ছোটো গল্প
FREE SHIPPING IN INDIA
ছোটো গল্প
বছর দেড়েক আগে বদ্যিবাটি আর শেওড়াফুলির মাঝে গঙ্গা লাগোয়া খালপুলের তলায় জেলেদের পেতে রাখা জালে কী করে একটা শুশুক ধরা পড়ে। যেখানে চাকরি করি, সেই সম্পাদকের ঠ্যালায় বাঙালি হুজুগে মেতে অনেকের সঙ্গে আমিও যাই সেখানে। ততক্ষণে শুশুক-টুশুক চালান হয়ে গেছে আলিপুর চিড়িয়াখানায়। লোকের ভিড় কিন্তু একটুও কমেনি। একটা অদ্ভুত লোককে ঘিরে শয়ে শয়ে লোক সেখানে তখনও দাঁড়িয়ে গুলতানি করছে। ওর নাকি অসাধারণ ক্ষমতা। জন্তুজানোয়ারদের ভাষা বুঝে তাদের সঙ্গে কথা চালাচালি করতে পারে। ভিড়ের মাথার ওপর দিয়ে ডিঙি মেরে প্রথম দর্শন করি তাল ঢ্যাঙা খ্যাংরা-চুলো গোল চশমা পরা বিতিকিচ্ছিরি চেহারার হারাধন সমাদ্দারকে।
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য
সত্যি বলছি, হারাধনবাবুর ব্যাপারটা যে ঠিক কী, তা সবমিলিয়ে একটুও বোঝা গেল না। তাই তাঁর ঘটনাগুলোর মতো আমার এই লেখাটাও হল দুর্বোধ্য আর খামচা খামচা। লিখতে হয়, তাই লিখছি। তোমাদেরও এসব মন দিয়ে পড়ার দরকার নেই। পড়লে আমার মতো তোমাদের মাথাতেও বোধ হয় ঢুকবে না। পড়াটা নেহাত পণ্ডশ্রম হবে। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হবে। অঙ্ক-টঙ্ক মিলতে চাইবে না। ডারউইন, হিচকক, সুকুমার রায় সব যেন ঘেঁটে ঘ।
খবরের কাগজে চাকরি করতে গিয়ে আমাকে অনেক কিছুই দেখতে বা শুনতে হয়েছে গত কয়েক বছরে। হজমও করতে হয়েছে। ছোটবেলা থেকে বন্ধুদের কাছে গুলমাস্টার হিসেবে নামডাক হওয়ার কারণে সাংবাদিকের কাজে উন্নতির, নিদেন চাকরিটা পাকা হওয়ার আশাও ছিল। কিন্তু কপালের দোষে হারাধনবাবুর ধাঁধায় জড়িয়ে নাকানিচোবানি খেয়ে গেছি একেবারে। এখনও মাথার মধ্যে সবসময় ভোঁ ভোঁ করে, ঘুম-টুম নেই দু-চোখে। নিজের মনকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। পাড়ায় খেঁকি নামে ডাকা হচ্ছে আমায় আড়ালে। সবচেয়ে বড়ো কথা, কাগজ-কলমের দিকে তাকাতে পর্যন্ত ইচ্ছে করছে না। পত্রিকার কাজটা টিকলে হয়।
গতবছর হারাধনবাবু নিয়মিত আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। অন্তত মাস ছয়েক তো প্রায় এ-বেলা ও-বেলা। আসতেন ডায়েরি লেখাতে আমাকে দিয়ে। জন্মে শুনিনি বাপু নিজের ডায়েরি কেউ অন্য লোককে দিয়ে লেখায়! তোমরা শুনেছ? বলেছিলাম ডায়েরি হল প্রাইভেটস্য প্রাইভেট, মানে একেবারে আপন জিনিস যাকে বলে। কেউ কাউকে দেখায় না পর্যন্ত, পড়তে দেয়া তো দূরের কথা। কানেই নিলেন না। ইদানীং হিব্রু শিখতে গিয়ে তাঁর হাতের লেখায় নাকি বেজায়রকম গোলমাল হয়ে গেছে, নিজের লেখা নিজেই পড়তে পারছেন না। তাই আমাকেই লিখে দিতে হবে তাঁর ডায়েরি। আমি মরিয়া হয়ে বলতে চেষ্টা করেছিলাম, দরকারটা কী অমন জিনিস লিখবার! লোকের কোন কাজে লাগবে? তাতে উনি জ্বোরো রুগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে, চোখ পিটপিট করতে করতে, খাড়া খাড়া চুল টেনে, চশমার ডাঁটি কামড়ে-টামরে এমন দুঃখ করতে লাগলেন যে আমার আপত্তি টিকল না। অমন ডায়েরি নাকি বার্নাড শ আর সুবিনয় রায় ছাড়া আর কারও নেই! দেশের লোক আজ না হোক কাল এই ডায়েরির কদর করবেই। চাই কি নোবেল কমিটির নজরেও পড়ে যেতে পারে। কে বলতে পারে কী আছে কার কপালে?
অগত্যা রাজি হতে হল। গতবছরের ছ’টা মাস আমার ঢাকুরিয়ার বাড়ির ‘তোল মাটি খোল’ করা হয়েছে ওটা লিখতে। সেই ডায়েরির কিছু টুকরোটাকরা চুপিচুপি তোমাদের জন্য পত্রিকায় ছাপিয়ে দেবার ইচ্ছে হয়েছিল। অবশ্য ছিল কেন, আছে ইচ্ছে। পুরো ডায়েরি ছাপার ব্যাপারে মুশকিল আছে বলে আমি দুঃখিত। পরে তাও ছাপার ইচ্ছে আছে। পড়া হয়ে উঠলে মতামত জানিও। আমার মতে অবশ্য ও পাগলের বকবকানি ছাড়া আর কিছু নয়।
আর একটা কথা। যদি তোমাদের সঙ্গে তাঁর কখনও দেখা-টেখা হয়, লোকটাকে এড়িয়ে চোলো। ভালো হোক আর মন্দ হোক, ওই হারাধন সমাদ্দার লোকটা যে বেশ ঝঞ্ঝাটিয়া, সে ব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহ নেই।
এ সুযোগে হারাধনবাবুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হওয়ার ব্যাপারটা তোমাদের জানিয়ে রাখি। বছর দেড়েক আগে বদ্যিবাটি আর শেওড়াফুলির মাঝে গঙ্গা লাগোয়া খালপুলের তলায় জেলেদের পেতে রাখা জালে কী করে একটা শুশুক ধরা পড়ে। যেখানে চাকরি করি, সেই সম্পাদকের ঠ্যালায় বাঙালি হুজুগে মেতে অনেকের সঙ্গে আমিও যাই সেখানে। ততক্ষণে শুশুক-টুশুক চালান হয়ে গেছে আলিপুর চিড়িয়াখানায়। লোকের ভিড় কিন্তু একটুও কমেনি। একটা অদ্ভুত লোককে ঘিরে শয়ে শয়ে লোক সেখানে তখনও দাঁড়িয়ে গুলতানি করছে। ওর নাকি অসাধারণ ক্ষমতা। জন্তুজানোয়ারদের ভাষা বুঝে তাদের সঙ্গে কথা চালাচালি করতে পারে। ভিড়ের মাথার ওপর দিয়ে ডিঙি মেরে প্রথম দর্শন করি তাল ঢ্যাঙা খ্যাংরা-চুলো গোল চশমা পরা বিতিকিচ্ছিরি চেহারার হারাধন সমাদ্দারকে। শোনা গেল, ওই লোকটির হাতযশেই নাকি জলের শুশুক জল ছেড়ে ডাঙায় উঠে লক্ষ্মী ছেলের মতো গা-মাথা মুছে গাড়িতে চেপে চিড়িয়াখানায় চলে গেছে। তাছাড়া ওকে দেখেই পাড়ার যত গোরু-কুকুর-বেড়ালেরা ওর সাক্ষাৎকারের জন্য উচাটন হয়ে রয়েছে, মানুষের জমায়েতের ঠ্যালায় কাছে ঘেঁষতে পারছে না। এসব দেখেশুনে তখন অত ঝামেলার মধ্যে তার সঙ্গে আলাপ করবার সুযোগ হয়নি। সত্যি কথা বলতে কী, আলাপ-পরিচয় করার তেমন ইচ্ছেও হয়নি আমার। লোকের মুখে আরও জানা গেল, চিড়িয়াখানার কর্তারা নাকি ওকে চাকরিতে নেবার জন্য ঝুলোঝুলি করেছিলেন। ও বিশেষ পাত্তা দেয়নি। বলেছে ইচ্ছে হলে যাবে। বলেছে তো বলেছে, তাতে আমার কী? আমার কাজ ওই শুশুক অবধি। তবে শুশুকের না হোক, গামছা পরা ওই লোকটির একটা ছবি তুলে আনতে পেরেছিলাম।
গড়বড় বাধল ওখান থেকে অফিসে ফেরার পর। আমার কাছে সব শুনে-টুনে পত্রিকার সম্পাদকমশাই বিঘত খানেক হাঁ করে আমার মুখের দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলেন। পাক্কা তিন মিনিট ওইভাবে চেয়ে থেকে দম নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে শেষমেশ ফেটে পড়লেন, “করেছেন কী! ওইরকম একটা প্রতিভাবান আশ্চর্য লোকের ইন্টারভিউ না নিয়ে চলে এলেন!”
আমি শুশুক মিস করার কথা বলতে শুরু করতেই আবার শুরু হল, “হ্যাং ইওর শুশুক! খবর তো ওই লোকটা! তার ঠিকানা জোগাড় দূরে থাক, আলাপটাও করতে পারলেন না? কত বড়ো একটা হেডলাইন নিউজ হত, শুশুক!”
ফলে পরদিনই আমায় চিড়িয়াখানায় যেতে হল। খোঁজ পেলাম ওখানে যেতেই। আমার ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর ওইখানেই শুরু। আগে জানলে পত্রিকার চাকরি ছেড়ে হরিনামের দল খুলতাম। সাংবাদিকতার নিকুচি করেছে। কিন্তু দরকারের নাম চণ্ডীচরণ। চিড়িয়াখানার অফিসের লোকজন ভদ্রলোকের সুলুকসন্ধান কালকেই জোগাড় করে এনেছিল। ওঁর নামধাম, ঠিকুজি-কুলুজি সবই পেলাম, কিন্তু তাঁকে নয়। চাকরি করতে এখনও রাজি নন তিনি। বলেছেন মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে আসবেন। শুশুক বন্ধুকে দেখতে অবশ্য আজ বিকেলেই আসার কথা।
এদিকে বেলা পাঁচটায় কাগজ যাবে ছাপতে। ওঁর বাড়ির দিকেই যেতে হল। ক্যানিং লোকালের ভিড়ের মধ্যে ঘামতে ঘামতে, মনে মনে সম্পাদকের মুণ্ডু চিবোতে চিবোতে সোনারপুর জংশন। সোনারপুরের ঘাসিয়াড়া গ্রামের শেষপ্রান্তে তাঁর বাড়ি। পথে একজনকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, “এখানে হারা পাগলাকে সবাই চেনে। গোরু-ছাগল-পাখপাখালি সবার সঙ্গে কথা কয়। সোজা এগিয়ে যান, তবে হারাধন সমাদ্দার নামটা বলবেন না। ওর এখানকার নাম হারা পাগলা।”
খিদে পেয়েছিল বলে খান ছয়েক পাকা কলা কিনেছিলাম। একটা ছিঁড়ে খেতে খেতে পথ চলছি, কোত্থেকে একটা হনুমান আমার হাত থেকে বাকি ছড়াটা কেড়ে নিয়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে ভ্যানিশ। মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবে হারাধনবাবুকে খুঁজে বার করতে আর বেশি সময় লাগল না। দূর থেকে একটা অপূর্ব সিম্ফনি কানে এল। আহা, এমনটা বহুদিন কানে শুনিনি।
শ-খানেক অসুস্থ ছুঁচো, চামচিকে আর ইঁদুর যেন বিলাপ করে কাঁদছে। দূর থেকে সেই শব্দ কানে এল। একটা ভাঙা সাইকেল চড়ে বোধ হয় বাজার করতে চলেছেন হারাধন সমাদ্দার। সিম্ফনি ওই সাইকেলের লজঝর যন্ত্রপাতি থেকে বার হচ্ছে। না, আরও আছে! এর সঙ্গে গলা মিলিয়েছে পিছু পিছু আসা এগারোটা বেড়াল, সাতটা নেড়ি কুকুর, তিনটে রাজহাঁস আর দুটো রামছাগল। রীতিমতো মিছিল বা ভালো কথায় শোভাযাত্রা বলা যায়। রিং বাঁকা বলে সাইকেলের চলনটাও ঠিক সিধে বলা যাবে না। তার ওপর রাজার মতো বসে সমাদ্দার। অমন সাইকেলে সত্যি বলছি, হারাধনবাবুকেই মানায়। এক নজরেই মার্কামারা চেহারাটা চিনতে পারলাম। মিছিলের ছবিটা তুলে বেশ গর্ব হয়েছিল, পরে ওটা প্রাইজ পায়।
আমি রিপোর্টার শুনে একগাল হেসে একটা বটগাছের তলায় আমায় বসিয়ে বাজারে গেলেন সমাদ্দার আধঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসার কথা বলে। বসে বসে কী করব ভাবছি, দূর থেকে একজন লোককে আসতে দেখে হাত নেড়ে ডাকলাম। ব্যাগের মধ্যে রাখা রেকর্ডার চালু করে আলাপ করলাম তাঁর সঙ্গে। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে, ইশকুলে পড়াতেন। সমাদ্দারের কাজকর্ম সম্বন্ধে খুবই উচ্ছ্বসিত। ছোটবেলায় ছাত্র হিসেবে ভালোই ছিলেন সমাদ্দার। কী একটা দুর্ঘটনার পর থেকে তাঁর নাকি আশ্চর্যরকমের ক্ষমতা লাভ হয়। মানুষ হোক কি জানোয়ার, এমনকি পোকামাকড়-পাখপাখালি যে-ই হোক, তার মনের কথা মায় ভাষাও বুঝতে পারেন তিনি। এমনকি তার ভাষায় আলাপ করতেও পারেন। প্রথম প্রথম লোকে পাগল ভাবত, ইদানীং তাঁকে বুঝতে পেরে ভক্তি-শ্রদ্ধা করলেও একটু এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করে। সমাদ্দারের কাজকর্ম একটু রহস্যময় হয়ে উঠেছে দিনে দিনে।
বেশ তাড়াতাড়িই ফিরে এলেন হারাধনবাবু দলবল নিয়ে। বাজার তেমন দেখলাম না। অত মিছিল করে গিয়ে ওইটুকু রুমালে বাঁধা বাজার কেনর জবাবে বললেন, এটুকু তাঁর নিজের জন্য। অল্প কিছু চুনোমাছ কেনা হয়েছে ঝোল রাঁধার জন্য। বাকিরা তো রেঁধে খায় না, তাই বাজার করতে-করতেই খেয়ে নেয়। সবাই মিলেমিশে বাজার করলে সময় লাগে না তেমন। কেমন তাদের বাজার করা বেশ বোঝা গেল গাছের ডাল থেকে ঝুপ করে একটা হনুমান নেমে আসায়। তার বগলে আমার সেই সকালে কেনা কলার ছড়া। একটুও ভালো লাগল না। আমার ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি শুনে হারাধনবাবু বললেন, ওরকম বাজার করা নাকি ওদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। এটা হল একরকম সিন্ডিকেট। ওদের চোর-টোর বলার অধিকার মানুষের নেই। কারণ, ওরা নাকি মানুষদের চাইতে ঢের ভালো। তর্কে না গিয়ে হজম করতে হল।
যাই হোক, ওঁর সঙ্গে ঘণ্টা দুই আমার নেয়া সাক্ষাৎকার ছবিসহ বিকেলের ‘খামখেয়ালি’ পত্রিকায় ছেপে বার হওয়ার পর বাজারে হইচই পড়ে গেল। চার দফা নতুন করে ছেপেও পাঠকের চাহিদা পূরণ করা গেল না। আমার চাকরি পাকা হল। তিন মাসের মাথায় সম্পাদকমশাই পদ্মশ্রী পেয়ে মাথার রোগ বাধিয়ে বসলেন। আমার নিত্যিদিনের কাজ হল, হারাধনবাবুর সঙ্গে সেঁটে থেকে ধারাবাহিক খবর বার করা। এই করতে গিয়েই হল বিপদ। হারাধনবাবু আমায় ধরে ঝুলোঝুলি শুরু করলেন তাঁর ডায়েরি লেখার জন্য।
প্রাণ আর চাকরি বাঁচাবার খাতিরে লিখতেই হল। কত যে রঙবেরঙের কথা লেখা হল তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর কথা অনুযায়ী নোবেল পাবার যোগ্যতা আছে তাঁর। তাঁর সঙ্গে কত জায়গায় যেতেও হল আমায়, তবে সবই ওই সাইকেলে চড়ে। কারণ, ওই সিম্ফনি গাওয়া সাইকেল ছাড়া তিনি কোথাও যান না। ওই আওয়াজে নাকি খিচুড়ি ভাষা এসপেরান্তোর মতো জীবজন্তুদের বিশ্বশান্তির বার্তা আছে, সমবায়ের তত্ত্ব আছে, আবার কমিউনিজমের বাণীও পাওয়া যেতে পারে। আরশোলা থেকে এলিফেন্ট ওই শুনেই এক ছাতার তলায় জড়ো হয়। তবে এসব মহান বিষয় মনুষ্য বোঝে না।
টের পেলাম জিরাট গিয়ে। হ্যাঁ, আমাকেও যেতে হল। নতুন একটা সাইকেল কিনতেও হল। কারণ, এটাই তো আমার চাকরির শর্ত। চক্রবর্তীদের বিখ্যাত বাড়ির ছেলে শান্তি আমার বন্ধু। ওদের বাগানে হনুমানদের ডাকা সংবর্ধনা সভায় হারাধনবাবু সভাপতি। কীসব খেতাব-টেতাব দেবে ওরা ওঁকে।
শান্তির বাড়িতেই উঠলাম। ওদের বাগানে শ-খানেক হনুমানের বসবাস। তাদের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক শান্তির। খবর পেলাম, শান্তিকেও নাকি ওরা ‘হনুমিতে’ তকমা দিতে চায় ওর ভালোমানুষির জন্য ওই সভায়। শান্তি তাতে রাজিও আছে। সভা বসবে দুপুরে। মুশকিল বাধল সকাল পেরোতেই। কাটোয়া, নবদ্বীপ, অম্বিকা, কালনা, বাগনাপাড়া, সোমড়াবাজার, বলাগড়ের হনুমান-হনুমানীরা লোকাল ট্রেনের কামরা বোঝাই করে আসতে গিয়ে ডেলি প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে গণ্ডগোল হয়ে হুলুস্থুল লেগে গেল। ব্যান্ডেল থেকে এ-লাইনে ট্রেন বন্ধ হয়ে স্টেশনে স্টেশনে হকারে-হনুমানে-চেকারে-প্যাসেঞ্জারে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড বেধে গেল। রেল পুলিশরা কোথায় পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল কে জানে। আমি অবশ্য এ-খবরটাও পত্রিকার অফিসে মেইল করে দিলাম জিরাট স্টেশনের ছবিসহ। হনুমানদের ট্রেনে চড়ার ব্যাপারটাও খবর হল, অবশ্য সভার কথাটা চেপে দিয়েই।
চুপিচুপি সংবর্ধনার পাট চুকিয়ে ফিরলাম আমরা। কাটোয়া লাইনের ডেলি প্যাসেঞ্জাররা ‘হনুরাজ’ সংবর্ধনার খবর পেলে শান্তি বেচারার গায়ে চামড়া থাকত না। বলা বাহুল্য, হারাধনবাবু পেলেন ‘হনুরাজ’ তকমা আর শান্তি হল ‘হনুমিতে’। তবে এ-খবর শুধু তোমাদের জন্য। পুলিশ বা ডেলি প্যাসেঞ্জারদের কানে যেন না যায়।
চন্দ্রকোনার জঙ্গল থেকে একদল হাতি কলকাতার বিধানসভায় আসছিল। কেন আসছিল জানলেও বলা যাবে না। তবে সেই জঙ্গল থেকে শহরে ফিরতে সাইকেলে আমাদের সময় লেগেছিল সাতদিন। ডায়েরিতে লেখা আছে সেই রোমাঞ্চকর ঘটনার কথা।
আরও আছে লাল-কালো পিঁপড়েদের একমাস ধরে চলা মারাত্মক দাঙ্গা থামাতে যাওয়ার কথা। কী নৃশংস সে বিবরণ! শেষে লাল-কালোদের কোলাকুলি করিয়ে তবে ফিরে আসি আমরা। কলকাতার নেড়ি কুকুরদের শিশুশিক্ষার গোপন ইস্কুল খুলতে গিয়ে হারাধনবাবুর জলাতঙ্কের খবরও আছে ওতে লেখা। মার্কাস স্কোয়ারের সার্কাসের জলহস্তির মনখারাপের খবর আর তার মানসিক চিকিৎসার কাউন্সেলিংয়ের কথা ধারাবাহিক তোলা আছে ওতে। সব তোমাদের জানাবার ইচ্ছে ছিল। ছাপতে পারলে সে এক ব্যাপার হত সন্দেহ নেই। কিন্তু আপাতত ছাপানো যাচ্ছে না। কারণ, হারাধনবাবুর আচমকা অন্তর্ধান।
মাস কতক আগে সুন্দরবনের অবাধ্য বাঘেদের সঙ্গে আলোচনা করে এলাকায় শান্তি ফেরানোর অনুরোধ রাখতে গিয়ে সমাদ্দার ভ্যানিশ। পেটখারাপ হওয়ায় আমি যেতে পারিনি তাঁর সঙ্গে। সরকারের তরফে খোঁজখবর কম করা হয়নি। ক’দিন মন-টন খারাপ করে সেদিন খামখেয়ালির দপ্তরে গিয়ে দেখি ডায়েরি ইতোমধ্যে সম্পাদকমশাই আমার দেরাজ থেকে বার করে নিজের কাছে রেখেছেন। রোজ নাকি ওটা গীতার মতো পাঠ করেন। কিছুতেই আমাকে ফেরত দিতে চাইলেন না। কী আর করি! আচমকা পদ্মশ্রী পেয়ে থেকে তাঁর মাথার গোলমাল। পাগল মানুষকে বেশি কিছু বলাও যায় না। তাই ডায়েরি ছাপাও মুলতুবি রইল। ভাগ্যে থাকলে পরে ছাপা যাবে। হারাধনবাবুর হদিস হারাবার ফলে তাঁকে দিয়েও বলানো যাচ্ছে না, আমি নাচার। নোবেলটা বুঝি মাঠে মারা গেল। অন্তত কাক-সমাজের চরিত্র সমীক্ষাটা অথবা ওভারব্রিজের পিলারের ওপর কেন ইঁদুরেরা খাপ্পা তাও যদি ছাপা যেত। হল না।
তবে হঠাৎ করেই একটা ঘটনা ঘটে গেছে। খানিকটা আশার আলো ফুটছে হতাশার কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে।
বন্ধুরা মিলে বেড়াতে গিয়েছিলাম সুন্দরবনে। পাখিরালয় থেকে খানিক দূরে একা একা মর্নিং ওয়াক করতে করতে জঙ্গলের মধ্যে বড়ো এক বটগাছের তলায় বিশ্রাম করতে বসি। বিশাল নদীর ওপর তখন সূর্য উঠছে। মাথার ওপর গাছটা জুড়ে একপাল হনুমান লাফালাফি করছিল। হঠাৎ মগডালে নজর পড়তেই চমকে উঠি। হনুমানদের মধ্যে একজনের চোখে চশমা। আরও ভালো করে নজর করতেই চিনতে পারলাম, মগডালে বসে আছেন হারাধন সমাদ্দার মশাই। চেহারা একটু পালটেছে। হাতে পায়ে বড়ো বড়ো লোম, মুখ-টুখ রোদে পুড়ে কালো, মাথার চুল তো খ্যাংরা কাঠির মতো খাড়া ছিলই। তবু চিনতে পারলাম। নীচ থেকে ডাকলাম, “হারাধনবাবু!”
হারাধন সমাদ্দার বললেন, “হুপ।”
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্যের অসামান্য লেখায় ও আঁকায় কিশোর গল্প সংকলন।
গুণময় রায় বিজ্ঞানী মানুষ। নিজের পরিচয় দেন ‘ইনভেনটর’ বলে। বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও তুখোড়। আবার ভারতীয় পুরাণ, ইতিহাস এবং পুরাতাত্ত্বিক বিষয়েও তাঁর গভীর জ্ঞান। কখনও নিজের মনোজগত, কখনো-বা প্রজন্মবাহিত স্মৃতির সরণিতে অক্লেশে ঘুরে বেড়ান ‘গুণময় দ্য গ্রেট’, আর পাঠকেরাও সুযশ মিশ্রের জবানিতে স্বাদ পায় সেই অতুলনীয় অ্যাডভেঞ্চারগুলির।