লোককাহিনি
15% OFF * FREE SHIPPING
লোককাহিনি
অরিন্দম ঘোষ
অনেক দিন আগের কথা। ভুটানের এক পাহাড়ঘেরা প্রান্তে বাস করত একটা ছেলে। তার নাম ছিল তানদিন। কতই-বা বয়স তার—চোদ্দো কি পনেরো। সে ছিল খুবই গরিব, আর একাকী। বাবা-মা, ভাই বা বোন কেউ ছিল না তার। তার বাড়ির সামনে একটুকরো ছোটো খালি জমি ছিল; ইচ্ছে করত তাতে সে গমের চাষ করবে আশেপাশের আর সবার মতো। কিন্তু তাতে বোনার জন্য গমের বীজ ছিল না তার কাছে। বেচারা তখন অনেক আশা নিয়ে পাড়াপড়শিদের কাছে চাইতে গেল। কিন্তু তারাও কেউ বীজ দিয়ে তাকে সাহায্য করল না।
একদিন তার এক পড়শি ফসল কাটছিল। ধারালো কাস্তের এক আঘাতে গমের গাছগুলো কেটে যাচ্ছিল, আর কাটা গমের শিষ জমা করে রাখা হচ্ছিল একজায়গায়। চুপ করে দাঁড়িয়ে গম কাটা দেখছিল তানদিন। হঠাৎ একটা বীজ ছিটকে এসে তার ঝাঁকড়া চুলে আটকে গেল, তারপর আরও একটা। বুদ্ধি করে তানদিন কয়েক পা এগিয়ে গেল। এবার গমের বীজগুলো পরপর ছিটকে এসে তার চুলে জমা হতে থাকল। সে ভাবল, এ তো বেশ মজার কথা! বাড়ি গিয়ে চুল থেকে সমস্ত গমের দানা এক করে নিতে বেশ একমুঠো হল। এই তো! তার ক্ষেতে বোনার জন্য বীজ একদম তৈরি।
ভগবানের নাম নিয়ে তানদিন পরদিনই ক্ষেতটা খুঁড়ে তাতে ওই গমের দানা ছড়িয়ে দিল। তার কাণ্ড দেখে পাড়াপড়শিদের হাসি আর ধরে না। সবাই তাকে বলল যে বীজ ছড়ানোর সময় এখনও আসেনি। বীজ বুনতে হয় বর্ষার আগে আগে। বর্ষার জলে লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে গমের চারা। কিন্তু তানদিন ওদের কথা শুনল না। সে ওই জমিতে বীজ ছড়াল আর প্রতিদিন নদী থেকে তুলে এনে জল দিতে লাগল তাতে। দূরের নদী থেকে কাঠের বালতি করে জল নিয়ে আসতে তার বেশ কষ্ট হত। কিন্তু সে দমল না একটুও, বরং উদ্যম নিয়ে মন দিয়ে লেগে রইল চাষের কাজে।
কয়েকদিনের মধ্যেই তানদিন অবাক। তার সমস্ত ক্ষেত তখন সবুজ ছোটো ছোটো চারায় ছেয়ে গেছে। তাই দেখে তার মনটা খুশিতে ভরে উঠল। সে জল দিতে থাকল নিয়ম করে। কয়েকদিন পরে দেখে এক আশ্চর্য কাণ্ড। গাছগুলো খুব তাড়াতাড়ি এত বড়ো হয়ে গেছে এবং তাতে গমের শিষ ধরেছে। সে অবাক হয়ে ভাবল, এত তাড়াতাড়ি কী করে সম্ভব হল। যে অবস্থায় পৌঁছতে তিন মাস সময় লাগে, সেটা মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে কীভাবে হল? এ নিশ্চয়ই ভগবানের আশীর্বাদ। তার দু-একদিন বাদেই সে দেখল ফসলগুলো কাটার জন্য একদম তৈরি হয়ে গেছে।
তানদিন ঠিক করল, পরদিন যাবে সে ফসল কাটতে। কাস্তে আর একটা বড়ো ঝুড়ি নিয়ে সে হাজির হল ক্ষেতে। কিন্তু কী আশ্চর্য! পরদিন তার অর্ধেক ফসল কোনও কিছুতে খেয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। ক্ষেতের অবস্থা দেখে স্বাভাবিকভাবেই তার মনখারাপ হয়ে গেল, চোখ জলে ভরে গেল। তখন সে ঠিক করল, এর পেছনে কে আছে দেখতে হবে। একটা বড়ো পাথরের আড়াল থেকে লক্ষ রাখতে লাগল সে। কিছুক্ষণ পরেই দেখল, একটা পাখি এসে গমের দানা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। বুদ্ধিমান তানদিন চট করে একটা ফাঁদ পেতে পাখিটাকে বন্দি করে ফেলল। আর ধমক দিয়ে বলল, “আমার ফসলের এই সর্বনাশ করেছিস তুই! তোকে আমি মেরেই ফেলব এক্ষুনি।”
পাখিটা অনুনয়-বিনয় করে বলল, “আমায় মেরো না। আমায় মেরে ফেলে তুমি তো আর ফসল ফিরে পাবে না। তার চেয়ে বরং আমার সঙ্গে আমার বাসায় এসো। তোমায় একটা জিনিস দেব, তাতে তোমার সারাজীবনের দুঃখকষ্ট দূর হয়ে যাবে।”
তানদিন পাখিটাকে বিশ্বাস করল। কিন্তু আবার ভয় হল, যদি ছেড়ে দিলেই সে উড়ে দূরে পালিয়ে যায়!
পাখিটাকে সে-কথা বলতে পাখি বলল, “আমাকে বিশ্বাস করো। তুমি আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছ, আমি তোমাকে ঠকাব না।”
এবার পাখিটা অল্প অল্প করে উড়ে এ-গাছ থেকে ও-গাছে যায়, আর তানদিনের আসার জন্য অপেক্ষা করে। এভাবে যেতে যেতে বেশ কিছুক্ষণ পরে ওরা একটা পাহাড়ের ওপর পাথরের ফাটলের মধ্যে পাখির বাসার কাছে পৌঁছল। তানদিনকে অপেক্ষা করতে বলে পাখিটা উড়ে গেল তার বাসায়। আর একটু পরে একটা পুরোনো ভাঙা মাটির হাঁড়ি এনে হাজির করল। বলল, “এটা একটা জাদু হাঁড়ি। এর মধ্যে প্রার্থনা করলে তুমি যা খেতে চাও তাই পাবে।”
তানদিন পরীক্ষা করার জন্য অল্প সময় প্রার্থনা করে বলল, “ভাত আর মাংস দাও।”
কী আশ্চর্য! হাঁড়িটা তক্ষুনি ভাত আর সুগন্ধি সুস্বাদু মাংসতে ভরে গেল। অনেকটা পথ চলার জন্য তানদিন ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। পেটভরে মাংস-ভাত খেয়ে পাখিকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে সে খুশি মনে হাঁড়িটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। এমন সুস্বাদু খাবার সে কোনোদিন খায়নি। এরপর প্রতিদিন তানদিন নিজের ইচ্ছামতো ভালোমন্দ খাবার খুব আনন্দ করে খেতে লাগল।
আশেপাশের সবাই উৎসুক হয়ে উঠল তানদিনের ব্যাপারে, তার চেহারার জেল্লা দেখে।
সেই দেশে এক দুষ্টু রাজা ছিল। খবরটা একদিন রাজার কানেও পৌঁছল। রাজা তখন গুপ্তচর পাঠাল বিষয়টা অনুসন্ধান করে দেখার জন্য। গুপ্তচর উঁকিঝুঁকি মেরে খুঁজে বার করল ভাঙা হাঁড়ির কথা। রাজার কানে কথাটা তুলতেই রাজা ভাবল, হাঁড়িটা তার চাই। সেইমতো সুযোগ করে একদিন লোক পাঠিয়ে হাঁড়িটা চুরি করল রাজা। বদলে সেখানে রেখে আসা হল একটা একইরকম দেখতে নকল হাঁড়ি।
তানদিন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে হাঁড়ি থেকে খাবার চাইল। কিছুই এল না। আবার চাইল, কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। সে ভাবল, হাঁড়িটার সব জাদুশক্তি হয়তো শেষ হয়ে গেছে। বেচারা সেদিন উপায় না দেখে শুধু জল খেয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।
পরদিন সকালে তানদিন গেল পাহাড়ের ওপর সেই পাখিটার বাসায়। সব শুনে পাখি বলল, “এমন তো হবার কথা নয়! হাঁড়ির শক্তি তো শেষ হয়ে যায় না কখনও। নিশ্চয়ই কোনও বদমাশ তোমার হাঁড়িটা চুরি করে অন্য কোনও হাঁড়ি তার বদলে রেখে দিয়ে গেছে।”
এবার পাখিটা তাকে একটা লোমশ পাহাড়ি ছাগল এনে দিল। বলল, “এই ছাগলটারও জাদু শক্তি আছে। তুমি একে তুলে ঝাঁকালে তুমি যা চাও তাই ঝরে পড়বে এর লোমের ভেতর থেকে।”
তানদিনের খাওয়া-পরার সমস্যা মিটল ঠিকই, কিন্তু এই খবরটাও রাজার কাছে চাপা থাকল না। নিশ্চিত হবার পর রাজা এবারেও একই কাজ করল। একইরকম দেখতে একটা লোমশ ছাগল এনে তানদিনের ছাগলটার সঙ্গে বদল করে দিল তার অগোচরে।
ব্যাপারটা জানতে পারার পর তানদিন আবার গেল পাখির সঙ্গে দেখা করতে। খুলে বলল সবকিছু। শুনে পাখি বলল, “নিশ্চয়ই কেউ সবসময় তোমার ওপর নজর রাখছে, আর তোমার জিনিসগুলো চুরি করছে একে একে।”
তানদিন বলল, “বুঝলাম, কিন্তু কী করা যায় এবার?”
পাখি তখন তাকে একটা লাঠি দিল বলল, “এটাকে নিয়ে যদি মাটি থেকে একটু উপরে তুলে ‘জামা গাচি টেঙাচে’ বলে চেঁচাও তো সেখানে থাকা সবাই তখন মজাটা টের পাবে।”
তানদিন বুঝল এবার বদলা নেবার একটা সুযোগ এসেছে। সে লাঠিটা বাড়িতে নিয়ে গেল আর অপেক্ষা করতে লাগল রাজার পাঠানো লোকের আসার।
একদিন বাড়ির বাইরে খুটখাট পায়ের আওয়াজ শুনে তানদিন বুঝল যে চোর এসেছে। উঁকি মেরে দেখল, রাজার একজন লোক বাইরে ঘোরাঘুরি করছে। সে বুঝল যে দুষ্টু রাজাই লোক পাঠিয়ে এসব কুকর্মগুলো তাহলে করছে। তখন সে গুপ্তচরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল, “ধন্যবাদ ভগবান। তুমি আমাকে যে জাদুলাঠি দিয়েছ সেটা আমার সব দুঃখকষ্ট দূর করে দেবে। খালি একবার ‘জামা গাচি টেঙাচে’ বললেই লাঠি তার জাদু দেখিয়ে দেবে। অনেক ধন্যবাদ ভগবান।”
রাজার লোক শুনে বুঝল, এটাও চুরি করার ব্যবস্থা করতে হবে। তানদিনও সেটাই চাইছিল, তাই সে একটু পরেই বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। আর সেই সুযোগে রাজার পাঠানো লোক সহজেই চুরি করে নিল লাঠিটা।
ক’দিন পর রাজা সমস্ত মন্ত্রী, সান্ত্রী, সেনাপতি, রানি, রাজকুমার—সকলকে ডেকে এনে তার জোগাড় করা জিনিসগুলো দেখাবার কথা ভাবল। সেইমতো একটা বড়ো ঘরে সবাইকে জড়ো করে একটা একটা করে জিনিসগুলো দেখাতে লাগল। হাঁড়ি থেকে পাওয়া সুস্বাদু খাবার খেয়ে সবাই খুব প্রশংসা করল। ছাগলের থেকে রাজা দামি পোশাক নিয়ে সবাইকে উপহার দিল। সবাই নতুন পোশাক পেয়ে খুব খুশি। এবার রাজা নতুন পাওয়া লাঠিটা দেখাবার জন্য নিল। সবাই উৎসুক জাদু দেখার জন্য। লাঠি হাতে নিয়ে যেই না রাজা ‘জামা গাচি টেঙাচে’ বলে চেঁচিয়ে উঠল, তক্ষুনি লাঠি হাত ছেড়ে আপনা-আপনিই শূন্যে উঠে গেল। আর দমাদম করে সবাইকে এলোপাথাড়ি মারতে লাগল। বন্ধ ঘরের মধ্যে সবাই হুড়োহুড়ি করে পালাতে গিয়ে এ-ওর ঘাড়ে ছিটকে পড়ল। তার ওপর অবিরাম লাঠির মার।
কিছুক্ষণ পর লাঠি নিজেই থামল, সবাই তখন আধমরা।
রাজা এবার আর ওইসব জিনিস নিজের কাছে রাখতে চাইল না। লোক পাঠিয়ে তানদিনের বাড়িতে সবকিছু পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করল। তানদিন সব জিনিস ফিরে পেয়ে খুব খুশি, তার অভাব আর রইল না। পাখির সঙ্গে তার বন্ধুত্বটা রয়ে গেল চিরকাল।
(ভুটানের উপকথা)
ছবি - অঙ্কিতা নন্দী
কচিপাতা
ছোটো গল্প
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
ছড়া
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বড়ো গল্প
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
লোককাহিনি
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
অনুবাদ
না-মানুষের পাঁচালি
প্রবন্ধ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী