উপন্যাস
FREE SHIPPING IN INDIA
উপন্যাস
বাঘা বাঘা প্রাইভেট টিউটর, আকাশ চুমু দেওয়া টপ টু বটম বাতানুকূল ইন্সটিটিউট, স্মার্টবোর্ডে স্মার্ট ক্লাস, স্মার্ট স্টাডি মেটেরিয়াল, পাতায় পাতায় কিউ আর কোড, স্ক্যান করলেই মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে ডাউট ক্লিয়ারিং। শিডিউল কাকে বলে রে বাপ! এক মিনিট সময় নষ্ট করতে দেবে না। একবার সিস্টেমে ঢুকে পড়লেই হল, তারপর তরতর করে নৌকো ভেসে চলবে স্রোতে।
শাশ্বত কর
এক
অনেকটা দূর চলে এসেছে শাম্ব। একদম অচেনা অজানা জায়গা। দু-ধারেই যতদূর চোখ যায় জলা আর জলা। মাঝখানে এই রাস্তাটা যেন বেমানান। অনর্থক জলাটার বুক চিরে দু-ভাগ করে রেখেছে। অনর্থক কি? রাস্তাটা না থাকলে শাম্ব পৌঁছত কেমন করে এখানে? পৌঁছনো কি খুব জরুরি? এখানে না হলে অন্য কোথাও পৌঁছত সে। কী এসে যেত! গন্তব্য কি সবসময় স্থির হতেই হবে? কে ঠিক করে দেবে গন্তব্য? অন্যের ঠিক করা গন্তব্যেই কেন মানুষ চলবে?
শাম্ব একাই নেমেছে এই নিরালা প্রকৃতিতে। ওকে নামিয়ে দিয়ে বাসখানা চলে যেতে যেতে এখন প্রায় একটা বিন্দুবৎ। খুব একটা গাড়িও চলে না বোধ হয় এখানে। তেমন চোখে তো পড়ছে না। ভালোই হয়েছে। লোকজন বেশি থাকলেই প্রশ্ন; প্রশ্ন তো নয়, প্রশ্নের ঢেউ। আছড়ে আছড়ে পড়বে মগজের চরে। প্রশ্ন ছাড়া কি মানুষে মানুষে কোনও কথা থাকে না?
জলার দিকে মুখ করে ঘাসের উপর থেবড়ে বসল শাম্ব। সাদা বক উড়ছে। পানকৌড়ি ডুবসাঁতার দিতে দিতে হুস হুস করে মাথা তুলছে। জলায় পোঁতা বাঁশগুলোর উপর মাছরাঙা ঠায় দাঁড়িয়ে। ছোটো ডিঙি নৌকোয় ছিপ ধরে বসে আছে কেউ একজন। সবার লক্ষ্য মাছ। আর মাছের লক্ষ্য জল। নিরিবিলি জল। তাই কি? নিরিবিলি জল হলে মাছ খাবে কি? তা হলে মাছের লক্ষ্য কি খাবার? নাকি বেঁচে থাকা? বাঁচা মানে কী? বাঁচা মানে কি শ্বাস নেওয়া?
একট লম্বা শ্বাস নিল শাম্ব। দুই হাত কপালে মাথায় বেশ কয়েকবার দ্রুত চালনা করে কী যেন ভেবে সোজা নেমে গেল জলার দিকে।
দুই
জলার জলে যার বিম্ব তৈরি হয়েছে, সেই শাম্ব চ্যাটার্জী। কলকাতার নামি পরিবারের একমাত্র সন্তান। নামি স্কুলের নামি ছাত্র। বহু মানুষের বহু আশার ধন শাম্ব। সবাই চায় শাম্ব বড়ো হোক, বড়ো ডাক্তার হোক। নামটা কেমন ডাক্তারির জন্য যেন পারফেক্ট। ড. শাম্ব চ্যাটার্জী, এম.ডি., ডি.এম. অথবা এফ.আর.সি.এস., নয়তো এম.আর.সি.পি., নয়তো আরও অন্য কিছু। শুনতে শুনতে অন্যের দেখানো স্বপ্নগুলো কখন যেন নিজের স্বপ্ন দেখাগুলোকে গ্রাস করে নিয়েছে।
এই যে ঝিরঝিরে বাতাসে তিরতির করে শাম্বর বিম্বখানা কাঁপছে, সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শাম্বর যে কত কী মনে হচ্ছে! কী মনে হচ্ছে সে কি আর জানা যায়? জগতের ওই তো একমাত্র গোপনতম স্থান। কোনও চোর ডাকাত হ্যাকার মাফিয়ার ক্ষমতা নেই সেখানে সেঁধোনোর, যদি না মনের মালিক নিজে থেকে অনুমতি দেন। তবু শাম্বর কথা লিখতে বসেছি যখন, অনুমতি তো নিশ্চয়ই আছে।
তাহলে একটু চেষ্টা করেই দেখা যাক না-হয়! কিছু স্বীকার্য নয় নেওয়াই যাক, যদি শাম্বর পরবর্তী ঘটনাক্রম সেই অনুসারী হয় তখন না হয় গণিতের নিয়ম মেনে হাইপোথিসিস-টিসিস সে যাই হোক কিছু একটা বলে ডাকা যাবে। আর তাছাড়া এতসব ডাকা-টাকার দরকারই-বা কী!
কাঁপা কাঁপা বিম্বের দিকে তাকিয়ে শাম্ব হয়তো ঘটনাক্রমের কথা ভাবছে। হয়তো ভাবছে যে সে কেমন করে পারল এমন বেরিয়ে পড়তে।
সত্যিই তো! কতটুকু আর বয়স তার? আঠারো ছুঁতে এখনও মাস দেড়েক বাকিই হবে। অবশ্য খুব কমও নয়! বরং বলা ভালো গোলমেলে বয়স। ধন্দের বয়স। সেই যে এমন এক-একটা মোড় আসে না, পাঁচ দিকে পাঁচ রাস্তা, কোন দিকটা আমার দিক ভাবতে ধাঁধা লেগে যায়— ঠিক তেমন। রাস্তায় অবশ্য ট্রাফিক পুলিশ থাকে। এখন তো আবার জিপিএস আছে, কাজেই সমস্যা কম। তা জীবনেও সমস্যা খানিক কমেছে বইকি। টেনথ স্ট্যান্ডার্ড পাস হতে না হতেই অজস্র সংস্থা আছে যারা ট্রাফিক সার্জেন্টের মতো ওই কাজটি যত্নে করে দেন বলে দাবি করেন। বেশ সুন্দর নাম সেই ব্যাপারটার, কেরিয়ার কাউন্সেলিং। কেমন জলতরঙ্গের মতো মিষ্টি সুর না!
জনমোহিনী এমন কাজ তো জনপ্রিয় হবেই। জনপ্রিয়তার ঠেলায় বড়ো বড়ো স্কুলগুলোতেও কেরিয়ার কাউন্সেলিং সেশন। না-হলে চলে না যে! গার্জেনরাই সে-সব স্কুলকে বাবা আদমের জমানার বলে ছায়া বাঁচিয়ে চলবেন। যস্মিন দেশে যদাচার।
সে যাই হোক, আপাতত আমাদের কথা হচ্ছে শাম্ব চ্যাটার্জীর ভাবনা নিয়ে। ভাবনায় ডুবে ছিল ছেলেটা। কীসের ভাবনা? ওরে বাবা, ভবিষ্যতের ভাবনা! এ তো আর আমাদের মতো অবিবেচক ছোটবেলা না যে মাধ্যমিক পরীক্ষার পর না-হোক মেরেকেটে মাস তিনেকের ছুটি! ছুটি মানে ছুটিই। মামাবাড়ি, মাসির বাড়ি, পিসির বাড়ি ঘুরে বেড়ানোর, মাঠে মাঠে খেলার, অচেনা রাস্তায় সাইকেল চালানোর, পুকুরে ঝাঁপানোর, গামছা দিয়ে তেচোখা মাছ ধরার অঢেল সময়। এখন সে-সব সময় নষ্ট করা হয় না। টাইম ইজ গোল্ড। গোল্ডের ভ্যালু তো রোজই আকাশমুখী। তা ছাড়া এখন কেউ কারও বাড়ি গিয়ে অতদিন করে থাকেও না— ব্যাড ম্যানার্স। না বাবা-মা একা রাখতে সাহস পায়, না যাঁদের বাড়ি গেল তাঁরা সাহস পান।
আবার অন্য কথা! আসল কথা হল শাম্ব চ্যাটার্জী। তা এখনকার আর পাঁচটা ভালো ছেলের যা হয়, ওরও তাই আর কী। পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই টিউশন। বাবা ডাক্তার বলে এমনিতেই একটা ইচ্ছে ছিল পরিবারের সবার, রেজাল্ট ভালো হওয়াতে আর ওই যে বললাম কেরিয়ার কাউন্সেলিং— তার ঠেলায়, থুড়ি, কী যেন বলে, উদ্বুদ্ধকরণে শাম্বর ডাক্তারিতে যাওয়ার পথে হাঁটা একদম স্থির।
স্থির হলেই কি হল? এরপর? এর পরের কাজটাই তো আসল কাজ রে বাপু! বলছিলাম না, সময় বদলেছে? ওই যেমন তেমন করে খেলেধুলে, পড়শির বাড়ি নববর্ষ, বিজয়া, সত্যনারায়ণের সিন্নি খেয়ে, ইশকুলে রেনি ডের ছুটিতে ভিজে ভিজে বল খেলার নয়তো পুকুর ভাসা জলে মাছ ধরার আনন্দ নিয়ে ধীরেসুস্থে পড়াশুনো করার দিন কেঁদো বাঘে খেয়ে গেছে। এখন হচ্ছে সবকিছু, যাকে বলে একেবারে পারফেক্টলি মেপেজুকে সময় বেঁধে কাজ করার দিন। পাঁচ মিনিট সময় নষ্ট করা যাবে না। সময় নষ্ট করেছ কি পিছিয়ে পড়লে। কোত্থেকে পিছোলে? অতসব বোঝার সময় নেই। যতই মুঠোর ভিতর দুনিয়া হোক, ভবিষ্যতের স্বপ্ন ঝলকানি চোখের সামনে জ্বেলে রেখে মোটামুটি বর্তমানের বাঁধা বেড়াতেই মানুষ বাঁচে এখন। কাজেই পারিপার্শ্বিক চেনা পরিচিতই এখনকার নির্দেশতন্ত্র। তার সাপেক্ষেই পিছিয়ে যাওয়া আর কী!
শাম্ব চ্যাটার্জীর সচেতন অভিভাবকরাই-বা ওকে পিছোতে দেবেন কেন?
একে মেধাবী ছেলে, তার উপর বাবা ডাক্তার, কাজেই নিশ্চয়ই কম্পিটিটিভ একজামে বসবে! নিত্যদিন টুংটাং করে মেসেজ আসছে বড়ো আর মাঝারি ইন্সটিটিউশনের। দুয়ে মিলে একটা স্টুডেন্ট ফ্রেন্ডলি প্রোডাক্ট। এটাই এখন চল। মুখ্য উদ্দেশ্য যদি হয় মেডিক্যাল এন্ট্রান্সে সুযোগ পাওয়া; না, কী যেন বলে, ক্র্যাক করা, তাহলে তৃতীয় পাণ্ডবের মতো মাছের চোখেই দৃষ্টি আটকাতে হবে। রইল বাকি এলিজিবিলিটি জোগাড় করা মানে টুয়েলভথ স্ট্যান্ডার্ড টপকানো, সেজন্য খোঁজ নিতে হবে এমন বোর্ডের যেখানে পড়ার চাপ কম অথচ মেডিক্যাল এন্ট্রান্সের সঙ্গে— কী যেন বলে, অ্যাটপার সিলেবাস! খোঁজ নিতে হবে ভালো স্কুলের। এক্ষেত্রে ভালোর সংজ্ঞা কিন্তু আলাদা। যে স্কুল যত বেশি অ্যাবসেন্ট হওয়া অ্যালাও করে, সে স্কুল তত ভালো। কী হবে স্কুলে গিয়ে? কমন টয়লেট শেয়ার করা, পাঁচটা অবিবেচক ছেলেপুলের সঙ্গে মেলামেশা— সময় নষ্ট। বরং বাঘা বাঘা প্রাইভেট টিউটর, আকাশ চুমু দেওয়া টপ টু বটম বাতানুকূল ইন্সটিটিউট, স্মার্টবোর্ডে স্মার্ট ক্লাস, স্মার্ট স্টাডি মেটেরিয়াল, পাতায় পাতায় কিউ আর কোড, স্ক্যান করলেই মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে ডাউট ক্লিয়ারিং। শিডিউল কাকে বলে রে বাপ! এক মিনিট সময় নষ্ট করতে দেবে না। একবার সিস্টেমে ঢুকে পড়লেই হল, তারপর তরতর করে নৌকো ভেসে চলবে স্রোতে।
সবাই ভাসে।
কোথায় যায়? অত জানার কী আছে বাপু! সবাই ভাসে এই হচ্ছে কথা।
না, সবাই ভাসে না। শাম্ব তো ভাসেনি। অন্তত চেষ্টা করেছে খানিকটা নিজের মতো থাকতে। কোনোভাবেই তেরো বছর ধরে পড়ে আসার ইশকুলটাকে বদলায়নি। মায়ের কাছে গান শেখাটা ছাড়েনি। গল্পের বই পড়া ছাড়তে পারেনি। মোবাইলে গেম খেলাটাও ছাড়তে পারেনি। অবশ্য তার ফল হয়েছে উলটো। সময়ের এত কড়া বাঁধনে প্রথম প্রথমে ঠিক থাকতে পারেনি। পরের দিকে আরও পারেনি। ক্রমশ পিছিয়েছে।
পিছিয়েছে কি? কেউ কি পিছোয়? কোত্থেকে পিছোয়? কার সাপেক্ষে? এত বড়ো জীবনের নিরিখে কারও সাপেক্ষে এগোনো-পিছোনোর কি আদৌ কোনও মূল্য আছে?
অতসব কেউ ভাবে না। ভাবার সময় কোথায়? গতে না পড়লেই ব্যস, উলটো কথায় জেরবার। আমাদের শাম্ববাবুরও খানিকটা সেই অবস্থাই হয়েছিল। সেই গপ্পোটাই এবার বলি।
তিন
আর পাঁচজন সাধারণ ঘরের ছেলের মতোই শাম্বর জীবন। তবে একটা ব্যাপার সে বেশ বুঝতে পারত, তার বাবা আর সবার মতো নন। কম কথার মানুষ। যাকে বলে টপ টু বটম পাংচুয়াল। পান থেকে চুন খসলেই মুখ ভার হয়ে যায়। মুখে কিছু বলেন না তখন, তবে বোঝা যায়। বাবাকে সবাই বেশ মানেন। আত্মীয়স্বজন, পাড়ার লোক— সবখানে বেশ একটা আলাদা স্থান। রোববার বাড়িতে চেম্বার করেন। প্রচুর ভিড়! যে পারে ফিজ দেয়, যে পারে না দেয় না। ওই একদিন বাবার চ্যারিটির জন্য বরাদ্দ। রবিবার সকাল দশটা থেকে দুপুর একটার মধ্যে পঞ্চাশ জন পেশেন্ট। ওর বাইরে একজন এলেও দেখবেন না। আগের দিন থেকে লোকজন নাম লেখায় বাড়ির পাশে নিতাইদার চা দোকানে।
বাবা যতক্ষণ বাড়িতে রুগী দেখেন, কানুকাকু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাবা প্রেসক্রিপশন করে ছেড়ে দেন, কানুকাকু সেটা নিয়ে রুগীদের বোঝান, যে যা ফিজ দেয় সেটা নেন। কানুকাকুর তখন আলাদাই মেজাজ!
অন্যদিনগুলো তো বাবার হাসপাতাল নয়তো চেম্বার থাকে বাইরে বাইরে। সকাল ন’টায় বেরোন, ফেরেন রাত ন’টার পরে।
ছোটবেলার কথা বেশ মনে আছে শাম্বর। বাবা তখন আর একটু আগে আসতেন। শাম্ব অমনি দৌড়ে যেত। বাবা হাসিমুখে তাকে কত কথা বলতে বলতে বাথরুমে ঢুকে যেতেন, গল্প করতে-করতেই সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ঘরের জামাকাপড় পরে বেরিয়ে এসেই ওকে কোলে তুলে নিয়ে কত যে গল্প বলতেন! আর শোয়ার সময় বই পড়ার অভ্যাস? সেও তো বাবারই তৈরি করে দেওয়া। বাবাই তো কোনও না কোনও গপ্পের বই নিয়ে শুয়ে শুয়ে শাম্বকে গল্প পড়ে শোনাতেন। কত যে ছবি থাকত সেই বইগুলোয়! একটা ছবি তো এখনও শাম্বর মনে আছে— চিনেবাদামের খোল থেকে কুল কুল করে বয়ে যাচ্ছে একটা নদী।
শাম্বর মা অধ্যাপিকা। মধ্য কলকাতার একটি কলেজে সোশিওলজি পড়ান। সোশিওলজির ওপর বেশ কয়েকটা বই আছে তাঁর লেখা। গান গাওয়া, বই পড়া, ডাকটিকিট জমানো, উল বোনা— মায়ের অনেকরকম হবি। মাও দারুণ গল্প শোনান। শাম্বর নামটিও তো মায়েরই দেওয়া। শাম্বর বাবা ড. কৃষ্ণপ্রসন্ন চ্যাটার্জী, আর মা হলেন প্রফেসর রোহিণী চ্যাটার্জী। মা তাঁকে বলতেন শ্রীকৃষ্ণের ছেলেবেলার গল্প; দাদু-ঠাম্মা বলতেন দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণের প্রাগজ্যোতিষপুরের কাহিনি— নরকরাজকে হারানোর বীরগাথা, স্যমন্তক মণির গল্প। জাম্ববনের কন্যা জাম্ববতী, দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণের দ্বিতীয়া পত্নী, তাঁর তনয় শাম্ব। বীর শাম্ব। বাঁধনছাড়া শাম্ব। পিতার গৌরবে গৌরাবান্বিত, কখনো-বা বিভ্রান্ত শাম্ব। পিতার আদরের শাম্ব। পিতা নিজের হাতে তাঁকে অস্ত্রশিক্ষা দান করেন, ব্রহ্মজ্ঞানের পাঠ দেন, নীতিশিক্ষা দেন।
অথচ সেই প্রাণের ধন শাম্ব কীভাবে পিতার অভিশাপপ্রাপ্ত হলেন সে-কথা বুঝতে পারত না আমাদের শাম্ব চ্যাটার্জী। দাদু-ঠাম্মাকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর মিলত না; বড়ো হলে বুঝতে পারবে গোছের আশ্বাস মিলত, বাবাকে জিজ্ঞেস করলে বাবা জানেন না বলে চলে যেতেন।
শাম্ব চ্যাটার্জী অনায়াসে তাদের তিন কামরার ফ্ল্যাটটাকে বিশ্বকর্মার নিজের হাতে গড়া শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরী কল্পনা করে খেলে বেড়াত। মাসতুতো বোনটা এলে তাকে প্রদ্যুম্ন মনে করে খেলা চলত সারাদিন। ব্যালকনিতে প্লাস্টিকের গদা, আর ছাতার লাঠি নিয়ে প্রায়ই শিশুপালের আক্রমণ থেকে রক্ষা করত দ্বারকা নগরীকে। ব্যালকনির গ্রিলের দু-দিকে দুই পা ঝুলিয়ে বায়ুবেগে ছুটিয়ে দিত অশ্ব; শত্রুদলের মধ্যখানে পড়ে সে কী লড়াই, সে কী যুদ্ধ! কখনও মা, কখনও ঠাম্মা দৌড়ে আসতেন দেখতে।
এক-একদিন রাতে মার কাছে শুয়ে গল্প শুনতে শুনতে শাম্ব জিজ্ঞেস করত, “মা, বাবাও কি রেগে গেলে আমাকে অভিশাপ দেবে?”
মা বলতেন, “তা কি হয়? বাবারা কি সন্তানকে অভিশাপ দিতে পারেন? শাম্বর বাবা শ্রীকৃষ্ণও কি শাম্বকে শাপ দিয়েছিলেন? শাম্বর আচরণ একসময় খারাপ হয়ে যাওয়ায় ভবিতব্য দেখে পিতার মুখ থেকে অমন কথা বেরিয়ে গিয়েছিল। কক্ষনো অভিশাপ নয়।”
মা যা-ই বলুন, শাম্বর কিন্তু বাবা সম্পর্কে এই একটা ভয় ছিল। পান থেকে চুন খসলে বাবা যেমন গোমড়া হয়ে যান, কী জানি বাবা কোন দিন আবার তার আচরণে রেগে গিয়ে কী বলে বসবেন আর ব্যস, সেই পৌরাণিক শাম্বর মতো আমাদের শাম্ব চ্যাটার্জীকেও ঘুরে বেড়াতে হবে চন্দ্রভাগার তীরে!
বাবাকে তাই খুব বেশি অসন্তুষ্ট হতেই দিত না শাম্ব। নীচে বাবার গাড়ির শব্দ পেলেই রাতদিন সাতদিনই তড়াক করে উঠে বইপত্র খুলে বসে যেত পড়াশুনোয়। বাবা যখন ঘরে ঢুকে পাঠরত শাম্বর মাথায় হাত বুলিয়ে হাসিমুখে চলে যেতেন নিজের ঘরে, শাম্বর মনে কত কী যে মনে হত! বাবাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই যেন জগতের সব কাজ করা হয়ে গেছে মনে হত ছেলেটার।
বাবার সঙ্গে খেলাও জমত দারুণ! শাম্বর বেশ মনে আছে ছোটবেলায় ড্রইং-রুমে প্লাস্টিকের বল-ব্যাট নিয়ে ক্রিকেট খেলার কথা, ছাদে ফুটবল খেলার কথা, হাজার কিসিমের পুতুল নিয়ে, গাড়ি নিয়ে খেলার কথা। করোনা যখন মহামারীর আকার নিয়েছে তখন তো বাবাকে প্রায় টানা চারদিন হাসপাতালে থাকতে হত, তারপর বাড়িতে তিনদিন ছুটি। ওই তিনদিনই সন্ধেবেলা বাবার সঙ্গে খেলা। লুডো-দাবা ছাড়াও মনোপলি, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, গেম অফ লাইফ— আরও অনেক বোর্ড গেম আছে শাম্বর। রোজ সে-সব খেলা জমত। কোনোদিন দাদুও জুড়ে যেতেন খেলায়। মা মুড়ি-চানাচুর সরষের তেল দিয়ে মেখে কড়াইয়ে গরম করে দিতেন, রাবেয়াদি চা দিয়ে যেত। সন্ধেবেলাটা পুরো জমে যেত।
বাবা আর মায়ের সঙ্গে কত ছবি দেখতে গেছে শাম্ব! ছবি দেখতে যাওয়া মানেই লার্জ পপকর্ন আর কোল্ড ড্রিংক। ছবি দেখতে গেছে, থিয়েটার দেখতে গেছে, সার্কাস দেখতে গেছে; বেড়াতে যাওয়ার কথা তো ছেড়েই দিলাম। সে তো সবাই-ই যায়। শাম্ব চায়নি বলে পড়াশুনো ছাড়া আর কিছু শিখতে বাইরে কোথাও ভরতিও করাননি বাবা। না ড্রইং, না গান, না আবৃত্তি, না ক্রিকেট-ফুটবল— কিচ্ছুতে না। মার কাছে গান শিখেছে, দাদু-ঠাম্মার কাছে গল্প শুনেছে, খেলেছে। পড়তে ভালোবাসে বলে বই কিনে দিয়েছেন অসংখ্য। শাম্বর সঙ্গে মিলে ইউটিউব চ্যানেলে ছোটোদের গল্পও পড়েছেন বাবা। কিন্তু সে সবই ছোটবেলায়। নাইনে ওঠার পর থেকেই ছবি ঘুরে গেছে।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুখে কোনোদিনই বাবা-মা কোনও চাপ দেননি। কিন্তু বোঝা তো যায়! বাবা-মা কী চান, সে-কথা বুঝতে পারবে না এতটা বোকা ছেলে তো শাম্ব নয়।
চার
শাম্বর বোর্ডের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আগাগোড়া স্কুল টপার আশানুরূপভাবেই চোখ ধাঁধানো ফল করেছে। সম্ভবত একটা স্টেট র্যাংকও করেছে। এসব নিয়ে কোনোদিনই মাত্রাতিরিক্ত মাতামাতি শাম্বদের বাড়িতে হয় না, এবারেও হয়নি। বেশ কিছু উপহার পেয়েছে অবশ্য শাম্ব আত্মীয়পরিজনদের কাছ থেকে।
শাম্বর বেজায় আনন্দ হয়েছে বলাই বাহুল্য। শুধু আনন্দই-বা বলি কেমন করে! বেশ একটা উদ্যম অনুভব করছে শাম্ব। স্কুলের স্যার-ম্যামরা প্রশংসা করছেন, পাড়ার লোক প্রশংসা করছে, আত্মীয়স্বজনের তো কথাই নেই! পাড়ার ক্লাব, ওয়ার্ড কর্তৃপক্ষ, পৌরসভা, সামাজিক সংগঠন তো বটেই, দু-দুটো প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আর খবরের কাগজ, টেলিভিশন চ্যানেলও সংবর্ধনা দিতে ডাকছে। হোয়াটস-অ্যাপ মেসেজ আসছে বিভিন্ন স্কুল থেকে— কোথাও পড়লে ফিফটি পার্সেন্ট ছাড় তো কোথাও পুরোটাই ফ্রি! সে নিজেও যে বেশ একজন, তারও যে বড়ো ধরনের প্রশংসা প্রাপ্য, এ কথাগুলো শাম্বর খুব ভালো লাগছে। আর এইখানেই সমস্যা। বাবা একটি জায়গাতেও যেতে দিতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, এসব নাকি পরেও পাওয়া যাবে, এখন এই সংবর্ধনা নিতে গেলে নাকি শাম্বর যেমন সময় নষ্ট হবে তেমনি মনে অন্যরকম একটা ভাব তৈরি হতে পারে যা আখেরে ওর ক্ষতিই করবে।
আগেই বলেছি, বাবার অমতে চলতে শাম্ব এখনও ভয় পায়। ওদিকে বন্ধুরাও নানান অনুষ্ঠানে যাচ্ছে, কাজেই যেতে তো শাম্বরও ইচ্ছে হচ্ছে। মা অবশ্য বলছেন, এইগুলো তো ছেলেটার প্রাপ্য, কিন্তু বাবা মানতে নারাজ। বার বার বলায় শেষমেশ রাজি হয়েছেন বটে, তবে শাম্বকে ডেকে বলে দিয়েছেন সে যেন এইসব সংবর্ধনা পেয়ে ভুলে না যায়। সবে ক্লাস টেন পাশ হয়েছে। সামনে অনেক পথ, ক্লাস টেনের তুলনায় অনেক বড়ো পরিধি। এখানে ভালো করতে পারলে ভবিষ্যতে কী করা যাবে তার পথ নির্ধারণ করা যায়।
এই পথ নিয়েই খানিক বিভ্রান্ত শাম্ব। অনেকদিন পর্যন্ত ঠিক কী নিয়ে পড়বে বুঝে উঠতে পারছিল না। শেষমেশ বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলে আর কেরিয়ার কাউন্সেলরের উপদেশ মেনে সায়েন্স নিয়েই ভরতি হয়েছে। এই উপদেশটা মেনে নিয়েছে ঠিকই, তবে স্কুল আর বোর্ড বদলানোর উপদেশ মানতে পারেনি। এতগুলো বছর যে-স্কুলে রয়েছে, খানিক সুবিধার জন্য তাকে ছেড়ে যেতে মন চায়নি। বাড়ি থেকেও অমত করেননি বাবা-মা।
সায়েন্স নিয়ে ভরতি হওয়ায় পছন্দের একটা বিষয় আর পড়া হচ্ছে না। ইতিহাস। ইতিহাস পড়তে খুব ভালোবাসত শাম্ব। পড়তে পড়তে যেন ঘটনাগুলো চোখের সামনে দেখতে পেত। যাই হোক, ইতিহাস বাদ গেলেও আর সব পছন্দের বিষয়গুলো তো নিতে পেরেছে।
কম্পিটিটিভ এক্সামের জন্য কোনও ইন্সটিটিউটে শাম্বকে ভরতি করাতে চাননি ওর বাবা-মা। অকারণ চাপ পড়বে ছেলেটার ওপর, এমনটাই ভেবেছেন ওরা। বরং প্রাইভেট টিউশন নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শাম্বর বন্ধুরা কেউ কেউ ক্লাস সেভেন থেকে, কেউ-বা ক্লাস নাইন থেকে প্রস্তুতি নিত। শাম্বকে দেওয়া হয়নি। এমনকি এইসব ইন্সটিটিউটে ভরতির জন্য যেসব স্কলারশিপ পাওয়ার পরীক্ষা হয়, তাতেও শাম্বকে বসানো হয়নি কখনও। শাম্বর দাদু একটা কথা বলতেন, ‘হাউশে বিদ্যা, কৃপণে ধন। আনন্দে বিদ্যালাভ হয় আর কৃপণের ধনলাভ হয়।’ পড়াশুনোর আনন্দটুকু যাতে বদ্ধ না হয়ে যায় সেই চেষ্টাটা ওর বাবা-মা খুব করতেন।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। অল রোডস লিড টু রোম। আর এখন তো রোমের নাম ইন্সটিটিউট। নামজাদা সব ইন্সটিটিউটের লোভনীয় সব ফোন-কল আলগোছে এড়িয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত সেখানেই যাওয়া হল শাম্বর। ব্যাপারটা আকস্মিকই। শাম্বর এক মামাদাদুর বাড়িতে যাওয়া হয়েছিল। তিনি নিজে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। সুঠাম চেহারা, সৌম্যকান্তি বলতে যা বোঝায় তিনি এক্কেবারে তাই-ই। সাতষট্টি বছর বয়স। বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরের চেম্বারে এখনও নিয়মিত যাতায়াত করেন। খুব মজার মানুষ। শাম্বকে খুব ভালোবাসেন। শাম্বরও খুব ভালো লাগে দাদুকে। দাদুর চিকিৎসার ধরনটাই আলাদা। গল্প করতে করতে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কখন আর কীভাবে যে সব বুঝে নেন আর এক্কেবারে অব্যর্থ একটা ওষুধ দিয়ে দেন, সে এক আশ্চর্যের বিষয়। সেদিন বিকেলে নানান কথা চলতে চলতে তিনি শাম্বর মনের ইচ্ছেটার খানিকটা আঁচ পেয়েই বললেন যে তাঁর চেম্বারের কাছে একটা ইন্সটিটিউট আছে; মেদিনীপুর, বীরভূম থেকেও ছেলেমেয়েরা সেখানে এসে ক্লাস করে যায়, একবার ঘুরে তো আসাই যায়। শুধু বললেনই না, নিজে সঙ্গে করে নিয়েও গেলেন ওদের। ওঁর কথায় তো আর না করা যায় না!
আর সেখানেই হল সেই মিরাকল। বাবা-মা মোটামুটি ঠিকই করে রেখেছিলেন, চড়া কোর্স ফি অথবা বাড়ি থেকে প্রায় সওয়া ঘণ্টা জার্নি, এসব অজুহাত দিয়েই ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নেবেন। কিন্তু তা আর হল কোথায়!
ঝাঁ চকচকে ইন্সটিটিউট। চারতলা। বাইরে উর্দিপরা ইংরিজি বলা সিকিউরিটি। ফার্স্ট ফ্লোরে অফিস। অফিসের ক্যাশ কাউন্টারে লম্বা কিউ। সবাই ছেলেমেয়েদের ভরতি করাচ্ছেন। ইনস্ট্যান্ট স্টাডি লোন দেওয়ার কিয়স্কেও লম্বা কিউ। সুবেশা স্টাফ শাম্বর সঙ্গে কথা বললেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বললেন। তারপর শাম্বর রেজাল্টের সফট কপি নিয়ে বললেন, “দিন কয়েক বাদে আপনাদের ফোন করে জানাব স্যার। ওর রেজাল্টটা তো খুব ভালো! আমাদের একটা সার্কুলার আসার কথা আছে এমন রেজাল্টের ছেলেমেয়েদের আলাদা একটা স্কলারশিপের জন্য।”
কোর্স ফিজ জিজ্ঞাসা করেছিলেন শাম্বর বাবা। জানা গেল দু-বছরের কোর্স ফিজ প্রায় চার লাখ কুড়ি হাজার টাকা।
ওঁরা তো বাড়ি চলেই এসেছিলেন। এত টিউশন ফিজ দিয়ে নিজের আর ছেলের চাপ বাড়ানোর পক্ষপাতী ওঁরা নন। শাম্বর বাবা নিজে কোন ইন্সটিটিউটে পড়েছেন? তাছাড়া ওদের তরফেও আর ফোন আসেনি, শাম্বদেরও কিছু মনে নেই। কিন্তু পঞ্চম দিনে শাম্বর বাবার কাছে ফোন এল। শাম্বর টিউশান ফিজ পুরোপুরি ওয়েভ করা হবে, কেবল রিফান্ডেবল একটা কশন মানি লাগবে, মাত্র পাঁচ হাজার টাকা।
এইবার তো বিভ্রান্তি হবেই। ছেলে চাইছে ভবিষ্যতে বাবার মতো ডাক্তার হতে। ডাক্তার হতে গেলে এখনকার রীতি মেনে ইন্সটিটিউটের কোচিং মাস্ট। ওঁরা তো নিজেরাই দেখে এলেন পড়ানোর জন্য গার্জিয়ানরা লোন পর্যন্ত নিচ্ছেন! শনি-রবিবার হোটেলে থেকে পড়িয়ে ফিরে যাচ্ছেন দেড়শো দু-শো কিলোমিটার দূরের জেলায়। আর সেখানে নামমাত্র খরচে বাড়ি থেকে এইটুকু দূরত্বে ছেলেটাকে তৈরি হতে দেওয়ার সুযোগ হারানো কি ঠিক হবে? আর তাছাড়া এই সুযোগটা যখন ছেলেটা নিজের যোগ্যতায় অর্জন করেছে, সেটা কি অবজ্ঞা করা ঠিক?
সুতরাং আবার আলোচনা চলল। আর আলোচনার ফলশ্রুতিতে শাম্ব চ্যাটার্জী ভরতি হয়ে গেল মেডিক্যাল এন্ট্রান্সের বলা যায় প্রিমিয়ার ইন্সটিটিউটে।
পাঁচ
জলার ধারে সেই যে হুড়মুড় করে নেমে এসেছিল শাম্ব, মনে আছে? তারপর কী হয়েছিল জানো?
কী ভেবে যে শাম্ব নেমে এসেছিল কে জানে। যদি-বা কেউ জানেও, সে-সব তোমাদের বলবে বলে মনে হয় না। দরকারই-বা কী? তার চেয়ে ঘটনাক্রমে মন দিই চলো।
শাম্ব তো অমন করে ঢালু দিয়ে জলের দিকে নেমে গেল। নামতে-নামতেই সে বেশ বুঝতে পারল তার ঠিক একহাতের মধ্যেই বড়ো বড়ো ঘাস আর কলমির বনে রীতিমতো আলোড়ন তুলে সড়সড় করে কী যেন একটা তার সহযাত্রী হয়ে নেমে যাচ্ছে। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল শাম্বর। প্রাণীটার মোটা লেজটা এক ঝলক দেখতে পেয়েছে সে কলমি ঝোঁপের ফাঁক দিয়ে। কীসব ভেবে নাকি কিছুই না ভেবে সেই যে জলে নামছিল, সে-সব ভাবনা-চিন্তা তখন সটান মাথায় উঠেছে ওই ন্যাজের ডগা দেখেই। ঘরে মথ উড়লে, চ্যাল্লা, ইঁদুর, টিকটিকি দৌড়লেই যে বীরপুরুষ দ্বিগুণ বেগে যাকে পরিষ্কার বাংলায় বলে জগঝম্প তাই শুরু করে, সে যে এই ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে ইয়া মোটা এক কুচকুচে সাপের চলন্ত ন্যাজ দেখে নিজ লক্ষ্যে স্থির থাকবে, সে-কথা যারা গপ্পের গোরু গাছে তুলে দিতে ভালোবাসে তারা ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করবে না।
কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে ঢালু জায়গায় নামছে বলে চাইলেও থামতে পারছে না শাম্ব। অথচ রিফ্লেক্স অ্যাকশন তো তাকে বিপরীতমুখী করতে চাইছে। সে এক চরম বায়োফিজিক্যাল টানাটানি। শেষমেশ সে যে কী অদ্ভুত কায়দায় ঢালুতে নামতে-নামতেই শাম্ব কেবলমাত্র বাঁ পায়ের গোড়ালি আর ডান পায়ের আঙুলের চাপের তারতম্যে ভর করে শূন্যে নিজের দেহটাকে জাস্ট অপোজিট ডিরেকশনে ঘুরিয়ে ফেলল, তা নিয়ে জবরদস্ত একটা ফিজিক্সের অঙ্ক হতে পারে।
কিন্তু মুশকিলটা সেই ফিজিক্সই বাধাল। অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ ১৮০ ডিগ্রি তো ঘুরল ওর দেহ, কিন্তু জাড্য তো সেই জলের পানেই! কাজেই যেই না মাটিতে পা পড়ল, অমনি জাড্যের টানে শাম্বর কোমর থেকে দুটো পা পিছন দিকেই হড়বড়িয়ে খানিক নেমে যেতে গেল আর ওপরের শরীরটা যেতে চাইল সামনের দিকে। ফল যা হওয়ার তাই— একেবারে পা পিছলে আলুর দম। তারপর কাদা ভেজা ঢালু পথে একেবারে সুড়ুৎ করে স্লিপ করে উলটো পথে সরোবরের জলে।
এ সরোবর তো আর স্বর্গের সরোবর নয়! হাইরোডের পাশের বিল। তার পাড়ের কাছে গুঁড়িপানা, ইট, টায়ার, কাচ আর প্লাস্টিকের বোতলে বোঝাই। কাজেই কলমির ঝোপ দলে-মলে বিপরীত চলনে শাম্ব জলে ঝপাত হল বটে, কিন্তু জলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তার নাক-মুখে জল আর গুঁড়িপানাও একেবারে হু হু করে ঢুকে পড়ল। মাথাটা ঠক করে লাগল শক্ত কী একটায়। একে তো জলে ডোবা অভ্যেস নেই ছেলেটার, এতটা বড়ো হয়েছে বটে তবে আজ অবধি পুকুরে একটাও ডুব পাড়েনি। নিয়ম করে দিঘা-পুরী যাওয়া হলেও বাবার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে জলে নামা হয়ে ওঠেনি। বাবার মতে সাগরের জলে এখন তুমুল দূষণ, পুরীর জলে নাকি জেলিফিস আর দিঘায় জনগণ এত খারাপভাবে জল নোংরা করে যে তাতে নাকি নামা মানে রোগ ডেকে আনা। ফলে মা আর শাম্বকে সাগরের পাড়ে বসে জোলো হাওয়া খেয়েই শান্ত থাকতে হত।
সেই শাম্ব এমন হুড়মুড়িয়ে চিৎ হয়ে জলে সেঁধোলে তো রিফ্লেক্সের ঠেলায় হাঁকুপাকু করবেই। ফলস্বরূপ খানিক কাদাজল পেটে ঢুকবেই। আর নানা জোলো গুল্মর শিকড়-টিকড় মেশা সে-জলের স্বাদও যে তথৈবচ হবে সে-কথা বলাই বাহুল্য! অবশ্য শ্বাস আটকালে কি আর স্বাদের বোধশোধ থাকে? থাকে না তো! মানুষ তো যে করেই হোক হাওয়ায় নাক-মুখ ভাসিয়ে শ্বাস নিতে চাইবে। শাম্বও তাই করেছে। জলে পড়েই কোনোরকমে পালটি খেয়েই মাথা তুলেছে। মাথায় গুঁড়িপানা আর শ্যাওলার মুকুট, বেদম কাশছে। পরনের সবকিছু একেবারে জলে-কাদায় মাখামাখি।
উপরে উঠে আসতে গিয়ে আরও বার দুই পিছলাল শাম্ব। তারপর চারদিক দেখে নিয়ে একেবারে আদিম মানুষের কায়দায় চার হাতে পায়ে ভর করে কোনোমতে উঠে এল উপরে। পিঠ থেকে পানা আর শ্যাওলায় মাখামাখি ব্যাগখানা ঘাসের উপর ফেলে কাশতে কাশতে, হাঁপাতে হাঁপাতে চশমাটা চোখ থেকে খুলে নিয়ে চারপাশ দেখতে থাকল।
চশমাতেও পানা লেগে আছে। রুমালটাও ভিজে গেছে। পকেট থেকে বের করে ঘাসের উপর মেলে দিল। চশমা ছাড়া দূরের সেই ডিঙিতে বসা মাছ শিকারিকে আরও ঝাপসা লাগছে। তবে বাঁচোয়া সেই পাবলিক ছাড়া আর কেউ আশেপাশে নেই, থাকলে লজ্জার আর শেষ থাকত না শাম্বর।
তবে সবরকম পতনের পরে একটা উত্থানের গপ্পো থাকে। শিশু যতবার পড়ে, ততবার উঠে দাঁড়ানোর টেকনিক খানিকটা করে শেখে। শাম্বরও নিশ্চয়ই একটা উত্থানপর্ব থাকবে এর পরে। আপাতত তো দেখা যাচ্ছে যে নির্লিপ্ত নাকি বিভ্রান্ত দৃষ্টি আর মনোভাব শাম্বর মধ্যে দেখা যাচ্ছিল, সেটা বদলে গিয়ে ব্যাগের ভিতরের বইপত্র আর নিজের জামা-প্যান্ট শুকোনোর ব্যস্ততা উঁকি দিচ্ছে। ভাসা ভাসা দৃষ্টি বদলে গিয়ে শাম্ব চ্যাটার্জীর চোখে এখন সেই দু-বছর আগের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টির ঝলক। এটাও যে একটা উত্থান বই কিছু নয়, সেটা বুঝতে গেলেও শাম্বর এই ছোট্ট জীবনের ফেলে আসা পথে একটু পায়চারি করে আসতে হবে।
সে না-হয় খানিক পরে ঘুরে আসা যাবে, আপাতত তো আমাদের চেনাজানা শাম্বর দিকে চোখ রাখি! রোদ ঝলমলে দিন বলে জামাকাপড় শুকিয়ে গেছে শাম্বর। কিন্তু বইগুলো এখনও শুকোয়নি। আচ্ছা, কী বই ওগুলো, যেগুলো নিয়ে ছেলেটা পাতার পর পাতা একবার রুমাল দিয়ে তো একবার জামা দিয়ে মুছছে! এমন মারকাটারি রেজাল্টের ছেলে শাম্ব, নিশ্চয়ই গাবদা ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি এইসব কিছু হবে। না-হলে ইন্সটিটিউটের স্টাডি মেটেরিয়াল— হ্যাঁ, তাও তো হতে পারে। কিন্তু অমন ঝকঝকে মলাট! অবশ্য আজকাল স্টাডি মেটেরিয়ালের প্রচ্ছদও অমন ঝকঝকেই হয়। তবে কিনা বইয়ের সাইজ দেখে স্টাডি মেটেরিয়াল মনে হচ্ছে না। চলো, আর একটু নজর দিয়ে দেখি।
দিনকাল এমন পড়েছে যে চোখে দেখলেও হবে না, খতিয়ে না দেখে কোনোকিছু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জো নেই। ভাবো একবার, শাম্ব চ্যাটার্জী ব্যাগ ভরতি করে এইসব বই নিয়ে এই জনমনিষ্যিহীন ভুঁইয়ে এসে উঠেছে! এ তো ভাবাই যায় না! এইসব কেন বললাম তার লিস্ট দিচ্ছি, তাহলেই সবাই বুঝতে পারবে।
১) ব্যাড গাইজ পার্ট সিক্সটিন অ্যান্ড সেভেনটিন
২) চার্লি অ্যান্ড দ্য চকলেট ফ্যাক্টরি
৩) চার্লি অ্যান্ড দ্য গ্রেট গ্লাস এলিভেটর
৪) হ্যারিপটার - ডেথলি হ্যালোস
৫) আন্তন চেকভ - সিলেক্টেড শর্ট স্টোরিজ
৬) হান্ড্রেড গ্রেটেস্ট শর্ট স্টোরিজ
৭) দ্য অ্যানার্কি - উইলিয়াম ডালরিম্পল
৮) একটা ডায়েরি
৯) একটা নোটবুক
নো ফিজিক্স, নো কেমিস্ট্রি, নো বায়োলজি, নো ম্যাথামেটিক্স; ব্যাগ-ভরতি কেবল গপ্পের বই— ফিকশন অ্যান্ড ননফিকশন!
অবশ্য গল্পের বই বললে কম বলা হবে। এগুলো শাম্বর ভালোলাগা বইগুলোর একটা একটা। ছোট্টবেলা থেকে রোয়াল্ড ডাল শাম্বর ফেভারিট। অমন করে গল্প বলতে কে পারেন আর! ব্যাড গাইজ-এর প্রত্যেকটা পার্ট এক-একবার রেজাল্ট বেরোনোর পর বাবার কাছ থেকে আদায় করা। গোটা হ্যারি পটার সিরিজটা, তারপরে ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস— জে.কে. রাউলিংয়ের সব বইগুলো শাম্বর প্রাণ। আর উইলিয়াম ডালরিম্পলের ইতিহাসের কথা বলার যে ধরন, তার রীতিমতো ভক্ত শাম্ব। চেকভের গল্পের ভক্ত হয়ে পড়েছে হানড্রেড গ্রেটেস্ট শর্ট স্টোরিজ নামের সংকলনটা থেকে।
মানে কী দাঁড়াল? মানে দাঁড়াল এই, ছেলেটা নিজের সবচেয়ে পছন্দের জিনিসগুলোর একটা দুটো প্রতিভূ নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে। ব্যাগ ভারী করে এতসব বয়ে এরকম পাণ্ডববর্জিত জায়গায় নেমে পড়ার কারণটা কী? এইদিকে তো ওর কোনও আত্মীয়স্বজনের বাড়িও নেই! আর তাছাড়া দাদুর বাড়ি আর মাসির বাড়ি ছাড়া কোন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি গেছে ও? তাও আবার একা!
ব্যাপারটা মোটেই সুবিধার ঠেকছে না তো?
কী মনে হচ্ছে, শাম্ব চ্যাটার্জী পালাচ্ছে? কোত্থেকে? বাড়ি থেকে? কিন্তু কেন? অমন আদুরে ছেলে, অত যত্নআত্তি, পালাবে কেন? আর তাছাড়া এমন জনমানবহীন জায়গায় অমন নির্লিপ্ত দৃষ্টি নিয়ে হুড়মুড় করে জলে নেমে যাচ্ছিল কেন?
অনেক ‘কেন’। আমাদেরও যেমন শাম্বরও তেমন।
মা-ঠাকুমা খেতে দেওয়ার সময়ও তো আগে বাচ্চাদের পাত পেড়ে দেন, তাই না? কাজেই চলো, আমরাও আমাদের কেনগুলোর উত্তর খোঁজার আগে শাম্ব চ্যাটার্জীর কেনগুলোর উত্তর খুঁজি গে’।
ছয়
ফার্স্ট বয় শাম্ব। নার্সারি থেকে টানা এগারো বছর প্রায়। সেকেন্ড পজিশনের সঙ্গে নয় নয় করেও অন্তত পঞ্চাশ-ষাট নম্বরের ফারাক তো থাকেই। জল পড়া পাতা নড়ার মতো সে ছিল ওদের ক্লাসের স্বাভাবিক ব্যাপার।
ইলেভেনে এসে নানান স্কুল থেকে আরও সব ছেলেমেয়েরা এল। অম্বরীশ তাদের একজন। এই সেই ছেলে যে কিনা শাম্বকে খানিক, খানিক কেন, বেশ ভালোরকমের বেগ দিল। ক্লাস রেসপন্স তো দুর্দান্ত! শাম্ব তো এমনিতেই কেউ জিজ্ঞেস না করলে কিছু বলে না, প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও যতক্ষণ না ওর কাছে জানতে চাওয়া হয় কিছু বলে না। সেখানে অম্বরীশ ঠিক উলটো। যাকেই জিজ্ঞাসা করা হোক, সবার আগে ও-ই উত্তর দিয়ে দেয়। ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই ভালো ছেলে হিসেবে বেশ নাম ছড়িয়ে পড়ল অম্বরীশের। স্যাররাও ক্লাসে এসে খোঁজ নিতে শুরু করলেন অম্বরীশ এসেছে কি না। অবশ্য এসবে শাম্বর কিছু মনে হত না। বন্ধুরা মাঝে মাঝে এসে বলে যেত, ‘ভাই, সাবধান!’ শুনে শাম্ব হাসত।
ইলেভেনের হাফ ইয়ার্লিতে শাম্বর থেকে মাত্র সাত নম্বর পিছিয়ে থাকল অম্বরীশ। তারও মধ্যে ইংরেজিতেই পনেরো। তার মানে সায়েন্স সাবজেক্টে অম্বরীশ শাম্বর চেয়ে আট নম্বর এগিয়ে।
এইবার শুরু হল অন্যরকম সব ঘটনা। স্যারদের রেসপন্স বদলে গেল। কথায় কথায় শাম্বকে ঠেস দেওয়া শুরু হল। নাম ধরে ডাকার বদলে ফিজিক্স-স্যার তো ডাকতে শুরু করলেন বিজ্ঞানী বলে। বাছাই বাছাই প্রশ্ন ধেয়ে এল ফিজিক্স ক্লাসে। না পারলেই সেকেন্ডারির রেজাল্ট সংক্রান্ত বিষয় তুলে কথা শোনানো চলল। পারলেও জ্বালা কম নয়। মুখ-চোখের বিকৃতি তো আছেই, পাশাপাশি আবার ‘সায়েন্টিস্ট স্যার স্পিকস নাথিং বাট নোজ এভরিথিং’ গোত্রের ঠেস দেওয়া কথা। বন্ধুরা কেউ কেউ ওর দিকে তাকিয়ে দেখত, কেউ কেউ হাসত। ম্যাথসের ক্লাসেও প্রায় একই ধরনের ব্যাপার-স্যাপার। বরং আর এক কাঠি এগিয়ে। কোনও একটা অঙ্ক না পারলেই যেন স্যার খুশি হতেন মনে হত শাম্বর। আসলে ম্যাথস-স্যার শাম্বকে উপদেশ দিতেন হিউম্যানিটিসে যাওয়ার। শাম্ব ইতিহাস ভালোবাসে, ইন্টার স্কুল এসে কম্পিটিশনে ইংলিশ সাবজেক্টে স্কুলকে রিপ্রেজেন্ট করে, আবৃত্তি করে, গল্প লেখে— কাজেই স্যারের মতে ও হিউম্যানিটিজের ছাত্র। কিন্তু বায়োলজি-ম্যাম, বাংলা-ম্যাম এঁরা সবাই এর ঘোর বিপক্ষে ছিলেন। কেউ ক্রিয়েটিভ হওয়া মানেই যে সে হিউম্যানিটিজের, এরকম দেগে দেওয়া ঠিক নয় বলেই তাঁরা বোঝাতেন শাম্বকে। সেজন্যই হয়তো স্যার কিছু বলতেন না, কিন্তু অম্বরীশ আসার পর থেকেই অকারণ একটা তুলনা টানা চলেছে দুজনের মধ্যে। আরও অস্বস্তিকর ছিল সহপাঠীদের হাসি। তাদেরও কীই-বা করার ছিল! স্যাররা এমন-এমনভাবে কথা বলতেন, বলা ভালো বিদ্রুপ করতেন যে হাসি এসে যেত।
শাম্বর একটু অস্বস্তি হতে শুরু হয়েছিল। মাঝে মাঝে মনে হত যারা হাসছে স্যারের কথা শুনে তারা আদৌ উত্তর দিতে পারবে তো? মনে হত পরে ওদের কিছু কথা শুনিয়ে দেয়, কিন্তু পারত না। চুপ করে থাকত।
আচ্ছা, শাম্বর মনে কি একটু অহংকার তৈরি হয়েছিল? নাকি রাগ হচ্ছিল?
কিছু একটা তো চলছিল ওর মনের ভিতর, না-হলে একদিনও অ্যাবসেন্ট হতে চাইত না যে ছেলে সে এখন প্রায়ই স্কুল যেতে চাইবে না কেন? আর পাঁচটা ছেলের মতোই কেন যে-ক’দিন প্র্যাকটিকাল ক্লাস আছে, সেই দু-দিনই যেন বাধ্য হয়ে যেতে চাইবে, অন্যদিন স্কুলে যাওয়ার চাড়ই থাকবে না!
টিউশনেও যেন খানিকটা এফেক্ট পড়ছিল। বিশেষ করে ফিজিক্সে। পারফরম্যান্স পড়ে যাচ্ছে বলে ম্যাম প্রায়ই বলছিলেন। মাকেও একবার ফোন করে বলেছিলেন।
মাও দেখছিলেন শাম্বর এই পরিবর্তন। জিজ্ঞাসাও করতেন। শাম্ব হয় কিছু বলত না, না-হলে সব ঠিক আছে বলে মাকে জড়িয়ে ধরত। তখনকার মতো চুপ করে গেলেও মা ঠিক বুঝতে পারতেন শাম্বর বদলে যাওয়াটা। দেখতেন ছেলেটা এখন প্রায়ই অন্যমনস্ক থাকে। এমনকি পড়তে বসেও মাঝে-মাঝেই আনমনা হয়ে কী যেন ভাবে। পড়ার সময় কোনও আওয়াজ নেই, খাতায় কিছু লিখছে না, কেবল বইয়ের দিকে তাকিয়ে কখনও মন দিয়ে পড়ছে তো কখনও যেন জাস্ট ব্ল্যাংক তাকিয়ে আছে। মোবাইল ফোনের ব্যবহারও অনেকটাই বেড়েছে। পড়তে পড়তে মাঝে-মাঝেই হাতটা চলে যাচ্ছে মোবাইলে।
বাবাকে বলেছিলেন। উনি বললেন, এই সময় তো মনে নানারকম দ্বন্দ্ব চলে ওদের, খুব বেশি ঢুকে পড়া অথবা ক্রমাগত নির্দেশ দিয়ে যাওয়া একেবারেই ঠিক হবে না। তাও শাম্বর সঙ্গে খাওয়ার টেবিলে পড়ার বিষয়ে, অথবা অন্য কোনও বিষয়ে সমস্যা হচ্ছে কি না জিজ্ঞাসা করতেন। শাম্ব অবশ্য কোনও অভিযোগ করত না, সব ঠিক আছে বলে খাবার খেয়ে উঠে যেত। বাবা মাকে বলতেন, “ওর খাওয়াদাওয়ার দিকে নজর রেখো। এই সময় শরীরের চাহিদা বাড়ে কিন্তু।”
কিন্তু মনেরও যে চাহিদা বাড়ে সেটা কি ওঁরাও বুঝতেন? আমি কেমন করে বুঝলাম? আমার যে শাম্ব চ্যাটার্জীর মনের খানিকটা অংশে প্রবেশাধিকার আছে। তাই তো বলতে পারছি। ওঁরাও হয়তো বুঝতেন। কিন্তু কালেরও তো চাহিদা বলে একটা বিষয় আছে! তাকেই-বা অস্বীকার করেন কেমন করে?
শাম্ব বুঝতে পারে না ইদানীং কেন মাঝে-মাঝেই তার কিছুই ভালো লাগে না। কেন যেন ক্লান্ত লাগে। কেন যেন মাঝে মাঝে একটা ভয় হয়। কীসের ভয় শাম্ব বুঝতে পারে না, তবে হয়। আগে পড়াশুনো করেও শাম্ব কিছু না কিছু লিখত, এখন লিখে উঠতে পারে না। তলিয়ে ভেবে দেখেছে শাম্ব। মনে হয়েছে যেন টাইম ম্যানেজমেন্টটা ঠিক হচ্ছে না। বাবার সঙ্গে বসে দুজনে মিলে রুটিন বানিয়ে নিয়েছে, কিন্তু শাম্ব নিজেই বুঝছে সেই রুটিন মেনে চলা হচ্ছে না। সামান্য ক্লাস টেস্টেও এখন কেন যেন টেনশন হয় শাম্বর। মনে হয় মা যদি একটু পাশে বসে মাথাটায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে, বাবা যদি একবার পিঠে হাত রেখে বলত, ‘চিন্তা করিস না। যা করবি তাতেই আমি খুশি।’
স্কুলে স্যার-ম্যামরা কেউ যদি একটা বার মাথায় হাত রেখে বলতেন, ‘তুই যেমন পারবি তেমন করে যা। এক্কেবারে নিজের স্পিডে যতটা পারিস শিখে যা। আমি তো আছিই!’ তেমন বোধ হয় বলেননি, না-হলে কেমিস্ট্রি ল্যাবে পিপেট দিয়ে অক্সালিক আসিড টেনে কিছুতেই যখন আঙুলের কায়দায় পিপেটের দাগে আসিডের নিম্নতল নামিয়ে এনে থামতে পারছিল না, বার বার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, অনেকেই পেরে কাজ সেরে ঘিরে দাঁড়াচ্ছিল শাম্বর চারদিকে। ওরা যত এই কর ওই কর, আঙুল ঘোরা, আঙুল চাপ এইসব ইন্সট্রাকশন দিয়ে যাচ্ছিল, তত শাম্বর সব গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল। কেউ বোঝেনি, কিন্তু শাম্ব জানে ওর হাত কাঁপতে শুরু করে দিয়েছিল। সেজন্যেই তো পিপেটের খোঁচা লেগে কাচের বিকারটা নীচে পড়ে ভাঙল! সবাই হাসছে। কী লজ্জা! শাম্ব পারছে না। কী লজ্জা! সবার হয়ে গেছে শাম্বর হয়নি। কী লজ্জা! মুখে অ্যাসিড ঢোকার বাহানা করে বাইরে ছুটে গিয়ে চোখে-মুখে জল দিয়েছিল শাম্ব। কেমিস্ট্রির স্যার যদি একটা বার পিঠে হাত রেখে বলতেন, ‘এরকম হয়ই রে! নে আবার শুরু কর, ঠিক পারবি।’ যদি বলতেন, ‘সবাই এক স্পিডে শেখে না রে, এক স্পিডে যেমন সবাই দৌড়তেও পারে না। আমি তোদের কেমিস্ট্রি শেখাচ্ছি বটে, কিন্তু দৌড়তে গেলে দেখবি কতজন আমার সামনে দৌড়বে। জানিস আমি হোল্ডারে বাল্ব লাগাতে জানি না, জানিস আমি বার্নার জ্বালাতে ভয় পাই, তোদের জয়নারায়ণদা এসে ধরিয়ে দিয়ে যায়! তুই আজ পারছিস না কাজটা তো কী হয়েছে, কালকে ঠিক পারবি।’ কিন্তু সেসব তো হয়ইনি, বরং তার বদলে ওকে অফিসে যেতে হয়েছিল। বিকার ভাঙার ফাইন দিতে।
আচ্ছা, শাম্বর মনে কি এক্সপেক্টেশন আর রিয়েলিটির মধ্যে ফারাক তৈরি হচ্ছিল? কে ওর মনে এক্সপেক্টেশনের বীজ পুঁতল? ওর বাবা-মা তো কোনোদিন ওকে চাপ দেননি! এখনকার রেওয়াজ মেনে কোনোদিন এটা শেখো, সেটা শেখো, সব শেখো করে জোর করেননি! খোলা মনে শাম্বর সঙ্গে মিশছেন বলেই জেনেছেন।
অ্যাই! ওইখানেতেই গণ্ডগোলটি পকিয়েছে। বাবা-মা খোলা মনে মিশছেন বলে জেনেছেন! অর্থাৎ কিনা ভাবনার মাপকাঠিটি ধরা হয়েছে তাঁদের মনেই। শাম্বর মনের মাটিতে নেমে কিন্তু ভাবনাটা করা হল না তাতে। জোর করে তাঁরা ভাবাননি বটে, কিন্তু বাবা-মায়ের মতো হবার যে অদম্য চাহিদা সব ছেলেমেয়ের ভিতরে থাকে; বাবা-মার কাছে ভালো হয়ে ওঠার, ভালো হলে আরও ভালো হবার যে চাহিদা শাম্বর মতো ভালো ছেলেদের মনে থাকে তার কাছে নেমে এসে ভাবা কি হয়েছিল? যে-কোনো ভালো কিছুই যে আরও বেশি যত্নআত্তি দাবি করে সে-কথা ভুললে তো চলবে না! কাচের পুতুল যে, টোকা লাগলেও ভেঙে যাবার ভয়।
তা বলে কি নড়নচড়ন বন্ধ? মোটেই না, বরং পাশে থাকা, আরও বেশি তাকে নিয়েই থাকা জরুরি। বলা যতটা সহজ, কাজটা ততটা সহজ কি?
সহজ তো নয়ই, কিন্তু যদি কঠিন কাজটা করা যায় তা হলে কিন্তু আর বাইরের দাগ ছোপ মনের ভিতরে কিচ্ছুটি করতে পারে না। শাম্ব তো আর স্পোর্টসম্যান নয়, ফলে হারজিত অত সহজে একইভাবে নেওয়া তো ও শেখেনি। আসলে হারজিত নিয়ে ভাবেইনি কোনোদিন। প্রতিযোগিতার ধারকাছ দিয়েই কোনোদিন যায়নি। ভালো কথা শুনে আসা ছেলেটার একটু আধটু বাঁকা কথাই হয়তো মনে ছাপ ফেলে দিয়েছে। হয়তো নামিয়ে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস। এমনিতেই তো নিজে-নিজেই একটা গোল হয়তো ঠিক করে ফেলেছে, কিন্তু আত্মবিশ্বাস কমতে থাকায় হয়তো সেই এক্সপেক্টেশন থেকে দূরত্ব বাড়ছে। আর এই দূরত্বটুকুরই তো পোশাকি নাম স্ট্রেস। তা হলে কী দাঁড়াল?
দাঁড়াল এই যে ইলেভেনে পড়ার ছ’মাসের মধ্যে শাম্ব চ্যাটার্জী স্ট্রেসে রয়েছে। আর সত্যিটাও এই যে, ইলেভেনে পড়ার ছ’মাসের মধ্যে শাম্ব চ্যাটার্জীর মতো বেশিরভাগ পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা স্ট্রেসে থাকে।
সাত
যাক গে যাক। সব ছেলেপুলে নিয়ে তো আর আমরা মহাকাব্যি লিখতে বসিনি! কাজেই চলো ফোকাস করি শাম্ব চ্যাটার্জীর দিকেই।
আসলে এর পরে শাম্ব চ্যাটার্জীর গ্রাফটায় খানিক ঋণাত্মক নতি। যেমন পড়াশুনোর গ্রাফে, তেমন আত্মবিশ্বাসে। মন থেকে কেউ যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে চোঁ চোঁ করে শুষে নিচ্ছিল আত্মবিশ্বাসের রস। হাল ছাড়ছিল না শাম্ব। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল প্রাণপণ। পড়ার সময় বাড়িয়ে দিয়েছিল, ইশকুলের সময় কমিয়ে দিয়েছিল, টিউশন ব্যাচে অনিয়মিত হয়ে খামতি কমাতে বাড়িতে পড়ার চেষ্টা করছিল, তবু কেন কে জানে টিউশন ব্যাচের পরীক্ষার দিনও বাড়ি থেকে তার পা সরতে চাইত না। যা পড়েছে কিচ্ছুটা যেন মনে পড়ত না। তবু বাড়ির কাউকে বুঝতে না দিয়ে পড়তে চলে যেত। অনেকবার মনে হয়েছে পড়তে না গিয়ে অন্য কোথাও চলে যায়। কিন্তু উপায় কী? হয় মা নিয়ে যান, না-হলে বুবুনকাকুর টোটো। পরীক্ষার প্রশ্ন পাওয়ার পর তাকাতে ভয় হয়, কিন্তু শাম্ব তো ঠিক কোনোমতে পরীক্ষা দিয়ে আসে। সব নম্বরের উত্তর হয়তো হয় না, তবে মোটামুটি প্রথম দু-তিনজনের মধ্যেই নম্বর ঘোরাফেরা করে।
শাম্ব তো বোকা ছেলে নয়। মাঝে মাঝে নিজেই নিজেকে বোঝায়, টেনশন না করলে হয়তো পরীক্ষাগুলো আরও অনেক ভালো হবে। ভয়ে ভয়ে না পড়ে আগের মতো শেখার জন্য যদি পড়তে পারে তা হলে পড়াগুলো ঠিক মনে থেকে যাবে। কিন্তু পারে কই? পড়তে গেলেই পরীক্ষার চিন্তা, পরীক্ষা মানেই নম্বরের চিন্তা, নম্বর মানেই প্রথমে থাকতে পারা যাবে কি না সেইসব চিন্তা ভিড় করে। কতটা সময় কেটে যায়, পড়াশুনোয় মন বসে কই ছেলেটার? তোমরা বিশ্বাস করবে কি না জানি না, শাম্ব কিন্তু মোবাইলে যে দু-একটা গেম খেলত, সেটাও নিজেই ছেড়েছে। কেবল ভালো নম্বর পেয়ে নিজের স্থানটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য কী লড়াইটাই না ছেলেটা করছে মনের সঙ্গে! রাত দুটো তিনটে অবধি বই নিয়ে বসছে, সকাল সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে বসে যাচ্ছে। কিন্তু তাও হোমওয়ার্ক, অ্যাসাইনমেন্টের বিপুল চাপ সামলে উঠতে পারছে না। এইসব নিয়ে হাবুডুবু খেতে-খেতেই ইলেভেনের বার্ষিক পরীক্ষা চলে এল।
কী ভাবছ, শাম্ব চ্যাটার্জী এবারে একেবারে নাজেহাল হবে? তা তো ভাবতেই পারো, ভাবাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। শাম্ব নিজেও তো সেরকমই ভাবছিল। ভয়ে টেনশনে গুটিয়ে গেছিল। বাড়িতে অবশ্য আদর বেড়ে গেছিল। যে বাবা হেলথ ড্রিংকের বিপক্ষে, তিনি নিজে হেলথ ড্রিংক এনে দিয়েছেন, ফল খাওয়া বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন, ডিম, মাছ, মাংস নিয়ম করে নিয়মিত। পাতে জাতীয় পতাকার তিন রঙের সবজি মাস্ট। এটা না হলে নাকি পুষ্টি অসম্পূর্ণ থেকে যায়, সব ভিটামিন, সব খনিজ মেলে না। কাজেই শাম্বর আদরযত্নের কোনও খামতি ছিল না। ছেলেটিও যে খাটিয়ে, সে তো আগেই বলেছি। কাজেই যতটা এলোমেলো হবে বলে ভাবা হচ্ছিল ততটা হল না। প্রথম স্থান ধরে রাখতে পারল না শাম্ব ঠিকই, কিন্তু অম্বরীশের পরেই রইল আর অম্বরীশের থেকে খুব পিছনে তার নম্বর ছিল না। মাত্র এগারো মার্কস পিছিয়ে।
ভাবছ বোধ হয় এতক্ষণ তা হলে বাড়িয়ে বাড়িয়ে লিখেছি সব! একটুও না, বিশ্বাস করো, এক বিন্দু বাড়িয়ে লিখিনি। আসলে পুরো কথাটা তো বলিনি। বলেছি তো কেবল অন্যের সঙ্গে তুলনামূলক কথাটুকু, ওই আর সবাই যেমনটি বলে থাকে। নিজের সঙ্গে যদি তুলনা করি, তাহলে বলতেই হয় গোটা ক্লাসের সব্বাই পিছিয়ে গেছে। সেখানে একই হারে শাম্ব পিছোনোয় র্যাঙ্কিং তার খুব পিছোল না বটে, কিন্তু নম্বর খুব ভালো কিন্তু হল না। কোনও বিষয়েই আর পুরো নম্বর হল না। সব মিলিয়ে ওই সাতাত্তর দশমিক আট শতাংশ। অথচ বছর খানেক আগের বোর্ড এক্সামে ছিল তা প্রায় আটানব্বই শতাংশ। তা হলেই বোঝো, নিজের তুলনায় পিছোল কি না? ক্লাসের প্রায় প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ের এই দশা। বিজ্ঞান পড়লে যে স্বপ্রতিভ চোখ-মুখ দেখতে পাওয়ার কথা, তার বদলে এক বছর পর কেমন যেন ভয়গ্রস্ত দৃষ্টি। এই বয়সে যে চনমনে ভাব থাকার কথা, তার বদলে কেমন যেন মিনমিনে ভাবসাব। বাণিজ্য বা কলা বিভাগে কিন্তু এরকম নয়। সেখানকার ছেলেমেয়েরা খেলছে, পড়ছে, নাচছে, নাটক করছে— যেমন হওয়ার কথা তেমনই আছে। রেজাল্টও ভালো করছে।
তা হলে কি বিজ্ঞান পড়াটাই শাম্বর মতো পড়ুয়া ছেলেমেয়েগুলোর স্ট্রেসের কারণ? নাকি বিজ্ঞানকে আলগোছে বাদ দিয়ে বিজ্ঞান চেপে কেরিয়ার তৈরি করার আশা এই অবস্থা করল ওদের?
কে জানে!
এসব নিয়ে যারা ভাবেন তাঁরা বোধ হয় লোকজনকে বোঝান না, কেবল দিস্তে দিস্তে মোটা মোটা বই লেখেন, অথবা তাঁদের কথা কেউ শোনে না এরকমও হতে পারে।
যাই হোক, যেদিকে হাওয়া বইছে সেদিকেই তো সবাই ভাসবে। দু-একজন হয়তো বিপরীতে চলার চেষ্টা করবে; তাদের কেউ যুঝতে যুঝতে বাঘা ইলিশ হয়ে উঠবে, আবার কেউ-বা পোনা অবস্থাতেই ভোগে চলে যাবে।
আমাদের শাম্ব স্বাভাবিকভাবেই আর পাঁচজনের মতো চলছিল। সিলেবাসের বোঝা যতদিন গড়াচ্ছিল ততই গিলে ফেলছিল যেন ছেলেটাকে। শেখার আনন্দ মাথায়, কোথা থেকে কতটুকু পড়লে পরীক্ষায় লিখতে পারবে, যন্ত্রের মতো সেইসব গিলতে শুরু করেছিল গোগ্রাসে। রাত নেই, দিন নেই কেবল পড়া। ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ। অধ্যয়ন মানে কি কেবল দুলে দুলে গাঁক গাঁক করে পড়া?
কে জানে!
আট
আদত কথা, শাম্বর মন ভালো ছিল না। থাকার কথাও যে নয় সে তো তোমরা ভালোই বুঝতে পারছ। ভয় চাপতে চাপতে কবে যে কথা চাপতেও শিখে গেল ছেলেটা, ইচ্ছে চাপতে শিখে গেল, ভালো লাগার বিষয়গুলোকে চাপতে শিখে গেল, তা না বুঝল ছেলেটা নিজে, না ওর বাবা, না ওর মা, না ওর শিক্ষকরা। বুঝবে কেমন করে? যে নির্দেশতন্ত্রের সওয়ার শাম্ব, সেই নির্দেশতন্ত্রেরই তো অংশ ওঁরা। চেয়ারে বসে কি আর চেয়ার তোলা যায়?
মন ভালো না থাকা আর আকাশে নিম্নচাপ ঘনানো একইরকম। কথায় কথায় আলো যায় ঢেকে, মেঘ ছেয়ে যায় আকাশে ঘোর করে, বৃষ্টির ধারা নেমে এলে যেন তার শান্তি। মনখারাপেও বৃষ্টি হয়। মনের ভিতরে। কারো-কারো সে ধারাজল বাইরে এসে অশ্রু হয়, কারো-বা আবার মনের বাঁধ এমন কঠিন যে ধারা আর বাইরে আসতে পথ পায় না। মনের ভিতরেই আছাড়িপিছাড়ি করে।
শাম্বর ছিল ঠিক তেমন দশা। পড়তে পড়তে যখন রাত ঘন হয়ে যেত, পাশের ঘর থেকে বাবার নাকডাকার শব্দ ভেসে আসত, শাম্বরও মনে হত এবার শুয়ে পড়ে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হত অম্বরীশ তো এখনও পড়ছে, ও যে বলে সারারাত পড়ে! কিন্তু শাম্বর ভালো লাগে না রাতে পড়তে। খুব ইচ্ছে করে বছর খানেক আগেও যেভাবে বাবাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, তেমন করেই আবার গিয়ে শুয়ে পড়ে বাবার পাশে। কিন্তু পারে না। শাম্বর মনখারাপ হয়, কাঁদতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কাঁদতে পারে না। কান্নার ঢেউ মনের ভিতর বাঁধের দেওয়ালে ধাক্কা খায়, ধাক্কা খায়।
যাই হোক, সবকথা বলতে গেলে ইয়া মোটা বই হয়ে যাবে। আর তোমাদেরও বিরক্তি হবে। আর তাছাড়া বাকি সব কথা সহজেই অনুমেয়। আকছার ঘটে তো এমন, প্রায় ঘরেই ঘটে।
আসল কথায় আসি এবার। এমনি করেই টুয়েলভের প্রি-মক, প্রি-বোর্ড পার হয়ে গেল শাম্ব। অনেকটা পরিণত এখন। এতবার পরীক্ষা দিয়ে পরীক্ষার ভীতিটা হয় অনেকটা চলে গেছে, নয় গায়ে থুড়ি মনে সয়ে গেছে। পরীক্ষার আগের রাতে ওর হাত কাঁপে, মনে করতে গেলে মনে পড়ে না। তাই এখন আর ও মনে করার চেষ্টাটাই করে না। কেবল যতটা পারে গোটা সিলেবাসটা একবার অন্তত পড়ে যাবার চেষ্টা করে। প্রি-মক, প্রি-বোর্ড দুটো এক্সামেই ও দেখেছে, ঘরে মনে না পড়লেও পরীক্ষার হলে একবার যদি কলম চলে তখন হু হু করে সব ওর মনে পড়ে যায় আর লিখতে পারে। কাজেই সেই ফ্লোটা যাতে থাকে তাই গোটা সিলেবাসটা একবার অন্তত দেখে যেতে চায়।
অম্বরীশের সঙ্গে কম্পিটিশনটাও মিটেই যেত, কিন্তু অম্বরীশ নিজেই সেটা জিইয়ে রেখেছে। প্রি-বোর্ডের পরে এসেও বলে গেল, ‘শাম্ব, এবারও মনে হয় পারলি না। ম্যাথস আর ফিজিক্সটা না জাস্ট ফাটাফাটি হয়েছে।’ এই ব্যাপারটাই নিতে পারে না শাম্ব। ও পারবে কি পারবে না তা নিয়ে অম্বরীশের মাথাব্যথার কী আছে? তাছাড়া ও ভালোই জানে যে শাম্ব এই দুটো বিষয়ে একটু দুর্বল।
শাম্ব মুখে কিছু তো বলে না, তবে মনে মনে একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে নেয়। যে করেই হোক ম্যাথস আর ফিজিক্সে বেশি পেতেই হবে। ওদিকে ওর যা লক্ষ্য তাতে তো আবার বায়োলজিতে সময় বেশি দেবার কথা। সে যাই হোক, আগে তো বোর্ড মিটুক, তারপর অন্য পরীক্ষা। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। দিনরাত এক করে চলল পড়াশুনো। বায়োলজির সময় কমে রুটিনে অঙ্কের সময় বাড়ল, কেমিস্ট্রির সময় কেটে ফিজিক্সে যোগ হল।
সময় গড়াতে গড়াতে এক্কেবারে পরীক্ষার আগের দিন।
সন্ধের পর থেকে শাম্বর মনে হতে লাগল, যাব্বাবা, পরদিন পরীক্ষা! কই, ওর তো টেনশন হচ্ছে না! টেনশন যেমন হচ্ছে না, তেমনি পড়ায় মনও বসছে না। একজায়গায় কেন যেন বসতেই পারছে না। মা শাম্বকে দেখে কিছু আঁচ করে বাবাকে ফোন করলেন। বাবা যখন এসে উঠলেন ততক্ষণে শাম্বকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছেন মা। শাম্বর বাঁ পা আর বাঁ চোখের নীচের গাল কেঁপে কেঁপে উঠছে।
বাবা এসে প্রেশার চেক করলেন। সারাদিনে খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক হয়েছে কি না জানতে চাইলেন, তারপর শাম্বর পিঠে আলতো চাপড় মেরে বললেন, “কিছু হয়নি, ওঠ।”
তড়াক করে উঠে বসল শাম্ব।— “তাহলে এখন পড়ব আমি?”
“কিচ্ছু পড়তে হবে না এখন, সব পড়া আছে।”
“না বাবা! সবটা একবার দেখে নিতেই হবে।”
“অ্যাই শোন, কাল তোর ফেভরিট পেপার, ইংলিশ। ওটা এত পড়েছিস যে আজ না পড়লেও চলবে।”
“চলবে না বাবা!”
“আমি বলছি তো! তোকে তো চিনি আমি। বরং চল দুজনে মিলে একটু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড খেলি।”
এমনি করেই ইংলিশ পরীক্ষার আগে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, কেমিস্ট্রির আগে চ্যাপলিনের মডার্ন টাইমস, ফিজিক্সের আগের রাতে ঘুম আর বায়োলজির আগের রাতে গল্পগাছা করে পরদিন সকালে খেয়ে, হিক্কা তুলে, কেশে, বমি করে পরীক্ষা দিতে গেল শাম্ব।
অবশ্য পরীক্ষা কি খারাপ হল?
কে জানে! শাম্ব লিখল তো শুরু থেকে শেষের ঘণ্টা অবধি।
তারপর? পরীক্ষা তো শেষ হয়েই গেল। গপ্প তো তাহলে শেষ হবার কথা।
রোসো বাপু! এ তো গপ্পকথা নয় যে বানিয়ে বানিয়ে ফেঁদে ফেঁদে যা মনে হয় তাই কইব! তাই এখানে গপ্পের শেষ নয়। বরং গপ্পের শুরু।
ক্লাস টুয়েলভ বোর্ড এক্সাম শেষ হবার দিন তিনেক পরে একদিন বাবা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলেন। সন্ধেবেলা ডাইনিং টেবিলে ওরা তিনজন— মা, বাবা আর শাম্ব। বাবা অনেক কথা বললেন। মাও বললেন। অনেক বোঝালেন ওঁরা শাম্বকে। বললেন, “তুই যেমন রেজাল্ট করবি আমরা তাতেই খুশি হব। টেনশন করিস না বাবা এত।” বললেন, “জানিস, পরীক্ষার আগের রাতগুলোতে প্রেশার কোথায় তুলে ফেলেছিলি? কীসের এত চাপ রে বাবা? তোর কিচ্ছু করে দেখাতে হবে না কাউকে। কারও সঙ্গে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। কোনোদিন তো আমরা বলিনি তোকে কিছু!” বললেন, “যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। এখন আর সে-সব নিয়ে ভাবনা-চিন্তা নয়। বরং এখন খোলা মনে প্রিপারেশন নে। নিটের তো এখনও মাস দু-এক বাকি।” বললেন, “তুই পড়লে পারবি না এ-কথা আমরা বিশ্বাস করি না।” বললেন, “কোনও চাপ নিস না কেমন? সামনের সপ্তাহ থেকে তোর ইন্সটিটিউটে মক শুরু হচ্ছে। স্টাডি ম্যাটস নিয়ে এবার একটু একটু বস। তোর সব জানাই আছে। দেখবি ঠিক সব মনে পড়ে যাবে।”
শাম্ব তো ভালো ছেলে। বাবা-মায়ের কথা শুনেছিল। সেদিনই রাতে স্টাডি মেটেরিয়ালগুলো খুলে বসেছিল। কিন্তু বিশ্বাস করো সব কেন যেন ওর কাছে নতুন লাগছিল। বইগুলো, খাতাগুলো— যে-খাতাগুলো ভরে ভরে ও কেবল ক্লাস নোটস নিয়েছে, হাজার হোমটাস্ক অ্যাসাইনমেন্ট করেছে, সেগুলো দেখেও ওর কেমন যেন গলার কাছে দুক দুক করছিল। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। হাত ঘামছিল। কানের পিছনে একটা অদ্ভুত আওয়াজ। সব ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে অন্ধকার রাস্তায় তাকিয়ে দেখেছিল অনেকক্ষণ।
কী দেখেছিল, কী ভেবেছিল তা কেই-বা জানে।
কিন্তু এটা ঠিক, ব্যালকনি থেকে ফিরেই বইয়ের আলমারির কাচ সরিয়ে কয়েকটা বই আর একটা ডায়েরি আর একটা নোটবুক ব্যাগে ভরে নিয়েছিল। নাইট ল্যাম্পের আধো অন্ধকারে ঝুপসি হয়ে বসে ছিল বিছানার উপর। আর রাত পুরোপুরি ভোর না হতেই সেই ব্যাগটা কাঁধে আর পার্সটা পিছনের পকেটে নিয়ে ঘর থেকে সোজা বেরিয়ে পড়েছিল শাম্ব।
পিছনে ওর ঘরে ছড়িয়ে পড়ে ছিল স্টাডি মেটেরিয়াল, অ্যাসাইনমেন্টের খাতা, ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি আর বায়োলজি বই। চিত হয়ে পড়ে ছিল ওর মোবাইল ফোনটা, সেটায় তখনও রোজদিনের মতো অ্যালার্ম বাজছে।
নয়
শাম্ব চলেছে হারা উদ্দেশে।
সেই জলাকর্ষী আছাড় খাওয়ার স্থান ছেড়ে এসেছে সে তা প্রায় ঘণ্টাটাক তো হলই। বইগুলো শুকোতে দিয়ে বার বার চারদিকে দেখছিল শাম্ব। ভাগ্যিস কেউ আসেনি। আসার কথাও তো নয়। মানুষ তো সেখানেই ভিড় করে যেখানে আরও মানুষ আছে; হয় রোজগারের না-হয় অন্য কোনও কাজের অথবা চিকিৎসা, নয় তো বিনোদন— কিছু একটা আছে! কিন্তু সে ধ্যাদ্ধেড়ে স্থানে সে-সব তো কিছুই নেই। কাজেই অমন অবেলায় কে আসবে ওখানে?
বই ভিজলে কি আর সহজে শুকোয়? তবু খোলা হাওয়ায় আর রোদে ঘণ্টা খানেক থাকায় সেগুলোর ন্যাতপেতে অবস্থা খানিক কেটেছে। নাকে-মুখে জল ঢুকে শাম্বর গতরাত থেকে লেগে থাকা ঘোর ঘোর ভাবটাও যেন খানিকটা কেটেছে। পুরোপুরি কেটেছে কি? না না, তাহলে তো গপ্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেত!
কী ভাবছ, ঘোর কাটার কথা তাহলে বললাম কেন? কারণ আছে। ঘোর খানিক কাটল বলেই না শাম্ব এই এতক্ষণ পরে সে কী কী করে এসেছে সে-সব মনে মনে ভাবতে পারল! কী করতে যাচ্ছিল তাও ভাবতে পারল! না-হলে কি আর হাউমাউ করে ভিজে ব্যাগ আঁকড়ে এত বড়ো ছেলে অমন করে কাঁদে? আহা রে! অমন আছাড়িপিছাড়ি করে কাঁদল ছেলেটা অথচ একটু গায়ে পিঠে হাত রাখার কেউ নেই। অবশ্য কেউ থাকলে ছেলেটা কাঁদতেও পারত না। কাঁদতে পারলে তো নিম্নচাপের মেঘ কেটে কখন সূর্য উঠে যেত। কিন্তু সবাই কি আর কাঁদতে পারে? সব মেঘে কি আর বৃষ্টি হয়?
অমন করে কেঁদে, হিক্কা তুলে, কেশে, জল খেয়ে তারপর খানিকটা ধাতস্থ হল শাম্ব। মা-বাবার মুখ মনে পড়ছিল খুব। চোখ ভেসে যাচ্ছিল জলে। খালি মনে হচ্ছিল বিনা কারণে ওদের কী কষ্টটাই না দিচ্ছে ও। কিন্তু ওরই-বা কী করার আছে? ও তো চায় বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে, ওর নিজের স্বপ্নও যে সেটাই। কিন্তু পারছে কই? চেষ্টা তো কম কিছু করেনি। প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। কিন্তু হলটা কী? বোর্ডের পরীক্ষাটাও তথৈবচ হল। কিচ্ছু ভাল্লাগছে না ওর। বার বার মনে হচ্ছে আদতে সে একটা হেরো। কিছুতেই কিছু হবে না ওর। মেডিক্যাল এন্ট্রান্স ক্র্যাক করা ওর কম্ম নয়।
সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে ড. এ.পি.জে. আব্দুল কালামের কথা।— ‘ফেল করলে কখনও যেন ভেঙে পোড়ো না। ফেল মানে হল, First attempt in Learning।’ মায়ের কথা, ‘না পড়লে কেউ উঠতে শেখে না রে বাবু।’
দু-হাতে চোখ মুছে মনস্থির করে নিয়েছে শাম্ব। রাস্তা থেকে সরে সে যাবে না। আবার পড়বে। শাম্বর ফেভারিট দল নাইট রাইডার্সের ক্যাচলাইন— করব, লড়ব, জিতব রে! কিন্তু এবারে নয়। এ-বছর এন্ট্রান্সে বসার মতো প্রিপারেশন একেবারেই হয়নি। সামনের বছর। একবছর ধরে পড়বে। তখন তো আর বোর্ডের প্রেশারটাও থাকবে না। ঠিক পারবে। কিন্তু এ-বছর যে পরীক্ষায় বসবে না বাবা-মা কি মানবেন? যদি বসতে হয় তখন কী করবে শাম্ব?
শাম্ব ভেবে ফেলেছে, এখন আর সে বাড়ি ফিরবে না। নিটের এন্ট্রান্স মিটুক, তারপর ফিরবে। কিন্তু এখন সে যাবে কোথায়? মনে তক্ষুনি বিবেকানন্দর কণ্ঠস্বর ভেসে উঠেছে, ‘ওঠো, জাগো!’ অমনি উঠে পড়েছে শাম্ব। ভেবে নিয়েছে, যে সুযোগ হঠাৎ করে তৈরি হয়েছে তার, অন্তত আড়াই মাস নিজের মতো জগৎটাকে দেখে নেবার, চিনে নেবার, তাই সে করবে। শাম্ব চ্যাটার্জী নয়, পরীক্ষার ঘেরাটোপে নয়, এক্কেবারে সাধারণ মানুষ হয়ে, কিচ্ছু না চেয়ে কেবল স্রোতে গা ভাসিয়ে যেমনটি তেমন করে সমাজ আর প্রকৃতিকে দেখে নেবে শাম্ব। অচেনা, অজানার পথে হেঁটে চলবে নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে। ঘরে ফেরার কথা পরে ভাবা যাবে।
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। বইপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে ব্যাগটাকে এক কাঁধে ঝুলিয়ে বড়ো রাস্তা ধরেই হাঁটতে শুরু করেছিল শাম্ব। কিন্তু বার দু-এক পুলিশের প্যাট্রল ভ্যান পনেরো মিনিটের মধ্যে দু-দু’বার ওকে দু-দিক থেকে ক্রস করায় আবার খানিক ভয় ঢুকেছে। বাবা-মা তো নিশ্চয়ই এতক্ষণে থানাপুলিশ করেইছেন। বাবার দু-তিনজন বন্ধুই তো পুলিশের বড়ো আধিকারিক। কাজেই তৃতীয়বার আর একটা প্যাট্রল ভ্যানকে দূর থেকে আসতে দেখেই ফের রাস্তা থেকে হুড়মুড় করে ঢালু বেয়ে নীচে নেমে গেছে শাম্ব।
এখানে নয়ানজুলিটা বেশি চওড়া নয়। এক লাফে পার হয়ে ক্ষেতের আলের উপর দিয়ে বড়ো রাস্তার একেবারে লম্ব বরাবর পশ্চিমদিকে হাঁটা দিয়েছে শাম্ব চ্যাটার্জী। ওর তো হারা উদ্দেশে হাঁটা! কাজেই উত্তরদিকে হাঁটাও যা, পশ্চিমেও তাই। আল বরাবর হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছে। বড়ো রাস্তাটা প্রায় আর দেখাই যায় না।
সত্যি বলতে কী, এই পড়ন্ত বেলায় এমন বিজনে হাঁটতে ভালোই লাগছিল শাম্বর। গোটা চরাচর জুড়ে যেন শাম্ব আর শাম্বর মতো স্বাধীন পাখপাখালি, গাছপালা, কীটপতঙ্গ। জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। আচ্ছা, জনমনিষ্যি নেই কেন? ক্ষেতে তো কাজ করা কৃষকদের থাকার কথা। তারাও কেউ নেই কেন? নেই তো ভালোই হয়েছে। মনের ভিতর মায়ের গলায় রবি ঠাকুরের গান বাজছে—
আমার মুক্তি ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে
এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়!
অনেক দূরের আকাশে একটা নীল ঘুড়ি একাই উড়ছে। শাম্ব ঘুড়ি ওড়াতে পারে না। ইচ্ছে করে ওড়াতে, কিন্তু সময় কোথায়! এখন অঢেল সময়। কাজেই আকাশের নীল ঘুড়ি দেখতে দেখতে পা বাড়াল শাম্ব।
জায়গাটা এমন বিজন হওয়ার সম্ভাব্য একটা উত্তর অবশ্য মিলল আরও অনেকটা দূর হেঁটে চলার পর। এমন নৈসর্গিক নিরিবিলিটাকে একেবারে দলেমলে দিয়ে হঠাৎ করে ভেসে এল মাইকের চড়া সুর। কারা কীর্তন গাইছে বোধ হয়। তার মানে কাছেই কোথাও লোকজনের সমাগম হয়েছে। অথচ এখনও শাম্বর চারদিকে ধু ধু করছে মাঠ। মাঠে আল দিয়ে ভাগ করা জমিগুলোর বেশিরভাগে কিশোর ধানগাছে বিকেলের হাওয়ায় সবুজ ঢেউ। সেই ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে উড়ছে টিয়ার ঝাঁক। টুনটুনির দল পাতার ফাঁকে ফাঁকে শেষবেলার লুকোচুরিতে মত্ত। কোনো-কোনোটায় আবার সবজির চাষ হয়েছে, ফুলের চাষ হয়েছে। শাম্ব সব সবজির নাম জানে না। খায়ই না, জানবে কী করে!
পরিচ্ছন্ন দেখে একটা আলের উপর বসে পড়ল ও। সামনের জমিটায় চাষ হয়নি কোনও। শুকনো নাড়া পড়ে আছে গোটা জমিটায়। এখানে হাওয়া যেন অনেক হালকা, এতসব গাছের গা ছুঁয়ে বয়ে আসা বাতাসে গাছেদের গন্ধ মাখা। সেই আদুরে বাতাস শাম্বর উসকোখুসকো চুলে বিলি কেটে গেল মায়ের মতো।
বীর শাম্ব। শ্রীকৃষ্ণতনয় শাম্ব। হারতে শেখেনি। লড়তে জানে। এত শান্তির স্থানেও কেন যে নিজের সবকথা মনে আসে শাম্বর!
বাতাসে ভেসে আসছে কীর্তনের সুর। খোনা গলায় কেউ তারস্বরে হরিনাম করছে। মধ্যে-মধ্যে বেহালার সুরের মাঝে আর কেউ ব্যাখ্যা করছে কৃষ্ণলীলার। কেবল শ্রীকৃষ্ণের লীলা! শাম্বও তো কৃষ্ণতনয়, তাকে নিয়ে কি কোনও সুরে কথা বাঁধা যায় না? নাকি আছে? থাকলেও সেখানেও যে শ্রীকৃষ্ণেরই ত্যাগ, বাৎসল্য, জ্ঞান মুখ্য হবে সে-কথা যে-কেউ বুঝতে পারে। শাম্বর জন্য বরাদ্দ থাকবে বীরত্ব, উচ্ছৃঙ্খলতার কাহন আর চন্দ্রভাগা বৃত্তান্ত। শাম্ব বেশ জানে।
শাম্ব জানে এতক্ষণে কী খোঁজাখুঁজিই না চলছে! কতজন হয়তো কতকিছু বলছে। মায়ের মুখটা মনে পড়ছে। মাকে কিছু লিখে এলে হত। কিছু তো লিখেও আসেনি শাম্ব। মোবাইল আনেনি। মা কাঁদছে মনে হলেই কান্না পাচ্ছে শাম্বর। মনে হচ্ছে না বেরোলেই হত। কিন্তু পারছিল না যে! কিছুতেই যে পারছিল না। চারদিক যেন ক্রমশ ছোটো হতে হতে চেপে ধরছিল ওকে। দম নিতেও যেন গলা চেপে আসছিল। সারা জগতের যেন একটাই কাজ— শাম্ব চ্যাটার্জীর পড়াশুনোর হালহকিকত জানা, শাম্ব ডাক্তার হবে কি হবে না, হলে স্পেশালিটি কী হবে সব যেন তাদের একমাত্র জ্ঞাতব্য।
উফ্!
পায়ে কী কামড়াচ্ছে শাম্বর। এবড়ো-খেবড়ো ঢেলা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল পিঁপড়ে বেরিয়ে পড়েছে।
“জল হবে দু-একদিনের ভিতর।”
চমকে উঠে শাম্ব এদিক ওদিক চারদিকে তাকিয়ে দেখল। কই, কেউ তো নেই কোথাও! কিন্তু স্পষ্ট শুনেছে কথাটা।
নীচের দিকে ফের তাকিয়ে দেখল শাম্ব। সার বেঁধে পিঁপড়ের দলও এগিয়ে চলেছে। একটা দুটো এ-পাশ ও-পাশ ছিটকে গেলেও অন্যেরা ফের নিয়ে আসছে প্রবাহে। পিঁপড়েরা সমাজবদ্ধ জীব, মানুষও তাই, তাই কি প্রবাহে টেনে আনতে চায় সবাই সবাইকে।
“তা-ই তো বটে!”
ফের চমকে উঠল শাম্ব। কিন্তু এবারেও তো কাউকেই দেখতে পেল না। অবশ্য আলো কমে এসেছে, প্রায় অন্ধকার। তবু খোলা জায়গায় তো দৃষ্টি ভালোই চলে। কই, কেউ তো কোত্থাও নেই!
শাম্বর কি খানিক গা ছমছম করল? না বোধ হয়। গা ছমছম করার মতো কোনোকিছুর সামনে তো ও পড়েইনি কোনোদিন। তাতে কী? গা ছমছম করা তো রিফ্লেক্স।
তাই যদি হয় তো বলা যেতেই পারে শাম্বর খানিক গা ছমছম করল। কেননা, শাম্ব সামনে চলার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে দেখা যাচ্ছে। ব্যস্ততার মাত্রাটাও যেন মাত্রাছাড়াই। আর সবচেয়ে বড়ো কথা এই যে শাম্ব হাঁটা দিল, তা কিন্তু দিল যেদিক থেকে মাইকের আওয়াজ ভেসে আসছে সেই দিকেই!
শাম্ব চ্যাটার্জী হাঁটছে, জোরে জোরে হাঁটছে। ওর পিছনে ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে অন্ধকার আর সামনে ক্রমশ জোরালো হচ্ছে কীর্তনের সুর—
হারিয়ে গেছে ব্রজের কানাই
দ্বারাবতীর দেশে,
তাই সারা গোকুল কেঁদে আকুল
চোখের জলে ভেসে…
দশ
গ্রামের নাম বদরপুর। নদীর নাম সুতি। সুতোর মতো সরু তার প্রবাহ। সেই সুতোর মতো প্রবাহই বর্ষার সময় একেবারে যাকে বলে স্রোতস্বিনী তরঙ্গিনী। দু-কূল ছাপিয়ে চরের ক্ষেতে নবীন পলি জমিয়ে মাইল-কে-মাইল প্লাবিত করে ছুটে চলে উত্তর থেকে দক্ষিণে। সেই তিনমাস বদরপুরে চাষ হয় না। হবে কেমন করে? সব তো তখন জলের তলায়। ওই নদীই তখন বদরপুরের মানুষদের অন্নদাত্রী।
বদরপুরের মানুষ তাই বর্ষা আসার আগে জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় সুতি মায়ের পুজো করে। প্রায় গোটা গ্রামটাই বৈষ্ণব। সুতি নদীকে গ্রামের মানুষ কল্পনা করে যমুনার অংশ রূপে। গোটা বদরপুর ওই জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমার উৎসবের আগে মনে প্রাণে হয়ে ওঠে নন্দলালার গোকুল। পালা করে এক-একবার এক-একটি বাড়ি সেজে ওঠে নন্দ গৃহ, আয়ান গৃহ, সুদামা গৃহ, বিশাখা গৃহ— এমনি করে। ঠিক যেন যমুনাতীরের সেই গোকুলটিই।
ফি-বছর প্লাবনে অভ্যস্ত গ্রামের প্রতিটা বাড়ি ভূমিতল থেকে প্রায় এক মানুষ উঁচু। অনেক বাড়িতেই পৈঠার দু-ধারে চালের গুঁড়োর আলপনা। উঠোনে তুলসি মঞ্চ তো আছেই, তাছাড়াও অনেক বাড়িতেই নানাধরনের তুলসির ঝাড়। সুতি নদীর ধার বরাবর হাঁটলে যেখানে তুলসির বন সেখানেই ঠাকুরদালানে বিরাজ করেন নন্দদুলাল। পাশেই আর এক মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণ আর শ্রীরাধিকার যুগলমূর্তি। ঠাকুরদালানও ভূমিতল থেকে অনেক উঁচু, তা প্রায় চৌদ্দ-পনেরোটা সিঁড়ি চড়ে মন্দিরে ঢুকতে হয়। পুরোনো মন্দির। মন্দিরের পিছনে এক আশ্চর্য গাছ। শেকড়টি পাকুড় গাছের, কিন্তু সেই পাকুড়ের ভাঁজ থেকে একটি নিমবৃক্ষ। দুয়ে মিলে যেন ত্রিভঙ্গ মুরারির মতো বাঁশি হাতে দাঁড়িয়ে শান্তির ছায়া বর্ষাচ্ছে দেবালয়টির উপর। ওই দেবালয়ের পাশেই বিস্তৃত মাঠে জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমার সময় অষ্টপ্রহর নামসংকীর্তন হয়। সংলগ্ন নদীচরে মেলা বসে। গ্রামের মানুষ তো বটেই, আশেপাশের গ্রামের মানুষও মেলায় আসে। দেবালয়ে পুজো দেয়, নিম-পাকুড়ের ডালে সুতো বেঁধে মানত করে।
শাম্ব মাইকের শব্দ অনুসরণ করে এসে উঠেছিল নদীচরের সেই মেলায়। গ্রামের মেলা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের পসরা। হাতে ঘোরানো নাগরদোলা, ইলেকট্রিক নাগরদোলা-সহ বাচ্চাদের আনন্দদায়ক হরেকরকম উপকরণ মজুত। তাঁতের কাপড় থেকে আশ্চর্য সার্কাস—কী নেই! বইয়ের দোকান থেকে মাটির পুতুল, সেজে বসে আছে দোকানে দোকানে।
কেনাকাটি তখনও তেমন জমেনি। ভিড় তেমন ঘন হয়নি। নানানরকম পসরা পার করে শাম্ব এসে পড়ল খাবারের দোকানের সামনে। বৈষ্ণব অধ্যুষিত গ্রামের মেলা। খাবারদাবার একেবারে নিষ্ঠা নিরামিষ। মোদকের দোকানে কড়াইয়ের তেলে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তেলে ভেজে জিলিপি ছাড়া হচ্ছে রসে। গন্ধে ম ম। সারাটা দিন যে কিছুই খাওয়া হয়নি, সে কথা একটা বারের জন্যও এতক্ষণ মালুম হয়নি শাম্বর! প্যাঁচে প্যাঁচে রসসিক্ত জিলিপি দেখে তার খিদেটা যেন একেবারে চাগিয়ে ওঠে। এক ঠোঙা জিলিপি নিয়ে দেবালয়ের সিঁড়িতে বসে সবে কামড় দিয়েছে, অমনি ফের সেই গলার স্বর, “ঠিক জায়গাতেই এসেছ হে! আগে খেয়ে নাও, তারপর হাত ধুয়ে ভিতরে যেও। কাল থেকে বৃষ্টি নামবে জেনো। তার আগে আশ্রয়টা তো খুঁজে নাও!”
যথারীতি কাউকেই দেখতে পেল না শাম্ব। তবে কথার অবাধ্যও হল না। তাড়াতাড়ি খেতে লাগল ঠোঙা থেকে। কয়েকটা জিলিপি গলায় চালান করতে না করতেই জলতেষ্টা পেয়ে গেল। মন্দিরের পুবদিকে একটা টিউবওয়েল। সেখানে সবাই এখন হাত ধুচ্ছে। লম্বা লাইন। শাম্ব কি লাইনে দাঁড়াবে? দাঁড়ায়নি তো কোনোদিন, একটু তো জড়োসড়ো লাগবেই। তবু তেষ্টা মেটাতে যেতেই হল। লাইন পেরিয়ে টিউবওয়েলের কাছে পৌঁছতেই দেখল এক নেড়ামুণ্ডি ছোটো মেয়ে টিউবওয়েলের হ্যান্ডেলে ঝুলে ঝুলে পাম্প করছে। শাম্ব নিজে পাম্প করে নিতে চাইলেও সে-কথা সেই মেয়ে শুনলই না। মুখ ধুয়ে শাম্ব রওনা হল দেবালয়ের ভিতরে।
সন্ধে নেমে এসেছে, মন্দির চত্বরে আলো জ্বলে উঠেছে। মেলার চর থেকে জেনারেটরের একটানা গুবগুব শব্দ ভেসে আসছে। শাম্বর অবশ্য সুবিধা হয়েছে। মেলার সময় বলে কথা, আশেপাশের গ্রাম থেকেও দর্শনার্থীরা আসছেন। তাছাড়া বাড়িতে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এসে উঠেছেন, তাঁরাও আসছেন দেবালয়ে। কাজেই এতসব অচেনা মানুষের ভিড়ে নতুন মুখ শাম্বকে কেউ অত খেয়াল করবে না।
শ্যামরাইয়ের মন্দির নামেই সবাই চেনে একে। মন্দিরে শ্যামরাইয়ের যুগল বিগ্রহ। আহামরি কিছু কারুকার্য নেই। মাটির বিগ্রহ। কিন্তু যত্নে, ভালোবাসায় অপরূপ। শ্রীকৃষ্ণ আর শ্রীরাধিকা দুজনেই হালকা গোলাপি পোশাকে সুসজ্জিত। মোহন মূর্তি। স্বর্ণাভ মুকুটের বামপাশে ময়ূর পালক। তাকিয়ে ছিল শাম্ব। তাকিয়ে থাকতে থাকতে যুগলমূর্তির মোহন রূপ যেন মনে গেঁথে যাচ্ছিল ওর। ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর শ্রীকৃষ্ণ, কত না তাঁর লীলা! বীর শাম্বের পিতা শ্রীকৃষ্ণ। রাধিকামোহন শ্রীকৃষ্ণ। প্রিয়তম পুত্রকে কেন তবু শাপ দিলেন তিনি?
চোখ ভিজে আসছিল শাম্বর। বাবা-মায়ের মুখ দুটো ভেসে উঠছিল যুগলমূর্তির অবয়বে। সব মিলেমিশে এক। তবে কি বাড়িই ফিরে যাবে? কী বলবে সবাই?
“প্রসাদ নাও খোকা।” একজন বৃদ্ধা ডেকে ওর হাতে প্রসাদ দিলেন। ঠিক যেন ঠাম্মা! ঠাম্মা চলে গেছেন তিন বছর আগে। দাদু বলেছিলেন, ‘এক মুঠো বালি দাদুভাই, আজ হাত গলে সব পড়ে গেল।’ তিন বছর বাদে ঠাম্মার জন্য মনটা হু হু করে উঠল শাম্বর। ঠাম্মা যেমন করে প্রসাদ পেতেন, তেমন করে কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রসাদ মুখে পুরল শাম্ব। মালপোয়া। শাম্বর প্রিয় মালপোয়া। তবে স্বাদ আরও ভালো এখানে।
অন্যরকম লাগছে শাম্বর। কষ্ট, দুঃখ, ভালোলাগা সব মিলেমিশে একটা অনুভূতি হচ্ছে যেটা ভালো লাগছে শাম্বর।
হঠাৎ চারপাশ থেকে উলুধ্বনি উঠল, শাঁখ বাজল। শাম্ব দেখল পূজারি দাঁড়িয়ে পড়েছেন। বাঁহাতে ঘণ্টা, ডানহাতে জ্বলন্ত পঞ্চপ্রদীপ। আরতি শুরু হল শ্যামরাইয়ের। একে একে পুষ্প, শঙ্খ, পদ্ম, বস্ত্র, ময়ূর পালকের পাখা, চামর— নানান উপচারে আরতি চলল যুগলমূর্তির। আরতি শেষে ফের উলুধ্বনি উঠল। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে কেউ, কেউ-বা উদ্বাহু হয়ে জয়ধ্বনি দিচ্ছে।
মন্দিরের সোজাসুজি মণ্ডপ। সেখানে নামসংকীর্তন হচ্ছে। এই কীর্তনের সুর শুনেই শাম্ব এদিকে এসেছে। শাম্বর ঠাম্মা কীর্তন করতেন অনেকদিন। সে-কীর্তন আর এই কীর্তন অনেক আলাদা। শাম্ব দেখল কীর্তনের আসরে ভিড় জমেছে। মূলত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরই ভিড়। দাদু-দিদাদের হাত ধরে যেসব নাতিনাতনির দলও এসেছে, তারা মণ্ডপের ধার দিয়ে ছোটাছুটি করে খেলা করছে। ভালো লাগছিল এসব দেখতে শাম্বর, এমন স্বতঃস্ফূর্ত খোলামেলা আনন্দ তো দেখেনি বহুদিন।
এগারো
শাম্বর একটা সমস্যা আছে। ও চট করে মিথ্যে কথা বলতে পারে না। অচেনা বা অল্প চেনা কাউকে তো নয়ই। সেই ছোটবেলা থেকেই কোনোরকম দুষ্টুমি যদি ও করত, তাহলে যতই জিজ্ঞেস করুক কেউ, যতভাবেই জিজ্ঞেস করুক, শাম্ব একেবারে স্পিকটি নট। মুখ দিয়ে কথাই সরত না শাম্বর। একটু ঘুরিয়ে বললেই বা একটু বানিয়ে বললেই মিটে যায়; কত বার বানিয়েও ফেলেছে, কিন্তু সেই কথাগুলো মন থেকে আর মুখে টেনে আনতে পারেনি। একেবারে চুপ থেকেছে। কতবার যে কতজন রেগে গেছে এ-জন্য!
ঘটনা ঘটেছিল সেই মন্দিরেই। সন্ধ্যারতি দেখে, কীর্তন শুনে বেশ ভালো লাগছিল শাম্বর। মন্দিরের একপাশে বসার একটা জায়গাও পেয়ে গেছিল। সেখানে বসে গান শুনতে শুনতে কখন যে চোখ লেগে গেছে। তা চোখেরই আর দোষ কী বলো? পরিশ্রম বলো, ধকল বলো, স্ট্রেস বলো— কম তো যায়নি আজ! হাতে-পায়ে-মাথায় অসহ্য ব্যথা। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ লেগে গেছে তাই। শাম্বকে অমন ধুলোমলিন দশায় মন্দিরের এক কোনায় ঘুমে ন্যাতাপ্যাতা দেখলে ওর মায়ের যে কী কষ্টটাই হত!
কষ্টটা কেন যেন বিনু ধোপানীরও হচ্ছিল। অভ্যেসমতো একা-একাই অনেকক্ষণ বিড়বিড় করেছে। কাদের বাড়ির ছেলে গো? অমন গোরাচাঁদের মতো গায়ের রঙ! কেমন করে দেয়ালে মাথাখানা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে! মুখখানা কেমন যেন শুকনো। চোখের কোলে জলের শুকনো দাগ। প্যান্টে, জামায় কাদা শুকিয়ে আছে। ব্যাগটাকে কেমন আঁকড়ে ধরে!
বিনু ধোপানীর এরকম বিড়বিড় করার অভ্যেস আছে। তবে গোঁড়া বৈষ্ণব সে। কৃষ্ণ ছাড়া জীবনে তার কিছু নেই। সুতি নদীর পাড়ে থুত্থুড়ে এক কুটির তার। তবু মাটির দাওয়া, তুলসি মঞ্চ একেবারে তকতক করে। করবে নাই-বা কেন? ভোর না হতেই তার কাজ শুরু হয়ে যায় যে! আলো ফোটার আগেই পরিচ্ছন্ন হয়ে ঘরে গোপালের ভোগ দিয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর আসে এই মন্দিরে। শ্যামরাইয়ের দর্শন সেরে গুনগুন করে কৃষ্ণনাম করতে করতে সুতির চরে ঘোরে। এই সময় হয়তো ধীরে ধীরে আকাশ লাল হয়। গাছের মাথা চুমে শিশু রোদ্দুর নেমে আসে সুতির জলে।
এই সময়টা বড়ো নরম। নির্জন নদীর তীরে তো আরও অকৃত্রিম। এই সময়টায় মনে হয় যেন এই সেই গোকুল। সেই যমুনাতীর যেন কিছুমাত্র বদলায়নি। এই যে কুলকুলিয়ে বইছে ক্ষীণতোয়া সুতি, সে কি পুণ্যতোয়া যমুনা নয়? হয়তো খানিক দূরেই নন্দরানির কোলে হাসছেন সেই দেবশিশু। সেই ভুবনভোলানো হাসি, যে হাসিতে নিমেষে ঘায়েল হবে গোপিনীর দল! ঘায়েল হবে কত না পূতনা, অজাসুর, বকাসুর, কালীয়।
বিনু ধোপানী মন্দির থেকে নেমে সুতির চর ধরে হাঁটে। আঁচলের গিঁট থেকে খুদ বের করে ছড়িয়ে দেয় চরে। পাখির দল ঝাঁক বেঁধে উড়ে এসে খুঁটে খুঁটে খুদের দানা খায়। কোমর পড়া ন্যুব্জ বিনু ধোপানীকে কেউ তারা ভয় পায় না। ফড়ফড়িয়ে ওড়ে বিনু ধোপানীকে ঘিরে। বিনু হাতের চেটোয় খুদ ধরে। ছোটো ছোটো পাখিগুলো বিনুর কবজিতে বসে খুঁটে খায়, কাঁধে বসে অপেক্ষা করে। এ-দৃশ্য যে একবার দেখেছে তাকে ফিরে ফিরে আসতেই হবে দেখতে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, কেউ কি দেখেছে? কার কোন দরকার বলো তো এই নির্জন সুতির চরে ভোর হওয়ার আগে এসে থুত্থুড়ি বিনু ধোপানীকে দেখবার? মানুষের এত সময় কোথায়? মানুষ ঈশ্বরকেই ডাকে নিজের সময় হলে, সেখানে আবার বিনু ধোপানীর পাখি খাওয়ানো দেখতে আসা!
অবশ্য একজন কিন্তু রোজ আসেন। রোজই আসে। ঘোষালবাড়ির বড়ো জামাই অমিত। কথায় বলে, আহাম্মক ছয় যে ঘরজামাই রয়। অমিতকে কি আহাম্মক বলা চলে? না। আহাম্মক সে নয়, বরং পরোপকারী। বিরাট বাগানবাড়িতে একা শাশুড়িকে রেখে সে কোত্থাও যেতে পারে না। একে যদি আহাম্মকী বলা যায় তাহলে সে আহাম্মক! সে তুমি যাই বলো অমিত রা কাড়বে না। পত্নীবিয়োগের সঙ্গে-সঙ্গেই সেই যে তার কথা বন্ধ হয়েছে, আজ অবধি আর তার গলার স্বর শোনেনি এ-গাঁয়ের লোক।
নিত্যদিন একটু দূর থেকে অমিত বিনু ধোপানীর পাখি খাওয়ানো দেখে, খাওয়ানো শেষ হলে বিনুকে নিয়ে এসে বসে চর যেখানে শেষ হয়ে পাড়খানা উঁচু হয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেইখানে এক হেলে পড়া কদমগাছের ডালে। কাঁধের ফ্লাস্ক থেকে গেলাসে ঢেলে চা দেয় বুড়িকে। সেই নরম লাল আলোর ভোরে স্টিলের টোল খাওয়া গেলাসে লাল চা খায় ঘোষালবাড়ির বড়ো জামাই অমিত আর ন্যুব্জ বিনু ধোপানী। কেন যে রোজ অমিত আসে আর কেনই যে বিনুকে চা খাওয়ায় কে জানে। বিনু ধোপানী ফুঁ দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে চা খায় আর মৃদু স্বরে কত কী যে বলে চলে কে জানে।
সুতির জলে গেলাস দুটো ধুয়ে এনে ফেরত দেয় অমিতকে। একবার নিজের কপালে হাত ছোঁয়ায় আর একবার সস্নেহে অমিতের কপালে ঠেকায়। বিড়বিড় করে কী যেন বলে। বাহুল্যবর্জিত এই স্নেহ দেখতে-দেখতেই নতুন সূর্য খানিক বড়ো হয়ে ওঠে, লাল নিমা ছেড়ে দুধসাদা তুলোর জামাটি গায়ে দেয়।
এবার বিনুর কুটিরে ফেরার পালা। কুটিরের পিছন দিকে রাখা একটা ছোট্ট ঝুড়ি নিয়ে তাতে দুধকচুর পাতা ছিঁড়ে পেতে নেয়। একহাতে ঝুড়ি উঁচিয়ে ফের নেমে আসে সুতির চরে।
বৈষ্ণব গ্রাম। গোরু চরতে বেরোয় সকাল-সকালই। নদীর চর থেকে গোবর কুড়ায় বিনু। বাচ্চারা প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার পথে সেই দেখে ছড়া কাটে—
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ রাধারানি,
ভোরবেলাতে গোবড় কুড়ায়
বিনু বুড়ি গোবর কুড়ানি
বিনু বুড়ি গোবর কুড়ানি।
ন্যুব্জ কোমরখানা কোনোমতে উঁচু করে ঘাড় ঘুড়িয়ে চোখ কুঁচকে বুড়ি কোনো-কোনোদিন বাচ্চাদের দেখে, মুচকি হাসে, বিড়বিড় করে গান করে— হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ।
কুটিরে ফিরে বিনু তুলসি মঞ্চটিতে বেশ করে গোবর লেপে। একটুকরো উঠোন লেপে, ছোট্ট দাওয়াটি লেপে, মাটির উনুনটি লেপে। তারপর স্নান সেরে উঠোনের একপাশে রান্না চাপায়।
বিনু ধোপানী নিজে কিন্তু ধোপা নয়। ধোপার গিন্নিও নয়। তার তো বিয়েই হয়নি! বিনুর বাবা ছিল এ-গাঁয়ের ধোপা। গ্রামের প্রায় শেষ দিকে ওদের বাড়ি। বাবা মরল যখন বিনু তখন না বড়ো, না ছোটো। এমন এক বয়স যে-বয়সে আদর খেতেও ইচ্ছে হয়, আবার লজ্জাও লাগে। এমন এক বয়স যে-সময় শিশুর নরম স্বভাবটি শক্ত হতে শুরু হয়। ধ্যাদ্ধেড়িয়ে লম্বা হয়, কাঠি কাঠি হাত-পা হয়, আর বাবা-মা ছাড়া অন্যরা প্রায় কেউই সহ্য করতে পারে না।
বাপ-মাহারা বিনুকে তখন কে পড়াবে, কেই-বা বড়ো করবে আর কেই-বা বে-থা দেবে? কাকা-জ্যাঠারা তো জমিজমা, চাষবাস আর ধোপার কাজেই ব্যস্ত। আর কাকিমা-জেঠিমারা ব্যস্ত তাদের ছেলেপুলে নিয়ে, নিজের নিজের সংসার নিয়ে। কাজেই বাপের ঘরখানাও সরতে সরতে, বিনুর ঠাঁই ছোটো হতে হতে শেষ অবধি হল রান্নাঘরে। খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো ভাইবোনগুলো বড়ো হয়ে গেলে, তাদের বে-থা হলে ছানাপোনাগুলো মানুষ করার দায় পড়ল বিনুর। যখন যার ঘরে তার পালা পরে, তার হয়ে বিনু রাঁধে, ট্যাঁকে করে ছেলে সামলায়, কাঁথা কাচে, ঘর মোছে, গিন্নি না হয়েও গিন্নির দায় সামলায় আর অকথা কুকথা শোনে প্রায় সবার কাছে। এইসব করতে-করতেই তার বয়স হল। বেতো ঘোড়া আর কে বাড়িতে রাখে? নিত্যদিন তাকে নিয়ে অশান্তি, যমরাজের সঙ্গে বিনুর সমঝোতা কেন্দ্রিক গালিগালাজ। এসবের মধ্যেই যেই না বিনুর মায়ের দয়া হল, অমনি কলার পাতায় মুড়ে কলাগাছের বিছানায় তাকে ফেলে আসা হল সুতির চরে।
কই মাছের জানা বিনুর। সেরে উঠল সে। প্রথমে মন্দিরের দাওয়ায় থাকত। তারপর মন্দিরের ঘরামি নেতাই বিনুবুড়ির জন্যে এই কুটিরখানা দিলে বেঁধে। সেই ইস্তক বুড়ি এখানে। কোমর পড়ার আগে অবধি বিনু গ্রামের লোকের বাড়িতে বাড়িতে ফাইফরমাশ খাটত— কারও বাটনা বেটে দিত, কারও কুটনো কুটে দিত, বিচুলি কাটত, গোরুর জাবনা দিত, আর কাচাকাচি তো করতই। এতে করে তার খোরাকটুকু চলে যেত। তাছাড়া তার শ্যামরাইয়ের মন্দির তো আছেই।
এই হল মোটামুটি বিনু ধোপানীর ইতিহাস। ছোটো মানুষের আর কত বড়ো কথা হবে বলো!
যাই হোক, শাম্বর কথায় আসি এবার। সেই যে বলেছিলাম, শ্যামরাইয়ের মন্দিরে ধুলোমলিন শাম্বকে দেখে বিনুবুড়ির মনখারাপ হয়েছিল, তারপর বিনু টুকটুক করে গেছিল তার কাছে। নিজের বে-থা হয়নি তো কী হয়েছে, এই বাঁকা ট্যাঁকে কম ছেলেপুলে তো বড়ো হল না তার। দেখেই বুঝেছে এ-ছেলে কত যত্নে মানুষ। অথচ কেমন ধুলোকাদা মাখা। একটা হাত সে রেখেছিল শাম্বর কপালে, বেশ গরম গা। নন্দরানিতনয়ের নিত্যসেবাদাত্রী বিনু ধীরে ধীরে ডেকেছিল, “গোপাল! গোপাল!”
ধড়মড় করে উঠেই বিস্ফারিত চোখে তাকিয়েছিল শাম্ব। এ নামে যে দিদা ডাকে তাকে! তবে কি বাড়ির সবাই এসে গেল?
বিনুবুড়ি তাকে বলেছিল, “গোপাল, তুমি আমার বাড়ি চলো।”
সে-ডাকে হয়তো বড়ো আপনার সুর থেকে থাকবে, হয়তো এমন মমতা থেকে থাকবে যে শাম্বর একবারও কিছু মনে হল না। যে শাম্ব অচেনা কারও ডাকে সাড়া অবধি দেয় না, মনের ভিতরের কথা মুখ অবধি আনতে পারে না, সে-ই কিনা অচেনা অজানা কোমর পড়া বিনুবুড়ির এক ডাকে তার সঙ্গে চলে গেল!
বারো
জমা জলেও ঢেউ ওঠে, আর লোকে সুযোগ পেলে কথা বলবে না তা কি হয়? জীবনে যার কোনোকিছুই পূর্ণ হল না, যার বে-থাই হল না, বাপের ঘরের কুটোটা না জুটলেও সেই বাপের ঘরের পরিচয়ে সে অভাগিনীকে ধোপানী পরিচয় লোকে দেয় দিক গে, আমরা এখন থেকে বিনুকে তার বাবার দেওয়া নাম ধরেই ডাকব।
কানাই ধোপার একমাত্র মেয়ে যখন জন্মাল, কানাইর তখন রমরমা না হলেও গাঁ-ঘরে যেমন হলে মোটামুটি না চেয়ে মেগে দিন কাটানো যায় তেমন অবস্থা ছিল। কীর্তনের দলে শ্রীখোল বাজাত কানাই। নানা বাড়িতে, নানা গ্রামে বাজাতে যেত। কেবল মনে হত সে নিজে হয়তো পারেনি, কিন্তু তার সন্তানকে ঠিক লেখাপড়া শেখাবে। কিন্তু সবকিছু তো আর সাধমতো হয় না! রোগের ঠেলায় কাজকাম বন্ধ করে যবে থেকে কানাই শয্যাশায়ী হল, তখনই তার মেয়ের লেখাপড়ায় ইতি। কত আর বয়স তখন মেয়েটার, এই পাঁচ-ছয় হবে! হতভাগিনীর মাও প্রায় হঠাৎ করেই চলে গেল মেয়েটাকে ওই আট-ন’ বছরের রেখেই। এরপরেও রুগ্ন কানাই আরও বছর পাঁচেক ছিল। বিনা চিকিৎসায় কেবল জ্ঞাতিদের শাপশাপান্তে ভর করে যে কেমন করে বেঁচে থাকা যায়, সে বোধ হয় কানাইর মতো গরিব মানুষ ছাড়া কেউ বুঝবে না।
বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আর কেউ মেয়েটাকে পুরো নাম ধরে ডাকেনি। বীণাপাণি বাউরি থেকে বিনু, বিনু থেকে বিনু ধোপানী, বিনু ধোপানী থেকে বিনুবুড়ি। বর্ষা বৃষ্টি পিছল তার জীবন পথ। এবড়ো-খেবড়ো। দুচ্ছাই ভরা। সে যাই হোক, মায়াভরা তার মন। নইলে পরের ছেলেমেয়েকে, এত ছেলেমেয়েকে কোলে কাঁখে মানুষ করতে পারে? মায়া না থাকলে অচেনা অজানা শাম্বকে নিজের ঘরে এনে তোলে? নিজেরই জোটে না যার সে কিনা যেচে দায় নেয় আর এক ছেলের?
এমন মায়াভরা মন যার, তাকে আমরা আর অমন তাচ্ছিল্যের নামে ডাকতে পারি? ডাকব না। ডাকব বীণাপাণি নামেই।
বীণাপাণির পাতার কুটির। ঠিক যেন রূপকথার দুয়োরানির কুটির। তফাত কেবল রাজা আসবেন না কোনোদিন।
তাই কি? রাজা না আসুক, রাজার ছেলে রাজপুত্তুর তো এসেছে। শাম্ব কি বীণাপাণি বাউরির কাছে রাজপুত্তুর থেকে কিছু কম? সেই যে এনে কুটিরে তুলল, সেই যে ফাইবারের সবুজ বাতার দরজাখান ক্যাঁচকেঁচিয়ে ঠেলে একমাত্র তক্তপোশখানায় বসাল, সেই যে পরিষ্কার কাপড় ভিজিয়ে শাম্বর মুখখানা হাতখানা মুছিয়ে দিতে দিতে জামার নীচে ঘাড়ের কাছে পৈতেখানা দেখল, সেই যে জ্বরক্লান্ত, ধকল ক্লান্ত, পলায়ন ক্লান্ত বীর শাম্ব ‘দিদা’ বলে তার কাঠের তক্তপোশ, কাঁথার বিছানায় নেতিয়ে পড়ল, সেই ইস্তক বীণাপাণি বাউরির কাছে সে রণক্লান্ত রাজপুত্তুর বই আর কেউ নয়।
বৃদ্ধা বীণাপাণির তাই কত কাজ! রাজপুত্তুরের শুশ্রূষা করতে হবে, রাজপুত্তুরের পথ্যির জোগাড় করতে হবে। তাকে যে দিদা বলে ডেকেছে রাজপুত্তুর! দিদা যে মায়েরও মা! দায় কি তার কম?
জ্বরে বেহুঁশ শাম্বর মাথায় অনেকক্ষণ ধরে জলপট্টি দিল বৃদ্ধা। গরিবের ঘরে পোলাপান টানতে টানতে জীবন কেটেছে। জ্বরজ্বালা তার কাছে নতুন নয়। তাছাড়া নানান রোগের বেশ কিছু ওষুধ সে জানে। টোটকা জানে। এখনও গ্রামের অনেকেই ওষুধ নিতে আসে তার কাছে। ওষুধের জন্য পয়সা নেওয়া বারণ। মায়ের কাছ থেকে পাওয়া এইসব ওষুধ। মা বারণ করেছে ওষুধ দিয়ে পয়সা নিতে। মা কোত্থেকে এসব ওষুধ পেল, তা জানার সময় পায়নি বৃদ্ধা। যে বয়সে এসব জানার জন্য আগ্রহ হয় সে-বয়সে পৌঁছনোর আগেই মাহারা হয়েছে।
শাম্বর লক্ষণ দেখে ওষুধ দিয়েছে বীণাপাণি। জ্বর খানিক নেমেছেও। হুঁশ ফিরতে ধড়ফড় করে উঠেছে। বীণাপাণি ওর বুক-পিঠ সাপটে দিতে দিতে বলেছে, “ভয় নাই, ভয় নাই ভাই! আমি আছি তো!”
বড়ো বড়ো চোখে বীণাপাণিকে দেখেছে তাঁর রাখালরাজা, রাজপুত্তুর। কুটিরের চারপাশ দেখেছে, দেয়ালের মাথা জাগানো তালের বাতায় গোঁজা হ্যারিকেন দেখেছে, ঘরের কোণে ট্রাংক দেখেছে, ট্রাংকের উপরে রাখা তার লাল রঙের পিঠব্যাগখানা দেখে দিদার কাছে জল চেয়ে খেয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে।
বীণাপাণির হয়েছে জ্বালা। এমন জায়গায় তার কুটির যে সেখানে খুব একটা কেউ আসে না, সন্ধের পরে তো প্রশ্নই নেই। এদিকে রাজপুত্তুরের জন্যে যে একটু দুধ লাগে, একটু বার্লি লাগে, একটা পাঁউরুটি লাগে— সে-সব কে এনে দেবে? নিজে গিয়ে যে আনবে তার তো উপায় নাই। এ-ছেলের ঘুম ভাঙলে সে যে এই শরীরেই এখান থেকে সরে পড়বে সে বীণাপাণি বিলক্ষণ জানে। দুয়ারের ফাইবারের দরজা দুই হাতে ধরে কষ্ট করে কোমর উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বীণাপাণি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছে আবছা অন্ধকারে ঢাকা চরের দিকে, যদি কারও দেখা মেলে। একমনে ডেকে যাচ্ছে আরাধ্য শ্যামরাইকে।
ভগবান আছেন কি নেই, সে-চিন্তা করে ঘুম উড়াক পন্ডিতেরা। আমরা যারা ধুলোকাদার মানুষ, আমাদের সে-সব তত্ত্বজ্ঞানে কাজ নেই, আমাদের আছে বিশ্বাস। তিনি আছেন সেও যেমন বিশ্বাস, তিনি নেই সেও এক বিশ্বাস। সবটাই শোনা কথা আমাদের। দেখিনি বলে নেই যেমন বলতে পারি না, তেমনি আছেই-বা বলি কেমন করে? কথায় কথা বাড়ে। ধুলোবালির মানুষ, এই সব দ্বন্দ্বে ধন্দে গিয়ে কাজ নেই, বরং কাজের কথায় আসি।
বীণাপাণির ঈশ্বরে বিশ্বাস তো আর বিশ্বাস নয়, প্রত্যয়। হয়তো-বা সেই প্রত্যয়ের ফলস্বরূপ এই অসময়ে দেখা মিলে গেল অমিতের। দুই হাতে দুই ঘট নিয়ে নামছিল অমিত সুতি নদীর দিকে। বোধ হয় জোয়ারের জল নেবে। অমিতকে দেখেই বীণাপাণি নাম ধরে ডাকতে শুরু করল। কাছে যেতেই বৃদ্ধা তাকে দুধ, বার্লি, পাঁউরুটি এনে দিতে বলল। অমিত খানিক অবাক হয়ে বৃদ্ধার দিকে তাকাল। তারপর কথা না বাড়িয়ে হাতের ঘট দুটো তুলসিতলায় নামিয়ে রেখে বেরিয়ে পড়ল। ফিরে জিনিসগুলো বীণাপাণিকে বুঝিয়ে দিতে বৃদ্ধা প্রত্যেকটা জিনিসের দাম মিটিয়ে দিল। আশ্চর্য হল অমিত। বৃদ্ধার কপালে হাত রেখে নিজের মনেই বলল, ‘কই, কিছু তো হয়নি!’
বৃদ্ধা বীণাপাণি সন্ধে রাত থেকে বার দু-এক বার্লি দিল শাম্বকে। গাছ থেকে লেবুর পাতা এনে বার্লিতে মিশিয়েছে সে। শাম্ব কখনও এর আগে এ-জিনিস খায়নি। লেবুর গন্ধে খুব খারাপ লাগছিল না খেতে। অবশ্য খারাপ লাগলেও খেতেই হবে, না-হলে দাঁড়াবে কী করে! তাছাড়া বীণাপাণির শুশ্রূষা এতই আন্তরিক ছিল যে মা, ঠাকুমা, দিদাদের মতনই মনে হচ্ছিল ওকে। রাতে দুধ-পাঁউরুটি খাইয়ে কৌটো থেকে ক্ষীরের ছাঁচ বের করে খাইয়েছিল শাম্বকে।
অনেক রাতে জ্বরের ঘোরে ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে শাম্ব অনুভব করছিল বীণাপাণির শীতল হাত ছুঁয়ে আছে তার গরম কপাল। যেন শুষে নিচ্ছে সব কষ্ট, সব তাপ তপ্ত শরীরটা থেকে। মায়ের মুখটা ভেসে উঠছে বার বার। কী কষ্টই না পাচ্ছেন মা শাম্বর এই নির্বুদ্ধিতায়। হায় রে!
উষ্ণ জল নেমে এসেছিল শাম্বর চোখের কোল থেকে। সরু সরু আঙুলে জল মুছে দিতে দিতে কাঁপা কাঁপা গলায় বীণাপাণি বলেছিল, “ঘুমাও গোপাল। ঘুমাও লক্ষ্মী দাদা আমার। আমি তো আছি!”
তেরো
বীণাপাণিকে সবকথাই বলেছে শাম্ব।
এই চলমান উন্নতির দুনিয়াতেও প্রাচীন গাছের মতো বীণাপাণি কী যে বুঝেছিল সে-কথা থেকে তা বলা মুশকিল। শুনেছিল মন দিয়ে। তবে কিছু তো নিশ্চয়ই বুঝেছিল, না-হলে বলবে কেন, “তুমি ভেবো না গোপাল। দিদার কাছে নিশ্চিন্তে থাকো।”
অচেনা অজানা জায়গায় এমন পর্ণকুটিরে দরিদ্র বৃদ্ধা বীণাপাণির কথায় কী এমন আশ্বাসের ছোঁয়া ছিল যা কিনা তপ্ত উদ্ভ্রান্ত মনকে শান্ত করতে পারে? নাকি বিভ্রান্ত দিক্ভ্রান্ত শাম্বর এই নিরাল নির্জন আশ্রয়টুকুর প্রয়োজন ছিল বলে সে আশ্বস্ত হল? কে জানে!
বীণাপাণির কাছে কেটে গেল নিস্তরঙ্গ দুটো দিন। শরীরও অনেক ঠিক। ভোর হলেই এখন নিমের ডাল হাতে সুতির চরে যায় শাম্ব। একাই ঘুরে বেড়ায়। শান্ত সুতির জলে বেগুনি পানার ফুল শাম্বকে প্যাটপেটিয়ে দেখে যায়। বৃদ্ধা বীণাপাণি কাজ করে চলে কুটিরে। শাম্ব দেখে। বৃদ্ধা শাক ভাজে, আলু ভাজে, মুগের ডালে ফোড়ন দেয়, শুষনি পাতায় তেঁতুল দিয়ে টক রাঁধে। কলার মাঝ-পাতায় সাজিয়ে প্রায় পাঁচ পদেই ভোগ দেয় তার রাজপুত্তুরকে।
শাম্ব খায়। ভাঙা তালপাখা নেড়ে বাতাস করে বীণাপাণি। চেয়ে থাকে শাম্বর দিকে, শাম্বর পৈতের দিকে। হয়তো ভাবে নিজের সৌভাগ্যের কথা, বীণাপাণি বাউরির বাড়িতে বামুন সন্তান! খাঁটি রাজপুত্তুর। হয়তো কিছুই ভাবে না, কেবল শাম্বর দিদা ডাক যেন বৃদ্ধাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।
মানব মন এক আজব দেশ। আজব গতিময়। কেউ সোনার স্তূপেও অসন্তুষ্ট, আবার কেউ কিছু না থেকেও সন্তুষ্ট। এখানে এক আশ্চর্য মিথোজীবীতা। বৃদ্ধা বীণাপাণির হাতে খেয়ে, তার মমতার সান্নিধ্যে শাম্বর উদ্ভ্রান্ত মন তুষ্ট; আবার শাম্বকে খাইয়ে ধুইয়ে বৃদ্ধা বীণাপাণির একাকিত্ব মোচনের তুষ্টি।
অমিত এসেছে বেশ কয়েকবার। বীণাপাণি শাম্বর পরিচয় দিয়েছে নাতি বলে। পুরোপুরি বিশ্বাস পায়নি অমিত। তবে বৃদ্ধার কথা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করতেও মন চায়নি তার। তবে শাম্বকে অমিতের খুব ভালো লেগেছে। ওকে নিয়ে বিকেলবেলায় সুতির চরে ঘুড়িও উড়িয়েছে।
শাম্বর কথা ভাবো একবার! এই প্রথম উড়ন্ত ঘুড়ির টান আঙুলে পেয়েছে শাম্ব। উড়ন্ত ঘুড়ির টান! উড়ন্ত ঘুড়ি ছুঁয়ে আকাশের নীল। অনন্ত আকাশের টান। সেই টান অনুভব করেছে শাম্ব নিজের আঙুলে! আনন্দ না হয়ে পারে?
অমিত একদিনেই গোঁত্তা খাওয়া ঘুড়ি ঢিল দিয়ে টেনে ঊর্ধ্বমুখী করার কায়দা শিখিয়ে দিয়েছে শাম্বকে। কথা বলে না বটে, তবে অসাধারণ শিক্ষক অমিত। মেধাবী ছাত্র বটে শাম্ব। শিখে নিতে একটুও দেরি হয়নি। আকাশ ছোঁয়ার আনন্দে বার বার টেনে গেছে মাঞ্জা দেওয়া সুতো।
নীল আকাশে পতপত করে উড়েছে শাম্বর ঘুড়ি। পাশ দিয়ে শেষ বিকেলের রঙে স্নান করে উড়ে গেছে ধবল বক। বৃদ্ধা বীণাপাণি স্বস্তির দৃষ্টিতে ফাইবারের বাতার ক্যাঁচকেচে দরজা দুই হাতে ধরে কোমর উঁচু করে দেখেছে তার রাজপুত্তুরকে। দ্বারাবতীর রাজার রাজা, তার প্রাণের শ্যামরাইয়ের কাছে প্রার্থনা করেছে, ‘আমার গোপালটাকে দেখো।’
মূক অমিত কেবল একবার দেখেছে আনন্দে ভাস্বর শাম্বকে, আর একবার দেখেছে পরিতৃপ্ত বীণাপাণিকে। তারপর স্মিত হেসে গুটিয়েছে লাটাই, সুতোয় একটুও জট পাকাতে দেয়নি।
চৌদ্দ
সেই যে সেদিন অমিত ঘটে জোয়ারের জল নিতে এসেছিল মনে আছে? সে কিন্তু নিত্যপুজোর জন্যে নয়। ঘোষালবাড়ির রীতি মেনে আষাঢ়ের সপ্তম দিনে ধরিত্রীমায়ের পুজো হয়, সেই পুজোর জন্যই এই জল ধরা।
সাধারণত বাড়ির এয়োরাই এ-কাজের অধিকারিণী। কিন্তু ঘোষালবাড়িতে এখন এয়ো কোথায়? বাসিন্দা বলতেই তো এখন দুজন— ঘোষাল গিন্নিমা আর অমিত। অমিতের স্ত্রী তো সেই কবেই চলে গেছে গ্রামীণ হাসপাতালের ভুল চিকিৎসায়। বাড়ির আর সব সদস্যরা সবাই শহরে। তবু ঘোষালগিন্নির বড়ো মেয়ের চিকিৎসা শহরে হতে পারেনি। শাশুড়িমাকে একা ছেড়ে যেতে পারেনি অমিত। ঘোষাল গিন্নিমার স্নেহ তাকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
অত বড়ো বাড়িটায় দুটো মাত্র মানুষ। কুলপুজোর এই সময়টায় অবশ্য দু-দিনের জন্য ছবিটা বদলায়। দল বেঁধে সবাই চলে আসে। ঘোষালগিন্নির আর দুই মেয়ে, তাদের জামাই, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজনে বাড়ি একেবারে গমগম করে।
এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঘোষালবাড়ির সব ঘর এখন ভরতি। ছেলেমেয়ের দল কলকলিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। নীচে ঠাকুরঘরে পুজো শুরু হয়েছে। উঠোনের একদিকে ম্যারাপ বেঁধে ঝাঁকড়া-চুলো সুধীরঠাকুর দলবল নিয়ে রান্না শুরু করেছে। ফোড়নের ঝাঁজ আর কাঠের ধোঁয়ায় সেদিকে যাওয়া দায়। মেজো জামাই, ছোটো জামাই চারদিকে তদারকি করছে। ঘোষালগিন্নির ননদাই জীতেনবাবু তুমুল আমুদে মানুষ। তিনি আর তাঁর ভাই হিতেনবাবু বাড়ির কাচ্চাবাচ্চাদের একসঙ্গে নিয়ে কী যেন কী একটা করছেন। পুজো হচ্ছে যে-ঘরে, ঠিক তার পাশের ঘরেই বিজয় বণিক তার সম্প্রদায় নিয়ে থানা গেড়েছে। সন্ধেবেলা ত্রিনাথের মেলা বসবে এ-ঘরে। মাঝে-মাঝেই সে-ঘর থেকে বেহালার ছড় টানার, খোলে হাতুড়ি ঠোকার, হারমোনিয়ামের, ক্ল্যারিওনেটের পোঁ ভোঁ মিলে এক বেসুরো কনসার্ট ভেসে আসছে। বিজয় বণিকের কারবারই এই। জানে তার গান শুরু করতে হবে সন্ধের পর, তবু দলবল নিয়ে একেবারে সাতসকালে হাজির। এসেছে যখন দুপুরের সেবা পর্যন্ত এমন ধারা চলবে। তারপর দ্বিপ্রাহরিক সেবা দেওয়া হয়ে গেলে ও-ঘরেই টানটান হবে তার দল। তারপর সন্ধেবেলা উঠে যন্তর বেঁধে তেড়ে কনসার্ট। শেষে শুরু হবে ত্রিনাথের মেলার গান আর কথকতা। এই চলে আসছে বছর বছর।
এখানে আজ কতজনের যে নেমন্তন্ন! অমিতের নেমন্তন্নে বীণাপাণি বাউরিও এসেছে তার রাজপুত্তুরকে নিয়ে। অমিতের বাড়ি বলেই বোধ হয় শাম্বও আপত্তি করেনি। তবে আসা ইস্তক তার একটু অস্বস্তি হচ্ছে। এত লোক! তাছাড়া বেশভূষায়, কথাবার্তায় শাম্ব বেশ বুঝেছে যে এ-বাড়ির অনেকেই শহরে থাকে। কে জানে হয়তো কলকাতাতেই! এদের মধ্যে কেউ তো বাবার পেশেন্ট হতেও পারে!
বিজয় বণিকের দল যে-ঘরে আস্তানা গেড়েছে, সে-ঘরেই একটা ফাঁকা চেয়ার পেয়ে চুপ করে সেখানে বসে আছে শাম্ব। কিন্তু বীণাপাণি করছে জ্বালাতন। নতুন পাওয়া এই নাতিটিকে সে সবাইকে দেখাতে চায়। নাতি তো নয়, ন্যুব্জা অনূঢ়া বৃদ্ধার কাছে এ যেন সাতরাজার ধন এক মানিক। ‘গোপাল চলো, গিন্নিমা তোমাকে ডাকে।’ বার বার একই কথা বলে চলেছে। কতক্ষণ আর শাম্ব অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে? ঘাড় নেড়ে না বলে।
একসময় যেতেই হয়। গিন্নিমা শাম্বকে দেখে খুশিই হন। শাম্ব তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করায় তিনি খুশি হয়ে ওর চিবুক ছুঁয়ে আদর করেন। আর তক্ষুনি গলার ভিতর পৈতেগাছা চোখে পড়ে গিন্নিমার। আশীর্বাদ করে বীণাপাণিকে বলেন, “বিনু! এ তোর কেমন নাতি রে? বামুনের ছেলে তোর নাতি হল কেমন করে?”
বীণাপাণির বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। হুড়মুড় করে উঠে পড়তে পড়তে বলে, “আমার জ্যাঠার মেয়ের ঘরের গো! ওর বামুন ঘরে বে’ হয়েছিল না! নিজে থেকে বে’ করল, মনে নাই?”
ঘোষালগিন্নি খুব আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হয় না। তবে বামুনের ছেলে যখন, এমনি এমনি তো যেতে দেওয়া যায় না। অমিতকে ডেকে বললেন, “বাবা, ওকে ব্রাহ্মণ ভোজনের ঘরে নিয়ে যাও না একটু।”
বীণাপাণি বাইরে যাওয়ার উপক্রম করছিল। তাকে ডেকে বললেন, “বিনু, চললি কোথায়? প্রসাদ নিয়ে যা! তোর নাতি খেয়ে আসুক, তারপর একসঙ্গে যাস। এখন এখানে বস দেখি আমার কাছে।”
বীণাপাণি স্থির হয়ে বসতে পারছে না। খালি মনে হচ্ছে গিন্নিমা এক্ষুনি ঠিক কথাগুলো বের করে নেবেন ওর পেট থেকে। অজুহাত খুঁজে বেড়ায় মনে মনে।
“কোমরটা নিয়ে বেশিক্ষণ একজায়গায় বসতে পারি না গিন্নিমা। তাছাড়া কতদিন বাদে এলাম, একটু ঘুরে ঘুরে দেখি।”
গিন্নিমা হয়তো ছাড়তেন না বীণাপাণিকে, কিন্তু তখনই নাতিনাতনিরা এসে ছেঁকে ধরল তাঁকে, আর সুযোগ বুঝে বীণাপাণিও টুক করে বেরিয়ে এল সেই ঘর থেকে।
পনেরো
শাম্বর হয়েছে জ্বালা। অমিতের সঙ্গে ভোজনঘরে আসার পথেই একেবারে প্রায় প্রত্যেক পদক্ষেপে ঘোষালবাড়ির কারও না কারোর সঙ্গে দেখা আর সবার এক প্রশ্ন— ‘ওমা! এই ছেলেটা কে রে?’ অমিতের ইশারা কেউ বোঝে, কেউ না বুঝে সরাসরি শাম্বকে প্রশ্ন করে। প্রশ্ন তো নয়, একেবারে প্রশ্নগুচ্ছ। মৃদুস্বরে দু-একটা উত্তর দেয় শাম্ব। কেউ শোনে, কেউ-বা শুনতে শুনতে সামনে এগিয়ে যায়, আবার কেউ-বা হাসতে হাসতে বলে, ‘ওমা! কী লাজুক দেখো!’ আরও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে শাম্ব। অমিত পরিত্রাতা হয়ে ওকে নিয়ে এগিয়ে চলে।
কোনোরকমে সেইসব প্রশ্নবাণ কাটিয়ে ভোজনঘরে গিয়ে হাঁপ ছাড়ে শাম্ব। ও বাবা, এ যে জ্বর সারাতে কুড়িকুষ্টি! সাত-আটজন হলদে ধুতি আর বাটিকের ফতুয়া পরা শিখাধারী ব্রাহ্মণ তাদের প্রশ্নগুচ্ছ নিয়ে একেবারে ফাল দিয়ে পড়ে। ঘোষালবাড়ির কী হয় সে, কোন ঘরের, বাড়ি কোথায়— কত যে সাত-সতেরো প্রশ্ন! একটাও উত্তর দেয় না শাম্ব। তাতে শহরের ছেলে, বড়োলোকের ব্যাটা— এরকম আরও সব চোখা চোখা বিশেষণ কানে আসতে থাকে।
ভাগ্যিস একজন এসে আসন পাততে শুরু করল। অমনি সেইসব বকবকম থেমে সেই ভিড়ে এক অভিনব ব্যস্ততা চোখে পড়ল শাম্বর। কে আগে বসবে, কার পাশে কে গিয়ে বসবে।
সবাই বসে গেলে শাম্ব ধীরে ধীরে একদম কোনায় গিয়ে বসল। খিদেটাও পেয়েছে খুব। পোলাও হয়েছে বোধ হয়। গন্ধ এসে খিদেটা আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ব্যবস্থা একেবারে তোফা! একে একে কলাপাতাবৃত শালপাতা পড়ল, জলের বোতল এল, নুন, গন্ধরাজ লেবু পড়ল। সরু চালের সুগন্ধী ভাত, ঘি, ঝুরঝুরে আলুভাজা, শুক্তো, সোনা মুগডাল, উচ্ছে ভাজা, বেগুন ভাজা, কুমড়োর পাট ভাজা, পটল ভাজার শেষে পুষ্প পোলাও, চাল পটল, ছানার ডালনা, পনির কোপ্তা, ধোকার ডালনা, চাটনি, পায়েস। তার পরেও সবাই না হলেও গড়ে তিনবার করে চেয়ে চেয়ে দই, সন্দেশ আর রসগোল্লা খেল। শাম্ব খেল না। পায়েসের স্বাদটা এত দারুণ যে সেটা নষ্ট করতে চাইল না।
খাওয়ার পর গিন্নিমা নিজে এসে পিতলের ছোটো ছোটো রেকাবিতে সবাইকে ফল, পৈতে, গীতা আর দক্ষিণা দিলেন। শাম্বকে দিলে শাম্ব প্রণাম করল। শাম্বকে আশীর্বাদ করে বললেন, “ভালো থাকো, বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল কোরো।”
বাবা-মায়ের কথা শুনে মনটা আবার উদাস হল শাম্বর। কী যে করছেন বাবা-মা!
ঘর থেকে বেরোতেই শাম্ব সটান পড়ল জীতেনবাবুর সামনে। কচিকাঁচার দলবল নিয়ে হইহই করে তিনি যাচ্ছিলেন যেন কী কাজে। আগেই বলেছি, তিনি ভারি আমুদে মানুষ। থাকেন দক্ষিণ কলকাতায়। কথায় কথায় বলেন, ‘জানিস, আমি শরৎ চাটুজ্যের প্রতিবেশী?’ টাইমলাইনটুকু না ধরলে তা অবিশ্যি ভুল কিছু বলেন না। ওঁর বাড়ি তো অশ্বিনী দত্ত লেনে। সেই পাড়াতেই তো শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই বাড়ি, যে-বাড়িতে তাঁর শেষ দিনগুলো কেটেছে। যাঁর জন্য গোটা দেশবাসীর গর্ব, সেই অবিস্মরণীয় লেখকের একই পাড়ার বাসিন্দা বলে দীর্ঘবপু, দীর্ঘোদর জীতেনবাবুর এই অভিমানটুকু তো ন্যায্যই।
শাম্বকে দেখেই জীতেনবাবু খপ করে তার হাতখানা ধরে বললেন, “এই তো পেয়েছি! আমার নাটকে তুমি যে আমার কেষ্টঠাকুর বাপু।”
জীতেনবাবুর চ্যালা-চামুণ্ডারাও একেবারে হইহই করে উঠল।
শাম্ব যত হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে, জীতেনবাবু তার মোটা থাবায় তত আঁকড়ে ধরেন।
শাম্ব যত বলার চেষ্টা করে, ‘না, না! আমি জীবনে নাটক করিনি। আমাকে ছেড়ে দিন।’ কেউ শোনেই না! জীতেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে মুখে একগাল হাসি টেনে বলেন, “উঁহু বাওয়া! ওটি তো হচ্ছে না। পেয়েছি যখন ছাড়ব না!।” বলতে বলতে ওর হাত ধরেই দুলে দুলে খোলা গলায় গান ধরেন—
যেতে দোব না
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখব যেতে দোব না
তোমায় মঞ্চ মাঝে রাখব যেতে দোব না
নিজেই গান, নিজেই হ্যা হ্যা করে হাসেন। তারপর ‘চলো সবাই’ বলে হুংকার দিয়ে শাম্বর হাত ধরে প্রায় টানতে-টানতেই ঢুকে পড়েন একতলার একেবারে কোণের দিকে একটা ঘরে। সে-ঘরে আরও সব কাচ্চাবাচ্চা, আরও যেন বড়ো কয়েকজন— একেবারে হট্টমেলা। পুরোনো একটা হারমোনিয়ামের ধুলো ঝাড়ছে এক মেয়ে, সুর বাঁধার নামে একটা নালে তেড়ে চাটাচ্ছে দুই যমজ ভাই। নালটা বোধ হয় বিজয় বণিকের দলের, ও-ঘরে এটা দেখেছিল শাম্ব। মেয়েটি ঘোষালগিন্নির মেজো মেয়ের বড়ো জায়ের আর যমজ দুটি সেজো জায়ের। যেই না অমন হুড়মুড়িয়ে শাম্বকে নিয়ে সদলবলে জীতেনবাবু সে-ঘরে প্রবেশ করলেন, সব একেবারে যেন হেঁচকি তুলে থেমে গেল।
সেই নিস্তব্ধতা ছিন্ন করে যাত্রার মারকাটারি টোনে প্রায় সংলাপসদৃশ কথা বলতে বলতে ঘরের কোণ থেকে এগিয়ে এলেন অবিকল জীতেনবাবুর মতো দেখতে অপেক্ষাকৃত শীর্ণদেহী আর এক পুরুষ—
“কে এই বালক?
আয়তচক্ষু উদাম কেশ,
স্মিত হাস্য স্নিগ্ধ বেশ!
প্রহরী! এ কাহাকে আনিলে দুয়ারে?
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে!”
সেই একই টোনে জীতেনবাবু আবৃত্তি করে উঠলেন—
“কোনোদিকে নাহি চায়
ঢেউগুলি নিরুপায় ভাঙে দু-ধারে
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে!”
প্রত্যুত্তরে ‘বু-হু-হু-হা-হা-হা’ করে অট্টহাস্য করে সেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন—
“চিনিয়াছি, চিনিয়াছি! তুমি সেই ব্রজের বালক!
দেবকী তোমার মাতা, নন্দ পালক!
জানি কী ফন্দি লয়ে এলে মথুরায়!”
অনুচরবৃন্দ সবাই সমস্বরে বলে উঠল—
“গো ব্যাক! গো ব্যাক! হায় হায়! হায়!”
জীতেনবাবু ধমক দিয়ে বলে উঠলেন—
“ইয়ার্কি হচ্ছে?
এখানে কি পলিটিকাল ড্রামা চলছে?”
সেই ভদ্রলোক শান্তভাবে বললেন—
“না হে, না হে মুচকুন্দ! যা দিনকাল!
ঘরোয়া নাটক হবে অ্যাপলিটিকাল!”
জীতেনবাবু দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলেন—
“অ্যাই হতভাগা! মুচকুন্দ কে র্যা!
ভুলে গেলি আপন দাদার নাম!
ঘোর কলি! ঘোর কলি!
আরে ছো ছো! রাম রাম!”
ঘাড়-টাড় নেড়ে সেই ভদ্রলোক বললেন—
“আমি নহি! আমি নহি!
শ্রীকৃষ্ণ সকাশে হে প্রহরী
তুমি নিজে ভুলিয়াছ তব নামধাম!
ভুলিয়াছ মুচকুন্দ তুমি, মম খাস প্রহরী!”
অনুচরবৃন্দ পোঁ ধরলে—
“হরি হরি, হরি হরি!”
দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে জীতেনবাবু প্রায় ধমকে উঠে বললেন—
“ওরে থাম! বেহুলো যত-বা বাজে পোঁ বাজে বেশি!
কাজের কথাটি শোন, নইলে খাবি ঘুসি।
নৃত্যনাট্য হইবে এইবার, নাম চিত্রাঙ্গদা
এই হবে অর্জুন। বুঝলি রে হাঁদা?”
মুহূর্তে এক্সপ্রেশন পালটে চোখ বিস্ফারিত করে সেই ভদ্রলোক শাম্বর দিকে ধেয়ে এসে চোখ নাচিয়ে নাচিয়ে গাইতে থাকলেন—
“অর্জুন, তুমি অর্জুন!”
লোকটা খানিক আগে ওকে চেনেন বলছিলেন বলে একটু ভয় ভয় লাগছিল বটে, কিন্তু এখন সব মিলিয়ে মজাই লাগছে শাম্বর। ভদ্রলোক যখন নাচের ভঙ্গিমায় এক পাক ঘুরে ফের ‘অর্জুন, তুমি অর্জুন!’ বলে গেয়ে উঠলেন, অমনি শাম্বও গেয়ে উঠল—
“নহি অর্জুন, নহি অর্জুন আমি, শাম্ব
অর্জুন সাজা নহে মোটে মোর কম্ম।”
“ব্রাভো! ব্রাভো!” বলতে বলতে সেই ভদ্রলোক মানে হিতেনবাবু ওর পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন—
“এই তো! দাদা হীরা খুঁজে আনলিরে!
বল দেখি পেলি কোথা এই চাঁদটিরে?”
নিজের ফতুয়ার গলার কাছ দুটো দু-আঙুলে খানিক চাগিয়ে জীতেনবাবু বললেন—
“জহুরির চোখ রে ছোটো ভাই,
দেখ কেনে নিয়ে এনু ব্রজের কানাই।
পরিচয় হয়ে যাক এবে
আয় দোঁহে বন্ধ করি ধানাইপানাই।”
বলে নিজেই নিজের কথায় হো হো করে হেসে উঠে বললেন, “নাও আমিই শুরুটা করি। শোনো হে বাপু, আমি হলাম জীতেন চক্কোত্তি আর এ আমার ছোটো ভাই হিতেন চক্কোত্তি। আর এই যে আর সব কুশীলব, দেখে নাও এই আমাদের নতুন মেম্বার, মেধাবী ছোকরা।” বলেই শাম্বর দিকে ফিরে বললেন, “ওই যাহ্! তোমার নামটাই তো জিজ্ঞেস করিনি! তা তুমি নিজেই নিজের ইন্ট্রোটা এদের দিয়ে দাও তো ব্রাদার।”
ষোলো
শাম্বর বাবা-মাও তো বসে নেই।
সেদিন তো রাত ভোর না হতেই শাম্ব বেরিয়ে এসেছিল। কেউ তখনও ওঠেননি।
তাই কি? এমন ভাবনাটা তো ছিল শাম্বর। ভাবার কারণও অবশ্য ছিল। পড়ুয়া বাড়ি, শুতে রাত হয়, কাজেই এ-বাড়ির সকাল হতে তা একটু দেরিই হয় বরাবর। তাছাড়া তখন শাম্বর যা মানসিক অবস্থা ছিল, তাতে কেউ জেগে দেখছে কি না সে-সব তার বিবেচনায় আসার সম্ভাবনা কিছু ছিল না।
তবে সেদিন শাম্বকে বেরিয়ে যেতে কিন্তু দেখেছিলেন একজন। শাম্বর দাদু। চলচ্ছক্তিহীন বৃদ্ধ হয়েছেন বলে অবশ্য নিয়মমাফিক খাওয়ানো-দাওয়ানো, ওষুধ-বিষুধ দেওয়া ছাড়া তাঁকে সেরকম ধর্তব্যে কেউ তেমন রাখেন না। কিন্তু ভুললে চলবে না, চলতে না পারলেও দাদুর মাথাটি কিন্তু এখনও বেশ চলে। শাম্বকে বেরোতে দেখে প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন নাতি হয়তো মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছে। কিন্তু এত ভারী একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মর্নিং ওয়াক!
দাদুকে রাতে দেখাশোনা করে ভোম্বলদা। দেখে না ছাই! দাদুর বেডের নীচে বিছানা পেতে ঘুমোয়। ভোম্বলকে ডাকতে ডাকতে তো ওঠেই না। শেষে দাদু তাঁর জলের গেলাস থেকে খানিকটা জল ওর মুখে ঢেলে দিতে একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে বসে বলল, “কী হয়েছে? বাথরুম যাবে নাকি?”
“তুই নিজে বাথরুম যা হতভাগা! মাথায় ঠান্ডা জল ঢেলে নিজের ঘুম ভাঙা!”
“তাহলে ডাকলে কেন?” হাই তুলতে তুলতে বলে ভোম্বলদা।
“গিয়ে বউমা বা খোকাকে ডাক দেখি! শাম্ব এত সকালে কোথায় গেল ওরা জানে নাকি।”
তারপর যা হয়! বাড়িময় হুলুস্থুল। বাড়ির বাসিন্দারা বিচক্ষণ বলে পারস্পরিক দোষারোপে সময় নষ্ট না করে ভোম্বলদাকে খুঁজতে পাঠিয়ে কয়েকজনকে ফোন করতে-করতেই শাম্বর বাবা-মা থানায় চলে গেছিলেন। এলাকার নামি ডাক্তারবাবুকে ওসি ভালোমতোই চেনেন, তাছাড়া এই মিনিট দু-এক আগেই ওপরমহল থেকে ফোন এসেছে ব্যাপারটা জানিয়ে। ডি. এস. পি. সাহেব আবার ড. কৃষ্ণপ্রসন্নর ক্লাসমেট। তাছাড়া আরও অনেক বড়ো কর্তার প্রায় ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান উনি। ওপর থেকে ফোন পেয়েই ওসি খবর পাঠিয়েছেন কন্ট্রোল রুমে। সিসিটিভিতে নজর রাখার কথা বলেছেন, খবর পাঠিয়েছেন প্যাট্রলে বেরোনো গাড়িগুলোতে, ট্র্যাফিক গার্ডে। আর আর্জেন্ট তলব করেছেন এস. আই. রঘুবীর পানিসরকে। নিউ রিক্রুটমেন্ট, কিন্তু প্রচণ্ড ইন্টেলিজেন্ট। মাস ছয়েক হল থানায় এসেছেন, এরই মধ্যে প্রায় গোটা তিনেক জটিল তদন্তে এমন মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন যে ওপরওয়ালারা তো বটেই, ওসি অমরেশ পালিত নিজেও খুব খুশি হয়েছেন। ছেলেটার দু-দিনের ছুটি নিজেই গ্র্যান্ট করেছিলেন গতকাল। খারাপ লাগছিল ডাকতে, কিন্তু এরকম ওজনদার কেসে ওঁকে দরকার ভেবেই ফোন করেছিলেন।
শাম্বর বাবা-মা যখন থানায় এলেন তখন ওই সাড়ে পাঁচটা মতো হবে। ওসি তাঁদের বসালেন। আইনগত যা যা কাজ সে-সব টেবিলের ডিউটি অফিসার সারতে-সারতেই এস. আই. রঘুবীর পানিসর এসে গেলেন।
ওসি সাহেব ওঁদের নিয়ে নিজের ঘরে বসলেন। রঘুবীরকে পুরো ব্যাপারটা বিশদে বললেন। আরও যা যা খুঁটিনাটি সে-সব কিছু শাম্বর বাবা-মা যতটা জানেন জানালেন। ওঁরা সঙ্গে করে শাম্বর ফটো এনেছিলেন গোটা তিনেক। সেগুলো দিলেন। রঘুবীর দেখে বললেন, “একদম ভেরি রিসেন্ট কোনও ফোটোগ্রাফ আছে?”
একটু ভেবে নিয়ে শাম্বর মা বললেন, “সফট কপি আছে মোবাইলে।”
“পাঠিয়ে দিন তো ম্যাডাম।”
রঘুবীরের মোবাইলে ছবি পাঠাতে-পাঠাতেই ওসি সাহেবের কাছে বেশ কয়েকটা ফোন এল। একতরফা শুনে মনে হচ্ছে যেন শাম্বর কথাই হচ্ছে। টেবিল ডিউটি অফিসারও এসে কিছু একটা খবর দিলেন।
শাম্বর বাবা-মা দুজনেই উতলা হয়ে উঠেছেন— কী খবর এল? পাওয়া গেছে শাম্বকে? কোথায় ছেলেটা? কত যে আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছে ওঁদের মনে, সে-সব ওরাই জানেন। কেবল মানী লোক যে, তাই প্রকাশ পেতে দিচ্ছেন না। কষ্ট করে আবেগ উৎকণ্ঠা চেপে রেখেছেন।
তবু পুলিশের চোখে কি আর কোনোকিছু চাপা থাকে?
এস. আই. রঘুবীর পানিসর ওঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। বললেন, “দুশ্চিন্তা হচ্ছে তো স্যার, ম্যাডাম? হবেই তো। ছেলে বলে কথা। বাবা-মায়ের চিন্তা তো হবেই। তবে আমি বলি কী, আপনারা খুব তাড়াতাড়ি আমাদের জানিয়ে খুব ভালো করেছেন। চিন্তা করবেন না, আশা করছি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ছেলেকে আমরা বাড়িতে পৌঁছে দেব আপনাদের।”
ডাক্তারবাবু চুপ থাকলেও শাম্বর মা থাকলেন না। ওসি সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, “বলুন না স্যার কী খবর পেলেন আমার ছেলের?”
ওসি সাহেব বললেন, “দেখুন ম্যাডাম, রঘুবীর একদম ঠিক কথা বলেছে। আপনারা তাড়াতাড়ি ডি. এস. পি. স্যারকে জানানোয় আর এখানে আসায় কাজটা খুব দ্রুত হয়েছে। অলরেডি ওকে ট্রেস করা গেছে। আপনারা ওর পোশাকের আর ওর যা বর্ণনা দিয়েছেন, আমাদের একটা প্যাট্রল ভ্যান সেই শুনে আইডেন্টিফাই করতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে। অ্যাজ পার দেয়ার ভার্সন ওরকম পোশাকের একটি ছেলেকে ওরা বাস-স্ট্যান্ডের দিকে যেতে দেখেছে। সময়টা বলছে প্রায় সওয়া চারটে। আপনাদের বাড়িটা যে এলাকায়, সেখান থেকে বাস-স্ট্যান্ড হেঁটে গেলে কতক্ষণ? আধঘণ্টামতো হবে, তাই না?”
এতক্ষণে আর সামলাতে না পেরে ওড়নায় মুখ চেপে হু হু করে কেঁদে উঠলেন শাম্বর মা। শাম্বর বাবা মাথা নেড়ে ওসি সাহেবের কথায় সায় দিলেন।
ওসি সাহেব বলে উঠলেন, “কাঁদবেন না ম্যাডাম। বললাম তো খবর পাওয়া গেছে। অলরেডি বাস-স্ট্যান্ডে লোক চলে গেছে আমাদের। তাও শিওর হবার জন্য সিসিটিভি ফুটেজ দেখা চলছে। এবার আপনারা বরং বাড়ি যান। আমরা টাইম টু টাইম আপনাদের খবর দেব।”
শাম্বর বাবা ওঠার উপক্রম করতেই শাম্বর মা চোখ মুছতে মুছতে বলে উঠলেন, “আমি কোথাও যাব না। এখানেই ওয়েট করব।”
শাম্বর বাবা তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, থানায় এভাবে বসে থাকা যায় না। কতজন কত কাজ নিয়ে আসবে আর সবার সামনে তো ওঁদের কাজ করা সম্ভব নয়। কিন্তু কোনও কথার উত্তরও দিলেন না শাম্বর মা, নড়লেনও না জায়গা থেকে।
এমন সময় ওসি সাহেবের মোবাইল ফের বেজে উঠল। কথা শেষ করে বলে উঠলেন উনি, “ম্যাডাম, আপনার ছেলের সংবাদ পাওয়া গেছে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আর আপনাদের দেওয়া ফোটো থেকে কনফার্ম করা গেছে।”
“কোথায়, কোথায় আছে আমার শাম্ব?”
“ধৈর্য ধরুন ম্যাডাম। তদন্তের মাঝখানে এত কথা আমরা সাধারণত ডিসক্লোজ করি না। কাজের অসুবিধে হয়। কিন্তু ডাক্তারবাবু যেহেতু ডি. এস. পি স্যারের বন্ধু, এটুকু বলি যে, আপনার ছেলের শারীরিক অবস্থা কিন্তু মোটেই ভালো নয়। প্রচণ্ড আনস্টেবল। টলমল করছিল। বাসে উঠতে গিয়ে দু-বার পড়েও গেছে।”
“বাসে? মানে? কোথাকার বাসে উঠেছে শাম্ব?”
“উত্তরবঙ্গের।”
শাম্বর মা এবার লুটিয়ে পড়লেন টেবিলে। ওর বাবা জল খাইয়ে ধাক্কাটা সামাল দিলে ওসি সাহেব বললেন, “আপনি স্যার ম্যাডামকে বাড়ি নিয়ে যান। আমরা আমাদের কাজ করছি। বাস ছেড়েছে যখন তার জাস্ট দশ মিনিট পরে আমরা খবর পেয়েছি। আমাদের লোক চলে গেছে। এবার আমাদের ছেড়ে দিন। ব্যাপারটা অন্য এরিয়াতে পড়ে যাচ্ছে তো, বেশ কিছু অফিসিয়াল ডেকোরাম এবার আমাদের সারতে হবে।”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে শাম্বর মাকে নিয়ে ধরে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন শাম্বর বাবা।
ওসি সাহেব রঘুবীরকে বললেন, “রঘুবীর, এবার কী করা বলো তো?”
“স্যার, আপনি তো সব কাজ প্রায় সেরেই ফেলেছেন। এবার শুধু বলুন বাসের পেছনে কে গেছে।”
“হরেন আর শ্যামল। হরেনের বাইকে চেপে গেছে।”
“ওরা কি ইউনিফর্মে আছে?”
“তা তো জানি না।”
“দাঁড়ান, আমি জেনে নিচ্ছি।” বলে মোবাইলে শ্যামলকে ডায়াল করলেন রঘুবীর। চটুল একটা গান বাজছে ওর সিং টোনে। সত্যি, পুলিশের চাকরি করলে কত কী যে করতে হয়! যে ছেলেটা দেবব্রত বিশ্বাসের গান অবিকল গায়, তাকে কিনা মোবাইলে এই সিং টোন রাখতে হয়!
শ্যামল ফোন ধরলে রঘুবীর জিজ্ঞেস করলেন, “শ্যামল কি ইউনিফর্মে আছ?”
“না স্যার।”
“গুড। বাসটা কি পেলে?”
“না স্যার, এখনও পাইনি। ভোরবেলা তো, রাস্তা ফাঁকা পেয়ে হু হু করে টেনেছে।”
“পেয়ে যাবে। মাঝখানে কয়েকটা স্টপ আছে। দাঁড়াবে, প্যাসেঞ্জার তুলবে। তোমরা সাবধানে চালিয়ে একটু জোরে যাও। আর শোনো, বাস পেয়ে গেলে হরেনকে ছেড়ে দিও। তুমি বাসে উঠে যাবে।”
ঠিক সেই সময় ফের ঘরে ঢুকলেন শাম্বর বাবা।
রঘুবীর শ্যামলকে বললেন, “একটু পরে কল করছি।”
উনি একটা চেয়ার টেনে বসে বললেন, “আমি জানি আপনাদের ডিস্টার্ব করছি, তবু একটা অনুরোধ জানাতে ফিরে এলাম।”
“বলুন না স্যার।” রঘুবীর বললেন।
একটু থেমে থেকে ঠোঁটটা একবার কামড়ে ধরলেন ড. কৃষ্ণপ্রসন্ন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, “স্যার, ছেলেটা ঠিক নেই। আমি আমার সুস্থ ছেলেকে ফেরত চাই।”
“দেখুন ডাক্তারবাবু, আমরা কেউ আপনার মতো ডাক্তার নই।” ওসি বলে উঠলেন।
“না না, আমি আসলে বোঝাতে পারিনি বোধ হয়। বলছি আপনারা যেভাবে এগোচ্ছেন তাতে খুব তাড়াতাড়ি ওকে পেয়ে যাবেন। এখানেই আমার অনুরোধ স্যার, প্লিজ ওকে পেয়ে গেলেও ধরে বেঁধে আনবেন না। লজ্জায় মনটা ভেঙে যাবে ছেলেটার। যদি আপনার লোকেরা ওকে একটু শ্যাডো করে!”
“সম্ভব নয় ডাক্তারবাবু। ওসব প্রাইভেট ডিটেক্টিভরা করে। পুলিশের প্রোটোকল ওরকম নয়।”
“প্লিজ স্যার! কিছু না, দুটো-একটা দিন। আমি শিওর, তার মধ্যেই ও আমাদের কাছে নিজেই ফিরে আসতে চাইবে। খুব ভালো ছেলে স্যার। নিজের বলে বলছি না, কেবল ব্রিলিয়ান্ট নয়, মন থেকে এখনও একেবারে সাদা। আমাদের ছেড়ে আজ অবধি কোথাও থাকেনি। ও পারবে না। স্ট্রেস নিতে না পেরে বেরিয়ে গেছে। দেখবেন ঠিক আমাদের কথা ভেবে ফিরে আসবে।”
“ওইখানেই তো গণ্ডগোল করেন আপনারা। কারও সঙ্গে মিশতে না দিয়ে একেবারে আইসোলেটেড একটা জীব, আয়্যাম সরি, কিন্তু সত্যি সেরকমই করে তোলেন। আরে বাবা, মানুষ সমাজবদ্ধ জীব! কথাবার্তা না বললে, মেলামেশা না করলে, ঠোক্কর না খেলে, হোঁচট না খেলে চলবে কী করে বলুন তো?”
“ঠিক বলেছেন স্যার। ওই জন্যই এই সুযোগটা আমার ছেলের জন্য আপনার কাছে চাইছি। আপনাদের নজরদারির মধ্যেই ও এবার জগৎটাকে দেখুক, ঠোকর খাক, হোঁচট খাক নিজে থেকে ফেরত না আসা পর্যন্ত। শুধু দেখবেন যেন…” আর কথা বলতে পারলেন না, ড. কৃষ্ণপ্রসন্ন চ্যাটার্জীর কঠিন খোলসটা ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল। শিশুর মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি।
রঘুবীর তাঁর হাতটা ধরে বললেন, “ডোন্ট বি সো আপসেট স্যার! আপনি বাড়ির লোকের খেয়াল রাখুন। শাম্বর দায় আমাদের।”
ডাক্তারবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে রঘুবীর বললেন, “স্যার, কেসটা আপনার কাছ থেকে শোনার পর আমারও এই একই কথা মনে হচ্ছিল। এই জন্যই আমি জিজ্ঞেস করছিলাম ওরা ইউনিফর্মে কি না। স্যার, শ্যামল ইউনিফর্মে নেই। আপনি পারমিশন দিলে আমি ওকে বলে দেব, ও চৌকস ছেলে, ঠিক সামলে নেবে।”
খানিক্ষণ কী যেন ভাবলেন ওসি সাহেব। তারপর ফোনে ডি. এস. পি. সাহেবের নম্বরটা মেলাতে মেলাতে বললেন, “দেখি একবার ওপরতলায় কথা বলে।”
ওসি সাহেবের দিকে একটা মৃদু হাসি দিয়ে ফের শ্যামলের নম্বরটা ডায়াল করলেন এস. আই. রঘুবীর পানিসর। কয়েকটা ইন্সট্রাকশন দিতে হবে ছেলেটাকে। সঙ্গে টাকা আছে কি না জানা দরকার। না-হলে দু-তিনদিনের মতো টাকা পাঠিয়ে দিতে হবে।
সতেরো
শাম্ব এসবের বিন্দুবিসর্গও টের পায়নি। বাস ছাড়ার প্রায় পৌনে একঘণ্টা পরে যে সাদা পোশাকের ছিপছিপে চেহারার শ্যামল বাসে উঠে তারই পিছনের সিটে বসে তাকে শ্যাডো করে চলেছে, সে-সব বোঝার ক্ষমতা শাম্বর হবে কেমন করে!
সেই থেকে যে-কোনো ঘটনা শ্যামল রঘুবীরকে রিপোর্ট করে গেছে। সেই বিলের সামনে যখন শাম্ব নেমে গেল, রঘুবীরের নির্দেশে একেবারে অ্যালার্ট ছিল শ্যামল। রঘুবীর তখন ভিডিও কলে নজর রাখছিলেন আর শ্যামলকে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছিলেন। এমনকি সেই যে কচুরিপানায়-জলে একেবারে মাখামাখি হল যখন শাম্ব, তখন তো শ্যামল ধরতে চলে যায় যায়, রঘুবীরই বারণ করেছেন ওকে। সেই সেখান থেকে বদরপুর, মন্দির হয়ে ঘোষালবাড়ি। মনে আছে সেই ফাঁকা মাঠে শাম্ব কার যেন কথা শুনেছিল? সে তো শ্যামলই। লুকিয়ে থেকে ছেলেটাকে একটু ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছিল। কাজও তো দিয়েছিল। তারপর বীণাপাণি বাউরির কুটিরে যখন থিতু হল শাম্ব, তখন রঘুবীরের মাধ্যমে এখানে একজন লোকাল সোর্সের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। সে-ই ওকে ব্যবস্থা করে সেদিন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে করতাল হাতে বিজয় বণিকের সম্প্রদায়ের একজনকে হাত করে ঢুকিয়ে দেয়।
ওসি সাহেব তো বড়ো সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করেই নিয়েছিলেন। কাজেই শ্যামল বলা যায় অফিসিয়াল ডিউটিতেই ছিল। কিন্তু শ্যামলও জানত না যে তারই মতো আর একজন অফিসারও সেখানে অফিসিয়াল ডিউটিতে রয়েছেন। তাঁর কাজটা শাম্বকে দেখার পাশাপাশি শ্যামলকেও দেখে রাখার। গ্রামে-গঞ্জে কারও সঙ্গে সম্পর্কহীন নতুন মানুষ খুব ভালো চোখে নেয় না। তাছাড়া বদরপুর থেকে বর্ডার বেশি দূরে তো নয়। নানান গণ্ডগোলের সম্ভাবনা।
বদরপুরে শাম্ব গেছে শুনেই রঘুবীর ওঁর নামটা প্রস্তাব করেন। রঘুবীর জানতেন, বদরপুরে ওই অফিসারের আত্মীয়বাড়ি আছে। কাজেই তাঁকে অ্যাপয়েন্ট করা হয়েছে। ইনি নিজেও এতে খুব খুশি। বদরপুরে যাওয়ার জন্য নাকি সেদিনই তিনি ছুটির দরখাস্ত দিতেন।
শাম্বর বর্ণনা আর বদরপুরে ওর অ্যাক্টিভিটি শুনেই তিনি বলে দিয়েছেন, “নট টু ওরি স্যার। শাম্ববাবুকে একেবারে বগলদাবা করে তবে ফিরব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”
“না। বগলদাবা করে আনতে হলে অনেক আগেই আনা যেত। রঘুবীর কেসটার আই. ও., ওর কাছে একবার শুনে নিন কী করতে হবে।”
হইহই করে তিনি কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন যেন, স্যারের মুখ দেখে স্যালুট করে সোজা চলে এসেছেন রঘুবীরের কাছে।
“বাবা, হঠাৎ এত চড়া মেজাজ স্যারের?”
“আরে রাজ্যের চাপ পড়েছে। পলিটিকাল মিটিং আছে, তার মধ্যে দুটো চুরি হয়েছে, দুটো বড়ো পরীক্ষা, একটা র্যালি, তার ওপর বাড়ির কী একটা ফাংশন। পুরো নাজেহাল।”
“অ। তা আমাকে এবার কী করতে হবে বলো তো। উনি তো তোমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।”
রঘুবীর পুরো কেসটা বলে প্ল্যানটাও ভেঙে বললেন। তাতে একটা ঢেঁকুর তুলে ভদ্রলোক বললেন, “ও, এই ব্যাপার? দেখো, ওই এলাকাটা না আমার পুরো নখদর্পণে। তাছাড়া যা শুনলাম, তাতে ও যেখানে আছে তাতে আমার কাজটা সহজ হয়ে গেল। আমি যেখানে গিয়ে উঠব, সেই উৎসব বাড়িতে শাম্বকে আনা কোনও ব্যাপারই নয়। আর ও-বাড়িতে আমার চাকরির পরিচয় দুজন বই আর কেউ জানে না। বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নেব।”
“তাহলে আর কী। সত্যিই তো কাজ সহজ হয়ে গেল। দুগ্গা দুগ্গা করে বেরিয়ে পড়ো এবার।”
ভদ্রলোক হ্যা হ্যা করে হেসে বললেন, “ওহ্! পুরো মেঘ না চাইতেই জল! পুরো অন-ডিউটিতে সপরিবারে পারিবারিক ডিউটি! কোনোদিন কেউ পেয়েছ নাকি ভায়া?”
ওঁর বলার ধরনটাই এমন যে ঘরের সবাই হেসে ফেললেন।
রঘুবীরও হাসতে হাসতে ওসি স্যারের ঘরে ঢুকলেন। এই কেসটায় তো আপাতত চলতে দেওয়া আর আপডেট নেওয়া ছাড়া তেমন কিছু করার নেই, তাহলে স্যারকে একটু হেল্প করা যাক।
আঠারো
সবই তো চলছে। ভালোই চলছে। শাম্ব চ্যাটার্জী বাড়ি ছেড়েছে, শাম্ব চ্যাটার্জী নতুন দিদা পেয়েছে, শাম্ব চ্যাটার্জী এই যে এখন ঘোষালবাড়িতে সবার সঙ্গে মিলেমিশে হাসতে হাসতে নাটকে অংশ নিচ্ছে, রবি ঠাকুরের গান গাইছে খোলা গলায়, বিজয় বণিকের দলে মিশে শ্যামল করতাল বাজানোর পাশাপাশি কড়া নজর রাখছে শাম্বর দিকে, যে যার মতো চলছে ফিরছে, হাসছে কাঁদছে, দুঃখ ভুলছে।
কিন্তু এই চলমান দুনিয়া কি খোঁজ রাখছে তাঁদের?
কাদের?
কাদের আবার! এই গল্পের ফিল গুড থিম বজায় রাখার আসল দুজন মানুষের! যাঁরা না থাকলে এতক্ষণে কাঁদিয়ে দেওয়ার, ভাসিয়ে নেওয়ার মতো যে কিছু একটা ঘটে যেতেই পারত সে-কথা তো বোঝাই যাচ্ছে! বোঝা যাচ্ছে কি না?
তাও অনেকেই হয়তো তাঁদের চিনতে পারছে না। সোজা কথায় বলি, আমি বলতে চাইছি শাম্বর দাদু আর বীণাপাণি বাউরির কথা। শাম্বর দাদু যদি ওই ভোররাতে শাম্বকে বেরোতে না দেখতেন আর সেই মুহূর্তেই শাম্বর বাবা-মাকে না জানাতেন, তাহলে এত তাড়াতাড়ি ছেলেটার খোঁজ পাওয়া যেত কি? উদ্ভ্রান্ত ছেলেটার তো মনের ঠিক নেই! কী যে করে বসত কখন কে জানে। আর বীণাপাণি না থাকলে তো গল্প এই অবধি গড়াতই না! অথচ দেখো, জীবনের তাড়নায়, ঘটনার ঘনঘটায়, আনন্দে আমরা কেমন ভুলে গেছি ওঁদের কথা! কী যে করছেন এখন এই দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, আমাদের জানার ইচ্ছেও তেমন কিন্তু হয়নি। এমনটাই হয়। শাম্বর দাদু বলেন, এটাই নাকি স্বাভাবিক। গাড়ি গড়ালে ধুলোবালি নাকি উড়বেই। সেদিকে দেখতে গেলে গাড়ি আর গড়াবে না। কিন্তু সে তো ওঁর অভিজ্ঞতার কথা, অভিমানের কথা।
আমরা যখন বুঝতেই পেরেছি, তখন চলো একবার দুজনের দিকেই নজর দিই। প্রথমে যাওয়া যাক শাম্বদের বাড়িতে। সেই দিনের সকালবেলা শাম্বর বাবা-মা থানা থেকে বাড়ি ফিরতেই দাদু ভোম্বলদাকে দিয়ে বার বার ডাকছিলেন কী হল জানবেন বলে। ওঁদেরও দোষ দেওয়া যায় না। প্রচণ্ড আপসেট হয়ে ছিলেন, বিধ্বস্ত ছিলেন। তাই এসেই বাবার ঘরে যাওয়া হয়নি। এদিকে বাড়িতে ফিরেই শাম্বর মা ফের সংজ্ঞা হারিয়েছেন। শাম্বর বাবা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন। মাঝে-মাঝেই ফোন আসছে। পেশেন্টদের ফোনও আসছে। এর মধ্যে বার বার ভোম্বলের ডাকাডাকি। মেজাজ হারিয়ে ফেললেন ড. কৃষ্ণপ্রসন্ন চ্যাটার্জী। বকা খেয়ে মুখ তুম্বো করে ফিরে সেই মেজাজের খানিকটা দাদুকে ফিরিয়ে দিয়ে ভোম্বলদা বলল, “যা বলার আমাকে বলো তো! কী লাগবে তোমার বলো। ওদের অনেক কাজ। গিন্নিমা অজ্ঞান হয়ে গেছে।”
দাদু চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর মনটি তো সচল। সে তো ভীষণ বেগে ধাবমান। কত কী যে আপদ-বিপদের সম্ভাবনায় তাঁর বুক কেঁপে চলেছে! এর মধ্যে আবার ভোম্বল বলল বউমা অজ্ঞান হয়ে গেছে। কী বলল থানায়? কেউ কিছু বলছে না।— “অ্যাই ভোম্বল!”
“দাদু, আমি আর এখন যেতে পারব না।”
“যা না ভাই! কিচ্ছু জিজ্ঞেস করতে হবে না, আমার কাছে ওদের ডাকতেও হবে না। শুধু আশেপাশে ঘুরঘুর করে যদি কিছু জানতে পারিস দাদুভায়ের কথা— দেখ না দাদা! তোকে কচুরি খাওয়াব।”
“তুমিও বড্ড অধৈর্য! একটু দাঁড়াও না দাদু! ওরা ঠিক এসে বলবে তোমায়।”
এইবার দাদু একেবারে পুরুষসিংহ।— “তোকে আর একবার যেতে বলেছি যখন যাবি! তোকে মাইনে দিই তো আমি! জ্ঞান না দিয়ে যেভাবে পারিস ভায়ের খবর এনে দে আমায়।”
এ-পর্যন্ত পড়েই আবার ভেবে বসো না যেন শাম্বর বাবা-মা ওর দাদুকে একেবারে ধর্তব্যের মধ্যেই আনছে না। ব্যাপারটা কিন্তু পুরোপুরি তা নয়। শাম্বর মায়ের জ্ঞান ফিরতেই তিনি চলে এসেছেন দাদুর ঘরে। যা যা শুনেছেন থানায় সবটা বলতে বলতে ফের কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শাম্বর মাকে সামলাতে সামলাতে গম্ভীর গলায় দাদুকে দুশ্চিন্তা করে শরীর খারাপ না করার কথা বলে চলে গেছেন। কিন্তু তারপরে এই যে তিন-তিনটে দিন চলে গেল, দাদুকে তো কেউ কিছু বলছেই না!
দাদুর তো তবু ভোম্বলদা আছে, টুকটাক খবর এনে দিচ্ছে। বীণাপাণির তো সেই জোটিও নেই। ছেলেটা যে কোথায় গেল! গিন্নিমার কাছে সব ফাঁস হয়ে গেলে রাজপুত্তুরটিকে হারানোর ভয় পুরোপুরি গ্রাস করেছে বৃদ্ধাকে। ভালো করে খেতে অবধি পারেনি। অস্থির লাগছে। খালি খালি ঠাকুরঘরে, বিজয় বণিকদের ঘরে উঁকি দিচ্ছে। হাজারো লোকজন। এমন কোমর পড়া মলিন বৃদ্ধার সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেলে তাদের কেউ কেউ বেশ বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু কোন ঘরে গেল তাঁর রাজপুত্তুর? অমিতটাকে পেলে যে কী ভালো হত!
তার রাজপুত্তুরকে তো তখন রীতিমতো ছেঁকে ধরেছে জীতেনবাবু হিতেনবাবু অ্যান্ড কোম্পানি। ধুলো ঝাড়া হারমোনিয়ামটা টেনে বসে গেছেন হিতেনবাবু আর শাম্ব মায়ের কাছে শেখা রবি ঠাকুরের গান গাইছে। শাম্ব একটা গায়, তারপর জীতেনবাবু গান, শাম্বর বয়সি যে মেয়েটি সে গায়। সবাই যে যার মতো বাজনা বাজায়, কেউ-বা চুপ করে শোনে। যাত্রার মহল ততক্ষণে গত। শাম্বকে অনেকদিন বাদে হাসিখুশি দেখাচ্ছে। হাসছে শাম্ব। সেদিকে অনেকক্ষণ লক্ষ করে হিতেনবাবু বললেন, “তাহলে কী হবে খোকা— অর্জুন, নাকি ব্রজের কানাই?”
শাম্ব লাজুক মুখে বলল, “দুটোর কোনোটাই নয় কাকু। ওসব আমাকে দিয়ে হবে না।”
“তা কেন ভায়া! তুমি তো বেশ গাও!”
“বেশ আর কোথায়? মায়ের কাছে একট আধটু শেখা।”
“তা তোমার মা কোথায়? তাঁকে তো একবার ধন্যবাদ দিতে হয়। এত ভালো একটা ছেলে তৈরি করেছেন!” জীতেনবাবু হইহই করে উঠলেন।
প্রমাদ গুনল শাম্ব। এই লোক এবার হইহই করে গণ্ডগোল পাকাবেই।
শাম্ব কিছু বলার আগেই একটা পুঁচকি মেয়ে বলে উঠল, “মা কোথায়! ও তো বিনু ধোপানীর সঙ্গে এসেছে!”
কথাটা শুনে সবাই ওর দিকে তাকাতেই একটু সংকুচিত হল যেন শাম্ব। অথচ কারও মধ্যে কিন্তু অন্যরকম কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। যাবেই-বা কেন? আচ্ছা, শাম্বর তাহলে সংকোচের কারণ কী? বীণাপাণির ওই বিনু ধোপানী নাম? এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে যে তাকে সারিয়ে তুলল, খাইয়ে-দাইয়ে ফের ঠিক করে তুলল, এত ভালোবাসল— সে ধোপানী হলেই কী আর আমিরনী হলেই-বা কী?
কিন্তু শাম্ব তো আর আকাশ থেকে নেমে আসা কেষ্টঠাকুরের অবতার নয়, এতক্ষণে তো সবাই আশা করি বুঝে গেছে সমাজের গেরোয় ফেঁসে থাকা আর পাঁচজনের মতোই শাম্ব। সামাজিক রীতিই যখন ছোটবেলা থেকে কাজের ভিত্তিতে, অর্থের ভিত্তিতে, ধর্মের, জাতপাতের ভিত্তিতে উঁচুনীচুর ধারণা-বিষের বীজ পুঁতে দেয়, তখন আর শাম্ব চ্যাটার্জীদের বিনু ধোপানীর সঙ্গী শুনে সংকুচিত হবার দোষ কী?
যে হিতেনবাবু এতক্ষণ গানে মজায় ফোড়নের ভূমিকায় ছিলেন, তিনি এবার হঠাৎ হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে বললেন, “আমার বন্ধুরা, আজ তোমাদের একটা মন্ত্র শেখাই। কবিগুরুর মন্ত্র। যখনই দেখবে ভয় হচ্ছে, কোনও কারণে নিজেকে গুটিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে, লজ্জা করছে, তখনই এই মন্ত্রটা মনে মনে আওড়াবে। আমি কিন্তু এখনও আওড়াই।” বলে দরাজ গলায় গান ধরলেন—
‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।
সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।
মুক্ত করো ভয়,
আপনা মাঝে শক্তি ধরো,
নিজেরে করো জয়!’
সবাই তাঁর সঙ্গে গলা মেলাল। আস্তে আস্তে শাম্বও গলা মেলাল। আর গানের কী অদ্ভুত ক্ষমতা, খানিক বাদে দেখা গেল খোলা গলায় সবার সঙ্গে গাইছে সেও!
বুড়ি বীণপাণি বাউরি দরজার বাইরে থেকে তার রাজপুত্তুরকে গাইতে দেখে কী যে আনন্দ পেল, সে সময় যে তার বলিরেখা সর্বস্ব ঝকঝকে মুখখানা দেখেছে সে-ই বলতে পারবে।
উনিশ
শাম্বদের ড্রইং-রুমে একটা বালিঘড়ি আছে। দাদু বলেন, বালিঘড়ি নাকি মানুষের জীবন। এই মুহূর্তে এতটা জীবন— হাসছে, খেলছে, নাচছে, কুঁদছে আর এই ঝুরঝুর করে ঝরতে ঝরতে শেষ। হাওয়া। শূন্য।
কিন্তু শূন্য বলে তো কিছু হয় না। দাদুই তো বলেন, শূন্যর ভিতরেই পূর্ণ থাকে। জ্ঞানীরা নাকি দেখতে পান পূর্ণ। সবদিকে পূর্ণ। ‘পূর্ণাৎ পূর্ণম উদচ্যতে। পূর্ণস্য পূর্ণম আদায় পূর্ণম হি অবশিষ্যতে।’ সমুদ্র থেকে জল নাও, আচমন করো, দু-হাত ভরে তুলে নাও, হাতেও সমুদ্র, সামনেও সমুদ্র। অঞ্জলি দাও সমুদ্রে সমুদ্রকেই।
জীবন তো সমুদ্র বই আর কিছু নয়। ঢেউ উঠবেই। ঢেউয়ের ধাক্কায় পাড় ভাঙবে। আবার গড়বে। চিন্তা কীসের?
বার বার দাদুর কথাগুলো মনে হচ্ছিল বীণাপাণির আধখোলা চোখ দুটো দেখে। নিজের কুটিরে শুয়ে আছে বৃদ্ধা। মাটির বিছানায়। তক্তপোশে শোয়নি। সেটি যে তার রাজপুত্তুরের জন্য ছেড়ে দিয়েছে।
ঘোষালবাড়ির সেই গান শুনতে-শুনতেই বীণাপাণির কেন যেন পায়ের নীচের মটিটা টলে যায়। ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টিতে তখনও হাসিমুখে সে তার গোপাল, তার রাজপুত্তুরের দিকে তাকিয়ে। তারপর যখন একেবারে সংজ্ঞা হারাল, লুটিয়ে পড়ল মেঝেয়, হইহই শুনে সবার সঙ্গে শাম্বও দৌড়ে আসে। মাটিতে লুটিয়ে পড়া বীণাপাণিকে দেখে বিহ্বল হয়ে পড়ে। এই প্রথম জনসমক্ষেও কেঁদে ফেলে শাম্ব। বৃদ্ধা বীণাপাণির মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে।
জীতেনবাবু, হিতেনবাবু, অমিত সবাই মিলে চোখে-মুখে জল দিয়ে, শরবত খাইয়ে বৃদ্ধার জ্ঞান ফিরিয়ে আনেন।
জ্ঞান এলে কি আর বীণাপাণি সে বাড়িতে থাকে? কাজেই ডেকোরেটরের ভ্যানে সওয়ার হয়ে ঠিক ফিরে এসেছে নিজের বাড়িতে। তখন সন্ধে হয়েছে। অমিত হ্যারিকেন জ্বালিয়ে দিয়েছে। হ্যারিকেনের আলোয় আধশোওয়া হয়ে দুর্বল বীণাপাণি তার রাজপুত্তুরের হাত ধরে কত কী যে কইছে মৃদু স্বরে কিছুই বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে তার শুষ্ক চোখের কোল থেকে কীভাবে যেন জল গড়িয়ে পড়ে। আজব এই চোখের জল, কোত্থেকে যে আসে! আর কী ছোঁয়াচে দেখো, শাম্ব তো শাম্ব, মাঝবয়সি অমিতেরও গাল গড়িয়ে নেমে আসে।
শাম্ব দেখে আর মনে মনে দাদুর কথাগুলোর মানে বুঝতে পারে। দাদু এখন পড়তে পারেন না, কিন্তু বছর দু-এক আগে অবধি জোরে জোরে উপনিষদ পড়তেন। পড়তেন আর শাম্বকে দেখলেই ডেকে ডেকে শোনাতেন। বলতেন, “শুনে নাও দাদুভাই। আমি এই বুড়ো বয়সে এসে জানছি। তুমি এই বয়সেই জেনে নাও, তাহলে দেখবে কেমন মানুষের মতো মানুষ হতে পারবে।”
শাম্ব দাদু বলছেন বলে শুনত, কিন্তু মনে রাখত না। আজ বীণাপাণিকে দেখে মনে পড়ছে। দাদু পড়ছেন, ‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জিথা - তাকে ত্যাগ করে ভোগ করো।’ কাকে বলে ত্যাগ? এই যে বীণাপণি, এর নাম ত্যাগ?
বীণাপাণির শ্বাস কখনও জোরে হচ্ছে, কখনও ধীরে ধীরে। কে জানে আর কতক্ষণ তার শ্বাস। অথচ এখনও কেমন নিজের বিছানাটুকুও ছেড়ে দিচ্ছে শাম্বকে। সারাজীবন যেমন ছেড়ে দিয়েছে ভাইবোনের সন্তানদের। এর নাম ত্যাগ।
বৃদ্ধা এখনও হাত ধরে রয়েছে শাম্বর। শীতল সেই হাত। অস্ফুটে বলছে, “খুব সেবা করবা আমার রাজপুত্তুর। গোপাল আমার, সবাইকে সেবা করবা।”
শাম্ব বুঝতে পারছে কোথায় আর কী ভুলটা সে করেছে। গোড়াতেই যে গলদ হয়েছিল তার। ডাক্তার হতে চেয়েছিল সে। কিন্তু তা যে প্রতিযোগিতা নয়, কেবল কেরিয়ার নয়, সে যে আসলে সেবা! সেবা আর সেবা। আনন্দে সেবা করার মহামন্ত্র শিক্ষা। যুগ যুগ ধরে বয়ে আসা এক শিক্ষা পরম্পরা বহন করতে চলেছে যে সে, সেটাই তো বোঝেনি। তাহলে কি আর এমন ভয় পেত? এমন করে পালাত পরিস্থিতি থেকে।
বীণাপাণির কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসছে যেন। তাকে যে বাঁচাতে হবে। বাবা কাছে থাকলে যে কী ভালো হত!
নাহ্, বাবাকেই ফোন করবে শাম্ব। কিন্তু ফোন কোথায়?
এদিক-ওদিকে তাকিয়ে শাম্ব অমিতকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার ফোন আছে? আমায় একটু দেবে?”
অমিত ওর ফোনটা দিলে বাবার নম্বরটা ডায়াল করল শাম্ব।
“হ্যালো!”
“বাবা!”
নিস্তব্ধতার শব্দে খুব জোর। নিমেষে কত কী যে বুঝিয়ে দিতে জানে নিস্তব্ধতা।
কুড়ি
বদরপুর। সুতি নদীর তীরে ছোট্ট গ্রাম বদরপুর। বীণাপাণির বৃন্দাবন বদরপুর। সেই জন্ম থেকে এই বদরপুরে তার ধুলোবালির জীবন। না কোথাও বেড়াতে গেছে, না কোনও চাওয়া পাওয়া। অথচ তার অসুস্থতায় এই প্রথম বদরপুরে এসি অ্যাম্বুলেন্স ঢুকেছে। তাকে সুস্থ করতে কলকাতার বড়ো ডাক্তার কৃষ্ণপ্রসন্ন চ্যাটার্জী নিজে এসেছেন। এসেছেন শুধু নয়, গতকাল সন্ধেবেলা থেকে তাঁর নির্দেশে শাম্ব সেবা করে গেছে তার এই দিদার। অমিত গিয়ে ওষুধ এনে খাইয়ে এখনও টিকিয়ে রেখেছে বৃদ্ধার প্রাণ।
বৃদ্ধার পর্ণকুটির লোকে লোকারণ্য।
শাম্ব আর শাম্বর মা দুজনেই বীণাপাণির সঙ্গে আছে। ঘোষালগিন্নি এত বছর পর নিজের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন তাঁর বিনু ধোপানীর বাড়িতে।
শ্যামরাইয়ের মন্দির থেকে প্রসাদ এনে কপালে ঠেকিয়ে মুখে দিয়ে গেছে অমিত। যে ছেলেমেয়েরা ইশকুল যাওয়ার সময় বুড়িকে খেপায়, তারা এসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে গেছে তাদের হরেকৃষ্ণ বুড়িকে। একজন তো আবার বীণাপাণিকে ডালসহ একটা কদমফুল দিয়ে গেল। সে-সব দেখে বীণাপাণি একটু হেসেছে।
শাম্বর বাবা কয়েকটা ইঞ্জেকশন করেছেন বীণাপাণিকে। বলেছেন, বীণাপাণির অসুখ খুব জটিল কিছু নয়। বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা তো আছেই, তার সঙ্গে মিশেছে অপুষ্টিজনিত অসুখ। কয়েকদিন হাসপাতালে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। এখান থেকে তাই অ্যাম্বুলেন্সে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হবে কলকাতায়, যে হাসপাতালে বাবা আছেন সেখানেই। তারপর সুস্থ হলে কিছুদিন শাম্বদের বাড়িতে থাকবে।
বীণাপাণি শাম্বর মায়ের মাথায় কাঁপা কাঁপা হাত বুলিয়ে আদর করেছে। বলেছে রাজপুত্তুরের যত্নআত্তি করতে। বলেছে, তাঁর কপালে যে এত যত্নআত্তি ছিল সে-কথা সে স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেনি। বলেছে, তার শ্যামরাই তাকে ছেলে, ছেলেবউ, নাতি সবকিছু দিল।
সবাই শাম্বকে দেখছে। অমিত এসে ঘুড়ি আর লাটাইটা শাম্বর হাতে গুঁজে দিয়ে কানে কানে বলেছে, “সময় পেলে ওড়াস ভাই। আকাশের দিকে তাকিয়ে ওড়াবি যত, তত মনটা আকাশের মতো থাকবে। ঘুড়িদের যত লড়াই সব গগনে গগনে। মাটিতে তোর জন্য শুধু আনন্দ থাক।”
অবাক হয়ে শাম্ব জিজ্ঞেস করেছে, “তুমি কথা বলতে পারো?”
“সবার সঙ্গে বলতে পারি না রে আর। যারা শুধু হাত পেতে চায়, দিতে পারে না কিছু, তাদের সঙ্গে কথা বলতে আর গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না। তুই তো বিনুমার কথা ভাবলি, তাই দেখ কেমন তোর সঙ্গে কথা বলতে পারলাম!”
এইসব কথা চলতে-চলতেই সব গোছগাছ সম্পূর্ণ হয়েছে।
অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে বৃদ্ধা বীণাপাণি বাউরিকে। সঙ্গে উঠছেন শাম্বর বাবা আর মা। আর আছে শ্যামল। শাম্ব শ্যামলকে চেনে না। শ্যামল চায়ও না শাম্ব ওকে চিনুক। শাম্ব যাবে সামনে ড্রাইভারের সঙ্গে। আর যাবেন হিতেনবাবু। তাঁর নাকি এখনই কলকাতায় ফেরা প্রয়োজন। যে-কাজের জন্য ছুটি পেয়েছিলেন তা নাকি সম্পূর্ণ হয়েছে। হিতেনবাবু সঙ্গে চলায় খুব খুশি হয়েছে শাম্ব। সারা রাস্তাটা গল্প করবেন হিতেনবাবু। শাম্ব চুপ করে শুনবে। গতকাল কবিগুরুর যে মন্ত্রটা উনি শিখিয়েছেন, কোনোদিন ভুলবে না।
গাড়ি চলল। হাত নাড়ছে সবাই। গাড়ির চাকায় সুতির চরের বালি থেকে ধুলো উড়ছে।
শ্যামরাইয়ের মন্দিরের কাছ দিয়ে টলে টলে অ্যাম্বুলেন্সটা উঠে পড়ল রাস্তায়। মন্দিরে ঘণ্টা বাজছে। বাল্যভোগ হচ্ছে। হাওয়া বইছে মন্দির ছুঁয়ে। বৃদ্ধা বীণাপাণিকেও সেই হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে কি?
বীণাপাণিকে ছুঁয়ে আছে শাম্বর মায়ের হাত। বীণাপাণির কাছে যে তাঁর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছেন চোখ বুজে।
হাওয়ায় ধুলো উড়ছে। ধুলো উড়ে পড়ছে সবার চোখে-মুখে। চোখ রগড়াচ্ছে সবাই। ধুলোই হবে। নইলে সাতজনমে খোঁজ না নেওয়া বিনু ধোপানীর গ্রাম ছেড়ে যাওয়াতে চোখ রগড়ে কাঁদছে নাকি বদরপুরের মানুষ? এরকম আবার হয় নাকি?
চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে বাঁকা কদমের ডালটায় বসে জোরে জোরে হাত নাড়ছে অমিত। প্রত্যুত্তরে গাড়ির জানালা থেকে হাত নাড়ছে শাম্ব।
এরকমটাও কি হয়?
ফাঁক বুঝে হিতেনবাবু পকেট থেকে ছোটো একটা ফোন বার করে কানে চেপে চাপা স্বরে কাকে যেন বলছেন, “মিশন অ্যাকমপ্লিশড স্যার।”
এরকম তো হয়ই। সত্যি হলেও হয়, গল্প হলেও হয়।
লেখকের অন্যান্য লেখা
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস
ছোট্ট এক পাহাড়ি কন্যে সুলুংটুং। তাকে ঘিরে থাকে স্বপ্নরাজ্যের তিন পাহাড়। ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মিথ। সুলুংটুংয়ের সেই তিন পাহাড়ে দুর্ধর্ষ অভিযানের কাহিনি পরিস্ফুট হয়েছে শাশ্বত করের দক্ষ কলমে।
ছোটোদের জন্যে লেখা আট খ্যাতনামা গল্পকারের প্রথম গল্পের সংকলন।
শেখর বসু, অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, জয়দীপ চক্রবর্তী, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, যশোধরা রায়চৌধুরী, সৈকত মুখোপাধ্যায়, চুমকি চট্টোপাধ্যায় ও দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী