পড়শি দেশের গল্প (শ্রীলঙ্কা)
FREE SHIPPING IN INDIA
পড়শি দেশের গল্প (শ্রীলঙ্কা)
গল্প ১
ছানা দুটো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে তারস্বরে কান্না জুড়ে দিল। তখন গুহার মুখে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে হরিণ মোটা গলায় চিৎকার করে তাদের খুব বকতে শুরু করল, “এই তো একটু আগে চিতাবাঘের শুকনো মাংস খেলি, কাল রাতে পেট পুরে চিতাবাঘের তাজা মাংস খেয়েছিস, তাতেও পেট ভরেনি? আর কী দেব খেতে? এক্ষুনি ফের চিতার তাজা মাংস কোত্থেকে জোগাড় করব আমি?”
তাপস মৌলিক
ঘন জঙ্গল। চারদিকে উঁচু-নীচু পাহাড়। ঝম-ঝমাঝম বৃষ্টি। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে এক সন্ধেবেলা এক খোঁড়া মা-হরিণ তার দুই ছোট্ট ছানাকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল এক পাথরের গুহায়। সে-গুহায় ছিল এক চিতাবাঘের বাসা। চিতা তখন গুহায় ছিল না, শিকারের খোঁজে বেরিয়েছিল জঙ্গলে।
গন্ধ শুঁকে মা-হরিণ বুঝেছিল গুহাটা চিতাবাঘের, কিন্তু ওই বৃষ্টির মধ্যে ছোটো ছোটো ছানাদের নিয়ে সে আর যায় কোথায়! তাই সেখানেই রাত কাটাবে বলে ঠিক করল। যা হবে দেখা যাবে।
ভোরবেলা হরিণ দেখল, বৃষ্টিতে ভিজে চুপ্পুস হয়ে চিতাবাঘ সেই গুহার দিকে আসছে। দেখেই সে তার ছানা দুটোকে শিং দিয়ে গুঁতোতে শুরু করল। ছানা দুটো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে তারস্বরে কান্না জুড়ে দিল। তখন গুহার মুখে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে হরিণ মোটা গলায় চিৎকার করে তাদের খুব বকতে শুরু করল, “এই তো একটু আগে চিতাবাঘের শুকনো মাংস খেলি, কাল রাতে পেট পুরে চিতাবাঘের তাজা মাংস খেয়েছিস, তাতেও পেট ভরেনি? আর কী দেব খেতে? এক্ষুনি ফের চিতার তাজা মাংস কোত্থেকে জোগাড় করব আমি?”
সেই শুনে তো চিতাবাঘের ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল। সে ভাবল, ‘বাপ রে, এরা কোন দেশি হরিণ, চিতাবাঘের মাংস খায়! আমাকে পেলেই তো ধরে খেয়ে ফেলবে।’ এই ভেবে সে এক লাফে পগারপার; ছুটতে ছুটতে অনেকটা দূর গিয়ে তবে থামল। ভাবল, ‘কী করি এখন? আমার গুহাটা যে বেদখল হয়ে গেল, কোথায় যাই?’ ভেবে ভেবে সে ঠিক করল, ‘শেয়ালের খুব বুদ্ধি। তার কাছে যাওয়া যাক, কী পরামর্শ দেয় দেখি।’
চিতাবাঘকে আসতে দেখে শেয়াল বলল, “কী ব্যাপার ভায়া, বৃষ্টিতে যে কাকভেজা হয়ে গেছ দেখছি! এত তড়িঘড়ি চললে কোথায়? কোনো বিপদ-আপদ হল নাকি?”
চিতাবাঘ বলল, “আর বোলো না ভায়া, বিপদ বলে বিপদ! বাড়ি ফিরছিলাম, দেখি আমার গুহার ভেতর এক হরিণ আস্তানা গেড়েছে, সঙ্গে তার ছানাপোনা। কোন দেশি হরিণ কে জানে, তারা চিতাবাঘের মাংস খায়। আমাকে দেখেই হাঁক পেড়ে লাফ দিয়ে ঘাড় মটকাতে এসেছিল, কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি।”
সেই শুনে শেয়াল বলল, “আরে ছো ছো, বাঘ হয়ে একটা হরিণকে ভয় পাচ্ছ? চলো আমি যাচ্ছি তোমার সঙ্গে, দেখি কেমনধারা হরিণ সে। গিয়েই এমন কামড়ে দেব যে বাছাধন পালাবার পথ পাবে না।”
দুজনে চলল চিতার গুহার দিকে। শেয়াল আগে আগে, চিতা পিছু পিছু। গুহার কাছাকাছি এসে চিতা শেয়ালকে বলল, “ওরে বাবা! আমি যাব না। তুমি যাও। আমার ভয় করছে।”
শেয়াল বলল, “এতই যখন ভয় তোমার, এক কাজ করি দাঁড়াও। একটা শক্তপোক্ত লতা জোগাড় করি চলো। লতার একটা দিক আমার ঘাড়ে বাঁধি, আরেক প্রান্ত তোমার কোমরে বেঁধে নাও। তারপর আমার পিছু পিছু এসো।”
সেইমতো লতা জোগাড় হল। তারপর লতার একদিক শেয়ালের গলায় আর অন্যদিক চিতার কোমরে বেঁধে তারা এগিয়ে গেল গুহার দিকে।
দূর থেকেই মা-হরিণ শেয়াল আর চিতাকে গুহার দিকে আসতে দেখেছিল। দেখেই সে তার ছানা দুটোকে ফের শিং দিয়ে গুঁতোতে শুরু করেছিল। ছানা দুটোও ফের ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ল। শেয়াল আর চিতা কাছে আসতেই হরিণ উঁচু গলায় বলল, “আহ্! কেঁদো না, কেঁদো না, এক্ষুনি শেয়ালকাকু তোমাদের জন্য আরও চিতাবাঘ ধরে আনবে।” তারপর গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে রাগ দেখিয়ে বলল, “কী হল শেয়াল ভায়া? তোমাকে তো কাজের লোক বলেই জানতাম। বলেছিলাম অন্তত সাতটা চিতাবাঘ ধরে নিয়ে এসো, আর তুমি কিনা মাত্র একটা রোগাপটকা চিতাবাঘ দড়ি দিয়ে বেঁধে আনলে? এই তোমার কাজের নমুনা? বাচ্চাগুলোকে এখন আমি কী খেতে দিই বলো তো? সেই কখন থেকে ওরা খিদের জ্বালায় কাঁদছে!”
চিতাবাঘ ভাবল, ‘এই রে! এ যে সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র! হরিণ আর শেয়ালের মধ্যে তো দেখছি যোগসাজশ রয়েছে। তাই শেয়াল আমাকে বোকা বানিয়ে বেঁধে আনল এখানে! আর আমি কিনা তার কাছেই পরামর্শ চাইতে গেছিলাম! দুজনে মিলে এক্ষুনি আমায় মেরে ফেলবে।’
এই ভেবে প্রকাণ্ড এক লাফ দিয়ে চিতা পাঁইপাঁই করে ছুট লাগাল। সে ভুলেই গেল শেয়াল তার কোমরের সঙ্গে লতা দিয়ে বাঁধা। দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ছুটে চলল চিতাবাঘ আর তার সঙ্গে বাঁধা শেয়ালও চলল পেছন পেছন হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে, এ গাছ সে গাছে ধাক্কা খেতে খেতে, এ পাথর সে পাথরে ঠোক্কর খেতে খেতে।
একটানা অনেকদূর ছুটে চিতা দম নিতে থামল। তখন তার খেয়াল হল, আরে শেয়াল তো তার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল! পেছনে তাকিয়ে সে দেখল একটু দূরেই মাটিতে শুয়ে শেয়াল দাঁত বার করে হাসছে, টানের চোটে লতার দড়িটা তার গলায় শক্ত হয়ে চেপে বসেছে। চিতা ভাবল, ‘ব্যাটা বদমাশ, আমাকে বোকা বানিয়ে আবার হাসা হচ্ছে! আমি কি অতই বুদ্ধু? দেখাচ্ছি মজা দাঁড়াও।’
এই ভেবে শেয়ালের কাছে গিয়ে চিতাবাঘ দেখল গলায় দড়ির ফাঁস লেগে শেয়াল অক্কা পেয়েছে, মুখটা হাঁ হয়ে দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে, ঠিক যেন হাসছে।
গল্প ২
বলো তো এ-ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করতে পারি আমি। নদীর ও-পাড়ে জঙ্গলের মধ্যে বেশ খানিকটা দূরে একটা জলা রয়েছে, সেখানে অনেক কুমির থাকে। একবার গিয়ে খুঁজে দেখতে পারি তোমার জন্য কোনও পাত্রী পাওয়া যায় কি না।
জঙ্গলের মধ্যে একটা নদী, তার দু-পাশে উঁচু পাড়। একদিকের জঙ্গলে থাকত একটা শেয়াল। একদিন সে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নদীর ধারে এসে দেখল, ও-পাড়ে জঙ্গলের সামনে একফালি সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠে একটা বিশাল হাতি মরে পড়ে রয়েছে। কিন্তু নদী পেরিয়ে ও-পাড়ে যায় কী করে?
সেই নদীতে থাকত এক বিরাট ভয়ংকর কুমির। তার দাপটে আর কোনও কুমির ছিল না সে-অঞ্চলে। নদীর পাড়ে নেমে এসে শেয়াল সেই কুমিরকে খুব ডাকাডাকি শুরু করল, “কুমির ভায়া, আছ নাকি? গেলে কোথায়?”
শেয়ালের ডাকাডাকিতে কুমির পাড়ে এসে জল থেকে মাথা তুলল।— “কী ব্যাপার, শেয়াল ভায়া?”
“এই তো এসে গেছ। তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল। ভাবছিলাম, একা একা এই বিশাল নদীতে থাকো কী করে তুমি! কোনও সঙ্গীসাথী নেই, মনের কথা বলার একটা লোক নেই। তাই ভাবলাম, যাই একটু দেখা করে আসি।”
“সঙ্গীসাথী আর কোথায় পাই ভায়া, জানোই তো এ-নদীতে আর কোনও কুমির নেই।”
“বলছিলাম কী, একটা বিয়ে করে ফেলো তুমি। তাহলে আর এই একা একা থাকতে হয় না।”
“বিয়ে? বিয়ে করতে গেলে তো একটা পাত্রী লাগে। কোথায় পাব তাকে?”
“বলো তো এ-ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করতে পারি আমি। নদীর ও-পাড়ে জঙ্গলের মধ্যে বেশ খানিকটা দূরে একটা জলা রয়েছে, সেখানে অনেক কুমির থাকে। একবার গিয়ে খুঁজে দেখতে পারি তোমার জন্য কোনও পাত্রী পাওয়া যায় কি না।”
“বেশ তো, দেখো না গিয়ে। ভালোই তো হয় একটা পাত্রী পেলে।”
“কিন্তু যাব কী করে? ও-পাড়ে যেতে গেলে যে নদী পেরোতে হবে!”
“সে আর এমন কী ব্যাপার! উঠে বোসো আমার পিঠে, এখুনি পার করে দিচ্ছি।”
এইভাবে শেয়াল কুমিরের পিঠে চড়ে নদী পেরিয়ে ও-পাড়ে গেল, তারপর সারাদিন ধরে সেই মরা হাতিটার মাংস খেয়ে সন্ধেবেলা নদীর ধারে নেমে কুমিরকে ডাক দিল।
কুমির জল থেকে মাথা তুলে বলল, “কী ভায়া, কোনও খোঁজখবর পেলে?”
“হ্যাঁ, সেটাই বলছি। জলার ধারে তো গেলাম। সে অনেক দূর। যেতে তিন ঘণ্টা, আসতে চার ঘণ্টা। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তাই ফেরার সময় দেরি হল। যাই হোক, সেখানে তো আমায় কেউ চেনে না। অনেক ডাকাডাকির পর জলার একটা কুমির পাড়ে এসে মাথা তুলল। সে বয়স্ক কুমির। তাকে তোমার কথা বললাম। বললাম যে একজন পরমা সুন্দরী পাত্রী চাই যাতে তোমার সঙ্গে মানায়। তখন সেই কুমির আবার আর একটা কুমিরকে ডেকে নিয়ে এল। প্রচুর কুমির থাকে সেই জলায়। দুই কুমিরে খানিক শলাপরামর্শ করে বলল, আজ রাতে একটা সভা ডেকে সমস্ত কুমিরকে আমার প্রস্তাবটা জানাবে। আগামীকাল ফের যেতে হবে আমায়, সভায় কী সিদ্ধান্ত হল জানতে।”
“বেশ, তাহলে কাল আবার যাবে তুমি?”
“নিশ্চয়ই যাব। তোমার মতো বন্ধুর জন্য এটুকু করব না? কাল ভোর-ভোরই রওনা দেব। এখন বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করি রাতটা, নদীটা একটু পার করে দাও আবার। উফ্, প্রচুর ধকল গেছে আজ।”
কুমির তখন ফের শেয়ালকে পিঠে চড়িয়ে এ-পাড়ে পৌঁছে দিল।
পরদিন ভোর হতে না হতেই শেয়াল ফের হাজির হল নদীর ধারে। তারপর আগেরদিনের মতোই কুমিরের পিঠে চড়ে নদী পেরিয়ে ও-পাড়ে গিয়ে উঠল। সারাদিন ধরে শুয়ে বসে আরাম করে হাতির মাংস খেল, শেষে সন্ধে নামার পর নদীর ধারে এসে ডাক দিল কুমিরকে।
কুমির নদীর পাড়েই জলের নীচে অপেক্ষা করছিল। মাথা তুলে বলল, “এসেছ বন্ধু? আমার যে আর তর সইছে না। বলো, সভায় কী সিদ্ধান্ত হল ওদের।”
“আরে সে একেবারে হুলুস্থুল ব্যাপার। আগেরদিন দুই কুমিরের কাছে তোমার এত গুণগান করেছি যে ওদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেছে। অন্তত দশটা কুমির তোমায় বিয়ে করতে চায়। আমি বললাম, উঁহু, দশজন তো হবে না, আমার একজনই চাই। দশজনের মধ্য থেকে আমি সবচেয়ে সুন্দরী একজনকে বেছে নেব। কারা কারা রাজি আমার সামনে নিয়ে এসো।”
“তারপর?”
“তখন ওরা নিজেদের মধ্যে ফের আলোচনা করে বলল, রাজি দশজন এরকম সাধারণভাবে আমার সামনে আসতে চাইছে না। কাল সবাই সাজগোজ করে তৈরি থাকবে, আমি গিয়ে যেন তাদের একজনকে বাছাই করে নিয়ে আসি। সুতরাং কাল আবার এতটা রাস্তা ঠেঙিয়ে যেতে হবে আমায়।”
“তাহলে অবশেষে আমি একটি সুন্দরী বউ পেতে চলেছি আগামীকাল?”
“আলবাত। রাতটা বিশ্রাম করে নিই, কাল সকালেই ফের এসে ডাক দেব তোমায়। এখন আমায় একটু পার করে দাও।”
“নিশ্চয়ই। সে আর বলতে! তোমায় যে কী বলে ধন্যবাদ দেব শেয়াল ভায়া!”
কুমিরের পিঠে চড়ে ফের এ-পাড়ে এসে সারারাত আরামে ঘুম দিল শেয়াল। তারপর সকাল হতে আবার ও-পাড়ে গিয়ে হাতির মাংস খাওয়া শুরু করল। সেদিন বিকেলের মধ্যে পুরো হাতিটাই খেয়ে শেষ করে ফেলল সে। একটু পরে সন্ধে নামলে নদীর ধারে এসে ডাক দিল কুমিরকে।
কুমির শেয়ালের ডাকের অপেক্ষায় কান খাড়া করেই ছিল। জল থেকে মাথা তুলে বলল, “কই, এনেছ আমার বউকে? সঙ্গে দেখছি না যে কাউকে?”
শেয়াল বলল, “আরে সে এক কাণ্ড! সেখানে তো গেলাম। দেখি দশটা কুমিরই সেজেগুজে একেবারে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে। প্রত্যেকেই খুব সুন্দরী। তাদের মধ্যে যে সেরার সেরা, পছন্দ করলাম তাকে। বললাম, চলো আমার সঙ্গে। এতক্ষণ সে খুশিতে ডগমগ করছিল, যেই বলেছি ‘চলো’ অমনি দেখি ভেউ ভেউ করে কান্না জুড়ে দিল। বুঝতেই পারছ, বাপের বাড়ি ছেড়ে আসা, কষ্ট তো একটু হবেই। তখন তার বাবা-মা আমায় বলল, ‘আজ থাক, কাল এসে নিয়ে যেও। আমরা জিনিসপত্র সব গোছগাছ করে রাখব।’ অগত্যা কী আর করি! আর একটা দিন সবুর করতে হবে তোমায়। এখন একটু পার করে দাও, বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করি, কাল সঙ্গে করে তোমার নতুন বউ নিয়ে আসব।”
পিঠে চড়িয়ে শেয়ালকে নদী পার করে নামিয়ে দিয়ে কুমির বলল, “বেশ, তাহলে কাল সকালে ফের আসছ তো?”
শেয়াল এক লাফে নদীর উঁচু পাড়ে উঠে বলল, “আর আসি আমি! বয়েই গেছে তোমার মতো বোকা একটা কুমিরের জন্য বউ খুঁজতে আমার। সব বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলেছি তোমায়। ও-পাড়ে একটা হাতি মরেছিল, এই তিনদিনে তার মাংস খেয়ে শেষ করলাম। এখন সাতদিন শুধু ঘুম।”
গল্প ৩
পথের কাঁটা সেই পন্ডিতকে সরানোর জন্য রাজা একটা মতলব ভাঁজলেন। লোক পাঠালেন তাঁকে রাজসভায় ডেকে আনার জন্য। পন্ডিত এসে রাজাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে দাঁড়ালেন। রাজা তাঁকে বললেন, “শুনেছি তুমি খুব বিদ্বান আর জ্ঞানী। তোমায় একটা কাজ দিচ্ছি। আমার সাদা ঘোড়াটাকে কথা বলা শেখাতে হবে। এক সপ্তাহ সময় দিলাম, তার মধ্যে তোমার মতামত জানাবে। কাজটা যদি না পারো তো তোমার গর্দান যাবে।”
এক দেশে এক মূর্খ রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন যেমন বোকা তেমনি অহংকারী। প্রজারা আড়ালে রাজার বোকামি নিয়ে হাসিঠাট্টা করত, তবে অত্যাচারের ভয়ে খোলাখুলি কিছু বলত না। রাজার একটা সাদা ঘোড়া ছিল। তাকে নিয়ে তাঁর অহংকারের শেষ ছিল না। প্রায়ই সেই সাদা ঘোড়ায় চড়ে তিনি রাজ্যপাট দেখতে বেরোতেন।
সে-দেশে ছিলেন একজন পন্ডিত মানুষ। অগাধ তাঁর জ্ঞান, প্রচুর তাঁর পড়াশুনো। রাজ্যের সবাই তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করত, বিপদে-আপদে পরামর্শ নিতে তাঁর কাছে ছুটে যেত, রাজার কাছে কেউ যেত না। পন্ডিতের এরকম জনপ্রিয়তা দেখে রাজা হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরছিলেন। ভাবলেন, ‘আমি কিনা রাজা, আমার কাছে কেউ আসে না। ব্যাটাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে।’
পথের কাঁটা সেই পন্ডিতকে সরানোর জন্য রাজা একটা মতলব ভাঁজলেন। লোক পাঠালেন তাঁকে রাজসভায় ডেকে আনার জন্য। পন্ডিত এসে রাজাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে দাঁড়ালেন।
রাজা তাঁকে বললেন, “শুনেছি তুমি খুব বিদ্বান আর জ্ঞানী। তোমায় একটা কাজ দিচ্ছি। আমার সাদা ঘোড়াটাকে কথা বলা শেখাতে হবে। এক সপ্তাহ সময় দিলাম, তার মধ্যে তোমার মতামত জানাবে। কাজটা যদি না পারো তো তোমার গর্দান যাবে।”
পন্ডিত বললেন, “যথা আজ্ঞা মহারাজ।” তারপর খুব চিন্তিত মুখে বাড়ি ফিরে চললেন।
পন্ডিতের একটি মেয়ে ছিল। সে ছিল যেমন সুন্দরী, তেমনি বুদ্ধিমতী। বাড়ি ফিরে পন্ডিতকে বিমর্ষ বদনে বসে থাকতে দেখে সে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে, বাবা?”
পন্ডিত মেয়েকে সব কথা খুলে বললেন।— “ঘোড়াকে কি কোনোদিন কথা বলা শেখানো যায়? বল তুই? আর আশা নেই, আমার মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। আয়, এই সাতদিনে তোকে আমার সমস্ত পুথিপত্র আর সামান্য বিষয়আশয় যা কিছু আছে সব বুঝিয়ে দিয়ে যাই। এবার থেকে তোকেই সব সামলাতে হবে।”
মেয়ে সব শুনে বলল, “বাবা, তুমি এত ঘাবড়াচ্ছ কেন? শোনো, সাতদিন পরে তুমি রাজার কাছে যাবে, তারপর আমি যেমন যেমন বলছি ঠিক তাই বলবে। তারপর দেখো কী হয় না হয়।” তারপর রাজার কাছে গিয়ে কী কী বলতে হবে তা বাবাকে বেশ করে বুঝিয়ে দিল সে। পন্ডিত ভাবলেন, এমনিতে তো আর আশা নেই, দেখাই যাক মেয়ের পরামর্শ মেনে কী হয়।
এক সপ্তাহ পরে পন্ডিত রাজসভায় গিয়ে রাজাকে প্রণাম করে দাঁড়ালেন।
রাজা জিজ্ঞেস করলেন, “কী, পারবে আমার সাদা ঘোড়াকে কথা বলা শেখাতে?”
পন্ডিত বললেন, “আজ্ঞে মহারাজ, নিশ্চয়ই পারব। তবে এটা বেশ সময়সাপেক্ষ কাজ। একটু সময় লাগবে।”
“কত সময়?”
“আজ্ঞে, বছর সাতেক।”
“সা-ত ব-ছ-র?”
“আজ্ঞে, ঘোড়া কিনা, ওদের বুদ্ধি একটু কম। আপনার ঘোড়া হলেও আপনার চেয়ে ওর বুদ্ধি ঢের কম। আপনি যেটা একদিনে শিখে যাবেন, ওর শিখতে সাতদিন লাগবে। ছোটোবেলায় কথা বলা শিখতে কত সময় লেগেছিল আপনার? এক-দেড় বছর? সে হিসেবে ওর সাত বছরের বেশিই লাগা উচিত, তবে আমার বিশ্বাস আমি সাত বছরের মধ্যে শিখিয়ে দেব। তবে তার জন্য সবসময় ওর পেছনে লেগে থাকতে হবে। আমার কাছেই থাকতে হবে ঘোড়াটাকে, এদিক ওদিক যেতে হলেও ওকে সঙ্গে নিয়েই, মানে ওর পিঠে চড়েই বেরোব। কিন্তু মহারাজ, আমি গরিব মানুষ, আপনার ঘোড়ার দানাপানি জোগানোর সামর্থ্য আমার নেই। ও রাজবাড়ির খানা আর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে অভ্যস্ত, আধপেটা খেয়ে থাকলে ওর শেখার আগ্রহ কমে যাবে, আরও অনেক সময় লেগে যাবে কথা বলতে। তাই যদি আদেশ করেন যে যতদিন আপনার ঘোড়া আমার কাছে থাকবে ততদিন তার দানাপানি রাজবাড়ি থেকেই পাঠানো হবে, তাহলে আর কোনও সমস্যা থাকে না।”
রাজা পন্ডিতের সব শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হলেন। বললেন, “বেশ, তাই হবে।”
পন্ডিত তখন রাজার বাড়ির সাদা ঘোড়া ছুটিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। রাজ্যের লোকজন অবাক হয়ে দেখল, যে-ঘোড়ায় চেপে রাজামশাই রাজপাট দেখতে বেরোতেন, সেই ঘোড়া ছুটিয়ে পন্ডিত বাজারহাট করতে যান, নদীতে স্নান করতে যান।
সাত বছর পার হওয়ার আগেই রাজামশাই স্বর্গে গেলেন। তাঁর সাদা ঘোড়া পন্ডিতের কাছেই রয়ে গেল। প্রতিদিন সেই ঘোড়ার জন্য রাজবাড়ি থেকে খানা আসতে লাগল।
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস