ছোটো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
ছোটো গল্প
অংশু পাণিগ্রাহী
কলকাতার উপকণ্ঠে একটা সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে আমি শিক্ষকতা করি। পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসেছি। গ্রামের নাম তেঁতুলতলা। প্রত্যন্ত গ্রাম। কলকাতা থেকে দুটো ট্রেন বদলে অটোয় প্রায় পনেরো কিলোমিটার পথ ঝাঁকুনি খেতে খেতে তেঁতুলতলা আসতে হয়।
গতকাল দীপান্বিতা কালীপুজো ছিল। সেই উপলক্ষ্যে শ্মশানকালীর মন্দিরের চত্বরে সাতদিন ব্যাপী বিরাট জমজমাট মেলা বসেছে। তেঁতুলতলার মেলা খুব বিখ্যাত।
আজ সন্ধের পর মন্দির চত্বরে পৌঁছে দেখলাম যথারীতি লোক ভেঙে পড়েছে। তারস্বরে লাউড স্পিকার বাজছে। শব্দের চোটে কানের পর্দা ফাটার উপক্রম। আমার বুক কাঁপতে শুরু করল। আমাদের এলাকায় এই উৎপাত আগে ছিল না। বিরক্ত হয়ে মন্দিরের পিছনের দিকে চলে গেলাম। একটা ঝাঁকড়া অশ্বত্থগাছের তলায় বসে খানিক স্বস্তি হল। শব্দের দাপট কিছু কম এদিকে। পাশেই শ্মশান। আজকের মূল আকর্ষণ আতসবাজির প্রদর্শনী। সেটা এতক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। হলুদ রঙের জ্বলন্ত বাজিগুলো সোঁ করে উঠে যাচ্ছে মন্দিরের মাথা ছাড়িয়ে; তারপর ফট করে ফেটে গিয়ে রঙবেরঙের আলোর ফুলকি ছড়িয়ে দিচ্ছে কালো আকাশের বুকে। এখানে বসেই বেশ দেখা যাচ্ছে।
তন্ময় হয়ে আতসবাজি পোড়ানো দেখছিলাম; খেয়াল করিনি, কখন যেন একটা প্রাণী এসে আমার হাত পাঁচেক সামনে বসেছে। মেলার আলোর যে সামান্য রেশ এসে পৌঁছচ্ছিল, তাতে মনে হল প্রাণীটা কুকুরজাতীয়। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বাললাম। কুকুর নয়, বেশ বড়ো সাইজের একটা শিয়াল। জ্বলজ্বলে চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে আমারই দিকে। নিশ্বাস ফেলছে ফোঁস ফোঁস করে। গা শিরশির করে উঠল। একটা ইটের টুকরো তুলে ছুড়ে মারার ভঙ্গি করলাম। কাজ হল না। অনড় হয়ে বসে রইল শিয়ালটা।
শিয়াল আমি ছোটবেলা থেকেই ভয় পাই। ভয় পাওয়ার সঙ্গত কারণ রয়েছে। ঠাকুরদাকে পাগলা শিয়ালে কামড়েছিল। জলাতঙ্কে ভুগে মারা যান ঠাকুরদা। বাবাও শিয়ালের কামড় খেয়েছে। অ্যান্টি-রেবিস ইঞ্জেকশন নিতে হয়েছিল চোদ্দটা। তবে শেষ বয়সে পাগল হয়ে যায়। প্রায়ই বলত, পাঁচটা শিয়াল ঘিরে ধরছে। দাঁত বের করে এগিয়ে আসছে। রক্ত চুষে খেতে চায়—ছোটবেলা থেকে এসব দেখেশুনে শিয়াল-ভীতিটা রক্তে চারিয়ে গেছে আমার।
এখন শিয়ালটার আচরণ দেখে ইটের টুকরো নামিয়ে রাখলাম। গতিক সুবিধের নয়। ক্ষেপে গিয়ে আক্রমণ করে যদি? তাড়াতাড়ি শ্মশানভূমি ত্যাগ করে মন্দির-মেলা ছাড়িয়ে বড়ো রাস্তায় এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
কালই অমাবস্যা গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। মাঝে-মধ্যে রাস্তার পাশে টুনি বাল্ব সজ্জিত বাড়িঘর পড়ছে। আকাশে হলুদ আলোকবিন্দু হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে ফানুস।
মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বেলে হাঁটছিলাম, আচমকা একটা লোক যেন রাস্তা ফুঁড়েই পথ আটকে দাঁড়াল। মুখে গ্যালগ্যালে হাসি। হাত দুটো জড়ো করে বিনয়ের অবতার হয়ে সে বলল, “আপনার শিয়ালে খুব ভয়। তাই না?”
আমি লোকটাকে পাশ কাটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, “আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না!”
“তাতে কী? ধীরে ধীরে চেনা-পরিচয় হবে। অত তাড়াহুড়োর কী আছে?”
উত্তর না দিয়ে এগিয়ে চললাম। লোকটা পাশ থেকে আবার বলল, “আসল কথাটা হল, আপনার শিয়াল-ভীতি আমি দূর করে দেব। ভালো চিকিৎসা জানি।”
আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। লোকটার চোখ দুটো ধকধক করে জ্বলছে। গায়ে কেমন একটা বদখত গন্ধ। পোষা কুকুরকে দীর্ঘদিন স্নান না করিয়ে রাখলে এমন গন্ধ বের হয়।
“তার প্রয়োজন নেই। আপনি আসতে পারেন।” বললাম আমি।
“আহা, পুরো কথাটা শুনুন আগে। আপনার ঠাকুরদাকে কেন পাগলা শিয়ালে কামড়েছিল জানেন? তারপর আপনার বাবার কথাটাই ধরুন...”
“আপনি কে বলুন তো? এ-গাঁয়ে আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আমার চোদ্দপুরুষের ইতিহাস জেনে বসে আছেন দেখছি।” একটু অবাক হয়ে বললাম।
“হ্যাঁ, তা একটু জানি।” কাঁধের ঝোলা সামলে খ্যাক খ্যাক করে হাসল সে।
বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম। কাঠের গেটটা খুলে চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে বললাম, “ওষুধপত্র লাগবে না।”
“লাগবে ঠিকই। আমি আবার আসব।” বলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সে।
ধান্দাবাজ লোক। ভুজুং ভাজুং দিয়ে সম্ভবত টোটকা ওষুধ বিক্রি করার তালে ছিল। কীভাবে যেন আমার ঠিকুজি-কোষ্ঠী জোগাড় করেছে। আজকাল কতরকমের লোক ঠকানো কারবার যে হয়েছে!
পরদিন বিকেলে চায়ের কাপ হাতে পুকুর-ঘাটায় বসে ছিলাম। পুজোর ছুটির আর চারদিন আছে।
আমার পরিবার বলতে দাদা, বউদি আর ভাইপো বিল্টু। সাধারণত ছুটিতে বাড়ি এলে বিল্টু আমার সঙ্গ ছাড়ে না। তবে এবার মাধ্যমিক দেবে। পুজোর ছুটি খুললেই স্কুলে মাধ্যমিকের মহড়া। টেস্ট পরীক্ষা। তাই সে পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত।
চা শেষ করে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। পুকুরের জল ছুঁয়ে একটা ঠান্ডা হাওয়া আসছিল। কালীপুজো পড়তে না পড়তেই এইসব গ্রাম্য এলাকার বাতাসে শীতের শিরশিরানিটা বেশ টের পাওয়া যায়। রাতে পাখা চালাতে হয় না, বরং ভোরের দিকে হালকা চাদর গায়ে দিলে আরাম বোধ হয়। পুকুরের ও-পাড়ে কুয়াশা জমছে, ধীরে ধীরে আবছা হয়ে আসছে দৃশ্যপট। সন্ধে নামছে।
উঠতে যাব, চোখ গেল বামদিকের বড়ো নিমগাছটার গোড়ায়। সেখানে বুনো কুলের ঝোপের পাশে বড়ো একটা গর্ত। গতকাল চোখে পড়েনি। সম্ভবত আজই হয়েছে। কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বুঝলাম, এ শিয়ালের গর্ত ছাড়া কিছুই হতে পারে না। গর্তটা যে কতদূর চলে গেছে ঠাহর করা যায় না। ছেলেবেলায় এ-জিনিস ঢের দেখেছি। আমাদের বাগানে আবার শিয়াল এসে বাসা বাঁধল নাকি!
সন্ধেবেলা নিজের ঘরে বসে কয়েকটা ম্যাগাজিন উলটেপালটে দেখছিলাম। একটা খচমচ শব্দ হতে পুকুরের দিকের জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, কালকের সেই লোকটা ঝোলা কাঁধে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে।
“ভিতরে ডাকবেন না?”
লোকটার কথা শুনে মাথা গরম হয়ে গেল আমার। আচ্ছা নাছোড়বান্দা তো! কড়া গলায় বললাম, “আপনি কি একটু বাড়াবাড়ি করছেন না?”
“ছি ছি! তা কেন? আপনার ভালোর জন্যই তো! বাগানে শিয়ালের গর্ত দেখলেন। চিকিৎসা আপনার লাগবেই।”
লোকটার কথা শুনে চমকে উঠলাম। আমার উপর রীতিমতো নজর রাখছে লোকটা। সামান্য একটা ওষুধ বিক্রির এত গরজ!
“আপনার সঙ্গে যা কথা হওয়ার গতকালই হয়ে গেছে। নতুন করে কিছু বলবার নেই আমার।” বলে লোকটার মুখের উপরেই জানালা বন্ধ করে দিলাম। ব্যবহারটা হয়তো অমার্জিত ও রুক্ষ হল। কিন্তু লোকটাকে আর এক মুহূর্তও সহ্য করতে পারছিলাম না।
“আপনার বাপ-পিতেমো আমাকে এড়াতে পারেননি, আপনি তো সেদিনের ছোকরা! আমি আবার আসব।” বন্ধ জানালার ও-পার থেকে মিহি গলা শোনা গেল।
লোকটার কথাবার্তার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। আমি আবার ম্যাগাজিনে মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। তবে মনের মধ্যে কাঁটার মতো একটা খচখচানি লেগেই রইল। লোকটা বার বার আমার পূর্বপুরুষের প্রসঙ্গ কেন তুলছে? আমি কি এতই আবেগ প্রবণ যে, বাপ-ঠাকুরদার নাম উঠলেই গলে যাব? সত্যিই কি লোকটার উদ্দেশ্য নিছক ওষুধ বিক্রি, নাকি অন্য কিছু? মানসিক ভারসাম্যহীন নয় তো? ম্যাগাজিনে কিছুতেই মন বসল না। উলটোপালটা চিন্তায় বরং তেতে উঠল মাথা।
সেই রাতে কীসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। মোবাইলের ঘড়িতে দেখলাম তিনটে চল্লিশ। উৎকট একটা গন্ধে ভরে গেছে ঘর। খরখর শব্দ হচ্ছে। কে যেন সিমেন্টের মেঝে আঁচড়াচ্ছে। ফ্ল্যাশ জ্বালতেই বুকটা ধক করে উঠল। একটা শিয়াল! সামনের পা দুটো আমার খাটে ঠেকিয়ে দাঁত দিয়ে মশারি কাটবার চেষ্টা করছে।
আমাকে উঠে বসতে দেখেই খাট থেকে নেমে পড়ল শিয়ালটা। লাফ দিয়ে জানালা গলে পালিয়ে গেল। জানালার একটা শিক ভাঙা ছিল। জন্তুটার ঢুকতে-বেরোতে তাই কোনও সমস্যা হয়নি। কাল থেকে জানালাটা বন্ধ করেই শোব। কিন্তু হঠাৎ শিয়ালের উপদ্রব কেন?
আজ বিকেলে পুকুর-ঘাটায় গিয়ে দেখলাম গর্তের সংখ্যা বেড়ে পাঁচ হয়েছে। এতগুলো গর্ত দেখে শিয়াল-ভীতিটা কেমন যেন মিলিয়ে গিয়ে দুর্দমনীয় একটা ক্রোধ জেগে উঠল আমার মধ্যে। এ-জিনিস চলতে দেওয়া যায় না। দৌড়ে গিয়ে ভাঙাচোরা জিনিস রাখার ঘর থেকে কোদাল এনে একে একে গর্তগুলো বুজিয়ে ফেললাম। যাক, এবার নিশ্চিন্তি।
ঘাম মুছে পুকুর-ঘাটায় এসে বসেছি, পিছনে ধুপ করে একটা শব্দ হল। মাথা ঘুরিয়ে দেখি, গর্তগুলো আবার তৈরি হচ্ছে। ঝুরঝুর করে ধসে পড়ছে মাটি। গর্তের ভিতর থেকে কেউ যেন চোঁ-চোঁ করে মাটি টেনে নিচ্ছে। আমার মাথায় রোখ চেপে গেল। আমি আবার লেগে পড়লাম কাজে।
কতক্ষণ এরকম চলল জানি না। সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকারের চাদরে মুড়ে গেছে চরাচর। শরীরও ভেঙে পড়তে চাইছে। কায়িক শ্রমের অভ্যাস নেই। কোদাল ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে দেখলাম যাবতীয় পরিশ্রম বিফলে গেছে। আমি যতবার গর্ত বুজিয়েছি, ততবারই পাশে নতুন গর্ত গজিয়ে উঠেছে। এই প্রথম আমার গায়ে কাঁটা দিল। কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না। ঠান্ডা মাথায় বসে সবটা ভাবা দরকার।
রাতে ঘুমনোর আগে জানালা-দরজা বন্ধ করে খিল এঁটে দিলাম। শুয়ে শুয়ে গর্তের ঘটনাটার একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খাড়া করার চেষ্টা করছিলাম। ঘুম ভাঙল তীব্র যন্ত্রণাময় একটা অনুভূতিতে। ফ্ল্যাশ জ্বেলে দেখি ডানপায়ের পাতাটা রক্তে ভিজে গেছে। ঘরের মধ্যে সেই বদখত গন্ধটা। পুকুরের দিকের জানালাটা কীভাবে যেন খুলে গেছে। ভোর হচ্ছে। পাখিরা ডাকাডাকি শুরু করেছে।
আমি টলতে টলতে গিয়ে দাদা-বউদির ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলাম। দাদা ঘুমজড়ানো চোখে বেরিয়ে এসে আমার অবস্থা দেখে আঁতকে উঠল। আমি কোনোমতে বললাম, “শিয়াল!”
দাদার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বলল, “এক্ষুনি হাসপাতাল যেতে হবে।”
পাড়ার টোটোতে চেপে যখন হাসপাতাল পৌঁছলাম, রোদ বেশ চড়েছে। ঝিম-ধরা একটা তন্দ্রার ভাব ক্রমশ আচ্ছন্ন করে ফেলছে আমাকে।
আজ শুক্রবার। ছুটির আর দু-দিন বাকি। শিয়ালটা আমার পা যেভাবে চিবিয়েছে, সোমবার স্কুলে জয়েন করতে পারব বলে মনে হয় না। বিকেল থেকে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ছে। এখনও গা-টা বেশ গরম।
দাদা বলছিল, “ঠাকুরদা-বাবার পরে তোকেও কামড়াল? পুরো ব্যাপারটা কাকতালীয় বলছিস?”
এর উত্তর কী হয় আমার জানা নেই। আমাদের বংশের প্রতি শিয়ালের এই আক্রোশ কীসের?
বিল্টু খুব ভয় পেয়েছে। ওর পড়াশোনা মাথায় উঠেছে। এই একটু আগে পর্যন্ত আমার মাথার কাছে বসে ছিল। ঘুম পাচ্ছে বলতে উঠে গেল। যাওয়ার আগে জানালাগুলো ভালো করে এঁটে দিয়ে গেছে। জানালা তো আমিও বন্ধ করেছিলাম আগের রাতে। তবু কীভাবে যে ঢুকল প্রাণীটা!
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম নেমে এল চোখের পাতায়। তবে কিছুতেই ঘুমটা গভীর হল না। ছেঁড়া ছেঁড়া তন্দ্রার মধ্যেই আজেবাজে সব স্বপ্ন দেখছিলাম। নিদ্রা আর জাগরণের মধ্যবর্তী একটা অবস্থায় মনে হল, সেই বিদঘুটে লোকটা আবার জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমি লোকটাকে ঘরের ভিতরে আসতে বললাম। লোকটা এসে বসল আমারই চেয়ারে। আমি খাটে শুয়ে।
আমি বললাম, “কী ব্যাপার বলুন তো! এসব কী ঘটছে? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না।”
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে বলল, “খুব সোজা। বুঝিয়ে দিলেই বুঝবেন।”
“বেশ তো! বলুন।”
“এক সময় এই গ্রামে কত গাছপালা, ঝোপঝাড় ছিল বলুন তো! আপনাদের পুকুরপাড়েই ছোটোখাটো একটা বন ছিল।”
“হ্যাঁ, বাবার মুখে শুনেছি। আমার জন্মের আগে থেকে সব সাফ হতে শুরু করেছে।”
“সেই সঙ্গে শিয়ালগুলোও সাফ হয়ে গেছে। ঝোপঝাড় না পেলে ওরা থাকবে কোথায়?”
আমি চুপ করে রইলাম। লোকটা আবার বলল, “তার উপর আপনার ঠাকুরদা যে কাণ্ডটি করলেন, তা ক্ষমার অযোগ্য। একসঙ্গে পাঁচটা শিয়ালকে পিটিয়ে মেরে ফেললেন একেবারে! তার ভিতর তিনটে আবার সদ্যোজাত শিশু। শাস্তি পেলেন তাই। শাস্তিটা আমিই দিলাম।”
“পাগলা শেয়াল...”
“ঠিক ধরেছেন। তবে শাস্তির শেষ সেখানেই নয়। আপনার ঠাকুরদার কৃতকর্মের ফল আপনার বাবাও পেয়েছেন। পাগল হয়ে গেলেন মানুষটা। শেষদিকে কী বলতেন মনে আছে?”
“হ্যাঁ, পাঁচটা শিয়াল রক্ত খেতে আসছে।” কথাটা বলতেই মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাল। এক লহমায় পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আবার বললাম, “আমিও কি সেই শাস্তির অংশ ভোগ করছি?”
“ঠিক ধরেছেন। তবে আপনি মরবেন না, পাগলও হবে না। তার জন্যই চিকিৎসা। উপরি পাওনা হিসেবে শিয়াল-ভীতিটা কেটে যাবে। তবে সম্পূর্ণ ছাড়ও পাবেন না। আপনার শাস্তি আলাদা। ধীরে ধীরে নিজেই বুঝবেন।”
“বেশ। কিন্তু আপনি কে? আপনাকে দেখে মনে হয় বয়স চল্লিশের বেশি নয়। কিন্তু ঠাকুরদাকে শাস্তি দিয়েছেন... ঠিক বুঝলাম না।”
“অত কথা জেনে আপনার কাজ নেই। তবে কয়েকটা তথ্য দেওয়া যেতেই পারে। এই যেমন ধরুন, আমার কিছু ক্ষমতা আছে। আমি শিয়ালের ভাষা বুঝতে পারি। ওরাও আমার কথা শোনে। আমার লক্ষ্য শিয়ালদের রক্ষা করা আর...” লোকটা থেমে গেল। জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
“কী হল, বলুন!” বললাম আমি।
“শিয়ালের সংখ্যা বাড়ানো।”
খ্যাক খ্যাক করে হাসল লোকটা। তারপর ঝোলা থেকে একটা শিশি বের করে আমার নাকে চেপে ধরল। মিষ্টি অথচ ঝাঁঝালো গন্ধে আমার মস্তিষ্কটা কিছুক্ষণের জন্য অবশ হয়ে গেল। লোকটা এই ফাঁকে আমার উপর ঝুঁকে পড়ে কীসব যেন প্রক্রিয়া করতে লাগল। একসময় বলল, “অপারেশন সাকসেসফুল। আপনি এবার ঘুমোন, আমি চলি।” তারপর যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
হঠাৎই আমার গা-টা গুলিয়ে উঠল। সেই সঙ্গে তীব্র বেদনা। হাড়গোড় সব ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে যেন। শরীরে কী একটা পরিবর্তন হচ্ছে! আকারে ছোটো হয়ে যাচ্ছি আমি। নখগুলো বেঁকে যাচ্ছে। ক্যানাইন দাঁত চারটে ঠোঁট পেরিয়ে বেরিয়ে আসছে বাইরে। পিঠের শেষে কক্সিস অঞ্চলে অমানুষিক কষ্ট। কিছু একটা বেরোতে চাইছে শরীর ফুঁড়ে। একটু করে ঝুঁকে পড়ছি আমি। অন্ধকারে দেখতেও কোনও অসুবিধে নেই। কোথায় যেন একপাল শিয়াল ডেকে উঠল। আমার মনে হল ওদের মতো আপনজন আমার আর কেউ নেই। জানালা গলে বাইরে বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে মুখ তুলে আমিও ওদের মতো...
দীর্ঘ ও বীভৎস স্বপ্নটার শেষে ঘুম ভাঙতে চোখ মেলে দেখি, বাইরে বেশ রোদ। তবে সকালের রোদ নয়। পুকুরটা আমার ঘরের পশ্চিমে। সেইদিকের জানালা গলে হলদেটে রোদ এসে পড়ছে চোখে-মুখে। দেয়াল ঘড়ি দেখাচ্ছে চারটে দশ। বাপ রে, এতক্ষণ ঘুমিয়েছি আমি! প্রায় সতেরো ঘণ্টা! একটানা! মোবাইল ফোন অফ করা ছিল। সেটা অন করে দেখলাম, আজ ৩১ অক্টোবর, মঙ্গলবার। ২৮ তারিখ, শনিবার নয়।
বিছানা ছাড়তেই শরীরটা ঝনঝন করে উঠল। সারা গায়ে ব্যথা। হাঁটবার শক্তি নেই। বিল্টুর নাম ধরে বার কয়েক ডাকতেই সে প্রায় দৌড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল। আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, “ঠিক করে বল তো আমি ক’দিন ঘুমিয়েছি?”
বিল্টু বলল, “কাকামণি, তুমি শনিবার সকাল থেকে মিসিং ছিলে। পুলিশ অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। কিছু পায়নি। শেষে আজ ভোরবেলা আমরাই তোমাকে পেয়েছি। এই ঘরেই। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিলে মেঝেতে। কাকামণি, কোথায় ছিলে এই তিনদিন?”
বিল্টুর কথাগুলো আমার মাথায় যেন হাতুড়ির বাড়ি মারল। মাথা জুড়ে তীব্র একটা যন্ত্রণার ঘূর্ণি পাকিয়ে উঠছে। আবার জ্ঞান হারালাম আমি।
ছবি - পুণ্ডরীক গুপ্ত
আমরা ভারতবাসী কাব্য-মহাকাব্য লিখেছি। লিখেছি পুরাণের নামে কিছু অলীক গল্পকথা। কিন্তু ইতিহাস লিখতে শিখিনি। তার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করিনি। তাই ঐশ্বর্যময় গরিমা সত্ত্বেও আমরা আমাদের উত্তরসূরিদের জন্য কিছুই রেখে যাইনি।
গিরিব্রজসিংহ এমনই এক অকথিত ঐতিহাসিক উপাখ্যান।
বহু কলমের গল্পে, প্রবন্ধে, সত্যি ঘটনায়, তথ্যে, গ্রাফিক নভেলে প্রাইমেটদের হাজারো কাণ্ড।
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী