প্রবন্ধ
FREE SHIPPING IN INDIA
প্রবন্ধ
গণমাধ্যমের কাছে স্থানীয় অধিবাসীরা কেউ এই জন্তুটি নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। বলা ভালো মুখ খোলেননি। একটা অজানা ভয় যেন প্রশ্নকারীদের চেপে রেখেছিল। অথচ কেউ মৃত প্রাণীটির অস্তিত্ব অস্বীকারও করেননি। একজন শুধু উত্তর করেছিলেন, ‘জানা বা খোঁজার চেষ্টা কোরো না, খুঁজে পাবে না। আর জন্তুটি দেখতে চেয়ে নিজের অমঙ্গলও ডেকে এনো না।’
অরিন্দম দেবনাথ
মন্টাক উপদ্বীপের (Montauk peninsula) কিনারায় ভেসে আসা অদ্ভুত প্রাণীটি প্রথম দর্শনের পর থেকে বছরের পর বছর ধরে রয়ে গেছে রহস্যের মোড়কে। এটি কি শূকর, না রেকুন, না কুকুর, না অন্য কোন প্রাণী?
মন্টাক দানোর গল্প শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের কাছে মন্টাক উপদ্বীপের জনপ্রিয় সার্ফিং বিচ ‘ডিচ প্লেইনস’-এর তীরে ভেসে আসা একটি অদ্ভুত আকৃতির প্রাণীর পচে যাওয়া একটি দেহ দেখার পর।
২০০৮ সালের জুলাই মাসের ১২ তারিখ তিন তরুণী বন্ধু জেনা হিউইট, রাচেল গোল্ডবার্গ ও কোর্টনি ফ্রুইন নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের ধার ধরে হাঁটার সময় বিচের লেজের মতো অংশের শেষে একটা অদ্ভুত গড়নের জন্তুর পচা-গলা মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। তরুণীরা ছবি তুলতে দেরি করেননি। রোদের তেজে পচা-গলা শরীরটা আধা ঝলসে ছিল যেন। পরে তরুণীরা দাবি করেছিলেন, রোদ্দুরে নয়, জন্তুর শরীরটা সম্ভবত আগুনে পুড়ে গেছিল। দিন কয়েক পর ২৯ জুলাই এই জন্তুর ছবিটা মাত্র ৮৭ শব্দের একটি পোস্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় ব্লগ গওকর-এ (Gawker) প্রকাশিত হবার সামান্য সময়ের মধ্যে ইন্টারনেটে ঝড় তুলেছিল। জন্তুটির কথা ছবি-সহ প্রকাশিত হয়েছিল নানা সংবাদমাধ্যমে, লক্ষ লক্ষ লোক মেতে উঠেছিল জন্তুর ছবিটি নিয়ে।
এই ছবিগুলো প্রকাশ্যে আসতে দেরি হয়েছিল, কারণ তিন তরুণীর তোলা ছবিগুলোকে গওকর ব্লগের আগে কেউ গুরুত্ব দেয়নি অথবা সঠিক জায়গায় পৌঁছয়নি।
অনেকটা কুকুরের মতো দেখতে হলেও নীলচে চামড়ার বড়ো বড়ো লোমওয়ালা প্রাণীটার মাড়ির দু-পাশ দিয়ে বড়ো বড়ো দাঁত বেরিয়ে ছিল। তার থেকেও আশ্চর্য ছিল মুখের সামনে নাকের নীচে ঠোঁটের মতো আকার। ওপরের পাটির দাঁত ও ঠোঁট ভাঙা ছিল। চার পায়ের আঙুলের গড়নও ছিল অদ্ভুত। ছবিটি দেখে কেউ ভেবেছিলেন এটা বোধ হয় অর্ধেক চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া কোনও রেকুনের মৃতদেহ। আবার কেউ ভেবেছিলেন পচে যাওয়া পিটবুল হবে। কেউ ভেবেছিলেন খোলা ছাড়ানো কচ্ছপ। কিন্তু রেকুন বা পিটবুলের ঠোঁট হয় না, আবার কচ্ছপের মুখের সামনের গড়ন ঠোঁটের মতো হলেও তার বড়ো বড়ো দাঁত হয় না। অনেকে আবার মন্তব্য করেছিলেন, কাছের প্লাম আইল্যান্ডের রহস্যময় প্রাণী রোগ গবেষণা কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়া কোনও ‘মিউট্যান্ট’ প্রাণী হবে। কিন্তু সবাই একটি বিষয়ে একমত ছিলেন যে প্রাণীটি যা-ই হোক না কেন, আগে এই আকৃতির কোনও জন্তু দেখা যায়নি। পাশাপাশি ছবির সত্যতা নিয়ে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেনি। জন্তুটির পচা-গলা মৃতদেহ দেখার দিন সতেরো পর যখন ছবিটি প্রকাশ পায়, ততক্ষণে দেহটি হাপিশ হয়ে গেছিল। সম্ভবত কেউ বা কারা তুলে নিয়ে গেছিল। কারণ, যেখানে মৃতদেহটি দেখা গেছিল, সেখান থেকে জোয়ারের জলে দেহটি ভেসে যাবার কোনও সম্ভবনা প্রায় ছিল না। অদ্ভুত গড়নের এই প্রাণীটি নাম পায় ‘মন্টাক মনস্টার’ (Montauk Monster)।
এই অজানা প্রাণীটির ছবি ও খবর গওকর ব্লগে দেরিতে প্রকাশিত হবার কারণ প্রথমে ছবিটি গিয়েছিল গওকরের সিস্টার কনসার্ন জেজেবেলের আনা হোমসের কাছে। তিনি প্রথমে এটিকে বেশি পরিমাণে পর্যটক আকর্ষণ করার জন্য কোনও বিজ্ঞাপনী গিমিক বলে মনে করেছিলেন। কারণ, তিনি সম্প্রতি বিজ্ঞাপন বিভাগ থেকে কন্টেন্ট রাইটিং বিভাগে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। ক’দিন ফেলে রাখার পর তিনি ছবিটি পাঠিয়ে দেন গওকরের রিচার্ড লারসনের কাছে। লারসন কিছুদিন আগে পর্যন্ত গওকরের বিজ্ঞাপন বিভাগ দেখতেন, সেখান থেকে কন্টেন্ট রাইটিং-এ যান। সেই সময় প্রায় কুড়ি জন কন্টেন্ট রাইটারকে তাঁদের ডেস্ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে গুরুত্ব দিয়ে নতুন বিষয় দেখার কেউ ছিল না। লারসন অত কিছু না ভেবে ছবিটি পোস্ট করার কয়েক মিনিটের মধ্যে শোরগোল পড়ে যায়। ফক্স নিউজ, হাফিংটন পোস্ট এবং এনবিসির মতো জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলি বিষয়টি লুফে নেয়। যাঁরা অদ্ভুত এবং সন্দেহজনক ছবি দেখলে তার গুরুত্ব এবং সত্যাসত্য যাচাই করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন, সেইরকম ব্যক্তিরা নেমে পড়েছিলেন বিষয়টি খতিয়ে দেখতে। ছবি ছাড়া আর কিছু ছিল না, ফলে প্রথমে একজন এটিকে রাবারের তৈরি ‘খেলনা’ বলে আখ্যা দিলেও বহু সংবাদ মাধ্যম ও বিশেষজ্ঞ মন্টাক উপদ্বীপে আস্তানা গেড়েছিলেন প্রাণীটির অস্তিত্ব যাচাই করতে। কিন্তু ততদিনে প্রাণীটি উধাও হয়ে গেছিল তট থেকে। পরে লারসন বলেছিলেন, ‘আমি ভাবতে পারিনি একটি মৃত ভয়ংকর দর্শন প্রাণীর ছবি এত গুরুত্ব পেতে পারে।’
গণমাধ্যমের কাছে স্থানীয় অধিবাসীরা কেউ এই জন্তুটি নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। বলা ভালো মুখ খোলেননি। একটা অজানা ভয় যেন প্রশ্নকারীদের চেপে রেখেছিল। অথচ কেউ মৃত প্রাণীটির অস্তিত্ব অস্বীকারও করেননি। একজন শুধু উত্তর করেছিলেন, ‘জানা বা খোঁজার চেষ্টা কোরো না, খুঁজে পাবে না। আর জন্তুটি দেখতে চেয়ে নিজের অমঙ্গলও ডেকে এনো না।’ শুধু পরিচয় দিতে না চাওয়া এক ব্যক্তি ‘নিউজ ডে’র সাংবাদিককে ডিচ প্লেইনের দানবের মৃতদেহকে এক অজ্ঞাত বাসস্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর কয়েকজন দেখেছেন বলে শুনেছেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনোভাবেই সেই প্রত্যক্ষদর্শীদের পরিচয় দেননি। ভয় চেপে ছিল সেই ব্যক্তির চোখে ও শরীরী ভাষায়।
এক প্রত্যক্ষদর্শী ‘নিউজ ডে’র সাংবাদিককে মন্টাক মনস্টারের ছবি দেখে বলেছিলেন, ‘আরে ওটা তো একজনের বাড়ির পেছনের জঙ্গলে পুঁতে রাখা হয়েছে। ওর মাংস, চামড়া সব পচে খুলে গেছে, দেখলেও এই ছবির সঙ্গে মেলাতে পারতে না। জন্তুটা তো বেড়ালের মাপের ছিল।’ কিন্তু কোনোভাবেই জন্তুটা কোথায় বা কার বাড়ির পেছনের জঙ্গলে পোঁতা আছে তা জানাননি।
পোর্টল্যান্ডের মেইন অঞ্চলে বসবাসকারী ক্রিপ্টোজুলজিস্ট (ক্রিপ্টোজুলজিস্ট হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি কিংবদন্তি, লুকোনো অথবা মূলধারার বিজ্ঞানের বাইরের প্রাণীদের বিষয়ে অধ্যয়ন এবং খোঁজখবর করেন।) লরেন কোলম্যান, যিনি পোর্টল্যান্ডের আন্তর্জাতিক ক্রিপ্টোজুলজি জাদুঘরের পরিচালকও, তিনি এই প্রাণীটি সম্পর্কে খবর ভাইরাল হবার আগেই শুনেছিলেন। বস্তুত তিনিই এই প্রাণীটির নামকরণ করেছিলেন ‘মন্টাক মনস্টার’।
কোলম্যান ‘দ্য অবজার্ভার’ পত্রিকাকে বলেন, ‘গাওকর ব্লগে খবরটা বের হতেই আমি নাগাড়ে ফোন পেতে শুরু করি। কিন্তু আমি সন্দেহবাতিক, সহজে কোনও কথা বিশ্বাস করি না।’
ক্রিপ্টোজুলজি হল বিজ্ঞানের এমন একটি ধারা যা ‘বিগফুট’ থেকে শুরু করে ‘চুপাকাব্রার’ (chupacabra - ল্যাটিন আমেরিকান লোককাহিনির একটি কিংবদন্তি, রহস্যময় প্রাণী, যাকে ভ্যাম্পিরিক জন্তু হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি গবাদি পশুদের, বিশেষ করে ছাগলকে আক্রমণ করে রক্ত শুষে নেয়।) মতো লোককাহিনি বিষয়ক বস্তুকেও গুরুত্ব সহকারে দেখে। কোলম্যান হলেন এই ধরনের বিষয় অনুসন্ধানের প্রথম সারিতে।
১৯৭৭ সালে ম্যাসাচুসেটসের বছর সতেরোর তিন স্কুল ছাত্র বাইবেল ছুঁয়ে শপথ করে বলেছিল, বোস্টন অঞ্চলে রাতের দিকে গাড়িতে করে ভ্রমণের সময় ডোভার নামের ছোটো এক শহরের কাছে গাড়ির হেড-লাইটের আলোয় কুকুর বা বেড়ালের মতো জ্বলজ্বলে চোখের একটি প্রাণীকে পাথরের ওপর বসে থাকতে দেখে যার পায়ের নখগুলো কুমড়ো গাছের আকর্ষের মতো লম্বা আর পাকানো। খবরের কাগজে শোরগোল পড়ে যায় এই কিশোরদের দাবি নিয়ে। কোলম্যান ছুটে যান সত্যাসত্য যাচাই করতে। তিনি জন্তুটির নাম দেন ‘ডোভার ডেমন’। ডেকে নেন আরও তিন ক্রিপ্টোজুলজিস্ট জোসেফ নাইম্যান, এড ফগ এবং ওয়াল্টার ওয়েবকে। সকলেই পূর্ব ম্যাসাচুসেটসের সুপরিচিত ইউফোলজিক্যাল (Ufology - অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু বিষয়ক গবেষণা) গবেষক। ওয়াল্টার ওয়েব ছিলেন বোস্টনের বিজ্ঞান যাদুঘর হেইডেন প্ল্যানেটারিয়াম-এর সহকারী পরিচালক। কোলম্যানের মনে হয়নি যে এই কিশোর বাহিনী মিথ্যে দাবি করছে, কিন্তু কথা বলে নিশ্চিত হতে এই বিশেষজ্ঞদের এনেছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় হাজির ছিল কিশোরদের পরিবার, শিক্ষাবিদ, মনোবিদ-সহ আইন রক্ষকদের দলও। কেননা বিষয়টা জনসাধারণের মধ্যে বিপুল কৌতূহলের পাশাপাশি ভয়ও জাগিয়েছিল।
তিনজনের এক কিশোর বিল বার্টলেট জানিয়েছিল, ফার্ম স্ট্রিটের পাথরের দেওয়ালের ওপর হামাগুড়ি দিতে থাকা প্রাণীটাকে প্রথমে কুকুর বা বেড়াল মনে করলেও সরাসরি গাড়ির হেড-লাইটের আলো ওর ওপর পড়াতে ভালো করে লক্ষ করে দেখে রোগাপাতলা প্রাণীটার মাথাটা তরমুজের মতো আর তাতে চোখ-কান বলে কিছু নেই। চোখগুলো কমলা কাচের গুলির মতো আর রোমহীন প্রাণীটার চার পায়ের আঙুলে লম্বা কুমড়ো গাছের আকর্ষের মতো লতপতে নখ। পুরো শরীরটা যেন স্বচ্ছ কাচের, ঠিক যেন কোন অলৌকিক চেহারার প্রাণী। আলো পড়ে ঝলসে উঠছিল।
আর একজন বলে, প্রাণীটির চোখগুলো সবুজ, লোমহীন লম্বা নখের প্রাণীটা লম্বায় প্রায় তিন ফুট, পাখি আর সাপের আওয়াজ মেশানো তীক্ষ্ণ হিসহিসে শব্দ করছিল। বিবরণে সামান্য হেরফের থাকলেও সবাই কিন্তু একটা কথা বলে, জন্তুটার মাথাটা ফুটবলের মতো গোল, তাতে চোখ থাকলেও কোনও নাক বা কান ছিল না, আর খুব রোগা।
এরপর জন ব্যাক্সটার (১৫) এবং পিট মিচেল (১৩) নামের দুই কিশোর অনুরূপ অদ্ভুতদর্শন প্রাণী দেখেছিল বলে জানিয়েছিল। জঙ্গলের পথ ধরে তারা যখন বাড়ি ফিরছিল, তখন একটি প্রাণী দেখেছিল যার দুটো পা, দুটো হাত এবং মাথাটা গোল। সেটা খাল পাড় ধরে দৌড়ে একটি গাছের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
পরদিন, ১৫ বছর বয়সি অ্যাবি ব্রাহাম এবং ১৮ বছর বয়সি উইল ট্রেইন্টর দাবি করে, তারা রাস্তার পাশে ট্রেইন্টরের গাড়ি থেকে একইরকম দেখতে একটি প্রাণী দেখেছে। ব্রাহামের বর্ণনা বার্টলেট এবং ব্যাক্সটারের বর্ণনার সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। দুজনেই বলে প্রাণীটার চোখ সবুজ রঙের ছিল। তবে ব্রাহাম প্রাণীটার উচ্চতা প্রায় ছাগলের মতো বলে দাবি করে। তদন্তকারীরা ব্রাহামকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে গাড়ির হেড-লাইটের আলোয় সবুজ চোখ প্রতিফলিত হয়েছে, অন্যদিকে বার্টলেট উল্লেখ করে যে সে গাড়ির আলোয় কমলা চোখই দেখেছে। দুজনেই তাদের বর্ণনায় অটল ছিল। এরপর এই প্রাণীটিকে কেউ আবার দেখেছে বলে দাবি করেনি। প্রাণীটি যে কী ছিল, আজও তা রহস্যই থেকে গেছে।
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রাণীটির ছবি আঁকা হয়। প্রচার হয়ে যায়, রাতে প্রাণীটি রাতে স্বচ্ছ আকার ধারণ করে বা অদৃশ্য হয়ে যায় আর দিনের বেলায় ডোভার ম্যাসাচুসেটসের গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে।
***
“১২ জুলাই ছিল আমার জন্মদিন। সারা বিশ্ব থেকেই প্রচুর শুভেচ্ছা বার্তা পেতে শুরু করেছিলাম সকাল থেকে, ওই ছবিটাও এসেছিল। ভেবেছিলাম আমার সঙ্গে মজা করার জন্য কেউ ছবিটা পাঠিয়েছে।” কোলম্যান বলেছিলেন।— “যদিও ছবিটা এক ঝলক দেখেই আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম।”
কোলম্যান নিজেই প্রাণীটার মৃতদেহ দেখতে উৎসাহী ছিলেন।— “আমার কাছে নিউইয়র্ক যাওয়াটা কোনও সমস্যাই ছিল না। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম যে মৃতদেহটি উধাও হয়ে গেছে।”
কোলম্যান চেষ্টা করেছিলেন যে তিন তরুণী ছবিটি তুলেছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার, কিন্তু তারাও উধাও হয়ে গেছিল। নিজেদের চারপাশে এক অদৃশ্য পাঁচিল তুলে সব যোগাযোগ ছিন্ন করেছিল তরুণীর দল।
“অনেক কসরত করে ওই অদৃশ্য পাঁচিলের ধারে পৌঁছতে পেরেছিলাম, কিন্তু ভাসা ভাসা ভাষা উত্তর ছাড়া আমার জিজ্ঞাসার কোনও বিস্তারিত উত্তর মেলেনি। তিনজনের কেউই জন্তুটিকে নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনায় যেতে চায়নি।” কোলম্যান এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন।
সার্ফার এরিক ওলসেন তথা রয়েল এস্টেট এজেন্ট ‘ইস্ট হ্যাম্পটন স্টার’ পত্রিকাকে বলেছিলেন যে তিনি মন্টেক মনস্টারের পচা মৃতদেহটি এক বন্ধুর বাগানে পুঁতে দিয়েছেন যাতে ভবিষ্যতে হাড়গুলো সংরক্ষণ করে সেগুলো এক ফ্যাশন ফটোগ্রাফারের আর্ট প্রজেক্টে বিক্রি করতে পারেন। ফেসবুকে পাওয়া এই খবরের ভিত্তিতে কোলম্যান এরিককে মেসেজ করেছিলেন, কিন্তু কোনও উত্তর মেলেনি। এরিকের সঙ্গে যোগাযোগের অন্য কোনও উপায়ও কোলম্যান খুঁজে পাননি। সাক্ষাৎকারের জন্য সময় চেয়ে মেসেজ করেছিলেন সেই ফ্যাশন ফটোগ্রাফার ও বাগান বাড়ির মালিককে – কেউ উত্তর করেননি কোলম্যানকে। এমনকি এক ব্লগ পরিচালক ব্যক্তি যিনি এই মনস্টারের মৃতদেহ দেখেছিলেন বলে তাঁর ব্লগে দাবি করেছিলেন, তিনিও কোলম্যানের সাক্ষাৎকারের অনুরোধ রাখেননি। তিনি নিজে এই দানবের মৃতদেহ দেখেছিলেন কি না—এইরকম সোজা প্রশ্নের উত্তর দিতেও অস্বীকার করেন।
রাচেল গোল্ডবার্গ মন্টেক মনস্টার দেখা ও ছবি তোলা তিন তরুণীর একজনকে কোলম্যান একটি ই-মেইল পাঠাতে পেরেছিলেন। উত্তরটা এসেছিল নিরাশাজনক— ‘আমি এই বিষয়ে কোনও আলোচনা করতে অপারগ – আলোহা।’ (একই সঙ্গে যার অর্থ হ্যালো ও গুডবাই)।
জনমানসে মন্টাক মনস্টার যেন এক অশুভ প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাকে নিয়ে আলোচনা করলেও বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে। ওই ঘটনা, ছবি বা খবরের সঙ্গে জড়িত সবাই এক অস্বস্তিতে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।
মন্টাক মনস্টার নিয়ে আরও একটি গুজব ছড়িয়েছিল যে, জন্তুটি আসলে ‘পাম আইল্যান্ড’-এর প্রাণী রোগ গবেষণা কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়া গোপনীয় একটি গবেষণার নমুনা। কিন্তু জানা গিয়েছিল, এই ধরনের কোনও গবেষনা ওখানে হয় না। প্রাণী জিন সংক্রান্ত গবেষণা হলেও ওটি মূলত একটি অ্যানিম্যাল ডিসিস সেন্টার। একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে কোনও গোপনীয়তার পর্দা না রেখেই পুরো কেন্দ্রটি ঘুরে দেখে ছবি তুলতে দেওয়া হয়। ছবি তুলিয়ে দলের প্রধান জোর গলায় বলেছিলেন, ওই পশু কেন্দ্রের নিরাপত্তা এতই কঠোর যে কোনও প্রাণীর ওখান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।
মন্টাক মনস্টারের কথা প্রকাশিত হবার বছর খানেক পর একটা গুজব ছড়িয়েছিল যে ওটা ভাইকিংদের এক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় পুড়িয়ে মারা এক সামুদ্রিক জীব যা ভেসে এসেছিল। আবার কেউ বলেছিলেন, ওটা একটা মরা রেকুনের শরীর।
ক্রিপ্টোজুলজিস্টদের অনেকেই, বিশেষ করে কোলম্যান এই মরা রেকুনের তত্ত্ব মেনে নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “প্রাণীবিদ্যা সম্পর্কে আমার জ্ঞান অনুযায়ী ছবি দেখে যা মনে হয়েছে তাতে মৃত রেকুন পচে দ্বিতীয় দিনে এইরকম রূপ ধারণ করতে পারে। জলে ভাসতে ভাসতে ঢেউয়ের আঘাতে চামড়া উলটে শরীরের ভেতরে চর্বি বেরিয়ে এসে পাথরের ঘষায় মুখের গঠনের বিকৃতি অসম্ভব কিছু নয়। যদিও নিশ্চিত করে বলা কঠিন।”
ক্রিপ্টোজুলজিস্টরা মন্টেক মনস্টারকে নিয়ে অজানা প্রাণী বা মনস্টারের তত্ত্ব উড়িয়ে দিলেও, এর রহস্যময় প্রাণীর তকমা জুটে গেছিল বিশ্ব জুড়ে। এমনকি একটি পানীয় কোম্পানি প্রচুর অর্থের বিনিময়ে কোলম্যানকে দিয়ে দু-লাইন বলিয়ে নিতে চেয়েছিল যে ‘এটি কোনও অজানা প্রাণী হলেও হতে পারে’, যা তাদের ‘মন্টাক মনস্টার’ নামের নতুন পানীয় বিজ্ঞাপনে নতুন মাত্রা দেবে। কোলম্যান রাজি হননি। অনেকে বলেন, মৃত প্রাণীর ছবিটি এমনভাবে তোলা হয়েছিল, যা দেখে এটাকে অজানা প্রাণী বলে মনে হয় এবং লোককে বোকা বানিয়ে এই ছবির বিনিময়ে তিন ছবি তুলিয়ে তরুণী অনেক অর্থ রোজগার করেছিল। কিন্তু প্রমাণ হয়েছিল, তরুণীরা না কোনও অর্থ দাবি করেছিল, না পেয়েছিল।
কোলম্যানের বিশ্বাস যে ছবি তুলিয়ে তরুণীরা কোনও কারচুপি করেনি। ওটা রেকুনের পচা-গলা দেহ। স্থানীয়রা দেহটি সরিয়ে এমনভাবে রহস্যময় অশুভ প্রাণীর গল্প তৈরি করেছিল যাতে ওই অঞ্চলে বেড়ে চলা পর্যটকদের আনাগোনা বন্ধ হয়ে তারা শান্তিতে থাকতে পারে।
এই রহস্যের আজও সমাধান হয়নি। মন্টেক মনস্টারকে নিয়ে নভেল লেখা হয়েছে। অজস্র টিভি শো হয়েছে। এখনও অনেকে মনে করে, কোনও বিজ্ঞানীর বেআইনি গবেষণাজাত জন্তু কোনোভাবে পালিয়ে এসে তটে ঢেউয়ের আঘাতে মারা গেছিল।
লেখকের অন্যান্য লেখা
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস