স্মৃতিকথা
FREE SHIPPING IN INDIA
স্মৃতিকথা
পরের দিন মামা অফিস কামাই করে মুচিপাড়া থানায় এলেন কার্ফু পাস নিতে। বেশ লম্বা লাইন পড়েছে। থানার সংশ্লিষ্ট অফিসার সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কাউকে পাস দিচ্ছেন, কাউকে হাজার অনুরোধেও দিচ্ছেন না, কাউকে আবার ধমক দিয়ে লাইন থেকে বের করে দিচ্ছেন। মামা লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছেন।
সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী
তারকনাথ চক্রবর্তী—সংক্ষেপে টি. এন. চক্রবর্তী। অফিসের সমবয়সি বন্ধুবান্ধবরা ডাকত টিনমামা বলে। আমিও তাঁকে টিনমামা বলতাম—প্রায় বছর দশেকের বড়ো আমার থেকে। ভালোবাসতেন আমায়। বেঁটেখাটো ফরসা চেহারা, কপাল থেকে শুরু করে মাথায় টাক। এ-কান থেকে ও-কান পর্যন্ত পেছনে কাঁচাপাকা চুলের বেড়। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। সবসময় বেশ হাসিখুশি। অনেকটা আর. কে. লক্ষণের ‘ইউ সেইড ইট’ কার্টুনের কমনম্যানের মতন। ১৯৮৩ সালে ইন্ডিয়ান জুট ইন্ডাস্ট্রিস রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনে আমি যখন চাকরিতে ঢুকেছি তখন টিনমামার প্রায় কুড়ি বছর চাকরি হয়ে গেছে। আমাদের কাজটাই ছিল পাট সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করা। আর এই গবেষণা করার প্রসঙ্গে মামা একদিন তাঁর একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা আমায় বলেছিলেন।
মামার তখন তেইশ-চব্বিশ বছর বয়স। বি. এসসি পাশ করে সবেমাত্র চাকরিতে ঢুকেছেন। টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। সিনিয়র গবেষকদের পরীক্ষামূলক কাজে টুকটাক সাহায্য করেন। হাতেকলমে কাজ শিখছেন। ১৯৬৪ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়। শীতকাল। কলকাতায় তখন সন্ধের পর থেকে কার্ফু চলছে। তারাতলায় মামার অফিস আর উত্তর কলকাতায় শ্রদ্ধানন্দ পার্কের কাছে বাড়ি। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে-ফিরতেই সন্ধে হয়ে যায়। ফিরে এসে করার কিছু থাকে না। কলকাতায় টিভি আসতে তখনও আরও দশ বছর। পাড়ার আড্ডা, তাস, ক্যারম সবই বন্ধ। মামা জানতে পারলেন, সন্ধের পরে রাস্তায় বেরোতে হলে থানা থেকে পাস নিতে হবে। কে কী করে, কার কাজের গুরুত্ব কতখানি— এসব বিবেচনা করে তবেই নাকি পাস দেওয়া হচ্ছে। পরিচিত দু-একজন পাস পেয়েও গেছে। টিনমামা গবেষণাগারে কাজ করেন, তাও আবার ভারত সরকারের অধীনস্থ সংস্থায়। পাড়ায় সম্প্রতি মামার খাতিরও কিছুটা বেড়েছে। সুতরাং পাস পেতে তাঁর কোনও অসুবিধা হবে না এ-ব্যাপারে মামা নিশ্চিত।
পরের দিন মামা অফিস কামাই করে মুচিপাড়া থানায় এলেন কার্ফু পাস নিতে। বেশ লম্বা লাইন পড়েছে। থানার সংশ্লিষ্ট অফিসার সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কাউকে পাস দিচ্ছেন, কাউকে হাজার অনুরোধেও দিচ্ছেন না, কাউকে আবার ধমক দিয়ে লাইন থেকে বের করে দিচ্ছেন। মামা লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছেন। দেখতে দেখতে এবার মামার পালা। আগের তিনজনকে পাস দেওয়া হল না। মামা তখন ছোটোখাটো ছোকরা ছেলে, মুখে-চোখে একটু ফচকেমি ভাবও আছে। পুলিশ অফিসার মামাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে গম্ভীরভাবে হাতে ধরা ব্যাটনটি উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী করা হয়?”
মামাও গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন, “আমি সরকারি চাকরি করি।”
“কোথায়?”
“ইন্ডিয়ান জুট ইন্ডাস্ট্রিস রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনে।”
“সেটা কোথায়?”
“তারাতলায়।”
অফিসার এইবারে শুধোলেন, “কাজটা কী?”
মামা জানালেন, “রিসার্চ করি।”
“কী-ই-ই?”
মামা এইবারে জোর গলায় উত্তর দিলেন, “রিসার্চ করি। আমি সায়েন্টিস্ট।”
অফিসার একটু থমকে গেলেন।— “সায়েন্টিস্ট? রিসার্চ? তা রিসার্চ তো দিনের বেলা, এর সঙ্গে সন্ধেয় বেরোনোর কী সম্পর্ক?”
“রিসার্চের কাজ শেষ করতে-করতেই তো সন্ধে হয়ে যায়। বাড়ি ফিরতে রাত হয়। তাই...”
পুলিশ অফিসার খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে মামার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বাঘের মতন গর্জন করে বলে উঠলেন, “সাতদিন রিসার্চ বন্ধ থাকলে দেশের কোনও ক্ষতি হয় না। বেরোও এখান থেকে!”
মামা কেমন থতমত খেয়ে লাইন থেকে বেরিয়ে এলেন।
মামার পরে যে লাইনে ছিল তাকে অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, “অ্যাই! কী করা হয়?”
লোকটি বলল, “আজ্ঞে স্যার আমি গোয়ালা, বাড়ি বাড়ি দুধ দিই।”
পুলিশ অফিসার তার অধীনস্থ পুলিশ কর্মচারীকে বললেন, “একে একটা পাস ইস্যু করে দাও তো। নেক্সট।”
লেখকের অন্যান্য লেখা
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস