প্রবন্ধ
FREE SHIPPING IN INDIA
প্রবন্ধ
প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ধমীর্য় আচার-অনুষ্ঠানে অনেক উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এসব উদ্ভিদকে বলা হয় ‘Secred Plant‘ বা ‘পবিত্র গাছ’। দুর্গাপূজায় ব্যবহৃত এইসব গাছের বিজ্ঞানভিত্তিক ভেষজ গুণাবলির অবতারণা এই প্রবন্ধ।
সুশান্ত কুমার রায়
পরমা প্রকৃতি দেবী দুর্গা। তিনি আদ্যাশক্তি ও সৃষ্টির আদি কারণ। প্রতিবছর শরৎকালে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায় অশুভ শক্তি বিনাশিনী বিশ্বমাতা দেবী দুর্গার আরাধনায় মেতে ওঠে শুভ সুন্দরের প্রত্যাশায়। শারদীয় দুর্গোৎসব আমাদের সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ এবং সর্ববৃহৎ সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব। আর এই শারদ প্রভাতেই শরতের আগমনী বার্তা নিয়ে মর্ত্যলোকে পদার্পণ করেন দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা। ‘আজি কি তোমার মধুর মুরতি / হেরিনু শারদ প্রভাতে! / হে মাত বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ / ঝলিছে অমল শোভাতে / পারে না বহিতে নদী জলধার / মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর / ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল / তোমার কানন সভাতে ! / মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী / শরৎকালের প্রভাতে’...
শরতের সকাল দেখেই পুজোর আগমন বোঝা যায়। শিউলি ফুলের স্নিগ্ধ মিষ্টি সুবাসে চারপাশ ম ম করে। দূর্বাঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুগুলি শ্বেতশুভ্র সকালে সোনালি রোদে মুক্তোর মতো মনে হয়। শরতের নিজস্বতা, শুভ্রতা আর স্নিগ্ধতায় মিশে আছে দিগন্তবিস্তৃত মাঠজুড়ে সবুজের সমারোহ এবং নদীর কোল ঘেঁষে সাদা কাশফুলের অপরূপ সৌন্দর্য। সেই সঙ্গে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতেই শরৎকালীন প্রকৃতির অপরূপ কাব্য-সাহিত্য চিরন্তন মাত্রা পেয়েছে। ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলা / নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা / ওগো শেফালী বনের মনের কামনা / সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা / আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ / শিউলি সুরভিত রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে / শরৎ প্রাতের প্রথম শিশির প্রথম শিউলি ফুলে / হৃদয় কুঞ্জবনে মঞ্জুরিল মধুর শেফালিকা’...
যিনি জীবের দুর্গতি নাশ করেন এবং যে দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন তিনিই দুর্গা। নীল আকাশে শ্বেতশুভ্র মেঘপুঞ্জ, নদীতীরে সাদা কাশফুলের দোলা, শিশিরভেজা সবুজ ঘাসে ঝরে পড়া শিউলি ফুল— সবই দেবী আরাধনার পূর্বাভাস, আর বয়ে আনে পুজোর গন্ধ। উলুধ্বনি আর শ্রীশ্রীচণ্ডীপাঠের মহামন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে ঢাকের বোল বাতাসে ভাসে। মর্ত্যলোকের সমস্ত কালিমাকে সরিয়ে শুভ্রতার রঙ ছড়াতে দেবী দুর্গার স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকে আগমন।
‘বাঙালি সংস্কৃতি’ হাজার বছরের পুরোনো। সময়ের আবহে আমাদের অনেক কৃষ্টি-সংস্কৃতি একদিকে যেমন আমরা হারিয়ে ফেলেছি, তেমনি দীর্ঘ সময়ের পথ পরিক্রমায় আবার অনেক নতুন নতুন কৃষ্টি যুক্ত হয়েছে আমাদের সংস্কৃতিতে। তথ্যপ্রযুক্তির ডামাডোলে, মানুষের প্রয়োজনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো অনেক কৃষ্টি-সংস্কৃতি ক্ষয়ে গেছে, আবার কোনোটি বিস্মৃত না হয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অপার সম্ভাবনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তেমন কোনও গুরুত্ব বা সুফল বয়ে না আনলেও সাংস্কৃতিক মূল্য বিচার্যে সেটির গুরুত্ব আজও অপরিসীম। আর অনুভূতি ও রস আস্বাদনে এখনও অনেকে সেগুলোর অতীত স্মৃতি রোমন্থন না করে পারেন না, যাঁরা বাস্তবে এসবের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।
প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ধমীর্য় আচার-অনুষ্ঠানে অনেক উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এসব উদ্ভিদকে বলা হয় ‘Secred Plant‘ বা ‘পবিত্র গাছ’।
পদ্ম: সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ভেষজ গুণাবলি
বিশুদ্ধতা, সৌন্দর্য ও পবিত্রতার প্রতীক এবং দুর্গাপূজায় অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ পদ্মের কথাই আসা যাক। একসময় বর্ষা ও শরৎকালে বিলে-ঝিলে শোভাবর্ধন করে ফুটে থাকত মনোহর পদ্মফুল। কিন্তু প্রকৃতি বৈরিতায় আগের মতো বিল-ঝিলের জৌলুশ হারিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পদ্মফুলসহ আরও অনেক জলজ উদ্ভিদ আজ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। পদ্মের বৈজ্ঞানিক নাম Nelumbo nucifera । ইংরেজিতে Lotus বলা হয়ে থাকে। পদ্ম সাধারণত Sacred lotus বা Indian lotus হিসেবে পরিচিত। এটি ভারতের জাতীয় ফুল। পদ্ম Nelumbonaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত Proteales বর্গের অন্তর্গত একপ্রকার হার্ব জাতীয় জলজ উদ্ভিদ। একসময় পুকুর, ডোবা, হ্রদ, নদ-নদী, জলাশয় ও খাল-বিলে প্রচুর পরিমাণে পদ্ম পাওয়া যেত। বিশুদ্ধতা, সৌন্দর্য ও পবিত্রতার প্রতীক হওয়ায় নীচু বংশকুলে জন্মগ্রহণ করে বিখ্যাত বা উচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত হলে তখন সেই ব্যক্তিটি ‘গোবরে পদ্মফুল’ নামক বাগধারায় অভিহিত করা হয় এই পদ্মের কারণে। এতেই অনুমেয়, পদ্মের রূপ-সৌন্দর্য ও বাহারের জৌলুশ ও গুরুত্ব। আমাদের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজায় পদ্মফুলের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। পদ্ম শুধু যে বিশুদ্ধতা, সৌন্দর্য ও পবিত্রতার প্রতীক হিসাবে মানুষের মনোহরণই করে তা নয়, পদ্মফুল প্রস্ফুটিত ও পরিপক্ক হয়ে যখন পদ্মখোঁচায় রূপ নেয় তখন আর এক অন্যরকম স্বাদ বা অনুভুতি। ছোটবেলায় পদ্মফুল আর পদ্মখোঁচার সঙ্গে ‘শাপলা ফুল’ আর ‘ভ্যাট’ আহরণ ছিল অন্য আর এক রস আস্বাদন। খাদ্য ও ওষুধিগুণযুক্ত হিসাবে পদ্ম আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত। পদ্মে রয়েছে ন্যুসিফেরিন, অ্যাপোরফিন ও আরমেপ্যাভিন জাতীয় অ্যালকালয়েড। সুগন্ধি বা ‘অ্যারোমা’ হিসাবে প্রসাধনী শিল্পে পদ্ম ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষকরা প্রমাণ করেছেন, পদ্মের অ্যান্টি অবেসোজেনিক ও অ্যান্টি ডায়াবেটিক ঔষুধিগুণ আছে।
শিউলি: সুরভিত শিউলির ভেষজ গুণাবলি
আবহমান বাংলার চিরায়তরূপে শরৎকালের স্নিগ্ধ সকালে হিমেল বাতাসে ভেসে বেড়ায় সুরভিত শিউলির মনমাতানো সুগন্ধি। শিশিরভেজা সকাল আর শিউলি ফুলের ঘ্রাণ দুর্গাপূজার আগমনী বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। কমলা রঙের টিউবের মতো বৃন্তে শিউলি ফুলের শ্বেতশুভ্র পাপড়িগুলো পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। একথোকায় কিংবা ক্লাস্টারে রাতে শিউলি ফুল সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে নিজেকে প্রস্ফুটিত করে। আর গাছ থেকে ফুল ঝরে পড়ে প্রাতে। বাড়ির উঠোনে গাছতলা ভরে যায় সাদা স্নিগ্ধ শিউলি ফুলের সমারোহে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে শিউলিতলায় ফুল কুড়াতে যাওয়ার সেই দৃশ্য ও আনন্দ চিরকালের, শিউলি সুরভিত শৈশবের। সকালবেলা পূজা হয় সুশোভিত শিউলি পুষ্পে পবিত্র মনে, অঞ্জলি চলে দেব-দেবীগণে। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গানে সকালবেলা শিউলি গাছের তলায় ফুল কুড়ানোর দৃশ্য তুলে ধরেছেন এভাবে— শিউলিতলায় ভোরবেলায় / কুসুম কুড়ায় পল্লীবালা...
শিউলি ভেষজগুণে অনন্য একটি উদ্ভিদ। বৈজ্ঞানিক নাম Nyctanthes arbortristis। এই উদ্ভিদের পাতা ও ফুলের নানারকম গুণ রয়েছে। পাতা, ফুল ও বীজ বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহুকাল থেকেই। পাতার রস স্বাদে তেতো হলেও কৃমি, মৌসুমি জ্বর, জন্ডিস ও গলাবসা সমস্যায় খুবই উপকারী।
দূর্বা: দীর্ঘায়ু ও কল্যাণের প্রতীক দূর্বাঘাসের ভেষজ গুণাবলি
ভারতীয় সংস্কৃতি ও পুরাণে দূর্বা হচ্ছে দীর্ঘায়ু ও কল্যাণের প্রতীক আর প্রাচীন আর্যসমাজে ধান ছিল ধন বা ঐশ্বর্যের প্রতীক। তাই আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পূজাপার্বণাদি ছাড়াও বিশেষ করে বিয়ে, অন্নপ্রাশন ও অন্যান্য শুভকাজে মঙ্গল কামনায় দূর্বা ও ধান মস্তকে দিয়ে ধন-ঐশ্বর্য ও দীর্ঘায়ু লাভে আশীর্বাদ প্রার্থনা করি। অযত্ন অবহেলায় পতিত জমি, মাঠে-ঘাটে ও বসতবাড়ির আনাচ-কানাচে বেড়ে ওঠে এই দূর্বাঘাস। এটি Gramineae (Poaceae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি উদ্ভিদ, যার বৈজ্ঞানিক নাম Cynodon dactylon। দূর্বার পাতা সরু ও লম্বা। গুচ্ছ মূল মাটির নীচে থাকে। প্রচণ্ড রোদেও দূর্বা সহজে মারা যায় না। প্রতিকূল পরিবেশে দূর্বাঘাস সহজে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে। দূর্বাঘাসের রয়েছে নানাবিধ ঔষধিগুণ। আয়ুর্বেদীয় মতে দূর্বাঘাস মহৌষধ। এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, প্রোটিন, এনজাইম, শর্করা, আঁশ, ফ্লাভোনয়েডস এবং বেশ কিছু অর্গানিক অ্যাসিড। এছাড়াও টারপিনয়েড যৌগ অরুনডেইন ও লুপিনোন বিদ্যমান দূর্বাঘাসে। শরীরের কোথাও কোনও অংশ কেটে গেলে ওই স্থানে দূর্বাঘাস পিষে লাগালে সঙ্গে-সঙ্গেই রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যায়। আঘাতজনিত রক্তপাত, শ্বেতপ্রদরজনিত দুর্বলতা, অধিক ঋতুস্রাব, চুলপড়া, চর্মরোগ, দন্তরোগ ও আমাশয়ে দূর্বা খুবই উপকারী।
অপরাজিতা: নবপত্রিকা ও বিজয়ায় অপরাজিতা এবং ভেষজ গুণাবলি
অপরাজিতা একটি পবিত্র উদ্ভিদ। শারদীয় দুর্গোৎসবে ষষ্ঠীতে বোধনের পর নবপত্রিকাকে সাদা অপরাজিতার লতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। বিজয়া দশমীর দিনে প্রতিমা বিসর্জনের পর কুলপ্রথা অনুসারে পূজামণ্ডপে ভক্তদের বিজয় কামনায় অপরাজিতা পূজার প্রচলন রয়েছে। রঙের বাহার আর মিষ্টি শোভায় অপরাজিতা অনন্য। আমাদের পুষ্প-নিসর্গ কত রঙেই না রঙিন! কোনোটি লাল, কোনোটি নীল, আবার কোনোটি সাদা, বেগুনি, গোলাপি। তেমনি অপরাজিতা। রূপসী অপরাজিতার লতানো গাছে সবুজ পাতার কোলে একটুকরো প্রগাঢ় নীল কিংবা শ্বেত-শুভ্রের সম্ভাষণ সত্যিই নজর কেড়ে নেয় অনায়াসে। প্রজাপতির মতো রঙিন বর্ণের আর শিম ফুলের মতো দেখতে, তাই একে বলা হয় Butterfly Pea। এটি ‘শঙ্খপুষ্পী’ নামেও পরিচিত। অপরাজিতা Fabaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি লতানো ঝোপময় বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। লম্বায় ১৫ থেকে ২০ ফুট হয়ে থাকে। পাতা পাঁচটি বা সাতটি ডিম্বাকৃতির পত্রে বিভক্ত। সাধারণত নীল, সাদা ও বেগুনি— এই তিন ধরনের ফুল দেখতে পাওয়া যায়। ফুল এক-পাপড়ি বিশিষ্ট, প্রায় সারাবছরই ফোটে। ফুলটির বৃতি একপাশে বিস্তৃত থাকে। দল অর্ধবৃত্তাকার। ফুল লম্বায় দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি, চওড়া পৌনে এক ইঞ্চি। গাঢ় নীল রঙের অপরাজিতা ফুলটি দেখলে মনে হয় নীলাম্বরী, তাই এর আর এক নাম নীলকণ্ঠ। ভেষজগুণ রয়েছে অপরাজিতার। এর লতাপাতা, শিকড় বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি নিরাময় করে। ব্রণ, আমাশয়, মূত্ররোগের চিকিৎসায় এ-ফুল ব্যবহার করা হয়। সাদা অপরাজিতার শেকড় সাপের বিষনাশক এবং প্রসবব্যথা নিবারণে কার্যকর বলে জানা যায়। নীল অপরাজিতার শেকড় বাতব্যথা উপশমে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বয়ঃসন্ধিকালীন উন্মাদ রোগ, গলগণ্ড, ঘন ঘন প্রস্রাব, স্বরভঙ্গ, শুষ্ক কাশি, আধকপালে ব্যথা ইত্যাদি রোগে অপরাজিতার মূল, ফুল, পাপড়ি, লতাপাতা, মূলের ছাল ও বীজ ব্যবহার হয়ে থাকে।
তুলসি: পূজায় তুলসি ও ভেষজ গুণাবলি
তুলসি একটি গুল্ম জাতীয় ঔষধিগাছ। এটি Lamiaceae পরিবারের অন্তর্গত একটি সুগন্ধযুক্ত উদ্ভিদ, যার বৈজ্ঞানিক নাম Ocimum sanctum Linn.। ইংরেজিতে তুলসি Holy Basil বা Sacred Basil নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ও ভারতের সর্বত্র এ-গাছ দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে যে কয়েক ধরনের তুলসি গাছ জন্মে তার মধ্যে বাবুই তুলসি, রামতুলসি, কৃষ্ণতুলসি, ও শ্বেত তুলসি অন্যতম। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি একটি পবিত্র উদ্ভিদ হিসাবে সমাদৃত। একটি ঘন শাখাপ্রশাখাযুক্ত পূর্ণাঙ্গ তুলসি গাছ সাধারণত ৭৫-৯০ সে.মি. লম্বা হয়ে থাকে।
তুলসি পাতার অনেক ঔষধি গুণ রয়েছে। সর্দি-কাশি, কাশি, শ্বাসকষ্ট ও লিভারের গোলযোগ ইত্যাদি নানা সমস্যায় তুলসির ব্যবহার অতুলনীয়। এ-গাছের রস কৃমি ও বায়ুনাশক। ঔষধ হিসাবে সাধারণত গাছের পাতা এবং বীজ ব্যবহৃত হয়। তুলসি পাতার রস সর্দি, কাশি, কৃমি ও বায়ুনাশক এবং মূত্রকর, হজমকারক ও অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তুলসি পাতায় আছে ভিটামিন সি ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। তবে বিশেষ করে কফের প্রাধান্যে যেসব রোগ সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে তুলসি বেশ ফলদায়ক। তুলসিতে বিদ্যমান ভিটামিন সি ও অন্যান্য অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলো মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে। এই উপাদানগুলো নার্ভকে শান্ত করে। এছাড়াও তুলসি পাতার রস শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। তুলসির অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-কারসেনোজেনিক উপাদান ব্রেস্ট ক্যান্সার ও ওরাল ক্যান্সারের বৃদ্ধিকে বন্ধ করতে খুবই উপকারী। বর্তমানে চিন এবং ভারতে তুলসি নিয়ে ভেষজ চিকিৎসায় ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে।
নয়টি গুরুত্বপুর্ণ উদ্ভিদশক্তির সঙ্গে আধ্যাত্মিক চেতনাশক্তির মেলবন্ধন হল ‘নবপত্রিকা’। কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মানকচু ও ধান। নয়টি উদ্ভিদের সমারোহে মহিমান্বিত রূপ নবপত্রিকা বা কলাবউ। যা গুণ ও কর্মে অতুলনীয়। নয়টি ভেষজ উদ্ভিদ মা দুর্গার নবরূপ ও শক্তির সম্মিলন। উদ্ভিদগুলো নিমার্ণ করে এক ‘মহাকল্পলোক’। এতে মা দুর্গার নয়টি শক্তির অর্ন্তমুখী রূপায়ণ রয়েছে। কলাগাছে দেবী ব্রহ্মাণী, কচুগাছে দেবী কালিকা, হলুদে দেবী উমা, জয়ন্তীতে দেবী কার্তিকী, বেলগাছে দেবীর শিবশক্তি, ডালিমে দেবী রক্তদন্তীকা, অশোকে দেবী শোকরহিতা, মানকচুতে দেবী চামুণ্ডা এবং ধানে দেবী লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান ভেবেই চলে দুর্গাপূজায় মায়ের আমন্ত্রণ ও অধিবাস। এই নয়টি গাছের চারাকে শ্বেত অপরাজিতার মূলে বেধে ‘কলাবউ’-কে সাজানো হয়। যার শাস্ত্রীয় নাম ‘নবপত্রিকা’। সংস্কৃতে নবপত্রিকাকে এভাবে তুলে ধরা হয়েছে—
‘রম্ভা কচ্বী হরিদ্রা চ জয়ন্তী বিল্বদাড়িম্বৌ।
অশোকা মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা॥’
কলা: নবপত্রিকার প্রতীক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ভেষজ গুণাবলি
শারদীয় দুর্গাপূজায় একটি স্বল্পবয়স্ক গাছকে নতুন শাড়ি পড়িয়ে নবপত্রিকার প্রতীকরূপে পূজা করা হয়। কালীপূজায় কলাগাছ পুঁতে কলাগাছের চারদিকে মাটির তৈরি দিয়ারে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয় কার্তিকী অমাবস্যা তিথিতে। ঘোরঘুট্টি অন্ধকারে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের দৃশ্য গ্রামে খুবই মনোমুগ্ধকর। ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান সমূহের সাজসজ্জায় প্রধান প্রবেশ পথের দু-দিকে দুটি কলার গাছ পুঁতে রাখা হয় যা প্রাচুর্যের প্রতীক হিসাবে গণ্য করা হয়। এছাড়াও বিষহরি পূজায় কলার পটুয়া দিয়ে ভেলা তৈরি করে পুকুর বা নদীর জলে শোলার প্রতিমা ভাসিয়ে দেয়ার রীতি অতিপ্রাচীন। পূজা-পার্বণাদি, মহানাম যজ্ঞানুষ্ঠাদিতে প্রসাদ বিতরণে কলার পটুয়া বা পাতা সুদীর্ঘকাল ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নবদম্পতির শুভ পরিণয়ে বিয়েবাড়িতে কলাগাছ দিয়ে এখন সুদৃশ্য ও মনোরম ‘গেট’ ও ‘ছায়ামণ্ডপ’ তৈরি হচ্ছে যা অতি সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য।
কলাগাছ একটি হার্ব জাতীয় সপুষ্পক উদ্ভিদ। কলাগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Musa paradisiaca। কলা একটি অতিপরিচিত ও সুস্বাদু ফল। বাঙালির অতিপ্রিয় ফল কলার কথা এখন থেকে দু-হাজার বছর পূর্বে বৌদ্ধ ইতিহাসে পাওয়া যায়। অনেকে ধারণা করেন, ফলটির প্রচীনত্ব আরও অনেক বেশি। কলা অনার্য ভাষার শব্দ। খনার বচনে লঙ্কেশ্বর রাবণের কলার চাষকে জড়ানো হয়েছে। ‘খনা বলে ভাদ্র মাসে রুয়ে কলা / সবংশে মরলো রাবণ শালা…। কাঁচাকলা সবজি হিসাবে খুবই উপাদেয়। সুস্বাদু ফল ও সবজি হিসাবে কলার ব্যবহার ও কদর ব্যাপক। কলাতে যথেষ্ট পরিমাণে শর্করা, সামান্য পরিমাণে প্রোটিন ও চর্বি আছে। কলা থেকে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর ও উপাদেয় খাবার। আর পাকা কলার সঙ্গে চিনি বা গুড় মিশিয়ে বাঙালি রমণীরা পিঠা তৈরিতে সিদ্ধহস্ত প্রাচীনকাল থেকেই। পাকা কলা থেকে তৈরি হয় মদ, বিয়ার ও সিরকা। শুধু তাই নয়, পাকা কলার শুকনো গুঁড়ো শিশুখাদ্য হিসাবে চকলেট ও বিস্কুট তৈরির উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
কচু ও মানকচু: পথ্য ও পুষ্টিগুণে কচু এবং ভেষজ গুণাবলি
কচু Araceae গোত্রভুক্ত একপ্রকার কন্দ জাতীয় উদ্ভিদ। ফুল থেকে মূল কোনোকিছুই ফেলনা নয়। এককথায় কচুর ডাঁটা, পাতা, লতি, মুখী, ফুল ও মূল সবই খাদ্য উপাদান ও পুষ্টিগুণে ভরপুর। গ্র্রমাঞ্চলে বসতবাড়ির আনাচ-কানাচে পতিত জমিতে কচু জন্মে। জলে ও ডাঙায় উভয় স্থানেই কচু হয়। সবজি হিসেবে খাওয়ার উপযোগী বুনো জাতগুলোর মধ্যে মুখীকচু, জলকচু, ওলকচু, দুধকচু, মানকচু, শোলাকচু, পঞ্চমুখীকচু অন্যতম। বাহারি পাতা ও ফুলের সৌন্দর্যের কারণে কিছু প্রজাতির কচু এখন বাগানে ও বসতবাড়ির ছাদে টবে লাগানো হয়। প্রজাতিভেদে কচুর মূল, লতি, ডাঁটা ও পাতা সবই মানুষের ভক্ষণযোগ্য। দামে সস্তা সবজি হিসেবে কচু পুষ্টিগুণে অনন্য। কচু আমরা বিভিন্নভাবে রান্না করে খেয়ে থাকি। কচুর পাতা শাক হিসেবে খাওয়া যায়। কচুশাকে বিদ্যমান ভিটামিন-এ রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে।
কচুতে রয়েছে আয়রন ও ক্যালসিয়াম যা শরীরের হাড় গঠনে সহায়তা করে এবং রক্তশ্যন্যতা দূর করে। কচুতে বিদ্যমান আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রেখে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ করে। ইলিশ কিংবা চিংড়ি মাছ অথবা শুঁটকি দিয়ে কচুর লতি বা কচু রান্না অনেকেরই প্রিয়। ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি, জলীয় উপাদান, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস ও আয়োডিন ছাড়াও কচুর লতিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। এই ফাইবার দেহ থেকে বর্জ্য অপসারণ করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে খাদ্য হজমে সহায়তা করে। কচুর ফুল দেখতে সাধারণত হলুদ বা হলদে সাদা বর্ণের, কিন্তু দুধকচুর ফুল দেখতে দুধের মতোই সাদা। দুধকচু পথ্য হিসেবে রোগীকে শিং ও মাগুর মাছ দিয়ে রান্না করে খাওয়ানো হয়। কচুর ফুলের বড়া অনেকেরই পছন্দ এবং খেতে খুব সুস্বাদু। রোগ প্রতিরোধ ও দৈনন্দিন পুষ্টির চাহিদা মেটাতে কচুর তুলনা হয় না।
হলুদ: হলুদের ব্যবহার ও ভেষজ গুণাবলি
হলুদের অপর নাম বর্ণবতী। বর্ণ, রুচি ও উজ্জ্বলতায় হলুদ উপকারী। বলবর্ধক, রক্তপরিষ্কারক, পিত্তনাশক, দাহ-নিবারকের কারণে হলুদ কাঞ্চনী, পীত, বরবর্ণিলী, যোষিৎপ্রিয়া ও বর্ণবিধায়িনী নামে পরিচিত। হলুদ একটি Zingiberaceae পরিবারের অন্তর্গত গুল্মজাতীয় একটি উদ্ভিদ। বৈজ্ঞানিক নাম Curcuma longa। হলুদ হাজার হাজার বছর ধরে রন্ধন শিল্পে ব্যবহার হয়ে আসছে। ত্বকের উজ্জ্বলতার জন্য প্রসাধনী হিসাবে হলুদের ব্যবহার বহু প্রাচীন ও সমাদৃত। অন্যদিকে হলুদের রয়েছে নানাধরনের ওষুধিগুণ। হলুদে গুরুত্বপূর্ণ উদ্বায়ী তেল টারমেরন, এটলানটোন, জিঞ্জিবারেইন এবং কিছু সাধারণ উপাদান চিনি, প্রোটিন, রেসিন, ফাইবার, পটাশিয়াম, ভিটামিন বি-৬, ম্যাগনেশিয়াম ও ভিটামিন সি রয়েছে। কফ, বাত, পিত্ত, ব্রণ, চর্মরোগ, শোথ, কৃমি, প্রমেহ, অরুচি, উদরী ও বিষদোষ প্রশমন করার ক্ষমতা রয়েছে হলুদের। কারকিউমিন নামে একপ্রকার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে হলুদে। এই অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট কারকিউমিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। কারকিউমিন আছে বলেই লিভারের রোগ বা সমস্যায় হলুদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসূ। মধু মিশিয়ে খেলে লিভারের সমস্যায় উপকার পাওয়া যায়। কাঁচা হলুদের রস সামান্য লবণ মিশিয়ে সকালবেলা খালি পেটে খেলে কৃমিনাশ হয়। আর্থ্রাইটিস, অ্যাজমা, হার্টের রোগ, অ্যালঝাইমার, ডায়াবেটিস ছাড়াও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ক্যান্সার প্রতিরোধেও কারকিউমিনের উপকারী গুণের কথা জানা যায়।
জয়ন্তী: জয়ন্তীর ভেষজ গুণাবলি
দুর্গাপূজায় ষষ্ঠীতে এই জয়ন্তী গাছ নবপত্রিকায় ব্যবহার করা হয়। Fabaceae পরিবারের অর্ন্তভুক্ত উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম Sesbania sesban। সংস্কৃতে জয়ন্তিকা নামে পরিচিত। এই গাছের পাতা দেখতে অনেকটা তেঁতুল গাছের পাতার মতো। জয়ন্তী গাছে সাধারণত শীত ও বর্ষাকালে ফুল ফোটে। দৃষ্টিনন্দন জয়ন্তী ফুল দেখতে অসাধারণ। ফুলের সৌন্দর্য সহজেই নজর কেড়ে নেয়। এটি ভেষজগুণে সমৃদ্ধ একটি উদ্ভিদ। গাছের পাতা, ফুল ও কাণ্ড বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। শ্বেতিরোগ, শূলবেদনা, অনিয়মিত ঋতুস্রাব, শ্বাসকষ্ট ও সর্দিতে এটির নানাবিধ উপকারিতার কথা জানা যায়।
বেল: বেলের ভেষজ গুণাবলি
বেল গাছ পবিত্রতার প্রতীক। বেলপাতা পূজাপার্বণাদিতে অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। বেল স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় একটি ফল। গ্রীষ্মকালীন ফলগুলোর মধ্যে বেল অন্যতম। বেল Rutaceae গোত্রের অর্ন্তভূক্ত একটি মাঝারি আকারের উদ্ভিদ। যার বৈজ্ঞানিক নাম Aegle marmelos এবং ইংরেজিতে Wood apple বলা হয়। পাকা ফলের শাঁস ও শরবত সুস্বাদু। বেলের পুষ্টিগুণ অন্যান্য ফলের চেয়ে অত্যন্ত বেশি। ভিটামিন-সি ও ভিটামিন-এ ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ট্যানিন ও লৌহ উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। বেলের রয়েছে নানাবিধ উপকারিতা। এই ফলে ন্যাচারাল ফাইবার বা আঁশের পরিমাণও অনেক বেশি। আঁশযুক্ত হওয়ায় হজমশক্তি বাড়িয়ে গ্যাস-অ্যাসিডিটির পরিমাণ কমায় ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। পাকা বেলের শাঁস শরবত, জ্যাম, জেলি, চাটনি, স্কোয়াস, বেভারেজ ও বিভিন্ন ধরনের আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ডায়রিয়া ও আমাশয়ে বেল খুবই উপকারী। যারা নিয়মিত বেল খায়, তাদের কোলন ক্যান্সার, গ্লুকোমা, জেরোসিস, জেরোপথ্যালমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম থাকে। এছাড়াও বেল ডায়াবেটিস ও বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে। বেলে অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি উপাদান রয়েছে। প্রতিদিন বেলের শরবত পান করলে শরীরের ক্লান্তি দূর হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিদিনের শারীরিক পরিশ্রমের পর এক গ্লাস বেলের শরবত সারাদিনের ক্লান্তি প্রশমন করে।
ডালিম: ডালিমের ভেষজ গুণাবলি
পুষ্টিগুণে ভরপুর ডালিম অনেকেরই প্রিয় ফল। এটি একটি পরিচিত ফল। টসটসে দানায় ভরপুর রসালো ফল ডালিম খুবই পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। ডালিমের বৈজ্ঞানিক নাম Punica granatum। ডালিমের বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে ও চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে হিতকর ফল ডালিম। তাই ডালিমকে শক্তিদাত্রী রক্তবীজনাশিনী বলা হয়। ডালিমের রসে বিউটেলিক অ্যাসিড, আরসোলিক অ্যাসিড, সিউডোপেরেটাইরিন, পেপরেটাইরিন, আইসোপেরেটাইরিন ও মিথাইপেরেটাইরিন উপাদান রয়েছে। ডালিমের রসে রয়েছে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধক, বীজের তেলে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধক এবং শুকনো ছাল ও মূলে রয়েছে কৃমিনাশক গুণ। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভিটামিন-সি, ফলেট, আয়রন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে ডালিমে। আর্য়ুবেদিক ও ইউনানি চিকিৎসায় ডালিম থেকে ঔষুধ তৈরি হয়।
অশোক: অশোকের ভেষজ গুণাবলি
অশোক মাঝারি আকৃতির বহু শাখাপ্রশাখা বিশিষ্ট এক ছায়াতরু। শোভাবর্ধনে অশোকের জুড়ি মেলা ভার। উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম Saraca asoca। কাণ্ড বা শাখায় ছোটো ছোটো ফুল গুচ্ছাকারে ধরে। পুষ্পমঞ্জরী গোলাকৃতির। সাধারণত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে গাছে দৃষ্টিনন্দন সুগন্ধযুক্ত কমলা রঙের ফুল ফোটে। নয়নলোভা পুষ্পশোভা দেখে শোক দূর হয় বলে অশোক ফুলকে প্রেমের প্রতীক বলা হয়ে থাকে। গৌতম বুদ্ধ লুম্বিনী উদ্যানে অশোক গাছের তলায় জন্মেছিলেন এবং শারদীয়া দুর্গাপূজায় নবপত্রিকায় এটি অপরিহার্য এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে বৌদ্ধ এবং সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের নিকট এটি পবিত্র গাছ। এটি একটি উপকারী উদ্ভিদ। এই গাছের রয়েছে নানাবিধ ভেষজগুণ। ভেষজ হিসেবে এই গাছের ছাল প্রাচীনকাল থেকে নানাধরনের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়ে আসছে। বিশেষ করে স্ত্রীরোগ, রক্তক্ষরণ, আমাশয় ও যন্ত্রণা উপশমে এই গাছের ছালের রস বেশ কার্যকরী। বন্যপ্রাণীরা খাদ্য হিসেবে এই গাছের ফল খেয়ে থাকে। এছাড়াও প্রস্রাবের জ্বালা-যন্ত্রণা, অকাল গর্ভপাত, জরায়ুর সমস্যা, অর্শ, অ্যালার্জিতে অশোকের উপকারিতার কথা জানা যায়।
ধান: মহালক্ষ্মীর ধন-ধান্য আর নবান্নে
নবপত্রিকার শেষ উদ্ভিদশক্তি হল ধান। ধানের বৈজ্ঞানিক নাম Oryza sativa। মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য হল ধান। ‘কার্তিক গেল অগ্রহায়ণ মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান / সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান / ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু / কলমিলতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।’ কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মিলে ঋতু হেমন্ত। হেমন্তে প্রকৃতিতে গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের এই কবিতায়। অগ্রহায়ণে সোনার ধানে ভরে উঠে কৃষকের জমি। হেমন্তের মৃদুমন্দ বাতাসে খেলা করে পাকা ধানের শীষ। বাতাসে আপনমনে হেলছে ধানগাছ, দুলছে ফিঙ্গে পাখি। নতুন ধানের ম ম গন্ধে ভরে যায় মন। সোনালি ফসলের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন বুনে কৃষক। অগ্রহায়ণ এলেই দিগন্তবিস্তৃত মাঠজুড়ে কৃষাণ-কৃষানীদের ধান কাটার ধুম পড়ে যায়। লোককবির ভাষায়, ‘আইলো অঘ্রাণ খুশীতে নাচে প্রাণ / চাষি কাঁচিতে দিলো শান / কাঁচি হাতে কচ কচা কচ কাটে চাষি পাকা ধান...’। তখনকার দিনে নানা বাহারি ধানের দেশি জাতের ধান গ্রামবাংলার জমিতে চাষাবাদ হত। সেইসব ধানের মধ্যে পানি শাইল, ইঁদুর শাইল, পাইজাম, ঢেপা, জলঢেপা, কালোজিরা, খিরশাপাত, বিন্দি পাকড়ি, যশোয়া, গাঞ্জিয়া, বেতো, কাটারীভোগ, উকনিমধু, নাইজার শাইল, কার্তিক শাইল, চাপালো, বাঙালি, ডুমরা চাপালো, গরিয়া, থরকাসাই, জাবর শাইল, জিগাশাইল, ভাসামালি, উড়কি, বিন্নি, দুধকলম, নীলকুমোর, শীলকুমোর, সূর্যউজাল, ঢলকাসাই, বেগুনবিচি, বকরী, দারকেশাইল ও বলদারের মতো আরও অনেক নাম না জানা দেশি জাতের ধান চাষাবাদ হত। এসব দেশি জাত আজ বিলুপ্ত প্রায়। হেমন্তে কৃষাণ-কৃষানী ধান কাটা ও ধান মাড়াইয়ের কাজে হয়ে পড়ে মহাব্যস্ত। গোলা ভরে উঠে নতুন ধানে, ভরে যায় লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। ধান ভানার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে বাতাসে। ঢেঁকির তালে মুখরিত হয় বাড়ির আঙিনা। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকির তালে মুখরিত হয় না আমাদের আবহমান গ্রামবাংলা। ঢেঁকিছাঁটা চাল দিয়েই রান্না হত ভাত। নতুন চালের ভাত আর নানা ব্যঞ্জনে খাবার পরিবেশন হত আনন্দঘন পরিবেশে। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসের পহেলা তারিখে নতুন আমন ধান ঘরে তোলার পর আয়োজন করা হয় নবান্ন উৎসবের। নবান্ন শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। আর নবান্ন উৎসব হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্র্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। নবান্ন শস্যভিত্তিক একটি ঐতিহ্যবাহী লোক উৎসব। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে-সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। নতুন চালের পিঠার ঘ্রাণে পুরো গ্রামবাংলায় চলে উৎসবের আমেজ।
লেখকের অন্যান্য লেখা
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস