প্রবন্ধ
15% OFF * FREE SHIPPING
প্রবন্ধ
কেয়া চ্যাটার্জী
বেড়াতে গিয়ে আমাদের নানারকমের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। কখনও কোনও ঘটনা মনে রেশ রেখে যায়। সেরকমই এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম উত্তরবঙ্গ ঘুরতে গিয়ে। সাধারণত শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে বা গতানুগতিক পর্যটন কেন্দ্র বাদে অন্য কোনও পাহাড়ি এলাকায় বেড়াতে গেলে হোটেলের বদলে আমাদের থাকতে হয় হোম-স্টেতে। সেখানে হোটেলের মতো সুবিধা না পেলেও থাকে আন্তরিকতা। উত্তর সিকিমের বিখ্যাত গুরুদংমার লেকে যাওয়ার পথে রাত্রিবাস করতে হয় লাচেন নামক একটি গ্রামে এবং ফেরার পথে থাকতে হয় লাচুং নামক আর একটি গ্রামে।
যাই হোক, এ তো গেল ভূগোলের ব্যাখ্যা। এবার আসি আসল কথায়। যেখানেই ঘুরতে যাই না কেন, চোখ আর মনের সঙ্গে তো পেটটিকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। তাই লাচেন এবং লাচুংয়ে গিয়ে যখন জানতে পারলাম খাবারে ডিম, সবজি (পাহাড়ি এলাকার সর্বত্র মাছ পাওয়া যায় না।) সবকিছু পাওয়া গেলেও মাংস কোথাও পাওয়া যাবে না বা রান্না হবে না—মনে প্রশ্ন জাগল, কেন? উত্তর এল, গোটা সিকিম জুড়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা বুদ্ধপূর্ণিমা থেকে শুরু করে পরবর্তী পনেরো দিন একটি বিশেষ ব্রত পালন করেন। এই ব্রতের নাম ‘শাকাদাওয়া’। আসলে তিব্বতি এই উৎসবটি সকল বৌদ্ধরাই আপন করে নিয়েছেন। এই তিব্বতি সংস্কারটি নিয়েই এই লেখার অবতারণা।
শাকাদাওয়া সম্পর্কে কিছু বলার আগে গৌতম বুদ্ধের জীবনী সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া বিশেষ প্রয়োজন। প্রায় ২৫০০ বছর আগে নেপালের কপিলাবস্তু নগরে শাক্য রাজবংশে জন্ম হয় রাজকুমার তথাগতর। রাজবংশে জন্ম নিলেও জাগতিক আরাম ও বিলাস তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। রাজা হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, রাজত্বের লোভ—সবকিছু ছেড়ে দিয়ে, এমনকি নিজের স্ত্রী ও পুত্রকেও পরিত্যাগ করে তিনি সন্ন্যাস নিলেন। শৈশব ও কৈশোর তাঁর কেটেছে রাজকীয়ভাবে। তবে অন্যান্য রাজবংশীয়দের মতো তিনি শিকার করা বা প্রাণীহত্যার বিরোধী ছিলেন। বরং হিংসা না করা, জীবে প্রেম করার বাণী তিনি ছড়িয়ে দিতেন তাঁর প্রজাদের মধ্যে। এমন এক বিকালে রথে চড়ে ভ্রমণকালে তিনি তিনটি ঘটনার সম্মুখীন হন। সেই ঘটনাগুলির মাধ্যমে তিনি প্রথমবার চাক্ষুষ করেন বার্ধক্য, জরা-ব্যাধি ও মৃত্যুকে। ব্যাপারটি তাঁকে ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন—যতই অর্থ, ঐশ্বর্যর অহংকার আমাদের থাকুক না কেন, মানবজীবনের চরম সত্য মৃত্যু। এই ঘটনা তাঁকে এতটাই বিহ্বল করে দেয় যে জীবনের অর্থ ও জীবনচক্রর আসল রূপ জানার জন্য তিনি সংসার ত্যাগ করে ভিক্ষু রূপে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন।
প্রায় ছয় বছর তিনি ভারতীয় মুনি-ঋষিদের কাছে শাস্ত্রশিক্ষা নেন; ধ্যান ও যোগাসন, অনাহার ও তপস্যার মাধ্যমে নিজের মনে ঘুরতে থাকা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বার বার ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বুঝেছেন, যে-প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজছেন তা এইভাবে গতানুগতিক পদ্ধতিতে পাওয়া সম্ভব নয়। এবার তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বন করলেন। শরীর ও আত্মাকে কষ্ট না দিয়ে যে সাধনার মাধ্যমে জ্ঞানলাভ করা যায়, সেই পথেই তিনি চলতে শুরু করলেন। গয়ার কাছে একটি বোধিবৃক্ষের নীচে তিনি ধ্যানে বসলেন এবং এই ধ্যানের মাধ্যমেই তিনি লাভ করলেন বোধ বা জ্ঞান। সিদ্ধার্থ বা তথাগত থেকে পরিবর্তিত হলেন বুদ্ধ হিসেবে। গৌতমীর পুত্র গৌতম বুদ্ধ। এরপর গৌতম বুদ্ধের হাত ধরে সৃষ্টি হল ইতিহাসের। তাঁর প্রচলিত ভাষা অর্থাৎ পালি ভাষায় ধর্মপ্রচার, মানুষের মধ্যে সখ্যতা ও বন্ধুত্বের বাণী প্রচার তাঁকে সকলের অনেক কাছের মানুষ করে তুলল। তাঁর অনুগামীদের দল তৈরি হল। তাঁরা গৌতম বুদ্ধের বাণী ভারত ও ভারত-সংলগ্ন অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে দিতে লাগলেন। এমনকি তৎকালীন রাজারাও বৌদ্ধধর্মের সার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে এই ধর্ম গ্রহণ করেন। তার সবথেকে বড়ো উদাহরণ হলেন সম্রাট অশোক। তাঁর প্রচারিত ধম্ম বা ধর্ম নতুন কোনও কথা বলেনি। তবে পুরাণ ও বেদের সারমর্মগুলি তিনি প্রান্তজ মানুষদের কাছে প্রচলিত ভাষায় তুলে ধরেছিলেন। বৌদ্ধধর্মের মূল কথা হল—জীবন দুঃখময়, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখ বিনাশের মাধ্যমও আছে, মধ্যপন্থাই হল দুঃখনাশের পথ। এছাড়াও তাঁর কিছু বাণী অষ্টাঙ্গিক মার্গ নামে পরিচিত।
বুদ্ধদেবের জীবনকে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। তবে তাঁর ধর্মীয় কার্যকলাপগুলিকে একদিকে রেখে যদি গৌতম বুদ্ধের সামাজিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ করি, তা হলে খুলে যায় এক বিশাল প্রান্তর। সেই সময় গৌতম বুদ্ধের হাত ধরে ভারতীয় সমাজ তৎকালীন ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেয়েছিল। সমকালীন পুরোহিতদের লোভ ও অত্যাচার এতটাই বেড়ে গেছিল যে ছোটো ছোটো কারণে পূজা, যজ্ঞ, প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদি করাতে তারা প্রজাদের বাধ্য করতেন। ফলে সাধারণ মানুষ এঁদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। এমনকি, পুরোহিতদের প্রভাব-প্রতিপত্তি এতটাই বেড়ে গেছিল যে তাঁরা রাজার বিরোধিতা করতেও পিছপা হতেন না। তাছাড়া সংস্কৃত ভাষা সকল প্রজার বোধগম্য ছিল না। অপরদিকে বৌদ্ধধর্ম ছিল সহজ, সরল ও নিয়মকানুনবর্জিত। বুদ্ধদেব পালি ভাষা অর্থাৎ তৎকালীন কথ্য ভাষায় ধর্মপ্রচার করায় মানুষের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন। পুরোহিতদের রোষ তাঁর উপর পড়লেও বিভিন্ন রাজা ও সম্রাটদের বদান্যতা থাকায় তাঁরা তেমন ক্ষতি করতে পারেননি। অবশ্য মোঘল আমলে প্রচুর বৌদ্ধবিহার ও পুথি নষ্ট করে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের নানা আবিষ্কার।
এবার আসা যাক মূল কথায়। তিব্বতি ভাষায় ‘শাকা’ কথার অর্থ নক্ষত্র; ‘দাওয়া’ কথার অর্থ মাস। তিব্বতি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, বছরের চতুর্থ মাসে এই উৎসব পালিত হয়। মূলত বুদ্ধদেবের জন্মদিন, বোধিলাভ ও মহাপরিনির্বাণের সময়কেই পালন করা হয় এই উৎসবের মাধ্যমে। সকল বদ্ধ জীবকে মুক্তি দেওয়া, দুঃস্থকে সাহায্য করা, দান করা, মিথ্যা না বলা, ছলনা করা, মাংস না খাওয়া ইত্যাদি নিয়ম পালন করেন সকল বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা। এককথায়, বৌদ্ধধর্মের অষ্টাঙ্গিক মার্গের আটটি কাজ পালন করতে হয় এই সময়ে। এছাড়াও প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে পূজাপাঠ ও মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে ভগবান বুদ্ধ ও তাঁর হিতোপদেশ স্মরণ করা হয়। এই উৎসবের সবথেকে আকর্ষণীয় অধ্যায় হল মুখোশ নাচ। সন্ন্যাসীরা বিহারের পতাকা নামিয়ে নতুন পতাকা উত্তোলন করেন। কথিত আছে, শাকাদাওয়া চলাকালীন মানুষ যা যা কর্ম করে, তাকে তার জীবনে সেই কর্মের ফল ভোগ করতে হয়। সেই কর্ম যদি সুকর্ম হয় তবে তার ফলও হবে ভালো, আর দুষ্কর্ম হলে তার ফল হবে খারাপ।
ভ্রমণ আমাদের অভিজ্ঞতা দেয়। দেয় জ্ঞান। নিত্যনতুন সংস্কৃতি ও সমাজের সঙ্গে যুক্ত করে। আমাদের বুঝিয়ে দেয়, এই পৃথিবী আসলে এক বিশাল জ্ঞান-সমুদ্র। এই সমুদ্রের অতলে ডুব দিয়ে অনায়াসেই তুলে আনা যায় রত্নরাজি। সেই মণিমুক্তার দল আমাদের ঋদ্ধ করে, সমৃদ্ধ করে তোলে। আমাদের করে তোলে বোধিসত্ত্ব।
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী