প্রবন্ধ
FREE SHIPPING IN INDIA
প্রবন্ধ
ভিনগ্রহীরা সত্যি সত্যি আছে কি না জানব কেমন করে? প্রথম যাঁরা সিরিয়াসলি এটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন আমেরিকার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ডোনাল্ড ড্রেক। তিনি ১৯৬০ সালে রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে কাছের দুটি নক্ষত্র থেকে কেউ আমাদের উদ্দেশে বার্তা পাঠাচ্ছে কি না খুঁজতে শুরু করেছিলেন।
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
তোমরা সবাই ইটি-র কথা শুনেছ নিশ্চয়ই? ইটি অর্থাৎ এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল, বাংলায় বলা হয় ভিনগ্রহী। ভিনগ্রহীদের নিয়ে অনেক গল্প সিনেমা ইত্যাদি হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা তাদের কারও অ্যান্টেনা, টিকি, শুঁড় কিংবা লেজ দেখিনি। সেটা আশ্চর্য নয়, কারণ নক্ষত্রদের মধ্যে দূরত্ব এত বেশি যে আমাদের সৌরজগতের কাছের কোনও তারা থেকে পৃথিবীতে আসতে কয়েকশো বছর লেগে যাবে। হয়তো খুব উন্নত প্রযুক্তি এই সময়টাকে কিছু কমাতে পারবে, কিন্তু সেটাকে কয়েক বছরের থেকে কমানো সম্ভব নয়। আইনস্টাইন দেখিয়েছেন যে আলোর থেকে বেশি দ্রুত কোনোকিছু যেতে পারে না। তাছাড়া বেগ যত বাড়বে, বস্তুর ভরও তত বাড়ে। ফলে তখন বেগ বাড়াতে অনেক বেশি পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন হয়। অবশ্য অনেকে শর্টকাটের কথা বলেছেন, কিন্তু তাকে এখনও গল্পের বাইরে পাওয়া যায়নি। স্লো রকেটে এলেও অবশ্য তাদের খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, সে-কথা আসবে পরে।
তাহলে ভিনগ্রহীরা সত্যি সত্যি আছে কি না জানব কেমন করে? প্রথম যাঁরা সিরিয়াসলি এটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন আমেরিকার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ডোনাল্ড ড্রেক। তিনি ১৯৬০ সালে রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে কাছের দুটি নক্ষত্র থেকে কেউ আমাদের উদ্দেশে বার্তা পাঠাচ্ছে কি না খুঁজতে শুরু করেছিলেন। রেডিও সংকেত অনেক দূর পর্যন্ত পাঠানো যায়, মহাকাশের ধূলিকণা ইত্যাদি তাকে শোষণ করতে পারে না। তাছাড়া একমাত্র উন্নত সভ্যতাই রেডিও বার্তা পাঠাতে পারবে। তিনি প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই মহাশূন্য থেকে সংকেত পেয়েছিলেন। কিন্তু ভালো করে বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, সেই সংকেত আমাদের চেনা সভ্যতাই পাঠিয়েছে। আমেরিকার স্পাই বিমান ইউ-২ সেই সময় ড্রেকের রেডিও টেলিস্কোপের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল।
ড্রেক শেষে বুঝতে পারেন, খোঁজ শুরুর আগে আমাদের ছায়াপথে এই সময় কতগুলি সভ্যতা থাকতে পারে তার একটা অনুমান করা দরকার। যদি এমন হয় যে সভ্যতার সংখ্যা খুবই কম, তাহলে খুঁজে পাওয়ার আশা বিশেষ নেই। আবার যদি এমন হয় যে ছায়াপথে সভ্যতার সংখ্যা অনেক, তাহলে সন্ধান করে লাভ আছে। তিনি একটা সহজ অঙ্ক কষেছিলেন, সেটাই ড্রেক সমীকরণ নামে পরিচিত। আমরা আজ তার কথাই শুনব।
অঙ্কটা শক্ত নয়, একটু তলিয়ে দেখার চেষ্টা করা যাক। প্রথমেই বুঝতে হবে যে আমরা আমাদের মতো গ্রহভিত্তিক সভ্যতার কথাই ভাবছি। বুদ্ধিমান প্রাণী বা সভ্যতা গ্রহের বাইরে সৃষ্টি হতে পারে এমন কোনও সম্ভাবনার কথা আমরা ধরছি না। সুতরাং, আমাদের দেখতে হবে কতগুলি তারাতে এমন গ্রহ থাকতে পারে যেখানে প্রাণের সৃষ্টি হওয়া সম্ভব এবং তার থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে উন্নত সভ্যতার জন্ম হতে পারে। সুদূর অতীতে সৃষ্টি হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে, এমন কোনও সভ্যতাকে আমাদের হিসাবে এনে লাভ নেই। আমরা দেখব ছায়াপথে গড়ে নিয়মিত কত তারার জন্ম হয়। ছায়াপথে যত বেশি তারা সৃষ্টি হবে, নিশ্চয় সভ্যতার সম্ভাবনা তত বাড়বে। তার মানে এই নয় যে নতুন তারার জন্ম হল, সঙ্গে-সঙ্গেই সেখানে সভ্যতার সৃষ্টির কথা বলছি। কিন্তু যদি আমরা ধরে নিই যে বহু কোটি বছর ধরে এই সংখ্যাটা মোটামুটি একই থাকে, তাহলে আমরা নিশ্চয়ই ধরতে পারি যে নতুন সভ্যতা সৃষ্টির হার নতুন নক্ষত্র সৃষ্টির হারের সঙ্গে সমানুপাতিক।
বিভিন্ন হিসাব দেখায় যে আমাদের ছায়াপথে প্রতিবছর গড়ে আনুমানিক পাঁচ থেকে কুড়িটি নক্ষত্রের জন্ম হয়। তোমরা নিশ্চয়ই বলবে, হিসাব করতে হবে কেন? গুনে দেখে নিলেই তো হয়। আসলে নক্ষত্রের জন্ম হয় মহাজাগতিক মেঘের সংকোচন থেকে, আর তা বহু লক্ষ বছর ধরে চলে। ঠিক কোন সময় তাকে আমরা নক্ষত্র বলব তা বলা শক্ত। আমাদের ছায়াপথে নক্ষত্রের সংখ্যা আমরা সঠিক জানি না, তবে তা দশ থেকে চল্লিশ হাজার কোটির মধ্যে। এতগুলো নক্ষত্রের মধ্যে দু-একটা বাড়ল কি কমল তা বোঝা বেশ কঠিন। তাছাড়া ছায়াপথের তল বরাবর ধূলিকণার জন্য তার অনেক অংশই আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়।
সব নক্ষত্রেই আবার প্রাণের সৃষ্টি আশা করি না। খুব উজ্জ্বল নক্ষত্ররা বেশিদিন বাঁচে না, বড়োজোর কুড়ি কোটি বছর। আমরা পরে দেখব যে ওইটুকু সময়ে বুদ্ধিমান জীবের জন্ম হওয়া প্রায় অসম্ভব। আবার ছায়াপথের নক্ষত্রদের মধ্যে তিয়াত্তর শতাংশই হল খুব অনুজ্জ্বল লাল বামন তারা। এই নক্ষত্রদের জন্মের সময় তার থেকে নির্গত নাক্ষত্র বায়ু (যা আসলে প্রোটনের স্রোত) এতটাই শক্তিশালী হয় যে নক্ষত্রের কাছের গ্রহে বায়ুমণ্ডল থাকলে তাকে ধাক্কা মেরে মহাশূন্যে পাঠিয়ে দেয়। আবার লাল বামনের জগতে দূরের গ্রহ এত কম আলো বা তাপ পায় যে সেখানে প্রাণ সৃষ্টি প্রায় অসম্ভব। কাজেই সূর্য বা তার কাছাকাছি শ্রেণির নক্ষত্রেই একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণীকে আশা করা যেতে পারে। অনুমান করা হয় যে প্রতিবছর ছায়াপথে মোটামুটি একটা এই ধরনের নক্ষত্রের জন্ম হয়। অবশ্য সবাই এই বিষয়ে একমত নন। তাঁদের বক্তব্য, আমরা কল্পনা করতে পারি না বলেই সূর্যের থেকে অন্য ধরনের নক্ষত্রে প্রাণের জন্ম হবে না, এ-কথা বলা ঠিক নয়। আবার এমন হতেই পারে যে সেই নক্ষত্র জগতে প্রাণের সৃষ্টি হয়নি, কিন্তু অন্য কোথাও থেকে বুদ্ধিমান প্রাণীরা এসে সেখানের কোনও গ্রহে উপনিবেশ স্থাপন করেছে। তাই এই ধরনের নক্ষত্রদের হিসাব থেকে বাদ দেওয়া উচিত নয়।
নক্ষত্র থাকলেই তো হবে না, তার গ্রহ থাকতে হবে। তিরিশ বছর আগেও সূর্য ছাড়া অন্য নক্ষত্রের গ্রহের সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের ধারণা ছিল না। কিন্তু গবেষণা দেখিয়েছে যে প্রায় সব নক্ষত্রের গ্রহ আছে। শুধু গ্রহ নয়, বড়ো উপগ্রহেও প্রাণের জন্ম হতে পারে। তাদেরকেও আমরা গ্রহের হিসাবেই ধরব। যেখানে আবার গ্রহ থাকলেই সেখানে প্রাণের সম্ভাবনা আছে কি? এই বিষয়টা একটু আলোচনা করা যাক।
যে-কোনো জায়গায় প্রাণ থাকতে পারে না। প্রাণের জন্য দরকার জল। নক্ষত্রের খুব কাছে জল ফুটে বাষ্প হয়ে যাবে, আবার খুব দূরে গেলে বরফে পরিণত হবে। প্রাণের জন্ম সমুদ্রে হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু প্রযুক্তির জন্য স্থলভাগের প্রয়োজন। জলের মধ্যে আগুন জ্বলে না, আগুন ছাড়া প্রযুক্তির সৃষ্টি অসম্ভব। গ্রহ খুব ভারী হলে সে হবে বৃহস্পতির মতো গ্যাস দানব, যেখানে দাঁড়াবার মতো কোনও জায়গা নেই, বা থাকলেও সেখানে বায়ুর চাপ প্রচণ্ড বেশি। তাই প্রয়োজন পাথুরে গ্রহ, যারা অপেক্ষাকৃত ছোটো। কিন্তু গ্রহের ভর খুব কম হলে তার বায়ুমণ্ডল হবে পাতলা, নক্ষত্রের অতিবেগুনি রশ্মি ও দূর মহাকাশ থেকে আসা মহাজাগতিক রশ্মি জীবকোশকে ধ্বংস করে দেবে। রূপকথাতে ছোট্ট মেয়ে গোল্ডিলক্স তিন ভাল্লুকের বাড়িতে গিয়ে তাদের খাওয়ার টেবিলে বসে প্রথমে বাবা-ভাল্লুকের খাবার মুখে দিয়েছিল। সেটা ছিল বড্ড গরম। মা-ভাল্লুকের খাবার আবার বড্ড ঠান্ডা। খোকা-ভাল্লুকের খাবারটা ছিল একদম ঠিক, তাই গোল্ডিলক্স সেটাই শেষ করে দিয়েছিল। সেই কথা মনে রেখে এইসব মাঝারি মাপের বিষয়টাকে বলা হয় গোল্ডিলক্স নীতি। পৃথিবীর মতো ছোটো পাথুরে গ্রহ খুঁজে পাওয়া প্রথমদিকে সম্ভব হয়নি। কিন্তু গত কয়েক বছরে আমরা এইরকম অনেক গ্রহেরই সন্ধান পেয়েছি। এখন বলা যায় প্রায় নক্ষত্র জগৎ থাকলে সেখানে গড়ে দুটো এইরকম গ্রহ থাকবে যেখানে প্রাণের উদ্ভব হতে পারে।
এই পর্যন্ত খুব একটা সমস্যা নেই। আকাশ পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা মোটামুটি এই সংখ্যাগুলো অনুমান করতে পেরেছি। কিন্তু এর পরের ধাপগুলো নিছকই আন্দাজ। প্রথম প্রশ্ন হল যে প্রাণ সৃষ্টির উপযোগী পরিবেশ থাকলেই সেখানে প্রাণের সৃষ্টি হবে কি? আবার প্রাণ সৃষ্টি হলেই কি সেখানে উন্নত সভ্যতার জন্ম হবে? বিবর্তন তত্ত্ব, বংশগতিবিদ্যা ও জিনবিদ্যা আমাদের দেখিয়েছে যে পৃথিবীতে আজ এই যে কোটি কোটি প্রজাতির জীব দেখা যায়, তাদের সকলের মূলে আছে এক আদিপ্রাণ। কিন্তু আমাদের সকলের ঠাকুমা সেই প্রাণের সৃষ্টি হল কেমন করে সে-কথা বলা ভারি শক্ত। একশো বছর আগে দুই বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ওপারিন ও জন বার্ডন স্যান্ডারসন হ্যালডেন আলাদা আলাদা করে বলেন যে সৃষ্টির আদিতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ছিল অ্যামোনিয়া, মিথেন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি গ্যাস। সৌরজগতের তিয়াত্তর শতাংশই হল হাইড্রোজেন। প্রথম হাইড্রোজেন আমাদের পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে বাঁধা পড়ে থাকেনি, ধীরে ধীরে মহাকাশে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু আদি যুগে বায়ুমণ্ডলে যথেষ্ট হাইড্রোজেন ছিল। এই সমস্ত গ্যাস ও জলীয় বাষ্প মিলে অতিবেগুনি রশ্মি, মহাজাগতিক রশ্মি, বিদ্যুৎচমক ইত্যাদির প্রভাবে নানা বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রথম জৈব যৌগ তৈরি হয়েছিল। সেই জৈব যৌগ সমুদ্রে জমা হতে থাকে। হ্যালডেন সেই সমুদ্রজলের নাম দিয়েছিলেন আদিম সুরুয়া (primordial soup)। এর পরের ধাপে কয়েকটি জৈব যৌগের অণু যুক্ত হয়ে জটিলতর অণু সৃষ্টি করে। প্রথম প্রাণ সেইরকমই এক জটিল অণু। একবার সৃষ্টি হওয়ার পরে তার জন্য খাদ্য সরলতর জৈব যৌগ রূপে মজুত ছিল। এই যৌগগুলি ভেঙে শক্তি পাওয়া যেত। প্রাণ সৃষ্টির রসায়নেও ডারউইনীয় বিবর্তন কাজ করে; সেই অণুই শেষ পর্যন্ত প্রাণের জন্ম দেবে যে পরিবেশ থেকে সহজে খাদ্য নিতে পারে ও ঠিক নিজের মতো আর একটা অণু সৃষ্টি করতে পারে।
লিখতে যত সহজ লাগল, বিষয়টা তার থেকে অনেক অনেক বেশি জটিল। তবে পরীক্ষা করে তার পক্ষে কিছু প্রমাণ পেয়েছিলেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী হ্যারল্ড ইউরে ও তাঁর ছাত্র স্ট্যানলি মিলার। তাঁরা ১৯৫৩ সালে এক কাচের ফ্লাস্কের মধ্যে মিথেন, অ্যামোনিয়া, জল ও হাইড্রোজেন নিয়েছিলেন। প্রাচীন পৃথিবী ছিল অনেক উত্তপ্ত, তাতে নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে বিদ্যুৎচমক হত। মিলার ফ্লাস্কটিকে গরম করলেন ও তার ভিতরে বিদ্যুতের স্পার্ক পাঠালেন। পরীক্ষা করে মিলার দেখলেন, ফ্লাস্কের মধ্যে পাঁচরকম অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি হয়েছে। অ্যামিনো অ্যাসিড হল প্রোটিন তৈরির কাঁচামাল। অর্থাৎ, প্রাণ সৃষ্টির প্রয়োজনীয় এক উপাদান প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্টি করা সম্ভব। তবে এই তত্ত্ব নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও কাজ করে চলেছেন। এমন কথাও এসেছে যে প্রথম প্রাণ হয়তো দূরের নক্ষত্রে থেকে এককোশী প্রাণীর মাধ্যমে আসতে পারে। তার পক্ষে বা বিপক্ষে কোনও প্রমাণ অবশ্য নেই।
একটা সমস্যা কিন্তু রয়েই গেছে— কত সময় লাগবে প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হতে। একদল বিজ্ঞানী বলেন যে পৃথিবীতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির অল্প দিন, অর্থাৎ পঞ্চাশ থেকে একশো কোটি বছরের মধ্যেই প্রাণের আবির্ভাব হয়েছিল। (বিজ্ঞানীদের অল্প বেশি আমাদের হিসাবের সঙ্গে মেলে না। পঞ্চাশ-একশো কোটি বছরও কিনা অল্প দিন!) সুতরাং অন্য গ্রহে অনুকূল পরিবেশ পেলে প্রাণ সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এক দল বিজ্ঞানী বলেন যে পৃথিবীর উদাহরণ দিয়ে কিছু প্রমাণ করা যায় না। লটারিতে সবসময়ই একজন ফার্স্ট প্রাইজ পায়, কিন্তু তার মানে এই নয় যে ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়াটা খুব সহজ। হয়তো এক কোটি লোক লটারির টিকিট কেটেছিল, কাজেই কোনও বিশেষ একজনের পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বুঝতেই পারছ বিষয়টা কত গুরুত্বপূর্ণ! যেসব নক্ষত্রের কাছে আমরা ইটিদের খুঁজে পাওয়ার আশা করি, তারা অনেকটা সূর্যেরই মতো, অর্থাৎ তারা মোটামুটি হাজার কোটি বছর একইভাবে আলো দেয়, তারপর মারা যায়। যদি এমন হয় যে প্রাণ সৃষ্টি হতে গড়ে হাজার কোটি বছর দরকার হয়, তাহলে সভ্যতা খুঁজে পাওয়ার আশা বিশেষ নেই। হয়তো প্রাণের সৃষ্টি হবে, কিন্তু তা বিশেষ এগোনোর আগেই ধ্বংস হয়ে যাবে।
এগোনো বলতে আমি বিবর্তনের মাধ্যমে বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টির কথা বলতে চেয়েছি। এককোশী থেকে বহুকোশী জীব সৃষ্টি হতে কিন্তু প্রাণ সৃষ্টির থেকেও অনেক বেশি সময় লেগেছিল। প্রথম বহুকোশী জীবের ফসিলের বয়স মাত্র ষাট কোটি বছর। তারপর বিবর্তনের মাধ্যমে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষের জন্ম হল। শুধু বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টি হলেই হবে না, যোগাযোগের জন্য রেডিও আবিষ্কার করতে হবে। আমাদের গ্রহে প্রথম প্রাণ সৃষ্টির চারশো কোটি বছর পরে আমরা অন্য নক্ষত্রের সঙ্গে যোগাযোগের পর্যায়ে পৌঁছেছি। নানা কারণে সব সভ্যতা সেই পর্যায়ে হয়তো শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। তবে এ বিষয়েও আমাদের জানা নেই।
একটা বিশেষ পরিস্থিতি পৃথিবীতে উন্নত জীবের বিবর্তনে সাহায্য করেছে। আমরা জানি যে সৌরজগতের বাইরের দিক থেকে অনেক ধূমকেতু সূর্যের আছে আসে, তাদের কারও সঙ্গে গ্রহের সংঘর্ষ হলে বিপর্যয় ডেকে আনবে। পৃথিবীকে রক্ষা করে গ্রহরাজ বৃহস্পতি। বৃহস্পতির ভর সৌরজগতের অন্যসব গ্রহের থেকে বেশি। তার আকর্ষণ অনেক ধূমকেতুকে সৌরজগতের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে অথবা নিজের কাছে বেঁধে রেখে পৃথিবীকে রক্ষা করেছে। আমাদের অনুমান, প্রায় সব নক্ষত্রজগতেই এক বা একাধিক বৃহস্পতির মতো গ্রহ আছে, তাই সেখানে প্রাণের উদ্ভব হলে তার বিকাশ হয়তো বার বার বাধা পায় না।
আবার সভ্যতা জন্মালেই যে চিরস্থায়ী হবে, এটা আমরা আশা করি না। পৃথিবীতে আধুনিক মানুষের জন্ম মোটামুটি দু-লক্ষ বছর আগে, আর রেডিও আবিষ্কার হয়েছে একশো তিরিশ বছর আগে। আমাদের সভ্যতা এক কোটি বছর টিকবে বলে আমরা কেউই বিশ্বাস করি না। এক কোটি বছর মানুষের পক্ষে অনেক বেশি, কিন্তু মহাবিশ্বের হিসাবে কিছুই নয়। তবে কোনও সভ্যতা জন্মের পরে ঠিক কত বছর টিকবে তা একেবারেই অনুমানের বিষয়।
এবার তাহলে ড্রেকের অঙ্কটা কষা যাক। ড্রেক ধরেছিলেন, প্রতিবছর R*-টা এমন নক্ষত্র জন্মায় যেখানে প্রাণের সৃষ্টি সম্ভব। সেই নক্ষত্র জগতে গ্রহ থাকার সম্ভাবনা fp। আবার প্রতি নক্ষত্র জগতে এমন ne সংখ্যক গ্রহ থাকতে পারে, যেখানে প্রাণের অনুকূল পরিবেশ আছে। সেই গ্রহে প্রাণের সৃষ্টির সম্ভাবনা হল fl; প্রাণ সৃষ্টি হলেই তা শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণীর জন্ম দেবে সেই সম্ভাবনাকে লেখা যাক fi। এবার সেই বুদ্ধিমান ইটি শেষ পর্যন্ত রেডিও বানিয়ে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করবে সেই সম্ভাবনাকে লেখা হল fc। তাহলে প্রতিবছর গড়ে R* ´ fp ´ ne ´ fl ´ fi ´ fc এই সংখ্যক সভ্যতার জন্ম হবে। শেষে ধরলেন যে সভ্যতা সৃষ্টির পরে সে L বছর স্থায়ী হয়। তাহলে আমাদের ছায়াপথে এই মুহূর্তে সভ্যতার সংখ্যা হল—
N = R* ´ fp ´ ne ´ fl ´ fi ´ fc ´ L
একে বলা হয় ড্রেক সমীকরণ। এখানে সাতটা সংখ্যা আছে। আগেই দেখেছি, প্রথম তিনটের মান আমরা মোটামুটি জানি; R* হল ১ থেকে ১০, fp ১-এর কাছাকাছি, আর ne হল ২। ড্রেক অবশ্য সংখ্যাগুলোকে অন্যরকম ধরেছিলেন। কিন্তু গত ষাট বছরে আমরা এগুলো সম্পর্কে আরও বেশি খবর পেয়েছি।
কিন্তু সমীকরণের বাকি সংখ্যাগুলো সম্পর্কে অনুমান ছাড়া উপায় নেই। ড্রেক প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাবনা fl-কে ধরেছিলেন ১, অর্থাৎ অনুকূল পরিবেশ পেলে প্রাণের সৃষ্টি হবেই। প্রাণ সৃষ্টি হলে বুদ্ধিমান জীব সৃষ্টির সম্ভাবনা অর্থাৎ fi-কে নিয়েছিলেন ০.০১, আবার রেডিওর মারফত অন্য জগতের সঙ্গে যোগাযোগের সম্ভাবনা fc-কে ধরেছিলেন ০.০১। শেষে ধরেছিলেন L=১০,০০০ বছর, অর্থাৎ কোনও সভ্যতা রেডিও আবিষ্কারের পরে দশ হাজার বছর স্থায়ী হবে। গত ষাট বছরে এই সংখ্যাগুলো সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বিশেষ কিছুই এগোয়নি। তাই যদি এখানে ড্রেকের সংখ্যাগুলোই ধরি, তাহলে N-এর মান দাঁড়ায় ২ থেকে ২০। এই বিশাল নক্ষত্র জগতের পক্ষে তা খুবই কম সন্দেহ নেই। সেই অল্পসংখ্যক সভ্যতার একটা আমাদের কাছাকাছি আছে এবং আমাদের উদ্দেশে বার্তা পাঠাচ্ছে, তেমন সম্ভাবনা খুব কম।
কিন্তু এখানে অন্য মতও আছে। যেমন, কেউ কেউ বলেন যে প্রাণের উদ্ভব হলে বিবর্তনের মাধ্যমে বুদ্ধিমান জীবের জন্ম হবেই, আবার বুদ্ধিমান জীব রেডিও মারফত যোগাযোগের চেষ্টা করবেই। সুতরাং fi ও fc, এই দুইয়েরই মান হওয়া উচিত এক। তাহলে সভ্যতার সংখ্যা কুড়ি হাজার থেকে দু-লক্ষ পর্যন্ত হতে পারে। তেমনি L-কে একশো গুণ বাড়িয়ে ধরলে সভ্যতার সংখ্যা একশো গুণ বেড়ে যাবে। আবার অন্য কেউ বলেন যে প্রাণের সৃষ্টির সম্ভাবনা ড্রেক অনেক গুণ বাড়িয়ে ধরেছিলেন। তাঁদের কথা ঠিক হলে হয়তো আমাদের ছায়াপথে এই মুহূর্তে আমরাই একমাত্র সভ্যতা যারা রেডিও আবিষ্কার করেছি।
তোমরা হয়তো সেটি-র (SETI) কথাটা শুনেছ। পুরো কথাটা হল, Search for Extraterrestrial Intelligence। সেই ড্রেকের সময় থেকে শুরু করে মহাবিশ্ব থেকে আসা রেডিও বার্তা শোনার চেষ্টা করছে এই প্রকল্প। আমরা অবশ্য ভিনগ্রহীদের উদ্দেশে রেডিও বার্তাও পাঠিয়েছি। ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে অ্যারেসিবো রেডিও টেলিস্কোপ মাধ্যমে পঁচিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরের মেসিয়ার ১৩ নক্ষত্রগুচ্ছের উদ্দেশে এক রেডিও বার্তা পাঠায়। সেই বার্তা অবশ্য সেই নক্ষত্রপুঞ্জে কোনোদিন পৌঁছবে না, কারণ পঁচিশ হাজার বছর পরে ওই নক্ষত্রপুঞ্জই ওখান থেকে অনেক দূরে সরে যাবে। আমরা নিজে থেকে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব সেই আশা আমরা বিশেষ করি না। সত্যিই যদি ভিনগ্রহের সভ্যতা থাকে, তাহলে তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে সেই সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, আমরা সবে অন্য নক্ষত্রে খবর পাঠানোর ক্ষমতা আয়ত্ত করেছি। প্রযুক্তির বিবর্তন হয় অত্যন্ত দ্রুত হারে; দুশো বছরেরও কম সময়ে আমরা ঘোড়ার গাড়ি থেকে রকেটে পৌঁছেছি। কাজেই কোনও সভ্যতা যদি আমাদের থেকে হাজার বছরও এগিয়ে থাকে, তাহলে তারাই অনেক সহজে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তাই শোনার ওপর বিজ্ঞানীরা বেশি জোর দিচ্ছেন।
আর এক দিক থেকে হিসাবটা করা যায়। নোবেলজয়ী বিখ্যাত বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি একবার অন্য কয়েকজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে ভিনগ্রহী সভ্যতার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। ফের্মি প্রশ্ন করেন, কিন্তু তারা কোথায়? ফের্মির যুক্তি ছিল এইরকম—
ধরা যাক কোনও সভ্যতা এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে যাওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে। তার জন্য খুব দ্রুত গতির রকেটের দরকার নেই। ধীরেসুস্থে কয়েক হাজার বছর লাগলেও অসুবিধা নেই। হয়তো সেই ইটিদের আয়ু খুব বেশি, কিংবা হয়তো তারা পুরো যাত্রার সময়টা শীতঘুমে কাটায়, সেই সময় তাদের বয়স বাড়ে না। ধরা যাক, একবার শুরু করে তারা কাছের সব নক্ষত্রে অভিযান পাঠাবে, সেখানে অনুকূল পরিবেশ পেলে আবার তারা নতুন করে সভ্যতা সৃষ্টি করবে। এই প্রত্যেকটা নক্ষত্র থেকে আবার আশেপাশের সব নক্ষত্রে অভিযান যাবে। ধরো, একটা নক্ষত্র থেকে পাশের চারটে নক্ষত্রে অভিযান গেল, তার প্রত্যেকটা আবার আরও চারটে নক্ষত্রে অভিযান পাঠাল। এমনভাবে মাত্র কুড়িটা ধাপের মধ্যেই সব নক্ষত্রে একবার পৌঁছানো সম্ভব। এভাবে ছায়াপথের সমস্ত অংশে ছড়িয়ে যেতে কত সময় লাগবে? মহাকাশযান যদি আলোর বেগের এক হাজার ভাগের এক ভাগ বেগেও যায়, তাহলেও দশ কোটি বছরের মধ্যেই ছায়াপথের সমস্ত প্রান্তে সেই ইটিরা পৌঁছে যাবে। আমাদের ছায়াপথে সূর্যের মতো নক্ষত্রের সংখ্যা কয়েকশো কোটি। তাদের অনেকেই বয়স বহু শত কোটি বছর। তাহলে তেমন কোনও নক্ষত্র জগতে যদি মাত্র দশ কোটি বছর আগেও এমন সভ্যতা সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে এর মধ্যে তাদের আমাদের সৌরজগতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু তেমন কোনও প্রমাণ আমরা পাই না। তাহলে তারা গেল কোথায়?
এই প্রশ্নের অনেক সম্ভাব্য উত্তর আছে। হয়তো একবার একটা গ্রহে পৌঁছানোর পরে পরের অভিযানের আগে বহু হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়। হয়তো কোনও সভ্যতাই বহু লক্ষ বছর স্থায়ী হয় না; সভ্যতার নিজের সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ, পারমাণবিক যুদ্ধ ইত্যাদি সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেয়। হয়তো ভিনগ্রহীরা তাদের নক্ষত্রের বাইরের জগতের বিষয়ে আদৌ আগ্রহী নয়। হয়তো তারা এতই উন্নত যে তাদের চিহ্নও বোঝাও আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে প্রথম যে সংকেত মহাকাশে যাত্রা করেছিল, তা হল টিভি সম্প্রচার। হয়তো সেই অনুষ্ঠান দেখে ভিনগ্রহীরা ঠিক করেছে আমরা যোগাযোগের যোগ্য নই। (এ আমার কথা নয়, এক বিখ্যাত বিজ্ঞানীর কথা। তবে মনে রাখতে হবে যে এখন যে সংকেত কাছের নক্ষত্রজগতে পৌঁছচ্ছে, তা যাত্রা শুরু করেছিল কয়েক বছর আগে। তাই এখনকার টিভির তারকাদের রাগ করার কিছু নেই।) হয়তো ভিনগ্রহীরা আমাদের উপর দূর থেকে নজর রাখছে, এখনই দেখা দিতে চায় না। উড়ন্ত চাকির ভক্তরা বলে, ভিনগ্রহীদের অস্তিত্বের প্রমাণ তো আছেই, উড়ন্ত চাকি না-হলে কোথা থেকে এল? তাঁদের বিশ্বাস, সরকার ও বিজ্ঞানীরা সব প্রমাণ ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে। যদিও লুকিয়ে রেখে কার কোন লাভ হবে, সে-প্রশ্নের উত্তর তাঁদের কাছে তোমরা পাবে না। আরও অনেক কারণ তোমরা ভাবলেই খুঁজে পাবে। যতদিন না অন্য কোনও সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগ হয়, ততদিন ভিনগ্রহী সভ্যতা আছে কি নেই তা নিয়ে তর্ক শেষ হওয়ার নয়। ড্রেক সমীকরণ থেকে মনে হয় যে খুব তাড়াতাড়ি তেমন যোগাযোগের আশা নেই। বার্তা পেলেও তা আমরা বুঝতে পারব কি না, সে নিয়েও আলোচনা চলছে।
ছবি: ChatGPT
লেখকের অন্যান্য লেখা
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস