উপন্যাস
FREE SHIPPING IN INDIA
উপন্যাস
খুব বড়ো একটা ঝামেলায় ফেঁসে গিয়েছি আমরা। আমাদের এক বিজ্ঞানী কী একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে দুই পৃথিবীকে মিশিয়ে ফেলেছেন। ফলে মাঝে-মধ্যেই আমাদের লোকজন অনিচ্ছাসত্ত্বেও আপনাদের সময়কালের পৃথিবীতে আসতে বাধ্য হচ্ছে। এখানের নানান জীবজন্তু, পোকামাকড়ের কামড়ে বহু লোক মারা যাচ্ছে রোজ। বাচ্চারাও। আমাদের ওষুধ কাজ করছে না। যতদিন না বিজ্ঞানীরা দুই পৃথিবীর মধ্যের দরজাটা বন্ধ করতে পারছেন, ততদিন এরকমই চলবে। একমাত্র আপনার ওষুধই আমাদের বাঁচাতে পারে। বাঁচাতে পারে ওই বাচ্চাগুলোকে।
রঞ্জন দাশগুপ্ত
আজ ভোরে আশ্চর্য এক স্বপ্ন দেখল গবাই। লাল মাটির মাঝখানে তলা বাঁধানো মস্ত বড়ো একটা ছাতিম গাছ। বাঁধানো জায়গাটার ওপরে বসে এক সাধুবাবা। তিনি এক রাজার গল্প বলছেন। নীচে অনেক লোকজন বসে সেই গল্প শুনছে। তাদের মধ্যে আছে গবাইও। গল্প বলতে বলতে সাধুবাবা হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে একবার হাসলেন। একটা আংটি তাঁর ডানহাতের তালুতে রেখে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “তুই-ই পারবি রাজকুমারীকে উদ্ধার করতে। এই নে আংটি।”
এর পরেই গবাইয়ের ঘুমটা ভেঙে যায়। আসলে মা উঠিয়ে দিলেন তাকে।
স্বপ্নের আগেও একটা ঘটনা আছে। গবাইয়ের বন্ধু মিন্টুর বাবা লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরোনো খাতা, কাগজ সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। সে সুবাদে মিন্টুর হাতে মাঝে-মধ্যে পুরোনো গল্পের বইও চলে আসে। গবাই আবার গল্পের বই পড়তে খুব ভালোবাসে। কাজেই তার প্রাণের বন্ধু মিন্টু সে-সব বই এনে তাকে দেয়।
এবারও দিয়েছিল একটা বই। মলাট ছেঁড়া, সবগুলো পাতা নেই। কাগজগুলোও মুচমুচে আর হলদে হয়ে গেছে কেমন।
বইটাতে এক রাজার গল্প আছে। রাজা খুব বীর। আর তাঁর একটি মাত্র মেয়ে। সেই রাজকুমারী সদ্য ফোটা পদ্মের মতো সুন্দর। গায়েও পদ্মফুলের গন্ধ। রাজামশাই খুব ভালোবাসেন তাকে।
একদিন সেই রাজ্যে এল এক লোক। কুচকুচে কালো, লম্বা আর দু-গালে দাড়ি। লোকটার অনেক গুণ। দারুণ গান গায়, মন্ত্রতন্ত্র জানে। আবার গাছগাছড়া দিয়ে আশ্চর্যসব ওষুধ বানাতে পারে। সে-ওষুধ খেয়ে লোকের শরীরে দুনো বল আসে। কাজেই খুব তাড়াতাড়ি সে রাজার প্রিয়পাত্র হয়ে গেল।
এই পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল। রাজার সঙ্গে লোকটার দারুণ ঘনিষ্ঠতা। তাকে ছাড়া রাজামশাই চোখে একেবারে অন্ধকার দেখেন। কিন্তু একদিন লোকটা হঠাৎই রাজাকে বলে বসল, সে রাজকুমারীকে বিয়ে করতে চায়। শুনে রাজা তো রেগে আগুন। তাঁর অমন সুন্দরী একটিমাত্র মেয়ে, তাকে তিনি ওই লোকটার মতো এক অজ্ঞাতকুলশীল মানুষের হাতে তুলে দেবেন? কোনও রাজ্যের রাজপুত্র হলেও না-হয় কথা ছিল! অন্য কেউ হলে তাকে নিশ্চয়ই রাজা শূলে দিতেন। কিন্তু এই লোকটার সঙ্গে কিছুদিন তাঁর খুব ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, তাঁকে দু-বার রোগমুক্ত করেছে, এসব কারণে তাকে তিনি তাঁর রাজত্ব থেকে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন। যেন কোনোদিন এখানে আর ফিরে না আসে। এলেই শূলে চড়ানো হবে।
লোকটা চলে তো গেল। কিন্তু ভীষণ রেগে গিয়েছিল সে। যাবার আগে বলে গেল, রাজকুমারীকে সে যেমনভাবে হোক বিয়ে করবেই। দরকার হলে তাকে চুরি করে এমন এক জায়গায় লুকিয়ে রাখবে, যেখানে কেউ পৌঁছতে পারবে না। তার কাছে একটা আংটি ছিল, যার সাহায্যে সে অদৃশ্য পর্দার অন্যদিকে অদ্ভুত এক জগতের সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখত।
রাজার গুপ্তচরেরা সে-খবর তাঁর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। রাজকুমারীর ঘরের চারপাশে অনেক পাহারাও বসানো হয়েছিল। কিন্তু তবু এক সকালে সে ঘুম থেকে ওঠে না। বার বার ডেকেও সাড়া না পাওয়ায় দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকা হল। দেখা গেল, রাজকুমারীর বালিশ, বিছানা সব ঠিক আছে। খালি সে বিছানার ওপরে নেই। অথচ ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
চারদিক খুঁজেও রাজকন্যার সন্ধান পাওয়া গেল না। রানিমা কেঁদে কেঁদে শয্যা নিলেন। রাজার সৈন্যরা কোথাও রাজকুমারীকে খুঁজে পেল না। তখন রেগে গিয়ে রাজা নিজেই তাকে খুঁজতে বেরোলেন। বেরোনোর আগে তিনি যে-লোক রাজকুমারীকে খুঁজে দিতে পারবে তার জন্য পুরস্কার, আর ওই দুষ্টু লোকটার জন্য ভয়ানক শাস্তি ঘোষণা করলেন।
দুর্ভাগ্যবশত বইয়ের বাকি পাতাগুলো না থাকায় কী পুরস্কার, কী শাস্তি তা গবাই জানতে পারেনি। রাজকুমারীর শেষ পর্যন্ত কী হল, তাও নয়।
গবাইরা খুব গরিব। নতুন বই কিনে পড়ার ক্ষমতা নেই। একরাশ দুঃখ নিয়েই শুতে গিয়েছিল ও। তারপর ওই স্বপ্ন।
গবাইকে উঠিয়ে দিয়ে মা চলে গেল পাড়ার কলে জল ভরতে। সকাল থেকে সেখানে পাড়ার যত মহিলা সবাই বোতল, কলশি নিয়ে গিয়ে লাইন দেয়।
গবাই উঠে দেখল বুনু ঘুমোচ্ছে। বাইরের একচিলতে টিনের ঘরে বাবাও ঘুমোচ্ছে তখনও। সে চোখ-মুখ ধুল। উঠোনের এককোণে থাকা পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা ছিঁড়ে চিবোতে চিবোতে ঘুঁটে আর গুল দিয়ে উনুন ধরাতে বসল। এ তার রোজকার কাজ। মায়ের আসতে একটু দেরি হবে। এসে বুনুকে ঘুম থেকে তুলে রান্না বসাবে। অবশ্য রান্না আর কী! ভাত, আর একটা যা-হোক কিছু শাকপাতা। সেও গবাই খেতে পাবে না। সে একটু ছাতু-মুড়ি খেয়ে স্কুলে যাবে। দুপুরে খাবে মিড-ডে মিল।
বেলা একটু গড়ালে স্কুলে গেল গবাই। কিন্তু কপাল মন্দ। প্রথম পিরিয়ডেই নন্দ মাস্টারমশাই (তাদের স্কুলে দুজন মাস্টারমশাই। গবাইদের যিনি পড়ান তাঁকে ওই নামেই ডাকে গ্রামের সবাই।) তার দিকে তাকিয়ে গর্জন করে উঠলেন, “সুকৃতিকুমার! কাল যে অঙ্কগুলো করতে দিয়েছিলাম, সেগুলো করে এনেছিস? কই, খাতা দেখি!”
গবাইয়ের ভালো নাম সুকৃতিকুমার। কিন্তু মাস্টারমশাই ছাড়া অন্য কেউ সে-নামে ডাকেন না। আর মুশকিল হল, অঙ্কগুলো গবাইয়ের করা হয়নি। আসলে তার খাতাই শেষ হয়ে গেছে। বাবাকে বলেছিল, তিনি কিনতে পারেননি। সে ম্লান মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “খাতা শেষ হয়ে গেছে স্যার।”
গোটা ক্লাসে একটা চাপা হাসির শব্দ উঠল। মাস্টারমশাই চোখ গোল করে বললেন, “খাতা শেষ হয়ে গেছে? কান ধরে বেঞ্চের ওপরে দাঁড়া। দুই পিরিয়ড দাঁড়িয়ে থাকবি।”
সে কান ধরে ওপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, রতন আর কুটু পেছন থেকে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আরতি সোমনাথের খাতা খুলে সেখান থেকে প্রাণপণে টুকছে। ঘর থেকে করে আনেনি নিশ্চয়ই। মিন্টু উদাস চোখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। জানালার বাইরে কাঁঠালিচাঁপার গাছটায় খেলা করছে দুটো শালিক। তার পা টনটন করছিল। চোখ থেকে একফোঁটা গরম জল টপ করে এসে পড়ল পায়ের পাতায়। সত্যি-সত্যিই তার খাতার পাতা শেষ। কিন্তু মাস্টারমশাই বিশ্বাস করলেন না।
এরকম কতক্ষণ চলত কে জানে, হঠাৎই নন্দ মাস্টারমশাইয়ের পকেটের মোবাইল বেজে উঠল। তিনি ক্লাসের বাইরে চলে গেলেন।
মিন্টু ফিসফিস করে বলল, “এখন বসে পড়। স্যার এলে আবার উঠে দাঁড়াবি।”
কিন্তু গবাই তা করল না।
মাস্টারমশাই অবশ্য একটু পরেই চলে এলেন। তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন বসে পড়। কাল-পরশু তো ছুটি। কিন্তু পরের দিন যদি খাতা না নিয়ে এসেছিস...” তারপর বাকি ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এক্ষুনি আমাকে একবার ব্লক অফিস যেতে হবে। কেউ গোল করবি না। পাশের ক্লাসে প্রদীপ-স্যার আছেন। তাঁর কাছ থেকে যেন কোনও খারাপ রিপোর্ট না পাই!”
এরকম মাঝে-মধ্যেই হয়। মাস্টারমশাইদের ডেকে পাঠায় বড়ো অফিস থেকে। তাঁর ফিরে আসতে আসতে বেজে গেল তিনটে। তার একটু পরেই ছুটি।
গবাইয়ের মনখারাপ। সে বাকিদের সঙ্গে সামনের গেট দিয়ে বেরোল না। পেছনের রাস্তা দিয়ে বাইরে গিয়ে হাঁটা লাগাল।
এই পথটা দিয়ে অনেকটা ঘুরে যেতে হয়। তাই তাদের কেউ সাধারণত এ-পথে যায় না। গবাই শেষবার এদিকে এসেছিল হয়তো মাস ছয়েক আগে। সেদিন তার সঙ্গে মিন্টুও ছিল। আজ একা।
নির্জন রাস্তা। অনেক দূরে একটা সাদা রঙের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। উত্তরদিকে জঙ্গল, তার সামনে মস্ত বড়ো কাঁকরডাঙার মাঠ। পাশ দিয়ে চলে গেছে মোরামের একটি রাস্তা।
গ্রীষ্মকাল শুরু হয়ে গেছে। বিকেল হলেও রোদ পড়েনি এখনও। কাঁকরডাঙার মাঠটা সারাদিনের রোদে তেতে আছে। হাওয়াও বইছে গরম।
তারা এত গরিব কেন? খুব মনখারাপ লাগছিল গবাইয়ের। যদি বাবা তার খাতাগুলো কিনে দিতে পারত! যদি বুনুর একটা জামা হত, মায়ের একটা নতুন শাড়ি। একেবারে ছিঁড়ে গেছে। বর্ষার সময় ঘরের চাল দিয়ে জল পড়ে। সেটাও সারানো দরকার।
মাথা নীচু করে হাঁটছিল সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে একবার মুখ তুলে দূরের দিকে তাকাল। তারপরেই চমকে উঠল।
লাল কাঁকরমাটির মাঝখানে তলা বাঁধানো একটা মস্ত ছাতিম গাছ। তার তলায় দাঁড়িয়ে গেরুয়া পোশাক পরা একজন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। চোখটা কচলে নিল সে।
এই গাছটা কি আগেও ছিল? কই, মনে পড়ছে না তো। স্বপ্নটা অনেকটা এরকমই ছিল না?
বুকটা দুরদুর করছিল তার। তবু শেষ পর্যন্ত ওদিকে এগিয়ে যাওয়াই ঠিক করল সে। কাছে গিয়ে আর একবার চমকে উঠল। হ্যাঁ, সাধুবাবাই। আর তাঁর মুখটা গবাইয়ের ভীষণ পরিচিত। আজ ভোরেই তো দেখেছে!
সাধুবাবা তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন একবার। গম্ভীর স্বরে বললেন, “তোর কপালে তো দেখছি পথিকের চিহ্ন! এই নে।”
গবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, সাধুবাবার এগিয়ে দেওয়া হাতের তালুতে একটা অদ্ভুত আংটির মতো জিনিস। তিনি চোখ মিটমিটিয়ে বললেন, “এই আংটিই তোকে পৌঁছে দেবে অন্য ভুবনে।”
॥ দুই॥
আজকের রোদটা খুব চড়া। সকাল ন’টা বাজতে না বাজতেই আর আকাশের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বাইরে বেরোলে মনে হয় গায়ে ফোসকাও পড়ে যাবে।
সব দেখেশুনে রঘু ঠিক করেছিল আজ আর বাইরে বেরোবে না। এমনিতেও লোকজন আজকাল খুব চালাক হয়ে গেছে। জ্যোতিষ-টোতিষে তাদের বিশ্বাস নেই। আর যাদের আছে, তারা জ্যোতিষীর নিজেরই হতশ্রী অবস্থা দেখে আর পয়সা খরচ করতে চায় না। কাজেই রঘুর বাইরে বেরিয়ে তেমন লাভ নেই। তার ওপর এমন চড়া রোদ!
মুশকিল হল, তার বউ নিস্তারিণী এসব কথা বুঝতে চায় না। মহিলা কেবলমাত্র চাল, ডাল, কাপড় আর টাকাপয়সার কথাই চিন্তা করে সারাক্ষণ। সুতরাং রঘু জ্যোতিষী যখন বাইরের একচিলতে টিন ফুটো ঘরটায় তক্তপোশের ওপরে আরও একটু গড়িয়ে নিচ্ছিল, সে এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। গলাটা গরম করে বলল, “বলি, ব্যাপারখানা কী! আজ কি আর বাইরে বেরোনো হবে না, নাকি?”
না তাকিয়েও রঘু বুঝতে পারল বউয়ের চোখ বড়ো বড়ো। নাক দিয়ে আগুনের হলকা বেরোচ্ছে। সে মিনমিন করে একবার বলার চেষ্টা করল, “যা রোদ! বাইরে লোকজনের দেখা পাওয়া যাবে না, বেরোনোটাই সার হবে।”
“তা বললে হবে!” গলাটা আরও গরম হয়েছে বলে বোঝা গেল।— “ঘরে চাল বাড়ন্ত। মেয়েটার দু-দিন ধরে জ্বর, ওষুধ চাই। ছেলেটার জন্য নতুন খাতা, কলম কিনতে হবে। সে-সব কি আকাশ থেকে পড়বে?”
মহিলাকে কে বোঝাবে, যে রঘুর বাজার খুব খারাপ। একটা টাকাও রোজগার হবে না তার। কেউ আর তার কাছে ভাগ্যগণনা করাতে চায় না। হাতও দেখাতে চায় না। বাইরে ঘুরে মরা সার হবে। সানস্ট্রোক-ফোকও হতে পারে। কিন্তু ঘরে থাকলে অশান্তি হওয়া অবধারিত। তাই একটু মুড়ি গুড় আর ছাতু দিয়ে গুলে খেয়ে, নিজের ছোটো টিনের বাক্সটা নিয়ে শেষ পর্যন্ত বেরিয়েই পড়ল সে। বেরোনোর মুখে শুনতে পেল, তার বউ বিড়বিড় করে বলছে, “কতবার বলেছি, ওসব লোক ঠকানো কারবার বন্ধ করে রতন ঠিকাদারের কাছে চলে যাও। ওর হাতে দেদার কাজ। গতর খাটালে দুটো ভাতের জোগাড় তো হবে!”
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে, রঘু সেনাপতি একজন জ্যোতিষী। তবে অতি দীনদরিদ্র অবস্থা তার, পসার নেই। সকালবেলা বাক্সটা নিয়ে বেরোয়। লোকজন দেখলে মৃদু স্বরে বলে, “হস্তরেখা-হস্তরেখা, জ্যোতিষ-জ্যোতিষ। আসুন দাদারা, মায়েরা। আসুন বড়োভাই। ভাগ্যবিচার করিয়ে যান।”
তার বউ যতই বলুক, লোক ঠকানো কারবার। রঘুর আবার জ্যোতিষে অন্ধবিশ্বাস। স্বয়ং নিবারণ সমাজপতির কাছে সে হাত দেখা শিখেছে। তিনি ছিলেন যাকে বলে, বাকসিদ্ধ পুরুষ। যা বলতেন তার প্রায় সবই ফলে যেত। মোটামুটি দশ শতাংশ তো মিলতই। তবে তাঁর শিষ্য হয়েও রঘু তেমন জমাতে পারেনি।
এটা ঠিকই যে, সব জ্যোতিষীকেই নির্দিষ্ট কিছু ছক মেনে চলতে হয়। যেমন ধরা যাক, কোনও কমবয়সি ছেলে বা মেয়ে হাত দেখাতে এলে বলতে হয়, এখন অবস্থা খারাপ চলছে। লাইফ যাচ্ছে খুব কঠিন দশার মধ্য দিয়ে। তবে অচিরেই ভালো টাইম আসতে চলেছে। আসলে কমবয়সিরা সামান্য ব্যাপারেই অস্থির হয়ে পড়ে খুব। আবার তারা বয়সের কারণেই আশাবাদী হয়ে থাকে।
বয়স্ক মানুষ দেখলেই বলতে হবে, শরীর আর আর্থিক অবস্থা খারাপ যাবে আরও ক’দিন। সাধারণত এই বয়সে ওসব সমস্যা থাকবেই। তাছাড়াও আড়চোখে দেখে নিতে হয় খদ্দেরের পোশাক-আশাক, গাল চকচক করছে, না বসা। চোখের তলায় কালি আছে, নাকি জ্বলজ্বল করছে চোখগুলি। মানুষের সমস্যা থাকা বা না থাকার প্রভাব তার বাহ্যিক অবস্থায় পড়ে।
তবে ভাগ্য বলেও জিনিস আছে। অন্তত রঘু তাই বিশ্বাস করে। হাতের রেখা, নবগ্রহের চলন অদ্ভুত উপায়ে মানুষের জীবনকে বিড়ম্বিত করে নিশ্চয়ই। সে-সব সমস্যা দূর করার উপায়ও থাকার কথা। আসলে রঘু জ্যোতিষটা তেমন শিখতে পারেনি বলেই যত ঝামেলা।
ভুবনডাঙার শেষপ্রান্তে, রেল-লাইনের ধারে নিজের বস্তি থেকে অনেকটা হেঁটে বাজারের দিকে চলল রঘু। ওদিকে ভদ্রলোকের বাস। বাজারে লোকজন জমা হয়। দু-পয়সা রোজগার হওয়ার সম্ভাবনা। তা সে যত কমই হোক, তবুও আছে। বস্তুত গরিব মানুষেরা কখনও হাত-টাত দেখায় না। তাদের জীবনে সমস্যা কম। সমস্যা বেশি আছে পয়সাওলা লোকেদেরই।
সারি সারি টিনের চালার ঘর। একপাশে কাঁচা ড্রেন আর অন্য পাশে স্তূপীকৃত আবর্জনা। মাঝখান দিয়ে যেটা চলে গেছে, সেটাকেই ওরা রাস্তা বলে ধরে নেয়। ওই পথ ধরেই চলল রঘু। রোদে গা পুড়ে যাচ্ছে তার।
একটু এগোনোর পর বাঁকা নালার পাশের পথটা ধরল সে। এখানে ডানদিকটায় প্রচুর ঝোপঝাড়, গাছপালা। আর বাঁদিকে নালাটা বয়ে চলেছে। লোকজন এসে ডানদিকের ঝোপে মরা ইঁদুর, কুকুর আর অন্যান্য আবর্জনা ফেলে যায় নিয়মিত। তাই প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। সেই কারণেই লোকজন এই রাস্তাটা এড়িয়ে চলে। কিন্তু গরম থেকে বাঁচতে রঘু অনেক সময় এদিক দিয়েই যায়। গাছপালায় ঢাকা বলে রাস্তাটায় ছায়া আছে।
অন্য লোকজন নেই। গন্ধের জ্বালায় পাখিও আসে না এদিকে। মুখে কাপড় চাপা দিয়ে নির্জন, ঝোপঝাড়ে ঢাকা পথ দিয়ে হেঁটে চলতে চলতে হঠাৎই থমকে দাঁড়াল রঘু। সামনে, পথের ধারে এই অল্প আলোতেও কী যেন ঝিলমিল করছে দেখা গেল। ওখানের ঝোপটাও নড়ছে। সাপ নয় তো? হাতে লাঠিসোঁটা কিছু নেই, হঠাৎ করে সেটা ফণা তুলে দাঁড়ালে বিপদ হতে পারে। কিন্তু তার সামনে পথ বলতে তো ওইটাই। না-হলে আবার অনেকটা ঘুরতে হবে। সাবধানে, পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল রঘু। আর কাছাকাছি যেতেই সে যাকে বলে, হতভম্ব হয়ে গেল।
ঝোপের ওপরে চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে ছটফট করছে এক বুড়ো মানুষ। অবশ্য তাকে মানুষ বলাটা ঠিক হবে কি না তা রঘু বুঝতে পারল না। কারণ লোকটার মুখটা খোলা, সেখানে চুল কান চোখ সবই আছে, কিন্তু লোকটার কপালের কাছটা যেন রঙবেরঙের কাচ দিয়ে তৈরি। মাঝে-মধ্যে সেটা সত্যিকারের মানুষের মতো হয়ে উঠছে, ফিরে আসছে চামড়া। কিন্তু তারপরেই আবার ভেঙেচুরে স্বচ্ছ হয়ে উঠছে, লাল-নীল-সবুজ রঙ ধরছে। আবার ফিরে আসছে স্বাভাবিক অবস্থায়।
সে যখন থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তখনই ক্ষীণ স্বরে, একটু যেন অবাঙালি টানে লোকটা বলে উঠল, “বাঁচাও। সাপে কামড়েছে।”
সাপে কামড়ালে কী করতে হয় রঘু জানে না। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়, সেটা জানা আছে, কিন্তু লোকটা বেশ লম্বা। অন্যদিকে রঘুর পেট পিঠ সব এক। ওকে বয়ে নিয়ে যাবে কেমন করে? আশেপাশে অন্য কেউ নেইও।
শেষ পর্যন্ত কী করবে ভেবে না পেয়ে রঘু তার টিনের বাক্সটা খুলে জলের বোতল বের করল। সেখান থেকে এক-দু’ঢোঁক ঢেলে দিল লোকটার মুখে।
আর কী আশ্চর্য! জলটুকু পেটে যেতেই আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে উঠল লোকটা। ছটফটানি কমে এল। কপালের নানা রঙের ঝিলমিলানি ব্যাপারটাও বন্ধ হয়ে গেল শেষমেশ। এমনকি উঠেও বসল লোকটা। বসে হাঁপাতে লাগল।
কী করে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারল না রঘু। ততক্ষণে বাজারে যাওয়ার কথাটা তার মাথা থেকে উড়েই গেছে। এমনকি মেয়ের জ্বরের কথাও মনে নেই। খালি ভেবে চলেছে, যা দেখল তা কি সত্যি, নাকি স্বপ্ন?
সে-সময়ই লোকটা তার হাঁপানি থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করল একবার। স্পষ্ট গলায় বলল, “অনেক ধন্যবাদ। যা কষ্ট হচ্ছিল, একবার ভাবলাম বোধ হয় আর বাঁচব না। ভাগ্যিস আপনি ছিলেন।”
রঘু কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। তক্ষুনি লোকটা তাকে আর একবার আপাদমস্তক দেখে বলে উঠল, “আপনি লোকের ভাগ্যগণনা করেন দেখছি। তবে আপনার পদ্ধতিটি সঠিক নয়। ঠিক আছে, আপনি আমার প্রাণ বাঁচালেন যখন, আমারও আপনার জন্য কিছু করা উচিত।”
এর পরেই লোকটা তার চাদরের মধ্যে হাতড়ে একটা কিছু বের করল। সেটা বাড়িয়ে দিল রঘুর দিকে। হাত বাড়িয়ে জিনিসটা নিল রঘুও। তারপর মুঠি খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, তার তালুতে ছোট্ট একটা আংটির মতো জিনিস। সম্ভবত রুপোর তৈরি।
লোকটা গভীর চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাঁহাতের বুড়ো আঙুলে পরে নেবেন। তাহলেই স্পষ্ট দেখতে পাবেন ভবিষ্যৎ। বা আপনার চারপাশে যা যা রহস্য আছে, সে-সবও। তবে সবটুকু নয়। আর সাবধান!”
চারদিকে একবার তাকিয়ে নিল লোকটা। তারপর ফিসফিস করে বলল, “মাত্র বারো বার ব্যবহার করতে পারবেন যন্ত্রটা। তার বেশি নয়।”
॥ তিন॥
সেদিন বিকেলে দারুণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল গবাই। অন্ধকারও হয়ে আসছিল। তারপর দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি ফেরা। মায়ের কাজে সাহায্য করা। রাতে টিমটিমে আলোর নীচে পড়তে বসা। আংটিটার কথা ভুলেই গিয়েছিল সে।
পরদিন ছুটি। দুপুরবেলায় ঘুমোচ্ছিল ওরা তিনজন। বাবা নিজের কাজে বেরিয়েছে বাইরে। হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল গবাইয়ের। তারপরেই মনে পড়ে গেল সব।
মা বুনুকে নিয়ে মেঝের ওপর হা-ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। ওপরে লোহার রডের সঙ্গে লাগানো পুরোনো ফ্যানটা খুব আস্তে আস্তে ঘুরছে। হাওয়া একেবারে কম, কিন্তু আওয়াজ অনেক বেশি। গবাইয়ের তো গোটা শরীর ঘামে ভিজে গেছে।
আংটিটার কথা মনে পড়া মাত্র বুকটা ধক করে উঠল। এখান ওখান কোথাও খুঁজে পেল না সে। এইটুকু একটা জিনিস। কোথায় যে রেখেছে! স্কুলের প্যান্টটার পকেটেই রয়ে যায়নি তো? কিন্তু সে-প্যান্ট তো মা কেচে দিয়েছে। দৌড়ে গিয়ে প্যান্টটা খুঁজল সে। পকেটে হাত ভরেই হাঁপ ছাড়ল। সেখানেই রয়েছে! মা খেয়াল করেনি।
এখন তো দিনের বেলা। মাও কাছে রয়েছে। একবার পরীক্ষা করে দেখলে হয় না? সাধুবাবা তাকে ছোটো পেয়ে ঠকিয়ে দেননি তো?
উঠোনের দিকে নেমে এল গবাই। আস্তে করে ভেজিয়ে দিল দরজাটা। তারপর আংটিটা পরার চেষ্টা করল। অনেক বড়ো। অন্য আঙুলে হয় না। বুড়ো আঙুলে পরে দেখল সে। একটু ঢলঢল করছে, তবে পরা যায়।
আলো কমে গেল একটু। সামান্য কেঁপে উঠল পায়ের তলার মাটি। তারপরেই তার চারপাশ থেকে মুছে যেতে লাগল উঠোন, পেয়ারাতলা, রোদে তেতে থাকা আকাশ।
কোনও লোকজন নেই। জঙ্গলের মাঝে সাফসুতরো একটা জমি। ওপরে বিকেলের আকাশ, নীচে ছোট্ট একটি কুঁড়ে। তার গায়ের কাঠের দরজাটি বাইরে থেকে হুড়কো টেনে বন্ধ। কুঁড়ের সামনে কাঠকুটো দিয়ে জ্বালানো আগুন। তার ওপর মাটির ছোটো হাঁড়িতে কী যেন একটা ফুটছে। সুগন্ধে ম-ম করছে চারদিক। সম্মোহিতের মতো ওদিকেই এগিয়ে গেল গবাই। উবু হয়ে বসে দেখল, কী যেন একটা স্বচ্ছ তরল ফুটছে সেটাতে। এমন তার গন্ধ, মনে হয় একটু মুখে দিয়ে দেখে। বিপদ হতে পারে বুঝেও গবাই পাশে শোওয়ানো কাঠের হাতা দিয়ে সামান্য তরল তুলে ফুঁ দিয়ে খেল একটু। নাহ্! যেমন মনমাতানো সুগন্ধ, খেতে তেমন সুস্বাদু নয়। মিষ্টি মিষ্টি একটা ভাব। তিতকুটে ভাবও আছে একটু।
সে উঠে পড়ল। পা টিপে টিপে ঘরটার চারদিকে ঘুরল একবার। তারপর দেখল ঘরের পেছন দিকের দেওয়ালে ছোট্ট একটা জানালা। ভেজানো আছে সম্ভবত। পাল্লাটা ঠেলে একটু সরিয়ে উঁকি মারল সে। চোখ সয়ে গেলে দেখতে পেল, ভেতরে জ্বলছে একটা মোটা মোমবাতি। আর তার পাশেই মাথা নীচু করে বসে আছে...
মুখ দেখা যায় না। তবে অল্প আলোতেও বোঝা যায়, সে একটা মেয়ে। তার একঢাল কালো চুল নেমে এসেছে হাঁটুর ওপর, ঢেকে দিয়েছে মুখের সামনের অংশ। পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি। তার ওপরে সোনার সুতোর কাজ। এত কম আলোতেও ঝলমল করছে।
গবাই একটা শুকনো পাতার ওপরে পা ফেলাতে মচ করে শব্দ হল একবার। মেয়েটা তখনই মুখ তুলল। কী সুন্দর মুখটি! গোলাপি গাল, বাঁশির মতো নাক, ছোট্ট কপাল। আর বড়ো বড়ো দুটি চোখ। বাঁশির মতোই মিষ্টি সুরে মেয়েটি বলল, “কে?”
ভয় খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আংটিটা খুলে ফেলল গবাই। ফিরে এল নিজেদের উঠোনে। সেই পেয়ারা গাছ। ওপরে চোখে জ্বালা ধরানো আকাশ। চুপচাপ গিয়ে সে আবার মায়ের পাশে শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম এল না। তখনও তার বুকটা ঢিবঢিব করছে।
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু হল না। বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল।
সেদিন বিকেলে তাদের বস্তির ছেলেরা তাকে খেলতে ডাকতে এল। বস্তির শেষে আগাছা-ঘেরা ছোট্ট একটি মাঠ। তারা বন্ধুরা মিলে বাঁশ কেটে দু-দিকে গোল-পোস্ট বানিয়ে নিয়েছে। পুরোনো একটি সুতো-খোলা ফুটবল আছে তাদের। সেটি দিয়েই খেলে তারা।
এমনিতে ফুটবলটা তেমন ভালো খেলে না গবাই। একটু ছুটলেই হাঁপ ধরে যায় তার। জোরে শটও মারতে পারে না। কিন্তু আজ যে কী হল! বলটা যেন তার পায়ের সঙ্গে লেগে থাকল সারাটা সময়। তিনজনকে কাটিয়ে সে এমন একটা শট মারল, গোল-কিপার প্রশান্তর পাশ কাটিয়ে গোল-পোস্টের ভেতর দিয়ে ঢুকে ধড়াম করে পেছনের গাছের গায়ে ধাক্কা খেল বলটা। প্রশান্ত অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাপস্!”
॥ চার॥
আজ দুপুরে রঘু ভাতের জোগাড় কিছুটা করতে পেরেছে বটে, তবে মেয়েটার ওষুধ বা ছেলেটার বই-খাতার বন্দোবস্ত কিছু হয়নি। দু-তিনজন লোকের হাত দেখে তিরিশটা টাকা পেয়েছে। তা দিয়ে কিছু চাল আর আলু কিনেছিল। এই পর্যন্ত।
সন্ধে নামার পর সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ঘরে থাকলেই নানান অশান্তি। নানান দুশ্চিন্তা। এলোমেলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছল বস্তি থেকে একটু দূরে ন্যাড়া ক্ষেতটার কাছে। এই জায়গাটায় আগে চাষ হত। বহুদিন বন্ধ। কাছাকাছি ডোবা আছে একটা। সেখানে বর্ষাকাল জুড়ে ব্যাঙের ডাক শোনা যায়। সে-কারণেই সাপের আড্ডা জায়গাটা। সন্ধে নামলে লোকে এদিকটায় পারতপক্ষে ঘেঁষে না। জমি পার করে একটা বহুদিন বন্ধ কারখানার গেট। তার ও-পাশে, অনেকটা দূরে পিচ রাস্তা। সেখান থেকে মৃদু আলো ভেসে আসে।
দুরুদুরু বুকে এবড়ো-খেবড়ো জমিটার ওপরে একটা ঢিবির ওপর গিয়ে বসল রঘু। সকালবেলায় দেখা লোকটার কথা সারা দুপুরজুড়ে তার মনের মধ্যে খলবল করেছে। কে লোকটা? আদৌ কি মানুষ সে?
সবথেকে বড়ো কথা, লোকটা তাকে যে আংটির মতো জিনিসটা দিয়েছে, সেটা কি সত্যি কাজ করে? লোকটা বলেছিল, এটা দিয়ে নাকি স্পষ্ট দেখা যাবে ভবিষ্যৎ। আরও অনেক কিছু। সেটা কি সত্যিই? সে-সব যাচিয়ে নেবার জন্যই এই ফাঁকা জায়গাটায় এসেছে রঘু।
ঢিবির ওপরে বসল সে। কাঁপা হাতে ছেঁড়া প্যান্টের ডানদিকের পকেট থেকে বের করল জিনিসটা। চারদিকে তাকাল। ওপরে ফ্যাকাসে আকাশের বুকে একফালি নখের মতো চাঁদ আর অগুনতি তারা। ঝাপসা হয়ে আছে দূরের গাছপালা। শহরের দিক থেকে হালকা আলো এসে পড়েছে গাছপালার মাথায়। হাওয়া বয়ে গেল একবার। তার মধ্যে কেমন যেন পচা গন্ধ একটা। অনেক সময়ই ইঁদুর, কুকুর বা বেড়াল মরে পড়ে থাকে দূরের ঝোপগুলোর কাছে। সে-সবের গন্ধ হতে পারে।
বুকটা দুরুদুরু করছিল তার। এতদিনের স্বপ্ন কি সত্যি হবে? ভবিষ্যৎ দেখতে পাবে সে? নাকি এটাও লোক ঠকানো?
হাতটা কাঁপছিল খুব। কোনোরকমে আংটির মতো জিনিসটা বাঁহাতের বুড়ো আঙুলে গলিয়ে নিল সে। মনে মনে স্মরণ করল ঈশ্বরকে।
হঠাৎই চারদিক যেন ঝাপসা হয়ে এল। সব মুছে গেল তার চোখ থেকে।
তার পরেই আগের থেকেও যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল চারপাশ। আর রঘু ওপরের দিকে তাকিয়ে একেবারে অবাক হয়ে গেল। শিউরে উঠল সে। আকাশটা বরাবরের মতো সেই চাঁদ আর তারা নিয়ে গড়া স্বাভাবিক আকাশ আর নেই। বরং দেখা যাচ্ছে, মাঝে-মধ্যেই সড়াৎ সড়াৎ করে লম্বাটে কয়েকটা আলোর রেখা নেমে আসছে সেখান থেকে। অনেকটা উল্কাপাতের মতো। তফাত হল, একটু খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছে, আসলে ওই আলোর রেখাগুলো হাউইয়ের মতো দেখতে কিছু যন্ত্র। তার প্রতিটিতে জানালার মতো ফোকর আছে। আর সেই ফোকরের ভিতরে কিছু লোকও বসে আছে। যদিও তাদের চেহারা ঠিক মানুষের মতো নয়। অনেক ওপর থেকে ওই হাউই গাড়িতে চেপে ক্রমাগত নীচে নেমে আসছে তারা। এতদূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় না। তবু যেন মনে হয়, লোকগুলোর নাকের জায়গায় শুঁড়ের মতো। অনেকের চোখ প্রায় পুরো কপালজুড়ে। কারো-বা দুটো হাতের জায়গায় একটাই ন্যাতপেতে বস্তু। সেটা দিয়েই ওই হাউই গাড়ির স্টিয়ারিং সামলাচ্ছে তারা।
একটা তো প্রায় তার কাছ ঘেঁষে একটু দূরে একটা শ্যাওড়া গাছের আড়ালে ঢুকে গেল। ভেতরে বসে থাকা লোকটার চোখ-নাক কিছুই নেই বললেই চলে। তবে কপালে যেন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আর আগুনের ভেতরে নড়ছে-চড়ছে সাদাটে একটা বলের মতো জিনিস। ভয়ে প্রায় লাফিয়ে উঠল রঘু। আর তখনই তার চোখ গেল দূরের রাস্তাটার দিকে। সেখানে এখন দিনের মতো ঝকঝকে আলো।
যন্ত্রটার কল্যাণেই হয়তো সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল সে। রাস্তার ওপরে থেমে আছে বেশ কয়েকটা বাস। অনেকগুলো লোক—মহিলা-পুরুষ বাস থেকে নেমে এদিক-ওদিক চলাফেরা করছে। তাদের মুখে হতাশা। কী যেন খুঁজছে তারা।
অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আংটিটা আঙুল থেকে খুলে ফেলল সে। সবকিছু আবার আগের মতোই স্বাভাবিক। আকাশ পরিষ্কার। অন্ধকার ঝোপ থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁর ডাক।
তক্ষুনি খুব মোলায়েম স্বরে কে যেন তার কানের কাছে বলে উঠল, “একবার হল।”
চমকে উঠল রঘু। কিন্তু চারপাশে তাকিয়েও অন্য কাউকে দেখতে পেল না সে।
॥ পাঁচ॥
ভুবনডাঙার বাইরে দিয়ে যে বড়ো রাস্তাটা চলে গেছে উত্তরবঙ্গের দিকে, তার পাশেই দোকান আছে কয়েকটা। যেমন অতীশ দফাদারের চা-বিস্কুটের চালাটি। সকালবেলাতেই অতীশ দোকান খুলে উনুনে চায়ের কেটলি চাপিয়েছে। দু-একজন নিয়মিত খদ্দের সবেমাত্র এসে পৌঁছেছে, সে গম্ভীর মুখে লক্ষ করল, গুটিগুটি পায়ে রঘু এসে ঢুকছে।
এককালে রঘু আর অতীশ ছিল ক্লাস-ফ্রেন্ড। অবশ্য সেভেন পর্যন্তই পড়েছে দুজন। তারপরেও একসঙ্গে কিছু খেলাধুলো করেছে তারা। কিন্তু যা হয় আর কী, সংসারের জোয়াল কাঁধে চাপলে বন্ধুত্ব-টন্ধুত্ব সব গুলিয়ে যায়।
আজকেও রঘুকে দেখে অতীশের মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেল। এর আগে অনেকবার রঘু ধার-বাকিতে চা খেয়ে গেছে। হিসেব করে দেখলে এখনও সে রঘুর কাছে তেরোটা টাকা পায়। কিন্তু সে আর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। রঘু একেবারে হাড়-হাভাতে। জোচ্চোরও বটে।
বেজার মুখেই সে চা করল। মর্নিং-ওয়াক করতে আসা বুড়োদের জন্য ভাঁড়-ভরতি করে সেই চা এগিয়েও দিল। রঘুর দিকে ফিরেও তাকাল না। তাতে অবশ্য রঘুর কিছু যায় আসে বলে মনে হচ্ছে না। সে বেঞ্চের এককোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। প্রত্যাশার দৃষ্টিতে তাকিয়েও আছে তার দিকে।
চোয়াল শক্ত হল অতীশের। রঘুর নোংরা জামাকাপড়ের জন্য ওই বেঞ্চ বদল করে অন্যদিকে চলে গিয়েছেন মজুমদার সাহেব আর মিত্তির বুড়ো। দাঁতগুলো নিশপিশ করছিল অতীশের। কিন্তু খদ্দেরদের সামনে তেমন কড়া কথা বলতেও পারছে না।
“এই যে, এদিকে একটা চা দে অতীশ।” সে তার দিকে মোটে তাকাচ্ছেই না দেখে বলে উঠল রঘু। একবার নয়, আরও দু-বার কথাটার পুনরাবৃত্তি করল সে।
প্রচণ্ড সংযমে নিজের রাগকে দমন করে অতীশ ডানদিকের ভুরুটা একটু তুলল। কড়া গলায় বলল, “তোর কাছে আগেকার তেরোটা টাকা পাই।”
“দেবো, দেবো।” হাত নেড়ে আশ্বস্ত করল রঘু।— “সব চুকিয়ে দিয়ে যাব আজ। বরং তোর উপকারও করে যাব কিছু। যতই হোক, তুই বন্ধু লোক!”
একটা ভাঁড়ে প্রায় আদ্ধেক চা ঢালল অতীশ। এটার পয়সাও পাওয়া যাবে না সে জানে। তারপর অদ্ভুত শক্তিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফিকে একটা হাসি হেসে বলল, “উপকার-টুপকার অনেক বড়ো জিনিস। অতটা না করলেও চলে। আপাতত তেরো আর পাঁচ, মোট আঠেরোটা টাকা দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়।”
নিজের হলুদ জিভটা দিয়ে এক চুমুকেই প্রায় আদ্ধেক চা সাবাড় করে ফেলল রঘু। তারপর দুঃখিত মুখে ভাঁড়টার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই যা! কতটা চা দিয়েছিলি? ভাঁড়টা তো ভরেইনি দেখছি। তারও বেশিরভাগ শেষ করে ফেললাম। তোর মনটা খুব ছোটো হয়ে যাচ্ছে দিনদিন, অতীশ। আজকেই যে কয়েক হাজার টাকার মালিক হতে যাচ্ছে, তার কি এত ছোটো কলজে হলে চলে, বল?”
কথাটা শুনে অতীশের গলায় একটা সটকি লাগল তো বটেই, উপস্থিত যে ক’জন, তাঁরাও হাঁ করে রঘুর দিকে তাকালেন।
“হাজার হাজার? আজকাল কি সকাল থেকেই গাঁজা খাওয়া ধরেছিস নাকি রে? তুই জোচ্চোর জানি, কিন্তু এতটা এগিয়ে গিয়েছিস তা তো কই শুনিনি!”
মাছি তাড়াবার মতো করে অতীশের কথাটা উড়িয়ে দিল রঘু। ভাঁড়টা পাশের টিনে ছুড়ে ফেলে, পকেট থেকে বের করা একটা নোংরা রুমালে মুখ মুছে মুখটা আরও নোংরা করল। তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, “তুই যেটাকে জোচ্চুরি বলছিস, তা আসলে জ্যোতিষ। আমাদের প্রাচীন বিদ্যা। সে-সব তুই বুঝবি না। বরং বল, আমি যদি তোকে এক্ষুনি দশ হাজার টাকা রোজগারের উপায় বাতলে দিই, তবে আমাকে কত দিবি?”
“একটা পয়সাও না।” তেরিয়া মেজাজে বলল অতীশ।— “উপায়টা যদি নিজে জানিসই, তবে সেটা কাজে লাগিয়ে নিজেই টাকা রোজগারটা করে ফেল। কমিশনও দিতে হবে না কাউকে।”
“তা বললে কী হয়?” ধীরেসুস্থে পকেট থেকে একটা ময়লা কুড়ি টাকার নোট বের করল রঘু। সেটা অতীশের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে মুচকি হেসে বলল, “যার যা কাজ। আমি হাত গুনতে জানি, আর তুই রান্না করতে। কথাতেই আছে, ‘যার কম্ম তারে সাজে, অন্য হাতে লাঠি বাজে’। এমন সুযোগটা ফসকাস না অতীশ। বন্ধুলোক বলেই বলছি। পরে হাত কামড়াবি।”
অতীশ কোনও উত্তর দিল না। রঘু তাকে কুড়ি টাকা দিয়েছে, এই ব্যাপারটাই তার হজম হচ্ছিল না। সে ভুরু কুঁচকে নোটটা উলটেপালটে দেখছিল জিনিসটা জালি কি না, অথবা ছেঁড়া আছে কি না। এমনিতে তো হাত খোলার বান্দা নয় রঘু! তবে তার খদ্দেরদের অনেকেই রীতিমতো কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। তাদেরই একজন, রিটায়ার্ড অফিসার সমরেশ ব্যানার্জী অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন, “কিন্তু সুযোগটা কী সেটা তো অন্তত বলো! আমরাও শুনি।”
জবাবে রঘু যাত্রাতে কংস সাজা বিখ্যাত অভিনেতা প্রবীরকুমারের মতো একটা অট্টহাসি দিয়ে বলল, “বলতেই তো চাই। কিন্তু আমার বন্ধুকে। আমি চাই সুযোগটা ও-ই পাক।”
“না, না।” বিরক্ত মুখে ঘাড় নাড়িয়ে রঘুকে দু-টাকা ফেরত দিত দিতে বলল অতীশ, “তুই অন্য কাউকে তোর সুযোগটা দে বরং। এখানে সুবিধা হবে না। আমি রাজি নই। তুই যে জোচ্চোর সেটা খুব ভালো করেই জানা আছে।”
চুকচুক করে মুখ দিয়ে একটা আপশোশের আওয়াজ বের করল রঘু। বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এমন দাঁওটা হেলায় হারালি। পরে তোর আপশোশের সীমা থাকবে না, দেখিস।”
সে চলে যায় দেখে সমরেশবাবু দু-পা এগিয়ে এসে বললেন, “শুনলে তো, অতীশ তেমন ইচ্ছুক নয়। তা আমাদের জানালে আমরা তো ইচ্ছুক হতে পারি। তোমাকে কমিশনও দেওয়া যেতে পারে কিছু, নাকি?” কথাটা শেষ করলেন আশেপাশের লোকজনদের দিয়ে তাকিয়ে। তাদেরও প্রাণটা আইঢাই করছিল ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত জানার জন্য। হইহই করে সমর্থন জানাল সবাই।
আসলে খোলসা করে বলতে চায় রঘুও। না-হলে তার পেট ফাঁপছে। কিন্তু পকেটে পয়সাকড়ি তেমন নেই। অতীশকে কাজে লাগাবে বলেই কুড়িটা টাকা চেয়েচিন্তে নিয়ে এসেছিল বউয়ের কাছ থেকে। কিছুক্ষণ পরে ফেরত দেবে বলেছে। যদিও তার বউ বলেছে, টাকাটা ফেরত না পেলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ কেমনভাবে হয়েছিল তার পরিষ্কার উদাহরণ দেওয়া হবে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে বিনি পয়সায় তো আর কাউকে সুযোগ-টুযোগ দেওয়া যায় না। তাই মুখটা ছুঁচলো করে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “আগে কমিশনের ব্যাপারটা ক্লিয়ার করা যাক।”
সমরেশবাবু একবার চারপাশের নিশ্চুপ লোকজনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চাটলেন। কমিশনের ব্যাপারে হ্যাঁ বলায় ক্ষতি কী! পরে রাজি না হলেই চলবে। আপাতত ব্যাপারটা জানা দরকার। রিটায়ার্ড মানুষ, সময় কাটে না। কী বলতে চাইছে রঘু, সেটা না জানলেই নয়। তিনি সরাসরি রঘুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কত চাও?”
“এক হাজার।”
“আমার কত থাকবে?”
“দিয়ে-থুয়ে অন্তত পাঁচ হাজার।”
“আমি রাজি। কিন্তু তোমার কথা যদি না ফলে?”
“জান বাজি রাখলাম।”
“বেশ! বলে ফেলো।”
এইখানে আর একবার প্রবীরকুমারের মতোই হা-হা করে অট্টহাসি দিল রঘু। তারপর মুখটা গম্ভীর করে বলল, “আশপাশের সবাই সাক্ষী, ডিল হয়ে গেল।”
পকেটের ভেতরে হাত পুরল রঘু। সেই আংটিটা মুঠো করে ধরে অবিকল যাত্রাদলের বিবেকের কণ্ঠস্বরে নীচু, কিন্তু পরিষ্কার শব্দে বলল, “আমি ভবিষ্যৎবাণী করছি, আরও ঘণ্টা তিন কি চারের মধ্যে এখানে থামবে প্রচুর বাস, ট্রাক, লরি আর অন্যান্য গাড়ি। তারা অনেকক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। খাবার চাইবে। ঠান্ডা জল আর বিশ্রামের জায়গাও। যদি কোনোভাবে সে-সব ব্যবস্থা করা যায়, তবে পাঁচ হাজার কেন, অনেক বেশি রোজগার হবে এক বেলাতেই। শেড তৈরি করতে হবে, আর রেডি রাখতে হবে সকলের খাবার আর জল, কোল্ড ড্রিংকস।”
রিটায়ার করার পর সমরেশ ব্যানার্জী একটা কেটারিংয়ের ব্যাবসা শুরু করেছেন। টাকার জন্য নয়। সরকারি অফিসে অনেকটা সময় ব্যস্ত থাকতে হত। এখন খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে, সেজন্যই। কয়েকটা লোককে খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করাটা তাঁর কাছে কিছুই নয়। কিন্তু লোকটা সত্যি বলছে তার প্রমাণ কী? একে অনেকবার হাটে-বাজারে, রাস্তায় দেখেছেন তিনি। নিতান্ত হা-ঘরে মানুষ। এর অধিকাংশ প্রেডিকশন মেলে না বলেই শুনেছেন। তবু মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘রিস্কটা নিয়েই ফেলো হে! যদি লেগে যায় তবে শুধু টাকা রোজগার নয়, আশেপাশে তোমার ‘ভাতে-ডালে’ কেটারিং কোম্পানির নামও ছড়িয়ে পড়বে হু হু করে।’
কপাল থেকে ঘাম মুছলেন সমরেশ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তার পাশে ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করে, তেরপল লাগিয়ে শেড তৈরি হল। এল ফ্যান। গ্যাসের উনুনে ভাত চাপল। ওদিকে কুমড়ো আর আলু কাটা হচ্ছে। গুচ্ছের লোক আজব খবরটা শুনে এসে জমা হয়েছে মজা দেখার জন্য।
আটটা বাজল, ন’টা, দশটা। বাস, গাড়ি রোজকার মতো পেরিয়ে যাচ্ছে। রোদ চড়ছে। কোথাও কোনও দুর্বিপাকের লক্ষণ পর্যন্ত নেই। কপালটা দিপদিপ করে উঠল সমরেশবাবুর। ওদিকে অতীশ মিটিমিটি হাসছে। বুক দুরুদুরু করছে রঘুরও। লোকজনে হাসাহাসি, কানাকানি শুরু করেছে।
তখন বাজে বেলা সাড়ে এগারোটা। হঠাৎই দক্ষিণদিক থেকে গাড়ি, বাস আসা বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ বাদে দ্রুতগতিতে পেরিয়ে গেল একটা পুলিশের গাড়ি।
আরও আধঘণ্টা কেটে যাবার পরে হঠাৎই দ্রুত গতিতে আসা একটা স্টেট-বাস সেখানে ব্রেক কষল। ড্রাইভার নেমে এসে প্রশ্ন করলেন, “এখানে চা পাওয়া যাবে?”
“কী হয়েছে ড্রাইভার সাহেব?” কে যেন জিজ্ঞেস করল।
জবাবে ড্রাইভার বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে বললেন, “আর বলবেন না। সামনে কোন গ্রামের লোকেরা রাস্তা অবরোধ করেছে। তাদের গ্রামে নাকি জল নেই, রাস্তা নেই, ইলেক্ট্রিসিটি নেই। এক্ষুনি সে-সবের ব্যবস্থা না হলে গাড়ি চলতে দেবে না। কী ঝামেলা বলুন তো!”
এরপরে একের পর এক উত্তরমুখো বাস, ট্রাক এসে দাঁড়াতে শুরু করল রাস্তার পাশে। পিলপিল করে নামতে শুরু করল লোক।
॥ ছয়॥
বটতলা বাজারের যে মূল বটগাছটি, তার কাছেই মাছের বাজার। নানানরকমের মাছ চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছি, আঁশটে গন্ধ, মাছওলা, থলে হাতে খদ্দেরের ভিড়— সব মিলে যাকে বলে নরক গুলজার।
আজ নতুন একটা হলুদ রঙের গেঞ্জি পরে এসেছে রঘু। চুল কেটেছে। দাড়িটা কামানো। দেখে চট করে চিনতে পারা দায়। আসলে হঠাৎই হাতে অনেকগুলো টাকা এসে যাওয়ায় নিজেকে একটু পালিশ করেছে সে। সমরেশবাবু সেদিন তিন-চারবার রান্না করেও কুলোতে পারছিলেন না। একের পর এক বাস এসে দাঁড়িয়েছিল সেখানে। সকলের পেটেই আগুন জ্বলছিল।
বিকেল নামার পর রাস্তা আস্তে আস্তে খুলে গেল। চলে গেল বাস, ট্রাক, গাড়ি। আর খুশি হয়ে সমরেশবাবু এক হাজার নয়, দুই হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলেন তার হাতে। জন্মে কখনও এত টাকা একসঙ্গে দেখেনি রঘু। ছেলের বই-খাতা, মেয়ের ওষুধ, বউয়ের শাড়ি কেনার পরেও কিছু তার কাছে রয়ে গিয়েছে।
বাজারের কাছে এসে একবার মনে মনে ঠাকুরকে ডাকল রঘু। বাঁহাতের বুড়ো আঙুলে পরে নিল আংটিটা। শরীরে কেমন একটা কাঁপুনি। চারদিক একবার ঝাপসা হয়েই আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপরেই শিউরে উঠল সে। বটগাছের গুঁড়ি আর ঝুরির গায়ে আটকে আছে অসংখ্য অদ্ভুতদর্শন প্রাণী। তাদের কেমন দেখতে তা এককথায় বলা সম্ভব নয়। লম্বাটে, গোল, চ্যাপ্টা, চৌকো— সবধরনেরই রয়েছে। কারও গায়ের রঙ সাদা, কেউ-বা কুচকুচে কালো। অনেকের চোখ, নাক, মুখ কিছুই নেই। এমনকি হাত-পাও না। অনেকের আবার তিন-চারটে করে চোখ। সকলের মুখই তার দিকে ফেরানো।
লম্বাটে, ঝুলের মতো আধা ফাঁকা আধা ভরতি একটা প্রাণীর নাকের আগায় অন্তত গোটা পাঁচেক চোখ কিলবিল করছে। হাত বলে কিছু নেই, কিন্তু লেজ আছে পাখির মতো। চোখগুলো পাকিয়ে সে লেজখানা দিয়েই ইঙ্গিত করল বিশেষ একজন মানুষের দিকে। রক্তিম হালদার। চেনে রঘু। হঠাৎই শরীরে যেন একটা ঝটকা লাগল তার। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সে।
মনা মাছওলা সাধারণত চালানি মাছ আনে না। দেশি বা টাটকা মাছ নিয়ে আসে। আজ তার সামনে একটা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে খলবল করছে দেশি কই। সেখানে দাঁড়িয়ে খুব আহ্লাদের সঙ্গে আঙুল উঁচিয়ে মাছ পছন্দ করছিলেন রক্তিম হালদার। হঠাৎই পেছন থেকে কে যেন তাঁর হাত ধরে টানল।
ধুর! এই অসময়ে কে আবার টানে! একবার চোখ সরালেই অন্য কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে বেছে রাখা মাছগুলো নিয়ে যাবে। এমনসব দেশি কই! খুব বিরক্ত হয়ে পিছনে ঘুরতেই চমকে গেলেন রক্তিম হালদার। এটা কে? একে তো আগে কখনও দেখেননি। ভিখারি-টিখারি বলেও মনে হচ্ছে না।
তাঁর হাতটা ধরে টানছিল রঘুই। বিরক্ত মুখে রক্তিমবাবু ঘুরতেই খুব নীচু আর বিষণ্ণ গলায় সে বলল, “বাবু, আজ আর মাছ কিনবেন না।”
“কেন হে? কেন কিনব না? আর তুমি লোকটাই-বা কে?”
“ওকে চিনলেন নে বাবু? ওই তো আমাদের বিখ্যাত জ্যোতিষী রঘু। ও-ই পরশুদিন বড়ো রাস্তায় মন্তর ফুঁকে সব বাস দাঁইড়্যে দেছিল যে, সে ওই রঘু পন্ডিতই!”
তাঁকে ইনফরমেশন জোগাল মনাই। যা বলা দরকার, বরাবরই সে তার চেয়ে একটু বেশি বলে। তবু রঘু শুনে একটু খুশিই হল। যদিও খুশি হলেন না রক্তিম। তিনি হলেন কমিউনিস্ট। কোনও কালেই বুজরুকিতে বিশ্বাস করেন না। ভুরু দুটো কুঁচকেই তিনি বললেন, “তা তুমি যতই বড়ো পন্ডিত হও না কেন, আমার মাছ কেনাতে তোমার আপত্তি কীসের? জ্যান্ত কইগুলো নিজেই গাপ করবে বলে ঠিক করেছ নাকি?”
“ছি, ছি!” জিভ কেটে কানে হাত দিল রঘু।— “তা নয় বাবু। আসলে আজ আপনার মাছ খাওয়া হবে না।”
“হবে না মানে? ইয়ার্কি নাকি! গরগরে তেল-কই হবে বলেই তো কিনছি হে। হবে না কেন?” দাঁত খিঁচিয়ে বললেন রক্তিম। তারপর মাছওলার দিকে ফিরে বললেন, “এক্ষুনি ছ’টা মাছ ওজন করে দাও। ঘরে গিয়ে ছাড়িয়ে নেব। যত্তসব ঝামেলা!”
গজগজ করতে করতে তিনি যখন বাড়ির পথ ধরলেন, কয়েকজন চুপিচুপি তাঁর পিছু নিল। আসলে রঘুর কাণ্ড ইতোমধ্যেই চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। কাজেই অনেকে বিশ্বাসও করতে শুরু করেছে সে যা বলছে, তেমনই কিছু একটা হতে চলেছে। ওই মাছ আজ আর তাঁর পেটে ঢুকছে না। অনেকে আবার এসবে বিশ্বাস করে না। এমন লোকও আছে যারা এককালে রঘুকে হাত দেখিয়েছে, কিন্তু তার একটা কথাও মেলেনি। তারা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে লাগল রঘুকে। সব মিলিয়ে বেশ একটা হইচই, চেঁচামেচি লেগে গেল গোটা বাজারে।
প্রদীপ ঘোষাল তাঁর ভারী বাজারের থলেটা হাতবদল করে একটা চুকচুক শব্দ করে বললেন, “রক্তিম হালদারের বুড়ি মাটা অনেকদিন ধরে ভুগছিল। আজ বোধ হয় সে যাবে।”
“যাবে মানে? কোথায় যাবে?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন সাধন গুপ্ত।— “তাঁর তো গেঁটে বাত। চলতে-ফিরতেই পারেন না, তো যাবেন কোথায়?”
“আহা! তুমি ব্যাপারটা বুঝলে না।” বললেন প্রদীপ ঘোষাল।— “রঘু পন্ডিত বললেন না, আজ আর রক্তিম হালদারের মাছ খাওয়া হবে না! তার মানেই হল হালদারের মা আজ মারা যাবে। তারপর তো অশৌচ। তখন আর মাছ খাবে কী করে?”
সাধন গুপ্ত চোখগুলো কপালে তুলে বললেন, “রঘু পন্ডিত? ও তো বরাবরের জোচ্চোর, পন্ডিত হল কখন? ছাই হবে। এই আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, হালদারের মা হেসেখেলে আরও দশ বছর বাঁচবে। কেউ আটকাতে পারবে না।”
এসব তর্কবিতর্ক চলছে, এমন সময়ই যে-সমস্ত লোকেরা রক্তিমবাবুর পিছু নিয়েছিল, তারা হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল। তাদেরই মধ্যে একজন খবর দিল, রক্তিমবাবু বাড়ির পথ ধরেছিলেন। মাঝপথ থেকেই পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে। কোথায় কোন মিটিং করতে গিয়ে তিনি ঢিল ছোড়াছুড়ি করেছিলেন, সেই অপরাধে।
তাঁর মা মারা যাননি, এই খবরে যেমন সকলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, তেমনই পুলিশের তাঁকে গ্রেপ্তার করার খবরে দুঃখপ্রকাশ করল অনেকে। তবে ভুবনডাঙা জুড়ে রঘুর ব্যাপারে বেশ একটা সাড়া পড়ে গেল।
॥ সাত॥
দিদিটাকে ভুলতে পারেনি গবাই। ইস্, কী সুন্দর দেখতে! অন্ধকারে ভালো করে বোঝা যায়নি, তবু মনে হয় সোনার মতো গায়ের রঙ। এই বড়ো বড়ো চোখ।
ও কি কাঁদছিল? কেন? কেনই-বা ওকে ঘরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে? ওই কি সেই রাজকুমারী?
প্রশ্ন অনেকগুলোই আছে। একটা গল্পের বইয়ের ঘটনা কেমন করে সত্যি হয়ে গেল। সাধুবাবা ওর হাতেই-বা আংটিটা তুলে দিলেন কেন? ওই জায়গাটাই কি অন্য ভুবন? এসব চিন্তাতে সারাক্ষণ অন্যমনস্ক থাকে গবাই। এখন তাদের অবস্থা অনেকটা ফিরেছে। চারদিকের যত লোক সবার মুখে মুখে তার বাবার নাম। এমনকি সেদিন নন্দ মাস্টারমশাই পর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমার সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে। একবার তোর বাবাকে দিয়ে হাতটা দেখিয়ে নিতে হবে।” তারপর নীচু গলায় বললেন, “বাবাকে আমার কথা একটু বলিস।”
অন্যমনস্কভাবেই ঘাড় নেড়েছিল গবাই। কিন্তু ওর মাথা থেকে চিন্তা যায়নি।
আবার ফুরসত পেল বুধবার। কোন একজন মন্ত্রী হঠাৎ করে মারা গেছেন। তাই তিন পিরিয়ড পরে ছুটি। মিড ডে মিল রান্না হয়ে গিয়েছিল। খিচুড়ি আর আলুমাখা। সে খেয়েই যেতে হবে। মাস্টারমশাইরা এসে বললেন, খেয়েদেয়ে লাইন করে সবাই ধীরেসুস্থে বাড়ি যাবে। তাড়াহুড়ো করবে না কেউ। অবশ্য ওসব কি আর কেউ মানে!
বেরোনোর সময় মিন্টু ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বেরোবি না?”
“হুঁ। একটু পরে। দরকার আছে একটা।”
“কী দরকার?”
“পরে বলব তোকে।”
“আমি দাঁড়াব?”
“না। তুই এগো, আমি আসছি। বিকেলবেলায় খেলার মাঠে দেখা হবে।”
আর কিছু না বলে মিন্টু বেরিয়ে গেল। তক্ষুনি উঠে পেছনের বাউন্ডারি টপকে বেরোল গবাইও। মিন্টুকে কিছু না বলতে পারায় মনে দুঃখ হচ্ছিল ওর। কিন্তু এখন বললে বিপদ হবে। ওকে পাগলও ভাবতে পারে সবাই। আর একটু দেখা যাক।
বেরোনোর একটু পরেই টিপটিপ বৃষ্টি নামল। রোদের তেজ নেই আজ। কিন্তু তেমন মেঘও নেই। এই বৃষ্টি আর একটু পরেই থেমে যাবে। রাস্তার পাশে একটা বাঁশঝাড়ের নীচে দাঁড়িয়ে আংটিটা বাঁহাতের বুড়ো আঙুলে গলিয়ে নিল গবাই।
মুছে গেল রাস্তা, দূরের স্কুলবাড়ি, বাঁশঝাড়। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলে ঘেরা একটা জমিতে। সামনে দিয়ে এঁকে-বেঁকে চলে গেছে একটা নদী। ও-পাড়ে কিছুটা বালির চর। তার পরে আরও ঘন জঙ্গল।
ওপরের আকাশ এখানেও মেঘলা। হয়তো বৃষ্টি নামবে এক্ষুনি। এই দিনের বেলাতেও খুব জোরে ঝিঁঝিঁ ডাকছে জঙ্গলের ভেতর থেকে। সামনে তাকিয়ে গবাই দেখতে পেল নদীর গায়ে একটা ছোট্ট নৌকো বাঁধা আছে। ওখান থেকে কেউ হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে।
আর একটু এগোতেই লোকটাকে চিনতে পারল গবাই। এই সেই সাধুবাবা। কিন্তু এখন তাঁর গায়ে গেরুয়া পোশাক নেই। আছে একটা খাটো ধুতি। কাঁধে লাল রঙের গামছা জড়ানো। ওকে দেখে তিনি একগাল হেসে বললেন, “ও-পাড়ে যাবে তো? চলো, পৌঁছে দিচ্ছি।”
বলতে না বলতেই তড়বড়িয়ে বৃষ্টি নামল। ঝাঁপ মেরে টলোমলো নৌকোর ছইয়ের নীচে দাঁড়াল গবাই। ঢোঁক গিলে জিজ্ঞেস করল, “আপনিই তো ওই সাধুবাবা?”
দু-হাতের দুই দাঁড়ের ধাক্কায় ছোট্ট নদীর মাঝে নৌকোটাকে নিয়ে ফেললেন মাঝি। দাড়ির ফাঁকে হেসে বললেন, “সাধুবাবা কেন হব! আমি হচ্ছি গাইড। তোমাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়াটাই আমার কাজ। তবে ঠিক এক ঘণ্টার মধ্যে আবার এখানে চলে আসবে। তারপর দারুণ বৃষ্টি নামবে। তার মধ্যে এখানে না পৌঁছলে বিপদে পড়বে।”
“খুব বুঝি বিপদ সামনে?”
বুক দুরুদুরু করছিল গবাইর। জবাবে মাঝি ঠোঁট উলটে বললেন, “বিপদ কোথায় নেই! তারই মধ্যে নিজের কাজ করে যেতে হবে।”
বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটায় অস্থির হয়ে উঠেছে নদী। তার মাঝখান দিয়ে একটু পরেই নৌকো গিয়ে লাগল অন্য পাড়ে। মাঝি বললেন, “যাও। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।”
বালির ওপর দিয়ে একটু এগিয়েই পেছন ফিরে গবাই দেখল নৌকো দূরে চলে গেছে। ঝাপসা দেখাচ্ছে এখান থেকে। ওর জামাকাপড়ও ভিজে চুব্বুস। কিন্তু এখন সে যাবে কোন দিকে?
তখনই সে জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে সরু একটা পায়ে চলা পথ দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে ওখানে ঢুকে পড়ল সে। ভেতরে একটা সুঁড়িপথ। ওপরের আকাশ ঢেকে রেখেছে গাছপালার ডাল। আগাছা আর কাঁটাগাছ পথ আগলে রেখেছে। মাথা নীচু করে চলতে হয়। এখানটা অন্ধকার, আর একটানা ঝিঁঝিঁর শব্দে কানে তালা ধরে যায়।
অনেকক্ষণ গুঁড়ি মেরে হাঁটার পর যখন গবাইয়ের পিঠ কোমর আর হাঁটু টনটন করছে, তখনই সে সামনে আবছা আলো দেখতে পেল। আর একটু এগোতেই সামনে সেই ফাঁকা জায়গা, আর সেই ছোট্ট কুঁড়ে। এবার তার বুক আর একবার ধড়াস করে উঠল। কারণ, সেদিনের সেই মেয়েটি আজ ঘরের বাইরেই বসে আছে। আশ্চর্য সুন্দরী, কিন্তু মুখটি বিষণ্ণ। একটি বড়ো গাছের তলায় গালে হাত দিয়ে বসে।
তাকে জঙ্গল থেকে বেরোতে দেখে একটু চমকে উঠল দিদিটা। ঘাড় সোজা করে তাকাল। চোখের মণি আশ্চর্য নীল, বড়ো বড়ো চোখের পাতা। তিরতির করে কেঁপে উঠল তার গোলাপি নাকের ডগা আর পাতলা ঠোঁট। প্রায় ফিসফিস করার ভঙ্গিতে সে বলল, “কে তুমি?”
তার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল গবাই। দিদিটা এত সুন্দর, চোখ ফেরানো যায় না। সে নীচু গলায় বলল, “আমি গবাই। তুমি কি রাজকুমারী?”
ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল সে। মৃদু স্বরে বলল, “রাজকুমারী নন্দিতা। তুমি কে? এখানে এসেছ কীভাবে?”
গবাইয়ের ইচ্ছে হচ্ছিল নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখে। স্বপ্ন নয় তো? তারপরেই সে বলল, “সাধুবাবা আমাকে পাঠিয়েছে, তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”
একবার যেন আশার আলো জ্বলজ্বল করে উঠল রাজকুমারীর চোখে। তারপরেই ম্লান হয়ে গেল। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কোন সাধুবাবা তিনি তা জানি না। কিন্তু তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। এই পৃথিবীকে চারদিক থেকে আড়াল করে রেখেছে জাদুকর মৃত্যুঞ্জয়। কেউ এখানে আসতে পারে না, কেউ যেতেও পারবে না এই দুনিয়া ছেড়ে। যদি না সে নিজে অনুমতি দেয়।”
“বা রে, তাহলে আমি এলাম কী করে? চলো ওঠো তো, আমার হাত ধরো। নদীর পাড়ে নৌকো দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাই চলো।”
ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল রাজকুমারীর চোখে। একবার পেছন দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, “ও এক্ষুনি এসে পড়বে।”
“তার আগেই আমরা পালিয়ে যাব। তুমি ওঠো।” বলেই গবাই দিদিটার হাত ধরে টান মারতে গেল। তার পরেই ‘উহ্’ করে উঠল। যেন পুড়ে গেল তার হাতটা। বিষাদের একটা হাসি ফুটে উঠল রাজকুমারীর ঠোঁটে। অস্ফুটে বলল, “ও ছাড়া কেউ ছুঁতে পারবে না আমায়।”
“ঠিক আছে। কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে তো যেতে পারি আমরা!” হাতটা ঘষতে ঘষতে বলল গবাই।
“চলো তাহলে। চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল রাজকুমারী। পেছন দিকে একবার তাকিয়ে গবাইয়ের পিছু পিছু দৌড়তে লাগল পায়ে চলা সরু রাস্তাটার দিকে।
গবাই একটু এগিয়ে গিয়েছিল। থমকে গেল পেছন থেকে রাজকুমারীর ডাক শুনে।— “গবাই!”
সে ঘুরে তাকিয়ে দেখল রাজকুমারী একটু পেছনে দাঁড়িয়ে। তার চারদিক ঘিরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।
“তুমি চলে যাও গবাই। আমার যাওয়ার উপায় নেই। বলেছিলাম না!”
॥ আট॥
সন্ধে নামার পর পচা ডোবাটার পাশে উঁচু ঢিবিটার ওপরে বসল রঘু। পা দুটো টানটান করে ছড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকাল সে। মনে শান্তি নেই। নানারকম চিন্তা চলছে। অথচ তার আর্থিক অবস্থা এখন বেশ ভালো। মুখে মুখে, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও তার নাম ছড়িয়ে গেছে বহুদূর পর্যন্ত। পরশুই এক লোকাল চ্যানেলের সাংবাদিক এসেছিল তার ইন্টারভিউ নিতে। লোকে লাইন দিয়ে হাত দেখিয়ে যাচ্ছে তার কাছে।
কিন্তু এসবের বাইরে দুশ্চিন্তারও অনেক কারণ আছে তার। সেই বুড়ো লোকটা কে, যে তার হাতের জল খেয়ে সুস্থ হয়ে উঠল? মানুষ নয় তো নিশ্চয়ই। আর আংটিটা আঙুলে গলালে যাদের দেখতে পায়, তারাই-বা কে? কেবলমাত্র ভুবনডাঙাতেই তারা আছে, নাকি সারা পৃথিবী জুড়েই? সেই লোকটি তাকে বলেছিল, মোট বারো বার আংটিটা ব্যবহার করতে পারবে রঘু। তিনবার তো হয়েই গেল। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে কী হবে? তার ভাগ্যগণনা কি তারপর আর ফলবে না?
আজ আকাশ একটু মেঘলা। দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়। বেশ একটা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। বৃষ্টির গন্ধ পাওয়াতেই বোধ হয় কটকট করে ব্যাঙ ডাকতে শুরু করেছে। রঘু মাথার পেছনে একটা হাত দিয়ে শুয়েই পড়ল। কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশপাতাল ভাবতে লাগল।
ঠিক তখনই মাথার কাছে একটা গলা খাঁকারির আওয়াজ। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল রঘু। আকাশে চাঁদ দেখা যায় না। দূর থেকে খুব অস্পষ্ট একটা আলো ভেসে আসছে। সেই আলোতেই রঘু দেখতে পেল, তার ঠিক পাশেই একজন বুড়োমানুষ দাঁড়িয়ে আছে। পরনে সাদা ধুতি। এই গরমেও মাথায় চাদর। ভালো করে ঠাহর হয় না, তবে মনে হয় কয়েকদিন আগে যে-লোকটার প্রাণ বাঁচিয়েছিল সে, ওই লোকটাই।
লোকটা অন্ধকারের মধ্যেই হাতজোড় করে নমস্কার করল তাকে। দুটো হাত জোড় করে রঘু বলল, “আমি আপনাকেই খুঁজছিলাম। ভালো হল আপনি এসেছেন।”
মৃদু গলায় লোকটি বলল, “আমরাও আপনাকেই খুঁজছি। ভিড়ের মধ্যে সুবিধা হয় না, তাই এখানেই এসেছি।”
“আমাকে খুঁজছেন? কেন বলুন তো?” অবাক হল রঘু।
“আজ্ঞে, সেদিন যেমন আমার বিপদ হয়েছিল, তেমন অনেকেরই নানান বিপদ ঘটছে তো! এখানে আসা ইস্তক সবারই নানান ব্যামো হচ্ছে। কষ্ট, জ্বালার কি আর শেষ আছে এই পৃথিবীতে! আপনার দেওয়া ওষুধ না পেলে তাদের রোগ-ব্যামো আর সারবে বলে মনে হচ্ছে না। এখন আপনিই আমাদের একমাত্র ভরসা। সেই ওষুধটা যদি আবার আমাদের দেন তাহলে খুব সুবিধা হয়।”
“ওষুধ? ওষুধ কোথায়? ও তো জল!” দু-চোখ কপালে তুলে রঘু বলল।
জবাবে অত্যন্ত বিনীত ভঙ্গিতে লোকটি বলল, “আজ্ঞে না। তা হলে কি আর আমি খেতে পারতাম! জল ছুঁলেই আমাদের সারা শরীর জ্বালা করে। আমাদের পৃথিবীতে জল বলে কিছু নেই। থাকলে সমস্যাও হত। হাত-পায়ে জল লাগলেই বিপদ ঘটে।”
“বলেন কী! তাহলে তো মুশকিল। কিন্তু আমি যতদূর জানি সেটাতে জলই ছিল। আমার খাওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলাম। আপনাকে বিপদে পড়তে দেখে বোতল থেকে সেটাই আপনার গলায় ঢেলে দিই। কিন্তু একটা জিনিস আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন?”
“নিশ্চয়ই।” হাত কচলে উত্তর দিল লোকটা।— “আপনার যা যা প্রশ্ন আছে দয়া করে বলে ফেলুন। যথাসাধ্য উত্তর দেব।”
“আপনারা কারা? এখানে এসেছেনই-বা কেন?”
“আমরা কারা মানে? আমরা মানুষ! আর এখানেই তো আমাদের ঘরবাড়ি! না-হলে যাবই-বা কোথায়?”
লোকটা যে খুবই অবাক হয়েছে তা তার গলাতেই বোঝা গেল। তাতে রঘুর মাথাটা আরও ঘেঁটে গেল। চোখ কপালে তুলে সে প্রশ্ন করল, “মানুষ? এখানেই থাকেন? আর গাছে যাদের ঝুলতে দেখেছি, হাউইয়ে চেপে আকাশ থেকে যারা নামছে, তারাই-বা কে? কই, এতদিন তো আপনাদের কাউকে দেখিনি!”
নীচু গলায় একটা হাসির শব্দ শোনা গেল। খুব বিনয়ের সঙ্গে লোকটা বলল, “আপনি আসলে ব্যাপারটা বোঝেননি। আসলে আপনারা যেমন, আমরাও তেমনই একই পৃথিবীর বাসিন্দা। তবে আমাদের মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। আমরা আরও এক হাজার বছর আগের বাসিন্দা।”
“বলেন কী! আপনারা আমাদের পূর্বপুরুষ?”
“উঁহু।” অন্ধকারের মধ্যেই মাথা নাড়ল লোকটা।— “তা নয়। আমাদের সঙ্গে আপনাদের কোনও রক্ত বা জিনের সম্পর্ক নেই। সব তো আর আপনি বুঝবেন না। ধরে রাখুন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যখন তৈরি হল, তখন একই জায়গায় আলাদা আলাদা অনেকগুলো পৃথিবী তৈরি হল। মানে, তাদের জমি এক, কিন্তু সময়কাল আলাদা।”
একটা ঢোঁক গিলল রঘু। এ সবই তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। কিচ্ছু বুঝতে পারছে না।
তাকে দেখে সম্ভবত লোকটার মায়া হল একটু। সে আর একটা গলা খাঁকারি দিয়ে নরম সুরে বলল, “আর একটু সহজ করে বলছি। ধরুন এই মাঠে পাশাপাশি আছেন আপনি আর ইতিহাসের একজন রাজা। একই সঙ্গে, একই জায়গায়, কিন্তু সময়টা আলাদা। তাহলে তো আর আপনার আর ওই রাজামশাইয়ের দেখাসাক্ষাৎ হবে না। জায়গা এক হলেও সময়টা তো আলাদা। বুঝতে পারা গেল?”
“বুঝলাম।” কপালের ঘাম মুছে বলল রঘু।— “কিন্তু আমাদের ইতিহাসের রাজা আর আমার মধ্যে পাশাপাশি থাকব কী করে? তাছাড়া আংটি পরলে তো আপনাদের দেখতেও পাচ্ছি!”
“ওখানেই তো ঝামেলা! আসলে আপনাদের ইতিহাসের লোকজন আপনার পাশাপাশি নেই। আছে আমাদের বর্তমানের লোকজন। আমরা একই জায়গায় অন্য সময়ে থাকি। এরকম আরও চার-পাঁচটা পৃথিবী আছে। সবার কেবল স্থানটাই এক। সময়, পরিবেশ সবই আলাদা। যাই হোক, ওসব অনেক জটিল ব্যাপার। আপাতত আপনাকে আমাদের সমস্যাটা মিটিয়ে দিতে হবে।”
“সমস্যা?” তখনও রঘুর ঘোর কাটেনি।— “আপনাদের সমস্যাটা কী যেন?”
“ওই দেখুন। দেখতে পাচ্ছেন?”
লোকটা তার হাত একদিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেদিকে তাকিয়ে আর একবার শিউরে উঠল রঘু। দূরে, অন্ধকারের মধ্যে ঝোপঝাড়ের সামনে সারি সারি অনেকগুলি বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে কিছু একটা ধরা। সেগুলি সামনে বাড়িয়ে ধরেছে তারা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে তাদের চোখ।
“ওরা কারা?” ফ্যাসফ্যাসে গলায় প্রশ্ন করল রঘু।
“ওরা আমাদের বাচ্চারা। খুব বড়ো একটা ঝামেলায় ফেঁসে গিয়েছি আমরা। আমাদের এক বিজ্ঞানী কী একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে দুই পৃথিবীকে মিশিয়ে ফেলেছেন। ফলে মাঝে-মধ্যেই আমাদের লোকজন অনিচ্ছাসত্ত্বেও আপনাদের সময়কালের পৃথিবীতে আসতে বাধ্য হচ্ছে। এখানের নানান জীবজন্তু, পোকামাকড়ের কামড়ে বহু লোক মারা যাচ্ছে রোজ। বাচ্চারাও। আমাদের ওষুধ কাজ করছে না। যতদিন না বিজ্ঞানীরা দুই পৃথিবীর মধ্যের দরজাটা বন্ধ করতে পারছেন, ততদিন এরকমই চলবে। একমাত্র আপনার ওষুধই আমাদের বাঁচাতে পারে। বাঁচাতে পারে ওই বাচ্চাগুলোকে। ওরা সবাই নানান রোগে আক্রান্ত। চোখের সামনে মারা যাচ্ছে ওরা। বলুন, ওদের কি আপনি বাঁচাবেন না?”
শুনে রঘুর চোখে জল চলে এল। তার বাড়িতেও বাচ্চা আছে। এই বাচ্চাগুলো যদিও অনেক দূরে আছে, অন্ধকারও খুব, তবু স্পষ্ট বোঝা যায় তারা অসুস্থ, আর খুব প্রত্যাশার দৃষ্টিতে তারা রঘুর দিকেই তাকিয়ে। কিন্তু কীই-বা করতে পারে সে!
“আপনারা তো ভবিষ্যৎ দেখতে পারেন। আমার বোতলে কী ছিল, সেটা বের করতে পারবেন না?”
“উঁহু।” দুঃখের সঙ্গে মাথা নাড়াল লোকটা।— “আপনাদের পৃথিবীতে আমাদের দৃষ্টি সীমিত। চাইলেও সবটুকু জানতে পারছি না আমরা।”
“আচ্ছা। আমি চেষ্টা করব।”
॥ নয়॥
নন্দিতাদিদির গায়ে আগুন লাগেনি। চারপাশের বাতাসটাই জ্বলছিল। সে কান্না চাপতে চাপতে যখন ঘরে ঢুকে গেল, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গবাই আবার সুঁড়িপথটা ধরল। ওরও কান্না পাচ্ছিল খুব। হায়, হায়! দিদিটাকে বাঁচাতে পারল না ও! দুষ্টু লোকটা দিদিটাকে কত কষ্ট দিচ্ছে।
গবাই পড়ে ক্লাস থ্রিতে। পাখি হোক বা ফড়িং, মানুষ হোক বা গাছ, কারও কষ্ট ও দেখতে পারে না। ফেরত যাবার পথটা রাজকুমারী, যাকে ও মনে মনে এতক্ষণে নন্দিতাদিদি বানিয়ে ফেলেছে, তার কষ্টতে সে এতই মুহ্যমান হয়ে রইল যে নীচু হয়ে পথ হাঁটার বা বৃষ্টি পড়লে জঙ্গলের মধ্যে যে গুমোট গরম দেয়, তার কিচ্ছুটি টের পেল না। কিন্তু জঙ্গল পেরিয়ে ফাঁকা জায়গায় আসার পর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আবার বেকুব বনে গেল ও।
কোথায় নদী, ও-পাড়ের জঙ্গল বা ছোট্ট নৌকোটি! বরং সেখানে ধু-ধু করছে মরুভূমি। একটা খেজুর গাছের তলায় বসে বিড়ি খাচ্ছে একটা বেদুইন। বেদুইনের ছবি সে পড়ার বইতেই দেখেছে, তাই চিনতে পারল। সাদা আলখাল্লা। মাথায় সাদা কাপড় বাঁধা। পেছন ঘুরে আছে, তবু বোঝা যায় তার গলাতে বিরাট মোটা একটা সোনার হার। ফুকফুক করে বিড়ি টানছে। বিড়ি খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। ফুসফুসটা নষ্ট করে দেয় একেবারে।
লোকটা তক্ষুনি তার দিকে ফিরে তাকাল। সেই সাধুবাবা, অথবা মাঝি। মুখটা দেখেই চেনা চায়। ওর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বলল, “এসে গেছো! খুব তাড়াতাড়ি! চলো, ফেরা যাক।”
প্রচণ্ড গরম। মাথার ওপরে সূর্য যেন আগুন ছড়াচ্ছে। পায়ের তলার বালি তার থেকেও বেশি গরম। ও-পাড়টা এত দূরে, কোনও সীমানার চিহ্ন দেখা যায় না। লোকটার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আগুনের মতো একটা শ্বাস ফেলে গবাই জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, এখানে একটা নদী ছিল না? একটু আগে?”
“তাই নাকি? ছিল নাকি?” লোকটা চোখ কপালে তুলল একবার। তারপর একটা হাই তুলে বলল, “এই নদীটা?”
গবাই আর অবাক হচ্ছে না। তবে চোখ তুলে দেখল, বালি-টালি আর নেই। শ্যামল-সবুজ জমি। গাছগাছালি, চওড়া পাথর দিয়ে বাঁধানো রাস্তা। মাঝে-মধ্যে উঁচু উঁচু ইমারত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গাছের ও-পার থেকে। আর বিশাল চওড়া সবুজ জলের এক নদী, যার এ-পাড় ও-পাড় দেখা যায় না, পড়ে আছে সামনে। সারি সারি নেমে গেছে বাঁধানো ঘাট। কত লোক সেই ঘাট ধরে নামছে স্নান করার জন্য।
সে একটু দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, “এটা নয়। জঙ্গলের মধ্যিখানে একফালি নদী ছিল। ছোট্ট একটা ছই দেওয়া নৌকো। আপনি চালাচ্ছিলেন। ও-পাড়ের সুঁড়িপথ ধরে আমি গিয়েছিলাম রাজকুমারীর কাছে।”
বলতে না বলতেই সে দেখল, অবিকল সেই আগের নদীটি। নৌকোর ওপরে ছইয়ের তলায় সে দাঁড়িয়ে আছে। গলায় লাল গামছা ঝুলিয়ে নৌকো চালাচ্ছে সেই মাঝি। লজ্জা লজ্জা মুখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভুলে যাই, বুঝলে কিনা! এত কাজের চাপ!”
“আপনি আসলে কে বলুন তো?” চোখ গোল গোল করে গবাই বলল।
“আমি? আমিই সেই!” গোঁফ-দাড়ির জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে মুচকি হাসল লোকটা।— “তারপর? ওদিকে কী হল?”
“দিদিটাকে বন্ধন দিয়ে রেখেছে দুষ্টু জাদুকর। ইস্! ওকে বাঁচাতে পারলাম না।” কান্না চেপে বলল গবাই।
জবাবে লোকটা ভুরু কুঁচকে বলল, “বাঁচাতে পারলে না? তুমি কে হে বাঁচাবার? কই, তোমার আংটিটা দেখি?”
সন্ধে নেমে আসছে আস্তে আস্তে। অন্ধকার নামছে। আর তারা এই মুহূর্তে আছে নদীর ঠিক মাঝখানে। যদিও নদীটা তেমন চওড়া নয়। গবাই সাঁতারও জানে। ওদিকে মাঝি ছেড়ে দিয়েছে তার হাতের দাঁড়। সামান্য স্রোত আছে জলে। নৌকো তার টানে ভেসে চলেছে। একবার জলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে গবাই আংটিটা খুলে মাঝির হাতে দিল। সে হাতের তালুর মধ্যে জিনিসটা আলতোভাবে নাড়াচাড়া করতে করতে আনমনে বলল, “ঠিকঠাক কাজ করছে না জিনিসটা। কেবলমাত্র একদিকের দরজাটা খুলছে। রাজবাড়িতে যাওয়া যাচ্ছে না। কোন সূত্র কখন কোথায় লুকিয়ে থাকে মনেই পড়ে না আজকাল।” তারপর বড়ো বড়ো চোখে গবাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বুকে সাহস আছে তো?”
“সাহস?” গবাই বুক ফুলিয়ে বলল, “বিকেলবেলায় বন্ধুরা মিলে শ্মশানে গিয়েছি। আমাদের বাঁধপুকুর এ-পাড় ও-পাড় করেছি আধঘণ্টায়। আর কত সাহস চাই?”
“বেশ, বেশ। নৌকোটা এক মিনিটের জন্য দাঁড় করাচ্ছি এখানে। তুমি দৌড়ে গিয়ে মৃত্যুঞ্জয় জাদুকরের ওষুধটা, যেটা উনুনের ওপরে ফুটছে, সেটা নিয়ে এসো। অবশ্য আর একটা কাজও করতে হবে তোমাকে। যেখানে উনুনটা জ্বলছে তার পূর্বদিকে গুনে গুনে তেইশ পা গেলেই একটা দেড় হাত লম্বা গাছ পাবে। পাতাগুলো তেকোনা। তুমি ওই গাছ থেকে মোট চব্বিশটা পাতা ছিঁড়বে। তার বেশি না কিন্তু! ওষুধের পরিমাণ যতটা কমল, ঠিক ততটা জল ঢেলে তোমার হাতের পাতাগুলো তার মধ্যে ফুটতে দিয়ে দেবে। ব্যস, তোমার কাজ শেষ। বাকি কথা তারপর হবে।”
“আমি এই জলের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে যাব কী করে?” অবাক হয়ে বলল গবাই।
তাতে লোকটা খুব বিরক্ত হয়ে বলল, “আহ্! বড়ো বেশি কথা বলো। দাঁড়াও না, সে-ব্যবস্থাও হচ্ছে।”
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গবাইয়ের চারপাশ অন্ধকারে ডুবে গেল। খুব ঝিঁঝিঁর শব্দ। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর সে দেখল, সামনে ধিকিধিকি জ্বলছে কাঠের লাল আগুন। তার সামনে লম্বা মতন একটা কালো ছায়া হাঁটু গেড়ে বসে আগুনের ওপরে চাপানো হাঁড়িটার ভেতরে একটা কিছু দিয়ে নাড়ছে। পেছনে আগুনের কাঁপা কাঁপা আলো গিয়ে পড়ছে কুঁড়েঘরের দরজায়। নিশ্বাস বন্ধ করে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকল গবাই। মনে মনে আন্দাজ করতে লাগল পুবদিক কোনটা। তক্ষুনি মনে পড়ল, এখানে সে এসেছিল বিকেলে। তখন আকাশের ওই প্রান্তটা কমলা রঙের হয়ে ছিল। সেটা পশ্চিম। তার মানে তার উলটোদিকটাই পূর্ব।
এক মিনিট, দু-মিনিট— কতক্ষণ কাটল কে জানে। ভয়ে নড়ছিল না গবাই। পায়ে খুব মশা কামড়াচ্ছে, তবুও।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত লোকটা উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর ওপরের অন্ধকার আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ঢুকল জঙ্গলের দিকে। তক্ষুনি নিঃশব্দে আগুনের দিকে দৌড়ে গেল গবাই। সেখান থেকে গুনে গুনে তেইশ পা হাঁটতেই ওই সাধুবাবা, কিংবা মাঝি, কিংবা বেদুইন যেমনটি বলেছিল, তেমনই দেড় হাত লম্বা গাছ পাওয়া গেল। অবশ্য তার পাতাগুলো তিনকোনা কি না তা এই অল্প আলোতে বোঝা গেল না।
তারপর সে চারদিকটা দেখে নিয়ে সোজা পৌঁছল আগুনের কাছে। এই দুষ্টু লোকটা সারাদিন সারারাত আগুনে এই ওষুধ ফোটায় কেন সেটা সে বুঝতে পেরেছে। এই ওষুধ তার শক্তি জোগায়। মাঝি ওরফে সাধুবাবার প্ল্যানটাও তার কাছে পরিষ্কার।
॥ দশ॥
“খুব কষ্ট হচ্ছে গবাই?” নরম গলায় প্রশ্ন করল বেদুইন।
জবাবে মাথা কাত করে চোখ ঘষতে লাগল গবাই। সত্যিই কষ্ট হচ্ছে তার, চোখ জলে ভরে আসছে। একটা দুষ্টু লোকের জন্য কতই না কষ্ট হচ্ছে রাজকুমারীর! না জানি তার মা আর বাবাও কত কাঁদছেন! গবাইয়ের বুনুর একটু জ্বর হলেই তার বুক কাঁপতে থাকে। যদি কোনোদিন সে হারিয়ে যায়, বা কোনও দুষ্টু লোক তাকে বন্দি করে রাখে, তাহলে তার মা বাবাও তো খুব দুঃখ পাবে। মা তো কেঁদেই ফেলবে।
বেদুইন কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখল। তারপর ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “ভালো। খুব ভালো। কেউ কষ্ট পেলে যদি তোমার কান্না পায়, তবে বুঝবে তুমি ঠিক পথেই আছ।” তারপরেই বিড়বিড় করে বলল, “আমিও তো সেটাই চেয়েছিলাম। কিন্তু হল কই!”
গবাইয়ের গলার কাছটায় কান্নার ডেলা পাকিয়ে আছে। সে অবরুদ্ধ স্বরে বলল, “রাজা আর রানিমা খুব কাঁদছেন, তাই না?”
“হুঁ। সে তো কাঁদছিলেনই। তবে অনেকদিন আগের ব্যাপার।”
“অনেকদিন আগের ব্যাপার?” চোখ মুছে অবাক হয়ে তাকাল গবাই।— “তার মানে রাজকুমারী, জাদুকর, রাজা, রানি— সবাই মরে গেছে? কিচ্ছুটি আর নেই?”
বেদুইন ফিক করে হেসে বলল, “তাতে কী! তোমাদের এক কবির লেখাতে আছে, ‘আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি।’ তার জবাবে কবিই আবার লিখেছেন, ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।’ যাক সে-কথা। তোমার আংটিটাতে একটা ত্রুটি ছিল। জাদুকরের তৈরি পৃথিবীটা ছাড়া আর কোথাও যাওয়া যেত না। এটা অবশ্য ওই মৃত্যুঞ্জয়েরই তৈরি। তবে আমি এটাকে শুধরে দিয়েছি। এবার বলো, তুমি কি রাজামশাইকে দেখতে চাও?”
ঘাড় নেড়ে গবাই বলল, “হ্যাঁ।”
বলতে না বলতেই আলো ফুটল। গবাই দেখল, তারা দাঁড়িয়ে আছে ভুবনডাঙার শহর অংশটাতে। চওড়া পিচ-রাস্তার পাশে একটা বড়ো গাছ। গাছতলায় গালে হাত দিয়ে বসে আছেন বিশালকায় এক পুরুষ। গলায়, হাতে সোনার গয়না। কানে সোনার মাকড়ি। গায়ে মলমলের ওপর সোনার সুতোর কাজ করা পোশাক। কিন্তু তাঁর চোখে শূন্য দৃষ্টি, দু-গালে পাকা দাড়ি। মাথায় টাক। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত একজন অসহায় মানুষের মতো বসে আছেন তিনি। যেন সব হারিয়ে ফেলেছেন।
তারা খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেও রাজা তাদের দেখতে পেলেন না। বরং একবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। তারপর দু-হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন। তাঁর বিশাল শরীরটি ফুলে ফুলে উঠছিল।
“উনি দেখতে পাবেন না আমাদের?” গবাই জিজ্ঞেস করল।
“উঁহু।” বলল সাধুবাবা।— “এখন তোমাকে দেখতে পেলে মুশকিল আছে। এখন চলো, রাজামশাই তাঁর মুকুট আর স্বর্ণমুদ্রার থলেটা হারিয়ে ফেলেছেন, উদ্ধার করা যাক।”
বেশি দূর যেতে হল না। একটু হেঁটে হাই-স্কুলের সামনের বাউন্ডারিটার পাশেই ফুটপাথে পরপর পাওয়া গেল মুকুট, চামড়ার ছোট্ট একটা থলে আর ছোট্ট একটা বাঁকানো ছুরি। আশপাশ দিয়ে কত লোক পেরিয়ে যাচ্ছে, কত গাড়ি, কিন্তু কারোর ভ্রূক্ষেপ নেই।
“কেউ তুলছে না কেন? এত দামি জিনিস?” গবাই জিজ্ঞেস করল।
“আহা, দেখলে তো তুলবে! তাছাড়া দেখতে পাবেই-বা কী করে! আশেপাশে এখনকার লোকজন আছে বটে, কিন্তু জিনিসগুলো তো আর এখনকার নয়! খুব জটিল ব্যাপার, তুমি বুঝবে না। লোক আর মুকুটের মাঝে আছে সময়ের বেড়া।”
“এগুলো নিয়ে রাজাকে গিয়ে ফেরত দিই?” গবাই বলল।
“দরকার নেই। তিনি তোমাকে দেখতে পাবেন না। তোমার হাতে থাকলে জিনিসগুলোকেও নয়। বরং রানিমার কাছে যাওয়া যাক। তিনি সবই দেখতে পাবেন।”
বহুদূর বিস্তৃত জঙ্গল। মাঝখান চিরে বয়ে যাচ্ছে ঝিলিমিলি একটি নদী। একজায়গায় গিয়ে নদীটি দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আর সেই মাঝের ‘ব’ আকৃতির জমিতে পোড়া ইট আর পাথর দিয়ে তৈরি বিশাল রাজপ্রাসাদ। চারদিকে পাথরের উঁচু পাঁচিল। আর ভেতরে যেন ছোটোখাটো একটি শহর। বাজার, সেনা আবাস, মন্দির, পাঠশালা— সবই আছে। দু-পাশে গাছের সারির মাঝে চওড়া একটা পাথরের রাস্তা এঁকে-বেঁকে চলে গেছে রাজপ্রাসাদের দিকে। বহু লোক দেখা যাচ্ছে চারদিকে। কেউ বাজারে সবজি বা অন্যান্য পসরা নিয়ে বসেছে। রঙিন পোশাক পরা মানুষেরা বাজার করছে। পুরোহিত মন্দিরে পুজো করছেন। সেনারা হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু কারও মুখে হাসি নেই। সবাই গম্ভীর। কেউ তেমন কথাবার্তা বলছে না। মুখ নড়ছে না কারও।
বিরাট একটি আমগাছ। তার পাশে মস্ত জানালা। ভেতরে বিশাল এক ঘর। ঘরের ভেতরটি ঝকঝকে পাথরের তৈরি মূর্তি দিয়ে সাজানো। চন্দনকাঠের আসবাব, সোনা-রুপোর কাজ করা বিশাল পালঙ্কের ওপরে মলমলের চাদর, দেওয়ালে দেওয়ালগিরি। আর জানালার গরাদে গাল ঠেকিয়ে বসে আছেন আশ্চর্য সুন্দরী এক মহিলা। তাঁর পরনে দামি শাড়ি, প্রচুর গয়না। কিন্তু মুখে গভীর বিষাদের ছাপ। চুলে তেল বা চিরুনি পড়েনি কতদিন। চোখের কোলে শুকিয়ে আছে জলের চিহ্ন।
“তুমি ওঁর পাশে যাও গবাই। হাতে হাত রাখো। উনি তোমাকে দেখতে পাবেন। জানিও, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তাই করল গবাই। যেন চোখ মেলেই ঘুমোচ্ছিলেন রানিমা। জেগে উঠলেন। তাকে দেখে ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসলেন। দু-চোখে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কে? মহলে কী করে প্রবেশ করলে? এই প্রহরী…”
“ভয় পাবেন না রানিমা।” নরম গলায় বলল গবাই।— “কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। রাজামশাই, রাজকুমারী সবাই ফিরে আসবেন।”
“তবে কি রাজকুমারীর সন্ধান পাওয়া গেছে?” রানিমার চোখে আশার আলো ফুটে উঠল।— “মহারাজ কি তাকে নিয়েছে ফিরে আসছেন? দুষ্ট জাদুকরকে পরাস্ত করেছেন মহারাজ?”
“এখনও ওসব কিছু হয়নি। তবে হয়ে যাবে। আমি রাজকুমারীদিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব।”
“তুমি!” বড়ো করে একটা শ্বাস নিলেন রানিমা।— “তুমি কী উপায়ে এই কক্ষে প্রহরীদের চোখকে এড়িয়ে প্রবেশ করলে জানি না। হয়তো তুমিও এক জাদুকর। কিন্তু তুমি বয়সে অত্যন্ত নবীন। জাদুকর মৃত্যুঞ্জয়কে পরাস্ত করতে পারবে না। অথবা তুমি কি আমার সঙ্গে ছলনা করতে এসেছ?” রানিমার চোখে অবিশ্বাস আর সন্দেহ।
গবাই মাথা নেড়ে বলল, “না, রানিমা। এই দেখুন রাজামশাইয়ের মুকুট, সোনার থলে। এগুলি আপনার কাছে রাখুন।”
“ওসব নিয়ে আমার কী হবে? আমি চাই আমার কন্যা আর স্বামী আমার কাছে প্রত্যাবর্তন করুন। হে ভগবান! তাঁরা এখন কী অবস্থায় আছেন কে জানে!” মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ফেললেন রানি।
“তাঁরা ভালো আছেন। আর কথা দিচ্ছি, খুব তাড়াতাড়ি তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে আসব। আমার সঙ্গে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একজন জাদুকর আছেন। তিনি সহায়তা করবেন আমায়। আপনি চিন্তা করবেন না।”
“পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকর? কই তিনি?” রানিমা গবাইয়ের দিকে অবাক চোখে তাকালেন।
“তাঁকে আপনি দেখতে পাবেন না। তবে আমার পাশেই আছেন তিনি।” গবাই একটু হাসল।— “আপনাকে এই খবরটুকু দিতেই আসা। এবার আমরা যাই? ধৈর্য রাখুন, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
॥ এগারো॥
শেষ রাতের দিকে দারুণ জোরে বৃষ্টি নেমেছিল। অনেকক্ষণ ধরে হাওয়াও বয়েছে। গত ক’দিন ধরে গরম পড়েছিল খুব, আর গাছের একটা পাতাও নড়ছিল না। এক ধাক্কায় গরম অনেকটা কমে যাওয়ায় ঘুমটা বেশ গাঢ় হয়েছিল রঘুর। সেটা ভাঙল প্রবল ধাক্কাধাক্কিতে। চোখ কচলে উঠে বসেই থ হয়ে গেল সে। প্রায় চার-পাঁচজন পুলিশ তার ভাঙা খাট ঘিরে রেখেছে। একটু দূরে ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে।
যাকে বলে আইন ভাঙা, তেমন কিছু তো করেনি সে। বুকটা ঢিবঢিব করছিল তার। তবুও মাথায় খুব জোর দিয়ে গত কয়েকদিনে নিজের সমস্ত আচরণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করল রঘু। উঁহু, পুলিশ ধরে নিয়ে যেতে পারে এমন কিছুর কথা তো মনে পড়ছে না!
ঠিক তখনই তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দশাসই পুলিশটি নিজের মোটা গোঁফে একবার তা দিয়ে অত্যন্ত বিনম্র ভঙ্গিতে বলল, “আপনি উঠুন। আপনাকে একবার যেতে হবে।”
“কো-কোথায়?”
রঘুর বুকে যেন ঢাক বাজছে তখন। কী করেছে সে? মনে পড়ছে না কেন? পুলিশ যদি তাকে জেলে ঢোকায় তবে তার বউ-বাচ্চাগুলোর কী হবে? তাছাড়া জেলের ভেতরে খাবারদাবারের অবস্থা খুব খারাপ। শুতেও দেয় কুটকুটে কম্বলে। সে কখনও সেখানে না গেলেও শুনেছে।
তবে সেই পুলিশটি তাকে অনেকটা ভরসা দিয়েই বিনীত ভঙ্গিতে বলল, “আমাদের এসপি সাহেব আপনার নাম শুনেছেন। অত্যন্ত গোপনীয় একটা ব্যাপারে তিনি আপনার সাহায্য চেয়েছেন। আপনি কাইন্ডলি একটু তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন।”
শুনে ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল তার। তাকিয়ে দেখল, তার বউ আর ছেলের মুখেও যেন অনেকটা স্বস্তির ভাব। মেয়েটা অতশত বোঝে না। সাতসকালে অতগুলো মুশকো লোককে ঘরে ঢুকতে দেখে সে কেঁদেই আকুল। তখন একটা পুলিশই তার হাতে কোথা থেকে একটা মস্ত চকোলেট এনে ধরিয়ে দিল।
দাঁতন করে, চোখে-মুখে জল দিয়ে রঘু তার সবচেয়ে ভালো পাঞ্জাবিটা, যেটার মাত্র এক জায়গায় ছেঁড়া, সেটা পরে পুলিশের জিপে গিয়ে উঠল। ইচ্ছে ছিল একটু ছাতু-মুড়ি খেয়ে নেয়। কিন্তু পুলিশই বলল, তাতে দেরি হয়ে যাবে অনেক। তাছাড়া ওখানে চা-নাস্তার বন্দোবস্ত আছে। পাড়ার লোক ততক্ষণে একেবারে জিপ ঘিরে ধরেছে। অনেকেরই ধারণা রঘু নিশ্চয়ই চুরি-জোচ্চুরি কিছু করেছে। তাছাড়া এত তাড়াতাড়ি তার অবস্থার এমন উন্নতি হল কী করে? ওসব জ্যোতিষ-টোতিষ সব ফালতু কথা।
রঘু আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, তার মেয়ে তার সঙ্গে ওই জিপে চড়ে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছে। ছেলেটা গাড়ির পাশের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কাঁটাতারের মতো চুলগুলি আঁচড়ে নিচ্ছে। সঙ্গে তার বয়সি আরও অনেকগুলি ছেলে। ওদিকে বউ সবাইকে গিয়ে গিয়ে ফলাও করে বলছে, কত বড়ো একজন পুলিশ সাহেব তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করবার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছে। সে-সব শুনে অনেকে আবার আড়ালে মুখ বেঁকাচ্ছে।
তার দু-পাশে দুজন পুলিশ এসে বসল। স্টার্ট নিল জিপটা। সামনের সিটে বসে থাকা পুলিশ অফিসারটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন, “হরিবল প্লেস!”
কথাটার মানে বুঝল না রঘু।
বিরাট একটা নীল-সাদা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড় করানো হল গাড়িটা। চত্বরটা পুলিশে পুলিশে একেবারে ছয়লাপ। তার সঙ্গে আসা দুজন পুলিশ তাকে নিয়ে একটা লিফটে উঠল। তারপর বিরাট বড়ো একটা এসি ঘরে একটা চেয়ারে রঘুকে বসিয়ে তারা বিদায় নিল। একটু পরেই সাদা রঙের কাগজের গ্লাসে তার জন্য চলে এল কোল্ড ড্রিংক, সঙ্গে একটি প্লেটে প্রচুর কাটা ফল, মিষ্টি। সে-সব গোগ্রাসে খেল রঘু। চুমুক দিল গ্লাসে। তারপর চারদিকে তাকিয়ে দেখল। সে গরিব হতে পারে, বোকা নয়। বুঝতে পারল, এটা একটা মিটিংয়ের ঘর। বড়ো পুলিশ সাহেবের ঘর হতে পারে। কোনও কারণে খুব ঠেলায় পড়ে গিয়েছেন তিনি। তাই তাকে এখানে আনা হয়েছে। আর সেজন্যই এত খাতিরযত্ন।
পেট ভরে খাওয়ার জন্য বুকের ভেতর থেকে বেশ বড়ো একটা ঢেকুর উঠে এল রঘুর। কোনোক্রমে সেটাকে আটকাল সে। এসি ঘরে কি ঢেকুর তোলা যায়? তার জানা নেই। বিশেষত এটা পুলিশ সাহেবদের অফিস। কোনও অপরাধ হলেই সোজা জেলে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দিতে পারে।
বসে বসে এইসব আকাশপাতাল ভাবছে, এমন সময় হঠাৎ মিটিং-হলের দরজাটা খুলে গেল। গাঢ় খাকি রঙের পুলিশি পোশাক পরা একজন ফর্সা, লম্বা, মাঝবয়সি মানুষ ঢুকলেন। তাঁর দু-পাশে আরও দুজন পুলিশ অফিসার। সকলেরই বেল্ট থেকে রিভলভারের খাপ ঝুলতে দেখা যাচ্ছে। পেছনে আরও জনা-পাঁচেক রাইফেলধারী পুলিশ। তাদের পোশাকের রঙ অপেক্ষাকৃত হালকা। তারা দরজাটা বন্ধ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল। কাছে এল না। কাছে এলেন প্রথমের তিনজন। এসে রঘুর টেবিলের উলটোদিকে পরপর তিনটে চেয়ারে পাশাপাশি বসলেন।
হাতজোড় করে উঠে দাঁড়িয়েছিল রঘু। আর বসেনি। বুকটা ঢিবঢিব করছিল তার। তখনই ডানদিকের চেয়ারে বসে থাকা অল্পবয়স্ক পুলিশ অফিসারটি, যাঁর ফর্সা কপালে একটা লালচে কাটা দাগ, তিনি ভুরু কুঁচকে তাকে ধমকের ভঙ্গিতে বললেন, “বসে পড়ুন।”
“আহা!” হাত সামান্য তুলে তাকে থামালেন মাঝের অফিসারটি। বাকিদের আচরণ দেখেই বোঝা যায়, ইনিই পালের গোদা। ইয়ে, মানে বাকিদের বস। টেবিলের ওপরে নিজের হাত দুটো রেখে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে এলেন তিনি। নীচু গলায় বললেন, “আপনিই রঘু পন্ডিত?”
নিজের কাঁপতে থাকা বুকটাকে কোনোরকমে সামলে, একটা ঢোঁক গিলে রঘু বলল, “হুঁ।”
“আমরা খুব মুশকিলে পড়ে গেছি। অনেকের কাছে আপনার নাম শুনলাম। তাই সাহায্যের জন্য আপনাকে তুলে এনেছি। কোনও অসুবিধে হয়নি তো?”
নিজেকে সামলে নিতে নিতে রঘু বলল, “নাহ্, এহ্, কিহি যেঃ বঃ!”
আসলে সে বলতে চেয়েছিল, ‘না। কী যে বলেন!’ কিন্তু যথেষ্ট ঘাবড়ে যাওয়ায় কথাগুলো ওরকম বেরোচ্ছে।
“তাহলে আমাদের সাহায্য করবেন তো? প্লিজ?” খুব বিনয়ী আর নম্রভাবে পুলিশ অফিসারটি বললেন।
বাঁদিকের বেয়াড়া অফিসারটি তক্ষুনি চোখ পাকিয়ে বললেন, “এসপি সাহেব কী বলছেন ঠিক করে শুনে নিন। যদি লোকটাকে খুঁজে পান তো ঠিক আছে। নইলে…” বলেই তিনি দাঁত কিড়মিড় করলেন।
মাঝের মানুষটিই সম্ভবত এসপি। তিনি মৃদু বকুনির ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, “আহ্, অরিন্দম! তোমরা সব মাটি করবে দেখছি। ওঁকে আগে বুঝিয়ে বলতে দাও ব্যাপারটা।”
রঘু আড়চোখে দেখল, বাঁদিকের অফিসার দাঁত কিড়মিড় করছেন। ডানদিকের জন তার দিকে হিমশীতল চোখে তাকিয়ে। আর এসপি সাহেবের দুই হাতের আটটা আঙুলে নানান পাথর বসানো আংটি।
সে লোক চরিয়ে খায়। চট করে বুঝে ফেলল, এসপি সাহেব সত্যিকারের ভদ্রলোক। জ্যোতিষ-টোতিষে দারুণ বিশ্বাস। কোনও লোককে ধরতে পারছেন না বলে তার দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু সেটা দুইপাশে জাম্বুবানের মতো বসে থাকা বাকি পুলিশ অফিসারেরা পছন্দ করছেন না। নিজেকে তৈরি করে নিয়ে সে একবার গলা ঝাড়া দিয়ে বলল, “সার, ব্যাপারটা আমাকে একটু খুলে বলবেন?”
“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই!” বলে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন এসপি সাহেব। তারপর আরও একটু সামনে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন, “আমরা খুব বড়ো একটা মুশকিলে পড়ে গিয়েছি। কথাটা যেন পাঁচকান না হয়, কেমন?”
আড়চোখে বাকি দুজন পুলিশ অফিসারের দিকে তাকাল রঘু। তারা এখনও অত্যন্ত কড়া চোখে তার দিকেই তাকিয়ে। গলা শুকিয়ে এল তার। একটা শ্বাস ফেলে সে বলল, “হুঁ।”
“কয়েকদিন আগেই একটা জায়গায় রেইড করতে গিয়ে ভারি খতরনাক একজন অপরাধীকে আমরা ধরেছিলাম। বিনোদ নাম তার। লোকটার নামে গোটা দশেক খুনের কেস আছে। ব্যাংক ডাকাতি, জালিয়াতি, নানান রকম অপরাধে সে যুক্ত। তার কাছ থেকে অনেক খবর বের করার ছিল বলে ব্যাপারটা গোপন রাখা হয়েছিল। কেবল উঁচুতলার অফিসাররা জানতেন, আর আমার এই দুজন সহকারী। আমাদের এই অফিসের নীচেই একটা গারদওলা সেল আছে, সেখানেই তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরশু রাতে সে-ব্যাটা গারদের তালা খুলে পালিয়েছে। বিশেষ গোপনীয়তার জন্য ওখানে সিসিটিভি লাগানো হয়নি। তাকে যদি না পাওয়া যায় তবে আমি গাল তো খাবই, প্রোমোশনটাও আটকে যাবে। এখন আপনিই একমাত্র ভরসা।” ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এসপি।
রঘুর তো মাথায় হাত। সে টেবিলের তলাতেই নিজের হাত দুটো কচলে বলল, “সার, আমি এই ব্যাপারটাতে কী করব যদি বলেন!”
“কী করবেন মানে?” ডানদিকের পুলিশটি রুখে উঠলেন।— “সবাই বলছে, আপনি নাকি ত্রিকালজ্ঞ। সব দেখতে পান। লোকটা কোথায় গেল, কোথায় গিয়ে উঠেছে, কে তাকে পালাতে সাহায্য করল, সব যদি না বের করতে পারেন তবে আপনারও ব্যবস্থা হবে।”
“ছি ছি, মাধব! ভদ্রলোককে ওরকমভাবে বোলো না।” এসপি মৃদু স্বরে তাঁর সহকারীকে বকুনি দিলেন একটু।
কিন্তু ততক্ষণে রঘুর বুকের ভেতরে যেন ঢাক বাজতে শুরু করেছে। কাল রাতে কার মুখ দেখে যে শুতে গিয়েছিল সে! আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল তো! সে মিনমিন করে বলল, “সার, গারদটা একবার দেখা যায়?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ! নিশ্চয়ই। এই মাধব, তুমি ভদ্রলোককে একবার সেলটার কাছে নিয়ে যাও না।”
অমন ঝাঁ-চকচকে অফিসটার পেছন দিকটা জঞ্জালে ভরতি। পুরোনো রঙচটা গাড়ি, বাইক, ঝোপ, লোহালক্কড়, এমনকি সার সার কাঠের গুঁড়ি— এমনসব জিনিস ডাঁই করা আছে। আসলে সবই চোরাই মাল। পুলিশ গিয়ে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। বছরের পর বছর সেগুলি জমে থাকে অফিসের এইখানটাতেই। কয়েকটি গাড়িতে তো রীতিমতো গাছ গজিয়ে গেছে।
সে-সবের মাঝখান দিয়ে ঝোপজঙ্গল ভেদ করে একটি সরু পায়ে চলা পথ ধরে রঘু, সেই রগচটা পুলিশ অফিসারটি, আর একজন গানম্যান গিয়ে দাঁড়াল ভাঙাচোরা একটি বিল্ডিংয়ের সামনে। এখানটা একেবারে নির্জন। কোনও লোকজনের মুখ দেখা গেল না। ভাঙা কাঠের একটা দরজা পার করে লম্বা, অন্ধকার একটা করিডোর। একটু এগিয়েই দু-পাশে দুই দুই মোট চারটি লোহার মোটা মোটা গরাদযুক্ত ঘর। গরাদগুলোর গায়ে একটা করে ছোটো লোহার গেট। তার গায়ে তালাচাবি লাগানোর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আলোর ব্যবস্থা নেই। জানালাও নেই।
মাধব নামের টেঁটিয়া পুলিশ অফিসারটি তাঁর হাতের শক্তপোক্ত লম্বা টর্চটি জ্বালিয়ে একটি সেলের ভেতর আলো ফেলে কড়া গলায় বললেন, “এখানেই ছিল সে। কী দেখবেন, দেখে নিন।”
আসার পথেই পকেটে হাত ভরে রঘু আংটিটা বের করে নিয়েছিল। এবার ঈশ্বরের নাম করে বাকি দুজনের আড়ালে সেটা বাঁহাতের বুড়ো আঙুলে গলিয়ে নিল।
জিনিসটা আঙুলে পরার সঙ্গে সঙ্গে গায়ে একটা শিহরন খেলে যায়। একটু বমি বমি ভাব, পায়ের তলার মাটি দুলে ওঠে কিছুক্ষণের জন্য। তারপর সব ঝাপসা হয়ে আবার পরিষ্কার হয়ে যায়। তখনই চারপাশে নানারকমের অদ্ভুত জীব দেখতে পায় রঘু।
আজকেও সে-সব হল। তবে অদ্ভুত জীব নয়, রঘু প্রথমেই দেখতে পেল সেলের ভেতরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা, কালো একজন লোক। কাঠির মতো দুই হাত বুকের ওপরে আড়াআড়ি ভাঁজ করে রাখা। মাথায় চুল নেই, তবে মস্ত একটা টিকি। পরনে ময়লা ধুতি। আর খোলা বুকের বাঁদিক থেকে ডানদিকে তেলচিটে একটা পৈতে ঝুলছে।
খুব জোরে চমকে উঠল সে। বুক ধড়াস ধড়াস করছে। শ্বাস নিতেও পারছে না রঘু। কারণ লোকটাকে সে চেনে। তার গুরু নিবারণ সমাজপতি। কিন্তু তিনি তো বেশ কয়েক বছর হল দেহরক্ষা করেছেন!
সবে সে অজ্ঞান হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় নিবারণ সমাজপতি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীর গলায় হুংকার দিয়ে উঠলেন, “খবর্দার রঘু, এখন ওসব মুচ্ছো-টুচ্ছো যাওয়া চলবে না!”
কোনোরকমে হাতজোড় করে রঘু বলল, “চোখের সামনে পষ্ট আপনাকে দেখছি, মুচ্ছো না গিয়ে কী করি বলুন তো?”
“ওরে হতভাগা, আমি কি ভূত, না রাক্ষস যে আমাকে দেখে ভিরমি খাবি? কতদিন হাতে ধরে তোকে জ্যোতিষ শিখিয়েছি। এখন আমাকে দেখেই ভয় পাচ্ছিস?”
“আজ্ঞে, আপনি যে মারা গেছেন!” প্রাণপণে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করতে করতে রঘু বলল।
তাতে নিবারণ সমাজপতি আরও তেতে উঠে বললেন, “তাতে কী হয়েছে?”
“আজ্ঞে, মরে যাওয়া লোককে আবার চোখের সামনে দেখলেই তো লোকে ভূত বলে চেঁচায়!”
এবার নিবারণ ব্যাপারটা বুঝলেন। অস্ফুটে বললেন, “তাই তো!”
এদিকে মাধব নামের পুলিশ অফিসারটি এতক্ষণ তাকে লক্ষ করছিল। সে হঠাৎই ধমকে উঠে বলল, “নিজের মনে কী বিড়বিড় করছেন মশাই!”
রঘুর হুঁশ ফিরে এল। সে প্রাণপণে তার ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে যাওয়া মুখ নিবারণের দিক থেকে মাধবের দিকে ফিরিয়ে ফ্যাকাসে একটা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে গালটা একটু চুলকে নিয়ে বলল, “ওই আর কী! একজন চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।”
“চেনা লোক? কই তোমার চেনা লোক? কাউকে তো দেখছি না!” চারদিকে তাকিয়ে অবাক গলায় বললেন মাধব।
তাঁর সঙ্গে যে গানম্যানটি ছিল সেও রঘুর কথা শুনে একটু ভয় পেয়েছে বলে বোঝা গেল। একটু ঘেঁষে এল অফিসারের দিকে। রঘু বুঝল, তার ভুল হয়েছে। একটু সতর্ক থাকতে হবে।
কিন্তু নিবারণ কি সতর্ক থাকতে দেবেন! ওদিক থেকে হাত নেড়ে বললেন, “তোর হাতে ওটা কীসের আংটি দেখছি?”
“ওটা আমাকে দিয়েছে একজন। তার চিকিচ্ছে করেছিলাম।”
কথা বলব না বলব না করেও উত্তরটা দিল রঘু। নইলে অস্বস্তি হচ্ছিল। যতই হোক, নিবারণ তার গুরুস্থানীয় ব্যক্তি।
জবাবে নিবারণ চোখগুলো অবিকল পেঁচার মতো পালটিয়ে গলার আওয়াজ আরও উঁচু করে বললেন, “হাসাসনি রঘু। তুই আবার চিকিচ্ছে কার করলি! বলি, পড়াশোনাটাও তো শিখলি না। মিথ্যে বলতে যদিও শিখেছিস দেখছি।”
“আজ্ঞে, আপনিও জানেন, আমিও জানি। পেশাটাই হল মিছে কথা বলার। তবে এতক্ষণ যেটা বললাম, সেটা মিথ্যে নয়। সত্যি-সত্যিই একজনকে বাঁচিয়েছি। তার বদলে সে এইটে দিয়েছে। কিন্তু এসব অতি গুহ্য কথা, হাটের মাঝে বলবার মতো নয়।”
গতবছর ভুবনডাঙার মাঠে যাত্রাপালা হয়েছিল ‘অন্ধ কারাগারে যশোদাদুলাল’। সেই পালার কংসের মতো হা-হা-হা করে রক্তজল করা একটা হাসি দিলেন নিবারণ। বললেন, “তুই কুলাঙ্গার, তাই জ্যোতিষকে মিথ্যে বলছিস। আর ভেবেছিস কী, আমি কিছু জানি না? ওরে সব জানি। আমি ত্রিকালজ্ঞ। নেহাত কলিযুগ, আর তুই আমার শিষ্য, তাই বেঁচে গেলি। ওটা তোকে দিয়েছে ও-পারের লোকজন। আংটিটা পরলেই ভবিষ্যৎ দেখা যায়। ছি ছি! শেষে ভবিষ্যৎ বিচারের জন্য তোকে যন্ত্র ব্যবহার করতে হচ্ছে? এই আমাকে দেখ! লোকের কপালের দিকে তাকিয়ে তার ভবিষ্যৎ বলে দিয়েছি বরাবর। একবারও ভুল হয়নি।”
আস্তে আস্তে মাথা গরম হচ্ছিল রঘুর। নিবারণ সমাজপতি যতই তার গুরু হোন, একজন ভূতের কাছ থেকে কটুকাটব্য সহ্য করা যায় না। তাই পাশ থেকে দুজন গোল গোল চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকা সত্ত্বেও সে দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল, “আপনার ভবিষ্যৎ বাণীর কথা আর বলবেন না। দশটা কথা বলতেন, একটা লাগত কি লাগত না। এই সেদিনই বটতলা বাজারে মিত্তিরবুড়োর সঙ্গে দেখা। তিনি প্রথমেই আমাকে বললেন, ‘তুই সেই নিবারণ চোরের কাছে ঘুরঘুর করতিস না? ব্যাটা এক নম্বরের জালিয়াত ছিল।’ শুনে লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল।”
“কে? পানু মিত্তির?” হুংকার দিয়ে উঠলেন নিবারণ।— “সে-ব্যাটা আবার জানে কী? খুব হিংসে করত আমাকে, ছোটোবেলা থেকেই। যত বড়ো বড়ো কথা! আমি জালিয়াত? বাটপাড়? আমার কথা মেলে না? এই দেখ, আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি। আর ঠিক আধঘণ্টার মধ্যে তোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশটার বউয়ের পিছলে পড়ে হাত ভাঙবে। দেখে নিস, মেলে কি না!”
“কোন পুলিশটার বউ? ওই ধুমসোমতোটা, নাকি আমার বাঁদিকের ফর্সা অফিসারটির বউ? কার হাত ভাঙবে?” স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গলা চড়িয়ে প্রশ্নটা করল রঘু।
জবাবে নিবারণ মুখ বেঁকিয়ে বললেন, “ধুমসোটারই। কিন্তু ফর্সা আবার কোনটা রে? হুঁহ্, বলে কিনা ফর্সা! ওরে ফর্সা ছিলাম আমি! ওকে বড়োজোর উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলা যায়। নাকি নিজেকে দিয়ে মাপ করছিস? তাহলে তো দাঁড়কাক ছাড়া সবাইকেই তোর ফর্সা বলে মনে হবে! আহা, আমার ছোটোবেলায় তুই যদি আমাকে দেখতিস। সবাই বলত, মায়ের কোল আলো করে এ কোন সোনার গৌরাঙ্গ যে নেমে এল!”
“যত সব ফালতু কথা আপনার। হচ্ছিল জ্যোতিষের কথা, হুট করে মাঝখানে নিজের গায়ের রঙ টেনে আনলেন।”
আরও চেঁচাতে যাচ্ছিল রঘু। ঠিক তক্ষুনি মাধব নামের পুলিশ অফিসারটি তার হাত ধরে টানলেন। শুকনো মুখে বললেন, “কার বউয়ের হাত ভেঙে যাবে বললেন? আমার বউয়ের?”
রঘু বুঝতে পারল উত্তেজনার বশে সে সবকথা খুব জোরে বলে ফেলেছে। সবে জিভ কেটে ব্যাপারটা সামলে নিতে যাচ্ছিল, গানম্যানের মোবাইল বেজে উঠল। সে উদ্বিগ্ন মুখে ফোনটা ধরে বলল, “হ্যালো!” তারপরেই তার গলা উঁচুতে চড়ে গেল।— “কী হয়েছে? পড়ে গেছ? হাত ভেঙেছে? ও, ভাঙেনি, একটু ছড়ে গেছে!”
একটু পরে কলটা কেটে সে একটা হাঁপ ছেড়ে বলল, “যাক বাবা, ফাঁড়াটা কেটেছে। গিন্নি বললেন, পা পিছলে পড়তে পড়তে সামলে নিয়েছেন। খালি ডানহাতটা একটু ঘষে গেছে চৌবাচ্চার গায়ে।” তারপরেই অভিমানের চোখে রঘুর দিকে তাকিয়ে সে বলল, “তা বলে আপনি আমায় ধুমসো বলবেন!”
মাধব ততক্ষণে ঘাবড়ে গিয়ে রঘুর হাত ছেড়ে দিয়েছেন। বার বার উদ্বিগ্ন মুখে নিজের মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছেন। রঘু তাঁকে আশ্বস্ত করে বলল, “আপনার কোনও চিন্তা নেই। ওঁর কথাই হচ্ছিল।”
“আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই!” বলে কপালের ঘাম মুছলেন তিনি।
রঘু থানা থেকে পায়ে হেঁটেই বেরিয়ে এল। ফেরত যাওয়ার সময় পুলিশ আর গাড়ির বন্দোবস্ত করেনি। তা একদিকে ভালোই হয়েছে। রঘুর মতো লোকদের আবার ঘাড়ে পুলিশ নিয়ে গাড়িতে চাপলে দম বন্ধ হয়ে আসে।
বাইরে বেরিয়েই সে দেখতে পেল নিবারণও তার পাশে পাশে মাথা নীচু করে হাঁটছেন। সে ব্যঙ্গের সুরে বলল, “দেখলাম আপনার জ্যোতিষ বিদ্যা। সামান্য পিছলে গেছে, সেটাকেও বিরাট বড়ো করে দেখাবার চেষ্টা করছিলেন। বললেন কিনা হাত ভেঙে যাবে! ফুহ্! ভাবতেই লজ্জা করে আপনার কাছে হস্তবিচার শিখতে গিয়েছিলাম। ছ্যা ছ্যা!”
বুকভাঙা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল নিবারণের বুক থেকে। অবশ্য হাওয়া-টাওয়া কিছু বেরোল না। কেবল তাঁর মুখটা হাঁ হয়ে ফের বন্ধ হয়ে গেল। দুঃখিত মুখে তিনি বললেন, “অনেকটা মিলিয়ে দিয়েছিলুম। আসলে বয়সও হয়েছে, মারাও গেছি। সবসময় দিব্যজ্ঞানটা কাজ করে না।”
“দিব্যজ্ঞান? সে আবার কবে ছিল আপনার?”
“ব্যঙ্গ করছিস কর। তোরই এখন সময়। তবে বলে যাই রঘু, ওই যে যন্তর তুই হাতে লাগিয়েছিস তা তোর বিপদ ডেকে নিয়ে আসবে। ওর থেকে পাথর, কবচ, তাবিজ অনেক ভালো জিনিস। পারিস তো ওটাকে আঙুল থেকে খুলে ছুড়ে ফেলে দে। খোদার ওপর খোদকারি ভালো নয়।”
রঘু স্পষ্ট দেখল, কথা বলতে বলতেই ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে নিবারণ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। একটা হাঁপ ছাড়ল সে। যে যাই বলুক, ভূতের সঙ্গে একসঙ্গে পথ চলতে হাড় হিম হয়ে আসে। তা তিনি যতই পূর্বপরিচিত হোন না কেন!
কিন্তু তার কপালে স্বস্তি এল কই? রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে যতদূর তাকায় ঝাপসা সব মূর্তি দেখতে পাচ্ছে সে। এমনকি রাস্তার পাশে বড়ো বড়ো গাছগুলির ডালে, গুঁড়িতে কাঁঠালের মতো সব বীভৎস ভূত ফলে আছে। বাস, ট্রাক, মোটরবাইক, সাধারণ মানুষ তো আছেই, সঙ্গে এরা হল বাড়তি। যেতে যেতে বেশ কয়েকটা কালো-কেলো মূর্তির সঙ্গে তার ধাক্কাও লাগল। অবশ্য ব্যথা-ট্যথা কিছু হল না। বায়বীয় দেহ কিনা! তবে তারা মুলোর মতো দাঁত বের করে যখন তার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যের হাসি হাসল, পিলে চমকে গেল রঘুর। হে ভগবান! এ কী বিপদ নেমে এল! এরা কি সকলেই ভূত নাকি?
পাঁই পাঁই করে দৌড় শুরু করেছিল রঘু। যদিও বয়স হয়েছে, পায়ে তেমন জোর নেই। বুকেও হাঁপ ধরে যাচ্ছে অল্পতেই। তাই পাঁই পাঁই দৌড় বললেও তেমন গতি ছিল না তার। তাছাড়া একটু পরেই তার ডান পায়ের চপ্পলের ফিতেটা ছিঁড়ে গেল। হাঁপাতে-হাঁপাতেই রাস্তার একপাশে সরে এসে একটা লোহার তারজাতীয় কিছু খুঁজতে লাগল সে। তাহলে ফিতেটা জোড়া দেওয়া যায়।
ঠিক তখনই পেছন থেকে গম্ভীর গলায় কে যেন বলে উঠল, “তুই রঘু না?”
ফিরে তাকিয়ে বুকটা ধড়াস করে উঠল একবার। না না, কোনও অদ্ভুত মূর্তি-টুর্তি নয়। সে-সব আস্তে আস্তে গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে তার। কিন্তু সাদা জামা আর ময়লা সাদা ধুতি পরা এ চেহারাটি তার অত্যন্ত পরিচিত। ইনি তো তার ছোটোবেলার ইস্কুলের মাস্টারমশাই তারাপদ চক্কোত্তি। দারুণ মারকুটে ছিলেন। বিশেষ করে রঘুর প্রতি তাঁর বিশেষ পক্ষপাতিত্ব ছিল। রোজ সকালে ইস্কুলে এসেই তার খোঁজ করতেন মাস্টারমশাই। পড়া ধরতেন, আর বলাই বাহুল্য, সে পারত না। সেই কারণে এবং নানান অকারণেও তাকে কান ধরে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে দিতেন তারাপদ চক্কোত্তি।
চপ্পল-সমেতই হাতজোড় করে রঘু তাঁকে প্রণাম জানাবার চেষ্টা করে বলল, “হ্যাঁ, মাস্টারমশাই। আমি রঘুই। আপনি ভালো আছেন?”
“গর্দভ কোথাকার!” গর্জন করে উঠলেন তারাপদ।— “এত বড়ো হলি, এখনও বেয়াদবই রয়ে গেছিস। উল্লুক! ছেঁড়া চটিটা আমার মুখের কাছে তুলে আনলি একেবারে!”
“ভুল হয়ে গেছে মাস্টারমশাই। ইচ্ছে করে করিনি। চটিটা ছিঁড়ে গেছে, তাই দেখছিলুম যদি...” মিনমিন করে বলল সে।
মাস্টারমশাইয়ের বরাবর বদগুণ ছিল মারাত্মক চেঁচিয়ে বা গর্জন না করে কথা বলতে পারতেন না। এখনও তিনি অকারণেই গর্জন করে উঠলেন, “ভুল হয়ে গেছে? বেয়াদব! কই, কানটা দেখি তোর।”
মাস্টারমশাই তাকে আর মুক্তি দেবেন না। ইস্, এ সময় কেউ এসে যদি তাঁকে থামাতে পারত, কত ভালোই না হত। একটা শ্বাস ফেলে রঘু ঘাড় কাত করে কানটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছিল, এমন সময় অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটল। কোথা থেকে একজন মাঝবয়সি বিশালদেহী পুরুষ তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মাথায় রঘুর প্রায় দেড়গুণ। সেখানে সোনার একটা মস্ত মুকুট থাকায় তাঁকে আরও লম্বা লাগছে। কাঁচাপাকা বিশাল গোঁফ, বিরাট বুক, শাল গাছের গুঁড়ির মতো হাত-পা। মিহি সোনার সুতোর কাজ করা মলমলের পাঞ্জাবি আর মালকোঁচা মারা ধুতি পরনে। কানে কুণ্ডল, গলায় মোটা মোটা সোনার হার। হাতে মস্ত বড়ো ঝকঝকে একখানা তরোয়াল। তরোয়ালখানা উঁচিয়ে সোজা তারাপদর দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে জলদগম্ভীর গলায় তিনি বললেন, “দরিদ্র ব্যক্তির ওপরে অত্যাচার করছ কেন?”
রঘু তো চমকে গিয়েছিলই, তার দোর্দণ্ডপ্রতাপ মাস্টারমশাইও সেই হুংকারের সামনে যেন কুঁকড়ে গেলেন। মুখ শুকিয়ে গেছে তাঁর। ভয়ে ভয়ে একবার তরোয়ালটির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেটে তিনি বললেন, “অত্যাচার করিনি স্যার। আমার ছাত্র। বেয়াদবি করছিল, তাই...”
“নীরব রও দুর্জন!” বাঘের মতো কণ্ঠস্বরে আবার গর্জন করে উঠলেন সেই ব্যক্তি।— “তোমার এত সাহস মহারাজ বিক্রমপ্রতাপের সম্মুখে বাক্যবিনিময়ের স্পর্ধা দেখাচ্ছ!”
“উনি অমনিই করেন রাজামশাই। সবসময় আমাদের নানান কটু কথা বলেন, বেঞ্চের ওপরে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এমনকি বেত দিয়ে আমাদের মারধোর করেন।”
সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটির আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দুটি ন’-দশ বছরের বাচ্চা। পরনে স্কুলের পোশাক। যদিও বেশ নোংরা। তাদের মধ্যে একজন মাস্টারমশাইয়ের দিকে আঙুল তুলে কচি গলায় অভিযোগ জানাচ্ছে। অন্যজন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রঘুর দিকে। মুখে মৃদু হাসি। দুজনকেই খুব চেনা চেনা লাগল রঘুর।
মহারাজ বিক্রমপ্রতাপ রক্তচোখে তাকালেন মাস্টারমশাইয়ের দিকে। তরোয়াল উঁচিয়ে দুই পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, “নিষ্পাপ বালকদিগের ওপরেও তুমি নিপীড়ন চালিয়ে থাকো? তোমাকে শূলিতে চড়াব।”
মহারাজ বিক্রমপ্রতাপ কে, তিনি হঠাৎ এখানে এসেছেন কেন, এসব নানান চিন্তা রঘুর মাথায় খেলছিল। বেচারি মাস্টারমশাইকে বাঁচানোও দরকার। কিন্তু তক্ষুনি সে তাকিয়ে দেখল মাস্টারমশাই চোঁ-চাঁ দৌড় লাগিয়েছেন। তাঁকে তাড়া করেছেন বিক্রমপ্রতাপ। বাচ্চা ছেলে দুটি মজা দেখবার জন্য চড়ে বসেছে সামনের গাছটাতে। তখন সে দুঃখিত মুখে ঘরের পথ ধরল। তার পক্ষে আর দৌড়নো সম্ভব নয়। এমনিতেই গা-হাত-পা ব্যথা করছে।
হাঁটতে হাঁটতে আরও অনেক চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হল তার। কী যেন একটা খটকা লাগছিল মনে। তার পরেই তার মনে পড়ল, তারাপদ চক্কোত্তি তো অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। আর যে বাচ্চা দুটি রাজামশাইয়ের কাছে অভিযোগ জানাচ্ছিল তারা অন্য কেউ নয়, সে আর তার দুষ্টুমির সঙ্গী পিন্টু! সেই ক্লাস ফাইভে পড়ার বয়সের। তারা দুজনেই জীবিত, ভূত নয়।
॥ বারো॥
নেহাত জরুরি প্রয়োজন না পড়লে রঘু আংটিটা পরে না। সেই লোকটি বলেই দিয়েছিল, মাত্র বারো বার ব্যবহার করা যাবে ওটা। কাজেই ভেবেচিন্তে ব্যবহার করাই ভালো।
কিন্তু আজ যা কাণ্ড হল, তারপর আর ওটা আঙুলে গলানোর সাহস হচ্ছিল না তার। সকালে উঠে পুলিশের ঝামেলা, তার ওপর অতটা পথ প্রায় দৌড়ে দৌড়ে ফেরত আসা। সব মিলিয়ে পরিশ্রমও কম হয়নি। কোনোরকমে দুপুরে দুটো ডাল-ভাত মুখে গুঁজে একটা ঘুম লাগিয়েছিল সে। মাঝে-মধ্যে শিউরে শিউরে উঠলেও চোখ লেগে গিয়েছিল একসময়। যখন উঠল তখন দিনের আলো ম্লান হয়ে এসেছে। রঘুর ছেলে বোধ হয় খেলতে বেরিয়েছে। ছোটো মেয়েটাকে নিয়ে তার মাও বেরিয়েছে বাইরে। চোখে-মুখে একটু জল দিয়ে, ভাঙা দরজাটা বাইরে থেকেই টেনে দিয়ে রঘু হাঁটা দিল তার প্রিয় জায়গা, সেই পোড়ো জমিটার দিকে।
পাড়ার লোকেরা তাকে দূর থেকে দেখছিল। সকালবেলা পুলিশের গাড়ি চেপে গেল যে লোকটা, তাকে কিছু না করেই পুলিশ আবার ছেড়েও দিয়েছে— এই ব্যাপারটা বোধ হয় পাড়ার লোক পছন্দ করেনি। নাহ্, এ-পাড়ার লোক খুব হিংসুটে। এখানটা ছেড়ে তাকে বেরোতেই হবে। মনে মনে ভাবছিল রঘু।
কিন্তু যাবেই-বা কী করে! তার অবস্থা সামান্য শুধরেছে বটে, তবে তেমন বলার মতোও কিছু নয়। অন্য জায়গায় ঘরবাড়ি করতে অনেক খরচ। তার ওপর সে এখানে আছে জন্ম থেকেই। একটা মায়া পড়ে গেছে। কিন্তু বাইরে না গেলে ছেলেটার পড়াশোনা সব উচ্ছন্নে যাবে। রোজ সকাল থেকে সন্ধে অবধি খালি খেলা আর খেলা। রঘু কিছু বললেও শোনে না।
এসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে সে একসময় ডোবাটা পার করে ন্যাড়া ক্ষেতের মাঝ দিয়ে হেঁটে পৌঁছে গেল ঢিবিটার কাছে। ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে বেশ। ইতিউতি ঝোপঝাড়ের ফাঁকে জোনাকির দেখা মিলতে শুরু করেছে।
ঢিবিটার ওপরে সবে সে গুছিয়ে বসেছে, কানের কাছে গলা খাঁকারির আওয়াজ পাওয়া গেল। মনে মনে এই গলা খাঁকারিটারই অপেক্ষায় ছিল রঘু। নড়েচড়ে বসল সে। মোলায়েম গলায় বলল, “আসুন। আপনারই অপেক্ষা করছি।”
“আমরাও স্যার। বলি, আমাদের ওষুধের ব্যাপারটা কিছু হল?” বুড়ো লোকটি বলল।
“কই আর হল!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রঘু।— “এতদিন দেখতে পেতাম আপনাদের সবাইকে। কিম্ভূতকিমাকার সব জীব। এখন দেখতে পাচ্ছি ভূত। আপনার দেওয়া আংটিটার মেজাজ-মর্জি বোঝা দায়।”
লোকটা জিভ দিয়ে বিরক্তিসূচক একটা টাক করে আওয়াজ করল। একটু রাগের গলাতেই বলল, “আপনি আমাদের কিম্ভূতকিমাকার বলছেন বটে, কিন্তু কথাটা মোটেই সম্মানসূচক নয়। আপনাদের দেখেও আমাদের অনেকের অদ্ভুত লাগে, তা বলে কি তারা আপনাদের এসে বলতে গেছে? যাই হোক, কই আপনার আংটিটা দেখি। কিছু গড়বড় হয়ে থাকলে মেরামত করে দেব।”
রঘু পকেট থেকে জিনিসটা বের করে লোকটার দিকে এগিয়ে দিল। সে অন্ধকারের মধ্যেই বেশ কিছুক্ষণ আংটিটা নেড়েচেড়ে দেখে কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “উঁহু! এ তো আমার দেওয়া নয়। এটা আলাদা জিনিস দেখছি!”
“মানে? এইটা আপনি আমাকে দেননি?”
লোকটা ঘাড় নেড়ে বলল, “না। আমাদের আংটিটায় আপনাদের ‘ব’ অক্ষরের মতো একটা চিহ্ন ছিল। এটাতে আছে স্বস্তিক চিহ্নের মতো একটা দাগ। এটা সেই আংটি হতেই পারে না।”
“বলেন কী? কিন্তু এটা সবসময় আমি লুকিয়ে রাখি। আমার জানামতে পালটাপালটির তো সুযোগ নেই।”
“তা বলতে পারব না। তবে নিশ্চিত করে বলতে পারি, এটা আমার দেওয়া আংটিটা নয়।” দৃঢ় গলায় বলল লোকটা। তারপরেই মিনতির সুরে বলল, “আর আমাদের ওষুধের বিষয়টা কি একটু দেখলেন স্যার? কালই আমাদের আরও দুজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আগের যারা অসুস্থ, তাদের মধ্যেও বেশ কয়েকজনের অবস্থা ভালো নয়। আপনিই আমাদের শেষ ভরসা।”
“কিন্তু আমি তো আপনাকে জলই খাইয়েছিলাম। আপনি বলছেন, জল আপনাদের সহ্য হয় না। তাহলে কী করি বলুন তো?” রীতিমতো হতাশার গলায় বলল রঘু।
জবাবে লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু, জল নয়। অন্য কিছু ছিল। আপনি একটু ভালো করে ভেবে দেখুন। আমাদের হাতে আর একদমই সময় নেই। একটু দেরি হলেই প্রচুর লোক মারা যাবে। দয়া করে আমাদের কথা একটু ভাবুন।”
বলতে-বলতেই লোকটার চেহারাটা কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যেন সে একটা কাচের তৈরি জীবন্ত পুতুল, যার মধ্যে নানান রঙের আলো এসে প্রতিফলিত হচ্ছে। ভেঙেচুরে যাচ্ছে তার চেহারা।
“বেশিক্ষণ আপনাদের চেহারা ধরে থাকলে নানানরকমের সমস্যা হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে খুব। থাকতে পারছি না। এবার আমাকে মুছে যেতে হবে।” ফ্যাসফেসে গলায় বলল লোকটা।
তার কণ্ঠস্বরেই বুঝতে পারা যাচ্ছে, যন্ত্রণা হচ্ছে তার। রঘু উঠে দাঁড়াল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মুছে যাবেন?”
“হ্যাঁ, পরে আবার আসব। যদি পারি। প্লিজ আমাদের কথা একটু ভাবুন।” অতিকষ্টে বলল লোকটা।
“আমাকে একটু জানাবেন, আংটি ছাড়াই আপনাকে কেন দেখতে পাচ্ছি?” রঘু জিজ্ঞেস করল।
“আমি বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছি আপনাদের পৃথিবীতে খাপ খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু…” বলতে না বলতেই লোকটা সত্যি-সত্যিই মুছে গেল রঘুর চোখের সামনে থেকে।
চারদিক অন্ধকার, নিস্তব্ধ। ঝিঁঝিঁর একটানা ডাক শোনা যাচ্ছে।
গত কয়েকদিন, বিশেষত আজ সকাল থেকে যা যা সব দেখতে হচ্ছে রঘুকে, কহতব্য নয়। পুলিশ, ভূত! শুধু শরীর নয়, মনের ওপরও ধকল গেছে কম নয়। ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। কিন্তু তখনই দারুণ একটা আইডিয়া তার মাথায় এল। আরে! ওই লোকটার দেওয়া যন্ত্র ব্যবহার করে সে ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিল। আর এইটা আঙুলে পরে ভূত! ভূত মানে অতীত। তাহলে কি সেদিন তার জলের বোতলের সঙ্গে কী হয়েছিল সেটা এই আংটি পরে দেখা যাবে?
আইডিয়াটা চমৎকার। কিন্তু ভূত দেখাটা মোটেই আনন্দের ব্যাপার নয়। তার ওপর এই রাত্তির বেলায়। এই ভয়েই সে হাতে আংটিটা গলায়নি। কিন্তু লোকটা অনেকবার করে অনুরোধ করে গেল। বলে গেল তাদের সমাজের বাচ্চারা একের পর এক অসুস্থ হচ্ছে। সে নিজেও দুটো বাচ্চার বাবা। এমন অসময়ে কিছু না করে চুপ করে বসে থাকবে?
অতএব মনে মনে একবার ঈশ্বরকে স্মরণ করে নিল রঘু। তারপর চোখ বন্ধ করে আংটিটা পরে নিল বাঁহাতের বুড়ো আঙুলে।
ঝিঁঝিঁর আওয়াজটা আর একটু স্পষ্ট হয়ে উঠল। হাওয়ার বেগও যেন বেড়েছে। বুকে সাহস এনে কোনোমতে চোখ দুটো একটু ফাঁক করল রঘু। তক্ষুনি তার বুকটা খুব জোরে ধড়াস ধড়াস করে উঠল।
কাছেই বেলগাছটা। তার উঁচু একটা ডালে ধবধবে সাদা ধুতি পরে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন বয়স্ক একজন মানুষ। তাঁর শরীরের ওপরের দিকটা স্বাভাবিক, সাধারণ মানুষের মতোই। কিন্তু পা দুটি অনেক লম্বা। অত উঁচু ডাল থেকে নেমে এসে একেবারে মাটি ছুঁইছুঁই করছে। মাথা ন্যাড়া। হালকা চাঁদের আলো এসে পড়ছে মাথায় আর খাড়া নাকের ডগায়। চকচক করছে। বিশাল বড়ো ও জ্বলজ্বলে একজোড়া চোখ মেলে তিনি রঘুর দিকেই তাকিয়ে।
ভয়ের ধাক্কাটা সামলে উঠল রঘু। সোজাসুজি ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই তিনি তাঁর বিশাল চোখগুলি নাচিয়ে গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, “আমাদের জগতে কী করছ হে? এ-পারের বলে তো মনে হচ্ছে না!”
“আজ্ঞে না।” হাতজোড় করে বলল রঘু।— “ক’টা রহস্যের সমাধান পেতে নেহাতই বাধ্য হয়ে আসা।”
“রহস্যের সমাধান!” মুচকি হাসলেন ভদ্রলোক।— “বেশ, বেশ! তা খোঁজো। তবে একটু সাবধানে। এদিকেও আজকাল দুষ্কৃতিদের ভিড় বেড়েছে। কে কখন ঘাড়-টাড় মটকে দেয় বলা যায় না।”
শুনেই রঘুর বুকে যেন ভূমিকম্প হতে থাকল। কিন্তু বেলগাছের ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না। ঝপাস করে ডাল থেকে নেমে মস্ত বড়ো হাঁ করে হাই তুললেন একবার। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে উত্তরের দিকে কোথায় যেন চলে গেলেন।
পাছে আরও কিছু দেখতে হয়, কোনও কালো হাত এগিয়ে এসে ঘাড়টা ধরে, বা বড়ো বড়ো দাঁত নিয়ে কেউ এগিয়ে আসে, ভয়ে রঘু দৌড় দিল ঘরের দিকে। কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারল না। হঠাৎই কীসে যেন পা লেগে হোঁচট খেয়ে পড়ল। তক্ষুনি তার মাথার ওপরে দেখা দিল ফুটফুটে জ্যোৎস্না। অবাক হয়ে সে দেখল, কোন জঙ্গলের মাঝে একটা ফাঁকা জায়গায় সে দাঁড়িয়ে আছে। খুব লম্বা আর কুচকুচে কালো একটা লোক সেখানে বসে শিলনোড়াতে কী যেন বাটছে। বাটা হলে থকথকে ঘন ক্বাথের মতো কী যেন শিল থেকে তুলে একটা মাটির কলশিতে ভরে হাতা দিয়ে গুলতে লাগল লোকটা। ভারি চমৎকার গন্ধ উঠছিল সেটা থেকে। নাকে গেলেই খিদে খিদে পায়। কাঁচা আমের ফালি দেখলে যেমনটা হয়, তেমনই ব্যথা ব্যথা করে ওঠে গালটা। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যায় না, তবে মনে হল লোকটা সেখান থেকে হাতা দিয়ে তুলে হাঁ করে খেল কয়েক ফোঁটা। তারপর যেন ভারি খুশি হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে কোথায় চলে গেল।
এরপরেই ঘটল অদ্ভুত ঘটনাটা। একটা ঝোপের আড়াল থেকে চুপিচুপি বেরিয়ে এল রঘুর ছেলে, গবাই। তার হাতে প্লাস্টিকের একটা বোতল। চোরের মতো মাথা নীচু করে এসে সে মাটির কলশিটা কাত করে নিজের হাতের বোতলে ভরে নিল কিছুটা। তারপর যেমন করে এসেছিল, তেমনই চলে গেল।
॥ তেরো॥
সামনের নড়বড়ে দেড়খানা ঘরের পেছনে খানিকটা আবর্জনা ফেলার জায়গা। সেখানে একটা চালাঘর কোনোমতে একদিকে হেলে দাঁড়িয়ে আছে। এককালে এটা ছিল রঘুদের রান্নাঘর। তার মা বেঁচে ছিলেন তখনও। তারপর একবারের বর্ষায় ওপরের খড়ের চালা ভেঙে পড়ল। টিন লাগানো হয়েছিল অবশ্য, কিন্তু ঘরের মাজাটাই ভেঙে গেলে ওপরে ছাউনি দিয়ে কী হবে! কোন দিন দেওয়ালটাই না ধসে পড়ে, এই ভয়ে ঘরটা পরিত্যক্তই হয়ে গেল।
তবে গবাই এ-ঘরটায় আসে। একটা বড়ো, ভাঙা টিনের ট্রাংক আছে এখানে। সেটাতে সে জমিয়ে রাখে নিজের ঘুড়ি, লাটাই, মার্বেল। নানান সম্পত্তি। অনেকবার তার মা বারণ করেছে এই ঘরটায় ঢুকতে। ‘কোন দিন সাপে কামড়াবে’ বলে চেঁচিয়েছেও অনেকবার। গবাই শোনে না।
সে এখন গেছে ইস্কুলে। রঘুর মেয়ে তার মায়ের কোলে চেপে পাড়া বেড়াতে বেরিয়েছে। এখনই সুযোগ!
সাবধানে আগাছার জঙ্গল ভেঙে চালাঘরটার সামনে গিয়ে নড়বড়ে কাঠের দরজায় লাগানো দড়িটা খুলে ফেলল রঘু। তারপর অন্ধকার ঘরটার ভেতরে ঢুকে পড়ল।
অবশ্য পুরোপুরি অন্ধকার নয়। আট ফুট বাই দশ ফুট ঘরটায় দুটো জানালা। কোনোটারই পাল্লা গোটা নেই। ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকছে। কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ। দরজার বাইরে একবার উঁকি মেরে সে ট্রাংকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারও কড়াতে একটা দড়ি বাঁধা।
দড়িটা খুলে ফেলে ট্রাংকের ভেতরে উঁকি দিল রঘু। নানান আজেবাজে জিনিসে ভেতরটা ভরতি। হাতের পেনসিল টর্চটা জ্বালিয়ে আলো ফেলে দেখতে দেখতে তার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল।
ছেঁড়াখোঁড়া কাপড়, কাগজ, ঘুড়ি-লাটাইয়ের নীচে লুকিয়ে রাখা আছে মস্ত একটা সোনার মুকুট। এই সামান্য আলোতেও ঝলমল করে উঠল সেটা। আর আছে গোটা চারেক সোনার মোহর, ঝকঝকে একটা বাঁকানো ছোরা— সম্ভবত রুপোর তৈরি। আছে কয়েকটা পুরোনো আমলের বাসনপত্র।
যে-জিনিসটির খোঁজে রঘু ঢুকেছিল, সেটিও একটু খোঁজার পরে পেয়ে গেল সে। প্লাস্টিকের একটি পুরোনো জলের বোতলে রাখা একটি তরল। জলের মতোই দেখতে, তবে আরও গাঢ়। ঢাকনাটা খুলে সেটা শুঁকে দেখলে চমৎকার একটা গন্ধ পাওয়া যায়। ইচ্ছে হয় এক ঢোঁক খেয়ে দেখতে। লোভ সামলাতে না পেরে চুমুক দিয়ে একটু খেলও রঘু। তেমন ভালো নয় স্বাদ।
ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে রঘুর কাছে। গবাই এইটা রেখেছিল ঘরের মধ্যে। রঘু পরে জলের বোতল ভেবে এইটি নিজের বাক্সে ঢুকিয়েছিল। দুটো বোতলই প্রায় একরকম দেখতে। এই বোতল থেকেই সেদিন বুড়ো মানুষটিকে তরলটি ঢেলে খাইয়েছিল সে। পরে গবাই আবার সরিয়ে নিয়ে এই বাক্সে ঢুকিয়ে রেখেছে। সোনার মুকুটটাও আসলে মহারাজ বিক্রমপ্রতাপের। তাঁর মাথায় সেদিন ছিল, দেখেই চিনতে পেরেছে রঘু।
কিন্তু প্রশ্ন হল, গবাই এসব পেল কোথায়। তার ছেলে হয়ে সে কি একের পর এক জিনিস চুরি করে এখানে এনে রাখছে? ছি, ছি! লজ্জায় মাথা কাটা যায় রঘুর।
মুকুটটা বের করে নিল সে। যার জিনিস তাকে ফেরত দিতে হবে। বের করে নিল বোতলটিও। আশ্চর্য সুগন্ধি এই তরল হয়তো বাঁচিয়ে দেবে ও-পারের ছোট্ট বাচ্চাগুলোকে।
সবে পেছন দিকে ঘুরবে, হঠাৎই তার মনে হল দরজার কাছে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। আলোটা যেন আড়াল হল একটু।
ঘুরে তাকিয়েই তার বুকটা ধড়াস করে উঠল। খোলা তরোয়াল হাতে সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন মহারাজ বিক্রমপ্রতাপ। কিন্তু এ কী অবস্থা হয়েছে তাঁর! হঠাৎ করেই যেন কয়েক বছর বয়স বেড়ে গেছে। মুখ শুকনো, দু-গালে না-কাটা কাঁচাপাকা দাড়ি। আর তাঁর মাথায় প্রকাণ্ড টাক।
“তস্কর!” গর্জন করে উঠলেন মহারাজ।— “পন্ডিত মহাশয় সত্যই বলেছিলেন। তুমি অত্যন্ত দুর্জন ব্যক্তি। তোমার এত বড়ো সাহস তুমি মহারাজ বিক্রমপ্রতাপের মস্তক থেকে মুকুট তস্করি করেছ!”
রঘু থরথর করে কাঁপছে। বিশালদেহী বিক্রমপ্রতাপ খোলা তরোয়াল মাথার ওপরে তুলে তার দিকে এগিয়ে আসছেন। দু-চোখে তীব্র দৃষ্টি। এক কোপেই তার মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা হয়ে যাবে।
জীবনে বেশ কয়েকবারই ঝামেলায় পড়েছে রঘু। কিন্তু এত ভয় পায়নি কখনও। কী বিপদ যে হল তার! করজোড়ে মহারাজের কাছে ক্ষমা চেয়ে সে যে চোর নয়, সে-কথাটাই বলার চেষ্টা করছিল রঘু। তার আগেই ভীমবেগে তরোয়ালটা তার ঘাড় লক্ষ্য করে নেমে এল।
শেষ মুহূর্তে চোখটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। কিন্তু কোথা থেকে যেন অদ্ভুত শক্তি আর ফূর্তি চলে এসেছে তার শরীরে। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই পায়ের সামান্য নড়াচড়ায় রাস্তা থেকে সরে গেল সে। পাশ দিয়ে সাঁই করে হাওয়া কেটে বেরিয়ে গেল তরোয়ালটা।
চোখ দুটো যখন খুলল, দেখতে পেল, মহারাজ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কী করে রঘু ফসকে গেল সেটাই ভাবছেন বোধ হয়। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়। নিজেকে সামলে নিয়ে পরমুহূর্তেই বিদ্যুদ্বেগে আবার তরোয়ালটা চালালেন তিনি।
এবার আর রঘু সরে গেল না। কী যেন একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে তার ভিতরে। হাত-পা কাঁপছে না। মাথা ঠান্ডা। চোখে পরিষ্কার দেখছে। সবথেকে বড়ো কথা, বাইরের পৃথিবীটা যেন তার কাছে অত্যন্ত ধীরগতির বলে মনে হচ্ছিল। দ্রুত গতিতে দেড়-পা এগিয়ে এল সে। তরোয়াল-সমেত মহারাজের হাতটা নেমে আসার ফাঁকেই সে বাঁহাত দিয়ে তাঁর ডানহাতের বগলের কাছে মৃদু ধাক্কা মেরে তরোয়ালটা লক্ষ্যচ্যুত করে দিল। তার অন্য হাতের বজ্রমুষ্টি সোজা গিয়ে পড়ল মহারাজের থুতনিতে। বোমার মতো ফাটল যেন সেটা। পেছনের দেওয়ালের দিকে প্রায় ছিটকে গিয়ে পড়লেন বিক্রমপ্রতাপ।
॥ চোদ্দ॥
বাঁধপুকুরের মালিক কে, তা এখন স্পষ্ট নয়। বহুদিন আগে কোনও এক ধনী মানুষ পুকুরটা খুঁড়িয়েছিলেন। আজ তিনি নেই। তবে তাঁর অজস্র উত্তরপুরুষের সকলেই সেটির মালিকানা দাবি করে। তাই পুকুরটা নিয়ে কোন কোর্টে কেস হয়েছে বলে শুনেছে মিন্টু। কেস কী জিনিস সেটা সে জানে না। তবে সম্ভাব্য মালিকদের কেউই বারণ করতে না আসায় ভুবনডাঙা বস্তির সকলেই এই পুকুরে মাছ ধরে, স্নান করে। কেউ বাধা দেবার নেই।
ছুটির দিন দেখে গবাই আর মিন্টু ছিপ নিয়ে এখানে বসে। অবশ্য বসবে নাই-বা কেন? ওদের ঘরে টিভি নেই। রোজ চিকেন-মাটন কেনবার সামর্থ নেই বাবাদের। এদিক-ওদিক থেকে শাকটা, মাছটা পেলে একটা দিনের খাওয়াটা অন্তত ভালো হয়। সেজন্য তাদের মায়েরাও বকে না। গরিবদের নিয়ম আলাদা।
একটা খেজুর গাছ আছে পুকুর ঘেঁষেই। তার পেছনে মস্ত তেঁতুলগাছ, অশ্বত্থ, বেল। ঘেঁটু গাছে ভরতি। এসব কারণে চমৎকার ছায়া হয়। ওটাই ওদের বসবার জায়গা। আজ ছুটির দিন দেখে ছিপ হাতে মিন্টু প্রথমে গিয়েছিল গবাইদের বাড়ি। তার মা বলল, সে নাকি সকালেই বেরিয়ে গিয়েছে। তখন মিন্টু প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে পুকুরের দিকে এল। হয়তো গবাই এখানেই এসেছে! মস্ত উঁচু আর ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছটার পেছনে মিন্টু তাকে দেখতেও পেল। হনহন করে হেঁটে তাকে প্রায় ধরে ফেলেছে, এমন সময়ে অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ করল মিন্টু। গবাই তার দিকে পেছন ফিরে ছিল, দেখতে পায়নি। পুকুরের পাড়ের একেবারে ধারে এসে একবার সে জলের দিকে তাকাল। তারপর পকেট থেকে একটা আংটির মতো কিছু বের করে আঙুলে পরল সে। তারপর বিলকুল গায়েব। একেবারে ‘নেই’ হয়ে গেল গবাই!
ধপ করে সেখানেই বসে পড়ল মিন্টু। বুকটা খুব জোরে ধড়াস ধড়াস করছিল তার। এ আবার কোন ম্যাজিক!
গত কয়েকদিন ধরেই গবাই একেবারে বদলে গেছে। এখন তার সঙ্গে তেমন কথাবার্তাও বলে না। একা একা থাকে। কোনও প্রশ্ন করলে জবাব দেয় না। মিন্টু ভেবেছিল, হয়তো ঘরে কোনও অসুবিধে হয়েছে। কিন্তু আজ সে বুঝতে পারল আসলে তা নয়। গবাই কোনও মন্ত্রের শক্তি পেয়েছে। যখন-তখন অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে সে।
উঠে পুকুরের পাশে ছিপটা নিয়ে গুছিয়ে বসল মিন্টু। গবাই তাকে দেখতে পাচ্ছে কি না কে জানে। হয়তো পাশ দিয়ে অদৃশ্য অবস্থায় চলে গেল। অথবা আবার এখানেই ফিরে আসবে সে। আর তখনই মিন্টু তাকে হাতেনাতে ধরবে। বসে বসে দারুণ রাগ হতে লাগল তার। মিন্টু তার এত বন্ধু, এত ভালোবাসে, তবু গবাই তাকে লুকিয়েছে এত বড়ো ব্যাপারটা! ভাবতে ভাবতে চোখে জল চলে এল মিন্টুর। তার ফাঁকেই তার ছিপে উঠল দুটো পুঁটি, একটা বাটা মাছ।
বেলা বয়ে যায়। ভাত খাওয়ার সময় এগিয়ে আসছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠল মিন্টু। মাছগুলো সব পলিথিনের প্যাকেটে জলের মধ্যে ভরা আছে। পুকুরে একটা ডুব দিয়ে নিয়ে চলে যাবে সে। তখনই খটকাটা লাগল। এতক্ষণ অন্যমনস্ক থাকায় বুঝতে পারেনি।
লম্বা, আবছা একটা ছায়া তার পিঠে এসে পড়ছে। অবাক হয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকল মিন্টু। ঠিক যেন পানাপুকুরের জলের মধ্যে পড়া ছায়া। নাক-মুখ-চোখ বোঝা যায় না। ভেঙেচুরে যায়। তফাতের মধ্যে এটা ভেসে আছে বাতাসে। তার মধ্য দিয়ে বাতাস বইছে। কিন্তু সূর্যের আলো পুরোপুরি ভেদ করতে পারছে না। খুব আবছা একটা ছায়া এসে পড়ছে সামনে।
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ দেখল মিন্টু। তারপরেই তার বুক আবার কেঁপে উঠল। ছায়াটার মাথার ঠিক ওপরে কয়েক গোছা চুল সামান্য উঠে আছে। যেন একটা হাফ-প্যান্ট আর কোঁচকানো গেঞ্জি পরা। বাঁ-পাটা একটু সামনে ছড়ানো। অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
একটা শ্বাস ফেলল মিন্টু। আজ অবাক হওয়ার দিন। আর এই ছায়াটা গবাইয়ের। সে পুরোপুরি লুকোতে পারেনি নিজেকে। এখানেই আছে।
দুরন্ত একটা রাগ পাগল করে দিল মিন্টুকে। দৌড়ে গিয়ে পাগলের মতো ছায়ার একটা হাত ধরে টানার চেষ্টা করল সে। চিৎকার করে বলল, “গবাই, কেন বলিসনি আমাকে?”
অবশ্য ছায়ার হাত ধরা গেল না। শূন্যে ঘুরে ফিরে এল তার নিজের হাতটা।
॥ পনেরো॥
গবাইয়ের ঘুমটা ভেঙেছিল খুব ভোরে। তখন আবছা একটা আলো বাইরে।
ঘরের বাকি সবাই ঘুমোচ্ছে। পা টিপে টিপে বাইরে এল সে। মা আজও সকালে কল থেকে জল ধরতে যাবে। বাবাও বেরোবে কাজে। কিন্তু উনুনটা এত সকালে ধরানো হবে না। তার আর বুনুর আর একটু বেশি ঘুমোনোর দিন আজ। রবিবার। কিন্তু তার ঘুম যে ভেঙে গেছে। কী আর করা যাবে!
সময় ও ভিন্ন পৃথিবীতে ভ্রমণটা একটা নেশার মতন পেয়ে বসেছে তাকে। অন্য কাজে মন লাগে না। পড়াশোনায় না, খেলাতে না। কিচ্ছুটিতে না।
একটা হাই তুলল সে। সাবধানে উঠোনের দরজা খুলে বাইরে বেরোল। আধো-অন্ধকার চারদিকে। এর আগেই ভাঙা উনুনের পেছনে লুকিয়ে রাখা সেই আশ্চর্য ওষুধ আর আংটিটা নিয়ে এসেছে সে।
বাঁহাতের বুড়ো আঙুলে আংটিটা পরল সে। একটু বেশিই ঢলঢল করছে আজ। তা করুক। কিন্তু পায়ের তলাটাও যেন একটু কেঁপে উঠল আজ। আকাশটা দুলে উঠল।
সে দাঁড়িয়ে আছে ঘোলাটে একটা আকাশের নীচে। চারদিকে অদ্ভুত দেখতে সব গাছ, মাঝখানে যেন রুপোর তৈরি এক রাস্তা। তার ও-পারে আভাস পাওয়া যায় বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ধু-ধু মাঠের। অনেক দূরে ডানদিক থেকে বাঁদিকে উঠে যাওয়া আশ্চর্য দিগন্তচিহ্ন। এমন দিগন্ত সে কখনও দেখেনি।
আর আকাশে আছে অদ্ভুত এক গোলক। চাঁদের থেকে বড়ো আর উজ্জ্বল। কিন্তু সূর্যের মতো তীব্র নয়। তাকিয়ে থাকা যায়।
এ কোথায় এল সে?
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল গবাই। গাছপালার ভিড় থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে আকাশচুম্বী দুটি স্তম্ভ দেখতে পেল সে। তার সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে অনেকজন। আর একটু এগিয়ে সে অবাক হয়ে দেখল ভিড়টাকে। যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে যেমন পুরুষ আছে, তেমনই কয়েকজন মহিলা। তবে সবচেয়ে বেশি আছে বাচ্চারা।
ওরা কি মানুষ? না, তা নয় হয়তো। কিছুটা যেন মানুষ, কিছুটা নয়। ফারাক আছে। হাত-পায়ের, মাথা আর চোখ, নাক আর মুখের গঠনে। তবে চেনা যায় পুরুষ আর মহিলা, বাচ্চা আর বয়স্কদের। অবাক করা অন্যান্য প্রাণীও আছে অনেকগুলো। তার পরেই শিউরে উঠল গবাই। এখানে যে কয়জন আছে তাদের সকলের শরীরেই দগদগ করছে ঘা। অসীম যন্ত্রণা তাদের মুখে-চোখে। বিশেষত বাচ্চাদের। অব্যক্ত এক হতাশা নিয়ে তারা তাকিয়ে আছে গবাইয়ের দিকেই।
তাদের মধ্য থেকে গম্ভীর আর বিষণ্ণ ভঙ্গিতে এগিয়ে এল একজন বয়স্ক মানুষ। ধীর পায়ে তার সামনে এসে বিষাদমলিন গলায় বলল, “আপনার বাবা একবার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। তাই চিনতে পারছি। তাঁর চোখ দিয়েই দেখেছি আপনাকে।”
“আপনারা কারা?” অবাক হয়ে বলল গবাই।
একটা শ্বাস ফেলল লোকটা। গম্ভীর আর নীচু গলায় বলল, “আমরা অন্য এক পৃথিবী থেকে এখানে এসে পড়েছি। দুই পারের মধ্যের দরজাটা খুলে আবার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার ফলে আমরা এখানে আটকে যাই। আজ আবার খুলেছে সেটা। ওই যে, বন্ধও হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আর ঢুকতে দেবে না।”
লোকটা যেদিকে আঙুল বাড়িয়ে দেখাচ্ছিল সেদিকে দেখল গবাই। দুই স্তম্ভের মাঝখানে একটা অর্ধস্বচ্ছ পর্দা খুব খেয়াল করলে বোঝা যায়। সেটা আস্তে আস্তে বাঁদিক থেকে ডানদিকে সরে আসছে।
“কেন? আপনাদের ঢুকতে দিচ্ছে না কেন?” গবাই জিজ্ঞেস করল।
“সাধারণ চোখে আপনারা আমাদের দেখতে না পেলেও ছোটো জীবরা, পোকামাকড়, সাপ, পাখি আমাদের অস্তিত্ব টের পায়। তাদের শরীরের জৈবকণার প্রভাবে আমাদের শরীরে নানান রোগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বাচ্চাদের। আপনার বাবা এক আশ্চর্য ওষুধ দিয়ে আমাকে সারিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক, দ্বিতীয়বার সে-ওষুধ আর আমার হাতে দেননি। এই রোগগ্রস্ত লোকগুলিকে আমাদের পৃথিবীর শাসক ফিরে নিতে চান না। যদি তাঁদের মধ্যেও এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে!”
“আপনি তো সেরে উঠেছেন বললেন। তবে আপনাকে কেন যেতে দিচ্ছে না?”
অদ্ভুত বিষণ্ণ এক হলুদ আভা ছড়িয়ে পড়ল লোকটির মুখে।— “বাচ্চাদের না নিয়ে কী করে যাই বলুন তো?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল গবাই। সে লোকটাকে চেনে না। তবে যে বাচ্চাদের ভালোবাসে, তার মনটি নিষ্কলঙ্ক। তাকে ভালো না বেসে উপায় নেই। তক্ষুনি সে তার কাছ থেকে একটু দূরে সেই সাধুবাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল। এখন তাঁর পরনে হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, সবুজ ফতুয়া। মাথায় লাল পাগড়ি আর হাতে একটি বাঁকানো লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। যেন বহুদূরের পথিক। গভীর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “দেখছ কী! তোমার হাতের ওষুধটা ওকে দিয়ে দাও।”
মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিজের হাতের বোতলটা বয়স্ক মানুষটির দিকে বাড়িয়ে দিল গবাই। উজ্জ্বল সবুজ চোখে তার দিকে তাকিয়ে লোকটা বলল, “এই কি সেই প্রাণদায়ী ওষুধ? অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।”
গবাই দেখল, সে একছুটে চলে গেল বিশাল সেই পর্দার কাছে। চিৎকার করে কী যেন বলল। তারপর বোতল থেকে খুব হিসেব করে বিন্দু বিন্দু তরল ঢেলে দিতে থাকল বাচ্চাদের মুখে। অন্যান্য নারী-পুরুষদের মুখেও। রঙিন পাথরের মতো ঝলমল করে উঠছিল তারা।
বাচ্চাদের চেহারায় ফিরে আসছিল প্রাণবন্ত এক নীল রঙ। কলরব করে অর্ধস্বচ্ছ পার্দাটির দিকে ছুটে যাচ্ছিল তারা, তাদের পরিবার।
পর্দাটি বন্ধ হওয়ার সামান্য আগে লোকটি আবার দ্রুত পায়ে ফিরে এল গবাইয়ের কাছে। বিনীত গলায় বলল, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। একটি শেষ অনুরোধ জানাই। তরলটির সামান্য অংশই অবশিষ্ট আছে। এটুকু কি আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি? ও-পারে গিয়ে এর বিশ্লেষণ করব আমরা। হয়তো ভবিষ্যতে অনেক রোগজ্বালার হাত থেকে মুক্তি দেবে এই ওষুধ। অনুমতি দেবেন?”
বড়ো করে একটা শ্বাস ফেলল গবাই। বলল, “নিয়ে যান। ভালো থাকুন আপনারা। আপনিও।”
“অনেক ধন্যবাদ।” উজ্জ্বল হয়ে উঠল লোকটির মুখ। দ্রুতপায়ে পর্দাটির দিকে এগিয়ে যেতে-যেতেই গলা তুলে সে বলে গেল, “আপনার বাবাকে একটি কাজের ভার দেওয়া হয়েছিল। তিনি সে-কাজ সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। আমি করে গেলাম। তাঁকে বলবেন, জেল থেকে পালিয়ে যাওয়া অপরাধীটিকে রক্ষক দলের একজনই বের করে নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছেন। তাঁর কপালে একটি কাটা দাগ আছে। তাঁর বাড়ির গ্যারাজের পেছনেই লুকিয়ে আছে অপরাধী। বলবেন!”
পর্দার ও-পারে হারিয়ে গেল তার কথা। আস্তে আস্তে মুছে গেল পর্দাটি, স্তম্ভ, ধু-ধু মাঠ। সে আর তিনি। তারা দুজনে দাঁড়িয়ে আছে নীল আকাশের তলায় আদিগন্ত বিস্তৃত এক সবুজ মাঠে। তার এ-পার ও-পার দেখা যায় না।
“ওরা কি আপনাকে দেখতে পায়নি?” জিজ্ঞেস করল গবাই।
“উঁহু।” ঘাড় নাড়লেন পথিক।— “আমি কেবল তোমার মতো কয়েকজনকে দেখা দিই।” তারপরেই বিড়বিড় করে বললেন, “অনেক গোলযোগ রয়ে গেছে সৃষ্টিতে। সব তো আর নতুন করে তৈরি করা সম্ভব নয়, শুধরে নিতে হবে।”
“আপনি আসলে কে বলুন তো?” আবার জিজ্ঞেস করল গবাই। অন্য একটা সন্দেহ হচ্ছিল তার। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল।
তবে পথিক তার প্রশ্নের জবাবে ভুরু কুঁচকে বললেন, “বলেছি যে! আমিই সেই!”
“মানে?”
“মানে পরে বুঝবে। এখন আমরা আছি এই নাটকের শেষ অঙ্কে। আমার হাতে আর বেশি সময়ও নেই। ওই দেখো, আর এক অপরাধীও এদিকেই আসছে!”
তিনি যেদিকে আঙুল বাড়িয়ে দিয়েছেন সেদিকে তাকাল গবাই। বহুদূরে, সবুজ ঘাসের ও-পাশে যেন একটা ধুলোর ঝড়। কালো একটা মেঘ দ্রুত এগিয়ে আসছে তাদের দিকেই।
বেশিক্ষণ লাগল না। ঝড়ের মতোই তার সামনে এসে দাঁড়াল কুচকুচে কালো, খুব লম্বা আর ছিপছিপে একটা লোক। তার চোখ দুটি টকটকে লাল। অঙ্গারের মতো জ্বলছে। ঘনঘন ওঠাপড়া করছে বিশাল বুক।
রক্তচোখে গবাইয়ের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “তুই-ই লুকিয়ে লুকিয়ে ঢুকেছিলি আমার পৃথিবীতে? রাজকুমারীকে চুরি করে নিয়ে যেতে চাস? এত আস্পর্দা?”
লোকটা গবাইয়ের চেয়ে প্রায় তিনগুণ লম্বা। ভয়ংকর তার চেহারা। বড়ো বড়ো চুল-দাড়ি সাপের মতো দুলছে বাতাসে। গলায় রঙবেরঙের স্ফটিকের একটা মালা। তার বিষাক্ত দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে যেন ছোটো হয়ে গেল গবাই।
“শত্রুর শেষ রাখতে নেই। তোকে এই মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন করে দেব।” দাঁতে দাঁত ঘষে বলল লোকটা।
অসহায়ের মতো গবাই তাকাল পথিকের দিকে। তিনি নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন একপাশে। মুচকি হেসে বললেন, “ভয় পেও না গবাই। ও-ও এককালে দেখতে পেত আমায়। যখন থেকে ওর মনে পাপ ঢুকেছে, আর পায় না।”
“আমি কী করব এখন?” প্রায় কেঁদে উঠল গবাই।
লোকটা চারদিকে তার বড়ো বড়ো চোখগুলি ঘুরিয়ে ধমক দিয়ে বলে উঠল, “কার সঙ্গে কথা বলছিস?”
পথিক হেসে বললেন, “তুমি কেবল ওর হাতটি ধরো। তোমার হাত ওকে ওর বিচারকের কাছে নিয়ে যাবে।”
জাদুকর মৃত্যুঞ্জয় ততক্ষণে তার বিশাল শাল-খুঁটির মতো হাত বাড়িয়ে দিয়েছে গবাইয়ের গলা চেপে ধরতে। একেবারে শেষ মুহূর্তে গবাইয়ের নরম আঙুলগুলি স্পর্শ করল তার কঠিন হাতটি। দুলে উঠল মাটি। আকাশ যেন পাক খেতে লাগল।
॥ ষোলো॥
চারদিকে মস্ত উঁচু পাঁচিল। তারও বাইরে গভীর নদীখাত। ও-পারে ঘন জঙ্গল। আর ভেতরে প্রায় একটা ছোটোখাটো নগর। বাজার আছে। সেনাদের ছাউনি, মন্দির, বিদ্যালয়, উদ্যান। আর একেবারে মাঝখানে উঁচু সাদা রঙের রাজবাড়ি। তার উঠোনে মল্লিকা আমের গাছটির নীচে খেলা করত রাজকুমারী। ওই আমটির মতো মিষ্টি আর সুগন্ধি আম আর কোত্থাও নেই। অন্য কোনও দেশে নেই সেই আমের গাছ। সারা পৃথিবীতে ওই একটিই। রাজকুমারী সে-আম খেতে বড্ড ভালোবাসত। খেলতও ওই গাছটির নীচেই।
রাজা বিক্রমপ্রতাপ সারাদিনের কাজের মাঝে যখন বিশ্রাম করার জন্য ফিরতেন, দেখতেন, গাছের নীচটিতে তাঁর অপেক্ষায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রাজকন্যা। তার গোলাপি গাল দুটিতে লাল ছোপ ধরেছে অপেক্ষার।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বিক্রমপ্রতাপ। কোথায় গেল সেই সুখের দিনগুলি। তিনি, রানি আর নন্দিতা মিলে মাঝে-মধ্যে একসঙ্গে বসতেন বিরাট বিশ্রামকক্ষটিতে। চারদিকে সোনা-রুপোর কাজ করা চন্দনকাঠের আসবাব, তার সুগন্ধে ম-ম করত কক্ষটি। দক্ষিণের জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসত। কেঁপে কেঁপে উঠত দেওয়ালের প্রকোষ্ঠে ঝোলানো মশালগুলি। আহা, সে-সব দিন আর কখনও ফেরত আসবে না।
কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল। রাজকুমারীকে চুরি করে নিয়ে গেল জাদুকর মৃত্যুঞ্জয়। কেউ তাকে ফেরত আনতে পারল না। দিনদিন শোকে-দুঃখে শুকিয়ে যেতে লাগলেন রানি। শেষে রাজা নিজেই বেরোবেন বলে ঠিক করলেন।
বেরিয়েও ছিলেন। যথেষ্ট সৈন্যসামন্ত নিয়ে। তারপর কী যে হয়ে গেল! জাদুকর বা নিজের মেয়েকে তো খুঁজে পেলেনই না, এমনকি সৈন্যদেরও দেখা পাচ্ছেন না। খুঁজে পাচ্ছেন না নিজের রাজধানী যাওয়ার পথ। আজব এক জগতে এসে পড়েছেন। এখানের মানুষজন অদ্ভুত। পথে পথে, গাছপালায় ঝুলছে ভূত। বিশাল বিশাল সব গৃহ। রাস্তায় আশ্চর্যসব যান চলাচল করছে। আর মানুষজন! সংখ্যায় প্রচুর। গাছপালা বরং কম। কিন্তু তাদের পোশাকও অদ্ভুত, আর তারা তাঁকে দেখতেই পায় না। অদ্ভুত এই পৃথিবী। লোকজন আসে, তাঁকে ভেদ করে চলে যায়। তিনি কিছু বললে তারা যেমন শুনতে পায় না, তিনিও তাদের কথাবার্তা শুনতে পান না। এমনই তাঁর কপাল, যে একজন তাঁকে দেখতে পেয়েছিল, সে আসলে তস্কর! আর বাকি যারা তাঁকে দেখতে পায় তারা সবাই ভূতপ্রেত।
এ-জগতে কীভাবে তিনি এসে পড়লেন তার পেছনেও একটা কাহিনি আছে।
ঘোড়ায় চেপে রাজকন্যাকে খুঁজতে যাওয়ার পথে একটা উঁচু খিলান দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। সেখানে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক তরুণ সন্ন্যাসী। তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “রাজামশাই কি জাদুকর মৃত্যুঞ্জয়কে খুঁজে বেড়াচ্ছেন?”
তিনি অবাক হয়ে বললেন, “হ্যাঁ। আপনি কি তার সন্ধান জানেন সন্ন্যাসী?”
তিনি ঘাড় নেড়ে বললেন, “জানি। আমারই দোষে সে আজ নিজের জগৎ গড়ে তুলতে পেরেছে। একবার তার ওপরে প্রীত হয়ে তাকে শক্তি দিয়েছিলাম, যাতে সে নিজের এমন এক গৃহ গড়ে তুলতে পারে যার সন্ধান আর কেউ পাবে না। তারপরেই সে পাপকাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কাজেই তার সেই দোষ সংশোধনও করতে হবে আমাকেই। আপনি এই পথে যান, তাকে দেখতে পাবেন।”
রাজার শরীর তখন ক্রোধে জ্বলছে। ঘোড়া সেখানেই রেখে খোলা তরোয়াল হাতে খিলানের পথ ধরে ঢুকেছিলেন। তারপর কী যে হয়ে গেল! মৃত্যুঞ্জয়ের দেখা পেয়েছিলেন। কিন্তু গর্জন করে তার দিকে যখন অগ্রসর হচ্ছেন, সে একটা অট্টহাসি হেসে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর তিনি খুঁজে পাননি নিজের রাজ্য। সেই সন্ন্যাসীর দেখাও পাননি।
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসলেন বিক্রমপ্রতাপ। আর সঙ্গে-সঙ্গেই বুঝতে পারলেন, তাঁর গোটা শরীরে ব্যথা, বিশেষত চোয়ালে। তক্ষুনি সব মনে পড়ে গেল। তাকিয়ে দেখলেন, সেই শুঁটকে লোকটা আধো অন্ধকার ঘরটিতে তাঁর পাশেই উবু হয়ে বসে জুলজুল করে তাঁর দিকে চেয়ে রয়েছে।
বিক্রমপ্রতাপের শরীরে আর সেই বল নেই। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, হতাশ তিনি। সিংহের মতো সাহসের কণামাত্র অবশিষ্ট নেই তাঁর শরীরে। তাকিয়ে দেখলেন, তাঁর তরোয়ালটাও দূরে পড়ে রয়েছে।
রঘু একবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “মহারাজ, দোষ-ত্রুটি মাফ করবেন। ইচ্ছে করে কিছু করিনি। এবার এই ওষুধটুকু খেয়ে নিন মহারাজ। গায়ে বল পাবেন।”
বিক্রমপ্রতাপের খিদে পেয়েছে খুব। তেষ্টাও। লোকটার হাতে থাকা অদ্ভুতদর্শন স্বচ্ছ পাত্রটির দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও থমকে গেলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, “ও কি বিষ নাকি?”
“না, মহারাজ। ওষুধ। গায়ে জোর পাবেন। খেয়ে নিন।”
তেষ্টা পেয়েছিল খুব জোর। তাছাড়া তাঁর কাছে বাঁচা মরা সব সমান এখন। বিড়বিড় করে বললেন, “বিষ হলেই-বা কী! রাজ্য হারিয়েছি। হারিয়েছি একমাত্র কন্যাকে। এই প্রাণ আর রক্ষা করতে চাই না।”
তরলটা গলায় ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন তিনি। তারপরেই আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। তেষ্টা তো মিটলই, ক্লান্তিও দূর হয়ে গেল। সারা শরীর যেন চনমন করে উঠল তাঁর। মনে হল, এখন একটা হাতির সঙ্গে লড়াইয়েও সেটাকে তুলে আছাড় মারতে পারেন। গর্জন করে উঠলেন, “আরে তস্কর, তোমার এত দুঃসাহস যে আমার রাজমুকুট তস্করি করেছ! এই মুহূর্তেই তোমার মস্তক দেহ থেকে ছিন্ন করব।”
রঘু ভূমিষ্ঠ হয়ে তাঁকে প্রণাম জানিয়ে বলল, “যদি ইচ্ছে হয়, তবে তাই করুন মহারাজ। তবু বলি, রঘু জ্যোতিষী চোর-তস্কর নয়। আপনার মুকুটও আমি চুরি করিনি।”
বলতে না বলতেই চারদিক যেন দুলে উঠল। মুছে গেল টিনের ঘর। কোথা থেকে ফুটে উঠল আশ্চর্য আলো।
॥ সতেরো॥
“ওদের ছেড়ে দাও গবাই। দুই পক্ষের দেখা হয়েছে। ওরা নিজেদের মধ্যে মোকাবিলা করে নিক এবার।”
পথিক গবাইকে বলল। গবাই তাকিয়ে দেখল, তারা দাঁড়িয়ে আছে জাদুকরের কুঁড়ের সামনে। মাঝের ফাঁকা জমিটার ঠিক মাঝখানে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মহারাজ বিক্রমপ্রতাপ আর জাদুকর মৃত্যুঞ্জয়। তারা পরস্পরের দিকে রাগ আর বিস্ময় মেশানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
প্রথমে গর্জন করে উঠলেন মহারাজ, “দুষ্ট মৃত্যুঞ্জয়! কোথায় কোথায় না তোমার সন্ধান করেছি। তোমার এত স্পর্ধা তুমি আমার কন্যাকে অপহরণ করেছ! আজ শেষ করে ফেলব তোমায়। বলো, কোথায় লুকিয়ে রেখছ রাজকুমারীকে?”
জবাবে বিকট একটা অট্টহাসি হাসল মৃত্যুঞ্জয়। বলল, “ওই দেখুন, ওই কুটিরে বন্ধ করে রেখেছি রাজকন্যাকে। যদি ক্ষমতা থাকে তাকে উদ্ধার করে দেখান।”
কুটিরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। রাজকুমারী রাজাকে দেখতে পাচ্ছে না। তবে ভেতর থেকে তার ফোঁপানি শোনা গেল। মহারাজের গলা শুনেছে সে। নিজের বাবাকে ডাকছে তাই। তার কান্না শুনে কেমন যেন দিশেহারা হয়ে গেলেন রাজা। দু-চোখ জলে ভেসে গেল তাঁর। ‘কন্যা! কন্যা!’ বলে তিনি ছুটে যাচ্ছিলেন কুটিরের দিকে। কিন্তু মাঝপথেই তাঁকে ধরে শূন্যে তুলে ফেলল মৃত্যুঞ্জয়। তুলে বিশাল এক আছাড় মারল। জমি কেঁপে উঠল যেন।
সে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “এই পৃথিবী আমার সৃষ্টি। আমিই এখানে রাজা। কারও ক্ষমতা নেই রাজকুমারীকে এখান থেকে নিয়ে যায়।”
রাজামশাই উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বাঘের মতো হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে। লেগে গেল ধুন্ধুমার।
গবাই আর পথিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই ভীষণ যুদ্ধ দেখছিল। একবার মৃত্যুঞ্জয় রাজাকে তুলে আছাড় মারে, একবার রাজা মৃত্যুঞ্জয়কে ধরে ছুড়ে ফেলে দেন। তার সঙ্গে আছে আঁচড় আর কামড়। যেন পশু হয়ে গেছে দুজনেই। কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, রাজামশাই ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন আস্তে আস্তে। বয়সও হয়েছে তাঁর। অন্যদিকে জাদুকর বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন। তাছাড়া এর মাঝেই একবার দূরে সরে গিয়ে মৃত্যুঞ্জয় কৌশলে মাটির পাত্র থেকে এক ঢোঁক খেয়ে নিয়েছে সেই বলদায়ক তরল। তারপর তার শক্তি যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ক্রমাগত রাজাকে ছুড়ে ফেলছে সে। একের পর এক বজ্রমুষ্ঠিতে রক্তাক্ত করে ফেলছে তাঁর মুখ।
“রাজামশাই তো হেরে যাবেন!” উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠল গবাই।
পথিক তখন তার দাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে বলল, “না, না। ও যে জাদু পানীয়টি খেয়েছে, তার মধ্যে তুমিই নিজের হাতে মিশিয়ে দিয়েছ শক্তিহরণকারী ওষুধ। আসলে মৃত্যুঞ্জয় মনে মনে ভাবছে, তার শক্তি বেড়ে গেছে। তাই দারুণ লড়াই দিচ্ছে সে। কিন্তু কন্যাহারা বাবার সঙ্গে কি কেউ পারে! রাজা মোটেই হাল ছাড়বেন না।”
বহুক্ষণ চলছিল এই লড়াই। কিন্তু আর একটু পরেই গবাই বুঝতে পারল, পথিক বা সাধুবাবা, বা বেদুইন— যে-ই হোক, লোকটা ঠিকই বলছে। ধীরে ধীরে যেন শ্লথ হয়ে আসছে মৃত্যুঞ্জয়ের গতি। ঘুসিতেও যেন সেই আগের জোর নেই। দু-বার রাজাকে ধরে ল্যাং মারতে গিয়ে নিজেই মাটিতে পড়ে গেল। অন্যদিকে রাজার শরীরে যেন নতুন শক্তি এসেছে। একটু পরেই এক আছাড়ে মৃত্যুঞ্জয়কে ভূমিতে শুইয়ে দিলেন তিনি। তারপর তার বুকে চড়ে বসলেন।
“এই নৃশংস কুস্তোকুস্তি আর ভালো লাগে না। এক কাজ করো তো গবাই। রাজাকে বলো, তিনি যেন মৃত্যুঞ্জয়ের গলার স্ফটিকের মালাটা টেনে ছিঁড়ে দেন। ওটা আমিই দিয়েছিলাম। যতক্ষণ না ওটাকে নষ্ট করা হচ্ছে, মৃত্যুঞ্জয় হারবে না।”
“রাজামশাই! এক্ষুনি মৃত্যুঞ্জয়ের গলার মালাটা টেনে ছিঁড়ে ফেলুন।” চিৎকার করে বলল গবাই।
মৃত্যুঞ্জয় কথাটা শুনতে পেয়ে সেটা বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল বটে, তবে ততক্ষণে রাজা মালাটা ধরে টান দিয়ে ফেলেছেন।
মৃত্যুঞ্জয়ের শরীরটা যেন গুঁড়ো হয়ে মুহূর্তের মধ্যে মিশে গেল বাতাসে। ভেঙে গেল কুঁড়েঘরটি। আশেপাশের জঙ্গল আর আকাশে বিরাট উথালপাতাল। ছুটে বেরিয়ে এসেছে রাজকুমারী নন্দিতা। দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছেন রাজা।
“মৃত্যুঞ্জয়ের রাজত্ব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল গবাই। এবার তুমি রাজা আর রাজকুমারীকে পথ দেখাও। ওই পুবদিকের রাস্তা ধরলে তাঁদের রাজ্য।”
“মহারাজ,” এগিয়ে গেল গবাই।— “ওই যে আপনাদের রাজধানী। এবার ফিরে যান আপনারা।”
পুবদিকের দিগন্তের গায়ে ততক্ষণে ঝিলমিল করছে একটি নদী। তার মাঝখানে ঝলমলে সাদা পাথরের রাজবাড়ি।
“তুমি আমাদের সঙ্গে আসবে না ভাই?” চোখ মুছে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল নন্দিতাদিদি।
গবাই বিষণ্ণ স্বরে বলল, “না, দিদি। তার উপায় নেই। তবে তিনি চাইলে আবার দেখা হবে আমাদের।”
তাঁরা হাঁটতে হাঁটতে বার বার পেছন ফিরে গবাইয়ের দিকে তাকাচ্ছিলেন। তক্ষুনি গবাইয়ের মনে হল কে যেন তার হাত ধরে টান মারছে।
“গবাই।” সাধুবাবা তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, “তোমার যাত্রা শেষ হল। এবার ফিরে যেতে হবে তোমাকে। এখান থেকে যাওয়ার পর সব ভুলে যাবে তুমি। তবে তোমার কপালে অভিযানের চিহ্ন লেগে আছে। কে জানে, পরে হয়তো আবার দেখা হবে আমাদের।”
ঠিক তার কপালের মাঝখানে নিজের ডানহাতের অনামিকাটি রাখলেন তিনি। কী আশ্চর্য মায়াময় সেই স্পর্শ। গবাইয়ের গোটা শরীর যেন প্রশান্তির ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আসছিল।
তার মধ্যেই কে যেন হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। শেষ মুহূর্তে সে শুনতে পেল, সাধুবাবা বলছেন, “যারা হাত ধরে, তাদের হাত কখনও ছেড়ো না গবাই। হাতে হাত রাখার মধ্যে আছে আশ্চর্য ম্যাজিক।”
॥ আঠারো॥
রঘুর মাথাটা ঘুরছিল। কেমন যেন ঘোর ঘোর ভাব। হঠাৎই মাথা তুলে সে দেখল, বাইরে দুপুরের কড়া রোদ। সে হাঁটু পেতে বসে আছে তাদের ভাঙা টিনের ঘরটায়। বাইরে তার বউ নিস্তারিণী কার সঙ্গে যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গল্প করছে। পাওয়া যাচ্ছে তার ছোটো মেয়েটার গলাও। কীসের জন্য যেন বায়না ধরেছে।
আকাশযান, ব্রহ্মদত্যি, ভূত, মাস্টারমশাই, রাজা— কী কী যেন সব ছিল! সবই কি স্বপ্ন? সেই আংটিটা? কই, আঙুলে নেই তো! তক্ষুনি তার চোখের সামনে ঘরের আলো-আঁধারি ভাবটা কেটে গিয়ে অদ্ভুত একটা ছবি ফুটে উঠল।
কোনও একটা আকাশি দেওয়ালের ঘর। তার একপাশে একটা খাটের ওপরে আধশোওয়া হয়ে আছে গোঁফ-দাড়িওলা একটা লোক। তার গালে গভীর কাটা দাগ। চোখে ধূর্ত ও বদমায়েশি হাসি। সামনে একটা চেয়ার নিয়ে বসে সেই কড়া পুলিশ অফিসারটি। কী যেন নাম? মাধব। বেশ হেসে হেসে গল্প করছেন দুজনে।
হঠাৎই বোধ হয় কেউ এল। বাইরে থেকে ডাকছে। মাধব কী একটা ইঙ্গিত করতে খাটের ওপরে থাকা লোকটা চুপিসারে খাটের তলায় গিয়ে ঢুকল। তখন পুলিশ অফিসারটি গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। সেখানে দাঁড়িয়েই কার সঙ্গে কথা বলছেন। তাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না।
এই কি সেই গুন্ডাটা? এসপি সাহেব যাকে খুঁজছিলেন?
হুঁ! এই তাহলে ব্যাপার। ঘাড় নাড়ল রঘু। আস্তে আস্তে দৃশ্যটা মুছে যেতে লাগল তার চোখের সামনে থেকে। কেউ কিছু বলছে না দেখে রঘু নিজেই বেশ হেঁকে বলে উঠল, “চারবার হল তো? বেশ!”
হাতে হাত ধরে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে মিন্টু আর গবাই। দুজনেই অবাক চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে। মাথার ওপরে ঝিলমিল করছে রোদ। কী যেন তাদের মনে পড়তে-পড়তেও পড়ল না। কেমন ঝাপসা ছবি খেলা করছে মনের ভিতরে। কী যেন ঘটেছে, কী যেন! নাকি সবই মনের ভুল? তারা অনেকক্ষণ হল মাছ ধরতে এসেছে একসঙ্গে? পাছে অন্যজন পাগল ভাবে, তাই দুজনেই চুপ করে থাকল। কেউ কিছু বলল না।
একটা লোক। দু-গালে ঘন দাড়ি, ঝুপো গোঁফ, মাথার চুল উসকোখুসকো। কিন্তু চোখ দুটি খুব উজ্জ্বল। গামছা পরে পুকুরে স্নান করতে এসেছে নিশ্চয়ই। তাদের পাশ দিয়ে জলের দিকে যেতে যেতে মুচকি হেসে বলল, “কী খোকারা, বাড়ি ফিরবে না বুঝি? ভাত খাওয়ার সময় হল তো!”
লোকটাকে খুব চেনা চেনা লাগল গবাইয়ের। কিন্তু চিনতে পারল না। সে মিন্টুর হাতটা চেপে ধরে তাড়া দিল— “চল ভাই। বাড়ি ফিরতে হবে এবার।”
লেখকের অন্যান্য লেখা
কিশোর ঘোষাল ▪ পুষ্পেন মণ্ডল ▪ রঞ্জন দাশগুপ্ত ▪ শাশ্বত কর
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য ▪ মৌসুমী রায় ▪ অদিতি ভট্টাচার্য ▪ অভিষেক ঘোষ ▪ সুস্মিতা কুণ্ডু ▪ সবিতা বিশ্বাস ▪ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪ শংকর লাল সরকার ▪ বাণীব্রত গোস্বামী ▪ সহেলী রায় ▪ অমিয় আদক ▪ সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ▪ সুতপা সোহহং
বদ্রীনাথ পাল ▪ শ্যামাচরণ কর্মকার ▪ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী ▪ স্বপন কুমার বিজলী ▪ সুব্রত দাস ▪ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪ মধুমিতা ভট্টাচার্য ▪ কণিকা দাস ▪ সৌমেন দাস ▪ নীলেশ নন্দী
রম্যাণী গোস্বামী ▪ দীপঙ্কর চৌধুরী ▪ বিশ্বদীপ সেনশর্মা ▪ রণিত ভৌমিক
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ অরিন্দম দেবনাথ ▪ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ▪ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪ সুশান্ত কুমার রায় ▪ ড. উৎপল অধিকারী
অলংকরণ
মায়াসখা নন্দী ▪ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ▪ একপর্ণিকা ক্রিয়েটিভস
আমাদের আশেপাশে যেসব মানুষরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁদের সকলের সঙ্গে আমাদের আলাপ-পরিচয় হয় না। অথচ এঁদের মধ্যে অনেকেই অসাধারণ সব গুণের অধিকারী। গুণময় রায় এরকমেরই একজন মানুষ। তিনি একজন বিজ্ঞানী। নিজের পরিচয় দেন ‘ইনভেনটর’ বলে। বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও তুখোড়। আবার ভারতীয় পুরাণ, ইতিহাস এবং পুরাতাত্ত্বিক বিষয়েও তাঁর গভীর জ্ঞান।
এ-হেন মানুষটির সঙ্গে কয়েকজন স্কুল-ছাত্রের নিতান্ত আকস্মিকভাবেই আলাপ হয়ে যায়। তাদের কাছে গুণময় রায় খোলসা করেন তাঁর কয়েকটি আবিষ্কারের কথা। একে একে খুলে যায় আশ্চর্য সব জগতের দরজা, যার তুলনা আর কোথাও নেই। কখনও নিজের মনোজগত, কখনো-বা প্রজন্মবাহিত স্মৃতির সরণিতে অক্লেশে ঘুরে বেড়ান ‘গুণময় দ্য গ্রেট’, আর পাঠকেরাও সুযশ মিশ্রের জবানিতে স্বাদ পায় সেই অতুলনীয় অ্যাডভেঞ্চারগুলির। বিচিত্রতর যাত্রাপথে সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত থেকে শুরু করে যুদ্ধরত মহাদেব—কতজনের সঙ্গেই না দেখা হয়ে যায় তাদের।
দুই শতাব্দী। গোটা বিশ্ব চরম অস্থির। একের পর এক ঘটে চলেছে ঐতিহাসিক ঘটনা। তারই মাঝে সে নজরদারি করে চলেছে গোটা বিশ্ব। খিদিরপুর থেকে চিনের ক্যান্টন, সুদূর আফ্রিকার সাভো নদীর তট থেকে ইম্ফল, নিউ পাপুয়া গিনির রহস্যময় ভূগর্ভস্থ জগৎ - কোনও স্থানই তার দৃষ্টিপথের বাইরে নয়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পথ চলে তার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সে নির্দেশ অমোঘ, অলৌকিক। তা অমান্য করার সাধ্য কারও নেই। সে জিচোলা তাতু। রহস্য, রোমাঞ্চ, ভয়, অলৌকিক, যুদ্ধ আর ইতিহাস দিয়ে গেঁথে তোলা হয়েছে রুদ্ধশ্বাস দুই শতাব্দীর আখ্যান।