ছোটো গল্প
FREE SHIPPING IN INDIA
ছোটো গল্প
ধাইমা ফুলের মতো শিশুটিকে কোলের মধ্যে জড়িয়ে সেই রাতেই রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে গেল। রানি তখন ওষুধের প্রভাবে ঘুমে অচেতন। এদিকে পূর্ণিমার চাঁদ রূপকপুরকে অন্ধকারে ডুবিয়ে ধাইমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। চাঁদ বিদায় নিতে সূর্য উঠল। ধাইমা অবাক হয়ে দেখল ভারি সুন্দর একটা ফুলবাগানের ভিতরে পাতায় ছাওয়া একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর। ঘরের ভিতর একটা ফুলের দোলনা দুলছে। এসব কে বানাল?
সবিতা রায় বিশ্বাস
ওই যে দূরে পাহাড় দেখছ, ওই পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলো ঝলমল এক মস্ত প্রাসাদ, রূপকপুরের রাজপ্রাসাদ। রূপকপুরের প্রজাদের মনে ভারি আনন্দ। ওমা, আনন্দ হবে না! এবার যে রাজপুত্তুর আসবে রানিমার কোলে! যদি রাজকন্যা আসে? চুপ! চুপ! এ-কথা শুনলে রাজা গর্দান নেবেন। তিনি কন্যাসন্তান মোটেই পছন্দ করেন না। কন্যা হলে খরচ বাড়বে বই কমবে না, তাকে সর্বগুণান্বিতা করে বিবাহ দিতে হবে। প্রচুর ধনসম্পদ দিয়ে কন্যাকে পাঠাতে হবে অন্য রাজ্যে। লোকসান বই লাভ কিছু নেই।
এ-কথাটা তিনি দেশের প্রজাদের বুঝিয়েছেন, তাই তারাও কন্যাসন্তান হলে তাকে পাঠিয়ে দেয় অন্য দেশে।
তা বলে দেশে কোনও মহিলা নেই? সে থাকবে না কেন? ছেলের বিয়ে দিতে হলে পাশের দেশ থেকে কন্যা কিনে এনে বিয়ে দিতে হয়।
রাজা প্রতাপ সিংহ রাজ-জ্যোতিষীর কথা শুনে খুব আনন্দে আছেন, ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে প্রজাদের মিষ্টি বিলিয়েছেন।
ওদিকে রানি ইন্দুমতী চান তাঁর একটি ফুটফুটে কন্যা হোক। তাকে তিনি নিজের হাতে সাজাবেন, নৃত্য-গীত শেখাবেন। সে-কন্যা হাসলে মুক্তো ঝরে পড়বে, কাঁদলে পান্না। কিন্তু রানির মনের ইচ্ছা কি পূর্ণ হবে? কন্যাসন্তান হলে রাজামশায় তাকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেবেন না তো?
রানি ইন্দুমতী যা চেয়েছিলেন তাই হল। লক্ষ্মী পূর্ণিমার রাতে আকাশে যখন গোল থালার মতো চাঁদ উঠে পুরো রাজ্য আলোর বন্যায় ধুইয়ে দিচ্ছে, ঠিক তখনই তাঁর কোল জুড়ে, রাজপ্রাসাদ আলো করে এক কন্যাসন্তান জন্মাল। তার কান্না শুনে উত্তেজনায় রাজা প্রতাপ সিংহ ছুটে এলেন। ধাইমার মুখে খবর শুনে রাজা রাগে ফেটে পড়লেন। কিন্তু রাগ সংবরণ করে ফিসফিস করে বললেন, “রাজবৈদ্যের ওষুধে রানি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়বে। তারপর আজ রাতের মধ্যেই ওই মেয়েকে নিয়ে রূপকপুর ছেড়ে চলে যাবে। আমি তোমার জন্য মোহর পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
ধাইমা বলল, “মহারাজ, মার্জনা করবেন, মোহর আমি নিতে পারব না। আমাকে যে মূল্যবান উপহার দিলেন তাতেই আমি খুশি। আপনার আদেশমতো তাকে নিয়ে আমি এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি।”
ধাইমা ফুলের মতো শিশুটিকে কোলের মধ্যে জড়িয়ে সেই রাতেই রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে গেল। রানি তখন ওষুধের প্রভাবে ঘুমে অচেতন। এদিকে পূর্ণিমার চাঁদ রূপকপুরকে অন্ধকারে ডুবিয়ে ধাইমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। চাঁদ বিদায় নিতে সূর্য উঠল। ধাইমা অবাক হয়ে দেখল ভারি সুন্দর একটা ফুলবাগানের ভিতরে পাতায় ছাওয়া একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর। ঘরের ভিতর একটা ফুলের দোলনা দুলছে। এসব কে বানাল?
“আমরা গো, আমরা।”
“তোমরা কারা?”
ধাইমার কথা শুনে বানর, হরিণ, পাখি ও বনের প্রাণীরা সবাই এসে বলল, “আমরা চাঁদমামার কাছে খবর পেয়ে রাজকুমারী ইরাবতীর জন্য এই ঘর, দোলনা সব বানিয়েছি। নাও, রাজকুমারীকে দোলনায় শুইয়ে দাও। আমরা দোল দিচ্ছি। মধু এনেছে প্রজাপতি, ইরাবতীকে খাইয়ে দাও, বাছার গলা শুকিয়ে গেল তো!”
ধাইমা অবাক হয়ে বলল, “ইরাবতী কে? রাজকুমারীর তো নামকরণ হয়নি এখনও।”
“আমরা দিলাম। ওই দেখো ইরাবতী নদী, কী সুন্দর টলটলে মিষ্টি জল। ওই জলে আমরা তেষ্টা মেটাই। আমাদের রাজকুমারী ঠিক ওই নদীর মতো। নদী যেমন ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ তুলে জলের নূপুর পরে নেচে চলেছে, তেমনি রাজকুমারীও হাঁটতে শিখলে ফুলের নূপুর পায়ে আমাদের সঙ্গে নাচ করবে, গান গাইবে। তাই আমরা নাম দিয়েছি ইরাবতী।”
ধাইমা ওদের কথা শুনে খুব খুশি হলেও রাজকুমারীর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের জল আটকাতে পারল না। যার আজ রাজপ্রাসাদে মায়ের কোলের মধ্যে থাকার কথা সে কিনা এই পাতার কুটিরে শুয়ে আছে?
রাজা প্রতাপ সিংহের বাবা ছিলেন খুবই ভালো একজন রাজা। তাঁর রাজত্বকালে এমন নিষ্ঠুর আইন ছিল না। তিনি বলতেন প্রতি ঘরে অন্তত একজন কন্যা না থাকলে সে-ঘরে আনন্দ থাকে না। কন্যা হল আনন্দময়ী, কল্যাণময়ী। প্রতাপ সিংহের আচরণ বরাবর উদ্ধত। অনেক বুঝিয়েছেন মহারাজা-রাজমাতা, কিন্তু কোনও কথাই শোনেননি প্রতাপ সিংহ। এখন তো তাঁর রাজত্ব, যা মন চাইছে তাই করছেন।
এদিকে ঘুম ভেঙে রানি ইন্দুমতী রাজকুমারীকে না দেখতে পেয়ে সবার কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু সবাই রাজার নির্দেশে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। রানি বুঝতে পারলেন, সর্বনাশ যা হবার হয়ে গিয়েছে। রাজাকে ডেকে পাঠিয়ে জানতে চাইলেন, “আমার কন্যা কোথায়?”
রাজা বললেন, “তুমি কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়ে এ-কথা জানতে চাইছ? কন্যাসন্তান দিয়ে আমি কী করব? পুত্র হলে আমি তোমায় মাথায় করে রাখতাম। আমার পরে সেই পুত্র দেশ শাসন করত।”
রানি বুঝলেন, এই হৃদয়হীন রাজার সঙ্গে কথা বলা বৃথা। সেই থেকে কান্নাই সাথী হল রানি ইন্দুমতীর। সারাদিন ঘরে বসে চোখের জল ফেলেন আর রাত্রিবেলায় রাজপ্রাসাদের ছাদে উঠে তাকিয়ে থাকেন দূরে। আকাশ-বাতাস-নদী সকলের কাছে প্রার্থনা করেন যেন কন্যা তাঁর কোলে ফিরে আসে।
‘ও আকাশ, ও বাতাস, ও নদীর জল
কন্যে আমার কোথায় আছে
বল রে আমায় বল।
কুচবরন কন্যা তার মৃগনয়ন আঁখি
নিঠুর রাজা নির্বাসন দিল বাছা রে
আমায় দিয়ে ফাঁকি।
সইতে নারি এ যাতনা আঁখিজলে ভাসি
ফিরে পেলে হারানিধি, ফিরবে আবার
আমার মুখের হাসি।’
রানি সারারাত কেঁদে কেঁদে গান করেন। সেই করুণ সুর শুনে নদীর জল শুকায়, গাছের ফুল শুকায়, শুকায় মাঠের ফসল। শুধু অহংকারী রাজা আস্ফালন করেন, আর প্রজাদের অত্যাচার করেন। কারণ, মাঠের ফসল শুকিয়ে যাওয়ায় তারা রাজাকে কর দিতে পারে না। কী করে কর দেবে? তারা নিজেরাই তো খেতে পায় না। রূপমতী নদীর সে-রূপ আর নেই, শুকিয়ে শীর্ণ এক নালায় পরিণত হয়েছে। প্রজারা সবাই বলাবলি করছে, রাজার অপরাধেই আমাদের এই সর্বনাশ। প্রকৃতি মা কুপিত হয়েছেন, আর রক্ষা নেই। আমাদের সবাইকেই নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। আমরা রাজার আদেশে আমাদের কন্যাকে ত্যাগ করেছি, আমরাও সমান অপরাধী।
এদিকে রোজ রাতে রানি কাঁদেন আর দিনে প্রজাদের ঘরে ঘরে কান্নার রোল ওঠে। রাজা বিরক্ত হয়ে ওঠেন। বিদূষকদের কথা শুনে হুকুম জারি করেন—
“প্রজাদের ঘরে
কেউ যদি কাঁদে,
ঘর থেকে বের করে
ফেলে দেবে ফাঁদে।
খেতে পাবে একদিন
উপবাস তিন,
নেচে যাবে দুই দিন
তাতা ধিন ধিন।”
তাতা ধিন ধিন, তা ধিন তা ধিন।
রাজকুমারী ইরাবতী নাচছে ফুলের নূপুর পায়ে। আহা, কী অপরূপ দৃশ্য! ইরাবতীর চারপাশে ঘুরে ঘুরে ময়ূর পেখম মেলে নাচছে। বানর বাজাচ্ছে ঢোল। নারকেল গাছে বসে তাল ঠুকছে কাঠঠোকরা। এমন সুন্দর দৃশ্য দেখে বুড়ি ধাইমা ফোকলা দাঁতে হেসেই কুটিপাটি।
রাজকুমারী এই বনে আসার পরে পাখিরা সবাইকে ডেকে বলেছে, “আমরা তো বনের ফলমূল খাই। কিন্তু রাজকুমারী জন্য চাল-গম চাই, সবজি চাই, গোরুর দুধ চাই, মিষ্টি চাই, নতুন পোশাক চাই।“
অন্য প্রাণীরাও সায় দিল, “ঠিক। ঠিক।”
“তাহলে আমরা শস্যের বীজ নিয়ে এসে এখানে ছড়িয়ে দিই, বৃষ্টি হলে ফসল হবে।”
ফসল তো হল, এখন সেগুলো ঝাড়াই-বাছাই করার জন্য তো লোক লাগবে। তাহলে?
ধাইমা ওদের কথা শুনে বলল, “যাদের গলায় সুর আছে, যারা মানুষের মতো কথা কইতে পারে সেইসব পাখিরা রূপকপুরের গাঁয়ে গাঁয়ে গিয়ে বলবে—
শোনো শোনো চাষিভাই
একটা কথা শোনো,
পাপী রাজার দেশ ছাড়ো
সুখ নেইকো কোনো।
এমন দেশে নিয়ে যাব
মাছ-ভাত পাবে,
গোয়ালভরা গোরু ভাই
খাঁটি দুধ খাবে।
সে-দেশে সবাই রাজা
বলছি ভাই ঠিক,
আমার পিছে পিছে এসো
ভুল কোরো না দিক।”
এরপরে রাজকুমারী ইরাবতীর ‘সবাই রাজার দেশে’ একে একে চাষি, কামার, কুমোর, তাঁতি সবাই এল তাদের গোরু-বাছুর, হাল-বলদ, হাপর-মাকু নিয়ে। তারা তো দেখে অবাক! চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ, টলটলে নদীর জল। কতদিন তারা তেষ্টা মিটিয়ে এমন টলটলে জল খায়নি। আগে তারা ইরাবতী নদীর মিষ্টি জল পেট ভরে খেল। তারপর একটু এগোতেই তারা দেখল ভারি সুন্দর একটা ঘর, তার মাটির দেওয়ালে কতরকম ছবি আঁকা, পাতায় ছাওয়া চালের উপর কচি লাউয়ের ডগা সাদা ফুলে ভরে আছে। দাওয়ায় বসে এক বুড়ি কাঁথা সেলাই করছে। পাশেই মাটির উনুনে পরমান্ন রান্না করছে পরমাসুন্দরী এক কিশোরী কন্যা। কাছেই তার আদরের বেড়াল কালিন্দী বসে। পরমান্নের গন্ধে তাদের সকলের জিভে জল চলে এল। কতদিন হয়ে গেল এমন পরমান্ন খায়নি তারা। খাবে কী করে? একদিন ভাত জুটলে এক সপ্তাহ উপোস থাকতে হয় যে।
রাজকুমারী ইরাবতী তার মৃগনয়ন আঁখি তুলে, পদ্মের পাপড়ির মতো ঠোঁট খুলে দোয়েল পাখির মতো মধুর সুরে বলল, “তোমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোসো, পায়েস খাও।
তুলশিমালা চাল দিয়ে আজ
রেঁধেছি আমি পায়েস,
পেটটি ভরে খাও বাছারা
মিটিয়ে নিয়ে আয়েশ।
এমন সুবাস মিলবে শুধু
‘সবাই রাজার দেশে’
সুখের হদিস পাবেই পাবে
মনখারাপের শেষে।
ঝগড়া-বিবাদ কোরো না কেউ
তাহলে পাবে সাজা,
কন্যা হলে যত্ন কোরো
না-হলে বিদায় বাছা।”
বহুদিন পরে পেট ভরে তৃপ্তি করে পায়েস খেয়ে সবাই বলাবলি করতে লাগল, এ নিশ্চয় কোনও দেবকন্যা। আজ থেকে আমরা সকলে এখানেই মিলে-মিশে থাকব। এবার আমাদের ঘরেও কন্যারা নাচবে, গাইবে।
মাত্র এক বছরের মধ্যে ‘সবাই রাজার দেশে’ যারা এসেছিল তাদের আবার গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গোরুতে ঘর ভরে উঠল। কয়েকটি কন্যার জন্ম হল, সকলেই খুব খুশি।
রূপকপুর থেকে যারা এসেছিল তাদের মধ্যে একজন পন্ডিতও ছিলেন। তিনি পাঠশালা খুলে বসলেন, সে-পাঠশালায় রাজকুমারীও পড়তে যেত। পন্ডিতমশায় রাজকুমারীর মেধা দেখে অবাক! এক বছরের মধ্যে রাজকুমারী সব বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠল।
রাজকুমারীকে দেখে সকলেই অবাক হত। এই কন্যা বানরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাছের ডালে ডালে ঘুরছে, দোল খাচ্ছে। কখনও আবার তির-ধনুক দিয়ে লক্ষ্যভেদ করছে। এমনকি গাছের ডালকে তরবারি বানিয়ে অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। যখন নদীতে সাঁতার কাটে তখন তাকে দেখে মনে হয় মত্স্যকন্যা। আবার যখন নাচ করে, গান গায়, তখন মনে হয় স্বর্গের অপ্সরা। মাঝে-মাঝেই ‘সবাই রাজার দেশে’র ঘরে ঘরে গিয়ে সকলের কুশল নেয়, বিপদে-আপদে পড়লে পরামর্শ দেয়।
সকলের মনেই প্রশ্ন, সর্বগুণান্বিতা এই কিশোরী কন্যা কে? কী তার পরিচয়? কিন্তু কেউই সাহস করে জিজ্ঞাসা করতে পারে না। কেউ কেউ বলে, রূপকপুরের রাজা প্রতাপ সিংহ রাতের অন্ধকারে তাঁর সদ্যোজাত কন্যাকে রাজ্য থেকে ধাইমাকে দিয়ে অজানা দেশে পাঠিয়ে না দিলে রাজকন্যা এমনই হত। কারো-কারো মনে এই প্রশ্নও উঁকি দেয়, এই কন্যা রাজকুমারী নয় তো? আর ওই বুড়ি ধাইমা? কিন্তু মনের কথা মনেই থাকে, মুখ ফুটে কেউ বলে না। বললেও কি ধাইমা তার উত্তর দিত?
ওদিকে রূপকপুর দিন দিন রুক্ষ মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। মেঘেরা দলে দলে রূপকপুরের ওপর দিয়ে উড়ে যায়, কিন্তু ভুলেও বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে না। প্রতাপ সিংহের রাজকোষ শূন্য হতে চলল। ফসল না হওয়ায় বাইরের দেশ থেকে চাল-ডাল সবকিছু কিনে আনতে হচ্ছে। এমনকি খাওয়ার জলও কিনতে হচ্ছে। প্রজারা রাজপ্রাসাদের সামনে এসে হল্লা করছে। প্রতাপ সিংহ তাদের শাস্তির ভয় দেখিয়েও দমন করতে পারছেন না। প্রতাপ সিংহের মনেও ভয় জন্মাল, এইভাবে চললে পুরো দেশ জনমানবশূন্য হয়ে যাবে। বাদ যাব না আমি, মহারানি কেউই। এর কি কোনও প্রতিকার নেই?
রাজা প্রতাপ সিংহ ছদ্মবেশ ধারণ করে মলিন পোশাকে রাজ্যবাসীর প্রকৃত অবস্থা দেখতে বেরোলেন। এতদিনে রাজার মনে হচ্ছে রাজ্যের এই অবস্থার জন্যে হয়তো তিনিই দায়ী। ঘুরতে ঘুরতে শ্রান্ত হয়ে একটা পাতাবিহীন শুকনো বটগাছের গুড়ির ওপরে বসলেন। সেখানেই একজন বৃদ্ধ বসে ছিল মাথা নীচু করে। তার গায়ে কোনও পোশাক নেই, পরনে একটা শতচ্ছিন্ন কাপড়ের টুকরো জড়ানো।
রাজা প্রশ্ন করলেন, “তোমার এ অবস্থা কেন?”
রাজা ছদ্মবেশে এলেও বৃদ্ধ ঠিকই বুঝতে পেরেছিল, ইনি মহারাজ না হয়ে যান না। কারণ, অন্য সকলেরই তার মতো করুণ দশা। তাই সে বলল, “মাফ করবেন মহারাজ, এ-প্রশ্ন আমাকে করবেন না। উত্তর শুনলে আপনি অসন্তুষ্ট হবেন।”
মহারাজ বললেন, “কোনও ভয় নেই, তুমি নির্ভয়ে বলো।”
বৃদ্ধ বলল, “ঠিক বলেছেন মহারাজ। আমি বড়োজোর আর এক সপ্তাহ বাঁচব, আমার আর ভয় কীসের? আপনি মারলেও মরব, না মারলেও মরব। তবে বলি শুনুন—
কন্যা সন্তান ঘরে এলে
তারে তুমি করো যতন,
আদর দিও, শিক্ষা দিও
সে-ই হবে শ্রেষ্ঠ রতন।
কিন্তু আপনি তা না করে প্রজাদের এমনকি নিজের কন্যাসন্তানকেও বিসর্জন দিয়েছেন। আপনি কি এটা জানতেন না!
কন্যাকে করলে হেলা
স্রষ্টা হবেন রুষ্ট,
কন্যা হল মায়ের তুল্য
তাদের করুন তুষ্ট।
আজ আপনার রূপকপুর শ্মশান হবার মূলে আপনি মহারাজ। এখনও সময় আছে কন্যাকে সসম্মানে ফিরিয়ে এনে তাকে আদর-যত্ন করুন। তবেই প্রকৃতি মা তুষ্ট হবেন।
ফিরিয়ে আনুন তাকে
জড়িয়ে ধরুন বুকে,
রূপকপুর ভরে যাবে
শান্তি আর সুখে।”
এই কথা বলেই বৃদ্ধ একটা লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতে লাগল সামনের দিকে। মহারাজ ডেকে বললেন—
“কোথায় গেলে পাব তারে
একবারটি বলে যাও আমারে!”
বৃদ্ধ বলল, “আমি যাচ্ছি সেখানে, সবাই রাজার দেশে। মৃত্যুর আগে সেখানে পৌঁছলে শান্তিতে মরতে পারব। আপনি যেতে চাইলে আমার সঙ্গে আসুন।”
মহারাজ প্রতাপ সিংহ যিনি পালকি ছাড়া পথে বেরোন না, আজ তিনি সেই সর্বহারা বৃদ্ধের পিছনে কাঙালের মতো চলেছেন।
পথ আর শেষ হয় না। তিনদিন দু-রাত্রির শেষে রাজা শুনলেন পাখির কলকাকলি, ঝরনার কলকল ধ্বনি, আর সেই সঙ্গে কিশোরীর মধুর কণ্ঠের গান।
এই কি সেই ‘সবাই রাজার দেশ’? যেদিকে চোখ যায়, প্রাণ জুড়িয়ে যায়। গাছে গাছে ঝুলে আছে সুমিষ্ট ফল। রাজা ও বৃদ্ধ দুজনেই সেই ফলে খিদে মেটালেন, ইরাবতীর সুমিষ্ট জলে তৃষ্ণা নিবারণ করলেন। বৃদ্ধ সেখানেই বসে বিশ্রাম নিতে লাগল। মহারাজা এগিয়ে চললেন তরুলতায় ছাওয়া সেই কুটিরের দিকে।
রাজকুমারী ইরাবতী তখন তার চম্পককলি আঙুল দিয়ে কুটিরের গায়ে সুন্দর চিত্র ফুটিয়ে তুলছিল। রাজা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার নাম কী মা?”
কিশোরী কন্যা উত্তর দিল, “আমি ইরাবতী।”
মহারাজের গলা শুনেই কুটির থেকে বেরিয়ে এল ধাইমা। মহারাজ ধাইমাকে দেখে বুঝলেন এই কিন্নরকণ্ঠী কন্যাটি তাঁরই, যাকে অনাদরে, অবহেলায় রূপকপুর থেকে নির্বাসন দিয়েছিলেন।
মহারাজের চোখ থেকে আপনা-আপনিই জল ঝরে পড়তে ইরাবতী কাছে এসে বলল, “আপনি কাঁদছেন কেন? আপনি কি ক্ষুধার্ত? আমি এখনি আপনার জন্য খাদ্য নিয়ে আসছি।”
রাজা প্রতাপ সিংহ কন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “মাগো, আমি খাবার চাই না। আমি বড়ো অপরাধ করেছি, তাই আমার সোনার দেশ আজ মরুভূমি। আমায় ক্ষমা কর মা, আমার সঙ্গে চল। তুই না গেলে যে প্রজারা মারা যাবে! মাগো, একবার আমাকে বাবা বলে ডাক। তোর মা তোকে হারিয়ে পাগল প্রায়। চল মা, মায়ের কাছে চল।”
রাজকন্যা ধাইমার মুখে সব শুনে রাজাকে ও ধাইমাকে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে চলল রূপকপুরে। রাজকন্যার পিছন পিছন এল মেঘের দল। উল্লাসে নৃত্য করতে করতে ঝরে পড়ল বৃষ্টি। রূপমতী নদী দেখতে দেখতে দু-কূল ছাপিয়ে বয়ে চলল।
প্রজারা রাজকুমারী ইরাবতীর নামে জয়ধ্বনি দিল—
রূপকপুরের ইরাবতী
কন্যা সে সৌভাগ্যবতী,
কন্যার নেই গুণের শেষ
তার পুণ্যে বাঁচল দেশ।
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস