ছোটো গল্প
FREE SHIPPING IN INDIA
ছোটো গল্প
পৃথিবীর মানুষেরা যে মহাকাশযান তৈরি করে তা অনেক বড়ো, চলেও ধীরগতিতে। কিন্তু মঙ্গল গ্রহের অধিবাসীরা প্রযুক্তি বিজ্ঞানে কয়েকশো বছর এগিয়ে। আমরা অনেক ছোটো মহাকাশযান তৈরি করতে পারি। প্রায় আলোর গতিবেগে সেই সমস্ত যান চলতে পারে। তোমাকে ছাদে দেখতে পেয়ে আমরা মহাকাশযান থেকে একটা অদৃশ্য রশ্মি ছুড়ে দিলাম। তুমি অজ্ঞান হয়ে পড়লে আমরা তোমাকে মহাকাশযানে চাপিয়ে মঙ্গল গ্রহে নিয়ে এলাম।
শংকর লাল সরকার
চোখ বোজা অবস্থাতেই দিতি চারপাশে বিচিত্র ধরনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। আশেপাশে কারা সব অজানা ভাষায় কথা বলছে। অদ্ভুতভাবে গুজগুজ ফিসফিস করছে। সহ্য হল না। ওকে নিয়ে মশকরা! চোখ খুলে যা দেখল দিতি, সেজন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিল না। মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে তিনটে মুখপোড়া বানর। রীতিমতো হকচকিয়ে গেল সে। প্রচণ্ড ভয় পেল। আচমকা ওদের মধ্যে একজন নির্ভেজাল বাংলায় বলে উঠল, “এই তো জ্ঞান ফিরেছে।”
সুপর্ণা-ম্যাম অঙ্ক পরীক্ষায় ওকে একশোয় একশো দিলেও দিতি বোধ হয় এতটা আশ্চর্য হত না। বানররা বাংলাতে কথা বলে!
একটু ধাতস্থ হয়ে দেখল বানর তিনটেকে। না, এদের ঠিক সাধারণ বানর বলে মনে হচ্ছে না। লম্বা লেজ আছে বটে, কিন্তু মুখ-চোখ? এত টিকালো নাক, বড়ো বড়ো চোখ বানরের হয় নাকি! তাছাড়া স্পষ্ট বাংলায় কথা বলছে! বানর বাংলা ভাষাতে কথা বলে কেউ কখনও শুনেছে? অবাক হয়ে দিতি দেখল বানরগুলোর মাথায় হেলমেট, গায়ে প্লাস্টিক জাতীয় জিনিষের তৈরি অদ্ভুতরকমের পোশাক।
দিতিকে অবাক করে দিয়ে একজন বলল, “তুমি জানতে চাইছ, আমরা কারা? কী আমাদের পরিচয়?”
দিতি হতবাক হয়ে গেল। ওরা কি মনের কথাও বুঝতে পারে নাকি? ও এই প্রশ্নগুলোই করবে বলে ভাবছিল।
প্রথমে যে কথা বলেছিল, সে বলল, “এক এক করে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। তুমি এখন মঙ্গল গ্রহে। আমরা সবাই মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দা।”
দিতি হেসে ফেলল।— “তামাশা নাকি? আমাকে বুদ্ধু ভেবেছ? ইসরোর মঙ্গলযান পৃথিবী থেকে মঙ্গল গ্রহে পৌঁছতে দুশো আটানব্বই দিন লাগাল আর আমি মাত্র একবেলার মধ্যে মঙ্গল গ্রহে পৌঁছে গেলাম!”
“বিশ্বাস করলে না? অবশ্য বিশ্বাস না হবারই কথা। কিন্তু যা বলছি তা সত্যি।”
দিতি বলল, “এই তো কিছুক্ষণ আগে একা একা বাড়ির ছাদে উঠেছিলাম। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল। সকালবেলাতেই নেমে এসেছিল সন্ধ্যার অন্ধকার। ঝড়ের উঠবে। ঘরে বসে একা একা অঙ্ক করতে ইচ্ছা করছিল না, বাড়িতে কেউ নেই। ঝড় দেখব বলে ছাদে উঠেছিলাম। মা জানতে পারলে ভীষণ বকবে। আর এরই মধ্যে মঙ্গল গ্রহে চলে এলাম! আমি মোটেই এত ছোটো নই যে, যা খুশি বুঝিয়ে দেবে।”
“হ্যাঁ, এটা একটা আশ্চর্য ঘটনা বটে। পৃথিবীর মানুষ প্রযুক্তি বিজ্ঞানে অনেক পিছিয়ে আছে। এরকম ঘটনা যে বাস্তবে ঘটতে পারে তা পৃথিবীর মানুষের কল্পনার বাইরে। কিন্তু আমাদের কারিগরি প্রযুক্তির কাছে এই কাজ জলভাত।”
পাশ থেকে অন্য একজন বলল, “তুমি যখন ছাদে ঘুরছিলে তখন সেখান দিয়ে মহাকাশযানে চেপে আমরা যাচ্ছিলাম।”
“মহাকাশযান? সে তো অনেক বড়ো হয়। মঙ্গলযানের উৎক্ষেপণ টিভিতে দেখেছি। টিনটিনের বইতেও মহাকাশযানের কথা আছে। কত বড়ো রকেট! এক এলাহি ব্যাপার।”
“তুমি ঠিকই বলেছ। পৃথিবীর মানুষেরা যে মহাকাশযান তৈরি করে তা অনেক বড়ো, চলেও ধীরগতিতে। কিন্তু মঙ্গল গ্রহের অধিবাসীরা প্রযুক্তি বিজ্ঞানে কয়েকশো বছর এগিয়ে। আমরা অনেক ছোটো মহাকাশযান তৈরি করতে পারি। প্রায় আলোর গতিবেগে সেই সমস্ত যান চলতে পারে। তোমাকে ছাদে দেখতে পেয়ে আমরা মহাকাশযান থেকে একটা অদৃশ্য রশ্মি ছুড়ে দিলাম। তুমি অজ্ঞান হয়ে পড়লে আমরা তোমাকে মহাকাশযানে চাপিয়ে মঙ্গল গ্রহে নিয়ে এলাম।”
“আমাকে এখানে নিয়ে এলে কেন? মা অফিস থেকে ফিরে আমাকে দেখতে না পেলে খুব কান্নাকাটি করবে।” এবার দিতির কান্না পেল।
“চিন্তা কোরো না, তোমাকে ঠিক সময়ে আমরা পৌঁছে দিয়ে আসব। এখন তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই।”
দিতি এতক্ষণ লক্ষ করেনি। ও যেখানটায় ছিল সেটা আসলে একটা গাড়ি। এবার সেটা চলতে শুরু করল। বড়ো বড়ো স্বচ্ছ জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখা যাচ্ছিল। সবুজের চিহ্নহীন ধু ধু রুক্ষ লাল পাথুরে এলাকা। সিসে রঙের ঘোলাটে আকাশ। বাইরের পরিবেশে কেমন এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা, দেখলেই মনখারাপ হয়ে যায়।
বানরদের মধ্যে একজন বলল, “তোমার সঙ্গে আমাদের পরিচয়পর্বটা সেরে নিই। তোমার নাম আমরা জানি, দিতি। নিবেদিতা বিদ্যামন্দিরে ক্লাস সিক্সে পড়ো। আমি হলাম জিরো-ওয়ান-টু-এক্স, ওরা দুজন হল থ্রি-সেভেনটি-ফাইভ-এক্স এবং ফাইভ-ফর্টি-ওয়ান-ডি।
“তোমাদের কোনও নাম নেই?” দিতি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
“ওগুলোই আমাদের নাম। তোমাদের মতো নাম দেবার প্রচলন আমাদের মধ্যে বহুবছর উঠে গেছে। আমাদের প্রত্যেকের এক-একটা আলাদা আলাদা কোড নম্বর আছে। অনেকটা তোমাদের আধার কার্ডের মতো। সেই কোডের একটা অংশ আমরা নাম হিসাবে ব্যবহার করি।”
দিতি অনুভব করল উঁচু-নীচু পাথুরে এলাকা দিয়ে গাড়িটা কেমন ঝাঁকুনিহীন ভাবে দ্রুত ছুটে চলেছে। দিতি সবেমাত্র এটা চিন্তা করেছে, অমনি ফাইভ-ফর্টি-ওয়ান-ডি নামে যাকে পরিচয় দেওয়া হয়েছিল সে বলল, “এই গাড়িটাতে কোনও চাকা নেই। চলেছে তড়িৎচুম্বকীয় শক্তিতে। তাই কোনোরকম ঝাঁকুনি অনুভব করছ না।”
দিতি নিঃসন্দেহ হল, বানরগুলো মানুষের চিন্তাভাবনা বুঝতে পারে, পড়তে পারে মানুষের মন। ও জিজ্ঞাসা করল, “তোমরা বাংলা ভাষাতে কেমনভাবে কথা বলছ?”
জিরো-ওয়ান-টু-এক্স বলল, “আমাদের মাথায় হেলমেটের মতো যে যন্ত্রটা দেখছ, সব ওটারই কারসাজি। যন্ত্রটা তোমার মস্তিষ্কের সঙ্গে আমাদের চিন্তাভাবনার সংযোগ ঘটাচ্ছে। ফলে তুমি কোনও বিষয়ে চিন্তা করলেই আমরা তা বুঝতে পারছি আর যন্ত্রটাই তোমার বোধগম্য ভাষায় তার উত্তর সরাসরি তোমার মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দিচ্ছে।”
গাড়িটা একটা লম্বা টানেলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সাপের মতো এঁকে-বেঁকে টানেল এগিয়েছে। গাড়িটাও সেইভাবেই তীব্র গতিতে ছুটে চলল। মেট্রো রেলের মতো লম্বা সুড়ঙ্গ। দিতি বুঝতে পারল, কিছুটা পথ সোজা চলবার পর গাড়িটা নীচের দিকে নামছে। নামছে তো নামছেই। যেমন আচমকা চলতে শুরু করেছিল, তেমনি আচমকাই ঝট করে থেমে গেল। এতটুকু ঝাঁকুনি পর্যন্ত হল না।
চারদিকে তাকিয়ে দিতির চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মাটির তলায় এ তো রীতিমতো একটা শহর! উঁচু উঁচু বাড়ি, দোকান, আলোকোজ্জ্বল রাস্তাঘাট। বেঁটে, গাট্টাগোট্টা, লম্বা লেজওয়ালা বানরের মতো দেখতে কয়েকটা প্রাণী ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চওড়া রাস্তা দিয়ে হুসহাস করে চলে যাচ্ছে বড়ো বড়ো বলের মতো দেখতে আশ্চর্য সব গাড়ি।
জিরো-ওয়ান-টু-এক্স বলল, “এই আমাদের শহর। বানর সভ্যতার একত্রিশ নম্বর জনপদ।”
“মাটির নীচে এত বড়ো শহর?”
“এই গ্রহের ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগ বসবাসের অযোগ্য। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের মাটির তলায় জনপদ বানাতে হয়েছে। এইরকমের চল্লিশটা জনপদ বিরাট গ্রহটার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে।”
দিতি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
জিরো-ওয়ান-টু-এক্স বলল, “বুঝতে পারছি তোমার মনে প্রশ্ন জাগছে। একদিন এই মঙ্গল গ্রহও তোমাদের পৃথিবীর মতোই সবুজ ছিল। বিরাট বিরাট জলাশয়, ঘন সবুজ অরণ্য, নীল আকাশ—কোনোকিছুর অভাব ছিল না। কিন্তু লোভ, অন্তহীন লোভ সবকিছু নষ্ট করে দিল। নৃশংস লোভ আর নির্লজ্জ উদাসীনতা আমাদের সুন্দর গ্রহটাকে ধীরে ধীরে রুক্ষ, অসুন্দর, বসবাসের অযোগ্য করে তুলল। গাছ কেটে বসতি বানিয়েছিলাম। তৈরি করেছিলাম বড়ো বড়ো শহর। অরণ্য ধ্বংস করে খনিজ উত্তোলন করেছি। উর্বর মাটিতে গড়ে তুলেছি কারখানা। এই করতে করতে একদিন গ্রহটা হয়ে গেল ঊষর মরুভূমি। বেহিসেবি উন্নয়নের ফলে ভূপৃষ্ঠের জল আর বাতাস বিষিয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে আমাদের মাটির নীচে বসতি গড়ে তুলতে হল। নির্বিচার বৃক্ষনিধনের ফলে আমাদের প্রিয় সবুজ গ্রহটা বসবাসের অযোগ্য রুক্ষু লাল গ্রহে পরিণত হল। একদিন সমস্ত গ্রহটা জুড়ে ছিল আমাদের রাজত্ব। আর আজ, কেবলমাত্র জীবনধারণের জন্যই ইঁদুরের মতো আমাদের গর্তে আশ্রয় নিতে হয়েছে। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত উন্নতি সত্ত্বেও প্রকৃতির আছে আমরা নিতান্তই অসহায়।”
আকৃতিগতভাবে বানরের মতো দেখতে হলেও এরা যে বেশ উন্নত জীব তা বুঝতে পেরে দিতি মনে মনে ওদের শ্রদ্ধা করতে আরম্ভ করেছিল। এতক্ষণ তুমি তুমি করে বলার জন্য দিতি ভীষণ লজ্জিত হয়েছিল।
জিরো-ওয়ান-টু-এক্স বলল, “আমাদের পূর্বপুরুষেরাও পৃথিবীর মানুষদের মতোই বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা কানে তোলেনি।”
দিতি জিজ্ঞাসা করল, “পৃথিবী থেকে যেসব মহাকাশযান মঙ্গলে এসে অনুসন্ধান চালিয়েছিল, যেমন নাসার মহাকাশযান কিউরিওসিটি বেশ কিছুদিন মঙ্গলে ছিল, ওগুলো আপনাদের সভ্যতার বিষয়ে কোনও তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি?”
জিরো-ওয়ান-টু-এক্স গম্ভীর স্বরে বলল, “অনাবশ্যক ঝামেলা এড়াবার জন্য আমরা সতর্ক ছিলাম যাতে মঙ্গল গ্রহের বানর সভ্যতার কোনও খবর যন্ত্রগুলি না পায়।”
একটা বিরাট গোল চত্বরের একপাশে এসে গাড়িটা থামল। চারদিক আলো ঝলমলে অথচ বড়ো চত্বরটা ছায়াচ্ছন্ন, কেমন যেন বিষাদভূমি। চত্বরের মাঝখানে একটা অদ্ভুত আকৃতির গাছ। দিতি দেখল, জিরো-ওয়ান-টু-এক্স বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে চত্বরের দিকে। ফাইভ-ফর্টি-ওয়ান-ডি ইশারায় দিতিকে চত্বরের মাঝখানের গাছটাকে দেখাল। বলল, “গাছের মতো যেটাকে দেখছ, ওটা মোটেই কোনও গাছ নয়। ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা লাভা জমাট বেঁধে ওরকম আকার ধারণ করেছে।”
দিতির মুখোমুখি বসা থ্রি-সেভেনটি-ফাইভ-এক্স বলল, “প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে সমস্ত চত্বরটাই গলিত লাভাতে ভরে গিয়েছিল। কেবলমাত্র ওইটুকু নিদর্শন ছেড়ে রেখে বাকিটা পরিষ্কার করা হয়েছে। পঞ্চাশ বছর আগে, আমাদের সভ্যতা তখনও আজকের মতো উন্নত হয়ে উঠেনি, এসব এলাকায় তখন সবেমাত্র বসতি স্থাপন করা শুরু হয়েছিল। এই এলাকা ছিল ভূমিকম্পপ্রবণ। আর ভূমিকম্প হলেই ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসত গলিত লাভার স্রোত। সে ছিল এক ভয়ানক আতঙ্কের ব্যাপার।”
জিরো-ওয়ান-টু-এক্স এতক্ষণ বাদে দিতির দিকে তাকাল। তার বড়ো বড়ো চোখ দুটি কাচের মতো চকচক করছে। ধরা গলায় বলল, “আমি ছোটবেলায় এখানে বাস করতাম। মঙ্গল গ্রহের ভূপৃষ্ঠ তখন বসবাসের অনুপযুক্ত। উন্নত প্রযুক্তি দ্বারা এইসব বসতি তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু গলিত লাভা উদ্গিরণের আশঙ্কা দূর করা যায়নি। আপদকালীন ব্যবস্থা হিসাবে কয়েকটি লিফট বসানো হয়েছিল যাতে লাভা বের হতে শুরু করলে বাসিন্দারা দ্রুত ওপরের নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে। তৎকালীন বৈজ্ঞানিকেরা ভেবেছিলেন নিরাপত্তার এই ব্যবস্থা একেবারে নিশ্ছিদ্র। কিন্তু প্রাকৃতিক শক্তির কাছে আমরা যে কত অসহায় তার সাক্ষী আমি নিজে। পঞ্চাশ বছর আগেকার সেই ভয়ানক লাভা উদ্গিরণের স্মৃতি মনে পড়লে আজও আমরা আতঙ্কে শিহরিত হই।”
জিরো-ওয়ান-টু-এক্স বলতে লাগল, “তখন আমার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। মার সঙ্গে এখানে থাকতাম। মা একটা শিক্ষায়তনে শিক্ষকতার কাজ করতেন। বাবা থাকতেন অনেক দূরে অন্য এক জনপদে। ছুটিছাটায় হয় আমরা বাবার কাছে যেতাম, নয়তো বাবা আসতেন আমাদের কাছে। সে-সময় দিনগুলি কত আনন্দময় ছিল। কিন্তু সেই প্রলয়ের দিন সন্ধ্যাবেলাতে…”
দিতি বুঝতে পারল, চোখের জল আড়াল করার জন্য সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। একজন বড়ো লোককে, থুড়ি, বানরকে কাঁদতে দেখা যে কী ভীষণরকমের অস্বস্তিকর। দিতির খারাপ লাগছিল।
জিরো-ওয়ান-টু-এক্সের মুখের রেখাগুলো ভেঙেচুরে গিয়ে একরাশ অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল। সে আবার বলতে শুরু করল, “সেদিন সকাল থেকেই চারদিক কেমন যেন একটা থমথমে। একটা কী হয়, কী হয় ভাব। দুপুর গড়াতেই পায়ের নীচে মাটি কাঁপতে শুরু করেছিল। প্রথমে ধীর লয়ে, তারপর আচমকা সেই কাঁপুনি ভয়ংকর রকমের বেড়ে গেল। ঘরের ভিতরে তাক থেকে সব জিনিসপত্র গড়িয়ে নীচে পড়তে লাগল। ধাতুর বাসনে ঠোকাঠুকির ফলে চারদিকে এক বিচিত্র কর্কশ আওয়াজ। মায়ের সঙ্গে আমি ছুটে ঘর থেকে বের হলাম। বাইরে তখন অনেকের ভিড়। সকলেই পড়িমরি করে ছুটছে লিফটের দিকে। পায়ের নীচে মাটি ভয়ংকর রকম দুলছে। দাঁড়িয়ে থাকাই কষ্টকর, এগোব কী করে! এরপর শুরু হল আর এক বিপত্তি। জায়গায় জায়গায় মাটি ফেটে যেতে লাগল আর তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল গাঢ় সাদা ধোঁয়া। আমি আর মা কোনোমতে ছুটতে লাগলাম লিফটের দিকে। লিফটের সামনে পৌঁছে দেখি সেখানে প্রচুর ভিড়। সকলেই লিফটে ওঠার জন্য হুড়োহুড়ি করছে। কিন্তু লিফটে এতজনের ঠাঁই হবে কীভাবে? ভূমিকম্পের ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার বদলে লিফট চলছে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। ফলে তার গতি অনেক ধীর। আমাদের জনপদে যাঁরা সর্দার ছিলেন তাঁরা সকলকে বয়সের ক্রম অনুসারে লাইন করে দাঁড়াতে বললেন। সবচেয়ে যারা ছোটো তারা সবার আগে লিফটে উঠার সুযোগ পাবে। তারপর কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা, সবশেষে বয়স্ক মহিলা ও পুরুষ।
“বিপদসংকেত সূচক ঘণ্টা বাজছে তারস্বরে। অনেকে কাতর স্বরে বিলাপ করতে শুরু করেছে। গোলমালের মধ্যেই একদল চিৎকার করে বলল, জনপদের একদিকে মাটি ফেটে গলিত লাভা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। পুরো জনপদ ধীরে ধীরে ধোঁয়ায় ঢেকে যেতে লাগল। প্রচণ্ড আগুনের হলকা টের পেতে শুরু করেছি। আমার মা দাঁড়িয়ে ছিলেন দীর্ঘ লাইনের অনেক পিছনে। যখন প্রায় লিফটের কাছাকাছি চলে এসেছি, চেষ্টা করলাম লাইন থেকে বেরিয়ে মায়ের কাছে চলে যেতে। কিন্তু কয়েকজন ধাক্কা মেরে আমাকে লিফটের ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। ঘাড় ঘুরিয়ে শেষবারের মতো মায়ের দিকে তাকালাম। অসম্ভব কাতর, করুণ, বিষণ্ণ মুখে এক অদ্ভুত আলো। হতাশা, অসহায়তার পাশাপাশি সেই দৃষ্টিতে মিশে আছে এক পরম তৃপ্তি। মা হাত নেড়ে আমাকে বিদায় জানালেন। গাঢ় সাদা ধোঁয়ার আড়ালে হারিয়ে গেল মায়ের মুখটা। মায়ের সেই দৃষ্টি আমি আজও ভুলতে পারিনি। আমাদের লিফট চালু হবার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই টকটকে লাল গলিত লাভা আর ছাই সমস্ত জায়গাটা ঢেকে দিল। লিফট ছিটকে ওপরে ওঠার সময়ই পুরু কাচের জানালা দিয়ে দেখলাম, সেই গলিত পাথর এক লহমায় গ্রাস করে নিল নীচের সমস্ত সজীব প্রাণ। এক সম্মিলিত হাহাকার। আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। মৃত্যুকে সামনাসামনি দেখার সেই অন্তিম হাহাকার আজও আমার কানে ভাসে।”
শুনতে শুনতে দিতির বুকটা বেদনায় মুচড়ে উঠল। গলার কাছে একদলা কান্না।
থ্রি-সেভেনটি-ফাইভ-এক্স বলল, “দিতি, আমাদের সময় শেষ, এবারে তোমাকে আমরা ফিরিয়ে দিয়ে আসব। দেখবে এখন থেকে তোমার অঙ্কের ভয় একদম কেটে গেছে। অঙ্ক হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র ভাষা যার সাহায্যে আমরা ভাববিনিময় করতে পারি।”
জিরো-ওয়ান-টু-এক্স বলল, “আর একটা কথা মনে রেখো, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন আমাদের এইরকম করুণ পরিণতির জন্য দায়ী।”
দিতির নাকে এল একটা মিষ্টি গন্ধ। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে ওর। যখন ঘুম ভাঙল, দেখে নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে রয়েছে। সামনে অঙ্কের বইখাতা খোলা। কিছুক্ষণের মধ্যেই মা অফিস থেকে ফিরবে। তাড়াতাড়ি দিতি বইটা টেনে নিয়ে অনুশীলনীর বাকি অঙ্কগুলো করার চেষ্টা করতে লাগল। আশ্চর্য, আজ কঠিন অঙ্কগুলোর সমাধান কী দারুণভাবে ওর মাথায় আসছে! ওদের ক্লাসের ফার্ট গার্ল সায়ন্তনীও বোধ হয় এত ভালো অঙ্ক করতে পারে না।
হোম টাস্ক শেষ করে দিতি বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই শিউরে উঠল। উলটোদিকে পিয়াদের বাড়ির বিশাল নাগকেশর গাছটা কাটার তোড়জোড় চলছে। দিতির কান্না পেল। নাগকেশর গাছটা ওদের সবার ভীষণ প্রিয়। কী মোটা গুড়ি! ও আর পিয়া দুজনে মিলে জড়িয়ে ধরলেও পুরো বেড় দেওয়া যায় না। কী সুন্দর ফুল, সাদা ফুলে অপূর্ব সুন্দর মিষ্টি গন্ধ। বড়ো বলের মতো ফলগুলি দিয়ে দারুণ লোফালুফি খেলা যায়। লম্বা করাত দিয়ে ইতোমধ্যেই একটা ডাল কাটা হয়ে গেছে। পাড়ার কয়েকজন মজা দেখবার জন্য আশেপাশে জড়ো হয়েছে। কিন্তু কেউ গাছটাকে কাটতে বাধা দিচ্ছে না। জিরো-ওয়ান-টু-এক্সের বিষণ্ণ মুখটা মনে পড়ল দিতির। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ও ছুটে গেল গাছ কাটতে জড়ো হওয়া লোকগুলোর দিকে। চেঁচিয়ে বলল, “গাছটা কাটছ কেন?”
একজন দায়সারাভাবে উত্তর দিল, “অর্ডার আছে।”
দু-হাত দিয়ে গাছটাকে যতটা সম্ভব জড়িয়ে ধরে দিতি বলল, “আমি কিছুতেই গাছটাকে কাটতে দেব না।”
আশেপাশে ভিড় করে থাকা লোকগুলোর মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠল। একজন চেঁচিয়ে বললেন, “এত বড়ো গাছ, কাটতে বনদপ্তরের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন, সেই অনুমোদন কি পাওয়া গেছে?”
গাছ কাটতে উদ্যত লোকগুলো এবার থমকে গেল।
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস
দু-হাজার তিনশো বছর আগে পাটলিপুত্র থেকে তক্ষশিলা পর্যন্ত বাণিজ্যদলের সংঘাতবহুল রোমাঞ্চকর যাত্রাপথ শেষে এক তরুণ পৌঁছল তক্ষশিলায়। সেই নগরীর রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন উত্তাল। একদিকে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার, অন্যদিকে আচার্য কৌটিল্যের অখণ্ড ভারতের স্বপ্নে মশগুল একদল যোদ্ধা। অসংখ্য চরিত্রের ঘনঘটা, ষড়যন্ত্র, কাপুরুষতা আর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে কিছু মানুষের আত্মমর্যাদা আর স্বাধীনতা রক্ষার সাহসী সংগ্রামের আখ্যান এই উপন্যাস।
বিশেষ মুহূর্তে মন্ত্রের মাধ্যমে উচ্চারিত নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের ধ্বনি, তরঙ্গের আকারে যে-কোনো প্রাণীর মস্তিষ্ককে জড়বস্তুতে পরিণত করতে পারে, তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা থেকে মস্তিষ্কের মধ্যে রক্তক্ষরণ বা দুরারোগ্য ব্যাধির মাধ্যমে তাকে হত্যা করা, দীর্ঘ সময়ের জন্য নিজের শরীরের বার্ধক্যজনিত পরিবর্তনগুলিকে আটকে দেওয়া, ভবিষ্যৎ দর্শন, এ সবই সম্ভব। শুরু হয়েছে সেই আদিম তন্ত্রের দেবতা 'কাবাক্রব্যাদ'কে জাগিয়ে তোলার খেলা। কে জিতবে সেই খেলায়? আদিম তন্ত্রগুরু, না আধুনিক বিজ্ঞান? একটি ছোট্ট মেয়ে কীভাবে হয়ে উঠল সেই যজ্ঞের আহুতি?
মানস সরোবরে যাওয়ার জন্য লিপুলা-পাস পেরিয়ে তিব্বতে প্রবেশ করলে প্রায় সবুজ বিহীন বিস্তীর্ণ রুক্ষ প্রান্তর পড়ে, যেটার গড় উচ্চতা প্রায় ১৪ হাজার ফিট। সেখান থেকে মানসের হ্রদ প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার উত্তরে। তার বাঁয়ে আছে 'ভয়াল রাক্ষসতাল'। স্থানীয় যাযাবরদের মতে রাক্ষসতালের নীচে থাকে সিরিঞ্জুরা। কারা এরা? এখনও কোনো প্রাণী বিজ্ঞানী নাকি এদের সনাক্ত করতে পারেননি। যারা নিজের চোখে দেখেছে, বেঁচে ফেরেনি। কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। অনেকে বলেন মানুষের অনেক আগে পৃথিবীর বাইরে থেকে এসেছে এরা। কিন্তু তারা কি এখনও আছে?