারেন্স পাই। সবকিছু পড়ে যতটা বুঝতে পারি, তাতে আমি চমকে উঠি।”
“সেই ডায়েরিটা আছে আপনার কাছে?”
“হ্যাঁ, আছে। খুঁজলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।”
তানিয়াদি বলল, “ওই ডায়েরিটা আমাকে কয়েকদিনের জন্য পড়তে দিন।”
ভদ্রলোক বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় ভিতরের ঘর থেকে একটা পুরোনো চামড়ায় বাঁধাই করা ডায়েরি খুঁজে এনে আমাদের সামনে রেখে জানালেন, “শিমুলতলার এখনকার অফিসার-ইনচার্জ অজয় ভরদ্বাজ আমার খুবই পরিচিত লোক, তোর কথা আমি ওকে বলে দিচ্ছি। কোনও অসুবিধা হবে না।”
এরপর আরও কিছুটা সময় আমরা গল্পগুজব করে উঠে পড়লাম।
ফ্ল্যাটের নীচে এসে তানিয়াদি বলল, “আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই। তোরা হোটেলে বসে বোর না হয়ে ত্রিকূট পাহাড়টা ঘুরে আয়।”
বুঝলাম তানিয়াদি ডায়েরিতে মনোসংযোগ করতে চাইছে। এই ডায়েরির সঙ্গে মার্গারিটা হাউসের রহস্য কীভাবে যুক্ত আমাদের মাথায় ঢুকল না। তানিয়াদি স্কার্ফটা মাথায় পেঁচিয়ে নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। ভি.আই.পি. চক থেকে ময়ূরাক্ষী নদীর দিকে সোজা যে রাস্তাটা চলে গেছে, সেটা ধরে আমরা তিনমূর্তি হাঁটতে শুরু করলাম। দু-পাশের বাজার দোকান দেখতে দেখতে চলেছি। একটা বাইকের শো-রুমের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে কাচের উপর চোখ পড়তে হঠাৎ মনে হল একটা লোক আমাদের পিছনে আসছে। লোকটাকে আগে কোথাও দেখেছি। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই লোকটা দাঁড়িয়ে গেল একটা পান দোকানের সামনে। আর একটু এগিয়ে যেতে আর চোখে পড়ল না। রাস্তার বাঁদিকে কোজি নামে একটা রেস্তোরাঁ দেখে ঝিন্টু চেঁচিয়ে উঠল, “খুব জোর খিদে পেয়েছে। আর হাঁটতে পারছি না।”
কাচের দরজা ঠেলে ঢুকলাম আমরা। এসি চলছে। ঝিন্টুর ফেভারিট নান আর চিকেন টিক্কা মসালা অর্ডার দেওয়া হল। ভুরিভোজ সেরে বাইরে এসে একটা অটোতে উঠে বললাম, “ত্রিকূট পাহাড় চলিয়ে।”
অটো ছুটতে শুরু করল। প্রথমে শহরের মধ্যে দিয়ে ঘণ্টাঘর পেরিয়ে হাতি পাহাড়কে ডানদিকে রেখে সোজা দৌড়ল। কিছুক্ষণ পরেই দু-দিকে ফাঁকা জমি। ঝকঝকে রাস্তা। প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগল ত্রিকূট পাহাড় পৌঁছতে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর— তিনটে পাহাড় পরপর। ছোটো ছোটো দোকান পূজার সামগ্রী নিয়ে লাইন দিয়ে বসে আছে। একটা ঠেলাগাড়িতে রঙিন শরবত বিক্রি হচ্ছিল। ঝিন্টু টানতে টানতে আমাদের নিয়ে চলল সেদিকে। ঠান্ডা বরফকুচি দেওয়া শরবত খেয়ে আমরা আবার এগোলাম। অনেকেই পুরো রাস্তাটা সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন।
ঝিন্টু বলল, “চল আমরাও হেঁটে উঠি।”
শ্রী প্রায় আর্তনাদ করে উঠল কথাটা শুনে, “পাগল নাকি! ওতে সারাদিন সময় লেগে যাবে মহাদেব মন্দিরে পৌঁছতে।”
আমি মাথা নেড়ে এগিয়ে গেলাম রোপওয়ে স্টেশনের দিকে। পাহাড়ের ধাপ কেটে তৈরি রাস্তার দু-দিকেই প্রচুর বাঁদর। সুযোগ পেলেই তারা যাত্রীদের কাছ থেকে চশমা, মানিব্যাগ, চিপসের প্যাকেট ছিনতাই করে দৌড় দেবে জঙ্গলের মধ্যে। হঠাৎ একটা সবুজ জামা পরা খাটো লোককে দেখে চমকে উঠলাম। কোথায় যেন দেখেছি লোকটাকে কিছুতেই মনে করতে পারছি না। রোপওয়ের ছোটো ছোটো দেশলাই বাক্সের মতো কাচে ঘেরা ঘরে বসেতেই তারের উপর ভর করে চলতে শুরু করল। ঢেউখেলানো সবুজ বনজঙ্গলের মাথা দিয়ে আমরা পাখির মতো উড়ে চললাম আকাশের উপর দিয়ে। বেশ মজা লাগছে। ওইসব থেকে উঁচু পাহাড়টার মাথায় মহাদেবের মন্দির।
ঝিন্টু মন্তব্য করল, “যদি তার ছিঁড়ে যায়!”
বললাম, “তাহলে সোজা স্বর্গে পৌঁছে যাব।”
যদিও তেমন কিছু হল না। হেলতে-দুলতে আমরা পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের মাথায়। উপরে খুব জোরে হাওয়া চলছে। দারুণ লাগছে এখান থেকে নীচেটা দেখতে। ফুল, বেলপাতা আর ধূপের গন্ধ মিশে মন্দির চত্বরটা ম ম করছে। ধূপ, দেশলাই কিনে পুজো-টুজো দিয়ে, ঘণ্টা বাজিয়ে শ্রী বলল, “চল, ওইদিকে একটু ঘুরে আসি।”
হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরের পিছনে চলে এলাম আমরা। মনে হল এদিকে লোকজন খুব একটা আসে না। সেখানে একটা বড়ো পাথরের চাতালের নীচে এক সাধু বসে আছেন। আমাদের দেখে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। কৌতূহলবশত এগিয়ে গেলাম আমরা। গেরুয়া কাপড় জড়িয়ে আছেন। হাতে গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে লাল-সাদা তিলক কাটা। কাছে যেতে পাথরের উপর বসতে বললেন।
“পুরাণ মে হ্যায়, রাক্ষসরাজ রাবণ মহাদেবকা তপস্যা করনে কে লিয়ে ইঁহা পে আতে থে। উস জমানে মে ইয়ে ত্রিকূট পাহাড়সে স্বর্গ জানে কা রাস্তা থা। ওহি রাস্তা ঢুঁডনে কে লিয়ে বহুত লোগ হর সাল ইধর আতে হ্যায়।” ওঁর গলার শব্দের মধ্যে এমন কিছু ছিল যাতে আমরা সম্মোহিতের মতো বসে পড়লাম সেই পাথরের উপর।
“বোম শঙ্কর!” বলে তিনি তাঁর ডানহাতটা মুঠো করে আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। মুঠো খুলতে দেখা গেল হাতের তালুতে তিনটে পেঁড়া।— “প্রসাদ হ্যায় ভগবানকা। খা লে বেটা।”
সবার আগে ঝিন্টু মিষ্টিটা নিয়েই মুখে পুরে দিল। আমরাও খেয়ে নিলাম। সূর্য ততক্ষণে পশ্চিমদিকে ঢলে পড়েছে। পাহাড়ের উপর ঝড়ের মতো হাওয়া চলেছে। জায়গাটা এত ভালো লাগছে যে ছেড়ে আর উঠতে ইচ্ছা করছে না। কী একটা ঝাঁঝালো গন্ধ এসে ধাক্কা মারছে নাকে। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। চোখের পাতা টানছে চুম্বকের মতো। মিষ্টিতে কি কিছু মেশানো ছিল? ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে এল সামনেটা।
***
পশ্চাদপসরণ
অন্যান্য বছরের তুলনায় এ-বছর বর্ষা অনেক আগে এসেছে। মালয়, বার্মা, মণিপুরের পাহাড়-জঙ্গল প্রবল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে। যুদ্ধের প্রথম দিকে আজাদ হিন্দ বাহিনী মহাপরাক্রমে ইংরেজ সৈন্যদের অনেকটা পিছনে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগর সংলগ্ন অন্যান্য ফ্রন্টে জাপানের সঙ্গে আমেরিকান আর ইংরেজদের সাংঘাতিক যুদ্ধ বেধেছে। সেখানে ক্রমশ পিছু হটছে জাপানি সেনা। ফলে বার্মা ফ্রন্টে জাপানিদের রসদে টান পড়েছে। পিছন থেকে খাদ্য, ওষুধ, আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ আসছে না। ফলে বিশানপুর থেকে পালেল পেরিয়ে কোহিমা পর্যন্ত প্রায় দেড়শ মাইল পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনারা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আটকে পড়েছে। সবথেকে সমস্যা দেখা দিয়েছে খাবার নিয়ে। প্রায় প্রতিটা ক্যাম্পেই খাবারে ভাণ্ডার শেষ। জাপানি সেনারা বাধ্য হয়ে ঘোড়া, গোরু, মোষ যা পাচ্ছে মেরে পুড়িয়ে খাচ্ছে। কিন্তু ভারতীয় সিপাইদের ও-খাবার গলা দিয়ে নামবে না। তারা জঙ্গলের ফল-মূল, বাঁশগাছের কন্দ, ঘাস-পাতা সিদ্ধ করে খেয়ে কিছুদিন কাটাল। কিন্তু সেগুলোও শেষ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এখন খাবার না পেয়ে তাদের জীর্ণ দশা। একই ইউনিফর্ম দিনের পর দিন গায়ে পরে থেকে তাঁদের গায়ে পোকা জন্মেছে। যুদ্ধের সময় শরীরে যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল সেখানে ওষুধ না পড়ে বড়ো বড়ো ঘা হয়ে গেছে। ভিজে মোজা আর জুতোর মধ্যে থেকেও সাদা পোকা বের হচ্ছে।
মায়ওমিতে ঝাঁসির রানি রেজিমেন্টের বড়ো ট্রুপের দায়িত্বে আছেন কমান্ডার লক্ষ্মী স্বামীনাথন এবং কমান্ডার জানকী দেবর। তবে ট্রুপের বেশিরভাগ সদস্য মালয়ের রাবার ফ্যাক্টরির মহিলা শ্রমিক। তারা ভারতবর্ষ কোনোদিন চোখে দেখেনি। শুধু শুনেছে দেশটা বড়ো সুন্দর, সেখানে অত্যাচারী ইংরেজ শাসকদের কাছ থেকে নিরীহ দেশবাসীদের বাঁচাতে হবে। তবে নেতাজির আহ্বানে বাংলা থেকে কয়েকজন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ারসের সদস্যা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হাজির হয়েছেন ঝাঁসির রানি রেজিমেন্টে যোগ দেবেন বলে। মালতীদেবী তাঁদের মধ্যে একজন। একদিন তিনি কমান্ডার লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে দেখা করে বললেন, “কমান্ডার, আমাদের আর কতদিন এইভাবে হাতে হাত রেখে বসে থাকতে হবে? নার্সিং ট্রেনিং নেওয়ার পাশাপাশি আমরা গেরিলা যুদ্ধেরও প্রশিক্ষণও নিয়েছি। তাই আহত সৈনিকদের সেবা করার পাশাপাশি আমাদের যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক।”
“আমি জানি ক্যাপ্টেন মালতী, আমার গ্রুপের মেয়েরা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য কতটা ব্যাকুল। কিন্তু চিফ কমান্ডারের কাছ থেকে অনুমতি না এলে আমি কিছুই করতে পারব না। যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজি তাঁরা ঠিক করে দেন। আমরা শুধু পালন করি।”
“বেশ, তাহলে আমি চিফ কমান্ডারের জন্য একটা চিঠি লিখে নিয়ে এসেছি, আপনি তাঁর কাছে আমাদের সকলের পক্ষ থেকে এই বার্তা পৌঁছে দিন।” বলে ক্যাপ্টেন মালতী একটি কাগজ এগিয়ে দিলেন কমান্ডার লক্ষ্মীদেবীর দিকে। লক্ষ্মীদেবী দেখলেন সেই চিঠি পেনের কালিতে লেখা নয়, লেখা হয়েছে গায়ের রক্ত দিয়ে।
দু-দিনের মধ্যেই কমান্ডার লক্ষ্মী পৌঁছে গেলেন সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজের হেড-কোয়ার্টারে। নেতাজি কমান্ডার লক্ষ্মীকে বরাবরই খুব স্নেহের চোখে দেখেন। তাঁর মতো উচ্চশিক্ষিতা, সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুন্দরী, সর্বগুণসম্পূর্ণা তরুণী আজাদ হিন্দ ফৌজের মুকুটের অন্যতম রত্ন। তাঁকে দেখে নেতাজি প্রশ্ন করলেন, “কী ব্যাপার লক্ষ্মী, মায়ওমিতে রেজিমেন্ট ফেলে তুমি এখানে?”
কমান্ডার লক্ষ্মীদেবী সেই চিঠিটা নেতাজির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “মেয়েরা যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে চায়। তারা পরিচারিকা হওয়ার জন্য বাহিনীতে যোগ দেয়নি।”
চিঠিটার দিকে তাকিয়ে নেতাজির চোখ দুটো জলে ভরে এল।— “তোমার রেজিমেন্টকে গিয়ে বলো, আর কয়েকদিনের মাত্র অপেক্ষা। আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ইম্ফলের সেনা ছাউনিতে পৌঁছে গেছে। আমি নিজে ইম্ফল ফ্রন্টে যাচ্ছি কয়েকদিনের মধ্যে। সেখানেই ঝাঁসির রানি রেজিমেন্টের মহিলা সেনানীরা শত্রুপক্ষের সঙ্গে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হবে। কথা দিলাম।”
কমান্ডার লক্ষ্মীদেবী নেতাজির কথা শুনে খুশি হয়ে চলে গেলেন। এরপরেই জেনারেল কাওয়াবে ঢুকলেন নেতাজির সঙ্গে দেখা করার জন্য। তাঁর বিধ্বস্ত চেহারা দেখে চমকে উঠলেন নেতাজি। জেনারেল কাওয়াবে কাঁপা গলায় জানালেন, “একটা খুব খারাপ খবর আছে চিফ কমান্ডার।”
“কী খবর?”
“জাপানি সেনা সম্পূর্ণ পরাজিত হয়ে ইম্ফল থেকে পিছিয়ে আসছে।”
“পিছিয়ে আসছে?” চিৎকার করে উঠলেন নেতাজি।— “আমাদের এতদিনের পরিকল্পনা, এত আত্মবিশ্বাস, এত স্বপ্ন— সবকিছু শেষ হয়ে গেল? সেনা পিছিয়ে আসছে, কী বলছেন জেনারেল!”
“হ্যাঁ, চিফ কমান্ডার। আমাদের কাছে আর কোনও রাস্তা নেই।”
নেতাজি বজ্রগম্ভীর গলায় বললেন, “রাস্তা তো একটাই। সেটা দিল্লি যাওয়ার রাস্তা।”
কিছুক্ষণের বরফের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে জেনারেল কাওয়াবে আবার মুখ খুললেন, “চন্দ্রা বোস, আমার কথা মন দিয়ে শুনুন। গত পঞ্চাশ বছরে জাপান একটা যুদ্ধেও হারেনি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি কোনোদিক থেকেই অনুকূল নয়। শয়ে শয়ে জাপানি সৈন্য আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বার্মা ফ্রন্টে প্রাণ দিচ্ছে। আজ জাপানের মহা দুর্দিন। প্রকৃতিও এখন আমাদের বিরুদ্ধে। আমেরিকার বোমারু বিমানগুলো হায়েনার মতো জাপানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। একসঙ্গে চার-চারটি ফ্রন্টে লড়াই করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তাই ফিল্ড মার্শাল তেরাউচি আপনার কাছে আমাকে পাঠিয়েছেন এই অনুরোধ নিয়ে। আপনি যদি অন্তত সাময়িকভাবে যুদ্ধ স্থগিত করে দু-পা পিছিয়ে আসেন, তাহলে কয়েকমাস পরে এই বর্ষা থেমে যাবে। শীতের সময় আমরা আবার পূর্ণ শক্তি দিয়ে শত্রুপক্ষের মোকাবিলা করতে পারব।”
নেতাজি সামান্য টলে গেলেন। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন চেয়ারে।
***
কোথায় আমরা?
আমার চোখ যখন খুলল, চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাথাটা ভার হয়ে আছে। আরও অনেকক্ষণ ঝিম মেরে পড়ে রইলাম। তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা যখন একটু কাটল মনে হল কত যুগ ধরে এই অন্ধকার পাথরের ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে আছি তার কোনও ঠিক নেই। হাত দুটো পিছমোড়া করে শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা। পায়ের অবস্থাও এক। নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই। মুখটা খোলা, কিন্তু চেঁচাতে পারছি না। জোরে কথা বলার মতো শক্তি নেই। খুব ধীরে গোঙানির মতো একটা শব্দ বের হচ্ছে মুখ দিয়ে। সারা শরীরে ব্যথা। একটা স্যাঁতসেঁতে ভ্যাপসা গন্ধ নাকে আসছে। কোথায় আছি তাও বুঝতে পারছি না। বহুক্ষণ চিন্তা করার পর শেষ স্মৃতি ত্রিকূট পাহাড়ের সেই সাধুটার হাসি হাসি মুখ বার বার ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। ত্রিকূট পাহাড়ে কেউ কি ফলো করছিল আমাদের? ঝিন্টু আর শ্রী কোথায়? তাদের কোনও সাড়াশব্দ নেই কেন? বেশি কিছু ভাবতে পারছি না আমি। কিছুক্ষণ ছাড়া ছাড়া শব্দ করছিলাম, ‘কেউ আছে? কেউ আছে?’ কিন্তু কোনও প্রত্যুত্তর পাচ্ছিলাম না।
আরও অনেক্ষণ পর ‘বাবা গো! মা গো!’ বলে একটা আওয়াজ কানে এল। বুঝলাম ঝিন্টু কাছেই কোথাও আছে। ওর নাম ধরে ডাকতে সাড়া দিল। জিজ্ঞেস করলাম, “শ্রী কোথায়?”
“আমার পাশেই শুয়ে আছে। কিন্তু ওর জ্ঞান ফেরেনি এখনও।”
আমি অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করে হাত দুটো পায়ের নীচে দিয়ে ঘুরিয়ে সামনে নিয়ে এলাম। দাঁত দিয়ে কামড়ে হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নাইলনের দড়িটা খুব শক্ত। তবু হাল ছাড়লাম না। কত ঘণ্টা সময় লাগল জানি না। শেষ পর্যন্ত দাঁত দিয়ে খুলতে পারলাম দড়িটা। ততক্ষণে খুব ক্ষীণ আলো সরু হয়ে নেমেছে উপর থেকে। অন্ধকারের মধ্যে চোখটাও সয়ে এসেছে। চারপাশটা ভালো করে লক্ষ করতে বুঝলাম আনুমানিক দশ বাই ছ’ফুট একটা ইটের ঘর। কিন্তু দেয়ালগুলো সব নোনাধরা। প্লাস্টার খসে পড়ছে অনেক জায়গায়। ইট বেরিয়ে পড়েছে দেয়ালের।
শ্রীরও জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু ওদের হাত-পায়ের বাঁধন খোলা আমার দাঁত দিয়ে সম্ভব নয়। শ্রী উঠে বসতে গিয়েও পারল না। জিজ্ঞেস করল, “আমরা কোথায়?”
আমি জানালাম, “এটা মনে হয় মাটির নীচের কোনও চোরা কুঠুরি।”
“কীভাবে এলাম এখানে?”
“সেই সাধুর মিষ্টি প্যাঁড়া খেয়ে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কড়া ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল ওতে। তারপর আমাদের কেউ এখানে নিয়ে এসে বন্দি করে রেখেছে।”
পকেট হাতড়ে দেখলাম ফোনগুলো সব নিয়ে নিয়েছে ওরা। শ্রী বলল, “আমার পিছনের পকেটে একটা দেশলাই ছিল। ধূপ জ্বালানোর জন্য কিনেছিলাম মন্দিরে ঢোকার আগে।”
আমি মাটিতে ঘষটে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। জিন্স প্যান্টের পকেটে সত্যিই পাওয়া গেল দেশলাইটা। বদমাশগুলো ফোন সবার কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু দেশলাইটা খেয়াল করেনি। পকেট থেকে বের করে জ্বাললাম। আলোয় চারপাশটা দেখা গেল প্রথম। আমার অনুমানই ঠিক। এটা মাটির নীচের কোনও গুমঘর। একটা একটা করে দেশলাই জ্বেলে সবার হাত আর পায়ের বাঁধন কেটে ফেলতে বেশি সময় লাগল না। ঝিন্টু বাঁধন মুক্ত হয়ে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠে বলল, “এবার এখান থেকে বাইরে বেরোনোর রাস্তাটা খুঁজে বের করতে হবে।”
একটার পর একটা দেশলাই পুড়িয়ে আমরা তিনজনে মিলে আঁতিপাঁতি করে অনেক খুঁজেও বাইরে বেরোনোর কোনও রাস্তা পেলাম না। আমি কিছুক্ষণ ছাড়া দম নিয়ে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে চারপাশের দেয়াল আর মেঝেটা চেপে চেপে দেখছিলাম কোনও দরজা খোলে কি না। আচমকা একটা আলগা ইট নড়ে উঠল। ভাবলাম যদি এখান দিয়ে বেরোনোর রাস্তা পাওয়া যায়। ঝিন্টু আর শ্রীও হাত লাগাল আমার সঙ্গে। গায়ের জোরে টানাটানি করতে একটা একটা করে ইট খুলে আসতে লাগল। কিন্তু দেশলাইয়ের আলোয় আমরা যখন দেখলাম সেটা একটা ছোট্ট কুলুঙ্গি, খুব হতাশ হয়ে পড়লাম। ভিতরে একটা পুরোনো বাক্স রাখা আছে শুধু। ঝিন্টু সবথেকে বেশি মনমরা হয়ে পড়েছে। মেঝেতে বসে বিড়বিড় করছে, “আর কোনোদিন হয়তো জ্যান্ত বেরোতে পারব না এখান থেকে। পঞ্চাশ বছর পর আমাদের কঙ্কাল বেরোবে এই গুমঘর থেকে।”
শ্রী হাঁটু মুড়ে মাথা নীচু করে বসে রয়েছে এককোণে। প্রথমে খুব খিদে পাচ্ছিল। পরে ধীরে ধীরে সেই অনুভূতিও কমে গেল। তেষ্টায় গলা ফেটে যাচ্ছে। মুখের লালা চেটে খেতে গিয়ে সেটাও শুকিয়ে যাচ্ছে। খুব ঠান্ডা লাগছে। মনে হচ্ছে কতবছর ধরে বন্দি রয়েছি এখানে। সময়ের কোনও হিসাব নেই। উপরের সরু আলো ক্রমশ কমে এল। মাথাটাও ঝিম ধরে আসছে। শরীর অবশ হয়ে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
আরও কত ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর উপরে পায়ের শব্দ পেলাম। মনে হল আমরা এখনও বেঁচে আছি। যে গুমঘরের নীচে আটকে ছিলাম, তার উপরেই লোকজন হেঁটে যাচ্ছে। শব্দ শুনতে পাচ্ছি। সরু ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা এসে ঢুকছিল নীচে, সেখানেই মুখ দিয়ে অনেকক্ষণ চিৎকার করলাম আমরা। গলা দিয়ে শব্দ বের করতেও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কোনও কাজ হল না। শেষে আমার পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে দেশলাই জ্বেলে আগুন ধরালাম। রুমালটা পুড়তে শুরু করল। ফলে ধোঁয়া তৈরি হল প্রচুর। কাশতে কাশতে আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে ধোঁয়া সেই সরু ফাঁক দিয়ে উপরে উঠতে লাগল। তিনটে রুমাল পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পর আমরা যখন হতাশ হয়ে সব আশা ছেড়ে দিয়েছি, আচমকা ঘরঘর করে উপরে সিমেন্টের ঢাকনাটা খুলে গেল উপর থেকে। তিনজনেই তখন আধমরা। একজন ছ’ফুট লম্বা স্বাস্থ্যবান মাঝবয়সি লোক আমাদের হাত ধরে উপরে টেনে তুলল। রোদের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেছে।
জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় আমরা? আপনি কে?”
লোকটা ভারী গলায় একগাল হেসে উত্তর দিল, “হামার নাম যশওয়ন্ত সিং রানা। লোকে আমাকে গোরা সিং বলে ডাকে। আপনাদের শিমুলতলায় মার্গারিটা হাউসের নীচে আটকে রাখা হয়েছিল।”
নামটা শুনেই আঁতকে উঠলাম আমি। ঝিন্টু তোতলাতে শুরু করেছে, “তা-আ-আ… তানিয়াদি?”
বলতে-বলতেই তানিয়াদি হুড়মুড় করে ঢুকল এসে। পাশে পুলিশের উর্দি পরা দুজন লোক।
“কী রে, তোরা ঠিক আছিস তো? আমি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়ে ছিলাম। দু-দিন হয়ে গেল তোদের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। শেষে গোরা সিং তোদের খুঁজে বার করলেন।”
দেখালম গোরা সিং হিন্দি টানে বেশ ভালো বাংলা বলতে পারেন। আমাদের তিনজনের হাতে জলের বোতল ধরিয়ে দিয়ে জানালেন, “আমি এলাকার লোক। এখানেই বড়ো হয়েছি। কিন্তু ভয়ে কোনোদিন এ-বাড়িতে ঢুকিনি। ছোটো থেকে শুনে আসছি এ-বাড়িতে ভূত থাকে। অনেকেই দেখেছে ঠিক সূর্য ডোবার সময়, কিংবা ভোরবেলা, অথবা চাঁদনি রাতে কেউ সাদা কাপড় জড়িয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে মার্গারিটা হাউসের ছাদে। ত্রিকূট পাহাড়ে যেদিন তোমাদের কিডন্যাপ করা হয়, সেদিন মাঝরাতে এদিকে একটা অচেনা গাড়ি ঢুকেছিল। গুড্ডু আমাকে সে-খবর দিয়েছিল। তারপর তানিয়া-ম্যাডাম যখন বার বার বলছেন যে তোমরা এখানেই কোথাও আছ, আমি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। শিমুলতলায় এরকম পোড়ো বাড়ি আরও অনেক আছে। সবক’টাতেই লোক লাগিয়ে খোঁজা হয়েছে, কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি। শেষে আমরা মার্গারিটা হাউসের ভিতরটা ভালো করে খুঁজতে শুরু করলাম। হঠাৎ বাড়ির পিছন দিকে পাতকুয়ার পাশ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে দেখে আমার সন্দেহ হল।”
আমাদের তিনজনের তখন হাঁটার ক্ষমতাও নেই। গোরা সিং আর ওঁর দুই সাগরেদ, যারা সেদিন রাতে ঝাঁঝা স্টেশন পর্যন্ত ফলো করেছিল, তারাই আমাদের নিয়ে গিয়ে মুখার্জি ভিলায় পৌঁছে দিল। আমি তানিয়াদিকে সংক্ষেপে আমাদের কিডন্যাপ হওয়ার ঘটনাটা বললাম। আমাদের যে আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল সেখানে চোরা কুঠুরিতে একটা বাক্স দেখেছিলাম শুনে তানিয়াদি পুলিশের লোকগুলোকে নিয়ে আবার দৌড়ল মার্গারিটা হাউসের দিকে। মুরারিদা আর তাঁর স্ত্রীর যত্নে ধীরে ধীরে খাবার-জল খেয়ে, স্নান সেরে ঘণ্টা তিনেক ঘুম দিতে শরীরটা অনেকটা ধাতস্থ হল।
মুখার্জি ভিলার বৈঠক
বাইরে পলাশ গাছের পিছনে আকাশে লাল রঙের আভাটা মিলিয়ে যেতেই অন্ধকার নেমে এসেছে। তখন মুখার্জি ভিলার বৈঠাকখানায় আমরা সবাই চেয়ার নিয়ে গোল করে ঘিরে বসেছি। ইতোমধ্যে একপ্রস্থ চা দিয়ে গেছে মুরারিদা। পকোড়া ভাজার গন্ধ আসছে রান্নাঘর থেকে। তানিয়াদি তার প্রিয় লাল জ্যাকেট পরে মধ্যমণি হয়ে বসেছে। পাশে লোকাল থানার ওসি অজয় ভরদ্বাজ-সহ বেশ কয়েকজন বিহার পুলিশের লোক, মুখিয়া গোরা সিং, গৌরাঙ্গ দাস আর আমরা ক’জন। ওঁদের চোখ-মুখের ভাষা বলে দিচ্ছে কেস সলভ হয়ে গেছে। আজকের সন্ধ্যায় শুধুমাত্র আড্ডা দেওয়ার জন্যই এখানে জমা হয়েছেন সবাই। গৌরাঙ্গবাবুর সঙ্গে আমরা তিনজনে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছি পুরো ঘটনাটা শুনব বলে। তানিয়াদি আমাদের উপর চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “এদের মনের অন্ধকার আগে দূর করা দরকার। কী বলেন ভরদ্বাজজি?”
মধ্যবয়স্ক কাঁচাপাকা গোঁফওলা ভদ্রলোক কাঁধ ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলেন, “জরুর, জরুর। এই কেসের আসল হিরো তো এরা। দু-দিন ধরে এই ঠান্ডায় খুব কষ্ট পেয়েছে।”
তানিয়াদি শুরু করল, “সেদিন আকস্মিকভাবে মার্গারিটা হাউসে অমরেন্দ্রনাথ হালদারকে লেখা মালতীদেবীর চিঠিটা খুঁজে না পেলে এই রহস্যের সমাধান হয়তো আমার পক্ষে করা সম্ভব হত না। তখন ওই চিঠির গুরুত্ব অতটা বুঝিনি। কাকতালীয়ভাবে দু-বছর আগে একটা টাইপরাইটারের খোঁজ পড়েছিল। তোদের মনে আছে?”
ঝিন্টু সবার আগে বলে উঠল, “হ্যাঁ। ভদ্রলোকের নাম ছিল হরজিৎ সিং। ডায়মন্ডহারবারে ওঁর বাগানবাড়িতে গিয়েছিলাম আমরা। খুব ভালো খাইয়েছিলেন। অনেকরকম পুরোনো টাইপরাইটারের কালেকশন ছিল ওঁর কাছে। তিনি তোমাকে নেতাজির একটা টাইপরাইটার খোঁজার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।”
আমি যোগ করলাম, “কিন্তু সেই টাইপরাইটার তো খুঁজে পাওয়া যায়নি।”
চায়ে চুমুক দিয়ে তানিয়াদি মাথা নেড়ে বলল, “সেই জে. ডি. সলোমন, মানে সলোমন অ্যান্ড কোম্পানির মালিক, যিনি টাইপরাইটারটি নিলাম করার চেষ্টা করেছিলেন, তিনিই ছিলেন এই মার্গারিটা হাউসের প্রথম মালিক। তাঁর স্ত্রীর নামে তিনি বানিয়েছিলেন ওই বাড়ি। স্ত্রী মারা যাবার পর সলোমন খুব একা হয়ে পড়েন। তাঁর সবথেকে বিশ্বস্ত কর্মচারী মন্মথনাথ ধরকে ব্যাবসার ভার দিয়ে তিনি শিমুলতলায় চলে আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন সেই টাইপরাইটারটি। কারণ, জিনিসটির গুরুত্ব বুঝে শেষ পর্যন্ত নিলামে তিনি বিক্রি করেননি। আর সেই টাইপরাইটার এতদিন রাখা ছিল মার্গারিটা হাউসের নীচে গোপন কুঠুরিতে।”
“তার মানে এটাই সেই নেতাজির টাইপরাইটার!” আমরা তিনজনেই আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম।
একটু থেমে চায়ের কাপে আর একবার চুমুক দিয়ে তানিয়াদি বলে চলল, “আসলে ঘটনাগুলো ঘটেছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, বহুবছর আগে। টুকরো টুকরো ঘটনাক্রমকে পরপর সাজিয়ে একটা মালা তৈরির চেষ্টা করেছি। অনেকটা নির্ভর করতে হয়েছে পরোক্ষ প্রমাণের উপর।” একটু থেমে ও আবার মুখ খুলল, “আমরা সবাই জানি দেশকে স্বাধীন করার জন্য নেতাজি যে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন, তার মধ্যে ছিল প্রচুর সোনার গহনা। সেই সোনা গলিয়ে নিজস্ব কারখানায় মোহর বা কয়েন তৈরি করেছিল আই.এন.এ.। কিন্তু ১৯৪৫ সালের পরে সেই টাকার অনেক অংশের খোঁজ কেউ পায়নি। পরে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অনেক যোদ্ধারা জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। অমরেন্দ্রনাথ তাঁর ডায়েরিতে লিখে গেছেন, মুক্তি পাওয়ার পরে ১৯৫০ সালে তিনি আবার মণিপুরে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ, পাঁচ বছর আগে যেখানে আই.এন.এ.-র সঙ্গে শেষ যুদ্ধ হয়েছিল ব্রিটিশ সৈন্যের, সেই জায়গায় আবার ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কী কারণে গিয়েছিলেন দ্বিতীয়বার? আমার মনে হয়, যুদ্ধের সময় তাঁরা ইম্ফলে বা মোইরাং-এ কিছু মোহর লুকিয়ে রেখেছিলেন। পরে তার কিছুটা অংশ উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তারপর অমরেন্দ্রনাথ তাঁর পুরোনো বন্ধু মন্মথনাথের সঙ্গে শিমুলতলার মার্গারিটা হাউসে এসেছিলেন। এ-কথাও তাঁর ডায়েরিতে লেখা আছে। বছর দু-এক তিনি এখানেই ছিলেন। এর মধ্যে সম্ভবত মন্মথনাথ জানতে পেরেছিলেন ওই সোনার কয়েনের কথা। দুজনের মধ্যে হয়তো এ নিয়ে বাকবিতণ্ডাও হয়। তখন অমরেন্দ্রনাথ চলে গেলেন দেওঘরে। তার কয়েকদিন পরেই মন্মথনাথের আকস্মিক মৃত্যু হয়েছিল ওই বাড়িতে।”
ঝিন্টু প্রশ্ন করল, “তার মানে কি অমরেন্দ্রনাথই তাঁর বন্ধুর মৃত্যুর জন্য দায়ী?”
তানিয়াদি মাথা নেড়ে বলল, “হতে পারে। তবে পুলিশের ফাইলে এসব কিছু উল্লেখ নেই।”
ইতোমধ্যে ইন্সপেক্টর অজয় ভরদ্বাজের নির্দেশে পুলিশের লোক একটা বাক্স এনে বসিয়ে দিল ড্রয়িং-রুমের মাঝে। বাক্সটা খুলতে বের হল ধুলো-ময়লা-ঝুলে মাখামাখি সেই টাইপরাইটার। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, তানিয়াদি তাতে কয়েকটা সংখ্যা টিপতেই পিছনের একটা লোহার ঢাকনা খুলে গেল। ভিতর থেকে বেরোল আই.এন.এ.-এর ছাপ দেওয়া মোট সাতটা সোনার কয়েন আর কিং এম্পেরর ষষ্ঠ জর্জের তিনটে রূপোর কয়েন।
ইন্সপেক্টর ভরদ্বাজের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। বললেন, “সোনার কয়েনগুলো এক-একটা দশ ভরির কম হবে না। তার মানে বর্তমান মূল্য আনুমানিক পঞ্চাশ লাখ টাকা হবে।”
তানিয়াদি জানাল, “এর ঐতিহাসিক মূল্য আরও অনেক বেশি।”
“আপনি এর লক কোড কীভাবে জানলেন?”
একটা পুরোনো ডায়েরি হাতে তুলে নিয়ে তানিয়াদি বলল, “অমরেন্দ্রনাথ সাংকেতিক ভাষায় ডায়েরিতে লক কোড লিখে গিয়েছিলেন। আসলে শেষ বয়সে তাঁর স্মৃতিভ্রম রোগের জন্য অনেক কিছু মনে রাখতে পারছিলেন না। তাই হয়তো ডায়েরিতে লিখে গিয়েছিলেন। অনুমান করা যায়, অমরেন্দ্রনাথ নিজেই এই সোনা লুকিয়ে রেখেছিলেন ওই জার্মান টাইপরাইটারের মধ্যে। দেওঘর থেকে এসে মাঝে মাঝে প্রয়োজনমতো সোনা বের করে নিয়ে যেতেন তিনি।”
আমাদের চোখগুলো তখন সব গোল গোল হয়ে গেছে। তানিয়াদি বলে চলল, “তোদের যে আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বারে বন্দি করে রেখেছিল, তার মধ্যেই দেয়ালের গায়ে চোরা কুঠুরিতে ছিল এই টাইপরাইটার। বোঝা যাচ্ছে অমরেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর থেকে সেটাতে কেউ আর হাত দেয়নি। তোদের চোরা কুঠুরি থেকে উদ্ধার করার পরে আমরা মার্গারিটা হাউস থেকে যখন চলে এসেছি ঠিক সেই সময়, মানে আধঘণ্টার মধ্যে জিনিসটা সেখান থেকে চুরি হয়ে যায়।”
“সে কি!”
ভরদ্বাজজি মুখ খুললেন, “দুটো লোক মার্গারিটা হাউসের কাছে ঘুরঘুর করছিল। তার মধ্যে একজন বাচ্চা ছেলে। আমরা সন্দেহ করিনি। ভেবেছিলাম টুরিস্ট হবে। শীতকালে অনেকেই ঘুরতে আসে। কিন্তু তানিয়া-ম্যাডাম বলার পর বাক্সটা আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারে না পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের লোক চারদিকে খোঁজা শুরু করে। শেষে রাজওয়াড়ার কাছে একটা গাড়ি আটক হয়। ওয়ারলেসে খবর আসে আমার কাছে। যাকে আমরা বাচ্চা ভাবছিলাম সে একজন বামন।”
মনে পড়ল হাওড়া স্টেশনে দেখা সেই বামনের কথা। সেও একই ট্রেনে আমাদের সঙ্গে শিমুলতলা এসেছিল।
ভরদ্বাজজি বললেন, “ওই বামন হল কলকাতার কুখ্যাত চোর রফিক। পুলিশ ওকে অনেকদিন ধরেই খুঁজছিল। বেশ কয়েকবার সে জেলও খেটেছে। আর তার সঙ্গে ছিল রমেন সরকার।”
আমি বললাম, “নামটা শোনা শোনা লাগছে। কিন্তু ঠিক মনে আসছে না।”
তানিয়াদি মনে করিয়ে দিল, “রমেন সরকার হরজিৎ সিংজির কাছে ম্যানেজারি করে। সে পুলিশের জেরায় স্বীকার করেছে, রফিকের সাহায্যে মার্গারিটা হাউসে ভূতের ভয় নতুন করে সে-ই ছড়িয়েছিল। ব্ল্যাক ম্যাজিক আর ছোটো ছোটো ব্যাটারিচালিত স্পিকারের সাহয্যে লোককে ভয় দেখাত ওরা। কারণ, রমেন তার মালিকের কাছে জানতে পেরেছিল, এই বাড়িতেই কোথাও সেই টাইপরাইটারটি লুকানো আছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তার লোকজন এতদিন জিনিসটা খুঁজে পায়নি। তারপর প্রথমে তারা গৌরাঙ্গবাবুকে আক্রমণ করে এবং পরের দিন ত্রিকূট পাহাড় থেকে তোদের কিডন্যাপ করে আমাকে বেনামে ফোন করে হুমকি দেয় যে, টাইপরাইটারটি হাতে পেলে তবেই ওরা তোদের ছাড়বে। তোদের যেখানে লুকিয়ে রেখেছিল, সেই গুমঘরের খোঁজ ওরা আগে থেকেই জানত। কিন্তু মাটির নীচে সেই ঘরের ভিতরেই যে চোরা কুলুঙ্গির মধ্যে টাইপরাইটারটি লুকানো আছে, সেটার হদিস ওরা পায়নি। সে-কৃতিত্ব পুরোপুরি তোদের তিনজনের।”
শ্রী মন্তব্য করল, “সে তো বুঝলাম, কিন্তু টাইপরাইটারেই মধ্যে যে সোনা লুকানো ছিল, সেটা নিশ্চয়ই হরজিৎ সিং জানতেন না?”
ইতোমধ্যে গরম গরম চিকেন পকোড়া এসে হাজির হয়েছে আমাদের সামনে। আমরা সবাই হাত বাড়ালাম।
তানিয়াদি একটা পকোড়া শেষ করে উত্তর দিল, “না, সেটা ওঁর জানার কথাও নয়। আসলে যখন দিল্লির সুপ্রিম কোর্টে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাদের বিচার চলছিল, সেখানে সরকারি উকিল ছিলেন অ্যাডভোকেট জেনারেল রমাকান্ত দত্ত। ট্রায়াল চলাকালীন তিনি নিশ্চয়ই কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন আই.এন.এ.-র লুকানো অর্থের কথা। পরে তিনি মন্মথনাথ ধরের পরিবারের কাছ থেকে মার্গারিটা হাউসটা কিনে নেন। এদিকে অমরেন্দ্রনাথ তখন মাঝে-মাঝেই দেওঘর থেকে শিমুলতলায় মার্গারিটা হাউসে আসতেন। রমাকান্ত দত্ত অমরেন্দ্রনাথকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন এবং কেন তিনি মার্গারিটা হাউসে আসতেন সেটাও হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। রমাকান্ত হয়তো অমরেন্দ্রনাথকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তাই তাঁকেও পৃথিবী ছাড়তে হয়। ১৯৬৫ সালে রমাকান্ত আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। এর পরের ঘটনা ঘটে বারো বছর পর। কলকাতায় মালতীদেবীর সঙ্গে অমরেন্দ্রনাথের যোগাযোগ ছিল। ওই চিঠিটাই তার প্রমাণ। ওঁর বিপ্লবী জীবনে পা রাখার পিছনে মালতীদেবীর অনেক অবদান ছিল। শেষ জীবনটা মালতীদেবীর প্রচণ্ড কষ্টে কেটেছে। তিনি ছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী অন্তরা গুহর নিজের মাসি। অথচ অন্তরাদেবী ওঁকে সর্বস্বান্ত করে পথে বসিয়ে দিয়েছিলেন। চূড়ান্ত অবহেলায় কলকাতায় কসবার এক অন্ধকার বস্তিতে মালতীদেবী প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন যক্ষ্মা রোগে। এর কয়েক বছরের মধ্যে অন্তরা গুহ এখানে বেড়াতে এসে খুব সস্তায় মার্গারিটা হাউস কিনে নেন। এটা ছিল কাকতালীয় ঘটনা। এরপর ১৯৭৭ সালে জুলাই মাসে এক ঝড়জলের রাতে দোতলার ছাদ থেকে নীচে পড়ে মারা গেলেন অন্তরাদেবী। ফলে স্থানীয় মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা হল যে ওই বাড়িতে কোনও ভূতের উপদ্রব আছে।”
ঝিন্টু জিজ্ঞেস করল, “এইসব মৃত্যুর পিছনে কি অমরেন্দ্রনাথেরই হাত ছিল?”
তানিয়াদি বলল, “নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যায় না। তবে আন্দাজ করা যায়। অমরেন্দ্রনাথ ছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর কমান্ডার। কোনও প্রমাণ রেখে তিনি কাজ করেননি। আরও একটা সম্ভাবনা আছে। অন্তরা গুহ তাঁর মাসি মালতীদেবীর কোনও চিঠিপত্র থেকে মার্গারিটা হাউসের খোঁজ পেতে পারেন। হয়তো জেনেছিলেন কোনও বড়ো ঐশ্বর্য এখানে লুকানো আছে।”
গৌরাঙ্গবাবু মন্তব্য করলেন, “এত বছর ধরে অমরেন্দ্রনাথকে স্থানীয় লোক কেউ দেখেনি, এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়।”
তানিয়াদি বুঝিয়ে বলল, “ভুলে যাবেন না, তিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী। ব্রিটিশ পুলিশ কোনোদিন ওঁর টিকি ছুঁতে পারেনি। দেওঘরে থাকতেন অন্য নামে এবং খুবই দারিদ্র্যতার মধ্যে তাঁর জীবন কেটেছে। মাঝে মাঝে ছদ্মবেশে তিনি আসতেন মার্গারিটা হাউসে। সাদা কাপড় জড়িয়ে ঘুরে বেড়ানো, ভূতুড়ে শব্দ বের করা— এসবই খুব গোপনে করে গেছেন দীর্ঘদিন ধরে।”
গোরা সিং প্রশ্ন করলেন, “একটা কথা আমার মাথায় ঢুকছে না ম্যাডাম, অমরেন্দ্রনাথ তিন-তিনজন মানুষকে খুন করলেন, তাঁর কাছে এত সোনার মোহর ছিল; আপনি বললেন তিনি এখান থেকে মাঝে মাঝে সোনা নিয়ে যেতেন, কিন্তু নিজে অথবা মালতিদেবী দুজনেই খুব কষ্ট করে শেষ জীবন কাটিয়েছেন, তাহলে মালতীদেবী বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন কী করে? সোনার মোহরগুলো নিয়ে তিনি করতেন কী? হিসাব তো মিলছে না।”
“ওই টাকা অমরেন্দ্রনাথ বা মালতীদেবী নিজের জন্য কোনোদিন ব্যবহার করেননি। তাঁরা দুজনেই খুবই কষ্ট করে দিনযাপন করেছেন। অমরেন্দ্রনাথ নিজের পরিচয় গোপন করে সারাজীবন লুকিয়ে ছিলেন দেওঘরের এক ছোট্ট ঘরে। মার্গারিটা হাউসের যে পুরোনো কেয়ারটেকার ছিলেন, তিনি থাকতেন লাটু পাহাড়ের পিছনে তোলা চম্পাতারি গ্রামে। আমি সেখানে গিয়ে খোঁজ করতে জানলাম, কেয়ারটেকার ভোলা মুর্মু মারা গেছেন অনেক বছর আগে। এখন তাঁর ছেলে ডাক্তারি পাশ করে গ্রামেই প্র্যাকটিস করেন। ডাক্তার সদাশিব মুর্মু জানালেন, কলকাতায় গিয়ে মেডিক্যাল কলেজে তাঁর পড়াশোনার জন্য ওঁর বাবা এত টাকা কোথা থেকে পেলেন, সেটা তিনি জানতে পারেননি কোনোদিন।”
শ্রী বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, “তার মানে অমরেন্দ্রনাথ সন্তানের পড়াশোনার জন্য টাকা দিয়েছিলেন কেয়ারটেকারকে?”
“সম্ভবত সেটাই হবে। কারণ, সেই কেয়ারটেকারের সাহায্য ছাড়া মার্গারিটা হাউসকে ভূতের বাড়ি বানানো একা অমরেন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভব ছিল না। মন্মথনাথ ধর, রমাকান্ত দত্ত এবং অন্তরা গুহ— এই তিনজনকেই খুন করার পিছনে একটাই কারণ ছিল, আই.এন.এ.-র ট্রেজার সুরক্ষিত করা। ওঁরা তিনজনেই হয়তো কোনও না কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন এই সোনার কথা। আর সেই লোভের জন্যই তাঁদের মৃত্যু হয়।”
তানিয়াদি একটু জল খেয়ে আবার বলল, “অমরেন্দ্রনাথের চিঠিপত্র থেকে জানা যাচ্ছে তিনি মাঝে-মাঝেই উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে যাতায়াত করতেন। ১৯৮৫ সালের আগে পর্যন্ত বেশ কয়েকবার উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন ঠিকানায় তিনি মানি অর্ডার করে টাকাও পাঠিয়েছিলেন।”
গৌরাঙ্গবাবু জানতে চাইলেন, “উত্তরপ্রদেশে কাকে টাকা পাঠাতেন তিনি?”
তানিয়াদি কিছুক্ষণ থেমে উত্তর দিল, “কোন এক অজ্ঞাতপরিচয় সাধুকে।”
“সাধু!”
তানিয়াদির কথা শুনে গৌরাঙ্গবাবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় দরজার বাইরে থেকে বৈঠকখানার ভিতরে একজনের ছায়া পড়ল। সাদা পাঞ্জাবি পরে পাগড়ি মাথায় ধীর পায়ে ভিতরে ঢুকলেন হরজিৎ সিং। আমরা ওঁকে দেখে বেশ অবাক হলাম। কয়েকমাসেই ওঁকে যেন অনেক বৃদ্ধ লাগছে।
তানিয়াদি হাসিমুখে স্বাগত জানিয়ে বলল, “আসুন, সিংজি। দেখুন নেতাজির ব্যবহার করা টাইপরাইটারটি শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা গেছে।”
হরজিৎ সিং কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন মুখার্জি ভিলার বৈঠকখানার লাল সিমেন্টের মেঝেতে। তাঁর দু-চোখে জলের রেখা। বললেন, “স্বাধীনতার পরে আমার দাদু বলবিন্দর সিং একবার গিয়েছিলেন কলকাতার সলোমন কোম্পানির নিলামে। সেখানে এই টাইপরাইটারটি দেখেছিলেন। কিন্তু কিনতে পারেননি। সেই আপশোশ তাঁর ছিল সারাজীবন।”
পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করে ধুলো পড়া টাইপরাইটারটি মুছতে মুছতে তিনি বললেন, “তবে আমার দাদুর বাবা, মানে প্রপিতামহ নুর সিংয়ের কাঠের ব্যাবসা ছিল রেঙ্গুনে। সেখানে একটা নিলামে নেতাজির হাতে জীবনের সমস্ত সঞ্চয় তুলে দিয়ে একটা ফুলের মালা কিনেছিলেন।”
পুলিশ সবকিছু ডায়েরিতে নোট করে নিয়ে গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। শীতল রূপালি জ্যোৎস্নায় তখন ভেসে যাচ্ছে শিমুলতলার মায়াবী জঙ্গল। রাতচরা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। পরিষ্কার আকাশে পূর্ণিমার গোল চাঁদ। একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ভরে গেল আমাদের সবার।
লেখকের অন্যান্য লেখা
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস