ছোটো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
ছোটো গল্প
এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল
প্রতিবছর এই সময়টার অপেক্ষায় থাকে অভি আর নীলু। পূজার ছুটি মানেই মামার বাড়ি। আর মামার বাড়ি মানেই সবুজ খেলার মাঠ, শাপলা বিল আর মাথার উপর আস্ত একটা ঝকঝকে নীল আকাশ এবং অবাধ স্বাধীনতা। ওদের শহরে এগুলো ডুমুরের ফুল। এখানে সারাদিন টো টো করে মাঠে-ঘাটে চরে বেড়ালেও বকে না কেউ। শাপলা বিলে দুখের নৌকায় চড়ে বসলেও খোঁজ রাখে না কেউ। তখন বিলের বুক জুড়ে শালুক বনে থরে থরে ফুটে থাকা লাল শালুকের মাঝখান দিয়ে লগি ঠেলে ঠেলে ডিঙি নৌকাখানা এগিয়ে নিয়ে চলে দুখে। দুখের বাবা হরেনকাকা অভি-নীলুদের মামার বাড়িতে মুনিশ খাটে। দুখের বোন মরিকেও সঙ্গে নেয় ওরা। সে ডাঁটিসুদ্ধু শালুক ফুল দিয়ে মুকুট বানিয়ে দেয়। মরি মুকুটকে বলে মুটুক। নীলু খিলখিলিয়ে হাসে।
অভি ক্লাস নাইনে পড়ে। সে জানে এরকম রিকশাকে রিশকা, বাক্সকে বাস্ক, বাতাসাকে বাসাতা উচ্চারণ করে কেউ কেউ। বাংলা ব্যাকরণে একেই বলে বর্ণ বিপর্যয়।
অভি আর নীলু মুকুট মাথায় পরে নৌকার বসে থাকে গ্যাঁট হয়ে। নিজেদের তখন রূপকথার রাজপুত্র মনে হয়। ওরা ভেসে চলে বিলের জলে। আর মাথার উপর ভেসে থাকে দু-এক কুঁচি সাদা তুলোর মতো মেঘের টুকরো।
তবে এত কিছু ভালোর মধ্যেও একটা কটু গন্ধ বড়ো খারাপ লাগে। এই সময় বিলের জলে পাটগাছের কাণ্ড পচিয়ে পাট তন্তু তৈরি করা হয়। সেই পাট পচা গন্ধে ভারী হয়ে থাকে শরতের বাতাস।
তবে মামার বাড়ির এহেন সব আকর্ষণগুলোর মধ্যমণি হলেন মণিদাদু আর মণিদাদুর নানান ইন্টারেস্টিং গল্প। মণিদাদু আসলে অভি-নীলুর মায়ের ছোটো কাকা। যাযাবর টাইপের মানুষ। বাড়িতে একেবারে থিতু হতে পারেন না। সারাবছর নানান দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ান। তবে পূজার ঠিক আগে আগেই ফিরে আসেন প্রতিবছর। আর ঝোলা-ভরতি সেইসব দেশের গল্প কাহিনির ভাগ পায় অভি-নীলুদের দল। মানে বাড়ির ছোটোরা।
মামার বাড়ির দোতলার ঢালাও ছাদের উপর একটাই মাত্র ঘর। সেটি মণিদাদুর। সবাই বলে টংঘর। মণিদাদুর দেওয়াল-জোড়া কাঠের শো-কেসে সাজানো থাকে নানান জিনিস। বছর বছর সংখ্যায় বাড়ে তারা। নতুন দেশভ্রমণের সঙ্গে নতুন নতুন সংগ্রহ। কী নেই সেই শো-কেসে! নানান মুখোশ, ছবি, বই-পুথি, বাদ্যযন্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র এমনকি পশুপাখির শুকনো হাড়গোড়, পালক, শুকনো ফুলপাতা, রঙিন নুড়িপাথর—কিছুই বাদ নেই। আছে ভুটান থেকে আনা জপযন্ত্র যেটা হাতে ঘুরিয়ে ‘ওম মণি পদ্মে হুম’ জপ করেন বৌদ্ধরা। অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা বুমেরাং তাক কষে ছুড়ে দিলে গাছ থেকে আম-লিচুর থোকা পেড়ে নিয়ে কিংবা কোনও জিনিসকে আঘাত করে আবার ফিরে আসে যে ছুড়েছিল তারই হাতে। এভাবে মিশরের প্যাপিরাস পেইন্টিং থেকে নরওয়ের এস্কিমোদের সিল মাছের চামড়ার তৈরি বুটের মতো রকমারি দ্রব্যেরা হাজির মণিদাদুর শো-কেসে।
এ-বছর মামার বাড়িটাকে শূন্যপুরী মনে হয় অভি-নীলুদের। মণিদাদু নেই। আর কখনও ফিরেও আসবেন না মণিদাদু। নেপাল থেকে দাদুর মৃত্যুসংবাদ এসেছে মাস খানেক হল।
পূজার কয়টা দিন নতুন জামা, অঞ্জলি, সন্ধ্যারতি, আলোর রোশনাই, বাজিতে মেতে রইল ওরা। কিন্তু দশমীর রাত পোহাতেই খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল। দিনের বেলা তবু মাঠে-বিলে কেটে যায় সময়। তবে অন্ধকার নামলেই বড়ো ফাঁকা লাগে। সারা সন্ধ্যা-রাত মণিদাদুর ঘরে গল্পের আসর বসত।
একাদশীর সন্ধ্যাটা মনমরা হয়ে কাটল অভি আর নীলুর। পরদিন অভি তাদের দিদাকে বলে ম্যানেজ করল। মণিদাদুর ঘরের চাবি খুলে দিল দিদা।
“কিছুতে হাত দেবে না কিন্তু! এগুলো ছিল মণিঠাকুরপোর প্রাণের জিনিস।” পইপই করে নিষেধ করলেন দিদা।
“না না, আমরা শুধু এ-ঘরে বসে মণিদাদুর অভিযানের কাহিনিই পড়ব।”
মণিদাদুর শো-কেস থেকে দুটো তিনটে ডায়েরি বের করে শো-কেস লক করে ‘পৃষ্ঠা মুড়বে না। দাগ দেবে না।’ বলে চলে যান দিদা।
ঘরের এক কোণে মেঝেতে পাতা ফরাসে বসে পড়ে দুই ভাই। যেখানটাতে বসে দাদুর মুখে গল্প শুনত ওরা। অভি ডায়েরির পৃষ্ঠা খুলে পড়তে থাকে। নীলু শোনে। তবে বেশিক্ষণ নীলু মন লাগাতে পারে না। কোথায় মণিদাদুর রহস্য করে বলা অভিযানের গল্প, আর কোথায় দাদার গড়গড় করে ডায়েরি থেকে রিডিং পড়া। নীলু উঠে গিয়ে শো-কেসের ভিতরের জিনিস দেখতে থাকে ঘুরে ঘুরে।
হঠাৎ সেই বইয়ের আকারের জিনিসটা চোখে পড়ে নীলুর। এটাকে ঠিক বই বলা যায় কি না নীলুর জানা নেই। একবার মণিদাদু চিনদেশের গল্প করতে করতে বের করেছিলেন এটা। ছোটোদের অবশ্য ছুঁতে দেননি। নিজে খুলে দেখিয়েছিলেন। পৃষ্ঠাগুলো পপ-আপ পদ্ধতিতে কেটে কেটে সিনারি তৈরি করা হয়েছে। এক-একটা পৃষ্ঠা খুলে মেলে ধরলে বামদিক আর ডানদিকের পৃষ্ঠা জুড়ে জেগে ওঠে অদ্ভুত এক-একটা তোরণ। আর তোরণের ও-পাশে নানান গাছপালা, প্রান্তর, জলাশয়ের আকার। পৃষ্ঠা ভাঁজ করে বন্ধ করলে কাটা কাটা অংশগুলো ভাঁজে ভাঁজে মুড়ে যায় আবার।
“বুঝলে দাদুভাইয়েরা, এর মধ্যে এমন একটা তোরণ আছে যেটা পেরোলেই আছে এক মায়া জগৎ। সেখানে নিজের ইচ্ছা-খুশিমতো জিনিস হাসিল করা যায়।”
“কোন তোরণটা! কোন তোরণটা! কীভাবে পেরোতে হয়?” সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল বইটার উপর।
মণিদাদু রহস্যময় হাসি হেসে বলেছিলেন, “তবে সে-জায়গা বড়ো সর্বনেশে! ভয়ংকর রকমের মায়াবী! একবার কাউকে বাগে পেলে কব্জা করে নেয় তার মন। এর বেশি কিছু বলা নিষেধ।”
সেই সন্ধ্যায় নীলুর বায়নাক্কায় দিদা বের করে দেন বইটা। নীলু এক-একটা পৃষ্ঠা উলটে দেখতে থাকে পপ-আপ সিনারিগুলো। বইটাতে সাকুল্যে গোটা দশেক পৃষ্ঠা। শেষ ছবিটাতে তোরণের ও-পাশে সবুজ মাঠে গাছের ছায়ায় অনেকগুলো বিড়ালছানা। নীলুর বিড়াল খুব পছন্দের। পুষবে বলে মায়ের কাছে মাঝে-মাঝেই বায়না করে। মা এটা-সেটা বলে ঠিক ভুলিয়ে দেন নীলুকে। আসলে মা বিড়াল পছন্দ করেন না। বিড়ালে মুখ দেওয়া খাবার খেলে নাকি মানুষদের ডিপথেরিয়া হয়।
পৃষ্ঠা থেকে উঁচিয়ে থাকা বিড়ালগুলোর গায়ে হাত রেখে—‘এদের একটা যদি আমার হত!’ মনে মনে ভাবে নীলু।
যেমন ভাবা তেমনি অবাক কাণ্ড। নীলু ঢুকে পড়ে সবুজ মাঠটাতে। পায়ের পাতায় নাক ঘষে আদর করতে থাকে একটা পুচকু বেড়ালছানা। নীলু কোলে তুলে নেয় উলের বলের মতো ছানাটাকে। অন্যগুলো নীলুদের চারপাশে ঘুরতে থাকে গোল হয়ে। খেলা জমে ওঠে।
“এই নীলু, দে দে! আমায় দে দেখি বইটা।”
দাদার ঠেলাঠেলিতে হুঁশ ফেরে নীলুর। কোথায় পুচকু বেড়ালেরা আর কোথায়ই-বা তোরণের ও-পাশের সবুজ মাঠ! সে তো ঘরের মেঝেতে ফরাসে বসে। ছবির বিড়ালেরা আগের মতনই স্থির, নির্জীব।
অভি হাতে বইটা তুলে নিয়ে খানিক নেড়েচেড়ে আবার ফেরত দিয়ে দেয় নীলুকে।
“জানিস দাদা, একটা অদ্ভুত কাণ্ড হল।” বলে নীলু।
“কী হল আবার?” জানতে চায় অভি।
শেষ পৃষ্ঠা মেলে ধরে নীলু বলে, “একটু আগে এই বেড়ালগুলোর সঙ্গে খেলতে চাইতেই আমি ওই তোরণ পেরিয়ে সবুজ মাঠে পৌঁছে গেলাম। আর বেড়ালগুলোও সব জীবন্ত হয়ে উঠল। খেলল আমার সঙ্গে।”
“কই, দেখি দেখি!” বলে বইটা কোলের উপর রেখে শেষ পৃষ্ঠাটার উপর ঝুঁকে পড়ে অভি। তারপর ধীরে ধীরে ঘোর লাগে তার চোখে।
নীলু অপেক্ষা করে। দাদাও বুঝি বিড়ালগুলোর সঙ্গে খেলছে।
বেশ কিছুটা সময় কেটে যাবার পর নীলু ডাকে—“দাদা, দাদা রে!”
অভি সাড়া দেয় না। যেন বুঁদ হয়ে আছে নেশায়। দাদার হাত ধরে ঝাঁকাতে থাকে নীলু।—“অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, দে দাদা বইটা আমায়।”
“উফ্, দাঁড়া আর একটু! গেমটা শেষ করতে দে।” বিরক্ত মুখে বলে অভি।
বিড়ালের সঙ্গে কী গেম খেলছে দাদা! অবাক হয় নীলু। ততক্ষণে দিদা এসে পড়েছেন। রাতের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। এবার উঠতে হবে।
“তুই পুচকু বেড়ালদের সঙ্গে কী গেম খেলছিলি রে দাদা?”
অভি কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে যায়।
রাতে বিছানায় শুয়ে অভিকে চেপে ধরে নীলু।—“বল না রে প্লিজ, তখন কী গেমের কথা বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেলি?”
খানিক চুপ করে থেকে অভি বলে, “তোরণের ও-পাশের গাছের নীচে ঘাসের উপর একটা ফোনের সেটের মতো জিনিস পড়ে ছিল। স্ক্রিনের উপর আঙুল ছোঁয়াতেই অদ্ভুত একটা গেমের অপশন ফুটে উঠল, বুঝলি। আজ আমি দশটা লেভেল পেরিয়েছি। দারণ ছিল গেমটা।”
“আমিও খেলব কাল।” আবদারি গলায় বলে নীলু।
কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে অভি বলে, “বাবার ফোনটা তো হাত দিতেই দেয় না। আর মায়েরটা চেয়ে-চিন্তে একটুক্ষণ গেম খেলতে না খেলতেই তো কেড়ে নেয়। আমাদের ক্লাসের টুকুনের নিজের একটা ফোন আছে জানিস! মণিদাদুর বইটা দিদাকে বলে ম্যানেজ করতে পারলে নিশ্চিন্তে রোজ খেলা যেত।”
“দাদা রে, তবে দিদার কাছে কাল বরাবরের জন্য চেয়ে নে না বইটা।” বলে নীলু।
“উঁহু, দেবে না রে। আমার মাথায় অন্য একটা মতলব আছে।”
“কী মতলব রে?”
“সে বলব’খন পরে। চল ঘুমিয়ে পড়ি।”
দেখতে দেখতে ছুটি শেষ হয়ে আসে। এবার বাড়ি ফেরার পালা। শেষবারের মতো নীলু বইটা চায় দিদার কাছে। কিন্তু শো-কেস খুলেই হতভম্ব দিদা বলে ওঠেন, “কোথায় গেল! এখানেই তো রাখলাম কাল।”
তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোত্থাও পাওয়া গেল না বইটা।
নীলুর বায়নায় আগের তিনদিন প্রতি সন্ধ্যাতেই বইটা বার করে দিতে হচ্ছিল দিদাকে। সবাই দিদাকে বলল, মনের ভুলে কোথায় বলতে কোথায় রেখেছ। পরে ঠান্ডা মাথায় খুঁজলে ঠিকই পাওয়া যাবে।
নীলুর চরম মনখারাপ লাগল। কিন্তু দাদা যেন বই হারিয়ে যাওয়াতে একটুও দুঃখ পাচ্ছে না। অবাক লাগে নীলুর। দাদাও তো তার মতো বইটার তোরণ পেরিয়ে ও-পাশের অদ্ভুত জগতটাতে ঢুকে গেম খেলে বুঁদ হয়ে যেতে পছন্দ করছিল খুব।
২
নীলু-অভিদের স্কুল খুলে গেল। মাস খানেক পর নতুন ক্লাসে ওঠার অ্যানুয়াল পরীক্ষা। নীলু এবার ক্লাস ফাইভে উঠবে। পড়াগুলো সব ঝালাতে লাগল সে মন দিয়ে। দাদাটার যে পড়ায় মন নেই বেশ বুঝতে পারছে নীলু। সামনে বই খুলে বসে থাকে, কিন্তু পড়ে না। অন্যমনস্কভাবেই বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যেন কীসের ঘোরের মধ্যে আছে। মাঝে মাঝে একটা অদ্ভুত সন্দেহ হয় নীলুর। কিন্তু কাউকে বলতে পারে না। দাদাকেও না।
আগে দাদা যেমন নীলুর সঙ্গে খেলত, গল্প করত। এখন সেগুলোর ধারে-কাছে দিয়েও যায় না। বিকেলে খেলার মাঠেও যায় না। বই খুলে বসে থাকে। এমনকি মায়ের ফোনটা দেখার বায়না পর্যন্ত করে না। তাই নীলুর সঙ্গে এ-ব্যাপারে আগের মতো মারপিটও হয় না আজকাল।
পরীক্ষা শেষ হল। রেজাল্ট বেরোল। নীলু নতুন ক্লাসে উঠেছে। আর প্রায় সব বিষয়ে ফেল করে অভি তার পুরোনো ক্লাসে রয়ে গেল। মাস্টারমশাইরা সবাই অবাক। প্রতিবার পরীক্ষায় এক থেকে দশের মধ্যে নাম থাকে অভিনন্দন সেনের। কী করে এমনটা হল! বাবা-মাও থ হয়ে গেছেন। এমনটা যে কখনও হতে পারে তাঁরাও কল্পনা করেননি কখনও। বাবা-মা কখনও মারধোর করেন না ওদের। এবারেও করলেন না।
নীলু দেখল বাবা গুম হয়ে গেলেন। মাকে শুধু বললেন, “ছেলেটা যে মোটেই পড়াশুনো করেনি সে তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু কী করে হল এমন?”
মা বলছেন, “ও কিন্তু বই নিয়েই বসে থাকত বেশিরভাগ সময়। আমার ফোনটাও দেখতে নিত না আর। তবে সারাদিন কেমন ঘোরের মধ্যে থাকত। আমি ভাবতাম খুব পড়াশুনায় ডুবে আছে হয়তো।”
মা তো দিশেহারা অবস্থায় সবসময় চোখ মুছছেন আঁচলে।
নীলু মনে মনে প্রার্থনা করে দাদা যেন আগের মতন হয়ে যায় আবার। মা বলেন, পবিত্র মনে প্রার্থনা করলে ঈশ্বর শোনেন।
নতুন বছরে ক্লাস শুরু হয়ে গেল। নীলু লক্ষ করল, দাদা কিন্তু এখনও পড়ছে না। পড়তে বসার দু-তিন মিনিটের মধ্যে উঠে যায় মিনিট কয়েকের মধ্যে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে শুধু বইয়ের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে আগের মতো। দাদা যেন আর দাদা নেই। অন্য অপরিচিত কেউ।
নীলুর মনের সন্দেহটা গাঢ় হয়। একদিন দাদার পিছন পিছন উঠে গিয়ে সে দেখে, সিঁড়ির নীচের পুরাতন জিনিসপত্র খাতা-বই ডাঁই করে রাখার ঘরটাতে ঢুকে পড়ল দাদা। আর কয়েক সেকেন্ড পরেই আবার বেরিয়ে এল। তারপর ঘোরের মধ্যে হেঁটে এগোতে লাগল পড়ার ঘরের দিকে।
নীলু ঢুকে পড়ে ঘরটাতে। এই ঘরটায় কেউ ঢোকে না সচরাচর। মাঝে-মধ্যে মা পুরোনো খবরের কাগজ বা বাতিল জিনিস রাখতে ঢোকেন। মেঝের ধুলোয় পায়ের ছাপ বরাবর এগিয়ে গিয়ে থেমেছে একটা ভাঙা বুক-কেসের সামনে। পাল্লা দুটো খোলে নীলু। একটা মাত্র অক্ষত তাকের উপর বেশ কিছু পত্রিকা। আর ওদের মধ্যে আলগাভাবে গোঁজা আছে জিনিসটা। মণিদাদুর সেই চিনা বইটা!
খানিক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নীলু। তার সন্দেহটা যে সত্যি সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল এইমাত্র।
“এই ঘরের দরজাটা খুলল কে আবার!” মায়ের গলা ভেসে আসে।
ঝটিতে হাতের বইটা পাশে রাখা পুরোনো খবরের কাগজের ডাঁইয়ের মধ্যে গুঁজে দিয়ে নীলু বলে, “পুরোনো খবরের কাগজ নিতে এসেছিলাম। স্কুলে ক্রাফট করাবে আজ।”
সারাদিন স্কুলে একটা চাপা উত্তেজনার মধ্যে কেটে যায় নীলুর। অদ্ভুত একটা ছটফটানি। কতক্ষণে বাড়ি ফিরবে। ফিরেই সরিয়ে ফেলতে হবে বইটা। না-হলে দাদা এবারও পাশ করতে পারবে না। এবার থেকে শুধু সে-ই বইটা দেখে পৌঁছে যাবে মায়া জগতে। তবে মাঝে মাঝে। কোথায় লুকিয়ে রাখা যায় বইটা, শুধু সেই চিন্তাই ঘুরতে থাকে নীলুর মাথায়।
ছুটির ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই সাইকেল নিয়ে বাড়ির পথ ধরে নীলু। দাদাদের ছুটি হয় আরও দু-পিরিয়েড পরে। এটাই নিশ্চিন্তি।
হাত-মুখ ধুয়ে নাকে মুখে টিফিন না গোঁজা পর্যন্ত মা পিছনে পড়ে থাকবেনই। তারপরেই রেহাই। তাই গোগ্রাসে খাবার শেষ করে এক ফাঁকে সিঁড়ির নীচের ঘরটাতে ঢুকে পড়ে নীলু। আর ঢুকেই সে বেদম ধাক্কাটা খায়। ঘরের মেঝেতে রাখা খবরের কাগজের স্তূপ গায়েব! এমনকি ভাঙা বুক-কেসের পুরোনো ম্যাগাজিনগুলোও। তার মানে আজ...
“মা! মা!” বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে নীলু হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “পুরোনো সব খবরের কাগজগুলো?”
“পুরোনো খাতা-বই বিক্রি লোকটা এসেছিল আজ। সেই করোনা অতিমারির কালে লক-ডাউনের সময় থেকে রাজ্যের আবর্জনা জমে উঠেছে। সব বিদায় করলাম। যা আরশোলা হয়েছিল! কেন রে, ক্রাফটের জন্য আরও লাগত নাকি? গোটা দশেক সরিয়ে রেখেছি, চিন্তা করিস না।”
বুকটা ধক করে ওঠে নীলুর। তোরণটা পেরিয়ে আর কখনও ওই মায়াবী দুনিয়ায় যেতে পারবে না তারা। কিন্তু চরম হতাশাটা ক্রমে থিতিয়ে আসে। তার বদলে মনের মধ্যে একটা স্বস্তি জেগে ওঠে। যা হয়েছে ঠিক হয়েছে। বেশ হয়েছে। আবার তার দাদাকে আগের অবস্থায় ফিরে পাবে। এমনকি দাদার মতো সেও তো হারিয়ে যেতে পারত ওই সর্বনেশে গেমটার সম্মোহনী গোলক ধাঁধায়!
ছবি - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী