উপন্যাস
FREE SHIPPING IN INDIA
উপন্যাস
ওই জঙ্গলে যে বাঘ আছে, সে-কথা শহরের বয়স্ক মানুষের মুখে শুনলেও বাঘ কেউ কোনোদিন চোখে দেখেনি। কাজেই জঙ্গলের ধারে একটা নালার পাড়ে একজন দেহাতি মানুষের আধখানা দেহ যেদিন সকালে উদ্ধার হল, সেদিন থেকে ওখানকার সকল মানুষের মনে আতঙ্ক ঢুকে গেল। এসব ক্ষেত্রে যেমন হয়, নানান জনে নানা গল্প আর গুজব রটিয়ে বেড়াতে লাগল। কেউ বলল বাঘটাকে নিজের চোখে দেখেছে, কেউ বলল বাঘটার পিশাচের মতো দাঁত আর কান। আসলে ওটা বাঘ নয়, পিশাচ, বাঘের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কিশোর ঘোষাল
“কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথি। গভীর জঙ্গলের মধ্যে আলকাতরার মতো ঘন অন্ধকারের রাত ছিল সেটা, বুঝলি? এত ঘন, মনে হচ্ছিল, একটু নড়াচড়া করলেই চটচটে অন্ধকার লেগে যাবে জামা-প্যান্টে, মুখে-চোখে।” অরণিদা চায়ের ভাঁড় শেষ করে বললেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এটা কি ভূতের গল্প, নাকি ডাকাতের? বেশ জমজমাট হওয়া চাই অরণিদা, না-হলে এই ভিজে ওয়েদারে জমবে না।”
“যা বলেছিস, ভেজা ঢাকের মতো মনটা ঢ্যাব ঢ্যাব করছে।” মনা বলল।
অরণিদা জিভে চুক করে একটা আওয়াজ তুলে একটু বিরক্ত সুরে বললেন, “তাহলে তোরাই কথা বল, আমি চুপ করলাম।”
কাতু আমার মাথায় চাঁটি মেরে বলল, “চুপ কর না পিকলে! অরণিদা কোনোদিন ভোঁদা গল্প বলেছেন? আপনি বলুন তো অরণিদা, ওদের কথায় কান দেবেন না।”
অরণিদা আবার শুরু করলেন, “তখন আমি ছিলাম ছত্তিশগড়ের কিরণাগড়ে। তখনও ছত্তিশগড় হয়নি, নাম ছিল মধ্যপ্রদেশ। কিরণাগড়ের সূরযলাল ব্রিজলাল গোহ্রাকে রাজা বললেও কম বলা হয়। যদিও সে-সময় রাজরাজড়াদের যুগ আর ছিল না। কিন্তু সে না থাকলে কী হবে, দাপটের কমতি ছিল না। ওই দিগরের লোকেরা সূরযলালকে তখনও রাজা বলেই মানত। আর সূরযলালও তাদের প্রজার মতোই পালন করতেন। আমি ছিলাম রাজার দিওয়ানের সহকারী। সেই দিওয়ান আবার ছিলেন এক বঙ্গসন্তান, শ্রীযুক্ত নিত্যগোপাল গোস্বামী। যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি রাজার অনুগত। রাজা সূরযলালও খুব বিশ্বাস করতেন নিত্যগোপালবাবুকে। তাঁদের প্রায় পঁচিশ বছরের দীর্ঘ সম্পর্ক। এর মধ্যে কতবার যে এই ‘গোসওয়ামিজি’ রাজাকে কত বিপদের সময় সঠিক পরামর্শ দিয়ে উদ্ধার করেছেন, তার কোনও হিসেব নেই। সে-কথা রাজা সূরযলাল স্বীকারও করতেন সকলের সামনে। আর রাজার এই গভীর বিশ্বাস আর আস্থার জন্যে প্রাসাদের সকলেই নিত্যগোপালবাবুকে খুব ভয় পেত আর শ্রদ্ধাও করত।”
আমরা অরণিদার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনতে লাগলাম। অরণিদার গল্প বলার মধ্যে বেশ একটা ইয়ে থাকে। তাতে পুরো ব্যাপারটা চোখের সামনে যেন কল্পনা করা যায়। আর এই গল্প বলার জন্যেই অরণিদার ছেলেবুড়ো সব মহলেই এত সুনাম।
একটু থেমে থাকার পর অরণিদা আবার বলতে শুরু করলেন, “ভূগোলে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট তো হলাম। কিন্তু চাকরি খুঁজতে গিয়ে ভূগোলে না পড়া কত যে জায়গায় ঘুরলাম, তার ঠিক নেই। প্রায় বছর দু-এক এর দুয়োর, তার দুয়োর ঘুরে কোত্থাও খুব কিছু সুবিধে হল না। ইন্সিওরেন্সের দালালি, ওষুধ কোম্পানির পেটমোটা ব্যাগধারী মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, পার্ট টাইম স্কুলের চাকরি, শাড়ির দোকানে সেলসম্যান, পাটের গুদামের সিকিউরিটি, টিউশনি— কী না করেছি ওই দু-বছরে! আমি কলেজে পড়তে-পড়তেই বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। কাজেই ছোটো ভাই আর বোনের লেখাপড়া সামলে সংসার চালাতে আমার মায়ের তখন হিমসিম অবস্থা। আর বড়ো ছেলে হিসেবে আমার ওপরই তাঁর তখন অনন্ত ভরসা। এই কথাটা আমি যত চিন্তা করতাম, তত পাগলের মতো কাজের সন্ধানে ঘুরতাম। এইরকম দুঃসময়েই আমার এক বন্ধুর পিসতুতো জামাইবাবুর খুড়তুতো দাদা খবর পাঠালেন— মধ্যপ্রদেশ যাবি? খাসা চাকরি আছে।”
“বাপ রে, আপনার বন্ধুর পিসতুতো জামাইবাবুর খুড়তুতো দাদা! সম্পর্কের জটিল গুঁতো।” অরণিদার কথার মধ্যে ফচকে বদ্দেটা ফোড়ন কেটে বসল।
অরণিদা খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোর মাথার গোবরের মধ্যে এসব ঢুকবে না, বদ্দে। বৃথা চেষ্টা করিস না। তখনকার দিনে সব বড়ো বড়ো একান্নবর্তী পরিবার হত। এক-এক পরিবারে হয়তো পাঁচ ভাই, চার বোন। তাঁদের ছেলেমেয়ে, আত্মীয়পরিজন নিয়ে সে ছিল এলাহি ব্যাপার। তখনকার দিনে সব সম্পর্ক, সবার নাম সকলেই মনে রাখত। তোরা এখন নিজের একমাত্র কাকার কিংবা একমাত্র পিসির ছেলেমেয়েদের নামও ভুলে যাস রে গোবর্ধন!”
বদ্দেটা তবু থামল না। বলল, “যাহা একান্ন, তাহা বাহান্ন। বাহান্নবর্তী বললেও হয়, কিংবা তিপ্পান্ন।”
আমি বদ্দের মাথায় চাঁটি মারলাম।— “হতভাগা, একান্ন মানে এখানে ফিফটি-ওয়ান নয়, একই অন্ন পরিবারের সবাই খেত, তাই একান্ন। চুপ করে শুনতে হলে শোন, নয়তো তোকে তাড়াব, এই বলে রাখলাম।”
বদ্দের দিকে খুব করুণাঘন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অরণিদা আবার বলতে শুরু করলেন, “খবরটা পেয়ে সঙ্গে-সঙ্গেই আমি তো বন্ধুকে নিয়ে পড়িমরি ছুটলাম পিসতুতো জামাইবাবুর খুড়তুতো দাদার বাড়ি। আমরা তখন থাকি উত্তরের খাল পেরিয়ে কাশীপুরে, আর খুড়তুতো দাদা থাকতেন টালিগঞ্জে টলির নালার পাশে। রাত তখন প্রায় সাড়ে ন’টা। সেখানে উনি একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করে দিলেন। শান্ত সৌম্য চেহারা, বেশ একটা গ্রাম্ভারি ব্যক্তিত্ব আছে, কিন্তু মনে ভয় আসে না বরং শ্রদ্ধা আসে। পরিচয় হতেই আমরা দুজনকেই ঢকঢক করে প্রণাম করলাম।
“ভদ্রলোক আমাকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘আমার নাম নিত্যগোপাল গোস্বামী। আমি কিরণাগড়ের রাজার দেওয়ান। আমার একজন ইয়াং, শিক্ষিত, কর্মঠ ছেলে দরকার। তোমার কথা ফন্তুর মুখে শুনেছি। তোমাকে দেখেও মনে হচ্ছে তোমাকে দিয়ে আমার কাজটা হবে। তুমি যদি রাজি থাকো, কাল সকাল সাড়ে ন’টায় হাওড়া থেকে ট্রেন। আমি যাচ্ছি, তুমি আমার সঙ্গে গেলে তোমার কোনও অসুবিধেও হবে না। তার আগে মাইনের কথাটা বলে নিই। মাস গেলে ন’শো পঁচাত্তর টাকা তোমার বাড়িতে মানি অর্ডার করে দেওয়া হবে। ওখানে হাতখরচা পাবে পঁচিশ টাকা। মোট এক হাজার। থাকা-খাওয়া বিনি পয়সায়। ভেবেচিন্তে বলো তুমি রাজি কি না।’ ”
“ফন্তুবাবু কে, অরণিদা?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
অরণিদা হাসতে হাসতে বললেন, “ওই খুড়তুতো দাদার নাম। ফণীন্দ্রনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, ডাকনাম ফন্তু। তখনকার দিনে এমনই হত। ভালো নামটা বিরাট ভারী, আর ডাকনামটা একদম হালকা। খুড়তুতো দাদার ছোটো ভাইয়ের নাম নৃপেন্দ্রনারায়ণ, তাঁর ডাকনাম ছিল ন্যাপা।
“নিত্যগোপালবাবুর মুখে মাইনের কথা শুনে আমি তো অবাক। আকাশের চাঁদ পেড়ে দিলেও আমি অত আশ্চর্য হতাম না। আনন্দে কী যে উত্তর দেব ভেবে পেলাম না। আমার অবস্থাটা ফন্তুদা বুঝতে পারলেন। তিনিই আমার হয়ে উত্তর দিয়ে দিলেন, ‘ভাবনা-চিন্তার আবার আছেটা কী? ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে কাল সকালেই হাওড়া স্টেশনে বড়ো ঘড়ির নীচে চলে আসবি। সাড়ে আটটার মধ্যে। ব্যস, ফাইনাল।’
“নিত্যগোপালবাবু বললেন, ‘না না, ফন্তুবাবু। ওকে কাজ সম্বন্ধে তো এখনও কিছুই বলিনি। কাজের ধরন ওর ভালো না-ই লাগতে পারে।’
“ফন্তুদা সে-কথার কোনও গুরুত্বই দিলেন না। বললেন, ‘আপনার সঙ্গে থাকবে, আপনি যা বলবেন তা-ই করবে। আপনি তো আর চুরি-ডাকাতি করতে বলবেন না, বা পাহাড়ের মাথা থেকে ঝাঁপ দিতেও বলবেন না। কাজের আবার ভালোমন্দ কী? সব কাজই কাজ। কী রে, অরু? তাই না?’
“আমি বিশাল ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললাম, ‘ফন্তুদা যা বলেছেন, একদম ঠিক। সব কাজই কাজ। আমি স্যার, কাল সকালে সাড়ে আটটার মধ্যে হাওড়ার বড়ো ঘড়ির নীচে দাঁড়িয়ে থাকব।’
“বাড়ি ফিরে চাকরির খবরটা দিতেই ভাইবোন খুব খানিক নাচানাচি করল। কিন্তু মাকে মাইনের কথা বলতে খুব একটা খুশি হলেন না। বললেন, ‘তোর মতো ছেলের জন্যে ও ক’টা টাকা আবার টাকা নাকি?’ তারপর কাঁদতেও শুরু করলেন।— ‘কালকেই চলে যাবি? ক’দিন পরে গেলে হয় না? কবে ফিরবি?’
“বাংলার মায়েদের বুকেই ভগবান কেন যে এত মাতৃত্ব ভরে দেন, কে জানে! মা চলে গেছেন অনেকদিন, আজও খুব মনখারাপ করে মায়ের জন্যে।”
অরণিদা একটু চুপ করে দরজা দিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। আমরাও কেউ কিছু বলতে পারলাম না। অরণিদার সেই দিনগুলোর কথা ভেবে আমাদেরও মনটা ভারী হয়ে উঠল।
একটু পরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরণিদা আবার শুরু করলেন, “কিরণাগড়ে গিয়ে আমার কিন্তু বেশ মন বসে গেল। নিরিবিলি জায়গা। কলকাতার মতো এত হুড়ুমদুড়ুম হুজ্জুত নেই। কাজও তেমন কিছু নয়। চিঠি-ফিঠি আনতে বা পাঠাতে পোস্টাপিসে যাওয়া, ব্যাংকে যাওয়া। রাজা সূরযলাল বা তাঁর ভাইয়েরা কোথাও বেরোলে তাঁদের পিছনে থাকা। অবশ্যি আমি একলা নই, আরও অনেকেই থাকত আমার সঙ্গে। রাজামশাইদের কখন কী প্রয়োজন পড়ে বলা তো যায় না! বেশ মজাতেই ছিলাম। কিন্তু কয়েক মাস পরে অমন নিরিবিলি জায়গাতেও ঝামেলা পাকিয়ে তুলল একটা বাঘ। তাও যেমন-তেমন নয়, একেবারে মানুষখেকো।”
আমি আর কাতু একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম, “বাঘ! মানুষখেকো?”
“তবে আর বলছি কী? ক’টা চপ আর এক ঠোঙা মুড়ি হলে মন্দ হত না, কী বল?”
“সেই বাঘের চপ-মুড়িও চলত, বলছেন কী অরণিদা?”
আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতে অরণিদা বললেন, “ধুর পাগল, বাঘে চপ খাবে কেন? বলছিলাম, এমন বাদলার দিনে চপ-মুড়ি হলে ভালোই হত। শুধু মুখে আর কত গল্প বলা যায়? তা আমিই দাম দেব, নাকি তোরা দিয়ে দিবি?”
আমরা সমস্বরে বললাম, “আপনি কেন দেবেন? আমরাই আনাচ্ছি। কিন্তু আপনি গল্প থামাবেন না প্লিজ।”
“দাঁড়া দাঁড়া, বাঘও পালাবে না, গল্পও কিছু ফুরিয়ে যাবে না। চপ-মুড়ি খেয়ে, গলাটা চায়ে ভিজিয়ে আবার শুরু করব।”
অন্যসময় ফুটবল পেটালেও, বৃষ্টি-বাদলার দিনে আমরা ক’জন মনসাতলার মিলনতীর্থ সংঘের ক্লাব ঘরে ক্যারমে টুসকি মারি। বিকেলের দিকে কম করে ঘণ্টা দু-এক নির্ঘাত। আমরা বলতে নিতে, কাতু, মনা, বদ্দে আর আমি পিকলে। আমাদের নামগুলো শুনে খুব বদখত ফচকে ছোঁড়া মনে হলেও আমরা মোটেও তেমন নই। নিতের নাম নিত্যানন্দ। কাতু আসলে সৈকত, মনা হল মনমোহন আর বৈদ্যনাথ থেকে বদ্দে। আর আমি? নিজের নাম ঢাক পিটিয়ে বলার কোনও মানে হয় না।
এবারে বর্ষাটা এমন জাঁকিয়ে বসেছে, যাওয়ার নামটি নেই। আর এই ভরপুর বর্ষার মধ্যেই পুজোটা অন্যবারের তুলনায় তাড়াহুড়ো করে এল, আবার হুট করে চলেও গেল। কালীপুজোর সময়ও টানা বৃষ্টি যখন দু-দুটো দিন মাটি করে দিল, তখন আর আমাদের দুঃখের শেষ রইল না। কাল বাদে পরশু ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, তার পরেই তো স্কুল খুলে যাবে। এবারের পুজোর ছুটিটা বরবাদ করে দিয়ে কার যে কী লাভ হল কে জানে।
ওরা চারজন ক্যারম খেলছিল, আমি বসে বসে বৃষ্টি দেখছিলাম। পিছনের ডোবা থেকে ব্যাঙেদের গ্যাঙর গ্যাঙ আহ্লাদ শুনে গা জ্বলে যাচ্ছিল। হতভাগাদের খুব আনন্দ। ওদের তো আর দুর্গাপুজো, কালীপুজো নেই, ছুটির পর স্কুলও নেই। ওরা আর কী বুঝবে? এদিকে বদ্দে বেসের একটা সাজানো সহজ ঘুঁটি বিচ্ছিরি কেঁচিয়ে সেটাকে মাঝ বোর্ডে তুলে দিয়ে বললে, “খবরে বলছে, আরও বাহাত্তর ঘণ্টা চলবে এরকম বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়া।”
আমি হতাশ হয়ে বললাম, “বোঝো। তার মানে, স্কুল খোলার দিন থেকেই নিম্নচাপ সরে গিয়ে ওয়েদার পরিষ্কার হয়ে যাবে!”
বদ্দে বলল, “যা বলেছিস পিকলে। ছুটিগুলো তো ছুটেই গেল, এবার স্কুল খুললেই আমাদের ছুটোছুটি।”
বাইরে একটানা বৃষ্টি আর ঘরে বসে একঘেয়ে ক্যারম খেলা, মোটেই ভালো লাগছিল না। আর ঠিক সেই সময়ই ঘরে ঢুকেছিলেন অরণিদা। অরণিদা আমাদের পাড়ায় ভীষণ জনপ্রিয় লোক। ছেলেবুড়ো সকলের কাছেই তিনি অরণিদা। আমার বাবাও বলেন অরণিদা, আবার আমরাও বলি অরণিদা। বয়স পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন। লিকপিকে ঢ্যাঙা রোগা চেহারা, দাড়িগোঁফ কামানো। মাথা-ভরতি কালো কুচকুচে চুল। ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি সর্বদাই লেগে আছে। মাস দু-তিন পরপর তিনি হঠাৎ হঠাৎ উদয় হন, এক-আধদিন আমাদের বাড়ি থেকে কোথায় আবার চলে যান। কী করেন, কোথায় যান কেউ বলতে পারে না। অবিশ্যি সে নিয়ে কারও তেমন মাথাব্যথাও নেই। কারণ অরণিদার পকেটে অফুরন্ত গল্প, আর সে-সব গল্পে কী নেই? রহস্য-রোমাঞ্চ, ভূতপ্রেত, দত্যি-দানো সব আছে। অরণিদা যে-আড্ডাতেই বসেন, সেই আড্ডার তিনিই মধ্যমণি। তিনি বলেন, আর সবাই শোনে। এই গল্প ছাড়া তিনি নিজের সম্বন্ধে স্পষ্ট করে আর কিছুই বলেন না।
সেই অরণিদা ক্লাব ঘরে ঢুকে মেঝেয় পাতা শতরঞ্চিতে বসে পড়ে বললেন, “কী, খবর কী তোদের?”
আমরা চটপট সবাই ক্যারম বোর্ড তুলে অরণিদাকে ঘিরে বসলাম। নিতে উল্লসিত গলায় বলল, “খবর আর কী। হতভাগা নিম্নচাপ এমন জুটেছে টানা বাদল আর ঝড়ো হাওয়া নিয়ে, আমাদের গাঁটে গাঁটে ঘুণ ধরিয়ে দিল অরণিদা! বললে বিশ্বাস করবেন না, একটু আগে আপনার কথাই মনে হচ্ছিল। আজকের দিনে আপনার কোনও বিকল্প নেই।”
আমাদের ক্লাবের পাশেই গণেশদার চায়ের দোকান। মনা চেঁচিয়ে বলল, “গণাদা, ছ’টা চা, অরণিদার জন্যে স্পেশাল।”
সেই চা শেষ করে অরণিদা গল্পের গাড়ি চালু করেছিলেন। কিন্তু ভূমিকার পরেই মোক্ষম সময়ে এসে অরণিদা গল্পে এমন ব্রেক দিলেন, আমরা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। অগত্যা চপ-মুড়ি এল, তারপরে আবার চাও এল। চপ-মুড়ির সদ্ব্যবহার হয়ে যাওয়ার পর অরণিদা বললেন, “কম জায়গা তো ঘুরলাম না। কিন্তু তোদের এই গণশার চা আর গোপলার আলুর চপের জুড়ি আর কোথাও পাইনি।”
কাতু অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। বলল, “অরণিদা, বাঘটার কী হল?”
অরণিদা পা দুটো ছড়িয়ে আরাম করে বসতে বসতে বললেন, “কীসের বাঘ? বাঘ আবার কোত্থেকে এল?”
“বা রে, এইমাত্র বললেন যে, কিরণাগড়ের বাঘ—মানুষখেকো!”
“ওহ্, সেই বাঘটা? তার কথাই তো বলছি! কিরণাগড় শহরের সীমানা থেকে মাইল ছয়েক উত্তর থেকে একটা জঙ্গল শুরু হয়েছিল। বিশাল আর বেশ ঘন জঙ্গল। প্রচুর হরিণ, সম্বর, নীলগাই ছিল ওই জঙ্গলে। আর ওই জঙ্গলেই রাজাবাবুরা মাঝে মাঝে যেতেন পাখি-টাখি শিকারে। আমিও ওঁদের সঙ্গে তল্পিবাহক হয়ে গিয়েছি বার দু-এক। ওঁদের ওই শিকার ব্যাপারটা আমার মোটেই পছন্দ হয়নি, বিশেষ করে পাখি-টাখি। বন্দুক ছুড়ে নিরীহ পাখি মেরে কী যে আনন্দ পান এই মানুষগুলো, কে জানে! তবে ওই জঙ্গলে যে বাঘ আছে, সে-কথা শহরের বয়স্ক মানুষের মুখে শুনলেও বাঘ কেউ কোনোদিন চোখে দেখেনি। কাজেই জঙ্গলের ধারে একটা নালার পাড়ে একজন দেহাতি মানুষের আধখানা দেহ যেদিন সকালে উদ্ধার হল, সেদিন থেকে ওখানকার সকল মানুষের মনে আতঙ্ক ঢুকে গেল। এসব ক্ষেত্রে যেমন হয়, নানান জনে নানা গল্প আর গুজব রটিয়ে বেড়াতে লাগল। কেউ বলল বাঘটাকে নিজের চোখে দেখেছে, কেউ বলল বাঘটার পিশাচের মতো দাঁত আর কান। আসলে ওটা বাঘ নয়, পিশাচ, বাঘের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পিশাচ কেমন দেখতে? যে বলছে, সে তার জীবনে ক’টা পিশাচকে দেখেছে ভয়ে সেটাও কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারল না।
“এই নিয়েই সর্বত্র আলোচনা চলতে লাগল। রাজার বাড়ির অন্দরমহল থেকে রাস্তার ধারে চায়ের দোকানের ঝুপড়ি পর্যন্ত। ব্যাপারটা সবে একটু যখন থিতিয়ে আসছিল, ঠিক তখনই শহর থেকে একটু দূরের এক গাঁয়ে একদিন রাত্রে মারা পড়ল ভটকিপ্রসাদের গোয়ালের একটা মোষ। আর ওই গোয়ালেই থাকত এক ছোকরা রাখাল, দেখা গেল সেও বেপাত্তা। ভোরের আলো ফুটতেই গাঁয়ের বেশ কিছু লোকজন মিলে একসঙ্গে লাঠিসোঁটা নিয়ে বের হল। অনেক খোঁজাখুঁজি করে সেই ছোকরা রাখালের লাশ মিলল মাঠের ধারে ঘন একটা বাবলা ঝোপের মধ্যে। এরও শরীরের অনেকটাই খেয়ে ফেলেছিল বাঘটা।
“এই ঘটনার পর কিরণাগড় এবং তার আশেপাশের ছোটোবড়ো গ্রামগুলোর পরিস্থিতি পুরো পালটে গেল। জরুরি কাজ ছাড়া দিনের বেলাতেও লোকজন ঘর ছেড়ে বেরোতে ভয় পাচ্ছিল। সকলের মুখ-চোখে সর্বদাই একটা আতঙ্ক, বিকেলের পর থেকেই পথঘাট শুনশান। সন্ধে কিংবা রাত্রে তো কথাই নেই। বাচ্চাদের স্কুল-টুল সব লম্বা ছুটি দিয়ে দিল। পোস্টাফিস, ব্যাংক, সরকারি দপ্তর সবই প্রায় অচল; দেড়টা-দুটোর দুপুরবেলাতেই অফিসে বড়ো বড়ো তালা বন্ধ করে যে যার বাড়ি পালায়। হাসপাতালে যেসব পেশেন্ট ভরতি ছিল, তারাও অসুখ সারার আগেই বাড়ি চলে গেল। থানার দারোগাবাবু জিপ নিয়ে নিজে মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে সকলকে সতর্ক করতে লাগলেন। তিনি ঘোষণা করতে লাগলেন, সন্ধের পর বাড়ির বাইরে বেরোবেন না। জরুরি দরকার পড়লে হাঁকডাক করে দল বেঁধে বেরোবেন। ঘরের মধ্যে কথাবার্তাও বলবেন নীচু স্বরে। সকলে একসঙ্গে না ঘুমিয়ে ঘরের ভেতরে দু-একজন পাহারা দিতে পারলে খুব ভালো। এইরকম সব সতর্কবার্তা আর কী!
“মোদ্দা কথায়, সবকিছুই বন্ধ হয়ে যেতে বসল এক ওই বাঘের আতঙ্কে। নিশ্চিন্ত রাজবাড়িতেও তখন গভীর দুশ্চিন্তা। রাজা সূরযলাল খুব চিন্তিত মুখে তাঁর সকল ভাই, ছেলে, ভাইপো, লোকজনদের ডেকে বার বার জরুরি মিটিং করতে শুরু করলেন। সকলের মুখেই একই কথা— ‘ক্যায়া কিয়া যায়, ক্যায়া করনা চাহিয়ে?’ ‘ক্যায়সে ইয়ে আদমখোর কা নিধন কিয়া যায়?’ সেই আলোচনায় নিত্যগোপালবাবুও থাকতেন, আর তাঁর পেছনে আড়ালে বসে থাকতাম আমি। কে কী বলছেন মন দিয়ে শুনতাম।
“এইরকম এক আলোচনায় অনেকে অনেকরকম কথা বলল। দু-একজন বলল, বাঘটাকে ধরার জন্যে ফাঁদ পাতা হোক। ফাঁদে ধরা পড়ার পর বাঘটাকে ধরে নিয়ে যাক বনদপ্তরের কর্মীরা। তারা কলকাতা কিংবা দিল্লির চিড়িয়াখানায় রেখে দেবে। এই জ্যান্ত বাঘ ধরা নিয়ে যিনি সব থেকে উৎসাহী ছিলেন, তিনি হচ্ছেন ছোটেলালজি। সকলেই তাঁর মতামতের কদর করছিল এবং তাঁর কথা মন দিয়ে শুনছিলও। কিন্তু শেষমেশ অধিকাংশ লোকেরই মত হল, ওসব ফাঁদ-টাঁদ বানিয়ে বাঘ ধরার কাজটা বহোৎ জোখিম মানে খুব ঝুঁকির কাজ। এতটুকু এদিক-সেদিক হলেই অনেকের জান চলে যেতে পারে, ঘায়েল তো হতেই পারে! আর আজকাল তেমন এলেমদার লোকই-বা কোথায়? থাকত ছোটেলালজির জোয়ান বয়স, চিন্তা করে দেখা যেত। তার চেয়ে বড়ো বড়ো শিকারিদের ইনভাইট করে নিয়ে আসা যাক। বড়ো টাকার ইনাম ঘোষণা করলে বাঘটাকে মারতে অনেক বড়ো শিকারি নিশ্চয়ই এসে যাবে। আর ভালো শিকারি হলে ছাগলের টোপ দিয়ে বাঘটাকে গুলি করে মেরে ফেলা কোনও ব্যাপারই নয়।
“এই ব্যবস্থাটাই সকলেরই মনে ধরল, রাজা সূরযলালও সম্মতি দিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা ইনাম ঘোষণা করে দিলেন। তখনকার দিনে পঞ্চাশ হাজার টাকা বিশাল অঙ্ক, এখনকার হিসেবে তিন-চার লাখ তো বটেই!
“আমার কিন্তু এই শিকারি দিয়ে বাঘটাকে মেরে ফেলার ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হল না। বরং ছোটেলালজির বাঘ ধরার ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল। তবে ওই আলোচনায় আমার কথা কে আর শুনবে? আমার মতো সামান্য লোকের কিছু বলতে যাওয়া মানে সাধের চাকরিটা খোয়ানো।
“যে-মানুষটি রাজাবাবুর দরবারে ফাঁদ পেতে বাঘ ধরার কথা বলেছিলেন, সেই ছোটেলালজি, বেঁটেখাটো হলেও তাগড়া টানটান চেহারা। অনেক বয়স হয়েছে, কিন্তু চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, শরীর আর মনে এখনও অনেক ক্ষমতা রাখেন। ওই সভায় তাঁর বাঘ ধরার প্রস্তাব যখন অধিকাংশ লোকই নাকচ করে দিল, তাঁর মুখ দেখেই বুঝেছিলাম, তিনি আদৌ খুশি হননি। অনেকের থেকে আলাদা এই লোকটির সঙ্গে আমার আলাপ করার খুব ইচ্ছে হল। কিন্তু ওই সভায় তো আর সেটা সম্ভব ছিল না।
“দিন পাঁচ-ছয় পর আমি একটা কাজে শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে পোস্টাপিসের সামনে আমি ছোটেলালজিকে দেখলাম। দেখেই আমার আলাপের ইচ্ছেটা জেগে উঠল। আমি এগিয়ে গিয়ে মাথা নীচু করে প্রণাম জানাতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অবাক হয়ে। বুঝলাম আমাকে চিনতে পারেননি। খুব বিনীত স্বরে বললাম, ‘আমাকে চিনবেন না। আমার নাম অরণি। আমি দেওয়ানজির কাছে কাজ করি। এই মাস ছয়েক হল নতুন এসেছি। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই, যদি অনুমতি করেন।”
শয়তান বদ্দেটা চুপ করে থাকতে পারল না। বলে উঠল, “আপনি এমন বিশুদ্ধ বাংলায় বললেন, আর ছোটেলালজি বুঝে ফেললেন? ছোটেলালজি বাংলা বুঝতেন নাকি?”
“আমাদের কথাবার্তা হয়েছিল আমার কলকাত্তাই আর ওঁর দেহাতি হিন্দিতে। সে-ভাষা বললে তুই বুঝবি তো হতভাগা?
“ছোটেলালজি এবার চিনতে পারলেন। বললেন, ‘হাঁ হাঁ, ইয়াদ আয়া। এক-দু’বার দেখেছি বটে দিওয়ানজিকে সাথ। লেকিন আমার সঙ্গে কী কথা বলতে চাস বেটা?’
“সেদিন রাজসভায় আপনি বাঘটাকে ফাঁদে ধরার কথা বলছিলেন। বাঘটাকে মেরে না ফেলে যদি ধরে ফেলা যায় সেটাই চেষ্টা করে দেখুন না। বাইরের শিকারিরা আসার আগেই আমরা যদি বাঘটাকে ফাঁদে বন্দি করতে পারি?’
“ছোটেলালজি কিছুক্ষণ খুব হাসলেন। বললেন, ‘কিন্তু রাজাজি বাঘকে ধরার জন্যে কোনও ইনাম তো ঘোষণা করেননি, করেছেন মারার জন্যে। বাঘ ধরে কী লাভ?’
“আমিও ছাড়ার পাত্র নই, জবাব দিলাম, ‘বাবুজি, আপনি তো ইনামের লোভে বাঘ ধরার চিন্তা করেননি। মানুষখেকো হলেও আপনি বাঘটাকে মেরে ফেলতে চাননি। তাই না?’
“আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ছোটেলালজি। তারপর ভ্রূকুটি করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে বলেছে আমি মেরে ফেলতে চাইনি? আদমখোর বাঘকে একশো বার মেরে ফেলা দরকার।’
“আমি বললাম, ‘বাবুজি, স্বাভাবিক নিয়মে বাঘ তো মানুষ খায় না! বয়স হয়ে গেলে, কিংবা কোনও কারণে তার ক্ষমতা কমে গেলে সহজ শিকার হিসাবে ওরা মানুষ খায়, কিংবা দড়িতে বাঁধা পোষা জানোয়ার খায়।’
“এইবার ছোটেলালজি বেশ অবাক হয়ে বললেন, ‘আরে বাহ্! তুই এসব কী করে জানলি? তুই কলকাতায় থাকা বঙ্গালি না? কলকাতায় জঙ্গল আছে, আর সেখানে বাঘ আছে এমন তো শুনিনি কোনোদিন!’
“ ‘না, বাবুজি। কলকাতায় জঙ্গল নেই, চিড়িয়াখানা আছে। আর সেখানে খাঁচায় বন্দি বাঘ ছাড়া জঙ্গলের বাঘ কখনও চোখে দেখিনি। তবে বাঘ আর চিতা শিকার নিয়ে বিখ্যাত এক শিকারির লেখা কয়েকটা বই পড়েছি।’
“ ‘চিতা মতলব তেন্দুয়া? লেকিন ইয়ে শিকারি কৌন হ্যায়? হিন্দুস্থানি কেউ, নাকি কোন সায়েব?’
“ ‘সায়েব, বাবুজি। একসময় সরকারি নির্দেশে উত্তর ভারতের অনেক মানুষখেকো বাঘ, চিতা মেরেছেন। কিন্তু তিনি ভারতের জঙ্গলকে খুব ভালোবাসতেন। জঙ্গলের সমস্ত জানোয়ার, পাখি এমনকি সেখানকার মানুষদেরও তিনি বেজায় ভালোবাসতেন। সবার ওপরেই তাঁর খুব মমতা আর সহানুভূতি।’
“ছোটেলালজি বললেন, ‘তবে? তোর সায়েবও তো মানুষখেকো বাঘকে মেরেছে, সে তো ধরার চেষ্টা করেনি!’
“আমি বললাম, ‘তা করেছেন। কিন্তু তিনি তো আপনার মতো মানুষের খোঁজ পাননি, পেলে নিশ্চয়ই মারতেন না।’
“ছোটেলালজি হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুই আমার সম্বন্ধে কী জানিস? কোন ভরসায় বলছিস, যে আমি বাঘ ধরে ফেলব?’
“ ‘কিচ্ছু জানি না, বাবুজি। শুধু এটুকু বুঝেছি, আপনার মতো অভিজ্ঞ একজন মানুষ যখন একটা মানুষখেকো বাঘকে ধরার কথা চিন্তা করছেন, তার মধ্যে অনেক চিন্তাভাবনা আছে, বহুদিনের অভিজ্ঞতা আছে।’
“ছোটেলালজি হাসলেন। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘বুঝলাম। কিন্তু বাঘ ধরার ব্যাপারে তুই কী জানিস?’
“ ‘কিছুই জানি না বাবুজি, ও-কাজটা আপনার থেকে ভালো আর কে জানে? আমার মনে হল, খিদের জ্বালায় কয়েকজন মানুষকে মেরেছে বলেই একটা বাঘের এত বড়ো শাস্তি হওয়াটা উচিত নয় বোধ হয়। তাকে বাঁচার আর একটা সুযোগ দেওয়াই যায়। আর সেটা আপনিই করতে পারেন।’
“আমার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছোটেলালজি বললেন, ‘দেওয়ানজিকে বলেছিস?’
“ ‘আজ্ঞে না, দেওয়ানজিকে বলিনি। আপনি রাজি না হলে দেওয়ানজিকে বলে কী লাভ?’
“ ‘সহি বাত। আসলে কী জানিস, বাঘ হচ্ছে জঙ্গলের রাজা। তাকে এককথায় মেরে ফেলার প্রস্তাবটা আমার মোটেই মনোমতো হয়নি। আমিও বাঘটাকে ধরার কথা এখনও চিন্তা করছি। কিন্তু কাজটা তো আর অত সহজ নয়! জঙ্গলের রাজাকে জঙ্গলে ঢুকেই ঝপ করে ধরে ফেললাম, এমন তো হয় না! তুই এক কাজ কর, এখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব কথা হবার নয়, দেওয়ানজিকে বলে রাখিস, আগামীকাল দুপুরে আমি আসব, রাত্রে ওখানেই থাকব। এক-আধঘণ্টায় সব কথা তো হবে না, সময় লাগবে। বিকেলের পর আমার বাড়ি ফেরা মুশকিল হয়ে যাবে।’
“ছোটেলালজির আসার কথা আমি দেওয়ানজিকে বলে রেখেছিলাম। কী বিষয়ে কথা হবে সে-কথা বলতেই দেওয়ানজি রেগেমেগে একশা। বললেন, এসব চিন্তা মাথায় এলে আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবেন। বাড়িতে মা, ভাইবোনদের মুখগুলো মনে পড়তে আমিও দেওয়ানজির সঙ্গে তর্কে গেলাম না, চুপচাপ মেনে নিলাম। ছোটেলালজির আসার অপেক্ষায় রইলাম, দেখাই যাক না কী হয়।
“সে-সময় মানুষখেকো বাঘের ভয়ে দুপুরের মধ্যেই সবার সব কাজ শেষ হয়ে যায়, কাজেই দুপুরের পর আমাদেরও তেমন কাজ থাকে না। ছোটেলালজি দেওয়ানজির বাড়িতে উপস্থিত হলেন মাঝদুপুরে। দেওয়ানজির সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর ওঁরা একসঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সারলেন। তারপর আমার ডাক পড়ল। আমি ঘরে ঢুকতেই মেঝেয় বিছানো গদিতে বসা ছোটেলালজি আমাকে ডাকলেন, ‘অন্দর আ, বেটা। দেওয়ানজি, আপনার এই ছেলেটি খুবই সমঝদার।’
“দেওয়ানজি এ-কথায় খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন না, চুপ করে রইলেন। ছোটেলালজি আরও বললেন, আমি কোন এক সায়েবের কিতাব পড়ে বাঘের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানি। দেওয়ানজি খুব অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সায়েবের বই? কোন সায়েব?’
“ ‘জিম করবেট।’
“দেওয়ানজি খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ওঁর দুটো বই পড়েই জঙ্গলে ছুটছ বাঘ ধরতে? করবেট সায়েব কত বছর ধরে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন, জঙ্গল চিনেছেন, সে-খবর রাখো? এরপর তো লোকে ‘প্লেন চালানোর সহজ পাঠ’ পড়েই প্লেন চালাতে শুরু করে দেবে!’
“দিওয়ানজি আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলছিলেন, ছোটেলালজির কথাগুলো বুঝতে না পারলেও দেওয়ানজি আর আমার মুখের ভাব দেখে বুঝলেন, আমি খুব বকা খাচ্ছি। ছোটেলালজি দেওয়ানজিকে থামিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ওকে কেন বকাঝকা করছেন, দেওয়ানজি? কথা তো আমি বলতে এসেছি, নাকি?’
“দেওয়ানজি একটু অপ্রস্তুত হলেন। একটু রাগত স্বরে ছোটেলালজিকে বললেন, ‘এই ছোকরার বাড়িতে আছে বিধবা মা, ছোটো ছোটো দুই ভাইবোন। অনেক কষ্টে এই চাকরিটা জুটিয়ে সংসারটা সবে সামলে উঠছে! আর এই সময়েই ছোকরার কোথাও কিছু নেই, মাথায় বাঘ ধরার ভূত চেপেছে! আপনি বুঝতে পারছেন না ছোটেলালজি, ওর কিছু একটা হয়ে গেলে কী জবাব দেব আমি? যার কথায় আমি ওকে এখানে এনেছি, আমার সেই বন্ধুর কাছে, ওর সেই অভাগী মায়ের কাছে?’
“ছোটেলালজি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়লেন, আর জিভে আক্ষেপের চুকচুক আওয়াজ করলেন। কিছুক্ষণ কেউ কথা বললেন না, আমিও বুদ্ধুর মতো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম ওঁদের সামনে। বেশ কিছুক্ষণ পর ছোটেলালজি খুব নরম গলায় বললেন, ‘তু অভি যা বেটা, পরে কথা বলব।’
“আমি ওঁদের সামনে থেকে সরে গেলেও কৌতূহল ছিল ষোলো আনা। আড়ালে থেকে ওঁদের কথাবার্তা শুনতে লাগলাম। আমি বেরিয়ে আসার পর ছোটেলালজি বললেন, ‘দিওয়ানজি, সন্ধেবেলা আমি রাজাজির সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই। বাঘটাকে ধরার জন্যে একবার চেষ্টা করব, না পারলে শিকারি তো রইলই।’
“কথাটা শুনে দিওয়ানজি কোনঅ কথা বললেন না। মনে হয় তেমন উৎসাহ পেলেন না।
“ছোটেলালজি আবার বললেন, ‘দেখিয়ে, মানুষ মানুষকে খুন করলে ফাঁসি হয়, আবার যাবজ্জীবন জেলও হয়। সেটা নির্ভর করে অপরাধীর খুনের উদ্দেশ্য কী ছিল তার ওপর। উদ্দেশ্য দু-ধরনের হতে পারে, স্বার্থসিদ্ধি অথবা আত্মরক্ষা। এক্ষেত্রে এই বাঘটার জানোয়ার শিকার করার ক্ষমতা কমে এসেছে। আত্মরক্ষার জন্যে পেটের জ্বালায় সে মানুষ শিকার করতে শুরু করেছে। কাজেই তার একটা সুযোগ পাওয়া উচিত। যাবজ্জীবন খাঁচায় বন্দি থাকার শাস্তি।’
“উত্তরে দেওয়ানজি এবার হেসে ফেললেন। বললেন, ‘বাঘের হয়ে আপনি যা সওয়াল করলেন, তাতে আপনার তো আদলতে গিয়ে ওকালতি করা উচিত। ঠিক আছে, রাজাজিকে বলুন। তবে ফাঁদে বাঘ বন্দি করা তো সহজ ব্যাপার নয়। আমাদের দু-একজন ঘায়েল হতে পারে, মৃত্যুও হতে পারে।’
“ ‘তা তো হতেই পারে। বাঘ শিকার করতে গিয়ে বন্দুকধারী বীর শিকারিও কি মরে না? সে-ঝুঁকি তো সবসময়ই থেকে যায়।’
“রাজাজির সঙ্গে কী কথা হল জানি না, কারণ সেখানে আমার থাকার অনুমতি ছিল না। তবে রাজাজির মহল থেকে ওঁরা যখন ফিরলেন, দুজনের মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম কী সিদ্ধান্ত হয়েছে। দেওয়ানজি ভীষণ গম্ভীর, আর ছোটেলালজির ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি। দেওয়ানজি নিজের ঘরে ঢুকে ভেতরে চলে গেলেন, আর সামনের ঘরের তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে গদিতে আরাম করে বসলেন ছোটেলালজি। ভেতরের দিকে তাকিয়ে ছোটেলালজি আমায় নীচু গলায় বললেন, ‘দেওয়ানজি খুব গুস্সা করেছেন।’ বলে মুখ ফুলিয়ে রাগের ভঙ্গি করে হাসলেন।— ‘তবে রাজাজি বাঘ ধরার অনুমতি দিয়েছেন, আর বেটা তুইও আমার সঙ্গে যাবি, রাজাজি তাও মেনে নিয়েছেন। দেওয়ানজি কিছুতেই তোকে যেতে দেবেন না, শেষমেশ রাজাজি বলতে আর না করতে পারেননি। রাত্রে তোর ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে নিবি, কাল ভোরেই তুই আমার সঙ্গে বেরোবি, ক’দিন তুই থাকবি আমাদের সঙ্গে। কী, খুশি তো, এটাই তো চেয়েছিলি?’
“খুশি মানে? আমার ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন, গভীর বনের মধ্যে ওইরকম ঘুরে বেড়াব। জঙ্গলকে চিনব। এমন সুযোগ চট করে আসে নাকি? তার ওপর সঙ্গে যদি থাকেন ছোটেলালজির মতো একজন অভিজ্ঞ মানুষ। শুনেছি, মানুষটা এই জঙ্গলকে চেনেন হাতের তালুর মতো। শুধু তাই নয়, জঙ্গলকে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন জঙ্গলের বাসিন্দাদের। তা নইলে কেউ মানুষখেকো বাঘ জ্যান্ত ধরার কথা চিন্তা করতে পারে?
“আমাদের কথাবার্তার মধ্যে দেওয়ানজি ঘরে এসে ছোটেলালজির কাছে বসলেন। কিন্তু দেওয়ানজি আমার ওপর রাগ করেই রইলেন, আমার সঙ্গে তেমন আর কথা বললেন না। ছোটেলালজির সঙ্গে কিরণাগড় রাজ্য, তার ভূত-ভবিষ্যৎ, আগে কী ছিল আর এখন কী হয়েছে, আরঅ কী কী উন্নতি করা দরকার এসব নিয়ে নানান গম্ভীর আলোচনা করতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পর আমায় বললেন, ‘অরণি, ছোটেলালজির সঙ্গে তোমাকে কাল ভোর ভোর বেরোতে হবে। ক’দিন থাকতেও হবে। ঘরে গিয়ে তোমার জিনিসপত্র যা যা নেবে এখনই গুছিয়ে ফেলো, তারপর তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো।’
“আমি দিওয়ানজি আর ছোটেলালজিকে প্রণাম জানিয়ে বেরিয়ে আসছিলাম, দিওয়ানজি বললেন, ‘আর শোনো, যা করবে ভেবেচিন্তে কোরো। মনে রেখো, কলকাতায় তোমার পথ চেয়ে তিনজন অসহায় অপেক্ষা করছেন।’
“আমি ওঁর মুখের দিকে তাকালাম, উনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। মাথা নীচু করে বললাম, ‘আসছি।’
“পরদিন ভোরবেলা ছোটেলালজির সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম। অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। ছোটেলালজি বললেন মাইল তিন-চার, তবে আমার মনে হল সেটা অনেকটাই বেশি। কারণ, গ্রামের দিকে মানুষদের পথের হিসেবটা একটু অন্যরকম হয়। এঁরা যে পথকে ‘থোড়াসা’ বলেন, সে-পথও শেষ হতে চায় না। তবে হাঁটতে আমার কিন্তু ভালোই লাগছিল। এ-হাঁটা তো আর শহরের পথে, ট্রেন ধরতে যাওয়ার হনহনিয়ে হাঁটা নয়, দূর পথিকের পথ চলা। গন্তব্যে পৌঁছতে হবে, কিন্তু তার জন্যে কোনও তাড়া নেই। পথে যত লোকের সঙ্গে তাঁর দেখা হচ্ছে, সবার কুশল-মঙ্গল সংবাদ নিয়ে চলেছেন। এত লোককে চেনেন! শুধু যে নাম জানেন তা-ই নয়, কার কোমরে ব্যথা, কার মেয়ের বিয়ে, কার ভাইয়ের চাকরি, ছেলেদের লেখাপড়া, কার কবে সদরে ‘পেশি’ আছে। এখানকার লোকেরা সরল হলে কী হবে, প্রচুর পেশিবহুল। এ-পেশি অবিশ্যি মাসল নয়, পেশি মানে মামলা, জমিজিরেত নিয়ে এদের মামলা মকদ্দমা লেগেই থাকে। ছোটেলালজি যেমন সকলের সংবাদ নিচ্ছেন, লোকেরাও ওঁকে খুশি মনে এইসব সংবাদ দিচ্ছে। ওঁর মন্তব্য মন দিয়ে শুনছে। আমাদের শহরে ‘কী, কেমন আছেন’, আর তার উত্তরে ‘ওই চলে যাচ্ছে’ গোছের খেজুরে আলাপ নয়, রীতিমতো আন্তরিক।
“এইসব আলাপের মধ্যে ছোটেলালজি আমার সঙ্গেও কথা বলে চলেছেন। জঙ্গলের কথা, জানোয়ারের কথা। বাঘ ধরা এবং শিকারের কথা। দেশে এখন বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হওয়াতে তিনি স্বস্তি পেয়েছেন। বললেন ‘জঙ্গলের পরিস্থিতি এবার নিশ্চয়ই কিছুটা বদলাবে।’ একসময় আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাঘকে জঙ্গলের রাজা কেন বলে বেটা, বলতে পারবি?’
“আমি বললাম, ‘বাঘের অন্য সবার থেকে বেশি তেজ, তার দারুণ বুদ্ধি, খুব শক্তিশালী আর হিংস্র।’
“ছোটেলালজি আমার উত্তরে মোটেই খুশি হলেন না। বললেন, ‘তোর সব কথা ঠিক আছে, কিন্তু বাঘ হিংস্র, এ-কথাটা সম্পূর্ণ ভুল। মানুষের চেয়ে হিংসক জীব আর কেউ হয় নাকি? বাঘ শুধুমাত্র নিজের বাঁচার জন্যে, খিদে মেটানোর জন্যে জীবহত্যা করে। আর মানুষ? নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্যে যুগ যুগ ধরে মানুষ আর জীবহত্যা করে এসেছে। রাজরাজড়ারা বৈঠকখানায় মাথা আর চামড়া সাজিয়ে রাখবে বলে কত প্রাণীহত্যা করেছে দেখিসনি? বাঘ, ভালুক, শুয়োর, হরিণ, বাইসন, নীলগাই, বারশিঙা— কত নাম বলব? তাছাড়াও রাজ্য অধিকারের নামে, ধর্মের নামে, সম্পদ আর ক্ষমতা হাসিল করতে মানুষ কম মানুষকে হত্যা করে? অন্যসব কথা ছাড়, মানুষের এতরকম খাবার থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র জিভের স্বাদ বদলানোর জন্যে কম পাখি মারে? ছিঃ, সে তুলনায় বাঘ এমন কী হিংস্র?’
“তারপরে বললেন, ‘যে-জঙ্গলে বাঘ নেই, বুঝবি সে-জঙ্গলের আয়ু কমে আসছে। সে-সব জঙ্গলে হরিণের মতো তৃণভোজী প্রাণীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাদের সতর্কতা কমে যায়। অলস হয়ে পড়ে। একই জায়গায় দল বেঁধে নিশ্চিন্তে শুয়ে-বসে কাটায়, আর সেই এলাকার ঘাস ঝোপঝাড় নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য এলাকায় যায় না। এতে খুব ক্ষতি হয়, জঙ্গলের চরিত্র বদলে যেতে থাকে। শুধু বড়ো বড়ো গাছে তো আর জঙ্গল হয় না, জঙ্গলের চরিত্র তৈরি করতে বড়ো বড়ো ঘাস আর ঘন ঝোপঝাড়েরও জুড়ি নেই। বাঘের তাড়া খেয়ে এরা জঙ্গলের একদিক থেকে অন্যদিকে যখন পালিয়ে বেড়ায়, তখন জঙ্গলের নির্দিষ্ট কোনও এলাকাতেই তেমন কোনও ক্ষতি হয় না। তাছাড়া বাঘ যে-জঙ্গলে নেই সেখানে মানুষ নিশ্চিন্তে ঢুকে পড়ে। গাছ কাটে, ঘরের গাই-মোষের জন্যে ঘাস কেটে আনে, জ্বালানির জন্যে ঝোপঝাড় কেটে আনে। জঙ্গল ধীরে ধীরে সাফ হতে থাকে। জঙ্গল যত সাফ হতে থাকে, জঙ্গলের তৃণভোজী জানোয়ারও পেটের দায়ে মানুষের বসতির দিকে ঢুকে আসতে থাকে। মাঠের ফসলের ক্ষতি করে। তখন তারাও মানুষের তাড়া খায়, মানুষের হাতে মারা পড়ে।
“যোগ করলেন, ‘একটা বয়স্ক হরিণ শিকার করলে একটা বাঘের মোটামুটি দু-তিনদিন চলে যায়। বাঘের উচ্ছিষ্ট থেকে কিছু শেয়াল-শকুনেরও এক-দু’দিন চলে যায়। তার মানে ধরে নে, একটা বাঘ জঙ্গলে থাকলে মাসে গোটা পাঁচেক হরিণ, এক দুটো শুয়োর কিংবা নীলগাই মারা পড়বে। তাতে জঙ্গলের ভারসাম্য ঠিক থাকে। এরকম দু-তিনটে বাঘের জন্যে গোটা একটা জঙ্গল সত্যিকারের জঙ্গল হয়ে ওঠে। সেই কারণেই বাঘ জঙ্গলের রাজা। মানুষের সুস্থভাবে বাঁচার জন্যে জঙ্গল জরুরি, জঙ্গলকে বাঁচানোর জন্যে জরুরি সুস্থ বাঘের বেঁচে থাকা।’
“তখন তো পরিবেশ নিয়ে এত চিন্তাভাবনা শুরু হয়নি, ছোটেলালজি আসলে যে-কথাটা বলতে চেয়েছিলেন, সেটা হচ্ছে ইকো-সিস্টেম। বাঘ একটা জঙ্গলের পুরো ইকো-সিস্টেমটাকেই নিয়ন্ত্রণ করে। সে-কথাটা জেনিভা কিংবা প্যারিসে পরিবেশ নিয়ে সম্মেলন হওয়ার বহুযুগ আগে থেকেই ভারতের গ্রামের সাধারণ লোকজন জানত, মেনেও চলত। শুধু এখনকার গালভরা ওই নামগুলো তারা বলতে শেখেনি, এই যা।
“সেদিন আমরা ছোটেলালজির বাড়ি পৌঁছলাম জলখাবারের বেলা। তার মানে ধর বেলা দশটা সাড়ে দশটা। গ্রামের মানুষেরা তোদের মতো দাঁত ব্রাশ করেই ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে পড়ে না। ভোরবেলা উঠে মাঠে যায় ক্ষেতি-জমি সামলাতে, তারপর ওই সময় ঘরে ফেরে জলখাবার খেতে। ছোটেলালজির স্ত্রী, তিন ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি নিয়ে জমজমাট সংসার। দু-মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, তারা শ্বশুরবাড়িতে। ছোটো মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে, সামনের অঘ্রাণ মাসেই বিয়েটা মিটিয়ে ফেলার পরিকল্পনা। তারপর বাকি থাকবে ছোটো ছেলে। ব্যস, তারপরেই ছোটেলালজি ঝাড়া হাত-পা, মুক্ত।
“ছোটেলালজির স্ত্রী একদম মায়ের মতো। আমি ‘মৌসি’ বলতেই বুড়ি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘বেটা, তুই কলকাতা থেকে বাঘ ধরতে এসেছিস, তোর মা জানে?’ তারপর কাছে বসিয়ে চপচপে ঘি মাখানো রুটি, করেলার সবজি আর মোষের দুধ খাওয়ালেন। বউদিরাও আমাকে ভইয়া বলে খুব আদরযত্ন করতে লাগলেন। আর ছোটেলালজির ছোটো মেয়ে আমাকে বোধ হয় খুব বড়ো মাপের শিকারি ধরে নিয়েছিল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভইয়া, তোমাদের ওখানে শুনেছি বড়ো বড়ো শের, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। সে-সব ছেড়ে আমাদের দেহাতি শের ধরতে এলে কেন?’ কী আর উত্তর দেব, বোকার মতো হাসলাম।
“এদিকে বাঘ ধরার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। ছোটেলালজি গ্রামে আসার পথেই তাঁর দলের সকলকে খবর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারা সবাই এসে উপস্থিত হল পরদিন সকালে। তারপর থেকে প্রায় রোজই সকালে ছোটেলালজির বাড়ির উঠোনে ওই জমায়েত বসত। আমি একধারে বসে চুপচাপ শুনতাম। আমাকে কলকাতার বাঙালি জেনে আর বাঘ ধরতে এসেছি শুনে বাকি সকলের সে কী হাসি! তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাঙালিদের সায়েব তাড়ানোর লড়াই নিয়েও খুব উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল। সে-সব শুনে আমার মতো ভিতু আর সমস্ত বিপদ থেকে গা বাঁচানো মানুষ হিসেবে বেশ লজ্জাই পেতাম।
“এই জমায়েতে সবথেকে আশ্চর্য লাগত ডিসিপ্লিন দেখে। ছোটেলালজিই কথা বলতেন, সবাই শুনত এবং যার যা মতামত বা সাজেশন থাকত, জানাত। কোনও হইচই নেই, কোনও চেঁচামেচি নেই, অন্যের কথা থামিয়ে দাবড়ে মাতব্বরি করার চালিয়াতি নেই। আমাদের কলকাতার পাড়ার ক্লাবে গরিবদের কম্বল বিতরণ নিয়ে প্রত্যেক বছর কালীপুজোর পর একটা মিটিং হত। সেখানে উচ্চশিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত বড়োরা এমন ঝগড়া করতেন, সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার হত। কেউ কাউকে সম্মান করত না, কেউ কাউকে বিশ্বাস করত না। সবাই নিজের নিজের ক্ষমতা আর বাহাদুরি দেখাতে উঠেপড়ে লাগত। সে তুলনায় ছোটেলালজির বাড়ির জমায়েত ছিল দেখার মতো। শান্ত, ধীরস্থির, পরস্পরের ওপর আস্থা আর বিশ্বাস— সব মিলিয়ে অমন সুন্দর বোঝাপড়ার মিটিং আমি আর কখনও দেখিনি।
“পরপর চারদিন আলোচনার পর পুরো প্ল্যানটা ফাইনাল হল। সিদ্ধান্ত হল, আটদিন পরে আগামী কৃষ্ণা চতুর্দশীর রাতে প্রথম ফাঁদে বসা হবে। সেদিন বিফল হলে তার পরেও চার-পাঁচদিন বসা হবে। অমাবস্যার রাতে সম্পূর্ণ অন্ধকার এবং আগে ও পরের দু-চারদিন, যখন চাঁদের আলো খুব কম থাকে, সেই সময়েই নাকি বাঘ ধরার সুবিধে। এসব সত্ত্বেও বাঘ যদি ধরা না পড়ে তখন নতুন করে অন্য প্ল্যান ভাবা হবে।
“তিন-চারদিন ঘোরাঘুরি করে জঙ্গলের গভীরে একটা জায়গা সিলেক্ট করা হল। আজকাল তোদের সিনেমার শুটিং স্পট ঠিক করার নাম রেকি করা। আমরা তখন তো এতসব জানতাম না, আজকের দিন হলে বলতাম তিন-চারদিন রেকি করার পর একটা জায়গা ঠিক করা হল। দু-পাশে বড়ো বড়ো গাছ, ঘন ঝোপঝাড়, তার মাঝখান দিয়ে সরু পায়ে চলা পথ। ওই পথেই নাকি বাঘটা যাওয়া আসা করে। পথের ধুলোর ওপর বাঘের বেশ কিছু পায়ের ছাপ দেখা গেছে।
“ওই পথটা সোজা উত্তরদিকে একটা নালার কাছ থেকে বাঁদিকে ঘুরে চলে গেছে কিষাণপুরা ফরেস্টের দিকে। ওই নালাতেই বাঘটা জল খেতে যায়। একবার ভরপেট মাংস খাওয়ার পর বাঘকে অনেকটা জল খেতে হয়। তাছাড়া ভরপেট কাঁচা মাংস খাওয়ার পর বাঘের শরীর খুব গরম হয়ে ওঠে। নালার ধারের ঝোপঝাড়ের আড়ালে ভেজা ভেজা নরম মাটিতে পেট ঠেকিয়ে বিশ্রাম করাটা বাঘের খুব প্রিয় বিলাসিতা। বাঘটা ওই নালার ধারে প্রায়ই যায়, ঝোপের আড়ালে চুপ করে শুয়ে থাকে— সে-প্রমাণও নাকি বিস্তর পাওয়া গেছে। যে-জায়গাটা নির্দিষ্ট করা হল, সেখান থেকে নালাটার দূরত্ব খুব জোর সাড়ে তিনশো চারশো ফুট।
“বাঘ সম্বন্ধে এরকম নানান কথা আমি ছোটেলালজির থেকেই শুনেছি। সন্ধের পর খোলা আকাশের নীচে খাটিয়ায় বসে ছোটেলালজি কথা বলতেন, আর আমি মন দিয়ে শুনতাম। কিন্তু বেশিক্ষণ শোনা হত না, আটটা সাড়ে আটটার মধ্যেই আমরা রাতের খাওয়া সেরে যে-যার ঘরে ঢুকে পড়তাম। তারপরে সেই ভোর না হওয়া পর্যন্ত কাঠের হুড়কো বন্ধ ঘরের বাইরে বের হওয়ার নিয়ম ছিল না। খুব প্রয়োজনে বেরোতে হলেও সকলকে ডেকে হইচই করে বেরোতে হবে। এই নিয়ম আশেপাশের সমস্ত গ্রামের সব লোককেই বলা হয়েছিল। ছোটেলালজির বক্তব্য ছিল, আমাদের কাজ শেষ হওয়ার আগে আর কোনও মানুষ যেন বাঘটার শিকার না হয়।
“জায়গা ঠিক হওয়ার পরে ছোটেলালজি একদল লোককে দায়িত্ব দিলেন গর্ত খুঁড়ে ফাঁদ পাতার জোগাড় করার জন্যে। যেখানে ফাঁদটা পাতা হবে, তার দু-পাশের দুটো বড়ো গাছের ওপর মাচা বেঁধে আমরা বসব। আমাদের বসার জন্যে গাছের ওপরে পোক্ত দুটো মাচা বানানোর দায়িত্ব দিলেন রতনভাইকে। রতনভাই ছোটেলালজির মেজো ছেলে। অত্যন্ত করিতকর্মা, কিন্তু ভীষণ ঠান্ডা মাথার লোক। গ্রামের বয়স্ক লোকেদের বলতে শুনেছি, রতনভাইকে দেখলে কমবয়সের ছোটেলালজির কথা মনে পড়ে যায়।
“কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথির তখন আর মাত্র ছ’দিন দেরি। তার আগে সবকিছু রেডি করে ফেলার জন্যে সকলের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। দলের প্রত্যেকের মধ্যে উৎসাহ ছিল দেখার মতো। যার যার নিজের কাজ ছাড়াও প্রত্যেকদিন বাঘ ধরার খুঁটিনাটি নিয়েও বিস্তর আলোচনা চলল, প্রত্যেকদিন। এর পাশাপাশি খবর দেওয়া হল বনবিভাগের অফিসে। বন দপ্তরের অফিসাররা জিপ নিয়ে ছোটেলালজির বাড়িতে আসতেন, ছোটেলালজির ঘরে বসে দীর্ঘ আলোচনা হত, কিন্তু সেখানে আমার যাওয়ার অনুমতি ছিল না।
“সকলের সঙ্গে আলোচনা করে ছোটেলালজি ঠিক করলেন, যে-গর্তটা খোঁড়া হবে সেটা লম্বায় অন্তত আঠারো-কুড়ি ফুট আর চওড়া সাত-আট ফুট। আট থেকে দশ ফুট গভীর হলে ভালো হয়। সেটাকে ঢাকতে হবে গাছের হালকা ডালপালা সাজিয়ে, তার ওপর শুকনো পাতা বিছানোর পর ওপরে হালকা মাটির একটা আস্তর দিয়ে। আর তারপরই হচ্ছে আসল কাজ। সবকিছুর পর জায়গাটার এমন মেক-আপ দিতে হবে, কোনোমতেই যেন বুঝতে না পারা যায় ওটা সেই আগের পায়ে চলা পথ নয়, তার নীচে আছে মস্ত বড়ো ফাঁদ। আশেপাশে কোত্থাও একটুও বাড়তি মাটি পড়ে থাকবে না। পথের দু-পাশের ঝোপঝাড় সব যেন অবিকল আগের মতো থাকে। মাটি কাটার সময় লোকজন বিড়ি খেয়ে এদিক-সেদিক ছুড়ে ফেলে রাখবে, কিংবা খইনি খেয়ে থুতু ছিটিয়ে রাখবে, সে-সব মোটেই চলবে না। কারণ, বাঘের ঘ্রাণশক্তি তীক্ষ্ন। আর মানুষখেকো বাঘ মানে, সে মানুষের খুব কাছাকাছি এসেছে। পোড়া বিড়ির গন্ধ, তামাকের ঝাঁজ তার চেনা হতেই পারে। গভীর জঙ্গলের পথে হঠাৎ পোড়া বিড়ির গন্ধ পেলে তার সন্দেহ হওয়া বিচিত্র নয়। সেক্ষেত্রে সে হয়তো ওই পথে না গিয়ে ওটাকে পাশ কাটিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অন্য পথে হাঁটা দেবে। আর সেরকম হলে আমাদের এই পুরো খাটনিটাই বৃথা যাবে।”
অরণিদার গল্পের মধ্যে আমরা ডুবে গেছিলাম সকলেই। কেউ কোনও কথা বলছিলাম না। এমনকি বদ্দেও অনেকক্ষণ কোনও কথা বলেনি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “অরণিদা, গর্তটা আরও বড়ো করলে সুবিধে হত না?”
অরণিদা হাসলেন। বললেন, “ভেরি গুড। এই একই প্রশ্ন আমিও ছোটেলালজিকে করেছিলাম। তার উত্তরে উনি যা বলেছিলেন, সেটাই বলছি। বড়ো করলে তিনটে বিপদ ছিল। গর্তটা ঢাকার জন্যে আরও মোটা মোটা গাছের ডাল বিছোতে হবে। সেই ডাল বাঘের ভারে যদি ভেঙে না যায়, বাঘ দিব্যি হেঁটে পার হয়ে যাবে। আবার বাঘ যদি গাছের ডাল ভেঙে পড়েও যায়, বেশি লম্বা গর্ত পেলে তার লাফ মেরে পালাতে সুবিধে হবে। ছোট্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা কতটা আর হাই জাম্প বা লং জাম্প দিতে পারি? কিন্তু একটু দৌড়ে এসে লাফ দিলে সেটা অনেকটা বাড়িয়ে তোলা যায়। একটু লম্বা জায়গা পেলে বাঘ লাফ দিয়ে খুব সহজেই গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। তাছাড়া যত বড়ো গর্ত কাটা হবে, সেটা কাটতে তত বেশি সময় লাগবে, আরও সময় লাগবে সেটাকে ঠিকঠাক মেক-আপ দিয়ে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। ওঁদের দেখেছিলাম, ভোর থেকে কাজ শুরু করে বিকেলের মধ্যে পুরো কাজ শেষ করে ফেলেছিলেন। আরও বড়ো গর্ত করতে গেলে একদিনে শেষ করা যেত না। গর্ত খুঁড়ে দু-একদিন ফেলে রাখলে সেই ক’দিনে বাঘ দৈবাৎ যদি ওই পথে যাওয়া আসা করে, তার মনে সন্দেহ হবে। হয়তো ওই পথে সে দীর্ঘদিন যাওয়াই ছেড়ে দেবে।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “বাঘেদের এত বুদ্ধি হয় নাকি?”
“সাধারণ বাঘের না হলেও মানুষখেকোরা নাকি দারুণ বুদ্ধিমান হয়। মানুষখেকো বাঘ নাকি কোনও মানুষকে হুট করে আক্রমণ করে না। অনেকক্ষণ লক্ষ করে, পিছু নিয়ে, নিশ্চিত হয়ে তবেই আক্রমণ করে। একটা মানুষখেকো বাঘের অদ্ভুত ধৈর্য। সারারাত একটা শিকারের ওপর চুপটি করে লক্ষ রাখতে থাকে, উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায়। এও দেখা গেছে, উপযুক্ত সুযোগ না পেয়ে ভোরের আলো ফুটতেই বাঘ জঙ্গলে ফিরে গেছে, কিন্তু হঠকারী হয়ে শিকারকে আক্রমণ করেনি! মানুষের কাছাকাছি এসে তাদের দীর্ঘ সময় লক্ষ রাখার জন্যেই বাঘ মানুষের আচরণ এবং তাদের অভ্যাসের অনেক ব্যাপার জেনে যায়। যাঁরা ভালো শিকারি, তাঁরা নাকি বাঘ পিছু নিলেই টের পান। আর টের না পেলে শিকারিই বাঘের শিকার হয়ে যেতে পারে। তবে এখন আর একবার গণশার চা শিকার করলে মন্দ হয় না।”
আমি চায়ের জন্যে গণেশদাকে অর্ডার দেওয়ার পর অরণিদা বললেন, “ফাঁদের দু-পাশে দুটো বড়ো গাছে দশজন আরাম করে বসার মতো বাঁশের মাচা বাঁধা হল। মাঝারি সাইজের মোটা বাঁশের মাচা, দড়ি দিয়ে একটু ফাঁক ফাঁক করে বাঁধা। ফাঁক করার কারণ, মাচায় বসে নড়াচড়া করলে যাতে কোনও শব্দ না হয়। বাঁশকে পাশাপাশি রেখে টাইট করে বাঁধলে দেখবি সামান্য নাড়াচাড়াতেই মচমচ, ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ হয়। রাতের জঙ্গলে বাঘ সেই আওয়াজ শুনতে পেলে সে আর ধারেকাছে ঘেঁষবে না। এছাড়াও ছোটেলালজির কড়া নির্দেশ ছিল, মাচা বাঁধতে কোনও গাছের গায়ে পেরেক বা গজাল মারা যাবে না। নারকেলের কিংবা ঘাস দিয়ে বানানো মোটা রশি দিয়ে মাচা দুটো বেঁধে দেওয়া হল গাছের মোটা মোটা ডাল থেকে। সেটার জন্যেও ছোটেলালজি দুটো কারণ বলেছিলেন। প্রথমটা হল, কাঠে পেরেক বা গজাল ঠুকতে ঠকাস ঠকাস আওয়াজ হবে, আর সেই অস্বাভাবিক আওয়াজ বাঘের কানে গেলে বাঘ সন্দেহ করতে পারে। দ্বিতীয় কারণ, জ্যান্ত গাছের ডালে লোহার গজাল ঠোকার মতো নৃশংস কাজ আর কিছু হতে পারে না। এই কলকাতা শহরে রাস্তার ধারে ধারে গাছের গায়ে পেরেক পোঁতা বিজ্ঞাপন দেখলে খুব দুঃখ হয়। ছোটেলালজি দেখলে কী যে করতেন!
“ফাঁদে বসার জন্যে মোট বাইশ জন লোককে ঠিক করলেন ছোটেলালজি। তার মধ্যে আমিও একজন। ভেবে দেখ, ওদের সকলের মধ্যে আমিই ছিলাম সবথেকে আনাড়ি আর অকর্মার ঢেঁকি। আমাদের নিয়ে ছোটেলালজি ক’দিন রীতিমতো ক্লাস নিলেন। কিছু কিছু জিনিস পইপই করে মানা করে দিলেন। যেমন সর্দি-টর্দি লাগিয়ে হাঁচি-কাশি হলে দল থেকে বাদ। মাচায় শব্দ করে হাই কিংবা ঢেঁকুর তোলা যাবে না। বিকেলের আগেই মাচায় উঠে যেতে হবে। আর ভোর না হওয়া পর্যন্ত কোনোমতেই সেখান থেকে নামা যাবে না। কাজেই ওই সময়ে কারও যেন প্রকৃতির ডাক না আসে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মাচায় বসে যতটা সম্ভব নড়াচড়া কম করতে হবে। একভাবে বসে কোমর কিংবা হাঁটু ধরে গেছে, হাত-পা একটু ছড়িয়ে নিই— ওসব আরামের কথা না ভাবাই ভালো।
“এসবের সঙ্গেই জোগাড় করা হল অনেক অস্ত্রশস্ত্র।”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “অস্ত্রশস্ত্র কেন? আপনাদের তো বাঘটাকে জ্যান্ত ধরার প্ল্যান ছিল।”
“তা-ই তো! কিন্তু আমরা যাকে ধরতে যাচ্ছি, সেটা পায়রা বা তিতির নয় বৎস, সেটি একটি বাঘ। সামান্য উনিশ-বিশ হলেই ভয়ংকর অঘটন ঘটে যেতে পারে, তখন খালি হাতে আমাদের কে বাঁচাবে? নিজেদের নিরাপত্তার জন্যেই অস্ত্রশস্ত্রের সংস্থান রাখতে হয়। এই অস্ত্রশস্ত্র ব্যাপারটাও শিখলাম ছোটেলালজির কাছে। মা দুর্গার দশ হাতে যা যা থাকে, সবমিলিয়েই আমরা সাধারণত অস্ত্রশস্ত্র বলি। কিন্তু শত্রুকে আঘাত করার জন্যে যে জিনিস ছুড়ে মারা হয় তাকে অস্ত্র বলে— যেমন বর্শা, শূল, বল্লম, শাবল। আর হাতে ধরে থেকে যে জিনিস দিয়ে শত্রুকে আঘাত করা হয় তাকে শস্ত্র বলে— যেমন খড়্গ, তরোয়াল, টাঙি, ছুরি।”
আমি খুব অবাক হলাম শুনে। বললাম, “তাই? এতদিন জানতাম ভাত-টাত, বই-টইয়ের মতোই অস্ত্রশস্ত্রও একটা কথার কথা!”
অরণিদা মুচকি হেসে বললেন, “হুঁ হুঁ, লজ্জা পাস না, এর আগে আমিও তাই জানতাম। শুধু তাই নয়, অস্ত্রেরও নানান ভাগ আছে। কিন্তু সে-কথা আজ নয়, পরে একদিন বলা যাবে। গ্রামের দিকে দু-একখানা করে অস্ত্র এবং শস্ত্র মোটামুটি সব সম্পন্ন বাড়িতেই থাকত, আজকাল আর থাকে কি না জানি না।”
“কী বলছেন? গ্রামের লোকেরা অনেক শান্তশিষ্ট হয় শুনেছি, তাদের ঘরে ঘরে অস্ত্রশস্ত্র থাকত?”
“ওইসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রামেরা লোকেরা কি নিজেদের মধ্যে মারপিট করত রে, পাগল? তা নয়। অস্ত্রশস্ত্র রাখতে হত আত্মরক্ষার জন্যে। আগেকার দিনে গ্রামের লোকজন ডাকাতের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকত। তার ওপর থাকত কোনও যুদ্ধে হেরে যাওয়া দলছুট সৈন্যদের লুঠপাট। তখনকার দিনে রাজায় রাজায় যুদ্ধ লেগেই থাকত, সে-কথা তো ইতিহাসের পাতায় পাতায় পড়েছিস। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রামের সাধারণ মানুষ কার সঙ্গে যুদ্ধ, কীসের জন্যে যুদ্ধ জানতেও পারত না। কিন্তু ছত্রভঙ্গ হেরো সৈন্যদের অত্যাচার তাদের প্রায়ই সহ্য করতে হত। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যেই এসব রাখার নিয়ম ছিল।
“সে যাই হোক, অনেক বাড়ির গোয়ালঘর থেকেই অনেক অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় হয়ে গেল। দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় সেগুলো মরচে ধরা, কাঠের হাতলে ঘুণ ধরা। সেগুলোকে বালি আর পাথরে ঘষেমেজে শান দিয়ে, নতুন হাতল লাগিয়ে সবাই ঠিকঠাক করতে লেগে গেল।
“সত্যি বলতে, সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে সকলের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে এমন একটা উত্তেজনা অনুভব করছিলাম, চতুর্দশীর রাত যত এগিয়ে আসতে লাগল, আমার দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগল। এত কাছে এসে আসল সময়েই যদি কোনও কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ি, তাহলে দুঃখের আর শেষ থাকবে না।
“দুপুরে একটু তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে প্রথম রাতের জন্যে আমরা ষোলোজন রওনা হলাম। ছোটেলালজি নিজে এবং রতনভাই সেই দলে রইলেন। ছোটেলালজির স্নেহ আর প্রশ্রয় ছাড়া আমার মতো আনাড়ির ওই দলে থাকার কোনও প্রশ্নই ছিল না। তবে আমারও ভাগ্য ভালোই ছিল বলতে হবে, কোনোরকম সর্দি-কাশি বাধিয়ে বসিনি। সুস্থ-সবল চাঙ্গাই ছিলাম। ফাঁদের জায়গাটায় আমরা পৌঁছলাম মোটামুটি সাড়ে তিনটে নাগাদ।”
“পায়ে হেঁটে?” বদ্দে বোকার মতো জিজ্ঞাসা করে বসল।
মুখ বেঁকিয়ে অরণিদা খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “না রে, আমাদের জন্যে এসি ভলভো বাস বুক করা ছিল। এমন এমন প্রশ্ন করিস না, গা জ্বলে যায়।”
“আপনারা তো বাইশজনের দল ছিলেন, ষোলোজন গেলেন কেন?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
অরণিদা বললেন, “ছ’জনকে ছোটেলালজি গ্রামেই রেখে দিলেন। ওদের কাজ ছিল ভোরের আলো ফুটতেই রওনা হয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফাঁদের জায়গায় চলে যাবে। প্রথম রাতে বাঘ যদি ফাঁদে না পড়ে ফাঁদটাকে পাহারা দিতে হবে তো! নইলে সারাদিন অন্য কোনও জানোয়ার—হরিণ বা নীলগাইয়ের দল যদি ফাঁদের ওপর চলে আসে? তারাও তো পড়ে যেতে পারে! তাতে ফাঁদটা নষ্ট হয়ে পুরো আয়োজনটাই বৃথা হয়ে যাবে না? ওরা সকালে পৌঁছলে আমরা গ্রামে ফিরব, আবার আমরা বিকেলে ফিরে গেলে ওরা গ্রামে ফিরে আসবে। অবিশ্যি প্রথম রাতেই বাঘ ধরা পড়ে গেলে এসব আর দরকার হবে না।
“ফাঁদ বানানোর লোকগুলো সেদিন ভোরবেলা এসে কাজ শুরু করেছিল। তাদের কাজ শেষ হয়ে গেল বিকেল চারটের মধ্যে। ছোটেলালজির সঙ্গে আরও কিছু পরামর্শ সেরে, আমাদের মাচায় তুলে দিয়ে তারা গ্রামে ফেরার জন্যে রওনা হল সাড়ে চারটে নাগাদ। ছোটেলালজি ওদের খুব তাড়া দিচ্ছিলেন সূর্যের আলো থাকতে থাকতে সকলে যাতে গ্রামে নিজেদের বাড়ি পৌঁছে যেতে পারে। আমরা মাচায় ওঠার আগেই ফাঁদের দু-পাশে দুটো ছাগল খোঁটায় বেঁধে রেখে দেওয়া হল। ফাঁদ পাতা পথের দু-পাশে মুখোমুখি দুটো গাছের মাচায় দু-দলে ভাগ হয়ে উঠে পড়লাম আমরা। মাচার চারপাশে গাছের পাতার আড়াল থাকায় নীচে থেকে কেউ দেখতে পাবে, এমন তো মনে হয় না। আমাদের মাচায় আটজন, ওদিকেও রইল আটজন। আমি রইলাম ছোটেলালজির সঙ্গে, আর ওদিকের দলটার সর্দার হল রতনভাই।
“আমাদের সকলের হাতেই ছিল বল্লম, সড়কি কিংবা টাঙি। ছোটেলালজির কাছে বাড়তি ছিল একটা তলোয়ার। আমার হাতে রইল ইঞ্চি দেড়েক মোটা, ফুট ছয়েক লম্বা পোক্ত বাঁশের ডগায় ইস্পাতের চকচকে ফলা লাগানো একটা বল্লম। সেটা হাতে নিয়ে নিজেকে বেশ কেউকেটা এক যোদ্ধা বলে মনে হচ্ছিল। যদিও সত্যি সত্যি বাঘ এসে হামলে পড়লে হাতের বল্লম দিয়ে কী করব কে জানে।
“আমাদের মাচার একটু নীচে, গাছের অন্য ডালে বিশাল একটা জাল গুটিয়ে বেঁধে রাখা ছিল। এই জালটা, তার সঙ্গে আমাদের এই অস্ত্রশস্ত্র— সবকিছুই ভোরবেলায় ফাঁদ বানানোর লোকেরাই গোরুর গাড়িতে করে নিয়ে এসেছিল তাদের অন্যান্য সব জিনিসপত্রের সঙ্গে।
“মাচায় উঠে ছোটেলালজির পাশে বসে আমি ফাঁদের এক্স্যাক্ট জায়গাটা বোঝার চেষ্টা করলাম অনেকক্ষণ। ডাইনে বাঁয়ে লম্বালম্বি চলে যাওয়া সরু পথের ঠিক কোনখানে ফাঁদের শুরু, আর কোথায় শেষ, কিছুতেই ধরতে পারলাম না, লোকগুলোর এমন নিখুঁত হাতের কাজ। অবিশ্যি আমি বুঝতে না পারলেও বাঘবাহাদুর বুঝতে পারবে কি না জানি না। কারণ ছোটেলালজি বার বার বলেছিলেন, আদমখোর শের ভীষণ চতুর হয়।
“বিকেলের অল্প আলোয় কয়েকটা তিতির ঝোপের থেকে বেরিয়ে খুঁটে খুঁটে পোকা-টোকা খাচ্ছিল। একটু পরে একদল ছাতারে পাখি সামনের ছোট্ট একটা গাছের ডালে নিজেদের মধ্যে ঝটাপটি আর বেশ খানিকক্ষণ চ্যাকর চ্যাকর ডাকাডাকি করে উড়ে যাওয়ার কিছু পরেই সূর্য ডুব দিল। কিছুক্ষণ পরে পশ্চিম আকাশে নানান রঙের দাগ টেনে সূর্যের আলো সম্পূর্ণ মুছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কে যেন ঝপ করে অন্ধকারের চাদর বিছিয়ে দিল গোটা আকাশজুড়ে। চ্যাঁ চ্যাঁ করে কোন একটা রাতচরা পাখির ডাকের সঙ্গে জঙ্গলের কোণে কোণে ভরে উঠল অন্ধকার। নীচেয় বাঁধা ছাগল দুটো বেশ কয়েকবার ডাকাডাকি করে চুপ করে গেল। এদিকে অন্ধকার ঘন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল ঝিঁঝিঁর ডাক। নির্জন জঙ্গলে তাদের সেই একটানা রি রি রি ডাক যে কী তীব্র, কেমন যেন মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। অবিশ্যি বেশ কিছুক্ষণ শোনার পর সে-শব্দও সহ্য হয়ে গেল। প্রথমে মনে হয়েছিল, ঝিঁঝিঁর আওয়াজে আর কোনও শব্দ শুনতে পাওয়া যাবে না। তা কিন্তু নয়, কারণ আমাদের গাছের ঠিক নীচে হঠাৎ শুকনো পাতার খচমচ আওয়াজে আমি বেশ চমকে উঠলাম। আমার চমকে ওঠা বুঝে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে ছোটেলালজি বললেন, ‘ভয় পাস না বেটা। ওটা নীলগাইয়ের একটা দল, আমাদের নীচে দিয়ে নালার দিকে যাচ্ছে। সবে তো শুরু হল বেটা, জংলি রাতের রূপ অতি আশ্চর্য। যদি ভয় পাস, এর থেকে ভয়ংকর আর কিছু হতে পারে না। প্রতিটা আওয়াজে, প্রত্যেক ক্ষণে তখন চমকে চমকে উঠবি। আর যদি ভয় না পাস, তাহলে প্রকৃতির আদিম চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবি। এই অন্ধকারে কিছুই দেখা যাবে না, তাই সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হবে কানের ওপর। বকরি দুটো চুপ করে আছে, ভালোই হয়েছে। বাঘ এলে ডাকতে পারবে, আমরা জেনে যাব সে কাছাকাছি এসে গেছে। এই অন্ধকারে অন্য জানোয়ার বা নিশাচর পাখির সংকেত ছাড়া বাঘের অস্তিত্ব বোঝা অসম্ভব।’
“সারারাত আমরা কেউই দু-চোখের পাতা এক করিনি। কিন্তু সে-রাতে কিছুই ঘটল না। তবে গভীর জঙ্গলে মাচায় বসে রাত কাটানোর যে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল, আমার কাছে সেটাও ছিল মস্ত বড়ো পাওনা। ভোরবেলা আমরা যখন গাছ থেকে নামলাম, ছাগল দুটো মিহি সুরে ডাকতে লাগল। খোঁটা থেকে খুলে দিতে তারা আমাদের কাছে-কাছেই ঘুরতে লাগল। আমি রতনভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ও-দুটো ছাড়া পেয়ে পালাচ্ছে না কেন?’
“রতনভাই বলল, ‘পোষা প্রাণী জঙ্গলকে ভয় পায়। ওরা বরং মানুষকেই ভরসা করে। দেখো না, আমরা যখন গ্রামে ফিরব, ওরাও আমাদের সঙ্গে মহানন্দে গ্রামেই ফিরবে। তারপর যে-বাড়ির ছাগল, ঠিক ঠিক সেই বাড়িতেই ওরা ফিরে যাবে।’
“মাচা থেকে নামার প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে গ্রাম থেকে সেই ছ’জন লোক এসে পৌঁছল। তাদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা সেরে ছোটেলালজি আমাদের নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা হলেন।
“দ্বিতীয় দিনের যাত্রা একটু আলাদা। দুপুরে যাওয়ার পথে বেশ বড়ো একটা চিতল হরিণের দল দেখলাম। দলটায় বড়োসড়ো একটা পুরুষ হরিণ ছিল, সে-ই মনে হল দলের ক্যাপ্টেন। লম্বা ঘাড় তুলে আর কান নাড়িয়ে নাড়িয়ে সে আমাদের ষোলোজনের দলটাকে অনেকক্ষণ লক্ষ করার পর পুরো দল নিয়ে হঠাৎ দৌড় লাগাল জঙ্গলের আরও গভীরে। আগের দিনের মতোই বিকেলের আলো থাকতে থাকতে নীচে ছাগল দুটো বেঁধে আমরা গাছে উঠে বসলাম। আজকের ছাগল দুটো অন্য, নতুন ছাগল। সন্ধে হবার পর একটা ছাগল ভীষণ ডাকাডাকি করতে লাগল। ছোটেলালজি ফিসফিস করে বললেন, ‘ছাগলটা অন্যদিন এ-সময় অন্য ছাগলের সঙ্গে খোঁয়াড়ে ঢুকে পড়ে, আজ একা এই জঙ্গলে ভয় পাচ্ছে। ওর ওই জোরদার ডাকে বাঘটা আকৃষ্ট হতে পারে, কাছাকাছি চলে আসতে পারে।’ শুনেই আমার বুকের ভেতরটা গুড়গুড় করে উঠল।
“রাত বাড়তে লাগল। গতকাল প্রথম রাত ছিল বলে দারুণ একটা উত্তেজনা ছিল, আজ সেটা অনেকটাই কম। হঠাৎ আমাদের পেছনের গাছপালার আড়াল থেকে বেশ কিছু জন্তুর দল বেঁধে ছুটে যাওয়ার শব্দ পেলাম। আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হরিণের পাল, না?’
“ছোটেলালজি ফিসফিস করে বললেন, ‘ঠিকই বলেছিস, কিন্তু চুপ করে থাক, একদম আওয়াজ করিস না।’
“আর তার পরেই যেটা হল তার জন্যে আমি অন্তত মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমরা শহরের লোকেরা কথায় কথায় পিলে চমকানোর কথা বলে শব্দটার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু সেদিন কথাটার আসল মানে টের পেলাম। আমাদের বাঁদিকে কিছুটা দূর থেকে বাঘটা ডেকে উঠল!”
আমি আর কাতু দুজনেই উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “বাঘটা ফাঁদে পড়ে গেল?”
“না রে বাবা। ফাঁদটা তো আমাদের সামনে। বাঘটা ডাকল আমাদের বাঁদিক থেকে, একটু দূরে। আচমকা ওই ডাকে আমি ভীষণ চমকে উঠেছি দেখে ছোটেলালজি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর গাছের ডালের সঙ্গে আমার কোমর আর বুক বেঁধে দিলেন, যাতে চমকে উঠে আমি মাচা থেকে পড়ে না যাই। অনেকক্ষণ ধরে আমরা যখন ভাবছি বাঘটা যে-কোনো সময় আমাদের সামনের রাস্তার ওপর চলে আসবে, ঠিক তখনই বাঘটা আর একবার ডেকে উঠল। এবারের আওয়াজের জোরটা বেশ কম। তার মানে বাঘটা এদিকে আর না এসে ঘুরে অন্যদিকে দূরে চলে গেছে।”
“যাহ্, ফসকে গেল? বাঘটা কি বুঝে ফেলেছিল, আপনাদের লুকিয়ে থাকা?”
আমার এ-কথার কোনও উত্তর দিলেন না অরণিদা। বললেন, “বাঘটা যখন কাছে এসে ডেকে উঠেছিল, সে-সময় আমাদের ছাগল দুটোও ভয় পেয়ে তারস্বরে চেঁচাচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বাঁদিকের ছাগলটা হঠাৎ চুপ করে গেলেও ডানদিকেরটা বেশ খানিকক্ষণ চেঁচামেচি করে শান্ত হয়ে গেল। মাঝে মাঝে অসহায়ের মতো ডেকে উঠছিল ঠিকই, কিন্তু সেই আতঙ্কিত ভাবটা আর ছিল না। বাঘের আচমকা ডাকে আমার যা হাল হয়েছিল, সেটা কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। পিঠের সঙ্গে গাছের ডালে বাঁধা অবস্থাতে আমি বেশ স্বস্তি পাচ্ছিলাম। মোটা ডালে হেলান দিয়ে, মাচার ওপর পা দুটো ছড়িয়ে আরাম করে বসে একটু ঝিমুনি মতো এসে গেছিল। ওই অবস্থাতেও ঝিমুনি শুনে ভাবছিস, কী করে সম্ভব! গতরাত্রির জাগরণ, আজ ভোরে হেঁটে হেঁটে গ্রামে ফেরা, দুপুরে আবার এখানে এসে পৌঁছোনো, তার ওপর জঙ্গলের গহন অন্ধকারে বাঘের ওরকম গর্জন শোনা— সবকিছু মিলিয়ে শারীরিক এবং মানসিক চাপ যে কতটা, সেটা কলকাতা শহরের এই ক্লাব ঘরে বসে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে ধারণা করা অসম্ভব। এই ঝিমুনিটা চরম মানসিক ক্লান্তির, দুপুরের শখের আর আরামের ভাতঘুমের ঝিমুনির সঙ্গে তুলনা করলে ভুল হবে।”
অরণিদা একটু থেমে আমাদের সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে আবার বলতে শুরু করলেন, “ওই অবস্থায় কতক্ষণ ছিলাম বলতে পারব না, ডানদিকের ছাগলটার ভয় পাওয়া চেঁচামেচিতে ঝিমুনি ভাবটা কেটে গেল। একটানা তারস্বরে চেঁচিয়ে চলেছে ছাগলটা। তার নড়াচড়ার শব্দে বুঝতে পারছিলাম, খোঁটা উপড়ে কিংবা দড়ি ছিঁড়ে পালাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে বেচারা। দড়ির প্রচণ্ড টানে তার স্বর বিকৃত হয়ে উঠছিল বার বার। আমি ফিসফিস করে ছোটেলালকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ছাগলটা অমন করছে কেন?’
“ছোটেলালজি আমায় চুপ করতে বলে বললেন, ‘বাঘটা ফিরে এসেছে।’
“আমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নামতে লাগল। শিথিল হয়ে আসা সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলো একসঙ্গে যেন চমকে উঠল— বাঘ! আর সেই সময়ই আমাদের বাঁয়ে, যেদিকে অন্য ছাগলটা বাঁধা ছিল, সেদিক থেকে অদ্ভুত যে আওয়াজ পেলাম, আজও সে-কথা মনে পড়লে... এই দ্যাখ, গায়ের লোম সব খাড়া হয়ে উঠছে!”
একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরণিদা আবার শুরু করলেন, “ছোটবেলায় আমার বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, মাসের প্রথম রোববার বাড়িতে পাঁঠার মাংস হত। মাসে ওই একদিনই মাংস। তোদের মতো আজকাল যখন-তখন যেদিন খুশি চিকেন খাওয়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না। সেই রোববারগুলোতে আমরা তিন ভাইবোন আর বাবা মন দিয়ে মাংস আর মাংসের হাড় চিবোতাম মহানন্দে। নিশ্চুপ খাওয়ার কটমট কচমচ শব্দে আমাদের তৃপ্তি করে খাওয়ার ব্যাপারটা মা খুব এনজয় করতেন। বলতেন, ‘আর এক পিস দিই, বেশ হাড়-হাড় দেখে?’ সেদিন ওই জঙ্গলের অন্ধকারে সেই কটমট হাড় আর মাংস চিবোনোর শব্দ শুনে আমি শিউরে উঠলাম। বাঘটা যদি আমাদের মধ্যে কাউকে পায়, তারও ওই দশাই হবে। দু-হাতের মুঠিতে বল্লমটা চেপে ধরে রইলাম, যদিও জানি না বাঘের সামনে পড়লে বল্লমটা কীভাবে কাজে লাগাব।
“আতঙ্ক সহ্য করারও একটা সীমা আছে। বেশিক্ষণ সহ্য করতে করতে একটা বেপরোয়া ভাব চলে আসে। মনে হয়, ভাগ্যে যা আছে তা-ই তো হবে, বেশি চিন্তা করে লাভটা কী? কিছুক্ষণ পর আবার সব নিঃশব্দ হয়ে গেল। ডানদিকের বাঁধা ছাগলটারও অবস্থা সঙ্গিন। ডেকে ডেকে ক্লান্ত, এখন তার গলা দিয়ে যে আওয়াজ বেরোচ্ছে, সেটা তার ডাক নয়, ফ্যাঁসফেঁসে শব্দ। তার থেকে বাঘের গতিবিধি বোঝার আর কোনও উপায় নেই। বাঘটা ঠিক কী করছে বোঝা যাচ্ছিল না। রাস্তার এ-পারে আমরা আটজন দম বন্ধ করে টানটান বসে রয়েছি— চোখ-কান সজাগ। একটু পরে সামনের রাস্তা থেকে গাছের একটা ডাল ভাঙার আওয়াজ হল। আর তার পরেই হুড়মুড় প্রচণ্ড শব্দের সঙ্গে বাঘটা গর্জন করে উঠল ভয়ংকর। তার সঙ্গে প্রচণ্ড ধুলোয় নাক বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় হল। আমাদের একদম সামনে, গাছের নীচ থেকেই বাঘটা ডেকেই চলেছে বার বার। তার চঞ্চল চলাফেরার আওয়াজও কানে আসছে। ছোটেলালজি ফিসফিস করে বললেন, ‘জয় শেরওয়ালি মাতা, বাঘ ফাঁদে পড়েছে!’ তারপর চেঁচিয়ে ও-পারে বসে থাকা ছেলেকে ডাকতে লাগলেন, ‘রতনওয়া! হো রতনওয়া!’
“বাঘের গর্জনের আওয়াজে ওরা কিছু শুনতে পাচ্ছিল না। বেশ কয়েকবার ডাকাডাকির পর সাড়া এল, ‘জি বাবু।’
“ ‘সব ঠিক হ্যায় না?’
“ ‘ঠিক হ্যায়, বাবু। শের গিরি খড্ডে মে।’
“ ‘এখন কেউ নীচে নামবি না, সকাল হতে দে।’
“ ‘জি বাবু।’
“আমি ছোটেলালজিকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিন্তু নীচে নেমে দেখলে হয় না?’
“একটু বিরক্তি নিয়ে ছোটেলালজি বললেন, ‘ইতনা ভি জলদি ক্যায়া হ্যায়? ওটা বাঘ, শেয়াল-কুকুর নয়। ও অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখতে পায়। আমাদের থেকে অনেক বেশি ওর জোর আর তেমনি চটপটে। ফাঁদে পড়ে ভীষণ ভয় পেয়েছে, প্রাণের দায়ে এখন অসম্ভবকেও সম্ভব করে তুলতে পারে। এই অন্ধকারে এই সময়ে ওর সামনে যাওয়া মানে আত্মহত্যার সমান। আমাদের কাছে বন্দুকও নেই।’ তারপর একটু শান্ত হয়ে বললেন, ‘ভোর হতে খুব দেরি নেই, বেটা। সূর্য উঠুক, ততক্ষণে বাঘটাও কিছুটা ক্লান্ত হবে। আমাদের কাজ সহজ হয়ে যাবে।’
“জঙ্গলের অন্ধকার কেটে গিয়ে যখন ভোরের আলো ফুটল, একটা নতুন ব্যাপার উপলব্ধি হল। শুধুমাত্র স্পষ্ট দেখতে পেলেই মানুষের আত্মবিশ্বাস অনেকটা বেড়ে যায়। গাছ থেকে নীচে তাকিয়ে দেখলাম, গর্তের মধ্যে এককোণে বাঘটা বসে আছে, জিভ বের করে হ্যা হ্যা করে হাঁপাচ্ছে। তার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে ঝুরঝুরে নরম মাটি আর অজস্র টুকরোটাকরা ডালপালা, কাঠকুটো। এগুলো দিয়েই গর্তের ওপরটা আলগা চাপা ছিল। বাঁদিকে রাস্তার ওপরে মাটিতে পড়ে আছে মরা ছাগলটা। তার মাথা, গর্দান আর বুকের কিছুটা ছাড়া তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। আর রাস্তার ডানদিকের ছাগলটা ঘাড় মুচড়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে ছটফট করছে, কিন্তু উঠে দাঁড়াতে পারছে না। ছোটেলালজি বললেন, ভয়ে খোঁটা ছাড়িয়ে পালাবার চেষ্টায় বেচারা নিজেই নিজের ঘাড় ভেঙে ফেলেছে।
“ওপর থেকে গোটা ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করে ছোটেলালজিই প্রথম নীচে নামতে লাগলেন। আমাকে গাছের ওপর বাঁধা অবস্থাতে রেখে ওঁর সঙ্গে বাকিরাও তড়বড়িয়ে নীচেয় নেমে গেল। আমি কতবার কাকুতি মিনতি করলাম, কথা কানেই নিলেন না। নামার সময় দুজন নীচের ডালে বাঁধা জালটা খুলে গাছের নীচে ফেলে দিল। নীচে নেমে সকলেই হাতে নিজের নিজের অস্ত্রশস্ত্র— টাঙি, বল্লম, লম্বা তরোয়াল নিয়ে গর্তের একদিকে দাঁড়ালেন। বাঘটা গর্তের ধারে সাতজন মানুষকে দেখে উঠে দাঁড়াল; বিশাল মুখটা হাঁ করে আকাশ কাঁপানো গর্জন করে উঠল। তারপর উলটোদিকে বিশাল লাফ দিল গর্ত থেকে বেরোনোর জন্যে। পারল না। গর্তের দেওয়ালের মাটিতে গভীর নখের আঁচড় কেটে, ঘষটে পড়ে গেল নীচে। অসহায় রাগী চোখে তাকিয়ে দেখল গর্তের ধারে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে। আবার গর্জন করে উঠল। আবার একবার ব্যর্থ চেষ্টা করল লাফিয়ে বের হতে, পারল না। ততক্ষণে ও-পাশের মাচা থেকেও সকলেই নেমে এসেছে মাটিতে।
“ছোটেলালজি আর সাতজন এবার জালটা নিয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে চললেন গর্তের উলটোদিকে, যেদিক দিয়ে বাঘটা লাফিয়ে বেরোবার চেষ্টা করছিল। গর্তের দু-দিকে চারজন করে ধরে জালটা মেলে ধরল টানটান করে। মাথার ওপর জালটা দেখে বাঘটা আরও যেন খেপে উঠল। গর্জন করে আবার লাফ দিল, আর তখনই গলায় ‘হোইইইই’ আওয়াজ তুলে আটজনেই একসঙ্গে ছেড়ে দিল জালটা। এবারও মাটি আঁচড়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বাঘটা জড়িয়ে গেল জালে। নীচে পড়ার পর জালটা ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াতে বাঘটা যত হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করতে লাগল, তার চার পা ততই জালে জড়াতে লাগল। খানিকক্ষণ চেষ্টার পর অসহায় রাগে গর্জন করে উঠল বেশ কয়েকবার। তারপর চুপ করে বসে আবার হাঁপাতে লাগল। আর জুলজুল চোখে জরিপ করতে লাগল গর্তের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে। হতে পারে হিংস্র, হতে পারে কালান্তক যম, কিন্তু দারুণ ক্ষমতাশালী এই রাজকীয় প্রাণীর এমন অসহায় অবস্থাও বেশ ট্র্যাজিক।
“বাঘটাকে জালে বন্দি করার পর ছোটেলালজি আমাকে গাছ থেকে নামাতে রতনভাইকে পাঠালেন। আমি নীচে নেমে আসতে বললেন, ‘রাগ করিস না বেটা। এইসময় তুই নীচে থাকলে আমাদের কাজে অসুবিধে হতে পারত।’
“আমি হেসে বললাম, ‘আপনাদের সঙ্গে এনেছেন, তাতেই আমি কৃতজ্ঞ বাবুজি। রাগ করব কেন?’
“এর একটু পরেই অনেক দূর থেকে আমরা একটা মোটর গাড়ির আওয়াজ পেলাম। দেখলাম একটা জিপ আসছে, তার পেছনে বড়ো ট্রলি। তার সঙ্গে আসছে বেশ কয়েকটা ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে লোকজন। রতনভাই বলল, জিপটা বনদপ্তরের। আর ট্রলিতে আছে বড়ো লোহার পিঁজরা, মানে খাঁচা, বাঘটাকে শহরে চালান দেওয়ার জন্যে।
“আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওরা সবাই এত তাড়াতাড়ি খবর পেল কী করে?’
“ ‘রাজাসাহেব তো সব ব্যবস্থা করেই রেখেছিলেন। আর গতকাল রাত্রে বাঘটা গর্তে পড়ার পর থেকে যা গর্জন করেছে, তাতে আশেপাশের আট-দশ মাইলের মধ্যে কারও বুঝতে বাকি নেই যে বাঘটা ধরা পড়েছে। গ্রামের লোকেরাও এসে যাবে। কেউ হেঁটে আসছে, কেউ গোরুর গাড়িতে, তাই ওদের দেরি হচ্ছে।’
“আমাদের কথাবার্তার মধ্যেই জিপ এসে দাঁড়াল। অফিসার আর কর্মীরা গর্তের সামনে এসে বাঘটাকে দেখে খুব আশ্চর্য হলেন। ছোটেলালজির কাছে এসে বললেন, ‘আপনারা সব ঠিকঠাক আছেন তো ছোটেলালজি, কারও কোনও চোট লাগেনি তো?’
“রতনভাই হাসতে হাসতে বলল, ‘কারো গায়ে এক ভি খরোচ লাগেনি সারজি।’
“অফিসার বললেন, ‘সত্যি, লোকে যেভাবে পায়রা ধরে, শুনেছি আপনার পিতাজি সেভাবে বাঘ ধরেন। দেখে মনে হচ্ছে বাঘটাও তেমন কোনও চোট-টোট পায়নি। বাবুজি, এটা নিয়ে আপনার ক’টা হল?’
“রতনভাই বললেন, ‘এটা নিয়ে চারটে। তাই না বাবুজি?’
“ছোটেলালজি হাসলেন। বললেন, ‘সবই মায়ের কৃপা। তিনি তো চান না শের নিধন হোক, কিংবা শের আদমখোর হয়ে উঠুক। শেরওয়ালি মায়ি চান তাঁর সন্তানেরা সবাই সুখে শান্তিতে থাকুক।’
“এই সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এলেন মুখিয়াজি। আমরা সকলেই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে নমস্কার জানালাম। মুখিয়াজি ছোটেলালজিকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ছোটেভাই, জঙ্গলের সব বাঘকে ধরে এইবার শহরের চিড়িয়াঘরে পাঠিয়ে দাও। আর এ-কাজ তুমিই পারবে। তাতে না বাঁশ থাকবে, না বাঁশরী বাজবে, সবার পক্ষেই মঙ্গল। ক্যায়া বনার্জি সাব?’
“ফরেস্ট অফিসার সায়েব বাঁড়ুজ্জে বাঙালি? আমি চমকিত হলাম।
“ব্যানার্জি সায়েব হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমরা সবাই রাজি হলেও বাবুজি কক্ষনো রাজি হবেন না। উনি জানেন মানুষের বাঁচার জন্যেই জঙ্গল চাই, আর জঙ্গলকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে বাঘ।’
“মুখিয়াজি সঙ্গে করে চা এনেছিলেন, ফ্লাস্কে ভরে। তাঁর লোকজন কাচের গেলাসে ঢেলে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিল। কড়া মিষ্টি মশলাদার গরম চা। সারারাতের ক্লান্তি আর চরম টেনশনের পর প্রথম চুমুকেই মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠল। ব্যানার্জী সায়েব এবং তাঁর দলবল চা নিলেন না। বললেন, ‘আমরা একটু আগেই চা খেয়ে এসেছি। আমরা বরং আমাদের কাজটা নির্বিঘ্নে সেরে ফেলি। বেচারাকে আর বেশিক্ষণ কষ্ট দেওয়ার মানে হয় না।’
“ভয়ংকর অথচ অসহায় বাঘের চোখের দিকে তাকিয়ে ছোটেলালজি বললেন, ‘সচ বাত। ওই ছোট্ট গর্তের মধ্যে জালে বন্দি হয়ে থাকার মতো অসম্মান জঙ্গলের রাজার পাওনা হতে পারে না।’
“ছোটেলালজির এই কথায় উপস্থিত সকলেই মাথা নেড়ে সায় দিল, কেউ কিছু বলল না। আমরা চায়ের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে দেখলাম বনদপ্তরের কর্মীরা পেছনে ফুল লাগানো একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জে অনেকটা তরল ওষুধ ভরে নিলেন। বিশেষভাবে বানানো ওই সিরিঞ্জকে ডার্ট বলে। বাঘটা কিন্তু অনেকক্ষণ ধরেই ভীষণ শান্ত হয়ে বসে রয়েছে, আর মুখ তুলে আমাদের ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লক্ষ করছে।
“বনকর্মী আর একজন ভদ্রলোক একটা ফুট পাঁচেক লম্বা পাইপ আর সেই ওষুধভরা সিরিঞ্জ নিয়ে অ্যালুমিনিয়ামের হালকা মই বেয়ে খুব সন্তর্পণে নামলেন গর্তের মধ্যে। যে প্রান্তে বাঘটা জালে বন্দি, তার উলটো প্রান্তে, বাঘের পেছন দিকে। বাঘটা তাঁর দিকে তাকিয়ে মুখ হাঁ করে ঘ্রাউ ঘ্রাউ আওয়াজ করল বিরক্তিতে। চেষ্টা করল ঘুরে উঠে দাঁড়াতে, পারল না। পাগুলো জালের ফাঁদে এমন ফেঁসে গেছে! বাঘটা একটু শান্ত হওয়ার কিছুক্ষণ পর সেই বনকর্মী এক পা এক পা করে এগোতে লাগলেন বাঘের দিকে। গর্তের ওপর দু-পাশে চারজন বনকর্মী হাতে উদ্যত বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বাঘটা কোনোভাবে আক্রমণ করলেই গুলি চালাবেন গর্তের মধ্যে থাকা বনকর্মীর নিরাপত্তার জন্যে। কিন্তু তেমন কিছু ঘটল না। বনকর্মী মানুষটাকে ক্রমশ কাছে আসতে দেখে বাঘটা রেগে গিয়ে গর্জন করছিল ঠিকই, কিন্তু সে অসহায় গর্জন। সে-গর্জনে এখন আগের মতো ক্রোধ ফুটছে না। বেশ দুর্বল কণ্ঠস্বর। গতকাল রাত্রে যে-গর্জনে আমার বার বার পিলে চমকে উঠেছিল, এই গর্জন তার ভগ্নাংশ মাত্র।
“বনকর্মী লোকটি একসময় বাঘের থেকে ফুট দশেক দূরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। বাঘটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বনকর্মীর দিকে। আমরা তখন দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রয়েছি গর্তের কিনারায়। কেউ কোনও শব্দ করছি না। নীচে দাঁড়ানো ভদ্রলোক এবার প্রায় চার ফুট লম্বা একটি পাইপের মুখে ডার্টটি সেট করে নিলেন। তারপর পাইপের অন্য মুখটা নিজের মুখে লাগিয়ে ফুঁ দিয়ে ডার্টটি ছুড়ে দিলেন। ডার্টটা বিঁধে গেল বাঘের পেছনের একটা ঊরুতে। আচমকা ওই ডার্টের আঘাতে এবং অবশ্যই ডার্টের ছুঁচ ফোটার যন্ত্রণায় বাঘটা ভীষণ রেগে গেল, ছটফট করে উঠল। গর্জন করে উঠল ভীষণ। কিন্তু জালে বন্দি থাকার জন্যে কোনও বিপদ ঘটাতে পারল না। বনকর্মী ভদ্রলোক সে-সময় পিছিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন সিঁড়ির সামনে।
“কিছুক্ষণ অসহায় ছটফট করে বাঘটা আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এল। নিজের ঊরুতে গেঁথে থাকা ডার্টটার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে গলা দিয়ে গরগর আওয়াজ করছিল। কিন্তু একসময় সে আত্মসমর্পণ করল। মাথা হেলিয়ে শুয়েই পড়ল। শ্বাস-প্রশ্বাসের তালে তার পেটের ওঠানামা এখন খুব ধীর আর নিয়মিত। কোনও উত্তেজনা নেই। ব্যানার্জী সায়েব ঘড়িতে সময় দেখে তাঁর সহকর্মীদের বললেন, ‘মিনিট খানেক অপেক্ষা করে আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। আমরা কতক্ষণ সময় পাব, কৃপালালজি? এক ঘণ্টা?’
“বনদপ্তরের কর্মী কৃপালালজি বয়স্ক অভিজ্ঞ মানুষ, ঘুমন্ত বাঘের দিকে গভীর দৃষ্টি রেখে বললেন, ‘নহিজি, আধা ঘণ্টা পর্যন্ত নিরাপদ, তার মধ্যেই আমাদের কাজ সেরে ফেলতে হবে।’
কৃপালালজি ইশারা করতে আরও দুজন বনকর্মী সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লেন গর্তের ভেতর। বাঘটার একটা কান ঘুরে উঠল, লেজটা দুলে উঠল সামান্য। চোখ মেলতে চেষ্টা করেও পারল না। গর্তের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তিনজন বনকর্মী অপেক্ষা করলেন কিছুক্ষণ। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। যদিও জালে বন্দি হয়ে আছে, ঘুমের ওষুধ কাজও শুরু করে দিয়েছে, তবুও যদি বাঘটা এখন লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করে!
“কিন্তু সেরকম কিছু হল না। বাঘটা চুপ করে শুয়েই রইল। দুজন বনকর্মী তারপর বাঘের পেছনের পা দুটো বেঁধে ফেললেন প্রথমে, তারপর সামনের পা দুটোও। বনকর্মীদের কাছেই মোটা লম্বা একটা বাঁশ ছিল, সেটা এনে বাঁধা দুই পায়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বাঘটাকে গর্ত থেকে তোলার ব্যবস্থা হয়ে গেল। বাঁশের দুই প্রান্তে দড়ি বেঁধে অনেকে মিলে জালসমেত বাঘটাকে সহজেই তুলে ফেলল গর্তের বাইরে।
“গর্তের বাইরে এনে মাটিতে যখন শোওয়ানো হল, বাঘটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কী হচ্ছে তাকে নিয়ে। সকলেই সতর্ক হয়ে উঠল, কিন্তু বাঘটা আবারও ঝিমিয়ে পড়ল আগের মতোই। এরপর বনকর্মীরা দক্ষ হাতে মেপে নিলেন বাঘের শরীর। লম্বায় দশ ফুট চার ইঞ্চি, তার মধ্যে লেজটাই দু-ফুট সাড়ে সাত ইঞ্চি।
“বনদপ্তরের মাপজোকের মধ্যে গ্রামের লোকেরা এসে জড়ো হতে লাগল। ব্যানার্জী সায়েব বনকর্মীদের বললেন, ‘বেশি ভিড় জমার আগেই বাঘকে খাঁচায় ভরে দিন, নয়তো হইচই শুনে বাঘ ভড়কে যাবে।’
“বনকর্মীরা চটপট কাঁধে তুলে ট্রলির ওপরে রাখা লোহার খাঁচায় ভরে দিলেন বাঘকে। ছোটেলালজি বললেন, ‘জাল খোলার চেষ্টা না করে কেটে ফেলুন, তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।’
“তাই করলেন বনকর্মীরা, ছুরি দিয়ে চটপট জাল কেটে ফেললেন। জাল থেকে মুক্তি পেয়ে বাঘটা কিছুটা স্বস্তি পেল। ঘুমের মধ্যেই গোটা শরীরটা কিছুটা টানটান করে নিল, লেজটাও বার কয়েক নাড়াচাড়া করল। এবার সবথেকে বিপজ্জনক কাজ পায়ের বাঁধন খোলা। সেটাও খাঁচার বাইরে থেকে ভেতরে হাত বাড়িয়ে, দক্ষ হাতে সেরে ফেললেন বনকর্মীরা।
“খাঁচার গেট বন্ধ করে দেবার পর উপস্থিত সকলেই স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। ছোটেলালজি কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে বললেন, ‘জয় শেরওয়ালি মায়ি কি জয়।’ সবাই এক বাক্যে হেঁকে উঠলাম— ‘জয়।’ সেই আওয়াজে বাঘটা উঠে বসল, গরগর করে উঠল রাগে। দু-বার গর্জন করে উঠল। গ্রামের লোকেরা যারা খাঁচার কাছাকাছি ভিড় করেছিল, তারা লাফিয়ে বেশ খানিকটা দূরে সরে গেল।
“ব্যানার্জী সায়েব বাঘের আধখাওয়া এবং ঘাড়-ভাঙা দুটো ছাগলই খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে বললেন বনকর্মীদের। তারপর ছোটেলালজি এবং মুখিয়াজির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, ‘আজ চলি, এই বাঘকে কলকাতায় পাঠানোর কথা আছে। নির্বিঘ্নে রওনা না করানো পর্যন্ত আমার শান্তি হবে না। সবকিছু ঠিকঠাক মিটলে কালপরশু চলে আসব আপনাদের গ্রামে, সবার সঙ্গে আলাপ করতে।’
“তারপর আমাদের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি জিপে উঠে বাঘ নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। বাঘটা খাঁচার দেয়ালের ধারে মুখ রেখে শুয়ে ছিল। আমাদের দিকে তাকিয়ে মুখটা বেঁকাল। ছোটেলালজি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘বেচারার ওষুধের ঘোর এখনও কাটেনি। তুই চিড়িয়াখানায় গেলে তোকে ঠিক চিনতে পারবে, দেখে নিস।’
“বাঘটা ঘুম জড়ানো চোখে পিছিয়ে যেতে থাকা জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইল। ও কি বুঝতে পেরেছে, এই জঙ্গলে, যেখানে তার আশৈশব সারাজীবনটাই প্রায় কাটল, সেখানে আর ফিরে আসতে পারবে না কোনোদিন?”
গল্প শেষ হতেই অরণিদা মাথার ওপর হাত তুলে শরীরের আড় ভেঙে বললেন, “ওফ্, এমন অভিজ্ঞতা আমাদের মতো মিয়োনো বাঙালিদের ভাগ্যে ক’জনার জুটেছে আমার জানা নেই। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে মনে হচ্ছে। চল পিকলে, আজ রাতটা তোদের বাড়িতে কাটিয়ে কাল ভোরেই বেরোব, হাওড়া থেকে ট্রেন ধরতে হবে।”
ক্লাব ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে যেতে যেতে আমি অরণিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা অরণিদা, বাঘটা যখন দ্বিতীয়বার ফিরে এল তখন শুধু ডানদিকের ছাগলটাই চেঁচিয়েছিল বললেন, বাঁদিকেরটা চেঁচাল না কেন?”
অরণিদা হাসলেন। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বাহ্, বেশ মন দিয়ে শুনেছিস তো গল্পটা! বাঘটা প্রথমবার যখন এসেছিল, তখনই বাঁদিকের ছাগলটাকে মেরে ফেলেছিল। কিন্তু খেতে বসেনি। কিছু একটা সন্দেহ করেছিল। বললাম না মানুষখেকো বাঘ অনেক বেশি চালাক হয়! রাতের জঙ্গলে রাস্তার ধারে দু-দুটো ছাগল সাজানো দেখলে সন্দেহ হবে না? তাই গর্জন করে, ছাগলটাকে মেরে, একটু দূরে সরে গিয়ে আড়ালে বসে চুপটি করে লক্ষ রাখছিল। বেশ অনেকক্ষণ দেখার পর নিশ্চিন্ত হয়ে সে আবার ফিরে এসেছিল ছাগলটাকে খেতে। আমরাও সেদিন মাচায় বসে অদ্ভুত ধৈর্য দেখিয়েছিলাম। কেউ কোনও শব্দ করিনি, হাঁচি-কাশি কিচ্ছু না। ছোটেলালজি বলেছিলেন, সামান্য শব্দ পেলেই বাঘ টের পেয়ে যেত, আর ফিরে আসত না। অন্যদিকে চলে গিয়ে শিকারের সন্ধান করত।”
“হুঁ। স্বীকার করতেই হবে, এমন একটা শিকারের গল্প শুনে অনেক কিছু শিখলাম, জানলাম।”
“অ্যাইও, আমরা মোটেই শিকার করিনি। জ্যান্ত বাঘ ধরেছিলাম, সেটা তো আগে স্বীকার কর হতভাগা!”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “স্বীকার করলাম, অরণিদা।”
লেখকের অন্যান্য লেখা
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস