বড়ো গল্প
FREE SHIPPING IN INDIA
বড়ো গল্প
ভুরু দুটো যতটা সম্ভব উপরের দিকে তুলে মাস্টারদা বলল, “ব্যাপারগুলো কিন্তু যথেষ্ট সন্দেহজনক লাগছে। বিল্টুর রাতে দেখা ছায়া আদতে মিথ্যে নয়। ভূতের না হলেও এটা মানুষের হতেই পারে। যার প্রমাণ এই জুতোর ছাপগুলো। আমাদের কিন্তু আর একটু চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। কেন জানি না মনে হচ্ছে অনেক কিছুই আমাদের চারপাশে ঘটছে অথচ আমরা টের পাচ্ছি না।”
রণিত ভৌমিক
সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না, সে এগিয়ে চলেছে আপন বেগে। আর সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও নিজেদের জীবনে এগিয়ে চলেছি। আজও তো জীবনে অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে, কিন্তু এই জানা-অজানার খেলায় আমরা মাস্টারদাকে সঙ্গে পেয়েছি বলেই হয়তো এতটা পথ অতিক্রম করতে পেরেছি। মাস্টারদার এই অদ্ভুত দুনিয়ায় শুধু রোমাঞ্চই নেই, তার সঙ্গে আছে এক ভালোলাগা। যে ভালোলাগা বার বার তার সঙ্গে আমাদের জুড়ে দিয়েছে বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে। মাস্টারদার কাছ থেকেই আমরা শিখেছি কীভাবে জীবনে সমস্যার সঙ্গে লড়াই করতে হয়। সে হল আমাদের জিয়নকাঠি।
কাঠমান্ডু থেকে ফিরে আসার পর বেশ ক’টা মাস কেটে গেল। মাস্টারদা এখন স্কুলে ভূগোল বিভাগের প্রধান হয়েছে। সুতরাং বলতে দ্বিধা নেই যে নতুন দায়িত্বের পাশাপাশি নিজের রিসার্চের কাজ, সব মিলিয়ে বেশ চাপের মধ্যেই তার দিন কাটছে।
আমাদের পরীক্ষা শেষ। কিছুদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে কাটানোর সময় পেয়েছি আর কী। কিন্তু অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি, তাই মনটা বড্ড খারাপ। সবাই মানে আমি, রাজা, বিল্টু আর জোনাকি মিলে সেদিন মাস্টারদার সঙ্গে দেখা করতে তার বাড়িতে গেলাম। মাস্টারদা তখন সবে ক্লাস নাইনের ভূগোলের খাতা দেখা শেষ করে উঠেছে। আমাদের দেখামাত্র তাকে বলতে শুনলাম, “আজ দলবল নিয়ে সোজা এই তল্লাটে যে। কী ব্যাপার, এতদিনে তাহলে মাস্টারদাকে তোদের মনে পড়ল?”
মাস্টারদার কথা শুনে বুঝলাম আমরা পরীক্ষার পর দেখা করতে আসিনি বলে তার অভিমান হয়েছে। সামনে গিয়ে তাই আমি বললাম, “না, গো। আসলে তুমি এখন পরীক্ষার খাতা দেখছ, তারপর রিসার্চের কাজ রয়েছে, তাই আর আমরা বিরক্ত করতে চাইনি তোমায়।”
“থাক, অত ভাবতে হবে না তোদের। বড্ড ডেঁপোমি বেড়েছে দেখছি। তা মুখগুলো আসা থেকে এমন ঝুলে রয়েছে কেন? পড়াশোনা তো এখন বইয়ের র্যাকে তোলা, তাহলে সমস্যা কোথায়?”
এর উত্তরে দেখলাম বিল্টু বলে উঠল, “অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি মাস্টারদা। তাই আমাদের মনখারাপ। পরীক্ষা শেষ, সব বন্ধুরাই কোথাও না কোথাও ঘুরতে গেছে, কিন্তু আমরা পাড়ার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছি।”
আমাদের কষ্ট দেখে মাস্টারদা বলল, “বেশ কঠিন অবস্থা বটে তোদের। তাহলে কী করা যায় বল তো?”
জোনাকি পাশ থেকে বলে উঠল, “কী আর করবে বলো, তোমারও যে খাতা দেখার চাপ এখন।”
শুনে মাস্টারদা বলল, “হুম! মন্দ বলিসনি রে, জোনাকি। তবে দুটো দিনের জন্য ম্যানেজ করা যায়।”
উত্তেজিত হয়ে আমরা একসঙ্গে সবাই বলে উঠলাম, “তাই মাস্টারদা! তাহলে তো খুব ভালো হয়। চলো কোথাও একটা ঘুরে আসি।”
“হ্যাঁ, যাওয়ায় যায়। কিন্তু কোথায় যাব, সেটাই এখন কথা।”
এরপর অনেক চিন্তাভাবনা করার পর মাস্টারদা ঠিক করল দু-দিনের জন্য আমাদের সুন্দরবন ঘুরতে নিয়ে যাবে। আবার জঙ্গল শুনে বিল্টু একটু চুপ করে গেছিল। যদিও-বা জোনাকি আমাদের মধ্যে থেকে স্পষ্টই জানিয়ে দিল যে গতবার অর্থাৎ চিলাপাতায় ওর যাওয়া হয়নি। অতএব এবার জঙ্গলই যেতে হবে। ব্যস! আর দেরি নয়, আমরা কিছুদিনের মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম সুন্দরবনের উদ্দেশে।
সুন্দরবন এক প্রাকৃতিক বিস্ময়ের নাম। সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং বন্যপ্রাণীর আধার। এটি বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। এটি শুধুমাত্র এর অনন্য জীববৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত নয়, বরং এখানে বসবাসকারী রয়াল বেঙ্গল টাইগারের জন্যও বিশ্বব্যাপী পরিচিত। সুন্দরবনের নিসর্গ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের মন কাড়ে। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদনদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত।
মাস্টারদার মুখে সুন্দরবন সম্বন্ধে বলতে শুনেছিলাম, ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে সুন্দরবনকে স্বীকৃতি দান করে। ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৩,৪৮৩ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে ভারতে এবং বাকি ৬,৫১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশের মধ্যে।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপে অবস্থিত এই অঞ্চলের আঁকাবাঁকা জলপথ, অসংখ্য ক্ষুদ্র দ্বীপ এবং ঘন গাছপালার এই গোলকধাঁধা, প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৌন্দর্য গড়ে তোলে। সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য সেরা সময় হল শীতকাল, অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। এই সময় আবহাওয়া বেশ মনোরম থাকে এবং বন্যপ্রাণী দেখার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ থাকে। আমরা মার্চ মাসেই যাচ্ছিলাম তাই মনে মনে রয়াল বেঙ্গল টাইগার দেখার সুপ্ত বাসনা যে ছিল না, এমনটা বললে ভুল হবে।
যাই হোক, মাস্টারদার সঙ্গে আমরা খুব ভোরে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে রওনা দিয়েছিলাম ক্যানিংয়ের পথে। আমাদের ট্রেন সবে ছুটতে শুরু করেছে, তখনও আমরা কেউই সেইভাবে সিটে ভালো করে বসবার সুযোগ পাইনি। আর এমন সময় লক্ষ করলাম একজন স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি পিছন থেকে এসে ধুপ করে আমার পাশের খালি জায়গাটায় বসে পড়লেন।
মাস্টারদা, জোনাকি আর রাজা বসে ছিল আমার আর বিল্টুর ঠিক উলটোদিকে। সুতরাং ওরা তিনজনেই ওই ব্যক্তির উপর লক্ষ রাখছিল। খানিক বাদে সেই ব্যক্তি বিল্টুর উদ্দেশে বলে উঠলেন, “খোকা, তুমি আমার দিকে ওইভাবে তাকিয়ে আছ যে? কিছু কি বলবে?”
বিল্টু উত্তর দিতে যাবে এমন সময় ওকে থামিয়ে উলটোদিক থেকে রাজা বলে উঠল, “না না, ও কিছু বলবে না, আসলে ওটাই ওর বদ অভ্যাস। কোনও অপরিচিত লোক দেখলেই ও ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।”
সেই শুনে ওই ব্যক্তি বললেন, “তা তোমরা যাচ্ছ কোথায়?”
উত্তরে রাজা বলল, “আমরা সুন্দরবন ঘুরতে যাচ্ছি। আপনি কোথায় যাচ্ছেন কাকু?”
উনি হেসে বললেন, “আমি যাচ্ছি ক্যানিং। তবে আগামীকাল যাব সুন্দরবনের গোসাবায়। জায়গাটা চেনো তোমরা?”
রাজা আর বিল্টু তখন একে অপরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে। মাস্টারদা অমনি পাশ থেকে গম্ভীর গলায় রাজাকে বলল, “কী রে, চুপ করে গেলি কেন? ওঁকে উত্তর দে। তোদের না বলেছিলাম যেখানে যাবি তার আগে সেই স্থান সম্বন্ধে ভালো করে জেনে তারপর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হবি, নচেৎ নয়?”
“আহা! ছেলেগুলোকে ওভাবে বলবেন না। ওরা ছেলেমানুষ, অচেনা লোক দেখে হয়তো ঘাবড়ে গেছে।”
উলটোদিক থেকে সেই ব্যক্তি বলে উঠলেন এবং তারপরই ওঁকে এও বলতে শুনলাম, “আপনি কি ওদের দাদা?”
“না। উনি আমাদের মাস্টারদা।”
উলটোদিক থেকে বলল জোনাকি। তা শুনে ওঁর ভুরু দুটো কিছুটা কপালে উঠতে দেখে মাস্টারদা গুছিয়ে বলল, “আমার নাম হিমাদ্রিশেখর দাশগুপ্ত। পেশাগতভাবে একজন রিসার্চার ও ভূগোল শিক্ষক। ওরা আমাকে মাস্টারদা বলে ডাকে কারণ স্কুলে আমি ওদের মাস্টারমশাই হলেও, স্কুলের বাইরে আমি ওদের সঙ্গে মিশি দাদার মতো।”
এবার দেখলাম ওঁর ভুরু দুটো আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরল। একগাল হাসি নিয়ে উনি বললেন, “আমার নাম গৌতম চাকলাদার। ব্যাবসার কাজে ক্যানিং হয়ে গোসাবায় যাব।”
আমাদের মধ্যে কথাবার্তা আর একটু এগোল এবং কথায় কথায় জানতে পারলাম যে সেদিন আমরা গোসাবাতেই রাত কাটাব। এদিকে ট্রেনে তখন হঠাৎ একটা বড়ো বাক্স নিয়ে ‘হটো হটো’ বলতে বলতে একজন কালো লম্বামতো লোক আমাদের সিটের সামনে এসে হাজির হল।
প্রথম দিকে আমি আর বিল্টু তার বেশভূষা দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম বটে। পরনে কুর্তা-পাজামা আর সঙ্গে কোট। এমন বেশভূষা আমাদের বঙ্গ রাজ্যে তেমন দেখা যায় না বললেই চলে। কিন্তু এই বিষয়ে মাস্টারদা বা আমাদের সঙ্গে থাকা বাকি কাউকে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখলাম না। বিল্টু তাই ওর স্বভাব অনুযায়ী আগ বাড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে বসল, “আপনি এমন কাপড় কিয়ু পরা হাঁয়?”
এর উত্তরে সেই লোকটি কী বলবে বুঝে উঠতে না পেরে চুপ করে রইল আর সেখানে উপস্থিত আমরা বাকিরা তখন না হেসে পারলাম না।
মাস্টারদা ইশারা করতেই আমি পাশ থেকে ওকে ফিসফিস করে বললাম, “তুই হিন্দিটা পারিস না যখন, তাহলে কেন বলতে যাস বিল্টু?”
এর উত্তরে বিল্টু কিছু না বললেও ট্রেনে ওই মুহূর্তে সকলের মুখে হাসি লক্ষ করেছিলাম।
এদিকে আমাদের আবার নামবার সময় হয়ে এল, কিন্তু আমাদের কারোরই সেদিকে হুঁশ নেই। বাড়ি থেকে আনা সকালের লুচি ও আলুর দম খেয়ে আমরা দিব্যি ঘুম দিচ্ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ কানে কিছু শব্দ আসতেই আমার আর বিল্টুর ঘুম গেল ভেঙে আর তখনই দেখলাম গৌতমবাবু সেই লোকটিকে হিন্দিতে কী যেন ধীরে ধীরে বলছেন। আমি একবার ভাবলাম মাস্টারদাকে বলি, কিন্তু তাকে ডাকতে গেলে তো আবার এঁরা জেনে যাবেন। ফলে ওই দুজনের উপর আমি আর বিল্টু মিলে নজর রাখছিলাম।
ট্রেন ক্যানিং পৌঁছানোর পর আমরা তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে ওই ঘটনার কথা মাস্টারদাকে জানাতেই ভুলে গেলাম। গৌতমবাবু আমাদের বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন আর আমরাও স্টেশন থেকে বেরিয়ে সামনের এক ধাবায় দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। সেই ধাবাতেই একজনের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হল এবং তিনিই আমাদের সুন্দরবন যাওয়ার সবচেয়ে ভালো পথ বলে দিলেন। সেই পথ অনুসরণ করে আমরা এক প্রাইভেট গাড়িতে আমাদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চললাম।
রাস্তার দু-ধারে নজরে পড়ল প্রকৃতির সবুজ রঙের খেলা। আকাশে হালকা রোদের ঝলকানি। পাখিদের ডাক। হাইওয়ে দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে চলা নানা গাড়ির আওয়াজ। এই সবকিছুর মধ্যে দিয়েই আমরা এসে পৌঁছলাম গড়খালি।
বিল্টু উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “এবার কি আমরা মোটর বোটে চড়ব মাস্টারদা?”
মাস্টারদা হেসে বলল, “সাঁতার কেটেও যাওয়া যায়, কিন্তু তোদের সে কষ্ট দেব না। আমরা মোটর বোটেই বাকিটা পথ যাব।”
উত্তরটা যে মাস্টারদা রসিকতার ছলে দিল, তা বুঝতেই পেরেছিলাম। যাই হোক, আমরা ফেরিঘাটের দিকে এগলাম এবং সেখানে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মোটর বোটের জন্য অপেক্ষা করার পর অবশেষে একটা মোটর বোট ভাড়া করে আমরা তাতে উঠে পড়লাম। ওই বোটে অবশ্য আমরা ছাড়া সেদিন তেমন খুব বেশি পর্যটক ছিল না। আসলে বেশ কিছুদিন যাবৎ অবৈধ পশু শিকারের কারণে সুন্দরবনের কয়েকটা এলাকায় সরকার এবং বনদপ্তরের পক্ষ থেকে পর্যটকদের যাওয়া আসা সীমিত করে দেওয়া হয়েছে।
জলের মধ্যে মোটর ঘোরার আওয়াজ শুরু হল এবং বোট চলতে আরম্ভ করল গোসাবার উদ্দেশে। এতটা পথ জলের পথে যাওয়া যে-কোনো রোমাঞ্চের চেয়ে অনেক আলাদা।
মোটর বোটে যেতে যেতে, ওই সুন্দর মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে করতে মাস্টারদা আমাদের উদ্দেশে বলল, “এই সুন্দরবন নামটির অর্থ তোরা জানিস?”
আমি সবার আগে বলে উঠলাম, “হ্যাঁ, জানি তো। এখানকার সুন্দরী গাছের নামে এই তল্লাটের নাম সুন্দরবন হয়েছে।”
মাথা নাড়তে নাড়তে মাস্টারদা বলল, “তোর কাছ থেকে আরও বিস্তারিতভাবে উত্তরটা আশা করেছিলাম রে রজত। বাদ দে, আমিই বলছি।”
এই বলে মাস্টারদা বলতে লাগল, “সুন্দরবন নামের উৎপত্তি নিয়ে কিছু ভিন্ন মত আছে। অনেকেই মনে করে, এই নামটি এসেছে সুন্দরী গাছের নাম থেকে, যেমনটা রজত বলল। আসলে সুন্দরী গাছ এখানে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করে, সুন্দর এবং বন শব্দ দুটি মিলিয়ে সুন্দরবন নামকরণ করা হয়েছে। যা এ-বনের নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য নামটির যথার্থতা প্রমাণ করে।”
গোসাবা পৌঁছতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গেল। মাস্টারদা আগে থেকেই একটা লজ ঠিক করে রেখেছিল, তাই সেখানেই সরাসরি চলে গেলাম। লজে ঢুকেই আমরা ছুটলাম ঘরে আর মাস্টারদা গেল সামনের বাজার ঘুরে দেখতে। সেদিন রাতে আমরা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম কারণ, পরদিন সকালেই শুরু হবে আমাদের আসল সুন্দরবন দেখা।
কথামতোই পরদিন সকালে জলখাবার খেয়ে মাস্টারদার সঙ্গে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মোটর বোটে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এবারের বোটটা লজের মালিকের চেনা এক বন্ধু ঠিক করে দিয়েছিলেন। এই বোটে ছিলাম বলতে শুধু আমরা, সঙ্গে দুজন কর্মী। বেশ ভালো লাগছিল আমার। এ যেন এক আলাদা অনুভূতি। দু-ধারে সবুজে ভরা জঙ্গল, মাঝে শুধু একটা নদী আর তার উপর দিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের বোট।
সময়ের সঙ্গে অনেকটা পথই অতিক্রম করে এসেছি, কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনও ক্লান্তি ভাব নেই। মনে হচ্ছিল সব ক্লান্তিকেই যেন হরণ করেছে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য। দারুণ কাটছিল সময়, কিন্তু হঠাৎ বোটের মোটর গেল বিগড়ে। অনেক চেষ্টার পরেও সেই মোটর কিছুতেই আর সারানো গেল না। আমাদের বোট তখন জলে ভাসছে। সবার মনের মধ্যে তখন কেমন একটা ভয় উঁকি দিতে লাগল আর তখনই চোখ পড়ল কুমিরের দিকে। পাড়ে উঠে তারা তখন রোদ পোয়াচ্ছে।
মাস্টারদাকে বলতে শুনলাম, “রজত, জোনাকি, রাজা, বিল্টু। তোরা কেউ অযথা ভয় পাস না। এখানে মাঝেমধ্যেই এমনটা ঘটে। তবে এটা ঠিক যে লজের মালিকের বন্ধু এই ব্যাপারে বাড়তি সতর্ক থাকলে এই দুর্ভোগ এড়ানো যেত। আমাদের সঙ্গে আরও একটা ছোটো বোট ওঁর পাঠানো উচিত ছিল।”
মাস্টারদার কথা শুনে তখন বুঝলাম যে ব্যাপারটা জটিল না হয়েও জটিল হয়ে উঠছে। আর তাই আমাদের ঘোরা এখন সম্পূর্ণভাবে ভগবানের হাতে।
কিছুটা সময় ওইভাবে জলের মাঝে কাটানোর পর হঠাৎ চোখে পড়ল দূর থেকে একটা বড়ো মোটর বোট যেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সেই বোট থেকে একজন আমাদের উদ্দেশে এমনভাবে ওঁর হাত নাড়ছিলেন, যা দেখে মনে হতে বাধ্য যে লজ মালিকের বন্ধু হয়তো পাঠিয়েছেন। কিন্তু না, এই বোটে ছিলেন অন্য এক ভদ্রলোক আর সঙ্গে আরও তিনজন কর্মী। তাঁদের সঙ্গে ছোটো বোটও রয়েছে।
ওঁকে দেখে বুঝেছিলাম উনিও আমাদের মতো এখানে ঘুরতে এসেছেন। কিন্তু মাস্টারদা নিজের মুখে ওঁর কাছে সাহায্য চাওয়ার আগেই উনি বলে উঠলেন, “গুড আফটারনুন। আপনাদের কি কোনও সমস্যা হয়েছে?”
উত্তরে মাস্টারদা বলল, “হ্যাঁ, আসলে আমাদের বোটের মোটর খারাপ হয়ে গেছে। এখন সমস্যা হচ্ছে আমাদের সঙ্গে কোনও ছোটো বোটও নেই যে ফিরে যাব।”
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলে উঠলেন, “আপনাদের কোনও সমস্যা না থাকলে এই বোটে চলে আসতে পারেন।”
মাস্টারদা আমাদের নিয়ে ওঁর আনা বোটে উঠে পড়ল এবং সেই বোটের কর্মীরা দেখলাম আমাদের বোটের সাহায্যে এগিয়ে এল। তারপর আমরা ওই মানুষটির সঙ্গে ওঁর বোটে সুন্দরবন ঘুরতে লাগলাম। বলতে দ্বিধা নেই যে প্রথম সাক্ষাতেই ওঁকে আমার বেশ ভালো লেগে গেল। ওঁর কথা বলার ধরনের জন্যই শুধু নয়, ওঁর হাসি এবং খোলা মনের জন্যও।
কথায় কথায় জানতে পারলাম ওঁর নাম ড. শম্ভুনাথ সরকার। পেশায় পশুচিকিৎসক হলেও কলকাতায় একটি এনজিও চালান। এবার সুন্দরবন আসার কারণও ওই এনজিওর কাজ। শম্ভুনাথবাবুর চেহারার বর্ণনা দিতে গেলে বলতে হবে, উনি খুব একটা লম্বা নন, গায়ের রঙ মাঝারি আর মাথায় টাক।
এর মাঝে আমাদের মোটর বোট এগোতে লাগল তুলি দিয়ে আঁকা নদীর আঁকাবাঁকা পথে, যার দু-ধারে রয়েছে শুধুই সবুজ ক্যানভাস। আমরা বোটেই দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। সূর্যের তেজ তখন প্রখর। বোটের কর্মীদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে আমাদের জিজ্ঞেস করল, “বাবুরা, আপনারা কি পাখিরালয় যাবেন?”
উত্তরে মাস্টারদা বলল, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। পাখিরালয় যাব না তা কখনও হয় নাকি!”
এই পাখিরালয় হচ্ছে সুন্দরবনের এমন একটি স্থান যেটি পাখি পর্যবেক্ষকদের জন্য স্বর্গ, যেখানে সাড়ে তিনশোটিরও বেশি প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায়। হর্নবিলের সুরেলা ডাক শোনা যায়, ফ্ল্যামিঙ্গোদের মনোমুগ্ধকর নৃত্যের সাক্ষী হওয়া যায় এবং একাধিক প্রজাতির মাছরাঙার শিকার দেখে বিস্মিত হতে হয়।
তবে বোটে থাকা কর্মী রঘুকে বেশ হতাশার সুরে বলতে শুনলাম, “বাবু, যতটা মনে করছেন, ওখানে কিন্তু কিছু বছর যাবৎ সংখ্যাটা অনেক কমে গেছে।”
“কেন?”
কৌতূহলী জোনাকি জিজ্ঞেস করতেই রঘুর কাছ থেকে উত্তর এল, “আসলে পশু শিকারের সঙ্গে নানান রঙিন পাখির শিকারও যে এদিকে বেড়েই চলেছে। এই সুন্দরবন আর আগের সুন্দরবন নেই গো, দিদিমণি।”
এর সঙ্গে রঘু আমাদের আরও জানাল যে সে শ্রীধর কাঠি অঞ্চলের বাসিন্দা। যার ও-পারে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত পড়ছে। সে বোট চালানোর কাজ বিগত বারো বছর ধরে করে আসছে। তার গ্রামের বা অঞ্চলের কথা আমরা জানতে চাওয়ায় সে বলতে শুরু করল, “আমাদের গ্রাম খুবই গরিব বাবু, আজও ভাগ্যের জোরেই আমাদের জীবন চলছে বলতে পারেন। কারণ, জঙ্গলের হিংস্র পশুর হাতে প্রায়ই কেউ না কেউ প্রাণ হারাচ্ছে। তবে আমাদের মাথার উপর বনবিবি আছেন বলেই হয়তো হাজার দুঃখের মধ্যেও আমরা একটু খুশির মুখ দেখতে পাই।”
“আচ্ছা, বনবিবি কে?”
রঘুকে মাঝে থামিয়ে রাজা বনবিবি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই মাস্টারদা বলল, “সুন্দরবন অঞ্চলের লোকায়ত দেবী যিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পূজিত হন। মধু সংগ্রাহক, কাঠুরে, মৎসজীবী মানুষের দেবী বনবিবি। সুন্দরবনের মানুষকে তিনি বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেন, এই বিশ্বাস এখানে প্রচলিত।”
“জানেন মি. দাশগুপ্ত, বনবিবিকে নিয়ে একটি কাহিনি আছে। এক সওদাগরের দুই সুন্দরী স্ত্রী ছিলেন। ছোটো বউয়ের চক্রান্তে সন্তানসম্ভবা বড়ো বউ গুলালবিবি সুন্দরবনে নির্বাসিতা হন। কয়েকদিন পর সেখানেই যমজ পুত্র-কন্যার জন্ম দিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। সদ্যোজাত শিশু দুটির কান্না শুনে বনের বাঘ, কুমির, হরিণ, অজগর, বানর সবাই ছুটে আসে। তারাই দুই ভাইবোনকে লালনপালন করে বড়ো করে তোলে। ছেলেটি বড়ো হয়ে বাঘের রাজা এবং মেয়েটি বনবিবি নামে পরিচিত হয়। স্থানীয় বিশ্বাসে এই বনবিবি হলেন মানুষের রক্ষাকর্ত্রী। তারা মনে করে, বনের বাওয়ালি-মউলেরা বাঘের মুখে পড়লে বনবিবির নাম স্মরণ করে মন্ত্র পড়ে আর সঙ্গে সঙ্গে বাঘও দৌড়ে পালিয়ে যায়। অদ্যাবধি স্থানীয় মানুষ বনে কাজে যাওয়ার আগে বনবিবির পূজা করে।”
শম্ভুনাথবাবুর কথা শেষ হতেই দেখলাম রঘু বলে উঠল, “বনবিবিকে ইব্রাহিম ফকিরের মেয়ে হিসেবেও বিশ্বাস করা হয়। বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে ওঁর যুদ্ধ এখনও এখানকার মানুষের মুখে শুনতে পাবেন।”
আমরা কথা বলতে বলতে পাখিরালয় এসে পৌঁছলাম। সেই জায়গা ঘুরে আমাদের সবারই বেশ ভালো লাগল। আমি তো আলিপুর চিড়িয়াখানার স্বাদ পেলাম, তবে পরিমাণে দ্বিগুণ। শম্ভুনাথবাবুকেও দেখলাম খুবই আনন্দিত এই পরিবেশের সাক্ষী থাকতে পেরে।
পাখিরালয়ের সেই মনোরম পরিবেশ ছেড়ে আমাদের বোট এগিয়ে চলল সেই সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্কের দিকে। সেখান থেকে আমরা গেলাম সজনেখালির ওয়াচ টাওয়ারে। সেই ওয়াচ টাওয়ার থেকে আমরা পুরো সুন্দরবনটাই দেখতে পাচ্ছিলাম। সত্যি! এখানে না এলে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য দেখা থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম। আমাদের সঙ্গে থাকা শম্ভুনাথবাবু তখন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ছবি তুলতে। ওই ওয়াচ টাওয়ার থেকে ওঁকে দেখলাম সূর্যাস্তের মুহূর্তটা উনি ক্যামেরা-বন্দি করে রাখলেন।
আমাদের কথা ছিল সেই রাতটা আমরা বোটেই কাটাব। কিন্তু সব প্রায় দেখা হয়ে যাওয়ায় শম্ভুনাথবাবুর কথামতো আমরা শ্রীধর কাঠি অঞ্চলের একটি গেস্ট-হাউসে গিয়ে উঠলাম। আসলে ওই এলাকাসহ গোসাবার কিছু গ্রামে ওঁর এনজিওর কাজ রয়েছে। পরদিন সেই কাজ সম্পূর্ণ করে আমরা শম্ভুনাথবাবুর সঙ্গে আবারও ফিরে যাব, এমনটাই আমাদের মধ্যে তখন কথা হল।
সুন্দরবন এলাকার এমন একটা গ্রামে রাত কাটানো মানেই রোমাঞ্চ, তাই সেই স্বাদ পেতে কার না ভালো লাগে। আমাদের সেই গ্রামে পৌঁছতে প্রায় সাতটা বাজতে পারে আর ওইসব গ্রামে সাতটা বাজা মানেই অনেক রাত। সুতরাং বোটেই রাতের খাওয়া খেয়ে নিলাম।
সেই গেস্ট-হাউসের সামনে আসতেই মনে হল এ যেন এক পোড়ো বাড়ি। বিল্টু তো ভয়ে ভয়ে আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলতে লাগল, “রজত, ভূতের বাড়িতে আনল নাকি রে আমাদের?”
বললাম, “ব্যাপারটা আগে একটু বুঝে নিতে দে।”
মূল গেটের সামনে গিয়ে শম্ভুনাথবাবু আমাদের দিকে ঘুরে বললেন, “এই গেস্ট-হাউসটা দেখতে পুরোনো হলেও এখানে থাকার মজাই আলাদা।”
“কেন?” আমি প্রশ্ন করলাম।
উনি হাসতে হাসতে বললেন, “সব এখনই জেনে গেলে গেস্ট-হাউসে থাকার আসল মজাটাই তো চলে যাবে, খোকা।”
শম্ভুনাথবাবুকে আমরা আর কোনও প্রশ্ন করলাম না। গেস্ট-হাউসে ঢুকে আমরা যে যার ঘরে চলে গেলাম। কেয়ারটেকার আমাদের ঘরে এসে জলসহ বাকি সব জিনিস দিয়ে গেল।
মাস্টারদাকে ওই কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করতে দেখলাম, “আচ্ছা, শম্ভুনাথবাবু কি এখানে মাঝেমধ্যেই আসেন?”
উত্তরে সে কিছু না বলেই চলে গেল। তার এই আচরণ দেখে আমরা বড়োই অবাক হলাম। তবে মাস্টারদাকে লক্ষ করলাম, সে যেন কিছু একটা চিন্তা করছে।
আমি সেটা তাকে জিজ্ঞেস করতেই পাশ থেকে জোনাকি বলে উঠল, “বুঝলে মাস্টারদা, আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, এক বেলার আলাপে শম্ভুনাথবাবুর কথামতো এখানে চলে আসাটা আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হয়ে গেছে।”
মাস্টারদা গম্ভীর মুখে বলল, “হুম, হতে পারে। তবে আমাদের কিন্তু প্রতিমুহূর্তে সতর্ক থাকতে হবে। তোরা আমার কথা ছাড়া একদম একা একা কোথাও বের হবি না।”
মাস্টারদার কথা শুনে আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। জানি না আমাদের জন্য কোনও বিপদ অপেক্ষা করছে কি না।
রাতে শোবার আগে আমি মাস্টারদাকে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সামনে গিয়ে কিছু বলতে যাব এমন সময় দেখি বিল্টু চেঁচিয়ে উঠল, “ও মা গো!”
তারপর দৌড়ে এসে বিল্টু হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের বলল, “ওদিকে বাথরুমে যেতে গিয়ে দেখলাম উপরের সিঁড়ি দিয়ে একটা লম্বা মানুষের ছায়া যেন নীচে নেমে তেড়ে আসছে আমার দিকে।”
বিল্টুর কথা শুনে আমি হাসতে লাগলাম।— “ওরে বিল্টু, তুই মনে হয় নিজের ছায়া দেখে ভয়ে পেয়েছিস পাগল। ভূত আসবে কী করে এখানে?”
বিল্টু ওই মুহূর্তে কী বলবে বুঝতে না পেরে রাজার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে উঠে দেখি শম্ভুনাথবাবু আমাদের ঘরে এসে হাজির। সেদিন ঘুরতে যাওয়ার বিষয়টা আলোচনা করতেই ওঁর আগমন ঘটেছে। কিন্তু তার আগেই বিল্টু গতরাতে ওর দেখা সেই ছায়ার বিষয়টা ওঁকে জানাল। সেই শুনে শম্ভুনাথবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, “বিল্টুবাবু দেখছি একটু ভিতু গোছের। তা ভূতটা কি বাচ্চা ছিল, নাকি বড়ো?”
শম্ভুনাথবাবুর কথা শুনে মনে হল উনি ব্যাপারটা মজার ছলেই নিয়েছেন। সুতরাং বিল্টুকে আমি ইশারায় চুপ করে যাওয়ার পরামর্শ দিলাম।
এরপর আমরা নীচে নেমে এলাম জলখাবার খেতে এবং শম্ভুনাথবাবুকেও দেখলাম নিজ কাজে উনি বেরিয়ে গেলেন।
খাওয়ার টেবিলে বসে মাস্টারদা বলল, “চল, গেস্ট-হাউসের চারদিকটা একটু ঘুরে দেখি।”
আমরা বন্ধুরা এই প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম এবং মাস্টারদার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম।
ঘুরতে ঘুরতে আমরা হোটেলের পিছনের বাগানে এসে থমকে দাঁড়ালাম। মাটিতে কয়েকটা জুতোর ছাপ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আমি বিষয়টা মাস্টারদাকে জানাতেই দেখালাম সেও আমাদের মতো অবাক।
ভুরু দুটো যতটা সম্ভব উপরের দিকে তুলে মাস্টারদা বলল, “ব্যাপারগুলো কিন্তু যথেষ্ট সন্দেহজনক লাগছে। বিল্টুর রাতে দেখা ছায়া আদতে মিথ্যে নয়। ভূতের না হলেও এটা মানুষের হতেই পারে। যার প্রমাণ এই জুতোর ছাপগুলো। আমাদের কিন্তু আর একটু চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। কেন জানি না মনে হচ্ছে অনেক কিছুই আমাদের চারপাশে ঘটছে অথচ আমরা টের পাচ্ছি না।”
সেখান থেকে আমরা গেস্ট-হাউসের ভিতর কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এলাম। মাস্টারদা তখন মনোযোগ দিয়ে এই সমস্ত অজানা বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত।
বেলা এগারোটা নাগাদ আমরা রঘুর সঙ্গে ওর গ্রাম ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। কিছুটা পথ যেতেই বনবিবির এক মন্দিরের সামনে এসে উপস্থিত হলাম। রঘুর মুখে শুনলাম, মন্দিরটি নাকি বহু পুরোনো এবং খুবই জাগ্রত। সেই মন্দিরের সামনে সাক্ষাৎ শম্ভুনাথবাবুর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গেল। কথা বলে জানতে পারলাম উনি কাজ শেষ করে গেস্ট-হাউসেই যাচ্ছিলেন আমাদের সঙ্গে নিয়ে বেড়ানোর জন্য।
মন্দিরের ভিতর ঢুকে দেবী বনবিবি ও কোলে ছেলে দুখির মূর্তি আমাদের চোখে পড়ল। বনবিবি হিন্দুমতে বনদুর্গা, বনচণ্ডী, বনদেবী বা বনবিবি হিসাবে পূজিত হন। তিনি মাতৃদেবতা। মাথায় মুকুট, গলায় হার এবং বনফুলের মালা পরা। হাতে একটি ত্রিশূল রয়েছে। আর বাহন বলতে একটি বাঘ। যদিও-বা অনেক জায়গায় মুরগিও থাকে। মন্দিরের ভিতর আর যা ছিল বলতে গেলে চারদিকে ছড়ানো কিছু চার-পাঁচদিনের বাসি ফুল আর আধজ্বলা ধূপের ছাই।
দেবীমূর্তি দর্শন করে আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে গেলাম সামনের একটি চায়ের দোকানে। এরপর বৃষ্টি নামায় আমরা বাধ্য হলাম তাড়াহুড়ো করে গেস্ট-হাউসে ফিরে আসতে।
সেই বৃষ্টি ওই যে দুপুর থেকে শুরু হল, চলল গভীর রাত অবধি। ফলে সন্ধেবেলা ওই বৃষ্টির আবহাওয়ায় আমরা সবাই বারান্দায় চেয়ার পেতে, চা ও সঙ্গে মুড়ি তেলেভাজা নিয়ে বসে বেশ ভালোই আড্ডা দিচ্ছিলাম, কিন্তু আবারও বিল্টু সবার মাঝে হুট করে শম্ভুনাথবাবুকে বলে ফেলল, “কাকু, জানেন আজ আপনি বেরোনোর পর আমরা পিছনের বাগানে ঘুরতে গিয়ে অনেক জুতোর ছাপ দেখতে পেয়েছি। আমার মনে হয় রাতের দিকে নিশ্চয়ই কেউ এই গেস্ট-হাউসে ঢোকে। হতে পারে সেই ছায়ার সঙ্গে ওই জুতোর ছাপের কোনও মিল রয়েছে।”
শম্ভুনাথবাবু প্রথমে ব্যাপারটা মন দিয়ে শুনলেও পরে বিল্টুর কথাটা আবারও ওই একই ভঙ্গিতে মজার ছলে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “বিল্টু, তুমি গোয়েন্দা হতে চাও নাকি? আগে বললে ভূত, এখন বলছ মানুষ, তা কোনটা সঠিক বলে ধরব বলে দাও দেখি।”
এরপর রাতে আমরা কথামতোই মাস্টারদার সঙ্গে নিঃশব্দে হাতে টর্চ নিয়ে নিজেদের ঘর থেকে বেরিয়ে গেস্ট-হাউসের বাকি ঘরগুলোর উপর নজর রাখছিলাম, আর ঠিক তখনই ঘটল সেই অদ্ভুত ঘটনা। আমাদের চোখে পড়ল, শম্ভুনাথবাবু নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে একটা কালো রেনকোট গায়ে চাপিয়ে কোথাও একটা বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেলেন।
সেই দৃশ্য দেখার পর আমরা নিজেদের ঘরে ফিরে এলাম ঠিকই, কিন্তু ওই রাতে আমরা কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলাম না। আমরা সবাই জেগে রইলাম যতক্ষণ না শম্ভুনাথবাবু গেস্ট-হাউসে ফিরলেন। উনি যখন ফিরলেন, তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে এবং বৃষ্টিও ততক্ষণে থেমে গেছে।
সারারাত না ঘুমানোর জন্য আমরা ভোরবেলা একটু জিরিয়ে নিলাম এবং দশটা নাগাদ নীচে নামতেই শম্ভুনাথবাবুকে দেখলাম মাস্টারদাকে মজা ছলে বললেন, “গতকাল বৃষ্টির সৌজন্যে আপনারা বেশ ভালোই ঘুম দিলেন দেখছি।”
আমরা কথটা শুনে ইচ্ছার বিরুদ্ধে হাসলাম এবং মাস্টারদাকে তার উত্তরে দেখলাম বলতে, “তা যা বলেছেন। অনেকদিন পর কলকাতার বাইরে এরকম একখানা ঘুম দেওয়া গেল।”
এদিকে সেদিন আবার আমাদের গোসাবা ফেরার কথা। অতএব জলখাবার আর না খেয়ে একেবারে ভাত খেয়ে নিলাম। টেবিলে বসে খাওয়ার সময় বিল্টু আমাদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই শম্ভুনাথবাবুকে গতকাল রাতের বিষয়টা আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করতে গেল। তবে মাস্টারদা ওর হাত টিপে ধরায় সেই যাত্রায় বিল্টুকে আটকানো গেল। বিল্টুর হচ্ছে এই এক সমস্যা, ও কোনোদিনই কোনও কথা গোপন রাখতে পারে না। তবে সে-বারের মতো মাস্টারদর কারণে ওকে থামানো গেল।
তারপর আমরা খেয়েদেয়ে বেরোনোর মুহূর্তে দেখি আর এক কাণ্ড! রঘু দৌড়তে দৌড়তে এসে জানাল, “দাদাবাবু, আপনারা আজ এখান থেকে বেরোতে পারবেন না। গতরাতে সীমান্ত পেরিয়ে একদল পশু চোরাকারবারি এ-পারে এসেছিল এবং বাঘ শিকার করে নিয়ে যাওয়ার সময় এক বনরক্ষী সামনে এসে যাওয়ায় তার সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হয় আর সেই ঘটনায় বনরক্ষী নিজের প্রাণ হারায়। যার কারণে পুলিশ এবং বনদপ্তর থেকে গ্রামের সকলকে করা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে কেউ এখান থেকে বের না হয়। ওদের ধারণা এখান থেকে নিশ্চয়ই কেউ ওদের সাহায্য করেছিল।”
আমরা যখন রঘুর কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলাম, ঠিক তখন শম্ভুনাথবাবুর দিকে একবার লক্ষ করেছিলাম। উনি যেন বিষয়টাকে তেমন পাত্তা দিতে চাইলেন না। রঘুর কথা শেষ হওয়ার পর শম্ভুনাথবাবু হাসতে হাসতে আমাদের সামনে এসে মাস্টারদাকে বললেন, “কী মশাই, আপনি যে দেখছি চিন্তায় পড়ে গেলেন। আরে, এখানে এই সমস্ত ঘটনা প্রায়শই ঘটে। জঙ্গল তার সঙ্গে আবার সীমান্ত এলাকা, তাই অত চিন্তা করবেন না। আজ রাতের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা না-হয় আগামীকাল রওনা দেব।”
এই বলে উনি নিজের ঘরের দিকে এগোতে যাবেন, এমন সময় দেখি ওখানকার স্থানীয় থানার ইন্সপেক্টর সৌমেন জানা আমাদের গেস্ট-হাউসে এসে হাজির। ওঁর পদার্পণে আমরা সকলেই একটু অবাক হয়েছিলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম যে ওঁর আগমন আসলে আমাদের এখানে আসার কারণ জানতে। পুলিশের ভাষায় যাকে বলে জিজ্ঞাসাবাদ করতে।
মাস্টারদা-সহ আমাদের পরিচয় এবং শম্ভুনাথবাবুর এনজিওর কাজের কথা শোনার পর ইন্সপেক্টর জানাকে গতরাতের ঘটনার কথা আরও ভালোভাবে আমাদের বলতে শুনলাম। ওঁর কথায়, “আমাদের এই সুন্দরবনের কোথায় বাঘের বিচরণ ভূমি রয়েছে, তা ভালোভাবেই পাচারকারীরা জানত। আমাদের কাছে সূত্র মারফত খবর আছে যে এই কাজে এখানকার অনেকেই তাদের সাহায্য করছে। অতএব সেই লোকগুলোকে খুঁজে বের করতেই আমরা পুরো গ্রামে তল্লাশি চালাচ্ছি।”
ইন্সপেক্টর জানা আমাদের জানালেন যে একদিকে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ, অন্যদিকে বাংলাদেশ। এই দুই বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হল রয়াল বেঙ্গল টাইগার। বর্তমানে সুন্দরবনে রয়াল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা বাড়ছে। এরই মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বাঘ শিকার নিয়ে। চোরাচালানকারীরা বাঘ শিকার করার জন্য নিত্যনতুন পন্থা অবলম্বন করছে। আর এবার ওরা ছাগলের মাংসে বিষ মিশিয়ে বাঘ শিকার করছে। সম্প্রতি এদের মধ্যে দুজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে এরকম তথ্য পাওয়া গেছে।
“কী, বলছেন কী অফিসার? ছাগলের মাংসে বিষ মিশিয়ে বাঘ শিকার করছে এরা?”
মাস্টারদাকে এমন উত্তেজিত হয়ে পড়তে খুব একটা দেখিনি। ইন্সপেক্টর জানাকে উত্তরে বলতে দেখলাম, “হ্যাঁ, মি. দাশগুপ্ত। আর বিষাক্ত মাংস খেয়েই বাঘেদের মৃত্যু ঘটছে। তারপরে মৃত বাঘের চামড়া এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা করে নিয়ে এসে সেগুলো বিদেশি ক্রেতাদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে।”
শম্ভুনাথবাবুকে দেখলাম ইন্সপেক্টর জানাকে জিজ্ঞেস করতে, “আচ্ছা, সীমান্ত পেরিয়ে যারা এসেছিল, তাদের মধ্যে থেকে কেউ কি গতকাল ধরা পড়েছে?”
ইন্সপেক্টর জানা বললেন, “হ্যাঁ। দুজন ধরা পড়েছে। ধৃত দুই অপরাধীর নাম মহম্মদ শেখ ও ইসমাইল রানা। তারা সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ধলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। ওরা মূলত মৃত বাঘগুলোকে এ-পার থেকে ও-পার নিয়ে যাওয়ার কাজ করে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, এরপরে বাঘের চামড়া ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করার জন্য তারা একটি বিশেষ দলের হাতে তুলে দেয়।”
ইন্সপেক্টর জানার সঙ্গে আরও কথা বলে জানতে পারলাম যে এই এলাকায় পশুদের চোরাশিকার কোনোভাবেই রোধ করা যায়নি। মাঝে একটু কমলেও, বর্তমানে এর পরিমাণ আবারও বেড়েছে।
শম্ভুনাথবাবুকে একটু থেমে বলতে শুনলাম, “মাই গড! এদের কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার, ইন্সপেক্টর।”
ইন্সপেক্টর জানা মাথা নেড়ে বললেন, “হুম। আমরা সেটাই করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।”
এরপর ইন্সপেক্টর জানার প্রস্থান ঘটল। ওঁকে শম্ভুনাথবাবু গেস্ট-হাউসের মূল গেট অবধি এগিয়ে দিলেন।
এদিকে ওঁর এতক্ষণ হাবভাব দেখে মাস্টারদা আমাদের কাছে বলল, “আমার মন বলছে গতকাল রাতে গেস্ট-হাউস থেকে শম্ভুনাথবাবুর বেরিয়ে যাওয়া আর এখানে বাঘ মেরে চুরি ও বনরক্ষীর খুন, কোনও না কোনোভাবে এক সূত্রে গাঁথা।”
এই শুনে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্টু জোরে হেসে উঠে বলল, “তুমি দেখছি গোয়েন্দা হয়ে যাচ্ছ, মাস্টারদা। হা হা হা।”
গম্ভীর মুখে মাস্টারদা বড়ো বড়ো চোখ করে বিল্টুর দিকে একবার তাকাতেই ওর হাসি গেল থেমে। আমরাও হতাশ হয়েই রুমে ফিরে গেলাম। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই যে মাস্টারদার মাথায় তখনও ওই একই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে তাই ফিরেই ঠিক করল ওই রাতে শম্ভুনাথবাবুকে আবারও নজরে রাখতে হবে এবং দরকার পড়লে পিছুও নিতে হবে। কিন্তু এত কিছু মাস্টারদার একার দ্বারা যে সম্ভব নয়, তা সে নিজেও জানত। সুতরাং আমরা সবাই আবারও ওই রাতের অ্যাডভেঞ্চারের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে শুরু করলাম।
বিকেলবেলা রঘু খবর আনল যে গতরাতের ঘটনার পর গ্রামবাসীরা খুবই আতঙ্কিত হয়ে আছে, যার কারণে তারা বনবিবির মন্দিরে সন্ধ্যাবেলা পুজোর আয়োজন করেছে। আর যেই না শোনা, অমনি আমাদের মনে সেই পুজো কেমন হয় সেটা দেখবার ইচ্ছা হল। মাস্টারদাকেও দেখলাম বারণ করল না। সুতরাং সবাই মিলে বেরিয়ে পড়লাম বনবিবির মন্দিরের উদ্দেশে। আমাদের সঙ্গে শম্ভুনাথবাবুও গেলেন সেখানে।
পুজো আরম্ভ হতেই দেখলাম সেখানে এসে উপস্থিত হলেন সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবি পরা এক সুদর্শন পুরুষ। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে উনি এক অত্যন্ত ধনী ব্যক্তি। এখানে বলে রাখি, ওঁকে দেখামাত্র আমাদের সঙ্গে থাকা শম্ভুনাথবাবু একগাল হেসে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। রঘু তখন আমাদের জানাল যে উনি হলেন শ্যামসুন্দর বণিক। এলাকার এক বিরাট প্রভাবশালী ব্যক্তি, যাঁর নামে এখানে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খায়।
মাস্টারদা রঘুকে জিজ্ঞেস করল, “এই শ্যামসুন্দর বণিক কী করেন জানো কিছু?”
উত্তরে রঘু বলল, “আজ্ঞে দাদাবাবু, বণিকদের পর্যটনের ব্যাবসা আছে জানি। এছাড়াও ওঁর অনেকগুলো ব্যাবসা রয়েছে, কিন্তু সেইসব বিষয়ে আমি অতটা ঠিক জানি না।”
শম্ভুনাথবাবু হাত নাড়িয়ে আমাদের এগিয়ে আসতে বললেন। একটু অবাক হলাম বটে, কিন্তু মাস্টারদার সঙ্গে আমরা এগিয়ে গেলাম। সামনে যেতেই বুঝতে পারলাম যে শম্ভুনাথবাবু আসলে আমাদের সঙ্গে শ্যামসুন্দর বণিকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যই ওইভাবে তখন হাত নাড়ছিলেন।
“নমস্কার! আমি শ্যামসুন্দর বণিক। এই তল্লাটেই থাকি। ডাক্তারবাবুর মুখে শুনলাম আপনারা এখানে ঘুরতে এসে খামকা আটকে পড়েছেন। এই সমস্যার জন্য আমি সত্যি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।”
“আরে না না! আপনি ক্ষমা চাইছেন কেন? এমন ঘটনা ঘটলে আমাদেরও তো কর্তব্য প্রশাসনের পাশে দাঁড়ানো। অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়াটা জরুরি।”
এরপর পরিচয় পর্ব সেরে আমরা পুজোর দিকে মন দিলাম এবং পুজো শেষ হতেই শ্যামসুন্দরবাবু মাস্টারদাকে বললেন, “আমার বাড়ি মন্দিরের কাছেই। আপনি যদি রাতের খাওয়াটা সবাইকে নিয়ে আমার বাড়িতে আজ সারেন, তাহলে আমি খুশি হব।”
“না, মানে…”
মাস্টারদাকে কথা শেষ করতে উনি দিলেন না। করজোড়ে এমনভাবে বলতে লাগলেন যে মাস্টারদা বাধ্য হল রাজি হতে। আমরা তখনই শ্যামসুন্দরবাবুর সঙ্গে ওঁর বাড়ির পথে অগ্রসর হলাম।
শ্যামসুন্দরবাবুর বাড়ির অবস্থা, ওঁর বেশভূষা এবং ওঁর ব্যাপারে যেটুকু শুনেছি তার পর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এরকম প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রথম দেখাতেই একেবারে করজোড়ে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানাবেন। আমার মনে তখন সন্দেহ জাগছিল, এটা কোনও চক্রান্ত নয় তো? কিন্তু জানতাম মাস্টারদা থাকতে কোনও চক্রান্তই সে সফল হতে দেবে না।
শ্যামসুন্দরবাবু ওঁর ঘরের সোফাতে আমাদের বসিয়ে বলতে লাগলেন, “আমার স্বর্গীয় পিতা অভয়চন্দ্র বণিক বহুকাল আগে এই ব্যাবসা সম্পত্তি করে গেছিলেন। এখন ওঁর অবর্তমানে এই সমস্ত সম্পত্তি সামলাতে একেবারে হিমশিম খাচ্ছি। ডাক্তারবাবু এখানে এনজিওর কাজ করছেন। খুব ভালো বিষয়। আমি নিজে থেকে তাই ওঁকে ওই নদীর দিকের জমিটা এনজিওর কাজে ব্যবহার করতে বলেছি। একপ্রকার দিয়েই দিয়েছি বলতে পারেন।”
“বাহ! খুব ভালো করেছেন শ্যামসুন্দরবাবু। আপনার মতো মানুষেরা যত এগিয়ে আসবেন ততই সমাজের জন্য ভালো।”
মাস্টারদার কথা শুনে উনি হাসতে হাসতে বললেন, “আমাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছেন হিমাদ্রিবাবু।”
রাতের খাবারে দেখলাম যেন এলাহি আয়োজন। প্রথম পাতে ভাত, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, কচি পাঁঠার ঝোল হলে শেষ পাতে চাটনি-পাঁপড়ের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি।
রাতে গেস্ট-হাউসে ফিরে এসে আমরা একেবারে শুয়ে পড়লাম। এমন ভুরিভোজের পর আর যে শরীর দেয় না। তবে মাস্টারদা কিন্তু শুতে গেল না। সে তখন রয়েছে গভীর রাত হওয়ার অপেক্ষায়।
রাত তখন প্রায় দুটো। দরজা বন্ধ করার শব্দ কানে আসতেই মাস্টারদা আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলতে লাগল, “রজত, উঠে পড়। আমাদের বেরোতে হবে।”
কথাটা ফিসফিস করে বললেও গভীর ঘুমের মধ্যে ওমন অচমকা ডাক শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম। চোখ খুলে মাস্টারদার মুখটা দেখে চিৎকার করে উঠব, এমন সময় সে আমার মুখটা টিপে ধরল। ভাগ্যক্রমে সেই শব্দ আর বাইরে অবধি পৌঁছল না।
“আরে, করছিসটা কী? তুইও কি বিল্টু হয়ে গেলি? আমাদের বেরোতে হবে, চটপট তৈরি হয়ে নে।”
মাস্টারদা কথা শুনে আমার হুঁশ ফিরল। শম্ভুনাথবাবুর রাতে এমন বেরিয়ে যাওয়ার রহস্য কী, তা জানতে যে আমাদের এখন ওঁর পিছু নিতে হবে। আর তাই মাস্টারদার কথামতো আমি তৈরি হয়ে নিলাম। রাজার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ওকে মাস্টারদা রুমে বাকি দুইজন অর্থাৎ জোনাকি আর বিল্টুর সঙ্গে থাকার নির্দেশ দিল।
এরপর টর্চ হাতে আমি আর মাস্টারদা বেরিয়ে পড়লাম এবং গতরাতের মতোই দেখলাম ঠিক একই সাজে শম্ভুনাথবাবু ওই গেস্ট-হাউস থেকে বেরিয়ে গেলেন। মাস্টারদার কথা অনুযায়ী আমরা ওঁর পিছু নিলাম এবং হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলাম সেই বনবিবির মন্দিরের সামনে।
অদ্ভুত ব্যাপার হল যে মন্দিরের ভিতরটা অন্ধকার হলেও মন্দিরের পিছনে মশাল জ্বলছে দেখলাম। সেই আলোতে কারা যেন নিজেদের মধ্যে কথা বলেছে। আমরা ধীরে ধীরে মন্দিরের পাশ দিয়ে হেঁটে সেখানে যেতেই চমকে উঠলাম। কারণ, ওই স্থানে তখন শম্ভুনাথবাবু ছাড়াও উপস্থিত ছিল আরও তিনজন জ্যাকেট পরা লোক, যারা ক্রমাগতভাবে মাটি খুঁড়ে চলেছে। আমরা দূর থেকে সবটাই লক্ষ করছিলাম। শম্ভুনাথবাবু সেই তিনজনকে অনর্গল নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে সেই মাটি খোঁড়ার কাজ শেষ হল এবং তারপর ওখানে যা ঘটল তা আমাদের আরও অবাক করে দিল। আমাদের চোখের সামনে যে জিনিসটি মাটি খুঁড়ে বের করা হল, তা ওই ইন্সপেক্টর জানার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মৃত রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া। প্যাকেটে মোড়া সেই চামড়া দূর থেকে চিনতে আমাদের কোনও ভুল হয়নি। আমরা বুঝতে পারলাম, এই পশু চোরাশিকারি দলের সঙ্গে শম্ভুনাথবাবু বেশ ভালোভাবে জড়িত।
মাস্টারদা আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “দেখলি, কী বলেছিলাম? এই লোকটা ওই খুন আর চোরাকারবারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এবার মিলল তো আমার কথা?”
আমি অবাক চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে শুধু ঘাড় নাড়লাম। তারপর ওই স্থান থেকে ফেরার মুহূর্তে ঘটল আর এক কাণ্ড। আমাদের পাকড়াও করল ট্রেনের সেই কুর্তা-পাজামা পরা কালো মোটামতো লোকটা। ওখানে তাকে দেখে মাস্টারদা আর আমি দুজনেই হকচকিয়ে গেছিলাম। সেই লোকটা আমাদের জোর করে শম্ভুনাথবাবু এবং ওঁর সাঙ্গপাঙ্গদের সামনে নিয়ে গিয়ে হাজির করল আর তখনই ওই লোকটার আসল পরিচয় আমরা জানতে পারলাম। সে হল আসিফ মিঞা, শম্ভুনাথবাবুর ডানহাত। জন্ম বাংলাদেশে হলেও বিনা পাসপোর্টে তার ভারতে রোজকার আসাযাওয়া একেবারে হাতের মোয়া বানিয়ে ফেলেছে। এই বেআইনি পশু হত্যা ও চোরাকারবারের অন্যতম মাথাও তাকে বলা যেতে পারে।
মাস্টারদার সামনে এসে শম্ভুনাথবাবু বললেন, “আপনার বেশি কৌতূহলই আপনাদের বিপদে ফেলে দিল, মি. দাশগুপ্ত। এখন যে আপনাকে মরতে হবে।”
কোমরে গোঁজা পিস্তলটা বের করে শম্ভুনাথবাবু যেই না গুলি ছুড়তে যাবেন, অমনি সামনে পড়ে থাকা গাছের একটুকরো ডালটা কোনোরকমে পায়ে করে তুলে ছুড়ে মারল মাস্টারদা ওঁর দিকে। পিস্তলটা মাটিতে পড়ে যেতেই আমি আসিফ মিঞার হাতে এক ঝটকা দিয়ে সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে পিস্তলটা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিলাম।
ওই দৃশ্য দেখে মাস্টারদা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, “সাবাস রজত, সাবাস!”
আমি ততক্ষণে পিস্তলের নলটা শম্ভুনাথবাবুর দিকে তাক করে ফেলেছি। এবার মাস্টারদা তাঁর দিকে এগিয়ে যেতেই সেই দুষ্টু লোকটি কী করবেন ভেবে উঠতে পারছিলেন না।
“শম্ভুনাথবাবু, এবার আপনার খেলা শেষ। আপনার লোকেদের বলুন সবাই যেন যে-যার স্থানে নিজেদের হাত দুটো উপরে করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনও চালাকি করতে গেলেই রজত কিন্তু এক গুলিতে আপনার খুলি উড়িয়ে দেবে।”
শম্ভুনাথবাবু ইশারা করাতে ওঁর লোকগুলো, এমনকি আসিফ মিঞাও হাত তুলে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। সামনে প্লাস্টিক মোড়া মৃত রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চামড়াটা মাস্টারদা হাতে নিয়ে দেখতে যাবে এমন সময় সেখানে যেন আরও কয়েকজন এসে উপস্থিত হল। অল্প আলো ছিল বলে দূর থেকে তাদের চিনতে না পারলেও সামনে আসতেই উর্দিধারী একজনকে দেখে চিনতে পারলাম। হ্যাঁ, তিনি পুলিশ ইন্সপেক্টর সৌমেন জানা।
আমি ভাবলাম ইন্সপেক্টর জানা হয়তো এগিয়ে এসে মাস্টারদাকে ধন্যবাদ জানাবেন এবং শম্ভুনাথবাবু-সহ বাকিদের গ্রেপ্তার করবেন। কিন্তু পুরোটাই ঘটল একেবারে উলটো। আরও স্পষ্ট করে বললে ইন্সপেক্টর জানা আমার হাতে পিস্তল আর মাস্টারদার হাতে প্লাস্টিক মোড়া মৃত রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া দেখে আমাদেরকেই অপরাধী মনে করলেন এবং আমাদের দুজনকে গ্রেপ্তার করলেন।
“আপনি ভুল করছেন ইন্সপেক্টর। আমরা দোষী নই। এই পশু চোরাশিকারি দলের সঙ্গে শম্ভুনাথবাবু-সহ এই লোকগুলো জড়িত।”
ওঁর এমন কাজে বিরক্ত হয়ে মাস্টারদা যখন কথাগুলো বলছিল, শম্ভুনাথবাবুকে দেখলাম তখন করজোড়ে এগিয়ে গেলেন ইন্সপেক্টর জানার দিকে এবং পায়ে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, “ইন্সপেক্টর, আপনি আমাকে বাঁচান। এঁকে ভালো মানুষ ভেবে নিজের সঙ্গে এখানে নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু এখন দেখছি এই সমস্ত অপকর্মের সঙ্গে ইনিই জড়িত। আমাকে শেষ করে ফেলছিল ইন্সপেক্টর। আপনি না এলে আজ আমাকে মেরে ফেলত।”
শম্ভুনাথবাবুর লোকগুলোও আমাদের মতো ওঁর এমন ভোল বদল দেখে হকচকিয়ে গেছিল। কিন্তু পলক ফেলার মতো সময়ও দিলেন না ইন্সপেক্টর জানা। নিজের রিভলভার বের করে এক-একটা লোককে উনি গুলি করে মেরে ফেললেন। আমি তখন চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলাম, কিন্তু রক্তের ছিটে মুখে এসে লাগতেই তাকিয়ে দেখি তাদের দেহগুলো আমাদের সামনে পড়ে রয়েছে।
“ইন্সপেক্টর, আপনিও তার মানে এর সঙ্গে জড়িত?”
মাস্টারদা হতাশার সুরে ওঁকে জিজ্ঞেস করতেই উত্তর এল, “কী আর করব মি. দাশগুপ্ত, জলে থেকে তো আর কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় না। আর কয়েক বছর পর রিটায়ারমেন্ট। অতএব ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে শম্ভুনাথবাবুর মতো ব্যক্তিদের পাশে থাকতেই হয়!”
আমি আর মাস্টারদা ওঁর কথা শুনে স্তম্ভিত। সেই সময় মাথায় কিছুই আসছিল না। এদিকে শম্ভুনাথবাবুও ভাবলেন আর অভিনয় করে লাভ নেই। পুলিশ ওঁর পক্ষেই রয়েছে, সুতরাং ইন্সপেক্টর জানার পকেটে একটা টাকার বান্ডিল ঢুকিয়ে দিয়ে আসিফ মিঞাকে সঙ্গে নিয়ে উনি চলে গেলেন। অন্যদিকে রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চোরা শিকারকার্যের সঙ্গে যুক্ত থাকার মিথ্যে দায়ে ইন্সপেক্টর জানা আমাদের গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে গেলেন।
থানায় ঢোকামাত্র মাস্টারদা বলতে লাগল, “আপনার কাছ থেকে এটা আশা করিনি ইন্সপেক্টর। আপনাদের মতো পুলিশ কর্মীর জন্যই অপরাধীরা খোলাখুলি এই সমস্ত অপরাধ দিনের পর দিন করে চলেছে। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।”
“দাঁড়ান, দাঁড়ান। আমাকে না-হয় পরে গালাগালি করবেন মি. দাশগুপ্ত। আমার কিছু কথা আছে, সেটা মন দিয়ে শুনুন আগে।”
এই বলে ইন্সপেক্টর জানা আমাদের সামনে আসল চিত্রটা তুলে ধরলেন। ওঁর কথায়, “মি. দাশগুপ্ত, বনবিবির মন্দিরের ওখানে যা ঘটল সবটাই আমার পরিকল্পনা, কারণ এর পিছনে আমাদের বৃহত্তর এক স্বার্থ জড়িয়ে আছে। আপনাদের এখানে আসার ওই রাতে এক গোয়েন্দা বিভাগের অফিসারকে কারা যেন গোসাবা থেকে অপহরণ করে এবং সেই অফিসারকে আজ অবধি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। শম্ভুনাথবাবু আর আপনার উপর আমাদের সন্দেহ হয়, সুতরাং আমরা সবসময় আপনাদের উপর নজর রাখছিলাম। আসিফ মিঞা নামটা ধৃত মহম্মদ শেখের কাছ থেকে শুনেছিলাম। আর আজ যখন বুঝতে পারলাম যে আসিফ মিঞার সঙ্গে শম্ভুনাথবাবুর যোগ রয়েছে তখন বুঝে গেলাম যে আপনি নন, এরাই অপরাধী। কিন্তু গোয়েন্দাদের দাবি অনুযায়ী, এদের পিছনেও নাকি আরও একটা মাথা রয়েছে। তবে সেই মাথা অবধি পৌঁছানো আমাদের পক্ষে একেবারেই সম্ভবপর নয়। ফলে আপনাকে অপরাধী চিহ্নিত করে ওদের ছেড়ে দিলাম যাতে আমি ওদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারি এবং আগামী দিনে মূল মাথা অবধি পৌঁছতে পারি।”
পুরো বিষয়টা শোনার পর মাস্টারদা বলল, “সবই বুঝলাম ইন্সপেক্টর, কিন্তু এত সহজে কি মূল মাথা অবধি আপনি পৌঁছতে পারবেন?”
অবাক হয়ে ইন্সপেক্টর জানা মাস্টারদার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
এদিকে সকালের আলো তখন চারদিকে ফুটে গেছে। স্থানীয় লোকজন ততক্ষণে আমাদের বিষয়ে জেনেও গেছিল। সেখানকার কিছু লোকজন আমাদের শাস্তির দাবিতে থানা ঘেরাও অবধি করেছিল। কিন্তু পুরো বিষয়টা বেশ সাবলীলভাবেই ইন্সপেক্টর ও ওঁর দল সামলেছিলেন।
এদিকে গেস্ট হাউসে আবার আর এক কাণ্ড। হ্যাঁ, রাজা সারারাত আমাদের অপেক্ষায় ঘুমাতে পারেনি। সকালে যখন জোনাকি আর বিল্টু ঘুম থেকে উঠে আমাদের কথা জিজ্ঞেস করে, তখন রাজা আমাদের ব্যাপারে ওদের জানায় এবং সব শুনে আমরা ফিরছি না দেখে ওরা খুবই চিন্তায় পড়ে গেছিল।
বিল্টু তো কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করেছিল, “ওরে জোনাকি রে, ওরে রাজা রে, আর বুঝি আমাদের ফেরা হবে না। মাস্টারদা আর রজত মনে হয় আর বেঁচে নেই। আমাদের এখন এখানেই পচে মরতে হবে।”
সেই মুহূর্তে জোনাকি রেগে গিয়ে বলেছিল, “তুই একটু চুপ কর। এত সহজে হাল ছেড়ে দিস না বিল্টু। মাস্টারদা আর রজতের কিছু হবে না। দেখিস, মাস্টারদা ঠিক রজতকে নিয়ে ফিরে আসবে।”
আর এর মাঝেই আসিফ মিঞাকে সঙ্গে নিয়ে শম্ভুনাথবাবু ওদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আসিফ মিঞাকে ওরা সেই ট্রেনে আসার সময় দেখেছিল, নামটাও জানা ছিল না। গতরাতের ঘটনা অবশ্য ওদের জানার কথা নয়। ফলে চোখের সামনে তাকে দেখে ওদের চোখ উঠে কপালে।
শম্ভুনাথবাবু কাছে গিয়ে বললেন, “তোমাদের একটা খবর দিতে এলাম। তোমাদের শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই এখন অবৈধ পশু শিকার এবং মানুষ হত্যার দায়ে থানায় আটক হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও, আমাদের বেরোতে হবে।”
“কী? এমনটা মাস্টারদা করতেই পারে না। আপনি মিথ্যে বলছেন।” উত্তেজিত হয়ে জোনাকি কথাটা চিৎকার করে বলে উঠল।
সেইসঙ্গে রাজা আর বিল্টু পাশ থেকে বলতে লাগল, “মাস্টারদা না ফেরা অবধি আমরা কোথাও যাব না আপনার সঙ্গে।”
“এমনটা বললে কি চলে? তোমরা যেতে না চাইলে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে।”
এই বলে শম্ভুনাথবাবু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আসিফ মিঞাকে তার লোকদের ডেকে আনতে আদেশ করলেন এবং তারা এসে জোনাকি, রাজা আর বিল্টুকে বলপ্রয়োগ করে তাদের সঙ্গে নিয়ে গেল।
কান্নায় ভেঙে পড়া জোনাকি, রাজা আর বিল্টুকে ওরা চোখ বেঁধে কোথায় নিয়ে যেতে পারে সেটা আমাদের ভাবনার বাইরে ছিল। একটা অন্ধকার ঘরে ওদের আটকে রাখা হয়েছিল। চোখের বাঁধন খুলে দেওয়ার পর ওদের মনের ভয়টা যেন আরও আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরছিল। সারাদিন কেটে গেল, কিন্তু ওদের কান্না আর থামল না।
ওই সময় সব শেষ হয়ে গেল ভাবনাটা মানুষের মাথায় আসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এত সহজেই কি সব শেষ হয়ে যাবে? না। কখনোই নয়। সেই রাতে ওই শয়তানগুলো যখন জঙ্গলের মধ্যে একটি কাঠের বাড়িতে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, ঠিক তখনই ওদের ঘরের দরজায় কে যেন টোকা দিল।
ঘুম চোখে ওরা দরজা খুলতেই দেখে আমি আর মাস্টারদা ওদের সামনে দাঁড়িয়ে। সেই রাতে আবার প্রবল ঝড় ও বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, সেই সঙ্গে জঙ্গলের ভিতর ওই কাঠের বাড়ির বাইরে লাগানো মশলা দুটো গেল নিভে। এমনকি ঘরের ভিতর মোমবাতিটাও ঝোড়ো হাওয়ায় নিভে গেছিল। সুতরাং চারদিকে তখন অন্ধকার। আর অন্ধকারে ওরা দুজনে একেবারে হকচকিয়ে গেছিল।
কাঁপা গলায় শম্ভুনাথবাবুকে বলতে শুনলাম, “আ-আপনি এখানে এলেন কীভাবে মি. দাশগুপ্ত?”
উত্তরে মাস্টারদা বলল, “কী ভেবেছিলেন, খেলা মাঝপথেই শেষ হয়ে যাবে? না, এখনও বাকি আছে। তবে তার আগে বলুন আমার সঙ্গে থাকা বাকি বাচ্চাগুলোকে আপনি কোথায় আটকে রেখেছেন।”
“না! বলব না। ওদের যদি ভালো চান, তাহলে আমাদের এই মুহূর্তে যেতে দিন।”
কথাটা শম্ভুনাথবাবু বলামাত্র পাশ থেকে ইন্সপেক্টর জানা বেরিয়ে এসে বলতে লাগলেন, “আপনাকে আর যেতে দেওয়া হবে না, ড. শম্ভুনাথ সরকার। সময় নষ্ট না করে চটপট বলে ফেলুন বাচ্চাগুলোকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন।”
ওই কথোপকথনের মাঝেই নীচতলা থেকে কিছু শব্দ আমার কানে আসতেই আমি বলে উঠলাম, “মাস্টারদা, নীচের ঘর থেকে কাদের যেন কান্নার আওয়াজ কানে এল। একবার নীচের ঘরটা দেখি চলো।”
আমার কথায় দেখলাম মাস্টারদা সায় দিল এবং দুজনে মিলে নীচে গিয়ে ওই ঘরটা খুলতেই চোখের সামনে রাজা, জোনাকি আর বিল্টুকে দেখলাম বাঁধা অবস্থায় ওরা মাটিতে পড়ে আছে এবং কান্নায় ভেঙে পড়েছে। মুখগুলো দেখে মনে হবে সারাদিন তেমন কিছুই ওদের খেতে দেওয়া হয়নি। আমরা চটজলদি ওদের বাঁধনগুলো খুলে দিতেই তিনজনে আমাদের জড়িয়ে ধরে আরও উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে লাগল।
এদিকে ইন্সপেক্টর জানা শম্ভুনাথবাবু এবং ওঁর ডানহাত আসিফ মিঞাকে জঙ্গলের পশু চোরাকারবার-সহ মানুষ হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার করলেন।
জঙ্গল থেকে আমরা গেস্ট-হাউসে ফিরে আসার মুহূর্তে রাজা, জোনাকি আর বিল্টু এই সমস্ত ঘটনার কথা জানতে চাওয়ায় মাস্টারদা আমাদের থানা থেকে ওদের উদ্ধার করা অবধি পুরো ঘটনাটা এইবার খুলে বলতে লাগল, “গতকাল আমাদের থানায় নিয়ে যাওয়ার আসল কারণটা যখন ইন্সপেক্টর জানা আমাকে জানালেন, তখনই ওঁর সঙ্গে ঠিক করে ফেলি আসল মাথাকে ধরতে গেলে আমাদের আবারও বনবিবির মন্দিরে যেতে হবে। কারণ, সবকিছুর সূত্রপাত ওই স্থান থেকেই। আরও পরিষ্কার করে বললে, পুলিশ ওই মন্দিরের আশেপাশের জায়গাগুলো খুঁড়ে প্রায় তিনজোড়া প্লাস্টিকে মোড়া রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া উদ্ধার করেছে।”
মাস্টারদার কথা শেষ হওয়ার আগেই বিল্টু উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, “কী বলছ গো তুমি মাস্টারদা? তার মানে এতদিন ধরে মন্দিরের মতো পবিত্র স্থানে এই সমস্ত বেআইনি কর্মকাণ্ড চলছিল!”
“হ্যাঁ, এই ধরনের দুষ্টু কপট লোকেরা মানুষের আবেগজড়িত স্থানগুলোকেই সবসময় নিজেদের কার্যসিদ্ধি করবার ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেয়। আসলে তারা ভালো করেই জানে, গ্রামের মানুষেরা অতি সহজ-সরল হয় এবং ধর্মের স্থানকে চোরাকারবারের কাজে লাগালে যেমন মানুষের সন্দেহ হবে না, একইভাবে পুলিশের নজর থেকেও বাঁচা সম্ভব হবে।”
মাস্টারদা ফের বলতে লাগল, “এরপর আমি আর রজত ভাবলাম শম্ভুনাথবাবুর বিষয়টা এলাকার অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি শ্যামসুন্দর বণিককে জানিয়ে রাখি, কারণ ওঁর কাছ থেকে পাওয়া জমি হয়তো ওঁর অজান্তে একইভাবে অসৎ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু ওঁর বাড়ি পৌঁছানো মাত্র আমরা দুজনে অবাক হলাম শম্ভুনাথবাবু-সহ আসিফ মিঞাকে সেখানে আগে থেকে উপস্থিত থাকতে দেখে।”
কথাটা রাজা, জোনাকি আর বিল্টুকে যতটা অবাক করেছে, একইভাবে আমাদেরও অবাক করেছিল যখন তাদের আমরা শ্যামসুন্দরবাবুর বসার ঘরের সোফায় বসে এই চোরাকারবারের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে দেখলাম। তাদের কথায় বার বার উঠে আসছিল, “শ্যামসুন্দরবাবু, আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। মি. দাশগুপ্তকে ইন্সপেক্টর জানা কেস দিয়ে বেশ কিছুদিন জেলে রাখবে। আর আমরা এর মধ্যেই ওই চামড়াগুলো মন্দিরের পিছন থেকে বের করে পাচার করে দেব।”
শ্যামসুন্দরবাবুকে তার উত্তরে বলতে শুনেছিলাম, “ডাক্তারবাবু, আমার চিন্তা অন্য বিষয় নিয়ে। ইন্সপেক্টর জানা আপনার থেকে টাকা খেয়েও যদি সরকারের চাপে পালটি খায়, তখন কী হবে? ও-পার থেকে খবর এসেছে, আমাদের সেই পুরোনো চিনা মক্কেল অতি দ্রুত চামড়ার ডিলটা ফাইনাল করতে চাইছে। তাই চামড়াগুলো আজ রাতের মধ্যেই সীমান্ত পার করাতে হবে।”
ওঁদের এই সমস্ত কথা মাস্টারদার বুদ্ধিতে আমি মোবাইল ফোনে রেকর্ড করে নিয়েছিলাম এবং তারপর থানায় ফিরে গিয়ে ইন্সপেক্টর জানাকে ভিডিও সমেত পুরো ঘটনাটা ওঁর সামনে তুলে ধরলাম। সব স্বীকারোক্তি তখন ওঁর টেবিলে, অতএব বলতে দ্বিধা নেই যে শ্যামসুন্দর বণিক হচ্ছেন এই পুরো চক্রের আসল মাথা, যিনি দিনের পর দিন সকলের আড়ালে থেকে এই অপরাধমূলক কাজের পরিচালনা করে আসছেন।
“এরপর কী হল মাস্টারদা, শ্যামসুন্দরবাবু কি গ্রেপ্তার হলেন?”
জোনাকির এই কৌতূহলপূর্বক প্রশ্নের উত্তরে মাস্টারদা বলল, “হুম। তা নয়তো কী? ইন্সপেক্টর জানা আমাদের সঙ্গে নিয়েই শ্যামসুন্দরবাবুকে গ্রেপ্তার করতে ওঁর বাড়ি গেলেন এবং ওঁকে গ্রেপ্তার করার মুহূর্তে তোদের যে জঙ্গলের একটি কাঠের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখা হয়েছে, সেটা জানতে পারলাম। ব্যস, তারপর আমরা সোজা পৌঁছে গেলাম ওই কাঠের বাড়িতে এবং বাকি দুই অপরাধীকে গ্রেপ্তার করার সঙ্গে তোদেরও মুক্ত করে আনলাম।”
আমরা ততক্ষণে গেস্ট-হাউসে ফিরে গেছিলাম। রঘু এবং গেস্ট-হাউসের কেয়ারটেকার আমাদের মুখ থেকে পুরো বিষয়টা জানার পর একেবারে হতবাক হয়ে গেছিল। অবশ্য এটাই প্রত্যাশিত ছিল। কারণ, গ্রামের মানুষেরা প্রায় প্রত্যেকেই এতদিন ধরে শ্যামসুন্দরবাবুকে অন্য চোখে দেখত। তাদের কাছে উনি ছিলেন ঈশ্বরের সমতুল্য। একইভাবে ডাক্তারবাবু হিসেবে সুন্দরবনের ওই অঞ্চলে শম্ভুনাথবাবুরও যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। কিন্তু এইসবের আড়ালে ওঁদের বীভৎস মুখগুলো এখন সামনে আসতেই এক ঝটকায় সবকিছুর ইতি ঘটল।
আমাদের মাঝে তখন এসে উপস্থিত হলেন ইন্সপেক্টর জানা এবং উনি এসেই মাস্টারদাকে ধন্যবাদ জানালেন। পরদিন দুপুরে আমাদের থানায় ডেকে পুলিশের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হল এবং ইন্সপেক্টর জানা এটা জানাতে ভুললেন না যে কিছুদিনের মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের আরও বৃহৎভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। তবে আমার মতে এই সংবর্ধনা পাওয়ার যোগ্য একমাত্র মাস্টারদা।
হ্যাঁ। কারণ শুরু থেকে মাস্টারদাই একমাত্র যে শম্ভুনাথবাবুকে আগাগোড়া সন্দেহ করে আসছিল। যদিও আমরা বিষয়টাকে প্রথমে গুরুত্ব দিইনি। যাই হোক, সেদিন বিকেলের ট্রেনেই আমরা ফিরে এলাম কলকাতায়। কিন্তু এই অল্প কয়েকদিনের রোমাঞ্চকর স্মৃতি সারাজীবন আমাদের মনের ডায়েরিতে রয়ে যাবে।
সত্যি বলতে, আমাদের এই সুন্দরবন সফর প্রথম থেকে শুরু করে শেষ অবধি ছিল শুধুই টানটান অ্যাডভেঞ্চার। সেই অর্থে আমরা বাঘমামার দেখা পাইনি ঠিকই, তবে যে অভিজ্ঞতা আর সম্মান ওখান থেকে নিয়ে ফিরেছি, তা কোনও অংশেই কম নয়।
গল্পের শেষে ঈশ্বরের কাছে একটাই প্রার্থনা করি যাতে সকল মানুষের আশীর্বাদ ও ভালোবাসা সঙ্গে নিয়ে আমরা এভাবেই যেন মাস্টারদার সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারি জীবনের আরও অনেক রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির অনুসন্ধানে।
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস