বড়ো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
বড়ো গল্প
শাশ্বত কর
এক
কোলাঘাটের রেস্তোরাঁটায় ঢুকতেই আম্মার কথা মনে পড়ে গেল। এই রাস্তায় গেলে আমরা এখানেই খেতে আসি। গেল বার গালুডি গেছিলাম, তখন আম্মা-দাদানদা সঙ্গে ছিল। আম্মা থাকলে বেড়ানো ব্যাপারটা অনেক জমে। আম্মা যে শুধু ধরে ধরে এটা-সেটা খাওয়ায়, কেবল তার জন্য নয়, আসলে বেড়াতে বেরোলেই দেখেছি আম্মার চোখমুখ থেকে যেন আনন্দ ঝরে! এমনিতেই তো সুন্দর খুব, তখন আরও সুন্দর লাগে। বাস রে, কথাও বলে আম্মা তখন! থামেই না তো থামেই না! মা বলে, আম্মা খুব বেশি বললেই নাকি বেফাঁস বলে। কথাটা অবশ্য সত্যি। এই তো গেলবারই ওয়েটারের কাছে স্কচব্রাইট চেয়ে বসেছিল বাটারস্কচ চাইতে গিয়ে। এর আগে একবার দোকানে অ্যালপিনলিবে কিনতে গিয়ে আলপিনলিভার চেয়ে বসেছিল। তাছাড়া থিন লাইটকে ভুলে লাইফলাইন, ম্যাকাও ভুলে ম্যাকেনরো—এসব তো হামেশাই বলে। মুশকিল হচ্ছে, যখন ভোলে তখন নিজে যে নামটা বলছে সেটাই ঠিক বলে ভাবে, আর যারা বুঝছে না তাদের রীতিমতো ধমকায়। মা বোঝাতে গেলে মাকে ধমকায়, দাদানদার তো কিছু বলাই বারণ! হাঁ করলেই পুরো ধুয়ে দেবে—‘বলার আগে শোধরাতে পারো না? এত বড়ো একটা বুড়ো লোক! এই গরমে খাওয়ার পরে যে বাচ্চাটাকে একটা আইসক্রিম দিতে হয় সেটা বোঝো না? তুমি ডেকে বলে দিলে তো আমার বলার দরকার পড়ে না! নিজে তো তারিয়ে তারিয়ে চা খাচ্ছ, বাচ্চাটা খাবে না?’
সেই ওয়েটারই এবারও অর্ডার নিচ্ছে। এখন সকাল সোয়া সাতটা। এত সকালে ব্রেড-অমলেট হবে না। আমরা তাই আলুর পরোটা চেয়েছি। বাবা বলছিল, এখানে ব্রেড আসতে দেরি হয় বোধ হয়। তেকোনা তেকোনা চার টুকরো ধোঁয়াওঠা আলুর পরোটার সঙ্গে কাবলি ছোলার লাল ঘুগনি এলো। ওরে ঝাল কাকে বলে!
“না পারলেও যতটা পারিস খেয়ে নে বেলো। সামনে অনেকক্ষণ আর দাঁড়ানো যাবে না কিন্তু।” বাবা বলল।
মা অনেকটা আম্মার মতো। এমনিতে তো সারাদিন একেবারে মিলিটারি নজর, বেড়াতে বেরোলে যেন আরও নজরদারি বেড়ে যায়। অবশ্য কড়া আর তখন নয়, বরং অনেকটাই মিঠে। আর ওইটেতেই জ্বালা! সে-আদরের ঠেলায় তখন প্রাণ যায়। তবু ভালো, এখন খাওয়া নিয়ে কিছু বলছে না। কে জানে হয়তো গাড়িতে উঠলেই এটা-ওটা দেবে আর খেতে বলবে!
“গতবার তোর আম্মা-দাদানদা সঙ্গে ছিল মনে আছে?” একটুকরো আলুর পরোটায় ঘুগনি মুড়ে গালে চালান করে দিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করল।
উত্তর দিলাম না। সব কথার উত্তর দিতে ইদানীং আমার ভালো লাগে না।
“লোকজন বেশি থাকলেই কিন্তু বেড়ানোয় মজা হয়। এবার আমরা শুধু তিনজন।”
“বেরোবো বলে তো কিছু ঠিক ছিল না।” বাবার কথায় আমি উত্তর না করলেও মা যোগ দিল। ওরা ওদের মতো কথা বলুক গে।
কথায় কান দেব না ভাবলেও আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল, মে মাসে শিমলা থেকে বেড়িয়ে আসার পর মায়ের কথাগুলো—‘এ-বছর কিন্তু আর কোথাও বেড়ানোর কথা মনেও আনা যাবে না।’ কিন্তু ষষ্ঠী পেরিয়ে সপ্তমী পড়তেই কীভাবে যে মাকে বাবা ম্যানেজ করে ফেলল কে জানে! স্বরাজকাকুকে ফোন করে গাড়ির ব্যবস্থাও করে ফেলল। স্বরাজকাকু বাবার ছোটবেলার বন্ধু। বড়ো একটা কার রেন্টাল চালায়। বন্ধু বলে বাবার এইসব হুজুগে পাত্তা না দিয়েও পারে না। যেখান থেকে হোক ঠিক ম্যানেজ করে দেয়। এবারেও তাই হল।
তারই ফলস্বরূপ নবমীর সকালে আমাদের এই রাঁচি যাত্রা। হোটেল-টোটেল কিচ্ছু বুক করা নেই, দাদানদা-আম্মাও নেই, স্বরাজকাকু নিজেও নেই—নিতাইকাকু নামে একজনকে পাঠিয়েছে সাদা একটা সুইফট ডিজায়ার দিয়ে। কী যে আছে এবার কপালে কে জানে!
ব্রেকফাস্টের পর গাড়ি ছুটেছে। ন্যাশনাল হাইওয়ে সিক্স। সকাল সকাল রাস্তা মোটামুটি ফাঁকাই, তাই বেশ স্পিডেই ছুটছে নিতাইকাকুর সাদা ডিজায়ার। রাস্তার দু-ধারেই একইরকম দৃশ্য। অথচ বাবা-মা দুজনেরই বক্তব্য, সেদিকেই দেখতে হবে! আরে খ্যাবড়া খ্যাবড়া চায়ের দোকান, ঘুমন্ত ট্রাক, ভিড়ে ঠাসা বাজার নইলে ধু ধু সবুজ ক্ষেত। রাস্তায় বেরোলেই এসব তো প্রতিবারই দেখি।
মনটা ওদিকে খুব চাইছে। একবার নিই একবার নিই বলে ভিতরে কে একটা বিড়বিড় করেই চলেছে। হাতটা নিজে-নিজেই টুকটুক করে মাঝে মাঝে মার কাঁধ ব্যাগের দিকে চলে যাচ্ছে। কষ্ট করে আটকে রাখছি। হাতের কী আর দোষ! প্রায় ঘণ্টা তিনেক বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, এখনও তো একবারও চাইনি। এবার তো নিজেদেরই দেওয়া উচিত। আম্মা থাকলে এমন হত না। এরা তো নিজে থেকে দেবেই না, উলটে চাইলেও দু-চার কথা শুনিয়ে দেবে। ধুস! ঘুমোই।
“কী রে! বেড়াতে বেরিয়ে ঘুমোচ্ছিস কেন? বাইরে দেখ! তোর কি বেড়াতে এলেও আনন্দ হয় না!” সামনের সিট থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে বাবা বলল।
নেহাত নিতাইকাকু নতুন লোক, তাই বাবার কথার আর কোনও উত্তর দিলাম না। চোখ বুজে মনে মনে একটা রামভ্যাঙান ভেঙচে নিলাম।
ন’টা দশ। নাহ্, আর পারা যাচ্ছে না। বেশ বোর লাগছে।
“মা, একবার দেবে? সকাল থেকে কিন্তু নিইনি।”
“কী গো, দেব?” আমার দিকে দেখে মা বাবাকে জিজ্ঞেস করল।
“আমায় জিজ্ঞেস করছ কেন? আমার উত্তর তো জানো।”
মা ব্যাগ থেকে ফোনটা আমায় দিয়ে বলল, “আধঘণ্টা কিন্তু।”
ফোনটা হাতে নিতেই আনন্দে মনটা নেচে উঠল। মাথা নেড়ে বললাম, “তাই হবে।”
নোটিফিকেশনে নতুন একটা ভিডিও আপলোডের মেসেজ। ক্লিক করে ঢুকে গেলাম ভিডিওটায়। ডানজেন অ্যান্ড ড্রাগন। স্টান্ট টিবেটি, জিওফ্রে ট্রোমার, লিনি অ্যামব্রোজ, সুরাইয়া ত্রিপাঠী, জুলুক দোংমা আর হ্যারি মিশেল খেলছে। প্ল্যান খুলে গেছে। যে-যার কথা বলছে, খেলাও জমে যাচ্ছে।
কিন্তু ভিডিওটা যে একঘণ্টা সাঁইত্রিশ মিনিটের! ধুস, দেখা শুরু তো হোক! অভিজ্ঞতা বলছে, বাইরের দৃশ্য আর হোয়াটস-অ্যাপ দেখতে দেখতে দুজনেই ঠিক আধঘণ্টার হিসেব ভুলে যাবে।
দুই
গাড়ি থেমেছে। আড়চোখে একটু দেখে নিলাম। পরিস্থিতি তো স্বাভাবিকই লাগছে।
“ওটা রেখে নেমে আয় এবার।” বাবা ডাকছে। স্বাভাবিক গলা। যাক বাবা!
ধু ধু একটা মাঠ। মাঠের বুক চিরে হাইওয়েটা বরাবর শুয়ে আছে। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলে গাড়িগুলো দৌড়ে যাচ্ছে বেদম তাড়ায়। রাস্তার পাশ থেকে একটা সরু ঘাসওঠা পথ নেমে গেছে নীচের মাঠে। বাবা-মা দুজনেই সেই মাঠে নেমে আমাকে ডাকছে। নিজেরাই বলে অচেনা অজানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো ঠিক নয়, আবার নিজেরাই দেখো কোন বিভূঁইয়ে নেমে হাউকাউ করছে। পারেও এরা!
নামতেই মনটা অবশ্য আনন্দে ভরে গেল। একটা ছোটো পুকুর-ভরতি লাল গোলাপি পদ্ম ফুটে আছে। সাদা কালো কয়েকটা হাঁস সেই পদ্মের মধ্য দিয়ে ড্রিবল করছে। শনশন করে হাওয়া বইছে। পুকুরের জলে ছোটো ছোটো ঢেউ। সেখান থেকে আর একটু উঁচুনীচু সবুজ পেরিয়ে কাশবন। চিনে-বুড়োর দাড়ির মতো হাওয়ায় দুলছে কাশফুল। আমরা সেদিকে চললাম।
হাওয়া সরসর করছে কাশবনে। আমরা ছবি তুলছি। মাথায় মাঝে-মাঝেই কাশফুলের ছোঁয়া টের পাচ্ছি। ইস! আম্মা থাকলে কী ভালো হত!
বাবা ফিরে গেছে পুকুরটার কাছে। পদ্মের উপরে বসা ভোমরার ছবি তুলবে। কে বোঝাবে, মোবাইল ক্যামেরায় যতই জুম করুক, খুব ভালো ছবি আসবে না!
নিতাইকাকুও গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। ভাবলাম ওঁকে একবার থ্যাংকস জানাই এত সুন্দর জায়গায় গাড়িটা দাঁড় করিয়েছে বলে, কিন্তু বলে উঠতে পারলাম না। কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকল। নতুন দেখা কারও সঙ্গেই কেন যে কথা বলে উঠতে পারি না! অথচ কত কী বলতে ইচ্ছে করে।
নিতাইকাকু আমাদের কাশবনের সামনে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে দিচ্ছে। হঠাৎ পিছনে কী যেন সড়সড় করে উঠল। চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখি কাশবনের ভিতরটা বেজায় দুলছে আর কেমন খচমচ আওয়াজ উঠছে। ওরে লাফ কাকে বলে! আমার নয়, বাবার। এক লাফে নিতাইকাকুকে ছাড়িয়ে গেছে। আমি আর মাও অবশ্য খানিকটা সরে এসেছি। খচমচ আওয়াজটা এগিয়ে আসছে। কাশফুলের ডগাগুলো দুলে দুলে ঢেউ তুলছে। তোলপাড়টা যেন নীচের দিকটায় বেশি।
সমস্ত তোলপাড় খতম করে তিনটে ছাগলছানার বাদামি-সাদা মাথা উঁকি দিল। বাইরে আসতে পেরে যেন তাদের বেজায় আনন্দ। তিড়িংবিড়িং করে নাচতে নাচতে ছুট দিল মাঠ ধরে।
গাড়িতে উঠে বাবা বলল, “ওরা বোধ হয় অপু-দুর্গার মতো ভাইবোন। কাশবন পেরিয়ে হাইরোড দেখতে এসেছে।”
“তোমার মুণ্ডু! কাশবন পেরিয়ে কচিঘাস চিবুতে এসেছে। ওই দেখো!”
সত্যিই তখন তারা ঘাসে দাঁত ডুবিয়েছে। মনে মনে একবার টা টা করলাম। ওমা! অমনি তিনজনেই খাওয়া থামিয়ে আমার দিকে তাকাল। নিতাইকাকুও গাড়ি ছেড়ে দিল।
টুকরো টুকরো সাদা মেঘ থাকায় নীল আকাশটা মনে হচ্ছে আমাদের সঙ্গেই চলেছে। দুটো চারটে করে ছোটো ছোটো কালচে মেঘ জমছে আকাশটায়। মাঝে-মাঝেই তাদের ছায়া পড়ছে রাস্তায়। একটা জঙ্গল শুরু হল। দু-পাশে বড়ো বড়ো গাছ এসে পড়ায় রোদ্দুর আরও কমে এসেছে।
“দেখ বেলো, শালবন! তাকিয়ে থাক, একটা দুটো হরিণ বা বাইসনের দেখা পেয়ে যেতে পারিস।”
বাচ্চা ভাবছে নাকি! এই জঙ্গলে বাইসন! হরিণও থাকবে না। বড়োজোর ছাগল অথবা গোরু না হলে শুয়োর, শেয়াল দেখা যেতে পারে।
দু-ধারের জঙ্গল আরও ঘন হয়ে এসেছে। কালো মেঘগুলো এখন প্রায় গোটা আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। পুজোর সময় কীসের দুঃখ ওদের?
বাইরেটা এখন আরও সুন্দর। দু-ধারের বন এখন একটু কালচে সবুজ দেখাচ্ছে। রাস্তাটা কালো অজগরের মতো সোজা শুয়ে আছে। দু-দিকের বন সামনে মিলে গিয়ে যেন হাতজোড় করে আছে; তাদের মাথায় ঝুঁকে পড়েছে স্লেট রঙের আকাশ।
বড়ো বড়ো ফোঁটা এসে পড়ছে কাচে। জমে থাকা ধুলো ধুয়ে নেমে আসছে কাচ বেয়ে। বৃষ্টির বেগ বাড়াতে ওয়াইপার চালু করে দিল নিতাইকাকু। মাঝারি একটা গতিতে বৃষ্টি হচ্ছে। ওয়াইপার নড়েচড়ে কাচের ঝাপসাটাকে সরিয়ে দিলেই মনে হচ্ছে গাছ-রাস্তা-আকাশ—সবাই একসঙ্গে চান করছে বৃষ্টিতে।
এমনি করে প্রায় আধঘণ্টাটাক চলার পরে দু-ধারের বনটা হঠাৎ সরে গেল। আশ্চর্যের কথা, বৃষ্টিটাও ঠিক তখুনি একেবারে বন্ধ হয়ে গেল! দু-ধারের সবুজের বদলে ফুটে উঠল আদিগন্ত মাঠ। সে-মাঠের ছবিটা কিন্তু এতক্ষণ দেখে আসা মাঠগুলোর সঙ্গে একেবারেই মেলে না। সেসব মাঠ সবুজ আর সমতল, এই মাঠ রুক্ষ এবড়োখেবড়ো। একটা দুটো খেজুর বা ওরকমই কিছু গাছ মাঝে মাঝে। দিগন্তে, যেখানে মাঠ আর আকাশ মিলে যাওয়ার কথা, সেখানে তাদের বিভেদ তলে ধোঁয়া ধোঁয়া পাহাড়। তাদের মাথায় কালো মেঘ গলে গলে পড়ছে।
আর একটা অদ্ভুত কাণ্ড! গাড়ির সামনের কাচের জলের বিন্দুগুলো একজন আর একজনের সঙ্গে মিলে ছোটো ছোটো জলধারা তৈরি করছে আর সেই জলধারা নীচে নামার বদলে কাত হয়ে উপরের দিকে উঠছে। বাবাকে বলাতে খানিকক্ষণ দেখে আমার মতোই অবাক হল।
মা দেখে বলল, “এতে এত হাঁ করার কী আছে? হাই স্পিডে গাড়ি চলছে। হাওয়া যেভাবে কেটে যাচ্ছে, জলের কণাগুলোও সেভাবেই যাচ্ছে। গাড়ি থামিয়ে দাও, দেখবে হয় ওরা কাচের গায়ে লেগে আছে, না হলে নীচে নেমে আসছে।”
বাবা মাথা নাড়ল। আমার মনে হল, ব্যাপারটা বাবা আগেই বুঝেছিল। দেখেছি, আমি যাতে অবাক হই, আনন্দ পাই, বাবাকে বললে বাবাও আমার মতোই অবাক হয়, আনন্দে হইহই করে। সত্যি কি? নাকি অ্যাক্টিং? কে জানে!
তিন
জামশেদপুরে বেশ কিছুক্ষণ চক্কর কেটে শেষে শাকচিতে আমরা হোটেল পেয়েছি। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই প্রথামাফিক ঝগড়া শুরু হয়ে গেছে দুজনের। ঝগড়া সেরে বাবা স্নান সারতে বাথরুমে ঢুকেছে।
ভাত, ডাল, আলুভাজা আর আন্ডা কারি দিয়ে লাঞ্চ সেরে আমরা বিকেল বিকেল বেড়াতে বেরিয়ে এখানে এসেছি। এখানে মানে জুবিলি পার্কে। একেবারে দক্ষিণ ভারতে দেখা বৃন্দাবন গার্ডেনের মতো। রোজ গার্ডেনে অজস্র গোলাপ। ঘাসের বুকচেরা রাস্তায় মাঝে-মাঝেই নানান গুল্ম-ভরতি ফুল। বেশ লাগছে। এই খানিক আগে আমরা জুওলজিক্যাল পার্ক থেকে বেরিয়ে এলাম। অনেক জীবজন্তু আছে। কলকাতার চিড়িয়াখানা থেকে এখানে বাঘ-সিংহ অনেক স্বাস্থ্যবান দেখলাম। আর মধ্যিখানে অমন বড়ো একটা সরোবর থাকায় পরিবেশটাও দারুণ। তাছাড়া প্রচুর গাছ জুওলজিক্যাল পার্কটায়।
পার্কের মাঝখানের সরোবরে বোটিং হয়। আমাদের তো আবার মানা। বাবা বোটিং করতে দেবে না। আম্মা থাকলে তবু ম্যানেজ হয়ে যেত হয়তো। কী যে ভয় পায় বাবা! আরে আমি সাঁতার জানি না তো কী হয়েছে, তোমরা দুজন তো জানো! সাঁতার জেনেও যদি সাঁতার না জানা একটা ছেলেকে বাঁচাতে পারার কনফিডেন্স না থাকে, তাতে কী আর হাতিঘোড়া লাভ অমন সাঁতার শেখায়? কিন্তু এসব তো আর বলা যাবে না। ভারী গলার উপদেশমালা শোনার থেকে মনের কথা মনে বলাই ভালো।
তবে একটা কথা এইখানে বলে রাখি, পার্কের যেদিকটায় লেজার শো হয়, তার খানিকটা আগে আমি সেই লোকটাকে আবার দেখেছি। ওখানে হাতির গড়নে একটা বাঁধানো স্থাপত্য আছে। সিঁড়ি দিয়ে তার পিঠে চড়া যায়। বাবাকে বলেও না ওঠায় একাই উঠেছিলাম। গোটা পার্কটা দেখতে পাওয়া যায় সেখান থেকে।
সেখান থেকেই লেজার শোয়ের জায়গাটার একটু আগে সরোবরের পাশে সেই লোকটাকে দেখেছি। লেজার শো মেইন্টেনেন্সের জন্য বন্ধ বলে ওদিকটায় লোকজন তুলনায় একটু কম। সেখানেই লোকটা আলুকাবলি বেচছে। সেই লোকটাই, যাকে ইদানীং স্কুলে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকবার দেখেছি। এক-এক সময় দেখেছি এক-এক জিনিস বিক্রি করে লোকটা। কখনও বেলুন, কখনও আইসক্রিম, কখনো-বা সেফটিপিন, চিরুনি, আয়নার মতো হরেক জিনিস। যতবার দেখেছি, ততবার লোকটা কেন যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। দৃষ্টিটা খুব ঠান্ডা। একবার চোখ পড়লে কেমন যেন তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। লোকটাকে এখানে দেখে এত অবাক লাগত না যদি সকালে ওকে ডিমনা লেকে না দেখতাম।
আমরা তখন সবে জামশেদপুরে ঢুকেছি। হোটেল খোঁজার আগেই ডিমনা লেকে চলে গেছিলাম। সবুজ পাহাড়ের কোলে সে যে কী সুন্দর এক জায়গা সে আর কী বলি! শান্ত, নিরিবিলি। লেকের জলে পাহাড়ের মাথা ছুঁয়ে উড়ে চলা টুকরো মেঘেদের ছায়া। কয়েকটা রাজহাঁস সাঁতার দিচ্ছে। রাজার মতোই তাদের মেজাজ। একেবারে মাঝখান দিয়ে সোজা সাঁতরে যাচ্ছে। কয়েকটা ফড়িং পাড় ঘেঁষে ঘুরে ঘুরে উড়ছে।
আমরা লেকের দিকে খানিক এগিয়ে ডানদিকে একটা রেলিংয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছি। মার লাল ওড়নার প্রতিবিম্ব জলে। মা এমনিই খুব সুন্দর। লাল কুর্তিতে আজ আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। ডানপাশে এখন ঝোপে বুনোফুল ফুটে আছে। মৌমাছি উড়ছে। একটা ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল। ছোটো ছোটো ঢেউ উঠল লেকের জলে। ছোট্টো ঢেউগুলো পাড়ে এসে পড়ছে। ডিসকভারিতে এমন লেকের দেখা পাই। আমাদের এখানেও কত সুন্দর জায়গা আছে তাই ভাবছি। মার ফোনে ঠিক তখনই পরপর অনেকগুলো নোটিফিকেশনের টোন বাজল। হাতটা আবার নিশপিশ করছে। অনেকক্ষণ ফোনটা দেখিওনি। তাছাড়া ওই নোটিফিকেশনগুলোর মধ্যে ডানজেনের ভিডিও নোটিফিকেশন আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু গাড়িতে না উঠলে তো দেখার উপায় নেই। বাবা ওদিকে সোজা এগোচ্ছে জংলা পথে; মাও বাবাকে অনুসরণ করল। নির্ঘাত ওই বড়ো গাছটার নীচে গিয়ে হাঁ করে চারদিক দেখবে আর ফোটো তুলবে।
“কী খোকাবাবু! জলের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছেন?”
তাকিয়ে দেখি স্কুলের পথে দেখা সেই লোকটা। জামা আর হাওয়াই শার্টের বদলে এখানে ধুতি ফতুয়া পরেছে। কাঁধে গামছা। আমি অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারি না, তবু এ তো পুরোপুরি অচেনা নয়, তাই মনে হল উত্তর দিই। আড়চোখে একবার দেখে নিলাম বাবা বড়ো গাছটার নীচে পাথরে বসে এদিকেই তাকিয়ে আছে। বললাম, “কিছু না।”
“খোকাবাবু আমাকে চিনতে পারলেন না বোধহয়?”
“চিনেছি। আপনাকে স্কুলের গেটে দেখেছি। স্কুলের রাস্তাতেও দেখেছি।”
খুশি হল মনে হয়। মাথা নাড়িয়ে হেসে বলল, “হাঁ। এই পাশের গ্রামে আমার ঘর। আপনাদের তো ছুটি পড়ে গেল আর আমারও কাম খতম হয়ে গেল, তাই গ্রামে চলে এলাম। আপনাকে এখানে দেখে ভালো লাগল। তা এখানে কি বেড়াতে এলেন?”
আর কী করতে আসব এখানে! বড়োদের এরকম হাঁদা হাঁদা প্রশ্ন শুনলেই আমার পিত্তি জ্বলে।
“কী খোকাবাবু, বেড়াতে এলেন কি না?” উত্তর না পেয়ে সে ফের জিজ্ঞেস করল।
আচ্ছা ঠ্যাঁটা তো! বললাম, “হ্যাঁ।”
“তা ভালো। তা কোন হোটেলে উঠলেন?”
ব্যাপারটা তো ভালো ঠেকছে না! এতসব জেনে ওর কী? নাহ্, চুপচাপ বাবা-মার দিকে চলে যাই। তারপর মনে হল, না, আমিও তো যথেষ্ট বড়ো হয়েছি! চোখে-মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে বললাম, “কেন বলুন তো?”
লোকটা যেন একটু থতমত খেয়ে গেল। তারপর বলল, “না, এমনি পুছছিলাম। চেনাজানা মানুষ আপনি, যদি হোটেল লাগে তো এই লেকের ধারে বড়িয়া হোটেল দিতে পারি আমি।”
“ওই যে আমার বাবা বসে আছেন, গিয়ে কথা বলুন।”
“আচ্ছা, আচ্ছা।” বলে সেই লোকটা কাঁধের গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বাবার দিকে হাঁটা দিল।
পায়ের কাছে কয়েকটা চ্যাপ্টা পাথর পড়ে আছে। তাদের কয়েকটা পকেটে ঢুকিয়ে একটাকে ব্যাঙ-নাচুনি করব বলে জলে ছুড়তেই সেটা ঝপাস করে জলে পড়ে প্রথম লাফটা দিতেই অবিকল মানুষের গলায় কে যেন চিৎকার করে ‘আ যা, আ যা’ বলে উঠল! চমকে ছুট দেব ভাবছি, অমনি জল থেকে ঝুপ করে মাথা তুলল প্রায় আমার বয়সেরই একটা ছেলে। তাকে দেখা হয়েছে কি হয়নি, পিছনে ধপাধপ আওয়াজ। তাকিয়ে দেখি খালি গা হাফ প্যান্ট একটা রোগা ছেলে সোজা দৌড়ে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে আমার বাঁহাতের উপর দিয়ে এক ঝাঁপে গিয়ে পড়ল ডিমনার জলে। আর খানিক বাদে অনেকটা দূরে ভেসে উঠল ভুস করে। তারপর সে কী খেলা তাদের!
মার ডাক শুনে দেখি মা গাড়ির দিকে ইশারা করছে। সে অবশ্য ভালো। কিন্তু এই দুজনকে খেলতে দেখে জায়গাটা যেন আরও ভালো লাগছিল।
“চল রে। হোটেল খুঁজতে হবে তো!”
“কেন, ওই লোকটা তোমায় গিয়ে কিছু বলেনি?”
“কোন লোক আবার?”
“ওই যে ধুতি আর ফতুয়া পরা লোকটা! হোটেলের কথা বলছিল!”
“হোটেলের কথা তোকে কেন বলবে?”
“সেজন্যেই তো তোমার কাছে যেতে বললাম।”
“না, আমার কাছে কেউ আসেনি।”
“এজন্যেই বলি, ছেলেটার সঙ্গে থাকো। আরে হাতে পায়ে একটু নয় বড়ো হয়েছে, আদতে তো বাচ্চা ছেলে! কে কোথায় ধরে নিয়ে যাবে! বিদেশ-বিভূঁইয়ে তখন টের পাবে।” মা গজগজ করতে শুরু করল।
“কে বাচ্চা? জানো ওর এখন যা বয়স সেই বয়সে আলেক্সান্ডার দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে গেছিল?”
“রাখো আলেক্সান্ডার!” বলেই মা সোজা হাঁটা দিল গাড়ির দিকে। আমিও পকেটের ঢিল দিয়ে আর দুটো ব্যাঙ-নাচুনি করে নিয়ে এসে উঠলাম গাড়িতে।
তার পরের পর্ব তো আগেই বলেছি। ডিমনা লেকের সেই লোকটাকে ফের জুওলজিক্যাল পার্কে দেখা।
যাক গে সেসব। ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হল। দুটো ছাতা নিয়ে আমরা তিনজন এসে বসলাম ফোয়ারার কাছে বেঞ্চে। বসতে না বসতেই বৃষ্টি গেল থেমে। কিন্তু এই একটু বৃষ্টিতেই যেন পার্কের সবুজগুলো আরও সুন্দর হয়ে উঠল।
বাবা আমার হাতে ফোন দিয়েছে। আমি ফোটো তুলছি, ভিডিও ডায়েরি করছি। কিন্তু একটা কথা মাঝে-মাঝেই মনে খচখচ করছে। এতবার কি কাকতালীয়ভাবে কারও সঙ্গে দেখা হতে পারে?
চার
আশ্চর্য হওয়ার পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে।
পাহাড়-জঙ্গলে ছেয়ে থাকা পথে আমাদের গাড়ি একশো দশ-পনেরো স্পিডে চলছে। অথচ এতটা স্পিড কিন্তু মালুম হচ্ছে না। গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছে, আমাদের বাঁ-পাশের জঙ্গলটার ঠিক সমান্তরালে বয়ে চলছে সুবর্ণরেখা নদী।
একটা ছোটো ব্রিজ পেরোলাম। ওখানে সুবর্ণরেখা আমাদের বাম পাশ থেকে ডান পাশে গেল। একঝলক দেখে তো মনে হল নদীতে এখন বেশ ভালোমতোই জল আছে।
বাবা বলল, আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেই রাঁচি শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে পনেরো কিলোমিটার দূরে পিস্ক নামে একটা জায়গায় মাটির নীচ থেকে একটা প্রস্রবণ বেরিয়ে আসে। সেখান থেকেই নাকি সুবর্ণরেখার জন্ম। তারপর ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা হয়ে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ঢোকে। কাঞ্চি, করকরি, শঙ্খ, ডুলুং—এরকম অনেক ছোটো নদী মিশে সুবর্ণরেখাকে জল দেয়।
মা বলছিল, সুবর্ণরেখার বালিতে নাকি আগে সোনার রেণু মিশত। বালি থেকে সোনার রেণু আলাদা করত মেয়েরা। তারপর বিক্রি করত ‘নেহারা ধুলাইওয়ালা’দের কাছে। এই সুবর্ণরেখাই তাদের খাবার জোগাত। সুবর্ণরেখার চরের বালির পুজো করত তারা। মা এমন করে গল্প বলে যে শুনতে শুনতে যেন দেখতে পাওয়া যায়।
এর আগেরবার যখন আম্মা-দাদানদাকে নিয়ে গালুডি এসেছিলাম, তখন ব্যারেজের উপর থেকে সুবর্ণরেখায় সূর্যাস্ত দেখেছিলাম। সূর্যের লাল রঙ মিশে যাচ্ছিল জলে। বাবা বলেছিল, সূর্যের সোনা রঙ জলে মিশে নাকি সোনার রেণু হয়ে যায়। গ্যাঁজা দেওয়ার সুযোগ পেলে বাবা টানা দিয়ে যায়। বুঝলেও সবসময় বলি না। কারণ, গাঁজাখুরি গল্পগুলো শুনতে বেশ ভালোই লাগে। ইললজিক্যাল লজিক টেনে বাবা ঠিক নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করে দেয়। তবে সেসব তো প্রায় বছর চারেক আগের ব্যাপার। আমি তখন ক্লাস ফাইভ।
গাড়ি চলেছে। দু-ধারে এখন কাশবন। এখানকার কাশফুলের রঙ আমাদের বাংলার কাশফুলের মতো নয়। একটু বাদামি ঘেঁষা। একটানা এতটা চলে এবার একটু ঝিমুনি আসছে। মার ফোনটা একবার চেয়ে দেখব কি?
বাবা নিতাইকাকুকে গাড়িটা রাস্তার ওই পারের একটা সরু গলতায় ঢুকিয়ে নিতে বলছে—“ওই পথে চান্ডিল ড্যাম পড়বে। চলুন, একবার দেখেই যাই।”
নিতাইকাকু সেইদিকে টার্ন নিচ্ছে। আমার দিকে ফিরে বাবা বলল, “বেলো, সুবর্ণরেখার গল্প শুনলি না মার কাছে! এবার চল তোকে সুবর্ণরেখার উপর ড্যাম দেখিয়ে আনি।”
“এরকম সব জায়গায় বার বার দাঁড়ালে কিন্তু রাঁচি পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে!”
“যাক না! বেড়াতেই তো বেরিয়েছি!”
“তোমরা নেমো। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।”
হাই রোড থেকে ডানদিকের সেই সরু রাস্তা ধরে প্রায় সাত কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে আমরা ড্যামে পৌঁছলাম। তখনও জল ছাড়েনি। ট্যুরিস্টও খুব বেশি নেই। কয়েকটা ছোটো ছোটো ট্যুরিস্ট দল নদীতে চান করছে। একদল তো আবার গামছা দিয়ে কাদাবালি ছেঁকে তুলে লাফাচ্ছে আর সোনা সোনা বলে চিৎকার করে জলকাদা ছিটিয়ে মজা করছে।
আমি আর বাবা এগিয়ে গেলাম। ড্যামের কাছটায় নদীর পাড়ের পাথরগুলোকে লোহার জাল দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা আছে। ছোটো ছোটো লাল পিঁপড়ের দল হু হু করে বেরোচ্ছে সেইসব পাথরের খাঁজ থেকে। বাবার জুতোয় অনেক পিঁপড়ে। বলতেই লাফালাফি শুরু করে দিল। পিঁপড়ে তাড়াচ্ছে, না তাণ্ডব করছে!
ঠিক তক্ষুনি—“কী খোকাবাবু, সুবর্ণরেখায় নেমে দেখবে না?”
সেই লোকটার কথা ভেবে চমকে তাকিয়েই দেখি নিতাইকাকু। উফ্, যা ভয় পেয়েছিলাম না!
“তুমি আবার আমাকে খোকাবাবু বলছ কেন?”
“খোকাবাবু বললাম কোথায়? আমি তো বাবু বলে ডাকলাম! জলে নামবে না?”
“নাহ্!” নিতাইকাকুকে উত্তরটা দিতে দিতে মনে হল এতটা ভুল শুনলাম? অবিকল সেই গলা!
হতে পারে ভুল শুনেছি। আসলে লোকটার কথা আমার একেবারে মনে গেড়ে বসেছে। কাল রাতেও ওকে নিয়ে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে সেই লোকটা ছিল এক বায়োস্কোপওয়ালা। ভাবো, সিনেমায় ছাড়া কোনোদিন বায়োস্কোপ চোখেই দেখিনি! লোকটার পরনে তখন ধুতি আর চেক চেক ফতুয়া। মাথায় পাগড়ির মতো করে গামছা বাঁধা। আর একটা গামছায় একটা বাক্স বেঁধে কাঁধে নিয়ে সে চলে। চলতে চলতে কখন সেটা আমাদের স্কুলের পিছনের মাঠ। সেখানে কোত্থেকে একটা গোল পাথরের উপর সেই বাক্স রেখে সে আমায় ডাকছে—
‘খোকাবাবু বাইস্কোপ দেখো
দেখো খোকা বাইস্কোপ দেখো
দিল্লি দেখো আগ্রা দেখো
চপ কাটলেট রসগুল্লা দেখো
ফুটবল কিরিকেট খেলা দেখো
জশন দেখো মেলা দেখো
পুজা দেখো জুম্মা দেখো
রাঁচি দেখো ঝরনা দেখো
চাইছ যদি বাক্সের অন্দর
পেয়ারে, আম্মা ঠাম্মা দেখো!’
আম্মা-ঠাম্মার নাম শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেছিল।
নিতাইকাকুকে না বলে বাবাকে খুঁজতে গিয়ে দেখি খানিক দূরে একটা ঝোপের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে যেন কী করছে। কাছে যেতেই বলল, “বেলো দেখ, এ হল এক জ্ঞানী ছাগল।”
তাকিয়ে দেখি জ্ঞানীই বটে। থুতনিতে ইয়া লম্বা দাড়িওয়ালা এক ছাগল একমনে ঝোপের পাতা চিবুচ্ছে। আর বাবা হাঁটু মুড়ে বসে তার রঙ্গ দেখছে। বললাম, “চলো।”
“চলো মানে! তুই ওকে জ্ঞানী বলে বিশ্বাস করছিস না? দেখ ও কেমন কমিউনিকেট করবে আমাদের সঙ্গে—” বলেই বাবা স্থান-কাল ভুলে ‘ম্যা-অ্যা-অ্যা… মু-অ্যা-অ্যা…’ এসব বিটকেল আওয়াজ করতে শুরু করল। সে-ব্যাটা খানিক তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি দিয়ে কালো বোঁদের মতো বিষ্ঠা ত্যাগ করে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।
হাসতে হাসতে বললাম, “ঠিক বলেছ বাবা, জ্ঞানী ছাগলই বটে।”
বাবা তুম্বো হয়ে এসে উঠল গাড়িতে। নিতাইকাকুকে কেন যেন জিজ্ঞেস করলাম, “নেমেছিলে জলে?”
উত্তরে নিতাইকাকু বলল, “আমি তো গাড়ি থেকে নামিইনি!”
কী বলে রে! স্পষ্ট দেখলাম! কথা হল!
মা বলল, “তোরা দুজনে কি জলে নেমেছিলি?”
উত্তর না দিয়ে মার কানে কানে জিজ্ঞেস করলাম, “মা, নিতাইকাকু সত্যি নামেনি?”
মা বলল, “না! উনি তো গাড়িতেই ছিলেন।”
তাহলে! ব্যপারটা যে ক্রমশ ঘোরালো হয়ে উঠছে, সে-কথা বুঝতে পেরে চুপ করে গেলাম। তবে ওই যে শুরুতে বলেছিলাম না, আশ্চর্যের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে—সে কিন্তু কেবল এইসব ব্যাপারের জন্য নয়। আসল আশ্চর্য হওয়ার ঘটনা তো ঘটেছিল এখান থেকে তা প্রায় সোয়া একঘণ্টার দূরের দশম ফলসে। সেই কথাই এবার বলব।
পাঁচ
একেই বলে জলপ্রপাত! দশটা ধারা হইহই করে নেমে আসছে পাহাড়ের উপর থেকে। ক্লান্তি নেই। কোত্থেকে যেন অসীম শক্তি জুটিয়ে একেবারে লাফিয়ে পড়ছে নীচের পাথরে। চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে প্রবল আঘাতে। গুঁড়ো গুঁড়ো জল বৃষ্টির মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের রোদে তাতা মুখে সাপটে দিয়ে যাচ্ছে আরাম। ঠিক যেমন আম্মা মাঝে মাঝে এসে জল-হাতটা সাপটে দিয়ে যায় চোখে-মুখে।
আমি আর মা বসে আছি উপর থেকে নেমে আসার যে সিঁড়ি, তার ল্যান্ডিংয়ের ধারের একটা পাঁচিলে। চোখের সামনে দশম ফলস অবিরাম ঝরে পড়ছে। এর আগেও আমি প্রপাত দেখেছি। দক্ষিণ ভারতে। আবি ফলস। সে আরও বড়ো। আরও গম্ভীর তার আওয়াজ। তবে এতগুলো ধারা তার নয়। এই ধারাগুলোই দশমের সৌন্দর্য। ধারাগুলো নীচে পড়ে তারপর ছোটো শিশুর মতো পাথরের উপর লাফাতে লাফাতে নদী হয়ে বয়ে চলেছে আমাদের বাঁ-পাশ দিয়ে। সেই ধারায় স্নান সেরে নিচ্ছে কেউ কেউ।
“মা, নীচে যাবে না?”
“হাঁপিয়ে গেছি রে এতটা নীচে নামতে। একটু দাঁড়া। জলের বোতলটাও সঙ্গে আনা হয়নি। তোর বাবাটাকে দেখ, হাঁ করে দেখেই যাচ্ছে। একবারও খোঁজ নিল!”
মার শরীর ভালো নেই। শরীর বিগড়ালেই মার মেজাজ বিগড়ায়। একটু বসেই নিক বরং।
আমাদের সামনে পিছনে অনেকগুলো গাছ। এইসব গাছের নাম জানি না, আগে দেখিওনি। দাদানদা অনেক গাছ চেনে। আম্মাও চেনে, তবে ঠিক বলছে কি না দাদানদার কাছ থেকে ভেরিফাই করে নেয়। সামনের সরু সরু পাতাওয়ালা গাছটার একটা ডালে কচি একটা বাঁদর অনেকক্ষণ ধরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর দৃষ্টিটা এমন যে চোখ পড়লে ফেরানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে তাকালেও কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে আর ফিরে তাকাতেই হচ্ছে। আচ্ছা জ্বালা তো!
ওর দিকে তাকিয়ে এবার ভুরু দুটো একটু নাচালাম। অমনি সে-ব্যাটাও নাক-মুখ কোঁচকাল। এবার ঠোঁট দুটো ছড়িয়ে একটু জিভ বার করে ভেঙচালাম। সে খানিক ধড়মড়িয়ে এগিয়ে এল।
“ওই বাবু! এদিকে সরে আয়!” মা শশব্যস্ত হয়ে বলল।
“দাঁড়াও না!”
“আর কী? তাহলে থাপ্পড় খা। থাপ্পড় খেয়ে দাঁতখেউড়ি চুনাচাটা হয়ে ঘুরে বেড়া।”
এই দাঁতখেউড়ি চুনাচাটা কথাটা আমি বুঝি না। মাকে জিজ্ঞেস করলেই বলে, ‘এর মানে হল তুই। আয়নায় গিয়ে দাঁতগুলো দেখ, বুঝতে পেরে যাবি।’
ওদিকে সেই কচি বাঁদর তখন আর একটু কাছে এসেছে। আমাদের মধ্যে আর পাঁচ-সাত হাতের ফারাক। কিন্তু ও কী! সে-ব্যাটা যে আমায় দেখে হাসছে! কোনও মানে হয়! বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে মাঝে-মাঝেই নাকের নীচে বোলাচ্ছে আর হাসছে। আমি জানি আমার একটা সরু গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে; মা প্রায়ই সে নিয়ে আমায় খ্যাপায়, কিন্তু তা বলে একটা হাফ কচি বাঁদর! একটা পাথর হাতের কাছে পেলে না বাঁদরামি ঘুচিয়ে দিতাম।
বাঁদরটা ওপরের দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে মাথাটা এমনভাবে ঝাঁকাল, যার পরিষ্কার অর্থ—‘একবার মেরেই দ্যাখ না!’
মরিয়া হয়ে নীচু হয়ে একটা ঢিল খুঁজছি, অমনি সে-ব্যাটা হুড়মুড়িয়ে এসে এক্কেবারে আমার সামনে রেলিংয়ে বসল। আমি তো হতভম্ব। মা চিৎকার করছে। সে বাঁদর-ব্যাটা মার দিকে তাকিয়ে একটু যেন হাসল, তারপর পিছন ঘুরে আমার কাঁধের নীচে ন্যাজ দিয়ে হালকা একটা ঝাপটা দিয়ে তিন লাফে নীচের দিকে অদৃশ্য হওয়ার আগে হাতের আঙুল দিয়ে চৌকোমতো কী যেন কী একটা ইশারা করে ফের লম্ফমান হল।
দেখি কী, যেখানে তিনি ন্যাজ ঝুলিয়ে বসে ছিলেন, সেখানে চৌকোমতো ভাঁজ করা একটা রাংতা চকচক করছে। খুলে দেখি লাল কালিতে হিন্দিতে লেখা—
‘অসলি মজা দেখনা চাহো
তো বাবুয়া আ যানা সীতা ফলস মে।
আনা জরুর।’
বাঁদরের নেমন্তন্ন? না হুমকি? খানিক ভাবতেই মনে হল, হতেই পারে। সীতা ফলস বলে কথা। হয়তো সীতা-মা আশেপাশেই কোনো না কোনো রূপে বিরাজ করছেন। সাতপাঁচ ভেবে রাংতাটা ভাঁজ করে জিন্সের পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে মনে মনে বললাম, ‘বেশ! চ্যালেঞ্জ অ্যাক্সেপ্টেড। তুমি জানো না হে বানর, কাকে খোঁচাতে এসছ! ছোটোবেলা থেকে আমায় প্রায়ই তোমার নামেই ডাকা হয়। কাজেই তোমার চলন-বলন ভাবনা-চিন্তা কোন পথে এগোতে পারে সে আমি ঠিক বুঝব। তাছাড়া ডানজেন কি আর এমনি এমনি এতদিন ধরে পড়ি আর দেখি? তোমার প্ল্যান যাই থাক, সেটা আমি ঠিক ভেস্তে দেব। নাহ্, আজই একটা ফরেস্ট টেরিটরির প্ল্যানিং ভিডিও দেখতে হবে।’
“আরে ওই হাঁদা! এদিকে আয়। শিক্ষা হল না?” মা খুব খেপেছে। একটু ঝরনার জল মাথায় দিতে হবে।
“অনেকক্ষণ তো বসলে এখানে! এবার নীচে চলো।”
মাকে নিয়ে আরও দুটো বাঁক সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাবাকে দেখতে পেলাম। তর্জনী দিয়ে ব্রহ্মতালু চুলকোচ্ছে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে। গুঁড়ো জল উড়ে এসে লাগছে। সেই আরাম নিচ্ছে একমনে।
সবাই মিলে একদম নীচে নামলাম। এবড়োখেবড়ো পাথর পার হয়ে আর একটু এগোলে বড়ো বড়ো পাথরে উপর থেকে জল পড়ছে। পাথর বেয়ে উপরে উঠছে কয়েকজন।
মা ছায়া দেখে একটা পাথরের উপর বসল। আর এগোবে না। আমি আর বাবা এগোলাম ওই জলপ্রপাতের দিকে। চোখে-মুখে ঠান্ডা জলের গুঁড়ো বৃষ্টির মতো এসে লাগছে। এই ঠা ঠা রোদে যে সে কী আরামের!
আমি আর বাবা পাথর বেয়ে বেয়ে উঠছি। বাবা বেশ তরতর করে উঠছে। আমিই একটু ধীর হয়ে যাচ্ছি। সত্যি বলতে অভ্যেস তো নেই! বাবার মতো কোনোদিন গাছে চড়িনি, সাঁতার কাটিনি, পুকুরে ঝাঁপাইনি, মাঠে দৌড়ে দৌড়ে খেলিনি। আমার অত অভ্যাস কী করে হবে? তবে ছাড়ার পাত্র তো আর আমি নই। কাজেই টুকটাক পিছলে-টিছলে আমিও অনুসরণ করে চলেছি বাবাকে।
এখানে বেশ খানিকটা সমতল। সামনে কিছুটা এগোলে আবার চড়াই। ওই চড়াই বেয়ে উঠলেই জলের পতনস্থল। বাঁদিকে একটা সরু পথ গিয়ে ঠেকেছে একেবারে প্রপাতের কাছে। বাবা সেই পথে অনেকটা গেছিল। আবার ফিরে আমার কাছে এল।
“কী রে, এতেই হাঁপিয়ে গেছিস? তা’লে থাক আর উপরে যেতে হবে না।”
“উপরে কী আছে?”
“এই তো যা দেখছিস এখান থেকে, তাই। আর শুধু ডানদিকে একটা গুহা আছে।”
“ঢুকলে গুহায়?”
“নাহ্।”
“তা’লে চলো যাই।”
ধপ করে একটা পাথরে বসে বাবা বলল, “না রে, হাঁপিয়ে গেছি, আর যাব না।”
“তাহলে আমি দেখে আসি?”
“সে যাবি যা, তবে ওই গুহা থেকে আর প্রপাতের দিকে যাস না, কেমন? রাস্তাটায় দেখলাম শ্যাওলা জমে আছে।”
“ঠিক আছে।”
এগোলাম। প্রপাত নয়, আমি তো দেখতে চাইছি গুহাটা। বলা তো যায় না, গুহালিপিও দেখা যেতে পারে। বাইসন না-ই থাক, হাতির ছবিও তো থাকতে পারে। এই পুরো অঞ্চলেই নাকি হাতির আবাসস্থল ছিল, খানিক আগে তেমনই তো শুনলাম। একদল বিদেশি ট্যুরিস্টকে তখন নীল ক্যাপ-পরা একজন গাইড দশমের ইতিহাস ভূগোল বলছিল।
রাস্তা খুব সরু। অল্প পিছলও বটে। তার চেয়ে বড়ো কথা, ফাঁকা। সবাই জল যেখান থেকে নীচে পড়ছে সেই দিকটায় যাচ্ছে। এই গুহার দিকটায় কেউ তেমন আসছে না। বাবাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। আম্মা থাকলে যে সঙ্গে আসতই সে আমি নিশ্চিত। দেরাদুনে যেবার গেলাম, ওই সরু দ্রোণাকেভ, টপকেশ্বর মন্দিরের গুহা—সবখানে আমার সঙ্গে আম্মা ছিল।
বাঁক ঘুরে গুহার মুখ পেলাম। জলপ্রপাতের প্রায় পিছন দিক এটা, তাই নীচ থেকে দেখা যায় না। সামনে প্রায় এক মানুষ দূরে পড়ন্ত জলের ধারা দেখা যাচ্ছে। আর আওয়াজ কাকে বলে! মজা লাগছে বেশ।
গুহাচিত্র যে একেবারে নেই, তা নয়। তবে তা প্রাচীন বলা যায় না। যে যেমন পেরেছে হাবিজাবি এঁকেছে আর লিখেছে গুহার দেওয়ালে।
অবাক কাণ্ড! প্রথমে মালুম হয়নি। এখন দেখছি গুহাটায় যেদিক দিয়ে ঢুকলাম তার প্রায় উলটো দিকের দেয়ালে ডানদিক ঘেঁষে একটা বেশ চওড়া ফাটল। অনায়াসে একটা লোক কাত হয়ে গলে যেতে পারে। ভিতর থেকে কোনও আলো আসছে না। তাহলে কি ওটা কোনও সুড়ঙ্গ? নাকি কোনও গলিপথ যেটা আর একটা কোনও গুহায় মিশছে?
ফাটলের অন্ধকারে চোখ পাতলাম। পায়ের কাছে নড়বড়ে পাথর। পিছিয়ে এলাম দু-পা। মোবাইল থাকলে টর্চটা জ্বেলে দেখা যেত। কিন্তু কী যে ইচ্ছে করছে ফাটল গলে ও-পারে গিয়ে একবার দেখি!
আস্তে আস্তে পা বাড়াতেই হুড়মুড় করে পাথর গড়িয়ে যেন অনেক নীচে পড়ল। হঠাৎ এমন হওয়ায় আমার ব্যালেন্সটাও নড়ে গেল। সামলাতে সামনের দেওয়াল ধরতে গিয়েও পারলাম না। আমার পায়ের নীচের পাথর এখন নীচে পড়ছে। আমি ঢুকে যাচ্ছি কোন এক গহ্বরে। ভয়ে চোখ বুজে গেছে। মা!
হ্যাঁচকা একটা টান লাগল হাতে। কেউ টেনে ঢুকিয়ে আনছে আমায় শক্ত পাথরের খাঁজে। আমার কোমর পর্যন্ত প্রায় ঢুকে গেছিল বোধ হয়। ছেঁচড়ে যাচ্ছি।
মুহূর্তেই তার টানে শক্ত মেঝেয় এসে পড়লাম। বুকের ভিতর ধপ ধপ করে শব্দ হচ্ছে। এখনও নীচে পাথর গড়িয়ে জলে পড়ার আওয়াজ আসছে অনেক নীচ থেকে। কী হতে যাচ্ছিল আমার ভাবতেই গা শিউরে উঠল।
মাথাটা তুলে আরও অবাক হয়ে গেলাম। আমার রক্ষাকর্তা আর কেউ নয়, সেই লোকটা! অথচ দশমে আসা ইস্তক লোকটাকে কোথাও দেখিনি।
হাত দুয়েক দূরে ধপ করে বসে কাঁধের গামছায় মুখ মুছতে মুছতে সে বলল, “বাবাকে আবার এসব বলতে যেও না। শুধু শুধু ঘাবড়ে যাবেন, আর তোমাকে একা ছেড়েছেন বলে নিজেকে দোষ দেবেন।”
আশ্চর্য! আমিও মনে মনে ঠিক এই কথাটাই ভাবছিলাম।
ছয়
বাংলার বাইরে যে এত জমজমাট দুর্গাপুজো হয়, এর আগে সেটা আমি বুঝিনি। যেমন জমজমাট তেমনি ভিড়। একটু যেতে গেলেই ধাক্কাধাক্কি। ঠিক যেন একেবারে কলকাতার ভিড়। সঙ্গে আবার ফুটপাথ জুড়ে বসা হরেক পসরা। হরেক বললাম বটে, আসলে বেশিরভাগই জামা আর জুতোর পসরা। কলকাতার মতো খাবারের দোকান এখানে কম। লোকজন প্রায় হামলে পড়েছে প্রতিটা দোকানে। হাঁটা দায়। তবে এই ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে-হাঁটতেও যে ঘটনা ঘটল তার আকস্মিকতায় আমি হাঁ হয়ে গেছি। বিস্তারে সেসব কথা যথাসময়ে বলব।
আপাতত বলি, দুপুর দুটো একচল্লিশে আমরা হোটেলে চেক-ইন করেছি। এত সঠিকভাবে যে সময়টা বলতে পারছি তার কারণ হোটেলের ঝকঝকে রিসেপশনে থাকা দেয়ালঘড়িগুলো। পাঁচটা দেশের টাইম জোনের সময় দেখাচ্ছে সেগুলো। আমাদের আই.এস.টি. অনুসারে যে ঘড়িটা, সেটায় তখন ওই দুটো একচল্লিশ দেখাচ্ছিল।
হোটেলটা আমার খুব পছন্দ হল। যেমন বড়োসড়ো, তেমন পরিচ্ছন্ন। নিট অ্যান্ড ক্লিন শব্দবন্ধ যেন একেবারে যথার্থ। একতলাতেই রেস্তোরাঁ। সেটাও ঢুঁ মেরে দেখে নিয়েছি। আয়েশ করে ছ’জন করে বসার মতো দশটা টেবিল। দেয়ালঘেঁষা গোটা চারেক সোফা। হালকা একটা আলো আর হালকা সুগন্ধে লম্বা ডাইনিংটা একেবারে ভরে আছে। বাবাকে বলব, ঘরে নয়, চান করে এখানেই খেতে আসব আমরা।
আমাদের বরাদ্দ ঘর চারতলায়। লিফট থেকে ডানদিকে জিম পেরিয়ে তিন নম্বর দরজা। ঘরগুলোও খুব আরামদায়ক। ঘরের উত্তরদিকের কোণের টেবিলে দেখলাম দুটো সিলড কাচের বোতল-ভরতি জল। তাছাড়া একটা ইলেক্ট্রিক কেটলি, দুটো কাপ, টি ব্যাগ, দুধ, চিনি—এইসব চায়ের সরঞ্জাম। টেবিলের উপরে একটা লম্বা গেলাসের মতো ল্যাম্পশেড ঝুলছে। টেবিল থেকে কাছেই চওড়া ধপধপে বিছানা। খুব ইচ্ছে করছে ছোটোবেলার মতো একবার ক্লাউড বেডের উপরে দাঁড়িয়ে লাফাই। কিন্তু করতে পারছি না।
নাহ্, ভাবছি আর এসব বর্ণনা দিয়ে সবাইকে বিরক্ত করব না। এসবের সঙ্গে তো মূল ব্যাপারের তেমন সম্পর্ক কিছু নেই, কাজেই এত বিস্তারে না বললেও চলবে।
মার শরীরটা বেশ খারাপ করেছে। জার্নির ধকল। খানিক বসেই বাথরুমে ঢুকে পড়ল।
আমি টিভি চালাতে গিয়ে দেখলাম চলছে না। বাবাকে বলতে বাবা আবার আমাকেই ফোন করে হোটেলে জানাতে বলল। যথারীতি আমি ফোন করছি না আর বাবা আমায় লোকজনের সঙ্গে কথা বলার, সমাজবদ্ধ হয়ে ওঠার, নিজের কাজ নিজে করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বলে চলেছে। সেসবও আর বলছি না। আমার মতো যাদের বাবা-মা আছে, তারা সবাই জানে বাবা-মারা কী কী বলতে পারেন এরকম পরিস্থিতিতে। যাই হোক, লোক ডাকতে হল না, আমার চেষ্টাতেই টিভি চালু হল। তাতেও ফের যে-কোনো বিষয় খতিয়ে দেখে তারপর মন্তব্য করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বাবা শুরু হয়ে গেল।
সেসব থাক। বরং হোটেলের অমন রেস্তোরাঁয় কী আমরা খেলাম সেটা একবার বলি। ইন্ডিয়ান, কন্টিনেন্টাল, চাইনিজ—সবকিছুই আছে। আমরা সবটাই খুঁটিয়ে পড়লামও, কিন্তু অর্ডার দেওয়ার সময় দুপুরের খাওয়া বলে সরু ভাত, সোনালি রঙের ডাল, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আলু-গোবি, চিকেন কষা আর চাটনি দিয়েই সেরে নিলাম। ডেজার্টে কমপ্লিমেন্টারি গরম গুলাব জামুন। মনটা খুশি হয়ে গেল।
তারপর তিনজন মিলে ভাতঘুম সেরে এই তো সবে বেরিয়েছি। ঘুমিয়ে নিয়ে মাও এখন ফিট। বেরিয়ে এসে রাস্তায় পড়েই যে আলোর খেলা আর ভিড় পাচ্ছি, তাতে একবারও আর মনে হচ্ছে না যে আমরা কলকাতায় নেই।
ভিড় ঠেলে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে দেখি রাস্তার ওই পারে একটা প্যান্ডেল দেখা যাচ্ছে। গাদাগাদি ভিড়।
“সকালে দেখে নেওয়া যাবে।” বলে বাবা সামনের দিকে এগোল।
আরও খানিকটা এগোনোর পরে যেন ভিড়টা একটু পাতলা হল। এখানেও ফুটপাথে দোকানের অভাব নেই। এদিকটায় সব কাচের চুড়ি আর ওড়নার দোকান। বিচিত্র সুরে তারা খদ্দের ডাকছে।
হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে নতুন রাস্তায়। একটা বড়ো ক্রসিংয়ের সামনে এসে উঠেছি। এখানে এরা বলে চক। চারদিকে চারটে রাস্তা চলে গেছে। আমাদের প্রায় উলটোদিকের রাস্তার পারে হঠাৎ বাংলা লেখা চোখে পড়ল—‘দুর্গাবাড়ি’। বাবা তো সেখানে যাবেই। গেলাম। কিন্তু চওড়া হলঘর, নাটমন্দির পার হয়ে দেখলাম মণ্ডপ খালি। পিলসুজে প্রদীপ জ্বলছে। এদিক ওদিক কিছু মানুষ বসে আছেন। ডানদিকে অফিস। সেখান থেকে একজন বললেন, “বিসর্জনের জন্য ঠাকুর নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”
“এখানে বোধ হয় খুব নিয়মনিষ্ঠায় পুজো হয়।” মা বলল।—“আমাদের পাড়াতেও দেখতাম দশমীর দিনই বিসর্জন হত, কলকাতাতেই দেখি অন্যরকম।”
পুজোর সে-কাল এ-কাল, নিয়মনিষ্ঠা নিয়ে দুজনের আলাপ-আলোচনা চলতে-চলতেই আমরা বেরিয়ে এলাম দুর্গাবাড়ি থেকে। এখানেই লোকটাকে ফের দেখতে পেলাম। ছোলামাখার দোকান এখন তার। শালপাতা ভরে গ্যাঁড়ানো ছোলা আর মুগ-মশলা মাখিয়ে বিক্রি করছে। মাখার ধরনটা এমন যে দেখতে-দেখতেই জিভে জল আসছে। সে আমায় এবার দেখেনি, কিন্তু আমি তাকে ঠিক দেখে নিলাম।
আর বিস্তারে না গিয়ে বলি, এরপর হোটেলে ফিরে আমরা সবাই মিলে ফোনে বিজয়া করতে বসে গেলাম। ঠাম্মা, দাদা, দাদানদা, আম্মা সেরে আরও যত দাদু-দিদা-মামা-জ্যাঠা আছে, সবাইকে একে একে ফোন করে প্রণাম জানাতে হল। একটানা এতগুলো ফোন করতে মাঝখানে অবশ্য একটু বেগড়বাঁই করছিলাম। বাবা বলল, “শোন বেলো, এই রীতি আমাদের ঐতিহ্যের। আমরা আগে চিঠি লিখতাম বিজয়া জানিয়ে, তারপর যখন আশীর্বাদী চিঠি আসত বড়োদের কাছ থেকে সে যে কী আনন্দ হত! এই পৃথিবীতে যে আমাদেরও খোঁজ নেওয়ার, চিঠি লেখার অনেকে আছেন, সেই ভেবে খুব আনন্দ হত। এখন তো আর চিঠি নেই, স্ট্যাটাস দেওয়ার দিনকাল। আমি আমার মতো লিখে দিলাম, যার দরকার এসে দেখে যাও। এরকম চললে আত্মীয়তার সব বন্ধনগুলোই একদিন ফিকে হয়ে যাবে। তুই তো সবার ছোটো, সবার আদরের। তোর উচিত অন্তত সবার সঙ্গে কথা বলা, প্রণাম জানানো।”
তা সত্যি বলতে গেলে ভালোই লাগছিল অবশ্য। সবাই কেমন আশীর্বাদ করছিলেন, যেতে বলছিলেন। আম্মা তো আবার আশীর্বাদ করার পর জিজ্ঞেসও করল, “বাবু, কী লাগবে বল?”
এখন কিছু লাগবে না—বললাম বটে, তবে মনে মনে কে যেন বলল, শীতের ছুটিতে দেখা হলে ডানজেন অ্যান্ড ড্রাগন চেয়ে দেখব—বলা তো যায় না, পেয়ে যেতেও পারি! গতবার তো ‘ভারত সিক্স হান্ড্রেড বি.সি.’ পেয়ে গেছিলাম!
তো সেই বিজয়া পর্ব তো যেমন চলার চলল, এখন তোমাদের সেই কথাটা বলি যেটা বাবা-মাকেও বলিনি। রাস্তার ভিড়ে অনেকবারই ধাক্কাধাক্কি হয়েছে বটে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা। বাড়ি ফিরে পোশাক বদলাতে গিয়ে প্যান্টের ডান পকেটে আমি আবার একটা রুপোলি রাংতা পেয়েছি। সেইরকমই চার ভাঁজ করা। ভাঁজ খুলতে লাল কালিতে লেখা চোখে পড়ল—
‘আয়ে হো তো সোনা বাবুয়া হামার দেশ মে
আগে আগে দেখো বাবুয়া ক্যায়া ক্যায়া হোতা শেষ মে
ডানজান নাচে, ডিরাগন নাচে, আঁখো মে টিলিস্কোপ
আ তো যাও বাবুয়া সীতা ফলস মে দিখাউঁ আসলি বাইস্কোপ!’
—ছোট্টুলাল বাইস্কোপওয়ালা
ভিড়ের মধ্যে নির্ঘাত কেউ পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কেউ আবার কী! ওই লোকটাই করেছে নিশ্চয়ই। যতই আমায় দেখেনি দেখেনি ভাব করুক, ভিড়ভাট্টায় কাজ সেরে ফের ভালোমানুষের মতো না দেখার ভান করে ছোলা বিক্রি করেছে। আচ্ছা, দেখা যাক জল কতটা গড়ায়। একটা বিষয় তো জানা গেল, লোকটার নাম ছোট্টুলাল বাইস্কোপওয়ালা। বেশ। বাবার ডাক অনুসারে আমিও বেলোভূষণ খারবান্দা, এটা তো ও জানে না। যতই ভালো ছেলের মতো মুখ-চোখ হোক আমার, কতটা যে ডানপিটে আমি সে তো আর ওই ছোট্টুলাল জানে না! মা তো আর এমনি এমনি আমাকে মিচকে শয়তান বলে না! মা-বাবার দেওয়া এসব ডাকনাম সার্থক করার মতো অনেক কাজই এ পর্যন্ত আমি করে এসেছি, এবার না হয় আর একটু ভেবেচিন্তে করব।
ব্যাপারটা এতটা উত্তেজনা জাগাল যে মনের ভুলে হাতের তালু ঘষতে ঘষতে গুনগুন করে গেয়ে উঠলাম। আর কান দ্যাখ বাবার! নিজে তো শুনেছে শুনেছে, গুনগুন করে গেয়ে যেন ছেলে একেবারে অ্যামেরিকান আইডল জিতে ফেলেছে এমন ভাব করে মাকে ডাকতে লেগেছে। মার সাড়া না পেয়ে নিজেই বলতে শুরু করে দিল, “ছোটবেলায় ভালো গাইতিস বেলো। কতবার বললাম শিখতে। শিখলি না! অবশ্য এখনও শেখার সময় যায়নি। শেখ বেলো, প্রতিভা থাকলেই হয় না রে। প্রতিভা আসলে চারাগাছ—তাতে জল দিতে হয়, সার দিতে হয়, নিয়ম করে গোড়ার মাটি উসকে দিতে হয়। যত্ন না নিলে কোন দিন দেখবি প্রতিভা গাছের পাতা হলদে হয়ে ঝরে গেছে।”
বাবার এমন ভাব এলে আমি একদম চুপ করে থাকি। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এই চুপ করে থাকাটাই হলো তাড়াতাড়ি মুক্ত হওয়ার একমাত্র পথ।
“কত ভালো কবিতা লিখতিস। গল্প লিখতিস। দুটো নভেল লিখতে শুরু করেছিলি। এই মোবাইলের চক্করে পড়ে সব গেছে। ওই যন্ত্রটাকে প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করা ছেড়ে দে রে বেলো। ওটা অভিশপ্ত যন্ত্র। সব খেয়ে নেবে।”
উত্তর না দিয়ে পারলাম না।—“বাবা, সবকিছুকে একদিকে টেনে নাও কেন বলো তো! আর শোনো, কবিতা কোনোদিন আমি লিখিনি।”
বাবা ভ্রূ কুঁচকে একবার আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল, “সাড়ে তিন, নইলে খুব জোর চার বছর তখন তোর। আমাদের ফ্ল্যাটের উলটোদিকের মেসবাড়িটার ছাতে এক বিকেলে অজস্র কাক ভিড় জমিয়েছে। তুমুল চিৎকার তাদের। জানালা দিয়ে তাই দেখে তুই প্রথম কবিতা বানিয়েছিলি। দাঁড়া শোনাচ্ছি।” এই বলে বাবা ভুরু কুঁচকে চোখ বুজে দুই ভুরুর মাঝে গোটা দুয়েক টোকা দিল। তারপর মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলতে শুরু করল—
“কাক কাক
কাকই কাক
কাকই কাক
কত কাক
গুনতে পারবে না আর।”
হাসি পেয়ে গেল। হাসি চেপে বললাম, “বাবা, এটা কবিতা!”
বাবা একটু খিঁচড়ে গিয়ে বলল, “তাছাড়া কী! সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা এর থেকে আর কী বেশি বলবি? নিজেকে বেশি বড়ো ভাবিস না, বুঝলি?”
“যা ব্বাবা!”
খাটের পাশের পাপোশে পা ঘষে বিছানায় উঠতে উঠতে বাবা বলল, “বাবা তোর সামনেই, তাড়াতাড়ি শুতে আয় বেলো। আজ তোকে আম্মা-ঠাম্মার গল্প বলব।”
সাত
একেই বলে গ্র্যান্ড ব্রেকফাস্ট। লম্বা আলাকার্তে। আলুর পরোটা থেকে উপমা, ডোসা, বড়া, পুরি, ছোলে থেকে ম্যাগি পর্যন্ত সব। চাইলেই সাজিয়ে এনে দেবে। আমি খেলাম ব্রেড বাটার, দুটো ওমলেট, এক গ্লাস প্যাপায়া জুস আর ফ্রুটস। খেতে-খেতেই দুটো টিস্যু পেপারে আমার অস্ত্র আমি গুছিয়ে নিয়েছি। বলাই বাহুল্য, দুজনের চোখ এড়িয়ে। দু-দু’বার হুমকি পেয়েছি। কাজেই একটা অস্ত্র তো সঙ্গে রাখতেই হত। ভেবেচন্তে শেষে এই হাউসহোল্ড ব্রহ্মাস্ত্রই বেছে নিলাম। ঠিকঠাক প্রয়োগ করতে পারলে সে যত বড়োই বাঘা ভিলেন হোক না কেন, একেবারে নাকের জলে চোখের জলে হবেই।
ব্রেকফাস্ট শেষ করেই বেরোনোর কথা আমাদের। বেরোনোর আগে মা একবার ঘরে গেল। বাবাও কী কাজে রিসেপশনে ঢুঁ দিতে গেল। আমি এসে উঠলাম লনে। মাঝারি মাপের লনের একটা দিকে কেয়ারি করা বাগান। বাগানের প্রান্তে বোগেনভেলিয়ায় কোথাও কোথাও গোলাপি ছটা। শ্যাওলা রঙের ইউনিফর্ম পরা একজন ঝাঁঝি থেকে জল দিচ্ছে গাছে। লোকটার চারদিকে অনেকগুলো পাখি উড়ে উড়ে মাঝে মাঝে মাটি থেকে কী যেন খুঁটে খাচ্ছে। কী খাচ্ছে দেখার জন্য এক পা বাড়াতেই লোকটা একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠল। ইশারা দেখে নীচে তাকিয়ে দেখি আর একটু হলেই চারাগাছগুলো মাড়িয়ে দিচ্ছিলাম আর কী!
“সরি! দেখতে পাইনি।”
হাত উঁচু করে হাসল লোকটা। বলল, “ঠিক হ্যায়। উধারসে আ যাইয়ে ছোটেবাবু।”
বাবা! আমিও আবার বাবু! একটু বেশ গর্ব গর্ব হল। হাত-পাগুলো যেন একটু আঁটোসাঁটো হয়ে এল। একেই বোধ হয় গাম্ভীর্য বলে। লোকটির দেখানো পথে আস্তে আস্তে হেঁটে কাছে গিয়ে দস্তুরমতো সাহেবি কেতায় জিজ্ঞেস করলাম, “ডু ইউ নো দিজ বার্ডস?”
“বার্ডস? হাঁ ছোটাবাবু, বহোত আচ্ছা দোস্ত হমারা। হর সুবহ নিন্দসে উঠাতা হ্যায় ইয়ে চিড়িয়ালোগ। ম্যায় ভি দানা ডালতা হুঁ, লিট্টি ভি খিলাতা হুঁ। দিনভর মেরে আসপাস হি রহতা হ্যায়।”
মামাবাড়িতেও অনেক পাখি আসে। কাঠবিড়ালি আসে। কলপাড়ে ওদের খেতে দেয় আম্মা। আম্মা আবার ওদের এক-একজনের এক-একরকম নাম দিয়েছে। সাদা-কালো একটা পাখিকে আম্মা বলে উকিলবাবু। দাদানদা বলে, ওটা নাকি ডাহুক। আবার আর একটা পাখিকে আম্মা বলে ইন্সপেক্টর। বাদামি রঙের বেশ বড়ো পাখি সেটা। দাদানদা বলে, ওটা নাকি আসলে কুবপাখি।
এই লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এদের নাম কী?”
আমার কথায় সে হাসতে থাকল। না জানি কী এক মজার কথা বলেছি একেবারে। চুপ করে গেছি দেখে হাসি থামিয়ে বলল, “চিড়িয়া তো চিড়িয়া হোতে হ্যায় ছোটেবাবু, উসকা নাম তো কুছ দিয়া নহি।”
“ম্যায় পুছনা চাহতা থা কি, কৌন কৌন জাত কে হ্যায় ইয়ে সব চিড়িয়া?”
“ওহ মুঝে মালুম নহি ছোটেবাবু। জান কর ভি ম্যায় ক্যায়া করুঁ? হাঁ, ইনকি স্বভাব সে ম্যায় অচ্ছি তরহা সে ওয়াকিফ হুঁ।” এটুকু বলেই সে হাতের ঝাঁঝরিটা মাটিতে নামিয়ে রেখে আমাকে পাখপাখালির স্বভাব চেনাতে শুরু করল। আর তার সেই স্বভাব চেনানোর ধরনটাও যাকে বলে একেবারে পারফেক্টলি ম্যাজিকাল। এক একটা পাখির দিকে তাকায়, অদ্ভুত সুরে শিস দেয় আর অমনি সেই পাখিটা উড়ে এসে বসে ওর কাঁধে।
“ইয়ে দেখিয়ে ছোটেবাবু, ইয়ে যো লাল-পিলা চিড়িয়া—ইয়ে বহোত আচ্ছা গাতি হ্যায়।” বলেই হাতটাকে সামনে এনে পাখিটাকে বলে, “লে বেটা, ছোটেবাবু কো এক গানা সুনা দে।”
পাখিটা একটু নড়েচড়ে ‘ফুইইইত’ করে একটা শব্দ করে।
লোকটা বলে, “আরে কৌন সা ক্যায়া! কোই ভি গানা সুনা দে। অচ্ছা, পরসো বারিষ কে ওয়ক্ত যো গা রহি থি, ওহ সুনা দে।”
সেই পাখি অমনি আকাশের দিকে মুখ তুলে টুই-টুইই করে সুর তোলে। আমার মনে হয় সে যেন গাইছে—
‘টুক টুই টুই
টুক টুই টুই
নকশিকাঁথায়
গা জড়িয়ে
আয়েশ করে শুই।’
আরে, এ তো ঠাম্মা গায়! শীত পড়লে দুপুরবেলা আমার খাওয়ার পর মা আর ঠাম্মা খায়। তারপর রান্নাঘর থেকে বাসন-টাসন গুছিয়ে এসে বিছানায় কাঁথার নীচে পা ঢুকিয়ে এই গানটাই ঠাম্মা গুনগুন করে।
“বেলো! ওখানে কী করছিস?”
বাবার ডাক শুনে একটু চমকে উঠি। তারপরেই মনে হয় এই আশ্চর্য ব্যাপারটা বাবারও দেখা উচিত। এই ভেবে যেই লোকটার দিকে ফিরেছি, ও মা—‘কোথায় বা কী, ভূতের ফাঁকি!’ জলজ্যান্ত লোকটা কেমন মিলিয়ে গেছে চট করে! কেবল রাজ্যের পাখি আমায় ঘিরে বাগানের মাটি থেকে কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। নীচু হয়ে দেখি, লিট্টির ছোটো ছোটো টুকরো আর পাখির খাওয়ার দানা।
“বিকেলে ফিরে দেখিস, এখন চল বেরোই।” বাবা বলল।
গাড়িতে মা বসে আছে। আমি যেতেই বলল, “জুতোয় আবার কাদা লাগালি কোত্থেকে? তোর বাবাটা দেখেও না!”
বাবা হাঁ করে উঠেও থেমে গেল। যুদ্ধটা লাগল না ভাগ্যিস।
অফ হোয়াইট কুর্তিতে মাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। জানালা দিয়ে বাইরে চলমান সবুজ পাহাড়ের সারির দিকে তাকিয়ে আছে এখন। আমরা চলেছি পত্রাতু ভ্যালি। বাবা ড্রাইভারের পাশে বসে বোধহয় গুগল ম্যাপ খুলেছে। যান্ত্রিক মহিলা কণ্ঠ বলছে, ‘ড্রাইভ স্ট্রেট টু পয়েন্ট ফাইভ কিমি অ্যান্ড টার্ন রাইট টু কাকে পত্রাতু রোড।’
রাস্তা এত ফাঁকা যে গতরাতের ভিড়ের কথা ভাবলে যেন স্বপ্ন মনে হয়। তবু বলা তো যায় না, এর মধ্যেই কোথাও হয়তো ছোট্টুলাল বায়োস্কোপওয়ালা ঘাপটি মেরে বসে থাকবে! আজই তো পত্রাতু ঘুরে জোনহা ফলস দেখে সীতা ফলস যাওয়ার কথা আমাদের।
অবশ্য দু-পাশের দৃশ্য এমন যে আমার ফোন দেখতেই ইচ্ছে করছে না তো ছোট্টুলাল কোন ছার! দু-দিকেই এখন কেবল উঁচুনীচু সবুজ মাঠ। মাঠের শেষ সীমানা বোঝার জন্য বলদের কুঁজের মতো সবুজ পাহাড়গুলো গজিয়ে উঠেছে যেন। বাবা বলল, ম্যাপ বলছে নাকি আমাদের বাঁদিকে খুব কাছ দিয়ে সুবর্ণরেখা বয়ে চলেছে। গাড়ি থেকে অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। হয়তো এই যে হঠাৎ করে বাঁদিকে জঙ্গলটা এসে পড়ল তার ও-পারেই আছে, অথবা এই জঙ্গলের মধ্য দিয়েই হয়তো কুলকুল করে বয়ে চলেছে।
ডানদিকে এখন চাষের ক্ষেত। ক্ষেতের পারে গ্রাম। গ্রামের বাড়িগুলোর ছাত কেমন মাটির খুড়ি দিয়ে তৈরি। বাবা বলল, ওগুলো ছাপড়ার ঘর। ঘরের সামনে ছাগল চরছে। ছাগলের পিঠে উদোম বাচ্চা ছেলে।
ক্ষেতে এখন ধান। বাঁদিকে একটু দূরে সত্যিই একটা সরু জলরেখা দেখা যাচ্ছে এবার। সামনে থেকে একটা বিরাট ট্রাক আসছে। নিতাইকাকু কাচ তুলে দিয়ে এ.সি. অন করে বলল, “ধুলো আসবে প্রচুর।”
কাচ তুলে দিতেই বাইরের আওয়াজ কমে এল। অমনি আমার মনটাও এবার কেমন যেন ফোন ফোন, গেম গেম করে উঠল। মার দিকে আবদারের চোখে তাকালাম। মা যেন কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘাড়টা কাত হয়ে পড়েছে জানালার কাচে। সামনের সিটে বাবারও দেখছি মাথাটা ঝুঁকে আছে। নিতাইকাকু স্টিরিও অন করল। এবার পুরোনো দিনের হিন্দি গান বাজবে।
একটা গান শুরু হল। বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলাম। গানটার প্রিলিউডে শিসের সুরে বাজছে—
টুক টুই টুইই
টুক টুই টুইই…
শুনতে শুনতে আমারও চোখ দুটো জুড়িয়ে এল। মায়ের কাঁধে মাথা রাখতেই মায়ের ঘুমন্ত হাতটা উঠে এসে আমার গালে আদরের ছোঁয়া দিল। মায়ের কাছে আরও গুটিয়ে যেতে-যেতেই মনে মনে কে যেন গাইতে শুরু করল—
‘নকশিকাঁথায়
গা জড়িয়ে
আয়েশ করে শুই।’
আট
পত্রাতু ভ্যালির অজস্র হেয়ারপিন লুপ। মাঝেমধ্যে নামলাম। দেখলাম। সবুজের বুকচেরা আঁকাবাঁকা অজগরের মতো রাস্তার ছবি, সবুজ পাহাড়ের টলটলে প্রতিবিম্ব বুকে ধরা লেকের ছবি, ধোঁয়ার মতো পাহাড়ের ছবি তুললাম ফোনে। এখন একটা ব্যাপার হয় দেখেছি। ধরো, গেম খেলার খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার, অথচ অনুমতি মিলছে না—এরকম পরিস্থিতিতে ফোটো তোলার জন্য ফোনটা হাতে নিলেও ইচ্ছেটা যেন কমে। মনটাও যেন খানিক শান্ত হয়।
আজ হাতে সময় কম। ঝরনা দেখার আছে। বোটিং করার সুব্যবস্থা থাকলেও আমরা তাই সেসব না করেই ফিরতি পথ ধরলাম। সবুজের মধ্যখান দিয়ে আবার আঁকাবাঁকা পথ। এবারে অবশ্য নেমে যাওয়ার ঢালু পথ।
সেই আঁকাবাঁকা পথ পার করে তা প্রায় আধঘণ্টাটাক এগিয়ে এই মুহূর্তে আমরা সুবর্ণরেখার উপরের একটা ব্রিজে। নদীর রূপ দেখে বাবা গাড়ি থামাতে বলেছে। মাও নেমেছে। আমার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। বাধ্য হয়েছি নামতে। ব্রিজের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে এখন ছবি তোলা চলছে।
নদীটা এখানে বেশ চওড়া। এত চওড়া অবস্থায় সুবর্ণরেখাকে আজকেই প্রথম দেখলাম। হাওয়ার বেগ আছে। ঢেউ ফুটছে জলে। দূরে জেলে নৌকো চলছে গোটা তিনেক। নদীর বুকে ডানদিক ঘেঁষে একটা সবুজ গাছে ঢাকা দ্বীপ না চর কিছু একটা। নৌকোগুলো ঢিমেতালে সেদিকেই চলেছে।
বাবা ফুটপাথের একটা উঁচু পাথরে বসে পড়েছে। মাঝেমধ্যে হুস হুস করে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি। বাবা বলছে, “বুঝলি বেলো, এই পথগুলো আমাদের জীবন শেখায়।”
বেশ বুঝছি ভাব এসে গেছে, এই সময় উত্তর দেওয়া মানেই আরও কিছু বলতে উৎসাহিত করা। চুপ করে রইলাম। বাবা বলতে থাকল, “পত্রাতুতে তো দেখলি, পথ এই বাঁদিকে বাঁকছে তো এই ডানদিকে, এই উপরে উঠছে তো এই নীচে নেমে যাচ্ছে—জীবনটাও ঠিক এইরকম বেলো। উঠবে, নামবে, মোচড় খাবে; শুধু শক্ত করে স্টিয়ারিংটিকে ধরে রেখে এগোতে হবে পথের সঙ্গে। পথ ছাড়া যাবে না। বেপথ হলেই…”
“হাতি!”
“না রে, হাতি নয়। একেবারে নিখাদ সত্যি। মনে রাখিস।”
“আরে বাবা, সত্যিকারের হাতি! তোমার ডানদিকে দেখো না!”
“ডানদিক কি আর খুব বেশি দেখার রে বেলো! বাঁদিকটাই হলো বিশুদ্ধ। বাম অলিন্দ, বাম নিলয় কেমন শুদ্ধ রক্ত বয়ে নিয়ে যায়, পড়িসনি?”
কথাটা বলতে-বলতেই ‘হুয়া-আ-আ’ করে যা একটা লাফ দিল বাবা, যে অলিম্পিকের সিলেকশন কমিটির কেউ ওখানে উপস্থিত থাকলে বাবাকে নির্ঘাত অ্যাকাডেমিতে ভরতি নিয়ে নিত।
ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, রঙবেরঙের সাজে সাজা ইয়া দশাসই এক গজরাজ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আসছিল ব্রিজ ধরে। পিঠে তার এক মোটা গোঁফওয়ালা, মাথালি মাথায় মাহুত। বাবার কাছাকাছি সেই হাতি এসে পড়াতে আমি সাবধানও করেছিলাম। তখন শুনলই না। ওদিকে সেই হাতি প্রায় বাবার গা ঘেঁষে যাওয়ার সময় শুঁড়খানা যেই না একবার কোলে বুলিয়ে চলে গেল, অমনি বাবার এই অভিব্যক্তি।
বাবার ওই কাণ্ড দেখে আমি আর মা তো হেসে খুন। কিন্তু বাবা এত তুম্বো মুখে গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেল যে আমরাও হাসি থামিয়ে গাড়িতে উঠে বসতে বাধ্য হলাম।
গাড়ির সামনে দিয়ে দুলকি চালে চলেছেন সেই গজরাজ। পথ ছাড়ার নামগন্ধ নেই। শান্ত ধীর গতিতে হেলে দুলে তিনি চলেছেন। একেই বলে বোধহয় গজেন্দ্রগমন। নিতাইকাকু কায়দা করে সাইড কাটিয়ে যেতে চেষ্টা করল। তখনই হঠাৎ আমার চোখে পড়ল হাওদার ডানদিকে ঝুলছে একটা চকচকে হলদে কাপড়। তাতে লাল কালিতে লেখা—
‘ছোট্টুলাল হাতিওয়ালা, মোরনি গাঁও, সীতা ফলস।’
ছোট্টুলাল আর সীতা ফলস কথা দুটো দেখেই চমকে উঠে মাহুতের দিকে তাকালাম। ততক্ষণে নিতাইকাকুও সাইড পেয়ে গতি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তবুও দেখতে পেলাম, সেই গুঁফো মাহুত একটানে তার ইয়া মোটা গোঁফখানা খুলে ফেলে যেন আমার দিকেই তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে আর হাত নাড়ছে। আর সেই হাসিমুখখানা আমার খুব চেনা। জুবিলি পার্কে, দশম প্রপাতে, ডিমনা লেকে দেখা সেই লোক। চোখ গোল্লা গোল্লা করে হাসিমুখে মাথা দোলাচ্ছে।
“আরে ওই! এত ঝুঁকে পড়ছিস কেন গাড়ির দরজায়?” মা বকা দিয়ে উঠল।
মাকে তো আর এখনই এসব বলা যাবে না, কাজেই চুপ করে সরে এলাম।
মুডটা খিঁচরে গেছে। এই লোকটা চাইছেটা কী? বার বার আমার সামনে এসে জ্বালিয়ে খাচ্ছে! আমি আবার কী এমন কেউকেটা যে আমায় নিয়ে এত ব্যস্ত হবে? ধুর! একবার বাগে পাই ব্যাটাকে সীতা ফলসে, ব্রহ্মাস্ত্র এমন প্রয়োগ করব না যে, সাতদিন ধরে টের পাবে।
বাবাও সেই যে তুম্বো হয়েছে, আর কোনও কথা বলছে না। গাড়ির জানালা দিয়ে উলটোদিকে কেবল ছুটে যাচ্ছে রুক্ষ পাথুরে ভূমি, শুকনো কাশফুল, গোরুর দল, খেটো ধুতি- ফতুয়া পরা মাথায় মাথালি দেওয়া গোপালক; কখনও চওড়া, কখনো-বা সরু সুবর্ণরেখা।
আমাদের চুপ দেখে নিতাইকাকু স্টিরিও অন করে দিল। আম্মা-দাদানকে মিস করছিলাম। বেড়াতে এসে এমন পরিস্থিতি আমাদের অবধারিত। বাবা তুম্বো, মা গোমড়া—পিনড্রপ সাইলেন্স। আদিম বনের মতো সেই নৈঃশব্দ্য ভাঙতে একজনই পারে—আম্মা। এমনসব কথা জুড়ে দেবে আমার সঙ্গে যে খানিক বাদেই সবাই হাসিতে ফেটে পড়বে। আর দাদানদা থাকলে আশেপাশের প্রকৃতির, নইলে সেই অঞ্চলের মানুষজনের জীবন-জীবিকার বিবরণ দিতে থাকবে এই সময়। খুব সুন্দর করে বলে দাদানদা। একটুও বোর লাগে না।
যাই হোক, যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট হতে হবে—বাবার উপদেশ মনে করে নিতাইকাকুর স্টিরিওতে মন বসাতে চেয়েও পারলাম না। কে জানে কোন বাবরের জামানার গান বাজাচ্ছে! জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েও কোনও লাভ হচ্ছে না। সেই একই দৃশ্যই তো দেখা যাচ্ছে। সেই পাথরভরা এবড়োখেবড়ো মাঠ, সেই দূরে দূরে খাপরার ঘর, সেই ধু ধু মাঠের শেষে নাম না জানা বড়ো বড়ো পাখির পাক খেয়ে ওড়া, সেই সুবর্ণরেখা—কাহাঁতক দেখা যায়!
“আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?” সোজাসুজি কাউকে জিজ্ঞাসা না করে প্রশ্নটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলাম।
বাবা উত্তর দিল না। মাও না। মা বাইরে তাকিয়ে রয়েছে আর বাবার মাথা ঝুঁকে রয়েছে। খানিক দেখে নিতাইকাকু বলল, “আগে জোনহা ফলস, তার পরে সীতা ফলস।”
“কতক্ষণ লাগবে আর?”
“বেশিক্ষণ নয়, জোনহা আর মিনিট কুড়ি।”
নিতাইকাকুর কথা শুনে বুঝলাম, সীতা ফলস যেতে না হলেও অন্তত ঘণ্টা খানেক তো লাগবেই। বেশিই লাগবে। গতকাল রাতে গুগলে দেখেছি জোনহা ফলসে সাতশো বাইশটা সিঁড়ি। দশমেই যা দেখেছি, মার যদি সেই একই ফর্ম থাকে তাহলে এখানে তো ঘণ্টা খানেক লাগবেই।
এতক্ষণ যখন বাকি আছে তাহলে এখন একটু দেখে নেওয়াই যায়। তাছাড়া সুবর্ণরেখার ছবি তোলার পর থেকে ফোনটা তো আমার পকেটেই আছে। কথা না বাড়িয়ে পকেট থেকে ফোনটা বার করলাম। ইউটিউব নোটিফিকেশন এসেছে। অ্যামং আস-এর নতুন একটা ভিডিও। একবার বাবা-মা দুজনের দিকেই আড়চোখে দেখে নিয়ে ক্লিক করে ফেললাম ভিডিও লিংকটায়।
নয়
জোনহা ফলসে অবশ্য ক্লান্ত হওয়া আর মুগ্ধ হওয়া ছাড়া তেমন কিছু ঘটেনি। গাছে গাছে ছাওয়া সে এক ভারি সুন্দর জায়গা। সেই সবুজ বনের ভিতর দিয়ে মোড় ঘুরে ঘুরে সিঁড়ি নেমে গেছে নীচে।
সিঁড়ি দিয়ে নামার আগেই আদিবাসীদের অস্থায়ী দোকান। দোকানের সামনে মোরগ চরছে। কোনও দোকানের সামনে ছাগল বাঁধা। পাথরের উনুনে কাঠের আগুনে রান্না করছে আদিবাসী মহিলারা। দোকানদাররা ভাঙা বাংলায় আমাদের বলল অর্ডার দিয়ে নীচে গেলে ফেরার সময় তারা মাংস-ভাত খাওয়াতে পারবে। অনেকজন খাচ্ছেও দেখলাম। কাগজের প্লেটে মোটা ভাত, ডাল, ডুমো ডুমো আলুভাজা আর কষা মাংস।
আমরা খাবারের অর্ডার না দিয়ে নীচে নামতে শুরু করলাম। বাবার একটু দেশি মোরগের মাংস খাওয়ার ইচ্ছে ছিল বোঝা গেল, কিন্তু সত্যি বলতে কী, খাবার বানানোর পদ্ধতিটা আমার তেমন স্বাস্থ্যসম্মত মনে হচ্ছিল না। আর মা বলল, “তোমরা খাও, আমি এখন খাব না।”
“এক যাত্রায় তো পৃথক ফল হয় না।” বলে বাবা হনহনিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে শুরু করল। আমিও বাবাকে অনুসরণ করলাম। এমন মুহূর্তে মা যেমনটা করে থাকে, তাই করল। ধীরে সুস্থে চারপাশ দেখতে দেখতে নামতে শুরু করল। ভাবটা এমন যেন আমাদের কাউকে কোনও দরকারই নেই। আমাদের যেন কোনও অস্তিত্বই নেই। জানি, বেশ খানিকটা গিয়ে বাবা দাঁড়াবে, মাকে অনেক পিছনে দেখে বিড়বিড় করবে, তারপর মা এলে ঝগড়া হবে। সব বেড়ানোর ক্ষেত্রে এটা একেবারে কমন।
তবে নামাটা সার্থক। সে যে কী সুন্দর ঝরনা সে আর কী বলি! উঁচু থেকে জল লাফিয়ে পড়ছে; পাথরের উপর দিয়ে নেচে নেচে চলেছে, যেতে যেতে আবার যেন উঁচু সিঁড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ছে নীচে। আমরা সেইরকম একটা ধাপের পাশে এসে বসলাম।
ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর। চাঁদি তেতে উঠছে। ওদিকে জল তেমন ঠান্ডা। বাবা চোখে-মুখে সেই ঠান্ডা জল ছিটিয়ে নিচ্ছে। আমি ভাই ওই জল মুখে দেব না। খানিক আগেই দেখেছি উপরের ধাপের কাছে একটা দেহাতি লোক জলে থুতু ফেলেছে। পারেও এরা! এত সুন্দর একটা পরিবেশের সাড়ে সব্বোনাশ করে ছাড়ে!
জলের গুঁড়ো এখানেও মুখে এসে লাগছে। খুব আরাম। দূরে পাহাড়ের উপরে সবুজঘেরা একটা সাদা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। কারও নিজের বাড়ি, না গেস্ট হাউস? ওই বাড়িতে যারা থাকে তারা সবসময় এই সুন্দর দেখতে পায়। আমাদের ছাদ থেকে আগে চারপাশে সবুজ দেখা যেত, এখন কেবল অন্য বাড়ির মাথা আর দূরে এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে হু হু করে ছুটে চলা গাড়ি দেখা যায়।
আমারও এখন জলে হাত-পা ডোবাতে ইচ্ছে করছে। জুতো খুলে পা ডোবাব নাকি? মাকে জিজ্ঞেস করাতে মা হ্যাঁ বলতেই কাজ সেরে ফেললাম। আহ্, কী ঠান্ডা! কুলকুল করে পরিষ্কার জল আমার পায়ের উপর দিয়ে বয়ে নীচে নামছে। জলে রোদ চুঁইয়ে পায়ে ঝিলমিল করছে। এই পাথরগুলো সারাজীবন এমন করে জলের আরাম নেয়। নিতে নিতে ক্ষয়ে গিয়ে নতুন নতুন আকার পায়। বাবার কাছে বিন্ধ্যপর্বতের কাহিনি শুনেছি। আজও তিনি অগস্ত্য মুনির প্রতীক্ষায় উবু হয়ে বসে আছেন। আমি কতক্ষণ পারব এমন চুপ করে বসে আরাম নিতে? আম্মা অবশ্য অনেকক্ষণ পারে। আমরা যখন পুরী গেছিলাম, তখন আম্মার হাত ভাঙা ছিল। সে প্রায় সাত-আট বছর আগের কথা হবে। বেড়াতে যাওয়ার দিন দশেক আগে মাসিদিদার মালদার বাড়ি থেকে ফেরার সময় পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছিল আম্মার। আমরা তো ভেবেই নিয়েছিলাম আর বেড়াতে যাওয়া হবে না। কিন্তু আম্মাকে ঠেকায় কে! হাতে প্লাস্টার নিয়েই চলে এল। আমরা সমুদ্রে যতক্ষণ স্নান করতাম, আম্মা বালিতে পা ছড়িয়ে বসে থাকত। ঢেউ এসে আম্মার পা জলে ভিজিয়ে দিত। একটুও না নড়ে আম্মা শুধু আমাকে বলত, “বাবু, ঢেউ আসছে, লাফা!” আমি তখন অনেক ছোটো, তাই সব ঢেউই আমার মাথার উপর দিয়ে যেত। আম্মা চেঁচিয়ে বললেই আমি লাফ দিতাম আর ঢেউটা আমার বুকে কাছ দিয়ে হুউউস করে চলে যেত। কী যে মজা হয়েছিল সে-বার! আমরা ভেবেছিলাম আম্মার হাত ঠিক হয়ে গেলে আবার আমরা পুরী আসব, কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। আম্মা, ঠাম্মা সবাইকে নিয়ে সে আর একবার যাওয়ার প্ল্যান হয়েছিল, টিকিটও কাটা হয়ে গেছিল, কিন্তু বাবার একটা ইন্টারভিউ পড়ে যাওয়ায় আর আসা হয়নি। এখন তো জুজুদাদার যা শরীরের অবস্থা, ঠাম্মার আর আসা হবে না।
আমি একটা কাঠের তলোয়ার কিনেছি। সিঁড়ির ধাপে যারা বিক্রি করছিল, তাদেরই একজন এখানে এসে দিয়ে গেছে। তলোয়ারটা দিয়ে মাঝে মাঝে এখন বিপক্ষের সৈন্যসামন্তকে ঘা দিচ্ছি। অমনি জল ছিটকে ছিটকে উঠছে। সে উঠুক। এই জায়গাটা নিয়ে মনে মনে ডানজেনের একটা জায়গা ভেবে নিয়েছি। কারা কারা কোথায় কোথায় আছে সেসব ভেবে নিয়ে গেমটা খেলা শুরু করে দিয়েছি। দারুণ লাগছে!
পিঠের কাছে কী যেন একটা খুট করে খুঁচিয়ে দিল। বাবা তো সামনে! তাহলে হয়তো মনের ভুল। ভাবতে না ভাবতেই ফের একটা খোঁচা খেলাম পিঠে। পিছন ফিরে তো তাজ্জব! এই বড়ো এক মুরগি। ঠোঁট তাক করে রয়েছে খোঁচাবে বলে। হাঁইকাঁই করে লাফিয়ে উঠতে যাব, অমনি সেই মুরগি ঘাড় নেড়ে যেন বারণ করল। তারপর দু-চারবার নিজের পালক ঠুকরে কোন এক পালকের নীচ থেকে একটা কাগজ বার করে ঠোঁটে করে আমার সামনে রেখে মুণ্ডুটা উপর-নীচ করতে থাকল। কাগজটা হাতে নিতে নিতে মুরগিটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম। আর পাঁচটা দেশি মুরগির থেকে এটা অনেকটাই বড়ো। ভালোভাবে বলতে গেলে এর পা আর গলাটা যেন অস্বাভাবিকরকমের বড়ো। লাল আর বাদামি মেশানো পালক দিয়ে ঢাকা গলাটা রাজহাঁসের মতো না হলেও তা অনেকটাই লম্বা। এটা কি তাহলে রাজমুরগি? ভগাই জানে।
আমাকে সেই কাগজ দিয়ে সে পণ্ডিতের মতন ঘাড় দোলাতে লেগেছে। গপ্পে-কাহিনিতে এ পর্যন্ত অনেক পায়রা, বাজ এমনকি প্যাঁচাকেও দূতের কাজ করতে দেখেছি, কিন্তু মুরগিও যে এ-কাজ করে এ-কথা অন্য কোথাও শুনলে গ্যাঁজা বলেই উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু এ যে ঘোর বাস্তব! অবশ্য এই কাগজে যে আমার জন্য কোনও চিঠি লেখা আছে সে তো নাও হতে পারে। কিন্তু আমার মন বলছে এ ছোট্টুলালের খত না হয়ে যায় না। আড়চোখে বাবার দিকে দেখে নিলাম। জলে পা ডুবিয়ে এখন বাবার ভাষাতেই যাকে বলে একদম তুরিয়ানন্দে রয়েছে। কাজেই কাগজ খোলাই যায়।
যা ভেবেছি তাই। ছোট্টুলালেরই খত। ভাষাটা যেন এবার একটু নরম। স্বভাবসিদ্ধ হিন্দিতে যা লিখেছে তার বাংলা করলে দাঁড়ায়—
‘আমি জানতাম তুমি আসবে। আমার এই খাস দোস্তের কাছে তোমার জন্য তাই এই চিঠি পাঠাচ্ছি। মনের আনন্দে তুমি বেড়াও। সীতা ফলসেও এসো। খুব ভালো লাগবে। আমি অবশ্য থাকতে পারছি না তোমার খাতিরের জন্য। খুব জরুরি একটা কাজ করতে হবে। তবে আমার এই খাস দোস্তটিকে পাবে ওখানে। ওকে যেন হেলাফেলা ভেবো না, ওর নাম কুক্কুটেশ্বরী। নিজের বানানো ওষুধ খাইয়ে আমি ওকে বলশালী করেছি। ওর শক্তির পরিচয় পেলে বুঝবে কী ওষুধ বানিয়েছি! কুক্কুটেশ্বরী কিন্তু কথা বলতেও পারে। তবে সকলের সামনে বলে না। একটু আবডালে চেষ্টা করে দেখো, মুড ভালো থাকলে কথা তো বলবেই, সঙ্গে মুরগাওয়া নাচও দেখিয়ে দিতে পারে। ওকে জানিয়ে দিও সীতা ফলস আসছ কি না, ও তাহলে আগে গিয়ে তোমার খাতিরের জন্য কিছু বন্দোবস্ত করে রাখবে আর কী।
ইতি— তোমার পরম হিতৈষী শ্রী ছোট্টুলাল বাইস্কোপওয়ালা।’
ঠিক জানতাম সময়মতো ভাগলবা হবে এই ছোট্টুলাল। আরে বাবা, আমি তো তোমার চ্যালেঞ্জ নিয়ে এলাম, আর তুমিই কিনা! হাহ্! ওয়াকওভার পেয়ে যাওয়ায় মনটা এখন হেব্বি ফুরফুরে লাগছে। আচ্ছা, কুক্কুটেশ্বরী সম্পর্কে যা লিখেছে ছোট্টুলাল সেসব কি সত্যি? এটা তো সত্যি যে আর পাঁচটা মুরগি থেকে কুক্কুটেশ্বরী আলাদা গড়নের, তা হতেই পারে অন্য কোনও প্রজাতির, তা বলে ছোট্টুলালের বানানো ওষুধে ওর শক্তিশালী হওয়ার ব্যাপারটা আমার ভাই চূড়ান্ত গ্যাঁজা বলেই মনে হল।
কথাটা মনে হতেই দেখলাম কুক্কুটেশ্বরী যেন মাথাটা জোরে ঝাঁকিয়ে পালক ফুলিয়ে আমার দিকে কড়া চোখে তাকাল। বলতে দ্বিধা নেই, তার চোখের সেই দৃষ্টি দেখে বেশ ভয়ই করল। পালক যেমন ফুলিয়েছে, ঠোঁটটাও যেন আরও খানিক লম্বা আর ছুঁচলো হয়েছে। বাপ রে! যদি ঠুকরে দেয়! মনে মনে বললাম, ‘জয় মাতা কুক্কুটেশ্বরী! তোমার মতো কাউকে এর আগে আমি দেখিনি। তাই তোমার ব্যাপারে বুঝতেও পারছি না। তোমার দোস্ত নাকি মালিক ছোট্টুলাল এ যাবৎ বড্ড জ্বালিয়ে চলেছে আমাকে, তাই হয়তো না বুঝে তোমার ক্ষমতা সম্পর্কে ভুল ভেবে ফেলেছি। শান্ত হও মাগো! আমায় ঠুকরিও না। আমি সীতা ফলসে যাব। তখন দেখো তোমায় কত মান্যি করব। আপাতত শান্ত হও মাগো।’
বোধহয় কাজ হল। পালকগুলো নেমে আসছে দেখলাম। ঠোঁটটাও ছোটো হল কি? আলতো ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করতেই বাবার কথা কানে এল—“কী রে, হাতজোড় করে কী বিড়বিড় করছিস বেলো?”
অমনি দেখলাম সেই কুক্কুটেশ্বরী কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একেবারে আম মুরগির মতো হয়ে খুঁটে খুঁটে যেন দানা খেতে থাকল। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম সে যেন সেই দানা খেতে-খেতেই বলল, “আর কাউকে এক্ষুনি আমার কথা বলবে না।” কথাটায় সত্যিই বেশ বলশালী টিউন।
বাবার দিকে ফিরে বললাম, “কী হয়েছে?”
“হাতজোড় করে ওদিকে কাকে প্রণাম করছিস?”
“কাউকে না। নিজের কাজ করো না আমায় পাহারা না দিয়ে!”
বলেই ঘুরলাম। ব্যস! যা ভয় ছিল তাই। কুক্কুটেশ্বরী হাওয়া! কী যে মিস করলাম। কত কী জানা যেত ওর কাছ থেকে! অবশ্য ছোট্টুলালের কথা সত্যি হলে আর একটা চান্স আছে সীতা ফলসে ওর সঙ্গে কথা হওয়ার। তাই যদি হয়, তাহলে কথা বলতেই হবে। আর কী কী পারে কুক্কুটেশ্বরী সেসব জেনে নেব। আর তার এই সব স্পেশাল পাওয়ারের রহস্যটাও জানার চেষ্টা করব। তবে তার জন্য আপাতত ডেস্টিনেশন সীতা ফলস।
বাবার দিকে ফিরে তাড়া লাগালাম—“চলো ওপরে যাই। আরও তো দুটো ফলস আছে। দেখতে হবে তো!”
মা কোথায় খুঁজতে খুঁজতে দেখলাম উপরের চাতালে ব্যাকগ্রাউন্ডে ফলস নিয়ে মা হাত উঁচু করে ঘুরে ঘুরে সেলফি তুলছে। আমার বেলায়ই যত দোষ!
দশ
কিছুই ঘটল না। কিছু না মানে কিচ্ছু না! দস্তুরমতো ঘুরে বেড়ালাম সীতা ফলসের সব জায়গায়। কোথায় ছোট্টুলাল আর কোথায় তার সঙ্গীসাথীরা? অথচ এই কয়েকদিন ধরে কতসব খেলা তাদের! এই রকমারি রূপে নিজেই দেখা দিচ্ছে, এই হনুমানের হাতে চিঠি পাঠাচ্ছে, এই ছাগলের মুখ দিয়ে কথা বলাচ্ছে তো এই মুরগি অবতারের কাছে খবর পাঠাচ্ছে। অথচ কাজের বেলায় দেখো—ভোঁ ভাঁ। পিঠটান দিল যে কোথায়!
আবার ভাবছি, আমি কে এমন বাহুবলী যে আমায় ভয় পেয়ে পিঠটান দেবে? বরং ছোট্টুলালই তো আমায় দশম ফলসে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। এখানেও তো সে আমার ক্ষতি-টতি কিছু করবে বলে ডেকেছিল বলে মনে হয় না। বরং কী যেন কী ম্যাজিক দেখাবে বলেছিল। অবশ্য ম্যাজিক সে এখন পর্যন্ত কম কিছু তো দেখায়নি। বলতে গেলে এই গোটা বেড়ানোটাতেই একমাত্র সেই আমার উৎসাহ। ছোট্টুলাল আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ ছাড়া তো পুরো বেড়ানোটাই একেবারে ঝুল। আম্মা থাকলে তবু একটু মজা হয়। কিন্তু শুধু বাবা-মার সঙ্গে কি আর বিরাট মজার কিছু হয়? বেড়ানোর অনুভূতিই তো আসে না। যাদের সঙ্গে রোজ থাকি তাদের সঙ্গেই যদি বেড়াতে এসেও ওঠা-বসা করতে হয়, তাহলে আর রোজকার জীবনের থেকে আলাদা কী হল?
এই যে এখানে ছোট্টুলালকে পেলাম না, তাতে গোদা বাংলায় যাকে বলে একেবারে মোক্ষম কনফিউজড স্টেটে আছি। অবশ্য এসে যে ভুল করেছি তা কিন্তু একেবারেই নয়। আসলে যতগুলো ফলস দেখলাম, প্রত্যেকটা ফলসের আলাদা আলাদা সৌন্দর্য। সীতা ফলস জোনহার তুলনায় উচ্চতায় না হলেও বহরে যেন একটু হলেও ছোটো, তাছাড়া মাস খানেকের মধ্যে বৃষ্টি না হওয়ায় জলও খুব বেশি নেই। তবুও সেই গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা নিরিবিলি শান্ত ঝরনাটিকে ভালো না লেগে উপায় নেই। আমি তো একেবারে নীচে নেমে গেলাম। অন্য অন্য ঝরনাগুলোর তুলনায় ভিড় সেখানে অল্প, পায়ের নীচে ঘাস মেলে। দুই ধারে বুনো গুল্মের ঝোপে কোনোটায় হলুদ নয়তো গোলাপি রঙের ফুল ফুটেছে। একশো চুয়াল্লিশ ফুট উচ্চতা থেকে সবুজে ঢাকা কোনও পাথরে জল আছড়ে পড়ছে। কোন পাথরে সে এখান থেকে দেখা যায় না। এখানে দেখা যায় উপর থেকে নেমে আসা জলধারার যাত্রাপথ। মাথার সিঁথির মতো সবুজের মধ্যখান দিয়ে তার যাওয়ার পথ। পাখপাখালির শব্দও তেমন নেই। কেবল জল ঝরার একটানা সুরেলা শব্দ। সে-শব্দ জোনহার মতো জোরালো নয় অথবা দশমের মতো গম্ভীর নয়, তবে ভালো লাগার মতো সুরেলা বটে।
সেখানে এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম, কোথাও ছদ্মবেশে ছোট্টুলাল লুকিয়ে আছে কি না দেখার জন্য। তাকে তো পেলাম না, তবে পেলাম জুলজুলে চোখের তুলতুলে এক কুচকুচে কুকুরছানাকে। ঝরনার জল যেখান দিয়ে নীচে নেমে চলেছে সেই সরু সোঁতার ওই পাড়ে কুমিরের মুখের মতো হাঁ করে থাকা একটা পাথরের খাঁজ থেকে গোল্লাগোল্লা চোখে দেখছিল আমায়। আমি দেখতে পেয়ে খানিক এগিয়ে যেতেই ‘ভুক’ করে ডেকে উঠল। আমি একবার দু-দিক দেখে নিলাম। বলা তো যায় না আশেপাশে ওর মা আছে কি না! সেরকম কিছু চোখে না পড়ায় সোঁতা পার হয়ে ওর সামনে হাঁটু মুড়ে বসতেই গুটি গুটি করে এসে আমার হাঁটুর উপর এসে বসল। আমিও তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে থাকলাম।
বাংলা বইয়ে লেখা আছে, সুখ ক্ষণস্থায়ী। বইয়ের কথা মিথ্যে হয় না বাবা বলেন। বাবার কথা সত্য করতে মা ডাকতে শুরু করলেন। সবে সেই নরম ছানাকে কোলে করেছি, ব্যস, ডাক শুরু। ডাকের কম্পাঙ্ক, তীক্ষ্ণতা দুটোই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে। বাড়ুক গে! সবে বলে কালুয়া আমায় চিনতে শুরু করেছে; ছোট্ট ভেজা ভেজা নাক দিয়ে শুঁকে শান্ত হয়ে কচি দাঁত দিয়ে আমার আঙুল কামড়াতে আসছে! মানে আর খানিক বাদেই খেলা একেবারে জমে যাবে। এখন ছাড়া যায়!
ওদিকে আমার সাড়া না পেয়ে নীচে নামতে গিয়ে বোধহয় পাথরে হোঁচট খেয়ে থাকবে মা। আবার হোঁচট না হয়ে হোঁচটের সম্ভাবনাও হতে পারে। পায়ের আঙুলে ছোঁয়া লাগলেই মা যা করে তাই শুরু হয়ে গেল। শুনতে পাচ্ছি বাবার সঙ্গে লেগে গেছে। শান্তি অশান্তিতে টার্ন নিচ্ছে। বাধ্য হয়েই কালুয়াকে কোল থেকে নামিয়ে দিলাম। সে-ব্যাটা তো আমায় ছাড়তেই চায় না! বার বার পিছন পিছন আসে। কিন্তু আমার তো আর ওকে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আমাদের ফ্ল্যাটে তো পোষ্য রাখার অনুমতি নেই কারও।
সোঁতাটা পার হয়ে এলাম। কালুয়া ওই পাড় থেকে আমায় দেখছে। একটু এগোচ্ছে, তারপর জলের গতি দেখে আবার পিছিয়ে ভুক ভুক করে আমায় ডাকছে। আমি জানি, একবার ডাকলেই ওই জল এক লাফে পার করে আমার কাছে চলে আসবে। ডাকলাম না। সিঁড়ি দিয়ে বেশ খানিকটা উঠে গিয়ে ফিরে দেখলাম, পাথরের খাঁজটার ভিতর ঢুকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
কারও সঙ্গে আর কথা বলতে ইচ্ছে করল না। সিঁড়ি দিয়ে সোজা উপরের দিকে উঠতে শুরু করলাম। বাবা-মা দুজনেই আমার পিছন পিছন উঠছে। দুজনেরই মুখে ক্লান্তির ছাপ। বেলা প্রায় সাড়ে তিনটে। বেড়ানোর তাড়ায় আজ দুপুরে আমাদের খাওয়া হয়নি। খিদে আমারও পেয়েছে খুব, কিন্তু বলতে ইচ্ছে করছে না।
গাড়ির কাছে দরজায় ঠেস দিয়ে নিতাইকাকু দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে দরজা খুলে দিল।
গাড়ি চলতে শুরু করলে নিতাইকাকু আমায় জিজ্ঞেস করল, “বাবু! এবার কোথায়?”
“এবার কোথাও খেতে যাব। খুব খিদে পেয়েছে।” আমি কিছু বলার আগেই বাবা বলে উঠল।
গাড়ি তখন মোড় ঘুরে ঢালু রাস্তায় নামছে। নিতাইকাকু বাবার কথা শুনে বলল, “এখানে কি ভালো কিছু পাওয়া যাবে? শহরের আগে মনে হয় কিছু মিলবে না।”
মা ফোনটা বাইরে তাক করেছে। রাস্তাটা এখনও ঢালু। ঢালুটার শেষে সামনের চড়াইটা দেখা যাচ্ছে। চড়াইটার শেষ একেবারে নীল আকাশে। আকাশটা আজ একেবারে হাসিমুখে। মাছরাঙার ডানার মতো রঙে টুকরো শাদা মেঘগুলো ঝকঝক করছে। পাশের জঙ্গল থেকে দুজন খালি গা লোক হাতে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে আমাদের গাড়িটাকে দেখছে। গা যেন তাদের একদম পাথর কোঁদা। দেখছে আর কী যেন বলাবলি করছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মাথা নেড়ে কী যেন বলে তারা হুড়মুড় করে জঙ্গলে ঢুকে গেল। একটা কুচকুচে কালো, লালচোখো কুকুর ‘ভো’ করে ডেকে আমার দিকে যেন একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি দিয়ে ওদের পিছন পিছন জঙ্গলে ঢুকে গেল। এরা কি ছোট্টুলালের দোসর? কে জানে! আসলে ছোট্টুলালকে দেখতে না পেয়ে মনটা একটু তেতো হয়ে গেছে আমার। ওকে দেখতে না পেয়ে বুঝতে পারছি এই গোটা বেড়ানোটায় ওর ওই সব চ্যালেঞ্জ-ট্যালেঞ্জগুলো কতটা চনমনে রেখেছে আমাকে। ও না থাকলে তো বেড়ানোটাই জোলো হয়ে যেত। বিজন-স্যার ঠিকই বলেন—‘জীবনে দুঃখ, কষ্ট, চ্যালেঞ্জের দরকার আছে। না-হলে সুখের মজাটাই কখন যেন দুঃখের হয়ে যায়।’
যেমন এখন হয়ে যাচ্ছে। এই যে বাইরে এত সুন্দর দৃশ্য, এই যে ধু ধু পাথুরে মাঠ ছাপিয়ে হঠাৎ হঠাৎ করে এসে যাচ্ছে সবুজ জঙ্গল, কাঠের বোঝা মাথায় আদিবাসী দল, ছবির মতো সব নীচু নীচু কুঁড়েঘর, শিংয়ে শিংয়ে লড়াই খ্যাপা ছাগলের পাল, তুমুল ব্যস্ত বেজি পরিবারের চলাচল—এগুলোর কোনোটাতেই আর মন টানছে না। অবশ্য খিদেও পেয়েছে খুব। কিন্তু আমি তো আর বাবা নই যে খিদে পেলে খালি খালি রেগে যাব আর সবার সঙ্গে খিটখিট করব!
জঙ্গলের নির্জনতা ছাড়িয়ে যখন রাস্তাটা একটু লোকালয়ে পড়ল, তখন খানিক দূরে দূরে দুটো একটা করে দোকান চোখে পড়তে লাগল। তবে তার বেশিরভাগই ইমারতি জিনিসপত্রের নয়তো মোবাইল ফোন রিচার্জের। শেষ অবধি দিগন্তছাপা মাঠের পাড়ে একটা দ্যাগড়াব্যাগড়া ইটের লম্বামতো বাড়ির সামনে তারে ঝোলানো কয়েকটা আলুর চিপসের প্যাকেট ঝোলানো দেখা গেল। বাবার কথায় নিতাইকাকু সেখানেই গাড়িটাকে দাঁড় করাল।
সে এক চায়ের দোকান। ভিতরে একটা কাঠের তক্তপোশে অনেকে বসে অনেকে লম্বা সরু কাচের গেলাসে চা খাচ্ছে; কেউ আবার রুটি আর বাঁধাকপির সবজি খাচ্ছে। আমাদের দেখে সরে সরে বসে জুলজুল করে তাকিয়ে রইল। খাওয়ার সময় অচেনা কেউ ঘরে ঢুকলে আমার যেমন দশা হয়, বেশ বুঝছি ওদের তেমন অবস্থা। যাক বাবা, আমাদের সেখানে বসতে হল না। বাবা ভাঙাচোরা হিন্দিতে অমলেট আর চায়ের অর্ডার দিয়ে আমাদের নিয়ে বাইরে এল।
বাইরে দুটো ঝাঁকড়া গাছের নীচে তিনটে দড়ির খাটিয়া। তার একটায় বসে দুজন একতাড়া করে রুটি আর সবজি খাচ্ছে। সামনে বাটিতে রাখা আচার, এই মোটকা পেঁয়াজ আর কাঁচা লংকা। ওরা বোধহয় সামনে দাঁড় করানো লরিটার ড্রাইভার আর খালাসি। ওরাই ভালো আছে। মনের আনন্দে খায় দায়, গাড়ি চড়ে দেশবিদেশ যায়। পড়াশুনো নেই, হোম-ওয়ার্ক নেই, এই করো সেই করো শোনার জ্বালা নেই, কেবল পিচঢালা রাস্তায় যেমন খুশি এগিয়ে যাওয়া আর এগিয়ে যাওয়া।
এখানে আসা ইস্তক আমার মাঝে-মাঝেই ইচ্ছে করে ঘন রাত্তিরে বাবার সঙ্গে এমন কোনও লরি চেপে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে বাবাকে আকাশগঙ্গা দেখাই। বাড়ির ছাতে তো আকাশগঙ্গা ভালো করে দেখা যায় না। যাবেই-বা কী করে, এত আলো জ্বললে কি আর রাতের আকাশ দেখা যায়! বেশ মালুম হয়, এখানে রাত্তির বেলায় কেমন ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। এই দু-পাশের গাছগুলো কালো চুলের মতো আকাশের মুখ তখন ঢেকে রাখবে, আর যেই গাছ সরে গিয়ে ধু ধু মাঠ, অমনি রাতের বুকে জ্বলজ্বল করবে তারা আর তারা। সেখানে কালপুরুষের বেল্ট দেখা যাবে, পায়ের কাছে লুব্ধক দেখা যাবে, সপ্তর্ষিমণ্ডলের সাতজন ঋষিকেই দেখতে পাওয়া যাবে। আর রাত আরও গভীর হলে আকাশের বুক চিরে ভেসে উঠবে আকাশগঙ্গা। কী রূপ হবে তার! যদি দেখানো যেত বাবাকে!
আমার পায়ে কী যেন ঠোকরাল। তাকিয়ে দেখি এইটুকু একটা হলদে রঙের মুরগির বাচ্চা। বাবা আর মা খাটিয়ায় বসে বিস্কুট গুঁড়ো গুঁড়ো করে এই বড়ো বড়ো দুটো মুরগি আর মোরগকে খাওয়াচ্ছে। সেখানে সুযোগ করতে না পেরে এ-ব্যাটা আমার কাছে এসেছে নিশ্চয়ই।
পাশের খাটিয়াটায় বসলাম। এই প্রথম খাটিয়ায় বসলাম আমি। দারুণ আরাম। বসার সঙ্গে সঙ্গে টুপ করে খানিক নীচে ঝুলে তারপর দড়ির জালে আটকে থাকা। কয়েকবার দোল খেয়ে নিয়ে বাবার থেকে একটা টোস্ট বিস্কুট নিয়ে তার দু-টুকরো ঘষে ঘষে গুঁড়ো করে সে-ব্যাটাকে ডাকলাম। ও বাবা, তিনি এবার একা এলেন না, সঙ্গে এল তার সব বন্ধুবান্ধব। সব মিলিয়ে পাঁচজন। কুটুর কুটুর করে তাদের খাওয়া দেখতে-দেখতেই আমাদেরও অমলেট এসে গেল। স্টিলের প্লেট আর চামচটা কেমন যেন একটা দেখতে। মা চামচ দিয়ে অমলেটটা টুকরো করে দিয়ে আমার সামনে রেখে বলল, “নিশ্চিন্তে খেয়ে নে।”
টপ করে একটা টুকরো মুখে পুরে দেখলাম দারুণ খেতে! খিদেও তো পেয়েছিল। কাজেই টপাটপ খাওয়া শেষ করে দেখি তখনও কারও শেষ হয়নি। তক্ষুনি পায়ের কাছে আবার ঠোক্কর। তাকিয়ে দেখি সেই মুরগির বাচ্চা। তার বন্ধুরা তখন খাওয়াদাওয়া সেরে গুটি গুটি করে এই লম্বা ইটের বাড়িটার শেষ দিকে চলেছে। এ-ব্যাটাও আমায় ঠুকরে মুখের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে মাথাটা নাড়াচ্ছে যে দেখে মনে হচ্ছে যেন সেইদিকেই যেতে ইশারা করছে। এই তো কয়েক পা দূর! দেখেই আসি।
বাড়িটার শেষে মাঠ নেমে গেছে। ফাঁকা ঘেসো মাঠ। তিড়িং তিড়িং করে চারটে ছাগলছানা খেলছে। দূরে, মাঠের প্রায় মাঝবরাবর ঝাঁকড়া একটা গাছ। পাতা তার এতই ঘন যে ছায়াটা একেবারে কালো দেখাচ্ছে। হু হু করে একটা হাওয়া এলো হঠাৎ। হাওয়া না ঝড়? কোত্থেকে যে সে-হাওয়ায় মিশে এত ধুলো এল কে জানে! চোখে-মুখে ঢুকে যাচ্ছে একেবারে। দু-হাতে চোখ ঢেকে নিলাম। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সে-হাওয়া গেল থেমে। আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমি দাঁড়িয়ে আছি মাঠের মাঝখানের সেই ঝাঁকড়া গাছটার নীচে। দূরে সেই দাগড়া দাগড়া ইটের লম্বা চায়ের দোকান দেখা যাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, বেজায় আশ্চর্য হয়েছি। ভয় পেয়েছি ভেবো না তাই বলে। অকারণে ভয় পাওয়ার অভ্যেস ছোটবেলায়ও আমার ছিল না, আর এখন তো বড়ো হয়েছি। এই অদ্ভুতুড়ে কারবারের কারণ বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে দেখছি চারপাশটা।
সেই ছাগলের বাচ্চা চারটে খেলছে গাছের ছায়ায়। তার মানে ওই হাওয়া ওদেরও নিয়ে এসেছে এখানে। তাতে অবশ্য ওদের খেলায় কিছুমাত্র প্রভাব পড়েনি। ঢুসোঢুসি আর লাফানো যেমন ছিল তেমনিই আছে।
জায়গাটা বেশ মনোরম। এরকম গাছ এর আগে আমি দেখিনি। কাজেই নাম জানি না। গাছটা বোধহয় অনেক পুরোনো। আমি তো পারবই না, বাবা আর নিতাইকাকু দুজনে মিলেও গাছটাকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না এত মোটা তার কাণ্ড। তার মধ্যে আবার অন্ধকার জমা ইয়াব্বড় এক খোঁদল।
গাছের নীচে যে পথিক অথবা রাখাল-টাখাল এসে বসে তার প্রমাণ আছে। চারদিক থেকেই ঘাসের বুক চিরে পায়ে চলা পথ আছে গাছতলা পর্যন্ত। আর গাছের মোটা গুড়ির পাশে আছে একটা কঞ্চির লাঠি, কয়েকটা শালপাতা আর কিছু নেতানো মুড়ি। বেশ বোঝা যায় এখানে বসে খায়-টায় কেউ। উপরদিকে তাকিয়ে আকাশ দেখা যায় না পাতায় পাতায় এমন করে ঢাকা। গোটা মাঠে এই একটাই গাছ। আর একটাও গাছ নেই কেন? বাবা বলতে পারবে নিশ্চয়ই। বাবাকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করব ভেবে সেই কঞ্চির লাঠিটা হাতে নিয়ে রাস্তার দিকে পা বাড়ালাম। অমনি একটা মিহি গলার ডাক আমার বুকের রক্ত হিম করে দিল। এ-ডাক আমার চেনা। এ-ডাক আসছে আমার পিছন দিক থেকে। অথচ এক মুহূর্ত আগে পর্যন্ত সেখানে আমি ছাড়া আর কোনও মানুষ ছিল না। আমার পা আর চলতে চাইছে না। স্বীকার করছি, এবার আমি ভয় পেয়েছি। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা ঠিক হবে না। টেনে দৌড় দিতে যাব অমনি আমার কাঁধে কার হাত পড়ল। কানের খুব কাছে সেই মিহিগলা ডেকে উঠল—“খোকাবাবু! হে সোনা বাবুয়া!”
এগারো
মামাবাড়িতে একবার ভরদুপুরে গাছপালাভরা বাগানে হনুমানের ডাক শুনে চমকে গেছিলাম। দৌড়োতে চেয়েও পারিনি। এখানেও ঠিক তেমনই হল।
যেই না কাঁধে হাত পড়েছে অমনি গোটা শরীর একেবারে রাম ঝাঁকানি দিয়ে চমকে উঠেছে। ভয়ের ঠেলায় বসা গলায় ‘মা’ বলে চেঁচিয়েও উঠেছি। অমনি পিছন থেকে সামনে এসে হাজির হয়েছে ধুতি আর চেক চেক ফতুয়া। মাথায় পাগড়ির মতো করে গামছা বাঁধা। একমুখ সাদা আর বাদামি রঙের দাড়ি গোঁফের ভিতর গাল-ভরতি হাসি। কাঁধে গামছা দিয়ে একটা বাক্স বাঁধা। ঠিক যেমনটা স্বপ্নে দেখেছিলাম।
‘ছোট্টুলাল বায়োস্কোপওয়ালা’ দু-হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে নিজের বুকের দিকে ইশারা করে সুর করে সে নিজের নামটা বলেই আমার বুক পিঠ সাপটে দিল। ছোটবেলায় ঘুমের মধ্যে কখনও ভয় পেলে ঠাম্মা আগে এমনি সাপটে দিত। আর খেতে গিয়ে বিষম খেলেই আম্মা এমনি করে পিঠে হাত বুলিয়ে ঢেঁকুর তুলিয়ে ছাড়ত।
ছোট্টুলালের হাত বোলানোয় কিছু একটা জাদু তো ছিল, নইলে মুহূর্তের মধ্যে ভয়-টয় উবে গিয়ে তাকে আমার ভালো মানুষ মনে হতে যাবে কেন?
ছোট্টুলাল হঠাৎ শূন্যে হাত ঘুরিয়ে কোত্থেকে একটা ডুগডুগি জুটিয়ে ফেলল। ডুগডুগ ডুগডুগ করে সেখানা বাজায় আর তালে তালে কাঁধ-মাথা-হাত নেড়ে নেড়ে নাচে। সে এক মজার দৃশ্য।
দেখতে দেখতে ভোজবাজির মতো সেই গাছের খোঁদল থেকে যেন ট্যুইস্ট দিতে দিতে বার হয়ে এল সেই কচি বাঁদর, সেই লম্বা মুরগি কুক্কুটেশ্বরী, সেই ছোট্ট কুকুরছানা আর আম্মাবাড়ির বাগানের সেই হলদে ডানা খয়েরি মাথার ল্যাজঝোলা পাখিটা। ছোট্টুলালের ডুগডুগির তালে তালে তাকে ঘিরে তারা নাচতে শুরু করে দিল। খানিকক্ষণ বাদে দেখি কোত্থেকে যেন তিনটে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে এসে তাদের দলে ভিড়েছে। লম্বা তাদের চুল ঘাড় থেকে চুঁইয়ে নেমেছে, পরনে তাদের গোলাপি সুতোর ফুল আঁকা সাদা রঙের টেপ জামা। আমি তো এদের চিনি! কোথায় দেখেছি, কোথায় দেখেছি!
ছোট্টুলাল এবার বামহাতে ডুগডুগিটাকে বাজাতে বাজাতে ডানহাতটা অদ্ভুত মুদ্রায় ঘোরাতে ঘোরাতে সোজা তাকাল আমার দিকে। কী শান্ত তার দৃষ্টি! চোখ ফেরানো যায় না। মিষ্টি একটা হাসি। আস্তে আস্তে কাছে এসে যেই না সে আমার মাথা থেকে থুতনি অবধি হাতটা বুলিয়ে দিল অমনি আমার ধাঁ করে মনে পড়ে গেল, আম্মার ফ্যাকাশে অ্যালবামে এদের ছবি আমি দেখেছি। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? আমার মা-মাসিদের ছোটোবেলা এমনি করে আমার সামনে নাচবে কেমন করে!
ছোট্টুলাল ততক্ষণে দু-কদম পিছনে গিয়ে অদ্ভুত কায়দায় ডুগডুগিটাকে শূন্যে ছুড়ে দিয়েছে আর সেখানা শূন্যে ঝুলে ঝুলে একা একাই ডুগডুগিয়ে বেজে চলেছে। এ তো অসম্ভব! নির্ঘাত আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। নিজের গায়ে একটা রামচিমটি দেব ভেবে যেই না বুড়ো আঙুল আর তর্জনীটা বাগিয়েছি অমনি ছোট্টুলাল ফের এগিয়ে এসে তার ডানহাতের অনামিকা ছুঁয়ে দিল আমার দু-ভুরুর মধ্যিখানে, আর অমনি যেন মাথার মধ্যে একসঙ্গে দপদপ করে অনেকগুলো নানা রঙের আলো উঠল জ্বলে। এমন আনন্দ হল, যে মনে হল আমিও গিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচি ওদের সঙ্গে। কিন্তু আমার যে আবার লাজুক স্বভাব। কেউ না ডাকলে আমি যেতে পারি না। ডাকলেও অনেক সময় যেতে পারি না, যদিও যাওয়ার ইচ্ছে কিন্তু আমার ভালোই থাকে। কাজেই ইচ্ছেটাকে ঢোঁক গিলে আমি ওদের নাচটাই দেখতে থাকলাম।
ছোট্টুলাল গান ধরল—
‘ডুগডুগ ডুগডুগ খেলা দেখো
মনের ভিত্তর মেলা দেখো
খোকাবাবু বাইস্কোপ দেখো
দেখো খোকা বাইস্কোপ দেখো
ডুগডুগ ডুগডুগ খেলা দেখো
দিল্লি দেখো আগ্রা দেখো
চপ কাটলেট রসগুল্লা দেখো
ফুটবল কিরিকেট খেলা দেখো
ডুগডুগ ডুগডুগ খেলা দেখো
জশন দেখো মেলা দেখো
পূজা দেখো জুম্মা দেখো
রাঁচি দেখো ঝরনা দেখো
ডুগডুগ ডুগডুগ খেলা দেখো
ডানজিন দেখো ডেরাগন দেখো
পিল্যান্ট দেখো জোম্বি দেখো
মোবাইল ফুনকা খেলা দেখো
ডুগডুগ ডুগডুগ খেলা দেখো
ছোট্টুলাল কা বাইস্কোপ দেখো
সবসে আচ্ছা বাক্সের অন্দর
প্যায়ারে, আম্মা ঠাম্মা দেখো!’
গান শেষ হতে না হতেই কোত্থেকে এক দঙ্গল ছেলেপুলে ছোট্টুলালকে একেবারে ছেঁকে ধরল। তাদের কারও আদুর গায়ে খড়ি ফুটেছে, কারও ঢলঢলে হাঁটু অবধি হাফ-প্যান্টের কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা তো কারও আবার সাদা ফটফটে টেপ জামা। হাত তুলে তুলে তারা ছোট্টুলালকে কী যেন বলছে; কেউ আবার ছোট্টুলালের ফতুয়া ধরে টানছে। চোখগুলো তাদের আনন্দ আর কৌতূহলে ভরা। কিন্তু আশ্চর্য, কারও মুখে রা-টি নেই! এত যে লাফালাফি অথচ একটিও শব্দ নেই।
“আরে রোকো তো, দেতা হুঁ না! দেখো দেখো, দোস্তোঁ! মন মে যো আয়েগা ওহি দিখেগা হমারি বাইস্কোপ মে, হাঁ হাঁ!” বলতে বলতে ছোট্টুলাল ফের জাদুকরের মতো তার দু-হাতে যেন ঢেউ তুলল। আর অমনি কোত্থেকে একটা ট্রাইপড উদয় হল তার বাঁহাতে। সেখানাকে মাটিতে নামালে যখন তখন সেই বাচ্চাদের দেখে কে! এ ওকে ঠেলে, সে তাকে ঠেলে। সবাই আগে দেখবে। আচ্ছা, এরা কি টিভি-সিনেমা কিছুই দেখেনি? কী একটা বায়োস্কোপের বাক্স ঘিরে এত লাফালাফি!
মনের ভিতর ভাবনাটা শেষও হয়নি, তারা সোজা আমার দিকে তাকাল। কোটরে বসা তাদের চোখ। চোখের দৃষ্টি আমার দিকে।
ওদিকে ছোট্টুলালের ম্যাজিক তখনও চলছে। মাথা থেকে পাগড়ির মতো গামছাটাকে একটানে সে খুলে ফেলেছে ততক্ষণে। পাঁচ নম্বর মোড়ের ‘ফুডিজ’-এর ওস্তাদ কারিগর যেমন রুমালি রুটি ঘুরিয়ে দেন ওলটানো লোহার কড়াইয়ের উপর, লাল সেই গামছাটাকে অদ্ভুত কায়দায় দু-হাতে দুলিয়ে ঠিক তেমন করে ঘুরিয়ে ছেড়ে দিয়েছে আকাশে। সেটা ঘুরতে ঘুরতে কেমন করে এক থেকে দুই, দুই থেকে চার, চার থেকে আট, আট থেকে ষোলো হয়ে পালকের মতো নীচে পড়তে-পড়তেও পড়ল না। যেন কীসের মধ্যে আটকে গিয়ে সেটাকে ঢাকা দিয়ে ঝুলে পড়ল।
ছোট্টুলাল হাসতে হাসতে বলল, “ক্যায়া হুয়া দোস্তোঁ! দিখনা নহি হ্যায়?”
এই বলে সে সেইখানেই দাঁড়িয়ে বামহাতটাকে মুঠো করে তার উপর দিয়ে ডানহাতের তেলোটা বেশ কায়দা করে খসখসিয়ে সরাতে লাগল। একবার করে অমনি করে আর একটা করে গামছার ঢাকা উড়ে যায় হাওয়ায়। আমি অবাক হয়ে দেখি প্রত্যেকটা গামছার আড়ালে ট্রাইপডের উপরে রাখা একটা করে ছোট্টুলালের বাইস্কোপের বাক্স।
পনেরো জন বাচ্চার জন্যে পনেরোটা। ছোট্টুলাল ইশারা করতে পনেরো জনই হাসিমুখে চোখ পাতল বাক্সে।
“ওরা কী দেখছে?” আমার মুখ থেকে আপনা থেকেই প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল।
“ওদের যা মন চায়, তাই দেখছে। যা দেখেনি তার সবকিছু দেখা যায় ছোট্টুলালের বাইস্কোপে খোকাবাবু!”
“যা ইচ্ছে তাই?”
“যা ইচ্ছে তাই।”
“তুমি দেখাতে পারবে ওরা কী দেখছে?”
সরাসরি উত্তর না দিয়ে এইবার ছোট্টুলাল তার ফতুয়ার পকেট থেকে পুথির মতো লাল শালু মোড়া কিছু একটা বার করে সেটাকে বাঁহাতে ধরে ডানহাতে শালুটা খুলে ফেলল। সেটা কিছুই নয়, একটা কাঠের চৌকো খণ্ড। আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে কী এক কায়দায় ছোট্টুলাল সেই কাঠের খণ্ডটাকে যেন ভাঁজে ভাঁজে খুলে ফেলল। তারপর সেটায় তর্জনীর কয়েকটা টোকা মেরে ধরিয়ে দিল আমার হাতে। আমি তো হাঁ! সি.সি.টি.ভি.-র মতো খোপে খোপে সেখানে ষোলোটা পিকচার বক্স। পনেরোটায় মুভি চলছে যেন। কোনোটায় কবাডি খেলা তো কোনোটায় তাজমহল। কোনোটায় পপাই দ্য সেইলর তো কোনোটায় ডানজেন অ্যান্ড ড্রাগনের গেমিং ভিডিও। কোনোটায় নারকোলের ডগার ব্যাটে ক্রিকেট তো কোনোটায় কত্থক।
“কেমন করে চলছে? চিপ, না পেন ড্রাইভ? নাকি ওয়াইফাই?”
“ওসব ছোট্টুলালের বাক্সে কাম করে না খোকাবাবু। ছোট্টুলালের বাক্সে মনের খুশি কাম করে। যা মনে চায়, তেমনিই ছবি উঠে পর্দায়।”
ম্যাজিশিয়ান হোক কি অলৌকিক কেউ হোক, সত্যিই অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী এই ছোট্টুলাল। একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে ওর কথায়, দৃষ্টিতে। যা ঘটছে, যা বলছে সেগুলো আদতে সত্যি না বলে মনে হচ্ছে যেমন, তেমনই আবার পুরোপুরি বিশ্বাস করতেও খুব ইচ্ছে করছে। বিশ্বাস করলেই আরও অনেক অবাক কিছু কাণ্ড ঘটবে আর দেখতে পাব বলে মনে হচ্ছে। ছোট্টুলালের কাঁধের আসল বাক্সটা এখনও ফাঁকা পড়ে আছে। ছোট্টুলালকে বলে সেখানায় চোখ পাতব নাকি? কিন্তু বায়োস্কোপ দেখতে তো পয়সা লাগবে! আমার কাছে তো পয়সা নেই। মা কবে একটা পার্স কিনে দিয়েছে। অনিয়মিত হলেও মাঝে-মধ্যে পকেটমানিও দেয় বাবা, তাছাড়া এর-তার থেকে উপহার কিছু যা মেলে সেখানেই রাখে। মা কতবার বলেছে বাইরে গেলে কিছু টাকা-সহ পার্সটা পকেটে রাখতে। আমিই রাখিনি। বাবা-মা সবসময় সঙ্গে থাকে, আমি তো আর একেবারে একা কোথাও যাই না। কাজেই আমার আর পার্স রাখার দরকার কী, এই ভেবেই নিই না। এখন মনে হচ্ছে রাখলেই ভালো হত।
“আমার বাইস্কোপে পয়সা লাগে না খোকাবাবু। লাগলে কি আর ওরা দেখতে পারত?”
“তুমি সব বুঝে যাও কী করে?”
“ভালো করে দেখতে শিখলে সব বোঝা যায় খোকাবাবু। যা দেখছি তার মধ্যেই তো সব আছে, আলাদা করে আর কথা শুনতে হয় না।”
এ তো পুরো শার্লক হোমস! কিন্তু আমিও তো কম কেউ নই। সুযোগ পেয়েই জিজ্ঞেস করলাম, “ওরা কারা গো?”
“এরাও তোমার মতোই বাচ্চা।”
“কোথায় থাকে এরা? কথা বলে না কেন?”
“ওরা কথা বলে খোকাবাবু, তবে এখানে তো তা শুনতে পাবে না। সেসব শোনা যায় কেবল ওদের নিজেদের সময়ে।”
“মানে?”
“মানে আবার কী? বললাম তো!”
“এরা সবাই আলাদা সময়ের?”
“এরা কেন, তুমিও তো তাই।”
“এই দেখো, আর সহ্য হচ্ছে না। আমি আবার আলাদা সময়ের কোথায় হলাম, এই তো ওই দোকানটা থেকে খেয়ে দেয়ে এখানে এলাম।”
“তাই নাকি খোকাবাবু? তাহলে এই আয়নাটায় একবার নিজেকে দেখো তো।”
এই বলেই ছোট্টুলাল নীচু হয়ে পাশে রাখা একটা ঝুলি থেকে আয়না বার করে আমার সামনে ধরল। আমি তাজ্জব! আয়নায় যে আছে সে তো আমিই, তবে সে এখনকার আমি তো নই! জামাটা দেখে স্পষ্ট মনে পড়ছে আমি তখন ক্লাস ওয়ান। আম্মা এই জামাটা আমায় কিনে দিয়েছিল। খুব পছন্দের জামা। টাকি যাওয়ার দু-দিন আগে এই হলুদ জামাটা কিনে এনেছিল আম্মা। ইছামতীতে নৌকো নিয়ে বেড়ানোর সময় ঝড় উঠেছিল। বাবা ভয় পেয়েছিল খুব। আম্মাও ভয় পেয়েছিল আমার জন্যে। তারপর আমরা একটা অচেনা ঘাটে গিয়ে মাঝির ঘরে গেছিলাম। সেখানে একটাই ঘরে অনেকগুলো বাচ্চা আর অনেকগুলো ছাগল।
“চাইলে সেইসব দেখতে পাবে খোকাবাবু।”
আমি ধাঁধাটা ঠিক ধরতে পারছি না। যদি ছোট্টুলাল সত্যি কথা বলে তার মানে আমি আট বছর পিছনে চলে গেছি। কিন্তু আমি তো টাইম মেশিন চাপিনি! হঠাৎ মনে এল, একটা অদ্ভুত ঝড়ে চড়েই যে আমি এই গাছতলাটায় এসেছি! সেটা কী ছিল? কোনও টাইম মেশিন, নাকি কোনও ওয়ার্ম হোল?
“অত শক্ত শক্ত ভাবনা ভাবলে খোকাবাবু তোমার মনটা যে শক্ত হয়ে যাবে। তখন আর প্রকৃতির কোনও খেলা দেখতে পাবে না। এই ছোট্টুলালও তখন কিছু করতে পারবে না। কোনও জাদুই তো কাম করবে না।”
একটা খটকা মনে খোঁচাচ্ছিল। ছোট্টুলালকে সেটাই জিজ্ঞেস করলাম, “সব যদি আলাদা আলাদা সময়ের হয়, তুমি কীভাবে তাহলে সবার সবকথা শুনতে পাচ্ছ বলো তো!”
“সেজন্যেই তো আমি ছোট্টুলাল, খোকাবাবু! এই জগৎ সবাইকে একটা করে কাম দেয়, সেই কাম করার শক্তি দেয়, ক্ষমতা দেয়।”
“তোমার এটা আবার কী কাম? আমি খুব বুঝেছি, তুমি আসলে জাদুকর। খুব হাই লেভেলের সম্মোহন জানো। সম্মোহন করে যা খুশি বুঝিয়ে দাও। কিন্তু বাচ্চাদেরই কেন করো?” প্রশ্নটা করতে না করতেই আর একটা সম্ভাবনা মাথায় এসে আমার ভিতরে একটা ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিল বটে, কিন্তু মনের জোরে প্রশ্নটা করেই ফেললাম—“এই তুমি চাইল্ড ট্রাফিকিং-এর কেউ নও তো? ছেলেধরা?”
হো হো করে হেসে উঠল ছোট্টুলাল। হাসির ঠেলায় তার চোখ কুঁচকে এত্তটুকু হয়ে গেল। হাসির দমক থামলে ছোট্টুলাল হাত দিয়ে মুখটা সাপটে নিয়ে বলল, “না খোকাবাবু, আমি ছেলেধরা নই। তবে সম্মোহন জানি এ-কথাটা সত্যি। আমার গুরু আমাকে শিখিয়েছিলেন। বিহার-নেপাল সীমান্তে একটা ছোট্ট গ্রামে তাঁর দেখা পেয়েছিলাম। এই বাইস্কোপের বাক্স আমায় দিয়ে তিনি মুক্ত হয়ে তিব্বতের পথে রওনা হয়েছিলেন।”
একটু থেমে ফের ছোট্টুলাল বলতে লাগল, “সম্মোহন জানলেও তা অন্য কোনও কাজে ব্যবহারের অনুমতি নেই আমার খোকাবাবু। আমার কাজ কেবল যারা যা মন থেকে দেখতে চায়, তাদের সেই দেখার ব্যবস্থা করে দেওয়া।”
“কীভাবে ব্যবস্থা করো?”
“খুব সহজ খোকাবাবু। যারা যা দেখতে চায় তার সবকিছু তো তাদের মনের ভিতরেই থাকে। আমার কাজ তো সেই স্মৃতির বুদবুদ খুঁজে দেওয়া। বাকিটা ওই বাইস্কোপের কেরামতি।”
আমি চুপ করে ছোট্টুলালকে দেখছিলাম। কে এই ছোট্টুলাল? সবাইকে বায়োস্কোপ দেখিয়ে কী লাভ ওর? এরকম কি কেউ হয়?
“হয় খোকাবাবু, সবাই তাই হয়। বড়ো হলে দেখবে। বুঝবে কি বুঝবে না, তা বলতে পারি না, তবে দেখবে জরুর। এই যে কেউ ছবি আঁকে, কেউ গান গায়, কেউ দিস্তা দিস্তা গল্প লেখে—কীসের জন্য?”
“সে তো তাদের পেশা।”
“আমারও তাই।”
“তারা তো পয়সা পায়। তুমি কি পাও?”
“পয়সা নয় খোকাবাবু, তারা আসলে যেটা পায়, আমিও তাই পাই।”
“কী?”
“শান্তি। আনন্দ।”
আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না তখনও। ছোট্টুলাল বলল, “ওসব বাদ দাও খোকাবাবু, যা দেখবে বলে আমায় খুঁজছিলে আগে সেটা তো দেখো!”
“সত্যি আম্মা-ঠাম্মা দেখা যাবে?” আমার মুখ থেকে প্রশ্নটা ফস করে বেরিয়ে এল।
“যাবে না তো কি অমনি অমনি বলছি? এসো, চোখ রাখো দেখি আমার এই বাইস্কোপে।”
বারো
ছোট্টুলালের বাইস্কোপে চোখ রাখতেই বাক্সের ভিতরটা কেমন যেন থিয়েটারের বিরাট পর্দার মতো হয়ে গেল। পর্দায় হিজিবিজি দাগ নামতে নামতে একসময় আলো ফুটে উঠল। তারপর এক কোনায় কে যেন দিল এক খাবলা রঙ ছেড়ে। জলরঙ করার সময় যেমনটা হয়, তেমন করে সেই রঙ ভাসতে ভাসতে গোটা পর্দায় ছড়িয়ে গেল। তারপর সেই রঙ জায়গায় জায়গায় গুটলি পাকাতে পাকাতে আস্তে আস্তে আস্ত ছবি হয়ে গেল। চলমান ছবি। একটা মানুষ। গোল টম্বুল একজন। কী মিষ্টি তাঁর আঁচল! ওই আঁচল আমি খুব চিনি। আঁচল দিয়ে আলতো আলতো করে যাকে মুছিয়ে যাকে লাল গামলাভরা জল থেকে তুলছে, সেই খিলখিলে বাচ্চাটা কি আমি?
আমিই তো! এই ছবি তো আমাদের অ্যালবামে আছে। কতদিন যে পুরোনো ছবির অ্যালবাম দেখিনি! মা কত বলে। হুঁ হাঁ করে পালিয়ে গিয়ে ফোন দেখি।
আম্মার পাশে ঝেঁসি মাথা নিয়ে তাতাই খেলা দিচ্ছে। দাদানদা ছাতা মাথায় কেন? ও, এটা তো দাদানদার বাড়ির উঠোন। দোতলায় দিদিদি আর ছোদ্দিদির হাসিভরা মুখ দেখা যাচ্ছে। হাওয়ায় ওদের সাদা চুলগুলো ফুরফুর করে উড়ে গ্রিলের বাইরে এসে পড়ছে। দিদিদির ঘাড় কাঁপছে না! ছোদ্দিদিও তো সোজা হয়েই দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে। এখনকার দিদিদি, ছোদ্দিদির সঙ্গে তাদের মেলানো যায় না।
কোত্থেকে একটা হলুদ রঙের পাখি ফরফরিয়ে সেই ছোট্ট আমির উপর দিয়ে উড়ে গেল। অমনি সেই ছবিখানা যেন দুলে উঠে মুহূর্তের মধ্যে সব ঘেঁটে গিয়ে আবার রঙের নড়াচড়া শুরু হয়ে গেল।
রঙ নড়তে-চড়তে নড়তে-চড়তে এবার ফুটে উঠল যে ছবি, সেখানে আর একটু বড়ো আমি খাটের উপর বাবু হয়ে বসে। সামনে প্লেটে লুচি আর চিনি। পিছনে ঠাম্মা বসে পাখা দিয়ে মাথায় হাওয়া করছে। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে যে কী ভালোই না বাসতাম চিনি আর লুচি খেতে! যত কিছুই রান্না হোক, আমি লুচি খাব চিনি দিয়েই। পাশে জুজুদাদা বসে কী যেন বলছে। শোনা যাচ্ছে না কিছু, তবু আমি বুঝতে পারছি—জুজুদাদা বলছে, “ভাই ভালো! খেয়ে নাও তো এবার পেটটি ভরে।” হঠাৎ ঘরের দরজা খুলে কে যেন হুড়মুড়িয়ে এল আর ছবিটা ফের দুলতে দুলতে ঘেঁটে গেল।
আবার রঙের নড়াচড়া। এবার আম্মার কোলে চড়ে আমি রান্নার কড়াই দেখছি। কড়াইয়ে মশলা কষানো হচ্ছে আর আমি আম্মার ট্যাঁক থেকে ঝুলে ঝুলে জুলজুল করে দেখছি আর হাত দিয়ে এই কৌটো ওই কৌটো দেখাচ্ছি। আম্মা সেই কৌটো খুলে কখনও কড়াইয়ে কিছু দিচ্ছে, কখনো-বা দেওয়ার ভঙ্গি করছে। তারপর যেই না ভাজা মাছগুলো সেই মশলায় ছাড়ল, অমনি সেই ছবি দুলে উঠল।
ঠাম্মাকে নিয়ে আমরা বেড়াতে গেছি। এটা বোধহয় ঠাম্মার দাদার বাড়ি। বাবা আর মা আমাদের পিছনে, আমি ঠাম্মার হাত ধরে হাঁটছি। এটা একটা ধানক্ষেত। তার মাঝখান থেকে কারা সব কাস্তে হাতে উঠে এসে এসে ঠাম্মার সঙ্গে গল্প করছে আর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে, থুতনি ধরে আদর করছে। একটা হাফ-প্যান্ট পরা বাচ্চা এল। তার কোলে একটা খরগোশ। লাল চোখ। খরগোশ দিল এক লাফ। সেই ছেলেও দিল খরগোশের পিছনে দৌড়। আমিও দৌড়তে যাব অমনি মা এসে আমায় কোলে তুলে নিল আর এবারের ছবিটাও গেল শেষ হয়ে।
আবার ছবি ফুটছে। আম্মার সঙ্গে আদ্যাপীঠ মন্দিরের ছবি। আম্মা ঠাকুর দেখছে, প্রণাম করছে আর আমার মাথা-বুক সাপটে দিচ্ছে। মন্দিরের বাইরে থেকে বেলুন কিনে দিল আমায়।
ঠাম্মার বাড়িতে অনেক লোক। জুজুদাদা আমায় নিয়ে টিভির ঘরে বসে আছে। টিভিতে শিনচ্যান চলছে। আমি হাঁ করে দেখছি। ঠাম্মা আর মা এল। ঠাম্মা বলে দিচ্ছে আর মা একটু একটু করে আমায় ভাত খাইয়ে দিচ্ছে। আমি হাঁ করে টিভি দেখছি। জুজুদাদা আর ঠাম্মা হাসিমুখে আমায় দেখছে। আম্মা হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিয়ে বোধহয় সবার সঙ্গে কথা বলতে বলছে। আমি মাথা নাড়তে নাড়তে আবার কেড়ে নিচ্ছি রিমোটটা।
বেড়াতে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আমায় গাড়ি কিনে দিচ্ছে, বুড়ির চুল কিনে দিচ্ছে আম্মা। ফ্ল্যাটে আমার জ্বর হয়েছে, দাদানদার বাড়িতে আঁচলে চোখ মুছছে আম্মা।—
এরকম ছবির দল ভাসতেই থাকল, ভাসতেই থাকল। দেখতে দেখতে ঠাম্মার কোমর পড়ে ঠাম্মা কেমন ভাঁজ হয়ে গেল; আম্মার দাঁত পড়ে গিয়ে অমন সুন্দর ঢলঢলে মুখটা তুতলুপুতলু হয়ে গেল আর আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম যে যত বড়ো হচ্ছি আমি, তত কেমন যেন ছবিগুলো এখনকার মতো বোরিং হয়ে যাচ্ছে। আম্মা-ঠাম্মা সবাই কিন্তু তাদের মতো করে ভালোবাসছে। কিন্তু তারা যখন ভালোবাসছে, তখন আমার হাতে কখনও রিমোট তো কখনও ফোন।
আম্মার বাড়িতে বহুরূপী এসেছে। ফজুদাদু উঠোন থেকে ডাকছে। আম্মা ঘরে এসে আমায় ডেকে গেল, আমি বেরোতে পারলাম না। হাতের ফোনে যে ডানজেন অ্যান্ড ড্রাগনের ভিডিও চলছে। গেম জমে গেছে, ওদিকে বাইরে বহুরুপী হনুমানের নাচও জমে গেছে। সেও লাফায়, লিচু গাছে হুড়মুড়িয়ে আসল হনুমানও লাফায়। আম্মা আবার এসে ডেকে গেল। আমি বেরোলাম না। মা এসে জোর করে নিয়ে গেল। ওদের দেখে আমারও বোধহয় আনন্দ হল, কিন্তু থাকতে পারলাম না। দরজার পাশের চেয়ারে বসে ভিডিও দেখতে থাকলাম।
দেখতে দেখতে এখনকার সময় চলে এল। কোমরের জন্য এখন ঠাম্মা আর বাইরে যেতে পারে না। দাদানদার শরীর তেমন ভালো না বলে আম্মাও আর বাইরে যেতে পারে না। আমার হাতে মোবাইল গেম আরও বেড়েছে।
এসব তো জানি। তারপর?
এবারের পুজোর ঢাকিরা ফিরত যাচ্ছে। দশমীর যাত্রা-ঘট পাতা ঠাকুরঘরে। সামনে কলাপাতায় জোড়া পুঁটি মাছে লাল পিঁপড়ে জমেছে। ঠাম্মা কাঁপতে কাঁপতে খই পাক দিয়েছে। কাঁপা কাঁপা হাতে বয়াম ভরে তুলে রাখছে। বুঝতে পারছি, আমরা ফিরলেই বাটি ভরে আমায় খেতে দেবে। আমি তো খই খাই না। বাবা কটমট করে তাকাবে, আমি খাব। ঠাম্মা হাসিমুখে শুধু আমায় দেখবে।
আম্মার বাড়িময় এখন শুধু সবুজ। জঙ্গল। কে কাটবে! দাদানদা পারে না। দিদিদি, ছোদ্দিদি আরও বুড়ো হয়ে গেছে। বাড়ির অন্যরা সবাই এখন কলকাতায় থাকে। বিকেলবেলা। বসার ঘরে দুটো চেয়ারে দাদানদা আর আম্মা বসে টিভি দেখতে দেখতে ঝিমোচ্ছে। টিভিতে শিনচ্যান।
আবার পর্দায় আলো জ্বলে উঠল। আমার ভালো লাগছে না। কেন জানি না চোখ জ্বলছে। আমি বায়োস্কোপে চোখ রেখেই বললাম, “কী হল, এরপরে কী হবে দেখাও!”
ছোট্টুলালের গলা শোনা গেল—“এরপরে যা হবে সে তো তুমি দেখতেই পাবে খোকাবাবু! তার জন্য আর ছোট্টুলালের বাইস্কোপ কেন? জীবনের বাইস্কোপ তো আর ছোট্টুলালের নয়, তোমার। মন দিয়ে দেখো খোকাবাবু। ওই যন্ত্রটায় জীবন নাই খোকাবাবু, তেমন তোমার গেম দেখার যন্ত্রতেও জীবন নাই। জীবন আছে ভালোবাসায়। তোমার আম্মা-ঠাম্মায়।”
বায়োস্কোপ তখন অন্ধকার। চোখ বাইরে এনে দেখি অন্যরা কেউ নেই। কেবল ছোট্টুলাল দাঁড়িয়ে আছে। তারও গোছগাছ সারা।
আমি বায়োস্কোপ ছাড়তেই সে বাক্সখানা কাঁধে ঝুলিয়ে বলল, “তাহলে চলি খোকাবাবু?”
অচেনা এই লোকটা চলে যাচ্ছে বলে আমার কষ্ট হচ্ছে এটা আমারই বিশ্বাস হচ্ছে না। ছোটবেলায় আম্মা-দাদানদা যখন আমাদের ফ্ল্যাট থেকে চলে যেত, তখন এমন কষ্ট হত। বলতে পারতাম না। ছোট্টুলালকেও বলতে পারলাম না। কেবল বললাম, “তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না?”
“কেন হবে না? চাইলেই হবে। আকাশ যখন মেঘলা হবে, গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হবে, ধুলোর ঝড়ে অন্ধকার হবে সবদিক তখন ডুগডুগি বাজালেই ছোট্টুলালের বাইস্কোপ হাজির হয়ে যাবে খোকাবাবু।”
“ডুগডুগি তো আমার নেই!”
“কে বলেছে খোকাবাবু? দায়া পকেট তো দেখো!”
পকেটে হাত দিতেই কী একটা ঠেকল। বার করে এনে দেখি আমার তৈরি সেই ব্রহ্মাস্ত্রের মোড়ক। ছুড়ে ফেলে দিয়ে আবার হাত ঢুকালাম ডান পকেটে। ঠান্ডা কী একটা হাতে ঠেকছে। বার করে এনে দেখলাম, চকচকে একটা ধাতুর ডুগডুগি। এই এত্তটুকু। ব্যাজার মুখে বললাম, “ধুস! এটা বাজবে নাকি?”
“বাজনা তো মনে বাজে খোকাবাবু। তুমি বাজাতে চাইলেই বাজবে।” বলতে বলতে ফের টা টা করতে করতে ছোট্টুলাল সোজা হাঁটতে হাঁটতে সেই বটগাছে পার হয়ে দূরে, আরও দূরে চলে যেতে লাগল। পাশে পাশে চলল সেই ছাগলছানা চারটে তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে লাফাতে। যেতে যেতে যেতে একসময় মিলিয়ে গেল সবাই।
একটা শব্দ শুনে দেখি সেই বটগাছ তলায় ফের জমা হয়েছে কোত্থেকে এক দশাসই দাঁড়কাক আর আম্মার বাড়ির সেই হলদে পাখিটা। দাঁড়কাকটা আমার দিকে তাকিয়ে ‘ঘ্রাঁ’ করে এক পিলে কাঁপানো হাঁক দিয়েই উড়ে গিয়ে বসল উঁচু একটা ডালে। আর সেই হলুদ পাখিটা অবিকল আমার স্কুলের একটা দিদির গলায় আমায় বলল, “এই হাঁদা! হাবার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে আমার পিছন পিছন আয়।”
সে হলুদ পাখি উড়ল রাস্তার দিকে। তার পিছনে আমিও দৌড়োলাম। কিন্তু রাস্তা যে আর ফুরোয় না। এতদূর তো ছিল না! এত সময় তো লাগেনি আসার সময়! ভাবতে ভাবতে দৌড়তে দৌড়তে দু-বার হোঁচট খেয়ে পড়লাম মাঠে। হাঁটুর কাছটা ছড়ে গেল। কিন্তু পাখি তো থামল না।
তার পিছনে দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ সামনে দেখি একটা পুকুর। আমি তো সাঁতার জানি না। ওদিকে সেই হলুদ পাখিও আমার সামনে এসে উড়ছে আর বলছে, “আরে চল হাঁদু, থামিস না। থামলেই তো এসে পড়বে!”
“কে এসে পড়বে?”
“ওই দ্যাখ, এসে পড়ল! তোর জন্য হাঁদা আমায় ধরা পড়তে হবে।”
পাখির কথা শেষ হতে না হতেই ‘ঘ্রাঁ ঘ্রাঁ’ করতে করতে সেই দাঁড়কাকটা উড়ে এসে হলুদ পাখিটাকে এক ঠেলায় ফেলে দিল জলে। আমিও দিগ্বিদিক না ভেবে তাকে বাঁচাতে দিলাম ঝাঁপ। হাজার হাজার ঢেউ কোত্থেকে এসে তখন আমায় ধাক্কা দিতে শুরু করল।
“এই! অনেক হয়েছে, ওঠ এবার!”
তাকিয়ে দেখি মা ঠেলে ঠেলে আমায় ডাকছে। আমার মাথা ঠেকে রয়েছে জানালার বন্ধ কাচে।
তাহলে কী এতক্ষণ স্বপ্ন দেখলাম?
“হোটেল এসে গেছে, চল নাম।”
গাড়ির দরজা খুলে নামতে গিয়ে হাঁটুতে খচ করে লাগল। মা-বাবাকে আড়াল করে প্যান্টটা হাঁটুর কাছে তুলে দেখলাম ছড়ে গেছে খানিকটা। সঙ্গে সঙ্গে ডান পকেটে হাত দিলাম। হাতে ঠান্ডামতো যেটা ঠেকছে আমি জানি সেটা কী। খুব যত্ন করে রাখতে হবে এটাকে। ঘরে যাওয়া দরকার। তারও আগে দরকার যেটা সেটা বাবাকে একটা কথা বলা।
“বাবা, এবার বাড়ি গিয়ে ঠাম্মার বাড়ি যাব। খইপাক খাব। আর সামনের বছর থেকে পুজোর সময়টা আমরা তিনজনেই আম্মার বাড়ি যাব, অন্য কোত্থাও না। মনে থাকে যেন।”
বাবা আর মা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। আমি হোটেলে আমাদের ঘরের দিকে চললাম। বড়ো হতে পারি, কিন্তু এতগুলো মনখারাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্ত আমি এখনও হইনি।
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী