বড়ো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
বড়ো গল্প
মেঘনা নাথ
(এক)
পিন্নুরা নতুন যেখানে ভাড়া নিয়ে এসেছে, সে-জায়গাটা বেশ খোলামেলা। মোটামুটি ছোটোখাটো কয়েকটা বাড়ি নিয়েই ওদের পাড়াটা, সেগুলোও যে খুব গায়ে গায়ে তেমনটা নয়। তাতে পিন্নু পড়েছে মুশকিলে। প্রথমদিন এসে তো এত এত খোলা মাঠ দেখে আনন্দে নেচে উঠেছিল প্রায়, নতুন পাড়ার নতুন বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে খেলা হবে ভেবে। কিন্তু কপালটাই খারাপ। নতুন বাড়িতে এসে সব গুছিয়ে থিতু হওয়ার আগেই কোভিডের জন্য আচমকা লকডাউন—বাড়ি থেকে বেরোনোই বন্ধ, নতুন বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ, খেলাধূলা তো অনেক দূরের ব্যাপার! আর সেই যে স্কুল বন্ধ হল, তারপর আর খোলার নামটি নেই। বাবার অফিস অবশ্য খোলা, কিন্তু ট্রেন বন্ধ, তাই বাবা সাইকেল নিয়েই পাড়ি দেন অনেকটা পথ, ফিরতে ফিরতে সন্ধে গড়িয়ে বেশ রাত হয়। আগের মতো অফিস থেকে ফিরে চা-জলখাবারের বাটি নিয়ে ‘কই রে পিন্নু-মুন্নু! গল্প শুনবি নাকি!’ বলে হাঁক দেওয়ার সময় কই? ভোর থাকতে থাকতে বেরিয়ে যেতে হয়, দেরি হলেই জরিমানা। একেই তো টানাটানির সংসার, তার ওপর আবার জরিমানা দিতে হলে আর হাতে থাকে কী?
পিন্নু অবশ্য এতসব জানে না। সে শুধু দেখে চিন্তায় শুকিয়ে আসা বাবার মুখ, সারাদিন ঘরের সমস্ত কাজ সামলে মায়ের রোগা হয়ে আসা দুই হাত, আর তার ছোট্ট বোনু মুন্নুর কিচ্ছু না বোঝা খুদে খুদে দাঁত বের করা হাসি। বাইরে খেলতে না যাওয়ার, বন্ধুদের সঙ্গে দিনের পর দিন দেখা না হওয়ার মনখারাপগুলো তাই নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখে সে। আর তো সে ছোটোটি নেই, সাত পেরিয়ে আট বছর বয়স হল যে! বোনু আসার আগে মা-বাবা বার বার ওকে বোঝাতেন—পিন্নু এবার বড়ো দাদা হবে, অনেক দায়িত্ব! আগের মতো কথায় কথায় বায়না জোড়া চলবে না। তাকে দেখেই না বোনু বা ভাই যে আসবে, সব শিখবে!
তা দায়িত্ব পালন করে বটে পিন্নু। হাসপাতাল থেকে মা যেদিন মুন্নুকে নিয়ে এল, সে একটু চমকে গেছিল বটে। সে বেশ খেলার সঙ্গী আসার আনন্দেই মশগুল ছিল, বোনু যে একেবারে এইটুকু হবে সেটা ঠিক বুঝতে পারেনি। তবে তারপর থেকে মা কাজে ব্যস্ত থাকলে মুন্নুকে পাহারা দেওয়া, কখনো-কখনো মুন্নুর ভিজে কাঁথা পালটানো, মুন্নু হামা টানতে শিখলে চোখে চোখে রাখা, স্কুল বন্ধ হওয়ার পর থেকে রোজ নিয়ম করে মুন্নুকে ‘বাবা’, ‘মা’, ‘দাদা’ বলতে শেখানো—এসব সে বেশ মনোযোগ দিয়েই করে চলেছে।
কিন্তু মুশকিল হয়েছে, এখন সারাদিন এতটা সময় যে কী করে কাটাবে সেটাই বুঝতে পারছে না পিন্নু। মুন্নুর সঙ্গে খেলতে ভালো লাগে বটে, কিন্তু সে তো সবে হাঁটা, টলোমলো পায়ে একটু আধটু দৌড় শুরু করেছে। তার সঙ্গে বেশি হুটোপাটি করলে মা বকা দেন। লুকোচুরি খেললেও পিন্নুকে প্রায় মুন্নুর চোখের সামনেই লুকোতে হয়, নইলেই সে এত্ত বড়ো হাঁ করে কান্না জুড়ে! মাঠে গিয়ে ছুটোছুটি করে দস্যিপনা না হোক, অন্তত ঘরের মধ্যেই ধরাধরি, কুমিরডাঙা এসব একটু খেলতে পারলেও পিন্নুর মনের ছটফটানিটা খানিক কমে। ফোনে বা টিভিতে কিছুটা সময় কাটে বটে, তবে পিন্নুর বাবার কড়া নিয়ম—পড়াশোনার দরকার না থাকলে পিন্নু যেন মা বা বাবার ফোনে খবরদার হাত না দেয়, টিভিও দিনে আধঘণ্টার বেশি একদম নয়!
পিন্নুদের বাড়ির বেশ খানিকটা পিছনে একটা বাড়ি আছে। পিন্নুরই বয়সি বা একটু হয়তো বড়ো একজনকে পিন্নু প্রায়ই দেখে ছাদে কিংবা বাগানে ঘুরে বেড়াতে একা একা। খুব ইচ্ছে করে পিন্নুর, দাদাটার সঙ্গে আলাপ করতে। মনে মনে ভাবে, দাদাটার বাড়িতে কি ক্যারম বোর্ড আছে? ক্রিকেট ব্যাট? বা ব্যাডমিন্টন র্যাকেট? ও গেলে ওকে খেলতে নেবে? ধরতে দেবে খেলার জিনিসগুলো? তাকিয়ে থাকতে থাকতে কতবার চোখাচোখিও হয়ে গেছে। কিন্তু চেঁচিয়ে ডেকে কথা বলবে ভাবলেই রাজ্যের লজ্জা এসে জড়ো হয়। যদি শুনতে না পায়! যদি শুনতে পেয়েও সাড়া না দেয়! আর সাড়া দিলেও-বা, চিৎকার করে কতক্ষণ আর গল্প করা যায়! কোনোভাবে যদি পিন্নুদের বাড়িতে ওর বন্ধুদের নিয়ে আসা যেত! বা ও-ই চলে যেতে পারত বন্ধুদের বাড়িতে!
কয়েক দিন খুব কষ্ট করে মনের ভেতর ছটফটানিটাকে চেপে রাখলেও শেষে আর কিছুতেই পারল না পিন্নু। বিকেল হলেই আগের পাড়ার খেলার মাঠে, কাছেপিঠের সব কচিকাঁচা মিলে বেজায় হইচই, হাহাহিহির কথা মনে পড়ে আর মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠে। আর সেই সুযোগে পিন্নুর মনের মধ্যে যে আর একটা বিচ্ছু পিন্নু আছে, সে বলে ওঠে—‘যাও না কাল একবার চুপিচুপি। বাড়ির সামনে গিয়ে ডাকলে বেরিয়ে আসবে না, একটুও খেলবে না তাই হয়?’
পিন্নু তাড়াতাড়ি তাকে চাপা দিয়ে বলে, ‘না! না! মা-বাবা বারণ করেছে যে বার বার করে!’
বিচ্ছু পিন্নু মুখ বেঁকিয়ে বলে, ‘কত্ত গুড বয় একেবারে! কাল যে বাবার দেওয়া পনেরোটা অঙ্কের মধ্যে শেষ তিনটে খাতা দেখে দেখে করেছ, সেটা বুঝি বাবা বলে দিয়ে গেছিল?’
কাঁচুমাচু হয়ে পিন্নু বলে, ‘বা রে! বিকেলবেলায় অঙ্ক করতে ভালো লাগে বুঝি! অঙ্কগুলো তো মেলাতে পারছিলাম না কিছুতেই।’
‘এই জন্যই তো বলছি একবার ঘুরে এসো। দেখবে তারপরেই মনখারাপও ভ্যানিশ, অঙ্কগুলোও কেমন চটপট মিলে যাচ্ছে।’
রোজ এরকম বিচ্ছু পিন্নুর সঙ্গে দড়ি টানাটানি করতে করতে একদিন মরিয়া হয়ে পিন্নু ভাবল—নাহ্, এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। দুপুরবেলা, মুন্নুকে স্নান করানোর পর মা নিজে যখন স্নান করে একটু বসার সময় পান, তখন মায়ের মনটা একটু নরমমতো থাকে—পিন্নু খেয়াল করে দেখেছে। মায়ের কাছে গিয়ে একবার শুধু আস্তে করে—“মা, কাল একবার ওই পিছনদিকের বাড়িটায় যাব? ওই যে ওখানে একটা দাদা থাকে আমি দেখেছি—একটু খেলতাম…” বলতেই মা এমন কটমট করে তাকালেন যে ভয়ে পিন্নুর গলা শুকিয়ে কাঠ। মুখ নামিয়ে পা ঘষে ঘষে আবার মুন্নুর পাশে এসে বসল সে।
খানিক বাদে মা ঘরে ঢুকে দেখলেন তখনও পিন্নু একইভাবে চুপ করে বসে। হঠাৎ খুব মায়া হল তাঁর। সত্যি বলতে খুবই বাধ্য ছেলে পিন্নু, তার দস্যিপনা করার একমাত্র জায়গা ছিল ওই খেলার মাঠ। সেসব বাদ দিয়ে কতদিনই-বা এইটুকু ছেলের ঘরে বন্দি থাকতে ভালো লাগে! স্কুলও বন্ধ, মাসে দু-বার করে শুধু মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা ঘরের কাজ দিচ্ছেন—ঘরে বসে বসেই সেগুলো করছে, আবার মিড-ডে মিলের চাল-ডাল দেওয়ার দিন তিনি গিয়ে সেগুলো জমা দিয়ে আসছেন। এই তো চলছে কয়েক মাস ধরে! সারাদিন ঘরের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন তিনি, মুন্নুকে সামলে ওর দিকে নজর দেওয়ার সময় পান কই সেরকম! কিন্তু ছেড়ে দেওয়াও বিপদ, একবার গেলে রোজই যাওয়ার বায়না করবে। এই অসুখবিসুখের সময় সকলেই যে রোজ রোজ বাড়িতে অচেনা কারও আসা পছন্দ করবে তা তো নয়!
সাতপাঁচ ভেবে শেষে বললেন, “ও পিন্নু! যা তো, তোর হ্যাল্লোদাদুর জন্য টিফিন কৌটো করে একটু তরকারি দিচ্ছি, দিয়ে আয় দেখি চট করে! বুড়ো মানুষ একা একা থাকেন, কী বাজার করছেন, কীই-বা রান্না করছেন কে জানে।”
হ্যাল্লোদাদু থাকেন পিন্নুদের বাড়ির ঠিক উলটোদিকের ছোট্ট একতলা বাড়িটায়। একা মানুষ—হাসিখুশি, গোলগাল চেহারা, চোখে এই মোটা কাচের চশমা—সব মিলিয়ে পিন্নুর বেশ পছন্দ। এ-পাড়ায় আসার পরে একমাত্র এই একজনের সঙ্গেই যা আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল ওদের, তারপরেই তো দুমদাম সব বন্ধ, ঘরবন্দি। প্রথম দেখাতেই হ্যাল্লোদাদু এক হাঁক ছেড়ে পিন্নুকে বলেছিলেন, ‘হ্যাল্লো ইয়ং ম্যান! হাউ ডু ইউ ডু?’ ব্যস। সেই থেকে পিন্নু হ্যাল্লোদাদু বলেই ডাকে। তবে বাড়ির ভিতরে যায়নি যদিও কখনও।
তাই একটু অবাক হয়ে বলল, “আমি যাব?”
“হ্যাঁ, যা। আমি দরজার সামনে দাঁড়াচ্ছি। একটু পরেই চলে আসবি কিন্তু। ভাত বাড়ছি আমি।”
পিন্নু খুব রাজি। এই সুযোগে অন্তত এই দুখানা ঘর থেকে তো বেরোনো যাবে কিছুক্ষণের জন্য! চট করে হাওয়াই চটি গলিয়ে, রান্নাঘরে মায়ের হাত থেকে টিফিন কৌটো নিয়ে দে দৌড়।
(দুই)
কলিং বেল বাজানোর একটু পরে দরজা খুলে হ্যাল্লোদাদু পিন্নুকে দেখতে পেয়েই হাসিমুখে বলে উঠলেন, “আরে আমার ইয়ং ম্যান যে! কী ব্যাপার?”
টিফিন কৌটোটা বাড়িয়ে দিতে হ্যাল্লোদাদু আরও খুশি হয়ে ওকে ভিতরে ডেকে নিলেন।
ভিতরে এসে পিন্নু হাঁ! বাড়ির ভিতরে র্যাক, তাক, আলমারি-ভরতি শুধু শয়ে শয়ে বই! এত বই এক জীবনে মানুষ পড়ে শেষ করতে পারে? আলমারি, র্যাকগুলোর পিছনে আদৌ দেওয়াল বলে কিছু আছে তো নাকি! কিচ্ছু যে দেখা যায় না। পিন্নু হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে হ্যাল্লোদাদু হো হো করে হেসে বললেন, “বুড়োমানুষের আর যে বন্ধু নেই ইয়ং ম্যান! হতুম তোমার মতো তরতাজা, দেখতে সাঙ্গোপাঙ্গ জুটিয়ে সারাদিন কী দস্যিপনাই না করতুম! বইয়ের কাছে ঘেঁষতুমই না মোটে!”
“তুমি বুঝি ছোটবেলায় খুব দুষ্টু ছিলে হ্যাল্লোদাদু?”
“ছিলুম মানে! মা-বাবা এক-এক সময় রীতিমতো বেঁধে রাখত, বুঝলে! গ্রামের যত ছেলেছোকরা সারাদিন শুধু টইটই টইটই। পারলে পাঠশালাটাই শিকেয় তুলে দিই।”
পিন্নু দেখে নিজের ছোটবেলার কথা বলতে বলতে হ্যাল্লোদাদুর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। এক মুখ ঝলমলে হাসি নিয়ে কথাগুলো কি পিন্নুকেই বলছেন, নাকি নিজেকে? ইস, অমন সময়টা যদি পিন্নুর ছোটবেলাতেও থাকত! বাবা-মায়ের ছোটবেলাতেও কত মজার মজার গল্প আছে, শুধু পিন্নুর ছোটবেলাতেই ঘরের মধ্যে আটকে থাকা। এ ভারি অন্যায় কিন্তু, যাই বলো আর তাই বলো।
এসব ভেবে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল পিন্নু। হঠাৎ কানে ঢোকে হ্যাল্লোদাদু বলছেন, “আমার তো তখন কেঁদে ভাসানোর মতো অবস্থা। একমাস নট নড়নচড়ন হয়ে থাকব, আমি? বলে কী!”
ঘোর ভেঙে পিন্নু জিজ্ঞাসা করে, “কী হয়েছিল তোমার দাদু?”
“আরে, ওই যে বললুম না, ফুটবল খেলতে গিয়ে পা ভেঙে কুপোকাত! কিন্তু তার যা যন্ত্রণা, তার থেকেও বেশি কষ্ট পেয়েছিলুম শুনে যে কম-সে-কম একমাস পুরো চিলেকোঠার ঘরে ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে। বন্ধুদের ছাড়া থাকা যায়, বলো তো ইয়ং ম্যান?”
“আমি তো তাই রয়েছি দাদু! তোমার তো মোটে একমাস ছিল, আর আমি যে কত্তদিন খেলতে যাই না, বন্ধুদের কাউকে দেখি না!” মুখ নামিয়ে মনখারাপ-ভরা গলায় বলে পিন্নু।
হ্যাল্লোদাদু ভাবলেন, সত্যি তো! একমাস কী, মাসের পর মাস পেরিয়ে যাচ্ছে, বাচ্চাগুলো তো ঘরেই আটকা পড়ে রয়েছে। এর কাছে নিজের কোন ছোটবেলার মনকেমনের ভাণ্ডার খুলে বসেছেন তিনি। পিন্নুর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বললেন, “বন্ধুদের কথা ভেবে খুব অস্থির লাগলে আমি কী করতুম বলো তো?”
“কী?”
“শোনো তাহলে, তোমায় একটা ম্যাজিক বলে দিই।”
(তিন)
হ্যাল্লোদাদুর শেখানো কথামতো বিকেলবেলা গুটি গুটি পায়ে ছাদে উঠল পিন্নু। যদিও তার মনে ভালোই সন্দেহ, আদৌ কোনও ম্যাজিক হবে কি না কে জানে! ম্যাজিক হলে কি আর এতদিনে সে টের পেত না? মাঝে-মাঝেই তো সে ওঠে ছাদে, কই কোনোদিন কিছু দেখেনি তো! যাই হোক, তবুও গেল ছাদে। কড়া রোদ্দুরটা ততক্ষণে আর নেই, অনেকটা নরম হয়ে এসেছে। একটু একটু করে সূর্যটা হলুদ থেকে হালকা কমলা হচ্ছে। আকাশ জুড়ে ফুরফুরে মেঘ ছড়ানো, তাদের গায়ে ছোপ ছোপ সোনালি রঙ ধরছে। থেকে-থেকেই তারা যেন সাজ পালটে পালটে আসছে। এই সোনালি, তার একটু পরেই কমলা, তারপরেই গোলাপি, মোলায়েম লাল, গাঢ় লাল, তারপরে একটা একটা করে যখন তারা ফুটবে ফুটবে করছে, মেঘগুলো আর আলাদা করে দেখাই যায় না, তখন খানিকটা বেগুনি। দেখতে খুবই ভালো লাগল পিন্নুর। কিন্তু ম্যাজিক কই? বন্ধু কই? যেমন বলেছিল হ্যাল্লোদাদু, তেমন করেই তো আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল! ধুর, এসব নিশ্চয়ই মা-বাবার মতো হ্যাল্লোদাদুরও ওকে চুপ করে একজায়গায় বসিয়ে রাখার প্ল্যান। সব বড়োগুলোই একরকম। আর যাবেই না ও ছাদে। গাল ফুলিয়ে দুম দুম করে পা ফেলে নেমে এল পিন্নু।
কিন্তু না গিয়েই-বা করবেটা কী! সেই তো মুন্নুর সঙ্গে খানিকক্ষণ খেলার পরে একা একা ব্যাজার মুখে বসে থাকা। তাই আপনমনে খানিক গজগজ করতে করতে পরদিন আবার একই সময়ে ছাদে গেল পিন্নু। আজ আবার আকাশ অন্যরকম। কালকের মতো ফুরফুরে ভাবটা নেই, বেশ গুমোটের মধ্যে মেঘগুলো যেন বুড়ো দাদু সেজে ধূসর রঙের মাংকি টুপি পরে লাইন দিয়ে বসে আছে। এক্ষুনি যদি বৃষ্টি পড়ে, অমনি সব মেঘদাদুরা ভিজে চুপচুপে হয়ে হ্যাঁচ্চো আরম্ভ করে দেবে। কথাটা ভেবেই বেজায় হাসি পেল পিন্নুর।
এইবার খানিকটা মজা পেয়ে গেল পিন্নু। বিকেল হলে রোজই গিয়ে দেখে আকাশে মেঘ আছে কি না, থাকলে নিজের মনে মনে এটা ওটা ভেবে নেয় তাদের নিয়ে। আজ বুড়ো দাদু, তো তার পরের দিন দূরে নীল পাহাড়, তার পরের দিন হয়তো আকাশ জুড়ে মেঘগুলো সব ইয়া বিশাল বিশাল ভ্যানিলা আইসক্রিম হয়ে রয়েছে! কিন্তু হ্যাল্লোদাদুর কথামতো কোনও বন্ধুর দেখা না পেয়ে পিন্নুর মনটা বড্ড খুঁতখুঁত করে। ভাবে, দাদু সময় কাটানোর জন্য সান্ত্বনা দিয়েছেন হয়তো। তবে দাদুর কথা শুনে একদমই কিন্তু তা মনে হয়নি, নইলে কি আর রোজ সে নিয়ম করে ছাদে ওঠে?
এমনি করেই একদিন হঠাৎ এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। রোজকার মতো সেদিনও পিন্নু যথারীতি ছাদে উঠে নিজের মতো খানিকক্ষণ হাত-পা নেড়ে আগডুম বাগডুম বকে নেমে আসছিল ছাদ থেকে। হঠাৎ মনে হল আকাশে কী যেন একটা হল! আবার ফিরে তাকাতেই ও কী অদ্ভুত কাণ্ড!
আজ সেরকম একটা মেঘ ছিল না আকাশে—এদিক ওদিক ছাড়া ছাড়া ভাসা ভাসা ফুরফুরে সাদা মেঘ। সেগুলোকে নিয়ে কিছুই সেরকম গল্প বানাতে না পেরে শেষে ওগুলোকে মুন্নুর মতো মেঘেদের পুঁচকে ছানা ভেবে এতক্ষণ তাদের উপরেই একটু দাদাগিরি ফলাচ্ছিল পিন্নু। এখন দেখে ঠিক ওদের বাড়ির উপরেই যেন সেগুলোর কিছুটা জড়ো হয়েছে। ভালো করে তাকালে সত্যি-সত্যিই যেন চোখ-মুখ-হাতের আভাসে কতগুলো মেঘের ছানার মতোই দেখতে লাগছে। তার মধ্যে একজন আবার হাত নেড়ে ওকে কাছে ডাকছে।
নির্ঘাত চোখের ভুল। চোখ দুটো একদম টিপে বন্ধ করে রেখে খানিক বাদে খুলে দেখে এখনও সব একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আবার ওর কাণ্ড দেখে একজন আর একজনের গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়া হচ্ছে!
কান খাড়া করে শুনল পিন্নু। ঠিক মানুষের মতোই বলছে ছানা মেঘগুলো, “ওই দ্যাখ দ্যাখ কেমন করছে! ভাবছে চোখের ভুল।“
“শুধু কি আর চোখের ভুল, কানের ভুলও ভাবছে নিশ্চয়ই!”
“এবার চিমটিও কাটবে, দ্যাখ না মজাটা!”
ধাঁ করে রেগে গেল পিন্নু। ইয়ার্কি নাকি! একটু হাওয়া দিলে কোথায় উড়ে যাবে তার নেই ঠিক, ওকে নিয়ে ঠাট্টা করছে! বেজায় চটে সে বলল, “মোটেও চিমটি কাটব না। এ আবার দেখার কী আছে? ভুলই তো। মেঘ কখনও কথা বলতে পারে, না তাদের হাত-পা আছে? হুহ্!”
“ও বাবা! কেন বলতে পারে না শুনি? একা তোমারই শুধু কথা বলার দরকার আছে? আমাদের নেই?” একটু লম্বা মতো, ধূসর, গম্ভীর এক মেঘ ছানা ধমকে ওঠে।
“না… মানে থাকতেই পারে।” খানিক আমতা আমতা করে পিন্নু বলে, “তা, এত ভাষা থাকতে শুধু বাংলাতেই মেঘেরা কথা বলে বুঝি? আরও তো কত ভাষা আছে!”
“তাই তো! তুমি আর কী কী ভাষা জানো গো শ্রীমান পিন্নুচন্দ্র? বলে ফ্যালো দেখি ঝটপট!” হাত ধরে ভাসতে থাকা মেঘেদের মধ্যে ঘন কালো আর এক মেঘ ছানা বলে ওঠে।
পিন্নু পড়ল ফ্যাসাদে। একে তো এদের হাসাহাসির ঠেলায় আর শ্রীমান পিন্নুচন্দ্র বলায় তার গা একেবারে জ্বলে গেছে, তার উপরে সত্যি বলতে সে আর কোনও ভাষা তেমন জানেও না। ইংরেজিতে তার জ্ঞান একেবারে সামান্য, কিন্তু সেসব তো এদের জানানো যাবে না। তাই উলটো চাপ দেওয়ার জন্য সে বলে, “আচ্ছা ওসব বাদ দাও। কিন্তু শুধু আমি কেন তোমাদের কথা শুনতে পাচ্ছি? কই, এতদিন তো পাইনি? কেউ তো বলেনি আমায় যে মেঘেরাও কথা বলে?”
“উফ্, কোথায় আমরা হ্যাল্লোদাদুর কথা শুনে বন্ধু হতে এলাম, আর এর প্রশ্ন শেষ হয় না! চল তো সব, বাড়ি যাই।” ধূসর মেঘ ছানা আবার বলে।
“না না, চলে যাচ্ছ কেন? আমি কি যেতে বললুম নাকি? কী মুশকিল!” পিন্নু মরিয়া হয়ে ওঠে।—“কিন্তু তোমাদেরও হ্যাল্লোদাদু কোথা থেকে এল? হ্যাল্লোদাদু তো শুধু আমি ডাকি!”
“ভারি হিংসুটে তো তুমি! সবকিছুই তোমার একার নাকি?” কালো মেঘ ছানা এবার রীতিমতো গর্জে ওঠে—“হ্যাল্লোদাদু না বলে দাদুর নাম বললে তুমি চিনতে? হ্যাল্লোদাদু এত করে তোমার কথা বলল বলেই না আমরা এলাম, নইলে এত ক্যাবলা আর হিংসুটে ছেলের সঙ্গে মোটেও আমরা বন্ধু পাতাই না।”
এতক্ষণ চুপ করে থাকা ফুরফুরে সাদা তুলোর বলের মতো ছোট্ট এইটুকু এক মেঘ ছানা বলে, “আরে ও তো কিছু জানেই না। অবাক তো হবেই। তোমরা এরকম করে বলছ কেন ওকে দাদা?”
“হ্যাঁ, ঠিকই তো! নিজেরা কিছু বলে না, ওদিকে আমায় ক্যাবলা বলছে!” দলে লোক, থুড়ি মেঘ পেয়ে পিন্নুর বুকে বল আসে।
“এমনি এমনি বলা যাবে না।” ধূসর মেঘ ছানা জবাব দেয়, “কিছু ছাড়ো আগে!”
“ছাড়ব মানে? কী ছাড়ব?” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় পিন্নু।
“হাজমোলা, চুইং গাম—যা হয়! তিনজনের তিনটে। চটপট দাও। এক্ষুনি তোমার মা ডাকবে।”
“আমি এখন ওসব পাব কোথায়? আর তোমরা ওসব নিয়ে কী করবে?”
“বটে! আবার প্রশ্ন? তোমার পকেটে আধখানা বাবল গাম নেই বলছ?”
এবার পিন্নু প্রায় কেঁদেই ফেলে আর কী! বন্ধু পেতে গিয়ে কারা জুটেছে এসব ওর কপালে! এত্ত চিমটি কাটা সব কথা বলে এখন আধখানা বাবল গাম অবধি নিয়ে নিচ্ছে? জানছে কী করে এত? অনেক বায়না করায় বাবা দুটো এনে দিয়েছেন ক’দিন আগে; একটু একটু করে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে খেয়ে শেষ আধখানা পড়ে আছে। তারও আবার ভাগ!
ওর কাঁদো কাঁদো অবস্থা দেখে ধূসর ছানা মনে হয় আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখনই মায়ের গলা ভেসে এল—“একা একা ছাদে এতক্ষণ কী করছিস পিন্নু?”
অমনি কালো মেঘ ছানা বলে, “আমরা এবার পালাই। যদি চাও আমরা আবার আসি, তোমার পড়ার টেবিলের পাশে জানালায় কিছু রেখে দিও।” তারপরেই চোখের পলক পড়তে না পড়তেই পিন্নু দেখে তিনজনেই হাওয়া।
(চার)
সেদিন সন্ধেবেলা যতই বকা খাক, পিন্নু একফোঁটা মন বসাতে পারল না পড়ায়। একবার মনে হল নিশ্চয়ই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল ছাদে, স্বপ্নে ভুলভাল দেখেছে। নইলে আকাশে অত দূর থেকে কেউ কথা বললে তো সারা পাড়ার লোক জড়ো হয়ে যাওয়ার কথা! কই, সে ছাদ থেকে নেমে আসার পরে তো মা কিছু বললেন না! আর কেউ শুনতে না পেলেও, মা তো নিশ্চয়ই শুনতে পেতেন। কিন্তু মা ডাকার পরেই তো সে তখনই ছাদ থেকে নেমে এল, ঘুমিয়ে থাকলে কি তা পারত?
দু-বার কানমলা, শেষে সারারাত জাগিয়ে রেখে পড়াশোনা করার ভয় দেখিয়েও যখন পিন্নুকে কোনোভাবেই এক লাইনও পড়ানো গেল না, ক্লান্ত বাবা আর বেশিক্ষণ চেষ্টা না করে পিন্নুকে ছুটি দিয়ে দিলেন। বাবা পাশের ঘরে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ ইতস্তত করে পিন্নু সন্ধেবেলা মায়ের বানানো আলুকাবলি ওর পড়ার টেবিলের পাশে জানালায় একটু একটু করে তিনটে ভাগে রেখে দিল। ওদের কম পড়লে পড়বে, মায়ের বানানো আলুকাবলি মোটেও ও এর থেকে বেশি ভাগ দিতে পারবে না। আর আদৌ ওরা আসবে কি না তার নেই ঠিক, শুধু শুধু নষ্ট করা কেন বাপু? কাল সকালে মা দেখতে পেলে কানমলাটা তো ওকেই খেতে হবে, তাই না?
রাতে অনেকক্ষণ এ-পাশ ও-পাশ করে শেষে ঘুমিয়ে, পরদিন ঘুম ভাঙতেই পিন্নু একছুটে জানালায়। সত্যি সত্যি চেটেপুটে সাফ! ওরাই খেয়েছে, নাকি মা মাঝে মাঝে যে বিড়ালটাকে খেতে দেন, সেটা এসে খেয়ে গেল? বিড়ালে কি আলুকাবলি খায়? তখনই বাবা রাগী রাগী মুখ করে সেদিনের পড়ার কাজ পিন্নুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে, অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়তে, এসব বিটকেল প্রশ্ন পিন্নুর মনে বিশেষ সুবিধা করতে পারল না।
ছটফট করতে করতে অবশেষে বিকাল আসে। বিকালও নয়, পড়ন্ত দুপুরে, মুন্নুকে ঘুম পাড়িয়ে শুধু মায়ের চোখ লেগে যাওয়ার অপেক্ষা। একছুটে পিন্নু ছাদে। কই, আজও তো কেউ নেই! খাঁ খাঁ করছে আকাশ। খুব অভিমান হয় পিন্নুর। না-হয় তার সেরকম কোনও বন্ধু সত্যিই নেই, বড্ড একা লাগে বলেই না সে এত করে বন্ধু চায়! তাই বলে কি এমনি করে ঠাট্টা করতে হয় তার সঙ্গে? সকাল থেকে কম অপেক্ষা করে রয়েছে সে!
মাথা নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটু বুঝি চোখে জলই এসে গেছিল পিন্নুর। হঠাৎ শোনে কানের কাছে—“দিলেই যদি, অতটুকু কেন? অতটুকুতে মন ভরে বুঝি?”
চমকে উঠে পিন্নু দেখে সেই সাদা ফুটফুটে তুলোর বলের মতো ছোট্ট মেঘটা। সঙ্গে সঙ্গে সব অভিমান ফুড়ুৎ। তবে সেটা মুখ ফুটে না বলে মিছিমিছি গম্ভীর হয়ে বলে, “বেশি দেব কেন? তোমরা আমায় কেউ কিছু বলেছ? শুধু তো ঝগড়া করে গেছ কাল।”
“বলব বলেই তো এসেছি আজ। ওর’ম রাগ করে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছ কেন? জানো, ওইটুকু আলুকাবলি খেয়ে কিন্তু দাদারা মোটেও আজ আসতে রাজি হয়নি। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে এসেছি। কথা বলবে না?”
এরপরে আর রাগ করে থাকা যায়? পিন্নু একটু হাসি ফোটায় মুখে।—“স্বপ্নেও শুনিনি মেঘেরা কথা বলে, আবার আলুকাবলিও খায়! সত্যি বলছ, না গুল দিচ্ছ, না আমি ভুল দেখছি, বলো তো?”
“ওমা, গুল হতে যাবে কেন! আমাদেরও তো ভালো ভালো খাবার খেতে ইচ্ছা করে, নাকি? আমাদের আকাশবাড়িতে পাব কোথায় এসব?”
“তাও তো! তাহলে জানলে কী করে ভালো?”
“বা রে, আমাদের আরও মানুষ বন্ধু আছে তো! তাদের থেকেই মাঝে মাঝে আলুকাবলি, ফুচকা, চুরমুর, নিমকি, লজেন্স—এসব টুকটাক পাই আর কী! আকাশবাড়িতে তো শুধু জল আর হাওয়া। ভাগ্যিস তোমরা ছিলে! তাই তো তাও একটু ভালো খেতে পাচ্ছি।”
“আরও মানুষ বন্ধু? এদের তোমরা পেলে কী করে?” অবাক হয়ে পিন্নু জানতে চায়।
“যাদের যাদের তোমার মতো একা লাগে, বন্ধু খোঁজে এদিক ওদিক, তাদের সঙ্গে আমরা বন্ধু পাতিয়ে নিই।” এক গাল হেসে ফুটফুটে মেঘ ছানা বলে ওঠে।
“তা বলে তোমার সঙ্গেও যে খুব বন্ধু পাতাব, মোটেও সেসব ভেবে বোসো না। অনেক খাটাখাটনি করতে হবে তারপর।” পিন্নু আর তুলোর মতো মেঘ ছানা চমকে উঠে দেখে ঘন কালো আর ধূসর মেঘ ছানা হাজির। কালো মেঘের চুলের ফাঁকে ফাঁকে আবার বিদ্যুৎ ঝিকমিক করছে; ধূসর মেঘেরও সারা গায়ে জলের ছোট্ট ছোট্ট বিন্দু চিকচিক করছে।
ধুর, এরা তো না এলেই পারত! পিন্নু মনে মনে ভাবে। ছোট্ট তুলোর বলটা একা থাকলেই ভালো হতো। সবে ভাবছিল ওকে তুলতুলি বলে ডাকবে, ওর আর মুন্নুর খেলনাগুলো ওকে দেখাবে, ব্যস সে-আশায় ঝুপ করে এক বালতি জল। তুলতুলি তবুও একটু নরমসরম, বাকিগুলোর যা প্যাঁচালো কথাবার্তা!
“উঁহু, সেটি হচ্ছে না।”
কানের কাছে কালো মেঘের গুড়ুম শুনে চমকে গিয়ে পিন্নু বলল, “কী হবে না আবার?”
“এই যে ভাবছ আমাদের বাদ দিয়ে শুধু তুলতুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাবে—ওসব হবে না। বন্ধু হলে তিনজনেই হব, নইলে নয়।”
পিন্নু তো হাঁ! শেষে হাত-পা ছুড়ে হাউমাউ করে ওঠে—“তোমরা কী করে সব জানছ আগে বলো তো! ভাল্লাগে না।”
হো হো করে হেসে ওঠে মেঘেদের দল।—“যা কথা হচ্ছে কাল থেকে, সব তো মনে-মনেই। বুঝতে পারোনি? আমাদের কাছ থেকে কিচ্ছুটি লুকোনোর জো নেই তোমার, আমরা সব জানি।”
এতক্ষণে পিন্নুর কাছে কাল থেকে মনে খচখচ করা ধোঁয়াশাটা খানিক পরিষ্কার হল। নইলে পকেটের বাবল গামের কথা এরা জানল কীভাবে, আর কেনই-বা মা বা অন্য কেউ কিচ্ছু শুনতে পেল না, সেটা হাজার ভেবেও ওর মাথায় ঢুকছিল না।
“কিন্তু এ তো ভারি অন্যায়। আমি তোমাদের কথা জানতে পারছি না, তোমরা আমার মনের কথা পড়ে সব জেনে গেলে কী করে হবে?”
“আমাদের মনে আছেটা কী যে তোমাকে জানতে হবে? আমরা তো শুধু জল আর চাট্টি ধুলো—বইয়ে পড়োনি নাকি?”
ধূসর মেঘের কথা শুনে একটু থতমত হয়ে যায় পিন্নু। আমতা আমতা করে বলে, “হ্যাঁ, তা পড়েছি বটে।”
“তবে? ওই দিয়ে কোথায় কি লুকাব বলো দেখি? আমাদের ভিতরেও যা, বাইরেও তা।”
“তোমার মতো অত প্যাঁচালো নই আর কি, বুঝলে না?” ধূসর মেঘ ফোড়ন কাটে। তারপর তুলতুলির গোল গোল চোখ পাকানো দেখে ঢোঁক গিলে বলে, “আচ্ছা আচ্ছা, আর বলব না। তা আজকে কি কিছু খাবারদাবার পাওয়া যাবে, নাকি শুধু মুখেই বকবক?”
খানিক বাদে পিন্নুদের ছাদে সে এক দারুণ দৃশ্য। পিন্নু আর তার সঙ্গে তিন মেঘের ছানা গোল হয়ে বসে রান্নাঘর থেকে চুপিচুপি নিয়ে আসা মায়ের বানানো টক-মিষ্টি আমের আচার তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে। জল আর ধুলো দিয়ে তৈরি মেঘেদের পেটে আচারটা ঠিক কোথায় গিয়ে পৌঁছাচ্ছে, আর আচারের কৌটো দেখে মা প্রশ্ন করলে কী বলবে, সেটা ভাবতে গিয়ে পিন্নুর যদিও খুব একটা জুত করে খাওয়াটা হয়ে উঠছিল না। তার সঙ্গে আবার জুটেছে মনের সব কথা জেনে যাওয়ার জুজু।
তাকে অমন উশখুশ করতে দেখেই হয়তো বা মায়ের আচারের গুণে, কালো মেঘ ছানা একটু নরম হয়ে বলল, “তুমি যতটা ভাবছ, অতটা খারাপ নয় ব্যাপারটা।”
“কোন ব্যাপারটা?” পিন্নু চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করে। কী যেন ভাবছিল এক্ষুণি সে।
“আহা, এই যে মনে মনে সব জেনে যাওয়ার ব্যাপারটা। ওটা না হলে কিন্তু আমাদের পেতে না তুমি।”
“মানে?”
“মানে তুমি সেদিন দেখে ভাবছিলে না যে বুড়ো দাদুরা সব মাংকি টুপি পরে বসে রয়েছে…”
“আর সেই ভ্যানিলা আইসক্রিম…” ধূসর মেঘও আঙুল চাটতে চাটতে জুড়ে দেয়।
পিন্নু এতক্ষণে অবাক হওয়ার সব সীমা পেরিয়ে গেছে, তাই মনে মনে হাঁ হয়ে বাইরে অধৈর্য হয়ে বলে, “সে তো কত কিছুই ভেবেছি, তাতে কী?”
কালো মেঘ ছানাই মনে হয় ওদের মধ্যে বয়সে সবথেকে বড়ো। সে এবার বেশ একটু গুছিয়ে বসে মাস্টারমশাইদের পড়া বোঝানোর মতো করে বলল, “আহা, তাতেই তো বোঝা গেল তুমি অন্যদের থেকে একটু আলাদা! নইলে এত লোকের মনে এতরকম আবোল তাবোল কথা চলছে সারাক্ষণ, সব শুনতে গেলে তো আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। অত শুনে আমরা করবই-বা কী?”
“তাহলে?”
“তাহলে আবার কী! ওই তোমাদের রেডিওতে ঠিকঠাক চ্যানেল না ধরতে পারলে কেমন ঝিরঝির আওয়াজ হয় শোনোনি? খানিকটা সেইরকম সারাক্ষণ চলতে থাকে খুব আস্তে আস্তে। তবে তোমরা যখন আমাদের নিয়ে কিছু ভাবো, সেটা আমরা স্পষ্ট শুনতে পাই। মেঘ করে বৃষ্টি এসে আরাম পাওয়ায় খুশি হলে, নাকি হঠাৎ করে ঝুপ্পুস ভিজে দাঁত কিড়মিড় করলে, সবটাই জানতে পাই আর কী।”
“আর যদি কেউ আমাদের নিয়ে একটু অন্যরকম কিছু ভাবে, যেমনটি তুমি সেদিন ভাবছিলে, সেই ভাবনাগুলো আমাদের কাছে একেবারে গমগম করে বেজে ওঠে।” অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে তুলতুলি বলে উঠল, “আর অমনি আমরা বুঝে যাই, একে আমাদের বন্ধু করে নেওয়া যেতে পারে।”
মনের ভিতরের পাকানো জটগুলো খানিকটা খোলসা হয় পিন্নুর।—“এমনি করেই তাহলে তোমাদের সঙ্গে হ্যাল্লোদাদুর আলাপ হয়েছিল?” জানতে চায় সে।
“ঠিক আমাদের সঙ্গেই আলাপ হয়নি, দাদুর বয়স তো কম নয়!” মুচকি হেসে তুলতুলি জানায়।—“দাদুর যখন পা জখম হয়েছিল, তখন আমাদের অনেক অনেক মেঘ আগের মেঘেদের সঙ্গে দাদুর বন্ধুত্ব হয়েছিল। তারা অনেকেই এখন আর নেই, তবে যারা আছে, তাদের কেউ কেউ এখনও দাদুকে মনে রেখেছে। তাদেরই তো দাদু খবর পাঠিয়েছিল যে এখানে একজন আছে, যার বন্ধু দরকার।”
“তাহলে তোমরা পরের দিনই আসোনি কেন? আমি তো কতক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম!” হুশ করে ভারি অভিমান হয়ে যায় পিন্নুর।
“ইস রে! এমনি এমনি সব হয়ে যাবে নাকি? তার আগে একটু বাজিয়ে দেখে নেব না তুমি কেমন? আদৌ ভিতরে মন বলে কিছু আছে কি না, তাতে কল্পনা আছে কি না, এসব না দেখেই বন্ধু পাতাই আর তারপর তুমি যদি খটখটে আর খিটখিটে একজন মানুষ বেরোও, তার বেলা? সব জায়গায় পরীক্ষা হয়, এখানে হবে না কেন?” ধূসর মেঘ ছানা রে রে করে তেড়েই আসে প্রায়।
“ওসব ছাড়ো, আগে আমাদের দুজনের দুখানা ভালো দেখে নাম দাও দেখি, তুলতুলির মতো। কতক্ষণ আর কালো আর ধূসর হয়ে থাকব?” কালো মেঘ ছানাও সুযোগ বুঝে গর্জে ওঠে—“আমাদেরও তো মানসম্মান বলে ব্যাপার আছে।”
আচমকা এমন বেয়াড়া আবদারে পিন্নু কিছুটা থতমত খেয়ে বলে, “কেন, আমাকেই নাম দিতে হবে কেন? তোমাদের নিজেদের নাম নেই নাকি? সেগুলো বলে দিলেই হয়!”
“উঁহু, আমাদের নিজেদের কোনও নাম নেই।” মাথা নেড়ে তুলতুলি বলে, “তোমরা মনে মনে যদি আমাদের কোনও নাম দাও, সেটাই আমাদের নাম হয়ে যায়।”
“ওই জন্যই তো বলছি, ওর মতো আমাদেরও নাম দাও। ও আমাদের থেকে কত ছোটো, তবুও সুন্দর নাম পেল, আর আমরা বাদ? তোমায় যদি আমরা ক্যাবলা মানুষ বলে ডাকি কেমন লাগবে?” ধূসর মেঘ ছানা পিন্নুকে হালকা হুমকি দেওয়ার চেষ্টা করে।
আঁতকে উঠে পিন্নু বলে, “এই, একদম না। আমি কি নাম দেব না বলেছি? ভাবতে একটু সময় দেবে তো? এমন করে তাড়া দিলে কিন্তু এই পচা নামগুলো ধরেই ডাকব।”
তাই শুনে তিন মেঘ ছানাই মুখে আঙুল দিয়ে বসে। পিন্নু কিছুক্ষণ ছাদের এ-পাশ ও-পাশ পায়চারি করে শেষে কালো মেঘ ছানাকে বলে, “তুমি সারাক্ষণ যা গম্ভীর হয়ে থাকো আর ধমক দাও, তোমার জন্য গর্জন নামটাই ঠিক আছে। পছন্দ?”
পিন্নু ভেবেছিল নাম শুনেই আবার হয়তো তেড়ে আসবে। কিন্তু দেখল কালো মেঘ ছানা বরং এই নাম পেয়ে বেশ খুশি। এই প্রথম মনে হয় পিন্নুর দিকে তাকিয়ে সত্যি সত্যি একগাল হেসে বলল, “দিব্যি হয়েছে। তাহলে আজ থেকে আমার নাম গর্জন।”
ধূসর মেঘ ছানা এবার কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “আর আমি? আমি একাই বাদ পড়ে রইলাম?”
গর্জন তার নতুন পাওয়া নামের মহিমা বোঝাতে এবার তার মেঘ ভাইয়ের উপরেই গুড়ুম করে ওঠে—“চুপ করে বোস না একটু! দেখছিস না পায়চারি করলেই নাম বেরোচ্ছে!”
ধূসর মেঘের যে কী নাম দেওয়া যায়, তা নিয়ে পিন্নু সত্যি ভারি চিন্তায় পড়ে গেল। এটা ওটা মাথায় আসছে ঠিকই, কিন্তু কিছুতেই ঠিক মনের মতো হচ্ছে না। শেষে হঠাৎ ওর ধূসর মেঘের চুলে জড়িয়ে থাকা জলের ফোঁটাগুলোর দিকে চোখ পড়ল, ঠিক যেন এখনই টুপটাপ ঝরে পড়বে বৃষ্টি হয়ে। অমনি কয়েকদিন আগে বাবার কাছে পড়া একটা সুন্দর প্রতিশব্দ মনে পড়ে গেল। ছুট্টে এসে ধূসর মেঘকে বলল, “তোমার নাম বাদল হলে কেমন হয়?”
তাই শুনে তিন মেঘ ছানা মিলে হাততালি দিয়ে নেচে উঠে বলল, “বেশ হয়, খাসা হয়!”
খানিকক্ষণ পরে পিন্নু যখন নীচে নামল, তার ভেজা জামাকাপড় দেখে আর তাকে ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপতে দেখে মা তো অবাক! নিশ্চয়ই পিন্নু ইচ্ছে করে ছাদের কল খুলে জল নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেছে ভেবে আচ্ছা করে বকা দিলেন। তবে পিন্নুর ওইসবে ভ্রূক্ষেপ নেই। নাম পেয়ে তিন মেঘ ছানা যে তাকে খুশির চোটে জড়িয়ে ধরেছিল, সে তখন সেই আনন্দেই মশগুল। মেঘেদের শরীর যে এত স্নিগ্ধ ঠান্ডা হয়, তারা জড়িয়ে ধরলে এমনি করে যে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়, এসব তো সে জানত না এতদিন! তবে একটু বেশিক্ষণ জড়িয়ে ধরলে যে ভিজে চুপ্পুস হয়ে যেতে হয়, সেটাও অবশ্য মাথায় ছিল না। দিক গে মা যত খুশি বকা, কতদিন পরে সে এমন করে বন্ধুদের জড়িয়ে ধরল! তার কাছে ওসব বকা কিচ্ছু নয়।
(পাঁচ)
জমে উঠল পিন্নু, তুলতুলি, বাদল আর গর্জনের বন্ধুত্ব। রোজ বিকালের ধরাধরি, কুমিরডাঙা, লুকোচুরি আর প্রাণভরা হাহা-হিহির চোটে মনখারাপগুলো আর পিন্নুর সামনে এসে দাঁড়াতেই পারে না। এটা ঠিক যে সব খেলাতেই মেঘেদের দল পিন্নুর থেকে বেশ কিছুটা এগিয়েই থাকে। ধরাধরি, কুমিরডাঙাতে তো পিন্নু ওদের জাপটে ধরতেই পারে না ঠিক করে, তার আগেই ওরা হাওয়ায় ভেসে সরে সরে যায়। লুকোচুরিতেও বাদল আর গর্জন দুজন মিলে যা নাকানিচোবানি খাওয়ায় ওকে! ছাদে তো লুকোনোর জায়গা নেই-ই বলতে গেলে, লুকোনোর সঙ্গে-সঙ্গেই ধরা পড়ে যায় পিন্নু। আর যেই মেঘেদের লুকোনোর পালা আসে, ঠিক দূরে আকাশের কোন কোণে অন্য মেঘেদের মধ্যে চুপটি করে লুকিয়ে পড়ে বাদল আর গর্জন। তারপর পিন্নু খুঁজে খুঁজে হয়রান। তুলতুলি যদিও মাঝে মাঝে একটু আধটু ইশারা করে সাহায্য করার চেষ্টা করে বটে। তবে ওদের সঙ্গে খেলায় প্রায়ই হেরে গেলেও পিন্নুর মনে এক ফোঁটা দুঃখ নেই। প্রতিদিনের এত সুন্দর নির্ভেজাল বন্ধুত্বের আনন্দই তার মনপ্রাণ ভরিয়ে রেখেছে।
মা-বাবা তো দেখে অবাক। পিন্নুকে আর পড়াশোনা নিয়ে বার বার করে বকা দিতে হয় না, লক্ষ্মী ছেলের মতো সে ঠিক সময়ে প্রতিদিনের পড়া করে নেয়। খাবার নিয়ে সেভাবে বায়নাও করে না আর। হ্যাঁ, টুকটাক দুষ্টুমি করতেই থাকে, কিন্তু সারাক্ষণ ঘরবন্দি হয়ে থাকার ছটফটানিটা নেই। কী জানি ভেবে সারাক্ষণই তার মুখে দুষ্টুমিষ্টি একচিলতে হাসি লেগেই থাকে।
মা যদিও বেশ চিন্তায় পড়েছেন—বিকাল হলেই এক ছুট্টে ছেলে ছাদে। পুরোনো পাড়াতেও যেমন বিকাল হলে পিন্নুকে আর ঘরে ধরে রাখা যেত না, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে সে যাবেই, এখনও আবার ঠিক তেমনই। কিন্তু কাদের সঙ্গে খেলার জন্য যে সে এমন করে ছুটে ছাদে চলে আসে, সেটাই মা বুঝে উঠতে পারছেন না কিছুতেই। একতলা থেকে স্পষ্ট শুনতে পান পিন্নু ছাদময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে, হাসছে খিলখিল করে। একদিন চুপিচুপি উঠেওছিলেন ছাদে, কিন্তু সেরকম কিছুই চোখে পড়েনি। পিন্নু তো একা-একাই পায়চারি করছিল। চোখমুখ দেখে যদিও মনে হচ্ছিল কারও সঙ্গে যেন গল্প করছে, কিন্তু আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। বাবাকে বলায় বাবা বিশেষ পাত্তা দিতে চাইলেন না। বললেন, “এই বয়সটাই তো ওরকম, কতরকম কল্পনা আসে মাথায়, সেসবই হয়তো করছে কিছু! বাদ দাও না। মনমরা হয়ে ঘরে এককোণে বসে থাকছে না, ঠিকঠাক পড়া করে নিচ্ছে নিজের মতো, খাওয়া নিয়েও ঝামেলা করছে না—আর কী চাই? যা প্রাণে চায় করুক।”
মেনে নিলেন বটে মা, কিন্তু মনের খুঁতখুঁতানিটা রয়েই যায়। থেকে-থেকেই দেখেন কখনও নারকেল নাড়ু, কখনো-বা বাদামভাজা, কখনও আবার ক্রিম বিস্কুট কি নিমকির কৌটো লুকিয়ে লুকিয়ে ছাদে নিয়ে যায় পিন্নু। নেমে আসার পরে রান্নাঘরের একদম ঠিক জায়গায় রেখে দিলেও মায়ের চোখ এড়ানো কি অত সহজ! এক রোববার সকালে তো ওর পড়ার টেবিলের পাশের জানালা থেকে জলখাবারের খানিকটা লুচি-আলুরদমও খুঁজে পেয়েছেন তিনি। বাইরের হাজার চাপে ব্যতিব্যস্ত বাবাকে আর এসব কিছু বলতে চাননি তিনি, সোজা গিয়ে খাবার নষ্ট করার জন্য পিন্নুর কানটি ধরে মুলে দিয়েছেন। তবুও পিন্নু মুখ খোলেনি। তবে পরের দিন থেকে খাবারের কৌটো নিয়ে ছাদে ওঠা অনেকটাই কমে গেছে। বাবার মতোই ব্যাপারটাকে ছেলেমানুষি খেয়াল বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও, মায়ের মন একটু তো খচখচ করেই।
মায়ের মনে কিছু যে একটা সন্দেহ হচ্ছে, তা পিন্নু ভালোই বুঝেছে। সত্যি বলতে লুচি-আলুরদম তাদের বাড়িতে বিশেষ একটা হয় না। অনেকদিন পরে সেদিন হয়েছিল আর মা বানিয়েছিলও এত ভালো যে নতুন বন্ধুদের একটুখানি না দিয়ে খেতে তার কেমন কেমন লাগছিল। তাই জানালার পাশে রেখে মনে মনে ওদের ডাক দিয়েছিল, কিন্তু হাওয়ায় ভেসে ভেসে আকাশে মেঘ ছানাদের বাড়িগুলো কিছুটা দূরে সরে যাওয়ায় ওদের আসতে একটু দেরি হয়ে গেছিল। ব্যস, তারপর আর কী, মায়ের কাছে একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল পিন্নু। মায়ের হাতে কানমলার থেকেও বন্ধুদের খাওয়াতে না পারার দুঃখটাই তার বেশি হয়েছিল। ভালো ভালো খাবার ভাগ করে না খেলে তার স্বাদ ঠিকঠাক পাওয়া যায় নাকি?
তাই সে ঠিক করেছিল মাকে সব বলে দেবে। পিন্নুর নতুন বন্ধু হয়েছে জানলে, মা যে নিজে থেকেই ওদের জন্য বেশি বেশি করে খাবার বানিয়ে দিতেন, সে বিষয়ে পিন্নু নিশ্চিত। কিন্তু বাদল, গর্জন, তুলতুলি তিনজনেই মাথা নেড়ে পইপই করে মাকে কিছু জানাতে বারণ করেছে। বড়োরা শুনলেই নাকি সঙ্গে সঙ্গে মনের ভুল ভেবে সব উড়িয়ে দেবেন। বিশ্বাস তো করবেনই না, বরং পিন্নুকেও ভুলভাল বুঝিয়ে নিজেদের দলে টেনে নেবেন। ব্যস, তারপরেই আর কী, সব খেলা বন্ধ! পিন্নু ‘হ্যাল্লোদাদুও তো কত্ত বড়ো’ বলে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, গর্জনের চোখ পাকিয়ে ‘হ্যাল্লোদাদুর সঙ্গে যখন আমাদের আলাপ হয়েছিল, তখন কি হ্যাল্লোদাদু দাদু ছিল?’ ধমক খেয়ে চুপ করে গেছে। তবে কাউকে একটা বলতে না পারলে তার যে পেট গুড়গুড় করা কিছুতেই থামবে না, তা বুঝে শেষে একদিন মুন্নুকেই ঘরে একা পেয়ে তার কাছে সবটা উজাড় করে দিল পিন্নু। মুন্নু থেকে থেকে আঙুল চুষতে চুষতে সবটাই ভারি মন দিয়ে শুনে তারপর বলল, “গ্লুববপাপভবগ্লিহি।”
এটাকে ‘বাহ্, চমৎকার!’ বলে ধরে নিয়ে পিন্নু বলল, “একদিন তোকেও চুপিচুপি নিয়ে যাব ছাদে, দেখবি কেমন মজা হয়! যাবি? আমার বন্ধুদের দেখবি?”
মুন্নু তার এইটুকু-টুকু দাঁতগুলো দাদাকে দেখিয়ে জবাব দিল, “ব্লাপগ্লিমম!”
ধুর! এমনি করে গল্প করা যায়? কবে যে বড়ো হবে বোনুটা! তখন ওরা সবাই মিলে ছাদে কত্ত মজা করে খেলতে পারবে। আচ্ছা, তখন তো পিন্নুও বেশ কিছুটা বড়ো হয়ে যাবে। আর মেঘের দল? মেঘেরা বড়ো হলে কী হয়?
(ছয়)
সেদিন বিকালে ধরাধরি খেলার এক ফাঁকে, মনের মধ্যে ঘুরঘুর করা প্রশ্নটা মেঘ ছানাদের করেই ফেলল পিন্নু। সঙ্গে-সঙ্গেই বাদল আর গর্জন কেমন থমথমে হয়ে গেল।
“কী আর হয়? আরও বড়ো বড়ো মেঘ তৈরি হয়, তাই না?” তুলতুলি দাদাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আবার কী? আরও ফোলা ফোলা, আরও বড়ো হয়ে যায়। দেখছ না আমরা এই ক’দিনের মধ্যেই আরও লম্বাচওড়া হয়ে গেছি?” বাদল তাড়াতাড়ি করে বলে ওঠে।
কথাটা ঠিকই। কিন্তু গর্জনের মুখ দেখে পিন্নুর কেমন একটা সন্দেহ হল। সে আবার জিজ্ঞাসা করল, “আর আরও বড়ো হলে? তখন কী হয়?”
“তখন মেঘেরা আর আকাশে থাকতে পারে না। অনেক অনেক মেঘেরা মিলে হাত ধরাধরি করে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে।” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গর্জন উত্তর দেয়।
পিন্নুও তেমনটাই আন্দাজ করেছিল, কিন্তু তাও প্রাণপণে আশা করেছিল উত্তরটা যেন অন্য কিছু হয়। গর্জনের উত্তরটা তার সেই আশাটুকুও শেষ করে দিল। সঙ্গে-সঙ্গেই দুঃখে অভিমানে কোথা থেকে যেন একরাশ জল এসে তার দুই চোখ ঢেকে দিল। জলভরা চোখে সে কোনোমতে বলল, “তাহলে তখন আর আমাদের দেখা হবে না? আমায় আবার কোনও বন্ধু ছাড়া একা একা থাকতে হবে?”
তুলতুলি ওদের মধ্যে সবথেকে ছোটো, তাই ও মনে হয় এটা জানত না। পিন্নুর কথা শুনে সেও মুষড়ে পড়ে বলল, “আমাদের খেলাও বন্ধ হয়ে যাবে তখন?”
“উফ্, তা হবে কেন! এই ছিঁচকাঁদুনে দুটোকে নিয়ে আর পারা যায় না।” বাদল ওদের দুজনকে মিছিমিছি ধমক দিয়ে উঠল।
“তাহলে?” দুই হাতে চোখ মুছে পিন্নু সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল।
গর্জন আবার সেদিনের মতো মাস্টারমশাই সেজে পিন্নু আর তুলতুলিকে বোঝাতে শুরু করে।—“জলচক্র জানো? নাম শুনেছ?”
“হ্যাঁ।” পিন্নু মাথা নাড়ে। পরশুদিনই জলচক্র বুঝিয়েছেন বাবা। কয়েকদিন হল পিন্নুর বাবার অফিসের কয়েকজন মিলে একসঙ্গে অফিস যাওয়ার একটা গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন। তাই বাবা আবার আগের মতোই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারছেন। অফিস থেকে ফিরে সন্ধেবেলা গল্পের ছলে পিন্নুকে বিভিন্ন জানা অজানা জিনিস বোঝানোও তাই আবার শুরু হয়েছে। কিছু বুঝুক না বুঝুক, ছোট্ট একটা পুতুল নিয়ে মুন্নুও এই আসরে রোজ সামিল হয়। বাবার কাছে এভাবে গল্প করে করে পড়তে পিন্নুর বেশ ভালোই লাগে।
“বেশ। তাহলে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার পরে কী হয়?”
পিন্নু বাবার কথাগুলো মনে করতে করতে বলে, “ওই তো, বৃষ্টির জল তারপর জমা হয় মাটিতে, পুকুরে, নদীতে, সমুদ্রে।”
“তারপর?”
“তারপর… তারপর সেই জল সূর্যের তাপে বাষ্প হয়ে আবার উঠে যায় আকাশে।” বলতে বলতে পিন্নুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এবার সে বুঝতে পেরেছে গর্জন কী বলতে চাইছে।—“আর তারপর বিন্দু বিন্দু জল আর ধুলোকণা মিলে আবার মেঘ তৈরি হয়। তার মানে আবার আমাদের দেখা হবে?”
“নিশ্চয়ই দেখা হবে। শুধু মাঝখানে কয়েক মাসের অপেক্ষা।” মুচকি হেসে বাদল বলে, “তবে তখন আমাদের একইরকম দেখতে নাও থাকতে পারে।”
“মানে?”
“মানে এখন আমাদের মেঘ শরীরটা যে জল আর ধুলোকণা দিয়ে তৈরি হয়েছে, একেবারে সেগুলোই তো আর ফিরে পাব না, সেগুলো তো আমরা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার পর মাটিতে, নদীতে, সমুদ্রে মিশে যাবে। শুধু আমাদের প্রাণটুকু নিয়ে আমরা ফিরে আসব আকাশে। তারপর আবার যখন বেশ অনেকটা জল বাষ্প হয়ে আকাশে জমা হবে, আমরাও একটু একটু করে মেঘ শরীর ফিরে পাব। আর তারপর যেই না চলাফেরা করার মতো শক্তি পাব, আবার তোমার কাছে চলে আসব। তখন আমাকে দেখতে বাদলের মতো হতে পারে, আবার তুলতুলির মতোও হতে পারে, আবার আমাদের অন্য মেঘ ভাইবোনদের মতোও হতে পারে। হয়তো তখন আবার আমাদের নতুন নতুন নাম দিতেও হতে পারে। তবে মনখারাপ কোরো না, আমরা সবাই একসঙ্গে যাব না। তুলতুলি তো একেবারেই ছোটো। ওর মতো মেঘেদের থেকে বৃষ্টি হয় না। ও থাকবে তোমার সঙ্গে।” একটানা এতক্ষণ কথা বলতে বলতে গর্জন খানিকটা হাঁপিয়ে গিয়ে পিন্নুর পাশে বসেই পড়ল।
“আর তুমি তো আমাদের সবার বড়ো। তুমি কি আগে আগে চলে যাবে দাদা?” তুলতুলি ছলছলে চোখে জিজ্ঞাসা করে।
“আরে তুই আবার কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে? আমরা শুধু পিন্নুর কাছে আসতে পারব না। তুই তো আকাশবাড়িতে আমাদের দেখতেই পাবি। তোরা দুজন এখানে কেমন খেলা করছিস, আমরাও তো সব ওখান থেকে দেখতে পাব। কিচ্ছু বাদ যাবে না। দাদা আগে যাবে, তারপর আমি। শুধু কয়েকটা দিনের তো ব্যাপার।” বাদল তুলতুলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল।
পুরো ব্যাপারটা পিন্নুর মোটেও ভালো না লাগলেও উপায় কী মেনে নেওয়া ছাড়া? প্রথম প্রথম বাদল আর গর্জনকে তার অতটা পছন্দ না হলেও এখন তাদের মধ্যে বেশ ভালোই বন্ধুত্ব। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে টুকটাক চিমটি কাটা কথা শোনায় বটে, কিন্তু সাহায্যও করে কত। সাইকেল চালিয়ে অফিস যেতে গরমে বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে দেখে একদিন খেলার সময় একটু মনখারাপ করেছিল পিন্নু। ওমা, পরদিন সকালে বাবা অফিস বেরোনোর সময় পিন্নু দেখে বাবার সাইকেলের দুই পাশে বাদল আর গর্জন দাঁড়িয়ে! বাবা প্যাডেলে চাপ দিতেই ওরা দুজন পিন্নুর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে, ভাসতে ভাসতে বাবার সাইকেলটা পিছন থেকে আলতো করে ঠেলতে লাগল আর অমনি বাবার সাইকেলও গড়গড়িয়ে চলল অফিসের দিকে। সেদিন যখন বাবা অফিস থেকে ফিরে মাকে বলছিলেন, “কী অদ্ভুত ব্যাপার জানো, আজকে সাইকেল চালাতে কী আরাম লাগছিল! মনে হচ্ছিল যেন আমাকে কিছু করতেই হচ্ছে না, আপনা-আপনি সাইকেলটা এগিয়ে যাচ্ছে!” সেটা শুনে পিন্নু লুকিয়ে লুকিয়ে এক ছুট্টে ছাদে এসে ওদের ডেকে পাঠিয়েছিল। আর মেঘেদের দল এসে পড়তেই ওদের গলা জড়িয়ে ধরে পিন্নুর সে কী আদর! তারপর থেকে এই সেদিন গাড়ির ব্যবস্থা হওয়ার আগে অবধি পিন্নুর বাবার আর সাইকেল চালিয়ে অফিস যেতে অন্তত কোনও কষ্ট হয়নি। তারপর সেদিনও তো, মা ঘুমিয়ে ছিলেন, টের পাননি, মুন্নু একা একা খাট থেকে নামতে গিয়ে আর একটু হলেই পড়ে মাথা ফাটাত। ভাগ্যিস তখন তুলতুলি নীচের ঘরে লুকাতে এসে দেখতে পেয়ে পিন্নুকে হাঁক দিয়েছিল! তাই তো পিন্নু ছাদ থেকে পড়িমরি করে ছুটে এসে চাদর ধরে ঝোলা মুন্নুকে তুলে আবার মায়ের পাশে শুইয়ে এসেছিল। এমন বন্ধুদের ছেড়ে থাকা যায়?
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল পিন্নু। বাদল এসে হঠাৎ ওর কানে সুড়সুড়ি দিতে ও চমকে উঠল।—“কাল থেকে আমি আর দাদা বেশিক্ষণ খেলতে পারব না, বুঝেছ? আমাদের এখন খুব কঠিন ট্রেনিং চলছে। ছুটি পাওয়া মুশকিল।”
“অ্যাঁ? কীসের ট্রেনিং?”
“বা রে, ক’দিন পরেই আমাদের বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার কথা না? তা কখন বিদ্যুৎ চমকাতে হবে, কখন গর্জাতে হবে, কোন দিক থেকে হাওয়া এলে কার পরে কে কার সঙ্গে হাত ধরে বৃষ্টি হয়ে নামবে, সেটা বার বার অভ্যাস না করলে আসল কাজের দিনে যদি ভুল হয়ে যায়? আমার আর দাদার এবার প্রথমবার না? তাই অনেকদিনের পুরোনো মেঘেদের কাছে আমাদের সকাল-বিকাল ট্রেনিং হচ্ছে। ওদের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে আসার উপায় নেই।”
“ধুর! ভাল্লাগে না! এমনিই তো কতদিনের জন্য চলে যাবে তার ঠিক নেই, তার উপর আবার এখন থেকেই কম কম খেলা।” গোমড়া মুখ করে পিন্নু বলে।
“আরে আরে এত মনখারাপ করে না বন্ধু।” পিন্নুর কাঁধে হাত রেখে গর্জন বলে, “যাবার আগে তোমায় দারুণ একটা জিনিস দেখিয়ে তারপরেই যাব। এমন জিনিস যে হতে পারে, তুমি এর আগে ভাবতেই পারোনি কখনও। তোমার কিছুটা সাহায্যও লাগবে অবশ্য।”
“কী জিনিস? কীরকম সাহায্য?”
(সাত)
কয়েকদিন পরের কথা। গুমোট গরম কেটে বৃষ্টি হওয়ার কোনও লক্ষণই নেই, উলটে সেদিন ঝকঝকে নীল আকাশে ঝাঁ-চকচকে রোদ উঠেছে। পিন্নুর মা তাতে বিরক্ত হলেও পিন্নু বেশ উত্তেজিত হয়ে বিকেল হওয়ার অপেক্ষা করছে। সে তো আগে থেকেই জানে, আজ রোদ উঠলেও কাল থেকেই হাওয়া পালটাবে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামা শুধু সময়ের অপেক্ষা। বর্ষার বৃষ্টি নামার আগে আজ এই ঝলমলে রোদের পিছনে কারণও আছে বইকি! আজ যে এক বিশেষ দিন। পিন্নুদের স্কুলের মতো, আজ মেঘেদের আকাশবাড়িতে অ্যানুয়াল স্পোর্টসের দিন যে! প্রতিযোগিতা অবশ্য শুধু একখানা বিষয়েই—যেমন খুশি সাজো। সারা বিকাল ধরে সব মেঘেরা মিলে এক-একটা দল বানিয়ে, যেমন ইচ্ছে সেজে আকাশবাড়ি রাঙিয়ে তুলবে। তাদের সাজে রঙবেরঙের ছোঁয়া দিতেই তো আজ আকাশ এত পরিষ্কার, সূর্যের আলোও এত ঝলমল করছে। বহু বহু বছরের পুরোনো, বুড়ো থুত্থুড়ো মেঘেরা হবেন প্রতিযোগিতার বিচারক আর যে মেঘের দলের সাজ যত জমজমাট হবে, বৃষ্টি হয়ে মাটিতে ঝরে পড়ার পর তারা তত তাড়াতাড়ি মেঘ শরীর ফিরে পাওয়ার সুযোগ পাবে। বছরের পর বছর হয়ে চলা এই প্রতিযোগিতার এটাই পুরস্কার।
গত কয়েক দিনে পিন্নু সেভাবে মনখারাপ করার সুযোগই পায়নি। তার যত ছবিওলা গল্পের বই, আঁকার বই আছে—সব ছাদে নিয়ে গিয়ে তিন মেঘ ছানাকে দেখাতে হয়েছে। তারপর চারজনে মিলে গুরুগম্ভীর আলোচনা হয়েছে, কী সাজলে সবাইকে একেবারে তাক লাগিয়ে দেওয়া যায়। শুধু সাজ ঠিক করলেই তো হবে না, সেইমতো সুজ্জিমামার কাছেও ঠিক সময় ঠিক দিকে আলো ফেলার, হাওয়াকে ঠিক দিকে বওয়ার ফরমায়েশ জানাতে হবে না? তবেই তো সাজ জমবে। এই সাহায্যের কথাই সেদিন গর্জন বলেছিল। প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঠিক হয়, মেঘেরা আকাশবাড়িতে গিয়ে তাদের দলের অন্য মেঘেদের জানায়, সেখানে আবার একপ্রস্থ আলোচনার পর সেগুলো বাতিল হয় বা জানা যায় অন্য কোনও মেঘের দল সেই সাজ আগেই ঠিক করে রেখেছে। অনেক মাথা খাটিয়ে অবশেষে একটা ঠিক করা হয়েছে, তবে সেটা সবার কেমন লাগবে তাই ভেবে পিন্নুর ঘুম-টুম গেছে উড়ে। সবার ঠিকঠাক পছন্দ না হলে তারও যে খেলার সাথীদের ফিরে পেতে দেরি হবে—এ কি কম গুরুদায়িত্ব!
আজ আর বিকেল নয়, দুপুরের খাওয়া হতেই পিন্নু চুপিচুপি একবার ছাদে গিয়ে আকাশে উঁকি মেরে এল। মাকে আর মুন্নুকেও আজ যেভাবেই হোক ছাদে নিয়ে আসবেই, ঠিক করে রেখেছে পিন্নু। মেঘেদের যেমন খুশি সাজো প্রতিযোগিতা বলে কথা, এসব একা একা দেখে কি মজা পাওয়া যায়, না এমন সুযোগও বার বার আসে?
প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে পাঁচ মিনিট পরপর ছাদে উঠে উঁকি মারার পরে অবশেষে দূরে আকাশের এককোণে, গর্জনের কথামতো নীলচে ধূসর মেঘেদের আনাগোনা শুরু হল। তাই দেখেই পিন্নু ছুট্টে একতলায়। বিচারকেরা এসে পড়েছেন, প্রতিযোগিতা শুরু হল বলে! মাকে আর মুন্নুকে নিয়ে আসতে হবে না?
মুন্নুকে জড়িয়ে মা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ করে পিন্নু এসে হাত ধরে টানাটানি করে—‘মা, ও মা, দেখবে এসো, দেখবে এসো’ বলতে শুরু করায় হকচকিয়ে গেলেন। ঘুমের ঘোরে কোনোরকমে বললেন, “উফ্ পিন্নু, একটু শুতে দে বাবা, তুই তোর মতো খেলা কর।”
কিন্তু পিন্নু আজ নাছোড়বান্দা। মাকে আর বোনকে সে ছাদে নিয়ে যাবেই। একনাগাড়ে বেশ কিছুক্ষণ বায়না করার পর মাকে শেষে উঠতেই হল। ভাবলেন, এত করে বলছে যখন, দেখিই গিয়ে, হয়তো পিন্নুর খেলার সাথীদের রহস্যও বোঝা যাবে।
পিন্নুর হাত ধরে, মুন্নুকে কোলে নিয়ে ছাদে উঠে অবশ্য মায়ের বিরক্তি ঘুচে গেল। ঘরের দম বন্ধ করা গুমোটটা ছাদে নেই, বরং অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। আর আকাশ জুড়ে সত্যি সত্যি কী সুন্দর তুলোর মতো ছোট্ট ছোট্ট মেঘ পরপর সারি বেঁধে রয়েছে, ঠিক যেন কু-ঝিকঝিক করে ছুটে চলা খেলনা ট্রেনের ছোট্ট ছোট্ট কামরা। পিন্নু দেখেই হাততালি দিয়ে নেচে উঠল।—“দেখেছ মা, বলেছিলাম না? ওই দেখ মুন্নু, ট্রেন থেকে কী সুন্দর ধোঁয়া বেরোচ্ছে! চলো না মা, আমরা সবাই মিলে এখানে বসে বসে দেখি?”
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। একতলা থেকে মাদুর নিয়ে এসে সবাই মিলে গোল হয়ে বসে পড়া গেল। তারপর যা হল তাই দেখে পিন্নু, পিন্নুর মা দুজনেই হাঁ। মুন্নু অবধি একবারও না কেঁদে চুপ করে আকাশে মেঘেদের কারসাজি দেখতে লাগল। ক্ষণে-ক্ষণেই মেঘেদের রূপ পালটে যাচ্ছে। একবার দেখে মনে হচ্ছে ঘোড়ার পিঠে চড়ে তরোয়াল উঁচিয়ে কারা সব যুদ্ধ করছে; তার খানিক বাদেই ছাইরঙা কতগুলো মেঘ জুড়ে হয়ে যাচ্ছে মস্ত বড়ো এক ভাল্লুক। আবার চোখের পলক পড়তে না পড়তেই ভাল্লুক থেকে পালটে হয়ে গেল হাতির শুঁড়, তারপরেই আবার পেল্লাই এক ড্রাগন, ড্রাগনের হাঁ করা মুখের কাছের মেঘটায় আবার ঠিক সময়ে সূর্যের কমলা আলো পড়ে মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যি ড্রাগনের মুখ থেকে আগুন বেরোচ্ছে!
তবে পিন্নুর তাক লেগে গেল যখন কতগুলো মেঘ এসে আকাশ জুড়ে দারুণ একটা জাহাজ তৈরি করল। হাওয়ায় ভেসে ভেসে ধূসর মেঘগুলো জুড়ে তৈরি হল জাহাজের খোল, সরু কালো মেঘগুলো একে অন্যের উপর দাঁড়িয়ে পড়ে তৈরি করল জাহাজের মাস্তুল, আর সাদা সাদা মেঘেরা পরপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তৈরি করে ফেলল জাহাজের পাল। নীচের দিকে নীলচে ধূসর মেঘেরা মিলে সমুদ্রের ঢেউ বানাতেও ভুলল না। সব মিলিয়ে কী যে অপূর্ব লাগছিল আকাশটা দেখতে তখন! দু-চোখ ভরে দেখে দেখে পিন্নুর আর আশ মেটে না।
হঠাৎই দূর থেকে মেঘ ডাকার আওয়াজ আসায় মা ওদের নিয়ে নীচে নেমে যেতে চাইলেও পিন্নু আটকাল। এখনও তার বন্ধুদের সাজটাই বাকি পড়ে রয়েছে যে! আর তাছাড়া, বাদল তাকে গতকাল যাওয়ার সময় বলে গেছে যে, প্রতিযোগিতার সময় মেঘ ডাকার আওয়াজ মানে বিচারকদের সেটা ভারি পছন্দ হয়েছে—ওটাই ওদের হাততালি।
এরপর আরও কিছু মেঘের দলের তৈরি ডানা-মেলা প্রজাপতি, ঘুড়ি, পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনার পরে, সবার শেষে এল বাদল, গর্জন, তুলতুলি আর তাদের দলের অন্য মেঘেদের পালা। কারণ, কী সাজবে ঠিক করতে করতে তাদের নাম দিতেই দেরি হয়ে গেছিল কিনা!
উত্তেজনায় পিন্নু টানটান হয়ে বসে দেখল কী সুন্দর প্রথমে বাদল আর তার কিছু মেঘ ভাইবোন মিলে একটা মুখ, দুটো হাত বানিয়ে ফেলল। তারপর গর্জন আর তার মেঘ ভাইবোনেরা তৈরি করল মাথার চুল আর সুন্দর একটা খোঁপা। আর সবশেষে তুলতুলি আর তার দুই মেঘ ভাইবোন ছুটে গিয়ে দুই হাতের ফাঁকে ঢুকে পড়তেই, মনে হল আকাশে, একজন মা দুই হাত বাড়িয়ে তার ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে নিচ্ছেন, ঠিক যেমন মুন্নুকে মা কোলে নেন—সেইরকম। পিন্নু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। মা ওদের দুই ভাইবোনকে কোলের কাছে টেনে নিলেন। আর মুন্নুও হঠাৎ করে আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠল, “মাম্মাম্মা!” তখনই দূর থেকে আরও একবার মেঘেদের হাততালির আওয়াজ ভেসে এল।
(আট)
মাস দুয়েক পরের কথা। বর্ষা শুরু হয়ে প্রায় শেষের পথে। লকডাউন আর নেই, যদিও পিন্নুর স্কুল এখনও বন্ধ। মুন্নু এখন দিব্যি মা, বাবা, দাদা বলতে শিখে গেছে। এক-একদিন পিন্নুর আঙুল ধরে এক পা এক পা করে সিঁড়ি দিয়ে উঠেও আসে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির দিনগুলো বাদ দিয়ে এই ক’দিন পিন্নু একা একা বা কখনো-কখনো তুলতুলির সঙ্গে খেলে, কোনো-কোনো দিন হ্যাল্লোদাদুর সঙ্গে তার মেঘ বন্ধুদের নিয়ে গল্প করে আর আঁকার খাতার পাতায় পাতায় হাজারো রঙবেরঙের মেঘের ছবি এঁকেই কাটিয়েছে। প্রতিযোগিতায় তারা দ্বিতীয় হয়েছিল। প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল পালতোলা মেঘেদের দল, আর তৃতীয় হয়েছিল ড্রাগন সাজা মেঘেদের দল। প্রথম হওয়া মেঘেদের দলই সুযোগ পেয়েছে সবার আগে মেঘ শরীর ফিরে পাবার। তবে বাদল আর গর্জনেরও ফিরে আসতে বেশি দেরি নেই, তুলতুলির মুখে খবর পেয়েছে পিন্নু। তাও সব জেনেও অপেক্ষার দিনগুলো কাটতে চায় না। চারজন মিলে হইচই করে খেলা আর দুজন মিলে খেলার ফারাকও আছে বেশ খানিকটা। তার উপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির মধ্যে তুলতুলির মতো ফুরফুরে মেঘেদের বেশি আসাও সমস্যা। একটু ভিজলেই চুপসে যায় কিনা!
সেদিন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও তুলতুলির দেখা না পেয়ে ভারি অভিমান হল পিন্নুর। আজ তো মোটেও বৃষ্টি নেই, আজ আসতে কী হত? তিনদিন ধরে দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না ওর। রেগে গিয়ে চলেই যাচ্ছিল ছাদ থেকে, এমন সময়ে কী যেন হল আকাশে? পিছন ফিরে ভালো করে তাকিয়ে দেখার আগেই চেনা গলায় স্পষ্ট শুনতে পেল—“ওই দ্যাখ দ্যাখ কেমন রেগেমেগে চলে যাচ্ছে!”
“শুধু চলে যাচ্ছে কী, নীচে গিয়ে ফোঁসফোঁস করে চোখের জলও মুছবে কিছুক্ষণ।”
“তারপর আবার বলবে, আর কক্ষনও ছাদে যাবই না, দ্যাখ না মজাটা!”
আনন্দে গোটা ছাদে লাফিয়ে নেচে বেড়াতে ইচ্ছে করলেও পিন্নু মুখে মিছিমিছি রাগের ভান করে, দুই হাত কোমরে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল, তার সামনে একটা একটু বড়ো সাদা তুলোর বল, আর ছোট্ট ছোট্ট দুটো ধূসর আর কালো তুলোর বলের মতো মেঘ ছানা দুষ্টু দুষ্টু মুখ করে ভাসছে। সব অভিমান, দুঃখ ভুলে পিন্নু হাসিমুখে, “বলবই তো, আর কক্ষনও ছাদে আসব নাই তো! মেঘ কখনও কথা বলতে পারে, নাকি মানুষের সঙ্গে খেলতে পারে? হুহ্!” এই বলে দুই হাত বাড়িয়ে একসঙ্গে তিন মেঘ ছানাকেই জড়িয়ে ধরল। সঙ্গে-সঙ্গেই আবার সেই প্রাণ জুড়িয়ে দেওয়া, মন ঠান্ডা করে দেওয়া অনুভূতি। সব মনখারাপ আর অপেক্ষার দিন শেষ, হইহই করে আবারও নতুন করে শুরু হয়ে গেল পিন্নু আর তার তিন মেঘ বন্ধুর হাসি, মজা, খেলা আর নির্ভেজাল খুনসুটিতে ভরা বন্ধুত্ব।
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী