বড়ো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
বড়ো গল্প
বুমা ব্যানার্জী দাস
প্রথম পর্ব
জুন, ১৭৮৪
মাননীয় গ্রান্ট মহাশয়,
মালদায় আপনার অবস্থিতির কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে আপনাকে একটি বিশেষ অনুরোধ জানানো হচ্ছে। গৌড়ের ধ্বংসাবশেষে ব্যবহারযোগ্য দুই থেকে ছয় ইঞ্চি পুরু সমতল প্রস্তরখণ্ড আছে কি না সেই সংবাদ এবং সেই প্রস্তরখণ্ড সংগ্রহ ও কলিকাতা পর্যন্ত পরিবহণের আনুমানিক ব্যয় সম্বন্ধে সম্যক ধারণা আপনার কাছ থেকে প্রাপ্ত হলে কোম্পানি অত্যন্ত উপকৃত হবে। এই কার্যে কোনোরূপ সরকারি আদেশপত্রের প্রয়োজন পড়বে কি না তাও অনুগ্রহ করে জানাবেন।
ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।
ধন্যবাদান্তে,
ওয়ারেন হেস্টিংস,
গভর্নর জেনারেল, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি
জুলাই, ১৭৮৪
মাননীয় গভর্নর জেনারেল,
গৌড়সংলগ্ন এলাকার চারজন গ্রামপ্রধানের সঙ্গে এই মর্মে চুক্তি করা হয়েছে যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গৌড়ের ধ্বংসাবশেষে বিনা বাধায় যথেচ্ছ খননকার্য চালাতে পারে ও সেখান থেকে স্বাধীনভাবে প্রস্তরখণ্ড সংগ্রহ করতে পারে।
এক ফুট থেকে দুই ফুট পর্যন্ত লম্বা নীল মর্মরের পালিশ করা বেশ কিছু প্রস্তরখণ্ড জোগাড় করা সম্ভবপর হয়েছে। খোদিত প্রস্তরখণ্ডের সংখ্যাও কম নয়। কিছু প্রস্তরখণ্ড সম্ভবত রাজবংশীয় সমাধিক্ষেত্রের অংশবিশেষ। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রথম কিস্তি কলিকাতার উদ্দেশে প্রেরণ করতে সক্ষম হব। আশা করি গির্জা নির্মাণের কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী আরম্ভ হতে পেরেছে।
শুভাকাঙ্ক্ষী,
চার্লস গ্রান্ট,
অন্যতম অধিকর্তা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
জুলাই, ১৭৮৪
মাননীয় গভর্নর জেনারেল,
অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, গৌড়ের প্রস্তরখণ্ডবাহী একটি নৌকা কলিকাতার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। নৌকায় সর্বমোট আছে—
পাঁচটি বৃহদাকার সমতল খণ্ড,
আটটি খোদাই করা সমতল খণ্ড,
পঞ্চাশটি নানা আকারের নীল মর্মর খণ্ড।
গির্জা নির্মাণ উপলক্ষ্যে আয়োজিত লটারি থেকে তিরিশ হাজার টাকার সংস্থান হতে পেরেছে অবগত হয়ে অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছি।
ঈশ্বর আপনার সহায় হোন।
শুভাকাঙ্ক্ষী,
চার্লস গ্রান্ট,
অন্যতম অধিকর্তা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
১৫১৮, গৌড়।
গৌড়েশ্বর হোসেন শাহের ললাটে দুশ্চিন্তার ভ্রূকুটি। তিনি হার্মাদদের ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। আপাতদৃষ্টিতে তাদের উদ্দেশ্য নির্দোষ বাণিজ্য হলেও তাঁর সন্দেহ তাদের আসল অভিসন্ধি অন্য কিছু। সিলভেরা নামে এক পর্তুগিজ প্রতিনিধি তাঁর দর্শনপ্রার্থী। আজ তিনদিন এই গৌড়েই সে অবস্থান করছে। হোসেন শাহ্ আজ নয় কাল করে ঠেকিয়ে রেখেছেন তাকে। কিন্তু আর বিলম্ব করা চলে না। ইশারায় রক্ষীকে আদেশ করেন সিলভেরাকে সভাকক্ষে নিয়ে আসতে। আবার গভীর চিন্তায় ডুবে যান তিনি।
“সুলতান!”
চিন্তায় বাধায় পড়ে তাঁর। বিচিত্র বেশভূষায় সজ্জিত হার্মাদ সিলভেরা এসে দাঁড়িয়েছে সভাকক্ষে। মুহূর্তে সচেতন হন গৌড়েশ্বর হোসেন শাহ্। বিদেশি অতিথিকে যথোচিত সাদর সম্ভাষণ করেন। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা আগে একরকম দুঃসাধ্য ছিল। কিন্তু কোয়েলহো বলে এক হার্মাদ যুবক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বঙ্গদেশের চলিত ভাষা শিখে নিয়েছে। প্রায় বছর দুয়েক হল গৌড়েই আছে সে; এখানকার এক কুম্ভকার পরিবারের কন্যাকে বিবাহও করেছে। সিলভেরার পিছনে তাকে দেখে নিশ্চিন্তে সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান সুলতান। অন্তত কথাবার্তা চালাতে অসুবিধা হবে না।
প্রাথমিক কুশলাদি বিনিময়ের পর কণ্ঠে মধু ঝরিয়ে সিলভেরা বলে, “মহামান্য সুলতান, আপনার সুশাসনে গৌড় আজ স্বর্ণরাজ্য। গোটা ভারতভূমিতে এহেন বর্ধিষ্ণু স্থান আর দুটি আছে কি না সন্দেহ। এই অঞ্চলে বাণিজ্য করার সম্মতি প্রদান করলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।”
অন্তরের অপ্রসন্নতা গোপন করে সুলতান বলেন, “খাম্বাৎগামী বঙ্গদেশীয় দুটি বাণিজ্যতরী অধিকার করে আপনারা সৌহার্দ্যের পরিচয় দিয়েছেন কি?”
সঙ্গে সঙ্গে বিনয়ের অবতার হয়ে যায় সিলভেরা।—“আমরা তো পূর্বেও স্বীকার করেছি জাহাঁপনা, আমাদের ভ্রান্তি হয়েছিল। সে-দুটি জাহাজ আমরা জলদস্যুর জাহাজ বলে ভুল করেছিলাম। তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ মহামান্য অ্যালবারগারিয়া আপনাকে একটি অতি মূল্যবান উপঢৌকন পাঠিয়েছেন।” বিনয়ে গলে গিয়ে সিলভেরা এবার হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে তাঁর সামনে; দুই হাতে তুলে ধরে একটি সুবর্ণ নির্মিত বাক্স।
দ্বিধায় পড়েন সুলতান হোসেন শাহ্। এই অ্যালবারগারিয়া অর্থাৎ পর্তুগিজ ভাইসরয় লোপো সোরেস অ্যালবারগারিয়া মহা ধুরন্ধর। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমের কোচি অঞ্চলে রীতিমতো ঘাঁটি গেড়ে বসেছে সে। এবার হয়তো বঙ্গদেশেও সেটাই করার মতলব। কিছুতেই তিনি হতে দেবেন না সেটা। কিন্তু এখন কী কর্তব্য? এই উপঢৌকন গ্রহণ না করা চূড়ান্ত অভদ্রতা হবে। হাত বাড়িয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাক্সটি গ্রহণ করেন তিনি। ডালার উপর মিনাকারী করা। সন্তর্পণে বাক্সটি খোলেন সুলতান। মুহূর্তের জন্য চোখ ধাঁধিয়ে যায় তাঁর। দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান বস্তুই বটে। এরকম বৃহদাকার পদ্মরাগমণি তাঁর নিজের কোষাগারেও নেই। কিন্তু এ শুধুই সৌজন্যসূচক উপহার, না অভিসন্ধিমূলক উৎকোচ?
ক্ষণিক স্তব্ধ হয়ে থাকেন সুলতান। তারপর সুগম্ভীর স্বরে বলেন, “আমাকে কিঞ্চিৎ বিচার ও মন্ত্রণা করার সময় দিন। যথাসময়ে আমার মতামত আপনাকে জানাব। ইত্যবসরে আপনি গৌড়ের আতিথ্য গ্রহণ করুন।”
১৯১৩, কলিকাতা।
মাত্র সপ্তাহ খানেক হল রিচার্ড এদেশে এসেছে। রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না এখনও। তার বাপ-পিতামহ ইংল্যান্ডের বাইরে পা রাখেনি কোনোদিন। তারও যে খুব ইচ্ছা ছিল তা নয়। তিন পুরুষের স্টেইনড গ্লাস বা দাগ কাচের ব্যাবসা তাদের। তার পিতামহ টমাস উইলেমেন্ট তো কিংবদন্তি শিল্পী। তাঁকে ভিক্টোরিয়ান স্টেইনড গ্লাসের জনক বলা হয়। তাকে নিজের হাতে ধরে সবকিছু শিখিয়েছেন পিতামহ টমাস। সবাই বলে, সে একদিন টমাস উইলেমেন্টের মতোই বিখ্যাত হবে। ভালোই চলছিল সব, হঠাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে ভারত রওনা হবার নির্দেশ আসে। নির্দেশ নয়, বরং আদেশ বলাই ভালো। কলিকাতা পৌঁছেছে দিন সাতেক আগে। ফোর্ট উইলিয়াম বলে একটা গড়ের অতিথিশালায় তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। খুব মন্দ লাগছে না জায়গাটা। তবে আজ সকাল থেকে বুক কাঁপছে তার। ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। একজন আর্দালি এসে তাঁর সঙ্গে কোথায় গিয়ে দেখা করতে হবে তার পথনির্দেশ দিয়ে গেছে। কাউকে সঙ্গে নিয়ে গেলে নাকি চলবে না, একা যেতে হবে। সে হোক, রিচার্ড উইলেমেন্ট এত সহজে ঘাবড়াবার বান্দা নয়। সেইন্ট জনস চার্চ নামে একটা গির্জায় যেতে হবে তাকে। খুব কাছে একটা দিঘি আছে, নাম লালদিঘি। পাথরের তৈরি এই গির্জাকে লোকে নাকি পাথুরে গির্জা বলে ডাকে। নির্ঘাত ওই গির্জার জানালায় স্টেইনড গ্লাস দিয়ে অভিনব কোনও নকশা করার জন্যই তাকে ডাকা হয়েছে। এটাই একটু অদ্ভুত লাগছে রিচার্ডের। এমন কিছু নামি গির্জা নয়, তবুও সেই সুদূর ইংল্যান্ড থেকে তাকে নিয়ে আসার মানে কী? দেখাই যাক কী হয়।
“লর্ড, রিচার্ড উইলেমেন্ট এসে পৌঁছেছে।”
হার্ডিঞ্জ তাকান। চোখে মুহূর্তের জন্য সংশয় ফুটে ওঠেই মিলিয়ে যায়। ধীরপায়ে ঘরে ঢোকে রিচার্ড। মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানায়। বেশ গড়বড়ে একটা কাজ হার্ডিঞ্জ দিতে চলেছেন ছোকরাকে। পারবে কি না কে জানে।
১৯৪০, কলিকাতা।
আবছা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে গির্জার ভিতর। শীতের সন্ধ্যায় ঝপ করে অন্ধকার নেমে আসে। উঠে দাঁড়ান ফাদার জোনাথন; হালকা পায়ে ঘুরে ঘুরে জ্বালাতে থাকেন একের পর এক মোমবাতি। বড়ো পরিশ্রম গেছে আজ। যদিও তাঁর সতেজ চোখ আর সটান চেহারা দেখলে বোঝার উপায় নেই, তবুও বয়স তো সত্তর হতে চলল প্রায়। কতদিন হয়ে গেল তাঁর এই গির্জায়। লোকে বলে পাথুরে গির্জা। সেই চুনার থেকে বেলেপাথর এনে তৈরি করা হয়েছিল এর দেওয়াল। এটাই কলিকাতার প্রথম পাথরের তৈরি গির্জা। মোমবাতির নরম আলো ছড়িয়ে পড়ে নীলচে মেঝের উপর। এই নীলচে পাথর নাকি গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে আনা। নিজের মনেই হাসেন ফাদার জোনাথন। কত রহস্য, কত ইতিহাস মিশে আছে এর পরতে পরতে। আর তাঁদের, মানে এই সেইন্ট জন গির্জার পাদ্রিদের এক বিশেষ গোপন কথা বহন করতে হয়। তাঁকেও খুব তাড়াতাড়ি একদিন সেই গোপন রহস্য জানিয়ে যেতে হবে তাঁর উত্তরসূরিকে, যেমন একদিন তাঁকেও জানিয়েছিলেন তাঁর পূর্বসূরি ফাদার মিডলটন। খুব মনে পড়ে তাঁর সেই দিনটার কথা। তারপর কতদিন পেরিয়ে গেল, ধীরে ধীরে পনেরো বছর হয়ে গেল এখানে। যখন এসেছিলেন, বাংলা ভাষা একবর্ণও জানতেন না। নিজের উদ্যোগে শিখতে শুরু করেন তারপর। এখন তাঁর বাংলা শুনলে বোঝাই যাবে না তিনি ভিনদেশি। তবে পাথুরে গির্জার আগেকার রমরমা আর নেই। সেইন্ট পলস ক্যাথেড্রালেই ভিড় এখন বেশি।
সবক’টা মোমবাতি জ্বালিয়ে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায় বসে পড়েন তিনি। পাশের ঈষৎ খোলা দরজা দিয়ে পালকি রাখার ঘরের সামনে তাঁর পালকিটা দেখা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে কেউ নেই আর গির্জার ভিতর। তাঁর পালকি বাহকরা আছে কোথাও এদিক-ওদিক, যাওয়ার সময় হলেই চলে আসবে।
প্রার্থনা করতে করতে হাঁটুতে সামান্য চিনচিনে ব্যথা টের পান ফাদার। ইদানীং প্রায়ই টের পাচ্ছেন সেটা। হাঁটু জানান দিচ্ছে, অবসর নেবার সময় উপস্থিত। নাহ্, কালই চার্চ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবেন পরবর্তী ফাদারকে চিহ্নিত করতে।
ধুপ করে একটা শব্দে চমকে ওঠেন ফাদার জোনাথন। ভারী কিছু পড়ল নাকি? তাড়াতাড়ি ওঠার চেষ্টা করেন। পরমুহূর্তেই বুঝতে পারেন কেউ পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। দুটো ওজনদার হাত এসে পড়ে তাঁর কাঁধের উপর। ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করেন ফাদার, কিন্তু শক্ত হাত দুটো যেন তাঁকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে ধীরে ধীরে কাঁধ ছেড়ে গলার দিকে উঠতে থাকে। খসখসে বিশ্রী একটা গলা কানের কাছে ইংরেজিতে বলে, “কোথায় আছে সে-জিনিস, ফাদার?”
ভাষাটা ইংরেজি হলেও উচ্চারণ ব্রিটিশদের মতো নয়। পিঠ বেয়ে হিমশীতল একটা স্রোত নেমে যায় ফাদারের। কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, “কীসের কথা বলছ?”
হিসহিসিয়ে ওঠে আবার সেই স্বর—“বেশি চালাক হওয়ার চেষ্টা কোরো না ফাদার, আমার হাতে কী আছে দেখবে?”
একটা ঠান্ডা ধাতব ছোঁয়া গলায় ঠেকে ফাদারের। বুঝতে পারেন, খুব ধারালো ছুরি জাতীয় কিছু ছুঁয়ে আছে তাঁর গলা।
“এটা ঈশ্বরের গৃহ, এখানে এরকম আচরণ কোরো না দুর্বৃত্ত।” কোনোরকমে বলেন ফাদার। ভীষণ গলা শুকিয়ে আসছে তাঁর। শরীরটা টলে উঠছে এবার। আর হাঁটু গেড়ে থাকতে পারছেন না।
চাপা ব্যঙ্গের হাসি শোনা যায়—“ঈশ্বরের গৃহ? নাকি চোরাই ধন লুকানোর গৃহ?”
শিউরে ওঠেন ফাদার। মরিয়া হয়ে তাঁর পালকি বাহকদের দলের সর্দারের নাম ধরে ডেকে ওঠেন সর্বশক্তি দিয়ে—“চি-নি-বা-আ-আ-স!” এতক্ষণে নিশ্চয়ই এসে গেছে তারা। গির্জার বাইরেই সাধারণত অপেক্ষা করে শ্রীনিবাস তার দল নিয়ে। গির্জার দুই পাশে পালকি রাখার ছোটো ছোটো ঘর বানানো আছে। এই মোটা পাথরের দেওয়াল ভেদ করে তাঁর ক্ষীণ হয়ে আসা আওয়াজ সেখানে পৌঁছবে কি?
একটা জোরালো ধাক্কায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ফাদার জোনাথন। মাথাটা প্রচণ্ড জোরে মেঝেতে ঠুকে যায়। প্রায় অচেতন অবস্থায় দুটো জিনিস বুঝতে পারেন—এক, তাঁর আক্রমণকারী দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যাচ্ছে গির্জা ছেড়ে আর দুই, একটা তরল বস্তু তাঁর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে তাঁর চুল ভিজিয়ে দিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফাদার নিশ্চিত জানেন সেটা জল নয়।
কয়েক মিনিট কেটে যায়। আস্তে আস্তে হাতে ভর করে মাথা তোলেন ফাদার। খুব বেশি তুলতে পারেন না অবশ্য, মাথা একদিকে হেলে পড়ে তাঁর। বুঝতে পারেন, আর বেশিক্ষণ নেই। কিন্তু কাজ শেষ হল না যে। সেই গোপন রহস্য কাউকে বলে যাওয়া হল না তো। গির্জার কর্তৃপক্ষও তো সে-কথা জানে না। একমাত্র এই গির্জার পাদ্রিরা আজ বহুবছর ধরে সাবধানে রক্ষা করে আসছেন এই গোপন কথা। বুকে হেঁটে ফাদার এগোনোর চেষ্টা করেন বেদির দিকে, সেখানে তাঁর কাগজ-কলম রাখা আছে। ইঞ্চি ছয়েক এগিয়ে বুঝতে পারলেন আর এগোনো সম্ভব নয়। প্রভু যিশু কি তাঁর আনুগত্যের পরীক্ষা নেবেন আজ? রক্তধারা ততক্ষণে নীল মেঝে বেয়ে গড়িয়ে গেছে বেদির দিকে। সেদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলেন ফাদার। বেদির উপরে দেওয়াল থেকে ঝোলানো ক্রুশবিদ্ধ ঈশ্বরপুত্রের দিকে তাকিয়ে বলেন, “তাই যদি তোমার ইচ্ছা হয় প্রভু, তবে তাই হোক।”
নিজের বহমান রক্তে আঙুল ডুবিয়ে নেন ফাদার জোনাথন। তাঁর হাত আর কাঁপছে না এখন। একাগ্র হয়ে লিখতে থাকেন পাথরের মেঝেতে। নাহ্, সোজাসুজি তো কিছু লেখা চলবে না, ঠারে লিখে যেতে হবে। যদি কোনোদিন সেরকম কেউ এসে বুঝতে পারে।
স্তব্ধ কয়েকটা মুহূর্ত কেটে যায়। একসময় শেষ হয় রক্তাক্ষর। অবশেষে মাথাটা একদিকে এলিয়ে পড়ে ফাদার জোনাথনের। দায়িত্ব শেষ হয়েছে তাঁর।
অনেক পরে অপেক্ষা করে করে শ্রীনিবাস যখন ফাদারের খোঁজে গির্জার ভিতরে উঁকি দেয়, ফাদার জোনাথন তখন অনেক অনেক দূরে। শ্রীনিবাসই চিৎকার করে লোকজন ডাকে।
পুলিশ এসে গির্জা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়ার আগেই লোকমুখে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছিল হু হু করে। আর ছড়িয়ে পড়েছিল রক্তাক্ষরে লেখা কয়েকটি পঙক্তি, যা পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে রূপান্তরিত হয়েছিল কিংবদন্তিতে।
আকাশ জুড়ে ফুটল যখন পূর্ণ চাঁদের মায়া
উঠল ভেসে গৌড়শিলায় পদ্মরাগের ছায়া।
যত্নে রাখে মধ্যমণি সূত্র সে গোপন
প্রভুর তরে উপহার আনেন গুণীজন।
ফুলের ছায়ে পড়বে যখন চাঁদের আলোর রেখা
মিলবে তাতে লক্ষ্ণৌতির শিলার অচিন লেখা।
মিলিয়ে যাবে চাঁদের সাথে ক্ষণিক প্রকাশ মাত্র
তাঁর নামের রসে রসিকজন মজেন অহোরাত্র।
স্মৃতির ঘরের সঠিক হদিস যখন মিলে যাবে
আলোছায়া সরিয়ে নিলেই অরূপরতন পাবে।
২০১৫, কলকাতা।
খুব কায়দা করে তিন নম্বর পুরিটার ভিতর আলুরদম পুরে সাপটে মুখে ঢোকাতে যাবে সপ্তর্ষি ওরফে টুবলু, ধাঁই করে পিঠে একটা মোক্ষম কিল পড়ল।
“উফ্, খেতে দে না শান্তিতে!” পিছনে না তাকিয়েই কাতর গলায় বলে টুবলু।
“কখন থেকে খুঁজছি তোকে, আর তুই এখানে পুরি সাঁটাচ্ছিস?” সতেজ একটা গলা ভেসে আসে। পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে নবনীতা ওরফে মিতুল। একটা হাত এখনও তোলা, আর এক ঘা দেওয়ার ধান্দা করছে সম্ভবত।
“আমি কী করব? খেতে বেরোনোর সময় দেখলাম তুই তোর সখী বাহিনীর সঙ্গে হিহি করতে করতে ক্যান্টিনের দিকে চলেছিস। অগত্যা...” কাঁধ নাচিয়ে অসহায় ভঙ্গি করে টুবলু।
মিতুল আবার একটা খিমচি তুলেছিল, টুবলু পুরির শালপাতা হাতে এক পায়ে নেচে টুক করে সরে যায়। খিমচোতে না পেরে ব্যাজার মিতুল জিভ ভেঙিয়েই ক্ষান্ত দিল এখনকার মতো। ওরা পিঠোপিঠি মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন। টুবলুর বাবা মিতুলের নিজের মামা হন। দুজনেরই আর্ট কলেজের তৃতীয় বর্ষ চলছে।
“শোন, ভাগ্যিস ক্যান্টিনের দিকে গেছিলাম। এবার ফিল্ড ট্রিপে কোথায় যাচ্ছি বল তো আমরা, মানে থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্টরা? নোটিস লাগিয়েছে ক্যান্টিনের বাইরে।”
“কোথায় আর, বাগবাজারের গঙ্গার ঘাটে বসিয়ে ছবি আঁকতে বলবে নির্ঘাত।” ফিল্ড ট্রিপের উপর টুবলুর বিশেষ ভরসা নেই।
“উফ্, না! এবারে অরুণ-স্যার সব ব্যবস্থা করেছেন। আমরা সেইন্ট জনস চার্চে যাব। দারুণ হবে না?”
টুবলুর মুখ দেখে কিছু বুঝেছে বলে মনে হয় না। পুরিওয়ালাকে টাকা মিটিয়ে যাচ্ছেতাই নোংরা একটা রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বলে, “সেটা আবার কোথায়?”
“আরে লালদিঘির পাশে, পাথুরে গির্জা জানিস না?” মিতুল এবার সত্যি চটেছে।
“ওহো তাই বল, পাথুরে গির্জা। আরে সে তো অনেক পুরোনো।” আর্ট কলেজের গেটের দিকে হাঁটতে থাকে দুজনে এবার।
“তবে আর বলছি কী? ১৭৮৭-তে তৈরি, নোটিসে লিখেছে। চল, এরপর তো স্যারেরই ক্লাস, বলবেন নিশ্চয়ই সব।” মিতুলের আবার নেশা হল ইতিহাস।
“এসব পুরোনো গির্জায় ভূত থাকে তা জানিস?” টুবলু মোক্ষম জায়গায় ঘা দিয়েছে এবার।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দাঁড়িয়ে যায় মিতুল। তারপর তেজের সঙ্গে বলে, “তোর মুণ্ডু থাকে। আর যাব তো সকালবেলা—দেখব, শুনব, ছবি আঁকব, চলে আসব।”
মিতুলের বেজায় ভূতের ভয়। মিচকে একটা হাসি হেসে সাঁত করে ক্লাসে ঢুকে পড়ে টুবলু।
অরুণ-স্যার। মানে অরুণাংশু সেন। দেশের সেরা পোর্ট্রেইট আঁকিয়েদের একজন। এই রাজ্যে তাঁর মতো পোর্ট্রেইট আঁকিয়ে এই মুহূর্তে আর দ্বিতীয় কেউ নেই। সেই সঙ্গে আর্ট কলেজের সবার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক। কিন্তু তাতে কী? তাঁর সারাজীবনের শখ গোয়েন্দা হওয়ার। বছর দুয়েক আগে বিভাগীয় প্রধানের পদে বেমালুম ইস্তফা দিয়ে নিজের বাড়িতে অফিস খুলে বসেছেন। প্রাইভেট গোয়েন্দার অফিস। তাঁর মতে, পোর্ট্রেইট তিনি অনেক এঁকেছেন। প্রদর্শনীও হয়েছে অসংখ্য। সম্মান, পুরস্কারও কম পাননি জীবনে।—‘আর্ট সংক্রান্ত ক্রাইম আমাদের দেশে কম হয় না। আর সেখানে যদি আমার জ্ঞান কোনও কাজে না লাগাতে পারি, কেবল নিজের কাজ, নিজের সম্মান, প্রদর্শনী নিয়ে পড়ে থাকি, তাতে কী লাভ?’ এই হল তাঁর বক্তব্য। অবিশ্যি ক্লাস নিতে তাঁকে আসতে হয় এখনও; আর্ট কলেজ তাঁকে সে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়নি। টুবলু-মিতুলরা ভাবে, ভাগ্যিস দেয়নি, তাই এমন একজন মানুষের সংস্পর্শে তারা আসতে পেরেছিল। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাঁর সেই গোয়েন্দার অফিসে কোনও ক্লায়েন্ট আসেনি। অবিশ্যি ছাত্রছাত্রীদের ভিড় লেগেই থাকত তাঁর ছোট্ট কিন্তু সুন্দর একতলা বাড়িটিতে। সর্ব কাজের কাজি হেমন্ত আর ছাত্রছাত্রীদের নিয়েই এই অকৃতদার মানুষটির সংসার। টুবলু আর মিতুল বরাবরই তাঁর প্রিয়। তার উপর গতবছর তাঁর প্রথম কেসের সঙ্গে ঘটনাচক্রে তারাও জড়িয়ে গেছিল। এই কেসের মীমাংসা হওয়ার পর গোয়েন্দা হিসেবেও অরুণাংশু সেনের নাম কিছুটা ছড়িয়ে পড়ে। আজকাল অনেক সময়ই টুবলু-মিতুল স্যারের বাড়ি গিয়ে তাঁকে পায় না। মাঝে-মাঝেই ওরা ভাবে, স্যারের সঙ্গে আবার কোনও রহস্যে জড়িয়ে পড়লে বেশ হয়।
শীত শেষ হয়ে এলেও এখনও রেশ থেকে গেছে। খুব সুন্দর এই সময়টা। জনা পনেরো তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে অরুণ-স্যার যখন সেইন্ট জনস চার্চের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তখন ঘড়িতে সাড়ে আটটা। সকালের মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে পাথুরে গির্জার গায়ে। চার্চের অফিস থেকে খুব গম্ভীর দেখতে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে তাদের পরিচয়পত্র, আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অনুমতি পত্র ইত্যাদি পরীক্ষা করে ভিতরে যাওয়ার ও সারাদিন থাকার, ছবি আঁকার অনুমোদন পত্র দিলেন। আজ এমনিতে বাইরের লোকের জন্য চার্চ বন্ধ। আসলে এটা এখন হেরিটেজ সাইট, তাই এত কড়াকড়ি।
“পাথরের তৈরি গির্জা কলকাতায় এ-ই প্রথম। ১৭৮৭-তে এই গির্জার কাজ শেষ হয়। লোকে এই গির্জাকে বলত পাথুরে গির্জা।” মূল দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলেন অরুণ-স্যার। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কোথাও যাওয়ার আগে সে-জায়গাটা নিয়ে ভালোমতো পড়াশোনা করে নেওয়াটা তাঁর বরাবরের অভ্যেস।
“পাথর কোথা থেকে এনেছিল, স্যার?” সৌরিমার প্রশ্ন।
“পাথর এনেছিল চুনার থেকে। তবে আসল গল্প হল মেঝের ওই নীলচে পাথর নিয়ে।” দরজা থেকে আঙুল দিয়ে ভিতরে দেখান অরুণ-স্যার। বাইরের আলো থেকে এসে হঠাৎ ভিতরের আধো অন্ধকারে পরিষ্কার দেখতে পায় না মিতুলরা। চোখ কুঁচকে মেঝেটা দেখার চেষ্টা করে। স্যার বলে চলেন, “মেঝের পাথর এসেছিল গৌড়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে। কীভাবে গৌড় থেকে একরকম চুরি করেই পাথরগুলো জলপথে কলকাতা আনা হয়েছিল, তার প্রামাণ্য চিঠিপত্র নাকি এই গির্জার অফিসঘরেই সংরক্ষিত আছে। অবিশ্যি বুঝতেই পারছিস, সেসব সবাইকে দেখতে কখনোই দেবে না।”
মিতুলের গায়ে হঠাৎ কাঁটা দিয়ে ওঠে। সেই গৌড়! শশাঙ্ক, রাজা গণেশ, হোসেন শাহের গৌড়। আস্তে আস্তে চোখের আলো-আঁধারিটা কাটতে থাকে তার, নীলচে ধূসর পাথরের মেঝে স্পষ্ট হতে থাকে। দীপ্তেশ, টুবলু, পুনমরা ততক্ষণে দুই পাশের বসার জায়গার সারির মাঝখান দিয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে গেছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অল্টার বা মূল বেদির বাঁদিকে প্রাচীন পাইপ অর্গ্যানটার দিকে।
“এটা বাজে এখনও!” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে পুনম।
“বাজে বইকি, একেবারে বাজে এখন।” বদ রসিকতা করে টুবলু।
“শুনেছি চমৎকার আওয়াজ এখনও এই পাইপ অর্গ্যানের। এটা ইংল্যান্ডের উইলিয়াম হিল অ্যান্ড সন অ্যান্ড নরম্যান অ্যান্ড বেয়ার্ড লিমিটেডের তৈরি।” অরুণ-স্যার এসে দাঁড়ান ওদের পাশে। অর্গ্যান কোম্পানির নাম শুনে চক্ষু চড়কগাছ সকলের। স্যার পারেন বটে।
বলা যেতে পারে তিন ভাগে লম্বালম্বি ভাগ করা বিশাল হলটা। বাঁদিকে পাইপ অর্গ্যান, তার সামনে সোনালি পরি। বাকি অংশে বসার জায়গা। মাঝখানের অংশ সবচেয়ে চওড়া। দুই পাশের সার দেওয়া বসার আসনের মাঝখান দিয়ে গিয়ে সোজা বেদির সামনে পৌঁছানো যায়। মাঝখানের অংশটির দুই পাশে পিলারের সারি। ডানদিকে পিলারের ও-পাশে আবার বসার আসন। তার সামনে উঁকি দিয়ে একেবারে মুগ্ধ হয়ে যায় সবাই। কী অপূর্ব! পাশাপাশি তিনটে দাগ কাচ বা স্টেইনড গ্লাসের প্যানেল। টুকরো টুকরো রঙিন কাচ দিয়ে কী সুন্দর সব ছবি ফুটে উঠেছে। সবই মোটামুটি যিশুখ্রিস্টের জীবনের ঘটনা নিয়ে ছবি। এমনি ফুল-লতাপাতাও আছে। যেমন সুন্দর রঙ, তেমন নিখুঁত কাজ। অনেকক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ওরা।
“বাইরেটা একবার ঘুরে আয় তোরা, তারপর বাইরের গ্রাউন্ডে বসে ব্রেকফাস্ট সেরে কে কোনটা আঁকবি ঠিক করে নে।” স্যার সামান্য তাড়া লাগান—“বাইরে বহু কিছু দেখার আছে, জোব চার্নকের সমাধি কিন্তু এখানেই।”
“আসলে এটা আগে থাকতেই একটা গোরস্থান ছিল।” ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢালতে ঢালতে বলেন স্যার। ওরা সবাই এখন অরুণ-স্যারকে ঘিরে বসে আছে নরম ঘাসের উপর। পিঠের ভারী ব্যাগগুলো নামিয়ে রেখেছে পাশে। সকালে যখন মিউজিয়ামের সামনে জড়ো হল সবাই, স্যার তখনই ব্রেকফাস্টের প্যাকেটগুলো হাতে হাতে দিয়ে দিয়েছিলেন। খাবার, জলের বোতল ছাড়াও যার যার আঁকার জিনিস, ছোটো ক্যানভাস—সব ব্যাগে। সেসব নিয়ে মিনিট পঁচিশ হেঁটে সবারই বেশ খিদে পেয়ে গেছিল। গুছিয়ে পেস্ট্রি খেতে খেতে আড়চোখে মিতুলের দিকে তাকিয়ে টুবলু বলে, “আর সেই গোরস্থানের ভূতগুলো রাতে গির্জায় ঘুরে বেড়ায়?”
“এ-চার্চের ভৌতিক গল্প নেই, অন্য গল্প আছে। বলছি পরে।” সামান্য নীচু গলায় বলেন অরুণ-স্যার। তারপর কথা ঘুরিয়ে বলেন, “এ-জমি কার দান করা জানিস? মহারাজ নবকৃষ্ণ বাহাদুর, অর্থাৎ শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা এখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চার্চ তৈরি করবে শুনে এই জমি তাদের দান করেছিলেন। যদিও অনেকের ধারণা, ওরা আসলে বাধ্য করেছিল জমি দিতে।”
ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ওরা সবাই। যে-যার আঁকার সাবজেক্ট বেছে নেয়।
মিতুল আর টুবলু চার্চের একদিকে পালকি রাখার বহু প্রাচীন ঘরগুলোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। কখন স্যার ওদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়ালই করেনি। চাপা স্বর শুনে হঠাৎ দুজনেই চমকে ওঠে।
“তোরা ভিতরে গিয়ে আঁক, তোদের সঙ্গে কথা আছে।” চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে অরুণ-স্যারের।
উত্তেজনায় কথা বন্ধ হয়ে যায় টুবলু-মিতুলের। এখানে পৌঁছানোর পর থেকেই মিতুলের মন বলছিল আবার নতুন কোনও রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারা। একরকম ছুটেই চার্চের ভিতরে ঢুকে যায় টুবলু আর মিতুল।
“ফিল্ড ট্রিপ ছাড়াও আরও একটা উদ্দেশ্য আছে এখানে আসার।” মূল বেদির একেবারে সামনের সারির পিউ বা পরপর একসঙ্গে জোড়া প্রার্থনার আসনে বসে অরুণ-স্যার বলেন, “বহু প্রাচীন এক রহস্য জড়িয়ে আছে এই পাথুরে গির্জার সঙ্গে। আর তোরা দুজন তো আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট, নাকি?”
দুজনের চকচকে চোখ আর ঝলমলে মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন অরুণ-স্যার।—“দেখ, আগেই লাফাস না, হয়তো এক মৃত্যুপথযাত্রী পাদ্রির প্রলাপ মাত্র, কিন্তু আমার ধারণা তার থেকে আরও বেশি কিছু।”
এবার মিতুল আর টুবলু দুজনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে—“প্রথম থেকে, স্যার!”
সকাল বেশ খানিকটা গড়িয়ে গেছে। পাথুরে গির্জায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আঁকতে বসে গেছে ছেলেমেয়ের দল। কেউ ভিতরে, বেশিরভাগই বাইরের প্রাঙ্গণে। জোব চার্নকের সমাধির সামনে গোল হয়ে বসে বেশ কিছুজন। কুখ্যাত অন্ধকূপ স্মৃতিসৌধের সামনেও বেশ একটা জটলা। গির্জার ভিতরেও ইতস্তত ছড়িয়ে আছে জনাকয়েক। আর মন্ত্রমুগ্ধ দুটি ছেলেমেয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তাদের প্রিয় স্যারের দিকে।
“এই মূল বেদির সামনেই নাকি পড়ে ছিল ফাদার জোনাথনের মৃতদেহ।” হাত বাড়িয়ে সামনে নির্দেশ করেন অরুণাংশু।
“কে তাঁকে খুন করেছিল জানা যায়নি কখনও?” টুবলু একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে। স্যার তাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন আজ, দায়িত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছে যেন।
“নাহ্, খুনির কোনও খোঁজ কখনও পাওয়া যায়নি। আর সেই রহস্যময় ছড়ারও কোনও মানে আজ পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি।”
“অরূপরতন পাওয়া যাবে বলছে শেষে—গুপ্তধনের সন্ধান দিচ্ছে না তো ছড়াটা?” মিতুলের ভ্রূ দুটো প্রবল কোঁচকানো।
“বিচিত্র নয়। হলে আশ্চর্য হব না। একটাই শব্দ মোটামুটি পরিষ্কার—গৌড়শিলা। তোদের বললাম তো, এই গির্জার মেঝে গৌড়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে আনা পাথর দিয়ে তৈরি।”
“তাতে পদ্মরাগের ছায়া ভেসে উঠবে বলছে। মানে কী তার? ধুর, ফাদারের মাথার গোলমাল দেখা দিয়েছিল। অত রক্তক্ষরণ হয়েছিল তো।” টুবলু মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে।
“খানিক চেষ্টা করেছিল পুলিশ। শুনেছি তারা সে-যুগের বিখ্যাত দারোগা শ্রী প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়কে এই রহস্য সমাধানের ভার দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি তখন বৃদ্ধ, তার বহু আগেই তিনি লালবাজার থেকে অবসর নিয়েছেন। ইচ্ছা থাকলেও তিনি এই কাজ শুরু করতে পারেননি। তারপর যা হয়—গোয়েন্দা দফতর ক্রাইম সামলাবে, না ধাঁধার উত্তর খুঁজবে? যাই হোক, তোরা এবার আঁকা শুরু কর কে কোনটা করবি, চিন্তাভাবনা চলতে থাক সঙ্গে।”
মিতুল লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সে কোনটা আঁকবে অনেক আগেই ঠিক করে নিয়েছে। হলের ডানদিকের অংশে এগিয়ে যায় পায়ে পায়ে। বসার আসনের সারি পেরিয়ে আরও এগিয়ে যায়। তার সামনে এখন তিনটে স্টেইনড গ্লাসের জানালার শার্সি। ক্যানভাস বের করে বসে পড়ে মিতুল জানালাগুলোর সামনে। সত্যিই কী অপূর্ব কাজ—মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো।
টুবলু অবশ্য এদিকে আসেনি। ও ক্যানভাস নিয়ে বসে পড়েছে পাইপ অর্গ্যানটার সামনে। শার্সির উপর ফুটে উঠেছে ক্রুশবিদ্ধ যিশু, ফুল-লতাপাতা, দেবদূত, সশিষ্য যিশু, মেরি-মাতার কোলে সদ্যোজাত যিশু—আরও নানা মুহূর্ত তাঁর জীবনের।
মিতুল ভাবতে থাকে কোনটা আঁকা যায়। আচ্ছা, ওই যে তিনজন জ্ঞানী মানুষ তাদের সদ্যোজাত রাজার জন্য উপহার নিয়ে আসছে, সেই দৃশ্যটা আঁকলে কেমন হয়? হঠাৎ ছিলা ছেঁড়া ধনুকের মতো পেন্সিল-টেন্সিল ছিটকে উঠে দাঁড়ায় মিতুল।
“স্যার! টুবলু!” বেশ জোরে হয়ে যায় চিৎকারটা। গলা কাঁপছে তার।
দৌড়ে আসে দুজনে।—“হল কী তোর?”
“স্যার, ছড়ার দুটো লাইন...” ধরা গলায় বলে মিতুল। আঙুল তুলে দেখায় স্টেইনড গ্লাসগুলোর দিকে। হাতটা কাঁপছে তার।—“ওই যে, তিনজন জ্ঞানী বা গুণীজন তাদের প্রভুর জন্য উপহার আনছে, আর সেটা ঠিক মাঝের শার্সিতে।”
চাপা গলায় বলে ওঠে টুবলু, “যত্নে রাখে মধ্যমণি সূত্র সে গোপন/ প্রভুর তরে উপহার আনেন গুণীজন।”
“ওয়েল ডান মিতুল!” অরুণ-স্যার হাত বাড়িয়ে মাথাটা থাবড়ে দেন মিতুলের।—“আর কী সূত্র গোপন করে রেখেছে ওই মাঝের শার্সি?”
“পরের লাইন দুটো কী ছিল যেন? ফুলের ছায়া নিয়ে কিছু?” মিতুলের গলা শুকিয়ে আসে।
প্রায় ফিসফিস করে টুবলু বলে, “ফুলের ছায়ে পড়বে যখন চাঁদের আলোর রেখা/ মিলবে তাতে লক্ষ্ণৌতির শিলার অচিন লেখা।” একবার শুনেই পুরো ছড়াটা ওর মুখস্থ হয়ে গেছে।
“ওই দেখ,” আঙুল বাড়িয়ে নির্দেশ করে মিতুল। তার হাতটা অল্প কাঁপছে।—“ঠিক ওই উপহার নিয়ে আসা তিন গুণীজনের নীচে, অন্যরকম একটা ফুলের প্যাটার্ন। লতাসমেত ফুল তিনটে শার্সি জুড়েই অনেকগুলো জায়গায় আছে। বাকি সবক’টা একইরকম, শুধু ওই প্যাটার্নটা ছাড়া। ওটা আর একবারও কোথাও রিপিট হয়নি দেখ। কিন্তু, কিন্তু...” ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ে মিতুল। জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে অনেকটা জল খায়।
“একটা চাঁদের আলোর ব্যাপার প্রথম থেকে থেকেই যাচ্ছে স্যার। ওই ফুলের প্যাটার্নটার উপর চাঁদের আলো পড়লে তার সঙ্গে কিছু একটা মিলবে বলছে। লক্ষ্ণৌতির শিলা কী জিনিস?” টুবলু যেন খানিকটা নিজের মনেই বলতে থাকে।
“গৌড়ের আর একটা নাম লক্ষ্ণৌতি বা লক্ষণাবতী। মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের নামানুসারে রাখা হয়েছিল।” অরুণাংশুর গলাতেও চাপা উত্তেজনা।
“তাহলে লক্ষ্ণৌতির শিলা মানে গৌড় থেকে আনা পাথর? যা দিয়ে মেঝে তৈরি?” মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে টুবলু। এদিক-ওদিক ব্যস্তভাবে দেখতে দেখতে বলে, “শিলার অচিন লেখা তাহলে এই শিলার উপরেই কোথাও থাকবে নিশ্চয়ই।”
“দাঁড়া, ওভাবে হবে না। এখানে স্পষ্টভাবে শিলালিপি বা ওরকম কিছু মেঝের উপর কোথাও কিছু নেই। লক্ষ্ণৌতির শিলার অচিন লেখা কথাটা মোটামুটি পরিষ্কার। এটা হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করার পর আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার টিম আর কিছু না হোক, মেঝেটা তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। সেরকম কোনও লিপি-টিপি কোথাও নেই।”
হঠাৎ কী যেন খেয়াল হয় টুবলুর। বেশ গম্ভীর গলায় বলে, “স্যার, আপনাকে কি আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া থেকে এই ধাঁধার উত্তর বের করার ভার দিয়েছে?”
মৃদু হাসেন অরুণাংশু। মিতুল আর টুবলু প্রায় একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে—“স্যার, এ তো দারুণ ব্যাপার! এটা সলভ করতে পারলে আপনি গোয়েন্দা হিসেবেও বিখ্যাত হয়ে যাবেন।”
“আগে হোক তো সলভ। আমার ধারণা, এই অচিন লেখা কথাটা খুব জরুরি।” কথা ঘোরান অরুণ-স্যার।—“আগেই বললাম কোথাও কোনও শিলালিপির চিহ্নমাত্র নেই, কিন্তু হয়তো এমনভাবে আছে যাকে চেনা যাচ্ছে না লেখা বা লিপি বলে? তাই অচিন।”
“কিন্তু সেটা কীসের সঙ্গে মিলবে? কী হবে চাঁদের আলো ওই ফুলের প্যাটার্নের উপর পড়লে?” মিতুলের গলাটা এবার হতাশ শোনায় একটু। একই জায়গায় গোল গোল ঘুরছে যেন ছড়াটা।
“তার পরের লাইনটা দেখ।” কাঁধ থেকে ফ্লাস্ক নামিয়ে কফি ঢালতে ঢালতে অরুণাংশু বলেন, “মিলিয়ে যাবে চাঁদের সাথে ক্ষণিক প্রকাশ মাত্র। কিছু বুঝতে পারছিস?”
“চাঁদের সঙ্গে আবার কী মিলিয়ে যাবে, অন্ধকার নির্ঘাত।” ব্যাগ থেকে একটা অরেঞ্জ জুসের বাক্স বের করে স্ট্র ফোটাতে ফোটাতে নিশ্চিন্তভাবে বলে টুবলু।
“উঁহু।” কাকেশ্বর কুচকুচের মতো মাথা নাড়ায় মিতুল।—“ক্ষণিক প্রকাশ মাত্রটা ইগনোর করিস না। এমন কিছু যেটা ক্ষণিকের জন্য প্রকাশ পাবে, কিন্তু আবার চাঁদের সঙ্গে মিলিয়ে যাবে। মানে চাঁদের আলো মিলিয়ে গেলে সেটাও মিলিয়ে যাবে।”
“সবকিছু ওই চাঁদের কাছেই ফিরে যাচ্ছে কিন্তু।” নিজের মনে বলেন অরুণাংশু।
“কী হয় চাঁদ উঠলে?” গা-টা কেমন শিরশির করে ওঠে মিতুলের। স্যারের পাল্লায় পড়ে রাত্রিবেলা আসতে হবে নাকি এখানে? তাহলেই সর্বনাশ।
“আমরা রাত্রে এখানে আসব?” ওর মনের কথাটা টের পেয়েই যেন লাফিয়ে ওঠে টুবলু।
“তাই তো মনে হচ্ছে। তবে যে-কোনো রাত নয়। প্রথম লাইনটা মনে কর তোরা। আকাশ জুড়ে ফুটল যখন পূর্ণ চাঁদের মায়া, অর্থাৎ...”
“ফুলমুন নাইট!” চেঁচিয়ে ওঠে টুবলু। তারপর মিতুলের দিকে ফিরে বিকট মুখ বের করে বলে, “পূর্ণিমার গভীর রাত/ ওয়েরউলফ হোগা সাথ!”
চড় বাগিয়ে তার পেছনে ছোটে মিতুল। তাদের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকেন অরুণাংশু। ছেলেমেয়ে দুটোকে বড়ো স্নেহ করেন তিনি। ওদের কোনও বিপদে ফেলতে যাচ্ছেন না তো?
ছুটে বেরোতে গিয়ে অন্যমনস্ক টুবলু চার্চের দরজার কাছে ধমাস করে ধাক্কা খায় কার সঙ্গে যেন। পড়ে যেতে যেতে খুব জোর সামলে নিয়ে দেখে সামনে এক অচেনা ভদ্রলোক। আপাতত পেটে জোর ধাক্কা খেয়ে মুখ প্রবলভাবে কোঁচকানো। সর্বনাশ!
“স-স-সরি, সরি। আপনার লাগেনি তো?” বলেই ভদ্রলোকের চেহারার দিকে নজর পড়াতে টুবলুর মনে হয় উনি নির্ঘাত বাঙালি নন।—“আই মিন...”
টুবলুকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক বলেন, “এত তাড়া কীসের?”
উচ্চারণ বিদেশি—কীসেরটা খিসের শোনাল, তবে ভাষা পরিষ্কার। টুবলু এবার কী বলা উচিত তাই ভাবছে। মিতুলটাও সুযোগ বুঝে স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে। পিছন থেকে অরুণ স্যারের গলা পাওয়া গেল—“ওয়েলকাম মিস্টার পেরেইরা।”
স্যার সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন মিস্টার পেরেইরার। পুরো নাম ফ্রান্সিসকো পেরেইরা। ভদ্রলোক জন্মসূত্রে পর্তুগিজ, কিন্তু বহুদিন এ-দেশে আছেন। আপাতত আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে চাকুরিরত। মুখটা সর্বদা হাসি হাসি।
স্যার টুবলু আর মিতুলকে আলাদা করে ডেকে বললেন, “উনি পুরোনো গির্জার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। স্বাভাবিকভাবেই এই গির্জা রহস্য সমাধানে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
টুবলুর অবশ্য পেরেইরাকে ভালোই লেগেছে, কিন্তু মিতুল যেন ঠিক খুশি নয়। টুবলু ফিসফিস করে কারণ জিজ্ঞেস করাতে বলল, “ওঁর মুখটা বেশিরকম হাসি হাসি হলেও, চোখ দুটো একেবারেই হাসে না।”
তিনদিন বাদে পূর্ণিমা। মিতুল আর টুবলুর দুজনের বাড়ি থেকেই সামান্য আপত্তি উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু অরুণ-স্যার সঙ্গে থাকবেন জেনে মেনে নিয়েছেন তাঁরা। ওরা অবশ্য বাড়িতে সবকিছু খুলে বলেনি। তবে টুবলুর চাঁদের আলোয় ছবি আঁকার অজুহাতটা কেউ বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় না।
সন্ধে গড়িয়ে রাতের দিকে চলেছে। স্যারের সাত পুরোনো স্যানট্রোটা বেরিয়েছে আজ। লালদিঘি পেরোতেই রাস্তা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল। রবিবার, তাই রাস্তায় লোক এমনিতেই খুব কম। গাড়ি থেকে নামার পর টের পাওয়া গেল চারপাশ কতটা নিঝুম। চার্চের স্টেইনড গ্লাসের জানালা যেদিকে, চাঁদ সেদিকে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে যাবে। রাতের খাবার, জল আর টর্চ সঙ্গে নিয়ে নিয়েছে ওরা। চার্চের প্রধান দরজার উপর চাঁদের আলো পড়েছে, পিছন দিকটা এখনও আবছা অন্ধকার। কেমন একটা ছমছমে ভাব চারদিকে। স্মৃতিসৌধগুলোর কোনো-কোনোটার উপর চাঁদের আলো পড়েছে। আলোছায়ার অদ্ভুত খেলা চলেছে চারপাশ জুড়ে। মিতুলের খালি মনে হচ্ছে এই বুঝি গাছগুলোর আড়াল থেকে কেউ বেরিয়ে আসবে। রাম ইয়ার্কিবাজ টুবলু পর্যন্ত কেমন চুপ হয়ে গেছে।
“স্যার, আমরা ভিতরে ঢুকব কীভাবে? চার্চের অফিস তো এখন বন্ধ।” টুবলু যে কেন ফিসফিস করে কথা বলছে কে জানে।
“মিস্টার পেরেইরা চাবি নিয়ে থাকবেন দরজার কাছে। ওই তো উনি।” দরজার পাশে একটা ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে বটে।
গির্জার ভিতরে ঢুকে মিতুল অবাক হয়ে ভাবছিল, একটা জায়গা রাত্রিবেলা কতটা অন্যরকম হয়ে যায়। চাঁদ এখন মাথার কাছে। ঘুরে স্টেইনড গ্লাসের জানালার কাছে আসতে এখনও বেশ খানিকটা দেরি। স্বাভাবিকভাবেই আলো জ্বালা যাবে না এখন—চাঁদের আলোয় কী ঘটতে চলেছে সেটা না বোঝা পর্যন্ত।
মেইন দরজা দিয়ে যতটুকু চাঁদের আলো ভিতরে আসছে তাতে বসার আসনের আউটলাইনগুলো বোঝা যাচ্ছে। টর্চ জ্বেলে ওরা সাবধানে জানালার সামনের সারিতে গিয়ে বসল। টুবলু আলতো করে মিতুলের কনুইয়ের কাছটা একবার ছুঁল। যেন বলতে চাইল—ভয় পাস না। মিতুলের ঠিক যে ভয় করছিল তা নয়। শুধু মনে হচ্ছিল ও যেন অন্য কোনও সময়ে পৌঁছে গেছে। যেন এখুনি সেই স্যারের গল্পের ফাদার জোনাথন নেমে আসবেন ডানদিকের ঘোরানো আবছা অন্ধকারে ঢাকা সিঁড়িটা দিয়ে; বেদির সামনে প্রার্থনা করতে বসবেন।
স্যার ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢেলে প্লাস্টিকের কাপে করে হাতে হাতে দিলেন সবাইকে।
মিস্টার পেরেইরা এতক্ষণে গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বললেন, “সত্যি কি পদ্মরাগ মণিটা পাওয়া যাবে আজ মিস্টার সেন?”
“পদ্মরাগ মণি?” স্যার মনে হল বেশ অবাক হয়েছেন। টুবলু আর মিতুলও চমকে উঠেছে।—“একটা বহু পুরোনো রহস্য সমাধান করার আশায় এসেছি মিস্টার পেরেইরা, মণি আছে কি না তো জানি না। ছড়াটাতে বলছে বটে পদ্মরাগের ছায়া, কিন্তু ওটা যে একটা জেমই হবে সেটা আপনি কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন?”
ফ্যাকাশে নীলচে আলোর আধো অন্ধকারে দেখা না গেলেও বোঝা যায় পেরেইরা তাঁর মার্কামারা হাসিটা হাসছেন। ঈষৎ কর্কশভাবে যেন বলেন তারপরই, “তাছাড়া আর কী হতে পারে মিস্টার সেন? আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া প্রাইভেট গোয়েন্দা লাগিয়েছে, খরচ করছে—দামি কিছু নিশ্চয়ই আছে এর মধ্যে।”
চুপ করে যান অরুণাংশু। হঠাৎ যেন একটা বিপদের গন্ধ পান তিনি। মিতুলের হাতের তালু ঘামছে। টুবলু ভাবছে চার্চের আলো জ্বালিয়ে দেবে কি না, চাঁদের আলো জানালায় পৌঁছলে তারপর না-হয় আবার নিভিয়ে দেবে। কিন্তু আলোর সুইচ কোথায় কে জানে। কোনও একটা ঘড়িতে আওয়াজ উঠছে টিক টিক টিক টিক। মনে হচ্ছে ও-পাশের বসার আসনগুলো যেন খালি নয়, এই নীলচে আলোয় কারা যেন ওখানে বসে কীসের জন্য যেন অপেক্ষা করছে।
স্টেইনড গ্লাসের উপর চাঁদের আলোয় পড়তেই সামনের মেঝেটা রঙে রঙে যেন ভরে গেল। পৌঁছেছে চাঁদ। এখনও সেই বিশেষ জায়গার উপর সরাসরি না পড়লেও জানালার মাথায় পৌঁছেছে। সঙ্গে সঙ্গে যেন দাগ কাচের রঙগুলো গলে গিয়ে জানালা বেয়ে মেঝেতে নেমে এল। কী অপূর্ব দৃশ্য! মিতুলের মনে হয় আজ না-হয় তারা আছে, এই দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে—অন্য যে-কোনো চাঁদনি রাতে কেউ তো থাকে না দেখার মতো, তাও চাঁদ আর পাথুরে গির্জা মিলে কত বছর ধরে এই রঙের খেলা খেলছে।
চাঁদ আর একটু সরল। লাফিয়ে ওঠে টুবলু—“এবার ওই ফুলের প্যাটার্নের উপর আলো পড়ছে সরাসরি। স্যার এবার?”
মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে রঙের মেলা। স্বাভাবিকভাবেই সব রঙে মিশেছে একটু জ্যোৎস্নার নীলচে ভাব। এই অপার্থিব সৌন্দর্যের মধ্যে যেন হারিয়ে যেতে থাকে মিতুল।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন অরুণ-স্যার।—“কুইক টুবলু! মিতুল হারি আপ! শিগগির দেখ ওই ফুলের ছায়াটা মেঝের কোথায় পড়েছে। মিলিয়ে যাবে চাঁদের সাথে ক্ষণিক প্রকাশ মাত্র। চাঁদ সরে গেলেই ক্লুও হারিয়ে যাবে।”
দুই লাফে মেঝেতে ততক্ষণে নেমে পড়েছে মিতুল আর টুবলু। পাশে অরুণ-স্যার।
হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে মিতুলের। ওটা কী দেখছে সে? এটা তো কোনোভাবেই জানালার ছবির ছায়া নয়। মেঝের উপর যেখানে জানালার তিন গুণীজনের নীচের ফুলের ছায়াটা পড়েছে, সেখানে মেঝের উপরকার পাথরের কিছু এলোমেলো আঁকিবুকির সঙ্গে মিলে তৈরি হয়েছে এক নতুন ছবি। মেঝের এই দাগগুলো আগে চোখেই পড়েনি কারও, কারণ শুধু শুধু এই দাগগুলোর কোনও মানেই হয় না। পাথরের উপর অনেক সময়ই এরকম এলোমেলো দাগ থাকে। তাই সবার চোখের সামনে থেকেও এর কোনও বিশেষত্ব কেউ বুঝতে পারেনি। একমাত্র ওই ফুলের ছায়ার সঙ্গে মিললেই ছবিটা সম্পূর্ণ হয়। ফুলের ছায়ে পড়বে যখন চাঁদের আলোর রেখা/ মিলবে তাতে লক্ষ্ণৌতির শিলার অচিন লেখা।
“কুর্নিশ সেই শিল্পীকে যিনি এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন।” স্যারের গলায় সম্ভ্রম ঝরে পড়ে। মোবাইল বের করে ছবিটা তুলে নেন তিনি, কারণ চাঁদ সরতে শুরু করবে এখনই।
ছায়া দিয়ে তৈরি ছবিটা অদ্ভুত। বাইরে একটা গোল, তার ভিতরে একটা ক্রস। মানে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা গলায় যেরকম ক্রস পরেন, সেইরকম। ক্রসের উপর, নীচ আর দুই পাশের প্রান্তগুলোতে একটি করে ফুলের কুঁড়ি। খুব চেনা লাগে ছবিটা মিতুলের। সম্প্রতি কোথাও দেখেছে যেন এটা।
চাঁদ সরতে থাকে, মেঝের ছবিটাও নষ্ট হয়ে যেতে থাকে সেই সঙ্গে। স্যার তখনও মোবাইলে তোলা ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে মিস্টার পেরেইরা। মোবাইলের আলো তাঁর মুখের অদ্ভুত হাসিটার উপর পড়েছে। টুবলুরও যেন হাসিটা ঠিক ভালো লাগে না এখন আর।
“এবার স্যার? এই ছবির মানে কী?” শুকনো গলায় টুবলু বলে। তারও খুব চেনা লাগে ব্যাপারটা, কিন্তু ধরতে পারে না।
“এরকম ক্রস মেমোরিয়াল বা স্মৃতিসৌধের উপর থাকে। বাইরের বেরিয়াল গ্রাউন্ডে অনেক সৌধের উপর এটা আছে। এটা কোনটার মিস্টার সেন?” কেটে কেটে বলেন পেরেইরা। মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেছে এবার।
“তাঁর নামের রসে রসিকজন মজেন অহোরাত্র।” ধীরে ধীরে বলে মিতুল, “নামের রস?”
“রসগোল্লার রস হলেও কথা ছিল।” বিড়বিড় করে বলে টুবলু।
“বিখ্যাত কার কার স্মৃতিসৌধ দেখেছিস এখানে মনে কর একবার।” স্যারের গলা কি একটু হালকা মনে হয়? স্যার কি বুঝতে পেরে গেছেন?
“সব তো মনে নেই তবে জোব চার্নক, বেগম জনসন আর কাউন্টেস ক্যানিং—এগুলো মনে আছে।”
“তাহলে রসগোল্লা না হয়ে লেডিকেনির রসও তো হতে পারে, নাকি?” স্যারের গলায় হাসি স্পষ্ট।
“মানে?” টুবলু আকাশ থেকে পড়ে।
এবার লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে ওঠে মিতুল—“কাউন্টেস বা লেডি ক্যানিংয়ের অনারে তৈরি মিষ্টি লেডিকেনি! এই তো মিলে যাচ্ছে সব। তাঁর নামের রসে রসিকজন মজেন অহোরাত্র, মানে লেডিকেনি মিষ্টির রস!” প্রায় নাচতে থাকে মিতুল।
“কিন্তু, কিন্তু...” টুবলু এবার তোতলাতে থাকে।
“আবার কিন্তু কীসের? শেষ লাইন দুটো ভাব—স্মৃতির ঘরের সঠিক হদিস যখন মিলে যাবে/ আলোছায়া সরিয়ে নিলেই অরূপরতন পাবে। স্মৃতির ঘর মানে অবশ্যই ওঁর স্মৃতিসৌধ, সেখানেই আছে অরূপরতন। কিন্তু ওঁর স্মৃতিসৌধের ভিতরে? মানে ওটা ভাঙতে হবে নাকি?” মিতুলের গলায় দ্বিধা। এটা তো ঠিক ভালো হবে না।
চাঁদ বেশ খানিকটা সরে গেছে। ঘরে আলোর থেকে অন্ধকারটাই বেশি। এবার আলোগুলো জ্বেলে ফেললে হয়। স্যারকে সেই কথাটা বলার জন্য ঘুরতে যেতেই পাশ থেকে একটা ঠকাস, তারপরেই একটা ধুপ করে শব্দ হয় কীসের। চমকে উঠে দেখতে গিয়েই মাথায় একটা প্রচণ্ড আঘাত লাগে মিতুলের। টলে পড়ে যাওয়ার আগে আবছাভাবে মনে হয় টুবলু মাটিতে পড়ে আছে। তারপর সব অন্ধকার।
চোখ খুলে প্রথমে কী দেখছে বুঝতে পারে না টুবলু। ওগুলো কি তারা? শোবার ঘরে তারা এল কোথা থেকে? সে কি স্বপ্ন দেখছে? ওটা তো বেল্ট অফ ওরায়ন। হালকা ঠান্ডা লাগছে গায়ে। কোথায় সে? নড়তে গিয়ে মাথার মধ্যে ঝনঝন করে উঠল যেন। উফ্, কী ব্যথা! মা বলে ডাকতে গিয়েই হঠাৎ সব মনে পড়ে গেল টুবলুর। তারপরেই বুঝল, তার হাত দুটো বাঁধা। পিছমোড়া করে বেঁধে তাকে একটা গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আস্তে আস্তে দৃষ্টি পরিষ্কার হয় আরও। বুঝতে পারে সে পাথুরে গির্জার বাইরে, বেরিয়াল গ্রাউন্ডে। চাঁদের নীলচে সাদা আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। তার সামনে হাত পাঁচেক দূরে একটা স্মৃতিসৌধ। সৌধের উপরে একটা ক্রস, কিছুক্ষণ আগে দেখা মেঝের উপর আলোছায়ায় আঁকা ছবিটার প্রতিরূপ। সৌধের উপর আলো পড়েছে, দেখে মনে হচ্ছে এমার্জেন্সি ল্যাম্পের আলো।
লেডি ক্যানিংয়ের স্মৃতিসৌধের সামনে পড়ে আছে সে। আস্তে আস্তে মাথাটা বাঁদিকে ঘোরায় টুবলু। এবারে ঝনঝন করে ওঠে সারা শরীর। ভারী কিছু দিয়ে মেরেছে মাথায়। হাত খানেক দূরে পাশের গাছটার গায়ে ঠেস দিয়ে ঠিক তার মতো করেই হাত বাঁধা অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে মিতুলকেও। ওর জ্ঞান এখনও ফেরেনি মনে হচ্ছে। মাথাটা একপাশে হেলে কাঁধের কাছে ঝুলছে। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত নেমে যায় টুবলুর। ঠিক আছে তো মিতুল? স্যারই-বা কোথায়?
“কী সপ্তর্ষিবাবু, তোমাদের স্যারকে খুঁজছ বুঝি?” পিছন থেকে টানা টানা ভিনদেশি উচ্চারণে চমকে ওঠে টুবলু। দুজন মানুষ এমার্জেন্সি ল্যাম্পের আলোয় এসে দাঁড়ায়। স্যার দুই হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন, আর তাঁর কানের কাছে পিস্তল ঠেকিয়ে মিস্টার ফ্রান্সিসকো পেরেইরা। স্যারের সঙ্গে মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হয় টুবলুর। পেরেইরার অন্য হাতে একটা বিশাল ভারী ক্রস। টুবলুর মনে পড়ে, ক্রসটা চার্চের ভিতরে একটা মস্ত বড়ো টেবিলের উপর রাখা ছিল। ওটা দিয়েই তাহলে মিতুল আর তার মাথায় বাড়ি মেরেছে শয়তানটা।
বন্দুকটা তাক করে রেখেই পেরেইরা সামান্য নীচু হয়ে ক্রসটা ঘাসের উপর রেখে আর একটা কিছু তুলে নেন হাতে। তোলার সময় সৌধের সঙ্গে ধাক্কা লাগে জিনিসটার। ঠং করে একটা বিকট শব্দ ওঠে। দু-পাশের গাছ থেকে কিছু পাখি ডেকে ওঠে সেই শব্দে। টুবলু এবার বুঝতে পারে জিনিসটা কী। একটা শাবল। স্যারের দিকে শাবলটা বাড়িয়ে ধরে পেরেইরা বলেন, “নিন মিস্টার সেন, সৌধের উপরের ঢাকাটা ভেঙে ফেলুন। জিনিসটা আমার চাই।”
আশ্চর্য শান্ত গলায় অরুণ-স্যার বলেন, “একটা ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ ভাঙতে আমি পারব না মিস্টার পেরেইরা। আর আপনিও তো আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে চাকরি করেন। এই জিনিসের ঐতিহাসিক মূল্য আপনার অজানা নয় নিশ্চয়ই? আপনার লোভ আপনাকে অন্ধ করে দিয়েছে। কী জিনিস সেটা ভালো করে তো জানেনও না আপনি।”
টুবলু পাশ থেকে অস্ফুট একটা কাতরানি শুনতে পায় এবার। মিতুলের মাথাটা অল্প অল্প নড়ছে। চাপা গলায় ডাকে টুবলু, “মিতুল, অ্যাই মিতুল!”
উৎকটভাবে হেসে ওঠেন পেরেইরা। কর্কশভাবে বলেন, “আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন না, আমি পদ্মরাগ মণির কথা জানলাম কী করে? দেখুন তবে।” পকেট থেকে ছোটো একটা চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরিমতো কিছু বের করে আনেন পেরেইরা। দেখে মনে হয় জিনিসটা বহু প্রাচীন। ভীষণ জোরে প্রায় চিৎকার করে বলতে থাকেন, “এটা কার ডায়েরি জানেন? আমার পূর্বপুরুষ কোয়েলহো ডি-কস্টার। পর্তুগিজ হয়েও এ-দেশের ভাষা শিখেছিলেন তিনি। গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহকে পর্তুগিজ ভাইসরয় লোপো সোরেস অ্যালবারগারিয়া উপঢৌকন দিয়েছিলেন এক মহামূল্যবান দুষ্প্রাপ্য রুবি। কোয়েলহো দোভাষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তখন, সাক্ষী ছিলেন এই ঘটনার। সমস্ত লেখা আছে এই ডায়েরিতে। সেই রুবির বর্ণনা আমি ভুলতে পারিনি। ইতিহাস সেই রুবিকে হারিয়ে ফেলে তারপর। এই ডায়েরি পড়ার পর থেকে সেই রুবি আমি খুঁজতে শুরু করি। কোথাও কোনও হদিস পাই না তার। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে সূত্র পাই একটা। গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে নানা প্রস্তরখণ্ড এনে তৈরি হয়েছিল এই পাথুরে গির্জার মেঝে। এখানে এসে এই গির্জার ধাঁধা শুনে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে আমি যা খুঁজছি তা এখানেই আছে। এও বুঝতে পারি, আমার আগে আরও কেউ এসেছিল এই রত্নের সন্ধানে। সম্ভবত সেও আমারই পূর্বপুরুষ কেউ। স্বীকার করছি ধাঁধা সমাধান করার ক্ষমতা আমার ছিল না। আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার চাকরিটা পেতে কোনও অসুবিধা আমার হয়নি, নিজের যোগ্যতাতেই সেটা পেয়েছি। আমার উদ্যোগেই আপনাকে এই কাজের ভার দেওয়া হয় মিস্টার সেন। আপনার নাম আমি আগেই শুনেছিলাম। এবার কাজটা আপনি শেষ করুন।” আবার ঠং করে শাবলের ঘা দেন পেরেইরা সৌধের গায়ে।
এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল টুবলু। মিতুলের জ্ঞানও পুরোপুরি ফিরে এসেছে। শেষ ঠং শব্দে দুজনেই চমকে ওঠে।
আবার শান্ত গলায় অরুণাংশু বলেন, “এ-কাজ আমি করব না মিস্টার পেরেইরা। তাছাড়া ও-জিনিস আপনার নয়।”
এমার্জেন্সি ল্যাম্পের আলোয় কেমন বীভৎস দেখায় পেরেইরার মুখটা। তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন, “তাহলে আমারও আর অপশন থাকছে না মিস্টার সেন।”
আস্তে আস্তে বন্দুক ঘুরে যায় মিতুলের দিকে। স্যারের দিকে একবার তাকায় টুবলু। দুজনের মধ্যে অদৃশ্য এক ইশারা খেলে যায় যেন। এক পা দুই পা করে এগিয়ে আসছেন পেরেইরা। আর এক পা, আর একটু। বিদ্যুতের মতো দুটো পা দু-দিকে ছড়িয়ে যায় টুবলুর; পেরেইরার দুই পায়ের শিন বোনে গিয়ে লাগে। ল্যাম্পের আলোর বাইরে এসে মুহূর্তের জন্য চোখ ধাঁধিয়ে ভুল করে পেরেইরা টুবলুর দুই পায়ের দুই দিকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। সে-সুযোগ হারাবার বান্দা টুবলু নয়। ব্যালান্স হারিয়ে আছড়ে পড়েন পেরেইরা। হাত থেকে বন্দুকটা ছিটকে পড়ে অন্ধকারে কোথাও। একটা ভোঁতা ঠক শব্দ হয়।
স্যার ভারী ক্রসটা নামিয়ে রেখে সলজ্জ হাসেন।—“শিল্পী মানুষ, জোরে মারা সম্ভব নয়। তবে অজ্ঞান হয়েছে আপাতত।”
প্রায় শেষরাত। সৌধের সামনে ঘাসের উপর তিনজনে বসে। অজ্ঞান পেরেইরার হাত-পা ভালো করে বাঁধা। মিতুল আর টুবলু যতটা সম্ভব মাথা না নাড়িয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে। স্যার ওদের হসপিটালে চেক-আপের জন্য নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ওরা রহস্যের শেষ না দেখে যেতে রাজি হয়নি।
“মেমোরিয়ালটা সত্যিই কি ভাঙতে হবে স্যার?” মিতুলের গলাটা একদম হতাশ শোনায়।
“যদি সত্যি তাই হত, তাহলে আমি আর এগোতে রাজি হতাম না। শেষ পর্যন্ত না দেখেই ছেড়ে দিতাম।” দৃঢ়ভাবে বলেন অরুণ-স্যার।
“তাহলে?” একসঙ্গে বলে ওঠে মিতুল আর টুবলু।
“ধাঁধার শেষ লাইনটা ভাব।”
“আলোছায়া সরিয়ে নিলেই অরূপরতন পাবে। আলোছায়া, আলোছায়া...” বিড়বিড় করতে থাকে মিতুল।—“আলোছায়ায় কী ছিল? ওই ছবিটা যেটা মেঝেতে তৈরি হয়েছিল। মানে সৌধের উপরে ওই গোলের মাঝে ক্রসটা। ওটাই সরিয়ে নিতে হবে। স্যার?” শেষ শব্দটা প্রায় চিৎকার করে বলে লাফিয়ে ওঠে মিতুল। যদিও মাথার ব্যথায় সঙ্গে-সঙ্গেই উহ্ করে বসে পড়ে আবার। বসে-বসেই চেঁচায় এবার—“ওটা সরানো যায় স্যার?”
“যদি খুব ভুল না হয়। আর আমার ধারণা, ভুল আমাদের হচ্ছে না।” এগিয়ে যান সৌধের দিকে অরুণ-স্যার। উপরের ক্রসটা ধরে ঘোরাতে থাকেন আস্তে আস্তে।
এতদিনের পুরোনো জিনিস, প্রথমে ঘুরতে চায় না। ধীরে ধীরে টুবলু আর মিতুলের বিস্ফারিত চোখের সামনে অল্প অল্প করে ঘুরতে শুরু করল ক্রসটা। একসময় পুরো জিনিসটা হাতে উঠে এল স্যারের। মাথার ব্যথা ভুলে দুজনে ছুটে যায় লেডি ক্যানিংয়ের সৌধের দিকে। যেখানে ক্রসটা ছিল, সেখানে এখন একটা ছোট্ট খোপ। তার ভিতরে ফ্যাকাশে হয়ে আসা নীল ভেলভেটের উপর যেন খানিকটা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। অরুণাংশু সাবধানে দুটো আঙুল ঢুকিয়ে বের করে আনেন সেই জমাট বাঁধা রক্তের মতো দেখতে পাথরটা। ল্যাম্পের আলো পড়ে ঝিকিয়ে ওঠে সুলতান হোসেন শাহের হারিয়ে যাওয়া পদ্মরাগ মণি।
পুলিশ এলো আলো ফোটার পর। ভোর হচ্ছে তখন, গাছে গাছে পাখি ডাকছে। পাথুরে গির্জার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে টুবলু আর মিতুল। কত রহস্য লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন ধরে এই গির্জা। পুলিশের সঙ্গে আরও একজন এলেন। জাদুঘরের কিউরেটর শ্রী অপরেশ বাগচী। আলাপ করে ভারি ভালো লাগল তাঁকে অরুণাংশুর। ভেলভেটে মোড়া রুবিটিকে তাঁর হাতে তুলে দিয়ে অরুণাংশু বললেন, “ভাগ্যিস এটা এই দেশে থেকে গেছিল। কেন ইংরেজরা এটা নিয়ে যায়নি নিজেদের দেশে সেটা বোধহয় আর কখনও জানা যাবে না। এবার যথাযোগ্য মর্যাদায় থাকবে এটা।”
টুবলু-মিতুলকে নিয়ে এগিয়েই যাচ্ছিলেন অরুণাংশু গাড়ির দিকে। হঠাৎ থেমে ডাক দিলেন—“মিস্টার বাগচী!”
দ্রুত পায়ে এগিয়ে যান অরুণাংশু কিউরেটর বাগচীর দিকে।—“আরও একটা ঐতিহাসিক জিনিসের কথা ভুলেই গেছিলাম। ওটা পেরেইরার পকেটে পাবেন। একটা ডায়েরি।”
ফ্রান্সিসকো পেরেইরাকে পুলিশ ততক্ষণে গাড়িতে তুলে নিয়েছে।
ছয় মাস বাদে।
ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের চত্বর। আজ গৌড়েশ্বরের পদ্মরাগ মণি আর কোয়েলহোর ডায়েরি দেখার সৌভাগ্য হবে সবার। তার আবরণ উন্মোচনের ভার দেওয়া হয়েছে বিখ্যাত পোর্ট্রেট আঁকিয়ে কাম গোয়েন্দা অরুণাংশু সেনকে। টুবলু আর মিতুলকেও বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে মিউজিয়ামের তরফ থেকে।
বাইরে দাঁড়িয়ে একটা ডাবল স্কুপ ভ্যানিলা আইসক্রিম খুব মন দিয়ে চাটতে চাটতে টুবলু বলে, “ফাদার জোনাথনের ভূত তোকে পার্সোনালি আশীর্বাদ করতে আসে যদি কী করবি?”
মারাত্মক একটা ভেংচি কেটে মিউজিয়ামের ভিতর ঢুকে যায় মিতুল। ভূতের ভয় তার এক্কেবারে কেটে গেছে।
ছবি - বুমা ব্যানার্জী দাস
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী