প্রবন্ধ
FREE SHIPPING IN INDIA
প্রবন্ধ
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ইংরেজরা তিন-তিনবার বন্দি শিবির তৈরি করে। প্রতিটির উদ্দেশ্য এবং গঠন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু এই বন্দি শিবির গড়ে তুলতে গিয়ে ইংরেজরা উচ্ছেদ করে বহু জনজাতি এবং তাদের সংস্কৃতি। সেই কাহিনি যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি নির্মম।
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯০৫ সালে ইংরেজ সরকার ভারতে প্রথম বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব আনে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের বিরুদ্ধে সারা বাংলা জুড়ে জ্বলে ওঠে বিদ্রোহের আগুন। ইংরেজ উপনিবেশকে এই দেশের মাটি থেকে উচ্ছেদ করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে বাংলার যুবসমাজ। ইংরেজ বিদ্বেষের আন্দোলনে বিক্ষিপ্তভাবে এবং গোপনে বিপ্লবীরা আগেই সক্রিয় ছিলেন। এবার সেই বিদ্রোহ সংগঠিত হতে থাকে। বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠন কলকাতায় ও বাংলায় সংঘবদ্ধ আক্রমণের ছক কষতে থাকে।
বিপ্লবীদের ভয়ে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগও সক্রিয় হয়ে ওঠে। লাল বাজারের গোয়েন্দাদের দপ্তরে খবর আসে চিফ ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ডকে মারবার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছেন বিপ্লবীরা। এই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বাংলার রাজনৈতিক কর্মী এবং বিপ্লবীদের কঠিন শাস্তি দেবার জন্য কুখ্যাত ছিলেন। ইংরেজ সরকার কিংসফোর্ডকে বাঁচাবার জন্য তাঁকে রাতারাতি বদলি করে দেয় মুজফফরপুরে। কিন্তু বিপ্লবীরা তাঁকে ছেড়ে দেবার পাত্র ছিলেন না অত সহজে।
১৯০৮ সালে এপ্রিল মাসের তিরিশ তারিখ রাতে কিংসফোর্ড তাঁর বন্ধু উকিল কেনেডির সঙ্গে তাস খেলে ক্লাব থেকে ফিরছিলেন ঘোড়ায় টানা গাড়িতে। প্রথম গাড়িতে ছিলেন সস্ত্রীক উকিলবাবু আর পিছনে হুবহু একইরকম দেখতে আর একটি গাড়িতে কিংসফোর্ড ও তাঁর স্ত্রী। প্রথম গাড়িতে বিপ্লবীরা বোমা ফেলেন। সেই বোমার আঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান উকিল কেনেডি ও তাঁর স্ত্রী। কিন্তু কিংসফোর্ড থেকে যান অক্ষত।
এই বোমা ফেলেছিলেন এক আঠারো বছরের কিশোর বিপ্লবী, যাঁহার নাম ছিল ক্ষুদিরাম বসু। নিশানা ঠিক থাকলে হয়তো সেদিন কিংসফোর্ডের ভবলীলা সাঙ্গ হত। বোমা মারার সময় ক্ষুদিরামের সঙ্গী ছিলেন কানাইলাল দত্ত। ঘটনাস্থল থেকে দুজনে দু-দিকে পালিয়ে যান। ক্ষুদিরাম এবং কানাইলাল দুজনেই পুলিশের হাতে ধরা পড়েন মুজফফরপুর স্টেশনে। তাঁদের গ্রেপ্তারের পর পুলিশ আসল ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজতে থাকে। জানা যায়, মানিকতলায় বারীন্দ্রকুমার ঘোষের বাড়িতে পুরো পরিকল্পনা করা হয় অনুশীলন সমিতির সভায়। এই মামলায় অভিযুক্তদের সঙ্গে উঠে আসে অরবিন্দ ঘোষের নামও।
কলকাতার চারটি জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে মানিকতলা থেকে উদ্ধার হয় বোমা বানাবার সরঞ্জাম, কিছু চিঠিপত্র ও অন্যান্য গোপন তথ্য। গ্রেপ্তার হন ২৭ জন বিপ্লবী। প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা সাজিয়ে সমস্ত অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে চালান করা হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। এরপর জেলের ভিতরেই ঘটে যায় আরও মারাত্মক সব ঘটনা।
মামলা চলাকালীন পুলিশের চাপের মুখে পড়ে বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়ে যান। কিন্তু আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর বয়ান লিপিবদ্ধ করতে অস্বীকার করেন। এরপর দুই বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু নরেন্দ্রকে জেলের মধ্যে হত্যা করার পরিকল্পনা করে দুটি রিভলভার জেলের ভিতরেই জোগাড় করেন। কানাইলাল অসুস্থতার ভান করে জেল হাসপাতালের বিছানায় শয্যা নেন। জেল কর্তৃপক্ষকে তিনি জানান, কিংসফোর্ডকে মারার যে পরিকল্পনা ছকা হয়েছিল, সব তিনি বলে দিতে চান, শুধু নরেন্দ্রর সঙ্গে কিছু কথা বলে নেবার পর। জেল কর্তৃপক্ষ রাজি হয়। নরেন্দ্রনাথ কানাইলালের সঙ্গে দেখা করতে আসা মাত্রই কানাইলালের বুলেটের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাঁর শরীর।
নরেন্দ্রর ভয়াবহ হত্যার পর অবিলম্বে কানাইলাল ও সত্যেন্দ্রনাথকে ফাঁসি দেওয়া হয় হত্যার অপরাধে। আলিপুর বা মানিকতলা বোমা মামলায় একমাত্র অরবিন্দ ঘোষ ছাড়া আর বাকি সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তারপর উচ্চতর আদালতের রায়ে সব অভিযুক্তদের পাঠানো হয় দ্বীপান্তরে। তখন দ্বীপান্তর বা কালাপানির অর্থ ছিল আন্দামানের সদ্য নির্মিত সেলুলার জেল। বহু পরিকল্পনার পর এই অভূতপূর্ব কয়েদি নিবাস তৈরি করে ইংরেজ সরকার, যার আসল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় বিপ্লবীদের কঠোর ও ভয়াবহ শাস্তি দিয়ে বিদ্রোহ দমন করা।
স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে আন্দামানের সেলুলার জেলকে বলা হত মুক্তি তীর্থ। কিন্তু এই জেলে স্বাধীনতা সংগ্রামী অসংখ্য মানুষের উপর পাশবিক অত্যাচার চালানো হত ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অভিযোগে। দেশমাতৃকার মুক্তির পর সেলুলার জেল দর্শন করাকে তীর্থযাত্রা বলা হত। তবে এই বিষয়ে দ্বিমতও রয়েছে। কালাপানি পার করে সেলুলার জেলে পৌঁছলে ধরাধাম থেকে মুক্তি পেতে হত বিপ্লবীদের। তাই কি সেই শাস্তির কারাগারকে মুক্তির তীর্থ বলে অভিহিত করা হত? কে জানে। সেলুলার জেল ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ উপনিবেশকারীদের শোষণের এক ভয়াবহ স্থাপত্যের নিদর্শন হয়ে রয়ে গিয়েছে, যার পিছনে আছে মানুষের কষ্ট, নিপীড়ন এবং ত্যাগের কাহিনি।
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ইংরেজরা তিন-তিনবার বন্দি শিবির তৈরি করে। প্রতিটির উদ্দেশ্য এবং গঠন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু এই বন্দি শিবির গড়ে তুলতে গিয়ে ইংরেজরা উচ্ছেদ করে বহু জনজাতি এবং তাদের সংস্কৃতি। সেই কাহিনি যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি নির্মম। তথাকথিত সভ্য সমাজের আড়ালে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা নিজেদের জীবনে যথেষ্ট সুখী ছিল। সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে তারা অবলুপ্ত হতে থাকে পৃথিবীর বুক থেকে। প্রায় ৩৬টি বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে আজ বেশ কিছু সম্পূর্ণ বিলীন এবং বাকিরা বিলুপ্তির পথে। ইংরেজ উপনিবেশ এই মানুষদের হারিয়ে যাওয়ার কাজটা ত্বরান্বিত করে তোলে।
ভারত মহাসাগরে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ বড়ো বিচিত্র জায়গা। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষকে বিস্মিত করেছে এই উপকূল। ঝড়ে কোনও দ্বীপে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে পড়া জাহাজের যেসব নাবিকেরা নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে আসতে পারত, তাদের কাছে বিচিত্রসব কাহিনি শোনা যেত। ঘন জঙ্গলের ভিতরে কালো কালো মানুষেরা নাকি ভিনদেশি মানুষ দেখলে তির-ধনুক নিয়ে আক্রমণ করে; তারা মানুষ ধরে ধরে খায়, ইত্যাদি।
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে বাণিজ্য করতে এসে মাল আমদানি আর রপ্তানি করার জন্য ভারত মহাসাগরের এই অঞ্চল দিয়ে যাতায়াত করত। ঝড়ে বহুবার জাহাজ ভেঙে পড়ে তাদের প্রচুর ক্ষতি হতে থাকে। ভারতের প্রধান ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে উদ্ধারকারী দল নিয়ে আসতে সময় লেগে যেত প্রচুর। এই অঞ্চলে আরও একটা বড়ো সমস্যা ছিল জলদস্যুদের হানা। তাদের মধ্যে যেমন ছিল পর্তুগিজ বণিকদের ভাড়াটে সৈন্য, তেমনি মালয় দেশের দুর্ধর্ষ দস্যুরা। সবচাইতে কাছের উপকূল ছিল বর্মা। সেখান থেকেও জলদস্যুরা ইংরেজদের বাণিজ্য জাহাজ আক্রমণ করত। চড়া মাশুল দিয়ে তবেই পরিত্রাণ পাওয়া যেত। নচেৎ জীবন বলি দিতে হত তাদের হাতে। মোগল আমলেও বাদশাহরা এই অরাজকতা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতেন না। হয়তো তাদের কোষাগারেও যেত সংগঠিত জলদস্যুদের আদায় করা লুঠের মালের একটা বখরা।
১৭৮৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড ব্লেয়ারকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে জরিপের কাজে পাঠানো হয়। তিনি দক্ষিণ আন্দামান অঞ্চলে চ্যাথাম দ্বীপকে বন্দি শিবির বানাবার উপযুক্ত বলে মনে করেন। এই উপকূলের নাম রাখেন পোর্ট কর্নওয়ালিস। পরবর্তীকালে এই বন্দরের নাম দেওয়া হয় পোর্ট ব্লেয়ার, ক্যাপ্টেন ব্লেয়ারের নামেই। শুধু বন্দি শিবির বানালে তো চলবে না, তাই ক্যাপ্টেন ব্লেয়ার এই দ্বীপে নৌঘাঁটি বানাবার প্রস্তাব দেন।
ব্লেয়ারকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপনিবেশ গড়ে তোলার নেতৃত্ব দেয়। প্রথমে ভারতের বিভিন্ন জেল থেকে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বন্দিদের পাঠানো হয় আন্দামানে। ব্লেয়ারের আদেশে জঙ্গল কেটে সাফ করার কাজে লাগানো হয় তাঁদের। বিনা পারিশ্রমিকে বন্দর ঘাঁটি গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি করেছিল, তাতে আঘাতের পর আঘাত আসতে থাকে। আন্দামানের আবহাওয়ায় ইংরেজরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। কলকাতা থেকে ওষুধ পাঠানো বা অসুস্থ মানুষদের ফেরত পাঠানো খুবই কঠিন হয়ে যায় প্রতিকূল আবহাওয়ায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। আন্দামানের আদিম অধিবাসীরাও জঙ্গল কাটার প্রতিবাদস্বরূপ আক্রমণ করে মেরে ফেলে বহু বন্দিকে। কাজেই বছর দু-এক পরই এখান থেকে পাততাড়ি গোটাতে হয় সরকার বাহাদুরকে। হাতে গোনা সামান্য যে ক’জন বন্দি তখনও বেঁচে ছিলেন, তাঁদের আবার ভারতের জেলে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এরপর পঞ্চাশ বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আন্দামানে আর নতুন কোনও বন্দি শিবির বানাবার পরিকল্পনা করেনি। কিন্তু ১৮৪৪ সালে প্রচুর যাত্রী, সেনাবাহিনী এবং সামরিক রসদ নিয়ে ব্রিটেনের দুটি জাহাজ ব্রিটন আর রানিমেড আন্দামানের দ্বীপে ভেঙে পড়ে। দলে দলে দ্বীপের অধিবাসীরা জঙ্গলের আড়াল থেকে সমুদ্রের পাড়ে এসে হামলা চালায় জাহাজ দুটিতে। কিছু ইংরেজ এবং বহু অধিবাসী নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে মারা যায়। কলকাতা থেকে পাঠানো উদ্ধারকারী জাহাজ প্রায় দেড় মাস পর উদ্ধারকার্য চালিয়ে যাত্রীদের জীবন বাঁচায়, কিন্তু প্রবল অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় কোম্পানির। কাজেই আবার নতুন করে নৌঘাঁটি বানাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন কোম্পানির কর্তারা। তবে তেমন করে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি তখনও।
এরপর ১৮৫৭ সালে দেশজুড়ে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়। বিদ্রোহ দমন করে পরের বছরই কোম্পানির কর্তারা নড়েচড়ে বসেন আন্দামানে বন্দি শিবির বানাবার জন্য। ফলে ভারতে এল ইংরেজ সামরিক বাহিনী। বিদ্রোহী বহু সিপাহিকে ইংরেজরা বিনা বিচারে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয় দিল্লিতে। এই নৃশংস নরসংহার ব্রিটেনে প্রচুর আলোড়ন তোলে। লন্ডনে ব্রিটেনের সংসদ ভারত শাসনের দায়িত্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে কেড়ে নেয়। তখন থেকে ইংল্যান্ডের রানিই হলেন ভারতের সর্বেসর্বা অধিনায়ক।
জনমতের চাপে পড়ে সিপাহিদের মৃত্যুদণ্ড মুকুব করে আজীবন কারাবাসের আদেশ দেয় আদালত। ফলে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় জেলে বন্দিদের খাঁচায় ধরে রাখার জন্য জায়গার অভাব দেখা দেয়। অতিরিক্ত জনসংখ্যার ভারে জেলের ভিতরে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হিমশিম খেতে থাকে পুলিশ। সিপাহি বিদ্রোহের পর যে-কোনো ভারতীয়কেই সাদা চামড়ার মানুষ অবিশ্বাস করতে থাকে।
১৮৫৮ সালে প্রায় দুশো বন্দিকে আন্দামানের চ্যাথাম দ্বীপে নিয়ে আসে একটি ব্রিটিশ জাহাজ। এবার বন্দি শিবিরের দায়িত্ব দেওয়া হয় জন প্যাটিসন ওয়াকারকে। পরে এই লোকটি নৃশংসভাবে বন্দি ও আদিবাসী নিধনের পাণ্ডা হয়ে দাঁড়ায়। দুশো বন্দির প্রায় অর্ধেক লোক জাহাজেই অসুখে ভুগে এবং সমুদ্রযাত্রার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বা অনাহারে মারা যান। বাকিদের অনেকেই বন্দি শিবিরে এসে অসুস্থ হয়ে পরলোকে যাত্রা করেন। এরপরও দলে দলে বন্দিদের পাঠানো হয় আন্দামানে। দেড় বছরে প্রায় তিন হাজার বন্দি আন্দামানে নিয়ে আসা হয় করাচি, কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বম্বে থেকে। চ্যাথাম দ্বীপে পানীয় জলের অভাব দেখা দেওয়ায় রস আইল্যান্ডে বন্দি শিবির সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অচিরেই।
শুরুতে ইংরেজ পুলিশ ও সেনারা বন্দিদের উপর নির্মম ছিল না। ভালো জীবন কাটালে তাঁদের দ্বীপেই পারিবারিক জীবন শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ওয়াকারের পুলিশেরা বন্দিদের কাজে লাগায় জঙ্গল কেটে কাঠ জোগাড় করে শিবির তৈরি করতে।
রস আইল্যান্ডে গড়ে তোলা হয় পুলিশ ব্যারাক। বন্দিদের জন্য কুটির বানানো হয়। যেসব ইংরেজ রস আইল্যান্ডে চাকরি করতে এসেছিল তাদের জন্য বানানো হয় ক্লাব, বাজার আর জিমখানা। ঘন জঙ্গল কেটে বসতি তৈরি করা খুবই কষ্টকর ছিল। তাই বন্দিরা প্রায়শই পালাতে চেষ্টা করতেন। যেহেতু বন্দিদের বেশিরভাগই যোদ্ধা ছিলেন, তাই তাঁদের সাহস এবং শক্তি দুইয়েরই অভাব ছিল না। পালিয়ে যেতে গিয়ে অনেকেই ধরা পড়তেন আন্দামানের মানুষের হাতে। এই সময় অনেক বন্দির হাতে বা পায়ে বেড়ি পরানো হত এবং গলায় ধাতুর চাকতি ঝুলিয়ে দেওয়া হত পরিচয় হিসাবে। আন্দামানের অধিবাসীরা এমন বন্দিদের উপর আক্রমণ করত না, নিজেদের সঙ্গেই তাঁদের রেখে দিত। এমন অজস্র ঘটনা ঘটে যেত প্রায়ই। কিন্তু সাদা চামড়ার ইংরেজ বা তাদের ভারতীয় গোলাম দেখলেই তারা মারাত্মক আঘাত হানত। এমন আক্রমণে বহু ইংরেজ এবং ভারতীয় মারা যায়।
ধীরে ধীরে আন্দামান অঞ্চলে ইংরেজদের দাপট বাড়তে থাকে। দ্বীপে তাদের উপস্থিতিতে ভারত মহাসাগরের এই অঞ্চলে জলদস্যুদের উপদ্রব কমতে থাকে। মালয় এবং বর্মার দুর্ধর্ষ ডাকাতদের ধরে ভারতের প্রধান ভূখণ্ডে না পাঠিয়ে আন্দামানের জেলেই রাখা হতে থাকে। এরা আবার খুব ভালো কাঠের কাজ জানত। তাদের দিয়ে আসবাবপত্র বানিয়ে নিত ইংরেজরা। কিন্তু এই বার্মিজ ডাকাতরা পালিয়ে যেত সমুদ্র সাঁতরে বা নৌকায় করে। এমনকি উপজাতিদের নৌকো চুরি করে পালাতেও সিদ্ধহস্ত ছিল তারা।
তবে সবসময় পালিয়ে গেলেই যে বাঁচা যেত তা কিন্তু নয়। একবার আশিজন বন্দি বার্মিজ জলদস্যুদের সাহায্যে একসঙ্গে রস আইল্যান্ড থেকে পালায়। পালাতে ব্যর্থ হয়ে ইংরেজদের হাতে ধরা পড়লে কিন্তু চরম শাস্তি দেওয়া হত— ফাঁসি। ধৃত পলাতক বন্দিদের মেরে ফেলার পক্ষে ওয়াকার যুক্তি সাজিয়ে উপরমহলে চিঠি লিখে জানায় যে, সমুদ্রপথে বা গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যাওয়া বাধা দেওয়া কোনও পুলিশ বা নৌসেনার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ আন্দামানে জলে ও জঙ্গলে দুই দিকেই বিপদ বড়ো গভীর।
ওয়াকার আন্দামানের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বন্দিদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় বসবাস করে এবং উপজাতিদের হামলা মোকাবেলা করে ক্রমশ কঠোর হয়ে উঠতে থাকে। সমুদ্রতীরে সামান্য আলোর দেখা পেলেই সে সিপাইদের বন্দুক ছুড়তে নির্দেশ দেয়। আন্দামানের আসল অধিবাসীরা এই আলো জ্বালাত তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের ছন্দে। কিন্তু বহু সরল নির্দোষ আদিবাসী মারা যেতে থাকে ইংরেজ পুলিশ আর নৌবাহিনীর হাতে। ইংরেজ ও উপজাতির মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ নিয়মিত হতে থাকলে কলকাতায় প্রশাসক মহলও ওয়াকারকে সতর্ক করে দেয় এবং জানায় অন্যায়ভাবে উপজাতি নিধন তারা আদপেই ভালো চোখে দেখছে না।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রায় এক হাজার বন্দির জন্য কুটির তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু বিষাক্ত সাপ ও পোকামাকড়ের কামড়ে মারা যায় বহু লোক, অনেকে উপজাতিদের হাতে প্রাণ দেয়। ইতিমধ্যে দু-একজন বন্দি ওয়াকারকে হত্যার পরিকল্পনা করে, কিন্তু গুপ্তচরেরা আগেই সাবধান করে দেয় ওয়াকারকে। সে জানে বেঁচে গিয়ে বন্দিদের উপর আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। আগে উপজাতি লোকেরা অসংগঠিত আক্রমণ চালাত কখনো-কখনো। কিন্তু ১৮৫৯ সালের এপ্রিল মাসের ছয় তারিখে প্রায় দুশো উপজাতির মানুষ তির-ধনুক নিয়ে ইংরেজদের ব্যারাক আক্রমণ করে।
সপ্তাহ খানেক যেতে না যেতেই প্রায় দেড় হাজার উপজাতির একটি দল আবার ইংরেজ কুঠি দখল করার চেষ্টা করে। বেশ কিছু বন্দি হতাহত হয়। ডাকাতি হয়ে যায় কুঠিতে। ইংরেজদের বাসনকোসন, পোশাকআশাক লুঠ করে নিয়ে যায় আন্দামানের মানুষেরা। এবার যেসব বন্দিদের হাতে বা পায়ে বেড়ি পরানো ছিল, তাদের কোনও ক্ষতি না করে অন্যদের উপর হামলা চালায় উপজাতিরা। কারণ তারা বন্দিদের শনাক্ত করে তাদের উপর সদয় হয়, কিন্তু ততটাই নির্দয় আঘাত করে ইংরেজ এবং তাদের ভারতীয় ভৃত্যদের। ফলে বন্দি শিবির জুড়ে ভয়ের আবহাওয়া তৈরি হয়।
তৃতীয় হামলা আসে এই ঘটনার মাস খানেকের মধ্যে। বিখ্যাত এবারডিনের যুদ্ধ বলে সবাই যে হামলাকে চেনে। এই যুদ্ধে বন্দিদের ক্ষতি কম হয়, কিন্তু শয়ে শয়ে উপজাতির মানুষ ইংরেজদের গোলা ও বন্দুকের আঘাতে প্রাণ দেয়। তবে বন্দি শিবির থেকে পলাতক ভারতীয় বন্দি দুধনাথ তিওয়ারির দেওয়া খবরেই ইংরেজরা আগে থেকে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। দুধনাথ সিপাহি বিদ্রোহে ধরা পড়ে চালান হয় আন্দামানে। পালাতে গিয়ে সে উপজাতিদের খপ্পরে পড়ে যায় এবং প্রায় দেড় বছর তাদের গ্রামেই বসবাস করে। এক রাতে তার পালানোর সুযোগ আসে যখন উপজাতিরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে হামলা চালাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। পালিয়ে ইংরেজ কুঠিতে এসে দুধনাথ খবর দেয় এবং উপজাতিদের আক্রমণ প্রতিহত করা হয়। ইংরেজরা দুধনাথকে শাস্তি না দিয়ে মুক্তি দেয়।
ওয়াকারের পদোন্নতি হলে তাকে আন্দামানের বন্দি শিবিরের দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন হাটন বন্দি শিবিরের দায়িত্ব নেন। পেশায় সামরিক বাহিনীর লোক হলেও এই ভদ্রলোক যথেষ্ট সহমর্মিতার সঙ্গে বন্দি শিবিরের সমস্যার মোকাবেলা করেন। তাঁর উদ্যোগেই আন্দামানের উপজাতিদের সঙ্গে ইংরেজরা বন্ধুত্ব করার চেষ্টা শুরু হয়। উপজাতির মানুষের আক্রমণ কমতে থাকে ক্রমশ। ওয়াকারের মতো নিষ্ঠুরভাবে জঙ্গল না কেটে শুধু যতটুকু বন্দি শিবিরের জন্য প্রয়োজন, ঠিক ততটুকু অংশেই জঙ্গল কাটা হতে থাকে। অনেক উপজাতিই বুঝতে পারে, বাইরের দুনিয়ার মানুষের উপর হিংস্রতা তাদের স্বাভাবিক জীবন আর ফিরিয়ে দেবে না। তাই বিভিন্ন ইউরোপীয় জিনিস হস্তগত করার আশায় তারা প্রায় হাত পেতে ভিক্ষে করতে শুরু করে। এর ফলে বদলে যায় তাদের বহুবছর ধরে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি এবং অভ্যাস। বাইরের মানুষের সংস্পর্শে আসার ফলে তাদের দেহে বাসা বাঁধে নানা রোগব্যাধি। যে-সমস্ত ভাইরাস বাইরের লোকের শরীরে সুপ্ত ছিল, তারা উপজাতির মানুষের শরীরে ঢুকে অবাধে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে, কারণ তাদের দেহ এই ভাইরাসকে প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখত না।
উপজাতির যেসব দল চেয়েচিন্তে জিনিস আদায় করতে কুণ্ঠা বোধ করত, তারা মাঝরাতে চুরি করাও শুরু করে ইংরেজ কুঠিগুলোতে। ফলে তাদের স্বভাব ও আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন আসে। অজান্তেই তারা নিজেদের বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিতে থাকে ক্রমশ। তবে জারোয়া এবং সেন্টিনেলিসরা একেবারেই ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করেনি।
ইংরেজ সরকারের নির্দেশে উপজাতির মানুষের উপর গুলি চালানো নিষিদ্ধ করা হয়। সেই সঙ্গে বিদ্রোহী উপজাতিদের বন্দি করে রাখার জন্য গড়া হয় আন্দামান হোমস। চিরাচরিত জেল না হলেও সেই হোমগুলো ছিল মুক্ত বন্দিশালা, যেখানে রাখা হত শুধু উপজাতির মানুষদের। তাদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা হয়, কৃত্রিম সভ্যতা তাদের ঘাড়ে চাপানো হয়। ফলে উন্নতির বদলে তাদের সংস্কৃতি ও স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। বাড়তে থাকে নবজাত শিশুর মৃত্যুর হার।
জনজাতির জন্য প্রথম হোম গড়ে তোলা হয় ভাইপার আইল্যান্ডে। জলাজঙ্গলে সাপখোপের ভয়ে পুলিশ সেখানে বাস করতে চাইত না। এখান থেকে জলপথে পোর্ট ব্লেয়ারের দূরত্ব ছিল পাঁচ মাইল। সেখান থেকে হোমের দূরত্ব বেশি হওয়ায় সবসময় নজরদারি রাখা সম্ভব হত না। কাজেই অন্যান্য দ্বীপেও এই ধরনের হোম তৈরি করা হয়। অপরাধী বন্দি শিবিরের মানুষদের উপর নজর রাখার জন্যও এই হোমের মানুষদের ব্যবহার করা শুরু করে ইংরেজরা। বিনিময়ে তাদের টাকাপয়সা, তামাক, মাদকদ্রব্য দেওয়া হত। ফলে হোমের কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা লোভী হয়ে ওঠে, যা চিরকালই তাদের স্বভাববিরুদ্ধ ছিল।
বন্দি শিবিরের নানা সমস্যা উপরমহলের কাছে পৌঁছলে ১৮৯০ সালে কর্তারা দুজন হোমরাচোমরা আমলাকে আন্দামান পাঠান কলকাতা থেকে। উদ্দেশ্য, সরেজমিন তদন্ত। একজন হলেন ভারতীয় জেলের সর্বময় কর্তা ও আর একজন হলেন উচ্চপদস্থ আমলা। এই দুইজন পোর্ট ব্লেয়ারের বন্দি শিবিরের উপর একটা রিপোর্ট দাখিল করেন।
এই রিপোর্টে প্রস্তাব রাখা হয়, পোর্ট ব্লেয়ারে অবিলম্বে একটি কংক্রিটের জেল গড়ে তোলা উচিত। কেমন হবে সেই জেল তারও বয়ান দেন তাঁরা। ৬০০ বন্দিকে আলাদা আলাদা খুপরিতে ধরে রাখার উপযুক্ত শক্তপোক্ত জেলের খুঁটিনাটির প্রয়োজনীয়তা জানানো হয়। ম্যালেরিয়া ও উপজাতির উপদ্রব থেকে বন্দিদের বাঁচিয়ে রাখা ইংরেজ সরকারের আশু কর্তব্য বলে তাঁরা মনে করেন। শুধু তাই নয়, এই দুই কর্তার মত ছিল, নবনির্মিত জেলে বন্দিদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।
এই রিপোর্টের ভিত্তিতে পোর্ট ব্লেয়ারে সেলুলার জেল গড়ে তোলা হতে থাকে ১৮৯৬ সাল থেকে। আন্দামানের কাঠ উপযুক্ত নয় বলে কাঠ আনা হয় বর্মা থেকে। ইটের ব্যবস্থার জন্য বিভিন্ন দ্বীপে আরও বেশি করে ইটভাটি বসানো হয়। কলিচুন লাগবে মর্টার তৈরি করতে। স্থানীয় কাঁচামালের ব্যবস্থা হয়ে গেল। সব দ্বীপ অসংখ্য প্রবাল প্রাচীরে ঘেরা। সমুদ্রের ধারে একটু কম গভীরতায় জলের নীচ থেকে সুদৃশ্য প্রবাল ভেঙে নিয়ে এসে পোড়ানো হল কলিচুন তৈরির জন্য। হাজার হাজার বছর ধরে সমুদ্রসৈকতে যে অপূর্ব বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছিল, ইংরেজদের দুর্বুদ্ধিতে তার উপর আঘাত আসতে থাকল।
সেলুলার জেলের নির্মাণকার্য যখন শুরু হল, তখন মোট ৬০০ জন বন্দি আন্দামানে বাস করে। তাদের ধরে এনে কাজে জুতে দেওয়া হল বিনা পারিশ্রমিকে। জেল নির্মাণ শেষ হয় ১৯০৭ সালে। বিশাল একটি ওয়াচ টাওয়ারকে কেন্দ্রে রেখে সাতটি বাহু বিশিষ্ট ত্রিতল জেল তৈরি হল। উপর থেকে জেলকে দেখে মনে হবে যেন তারা মাছ (Star Fish)। মোট ৬৬৩টি বন্দি ঘর তৈরি হল। এমনভাবে সেলুলার জেল তৈরি করা হয়, যাতে বন্দি গারদের উলটোদিকে তাকালেই শুধু কংক্রিটের দেওয়াল দেখা যাবে। মজবুত গারদের ভিতরে যে প্রকোষ্ঠ, তাতে কোনোমতে বাস করা যাবে, হাঁটাচলার জায়গা থাকবে না। জেলের নির্মাণ কৌশলের জন্য একজন বন্দি কখনোই আর একজনের মুখ দেখতে পাবে না, যতক্ষণ না তাকে বাইরে ছাড়া হচ্ছে। এর আসল উদ্দেশ্য ছিল বন্দিদের নির্জন কারাবাসে রেখে শাস্তি দেওয়া।
বন্দিদের দিয়ে নানারকম কাজ করিয়ে নেওয়ার ফিকির বার করে ইংরেজ জেল কর্তারা। যেমন নারকেলের মালা থেকে ছোবড়া বার করে সেই ছোবড়া পিটিয়ে দড়ি তৈরি করা, শস্য পিষে তেল বার করার জন্য ঘানি টানা, কার্পেট বানানো ইত্যাদি। এইসব কাজ খুবই কষ্টসাধ্য ছিল এবং সময়মতো নির্দিষ্ট পরিমাণ দড়ি বা তেল বার করতে না পারলে বন্দিদের কপালে চরম শাস্তি জুটত। তাদের চাবুক মারা হত কিংবা অনাহারে রাখা হত এবং মলমূত্র পরিষ্কারের কাজে লাগানো হত। অনেক বন্দিই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মারা যেত বা আত্মহত্যা করত, কিন্তু দুর্ভেদ্য সেলুলার জেল থেকে পালানোর কোনও রাস্তা ছিল না। আগে দুইবার আন্দামানের দ্বীপগুলোতে যেমন জেল বানানো হয়েছিল, তাতে বন্দিদের জীবন অনেক মুক্ত ছিল। পালাবার সুযোগও ছিল তাদের। কিন্তু সেলুলার জেলে একবার ঢুকলে মুক্তি ছিল প্রায় অসম্ভব।
সেলুলার জেল বানানোর প্রাক্কালে ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, যেমন বাংলা, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র ইত্যাদি জায়গায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। কাজেই জেল নির্মাণ শেষ হতেই দলে দলে বন্দি পাঠানো হতে থাকে এই কারাগারে। আলিপুর মামলার অভিযুক্তরা প্রথম সেলুলার জেলের অতিথি হন।
১৯০৯ সালে প্রথম এই বিপ্লবী দলকে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে সেলুলার জেলে স্থানান্তরিত করা হয় ‘মহারাজা’ নামের জাহাজে। ‘ভয়ংকর অপরাধী’ লেখা তকমা ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের গলায়। জাহাজের নাম মহারাজা হলেও রাজসিক ব্যবস্থার একেবারে উলটো জোগাড় ছিল সবার জন্য। দামাল বিপ্লবীদের ভারতের মূল ভূখণ্ডের কোনও জেলে রাখাই নিরাপদ বলে মনে হয়নি কর্তৃপক্ষের। কিন্তু এঁদের সবাই ভদ্র ঘরের ছিলেন। বুকে যথেষ্ট সাহস এবং তারুণ্য থাকলেও নির্জন কারাবাসে কঠোর পরিশ্রম সহ্য করার ক্ষমতা তাঁদের কারোরই ছিল না। প্রশাসন সেই কথা ভালোরকম জানত।
কুখ্যাত জেল কর্তাদের বহু নির্যাতনের কাহিনি দিল্লি, বোম্বে আর করাচির কাগজেও ছাপা হত। সেই কাগজের সম্পাদকদের বিদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে পাঠিয়ে দেওয়া হত আন্দামানে। এইসব পত্রিকার মধ্যে প্রথম আঘাত আসে বাংলা পত্রিকা যুগান্তরের উপর। সরকার বিরোধী কাজের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি আন্দামানের সেলুলার জেলে কঠোর কারবাসে থাকতে বাধ্য হন। সেলুলার জেলকে বিদেশি কাগজে বলা হত কুখ্যাত বাস্তিল কারগারের (সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সের জেল) ভারতীয় সংস্করণ।
ইংরেজ জেলার ব্যারি সেলুলার জেলের বন্দিদের উপর অত্যাচার চালাবার এক জঘন্য নজির সৃষ্টি করেন। বিশেষ করে রাজনৈতিক বন্দিদের উপর মধ্যযুগীয় মানসিকতায় অত্যাচারের বিভিন্ন উপায় তিনি বার করেন। রোজ সকালে তিনি বন্দিদের জড়ো করে ভাষণ দিত যে, উপরে একজনই ভগবান আছে, কিন্তু আন্দামানের এই জেলে আছে দুজন ভগবান, এক তিনি আর এক উপরওয়ালা। কাজেই তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী না চললে জেলে বন্দিদের দুঃখের সীমা-পরিসীমা থাকবে না।
সেলুলার জেলে বন্দিদের খাবারের এক বিচিত্র ধরন ছিল। সকালে কাঞ্জি নামের এক চাল গোলা বিস্বাদ তরল গলায় নামিয়ে প্রাতরাশ সারতে হত তাঁদের। দুপুরে বাজরার রুটি, কাঁকর-ভরতি চাল, বালি মেশানো শাকপাতা সেদ্ধ করা তরকারি। রাতের খাবারও সেই একই। রাতে বারো ঘণ্টা ছোট্ট কুঠুরিতে কাটাতে হত। প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে গেলে সম্বল ছিল ঘরের মধ্যে রাখা একটি ছোট্ট পাত্র। পাত্রের দুর্গন্ধ সহ্য করে বন্দিদের রাতের ঘুম কীভাবে আসত, সহজেই অনুমেয়। সকালে স্নান ও অন্যান্য কাজের জন্য জেল কুঠুরির বাইরে ছেড়ে দেওয়া হত বন্দিদের। চরম কষ্ট দেবার জন্য নানা কাজ দেওয়া হত। সময়মতো কাজ না করতে পারলে খাবারের পরিমাণ যেত কমে। চাবুক মারা হত হাত-পা বেঁধে। কখনও অবাধ্য বন্দিদের হাতে পায়ে গলায় বেড়ি পরিয়ে রাখা হত।
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মানিকতলা বোমা মামলার অভিযুক্ত আসামি উল্লাসকর দত্ত পাগল হয়ে যান। তাঁকে মাদ্রাজের পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর একজন অভিযুক্ত ইন্দুভূষণ রায় জেলারের পোষা ওয়ার্ডেনদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন সেলের ভিতরে। এই খবর চেপে রাখার চেষ্টা করে আন্দামানের প্রশাসন। কিন্তু ইন্দুভূষণের মৃত্যুর খবর ভারত ভূখণ্ডে কারও অজানা থাকে না।
মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হয়ে বহু বন্দি অসুস্থ হয়ে পড়ে। আন্দামানের হাসপাতালে প্রায় বিনা চিকিৎসায় অনেকেই মারা যায়। বহুবার কলকাতা থেকে পরিদর্শক দল আসে এবং সেলুলার জেলের উপর রিপোর্ট তৈরি করে বাধ্য হয়েই। কিন্তু রিপোর্টে সব ঠিকঠাক আছে বলে জানানো হত। পরিদর্শনকারী আমলাদের কেউ যদি সামান্য উদ্বেগ প্রকাশ করত, সেই রিপোর্ট চেপে যাওয়া হত।
ইতোমধ্যে অন্যান্য মামলায় অভিযুক্ত আজীবন কারাবাসের শাস্তি পাওয়া দুর্ধর্ষ আসামিদের সেলুলার জেলে চালান করা শুরু হয়। ব্রিটিশ প্রশাসন জানত যে, এদের উপস্থিতিতে জেলের রাজনৈতিক বন্দিদের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা যাবে। এইসব খুন-ডাকাতি করা জঘন্য অপরাধীদের অনেক স্বাধীনতা দেওয়া হত সেলুলার জেলে। তাদের জন্য শুধু ছয় মাস কারাদণ্ড, তারপর সাড়ে নয় বছর আন্দামানের ক্ষেতখামার এবং নির্মীয়মাণ ঘরবাড়িতে শ্রম দিতে হত এবং মেয়াদ শেষে আন্দামানেই তাদের জমি দেওয়া হত সংসার পাতার জন্য। এই সুবিধা ছিল না রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য। আমৃত্যু কঠোর শ্রমের কারাবাস জীবন লেখা ছিল তাদের ভাগ্যে।
১৯২১ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে ভারতের জেল নীতি সংস্কার করার জন্য। ভারতের বিভিন্ন জেল পরিদর্শনের শেষে আন্দামানে বন্দি শিবির পর্যবেক্ষণ করে সেই কমিটি রিপোর্ট করে যে, অবিলম্বে আন্দামানে বন্দি শিবির বন্ধ করা প্রয়োজন। এর কারণ দেখানো হয়, বন্দি শিবিরের বন্দিদের ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর সংখ্যা এবং তাদের স্বাস্থ্য। প্রচুর খরচে বন্দি শিবির চালানো ব্রিটিশ সরকারের বিরাট অর্থনৈতিক অবস্থার পক্ষে আদৌ সমীচীন নয় বলেই এই কমিটি দাবি করে।
রিপোর্ট জমা করার পর যদিও কলকাতায় ব্রিটিশ কর্তারা সেলুলার জেল সহ আন্দামানের সব বন্দি শিবির বন্ধ করে দেওয়া স্থির করে, কিন্তু সরকারি গড়িমসির ফলে ১৯২৬ সালে নোটিশ জারি করে বন্দিদের সরিয়ে নিয়ে এসে ভারতের মূল ভূখণ্ডের জেলে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিছু বন্দিদের জাহাজে তুলে সরিয়ে নিয়ে আসা হলেও ভারতে সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলন আবার জোরদার হয়ে ওঠে।
স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা লাজপত রায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং তাদের হাজতে মারা যান। প্রতিশোধ নিতে পুলিশ সুপার স্যান্ডারকে লাহোরে মেরে ফেলেন সংগ্রামীরা। তল্লাশি চালিয়ে প্রচুর বোমা এবং বোমা বানাবার মশলা উদ্ধার হয় লাহোরের বিভিন্ন জায়গা থেকে। বিধানসভায় বোমা ফেলা হয়। প্রচুর বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং অন্যদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের রোমহর্ষক ঘটনা ব্রিটিশ পুলিশের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের ক্ষতি বেশি হলেও বিপ্লবীদের ধরপাকড়ে কোনও গাফিলতি করেনি তারা।
বিদ্রোহ দমনে আবার আন্দামানের বন্দি শিবিরকে জাগিয়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দলে দলে বন্দিদের চালান করা হয় সেলুলার জেলে। আগের মতোই তাঁদের উপর অকথ্য অত্যাচার চলতে থাকে। এবারে বিপ্লবীরা জেলের অবস্থার হাল শুধরানোর জন্য দাবি করেন অনশন ধর্মঘট শুরু করে। তাঁদের জবরদস্তি পাইপে করে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা চলতে থাকে। একজন বিপ্লবীর ফুসফুস পাইপের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি মারা যান। খবর ছড়িয়ে পড়ে ভারতে। মহাত্মা গান্ধি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সবাই লিখিতভাবে বিপ্লবীদের কাছে অনশন প্রত্যাহার করার আর্জি জানান। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কাগজ ও জনমতের চাপে একের পর এক জেলরক্ষক পরিবর্তন করতে থাকে। অবস্থার কখনও উন্নতি হয়, কখনও অবনতি। বছরের পর বছর এইভাবেই চলতে থাকে বন্দি নিগ্রহ। কিন্তু ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে গেলে বাধ্য হয়েই বন্দি শিবির চিরকালের মতো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় ইংরেজরা।
জাপান আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের উপর তাদের দাবি জানায়। প্রবল পরাক্রমে তখন তারা মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে। বাধ্য হয়ে ইংরেজরা আন্দামান থেকে তাদের সেনা ও বন্দি শিবির গুটিয়ে নিতে থাকে। শুধু যেসব বন্দিদের মুক্তাঞ্চলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল বসবাসের জন্য, তারাই আন্দামানের দ্বীপগুলোতে বসবাস করতে থাকে। উপজাতির মানুষদের সংখ্যা ব্রিটিশ বন্দি শিবির আর বন্দরের কল্যাণে ক্রমশ কমে যাচ্ছিল। বহু উপজাতি গোষ্ঠী এইভাবেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। শুধু বশ্যতা মানেনি জারোয়া আর সেন্টিনেলিসরা।
১৯৪১ সালে জাপানি বোমারু বিমান থেকে বৃষ্টির মতো বোমা ফেলা হয় আন্দামানে। এর ফলে দ্বীপের তো বটেই, সেলুলার জেলের পাঁচটি বাহু ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ব্রিটিশ উপনিবেশকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় আন্দামান থেকে। এমনকি জাপানি সেনা নির্বিচারে আন্দামানে বসবাসকারী বহু মানুষকে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে মেরে ফেলে।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়। তখন আন্দামানের সেলুলার জেল রয়ে যায় শুধু স্মৃতিতে আর বন্দিদের লিখে যাওয়া বিভিন্ন বইতে। ব্রিটিশ উপনিবেশের এক কলঙ্কময় ক্ষত আজও সেলুলার জেল পোর্ট ব্লেয়ারে গেলে দেখতে পাওয়া যায়, যার ভিতরে সুপ্ত রয়েছে অসংখ্য দেশমাতৃকার সন্তানের বলিদান। আর আন্দামানের আদি বাসিন্দা উপজাতির সরল মানুষগুলো আজ প্রায় হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে। কতিপয় যে ক’জন উপজাতির মানুষ আজও বেঁচে আছে, তারাও সভ্যতার নির্মম জাঁতাকলে পিষে হারিয়ে যেতে খুব সময় লাগবে না।
লেখকের অন্যান্য লেখা
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস
কুড়ি জন দিকপাল বিজ্ঞানীর অসাধারণ কর্মকাণ্ড আর জীবনের গল্প। যে বিজ্ঞানীদের হাত ধরে সভ্যতা এগিয়ে গিয়েছে, কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের ঢাকনা খুলে অনাবৃত হয়েছে বিজ্ঞানের সৌন্দর্য, যাঁদের আপসহীন জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানের জয়ধ্বজা উড়েছে, তাঁদের জীবনের অন্যান্য দিকগুলোও তুলে ধরা হয়েছে এই বইতে।
নদীর স্রোত কি কথা বলে? বাতাস তার জবাব দেয়? ফুল বুঝি গাছের দুঃখের ধন? ঝরে যাওয়া পাতায় কোন ইতিহাস লেখা থাকে? হাজার হাজার মাইল সাঁতার কেটে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে যায় পেঙ্গুইন। নেকড়ে-মা দুধ দিয়ে বড়ো করে মানুষের সন্তান। শান্ত মাটির তলায় কোটি বছরের ঘুম ভেঙে ক্ষেপে ওঠে আগ্নেয় লাভা। তাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে মেঘ-ভাঙা বৃষ্টি। নিরালা বনে পিউপার জাল ছিঁড়ে উড়ে যায় রঙিন প্রজাপতি। লক্ষ বছর আগে একজন দাগ কেটেছিল গুহার অন্ধকার দেয়ালে। দাগ হল ছবি, ছবি হল লেখা। চাপা থাকে আগামী দিনের জন্য। গম্ভীর হিমবাহ নিঃশব্দে নামে লঘু সঞ্চারে।