ছোটো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
ছোটো গল্প
সায়ন্তনী পলমল ঘোষ
দেবনগর রাজ্যটি ভারি সুন্দর। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা। রাজা সূর্যদেবের সুশাসনে প্রজারা নিশ্চিন্তে দিনযাপন করে। সূর্যদেবের দুই পুত্র, আয়ুষ্মান আর ঋদ্ধিমান—একটি কন্যা, বৃষ্টিলেখা।
রাজপুত্ররা আর রাজকন্যা সবাই বড়ো হয়েছে। রাজপুত্র দুইজন শাস্ত্রশিক্ষা আর অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করেছে। রাজকন্যা বৃষ্টিলেখা আবার নিজের ইচ্ছায় বিগত কয়েক বছর যাবৎ গুরু সিদ্ধাচার্যের আশ্রমে থেকে শাস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করছে। মহারাজ সূর্যদেব যথেষ্ট শক্তসামর্থ্য আছেন, কিন্তু তবুও তিনি এবার তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন করে নিতে চান। দুই রাজপুত্রের মধ্যে কে পরবর্তী রাজা হওয়ার যোগ্য বিচার করে দেখতে হবে। দুজনেই ভালো যোদ্ধা, কিন্তু যার মধ্যে রাজা হওয়ার সমস্ত গুণ আছে, সেই হবে পরবর্তী রাজা। রাজা সূর্যদেব অনেক চিন্তাভাবনা করলেন। তারপর তাঁর মাথায় একটি বুদ্ধি এল। একবার গুরুদেব সিদ্ধাচার্যের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে হবে।
রাজা সূর্যদেবের জন্মদিনের উৎসব চলছে। রাজসভায় সবাই উপস্থিত। এমন সময় রাজা বললেন, “আমি আজ একটি বিশেষ ঘোষণা করতে চাই।”
সবাই উৎসুক হয়ে উঠল।
“অনেকেই জানেন সুদূর মায়ানগরীর এক গুহায় আছে মুরগির ডিমের মতো বড়ো জোনাকজ্বলা হিরে। সেই হিরের ভেতরে জোনাকির আলোর মতো আলো জ্বলতে থাকে। আমার ইচ্ছা, সেই হীরা দেবনগরের রাজমুকুটে শোভা পাক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেই হীরা আনবে কে? মায়ানগরীর পথে পদে পদে বিপদ।”
রাজার কথা শোনামাত্র দুই রাজকুমার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি যাব।” “আমি যাব।”
রাজা শুনে ভীষণ খুশি হলেন। রাজকুমারদের কাছ থেকে এই উত্তরই আশা করেছিলেন তিনি।
সূর্যদেব এবার বললেন, “ঠিক আছে। তোমাদের মধ্যে যে আমাকে ওই হিরে এনে দিতে পারবে, সে-ই হবে এই রাজ্যের ভাবী রাজা। তোমরা যাত্রার আয়োজন করো।”
রাজার এই কথায় সবাই সমর্থন জানাল। রাজসভায় বেশ একটা খুশির পরিবেশ। এমন সময় হঠাৎ একটি ছেলে প্রবেশ করল।—“প্রণাম, মহারাজ।”
“তুমি কে? কী চাও?”
“মহারাজ, আমার নাম অগ্নি। আমিও আপনার জন্য জোনাকজ্বলা হিরে আনতে চাই।” দৃপ্ত কণ্ঠে বলল ছেলেটি।
“সে তো রাজকুমাররা যাবে।”
“মহারাজ, আপনি বলেছেন ওই হীরা দেবনগরের রাজমুকুটে শোভা পাবে। রাজমুকুট কি শুধুই রাজার? প্রজাদের নয়? প্রজারা ছাড়া রাজ্য তো সম্পূর্ণ হয় না মহারাজ।”
অগ্নির কথাবার্তায় মুগ্ধ হলেন মহারাজ। তবুও সন্দেহের বশে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি বলেছি, যে রাজকুমার হিরে আনতে পারবে সে-ই হবে ভাবী রাজা। তুমিও কি সিংহাসনের লোভে…”
কথা শেষ হল না মহারাজের। অগ্নি বলে উঠল, “না আছে আমার সিংহাসনের লোভ, না আছে আমার অর্থের পিপাসা, আমি শুধু একজন বীরযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে চাই। আর চাই জোনাকজ্বলা হিরের মতো শুভ জিনিস আমার মাতৃভূমি দেবনগরে আসুক।”
“আচ্ছা, তবে তাই হোক। তোমাকেও সুযোগ দেওয়া হল এই অভিযানের।”
এমন সময় মহামন্ত্রী সুনক উঠে দাঁড়ালেন।—“মহারাজ, আমার একটি বক্তব্য আছে।”
“বলুন মন্ত্রীমহোদয়।”
“আমার মতে রাজকুমারদের আগে সুযোগ পাওয়া উচিত যেহেতু এটা সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নির্বাচনের প্রশ্ন। রাজকুমাররা এক পক্ষকালের মধ্যে ফিরে না এলে তারপর এই ছেলেটি যাত্রা করুক।”
মন্ত্রীর পরামর্শ মনে ধরল মহারাজের।—“আপনি যথার্থ বলেছেন মন্ত্রীমশাই।”
অগ্নি শুনে বলল, “ঠিক আছে মহারাজ, আমি এক পক্ষকাল পরে ফিরে আসব।”
***
পনেরো দিন কেটে গেল রাজকুমাররা কেউ ফিরে এল না। মহারাজের অনুমতি নিয়ে অগ্নি বেরিয়ে পড়ল জোনাকজ্বলা হিরের সন্ধানে।
ঘোড়া ছুটিয়ে এক জঙ্গলের কাছে এল অগ্নি। এই জঙ্গলে থাকত মহা-রাক্ষস তাণ্ডব। তাকে দুই রাজকুমার মিলে হত্যা করেছে, তাই এখন তার বোন মহা-রাক্ষসী তাণ্ডবী দাদার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাগে ফুঁসছে। কোনও মানুষ ধারেকাছে এলেই খেয়ে ফেলছে তাকে। অগ্নি জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করতেই তাণ্ডবী হুংকার ছাড়তে ছাড়তে এসে হাজির। অগ্নিও তৈরি ছিল তির-ধনুক নিয়ে। তাণ্ডবীর নাভিতে আঘাত করতে পারলে তবেই তাণ্ডবীর মৃত্যু হবে। তাণ্ডবী তো প্রচণ্ড বেগে এগিয়ে আসছে অগ্নির দিকে। কিন্তু তার মধ্যেই লক্ষ্য স্থির রেখে তাণ্ডবীর নাভি লক্ষ্য করে তিরচালনা করল অগ্নি। অব্যর্থ তার লক্ষ্য। তির গিয়ে আঘাত করল তাণ্ডবীর নাভিতে আর প্রকাণ্ড শরীরটা নিয়ে তাণ্ডবী ভূপতিত হল।
তাণ্ডবীকে শেষ করে এগিয়ে চলল অগ্নি। পাহাড়, জঙ্গল পেরিয়ে এসে পৌঁছল দেড় হাত মানুষদের গ্রামে। একটানা ঘোড়া ছুটিয়েছে সে, এবার একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। দেড় হাত মানুষদের গ্রামের মোড়ল হল হিরণ। তাদের বাড়িগুলোর তো উচ্চতা কম, তাই সে একটা গাছের তলায় অগ্নির বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিল। অগ্নির জন্য ফলমূল, ছাগলের দুধ নিয়ে এল হিরণ। অগ্নির খাওয়া হতেই হিরণ অগ্নির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়াল।
“অতিথি, আপনাকে দেখে বীরযোদ্ধা মনে হচ্ছে। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। এর আগে দুজন অতিথি এসেছিলেন। তাঁরা কোনও এক রাজ্যের রাজকুমার। তাঁদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলাম, কিন্তু তাঁরাও আপনার মতো জোনাকজ্বলা হিরে আনতে যাচ্ছেন, তাই বললেন তাঁদের সময় নেই। দয়া করে আপনি সাহায্য করুন।”
অগ্নি বুঝতে পারল, হিরণ দেবনগরের রাজকুমারদের কথা বলছে। সে হিরণকে বলল, “আপনার কী সাহায্য প্রয়োজন সেটা আমাকে বলুন। না-হলে কীভাবে সাহায্য করব?”
“শলিক নামে এক আট হাত লম্বা মানুষ আছে। সে একজন দস্যু। সে প্রায়শ আমাদের গ্রামে এসে লুঠতরাজ করে, কিন্তু অত লম্বা মানুষের সঙ্গে আমরা পেরে উঠি না। খুব অত্যাচার করে আমাদের ওপর। আমাদের ওর হাত থেকে বাঁচান অতিথি!”
অগ্নি সব শুনে বলল, “আমি অবশ্যই আপনাদের সাহায্য করব। আমি কথা দিলাম, শলিককে হত্যা করে তবে আমি এই গ্রাম ছেড়ে যাব।”
“অনেক ধন্যবাদ অতিথি।”
অগ্নিকে বেশি অপেক্ষা করতে হল না। একদিন পরেই শলিক গ্রাম লুঠ করতে এল।
অগ্নি আগে থেকেই প্রয়োজনমতো একটা রণপা তৈরি করে রেখেছিল। সেই রণপা পরে সেও শলিকের মতো উচ্চতার হয়ে গেল। শলিক আক্রমণ করতেই অগ্নি বাধা দিল। শুরু হল দুই যোদ্ধার তরোয়ালের লড়াই। শলিকও নিপুণ যোদ্ধা, কিন্তু অগ্নিও কম যায় না। তুমুল লড়াই করার পর একসময় অগ্নি শলিকের বুকে তরোয়াল বিদ্ধ করল। শলিকের অত্যাচারের অবসান ঘটতেই পুরো গ্রাম আনন্দে মেতে উঠল। কিন্তু অগ্নির হাতে সময় নেই, তাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। সে বিদায় নিতে গেল হিরণের কাছে।
“বিদায় বন্ধু।”
“অতিথি, আপনার উপকার আমরা কোনোদিন ভুলব না। আপনাকে একটা ছোট্ট উপহার দিতে চাই। দয়া করে নিতে হবে।”
“অবশ্যই নেব বন্ধু।”
হিরণ তার ছোট্ট কুঁড়েঘরে ঢুকে গেল। বেরিয়ে এল হাতে একটা চৌকো কাচের খণ্ড নিয়ে। অগ্নির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা জাদু কাচ। আমার ঠাকুরদা বানিয়েছিলেন। যা তুমি খালি চোখে দেখতে পাবে না, এই কাচের মধ্য দিয়ে দেখতে পাবে।”
“অসংখ্য ধন্যবাদ বন্ধু।”
অগ্নি আবার এগিয়ে চলে। এবার সে এসে পৌঁছায় তুষার-ঢাকা এক বিশাল প্রান্তরে। অগ্নি অবাক হয়ে দেখে, সেই প্রান্তরে বেশ কিছু বরফের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়াটা এক জায়গায় বেঁধে অগ্নি এগিয়ে চলে। একটু যাওয়ার পর এক জায়গায় এক বৃদ্ধ মানুষকে বসে থাকতে দেখে। মানুষটি যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে বসে আছে। অগ্নি তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে বলে, “আমি আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি?”
“আমার পায়ে ঘা হয়েছে। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।”
“দেখি আপনার পা।”
অগ্নি দেখল বৃদ্ধের পায়ে দগদগে ঘা।
“আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি।”
অগ্নির কাছে কিছু মলম, গাছের শিকড় ছিল। সে বৃদ্ধের ক্ষত পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে দিল।
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব বাবা?”
“বলো বাছা।”
“এই পাথরের মূর্তিগুলি এখানে কেন বাবা?”
“এই বরফের প্রান্তর পার হওয়া সহজ নয়। ক্ষণে ক্ষণে বরফ-ঝড় শুরু হয় এখানে। তুমি যদি ঝড়ের আগে না ছুটতে পারো তাহলে তুমিও জমে বরফ হয়ে যাবে। এই তো কয়দিন আগে দুই রাজকুমার এল। তারাও বরফের মূর্তি হয়ে গেল।”
অগ্নি চমকে উঠল। বুঝতে পারল কেন রাজকুমাররা ফিরে যায়নি। সে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই মূর্তিদের প্রাণ ফেরানোর কোনও উপায় নেই?”
“আছে।”
“কী সে উপায়?”
“মায়ানগরীর জোনাকজ্বলা হিরের ছটা যদি এদের উপর পড়ে তাহলে এরা সবাই প্রাণ ফিরে পাবে।”
“হিরে আনতে তো এই প্রান্তর পার হতে হবে। বরফ-ঝড়ের আগে ছোটার কোনও সহজ উপায় আছে বাবা?”
বৃদ্ধ হাসল।—“তুমি বড়ো ভালো মানুষ। আমাকে বাবা বলে ডেকেছ। সাহায্য করেছ। তোমাকে সাহায্য তো করতেই হবে। এই যারা বরফের মূর্তি হয়ে গেছে, তারা কেউ আমাকে সাহায্য করেনি। শুধু তোমার মনেই দয়া হল।”
এই বলে বৃদ্ধ নিজের ঝোলা থেকে একজোড়া জুতো বের করে অগ্নিকে দিল।—“এই নাও। এই জুতো পরে বরফের ওপর অনেক দ্রুত ছোটা যায়। তাড়াতাড়ি করো, বরফ-ঝড় ধেয়ে আসছে।”
“বিদায় বাবা।”
জুতো পরে নিয়ে অগ্নি প্রাণপণে দৌড়তে আরম্ভ করল। পেছনে ধেয়ে আসছে তীব্র বরফের ঝড়। দৌড়তে দৌড়তে অগ্নি এক বরফ পাহাড়ের সুড়ঙ্গের সামনে হাজির হল। বরফ-ঝড় প্রায় তার কাছাকাছি চলে এসেছে। সে দ্রুত সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ল। সুড়ঙ্গ পার হতেই সে এক পাথুরে উপত্যকায় হাজির হল। এই উপত্যকা পার হলেই মায়ানগরী। কিন্তু সমস্যা হল, বিশাল এক খাদ পার হতে হবে মায়ানগরীতে পৌঁছানোর জন্য। সেই খাদের উপর পার হওয়ার কোনও উপায় নেই। কোনও এক জায়গায় পার হওয়ার জন্য একটি সেতু আছে বটে, কিন্তু তা অদৃশ্য। সেই সেতু খুঁজে পেলে তবে পার হওয়া যাবে। অগ্নি চিন্তায় পড়ল, এবার কী করবে। হঠাৎ তার মনে পড়ল হিরণের দেওয়া কাচটার কথা। সে কাচটা বের করে চোখের সামনে ধরল। হিরণের কথাই সত্যি। কাচটা চোখের সামনে ধরতেই অগ্নি দেখতে পেল, একটা দড়ি এই প্রান্তের একটা গাছ থেকে খাদের অপর প্রান্তের একটা গাছে বাঁধা আছে। অগ্নি কাচের টুকরোটা রেখে দিয়ে সেই দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল। তারপর অতি সাবধানে সেই অদৃশ্য দড়ি ধরে খাদ পার হতে লাগল। হাত ফসকালেই মৃত্যু অবধারিত। আস্তে আস্তে অগ্নি অপর প্রান্তে পৌঁছে গেল।
মায়ানগরীতে পদে পদে মায়াবী ফাঁদ। অগ্নির খিদে পেয়েছিল। একটা গাছে আপেল ঝুলতে দেখে সে যেমনি তুলতে গেছে অমনি আপেলটা একটা সাপ হয়ে কামড়াতে এল অগ্নিকে। অগ্নি চট করে সরে গিয়ে তরোয়ালের এক কোপে সাপটার মাথা কেটে ফেলল। এবার সামনে এক জঙ্গল। জঙ্গলে প্রবেশ করে এগিয়ে চলল অগ্নি। এই জঙ্গল পার হলেই আছে সেই পাহাড়ি গুহা। একটা ছোট্ট সুন্দর খরগোশ দৌড়ে গেল। অগ্নি খুশি মনে যেই এগোতে গেল অমনি সেই খরগোশ মস্ত বড়ো এক বাঘের রূপ নিয়ে অগ্নিকে আক্রমণ করল। বাঘের সঙ্গে অগ্নির বেশ খানিকক্ষণ লড়াই চলার পর অগ্নি বাঘকে পরাস্ত করল। আবার এগিয়ে চলল সে। খানিক এগোবার পর হঠাৎ করে বনে আগুন লেগে গেল। অগ্নির চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। অগ্নি কয়েক মুহূর্ত ভাবল। এখানে যা দেখা যাচ্ছে তা পরমুহূর্তেই বদলে যাচ্ছে। অগ্নি সাহস করে সেই আগুনে প্রবেশ করল। কোথায় আগুন! অগ্নি আগুনে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আগুন উধাও। চারদিক স্বাভাবিক। মনের আনন্দে জঙ্গল পার করে সেই পাহাড়ি গুহার কাছে পৌঁছল অগ্নি।
গুহার মুখে এক লোহার দরজা। জাদু দিয়ে বন্ধ এই দরজা। দরজায় তিনটি ফুটো আছে। তির ছুড়ে একসঙ্গে তিনটি ফুটোয় তির ঢোকাতে পারলে তবেই খুলবে দরজা। অগ্নি একসঙ্গে তিনটি তির নিল ধনুকে। চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরকে স্মরণ করল, তারপর তির ছুড়ে দিল। অব্যর্থ তার লক্ষ্য। ঘড়ঘড় শব্দ করে দরজা খুলে গেল।
গুহার ভেতরে প্রবেশ করল অগ্নি। কিছুদূর যাওয়ার পর সে মুগ্ধ হয়ে দেখল, একটি সোনার স্তম্ভের ওপর রাখা আছে একটি মুরগির ডিমের আকারের হিরে আর সেই হিরের দ্যুতি এমনই যে মনে হচ্ছে শত সহস্র জোনাকি উড়ে বেড়াচ্ছে গুহার মধ্যে। অগ্নি এগিয়ে গেল। স্তম্ভ থেকে হাতে তুলে নিল জোনাকজ্বলা হিরে। তারপর ফেরার পথ ধরল সে। জোনাকজ্বলা হিরে সঙ্গে ছিল বলে পথের মধ্যে আর কোনও বিপদ হল না তার। সে একসময় এসে পৌঁছল সেই বরফ-ঢাকা প্রান্তরে। সেই বৃদ্ধ তখনও সেখানে বসে ছিল।
“বাবা, আমি জোনাকজ্বলা হিরে এনেছি।”
“জানতাম তুমি পারবে। তুমি শুধু বীর নও, তুমি একজন দয়ালু মনের মানুষও। তোমার মতো মানুষদের সঙ্গে সবার আশীর্বাদ থাকে।”
“বাবা, এবার এই বরফের মূর্তিদের প্রাণ ফেরাই।”
“অবশ্যই।”
অগ্নি জোনাকজ্বলা হিরে বের করে সূর্যের আলোর সামনে ধরতেই চারদিক আলোর ছটায় ভরে উঠল আর মূর্তিগুলোর বরফ গলে সবাই প্রাণ ফিরে পেতে আরম্ভ করল।
“বাবা, সব মূর্তি প্রাণ ফিরে পেলেই আমি আবার যাত্রা শুরু করব। আপনি ওই রাজকুমার দুজনকে বলে দেবেন যে অগ্নি হিরে নিয়ে দেবনগরে ফিরে গেছে। তারাও যেন ফিরে যায়।”
সব মূর্তির প্রাণ ফিরতেই অগ্নি তার বেঁধে রাখা ঘোড়া খুলে নিয়ে লাগাম ছোটাল দেবনগরের উদ্দেশে।
***
দেবনগরের রাজসভায় সবাই খুব চিন্তিত মুখে বসে আছেন। রাজকুমারদের কোনও খবর নেই। মহামন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন।—“মহারাজ, আমার মনে হয় আর অপেক্ষা নয়, এবার সেনাপতিমশাই কিছু সৈন্য নিয়ে রাজকুমারদের খোঁজে যাত্রা করুন।”
“আমারও তাই মত।” সেনাপতি বললেন।
“চিন্তা করবেন না। রাজকুমাররা শীঘ্রই ফিরে আসবেন।”
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, অগ্নি প্রবেশ করছে।
“তুমি রাজকুমারদের দেখা পেয়েছ?” মহারাজ উৎকণ্ঠিত।
“হ্যাঁ, মহারাজ। ওঁরা ফিরে আসছেন।”
এই বলে অগ্নি একবার সবার মুখের দিকে তাকাল। তারপর জোনাকজ্বলা হিরে বের করতেই সারা সভাকক্ষ আলোকিত হয়ে উঠল। সবাই বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে গেল। অগ্নি এগিয়ে গিয়ে মহারাজের হাতে তুলে দিল হিরেটি।
গোটা সভাকক্ষ অগ্নির নামে জয়ধ্বনি করতে লাগল। গুরু সিদ্ধাচার্য সভাতে উপস্থিত ছিলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমার অভিযানের বর্ণনা শুনতে আমি আগ্রহী।”
“যথা আজ্ঞা গুরুদেব।”
অগ্নি তার অভিযানের বর্ণনা দেয়। শুনে সবাই চমৎকৃত। ইতিমধ্যে রাজকুমারাও এসে পৌঁছে গেছে। সভার মধ্যে আবার অগ্নির নামে জয়ধ্বনি উঠল।
মহারাজ বললেন, “সত্যিই তুমি বীরযোদ্ধা। তুমি যদি আমার পুত্র হতে, আমি খুব খুশি হতাম। এখন বলো তুমি কী পুরস্কার চাও।”
অগ্নির মুখে হাসি। হাসি গুরুদেবের মুখেও। অগ্নি বলল, “আমার কোনও পুরস্কার চাই না মহারাজ। আমি যা প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম, আশা করি তা প্রমাণ করতে পেরেছি।”
সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখল, অগ্নি তার মাথার পাগড়ি খুলে ফেলল আর সঙ্গে সঙ্গে লম্বা কেশরাশি তার পিঠ ছাপিয়ে গেল। নাকের নীচ থেকে নকল গোঁফ খুলে ফেলল সে।
“রাজকুমারী বৃষ্টিলেখা!”
“হ্যাঁ পিতা, আমি। অপরাধ নেবেন না। আজ থেকে কয়েক বছর আগে যখন আমি আমার দাদাদের সঙ্গে অস্ত্রশিক্ষা করতে চেয়েছিলাম তখন আপনি বাধা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, অস্ত্রশিক্ষা ছেলেদের কাজ। মেয়েরা দুর্বল। অস্ত্রশিক্ষা তাদের জন্য নয়। মেয়েদের স্থান অন্দরমহলে। আমি মানতে পারিনি, তাই গুরুদেবের আশ্রমে গিয়ে শাস্ত্রশিক্ষার পাশাপাশি অস্ত্রশিক্ষাও গ্রহণ করেছি। গুরুদেব বিশেষভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন। মেয়েরা যে দুর্বল নয়, তারাও ছেলেদের সমান বা কখনো-বা ছেলেদের ছাপিয়ে যেতে পারি, আশা করি আজ আমি প্রমাণ করতে পেরেছি।”
গুরুদেব বলে উঠলেন, “মহারাজ, রাজকুমারী অস্ত্র এবং শাস্ত্রশিক্ষা উভয়েই অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছে। তার শেখার আগ্রহ, একাগ্রতা প্রশংসনীয়। শুধু তাই নয়, আপনার কন্যাটির হৃদয়ও বিশাল। তার মতো দয়ালু, বিচক্ষণ মনের মানুষ খুব কম পাওয়া যায়।”
মহারাজের চোখে জল।—“রাজকুমারী, আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।”
“এমন বলবেন না পিতা।”
মহারাজ উঠে এসে বৃষ্টিলেখাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, “তুমিই আমার জোনাকজ্বলা হিরে। এই হিরে তোমার মুকুটেই শোভা পাবে। আমার যোগ্য উত্তরসূরি হল আমার কন্যা বৃষ্টিলেখা। তার হাতেই আমি আমার রাজ্যের ভার অর্পণ করব।”
গোটা সভা বলে উঠল, “জয়, রাজকুমারী বৃষ্টিলেখার জয়।”
ছবি - সায়ন্তনী পলমল ঘোষ
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী