বড়ো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
বড়ো গল্প
সুমন সেন
ঘটনাটা বছর বারো আগের। সময়টা গ্রীষ্মের শুরু, এপ্রিল মাসের শেষের দিক। ঠিক এরকম একটা সময়ে আমার এক তরুণ বন্ধু শিবনাথ অধিকারী ও তার পরিবার, তাদের পাড়ার লোকজনের সঙ্গে একটা ছোট্ট ট্যুরে যায় উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার চাকলা নামক গ্রামে ঘুরতে। উদ্দেশ্য, লোকনাথ বাবার মন্দির ও আশ্রম দর্শন করবে এবং পুজো দেবে।
শিবনাথরা থাকে হুগলি জেলার উত্তরপাড়া শহরে। তারা ও তাদের পাড়ার লোকজন একটি বাসে করে চাকলার উদ্দেশে রওনা হয়। পরিবার বলতে সঙ্গে যায় তার ভাই সোমনাথ, মা জয়তী, কাকি রীমা ও তার কাকার ছেলে সুজয়।
সকাল দশটার মধ্যেই তারা পৌঁছে যায় গন্তব্যে। বাসটা মন্দিরের পাশেই একটা পরিত্যক্ত জলাশয়ের পাশে দাঁড় করানো হয়। বাস থেকে নামতেই স্থানীয় কিছু মহিলা সকলের হাত ধরে নিয়ে যেতে শুরু করে তাদের দোকানে; পুজোর জন্য ফুল, মালা, প্রসাদ, ধূপকাঠি ইত্যাদি কেনার জন্য। শিবনাথের মা-ই তাদের পরিবারকে নেতৃত্ব দিয়ে একটি দোকানে প্রবেশ করেন এবং প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস ক্রয় করেন। তারপর শিবনাথরা সকলে সেই দোকানেই তাদের জুতোগুলো খুলে রেখে পুজো দেবার উদ্দেশ্যে মন্দিরে যায়। মন্দিরে পুজো সেরে তারা কিছুক্ষণ বসে মন্দিরের দ্বিতীয় তলে, বিশ্রামের জন্য। বিশ্রামকালীন সময়ে তাদের সঙ্গে ছিল তাদেরই পাড়ার একটি পরিবার। যাদের সদস্য সংখ্যা চার—কর্তা ফণীভূষণ দাস, তার স্ত্রী চারুলতা এবং দুই ছেলেমেয়ে স্বরূপ ও সুপ্রিয়া। স্বরূপের সঙ্গে শিবনাথের ভাই অর্থাৎ সোমনাথের খুব ভালো বন্ধুত্ব। কারণ, তারা দুজনেই একই কলেজ থেকে এ-বছর ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দেবে।
কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর দুই পরিবারই মন্দিরের ভোগ-প্রসাদ গ্রহণের জন্য রওনা হয়। টিকিট তারা আগেই নিয়ে রেখেছিল। অবশেষে এক প্রকাণ্ড লাইন অতিক্রম করার পর তারা প্রসাদ গ্রহণের জন্য জায়গা পেল।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তারা আবার বাসের দিকে ফিরে আসে। যেহেতু তাদের সহযাত্রী কিছু পরিবার তখনও লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল তাই তাদের আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল বাস ছাড়ার। তারা বাসটির পাশে যে পরিত্যক্ত জলাশয়টি ছিল, তারই পাড়ে বসল এবং একে অপরের সঙ্গে গল্পগুজব করতে লাগল। জলাশয়টার জল প্রায় শুকিয়েই এসেছে। মাঝে শুধুমাত্র খানিক সবুজ জল টলটল করছে। শিবনাথ, সোমনাথ, সুজয় ও স্বরূপ জলশয়টার ভিতরের জমিটায় নেমে পড়ল। সেখানে গিয়েই তারা বসল এবং জলাশয়ে চরে বেড়ানো হাঁসদের দেখতে লাগল। শিবনাথ লক্ষ করল, জলাশয়টিতে একটিও মাছ নেই। রয়েছে শুধু ব্যাঙাচি ও ছোটো ব্যাঙ। সোমনাথ তার মোবাইল ফোনে বাংলা গান চালিয়ে দিল। শিবনাথ ও স্বরূপ নিজেদের সঙ্গে আনা ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে আশেপাশের পরিবেশের কিছু ছবি তুলতে শুরু করল এবং নিজেরাও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তুলল।
একসময় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শিবনাথ দেখল তিনটে দশ বাজে। তাদের সেইদিন কচুয়া নামে আরও একটি গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। সবক’টি পরিবার একত্রিত হলে বাসটি ছাড়ে প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ। বাসটি রওনা হয় কচুয়ার লোকনাথ ধামের উদ্দেশে।
বাস চলাকালে শিবনাথ লক্ষ করল, তার কাকার ছেলে সুজয়, যে বাসে সফর করা একদমই পছন্দ করে না, যে আসার সময় একবার বমিও করে ফেলেছে, সে দিব্যি বাসের মধ্যে হেসে-খেলে গল্প করে বেড়াচ্ছে। যেন বাসে চড়া তার কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। অথচ শিবনাথ জানে বাসে চড়া সুজয়ের কতটা অপছন্দের! সে এখানে নিতান্তই এসেছে তার মায়ের চাপে পড়ে।
শিবনাথ মনে মনে ভাবল, সুজয়ের বাসে যাতায়াতের অস্বস্তিকর ভাবটা বোধহয় চিরদিনের মতো কেটে গেল। এই বয়সের ছেলেদের বাসে যাতায়াতের জন্য কোনোরকম অস্বস্তিকর ভাব আসা একেবারেই কাম্য নয়। কর্মজীবনে বাসে যাতায়াত করা কলকাতার মতো শহরে হল নিত্যদিনের কাজ। সুজয়ের এরকম হাবভাব দেখে সে খুশিই হল। কিন্তু কত বড়ো একটা বিপদের ছায়া সঙ্গে করে নিয়ে তারা ফিরছে, তা যদি সে ঘুণাক্ষরেও টের পেত!
***
কচুয়ার মন্দিরে পুজো দিয়ে প্রসাদ নিয়ে, আশেপাশের কিছু দর্শনীয় স্থান দেখে তারা বাসে উঠে রওনা হয় সোজা বাড়ির উদ্দেশে।
বাড়ি ফিরে শিবনাথ ফ্রেশ হয়ে ও একটু বিশ্রাম নিয়ে নিজের ল্যাপটপ খুলে বসে। তারপর সারাদিনের অভিজ্ঞতা ও সঙ্গে ছবিগুলি ‘ফেসবুক’ নামক সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে দিতে শুরু করে। ছবিগুলি আপলোড করার সময় সে আশ্চর্যভাবে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করে।
ফেসবুক-এ এমনই একটি প্রযুক্তি দেওয়া আছে যে, সেখানে যখনই কোনও নতুন ফটো আপলোড করা হয় তখনই সেই ফটোতে থাকা প্রত্যেকটি ব্যক্তির মুখের চারপাশ দিয়ে একটি করে চতুর্ভুজাকার রেখা সৃষ্টি হয় যাতে ব্যক্তিগুলির ফেসবুক-এ থাকা নিজের নিজের প্রোফাইলের সঙ্গে ওই ফটোগুলির সংযোগ করা যায়। শিবনাথ দেখল, তার, সোমনাথের ও সুজয়ের যে-ছবিটা স্বরূপ সেই জলাশয়ের কাছ থেকে তুলেছিল, তাতে চারটি চতুর্ভুজ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ছবিতে তো তারা তিনজনই বিদ্যমান। সে, তার ভাই সোমনাথ ও তার কাকার ছেলে সুজয় ছাড়া অন্য কোনও ব্যক্তি নেই সেই ফ্রেমে। শিবনাথের ঠিক বাঁদিকে দাঁড়িয়ে আছে সোমনাথ। সুজয় এখনও ছোটো বলে তাদের সামনে দুজনের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়েছে সে। তিনটে চতুর্ভুজ যথাক্রমে তাদের মুখের উপর দেখাচ্ছে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু সুজয়ের মুখের একটু ডানদিকে রয়েছে আরও একটা চতুর্ভুজ। সেখানে কোনও মানুষের মুখ নেই। তাহলে সেটি কে?
হঠাৎ করে তার পাশে আরও একটা ছবির দিকে নজর গেল। সেটাতেও একই জিনিস। সুজয়ের ডানদিকে আরও একটা চতুর্ভুজ। এই ছবিটা সে নিজে তুলেছিল। যাতে আছে সোমনাথ, স্বরূপ ও সুজয়।
শিবনাথ পাশের আরও দুটো ছবি দেখল। একটাতে শিবনাথ ও সোমনাথ আছে। অপরটাতে আছে সোমনাথ ও স্বরূপ। দুটো ছবিতেই কোনও তৃতীয় চতুর্ভুজ নেই, কিন্তু তার পরের ছবিতেই, যেটাতে সুজয় একা রয়েছে, সেটাতে ঠিক তার ডানদিক করে আর একটা চতুর্ভুজ।
শিবনাথ ফেসবুক থেকেই পরপর ছবিগুলোকে দেখল। যে যে ছবিগুলোতে সুজয় রয়েছে, ঠিক সেই ছবিগুলোতেই তার ডানপাশে আর একটা চতুর্ভুজ বিদ্যমান, যেটা কোনও দৃশ্যমান মনুষ্য মুখকে চিত্রিত করে না।
শিবনাথ খুবই অবাক হল এবং একই সঙ্গে ভয় পেয়ে গেল। সে প্রতিটা ছবিকে ওই অবস্থায় ‘প্রিন্ট স্ক্রিন’ করে সেভ করে রাখল।
***
পরের দিন সকালে শিবনাথ স্বরূপের বাড়ি গেল আগের দিনের সেই ছবিগুলোর তুলে রাখা সমস্ত ‘স্ক্রিনশট’ একটা পেন-ড্রাইভে ভরে নিয়ে এবং তাকে নিজের দুশ্চিন্তার কথাগুলো খুলে বলল।
শিবনাথ নিজে প্রযুক্তিগত ব্যাপারগুলো নিয়ে খুব একটা পণ্ডিত নয়। নিজে সে কোনোরকমে বি.কম পাশ করে একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে। তবে তার ভাই সোমনাথ এবং স্বরূপ একসঙ্গে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করছে। চাইলে সে সোমনাথের কাছেও যেতে পারত সাহায্যের জন্য, কিন্তু সোমনাথ একটু বেশিই ভিতু প্রকৃতির ছেলে। এইসব দেখেশুনে সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে। তাই শিবনাথ অনেক ভেবে স্বরূপের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়াই শ্রেয় মনে করেছে।
জলাশয়ের পাশের ছবিটা দেখিয়ে শিবনাথ কথাগুলো বলছিল স্বরূপকে। স্বরূপ তা দেখেশুনে মৃদু হাসল এবং শিবনাথকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল—“দেখ শিবুদা, ফেসবুকে যখনই আমরা কোনও ছবি আপলোড করি তখনই সেটার ব্যাক-এন্ডে একটা অ্যালগরিদম চলতে থাকে, যাকে বলে ‘ফেস ডিটেকশন’। ছবিতে কোনও মানুষের মুখ খুঁজে পেলেই সেটা অটোমেটিক্যালি ছবিতে থাকা ব্যক্তিকে ট্যাগ করার জায়গা করে দেয়। এই পুরো ব্যাপারটাই হয় একটা রোবোটিক পদ্ধতিতে, কোনও মানুষের দ্বারা হয় না। সুতরাং কিছু বেসিক জিনিস যেমন—দুটো চোখ, একটা নাক, একটা মুখ; এরকম ধরনের একটা অবয়ব পেলেই ওই অ্যালগরিদমটা সেটাকে মানুষের মুখ হিসেবে ধরে নেয়। তোমার এই ছবিটায় নিশ্চয়ই এরকম একটা অবয়ব খুঁজে পেয়েছে ফেসবুক, ঠিক ওই জায়গাটাতে।”
“সে না-হয় বুঝলাম, কিন্তু বাকিগুলো নিয়ে কী বলবি?” শিবনাথ এইবার বাকি ছবিগুলোও দেখাল।
স্বরূপ দেখল, যতগুলো ছবিতে সুজয় আছে, ততগুলো ছবিতেই ঠিক তার ডানদিকে একটা করে ফাঁকা চতুর্ভুজ রয়েছে কাউকে ট্যাগ করার জন্য। এবার স্বরূপও মৌনতা স্বীকার করে নিল।
“একটা কাজ কর তো, কাল তোর ক্যামেরা দিয়ে যেই ছবিগুলো তুলেছিলি, সেগুলো আমায় এই পেন-ড্রাইভে ভরে দিয়ে দে।” শিবনাথ বলল।
স্বরূপ ছবিগুলো পেন-ড্রাইভে ভরতে ভরতে শিবনাথ আবার বলল, “আচ্ছা শোন, তোর সঙ্গে আমার আজ যা যা কথা হল, তা আমার বাড়ির কাউকে জানাস না। সোমনাথকেও না। প্লিজ।”
বাড়িতে এসে স্বরূপের কাছ থেকে আনা ছবিগুলোকেও ফেসবুকে আপলোড করতে গিয়ে শিবনাথ দেখল সুজয়ের প্রতিটা ছবির পাশেই আর একটা করে ফাঁকা চতুর্ভুজ, যেখানে আর একজন ব্যক্তিকে ট্যাগ করতে জানানো হচ্ছে ফেসবুক থেকে। কিন্তু কাকে ট্যাগ করবে সে ওখানে?
***
ফটোর সমস্যা ছাড়া দিন কয়েক নিরুপদ্রবভাবেই কাটল তাদের জীবন। তবে শিবনাথ লক্ষ করতে থাকল তার কাকার ছেলে সুজয় প্রতিদিন যা খাবার খায়, ইদানীং সে তুলনায় তার থেকে অনেক বেশি খাবার খাচ্ছে। বেশি বলতে এতটাই বেশি যে তা সবার চোখে লাগতে শুরু করেছে। তার সঙ্গে যে খাওয়ার ভঙ্গি ব্যবহার করছে, সেটাও যেন তার নিজের নয়। এখন সে প্রচুর পরিমাণে খাবার একসঙ্গে নিয়ে এটা-সেটা খাবলে মুখে পুরতে থাকে। এর জন্য সে তার মায়ের কাছে রোজ বকা খায়। মাঝে মাঝে ধমকের জেরে সে খাবারের থালা ঠেলা মেরে উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। তবুও খাওয়ার ভঙ্গি বদলায় না।
একদিন এরকমই খাবারের থালা ফেলে রেখে নিজের ঘরে চলে যাওয়ার পর সুজয়ের মা তার ঘরে গিয়ে দেখতে পায় সুজয় বিছানায় শুয়ে তার ড্রয়িং খাতা নিয়ে কাদের যেন সব অচেনা মুখ আঁকতে শুরু করেছে। তার মা তাকে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আবার খেতে যেতে বলে। কিন্তু সুজয় একটা অদ্ভুত আবদার করে বসে তখন। সে তার মাকে খাইয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করে। এ-কথা শুনে সুজয়ের মা খুবই অবাক হয়ে যান। তিনি ভাবেন, যে-ছেলে আজ পর্যন্ত কোনোদিন তার হাতে খায়নি, সে আজ হঠাৎ এরকম আচরণ করছে কেন! আগে তিনি যদি কোনোদিন কোনও কারণে সুজয়কে খাইয়ে দিতে চেয়েছেন, তখন সে মুখের উপরই না করে দিয়েছে। কিন্তু আজ সে নিজে থেকেই এরকম কেন বলল? যাই হোক, ছেলের এহেন আবদারে মা মনে মনে খুশিই হলেন এবং ছেলেকে পরিপাটি করে এনে খাইয়ে দিলেন।
***
এদিকে দিনের পর দিন সুজয়ের আচরণ যেন অদ্ভুত থেকে অদ্ভুততর হয়ে উঠছে, আর ওইদিকে শিবনাথ সেই ছবিগুলির কোনও কূলকিনারা না পেয়ে ততই ব্যস্ত হয়ে উঠছে।
ঠিক এমনই একটা সময়ে শিবনাথ আমার কাছে এল।—“বটুকদা, শুনেছি তুমি নাকি অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে কীসব কাজ-টাজ করো? আমি একটা অদ্ভুত সমস্যায় পড়েছি, আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবে?” সে বলল।
“শিবু? আয় বোস। তবে তুই যা শুনেছিস সেটা পুরোপুরি ঠিক নয়। আমি অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে ঠিক ‘কাজ-টাজ’ করি না। আসলে অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপার-স্যাপারগুলো আমাকে ঠিক খুঁজে নেয় কোনো না কোনোভাবে। এখন বল, তোর কী সমস্যা হয়েছে?” আমি বললাম।
ক্ষণিক বিশ্রাম না নিয়েই সে শুরু করল। সে নিজের ল্যাপটপটা খুলে আমার সামনে মেলে ধরল এবং ছবিগুলো আমাকে দেখাতে শুরু করল।
সমস্ত কিছু দেখে আর শুনে আমি মৃদু ঘাড় নাড়ালাম শুধুমাত্র।
বাংলার প্রায় সমস্ত মধ্যবিত্ত ঘরে বাবা লোকনাথ পূজিত হন। অধিকাংশই জীবনে কখনও না কখনও চাকলা-কচুয়া গ্রামে ভ্রমণ করতে গিয়েছেন। সুতরাং, নির্দিষ্ট জায়গাটা সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া আহামরি কোনও ব্যাপার নয়।
আমি শিবনাথকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম বাড়ি ফিরে যেতে, ব্যাপারটা আমি দেখছি।
***
এদিকে যত দিন কাটতে থাকল, সুজয়ের অবস্থা যেন তত খারাপের দিকে যাচ্ছিল। সে স্কুলে যেতে বা পড়তে যেতে চাইত না। পারলে প্রায় সারাদিন ধরে মাঠে থাকত, কখনও বন্ধুদের সঙ্গে খেলত আবার কখনও একা। বিশেষ করে রাত্রিবেলা তো সে আরও ভয়ানক হয়ে যেতে শুরু করল।
একদিন রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, তখন কোনও একটা কারণে শিবনাথের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলে সে নাইট-ল্যাম্পের মৃদু আলোতে দেখতে পায়, তার ঘরের নৈর্ঋত কোণে একটা অদ্ভুত জন্তুর অবয়ব ছোটো থেকে ক্রমশ বড়ো হতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ ঘুম চোখে শিবনাথ ব্যাপারটাকে বোঝার চেষ্টা করল। অবয়বটা যত বড়ো হতে শুরু করল, তার বুকের ধুকপুকানি তত বাড়তে শুরু করল। একটা সময় মনে হল যেন অবয়বটা তাকে গিলে নিতে আসছে। ভয়ে শিবনাথের হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে যেন গলার কাছে চলে এল। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সে বেড-সুইচে চাপ দিয়ে বড়ো লাইট জ্বালিয়ে দিল। তারপর অবাক হয়ে দেখল, ঘরের কোণে সুজয় দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।
সে বুঝতে পারল না মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে তার ঘরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ভাইকে বকা দেবে, না কী করবে! খানিক বিরক্ত হয়ে শিবনাথ বিছানা থেকে নেমে সুজয়ের কাছে গেল। সুজয়ের গায়ে হাত দিয়ে সে বুঝল, সুজয়ের ধুম জ্বর এসেছে। শিবনাথ একটা চাদর তার ভাইয়ের গায়ে জড়িয়ে নিয়ে গেল কাকিমার কাছে।
***
এর তিনদিন পর আরও একটা এমন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটল যে, এরপর বাড়ির কেউই আর স্থির বসে থাকতে পারল না। যে যেভাবে পারল উঠে-পড়ে লাগল সুজয়ের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য। একের পর এক বাড়িতে আসতে শুরু করল নামিদামি ওঝা, তান্ত্রিক। বাড়িতে শুরু করল হোম, যজ্ঞ, শুদ্ধিকরণ। কিন্তু কিছুতেই কোনও সুফল দেখা গেল না।
সেদিন রাতে প্রায় তিনটে নাগাদ শিবনাথের মায়ের বারান্দায় খুটখাট আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। বিছানা থেকে উঠে শব্দের উৎস লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতেই তিনি দেখেন, বারান্দায় যেখানে ফ্রিজ রাখা থাকে সেই জায়গাটা আলো হয়ে রয়েছে। ফ্রিজের দরজা খোলা। সুজয় দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। শুধু দাঁড়িয়ে আছে নয়, সে ফ্রিজার থেকে কাঁচা মাছ বের করে কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে! দশ বছরের ছেলের এইপ্রকার অস্বাভাবিক কার্যকলাপ দেখে শিবনাথের মা সেই মুহূর্তে মূর্ছা গেলেন।
***
শিবনাথ দৌড়োতে দৌড়োতে আমার কাছে এল আবার। সুজয়ের ঘটনাগুলোর বিবরণ দিতে দিতে সে প্রায় ভেঙেই পড়ল। আমি অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে শান্ত করলাম।—“চিন্তা কোরো না। আশা করছি তোমার ভাই আবার আগের মতো হয়ে যাবে। কিন্তু তার আগে ওটা ভোগাবে বেশ কিছুটা।” আমি বললাম।
“ওটা মানে?” সে জিজ্ঞেস করল।
“ওটা হচ্ছে একটা অপশক্তি। অনেক পুরোনো—ওদের বলে ‘দেও’। জলে ডুবে মত্যুবরণ করা কোনও ব্যক্তি মরার পরে এইধরনের অপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।”
“তার মানে তুমি বলছ আমার ভাইয়ের উপর প্রেতাত্মা ভর করেছে?”
“আমার তো তা-ই ধারণা। সেদিন তোমরা লোকনাথ ধাম ঘুরে আসার সময় ওটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ। আর সে কোনও কারণে সুজয়কে পছন্দ করে, তাই এখনও বড়ো রকমের কোনও ক্ষতি করেনি। সাধারণত এরা নিজের আস্তানা ছেড়ে অন্য কোথাও যায় না। কিন্তু তোমাদের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে কোনও কারণে।”
“এখন উপায় কী বটুকদা? আমরা তো খুব ভয়ে ভয়ে আছি। আমার কাকা অর্থাৎ সুজয়ের বাবা তো সাইকায়াট্রিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টও নিয়ে ফেলেছে। কাকা ভাবছে, সুজয়ের বোধহয় মাথার কোনও সমস্যা হয়েছে।”
“সে তোমার কাকা নিজের মতো চেষ্টা করুন। তাঁর কাজে বাধা দিতে যেও না। আসলে, উনি তো বাচ্চার বাবা, তাঁরও তো আত্মতুষ্টির প্রয়োজন আছে, নাকি? আমি আমার মতো চেষ্টা করে দেখি। তবে তোমাকে কিন্তু আমার সঙ্গ দিতে হবে।”
“নিশ্চয়ই বটুকদা, তুমি যা বলবে আমি তাই করব। আমি নিশ্চিত এই সবকিছু কোনও ভৌতিক ব্যাপারই হবে। প্রথমদিন থেকেই আমার মনটা কু ডাকছিল। তাই তো তোমার কাছে ছুটে এসেছি। আর আমি এটাও জানি, এই সমস্যার সমাধান কোনও ভণ্ড তান্ত্রিক-ফান্ত্রিকের দ্বারাও হবে না।”
“এমন বোলো না শিবু। সকলেই ভণ্ড হয় না। আমার স্বচক্ষে দেখা তিনজন দিব্যজ্ঞান সম্পন্ন তান্ত্রিকের কথা তোমায় বলতে পারি, তবে আজ আগে তোমার সমস্যা সমাধানের জন্য পরিকল্পনা করতে হবে।”
“কিছু প্ল্যান আছে নাকি?”
“হুম। আমাদের আবার একবার ওই গ্রামে যেতে হবে। তবে তার আগে তোমাকে কিছু কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন।”
“হ্যাঁ, বলো।”
“ছবিগুলো প্রথম দেখেই আমার সন্দেহ হয়। তারপর থেকেই আমি খোঁজ নেওয়া শুরু করি। দেগঙ্গা থানায় আমার পরিচিত একজন আছে, তার সাহায্যে চাকলা ফাঁড়ি থেকে জানতে পারি একটা ঘটনা। প্রায় সাত বছর আগে একদিন সন্ধ্যায় বছর দশেকের একটা বাচ্চা বাবার বকা খেয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। মূল উদ্দেশ্য ছিল বাবা ঘুমিয়ে পড়া পর্যন্ত বাইরে কোথাও লুকিয়ে থাকা। তার দোষের জন্য যেন বাবার হাতে আরও পিটুনি খেতে না হয়। কিন্তু রাত গভীর হলেও বাচ্চাটি আর ফেরে না। রাতেই শুরু হয় খোঁজ। কিন্তু কোথাও পাওয়া যায় না তাকে। সকাল হলে তাদের পাড়ার একটা ঝিলে ভেসে ওঠে বাচ্চাটির মৃতদেহ। এখানে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, বাচ্চাটি সাঁতারে ছিল ভীষণভাবে পারদর্শী। সুতরাং জলে ডুবে মারা যাওয়ার ব্যাপারটা কেউই হজম করতে পারছিল না। কিন্তু পোস্ট-মর্টেমে দেখা গেল সে জলে ডুবেই মারা গেছে। শরীরে অন্য কোনোপ্রকার আঘাতের চিহ্ন নেই। কেসটা ক্লোজ হয়ে গেছে, কিন্তু রহস্যটা সমাধান এখনও হয়নি।”
“কিন্তু বাচ্চাটা তো সুইসাইডও করতে পারে!”
“তোমার মনে হয়, ওরকম একটা রুরাল এলাকার দশ বছরের একটা বাচ্চার মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা আসবে? দোষ করে বাবার হাতে পিটুনি খাওয়া রোজকার ব্যাপার ওখানে। তোমার কথা যদি মেনেও নিই, তবুও আত্মহত্যার জন্য সে জলটাকেই বেছে নিল কেন? যেখানে সে সাঁতারে বিশেষভাবে পারদর্শী!” আমি মৃদু হেসে বললাম। তারপর আবার বললাম, “তুমি নিজে সাঁতার জানো শিবু?”
“না, তা তো শেখা হয়নি।” সে অধোবদনে বলল।
“তাই হয়তো তুমি জানো না, যারা সাঁতারু হয় তারা সাধারণত জলে ডুবে আত্মহত্যা করতে পারে না। দম বন্ধ হতে থাকলে হাত-পা আপনা থেকেই কাজ করা চালু করে এবং সে জলের উপর ভেসে ওঠে জীবিত অবস্থাতেই।”
“আচ্ছা, তাহলে এখন আমাদের কী করণীয়?”
“পুলিশের সাহায্যেই আমি একটা পুরোনো খবরের কাগজ পেয়েছি, যাতে ওই ঘটনাটা একটু বিস্তারিতই লেখা আছে। যেহেতু ব্যাপারটা একটু রহস্যজনক, তাই সাংবাদিক একটু সময় নিয়েই খবরটা করেছেন। সেখান থেকেই আমি ওই পরিবারের নামধাম জানতে পারি। মৃত বাচ্চাটি ছাড়াও সেই পরিবারে আরও একটি ছেলে ছিল। আমাদের সেই পরিবারের খোঁজেই যেতে হবে। আর যখন বলব তখন সুজয়কেও সঙ্গে নেওয়া চাই।”
“আচ্ছা, তার মানে তুমি বলছ, মৃত বাচ্চাটিই সেই ‘দেও’ যে আমার ভাইয়ের উপর ভর করেছে?”
***
অন্যদিকে, সুজয় যেন নিজের সত্ত্বাকে একেবারেই হারিয়ে ফেলল। যেদিন সাইকায়াট্রিস্টের কাছে তার প্রথম সিটিং ছিল, সেদিন সে ডাক্তারকে কানে কানে এমন কিছু বলেছে, যার ফলে তিনি প্রচণ্ডভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আর তারপর থেকে সেই ডাক্তারের কোনও পাত্তাও পাওয়া যাচ্ছে না।
একদিন ঘটল আরও এক ভয়ানক ঘটনা। রাত একটার পর সুজয়কে বাড়ির কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। গোটা বাড়ি, ছাদ, বাগান—সব জায়গা খুঁজে ফেললেও দেখা মিলল না সুজয়ের। বাধ্য হয়ে বাড়ির সকলে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। ব্যাপার শুনে কিছু মানবিক প্রতিবেশী সুজয়কে খোঁজার কাজে লেগে পড়ল। অবশেষে তাকে খুঁজে পাওয়া গেল পাড়ার এক পুকুর থেকে গলা-জলে ডুবে থাকা অবস্থায়। তার আশেপাশে কিছু ক্ষত-বিক্ষত মরা মাছ ভেসে বেড়াতে দেখা গেল। কেউ কেউ বলে, সুজয়ের চোখগুলো যেন ভাঁটার মতো জ্বলছিল। আর সে নাক দিয়ে এমন একটা অমানুষিক গোঁ গোঁ আওয়াজ বের করছিল এবং আশেপাশের সবাইকে যেভাবে হিংসাত্মক চোখে দেখছিল—তা দেখে সকলেরই তাক লেগে গিয়েছিল।
***
চাকলা গ্রামের সেই মৃত বাচ্চাটির পরিবারের খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল, তাঁরা এখন আর সেখানে থাকেন না। বেশ কয়েকদিনের চেষ্টায় পাওয়া গেল তাঁদের বর্তমান ঠিকানা। ভবানীপুরের একটা ব্যস্ত এলাকায় বাড়িভাড়া করে থাকেন তারা। লোকটি এখন ট্যাক্সি চালান। তাঁর স্ত্রী গৃহবধূ, তবে এখন মানসিকভাবে কিছুটা বিকারগগ্রস্ত। বেঁচে থাকা ছেলেটি এ-বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।
তাঁরা সাত বছর আগে মৃত ছেলে এবং সেইদিনের ঘটনা সম্পর্কে যা যা বললেন, তা প্রায় সবই আমরা আগে থেকেই জেনেছিলাম পুরোনো খবরের কাগজ থেকে। শুধু যা অতিরিক্ত জানতে পেরেছিলাম সেটা হল, সেদিন ওরকম পরিস্থিতি হবার আসল কারণ।
মুকুল, অর্থাৎ মৃত বাচ্চাটি তার বাবাকে অনেকবার বলেছিল একটা বাচ্চাদের ছোটো সাইকেল কিনে দেবার জন্য। পাশের পাড়ায় তার সমবয়সি একটি ছেলের একটা সুন্দর ছোটো সাইকেল দেখে তার মনেও ইচ্ছা জাগে ওরকম একটা সাইকেল পাবার। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তার বাবা দেবেন দেবেন করেও কিনে দেননি ওরকম একটা সাইকেল।
একদিন মুকুল নিজেই নিজের সাইকেলের ব্যবস্থা করে ফেলে। সে পাশের পাড়ার ছেলেটির সাইকেলটা তার অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে লুকিয়ে নিয়ে পালিয়ে আসে নিজের বাড়িতে। বাড়িতে এনেও সে ওটা লুকিয়ে রাখার অনেক চেষ্টাই করেছিল, কিন্তু মা-বাবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না শেষ পর্যন্ত। তাঁরা যখন ঘাস-পাতার আড়ালে লুকিয়ে রাখা সাইকেলটা আবিষ্কার করেন, তখন তার বাবা রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন। দারিদ্রতা তাঁদের জীবনকে গ্রাস করে ছেলেকে চৌর্যবৃত্তির দিকে টেনে নিয়ে যাবে, তা তিনি কল্পনাও করতে চাইছিলেন না। তিনি বেশ খানিক্ষণ বকাঝকা দিয়ে, দু-চারবার হাতও চালান মুকুলের উপর।
ঠিক তখনই মুকুল ভয় পেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। এরকম আগেও বেশ কয়েকবার হয়েছে; বাবার মারের ভয়ে সে অন্য কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থেকেছে; তারপর বাবা ঘুমিয়ে গেলে অথবা কাজে চলে গেলে, আবার ফিরে এসেছে।
ছেলে যে ভুলটা করে ফেলেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করেন মুকুলের বাবা। সাইকেলটা ফিরিয়ে দেবারও চিন্তা এসেছিল একবার। কিন্তু কিছু একটা ভেবে তিনি দোকানের দিকে যান রঙ-তুলি কিনতে। উদ্দেশ্য ছিল গোটা সাইকেলটাকে নতুন রঙ করে বেশ কিছুদিন লুকিয়ে রাখা, তারপর সব শান্ত হয়ে গেলে মুকুলকেই ওটা ব্যবহার করতে দেওয়া।
ভাবনা মতন কাজও হয়েছিল। কিন্তু মুকুল আর ফিরে এল না কোনোদিন।
মুকুল মারা যাবার বছর খানেকের মধ্যে ওই পরিবার চাকলা থেকে ভবানীপুর চলে এলেও বাচ্চাদের সেই ছোট্ট সাইকেলটা তাঁরা সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিলেন। সেটা এখনও সঙ্গেই আছে। বলা যায়, খানিকটা মুকুলের স্মৃতি হিসেবেই। সেই সাইকেল ওঁরা নিজের দ্বিতীয় ছেলেকেও ব্যবহার করতে দেননি কোনোদিন।
***
আমি ওঁদের সুজয়ের ব্যাপারটা বিস্তারিতভাবে বললাম। আর সাইকেলটা একদিনের জন্য আমাদের দেবার জন্য অনুরোধ জানালাম। সব শুনে ওঁরা কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবং আমাদের পরিকল্পনায় সামিল হবার জন্য আমাদের সঙ্গে চাকলাতে যাবার ইচ্ছাপ্রকাশ করলেন।
আমাদের সর্বশেষ কার্যক্রমের জন্য দু-দিন পরের দিনটা ঠিক করা হল। সেইমতো সমস্ত প্রস্তুতিও নিয়ে ফেললাম।
***
চাকলা পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেল। সেখানে আরও কিছু প্রস্তুতি নেবার ছিল, তাই আরও খানিক দেরি হল।
সুজয়কে অনেক কষ্টে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি আর শিবনাথ একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে, সুজয়কে মাঝখানে বসিয়ে প্রায় চেপে ধরেই নিয়ে গিয়েছি। যাবার সময় ব্যাটা আমার হাতে কামড়েও দিয়েছে একবার। সুজয়ের মা-বাবা কিংবা বাড়ির অন্য কাউকেও সঙ্গে নিইনি ইচ্ছাকৃতভাবেই। কে জানে সেখানে ওর পরিস্থিতি দেখে ওঁদের কী প্রতিক্রিয়া হয়, এই ভেবেই। শিবনাথকে আগে থেকেই বলা ছিল, কাছে-পিঠে ঘুরতে যাবে বলেই ভাইকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে এসেছে।
মুকুলের মা-বাবাকেও আগে থেকেই বলা ছিল। আমরা গিয়ে দেখি তাঁরা জলাশয়টার ধারে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
আমরা পৌঁছোনোর পরেই হঠাৎ মনে হল, সারা আকাশ জুড়ে মেঘের ঘনঘটা শুরু হল। রৌদ্রদীপ্ত উজ্জ্বল আকাশ ছেয়ে যেতে থাকল অন্ধকারের করাল গ্রাসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবল ঝড় উঠল। কালবৈশাখী!
আমি তাড়াহুড়ো করতে শুরু করলাম। বুঝলাম, এসব অপশক্তির কারসাজি। আমাদের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটাতে চায়। ঠিক তখনই বের করলাম আমাদের মোক্ষম অস্ত্র—মুকুলের সেই সাইকেলটা।
সুজয় প্রচণ্ড লাফালাফি-দাপাদাপি জুড়ে দিল। শিবনাথের দুই হাতের বাহুডোরে তাকে চেপে ধরে রাখতে ভালোই বেগ পেতে হচ্ছে। সেই দেখে মুকুলের বাবাও শিবনাথের সঙ্গ দিলেন। মুকুলের মা সুজয়ের গায়ে-মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলতে থাকলেন, “এই তো বাবা আমরা আছি। কী কষ্ট তোমার?”
কথাটা শুনে সুজয় যেন একদৃষ্টে খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মুকুলের মায়ের মুখের দিকে। এই সুযোগে আমি বাচ্চাদের সাইকেলটা নিয়ে জলাশয়টার ভিতরের চরাটায় রেখে এলাম।
হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে এল। সুজয় আবার উত্তেজিত হয়ে উঠল। সে জলাটার দিকে এগোতে চাইল। আমি সঙ্গে করে আনা একটা মোটা দড়ি সুজয়ের কোমরে ভালো করে বেঁধে দিলাম। তারপর ওদের বললাম সুজয়কে আস্তে আস্তে ছাড়তে।
সুজয় এগোতে থাকল সাইকেলটা লক্ষ্য করে। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টিতে সামনে ভালো করে দেখা যায় না। তবুও তার মধ্যে দেখার চেষ্টা করে বুঝলাম, সুজয় সাইকেলটাকে ভালো করে দেখছে; কখনও হাত বুলোচ্ছে সেটার উপর। একবার চড়েও বসল সেটাতে। তারপর হঠাৎই সাইকেলটাকে তুলে নিয়ে জলাটার দিকে এগোতে শুরু করল। একটা দশ বছরের বাচ্চার গায়ে এত ক্ষমতা কী করে এল সেটা দেখে আর ভেবে আমার গায়ে কাঁটা দিল।
একটা ঝপ করে আওয়াজ হল। সামনে তাকিয়ে বুঝলাম কোথাও কেউ নেই।
“সবাই দড়ি ধরে টানো, সুজয় জলে লাফ দিয়েছে!” আমি চিৎকার করে বললাম।
সকলের প্রচেষ্টায় আমরা সুজয়কে জল থেকে বের করে আনতে সক্ষম হলাম।
জল-কাদা মাখামাখি সুজয় তখন একেবারে সংজ্ঞাহীন। শিবনাথ উত্তেজিতভাবে সুজয়ের বুকে-পেটে চাপ দিতে থাকল তাকে চিত করে শুইয়ে।
আমি শিবনাথের পিঠে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, “ওর কিছু হয়নি, জ্ঞান হারিয়েছে শুধুমাত্র। চিন্তা কোরো না।”
হঠাৎই ঝড়-বৃষ্টি কমতে শুরু করল যেন। দেখলাম, মুকুলের মা-বাবা একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন জলাটার দিকে। ওঁদের কাছে যেতেই আমাকে জলের উপর আঙুল দেখিয়ে ইশারা করলেন মুকুলের মা। চশমাটা মুছে নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলাম, গলা-জলে ডুবে থাকা একটা বাচ্চার অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যাচ্ছে। আমি ওঁদের বুঝিয়ে বললাম, “আর কিছু করার নেই আমাদের। ও থাকুক ওর প্রিয় সাইকেল নিয়ে, ওখানেই।”
মুকুলের মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন আমার কথা শুনে। মুকুলের বাবা তাঁকে জড়িয়ে ধরে রাস্তার দিকে এগোতে শুরু করলেন।
আকাশ ধরে এসেছে ততক্ষণে। বিকেলের সূর্যাস্তের আলোও খেলা করছে চারপাশে।
সুজয় চোখ খুলেছে ইতিমধ্যে। শিবনাথ তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে চলেছে রাস্তার দিকে।
মুকুলের মা-বাবাকে একটা গাড়িতে তুলে বিদায় জানিয়ে আমরা এগোলাম আমাদের গাড়ির দিকে।
***
ফেরার সময় সুজয় একেবারে ফিট। যেমন আর পাঁচটা বাচ্চা ছেলে হয় তেমনই কথা বলছে, খেলা করছে, খুনসুটি করছে তার দাদার সঙ্গে। শিবনাথ আমার দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির হাসি হাসল।
এমন সময় আমি আমার পার্সে রাখা পুরোনো খবরের কাগজ থেকে কেটে নেওয়া মুকুলের ছবিটা শিবনাথের হাতে দিলাম। সেটা নিয়ে সে বিস্ফারিত চোখে সুজয়ের মুখের পাশে রেখে দুজনকে মেলাতে থাকল। আর দেখল, দুজনের মুখের গড়নে খুব একটা পার্থক্য নেই!
“মাই গড!” মুখে বলল শিবনাথ।
ছবি - পুণ্ডরীক গুপ্ত
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী