FREE SHIPPING IN INDIA
শুভাঞ্জন ব্যানার্জ্জী (১৬)
জঙ্গলের মধ্যে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে বেশ সমস্যাই হচ্ছিল আর্থারের। মাঝে-মাঝেই লতাপাতায় ক্রাচ জড়িয়ে যাচ্ছিল। তবুও একটা অদম্য কৌতূহল ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। ফ্রেডরিকের মুখে অবশ্য কোনও বিকার নেই। আগের মতোই ব্যঙ্গের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে হেঁটে চলেছে ও। মায়াবৃক্ষের ব্যাপারটা যে ও একেবারেই বিশ্বাস করেনি, তা বেশ ভালোই বুঝতে পারল আর্থার। অবশ্য সেও যে একেবারে বিশ্বাস করেই চলেছে তা নয়। তবে, ওই বৃদ্ধ গাইড এমনভাবে বলল যে, ঠিক অবিশ্বাস করতেও মন চাইছে না। আজ সকালে যখন ফ্রেডরিক জিজ্ঞেস করেছিল লোকটাকে এখানে কিছু দেখার মতো আছে কি না তখন ওই বৃদ্ধ কেমন যেন রহস্যময় হেসে বলেছিল, “এ-জায়গা তো ঠিক ট্যুরিস্ট স্পট নয়। তেমন বেড়ানোর জায়গাও কিছু নেই। তবে এই যে কটেজের পিছনে জঙ্গল দেখছেন, সেখানে একজায়গায় নিয়ে যেতে পারি। যাবেন?”
আসলে দিন কয়েক আগে ওরা দার্জিলিং এসেছে। সেখান থেকেই এই বৃদ্ধ ওদের সঙ্গে রয়েছে। আর্থার আর ফ্রেডরিক ভারতে এসেছিল ক’দিন নিরিবিলিতে কাটাবে বলে। কিন্তু দার্জিলিংয়ে তেমন নিরিবিলি জায়গা পাওয়া গেল না। ফলে প্রথম তিনদিন কাটিয়েই এখানে নেমে এল ওরা। গাইড লোকটি অবশ্য সঙ্গেই রয়েছে। লোকটার এখানে ভালো পরিচিতি রয়েছে। ও-ই এই কটেজটার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
“কোথায়?” চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করেছিল আর্থার।
“মায়াবৃক্ষ দেখতে যাবেন বাবু?”
এতক্ষণ ভাঙা হিন্দি আর ইংরাজিতে কথা বললেও ‘মায়াবৃক্ষ’ শব্দটা সে বাংলাতেই বলল। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই আর্থার কথাটার অর্থ বুঝতে পারল না। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ফ্রেডরিক তাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “আরে মায়াবৃক্ষ মিনস দ্য ট্রি অফ ম্যাজিক।”
বৃদ্ধ হেসে বলল, “সাহেব একদম ঠিক বলেছেন। যাবেন দেখতে?”
আর্থার জানতে চেয়েছিল মায়াবৃক্ষের কোনও বিশেষত্ব আছে কি না। প্রত্যুত্তরে লোকটা হেসে বলেছিল, “আপনারা বিদেশি। আমাদের এখানকার রহস্য সম্বন্ধে কিছুই প্রায় জানেন না। এখানে, জঙ্গলের গভীরে কোথায় কী অকল্পনীয় রহস্য লুকিয়ে রয়েছে, ভাবতেও পারবেন না। মায়াবৃক্ষ সম্বন্ধে বেশি না জানাই ভালো। দূর থেকে দেখে আসতে পারেন। শুধু এটুকু বলে রাখি, মায়াবৃক্ষের সঙ্গে মানুষের দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক চলে।”
ফ্রেডরিক বলল, “তোমাদের এখানে রহস্য মানে তো যত গাঁজাখুরি গপ্পো আর কুসংস্কার। মায়াবৃক্ষও তেমনি কিছু নিশ্চয়ই? যাই বলো বাপু, গপ্পো ফাঁদতে তোমরা ওস্তাদ।”
আর্থার ভেবেছিল বৃদ্ধ নির্ঘাত রেগে যাবে। চিৎকার করে উঠবে উত্তেজিত হয়ে। কিন্তু ওদের অবাক করে দিয়ে বৃদ্ধ তার ধারপাশ দিয়েও গেল না। রহস্যময় হেসে উঠে কেমন একটা ফিসফিস করে বলল, “বললাম না, তোমরা আমাদের দেশের রহস্য সম্বন্ধে কিছুই জানো না। তাই এসব কথা বলছ। দাঁড়াও, তোমাদের একটা জিনিস দেখাই।”
বৃদ্ধ তার শার্টের বাঁহাতটা গুটিয়ে নিয়ে দেখায়। সবিস্ময়ে ওরা লক্ষ করল, বৃদ্ধের হাতের মাংসপেশি যেন কোনোভাবে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় শুধু শিরা-উপশিরা জড়িয়ে রয়েছে সাপের মতো। প্রথম দর্শনে কেমন একটা অস্বস্তির উদ্রেক হয় মনে। আর্থার বৃদ্ধকে বাঁহাত ব্যবহার করতে দেখেনি এ ক’দিনে। এবার তার কারণটা বুঝতে পারল ও। আসলে ওই হাত দিয়ে কোনও কাজ করাই সম্ভব নয়। হাতও কি বলা যায় ওটাকে?
ফ্রেডরিক সিগারেট জ্বালিয়ে বলল, “তোমার হাতের অবস্থা এরকম হল কেন?”
“এই হাতটার বদলে নিজের ছেলের আয়ু চেয়ে নিয়েছিলাম মায়াবৃক্ষের কাছে। চার বছর বয়সেই আমার ছেলের মারণরোগ ধরে। আমাদের গ্রামের যে ডাক্তার, সে বলেছিল, বড়ো ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেও বাঁচানোর সম্ভাবনা কম। দিন দিন ওর শরীর রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছিল। ছেলেটার ওই অবস্থা দেখতে পারিনি। আমার কাছে একটাই উপায় ছিল। দেওয়া-নেওয়া। মায়াবৃক্ষের গল্প ছোটো থেকে শুনে আসছি আমরা। তার কাছে চাওয়ার পদ্ধতিও সোজা। কেউ যদি দ্বিধাহীন মনে মায়াবৃক্ষের কাছে কিছু চায়, মায়াবৃক্ষ তাকে ফেরায় না। শুধু একটা অঙ্গ তার কাছে ভেট দিতে হয়। মায়াবৃক্ষ পুরোপুরি সেই অঙ্গটাকে নিয়ে নেয় না। শুধু শুষে নেয়। যে অঙ্গ তাকে দান করছে, তার গায়ে ছুরির আঘাতে রক্ত বের করে ফেলতে হয় ওই গাছের গায়ে। ব্যস।” একটানা কথা বলে বৃদ্ধ হাঁপাচ্ছিল।
শুনতে শুনতে আর্থার বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। সে বলল, “আমাদের দেখাবে সেই গাছ?”
“দেখাব।” বৃদ্ধ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই বলে উঠল ফ্রেডরিক, “তুইও এসব গাঁজাখুরিতে বিশ্বাস করিস নাকি?”
“একবার দেখে আসতে তো দোষ নেই।”
ফ্রেডরিক বাঁকা হেসে বলল, “ইন্ডিয়ার হাওয়া যে তোর গায়ে লেগেছে, বুঝতে পারছি।”
আর্থার যেন শুনেও শুনল না ওর কথা। বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল, “কখন বেরোব আমরা?”
“ব্রেকফাস্ট করে নিন। তারপর নিয়ে যাব।”
(২)
বাইরে থেকে দেখে জঙ্গলটা যে এত ঘন তা বুঝতে পারেনি আর্থার। সূর্যের আলো এখানে ঢুকছে না। গাছের পাতার ফাঁকে আটকে রয়েছে কুয়াশা। হাঁটতে বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল। মাঝে-মাঝেই ক্রাচ জড়িয়ে যাচ্ছে লতাপাতায়। ফ্রেডরিক ধীরেসুস্থে হাঁটছিল। মাঝে-মাঝে উঁচুনীচু জায়গাগুলোতে আর্থারকে হাত ধরে উঠতে সাহায্য করছিল সে আর গুনগুন করে কী একটা গানের গাইছিল।
বেশ কিছুটা উঠে তারপর একজায়গায় থমকে দাঁড়াল বৃদ্ধ। কান পেতে কী যেন একটা শুনে নিল সে। তার চামড়ার মধ্যে ঢুকে যাওয়া কুতকুতে চোখে যেন একটা ঝিলিক খেলে গেল। সে এবার পিছন ঘুরে বলল, “এসে গিয়েছি বাবু। বাঁদিকের এই রাস্তা দিয়ে আসুন।”
ওরা তাকিয়ে দেখল, একটা সরু রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। বৃদ্ধ বলেছিল, এ-রাস্তায় নাকি মানুষ খুব একটা আসে না। ওরা ওই রাস্তা দিয়ে এগোতে এগোতে অবাক হয়ে ভাবছিল, এমন নিখুঁত রাস্তা কি সত্যিই প্রকৃতির সৃষ্টি? দু-দিকে গায়ে গা ঠেকিয়ে গাছগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। আকাশ ঢেকে রেখেছে তাদের উঁচু মাথা। তার মাঝখান দিয়েই সংকীর্ণ পথটা এগিয়ে গিয়েছে সামনে।
আর্থারকে এবার সত্যিই বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল হাঁটতে গিয়ে। ক্রাচ মাঝে-মাঝেই উঁচুনীচু জায়গায় পড়ে গিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। তবে রাস্তাটা দীর্ঘ নয়। একটু এগোনোর পর একটা ফাঁকামতো জায়গায় এসে পৌঁছল ওরা। একটা সমভূমির মতো জায়গা। চারপাশটা গাছ দিয়ে ঘেরা। ঠিক সমতল ভূমিটার মাঝখানে দাড়িয়ে রয়েছে একটা দীর্ঘকায় গাছ। দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে গাছ দেখলে চিনে যাওয়ার একটা সহজাত ক্ষমতা তৈরি হয়ে গিয়েছে আর্থারের। কিন্তু এই দীর্ঘকায় গাছটা এক ঝলক দেখেই ও বুঝে গেল, তার চেনা কোনও গাছের সঙ্গে এই বৃক্ষের মিল নেই। বরং এমন একটা অদ্ভুত ধরনের গাছ আজ অবধি দেখেছে কি না তাতেই আর্থারের সন্দেহ হচ্ছিল। গাছটাকে দেখলে ঠিক একটা ন্যুব্জ বৃদ্ধের মতো মনে হচ্ছিল আর ওর লতাপাতা আর ডালগুলো গাছটার গায়ের সঙ্গেই এমনভাবে পাকিয়ে গাছটাকে জড়িয়ে রেখেছিল যে মনে হচ্ছিল ঠিক যেন একজন বৃদ্ধের গায়ের উপর শুধুমাত্র ছাল আর শিরা-উপশিরা লেগে রয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় আবার এই অস্বাভাবিকতাটা ছিল না। অন্যান্য গাছের মতোই সেই অংশগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই ডালপালা ছড়ানো ছিল। আর্থার বুঝতে পারছিল, কিছু একটা অদ্ভুত অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। কিন্তু হঠাৎ ফ্রেডরিকের অট্টহাসিতে ওর আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল।
ফ্রেডরিক হাসতে হাসতে বলছে, “ওহ্, বুড়ো! কী গল্প শোনালে আর শেষে এই সাধারণ একটা গাছ! এই একটা গাছকে নিয়ে কী না কী বললে?”
বৃদ্ধের ধৈর্যশক্তি অসাধারণ বলতে হবে। এই পরিস্থিতিতেও তার মুখে কোনও রাগের লেশমাত্র দেখা গেল না। বরং ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল অবজ্ঞার হাসি। সে বলল, “বিশ্বাস করতে তো তোমাকে বলিনি সাহেব। কিন্তু তোমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে মায়াবৃক্ষ বা তার ক্ষমতা কোনোটাই মিথ্যে হয়ে যাবে না।”
হঠাৎই বৃষ্টি নামল। কিন্তু আর্থার আর ফ্রেডরিক অবাক হয়ে দেখল, মায়াবৃক্ষের চারপাশের বৃক্ষহীন ভূমিটুকু বাদে সর্বত্রই বৃষ্টির জল পড়ছে, ফলে তাদের গায়েও একফোঁটা জল পড়ছে না। এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করতেই আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করল সে। অনেকক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা, অথচ একটাও পাখির ডাক শোনেনি আশেপাশে। যেন সবার অজান্তে আচমকাই নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গিয়েছে এখানকার সবকিছু। ঝোপের মধ্যে, গাছের মাথায় কোথাও কোনও প্রাণীর ডাকের শব্দ কানে আসছে না তার।
বৃদ্ধ তখনও ব্যঙ্গভরে বলে চলেছে, “তোমার যখন এতই অবিশ্বাস সাহেব, তখন একবার রক্ত দিয়েই দেখো না মায়াবৃক্ষকে। দেখো, সে তোমাকে কিছু ফিরিয়ে দেয় কি না।”
আর্থার ভেবেছিল, বৃদ্ধের অন্য কথায় মতো এই কথাটাকেও হেসে উড়িয়ে দেবে ফ্রেডরিক। কিন্তু আর্থারকে অবাক করে দিয়ে সে বলল, “বেশ। আমি রাজি। কোথায় রক্ত দিতে হয় বলো?”
ওঁর মুখ-চোখ ইস্পাতের মতো কঠিন। কৌতুকের লেশমাত্র লেগে নেই ওর চোখে-মুখে বা ঠোঁটের কোণে। বরং ওর মুখ-চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, যেন বৃদ্ধের সঙ্গে তার একটা ঠান্ডা নিঃশব্দ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে।
নিজের প্যান্টের পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে আনল সে। জঙ্গলে ঢোকার সময় ফ্রেডরিক এই ছুরিটা সঙ্গে রাখে।
“বলো, কোথায় রক্ত দিতে হবে?”
বৃদ্ধ গাছের একটা জায়গায় অঙ্গুলিনির্দেশ করল। আর্থার ও ফ্রেডরিক এগিয়ে গেল বৃদ্ধের নির্দেশিত জায়গাটার দিকে। আর্থার দেখল, বৃদ্ধ যে জায়গাটায় দেখাচ্ছে, সেটা গাছের গায়ে একটা গর্তের মতো অংশ। জায়গাটার গায়ে লেগে রয়েছে শুকিয়ে খয়েরি হয়ে যাওয়া রক্তের দাগ। ওদের বুঝতে অসুবিধা হল না, এর আগে অনেকেই এই পন্থা অবলম্বন করেছে তাদের জীবনের কোনও ভয়াবহ সমস্যা থেকে নিস্তার পেতে।
ফ্রেডরিকের মুখে আবার সেই হাসি ফিরে এসেছে। ছুরিটা দিয়ে নিজের বাঁ পায়ের উপর আলতো করে চালাল সে। ধারালো অস্ত্রটার আঘাতে ধীরে ধীরে রক্তের বিন্দু ফুটে উঠল জায়গাটায়। একসময় সেই রক্ত আঙুল দিয়ে তুলে সে লাগিয়ে দিল গাছের ওই জায়গাটায়। তারপর বিজয় গর্বে বলে উঠল, “নাও। লাগিয়ে দিয়েছিল রক্ত। কিছু হল? কিছুই না। যত্তসব তোমাদের আজগুবি গল্প।”
আর্থারের ভালো লাগছিল না। মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি খচখচ করছিল। মনে হচ্ছিল, খুব খারাপ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। আর বার বার মনে হচ্ছিল, ফ্রেডরিকের ওরকমভাবে বৃদ্ধের কথায় রক্তপাত করাটাও ঠিক হয়নি। ভালো লাগছে না। একদম ভালো লাগছে না। আকাশের দিকে তাকাল সে। কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে আকাশে। মেঘ ঘনিয়ে এসেছে তার মনেও।
(৩)
ফেরার পথে কোনও এক অজানা কারণে ওদের কেউই কোনও কথা বলল না। এই সময় ওদের মুখের দিকে তাকালে যে কেউ বলে দিত, প্রত্যেকের মুখে নেমে এসেছে আতঙ্ক আর বিষণ্ণতা মেশানো অদ্ভুত একটা অনুভূতির ছায়া।
হোটেলে ফিরে ব্যাগটা বিছানার উপর ফেলে আড়মোড়া ভাঙল ফ্রেডরিক। তারপর গর্বের হাসি হেসে বলল, “দেখলি, ওই বুড়োকে কেমন ভড়কে দিয়ে এলাম! আমাকে চ্যালেঞ্জ করছিল। হুহ্, পৃথিবীর এত জঙ্গল-টঙ্গল ঘেঁটে ফেললাম, ওইটুকু রক্ত দিতে নাকি ভয় পাব?”
আর্থার কেমন একটা ঝিমধরা গলায় বলল, “কী দরকার ছিল ওসব করার? ভারত রহস্যময় দেশ। আমার অনেক বন্ধুর মুখে শুনেছি, ভারতে বেড়াতে এসে এমন অনেক বিচিত্র কাহিনি ওরা লোকমুখে শুনেছে যার কোনও ব্যাখ্যা হয় না। অনেক গুপ্ত প্রথা রয়েছে এ-দেশের বিভিন্ন জঙ্গলে, যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না, বিজ্ঞান আজও যাকে ভেদ করতে পারেনি। এসব ব্যাপারে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করাটা ঠিক নয়।”
হো হো করে হেসে উঠল ফ্রেডরিক।
“তুইও এসব গালগপ্পে বিশ্বাস করছিস? আরে ওই বুড়ো আমাদের অচেনা লোক পেয়ে গপ্পো ফাঁদল, আর তুইও…”
আর্থার বলল, “পৃথিবীর সব রহস্য কি আজও ভেদ হয়েছে?”
“তুই থাম তো! খালি এইসব নিয়ে নাড়াচাড়া। বাড়িটাকে তো ভূতের বাড়ি বানিয়ে ছেড়েছিস, এখন এখানেও ওসব গাঁজাখুরি গপ্পের মধ্যে ভূত খুঁজছিস?”
ফ্রেডরিকের এই কথাটা বলার পিছনে কিন্তু কারণ ছিল। ছোটো থেকেই ভূতপ্রেত, অলৌকিক ইত্যাদি বিষয় গভীরভাবে আকর্ষণ করে আর্থারকে। বাড়িতে বিভিন্ন ভৌতিক বিষয়ের উপর লেখা বই ছাড়াও অনেক হাবিজাবি জিনিসপত্র জোগাড় করেছে। ব্ল্যাক ম্যাজিকের সরঞ্জাম থেকে শুরু করে জাপানের ভুডু ডল— কী নেই ওর সংগ্রহে।
কথা শেষ করেই ফ্রেডরিক বলল, “তোর কাছে কোনও মলম আছে? আমার পা-টা খুব চুলকোচ্ছে। মনে হয় কোনও পোকায় কামড়ে দিয়েছে।” বলে প্যান্টটাকে গুটিয়ে একটু উপরে তুলে ফ্রেডরিক বুঝল, ওর বাঁ পায়ের পাতাটা লাল হয়ে উঠেছে।
ফ্রেডরিকের কথার প্রত্যুত্তরে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল আর্থার। ব্যাগ থেকে মলম বের করে দিল ফ্রেডরিককে। মলমটা লাগিয়ে ঘরের পাশাপাশি থাকা খাট দুটোর একটায় শুয়ে পড়ল ফ্রেডরিক। বলল, “শরীরটা ভালো লাগছে না, বুঝলি। রাতে কিছু খাব না। তুই খেয়ে আয়। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই।”
আর্থার কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই শোনা গেল ফ্রেডরিকের নাসিকাগর্জন। গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছে ফ্রেডরিক। তবে ওর বাঁ পা-টা আরও লাল হয়ে উঠেছে। সেজন্যেই স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে ওর জন্মজড়ুলটা।
(৪)
খাওয়ার জন্য হোটেলের কিচেনেই চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা। নীচে নেমে আর্থার দেখল, এক কাপ কফি নিয়ে বৃদ্ধ গাইড বসে রয়েছে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে সে বলল, “আপনার বন্ধু এল না তো?”
বৃদ্ধের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু একটা ছিল যে অস্বস্তি হল আর্থারের। সে বলল, “হ্যাঁ, ওর শরীর ভালো লাগছে না। শুয়ে পড়েছে।”
“সেটাই স্বাভাবিক। ওর বাঁ পা কি খুব চুলকোচ্ছে? লাল হয়ে উঠেছে?”
এই কথাটায় যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল আর্থার। চকিতে বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকাল সে। ভেবেছিল বৃদ্ধের ঠোঁটে ব্যঙ্গবঙ্কিম হাসির রেখা দেখবে, কিন্তু তার পরিবর্তে দেখল, বৃদ্ধের মুখের নেমে এসেছে বিষণ্ণতার ধূসর ছায়া।
বৃদ্ধ বলল, “সাহেব, তোমার বন্ধু খুব বড়ো একটা ভুল করেছে। আমার উচিত ছিল তোমার বন্ধুকে আটকে দেওয়া। আসলে চাইলেও হয়তো আটকাতে পারতাম না। তোমার বন্ধুর মনে অহংকার ছিল। অহংকারকে বা অহংকারীকে মায়াবৃক্ষ টেনে নেয়। তোমার বন্ধুকেও মায়াবৃক্ষ টেনেছিল। তোমাদের তখন একটা কথা বলা হয়নি।” বলে একটু থেমে বৃদ্ধ বলল, “আগেই বলেছি, মায়াবৃক্ষের সঙ্গে যে দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক চলে মানুষের, তার মাধ্যম হল ওই রক্তের আহুতি। কিন্তু তোমার বন্ধু তো কিছু চায়নি। ফলে মায়াবৃক্ষ এবার ওর রক্তের গন্ধ পেয়েছে, ওকেই টানবে। কারণ, তোমার বন্ধু মনে মনে কিছু চায়নি। ওকে ছিবড়ে করে ফেলবে। তোমার বন্ধুকে বাঁচানো যাবে না সাহেব।” বিষণ্ণ মুখে বলল বৃদ্ধ।
আর্থারের হাত-পা কাঁপছিল। ও অলৌকিকে বিশ্বাস করে, কিন্তু এই মুহূর্তে প্রাণপণে চাইছিল যেন বৃদ্ধের প্রত্যেকটা কথা কাল্পনিক হয়, মিথ্যে হয়।
ভালোভাবে খাওয়া হয়ে উঠল না আর। কোনোমতে একটা রুটি খেয়ে ঘরে এসে পৌঁছল আর্থার এবং ঘরে ঢুকতেই চমকে উঠল।
(৫)
ঘরে ফ্রেডরিকের খাট খালি। শুধু কম্বলটা পড়ে রয়েছে। ভয়ে ভয়ে এগোল আর্থার। ও বুঝতে পারছিল, একটা অব্যক্ত কান্নার দমক ওর বুকের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে, কিন্তু তার থেকেও যে অনুভূতিটা ওর মধ্যে তীব্র হয়ে উঠেছে, তা হল ভয়। তীব্র একটা ভয়, অজানা একটা আশঙ্কা ওর সারা শরীরে একটা শিরশিরানি ধরিয়ে দিচ্ছিল। তবুও একটা দুর্নিবার আকর্ষণে ও এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল ফ্রেডরিকের খাটটার সামনে এবং কাঁপা কাঁপা হাতে সরিয়ে ফেলল কম্বলখানা।
শুয়ে আছে ফ্রেডরিক। ঘুমোচ্ছে। ওঁর বুক ওঠানামা করছে স্বাভাবিক ছন্দে। ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল আর্থারের, হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন। এতক্ষণ ওই বৃদ্ধের কথাগুলো মাথার মধ্যে এমনভাবে ঘুরছিল যে, সে কীসব উদ্ভট কথা ভেবে বসেছিল।
কিন্তু তবুও রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারল না সে। মাঝে-মাঝেই দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল আর্থারের। কখনও দেখছিল, ফ্রেডরিককে ওই মায়াবৃক্ষ তার ডালপালা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কখনো-বা দেখছিল, ওই বৃদ্ধের গা থেকে ডালপালা, পাতা গজাতে শুরু করেছে। এমনি সব টুকরো টুকরো দুঃস্বপ্নের অভিঘাতে ঘুম ভেঙে বার বার ধড়ফড় করে বিছানার উপর উঠে বসছিল সে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই ওর চোখ চলে যাচ্ছিল পাশের বিছানার দিকে এবং প্রতিবারই সে দেখছিল, ফ্রেডরিক ঘুমোচ্ছে অঘোরে।
ভোররাতের দিকে চোখটা লেগে গেল আর্থারের। কিন্তু তবুও ঘুম দীর্ঘস্থায়ী হল না। সাড়ে ছ’টা নাগাদ ঘুমটা ভেঙে গেল আর্থারের। চারদিকে তখনও একটা অন্ধকার অন্ধকার ভাব রয়েছে। বারান্দার দিকে চোখ চলে গেল ওর। ফ্রেডরিক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ও ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে এগিয়ে গেল। বারান্দায় গিয়ে ফ্রেডরিকের পাশে দাঁড়াতে ও যেন বেশ চমকে উঠল। আর্থারের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে ফ্রেডরিক বিড়বিড় করে বলল, “মায়াবৃক্ষ সত্যিই তোর পা ঠিক করে দিয়েছে।”
চমকে উঠে নিজের পায়ের দিকে তাকাল আর্থার। সত্যিই! সে ঘুম-চোখে খেয়ালই করেনি, ক্রাচ ছাড়াই যে আর্থার এক পাও চলতে পারে না, সে চলে এসেছে বিছানা থেকে বারান্দা পর্যন্ত, নিজের পায়ে হেঁটে! তখনই আর একটা কথাও মাথায় এসে ধাক্কা মারল ওর। তার মানে, ফ্রেডরিক ইচ্ছা করেই…
ও ফ্রেডরিকের মুখের দিকে তাকাল।
তখনও ফ্রেডরিক বিড়বিড় করে বলে চলেছে, “আমার জীবনে কিছুই হবার নেই। জুয়া, নেশা করেই সব নষ্ট হয়ে গেল, বেশিদিন হয়তো বাঁচব না। কিন্তু তুই ভালো ছেলে আর্থার। তোর অনেক কিছু করার আছে। ভাগ্যের পরিহাসে শুরু… খোঁড়া তো আমার হওয়া উচিত ছিল। আই ওয়াজ আ গুড ফর নাথিং। কিন্তু তুই, তুই চিরকাল চেয়েছিলি ছুটতে, এগিয়ে যেতে। হোস্টেলের ছেলেগুলো যখন তোর পা দেখে হাসিঠাট্টা করতে, খুব রাগ হত। অসহায় লাগত। বন্ধুর জন্য কি কিছুই করতে পারব না?”
এলোমেলোভাবে অনেক কথা বলে চলেছিল ফ্রেডরিক। কিন্তু সে-সব কানে ঢুকছিল না আর্থারের। ওর চোখ আটকে ছিল আর্থারের বাঁ পায়ে। শুকিয়ে সরু হয়ে এসেছে পা-টা। অজান্তেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠল ওর।
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস
বহু কলমের গল্পে, প্রবন্ধে, সত্যি ঘটনায়, তথ্যে, গ্রাফিক নভেলে প্রাইমেটদের হাজারো কাণ্ড।
সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান কোনও রোমহর্ষক অভিযানের চেয়ে কম নয়। প্রাণ বাজি রেখেছিলেন দুই সহযোদ্ধা—শিশিরকুমার বসু ও ভগৎরাম তলওয়ার। তাঁকে ছদ্মবেশ নিতে হয়েছে আফগান পাঠানের, কখনও সাজতে হয়েছে বোবা-কালা, নিতে হয়েছে ইতালিয় জনগোষ্ঠী সিসিলিদের সঙ্গে শারীরিক গঠনের মিলের আড়াল। কলকাতা ছাড়ার প্রস্তুতির দিনগুলো থেকে শুরু করে কাবুলের শেষ দিন পর্যন্ত সুভাষচন্দ্রের এই দুঃসাহসিক যাত্রার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ।