ছোটো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
ছোটো গল্প
কিশোর ঘোষাল
১
বিকেলবেলা বেড়াতে বেরিয়ে আমাদের ফিরতে বেশ দেরিই হয়ে গেল। ঊষাদিদি, তূষ আর আমি যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন প্রায় সাতটা বাজে। মা-পিসিমা দুজনেই চিন্তা করছিলেন। আমরা ঘরে ঢুকতেই পিসিমার বকুনি শুরু হয়ে গেল। আমাকে নয়, ঊষাদিদিকে।—“তোর কোনও বুদ্ধিসুদ্ধি নেই! ছেলেটা এতদূর থেকে আজই এল, আজই সব ঘুরিয়ে দেখাতে হবে? কালপরশু তাহলে কী করবি?”
ঊষাদিদি একটু অপ্রস্তুত হয়েই বলল, “বা রে। আমরা বেরোলামই তো সাড়ে চারটের সময়। কতক্ষণ ঘুরেছি বলো?”
আমি বললাম, “পিসিমা, ঊষাদিদির কোনও দোষ নেই গো। জলঙ্গীর ধারে বসে আমরা অনেকক্ষণ গল্প করছিলাম। দারুণ সুন্দর নিরিবিলি জায়গাটা। তারপর তো আমরা ফিরেই আসছিলাম! কিন্তু ফেরার সময় হঠাৎ আমার চোখে পড়ল, নদীর ধারে একটু দূরে পুরোনো একটা ভাঙাচোরা বাড়ি। ঊষাদিদি বার বার বলেছিল, অন্ধকার হয়ে আসছে ওখানে যাব না। আমিই জোর করে ওদের নিয়ে গেলাম।”
পিসিমা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “থাক থাক, তোকে আর দিদির হয়ে ওকালতি করতে হবে না। ভাঙাবাড়ি কোনটা রে ঊষা? দে চৌধুরীদের ভিটে?”
ঊষাদিদি একটু ভয়ে-ভয়েই উত্তর দিল, “হ্যাঁ।”
পিসিমা চমকে উঠলেন। চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, “এই তিন সন্ধেবেলা তোরা ওই হানাবাড়িতে গিয়েছিলি? জ্যোতি না হয় নতুন, কিছু জানে না। ও জোর করল বলেই তোরা চলে গেলি?”
ঊষাদিদি মাথা নীচু করে আমার দিকে তাকাল। আমার খুব খারাপ লাগছিল। ঊষাদিদি সত্যিই অনেকবার মানা করেছিল এ-সময় ওখানে না যেতে। আমিই জোর করেছিলাম।
ব্যাপারটা ঘোরালো হয়ে যাচ্ছে বুঝে মা এই সময় বললেন, “হানাবাড়ি? এখানে হানাবাড়িও আছে নাকি?”
পিসিমা বললেন, “হ্যাঁ গো, বৌদিদি। কতদিনের পুরোনো কেউ জানে না। কেউ বলে তিনশো, কেউ বলে পাঁচশো বছরের পুরোনো রাজবাড়ি। বাড়ি-ফাড়ি আর নেই, সবই ভাঙাচোরা ধ্বংসস্তূপ—বট, অশ্বত্থ আর তার শেকড়ে মোড়া। তার ওপর চারদিকে ঝোপঝাড় জঙ্গল। এখানকার লোকেরা বলে দে চৌধুরীদের ভিটে। খুব বদনাম আছে জায়গাটার। দিনের বেলাতেই ওখানে লোক যায় না, আর ওরা গেল কিনা ভর সন্ধেবেলায়?”
মা জিজ্ঞাসা করলেন, “বদনাম মানে? বদনাম কীসের জন্যে? তেনাদের জন্যে, নাকি অন্য কিছু?”
“এত রাত্রে তুমি আর ওইসব জিজ্ঞাসা কোরো না তো বৌদিদি। এখন ওসব কথা থাক।” পিসিমার গলায় একটু যেন আতঙ্কের ভাব। বললেন, “তোরা হাত-মুখ ধুয়ে আয়। মুড়ি মেখে দিচ্ছি, খা।”
“বিকেলেই তো এক পেট পরোটা-বেগুনভাজা খেলাম, এখন আর কিচ্ছু খাব না পিসিমা।”
“দুটো পরোটা খেয়েই এক পেট হয়ে গেল? তোরা সব পারিস বটে!”
মা হাসতে হাসতে বললেন, “তোরা মোবাইলে ছবি তুলিসনি? কোথায় কোথায় ঘুরলি আমাদেরও একটু দেখা।”
পিসিমার বকুনিতে ঊষাদিদি মুখ গোমড়া করে ছিল, এখন মায়ের কথায় খুশিই হল। বলল, “ছবি তুলেছি তো। দেখবে মামিমা? দাঁড়াও, ডেস্কটপে কানেক্ট করি। বড়ো পর্দায় দেখতে সুবিধে হবে।”
ঊষাদিদি ডেস্কটপ অন করে মোবাইলের সঙ্গে ইউএসবি পোর্ট কানেক্ট করল। তারপর মাউস স্ক্রোল করে ফোল্ডার সিলেক্ট করে ছবিগুলো দেখাতে শুরু করল। প্রথমদিকের ছবির সবগুলোই জলঙ্গীর ধারে তোলা। ছোটো নদীর ছবি—সবসময়ই ছবির মতো সুন্দর হয়। ও-পাড়ের গ্রাম, মাঠ-ঘাট, গাছপালা। নদীর বুকে দু-একটা নৌকো। বিকেলের মায়াবী আলোর আকাশ, নদীর সবুজ জল—সবমিলিয়ে ঊষাদিদির মোবাইলে ছবিগুলো সুন্দর এসেছে। মাও দেখতে দেখতে বেশ কয়েকবার ‘বাহ্’, ‘বিউটিফুল’ বললেন। তারপরেই এল সেই দে চৌধুরীদের ভিটের ছবি। বিকেলের আলোটা তখন খুবই কমে এসেছে, তাই ফ্ল্যাশে তোলা। আশেপাশের জঙ্গল, তার মাঝখানে ভাঙা প্রাচীন বাড়ি। এই ছবিগুলি দেখতে দেখতে মা বললেন, “ভেরি ইন্টারেস্টিং!”
এরপর পরপর তিনটে ছবি। একটাতে আমি আর তূষ বাড়িটার দিকে এগিয়ে চলেছি, আমাদের পিছন থেকে ঊষাদিদি তুলেছে। পরেরটায় আমি তূষের কাঁধে হাত রেখে ক্যামেরার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি, পেছনে বাড়িটা। আর শেষেরটা আমি তুলেছিলাম—ঊষাদিদি আর তূষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, ব্যাকগ্রাউন্ডে বাড়িটা।
ছবিগুলো দেখতে দেখতে পিসিমা বললেন, “দেখছ বৌদিদি, ওইসব জায়গায় সন্ধেবেলায় কেউ যায়? অন্য কিছুর কথা যদি নাও ভাবি—সাপখোপ, শেয়াল, ভাম তো থাকতেই পারে।”
পিসিমার কথায় মা বললেন, “সে-কথা সত্যি। তবে এই শীতের সময় সাপখোপের ভয় নেই বললেই চলে। অবশ্য শেয়াল-টেয়াল তো থাকতেই পারে। ঊষা, লাস্ট তিনটে ছবি রিপিট কর তো মা।”
ঊষাদিদি স্ক্রোল ব্যাক করে তিনটে ছবিই আবার দেখাল। মা বললেন, “এই তিনটেকে জুম করা যাবে?”
ঊষাদিদি মাউস স্ক্রোল করে আমাদের মুখের ওপর জুম করছিল। মা বললেন, “উঁহু, তোদের মুখ নয়, ওপরের বাঁদিকের ওই জানালাটা—ইয়েস, আর একটু—ব্যস, ব্যস। এবার পরের স্লাইডটা দেখা তো।”
ওই তিনটে ছবি মা বেশ মন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। পিসিমা মায়ের এই কৌতূহল দেখে বললেন, “ও বৌদিদি, কী দেখছ বলো তো?”
মা কিছু একটা চিন্তা করতে করতে বললেন, “একটা খটকা লাগছে। পোড়ো হানাবাড়ির দোতলার জানালায় একটা ইয়ে...”
পিসিমা বললেন, “আরে ধুৎ, ইয়েটা কী বলবে তো! আমার তো ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে গো।”
এবার মা একটু অপ্রস্তুত হলেন। বললেন, “ধুর ধুর, তুমি যা ভাবছ তা নয় শিল্পী। আমার কেমন যেন খটকা লাগছে। তোমার স্কুটারটা আমি একবার নেব। আর দে চৌধুরীদের ভিটেটা এখান থেকে কদ্দুর? ভুটকু চিনে নিয়ে যেতে পারবি তো?”
“সর্বনাশ। তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি, বৌদি? এই রাত্তিরে তুমি ওই ভূতুড়ে বাড়ি যাবে?”
মাকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। মায়ের মনে যখন একটা খটকা লেগেছে, সেটা যতক্ষণ না মিটবে, মা শান্তিতে বসবেন না। মায়ের পরনে ছিল সালোয়ার-কামিজ। তার ওপর একটা কার্ডিগান পরে নিলেন, আর দু-মিনিটের মধ্যে ছোট্ট সাইড ব্যাগে একটা টর্চ আর মোবাইল নিয়ে মা স্নিকার পরতে লাগলেন। আমার জামা-প্যান্ট-সোয়েটার পরাই ছিল, আমিও সময় নষ্ট না করে স্নিকার পরে ফেললাম চটপট।
পিসিমা খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন, “এ কি রে, জ্যোতি! তোরও মাথা খারাপ হল? কোথায় মাকে বুঝিয়ে বলবি, তা নয়, তুইও তালে তাল মেলাচ্ছিস! এ কী মেয়ে রে বাবা। কোথায় কী না কী মনে হল, এই রাতদুপুরে ছুটছে বনেবাদাড়ে, হানাবাড়িতে? ভয়ডর কিছু কী থাকতে নেই! দাদাকে আমি ফোন লাগাচ্ছি। দাদা আর তোমার ভাই ফেরা অবধি অপেক্ষা করবে তো?”
মা রেডি। পিসিমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। মুচকি হেসে বললেন, “স্কুটারের চাবিটা দাও শিল্পী। এখন তো সাড়ে সাতটা, ধরো ঘণ্টা দুয়েক, মানে সাড়ে ন’টা-পৌনে দশটার মধ্যে যদি আমরা না ফিরি, তোমার দাদা আর সন্দীপনকে ফোন কোরো। আমরা কোথায় গিয়েছি বলে দিও।”
আমি আর মা দুজনেই মাথায় হেলমেট পরে নিলাম। তারপর পিসিমা মায়ের হাতে চাবি দিতে দিতে বললেন, “বৌদিদি, আমার কিন্তু খুব ভয় করছে।”
মা মৃদু হাসলেন। তারপর পিসিমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “আমারও। কিন্তু একটা ব্যাপারে ভীষণ সন্দেহ হচ্ছে। সেটা কী না জানলে শান্তি পাব না।”
২
আমার নাম জ্যোতিষ্ক সান্যাল—ডাকনাম জ্যোতি। মা আদর করে ডাকেন ভুটকু। আজই বিকেলের দিকে আমরা বড়োপ্রতাপপুরে এসে পৌঁছেছি। আমরা বলতে মা, বাবা আর আমি। মায়ের নাম শোভাময়ী আর বাবা সমরেশ সান্যাল। এখানে আমার পিসিমার বাড়ি। শিল্পী আমার পিসিমার নাম, পিসেমশাই পুলিশের বড়ো অফিসার—নাম সন্দীপন লাহিড়ি। একটু বিশ্রাম করে চা এবং জলখাবার খাওয়া হল। আমি অবশ্য চা খাই না। জলখাবারের পর পিসেমশাই বাবাকে নিয়ে বেরোলেন তাঁর অফিসের দিকে। পিসেমশাই এখন এই থানায় পোস্টেড। এতদিন কলকাতেই ছিলেন, শুনেছি জাঁদরেল অফিসার।
ওঁরা বেরিয়ে যাবার পর ঊষাদিদি আমাকে বলল, “চ’, তোকে আমাদের জায়গাটা দেখিয়ে আনি।”
ঊষাদিদি আমার পিসতুতো দিদি, ভালো নাম ঊষসী। আমার থেকে দু-বছরের বড়ো, ক্লাস নাইনে পড়ে। তূষ আমার পিসতুতো ভাই, ভালো নাম প্রত্যূষ। একদমই বাচ্চা, তার সবে ক্লাস ফাইভ। তূষও দিদির কথায় নেচে উঠল। আমি এককথায় রাজি হয়ে গেলাম। নতুন জায়গায় বেড়াতে এসে বিকেলবেলা ঘরে বসে থাকার কোনও মানে হয় না।
মাও অমত করলেন না। বললেন, “সেই ভালো, তোরা একটু এদিক সেদিক ঘুরে আয়, আমি আর তোর পিসিমা বরং সুখ-দুঃখের গপ্পো করি।”
মোটামুটি সাড়ে চারটে নাগাদ আমরা বেরিয়েছিলাম। পিসিমার বাড়ি থেকে হেঁটে শহর ছাড়িয়ে জলঙ্গী নদীর ধারে একটা ছোট্ট পার্ক। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে নির্জন একটা জায়গায় গিয়ে আমরা কিছুক্ষণ বসেছিলাম। ঊষাদিদি খুব সুন্দর গান গায়। দুটো গান গাইল—‘অশ্রুনদীর সুদূর পারে’ আর ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’। গান দুটো শুনে বুঝতে পারলাম, বাড়িতে সোফায় বসে সিডি চালিয়ে শোনা আর এই খোলা আকাশের নীচে নদীর নিরিবিলি পাড়ে খালি গলার গান শোনা, এই দুয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক।
গান-টান শুনে আরও কিছুক্ষণ বসার পর আমরা যখন ফিরব বলে উঠে পড়েছি, তখনই ওই বাড়িটা আমার চোখে পড়ল। বিকেলের মরা আলোয়, প্রচুর গাছপালা, ঝোপঝাড়ের আড়ালে খুব রহস্যময় লাগছিল বাড়িটাকে। ঊষাদিদিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ওই বাড়িটা কাদের বাড়ি রে দিদি?”
ঊষাদিদি বলল, “ও-বাড়ির দিকে তাকাস না। হানাবাড়ি। লোকে বলে দে চৌধুরীদের ভিটে।”
নদীর ধারে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ভাঙাচোরা পুরোনো বাড়িটা আমাকে যেন টানছিল। আমি বললাম, “চ’ না রে দিদি, একবার দেখে আসি। বেশিক্ষণ না, একটু দেখেই চলে আসব।”
ঊষাদিদি বলল, “পাগল হয়েছিস? এই সময় ওই বাড়িতে তোকে নিয়ে যাব?”
ঊষাদিদির আপত্তিতে আমি কান দিলাম না। আমি বাড়িটার দিকে হনহন করে হাঁটা দিতে, “জ্যোতি, জ্যোতি, ওদিকে যাস না!” বলে ঊষাদিদি ডাকতেও লাগল, আবার আমার পিছন পিছন আসতেও লাগল—ও আর তূষ।
ওই হানাবাড়ির সামনে আমাদের তিন ভাইবোনের সেই ছবি দেখে মায়ের মনে যে কীসের খটকা লাগল তা জানি না। তবে এই মাকে আমি চিনি। স্কুটারে মায়ের পিছনে এই যে আমি বসে আছি, মাকে যদি আমি জিজ্ঞাসা করি কী দেখে তোমার মনে সন্দেহ হল, কিংবা কীসের সন্দেহ করছ—মা কোনও ঊত্তর দেবেন না। গম্ভীর হয়ে শুধু চিন্তা করতে থাকবেন। বেশি জিজ্ঞাসা করলে বিরক্ত হবেন—বলবেন, ‘সময় হলে ঠিক বলব। এখন বকে বকে মাথা খারাপ করিস না।’
পিছনে বসে আমি মাকে পথের ডিরেকশন দিচ্ছিলাম। একসময় মা বললেন, “তোরা জলঙ্গীর ধারে প্রথমে যে পার্কটায় গিয়েছিলি, আমরা এখন কিন্তু সেখানে যাব।”
“সেখান থেকে দে চৌধুরীদের ভিটে তো অনেকটাই দূর। অতটা হাঁটবে?”
“একশো বার। স্কুটার চালিয়ে দে চৌধুরীদের ভিটেতে রাত আটটার সময় ঢুকলে ওখানে যারা আছে, তারা বিরক্ত হবে না? রেগেও যেতে পারে!”
“কারা আছে বলে তোমার মনে হয়, মা?”
“ভূত যে নেই সেটা তোকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। সেক্ষেত্রে মানুষই থাকার সম্ভাবনা। তাদের উদ্দেশ্যটা কী সেটাই আমার জানা দরকার। লোকালয় ছেড়ে, নদীর ধারে পরিত্যক্ত পোড়ো বাড়িতে কারা থাকে? কেনই-বা থাকে? অবিশ্যি আমার ভুলও হতে পারে।”
“আমাদের তিনজনের ছবি থেকে কী করে তুমি বুঝলে, ওখানে কেউ আছে বা থাকতে পারে?”
“সে-কথা পরে বলব, এখন নয়। এটাই মনে হচ্ছে সেই পার্কটা, না? ওই তো সাইকেল আর স্কুটারের স্ট্যান্ডও রয়েছে একটা।”
এক ধারে পার্ক করে মা লক করলেন স্কুটারটা। তারপর বললেন, “চ’, কোন দিকে তোদের দে চৌধুরীদের ভিটে, নিয়ে চল। হেলমেট খুলিস না, মাথাতেই থাক।”
নদীর ধার ধরে উত্তরদিকে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। পার্কের কাছে কিছু লোকজন রয়েছে; ঝালমুড়ি, চানাচুর, ঘটিগরম, বাদামওয়ালা, ফুচকাওয়ালাও রয়েছে। কিন্তু পার্কের এলাকা ছাড়িয়ে যত এগোতে লাগলাম, লোকজন কমে আসতে লাগল। মিনিট পনেরো হাঁটার পরে যে জায়গাটায় আমরা তিনজন বসেছিলাম, ঊষাদিদি গান গেয়েছিল, সেখানে পৌঁছে গেলাম। এখানটা একদমই নির্জন, জনমানবশূন্য।
মাকে বললাম, “এইখানে আমরা কিছুক্ষণ বসেছিলাম। আর ওই যে, ওইদিকে দে চৌধুরীদের ভিটে।”
মাকে হাত তুলে দেখালাম, কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চারদিকেই অন্ধকার, আর বাড়িটা যেদিকে, সেদিকটা যেন জমাটবাঁধা কালো স্তূপ একটা!
মা ওই অন্ধকারের দিকে চলতে চলতে বললেন, “তোরা যে-রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলি, সেটা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায় কি না দেখতে হবে। আর কথাবার্তা যত কম বলা যায়, ততই ভালো। কথা বললেও, বুঝতেই পারছিস, একদম ফিসফিস।”
নদীর ধার বরাবর যে রাস্তা ধরে আমরা বিকেলে গিয়েছিলাম, সে-রাস্তা ছেড়ে মা নদীর বাঁধ ডিঙিয়ে নদীর একদম পাশে পাশে চলতে লাগলেন। বর্ষার সময় নদী যখন ভরে ওঠে, তখন এই পায়ে চলা পথ থাকে না, জলের নীচে ডুবে যায়। কিন্তু এখন শীতের সময়, নদীর জল অনেকটা সরে গিয়ে চিকচিকে বালি আর ছোটো ছোটো নুড়ি বিছোনো রাস্তা হয়ে গেছে।
অন্ধকারে আমি কিছুই প্রায় দেখতে পাচ্ছিলাম না। মাকে ফিসফিস করে বললাম, “টর্চটা মাঝে মাঝে জ্বালাও না, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না যে। আজকে চাঁদও ওঠেনি।”
মা খুব নীচু গলায় বললেন, “পাগল হয়েছিস? এই অন্ধকারে টর্চ জ্বাললে লোকে দেখে ফেলবে। আর এটা কৃষ্ণপক্ষ চলছে, আজ পঞ্চমী। চাঁদ উঠবে সেই মাঝ-রাত্তিরের পর। চাঁদের আলো ভাগ্যিস নেই, থাকলে আমরা নির্ঘাৎ ধরা পড়ে যেতাম। তুই আমার পিছনে পিছনে আয়, অসুবিধে হবে না।”
বেশ কিছুটা যাওয়ার পর মা হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। আমার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে নদীর বাঁধ-ঘেঁষা একটা ঝোপের আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম? আমার তো মনে হচ্ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর আমার বুকের মধ্যে আওয়াজ হচ্ছিল ঢিব-ঢিব। মা ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন, “কিছু শুনতে পাচ্ছিস?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। আর মাঝে মাঝে কোন একটা পাখি।”
মা বললেন, “ধুর, সে তো অনেকক্ষণ ধরেই শুনছি। আর কোনও শব্দ? ভয় পাস না। ভয় পেলে আমাদের চোখ-কান-মন ঠিকঠাক কাজ করে না। তখন পাখির ডাককেও মনে হয় ভূতে চেঁচাচ্ছে। একটু মন দিয়ে শোন, বুঝতে পারবি।”
মায়ের কথায় আমার ভয়টা একটু কাটল। একটু কান করে শুনতেই আলাদা একটা আওয়াজ কানে এল। খুব চাপা আর অস্পষ্ট একটানা আওয়াজ। আমি বললাম, “কোনও মেশিন চলছে অনেক দূরে?”
মা বললেন, “এক্স্যাক্টলি। তবে অনেক দূরে নয়, মাটির তলায়। পায়ের তলাতেও দেখ, খুব হালকা একটা ভাইব্রেশন হচ্ছে। বুঝতে পারছিস?”
আশ্চর্য, ঠিক তো! এতক্ষণ বুঝতেই পারিনি। বললাম, “হুঁ। তাই তো!”
“মনে হচ্ছে ছোটো জেনারেটর। আয়, এবার খুব আস্তে আস্তে আমরা এগোব।”
“আরও যাবে? আমার কিন্তু ভয় করছে মা।”
মা আমার কাঁধে হাত রেখে কাছে টেনে নিলেন, “আয়। ভয় কি আমারও করছে না?”
৩
এবারে আর নদীর পাশে বালির রাস্তা দিয়ে নয়, মা এগোতে লাগলেন বাঁধের গা ঘেঁষে এক ঝোপ থেকে অন্য আর একটা ঝোপের আড়ালে। ভীষণ সন্তর্পণে আর চারদিকে লক্ষ করতে করতে। ‘ভয় কি আমারও করছে না?’ মায়ের এই কথাটা শুনে আমার কেমন জানি সাহসটা অনেক বেড়ে গেল। বুক ঢিব-ঢিব করা ভয়টাও চলে গেল মন থেকে। এতক্ষণ আমি অন্ধকারে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। এখন আবছা আবছা সবই দেখতে পাচ্ছি। এই ঝোপঝাড়, নদীর পাড়ে বিশাল বিশাল গাছ। নদীর জল। তাছাড়া আমরা যত এগোচ্ছি, মেশিনের আওয়াজ আর পায়ের তলায় ভাইব্রেশনও বাড়ছে। কিন্তু কিছুটা এগিয়েই আমাদের যাওয়ার রাস্তাটা বন্ধ হয়ে গেল।
আমাদের সামনে খুব ছোট্ট একটা নালা। নালাটা আমাদের বাঁদিকের নদী থেকে শুরু হয়ে ডানদিকে দে চৌধুরীদের ভিটের দিকে চলে গেছে মাটির তলা দিয়ে। আমাদের বাঁদিকের নদী থেকে ঢুকে আসা নালাটা ডানদিকে একটা সুড়ঙ্গের মুখেই শেষ হয়ে গেছে। বর্ষাকালে সুড়ঙ্গের মুখটা মনে হল জলের মধ্যে ঢাকা পড়ে যায়। এখনও জল রয়েছে, তবে সুড়ঙ্গের মুখটা অর্ধেক খোলা। সুড়ঙ্গের মুখের কাছে দাঁড়িয়ে আমরা ভেতরে উঁকি মারলাম। এখানে মেশিনের আওয়াজটা আরও স্পষ্ট। সুড়ঙ্গের ভেতরটা অন্ধকার। সুড়ঙ্গের মুখে জলের মৃদু ঢেউয়ের ধাক্কায় আওয়াজ হচ্ছে ছলাৎ ছলাৎ। মাঝে মাঝে গুমোট একটা হাওয়া আসছে সুড়ঙ্গ থেকে, তাতে পোড়া ডিজেলের গন্ধ।
একটু দাঁড়িয়ে মা এবার নদীর বাঁধে উঠতে লাগলেন, পিছনে আমি। খাড়া পাড়, উঠতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল, কিন্তু ঝোপঝাড়ের সাপোর্ট নিয়ে উঠে পড়লাম। আমাদের ডানদিকে বাঁদিকে—দু-দিকেই নদীর এই বাঁধ, বরাবর চলে গেছে। ডানদিকে সোজা হাঁটলে আমরা সেই পার্কে পৌঁছে যাব যেখানে আমাদের স্কুটার রাখা আছে। বাঁধের এ-পাশটায় অনেক বড়ো বড়ো গাছ, অন্ধকারে চেনার উপায় নেই। গাছের গোড়ায় ছোটো ছোটো ঝোপঝাড়। গাছের ফাঁক দিয়ে সামনে তাকালে, জমাট ঘন অন্ধকারের মতো দাঁড়িয়ে আছে পোড়ো বাড়িটা। কোথাও কোনও লোকজন নেই। কোনও আলো নেই। অথচ সুড়ঙ্গের মধ্যে জেনারেটরের আওয়াজ পেয়েছি, পোড়া ডিজেলের গন্ধ পেয়েছি। বাঁধ থেকে নেমে মা বাড়িটার দিকে সন্তর্পণে এগোতে লাগলেন। আমরা যেখান দিয়ে চলেছি, আন্দাজ মতো, সুড়ঙ্গটা তার নীচে দিয়ে গিয়েছে। এ-পাশে পুরোনো ইটের পাঁচিল ছিল, এখন ভেঙে ধ্বংসস্তূপ। দে চৌধুরীদের ভিটের মধ্যে ঢুকে পড়তে অসুবিধে হল না। ঘন গাছপালা আর ঝোপের ভেতর গা-ঢাকা দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। মুখে-চোখে মাকড়শার জাল জড়িয়ে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল, কিন্তু মার ওসব দিকে কোনও খেয়াল নেই।
নদীর বাঁধের পাশের ভাঙা পাঁচিল থেকে পোড়ো বাড়িটা পর্যন্ত সবটাই প্রায় জঙ্গল। বাড়ির কাছাকাছি যখন এসেছি, মা আবার চুপ করে বসে পড়লেন ঝোপের আড়ালে। বুঝতে পারলাম, মা কিছু একটা দেখতে পেয়েছেন বা শুনতে পেয়েছেন। একটু মনোযোগ দিতে আমিও শুনতে পেলাম। বেশ কয়েকজন লোক কথা বলছে। কোনও কথাই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না, চাপা গমগমে আওয়াজ। বড়ো হলঘরে অনেকে কথা বললে যেমন শোনায়।
মিনিট খানেক বসে থাকার পর মা শব্দ লক্ষ্য করে আরও সন্তর্পণে এগিয়ে চললেন বাড়িটার দিকে। পিছনে আমি। এখান থেকে বাড়ির পাল্লাহীন সদর দরজাটা দেখা যাচ্ছে। মা সেদিকে গেলেন না। বাড়ির পাশের দিকে একটা জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন। লোকজনের আওয়াজটা ওদিক থেকেই আসছে। জানালাটার নীচে পৌঁছে মা আবার বসে পড়লেন। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আমায় ইশারা করলেন কথা না বলতে। আগেকার দিনের বিশাল জানালা, ঘরের মেঝে থেকে ফুট খানেক ওপর থেকে শুরু হয়েছে। কোনও কালে কাঠের পাল্লা ছিল হয়তো। এখন কিছুই নেই। জানালার একটা কোণ বরাবর মা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। মাটি থেকে দাঁড়িয়ে মায়ের বুকের কাছে জানালাটা। আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের মধ্যে উঁকি দিলেন। কী দেখলেন জানি না, কারণ আমার মাথা অত উঁচুতে পৌঁছবে না। কয়েক সেকেন্ড পরেই মা আবার নীচু হয়ে বসলেন। কথা বললেন না, ইশারায় বললেন, যা দেখার হয়ে গেছে, এবার ফিরে যাই চল।
যেভাবে এসেছিলাম, সেইভাবেই আমরা ফিরে চললাম। ভাঙা পাঁচিল পার হয়ে আমরা নদীর বাঁধে উঠে আবার নেমে গেলাম নদীর পাশের কাঁকুরে পথে। তারপর নিঃশব্দে দ্রুত হেঁটে চললাম জলঙ্গী পার্কের দিকে।
৪
আমাদের স্কুটারের আওয়াজ পেয়েই পিসিমা দৌড়ে এসেছেন বাড়ির বাইরে। আমাদের দুজনকে সুস্থ স্বাভাবিক দেখে বেশ নিশ্চিন্ত হলেন, মনে হল। কিন্তু উদ্বেগে কথা বলতে পারছিলেন না। মা স্কুটার পার্ক করে লক করে এসে পিসিমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “এত ভয় পাও কেন শিল্পী? ভয় করাটা নেশার মতো। যত করবে, ততই বাড়বে। চলো, ঘরে চলো।”
মায়ের কথায় পিসিমা একটু স্বাভাবিক হলেন। পিসিমাকে নিয়ে আমরা ঘরে ঢুকলাম। ঊষাদিদি আর তূষও আমাদের দিকে অবাক চোখে দেখছিল।
ঘরে ঢুকে সোফায় বসে মা বললেন, “চান করতে হবে। যা মাকড়শার জাল, চুলে জড়িয়ে গেছে।”
“কিছু দেখতে পেলে?”
পিসিমার কথায় মা হাসতে হাসতে বললেন, “কিছু শব্দ শুনেছি, কিছু গন্ধ পেয়েছি। আর পায়ের তলায় মাটি কাঁপছিল অনুভব করেছি। দেখতে কিছুই পাইনি। তবে হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি অনেক কিছু। আর তুমি যা জানতে চাইছ, সেই ভূতের কোনও হদিস পাইনি।”
“তবে যে বলছ, শব্দ পেয়েছ, গন্ধ পেয়েছ? কীসের গন্ধ, কীসের শব্দ?”
“সে আর যাই হোক ভূত নয়। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আমি চানটা সেরে আসি। একটু চা খাওয়াবে তো? সন্দীপনরা কখন আসবে?”
“ওর আসার কোন ঠিকঠিকানা নেই। তবে আজ দাদা সঙ্গে আছে বলে যদি তাড়াতাড়ি ফেরে। দশটার মধ্যে ফিরে আসবে মনে হয়। তুমি যাও বৌদিদি, চানটা সেরে এসো, আমি চায়ের জল চাপাচ্ছি।”
বাবা আর পিসেমশাই ফিরলেন দশটা পাঁচে। আমরা সবাই খেতে বসলাম সাড়ে দশটা নাগাদ। পিসিমার রাত্রের মেনু শুনেছি রুটি, ফুলকপির তরকারি, চিকেন আর মোহনভোগ।
বাবা খাওয়া শুরু করে বললেন, “বাহ্, তোদের এখানে ফুলকপির দারুণ টেস্ট তো! কলকাতায় এমন কপি আর পাওয়াই যায় না। আর একটু দে তো! তোমাদের এখানকার থানার যা ছিরিছাঁদ দেখলাম, কলকাতা থেকে এত ছোটো থানাতে তোমাকে হঠাৎ বদলি করল কেন?” শেষের কথাটা বাবা পিসেমশাইকে বললেন।
“জরুরি একটা কাজের জন্যে কলকাতা অফিস আমাকে কয়েক মাসের জন্যে পাঠিয়েছে। কিন্তু যে-কাজের জন্যে আমার আসা, সে-কাজ করার মতো এই থানায় কোনও ব্যবস্থাই নেই। অলরেডি ছ’মাস হয়ে গেল। তেমন কিছুই করে উঠতে পারলাম না।”
“জরুরি কাজটা কী? সিক্রেট?”
“সিক্রেট তো বটেই। তবে আপনাকে আর না বলার কী আছে? এই এলাকা দিয়ে নাকি প্রচুর বিদেশি অস্ত্রশস্ত্র পাচার হয়। সেটাকে ট্র্যাক করে আটকানো।”
“পাচারের মেন রুট কি এই জলঙ্গী নদী?” মা জিজ্ঞাসা করলেন।
“ঠিক বলেছেন বৌদি। ডিফেন্স রিপোর্ট তাই বলছে। জলঙ্গী শুরু হয়েছে সেই মুর্শিদাবাদের কাছে পদ্মা থেকে আর মায়াপুরে এসে হুগলিতে মিশেছে। লম্বায় প্রায় ৫৬ কিলোমিটার। দু-পাশে কম শহর আর গ্রাম আছে? আমাদের এই থানায় যা লোকজন আর ব্যবস্থা, এ প্রায় খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার অবস্থা!”
“এখনও পর্যন্ত কিছুই হদিস করতে পারোনি?” বাবা জিজ্ঞাসা করলেন।
“একদম কিছুই হয়নি তা নয়, তবে সে তেমন কিছু নয়—পর্বতে মূষিক।”
“জলঙ্গীতে ছোটোখাটো নৌকো চলে তো, ফেরি নৌকো ছাড়াও?” মা জিজ্ঞাসা করলেন।
“তা তো চলেই। নৌকো চেক করেই দু-একটা থেকে জং ধরা দিশি পিস্তল উদ্ধার করেছি। কিন্তু বিদেশি অস্ত্র একটাও নয়।”
“নৌকো চেক করার সময় নৌকোর বাইরেও চেক করো?” মা জিজ্ঞাসা করলেন।
“বাইরে মানে?” পিসেমশাই জিজ্ঞাসা করলেন।
মা খেতে খেতে বললেন, “বাইরে মানে, নৌকোতে রইল না, কিন্তু রশিতে বেঁধে নৌকো থেকে ঝুলিয়ে দিলে বস্তা রইল জলের তলায়। রশির টানে বস্তা চলতে লাগল নৌকোর সঙ্গে।”
পিসেমশাই খুব অবাক হয়ে খাওয়া থামিয়ে দিলেন। বললেন, “ব্রিলিয়ান্ট! এরকম তো হতেই পারে। এরকম ভাবিনি তো!”
“কিন্তু জলে ভিজে নষ্ট হবার ঝুঁকি থাকছে না?” বাবার প্রশ্নে একটু সন্দেহ।
“জলে থাকলেও জলে ভিজবে কেন? আমরা এখন প্লাস্টিকের যুগে রয়েছি। প্লাস্টিকের ব্যাগে বা কন্টেনারে ভরে মুখটা সিল করে দিলেই হল।” মা সহজ উপায় বলে দিলেন।
“সমরেশদা, বৌদি একদম ঠিক বলেছেন। মনে হচ্ছে মোক্ষম ক্লু পেয়ে গেছি। এবার সন্ধান পেয়ে যাব।”
কিছুক্ষণ কেউ কথা বললেন না। পিসিমা সরল-সাদা মনের মানুষ। এত জটিল ব্যাপার-স্যাপার বোঝেন না। তিনি এতক্ষণ বিরক্ত হচ্ছিলেন। সকলে থামতে পিসিমা বললেন, “দাদা-বৌদিদি এসেছে, কোথায় মন খুলে দুটো কথা বলব। তা নয়, খালি চোর-জোচ্চোর-ডাকাতদের কথা। তোমরা আসার আগে বৌদিদি আর জ্যোতি কী কাণ্ড করে এসেছে জানো?”
“পুলিশের সঙ্গে থাকবে আর চোর-ডাকাতের গল্প শুনবে না, তা হয় নাকি? কিন্তু এইটুকু সময়ে বৌদি আবার কী করে ফেললেন?” পিসেমশাই হাসতে হাসতে বললেন।
পিসিমা বললেন, “বৌদিদি আর জ্যোতি এই রাতের বেলা দে চৌধুরীদের ভিটে থেকে ঘুরে এল একটু আগে!”
“সে কি! বৌদির কি ভূতেও কৌতূহল আছে নাকি?”
পিসেমশাইয়ের কথায় মা হেসে ফেলে বললেন, “একদমই না। আমার কৌতূহল মানুষ নিয়েই। মানুষের মতো এমন বিচিত্র জীবকে ছেড়ে অন্য কোন অশরীরী প্রাণীর প্রতি আমার এতটুকুও আগ্রহ নেই। বিকেলের দিকে ঊষারা জ্যোতিকে নিয়ে দে চৌধুরীদের ভিটেতে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে ওরা কয়েকটা ছবি তুলেছিল। তার মধ্যে তিনটে ছবি দেখে আমার খুব সন্দেহ হল। ঊষা, খেয়ে উঠে বাবাকেও ছবিগুলো দেখাস তো মা।”
পিসেমশাই ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আর সেই সন্দেহ নিরসনের জন্যে আপনি পুঁচকে ছেলেকে নিয়ে ওখানে চলে গেলেন। আপনি তো সাংঘাতিক মানুষ বৌদি! কিন্তু সন্দেহটা কী?”
মা উত্তর দিলেন, “দে চৌধুরীদের বাড়ির ঊষা যখন ছবি তুলেছিল, তখন দিনের আলো নেই বললেই চলে। ও ফ্ল্যাশ ইউজ করেছিল। সেই আলোয় দোতলার জানালায় কিছু একটা ঝিলিক দিচ্ছিল। আমার সন্দেহ ওটা চশমার কাচ। ঊষাদের ও-বাড়িতে ঢুকতে দেখে কেউ একজন জানালার কোণ থেকে উঁকি দিচ্ছিল। ওরা বাচ্চা বলে কিছু বলেনি, জাস্ট লক্ষ রাখছিল।”
পিসেমশাই চমকে উঠে বললেন, “তাই? আপনি যে গেলেন, চশমাওলা লোকটাকে দেখতে পেলেন?”
মা বললেন, “চশমা কিংবা চশমা পরা লোকটা কোনও ব্যাপার নয়। আমার মনে হয়েছিল, অত পুরোনো বাড়িতে সন্ধের অন্ধকারে কী করছিল লোকটা? একটু ঝোল দিও তো শিল্পী, দারুণ রেঁধেছ কিন্তু চিকেনটা। ও-বাড়িতে যদি কেউ থেকে থাকে, সে লুকিয়ে লুকিয়ে লক্ষ রাখছিল কেন? তাও তিনটে বাচ্চা ছেলেমেয়ে দেখে? এহ্-হে, আবার চিকেন দিয়ে দিলে?”
“সেই থেকে বকে চলেছ বৌদি। কিছুই তো খাচ্ছ না। আর একটা রুটি দিই?”
মা হেসে ফেললেন।—“তোমাকে ঠেকানো আমার কম্মো নয়। দাও, কিন্তু একটাই দেবে। আমি আর ভুটকু গিয়ে চশমাওলা লোকটাকে পাইনি, পাওয়ার কথাও নয়। তবে যা বুঝেছি, আগামীকাল রাত্রে তোমার দলবল নিয়ে রেড করলে, আমার ধারণা, তুমি যা খুঁজছ তা পেয়ে যাবে। মাটির তলায়।”
পিসিমা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “মাটির তলায় কী পাবে গো বৌদি?”
“বৌদি, কী দেখলেন বলুন না।” পিসেমশাইও উত্তেজিত হয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করলেন।
মা হাসতে-হাসতেই বললেন, “দাঁড়াও সন্দীপন, দাঁড়াও। শিল্পীর রান্নাটা একটু মন দিয়ে খেতে দাও। এত ভালো রান্না বহুদিন খাইনি।”
“ঠিক বলেছ বৌদি। পুলিশের লোকের এই এক দোষ, সবসময়েই জেরা!” পিসেমশাইকে খোঁটা দিয়ে পিসিমা বললেন। বাবা, মা এমনকি পিসেমশাইও হাসতে লাগলেন হো হো করে।
৫
গতকাল রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর আমাদের শুয়ে পড়তে হয়েছিল। অতএব বাবা-মা, পিসিমা-পিসেমশাই ক’টা অবধি এবং কী আলোচনা করেছিলেন, আমার জানা নেই। আজকেও আমাদের তাড়াতাড়ি খাইয়ে শুতে পাঠানোর ষড়যন্ত্র চলছিল। কিন্তু আমি আর ঊষাদিদি তীব্র প্রতিবাদ করলাম। শেষ অবধি একটা আপস হল—আমরা খেয়ে নেব, কিন্তু পিসেমশাই না ফেরা পর্যন্ত শুতে যাব না। পিসেমশাই সন্ধে নাগাদ বেরিয়ে গিয়েছেন। ফিরতে ক’টা হবে কে জানে! আজ রাত্রে দে চৌধুরীদের ভিটেয় হানা দেওয়ার এই প্ল্যানটার পিসেমশাই নাম দিয়েছেন—মিশন চশমা। কারণ, আমাদের ছবিতে চশমার ঝিলিকের সূত্র ধরেই পুরো ঘটনাটা ঘটছে।
দশটার মধ্যেই আমরা খেয়ে নিয়ে সোফায় বসে টিভিতে অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট দেখছিলাম। বাবাও গম্ভীর মুখ করে টিভি দেখছেন। মা আর পিসিমা পাশাপাশি বসে নিজেদের মধ্যে নীচু গলায় কথা বলে চলেছেন। সাড়ে দশটা নাগাদ তূষ ঢুলতে লাগল। তাই দেখে পিসিমা খুব রেগে গেলেন।—“তখনই বললাম, শুতে যাও। বড়োদের সঙ্গে শুধু পাকামি করবে!”
তূষ কাঁচুমাচু মুখ করে বসেই রইল। মা তূষকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “আমার কোলে মাথা রেখে বোস তো তূষ। তোর বাবা এলে আমি ডেকে দেব, ভাবিস না।”
এগারোটা নাগাদ পিসিমার মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠতে আমরা সকলেই চমকে উঠলাম। তখনই খেয়াল করলাম, বসার ঘরে আমরা পাঁচজন বসে আছি, সকলেই টিভির দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু কেউই কোনও কথা বলছি না, কেউই টিভি দেখছি না। পিসিমা ফোন ধরলেন। ওঁর কথাগুলোই আমরা শুনতে পেলাম।—“হ্যাঁ, বলো। কোথায় তুমি? যাক বাবা, সবই মা দুগ্গার আশীর্বাদ। কালকেই আমি বৌদিকে নিয়ে কালীবাড়ি যাব পুজো দিতে। বলো কী? এত্ত? কী সর্বনাশ! তাই নাকি? অ্যাই, কখন দেখাবে গো? শোনো দেরি কোরো না। আধঘণ্টা? ঠিক আছে। আমরা সবাই তোমার জন্যে ওয়েট করছি। হবে না? হুঁ হুঁ, কার বৌদি দেখো, সাবধানে এসো।”
পিসিমা ফোনটা অফ করতে আমরা সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। পিসিমা, মা, বাবা—সকলেরই মুখে হাসি। ঊষাদিদি আর আমি হাতে হাতে তালি দিয়ে বললাম, ইয়ো! পিসিমা আনন্দে ভালো খবরটা কীভাবে শুরু করবেন ভাবছিলেন। মা পিসিমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কাজ-টাজ সেরে সন্দীপন এইমাত্র দে চৌধুরীদের ভিটে থেকে রওনা হচ্ছে। মিশন চশমা দারুণ সাকসেসফুল হয়েছে। প্রচুর হাতিয়ার সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করতে পেরেছে। টিভি চ্যানেলে থেকে লোকজন এসেছে, তারা সন্দীপনের ইন্টারভিউ নিয়েছে। সন্দীপন এখন থানায় যাচ্ছে, সেখানে কিছু ফর্ম্যালিটি সেরে বাড়ি আসছে। সন্দীপন আমাকে অনেক থ্যাংকস জানিয়েছে।”
পিসিমা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “অ্যাই বৌদি, তুমি নিশ্চয়ই সব শুনতে পেয়েছ, না? কী করে শুনলে? স্পিকার তো অন ছিল না!”
“না গো শিল্পী, তোমার কথা শুনে আন্দাজ করলাম। কোন চ্যানেলে কখন দেখাবে, সেটা তো জানি না, সেটা বলো। ঊষা জঙ্গলের বাঘ-সিংহ ছেড়ে তোর বাবাকে দেখ মা। তোর বাবাও কি কম সিংহ নাকি? অ্যাই তূষ, উঠে পড়, তোর বাবাকে দেখ টিভিতে দেখাচ্ছে!”
ঊষাদিদি চ্যানেল সার্ফ করে ‘তাজা বার্তা’ চ্যানেলটা চালু করল। সেখানে এইমাত্র খবরটা চালু হয়েছে। ব্রেকিং নিউজ! তোমরাও সবাই নিশ্চয়ই দেখেছ সেই খবরটা? সেই যে, প্রথমেই দেখাল আমার পিসেমশাই শ্রী সন্দীপন লাহিড়িকে। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখাল দে চৌধুরীদের ভিটে, সেই সুড়ঙ্গে যাবার সিঁড়ি, জেনারেটর, সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে গিয়ে দুটো বড়ো বড়ো আলো ঝলমলে ঘরের মধ্যে সাজিয়ে রাখা প্রচুর বিদেশি অস্ত্রশস্ত্র! তারপর দেখাল ধরা পড়ে যাওয়া জনা দশেক লোক। আর আশ্চর্য, তাদের মধ্যে সত্যি-সত্যিই একজনের চোখে দেখলাম চশমা!
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী