ছোটো গল্প
FREE SHIPPING IN INDIA
ছোটো গল্প
চশমাপরা ব্যাঙ মুখ বাঁকিয়ে বলে, “তোমাদের মুখ্যুসুখ্যুদের পাড়ায় আর হবেটাই-বা কী! বৃষ্টি পড়লেই তো শুনতে পাই যে যেমন খুশি তেমন চেঁচায়। না তাল, না সুর, না ছন্দ। আমাদের এখানে আকাশে মেঘ ঘনালেই আমরা মিটিংয়ে বসি। অল্প বৃষ্টি হলে কোন গানগুলো গাইব, জোরে বৃষ্টি হলেই-বা কোন গানগুলো গাওয়া যায়; যদি বিদ্যুৎ চমকায় তাহলে কোন রাগ, যদি মেঘ গুড়গুড় করে কোন তাল। তারপর সবাই ভোট দেয় কার কোন গানটা পছন্দ। যেটায় বেশি ভোট পড়বে সেই গানটাই গাওয়া হবে। এক-একবার তো মিটিং শেষ হওয়ার আগে বৃষ্টিই শেষ হয়ে যায়।”
সুস্মিতা কুণ্ডু
সেদিন মাঠের ধারে, ডোবার পাড়ে চারটে ব্যাঙ ঝিমোচ্ছিল নাকি ঘুমোচ্ছিল। এমন সময় ঢুলতে ঢুলতে একটা ব্যাঙ গড়গড়িয়ে পড়বি তো পড় কাদার মধ্যে— ঝপাস, পচাত। তাই না দেখে আর তিনটে ব্যাঙ ঢুলুঢুলু চোখে ‘দুয়ো দুয়ো দুয়ো’ বলে তিনবার চেঁচিয়ে ফের ঝিমোতে নাকি ঘুমোতে গেল। কাদামাখা ব্যাঙের তো ভারি রাগ হল। আরে বাপু কেমনধারা মানুষ, ইয়ে মানে, ব্যাঙ রে বাপু তোরা! একজন পড়ে গেছে, কোথায় এসে তুলবি ধরবি, মুখে একটু জল দিবি। একটা গঙ্গাফড়িং ধরে পদ্মপাতায় সেজে দিবি, তা না, দুয়ো দিচ্ছিস! তাও আবার তিনবার? ছি ছি, তিন দফা অপমান। কাদামাখা ব্যাঙ রেগে ভাবল, আর এইসব বিচ্ছিরি ব্যাঙেদের সঙ্গে একদিনও থাকব না, চললুম মাঠের ও-ধারের ডোবায়। সেখানের ব্যাঙেরা ঢের ঢের ভালো।
যদিও সেই ব্যাঙেদের কখনও দেখেনি সে, কিন্তু আকাশ কালো করে মেঘ করলে, টিপটিপানি বৃষ্টি পড়লে মাঝে মাঝে ওই ডোবা থেকে কেমন দল বেঁধে গ্যাঙর গ্যাঙ ডাকার আওয়াজ পাওয়া যায়। এক্কেবারে তালে তালে, সুরে সুরে ডাকে। এ-পাড়ার ব্যাঙেদের মতো ‘যেমন খুশি তেমন চেঁচাও’ নয়। নাহ্, বিরক্তি ধরে গেছে বাপু এমন অশিক্ষিত অগাইয়ে অকাজের ব্যাঙেদের সঙ্গে থাকতে। সারাদিন শুধু ঝিমোও আর ঘুমোও।
এই না ভেবে কাদামাখা ব্যাঙ থপথপিয়ে চলল ওই ডোবার ধারে। আস্ত একটা মাঠ পেরোতে হবে। সে কি কম খাটুনি? তার ওপর চার ব্যাঙ তো দিনরাত শুধু ঝিমোয় আর ঘুমোয় কিনা, তাই তাদের বেশি পরিশ্রম করার ধাত নেইকো মোট্টে। চলতে চলতে ব্যাঙ গান ধরল। আসলে গান গাইলে খাটুনিটা একটু কম মনে হয় কিনা, তাই।
ঘুমঘুম, ঝিমঝিম
দিনরাত, রাত-দিন
তাল নেই, নেই সুর
কতদূর, কতদূর।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গানটা গাইতে গাইতে ব্যাঙ পৌঁছল ও-পাড়ায়।
নামেই সেটা ডোবা। আসলে কিন্তু পুরোনো ডোবাটার চেয়ে একেবারেই আলাদা। জল বেশ পরিষ্কার, ওদের মতো কাদাগোলা ঘোলাটে নয়। চারপাশটায় দিব্যি সাফসুতরো, ঝোপে-ঝাড়ে ভরতি নয়। সব বেশ নিয়মে, গোছানো, হিসেবি। এদিক-ওদিক আবার পদ্মফুল ফুটে আছে। বড়ো বড়ো গোটা গোটা পদ্মপাতা ভাসছে জলে। গুটিকয় ব্যাঙ সেখানে চোখে চশমা পরে, কানে পেন্সিল গুঁজে, গেরামভারী মুখে কীসব আলোচনা করছে। ওকে দেখতে পেয়ে এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, কানে কানে ফিসফিস করল। তারপর ফের মুখ ঘুরিয়ে যে-যার কাজ করতে লাগল। কাদামাখা ব্যাঙ বেচারা কী করবে ঠাহর করতে না পেরে ইতিউতি চাইল, এক-পা দু-পা এগোল। গলা খাঁকারি দিল, হাত কচলাল। তবু ব্যাঙগুলো ওর পানে ফিরে চাইল না। এ তো ‘দুয়ো’ দেওয়ার থেকেও বেশি বেশি অপমান!
কাদামাখা ব্যাঙ একবার নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবলে, বুঝেছি। আমার গায়ে এত কাদামাখা কিনা, তাই ওরা ভাবছে বুঝি আমি কোথাকার কে অশিক্ষিত বোকা-হাঁদা ব্যাঙ। রোসো! আমিও দেখাচ্ছি আমি কেমন চালাকচতুর আমি।
এই ভেবে ঝপাস করে সামনের জলে লাফ দিল কাদামাখা ব্যাঙ। চান করলেই একদম সাফসুতরো, ধোপদুরস্ত হয়ে যাবে ওদেরই মতো। তার সঙ্গে ডোবার জলে একটু ডুবসাঁতার, একটু চিত সাঁতার আর শেষে একটু প্রজাপতি সাঁতারের এমন খেল দেখিয়ে দেবে না! একেবারে হাঁ হয়ে যাবে ব্যাঙগুলো।
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। ডোবায় ঝপ্পাস! চাদ্দিক জল থইথই। ব্যাঙের দল রেগে কাঁই। চেঁচিয়ে উঠল, “এইয়ো হাঁদা ব্যাঙ, কাদামাখা ব্যাঙ! বলি মাথায় বুদ্ধিটা কি নেই? মাথায় সুদ্ধিটা কি নেই? আমরা বসে মিটিং করছি আর তুমি গরমাগরম মিটিংটা জল ঢেলে ঠান্ডা করে দিলে?”
ব্যাঙ সাঁতার কাটা থামিয়ে রেগেমেগে বলে উঠল, “আমি হাঁদা? তুমি হাঁদা! তোমরা হাঁদা! আমার মাথায় বুদ্ধিও আছে, সুদ্ধিও আছে। আমায় কাদামাখা ব্যাঙ বললে যে বড়ো! এই তো আমি ডুব গেলে, সাঁতার কেটে এখন কাদা-ধোওয়া ব্যাঙ। আর মিটিংটা কী জিনিস? শিঙাড়া, নাকি জিলিপি যে ঠান্ডা হয়ে গেলে মুখে দেওয়া চলবে নাকো?”
ব্যাঙগুলো মুখ ভেংচে, ঘাড় বাঁকিয়ে বললে, “সাঁতার! ওটাকে সাঁতার বলে? ও তো মরা মাছের মতো ভেসে থাকা।”
কাদা-ধোওয়া ব্যাঙ তো রেগে লাল-নীল-বেগুনি হতে শুরু করেছে। এর থেকে তো পচা ডোবার ব্যাঙেদের খ্যাঁক খ্যাঁক হাসি আর দুয়ো শোনা অনেক ভালো ছিল। ওর মতো এক্সপার্ট সাঁতারুকে কিনা বলে মরা মাছ! ভাবো দেখি অপচ্ছেদ্দাটা! কোনোমতে আর একটা ডুব গেলে, মাথায় জল থাবড়ে একটু মগজ ঠান্ডা করে একটা শেষ চেষ্টা করল।— “তা শুনি তোমরা কী নিয়ে গরমাগরম মিটিং করছিলে?”
চশমাপরা দলের সর্দারমতো ব্যাঙটা উদাসীন গলায় বললে, “সে কি আর তোমায় বললেই বুঝবে? তুমি বাপু বেপাড়ার ব্যাঙ। আমাদের পাড়ার সমস্যার কথা তোমার মাথায় ঢুকবে নাকো।”
কাদা-ধোওয়া ব্যাঙ ফের অপমান অপমান বোধ করলেও ঢোঁক গিলে হজম করে নিল। এ-পাড়ায় থাকতে হলে এদের ব্যাপার-স্যাপারটা আগে বুঝতে হবে। বললে, “আহা, সে বলেই দেখো না বুঝি কি না! আমাদের পাড়ার নানান বড়ো বড়ো সমিস্যে তো আমিই সমাধান করি! এই তো সেদিন আমাদের পাড়ার বড়ো ব্যাঙের রাতে কিছুতেই ঘুম আসে না। দুপুরে সকালে বিকেলে দিব্যি ঘুমোচ্ছে অথচ রাত হলেই আর চোখে ঘুম নেই। অনেক ভেবে ভেবে বার করলুম যে সন্ধে হলেই আমাদের ডোবার পাড়ের ঝিঁঝিঁপোকাগুলো দল বেঁধে গাইতে শুরু করে, আর সেই আওয়াজেই বড়ো ব্যাঙের ঘুম আসে না। তাপ্পর সে-বার আমাদের মেজো ব্যাঙের কী সমিস্যে, কী সমিস্যে! ঘুমের মধ্যে সে নাকি লাফাতে লাফাতে হেথা-হোথা চলে যায়। ডোবার পুব পাড়ে ঘুমোয় তো জাগে দখিন পাড়ে। সারাদিন তাকে আমরা খুঁজেই মরি। শেষমেশ করলুম কী, তার পায়ে দিলুম পদ্মপাতার নালের সুতো বেঁধে। আর কোথাও যেতে পারে না ঘুমোতে ঘুমোতে। একই জায়গায় বসে বসে ঘুমোয় আর লাফায়। তাপ্পর আমাদের সেজো ব্যাঙ…”
কাদা-ধোওয়া ব্যাঙকে থামিয়ে এ-পাড়ার চশমাপরা ব্যাঙ বলে উঠল, “থামো হে, থামো! তোমাদের পাড়ায় সবাই শুধু ঘুমোয় নাকি? মিটিং করে কখন তাহলে?”
কাদা-ধোওয়া ব্যাঙ অবাক হয়ে বললে, “মিটিং কেন করব খামোখা?”
চশমাপরা ব্যাঙ আরও অবাক হয়ে বলে, “মিটিং না করলে সারাদিন কী করবে, কী খাবে, কী কথা বলবে সে-সব ঠিক হবে কেমন করে? মিটিং হবে, তারপর ভোট হবে, তারপর জোট হবে, তবে না দিন শুরু হবে!”
কাদা-ধোওয়া ব্যাঙের তো মুখে একগাল মাছি! মিটিং, ভোট, জোট এসব খায় না মাথায় মাখে? বলে, “আমাদের পাড়ায় বাপু সারাদিন যার যা খুশি সে তাই খায়, যা ইচ্ছে করে তাই বলে, যা প্রাণ চায় তাই করে।”
চশমাপরা ব্যাঙ মুখ বাঁকিয়ে বলে, “তোমাদের মুখ্যুসুখ্যুদের পাড়ায় আর হবেটাই-বা কী! বৃষ্টি পড়লেই তো শুনতে পাই যে যেমন খুশি তেমন চেঁচায়। না তাল, না সুর, না ছন্দ। আমাদের এখানে আকাশে মেঘ ঘনালেই আমরা মিটিংয়ে বসি। অল্প বৃষ্টি হলে কোন গানগুলো গাইব, জোরে বৃষ্টি হলেই-বা কোন গানগুলো গাওয়া যায়; যদি বিদ্যুৎ চমকায় তাহলে কোন রাগ, যদি মেঘ গুড়গুড় করে কোন তাল। তারপর সবাই ভোট দেয় কার কোন গানটা পছন্দ। যেটায় বেশি ভোট পড়বে সেই গানটাই গাওয়া হবে। এক-একবার তো মিটিং শেষ হওয়ার আগে বৃষ্টিই শেষ হয়ে যায়।”
কাদা-ধোওয়া ব্যাঙের গলা শুকিয়ে আসে এত কেরামতির কাণ্ড শুনে। কোনোমতে বলে, “আর যদি চারজন চারটে আলাদা আলাদা গান পছন্দ করে? তাহলে কার গানটা গাওয়া হবে?”
চশমাপরা ব্যাঙ বললে, “তাহলে গান গাওয়া হবে না! পরের বৃষ্টিতে আবার ভোট হবে।”
কাদা-ধোওয়া ব্যাঙের তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়! দাঁতকপাটি লাগার উপক্রম। এতরকম কাণ্ড করতে হয় এ-পাড়ায় থাকতে গেলে! কী খাবে, কী বলবে, কী গাইবে সেই নিয়ে মিটিং-ভোট-জোট! এমনিতে নিজের পাড়ার ব্যাঙেদের রোজ হাজারবার বদনাম করে নিজে, কিন্তু বেপাড়ার এই ওপরচালাক ব্যাঙগুলোর মুখে তাদের বদনাম শুনতে মোটেই ভালো লাগছিল না। মনে হচ্ছিল ওই সুরহীন তালহীন গান গাওয়াই ভালো। অন্তত যখন খুশি তখন গাওয়া তো যায়! মিটিং আর ভোটের অপেক্ষা করতে করতে বৃষ্টিই শেষ! এ আবার কেমনধারা অশৈলী কথা বাপু!
যতটা আগ্রহ নিয়ে এসেছিল, এখন ততটাই ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে কাদা-ধোওয়া ব্যাঙের। কিন্তু এসে যখন গেছে তখন এভাবে চলে যাওয়াটাও তো ভালো দেখায় না। এমনিই অহংকারী ব্যাঙগুলো ওদের পাড়াকে এত্তো এত্তো অপমান করছে, তার ওপর ও যদি লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায় তাহলে তো কথাই নেই। চিরকালের জন্য বদনাম হয়ে যাবে। আর একটু চেষ্টা করে দেখাই যাক।
কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে কাদা-ধোওয়া ব্যাঙ, “আচ্ছা, গানের কথা না-হয় বুঝলুম। তা তোমাদের এ-তল্লাটে খাওয়াদাওয়ার কী বন্দোবস্ত? অতিথি এলে পরে একটু মশা-মাছি...”
এই অবধি শুনতে না শুনতেই চশমাপরা ব্যাঙ ‘ইঁইইইককক’ করে হেঁচকি তুলে পদ্মপাতার ওপর থেকে ডিগবাজি খেয়ে জলে পড়ে যাচ্ছিল। কানে পেন্সিল গোঁজা ব্যাঙটা শিগগির ধরে ফেলল তাই রক্ষে। বাকি দুটো ব্যাঙ রেগেমেগে চোখ পাকিয়ে বলে উঠল, “তুমি কোথাকার জংলি ব্যাঙ হে বাপু? ওসব একটা খাবার হল? কোনও ভদ্রসমাজের ব্যাঙ ওই জিনিস খায়?”
কাদা-ধোওয়া ব্যাঙ তোতলাতে তোতলাতে কোনোমতে বলে, “ত-ত-তবে কী খাও তোমরা?”
পেন্সিল কানে ব্যাঙ রেগেমেগে বলে, “কী আবার খাব? মশা-মাছি মুখে তুললে গানের গলা খারাপ হয়ে যায় জানো না? এই তো কালকের মিটিংয়ে ঠিক হয়েছিল সবুজ সবুজ গঙ্গাফড়িং খাওয়া হবে। স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী। কিন্তু কাল সারাটা দিন এ-তল্লাটে একটাও গঙ্গাফড়িং এল না। চাট্টি ফড়িং শুধু উড়ে বেড়াল। কী করে খাওয়াটা হবে শুনি? উপোস দিয়েই থাকতে হল।”
শেষটায় পেন্সিল কানে ব্যাঙের গলাটা যেন একটু করুণ শোনাল।
কাদাধোওয়া ব্যাঙ তো যত এ-পাড়ার কাহিনি শোনে তত মাথা বনবনিয়ে ঘোরে। একবার পালাতে পারলে বাঁচে এখান থেকে এমন দশা। কী কুক্ষণেই না নিজের পাড়া ছেড়ে বেপাড়ায় এসেছিল। যত বাজেই হোক, যত সমিস্যেই থাকুক, নিজের চেনাজানা পাড়াই ভালো। যা খুশি তাই করা যাবে এমন পাড়াতেই বাস করে শান্তি। এত গেরামভারী, এত মিটিং-মিছিলওলা পাড়া বাপু কাদা-ধোওয়া ব্যাঙের পোষাবে নাকো।
এদিকে চশমাপরা ব্যাঙ ততক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়ে বলে উঠল, “এই যে কাদা… অ্যাহেম অ্যাহেম… নতুন ব্যাঙ! তা তুমি আমাদের সমিস্যে শুনবে বলছিলে না?”
কাদা-ধোওয়া ব্যাঙের তো আর সমিস্যে শোনার সাহস নেই। এদের তো যা-ই দেখে সবই সমস্যায় ভরা মনে হয়। কিন্তু না তো আর বলা যায় না মুখের ওপর, তাই বহুকষ্টে ঘাড় হেলায়।
চশমাপরা ব্যাঙ বলে, “আমাদের মিটিং চলছিল যে মিটিং জিনিসটা করাটা উচিত কি না তাই নিয়ে। আজকাল মাঝে-মধ্যেই কানে আসছে অনেকেরই নাকি ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না।”
এই অবধি বলে আড়চোখে কানে পেন্সিল গোঁজা ব্যাঙের দিকে চাইল।
কাদা-ধোওয়া ব্যাঙ মনে মনে বুঝতে পারল, ওই জন্যই খাবারের কথা জিজ্ঞেস করতেই কানে পেন্সিল গোঁজা ব্যাঙ অমন ক্ষেপে গিয়েছিল। মিটিং আর ভোটের নিয়মের চক্করে যদি অর্ধেক দিন খাওয়াই না জোটে তাহলে কার আর ভোট-জোট করতে ইচ্ছে করবে?
চশমাপরা ব্যাঙ বলে চলে, “মিটিং করতে গিয়ে নাকি গান গাওয়া হচ্ছে না, খাওয়া হচ্ছে না। ভেবেছিলুম পাড়াটাকে একটু সভ্য-ভদ্র করব, কিন্তু সবার তো আর সবকিছু সয় না! তা তোমাদের পাড়ায় মিটিং না করে তোমরা কী করে দিন কাটাও শুনি দেখি একটু। আমার তো ভেবেই অবাক লাগে।”
কাদা-ধোওয়া ব্যাঙ এতক্ষণে একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তখন থেকে এদের পাড়ার কাণ্ডকারখানা দেখে দেখে দম আটকে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। মুখে একটু গেরামভারী ভাব এনে বলতে শুরু করল, “দেখো বাপু, আমাদের পাড়াটা সত্যি বলতে কী, তোমাদের পাড়ার মতো এত গোছানো সাফসুতরো নয়কো। তোমাদের হেথায় যা যা আছে আমাদের সেথায়ও তাই তাই আছে। এই জল, এই গাছপালা, এই পদ্মফুল; কিন্তু যত্নের অভাবে জলটা ঘোলাটে, গাছপালাগুলো ঝোপঝাড়ে ঢাকা, পদ্মপাতাগুলো বসতে গেলে ছিঁড়ে যায়। তবে সুবিধেটা এই যে আমরা যার যখন যেটা ইচ্ছে সেটাই করতে পারি। মেঘ ডাকলেই যেমন খুশি গান গাইতে পারি। তার জন্য কোনও মিটিং করতে হয় না। যে আগে গান ধরল, বাকিরা তার সুরে সুর মিলিয়ে গাইতে শুরু করল। অবিশ্যি সুর যে সবসময় মেলে তাও নয়। তখন যে যেমন খুশি সুরে গায়। হ্যাঁ, ব্যাপারটা শুনতে খুব একটা মধুর লাগে নাকো, কিন্তু একেবারেই গান না গাওয়ার থেকে তো বেসুরো গান গাওয়া ঢের ঢের ভালো। তারপর আমরা যা প্রাণে চায় তাই খেতে পারি। গলা ধরে যাবে কি গলা ভেঙে যাবে, তাতে আমাদের কিচ্ছুটি এসে যায় নাকো। যখন খুশি, যতক্ষণ খুশি ঘুমোতে পারি। তবে এ-কথা মানতেই হবে, কিছু কিছু জিনিস একটু তোমাদের মতো মিটিং-টিটিং করে নেওয়াই ভালো। এই যেমন ধরো ডোবার পাড় কে পরিষ্কার করবে তা নিয়ে কোনও মিটিং হয়নি বলে কারও কোনও দায় নেই। বড়ো ব্যাঙ ভাবে মেজো ব্যাঙ করবে, মেজো ভাবে সেজো আর সেজো ভাবে ছোটো মানে আমি করব। মাঝখান থেকে পরিষ্কারটাই আর করা হয় না।”
চশমাপরা ব্যাঙ খুব মন দিয়ে সব শুনে বললে, “হুম্ম। যা বুঝছি তোমাদের সবটা ভালো নয় আবার আমাদেরও কিছু কিছু ভুল আছে। সবেতেই মিটিং করতে গেলে কাজটাই আটকে যাচ্ছে দেখছি। সবাই বিরক্তও হচ্ছে। উপায়টা কী? কিছু সমাধান বলতে পারবে নাকি হে, নতুন ব্যাঙ?”
কাদা-ধোওয়া ব্যাঙ তো এত গুরুত্ব পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। একটু গুছিয়ে বাগিয়ে বলে, “আমার মনে হয় এই যেমন আমি তোমাদের পাড়ায় এলুম বলে তোমাদের রকমসকম সব জানতে বুঝতে পারলুম, দুই পাড়ার ভালোমন্দ বিচার করতে তুলনা করতে পারলুম, তেমনই তোমাদেরও কেউ যদি আমাদের পাড়ায় একবার যায় তাহলে হয়তো…”
কথা শেষ হওয়ার আগেই চশমাপরা ব্যাঙ হাতে তালি দিয়ে বলে উঠল, “বটে! চলো সবাই তবে একটা মিটিং করে ভোট দিয়ে দেখি যে প্রথমে কে নতুন ব্যাঙেদের পাড়ায় সরেজমিনে তদন্ত করতে যাবে।”
এই শুনে তো কাদা-ধোওয়া ব্যাঙ বিষম খেল। কী মুশকিল! আচ্ছা মিটিং-পাগল ব্যাঙ তো রে বাবা! এদের মাথা থেকে তো ভোটের ভূত নামেই না। আর খানিকক্ষণ থাকলে ওকেই না ভোট দিতে হয়। তাচ্চেয়ে এই বেলা মানে মানে পালানোই বুদ্ধিমানের কাজ। গলা খাঁকারি দিয়ে সে বললে, “তাহলে ভাইসব, তোমরা বরং মিটিং সেরে নাও। কে যাবে ভোট দিয়ে নাও। আমি ফিরে যাই আমার পাড়ায়। খবর দিই বড়ো, মেজো, সেজো ব্যাঙকে। তোমরা আসবে, আপ্যায়নের বন্দোবস্ত করি গে’।”
এই না বলে আর পিছু না ফিরে প্রাণপণে থপাস-থপ থপাস-থপ করে লাফ দিয়ে রওনা দিল নিজের পাড়ার ডোবার দিকে।
মাঠ পেরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ডোবার ধারে পৌঁছে দেখল সেই চেনা তিন ব্যাঙ, চেনা ভঙ্গিতে পদ্মপাতায় আলসে হয়ে শুয়ে গুনগুনিয়ে বেসুরো গান ধরেছে। ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল। একবার ভাবল সবাইকে ওই পাড়ার ব্যাঙেদের খবরটা দেয়, তারপর ওদের মতো মিটিং ডেকে ঠিক করে কে ডোবার পাড় পরিষ্কার করবে আগে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, আগে একটু ঘুমিয়ে-ঝিমিয়ে তো নেওয়া যাক, তারপর না-হয় মিটিং-টিটিং হবে’খন। বড্ড ধকল গেছে। হাত-পা ছড়িয়ে পদ্মপাতায় চিতপটাং হয়ে শুয়ে গান ধরে ছোটো ব্যাঙ—
শোনো ভাই বড়ো ব্যাঙ
শোনো মেজো সেজো,
ও-পাড়ার ব্যাঙগুলো
জ্ঞানীগুণী কেজো।
নয় তারা আলসে
নয় ফাঁকিবাজ,
মিটিং আর ভোট দিয়ে
করে সব কাজ।
আমরাও ঘুম ছেড়ে
বদলাব হাল,
লেগে পড়ি কাজে চলো…
ছোটো ব্যাঙ শেষ লাইনটা বলার আগেই বড়ো, মেজো, সেজো ব্যাঙ তাল মিলিয়ে এক্কেবারে সুরে সুরে ধুয়ো ধরে—
...আজ নয়, কাল!
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস