ছোটো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
ছোটো গল্প
সুব্রত দাস
অবশেষে অনেক খোঁজখবর করবার পর, অনেক কাঠখড় পোড়াবার পর পাওয়া গেল।
বিয়ের পাত্রী। হলধরের জন্য। হলধরের বাবা জলধর নস্কর শেষমেশ এই মেয়েটিকেই পছন্দ করল। সুরোবালা। আহা, কী মিষ্টি নাম!
সুরোবালা ঢালি। দেখতে শুনতে মন্দ নয়। গায়ের রঙ চাপা হলেও মুখশ্রী খুবই সুন্দর। তবে গলার আওয়াজটা বেশ খরখরে। তা হোক। এমনটাতেই ধমক-চমক দিয়ে হলধরকে বাগে রাখা যাবে।
হলধরের বিয়ের কনে খুঁজতে গিয়ে পাক্কা তিনটি বছর সময় লাগল জলধর, মানে হলধরের বাবার। ছেলেকে নিয়ে জলধরের গর্বের শেষ নেই। রোগা ছিপছিপে হাড়গিলে মার্কা শরীর। মুখটা চৌকো। মাথায় হাফ ইঞ্চির থেকেও কম চুল। কদমছাঁটও বলা যায়। এর মধ্যেই দু-চার গাঁয়ে বেশ নামডাক হয়েছে তার। এখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় জলধরকে প্রায়ই শুনতে হয়, ওই দেখো হলধরের বাবা যাচ্ছে। জলধরের বুকে তখন ভালো লাগার সমুদ্রোচ্ছ্বাস হয়।
বছর দু-এক আগেও হলধরের কাজে মোটেও মন ছিল না। যাত্রা-নাটক শুনতে খুবই ভালোবাসে সে। তো সেই যাত্রা-নাটকের লোভ সামলাতে পারত না কিছুতেই। মাসের অর্ধেক দিন খালি হাতে রাত-জাগা লাল চোখ নিয়ে বাড়ি ফিরত। রাতবিরেতেই যার কাজ, মানে এর-ওর গৃহস্থালির জিনিসপত্র না বলে-কয়ে নিয়ে আসার কাজ আর কি। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। হলধরের বাবা জলধর, তার বাবা গদাধর, তার বাবা... সেই ব্রিটিশ আমল থেকে তাদের বংশের এই নিশি পেশা চলে আসছে।
কালাচাঁদ বোষ্টম ঘটকালির কাজ করে। জলধরের গাঁ আক্কেলপুরেই তার বাস। হলধরের বিয়ের সম্বন্ধ সে-ই এনেছিল। তবে তাকে বরাবর সন্দেহের চোখেই দেখত জলধর। এড়িয়ে চলত কালি বোষ্টমের ছায়া। কারণ, জলধরের বাবা গদাধর নস্কর ঘটক সেজে পাত্র বা পাত্রীর বাড়িতে বিয়ের খোঁজখবর দেওয়ার ছলে রাত কাটাত। আর সেই রাতেই বাড়ির সকলকে কী এক অজানা কৌশলে ঘুম পাড়িয়ে টাকাপয়সা, সোনাদানা নিয়ে চম্পট দিত। তাহলেই বোঝো, এমন মানুষকে কেমন করে বিশ্বাস করে জলধর?
কালি বোষ্টম যেন মনের কথা বুঝতে পারে। আকর্ণ হেসে বললে, “ওহে জলধর, দশ গাঁ খুঁজে এমন পাত্রী জোগাড় করিচি। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলনি বাপ! আমি জানি, তুমি আমারে বিশ্বেস যাওনি মোটে। তোমার বাপের মতো কোনোদিন হতে পারবনি। ত্রিভুবনে গদাধরকাকার মতো গুণধর লাখে একটা মেলে।” এই বলে দু-হাত জড়ো করে মাথার ওপর তুলে ‘জয়, গদাধরকাকার জয়’ বলে বার তিনেক পেন্নাম ঠুকলে। তারপর বললে, “তবে পত্রীপক্ষও কম যায় না হে! ওদের আবার বাটপাড়িতে খুব নামডাক।”
জলধরকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে কালি বোষ্টম বললে, “কী, বুঝলে না তো? ওরে বাবা, চোরের ওপর বাটপাড়ি তো শুনিচো। তেনারা তার চায়ি এক কাঠি দড়। ওরা যে ডাকাতের ওপর বাটপাড়ি করতি ওস্তাদ ছ্যালো গো! ডাকাতদের লুটপাট করা মালপত্তর বেমালুম হাওয়া করি দিতি পাত্ত এক রেতেই!”
“বলো কী কালিদা?” মহা আশ্চর্য হয়ে বিষম খেয়ে কাশতে কাশতে বললে জলধর।
“তবে আর বলচি কী!” আরও সোৎসাহে দু-চোখে রসগোল্লার সাইজ এনে এবার কালি বোষ্টমের ফিরিস্তি।—“খোদ বিটিশ সরকার থেকে পুরোস্কার পয্যন্ত পেয়েচে কতবার। ওদের কীসব যেন কয়—বড়লাট, মেজো লাট, ছোট লাট—পেত্তেকে, এমনকি হাফ লাট পয্যন্ত পালা করি ডাকাতের বংশ নিব্বংশি করতি দায় চাপায়ে ছ্যালো। তা সেই দায়ভার অক্ষরে অক্ষরে পালন করিছে জনার্দন ধর ও তাদের বংশের পুব্বপুরুষেরা।”
“থাক থাক, আর কইতি হবেনি। আমি তালি কালকেই যাব।” আনন্দে, উৎসাহে জলধর কালি বোষ্টমের দুই হাত চেপে ধরে বলল, “তুমি আমারে নে চলো কালিদা।”
“বেশ বেশ। খুব ভালো কথা। কালই তোমারে নে যাব।” জলধরের ঘনিষ্ঠ হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে কালি বোষ্টম চাপা স্বরে মাপা কথা বললে, “হলধরকে নে যেতি হবে। তোমার হবু বেয়াইমশাই ছেলেরে পরখ করি দেখতি চায়। যার-তার হাতে তো আর মেয়েরে তুলি দিতি পারেননি! পাত্তর কতটা করিৎকম্মা, তা যাচাই করি নেবেন জনার্দনবাবু। যদিও তোমাদের, মায় তোমার ছেলের পয্যন্তি হিসটিরি শুনায়ে ছেড়িছি। উনি খুব কড়াধাতির নোক। বললে, আমি নিজে যাচাই করি নিতি চাই।”
“তুমি কিচ্ছুটি চিন্তা করোনি কালিদা, ছেলে আমার সত্যি সত্যি, তিন সত্যি করিৎকম্মা। লেখাপড়ার পরীক্ষায় ফেলটুস হলি কী হবি, ছেলে আমার কোহিনূর বটে! কেন, দেখনি গমগমপুর থানায় দারোগা গীষ্পতি গোলের ঘরে আমার হলধরের ছবি কেমন সুন্দর করি বাঁধায়ে রাখিছে!”
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কালি বোষ্টম। মুখের কথায় বেমালুম দাড়ি বসিয়ে জলধর বললে, “তা কী কইলে কালিদা?”
হলধরের বাড়ির, না না, ভুল হলো, পাশের গাঁ পাটালিপোতার চৌকিদার লালবদনের বাড়ি থেকে হলধরের সটকানো নারকেল কোরা দিয়ে মুড়ি চিবোতে চিবোতে বললে কালি, “কেন, সেই যে তুমি একবার, ওই যে গো, যেবারি পুকুরডোবা গেরামে যাত্রার আসর বসিছ্যালো, গাঁশুদ্ধু নোক যাত্রার আসরে গিছিলো, আর বাড়ি বেবাক ফাঁকা পেয়েও যেবার চুরি কত্তি গিয়ে পেরায় ধরা পড়ি যাচ্ছিলে, সেবার তো তোমার ওই গুণধর ছেলে হলধর তোমারে বাঁচায়েছ্যালো! ওই সেবার হনুমানের লঙ্কাকাণ্ড পালা হতিছ্যালো, মনে পড়তিছে?” একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, “আহা, সেবার বুদ্ধি খাটিয়ে যদি হলধর হনুমানের গদাটা চুরি না কত্তো, কী হতি পারত বলো দেখি? আর ওই গদার ঝামেলার কারণেই তো বামাল সমেত উধাও হতি পাল্লে!”
পরের দিন বেলা দশটার মধ্যে হলধরকে নিয়ে কালি বোষ্টমের সঙ্গে পাঁচ গাঁ পর গাবতলায় জনার্দন ঢালির বাড়ি তাঁবু ফেলল জলধর। গোলগাল হৃষ্টপুষ্ট জনার্দন ধর আপ্যায়ন করল সাধ্য মতন। পাত্র-পাত্রী উভয়ের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ হল। কালি বোষ্টম যেন রেফারির কাজ সারল। জলধর-জনার্দনের বৈবাহিক সম্পর্কের খেলাটিকে গোল শূন্য অবস্থায় রেখে ড্র করিয়ে ছাড়ল। খাওয়াদাওয়াও হল জমকালো।
বাড়ি ফেরবার আগে খানিকক্ষণ কথা কইল জনার্দন। হলধরের সঙ্গে, একান্তে। হিরে বসানো সোনার নস্যির কৌটো থেকে দুই টিপ নস্যি নাকে গুঁজতে গুঁজতে বলল জনার্দন, “তা বাবা হলধর, আমার মেয়েরে তোমার যে পছন্দ হয়েছে সে আমি বুঝতি পারিছি। কিন্তু কাজেকম্মে মতিগতি আছে তো? দুটোর এট্টা কম হলি কিন্তুক আমার মেয়েরে তোমার হাতে তুলে দিয়ে শান্তি পাবনি।”
হলধরকে নিরুত্তর দেখে আরও দুই টিপ নস্যি নাকে গুঁজে বলল, “ব্যাপারটা তা’লি তোমারে খোলসা করিই বলি। মতি আর গতি এই দুটি নিয়েই মতিগতি, বুঝলে বাবা! কাজেকম্মে যেমন একটা স্বচ্ছ মতের পাশাপাশি মতি মানি ইচ্ছা থাকপে, তেমনি কাজের গতিও থাকতি হবে। এক্বেরে চোখের পলকি তোমার কাজ সারতি হবে। তবেই তুমি লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবে! বুঝলে কিনা?”
অধোবদন সলজ্জ হলধর বলল, “যে আজ্ঞে। আপনার মাথা নীচু হতি দেবনি, এইটুকুন শুধু হলপ করি বলতি পারি।”
আরও কিছু দরকারি-অদরকারি কথা হল। ছটফট করতে করতে সদর পর্যন্ত এসে জনার্দন পাত্রপক্ষকে বিদায় জানাতে এল। কালি বোষ্টমের উদ্দেশে শুধু একবার বলল, “পাত্তর বাবাজি আমার মেয়ের জন্য পছন্দ হয়েছে কি না কাল খবর পাঠাপো।”
বেশ কিছুদূর আলপথ দিয়ে হেঁটে তবে পাকা রাস্তায় ওঠা যায়। সেখান থেকে বাসে করে ফিরতে হবে আক্বেলপুরে। হোঁচট খাওয়ার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সাবধানে পথ চলতে চলতে কালি বোষ্টম বললে, “দেখো কী খপর আসে কাল।”
হলধর নিশ্চুপ।
“সে-কথা আমিও ভাবতেছি কালিদা।” একটু থেমে জলধর বললে, “কী জানি বাবা, কী পরীক্ষা নিলেন জনার্দন-কত্তা, মোটে ঠাওর কত্তি পারতেছি না।”
এমন সময় দুদ্দাড় কীসের শব্দ শুনে পেছনে ফিরে বেবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দুজন—কালি বোষ্টম আর জলধর। কে একজন তিরবেগে কী যেন কী বলতে বলতে ছুটে আসছে আলপথ বেয়ে। বার দুই আছাড়ও খেল লোকটা। তারপর অতিকষ্টে হাঁটু-কোমরে হাত বুলোতে বুলোতে জলধরকে উদ্দেশ করে বললে, “কত্তাবাবু, আপনার ছেলে পরীক্ষায় পাস করিছে। এতে আমার কত্তাবাবু খুব খুশি হয়েছে। আমারে কয়ে দিলেন আপনাদের বলে দিতি, এ বিয়ে পাকা হল। কালকের বাদ পরশু গিয়ে আমার কত্তাবাবু বিয়ের দিনক্ষণ পাকা করি আসপেন। এখন শুধু নস্যির কৌটো ফেরত দিতি বলিছেন। ওনার একদণ্ড নস্যি ছাড়া চলে না কিনা, তাই...”
ছবি - সুজাতা ব্যানার্জী
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী