ছোটো গল্প
FREE SHIPPING IN INDIA
ছোটো গল্প
দিন সাতেকের মধ্যে শান্তিপ্রিয়বাবু বুঝতে পেরে গেলেন, এই পাড়ার সমস্ত লোকজন অত্যন্ত ঝগড়াটে। কেবল ঝগড়াটে নয়, তারা ঝগড়াপ্রিয়। সকাল-সন্ধ্যা রোদ-বৃষ্টি-ভূমিকম্প-প্যান্ডেমিক যাই হোক না কেন ঝগড়ার গন্ধ পেলেই তারা সর্বস্ব ফেলে ছুটে আসবে। যার যার বাড়ির পার্সোনাল ঝগড়া তো আছেই, রাস্তায় কোনও সামান্য তর্কাতর্কি বা বচসার আভাস পেলেই সবাই দলে দলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর সবাই মিলে সেই ঝামেলায় অংশগ্রহণ করে। তবে সবচেয়ে ঝগড়াটে বোধ হয় টিয়াপাখিটা। বটব্যালবাবু অফিস যাওয়া আর বাথরুমে যাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে সবসময়ই ওকে কাঁধে বসিয়ে রাখেন।
বুমা ব্যানার্জী দাস
“ওই, ওই আবার শুরু হল।”
ব্যাজার মুখে শান্তিপ্রিয়বাবু চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখেন। আজও চা খাওয়াটা মাটি। বাড়ি কেনার আগে যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেতেন!
দিন পনেরো হল এই নতুন পাড়ায় উঠে এসেছেন তাঁরা। পুরোনো পাড়ার স্যাঁতসেতে ঘুপচি দুই কামরার ফ্ল্যাট ছেড়ে এই খোলামেলা ছোট্ট দোতলা বাড়িতে এসে একরকম হাঁপ ছেড়েছিলেন তিনি আর তাঁর গিন্নি। একমাত্র পুত্র চাকরিসূত্রে হায়দ্রাবাদ পাড়ি দেওয়ার পর তাঁরা কর্তা-গিন্নি একরকম ঝাড়া হাত-পা। তাঁর নিজের রিটায়ারমেন্টেরও আর কয়েক বছর মাত্র বাকি। জমানো টাকার বেশিরভাগটা দিয়ে অনেক আশা করে এই দোতলা বাড়িটা কিনেছেন শান্তিপ্রিয়বাবু। পুরোনো হলেও বাড়িটা বেশ ভালো, দেখলে মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। খোশমেজাজে গিন্নিকে বলেছিলেন, ‘বাকি জীবনটা বেশ হাত পা ছড়িয়ে কাটানো যাবে, কী বলো।’ শান্তিপ্রিয়বাবুর গিন্নি ভারি ভালো মানুষ, রাগ-টাগ করা তাঁর ধাতে নেই। একগাল হেসে ঘাড় নেড়েছিলেন তিনি। তখন কি আর জানতেন…
বাঁপাশের শিকদারদের বাড়ি থেকে ঝনঝন ঝনাৎ করে বিকট শব্দ ওঠে। দুই হাতে নিজের দুই কান চেপে ধরেন শান্তিপ্রিয়বাবু। ডানদিকের বটব্যালদের পোষা টিয়াটার চিৎকার সে-সব ভেদ করে তাঁর কানে ঢুকতে থাকে।
প্রথম দিন তিনেক কিচ্ছু টের পাননি শান্তিপ্রিয়বাবু। নতুন পাড়ায় আসার আনন্দে মশগুল ছিলেন। বুঝলেন বাজার করতে গিয়ে। রবিবার, ভেবেছিলেন জমিয়ে বাজার করবেন। চকচকে পুরুষ্টু পটল ক’টা ঝুড়িতে তুলতে তুলতে শুনলেন পাশের দোকানে কেউ বলছে, “এ কি ডাঁটা, না দড়ি? এত শুকনো!”
বাজার করতে গিয়ে এসব মন্তব্য হরবখত কানে আসে, উত্তরে ডাঁটা বিক্রেতা সাধারণত মোলায়েম গলায় তার সবজির গুণাগুণ বর্ণনা করে এবং কিঞ্চিৎ দরাদরির পর ক্রেতা হৃষ্টচিত্তে ব্যাগ বাড়িয়ে দেয়। অতিসাধারণ রোজকার ঘটনা, শান্তিপ্রিয়বাবু তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। হঠাৎ কানে আসে ডাঁটাওলা কটকটে গলায় বলছে, “আজ্ঞে দড়িই, নিয়ে যান। গলায় লাগিয়ে ঝুলে পড়ার সুবিধা হবে’খন।”
কী তিরিক্ষি মেজাজের সবজিওলা রে বাবা! শান্তিপ্রিয়বাবু পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে যাচ্ছেন, হঠাৎ দেখেন ডাঁটা সমালোচক ঝট করে একটা সজনে ডাঁটা তলোয়ারের মতো বাগিয়ে ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে ডাঁটার পাশে রাখা বিট, গাজর, বেগুনের ঢিবি টপকে এগিয়ে যাচ্ছে সবজিওলার দিকে। বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন শান্তিপ্রিয়বাবু। এমন আজব দৃশ্য তিনি জীবনে দেখেননি। তবে বিস্ময়ের তখনও কিছু বাকি ছিল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে গোটা বাজার দুই দলে ভাগ হয়ে গেল। বাজারওলারা একদিকে, খরিদদাররা আর একদিকে। এমনকি মুদি পর্যন্ত দোকান ফেলে চলে এসেছে। এত সামান্য কারণে যে এমন হুলুস্থুল হতে পারে তা শান্তিপ্রিয়বাবুর ধারণার বাইরে। ভিড়ের মধ্যে প্রতিবেশী বটব্যালবাবুকে দেখতে পেয়ে ধড়ে যেন প্রাণ পেলেন তিনি। বটব্যালবাবু দিব্য ভালোমানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে আধা-ভরতি বাজারের ব্যাগ, কাঁধে পোষা টিয়াপাখি। ভারি অদ্ভুত। পোষা পাখিকে নিয়ে কাউকে বাজারে আসতে আগে দেখেননি শান্তিপ্রিয়বাবু। তবু এই ঝামেলার মধ্যে চেনা একটা মুখ দেখে সাহস করে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন।
ওদিকে তখন এক হাতে কার একটা খোলা ছাতা ঢালের মতো করে ধরে অন্য হাতে প্রবল বিক্রমে সজনে ডাঁটা ঘোরাতে ঘোরাতে সেই লোক বাঘাটে গলায় বলছে, “হাম তুমকো নেহি ছোড়েঙ্গে! তুই একটা, তুই একটা…”
শান্তিপ্রিয়বাবু ঠিক সেই মুহূর্তে বটব্যালবাবুর পাশে পৌঁয়ে ধরা গলায় বললেন, “ও মশাই, হাতাহাতি হবে না তো? আমি আবার ওসবে…”
বটব্যালবাবুর কাঁধের টিয়া বলল, “জোচ্চোর।”
তলোয়ার, থুড়ি, সজনে ডাঁটাধারী বলল, “ঠিক, জোচ্চোর।”
ডাঁটাওলা বলল, “আমার সেজমাসির বাড়ির ডাঁটাকে শুকনো বলা? তুই একটা, তুই একটা…”
টিয়া বলল, “উজবুক।”
কী সর্বনাশ, এই টিয়া তো দুই দলেই খেলছে! বটব্যালবাবু আদর করে তাঁর টিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, মুখে স্বর্গীয় হাসির ঝিলিক। শান্তিপ্রিয়বাবুর প্রশ্নটা তাঁর কানেই যায়নি আদৌ।
শান্তিপ্রিয়বাবু বাজার ভুলে, পুরুষ্টু পটল ভুলে প্রায় খালি ব্যাগ হাতে একরকম ছুট লাগলেন বাড়ির দিকে। পরদিন অসম্ভব উদ্বেগ নিয়ে বাজারে ঢুকে দেখেছিলেন সবকিছু স্বাভাবিক, কোথাও কোনও ভাঙচুর, হাতাহাতির চিহ্নমাত্র নেই।
সেই শুরু। দিন সাতেকের মধ্যে শান্তিপ্রিয়বাবু বুঝতে পেরে গেলেন, এই পাড়ার সমস্ত লোকজন অত্যন্ত ঝগড়াটে। কেবল ঝগড়াটে নয়, তারা ঝগড়াপ্রিয়। সকাল-সন্ধ্যা রোদ-বৃষ্টি-ভূমিকম্প-প্যান্ডেমিক যাই হোক না কেন ঝগড়ার গন্ধ পেলেই তারা সর্বস্ব ফেলে ছুটে আসবে। যার যার বাড়ির পার্সোনাল ঝগড়া তো আছেই, রাস্তায় কোনও সামান্য তর্কাতর্কি বা বচসার আভাস পেলেই সবাই দলে দলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর সবাই মিলে সেই ঝামেলায় অংশগ্রহণ করে। তবে সবচেয়ে ঝগড়াটে বোধ হয় টিয়াপাখিটা। বটব্যালবাবু অফিস যাওয়া আর বাথরুমে যাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে সবসময়ই ওকে কাঁধে বসিয়ে রাখেন।
ইতোমধ্যে পাড়ার আরও কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তাঁর। রাস্তার উলটোদিকের একতলা বাড়িতে থাকে অতনু, সে আবার উঠতি কবি। শান্তিপ্রিয়বাবু ভেবেছিলেন কবি মানুষ, নিশ্চয়ই সে অন্তত ঝগড়াটে হবে না। সে-গুড়ে তিন বস্তা বালি। দেখা গেল, সে-হতভাগা ছড়া কেটে ঝগড়া করে!
অফিসে শুকনো মুখে বসে ছিলেন শান্তিপ্রিয়বাবু। গিন্নি লুচি-আলুর দম দিয়েছেন টিফিনে, তাও যেন মুখে রুচছিল না। সন্তোষ এসে চেয়ার টেনে বসল। ছোকরা বেশ এলেমদার, নানা ফিকির ঘোরে মাথায়।
“কী ব্যাপার দাদা, ক’দিন ধরে যেন কেমন কেমন দেখছি আপনাকে? বাড়ি কিনলেন, এখন তো সুখের সময়।”
“আর সুখ।” ফোঁস করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন শান্তিপ্রিয়বাবু।
চেয়ার নিয়ে ঘন হয়ে বসে সন্তোষ। তার চোখে ঝিলিক দিচ্ছে কৌতূহল।
“কী ব্যাপার বলুন তো।”
বলতে হয় সবটা। পুরোটা শুনে চোখ কপালে তুলে সন্তোষ বলে, “সে কি, আপনি শেষে ওই পাড়ায় বাড়ি নিয়েছেন!”
“জানো নাকি ও-পাড়ার কথা?”
“জানি না মানে! আমাদের ডিপার্টমেন্টের অখিল তো ওখানেই বাড়ি নিয়েছিল, এক মাসও থাকতে পারেনি। ও তো বিখ্যাত পাড়া। অখিল তাও বাড়ি কেনেনি, ভাড়া নিয়েছিল।”
“কী করি বলো তো ভাই, আমি এমন জায়গায় টিকতে পারব না। বাড়ি কিনে ফেলেছি, সেটা আবার বিক্রি করার হ্যাপা সামলানো কি আর আমার কম্ম?”
ভ্রূ কুঁচকে কীসব ভাবে সন্তোষ। তারপর বলে, “সবাই বেরিয়ে আসে ঝগড়া করতে? কেউ বাদ নেই?”
“ওই সতেরো-আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা ছাড়া যে যে বাড়িতে তখন থাকে, সবাই। বাড়ির মহিলারাও বাদ যান না। ওই ইয়াং জেনারেশনকেই কেবল ঝামেলার মধ্যে বের হতে দেখিনি।”
“আচ্ছা, তাতেই হবে। একটা মতলব এসেছে শুনুন।”
শান্তিপ্রিয়বাবুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করতে থাকে সন্তোষ। একটু পরে ক্ষীণ একটা হাসির আভাস ফুটে ওঠে শান্তিপ্রিয়বাবুর মুখে।
মাস খানেক পরের এক রবিবার। ক’দিন পাড়ায় গোলমাল হয়নি মোটে। পাড়ার বাৎসরিক পিকনিক আসছে, সবার মেজাজ বেশ ফিনফিনে। ডায়মন্ড হারবারের ওদিকে কোন এক বাগানবাড়িতে পিকনিকের আয়োজন করা হচ্ছে, ক্লাবে সেই নিয়ে জোর আলোচনা বসেছে। আজ মেনু ঠিক করার পালা। শান্তিপ্রিয়বাবু পাড়ায় নতুন হলেও তাঁকেও সবাই ডেকে নিয়েছেন মিটিংয়ে।
টিয়া কাঁধে বটব্যালবাবু বললেন, “বিরিয়ানি আর চিকেন চাপই হোক তবে।”
মোড়ের গোলাপি বাড়ির সুমনা-মাসিমা সঙ্গে সঙ্গে ফুট কাটলেন, “উফ্, সেই এক বিরিয়ানি, খেয়ে খেয়ে মুখে চড়া পড়ে গেল।”
বটব্যালবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, “তবে কি খিচুড়ি আর লাবড়া?”
সুমনা-মাসিমার মুখ টমেটোর মতো লাল হয়ে গেল। ব্যাপার হল, তাঁদের বাড়িতে বারোমাস নানারকম পুজো হয়। তবে সব পুজোর প্রসাদ ওই এক, খিচুড়ি আর লাবড়া। পাড়ার কেউ কেউ তাঁকে আড়ালে লাবড়া মাসিমা বলেও ডাকে। এহেন লাবড়ার এমন অপমান! তিরবেগে উঠে দাঁড়িয়ে পেল্লায় একটা চিৎকার ছাড়েন তিনি, “না না, তা কেন, হবে পচা মাছের কাঁটা চচ্চড়ি।”
আসলে বটব্যালবাবু কিঞ্চিৎ কিপটে প্রকৃতির, সাধারণত একটু বেলা করে ভাঙা বাজারে গিয়ে যা পড়ে থাকে সেইসব ব্যাগ ভরতি করে সস্তায় নিয়ে আসেন। মাছ একটু নরম হয়ে গেলে দরাদরি করার সুবিধাও হয়। বাজারের সেই ঝামেলার দিন বোধ হয় বাড়িতে আত্মীয়-টাত্মীয় আসার ব্যাপার ছিল, তাই তাড়াতাড়ি গিয়েছিলেন।
মুহূর্তে খণ্ড প্রলয়। উকিল শেখরবাবু বটব্যালবাবুর প্রাণের বন্ধু, তিনি চেঁচাচ্ছেন, “মাছ নরম হলেই কিছু পচা হয় না, বেনিফিট অফ ডাউট…”
তাঁকে শেষ করতে না দিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ শিকদারবাবু ফোড়ন কাটলেন, “আরে রাখো তোমার বেনিফিট। এ কি ক্রিকেট ম্যাচ, না পাড়ার ফাংশন? হচ্ছিল পিকনিকের কথা!”
শিকদারবাবু কানে বেশ কম শোনেন, কিন্তু কিছুতেই মানতে চান না সেটা।
টিয়াটা কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, “বিরিয়ানি! লাবড়া!”
হোমিওপ্যাথি ডাক্তার অক্ষয় সোম সরু গলায় চেঁচিয়ে ওঠেন, “তবে যে আগের বছর বলেছিলে এই বছরের পিকনিকে আমার ভাইপোর ভেড়ি থেকে মাছ নেবে?”
তমালিকা নতুন বিয়ে হয়ে পাড়ায় এসেছে। তার শ্বশুরবাড়ি, মানে চ্যাটার্জীবাড়ির চালচলন একটু সাবেকি। চ্যাটার্জী-গিন্নি আর নতুন বউ, দুজনেরই মাথায় তাই লম্বা ঘোমটা। ঘোমটার আড়াল থেকে এবার তমালিকার চাঁচাছোলা কণ্ঠ শোনা যায়, “আইসক্রিম না হলে আবার পিকনিক হয় নাকি? আমি কিন্তু স্ট্রবেরি ফ্লেভার ছাড়া খাই না।”
অতনু এতক্ষণ এককোণে বসে একটা বিল বইয়ের উলটোদিকে খসখস করে কী লিখছিল। এবার উঠে দাঁড়ায়। তারপর তারস্বরে সুর করে বলতে থাকে—
“বিরিয়ানি চাপ বা খিচুড়ি ও লাবড়া
নিয়ে এলে পিকনিকে দেব এক থাবড়া!
ভেড়ি থেকে মাছ তুলে হবে কার শ্রাদ্ধ?
যতসব উজবুকে বানিয়েছে ফর্দ।
কান খুলে শুনে নাও ব্যবস্থা খ্যাটনের,
পিকনিকে চাই আমি দোপিয়াজা মাটনের।”
প্রবল গোলযোগ উপস্থিত হয়। শ্যামাশিসবাবু গ্রামের দিকে কোন স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন, অবসর নিয়ে এই পাড়ায় এসেছেন। বাজখাঁই গলায় তিনি চিৎকার করে উঠলেন, “কী! আমরা উজবুক? একে তো ওই জঘন্য কবিতা, তার ওপর লঘু-গুরু জ্ঞান নেই। অঙ্কে কত পেতে হে ছোকরা?”
কেউ কারও কথা শুনতে পাচ্ছে না, চাইছেও না। সবাই যে-যার মতো চেঁচিয়ে চলেছে। সবার ওপরে টিয়াটার গলা, “বিরিয়ানি! মাটন! মাছ!”
দেখতে দেখতে হালকা একটা হাসি ফুটে ওঠে শান্তিপ্রিয়বাবুর মুখে। তাঁর গলায় যে একটা হুইসল ঝুলছে সেটা কেউ খেয়াল করেনি। একছুটে ক্লাবের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে হুইসলটা জোরে বাজিয়ে দেন তিনি। ক্লাবের ভিতরের শোরগোল থেমে যায় হঠাৎ। কিন্তু তা কয়েক মুহূর্তের জন্য মাত্র। তারপরেই আবার শুরু হয়ে যায় পূর্ণ উদ্যমে।
হুইসলের শব্দ পাড়ায় ছড়িয়ে পড়তেই অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটে। প্রায় সব বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে ছেলেমেয়ের দল, বয়স তাদের ওই তেরো-চোদ্দ থেকে ষোলো-সতেরো। শান্তিপ্রিয়বাবুকে ঘিরে দাঁড়ায় তারা। নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় কিছু আলোচনা করে নিয়ে মার্চ করতে করতে তারা ঢুকে পড়ে ক্লাবের ভিতরে।
হঠাৎ ছোটোদের দেখে চমকে ওঠে সবাই। শিকদারবাবু সামলে নিয়ে কড়া গলায় বলেন, “তোরা এখানে যে?”
তাঁর নাতি তমোঘ্নও দলে ছিল। সে স্মার্ট গলায় বলে, “তোমরা প্রত্যেকবার মেনু ঠিক করো, এবার আমরা করব।”
শেখরবাবু বলে ওঠেন, “বটে! তা কীভাবে করবি?”
গম্ভীরভাবে বুঝিয়ে দেয় ছোটোরা। একটা বড়ো পাত্রে সবরকম মেনু লিখে চাপা দিয়ে রাখা হবে, তারপর পাড়ায় সবচেয়ে নতুন যিনি এসেছেন, তাঁকে বলা হবে একটা কাগজ বেছে তু্লে নিতে। সহজ একটা সমাধান পেয়েও কেমন যেন মুষড়ে পড়ে সবাই।
ফিকফিক করে হাসতে হাসতে বাড়ির রাস্তা ধরেন শান্তিপ্রিয়বাবু। মতলবখানা জব্বর দিয়েছিল সন্তোষ। পাড়ার ছোটোদের ঝগড়াঝাঁটি এড়িয়েই চলতে দেখেছেন তিনি। তাদের একজায়গায় জুটিয়ে গোপনে পরামর্শ করেছিলেন। পাড়ায় ঝগড়া লাগলেই হুইসল বাজিয়ে তিনি সংকেত দেবেন, তারপর বুদ্ধি খাটিয়ে ঝগড়া বন্ধ করা হবে। আসলে সব ঝামেলা তো ছোটোদের পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়, তাই ওই হুইসলের সংকেতের ব্যবস্থা।
কয়েকবার এমন হলেই নিশ্চয়ই ধীরে ধীরে ঝগড়ার উৎসাহ কমে আসবে সবার। একটা নামও ঠিক করা হয়েছে দলটার— শান্তি কমিটি।
পিকনিকের ব্যাপারটা মিটিয়ে চাপা গলায় ‘থ্রি চিয়ার্স ফর শান্তি কমিটি’ বলে নিল সবাই মিলে। বাড়ি ফিরে পরম শান্তিতে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন শান্তিপ্রিয়বাবু।
পাড়াটা কেমন মনমরা হয়ে গেছে। পিকনিকের পর পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, পুজোর বাজেট নিয়ে বসা— সবই হচ্ছে, কিন্তু কেমন যেন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। ঝগড়া লাগো-লাগো হলেই বাঁশির সংকেতে নিমেষের মধ্যে হাজির হয় শান্তি কমিটি, একটা না একটা সমাধান বের করে ঠান্ডা জল ঢেলে দেয় ঝগড়ার ওপর। ছুটির দিনেই এসবের আয়োজন হয়, তাই নেহাত অন্য কোথাও বেড়াতে না গেলে বাড়িতে থাকেও সবাই। ইদানীং বিশেষ একটা কাজ নেই শান্তি কমিটির, যদিও শান্তিপ্রিয়বাবু হুইসলটা গলায় ঝুলিয়েই রাখেন। কেমন অভ্যেস হয়ে গেছে তাঁর।
পাড়ার বড়োরা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে, টিয়াটারও বিশেষ শব্দ পাওয়া যায় না।
ঝিমিয়ে পড়েছেন শান্তিপ্রিয়বাবুও। চা খেয়ে তেমন একটা আমেজ পান না আজকাল। অম্বলের ব্যামো ধরেছে তার ওপর। সেদিন গিন্নিও ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বললেন, “বাবা! পাড়া, না শ্মশান।”
সকাল থেকে মেঘ করেছে খুব। তার ওপর অম্বলের ব্যথাটাও চাগাড় দিয়েছে শান্তিপ্রিয়বাবুর। ব্যাজার মুখে একতলার বারান্দায় বসে ছিলেন তিনি। টিয়া কাঁধে বটব্যালবাবু কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। সাধারণত শান্তিপ্রিয়বাবু মিষ্টি হেসে, ‘কী, ভালো তো?’ গোছের কিছু একটা বলেন, আজ কী হল, বলে বসলেন, “টিয়া কাঁধে ঘোরেন কেন মশাই?”
বটব্যালবাবু গোবেচারা মুখ করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন, তারপর তাঁর চোখ চকচক করে উঠল। নীচু গলায় সাবধানে বললেন, “আমার টিয়া, আমি কাঁধে রাখি, মাথায় রাখি, আপনার কী?”
শান্তিপ্রিয়বাবু অবাক হয়ে শুনলেন তিনি নিজেই বেশ জোর গলায় বলছেন, “পাগলের মতো কাজ করলে লোকে তো বলবেই।”
বটব্যালবাবু পাড়া কাঁপিয়ে চেঁচালেন, “আমি পাগল, না আপনি?”
শান্তিপ্রিয়বাবু গলা থেকে ঝুলতে থাকা হুইসলটা এক টানে খুলে কোথায় ছুড়ে ফেললেন। তারপর লাফাতে লাফাতে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার ছাড়লেন, “আপনার বাড়ির সবাই পাগল, ইনক্লুডিং ইওর টিয়া।”
তিনি হঠাৎ খেয়াল করলেন, তাঁর অম্বলের ব্যথা বিলকুল বেপাত্তা।
এক এক করে এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে লোকজন বেরিয়ে আসে। তাদের মুখে হাসি, চোখ চকচকে। পাড়াটা যেন অনেকদিন পর জেগে উঠেছে আবার।
শিকদারবাবু সব কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন না, উকিল শেখরবাবু পাশে দাঁড়িয়ে চিল চিৎকার করে তাঁকে রানিং কমেন্ট্রি দিতে থাকেন।
তুমুল গণ্ডগোলের মধ্যে বহুদিন পর টিয়াটা হঠাৎ কর্কশ গলায় বলে ওঠে, “শান্তি কমিটি জিন্দাবাদ! শান্তি কমিটি জিন্দাবাদ!”
ঘরের ভিতর শান্তিপ্রিয়বাবুর নিরীহ প্রকৃতির গিন্নি দুই হাত জোড় করে কপালে ঠেকান। কাকে প্রণাম জানান কে জানে, হয়তো-বা নারদকেই।
লেখিকার অন্যান্য লেখা
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস
দু-হাজার তিনশো বছর আগে পাটলিপুত্র থেকে তক্ষশিলা পর্যন্ত বাণিজ্যদলের সংঘাতবহুল রোমাঞ্চকর যাত্রাপথ শেষে এক তরুণ পৌঁছল তক্ষশিলায়। সেই নগরীর রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন উত্তাল। একদিকে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার, অন্যদিকে আচার্য কৌটিল্যের অখণ্ড ভারতের স্বপ্নে মশগুল একদল যোদ্ধা। অসংখ্য চরিত্রের ঘনঘটা, ষড়যন্ত্র, কাপুরুষতা আর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে কিছু মানুষের আত্মমর্যাদা আর স্বাধীনতা রক্ষার সাহসী সংগ্রামের আখ্যান এই উপন্যাস।
উত্তরমেরুর দুর্গম তুষার-মরুতে জীবন যুদ্ধে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লোকমুখে গড়ে উঠেছিল নানা রূপকথা। মেরু অঞ্চলের অধিবাসীরা পৃথিবীর বাকি অংশ থেকে ছিল বিচ্ছিন্ন। সম্পূর্ণ অচেনা সেই দেশের লোকসংস্কৃতি, আচার ব্যবহার, মনস্তত্ত্বের সাক্ষ্য রেখে গেছে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বাহিত গল্প-গাথা, যার রূপরেখা ফুটে উঠেছে কুড়িটি লোককাহিনির সংকলন 'তুষারদেশের রূপকথারা' বইটিতে।