বড়ো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
বড়ো গল্প
রণিত ভৌমিক
আন্দামান নামটা শুনলেই মাথায় আসে কালাপানি, সেলুলার জেল আর অচেনা সবুজ দ্বীপের কথা। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বাঙালির মন সবসময় নতুন ডেস্টিনেশন খোঁজে। যদিও-বা আন্দামান এখন আর ভ্রমণপিপাসুদের কাছে তেমন নতুন কিছু নয়। তবুও ওখানকার এমন অনেক রহস্য রয়েছে, যা মানুষের কাছে আজও অজানা।
হ্যাঁ, আমাদের গল্পটা আন্দামান বা তার সংলগ্ন দ্বীপের রহস্যের দিকে যাওয়ার আগে আমার বা আমাদের কথা কিছু বলি। বাঙালিদের কাছে দুর্গাপুজো এমন একটা উৎসব যেটা বহু বিচ্ছিন্ন বাঙালি পরিবারকেই একসঙ্গে মিলিয়ে দেয়। সারাবছর যে-সমস্ত পরিবারের সদস্যদের দেখা পর্যন্ত হয় না, তাদেরও মিলিয়ে দেয় এই দুর্গাপুজো।
উত্তর কলকাতার এমনই এক বনেদি বাড়ির ছেলে আমি ওরফে বনি। ভালো নাম তীর্থ মজুমদার। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফার্স্ট ইয়ার স্টুডেন্ট। বাড়ির সদস্যদের কথা বলতে গেলে জেঠতুতো, খুড়তুতো মিলিয়ে প্রায় বারো জনের বসবাস। অবশ্য বছরের এই একটা সময় সারাবছর যাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে শুধুমাত্র হোয়াটস-অ্যাপ গ্রুপে, তারাও এসে সামিল হয় এই মহোৎসবে। আমার কাকার মেয়ে টিনা আর বড়দা ওরফে জ্যাঠাইয়ের ছেলে বিবেক হল আমার সবচেয়ে কাছের। আমাদের তিনজনের মধ্যে যেন আলাদাই বন্ড রয়েছে সেই ছোটো থেকে। আর এই বন্ড আরও মজবুত হয়েছে আমাদের বাড়ির সবচেয়ে আদরের ছোটো ছেলে অর্থাৎ আমার ছোটো কাকার জন্য। ভালো নাম কিঙ্কর মজুমদার হলেও আমরা তাকে ‘ছোটকা’ বলেই ডাকি। জার্নালিজম নিয়ে পড়াশোনা করার পর সে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফিকে নিজের পেশা হিসাবে বেছে নেয়। ছোটকা বরাবর আমাদের একটা কথা বলে—‘We must always follow our passion. Pursuing your passion and forging a career path that revolves around the interests would definitely bring about a sense of peace and contentment.’
আমাদের ছোটকা কিন্তু বছর দশেকের মধ্যে এই শহরের বুকে বেশ পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে। ওর তোলা ছবি শহরের বিভিন্ন এক্সিবিশনে যেমন শোভা পায়, একইভাবে বিদেশের মাটিতেও ইদানীং শোভা পাচ্ছে। এবার কর্মসূত্রে ওর গন্তব্য হল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। পুজো মিটলেই ওকে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশে। আর এখানেই বেঁধেছে যত গণ্ডগোল!
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। ছোটকার সঙ্গে টিনা, আমি আর বিবেকদা এবারের ট্যুরে জুড়ে যাওয়ায় বাড়িতে বেধেছে এক তুমুল গৃহযুদ্ধ। কারণ, সেদিন সকালে জ্যাঠাই খবরের কাগজ খুলতেই লক্ষ করে তাতে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা—জারোয়াদের হাতে এক বিদেশি পর্যটকের রহস্যজনক মৃত্যু।
“মেজো বউমা, আজকের খবরের কাগজটা দেখেছ? ছোটন বাড়ির ছেলেপুলেগুলোকে নিয়ে আন্দামান যাচ্ছে না! এই দেখো, খবর বেরিয়েছে ওখানে কোন এক বিদেশি পর্যটক জারোয়াদের হাতে নিহত হয়েছে।”
ব্যস, জ্যাঠাইয়ের কথাটা মায়ের কান অবধি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই মায়ের কান্না শুরু। একটুতেই যে বড্ড টেনশন করে মা! বাড়ির মেজো গিন্নির এই এক সমস্যা। সেটা যে-কারণেই হোক না কেন।
“বাবু, তোরা যাস না! জারোয়ারা নাকি এখনও সাংঘাতিক আদিম রয়ে গিয়েছে। আর তাই ওখানে এইসব ঘটনা ঘটছে। এখনই তোদের ওখানে যাওয়ার দরকার নেই। আর তাছাড়া কলেজ খুললেই সামনে তোর পরীক্ষা।”
“মা, আমার পরীক্ষা সেই ডিসেম্বরের আগে। আর এখন সবে অক্টোবর মাস। এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তো আর একা যাব না, সঙ্গে যাবে আমাদের সবচেয়ে ভরসার লোক—ছোটকা।”
মাকে বলা আমার এই কথাটা শেষ হতে না হতেই পাশ থেকে বড়ো মা বলে উঠল, “ভালো একজনের নাম বললি বনি—ছোটন নাকি ভারি ভরসার লোক! না না, তোদের যেতে হবে না। আমি আজই বাবাকে বলব, ওঁকে বলেই এই যাওয়া ক্যানসেল করাব।”
বড়ো মার কথার উত্তরে আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। ওই মুহূর্তে ছোটকা এগিয়ে এসে বলল, “তোমাদের ছেলেপুলেগুলো আর ছোট্টটি নেই বড়ো বউদি। আর তাছাড়া আন্দামান যাওয়া মানেই জারোয়াদের খপ্পরে পড়া নয়। ওখানে সভ্য মানুষেরও সমানভাবে বসবাস রয়েছে।”
আমাদের যাওয়ার বিষয়টাকে নিয়ে গোটা বাড়ির বড়োদের মধ্যে একদল যেমন মত দিয়েছে, তেমনই আর এক দল একেবারে বেঁকে বসেছে। বিশেষ করে মায়েদের গ্রপটা, সঙ্গে অবশ্যই জ্যাঠাইও রয়েছে। তবে দশমীর দিন এর সমাধান করে দিলেন আমাদের বাড়ির মূল দুই স্তম্ভ ওরফে ঠাকুরদা ও ঠাম্মা। ওঁদের কথাতেই আমাদের যাওয়ার বিষয়টায় পাকাপাকিভাবে সিলমোহর পড়ে গেল। কিন্তু শর্ত ছিল একটাই—ভাইফোঁটার আগে ফিরতে হবে।
ঠাকুরদা আর ঠাম্মার কথা মেনে নিয়ে আমরা যাওয়ার সব প্রস্তুতি সেরে নিলাম এবং কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর পরদিন সকাল সকাল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। কলকাতা থেকে বিমান বা জলপথে আন্দামানের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার যাওয়া যায়। এখন বিমানযাত্রা সস্তা ও সময় বাঁচে তাই অনেকেই আকাশপথ পছন্দ করেন। আমরাও আকাশপথেই আন্দামানের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছলাম।
বীর সাভারকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি পোর্ট ব্লেয়ার শহর থেকে প্রায় দুই কিমি দক্ষিণে অবস্থিত। বিমানবন্দর থেকে পোর্ট ব্লেয়ারের হোটেল যাওয়ার পথে আমাদের সঙ্গী ছিল ছোটকার মুখে শোনা এই অঞ্চলের ইতিহাস।
“বুঝলি, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সব বড়ো-ছোটো মিলিয়ে মোট ৫৭২টি দ্বীপ রয়েছে। এই পোর্ট ব্লেয়ার শহরটা দক্ষিণ আন্দামানে অবস্থিত। ব্রিটিশ নৌসেনা অফিসার লেফটেন্যান্ট আর্চিবল্ড ব্লেয়ারের নামে এই দ্বীপের নামকরণ করা হয়। এটিকে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র উল্লেখযোগ্য শহর বলা হয়। আমাদের এখানে ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য পৃথক কারাগার তথা সেলুলার জেল নির্মাণ করা হয়েছিল যা আজও স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মারক হিসাবে সংরক্ষিত।”
কিঞ্চিত ছোটকাকে থামিয়ে টিনার প্রশ্ন—“আচ্ছা ছোটকা, এই জারোয়াদের নিয়ে যে বাড়ির মা-জেঠিমারা ভয় পাচ্ছিল, এরা কি হিংস্র গো? কোথায় থাকে তারা আন্দামানে?”
হাসতে হাসতে বলতে লাগল ছোটকা, “মেজো বউদির মতো তুইও একই কথা বলছিস, দেখছি। ওরে, জারোয়া জাতিগোষ্ঠী হল ভারতীয় আদিবাসীদের মধ্যে এক গোষ্টীর আদিবাসী, যাদের বসবাস আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে হলেও, জারোয়াদের জনবসতি কিন্তু মূলত আন্দামানের পশ্চিমে বন-জঙ্গলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যদিও-বা ওই গ্রেট আন্দামান ট্রাঙ্ক রোডের নির্মাণের পর থেকে জারোয়া জাতিদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে বলে শোনা যায়।”
“হ্যাঁ, আমিও বিবিসির একটা আর্টিকেলে পড়েছিলাম যে জারোয়াদের বর্তমান সংখ্যা আনুমানিক ২৫০ - ৪০০-র মধ্যে এসে ঠেকেছে। তারা মূলত বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে পারস্পরিক সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে যেহেতু তাদের সমাজ, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের বিবরণ বোধ দুর্বল। এদিকে আবার পর্যটনের প্রভাবে, তারপর চোরা শিকার ও জারোয়া বাণিজ্যিক জমি শোষণ। এই নানান কারণে ওদের মধ্যে এক অদ্ভুত হিংস্রতা দেখা যাচ্ছে। তাই না ছোটকা?”
বিবেকদার কথায় সায় দিয়ে ছোটকাকে ফের বলতে শুনলাম—“ঠিক বলেছিস, বিবেক। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ যদিও-বা দীর্ঘকাল ধরে বাইরের মানুষের কাছে পরিচিত, তবুও জারোয়ারা বাইরের মানুষের সঙ্গে কম যোগাযোগ করেছে এবং এইধরনের যোগাযোগ প্রধানত অস্থায়ী ও বিক্ষিপ্ত ছিল। ফলে, ইঙ্গিত পাওয়া জারোয়া জাতিগোষ্ঠী বিলুপ্ত জাঙ্গিল উপজাতি থেকে শতাব্দী যুগ আগে বিভক্ত হয়েও জারোয়া জাতিগোষ্ঠী কিন্তু এখনও পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়নি।”
জারোয়ার ইতিহাস শুনতে শুনতে আমার ছোটবেলার কথা বড্ড মনে পড়ছিল। এই জারোয়াদের নিয়ে নানা প্রচলিত কথা বারংবার কানে এসে। সভ্য পৃথিবীর কাছে তাদের পরিচয় ভয়াল এক রহস্যের। জারোয়ারা নাকি নরখাদক। ওরা ক্ষমাহীন, নির্দয়, নৃশংস। জারোয়ারা উলঙ্গ থাকে। আদিম মানুষের মতো তাদের চালচলন। জারোয়াদের নিয়ে ত্রাসের এই ছবিগুলি নানাভাবে আমাদের সভ্য জগতে আজগুবি গাল-গপ্প তৈরি করেছে। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার উমেশ জানাল, পোর্ট ব্লেয়ারের কিছু পরেই নাকি জারোয়া রিজার্ভ ফরেস্টের শুরু।
কথোপকথনের মাঝে আমরা কখন দু-কিমি পেরিয়ে পোর্ট ব্লেয়ারের হোটেলের সামনে এসে পৌঁছেছি, টের পাইনি। ছোটকার আগে থেকে বুক করা ওই হোটেলেই আমরা সোজা গিয়ে উঠলাম। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়েই শহরের প্রাণকেন্দ্র অর্থাৎ জমজমাট সেই আবেরদিন বাজার থেকে মাত্র ছয় কিমি দূরে নারকেল গাছে ছাওয়া স্নানের উপযোগী বিখ্যাত করবাইনস কোভ বিচ দেখতে গেলাম। সৈকতটি যেন অনেকটা বাঁকানো চাঁদের মতো।
সেদিন ছোটকা ওর ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির ক্যামেরা Lumix FZ2500-এ কাজের চেয়ে আমাদের ছবি তুলেই কাটিয়ে দিল।
পরদিন সকালে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল বারাটাং। কিন্তু হোটেলের মালিক এসে ছোটকা সহ আমাদের জানালেন—“আপ লোগ উধার নহি যা সকতে হ্যায়। পুলিশ অউর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট সে উস এরিয়া কো অভি ভি টুরিস্টকে লিয়ে রেস্ট্রিক্টেড জোন করকে রকখা হ্যায়।”
এই কথার মাঝেই আমি বলে উঠলাম, “ছোটকা, এই রেস্ট্রিকশন কি এখনও ওই বিদেশি পর্যটকের মৃত্যুর কারণে?”
ছোটকা আমার দিকে ফিরে বলল, “হুম, ওই ঘটনার জন্য জিরকাটাং চেকপোস্ট এখন কিছুদিন সাধারণ মানুষ ও পর্যটকের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে।”
“দূর! আমাদের ঘোরাটা তার মানে মাটি হয়ে গেল।” বিমর্ষ মুখে টিনার কথাটা বলা মাত্র ছোটকা ফের বলে উঠল, “ওইদিকে এখন যাওয়া যাবে না মানে তো এই নয় যে আমরা ঘুরতে যাব না। আর তাছাড়া আমি এখানে হোটেলে বসে সময় কাটাতে আসিনি। অতএব আমরা পোর্ট ব্লেয়ার সংলগ্ন আরও দুটি বিখ্যাত দ্বীপ অর্থাৎ রস ও ভাইপার আইল্যান্ড দেখতে যাব এবং সেটা এখনই।”
ব্যস, কথামতোই কাজ। হোটেলের মালিক কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের রস ও ভাইপার আইল্যান্ড ঘুরতে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিলেন এবং আমরাও বেরিয়ে পড়লাম এক আলাদা রোমাঞ্চকর পরিবেশের স্বাদ নিতে।
নারকেল গাছে ভরা পোর্ট ব্লেয়ার থেকে দু-কিমি পূর্বে অবস্থিত একদা প্রশাসনিক সদর রস আইল্যান্ড এখনও কোয়ার্টার্স, চার্চ, সমাধিস্থল, সেনা মিউজিয়াম, হাসপাতাল, টেনিস কোর্ট—এইরকম অনেক ব্রিটিশ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা একে একে সবগুলোই দেখলাম। তবে পুরোনো জেল, ফাঁসিমঞ্চের মতো বিষাদগাথায় ভরা ভাইপার আইল্যান্ড দেখে বিবেকদা আর টিনা বেশি মুগ্ধ হয়েছিল। ওখানকার এক বাঙালি পর্যটকের সঙ্গে আলাপ হওয়ায় উনি আমাদের জানালেন, তত্কালীন ব্রিটিশ রাজত্বে এই দ্বীপে মহিলা কয়েদিদের রাখা হত ও ফাঁসি কাঠে ঝোলানো হত।
আর এই বিষয়টা টিনাকে বেশ আঘাত করেছে। ওর থমথমে মুখটা যার প্রমাণ বার বার দিয়ে যাচ্ছিল, এমনকি হোটেল ফেরার পরও ওর মুখে সেটা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছিল।
আমরা ওইদিন বিকেলের মধ্যে পোর্ট ব্লেয়ারের হোটেলে ফিরে এলাম ঠিকই, কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই যে একটু অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাওয়ার জন্য আমাদের মনগুলো যেন ছটফট করছিল। ছোটকা বিষয়টা ভালোমতোই বুঝতে পেরেছিল, যার কারণে সে পরদিন সকালেই পোর্ট ব্লেয়ারের সরকারি কার্যালয় গিয়ে অনেক তোষামোদের করে আমাদের বারাটাং যাওয়ার ছাড়পত্র আদায় করতে সক্ষম হল। যদিও সেটা খুব একটা সহজ বিষয় ছিল না। কারণ, সেখানকার সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসাররা সাফ বলে দিয়েছিলেন, “উই আর সরি, মি. মজুমদার। আপনাকে আমরা গ্রিন সিগন্যাল দিতে পারছি না। ওই ঘটনার পর এখনও বারাটাংয়ের কিছু এলাকায় আভ্যন্তরীণ কোন্দল লেগে আছে। তাই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে এই মুহূর্তে ওখানে যাওয়া নট অ্যাট অল সেফ।”
ছোটকা প্রায় বন্ডে সই করার মতো সেখানকার কাগজপত্রে সই করে আমাদের যাওয়ার ছাড়পত্র জোগাড় করেছিল। এখন বারাটাং যাওয়াটা নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায়, আমাদের উত্তেজনা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেল। আর যাবে নাই-বা কেন? প্রায় দু-হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে আসা জারোয়া জাতিগোষ্ঠীর সম্মুখীন হতে চলেছি যে! যদিও তাদের দেখা মিলবে কি না, সে নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে, কারণ কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার জন্য জারোয়া রিসার্ভ ফরেস্ট এখন হাই অ্যালার্ট এরিয়া।
ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ আমরা বারাটাংয়ের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। প্রায় দু-ঘণ্টা লাগবে জিরকাটাং চেকপোস্ট পৌঁছতে এবং তারপর সেখান থেকে নীলাম্বর হয়ে বারাটাং পৌঁছব জারোয়া জাতিগোষ্ঠীর এলাকার মধ্যে দিয়ে। জিরকাটাং হল জারোয়াদের রহস্যময় জীবনে ঢোকার গেটওয়ে। চেকপোস্টের ও-পাশেই সেই প্রাগৈতিহাসিক অরণ্যে ঘেরা জগৎ। চেকপোস্ট থেকে যখন গাড়ি এগোতে লাগল, তখন চোখে পড়ল সামনে এবং পিছনে রয়েছে একটি করে পুলিশের ভ্যান। ছোটকা বলতে শুনলাম, “পুলিশের ভ্যান দেখে তোদের মনে প্রশ্ন জাগছে, বুঝতেই পারছি। ওরে, ওটা হল আমাদের সেফটির জন্য। বলা তো যায় না জারোয়ারা হুট করে আক্রমণ শানাতে পারে।”
আকাশে তখনও সেভাবে রোদ ওঠেনি। রাস্তার দু-পাশের জঙ্গল কেমন ভেজা ভেজা। পাহাড়ি সর্পিল পথে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। রাস্তার হাল খুব ভালো নয়। দু-পাশের আকাশছোঁয়া কালচে, শ্যাওলাধরা বৃষ্টি অরণ্য। ভোরের আলোয় নাকে আসছে বিচিত্র সোঁদা গন্ধে পৃথিবীর আদিম রহস্যময়তা। আমাদের গাড়ি যত এগোচ্ছে, ততই ভাবনারা ডানা মেলছে। কেমন অবাক লাগছে ভাবলে যে প্রায় ২০০০ বছর আগে আফ্রিকা থেকে আসা এই জাতিগোষ্ঠীর আমরা সম্মুখীন হতে চলেছি। গাড়ির ড্রাইভার বার বার স্মারণ করিয়ে দিচ্ছিল এই বলে—“গাড়ির জানালার কাচ নামাবেন না বাবুরা। কোনও জারোয়া যদি গাড়ির কাছে চলে আসে, তাদের যেন আবার কোনও খাবার দিতে যাবেন না। ইধর ওইসব কাম করা যায় না। সরকার নে মনা কিয়া হ্যায়।”
আর যেটা বলল, অতি অবশ্যই যেন কোনও ছবি তোলার চেষ্টা না করি। হ্যাঁ, এটাই নাকি নিয়ম এই জারোয়া রিসার্ভ ফরেস্টের।
এছাড়াও ওর মুখে শুনলাম—“বাবুরা, আপনারা জেনে রাখুন, এই বারাটাংকে মিডল আন্দামান জেলার রানি বলা হয়। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে লগভগ ১০০ কিমি দূরে এই বারাটাং। জলপথ বা সড়ক—দু-পথেই আসা যায় এখানে।”
ম্যানগ্রোভ ঘেরা খাঁড়ি পথ বেয়ে, অসংখ্য গাছের ডাল মাথার উপরে নিয়ে এগিয়ে চললাম। প্রকৃতির রূপে উদাস হলে চলবে না। আমরা অ্যাডভেঞ্চার আর অশেষ উত্তেজনা নিয়ে প্রায় দু-ঘণ্টার যাত্রা শেষে বারাটাং দ্বীপের মাড ভলকানোর নিকটবর্তী স্থানে এসে পৌঁছলাম।
ভারতের একমাত্র মাড ভলকানো এই দ্বীপেই আছে। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘জলকি’ নামে পরিচিত। ছোটকা যেহেতু সরকারি কার্যালয় থেকে ছাড়পত্র নিয়ে এসেছিল, সুতরাং একজন অফিসার নাম অবিনাশ শর্মা আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন। অবিনাশবাবু স্থানীয় লোক হলেও পেশাগত কারণে ভালো বাংলা বলতে পারেন। অবশ্য তাঁর পৈতৃক ভিটে কলকাতায়। আমরা তাঁর কাছ সেই স্থান সম্পর্কে নানান তথ্য জানতে পারলাম। তাঁর কথা অনুযায়ী, মাটির তলার বিভিন্ন জৈব পদার্থ ক্ষয় হয়ে যে গ্যাস নির্গত হয়, সেটাই হচ্ছে মাড ভলকানো। গত ২০০৫ সালে এখানে শেষ অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে। তার আগেরটি ঘটেছিল ২০০৩ সালে। এখানে মাটিতে সামুদ্রিক পলির বিভিন্ন শিলা টুকরো আছে। এছাড়া বেলে পাথর, লাল ও সবুজ রঙের কর্দম শিলা, কোয়ার্টজ ক্যালসাইট ইত্যাদি জৈব গ্যাসের দ্বারা উপরদিকে ঠেলে উঠে আসে এবং জমির উপর জমা হয় আর শক্ত হয়ে যায়।
এই সকল তথ্য শোনার ফাঁকে আমরা বেশ কয়েকটা নিজেদের মধ্যে ছবি তুলে নিলাম এবং ছোটকাও নিজের পেশাগত কাজটি যথাযতভাবে পালন করতে লাগল। এরপর আমরা আবার বারাটাং জেটি ঘাটের দিকে অগ্রসর হলাম, কারণ আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থান হল এখানকার লাইমস্টোন কেভ অর্থাৎ চুনাপাথরের গুহা—এই এলাকার হল মূল আকর্ষণ। বলে রাখা ভালো যে এখানেই কিছুদিন আগে সেই ঘটনা ঘটেছিল বলেই স্থানীয়দের ধারণা।
স্টিমারে করে যেতে যেতে সেই অবিনাশবাবুর কাছে জানতে পারলাম যে গোটা আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে মোট ১১টি এইরকম মাড ভলকানো আছে। যার মধ্যে ৮টি রয়েছে এই বারাটাং-এ।
আমরা ধীরে ধীরে ম্যানগ্রোভে ঘেরা সেই জঙ্গলের যেন আরও গভীরে ঢুকে চলেছি। একটু সুন্দরবন সুন্দরবন অনুভূতি হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে এখানকার একটাই তফাত। হ্যাঁ, বিবেকদা সেটা অবশ্যই টিনা আর আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল—“সুন্দরবনের মতো মনে হলেও, ওখানে কিন্তু স্রেফ বাঘের ভয় ছিল আর এখানে জংলি জানোয়ারের সঙ্গে রয়েছে জারোয়াদের হামলার আতঙ্ক।”
আর এই কথাটা বলতে না বলতেই ওই স্টিমারে থাকা একটা লোক হঠাৎ করে চেঁচিয়ে উঠল—“হট যাইয়ে, হট যাইয়ে!” আমরা শুনে তাড়াহুড়ো করে সরতে না সরতেই দেখি দূর থেকে একটা ধারালো তিরের মতো অস্ত্র ঝড়ের গতিতে এসে স্টিমার চালকের বুকে বিঁধল এবং সে সঙ্গে সঙ্গে অচেতন হয়ে পড়ল। ওই অবস্থায় তাকে শুশ্রূষা করব কী, সেটা বুঝে ওঠার আগেই আবারও তিরের ঝড় ধেয়ে এল আমাদের দিকে। কোনোক্রমে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে আমরা যতটা সম্ভব শুয়ে স্টিমারের বিমগুলোয় নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করলাম। ওই মুহূর্তে আমার মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছিল। এই ভয়ের আশঙ্কাটাই বুঝি করছিল মা।
খানিকক্ষণ পর সেই তির বৃষ্টি থামতে আমরা একটু মাথা তুলে তাকাতেই চোখে পড়ল, বেশ কয়েকটি জারোয়া হাতে তাদের প্রত্যেকের রয়েছে তির আর ধনুক। মহিলাদের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। ছেলেদের কোমরের নীচে লাল রঙের কাপড় জড়ানো। তবে যে শুনেছিলাম জারোয়ারা উলঙ্গ থাকে!
পাশে থাকা অবিনাশবাবুকে উত্তরে বলতে শুনলাম—“ওসব আগে ছিল। এখন ওরা অনেক স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে।”
তাঁর কথা শেষ না হতেই আবার সামনে একঝাঁক কালো ছোটো চুলের দম্পতি নজরে এল। তবে এদের কিন্তু অতি আধুনিক জারোয়া বলতে হবে। কারণ, মহিলা জারোয়াটির শরীর ঢাকা রয়েছে আমাদের সভ্য সমাজে ব্যবহৃত একটি নাইটি জাতীয় পোশাক। আর পুরুষ জারোয়াটির পরনে রয়েছে আমাদের ঘরে পরার মতো বারমুডা বা ছোটো প্যান্ট।
স্টিমারের মোটর বন্ধ করতে বাধ্য হল আমাদের সঙ্গে থাকা আর একজন মাঝি। তখন জলের দু-পাশের জমিতে হিংস্র প্রাণীর মতো তির-ধনুক হাতে জারোয়ারা দাঁড়িয়ে আর আমরা জলের ওপর ওই স্টিমারে ভেসে ভেসে এগিয়ে চলেছি। জানি না কোন পাড়ে এই স্টিমার গিয়ে দাঁড়াবে, সেখানে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।
কিছুক্ষণ পর অবিনাশবাবুকে ওই মাঝির উদ্দেশে বলতে শুনলাম—“মোটর অভি চালু করো। উও লোগ অভি দিখাই নহি দে রহা হ্যায়।”
কথামতো সেই মাঝি আবারও মোটর চালু করল এবং মোটর ঘোরার শব্দ ফের একবার কানে আসতে লাগল। লক্ষ করলাম, দু-পাশে তখন সবুজে ঘেরা জঙ্গল ছাড়া আর কিছু নেই। সেই মানুষগুলোর আর টিকিটিও দেখা যাচ্ছিল না। এরপর আহত লোকটির শুশ্রূষা করতে করতে অবিনাশবাবুকে আমাদের উদ্দেশ বলতে দেখলাম—“দেখলেন, এরাই হল জারোয়া উপজাতি। বর্তমান সময়ে পাচারকারীরা যেভাবে সংরক্ষিত জারোয়া উপজাতিদের এলাকায় অবাধে ঢুকে পড়ছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।”
“কিন্তু জারোয়াদের জন্য সংরক্ষিত অঞ্চলে চোরা শিকার একটি কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এটা তো আইন করা আছে।”
আমার এই কথার উত্তরে তাঁকে বলতে শুনলাম—“বনি-ভাই, তুমি হাসালে। চোরা শিকারিরা আবার আইন মানে নাকি? সি টার্টল বা সামুদ্রিক কচ্ছপ পাচার এখানে সবচেয়ে বেশি হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এই চোরাই কচ্ছপ বা তাদের দেহের বিভিন্ন অংশ চড়া দামে বিক্রি হয়। জারোয়ারা অনেক সময় বাধা দিতে বিভিন্ন সময় তাদের হুমকি দেওয়া দেয় এবং কয়েকজনকে তো নৃশংসভাবে পুড়িয়ে খুন করা হয়েছে। পোর্ট ব্লেয়ারে গিয়ে খোঁজ নিলে জানতে পারবে, এইরকম কত কেস এখনও তোমাদের কলকাতা হাইকোর্টে বিচারাধীন অবস্থায় পড়ে রয়েছে।”
“এইবার বুঝলাম কেন এরা বাইরের মানুষ দেখলেই আক্রমণ করছে।”
বিবেকদা কথাটা বলামাত্র সেই কথায় সায় দিয়ে ছোটকা বলে উঠল, “হ্যাঁ, কিন্তু কয়েক বছর আগে এমনটা ছিল না রে। বাইরের লোকেদের সঙ্গে জারোয়ারা ক্রমশ মিশতে শুরু করেছিল। জারোয়া জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে বাইরের মানুষের যোগাযোগ অনেক ভালো হয়ে গেছিল। আন্দামান ট্রাঙ্ক রোডের মাধ্যমে এদের নিকটবর্তী হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও কিছু জারোয়া সভ্য হয়েছে, তাদের ছেলেমেয়েদেরকে নিকটবর্তী স্কুলে ভরতিও করানো হয়েছে।”
আমরা কথা বলতে বলতে পাড়ে এসে উপস্থিত হলাম। এখনও মোটামুটি এক কিমি আমাদের পায়ে হেঁটে চুনাপাথরের গুহায় পৌঁছতে হবে—জানালেন অবিনাশবাবু। তাঁর কথা এবং পথ অনুসরণ করে আমরা এগোতে লাগলাম ওই ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে।
আমরা প্রায় যখন এক কিমি পথ অতিক্রম করে চলে এসেছি, ওই মুহূর্তে অবিনাশবাবু কিছু পাথরের চাঁই দেখিয়ে বললেন, “দেখো সবাই, লাইমস্টোনের ফর্মেশন এখান থেকেই শুরু। আমরা গুহার একেবারে সামনে এসে গেছি।”
হাঁটতে হাঁটতে টিনা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “রাস্তাটা বড্ড উঁচুনীচু রে বনি। এখানে ঠাকুরদা আর ঠাম্মা এলে একেবারেই শেষ অবধি পৌঁছতে পারত না।”
“ঠাকুরদা আর ঠাম্মার কথা ছাড়, আমরা পৌঁছতে পারলেই হল। আমার চিন্তা হচ্ছে ওই জারোয়াদের নিয়ে। কয়েকজন যদি এখানে হামলা করে বসে, তাহলে তো আর রক্ষা নেই।”
আমার কথাটা শুনতে পেয়েছিল ছোটকা। তাই তো ওকে বেশ গম্ভীর গলায় বলতে শুনলাম—“মনে যখন এত ভয়, তখন না এলেই পারতিস বনি। তুই এত ভিতু আগে জানলে আনতাম না তোকে। পোর্ট ব্লেয়ারের হোটেলে বসেই দিনটা কাটাতে পারতিস।”
“আহা, রাগ করছ কেন ছোটকা? আমি তো এমনি টিনাকে কথার কথা বলছিলাম।”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই বিবেকদা পাশ থেকে হেসে উঠল—“ও, তাই বুঝি? হা-হা-হা!”
এইভাবে প্রায় আরও কিছুটা পথ হেঁটে আসার পর আমরা অবশেষে একটা গুহার সামনে এসে উপস্থিত হলাম। অবিনাশবাবু সেটার প্রবেশদ্বার দেখিয়ে বললেন, “এটাই হল লাইমস্টোন কেভ।”
যেহেতু এই এলাকাটা কয়েকদিন ধরে সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা ছাড়া সেখানে আর কোনও মানুষের সামান্য চিহ্নটুকুও নেই। স্রেফ রয়েছে বলতে গেলে সামনে এগিয়ে চলা সংকীর্ণ পাথুরে পথ। দু-পাশে বিশাল আকৃতির দেওয়াল। ছোটকার সঙ্গে থাকা টর্চের স্বল্প আলোয় মনে হবে সেই দেওয়াল যেন নীলাভ বর্ণ ধারণ করেছে। অবিনাশবাবুর কাছে জানলাম, দু-পাশের এই পাথরের দেওয়াল ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। একটু একটু করে বেড়েই চলেছে এই গুহা। নীচের পাথরগুলোতে মানুষের হাত পড়ে যাওয়ার ফলে তাদের মৃত্যু ঘটেছে আর কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে।
ছোটকা জানাল—“তোরা জেনে রাখ, এই গুহার ষাট শতাংশ পাথরের ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে। বাকি চল্লিশ শতাংশের জীবনের ব্যাপারে আমাদের তাই অধিক সতর্ক থাকতে হবে। অর্থাৎ কোনোভাবেই দেওয়ালে হাত দেওয়া যাবে না।”
“আপনি তো দেখছি মশাই, আমাদের সিনিয়র চৌধুরীজির থেকেও এক কাঠি ওপরে।”
ছোটকার কথা শুনে অবিনাশবাবুর এইরূপ মন্তব্য করায়, ছোটকা ওঁর উদ্দেশে বলল, “দেখুন অবিনাশবাবু, প্রকৃতির দান আমরা যদি যত্ন না করি, তাহলে কে করবে বলতে পারেন? আর তাছাড়া এই সমস্ত জিনিস হল আমাদের দেশের সম্পদ। তাই বিয়িং অ্যান ইন্ডিয়ান, ইটস আওয়ার ডিউটি টু প্রিসার্ভ ইট।”
ছোটকা সতর্ক করেছিল ঠিকই, তবুও সংকীর্ণ পথে টালমাটাল আমি একবার হাত রেখে ফেলেছিলাম সে দেওয়ালে। মনে হল কী একটা নরম চটচটে জিনিসে হাত লাগল। পরক্ষণেই ছোটকার কথা মনে পড়ে গেল। মন বড়ো বিমর্ষ হয়ে গেল। আহা রে, আজ থেকে ওই পাথরটি স্থবির হয়ে যাবে। জীবন্ত পাথরগুলো নরম প্রকৃতির। পাথুরে কাঠিন্যের উপমা অন্তত তার ক্ষেত্রে চলবে না।
আমরা অবিনাশবাবুকে অনুসরণ করে গুহার আরও ভিতরে ঢুকলাম। অন্ধকার যেন আরও গভীরভাবে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। গুহায় আরও কিছুটা পথ এগোতেই হঠাৎ কারা যেন আমাদের মুহূর্তের মধ্যে ঘিরে ফেলল। এই অবস্থায় আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই লক্ষ করলাম, অবিনাশবাবু ছোটকার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “কলকাতা থেকে আমি প্ল্যান করে আসছি কীভাবে এখানকার প্রাকৃতিক চুনাপাথরের মূর্তিগুলো লোপাট করব। এত বড়ো বড়ো চুনাপাথরের মূর্তি বিদেশের মার্কেটে অনেক ভ্যালু, মি. ফটোগ্রাফার।”
“মানে, আপনি সরকারি দফতরের লোক নন? আমি কিছুই ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছি না অবিনাশবাবু!”
কথাটা ছোটকা বলামাত্র তাঁকে হাসতে হাসতে বলতে শুনলাম—“ওই সরকারি চাকরি করে আর কতটুকু মাইনে পাই বলুন, এইসব কাজ তাই করতেই হয়। হা-হা-হা!”
এই শুনে উত্তেজিত হয়ে বিবেকদা বলে উঠল, “আপনি দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।”
“লজ্জা? কার, আমার? হা-হা-হা!” হাসতে হাসতে তাঁকে বাকি লোকগুলোকে নির্দেশ দিতে দেখলাম—“ইন লোগোকো অভি গুফা কে অন্দর বাঁধ কে রকখো। অউর কাম হো যানে কে বাদ সবকো মার দে না।”
এই বলে অবিনাশবাবুকে বাইরে বেরিয়ে যেতে দেখে ছোটকা চেঁচিয়ে উঠল—“অবিনাশবাবু, এইভাবে আপনি জিততে পারবেন না। ভগবান আছেন, উনি এর সঠিক বিচার করবেন।”
পিছন থেকে ছোটকার বলা কথাগুলো শুনে উনি দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং ফের ঘুরে এসে ছোটকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, “ভগবান আছেন বলেই এত সহজে আমার পরিকল্পনাটা আজ সফল হতে চলেছে, মি. মজুমদার। ওই ঘটনার পর এই এলাকায় দলবল নিয়ে ঢোকা আমার একার পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। সুতরাং আপনার এই ফরমান নিয়ে আসা এবং আমাকেই আপনাদের সঙ্গে আসার এই দায়িত্ব দেওয়া—সবটাই আমি মনে করি ভগবানের ইচ্ছা। আর তাই এখানকার সমস্ত চুনাপাথরের মূর্তি না সরানো অবধি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন।”
“আপনি ভুল করেছেন। দেশের সম্পদ এইভাবে বাইরে চালান করে দেওয়া সঠিক কাজ নয়। আর তাছাড়া এইসব মূর্তি হল প্রকৃতির দান। এই আপনাদের মতো মানুষের জন্যই হয়তো ওই পর্যটককে মরতে হয়েছে জারোয়াদের হাতে। ওদের কী দোষ, ওরা দেখে আসছে আপনাদের মতো কিছু ছলকপট ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য এইরূপ কাজ করে চলেছেন।”
“বেশি কথা বলবেন না মি. মজুমদার, নইলে এখনই এদের নির্দেশ দেব আপনার সঙ্গে থাকা বাকি ছেলেমেয়েগুলোকে গুম করে দিতে। কালাপানির জঙ্গলে নিমেষের মধ্যে এরা কপ্পুরের মতো উবে যাবে।”
ছোটকা আর অবিনাশবাবুর ওই বাকবিতণ্ডার মাঝে যখন তাঁর সঙ্গে থাকা লোকগুলো চুনাপাথরের বড়ো বড়ো মূর্তির রূপ নেওয়া চাঁইগুলো ভেঙে নামাতে যাবে, এমন সময় লক্ষ করলাম গুহার সিংক-হোল দিয়ে কারা যেন মুখে কীসব—লোলা-পালা, ঝালা-পালা, হু। লোলা-পালা, ঝালা-পালা, হু। লোলা-পালা, ঝালা-পালা, হু—আওড়াতে আওড়াতে উপর থেকে এক এক করে ঝাঁপ দিয়ে নেমে আমাদের সকলের সামনে এসে দাঁড়াল। বল্লম হাতে প্রায় অর্ধনগ্ন বলা যেতে পারে। ছেলেগুলোর কোমরের নীচে সেই একই ধরনের লাল রঙের কাপড় জড়ানো লক্ষ করলাম। আর মুখে কেমন আওয়াজ করতে করতে তারা এগিয়ে এল আমাদের দিকে। বুঝতে পারলাম, এরাই হল আন্দামানের সেই জারোয়া উপজাতি।
রিভার্স প্যাটার্ন লোটাস বাড, শিবলিঙ্গের মতো চুনাপাথরের মূর্তিগুলো যে-মুহূর্তে অবিনাশবাবুর দলের লোকগুলোকে ওরা সরাতে দেখল, অমনি ওদের ওপর তারা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল বল্লম হাতে এবং দু-পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল।
চোখের সামনে সেই ভয়ংকর দৃশ্য দেখে আমরা তো হতবাক হয়ে গেছিলাম। একজায়গায় একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ছোটকা অবশ্য আমাদের মধ্যে ব্যতিক্রম। নিজের তাৎক্ষণিক বুদ্ধি প্রয়োগ করে সে তার নিজের ক্যামেরায় সমস্ত ঘটনাটাই ক্যামেরাবন্দি করতে সক্ষম হয়েছিল।
অবিনাশবাবু-সহ ওঁর লোকেরা জারোয়াদের আচমকা হামলায় আহত অবস্থায় তখন গুহার ভিতর একেবারে লুটিয়ে পড়েছেন। তবে ওই সংঘর্ষে জারোয়াদের মধ্যে একটি অল্পবয়সি জারোয়া যুবকের প্রাণ যাওয়ায় কয়েকজন জারোয়াকে লক্ষ করলাম তারা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে এবং সেই দলের মধ্যে থেকে একজন বল্লম তাক করে অবিনাশবাবুর দিকে তেড়ে গেল। ওই দৃশ্য দেখে ছোটকা চিৎকার করে উঠল, “এ কি, থামো, থামো! মেরো না ওঁকে এভাবে।”
ছোটকাকে ওইভাবে চিৎকার করতে দেখে জারোয়াদের মধ্যে থেকে একজন আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, “আপনারা ওদের সঙ্গে এসেছিলেন তো? কিন্তু ওদের সাহায্য করতে এগিয়ে না এসে এইভাবে চিৎকার করছেন যে? কী ব্যাপার?”
এমন স্পষ্ট বাংলা এক জারোয়ার মুখ থেকে শুনব হয়তো স্বপ্নতেও কল্পনা করিনি। ফলে সেই মুহূর্তে আমরা ওর কথার উত্তর দেব কী, নিজেরাই কেমন যেন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
যদিও ছোটকাকে ওর উদ্দেশে বলতে দেখলাম, “আপনি জারোয়া হয়ে এত ভালো বাংলা বলছেন, আপনি…”
না, ছোটকাকে ওই ব্যক্তি কথাটা শেষ করতে দিল না। সে নিজে থেকেই বলতে লাগল, “আমি জারোয়াদের সঙ্গে থাকি ঠিকই, কিন্তু আমি জারোয়া নই। আমার নাম কৃষ্ণদাস গাঙ্গুলি। এককালে এখানকার বন দফতরের কর্মী ছিলাম। অনেক বছর আগে এখানকার অবৈধ কার্যকলাপ আটকাতে গিয়ে একদল দুষ্কৃতীর সঙ্গে আমার সংঘর্ষ হয়। তাদের দ্বারা আমি আহত হই এবং অচেতন অবস্থায় জঙ্গলের মধ্যেই পড়ে থাকি। কয়েকজন জারোয়া সে-বার আমার প্রাণ বাঁচায় এবং সেই থেকে আমি তাদেরই একজন হয়ে উঠি।”
ওঁর কথা আমরা এতটাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম যে আমাদের চুপ করে থাকতে দেখে সেই ব্যক্তি নিজে থেকেই ফের বলে উঠলেন, তবে এবার একটু রেগে, “কী হল? চুপ কেন আপনারা? আমার কথার জবাব দিন। আপনরাও তো এদের সঙ্গে মিলে এখানে প্রকৃতির দ্বারা নির্মিত এই চুনাপাথরের অদ্ভুত মূর্তিগুলো দেওয়াল থেকে ভেঙে লোপাট করার ধান্দাতেই এসেছিলেন।”
ছোটকাকে ওঁর প্রশ্নের উত্তরে বলতে শুনলাম, “আপনি ভুল করছেন। আমরা অবিনাশবাবুর সঙ্গে এসেছিলাম ঠিকই, কিন্তু কোনও মূর্তি দেওয়াল থেকে ভেঙে লোপাট করতে নয়, স্রেফ প্রকৃতির এই অদ্ভুত সৌন্দর্য উপভোগ করতে এবং ক্যামেরাবন্দি করতে। কারণ, আমি হলাম একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার।”
জারোয়াদের মতো ওই ব্যক্তিও মনে হয় এই ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার শব্দটা আগে কখনও শোনেননি। তাই ভুরু দুটো অমনভাবে উঁচু করে এক অবাক দৃষ্টিতে ছোটকার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বুঝতে পেরে ছোটকা তাঁর উদ্দেশে বলল, “এই যন্ত্রটাকে আপনি হয়তো চেনেন। তাই দয়া করে জারোয়াদের বুঝিয়ে বলুন যে এই যন্ত্রটিকে ক্যামেরা বলে। এটা দিয়ে মানুষ মারা যায় না। এটার মাধ্যমে যে-কোনো দৃশ্যকে সহজেই ফ্রেমবন্দি করা যায়। আর এই যন্ত্রকে যারা পেশাগতভাবে ব্যবহার করে, তাদের ইংরাজিতে বলে ফটোগ্রাফার। আবার নির্দিষ্টভাবে যারা বন-জঙ্গলের ছবি ফ্রেমবন্দি করে বা পশুপাখির, তাদের বলে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার।”
ছোটকার বিশ্লেষণ শুনে কৃষ্ণদাসবাবু জারোয়াদের বুঝিয়ে তো বললেন, কিন্তু তাদের ঠিক কতটা বোধগম্য হল, সেই বিষয়ে আমাদের তিনজনের মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যাই হোক, কৃষ্ণদাসবাবুকে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে ছোটকা এইবার তাঁকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি তো এদের সঙ্গে এতদিন ধরে এখানে রয়েছেন। তাহলে কেন এদের কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে উঠতে পারলেন না?”
এবারে দেখলাম কৃষ্ণদাসবাবু ছোটকার কথার উত্তরে বলতে লাগলেন, “সেই ১৯৯৮ সাল থেকে ওরা বাইরের লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আসছে। সেই থেকেই আপনাদের সভ্যতার সঙ্গে ওদের পরিচয়। ভাষা, খাওয়া, অনেক কিছুই ওদের শেখানো হয়েছে। আমিও অনেক ক্ষেত্রে সেই চেষ্টা করেছি। ওদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়ানো হয়েছে। আন্দামান ট্রাঙ্ক রোডের মাধ্যমে হাসপাতালে চিকিৎসাও করানো হয়। কিন্তু ইদানীংকালে ওরা সেইসব প্রত্যাখ্যান করছে। কারণ, বাইরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ওদের জন্য ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এইসব প্রকৃতির দান নষ্ট করে দেওয়ার জন্য কিছু মানুষ উঠে পড়ে লেগেছে। যার ফলে, রোগ আর মাদক দ্বারা জারোয়াদের পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার একটা চেষ্টা চালানো হচ্ছে যেহেতু ওরা এই কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। সেইজন্য জারোয়ারাও এখন নিজেদের স্বার্থে এইরূপ হিংস্র হয়ে উঠছে।”
“আমি বুঝতে পারছি বিষয়টা। কিন্তু এই হাতাহাতি করে কী লাভ হবে, স্রেফ কয়েকটা প্রাণ যাবে। যেমনটা হল এখন এই মুহূর্তে। ওদের একজনের প্রাণ গেল। এর চেয়ে ভালো হয় না, যদি সরকারের হাতে এমন অপরাধীদের তুলে দেন আপনারা?”
“কাকে? সরকারকে? হা-হা-হা!” ওই ব্যক্তিটির হাসির আওয়াজে যেন চারপাশের দেওয়ালগুলো কেঁপে উঠল।—“আমার এই হাসির মধ্যে কতটা রাগ আর কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে, সেটা আপনারা কেউই বুঝতে পারবেন না। শুনুন, যদি আপনাদের সরকারের অত ক্ষমতা থাকত, তাহলে পশুর সঙ্গে জারোয়া মেরে চোরা শিকার এবং ওদের জমি বাণিজ্যিক কারণে শোষণ করাটা অনেক কাল আগেই বন্ধ হয়ে যেত। এইসব চুনাপাথরের অদ্ভুত মূর্তিগুলো দেওয়াল থেকে ভেঙে লোপাট করার ধান্দা বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু হয়নি। কিছুই হয়নি। এখন তো এক-দু’বছরের ওই এক ইঞ্চির গঠনগুলোও লোপাট হয়ে যাচ্ছে। তাই কোনও সরকার নয়, ওরাই এদের শাস্তি দেবে। যেমনটা কয়েক মাস আগেই একটাকে মেরে দিয়েছিল।”
“তার মানে জারোয়ারাই এখানে সেই বিদেশি পর্যটককে মেরেছিল?”
ছোটকার কথার উত্তরে কৃষ্ণদাসবাবু বললেন, “কোনও পর্যটক নয়, এদের সঙ্গেই সে এখানে এসেছিল মূর্তি ভেঙে নিয়ে যেতে। ওই দেখুন, এই দেওয়ালের চুনাপাথরের ক্রোকোডাইল হেডের মতো স্ট্রাকচারটা ভেঙে নিয়ে যেতে এসেছিল। জারোয়ারা এসে পড়েছিল বলেই ভাঙতে পারেনি। ওকে মেরে জারোয়ারা এদের একটু ভয় পাওয়াতে চেয়েছিল মাত্র।”
“কিন্তু কোনও লাভ কি হল?” ছোটকা এই প্রশ্নটা করায় ওঁকে বলতে শুনলাম, “লাভ-ক্ষতি অত বুঝি না। যেটা বুঝি, সেটা হল প্রকৃতি এবং তার মাঝে থাকা এই জারোয়া উপজাতির স্বার্থ।”
“আপনার প্রত্যেকটা কথা বুঝলাম। কিন্তু আমার কথায় একবার বিশ্বাস করে দেখুন, ঠকবেন না কথা দিচ্ছি। এদের সবাইকে আমি পোর্ট ব্লেয়ারে নিয়ে গিয়ে প্রশাসনের হাতে তুলে দেব এবং যথাযত সাজা দেওয়ানোর চেষ্টা করব। আমার এই ক্যামেরায় যে ভিডিওটি রেকর্ড হয়েছে, সেটাই থাকবে এই ঘটনার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ হয়ে।”
এই বলে ছোটকা সেই হাতাহাতির রেকর্ডেড ভিডিওটা ক্যামেরার স্ক্রিনে চালিয়ে তাঁর চোখের সামনে তুলে ধরল। সেই ব্যক্তিটির সঙ্গে তাঁর আশেপাশে থাকা জারোয়ারাও ক্যামেরার স্ক্রিনে চোখ রাখতে গিয়ে একে অপরের কাঁধে মুখ রেখে যেন হুমড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা।
রেকর্ডেড ভিডিওটা দেখার পর ছোটকাকে কৃষ্ণদাসবাবুর প্রশ্ন, “এটা দিয়ে কি এরা সাজা পাবে?”
উত্তরে ছোটকা মুখে একগাল হাসি নিয়ে বলল, “দেখি না, চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। আর তাছাড়া এই কেস আদালত অবধি গড়ালে আমার অনুমান, এই ভিডিওটা মূল হাতিয়ার হতে পারে আমাদের। তবে সবার আগে আপনাদের একটু ভরসা রাখতে হবে আমার ওপর। এদের সবাইকে নিয়ে আমি পোর্ট ব্লেয়ার ফিরে যাব এবং তারপর থানায় গিয়ে বাকি কাজ।”
কথাটা শুনে সেই ব্যক্তি জারোয়াদের সঙ্গে খানিকক্ষণ শলাপরামর্শ করে নিয়ে ছোটকার উদ্দেশে বললেন, “ঠিক আছে। আপনাকে আমরা বিশ্বাস করছি। কিন্তু কথার অন্যথা হলে এটাই হবে আমাদের শেষবারের মতো শহুরে মানুষকে বিশ্বাস করা। ওদেরকে আপনি নিয়ে যান এবং দেখবেন ওরা যেন প্রত্যেকে সাজা পায়।”
“হ্যাঁ। আমি কিঙ্কর মজুমদার, প্রকৃতিকে সাক্ষী করে আপনাদের সকলকে আমি কথা দিচ্ছি, এদের প্রত্যেককে সাজা পাওয়ানোর চেষ্টা আমি শেষ অবধি করে যাব।”
ছোটকার সংকল্প এবং ওর দেওয়া সেই আশ্বাস পেয়ে ওই ব্যক্তি কয়েকজন জারোয়াকে তখন ইশারায় কী যেন বোঝাতে চাইলেন এবং তারপর ছোটকাকে বললেন, “হুম। নিয়ে যান এদের। আপনাদের ফিরে যাওয়ার জন্য স্টিমার ঘাটে রাখা থাকবে। বিদায়।”
“বিদায়।”
আমরা কৃষ্ণদাসবাবু-সহ সেই সকল জারোয়াদের বিদায় জানিয়ে, সেই বাঁধা অবস্থায় থাকা অবিনাশবাবু ও তাঁর দলবল সমেত দোদুল্যমান সমুদ্র বক্ষে স্টিমার চেপে ফিরে এলাম।
পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছে সর্বপ্রথম যা করার কথা ছিল, ছোটকা সেটাই করল। আমাদের সঙ্গে নিয়ে সে পোর্ট ব্লেয়ার থানায় গিয়ে হাজির হল এবং সঙ্গে থাকা অবিনাশবাবু ও তাঁর দলের লোকেদের কীর্তিকলাপ সমস্তটা পুলিশের বড়ো কর্তাদের খুলে জানাল। পুলিশ কর্তারা আমাদের দিয়ে ডায়েরি লিখিয়ে নিয়ে ওদের প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করলেন এবং সেই ভিডিও রেকর্ডিং-এর এক কপি প্রমাণ স্বরূপ রেখে দিলেন তাঁদের কাছে।
হোটেলে ফেরার পর ওইদিনের পুরো ঘটনাটা ছোটকা বাদে আমাদের তিনজনের তখনও যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। একদিনের মধ্যে এতকিছু ঘটে গেল যে প্রত্যেকটা মুহূর্ত তখনও রূপালি পর্দার কোনও গল্প মনে হচ্ছিল। টিনা তো আবার বাড়িতে ফোন করে তখনই সবকিছু জানাতে শুরু করে দিয়েছিল। আর বলাবাহুল্য যে এইসব কথা শুনে বাড়ির লোকের কী অবস্থা! আমরা এখানে বসে ভালোমতোই আন্দাজ করতে পারছি যে মায়েদের হৃৎস্পন্দন প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়।
এদিকে অবিনাশবাবু ও তাঁর দলবলকে কলকাতা হাইকোর্টে তোলার জন্য ইতিমধ্যেই তাঁদের বিশেষ বিমানে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কেসটা আগামী দু-দিনের মধ্যেই নাকি কোর্টে উঠবে। খবরটা খবরের কাগজে বেরোনো মাত্র আমাদের বাড়ি-সহ আত্মীয়স্বজনদের ফোন আসতে শুরু করল।
ঠাকুরদা তো আমাকে ফোন করে বলেই দিল, “দারুণ কাজ করেছ তোমরা দাদুভাই। আমাদের মুখ এইভাবে উজ্জ্বল করার জন্য তাদের একটা গিফট পাওনা রইল আমার কাছ থেকে।”
জানি না ঠাকুরদার প্রশংসা আমাদের জন্য ঠিক কতটা প্রযোজ্য, কারণ অপরাধীদের সাজা পাওয়ানোর পিছনে মূল কারিগর কিন্তু আমাদের সবার প্রিয় ছোটকা। সুতরাং আমাদের চেয়েও হাজার গুণ বেশি বাহবা পাওয়ার যোগ্য সে।
তবে ছোটকা আবার একটু আলাদা ধাতু দিয়ে গড়া। ওর কথায় সেটা আবারও স্পষ্ট হয়ে গেল যখন সবাই ওর তারিফ করতে ব্যস্ত। ওর কথায়—“যেমন মানুষের শরীর সচল থাকার জন্য সকল যন্ত্রের প্রয়োজন, একইভাবে এই ঘটনাটাতেও জারোয়াদের সাহায্য ভুললে চলবে না। ঠিক সময়ে ওরা না এসে পড়লে হয়তো আমাদের সকলের প্রাণ যেত ওই অবিনাশবাবুর লোকেদের হাতে।”
আমরা নীল দ্বীপ-সহ বাকি রয়ে যাওয়া স্থানগুলো ঘুরে, পোর্ট ব্লেয়ার থেকে আকাশপথে কলকাতা ফিরে এলাম। আমাদের ফেরার মাস চারেকের মধ্যে খবর পেলাম যে অবিনাশবাবু সমেত তাঁর গোটা দলবলের বিরুদ্ধে ওঠা প্রত্যেকটা অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এবং আদালতের রায় অনুযায়ী তাদের প্রত্যেকের সাজা ঘোষণা হয়েছে। মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায়, চাকরি তো গেলই, সেই সঙ্গে অবিনাশবাবুর কপালে জুটল চোদ্দ বছরের কারাদণ্ড। ভ্রমণ শেষে এই সুখবরটা যেন আমাদের সবাইকে বাড়তি আনন্দ দিয়ে গেল। এতদিনে যেন আমাদের আন্দামান সফরের যথার্থ সমাপ্তি ঘটাল।
কৃষ্ণদাসবাবু এবং সেই জারোয়াদের সঙ্গে হয়তো আমাদের আর কখনোই দেখা হবে না। কিন্তু তাঁকে দেওয়া কথা যে ছোটকা রাখতে পেরেছে, সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড়ো পাওনা। কারণ, ওই জারোয়াদের কাছে মানুষ মানেই যে প্রতারক, সেটা আমরা ভুল প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি বলেই আমাদের ধারণা।
যাই হোক, আন্দামানের এই রোমাঞ্চকর অভিযান আমাদের অনেক নতুন অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছিল। তবে যেটা দেখে সবচেয়ে বেশি অভিভূত হয়েছি, সেটা হল লাইমস্টোন কেভ আর ওই জারোয়া দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ। সুতরাং এক অদ্ভুত ভালোলাগা, মনখারাপ মিলেমিশে একাকার করে দিয়েছিল এই কালাপানির সফর। যেন এক অচেনা কালাপানির খোঁজ দিয়ে গেল। যার রেশ আজীবন মনে থেকে যাবে। থাকবেই।
ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জী
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী