ছোটো গল্প
FREE SHIPPING IN INDIA
ছোটো গল্প
মনে মনে মা দুর্গাকে গাল পাড়ি— সেই তৃতীয়ার দিন শিলং ছেড়ে নেমেছি দুর্গাপুজোয় বাড়ি যাব বলে, আর সেই থেকে এমন পেছনে লেগেছ মা যে, অতিষ্ঠ করে ছেড়েছ একেবারে। ডাকাতের তাড়া খাওয়ালে প্রথমে, তারপর এই ভাঙাচোরা ট্রেনে চাপিয়ে কোন চুলোয় নিয়ে চলেছ কে জানে। তাতেও সাধ পুরল না, এখন না খাইয়ে মারবার চাল ধরেছ। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই, হাতে চার পিস বাসি স্যাঁতসেতে পাউরুটি, সে যে গিলব দুজনে তার জন্য একফোঁটা জলের জোগাড় অবধি হল না গত তিন-চার ঘণ্টায়।
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
সে-বছর বৃষ্টি হয়েছিল সাংঘাতিক। শিলং পাহাড়ে থাকি তখন। সবে মেয়ে জন্মেছে। অতএব সকন্যা গিন্নি ও তাঁর শাশুড়ি পশিমবঙ্গের বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন, পাহাড়ের বাসায় আমি একা।
তা, পুজোর ঠিক আগে আগে বাড়ি যাবার জন্য রওনা দিয়ে শিলং পাহাড় থেকে গুয়াহাটি নেমে এসে দেখি বন্যার চোটে ট্রেন বাতিল। প্রথমে চেষ্টা করলাম একটা ওভার-নাইট বাসে চেপে শিলিগুড়ি চলে আসবার। তাতে মাঝরাস্তায় ডাকাতে ধরল। সে-গল্প অন্যত্র লিখেছি। সে দুর্যোগ থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে ফের গুয়াহাটি ফিরে শুনি রেল কর্তৃপক্ষ নাকি বেদম দয়াপরবশ হয়ে একখানা প্যাসেঞ্জার স্পেশাল জোগাড় করেছেন কলকাতা অবধি লোক নিয়ে যাবার জন্য।
তা, সে-গাড়ির কামরাদের যে কোন কবরখানা খুঁড়ে তুলে আনা হয়েছিল তা মা কামাখ্যাই জানেন। ভাঙাচোরা, আলো জ্বলে না, জল নেই, টয়লেটে দেড় ইঞ্চি শ্যাওলা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এহেন অখাদ্য ট্রেনের একেবারে লেজের দিকে একটা পরিত্যক্ত প্যান্ট্রি কারও জুড়ে দেয়া হয়েছিল। সম্ভবত দূরপাল্লার ট্রেনে প্যান্ট্রি কার জোড়া তখনকার আইন ছিল তাই জুড়ে দিয়েছে। বাস্তবে তার জীবদ্দশা বহু আগেই ফুরিয়েছে। রান্নাবান্নার বন্দোবস্ত নেই। ওদিকে লোক বসবার আসন-টাসনও নেই। কাজেই কোচটা ছিল একেবারেই ফাঁকা।
বাকি কামরাগুলোয় বিচ্ছিরি ভিড়। তাদের সঙ্গে বেদম গুঁতোগুঁতিতে হার মেনে আমি আর আমার সফরসঙ্গী এক ছোকরা মিলে সেই পরিত্যক্ত প্যান্ট্রি কারেই গিয়ে উঠলাম। তারপর জানালার পাশে রাখা একটা বেঞ্চি খুঁজে নিয়ে টর্চের আলোয় আরশোলা ইঁদুর তাড়িয়ে তাতে গিয়ে বসা গেল।
রসদ বলতে দু-বোতল জল আর দু-খানা এক পাউন্ড করে পাউরুটি জোটানো গিয়েছিল। তুমুল বর্ষার মাঝ-রাত্তিরে নিষ্প্রদীপ গুয়াহাটি স্টেশনে তখন সেইটুকু যে জুটেছে সেটাই সৌভাগ্য।
পথচলতি যেসব নাটক-নভেল ঘটেছিল সে-যাত্রা, তার কথা বাদ দিচ্ছি। তা, সেই করতে করতে একদিনের পথে পাক্কা দুটো দিন খরচা করে অবশেষে গাড়ি এসে ঢুকল বর্ধমান স্টেশনে। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে কর্ড লাইনে এসে ঢুকতে এতক্ষণ গুটগুটিয়ে যেটুক এগোচ্ছিল তাও গেল। এক মিনিট চলে তো তিন মিনিট দাঁড়ায়। আর দাঁড়াবে সবসময় দুটো স্টেশনের মাঝখানে।
ক্লান্তিতে তখন আমাদের শরীর ভেঙে পড়ছে। খিদেয় তেষ্টায় শরীরে ত্রাহি মধুসূদন হাঁক। সঙ্গে সম্বল বলতে কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখা পাউরুটির চারখানা স্যাঁতসেতে স্লাইস। জল যেটুকু ছিল তা ফুরোবার পর ট্রেন এমন কোথাও দাঁড়ায়নি যে বোতল ভরে নিতে পারি।
রাত্তির তখন বাজে প্রায় সাড়ে ন’টা। আজিমগঞ্জ ছাড়িয়ে গাড়ি তখন শামুকের মতো হাঁটছে কলকাতার দিকে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে মাঝে মাঝে চোখে পড়ে, অত দুর্যোগের মধ্যেও মা আসছেন। সেদিন মহাষষ্ঠী। অন্ধকার জল-মাটি পেরিয়ে, রেলগাড়ির একটা নিরানন্দ অন্ধকার কামরায় চেপে দুজন ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত মানুষ চলেছে। জানালার বাইরে মাঝে-মাঝেই ইতিউতি কাছে-দূরে পুজোর আলো, ঢাকের চাপা শব্দ…
সেইসব দেখি, শুনি আর মনে মনে মা দুর্গাকে গাল পাড়ি— সেই তৃতীয়ার দিন শিলং ছেড়ে নেমেছি দুর্গাপুজোয় বাড়ি যাব বলে, আর সেই থেকে এমন পেছনে লেগেছ মা যে, অতিষ্ঠ করে ছেড়েছ একেবারে। ডাকাতের তাড়া খাওয়ালে প্রথমে, তারপর এই ভাঙাচোরা ট্রেনে চাপিয়ে কোন চুলোয় নিয়ে চলেছ কে জানে। তাতেও সাধ পুরল না, এখন না খাইয়ে মারবার চাল ধরেছ। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই, হাতে চার পিস বাসি স্যাঁতসেতে পাউরুটি, সে যে গিলব দুজনে তার জন্য একফোঁটা জলের জোগাড় অবধি হল না গত তিন-চার ঘণ্টায়।
এইসব সাত-পাঁচ ভাবছি আর মুখটা প্যাঁচার মতো করে সব দোষ মা দুর্গার কাঁধে চাপিয়ে প্রাণভরে গাল পাড়ছি, এমন সময় গাড়ি ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি কাছেই স্টেশন। বিজলি নেই সেখানে তখন। ঘুটঘুটে অন্ধকার স্টেশনবাড়ি খানিক দূরে ভূতের বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে। ট্রেনের আগাটা তার প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে পেরেছে, লেজের দিকে আমাদের কামরাটা প্ল্যাটফর্মের বাইরে রয়ে গেছে।
দেখে আমি বেপরোয়া হয়ে সঙ্গীকে বললাম, “স্টেশন যখন পেয়েছি তখন আর কিছু না হোক জলের একটা ব্যবস্থা হবেই। যা থাকে কপালে, আমি নেমে যাচ্ছি। ছুটে গিয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠে কল খুঁজে বোতল ভরে নেব। এর মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিলে দৌড়ে গিয়ে একটা না একটা কোচে উঠে পড়া যাবে।”
এই বলে খালি বোতল হাতে রেল-লাইনে নেমে এসে অন্ধকারে হাঁটা দিলাম গজ ত্রিশেক দূরে অন্ধকার প্ল্যাটফর্ম লক্ষ্য করে।
প্ল্যাটফর্মের প্রান্তিক ঢালটা বেয়ে উঠে আসতে আসতে চোখে পড়ছিল, খানিক দূরে অন্ধকারে কিছু একটা নড়ছে। উঠে এসে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। ভুল দেখিনি। প্ল্যাটফর্মের মাঝবরাবর কয়েকটা গোড়া-বাঁধানো গাছ এগিয়ে গেছে। মিটার ত্রিশেক দূরে তেমনই একটা গাছের নীচে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। তাকেই আবছা আবছা চোখে পড়ছিল দূর থেকে।
কাছে এগিয়ে গিয়ে টর্চ জ্বালতে দেখি সে রেলেরই লোক। গায়ে রেলের প্যান্ট্রি কারের কর্মীদের উর্দি। তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, “প্ল্যাটফর্মে জল পাওয়া যাবে কোথাও?”
জবাবে সে বলল, “জল পাবেন। রাতে ডিনার চাইলে তাও আছে।”
শুনে আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতে সে ইশারায় পাশের বাঁধানো গাছতলা দেখিয়ে দিল। টর্চ ফেলে দেখি সেখানে রেলের খাবার দেবার দু-খানা স্টিলের ট্রে। যত্ন করে ঢাকা দেয়া। পাশে দু-খানা জলের বোতল।
থালা দুটো তুলে আমার পিছু পিছু এসে মানুষটা সেদিন আমার কামরা অবধি এসেছিল রেল-লাইন বেয়ে। সিঁড়ি বেয়ে কামরায় উঠে তার হাত থেকে জলের বোতল আর থালা দু-খানা নিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “কত?”
সে অন্ধকারেই জবাব দিয়েছিল, “খেয়ে নিন আগে। আমি পরে এসে থালা, পয়সা সব নিয়ে যাব’খন।”
সে-থালায় ভাত, ডাল, সবজি, মাছের ঝোল, চাটনি, পাঁপড় আর একটা করে লাড্ডু ছিল। ছুটন্ত ট্রেনের অন্ধকার কামরায় বসে খিদের মুখে সে খাবারকে অমৃতের মতো লেগেছিল আমাদের।
তারপর, একসময় গাড়ি এসে লিলুয়া পৌঁছল। লিলুয়া ছেড়ে হাওড়া স্টেশন এল। থালা বা খাবারের দাম নিতে কেউ ফিরে এল না।
থালা দুটো ওই কামরাতেই রেখে দিয়ে এসেছিলাম। খাবারের দামটা আজও বাকি রয়ে গেল। মনে হয় ঋণটা সঙ্গে নিয়েই যেতে হবে একদিন। মাতৃঋণ। শোধ হয়?
এই হল গল্প। এর একশোখানা যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা আমি লিখতে পারি। তার যে-কোনো একখানা নিঃসন্দেহে সত্যি। কিন্তু আমার নির্বোধ কলজেটা অন্য কিছু ভাবতে চায় যে! যুক্তহীন বিজ্ঞানহীন একটা ব্যাখ্যা।
আর আপনি? আপনার হৃদয় কী বলে?
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস
সদ্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার শিকার হতে শুরু করা বাংলা ও উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলা। একই গ্রামজীবন, দুটি ভিন্ন যাপন। সোয়া শতাব্দীর ব্যবধানে দাঁড়ানো দুই বাঙালি গ্রামের আনন্দ, বেদনা, মৃত্যু ও জীবনের দুটি খণ্ড চিত্র। দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের দুটি মরমী কিশোর উপন্যাস।
আমরা ভারতবাসী কাব্য-মহাকাব্য লিখেছি। লিখেছি পুরাণের নামে কিছু অলীক গল্পকথা। কিন্তু ইতিহাস লিখতে শিখিনি। তার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করিনি। তাই ঐশ্বর্যময় গরিমা সত্ত্বেও আমরা আমাদের উত্তরসূরিদের জন্য কিছুই রেখে যাইনি। গিরিব্রজসিংহ এমনই এক অকথিত ঐতিহাসিক উপাখ্যান।