প্রবন্ধ
15% OFF * FREE SHIPPING
প্রবন্ধ
গোপালবাবুদের এখনকার রসগোল্লা। ছবি - পরিবারের সৌজন্যে।
দীপক দাস
নামের সঙ্গে গোল্লা আছে এরকম কতগুলো মিষ্টি জানা আছে তোমাদের? এই ধরো, রসগোল্লা, কাঁচাগোল্লা। তার পর? বাড়ির বড়োরা যদি পুরোনো মিষ্টি নিয়ে আগ্রহী হন তাহলে কেউ কেউ গোল্লা সন্দেশের নামটা জানতে পারো। এর বেশি যদি কিছু জানা থাকে তাহলে বোলো কিন্তু। একবার খোঁজখবর করে দেখতে হবে। আমাদের মিষ্টি খোঁজাখুঁজির একটা দল আছে। তোমরা গোল্লা দিয়ে নামের নতুন মিষ্টির কথা জানালেই তারা বেরিয়ে পড়বে ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়ে।
আর একটা প্রশ্ন করি? মোদক বা ময়রারা মিষ্টি তৈরি করেন। বহু বিখ্যাত মিষ্টি করিয়ে আছেন। কিন্তু মিষ্টি করিয়েদের নামে কোনও মিষ্টি আছে? এরকম মিষ্টিও খুব বেশি নেই। মিষ্টি তৈরির জাদুকরেরা অন্যের নামে মিষ্টি তৈরি করে বিখ্যাত করেছেন। এই যেমন, আশুভোগ। ‘বাংলার বাঘ’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নামে এই সন্দেশ। আবার নেহরু সন্দেশও আছে। মতিলাল নেহরুর নামে নাকি তৈরি হয়েছিল। তবে ময়রাদের নামে মিষ্টি একদম নেই, তা কিন্তু নয়। ল্যাংচাই তো নাকি কোনও এক চলতে অসুবিধা থাকা ময়রার তৈরি। তিনি লেংচে হাঁটতেন বলে তাঁর তৈরি মিষ্টির এমন নাম। কেউ কেউ বলে থাকেন, বর্ধমানের সীতাভোগ তৈরি করেছিলেন সীতানাথ নন্দী। তাঁর নামেই মিষ্টি।
এমন একটা মিষ্টির সন্ধান পেয়েছিলাম যা উপরের দুটো প্রশ্নেরই উত্তর দেয়। মিষ্টিটার নামের সঙ্গে গোল্লা রয়েছে। আবার যিনি তৈরি করেছিলেন সেই মোদকেরও নাম মিষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে। মিষ্টির নাম গোপালগোল্লা। প্রণব রায় তাঁর ‘বাংলার খাবার’ বইয়ে জানিয়েছিলেন, ‘গোপালগোল্লা’ও একধরনের স্পঞ্জ রসগোল্লা। এটা পাওয়া যায় বর্ধমান জেলার ভাতার গ্রামে। জেনেই বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তার আগে একটু খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। আমার মেজো ভাইয়ের সহকর্মী অরিজিতের শ্বশুবরবাড়ি ভাতারে। কিন্তু অরিজিৎ খোঁজ দিতে পারল না। তাই বেরিয়ে পড়তে হল। কিন্তু দলের লোকেরা সঙ্গে গেল না। তাদের নাকি অনেক কাজ! আমাদের হাওড়ার বাড়ি থেকে জায়গাটা অনেক দূর।
কাজটা তবে কীভাবে হবে? ট্রেনে আসতে-আসতেই ছক কষে নিয়েছিলাম। প্রথমে খোঁজ করতে হবে পুরোনো মিষ্টির দোকানের। সেখান থেকে পাওয়া তথ্য নেড়েচেড়ে দেখতে হবে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে এক টোটোচালক দাদাকে জিজ্ঞাসা করে পুরোনো মিষ্টির দোকানের সন্ধান নিলাম। তিনি বাজারের দিকে যেতে বললেন। সেদিকে যেতে-যেতেই মনে পড়ল, ফেরার ট্রেনের খবরটা নিয়ে নেওয়া দরকার। যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, ট্রেন কম বর্ধমান-ভাতার লাইনে। গোপালগোল্লার খোঁজে ঘুরপাক খেতে হলে ফেরাটা চাপের হবে। কিন্তু টিকিট খিড়কিতে পর্দা টানা। এক টোটোচালক জানালেন, ফেরার শেষ ট্রেন সন্ধে সাড়ে ছ’টায়।
স্টেশন থেকে সামান্য দূরে ভাতার বাজার। রাস্তার পাশেই কমলা সুইটস। শিবপ্রসাদ মোদক আর তাঁর বাবা তপনকুমার মোদক দোকান চালান। আসার উদ্দেশ্য জানিয়ে শিবপ্রসাদবাবুকে প্রণব রায়ের বইটা দেখালাম। তিনি গোপালগোল্লার অংশটা পড়লেন। কিন্তু এমন মিষ্টির কথা শোনেননি জানালেন। আর একটা তথ্য দিলেন। ভাতার গ্রামে কোনও ময়রা বা মোদকের বসবাস নেই। আগেও ছিল না। মোদকেরা সব বেলডাঙার বাসিন্দা। ভাতারের মিষ্টির দোকানগুলোর মালিকেরাও বেলডাঙাবাসী। শিবপ্রসাদবাবুরাও। কিন্তু বইয়ে যে লেখা ভাতার গ্রামের গোপাল ময়রা!
ভাতারের মূল গ্রামটা কোথায়? মানে জনবসতিটা? সেখানে একবার যাওয়া দরকার। কিন্তু তার আগে খাওয়া দরকার। তিনটে বেজে গিয়েছে। বর্ধমানে নেমে খেয়ে ট্রেনে উঠব ভেবেছিলাম। কিন্তু যে ট্রেন থেকে নেমেছি সেই ট্রেনই যে ভাতার লাইনে যাবে জানব কী করে! নেমে পড়ে মাঝখান থেকে আসন হারালাম। ভিড়ও হয়েছিল। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার ভয়ে আর খাওয়া হয়নি। ট্রেনে ঝালমুড়িও ওঠেনি। শিবপ্রসাদবাবু জানালেন, পাকা সড়কের ওপারে ভাতার যাওয়ার রাস্তার মুখেই একটা হোটেল আছে। হোটেলের সামনে গিয়ে দেখি মালিক খেয়েদেয়ে পাতা ফেলছেন। হোটেলে আর কেউ নেই। আর খাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করিনি। ভাতার যাওয়ার টোটোর কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উনি আবার বাজারের দিকে ফিরে যেতে বলছিলেন। ফিরব বলে মুখ ঘুরিয়েছি, ঠিক তখনই একটা টোটো ভাতারের দিক থেকে এল। ‘যাবেন?’ জিজ্ঞাসা করাতে তিনি রাজি। তবে কুড়ি টাকা লাগবে। খালি পেটে হাঁটতে ইচ্ছে করছিল না। তাই দশের বদলে কুড়িতেই রাজি হলাম। টোটো মুখ ঘোরাতে হোটেল মালিক ‘মেজদা মেজদা’ বলে হাঁক দিতে শুরু করলেন। মেজদা বাড়ি ফিরবেন।
মেজদার নাম সন্দীপ রায়। হোটেল মালিক তাঁর ভাই। টোটোচালকের নাম মদন মাজি। যেতে যেতে কথাবার্তা চলছিল। সন্দীপবাবুও আসার উদ্দেশ্য শুনে বললেন, ‘‘ভাতারে তো কোনও ময়রা নেই। মিষ্টির দোকানও নেই। যা আছে বাজারে। ময়রারা সব বেলডাঙার লোক।’’
এখন উপায়? সন্দীপবাবুকে অনুরোধ করলাম, এমন কারও কাছে নিয়ে যেতে যিনি স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে একটু খোঁজখবর রাখেন। তিনি আশিস নামে কোনও একজনের কথা বললেন। কিছুক্ষণ পরে রাস্তার পাশে একটা পাঁচিল ঘেরা বাড়ির সামনে টোটো দাঁড় করিয়ে সন্দীপবাবু ভিতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে এলেন একজনকে সঙ্গে নিয়ে। ইনিই আশিসবাবু।
আশিসবাবুর পোশাকি নাম পার্থসারথি হাজরা। ভাতারের জমিদার পরিবারের সন্তান। স্থানীয় বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন। ওঁর ঘরে বসে কথা হচ্ছিল। একটু অবাকই হলেন মিষ্টির খোঁজে এত দূর এসেছি বলে। জানালেন, তাঁরা গ্রামের খাবারের ইতিহাস নিয়ে কোনোদিন ভাবেননি। গোপালগোল্লা নামের কোনও মিষ্টির কথাও শোনেননি। আশিসবাবুরও একই কথা, ভাতারে কোনও ময়রার বাস নেই। তাঁরা বেলডাঙায় থাকেন। গ্রামের ভিতরে কোনোদিনই মিষ্টির দোকান ছিল না। আগে ভাতার বাজারেই দু-তিনটে মিষ্টির দোকান ছিল। তখন ভাতারের উপর দিয়ে ছোটো ট্রেন চলত। স্টেশন ছিল এখানে। এইসব মিষ্টির দোকানে রসগোল্লা আর সন্দেশ হত আর মণ্ডা। দোকানগুলোর মালিকেরা ছিলেন ভাতার ও আশেপাশের পালার, কুলচণ্ডার (কুলাইচণ্ডী) বাসিন্দা। তাঁরা ময়রা ছিলেন না। কিন্তু মিষ্টির দোকানের কারিগরেরা ছিলেন বেলডাঙার ময়রা। সে-সব দোকান আর নেই।
বেলডাঙার নাম বার বার আসছে। এই সূত্র একবার নেড়েচেড়ে দেখা দরকার। শেষ ট্রেন ফসকে গেলেও বর্ধমান যাওয়ার বাস রয়েছে। বর্ধমান থেকে ঠিক ফিরতে পারব। গভীর রাতে মুরগির ভ্যান, ছাগলের ম্যাটাডরে বাড়ি ফেরার অভ্যাস আছে। ভয় কী!
আশিসবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ফেরার টোটো পাওয়ার অপেক্ষা বৃথা। হাঁটতে হবে। আশিসবাবু মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন। মিষ্টির এনার্জিতে কিছুক্ষণ চলবে।
হেঁটে বাজার টপকে বাস-স্ট্যান্ড থেকে টোটো ধরলাম। ভাতার বাজার থেকে বেলডাঙা পাঁচ-ছ’ কিলোমিটার। বেলডাঙা মোড়ে নামিয়ে দিলেন টোটোচালক। মোড়েই সুকুমার মোদকের মিষ্টির দোকান। এখন চালান ছেলে অর্ণব মোদক। দোকানের সামনের বেঞ্চে কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছিলেন। গোপালগোল্লার কথা বলতে বুঝতে পারলেন না। গোপাল ময়রা কে বুঝতে পারছিলেন না। তবে তাঁরা জানালেন, বেলডাঙার মোদকদের নাম আছে। ভাতার বাজারে এখন যাঁদের মিষ্টির দোকান তাঁরা বেলডাঙারই লোক। স্টেশনের কাছের দোকানটাও। কথাবার্তা চলার মাঝে একজন বললেন, ননীগোপাল নামে একজন মোদক ছিলেন। তাঁর মিষ্টির দোকানও ছিল। কিন্তু ননীগোপাল নয়, চাই গোপালকে। কিছুক্ষণ পরে আর একজন মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘আশিসের দাদুর নাম ছিল গোপাল। ওঁর রসগোল্লার বেশ নাম ছিল।’’
তিনি বেলডাঙায় নয়, নবাস্থার হাটগোবিন্দপুরে দোকান করেছিলেন। আরও একজন তাতে সায় দিলেন। তারপর আমাকে পরামর্শ দিলেন, ভাতার কিসান মান্ডিতে গিয়ে আশিস মোদকের খোঁজ করতে। চায়ের দোকান আছে আশিসের।
অর্ণববাবুর দোকান থেকে শিঙাড়া-মুড়ি কিনে টোটোয় চেপে বসলাম। টোটো থামিয়ে তুলে দিয়েছিলেন দোকানের সামনে আড্ডা দেওয়া লোকগুলোই। টোটোচালককে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কোথায় নামাতে হবে। টোটোয় বসে মুড়ি খাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু চলন্ত টোটোয় মুড়ি নিয়ন্ত্রণে থাকছিল না। দু-চারটে উড়ে গিয়ে পড়ছিল চালকের গায়ে। আপত্তি ওঠার আগে ঠোঙা পুরে ফেললাম ব্যাগে।
কিসান মান্ডির একটু ভিতর দিকে আশিসবাবুর দোকান। খদ্দেরদের ভিড় দোকানে। আসার কারণ বলে বইটা খুলে দেখালাম। আশিসবাবু বললেন, ‘‘আমার দাদু।’’
শুনে আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে করছিল। দোকানের এক খদ্দের বললেন, ‘‘ভালো করে বল সব। লেখা হবে।’’
তার আগে আশিসবাবু জানতে চেয়েছিলেন কেন দাদুর খোঁজ করছি। বললাম আমাদের ঘোরাঘুরি আর মিষ্টির খোঁজের কথা।
আশিসবাবু বলতে শুরু করলেন। কিন্তু ভিতর থেকে উঠে আসা কান্না তাঁর কণ্ঠরোধ করছিল বার বার। আশিসবাবু এক মাসের ব্যবধানে বাবা আর বড়দাকে হারিয়েছেন। সদ্য প্রিয়জন হারানোর শোক আমার জিজ্ঞাসায় জেগে উঠেছে। বার বার বলছিলেন, ‘‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’’
জানালেন, দাদু তাঁকে খুব ভালবাসতেন। কষ্ট হচ্ছিল আমার। কিন্তু কাজ তো করতে হবে। তাই প্রশ্ন করছিলাম। কিন্তু কান্নায় ধরতাই ছিঁড়ে যাচ্ছিল বার বার। সরল সাদাসিধে মানুষটা আবেগ বশে রাখতে পারছেন না কিছুতেই। এদিকে আমার শেষ ট্রেন ধরার তাড়া। জিজ্ঞাসা করলাম ফোন নম্বর আছে কি না। দোকানে আশিসবাবুর সপ্তম শ্রেণিতে পড়া ছেলে ছিল। ছেলেটি মোবাইল ফোনের দুটো নম্বর দিল। আশিসবাবুকে বলে এলাম, ‘‘একটু সামলে নিন। পরে ফোন করব।’’
ফোন করেছিলাম কয়েকদিন পরে। সেদিও ফোনে কান্নার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। কান্নাভেজা গলায় বলছিলেন, ‘‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝলেন।’’
বললাম, ‘‘বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনার দাদুর কৃতিত্বকে সম্মান জানাব বলেই আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি।’’
দাদুর মুখে শোনা কথা আর নিজের দেখা ঘটনা মিলিয়ে অনেক কথা বললেন আশিসবাবু।
রামদাস মোদকের বেলডাঙায় মিষ্টির দোকান ছিল। তিন ছেলে তাঁর। ছোটো ছেলে গোপাল মোদক। বাবার দোকানে কাজ শিখেছিলেন তিন ছেলে। বড়ো ছেলের মৃত্যুর পরে সংসারের হাল ধরেছিলেন মেজো ছেলে ননীগোপাল। এঁর কথাই বেলডাঙার মোড়ের লোকেরা আমাকে বলেছিলেন। ননীগোপালের সামাজিক সুনাম ছিল। বেশ বড়ো যৌথ সংসার তাঁদের। গোপালবাবু তখন বেলডাঙার দোকানে কাজ করতেন। পরে সংসার ভাগ হয়ে যায়। বেলডাঙার দোকান নেন ননীগোপাল। এদিকে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সংসারে ধারদেনা হয়েছিল গোপালবাবুর। ফলে একদিন কাজের সন্ধানে হাতা-খুন্তি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় তাঁকে।
হাঁটতে হাঁটতে গোপাল মোদক চলে যান শালগ্রাম নামে এক জায়গায়। থানা মেমারি। গ্রামে যখন পৌঁছন তখন সন্ধে হয়েছে।
আশিসবাবু বললেন, ‘‘তখন মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করত। একটা বাড়ির লোক আশ্রয় দেয় দাদুকে। দাদু তাঁদের নিজের সব কথা বলেছিলেন। গ্রামের পাঁচজন দাদুকে গ্রামে থেকে যেতে বলেন।’’
তাঁরা গোপালবাবুকে পরামর্শ দেন, গ্রামে কোনও মিষ্টির দোকান নেই। এখানে তিনি যেন মিষ্টির দোকান দেন। গোপাল মোদককে বৈঠকখানায় জায়গা দেওয়া হয়েছিল। গ্রামের লোকেরাই তাঁকে দুধের জোগান দেন। বাসনপত্রও তাঁদের দেওয়া। গোপালবাবু দুধ কাটিয়ে ছানা তৈরি করে মিষ্টি তৈরি শুরু করলেন। প্রথমে মিষ্টির সঙ্গে বেগুনি, ফুলুরিও ভাজতেন।
গোপাল মোদক প্রথম থেকেই রসগোল্লা তৈরি করতেন। নাম ছড়াচ্ছিল গোপালবাবুর মিষ্টির। বিশেষ করে রসগোল্লার। শালগ্রামের আশেপাশের মানুষজন মিষ্টি কিনতে আসতেন। গ্রামটা ছিল একটু ভিতরের দিকে। এইরকম সময়ে কালনা-বর্ধমান সড়ক তৈরি হল। অনেকে গোপালবাবুকে পরামর্শ দিলেন গ্রামের ভিতর থেকে উঠে এসে রাস্তার পাশে দোকান দিতে। তাতে সব গ্রামের লোক মিষ্টি পাবেন। নবাস্থা নামে একটা জায়গা তখন জমজমাট। নবাস্থার হাটগোবিন্দপুরে হাটও বসে। ওই হাটের কাছে দোকান দিতে পরামর্শ দিলেন শুভানুধ্যায়ীরা। শালগ্রামের লোকের জমি ছিল নবাস্থায়। একজন জমি দান করলেন। দোকান করলেন গোপাল মোদক। মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল।
গোপাল মোদকের রসগোল্লা আরও জনপ্রিয় হতে শুরু করল। এলাকার অনুষ্ঠান বাড়িগুলোয় গোপালের রসগোল্লা অপরিহার্য হয়ে উঠল। এলাকার বিশ্বাসের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল গোপালের রসগোল্লা। আশিসবাবু একটা উদাহরণ দিলেন। গ্রামের কারও বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। সেদিন হবু অতিথিদের গোপালের রসগোল্লা দিয়ে আপ্যায়ন করলে সম্পর্কটা এগোত, এমন বিশ্বাস ছিল লোকের।
এসব তো এলাকায়। বাইরে কীভাবে নাম ছড়াল?
আশিসবাবু জানালেন, শালগ্রামের বহু লোকের কলকাতায় যাতায়াত ছিল। চাকরি, পড়াশোনা ইত্যাদি সূত্রে। তাঁরা রসগোল্লা নিয়ে যেতেন। আত্মীয়ের বাড়িতে যেত। আত্মীয়েরা এলে ফেরার সময়ে নিয়ে যেতেন। এভাবেই নাম ছড়াতে থাকে। আমার মনে হয়, হাট আর কালনা-বর্ধমান সড়কও নাম ছড়াতে সাহায্য করেছিল।
কিন্তু ‘গোপালগোল্লা’ নামের উৎপত্তি কীভাবে?
আশিসবাবু বলছেন, তিনি ‘গোপালগোল্লা’ বলতে কখনও শোনেননি। লোকে গোপালের রসগোল্লাই বলতেন। আমার অনুমান, এই নামের উৎপত্তি সম্ভবত বাইরে। হতে পারে দূরের যাঁরা গোপালের রসগোল্লার ভক্ত ছিলেন তাঁরা এই নাম দিয়েছিলেন। ধরা যাক, শালগ্রামের কোনও ছেলে কলকাতায় থেকে পড়াশোনা করতেন। ছুটিছাটায় বাড়ি এলে গাঁয়ের মোদকের বিখ্যাত সৃষ্টি নিয়ে ফিরতেন। তিনি গ্রাম থেকে ফিরলে বন্ধুরা মজা করে বলতেন, গোপালের গোল্লা এনেছিস তো? গোপালের গোল্লা থেকে ‘গোপালগোল্লা’ হতে পারে। প্রণব রায় বাইরে থেকেই সম্ভবত শুনেছিলেন। তাই তিনি ‘গোপালগোল্লা’ হিসেবে উল্লেখে করেছেন। বাইরে থেকে শোনার আর একটা প্রমাণ, গোপাল মোদককে ভাতার গ্রামের বলে উল্লেখ। বেলডাঙা অখ্যাত জায়গা। বাইরের লোককে জায়গার অবস্থান বোঝাতে গেলে কাছাকাছির বড়ো নাম উল্লেখ করতে হয়। অথবা থানার নাম। ভাতার বিখ্যাত বরাবরের এবং থানার নামও একই। প্রণববাবু যাঁর বা যাঁদের থেকে ‘গোপালগোল্লা’ শুনেছিলেন, তাঁরা হয়তো এমনভাবেই পরিচয় দিয়েছিলেন। আমাকেও তো আমার গ্রাম পাতিহালের অবস্থান বোঝাতে ডোমজুড় থেকে শুরু করতে হয়।
গোপাল মোদক ১৯৮৪ সালে পঁচাশি বছর বয়সে মারা যান। তিনি ছেলে ভবানীপ্রসাদকে কাজ শিখিয়েছিলেন। ভবানীপ্রসাদ শিখিয়েছিলেন তাঁর দুই ছেলে বিদ্যুৎ ও সুব্রতকে। এঁরা আশিসবাবুর দাদা। ভবানীপ্রসাদবাবু এবং বিদ্যুৎবাবু সম্প্রতি মারা গিয়েছেন এক মাসের ব্যবধানে। এখন নবাস্থা-হাটগোবিন্দুপুরের দোকান চালান সুব্রতবাবু। রসগোল্লাও তৈরি হয়। খেয়ে দেখার সুযোগ হয়নি।
গোপালগোল্লা কি স্পঞ্জ রসগোল্লা ছিল?
আশিসবাবু বলছেন, ‘‘দাদু স্পঞ্জ করতে চায়নি। স্পঞ্জের মতো হয়ে গিয়েছিল।’’
এই কারণেই বোধহয় প্রণব রায় লিখেছেন, ‘একধরনের স্পঞ্জ রসগোল্লা’।
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী