প্রবন্ধ
15% OFF * FREE SHIPPING
প্রবন্ধ
সুদীপ ঘোষাল
বিবেকানন্দের প্রথমে নাম রাখা হয়েছিল বীরেশ্বর, সংক্ষেপে বিলে। তাঁর পোশাকি নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ। ছোটবেলায় নরেন ছিলেন খুব জেদি ও দুরন্ত মনের। তিনি যা মনে করতেন তাই করতেন। মাঝে-মধ্যে খেলায় খেলায় তিনি সন্ন্যাসী সাজতেন আর তাঁর মাকে গিয়ে বলতেন—দেখো মা, আমি কেমন শিব সেজেছি। ছোটবেলা থেকেই স্বামীজির আধ্যাত্মিক দিক আগ্রহ ফুটে উঠে। তিনি ছোটবেলা থেকেই রাম-সীতার এবং শিবের মূর্তি পূজা করতেন এবং দীর্ঘক্ষণ পূজা করতে করতে ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন।
নরেনের বন্ধু একদিন বলেন তাঁর মাকে, “নরেন হল আমাদের দলের অলিখিত নেতা। নেতা তো এমনি এমনি হয় না। তার কাজ, দল চালানোর কৌশল তাকে নেতা বানিয়েছিল। একদিন দুপুরবেলায় সে আমাদের ডাক দিল তার বাঁশি বাজিয়ে। বাঁশির ডাক শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠত। চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে বটতলায়। আমাদের মিলন অফিস ছিল এই বটতলা। চারজন ছুটে চলে যেতাম মাঠে। নরেন শিবঠাকুরের পুজো করত আর বন্ধুরা প্রসাদ পাওয়ার আশায় বসে থাকত। গ্রীষ্ম অবকাশে বটগাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম নরেনের নেতৃত্বে। তারপর ঝোল-ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়।”
বন্ধুর মা বললেন, “নরেন খুব ভালো ছেলে। ওর সঙ্গে খেলবি। কিছু শিখতে পারবি।”
***
নরেন বন্ধুর বাড়ি এসে বললেন, “চল বটতলায় যাই।”
তাঁর বন্ধু বললেন, “বটতলায় যেতে গা ছমছম করে।”
কোনও বন্ধুই ভয়ে সেদিন বটতলায় গেলেন না। বন্ধুরা কোন লোকের মুখে শুনেছেন, গাছে ভূত আছে।
নরেন একা একা চলে গেলেন গাছতলায়। বন্ধুরা খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখলেন, ভূত থাকা গাছটায় নরেন বাদুড়ের মতো ঝুলছেন। তাঁকে দেখে অন্য বন্ধুদের সাহস বেড়ে গেল।
নরেন ছোটবেলা থেকেই নিজের বন্ধুদের নিয়ে দল গঠন করেছিলেন। বন্ধুরা নরেনকে দলের নেতা বলে মেনে নিয়েছিলেন। তাঁর সাহস, বুদ্ধি ও উদার হৃদয় তাঁকে নেতা হতে সাহায্য করেছিল।
ছোটবেলা থেকে নরেন ছিলেন শিবের ভক্ত। তিনি শিবের পুজো এবং শিবের সামনে বসে ধ্যান করতে ভালোবাসেন। মাঝে-মধ্যে নরেন এবং তাঁর বন্ধুরা ধ্যান ধ্যান খেলতেন। একদিন সেইরকম ধ্যান ধ্যান খেলতে খেলতে একটি সাপ এসে হাজির হয়। এই দেখে তাঁর বন্ধুরা পালিয়ে যান আর নরেন ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকেন। কিছুক্ষণ পর সাপটি নরেনকে কিছু না করে চলে যায়। পরে ধ্যানভঙ্গ হলে নরেন বলেছিলেন যে তিনি বন্ধুদের ডাক বুঝতে পারেননি। বরং তাঁর মনে হচ্ছিল যে তিনি এক অন্য জগতের বাসিন্দা হতে গিয়েছেন, যেখানে শুধু আনন্দের ঢেউ।
স্বামীজির ছোটবেলার ওপর আলোকপাত করলে আমরা দেখতে পাই, ধ্যানপরায়ণতা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, কর্মপ্রিয়তা, পরোপকার ইত্যাদি ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এইসব বৈশিষ্ট্য তাঁর চরিত্রের মধ্যে বীজের আকারে নিহিত ছিল। পরবর্তীকালে তাদের সম্যক বিকাশ ঘটে। তাঁর শিক্ষা তাঁর মায়ের কাছে থেকে শুরু। তাঁর মা তাঁকে সর্বপ্রথম বাংলা এবং ইংরেজি ভাষার বর্ণমালার শিক্ষা দিয়েছেন। এছাড়া রামায়ণ এবং মহাভারতের বিভিন্ন গল্পও শোনাতেন যা স্বামীজি খুবই মনোযোগ সহকারে শুনতেন।
ছ’বছর বয়সে নরেনকে স্থানীয় এক পাঠশালায় ভরতি করে দেওয়া হয়। এরপর পাঠশালা থেকে তাঁকে স্কুলে নিয়ে আসা হয়। নিযুক্ত করা হয় এক গৃহশিক্ষক। নরেন পড়াশোনা করতে ভালোবাসেন, এর পাশাপাশি ছেলেমানুষি দুষ্টুমিতে ছিলেন সবার সেরা। ছোটবেলা থেকেই ছিল তাঁর দারুণ স্মরণশক্তি। ছোটবেলা থেকেই স্বামীজির মধ্যে নেতৃত্বে ভাবের জাগরণ ঘটে গিয়েছিল। তাঁর সমস্ত বন্ধুরা তাঁকে নিজেদের নেতা বলে মনে করতেন। কারণ, তিনি তাঁর সমস্ত বন্ধুকে সমানভাবে দেখতেন, কখনও কাউকে ছোটো করতেন না। এছাড়া ছোটো থেকে তাঁর মন ছিল উদার সহানুভূতিসম্পন্ন।
শিক্ষকমশাই যখন ক্লাসে পড়াতেন, তখন স্বামীজি ধ্যানমগ্ন হয় শিক্ষকের পড়া শুনতেন। এই দেখে শিক্ষকমশাই মনে করেন যে স্বামীজি ক্লাসে ঘুমোচ্ছেন। এই দেখে তিনি ভীষণ রেগে যান। তখন স্বামীজিকে পড়া ধরলে স্বামীজি শিক্ষকমশাইর সমস্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে থাকেন। এই দেখে শিক্ষকমশাই খুব খুশি হন।
একবার অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে জমে যাওয়া জলের বন্যার সময় স্কুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন বন্ধু দলের নেতা নরেন। কোথাও সাঁতার জল, কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ নরেনের হাতে জড়িয়ে ধরেছে। নরেন এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলে দিলেন সাপটা। স্কুলে তাঁকে যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে সে কী উল্লাস! যে-কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা নরেনের ছিল। তিনি সামনে আর বন্ধুরা চলেছেন তাঁর পিছু পিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলেন স্কুলে। হেড-মাস্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।
টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেল। নরেন সকল বন্ধুদের নিজের টিফিন বের করে দিলেন। বন্ধুরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলেন। তারপর তিনি বললেন, “এসো সবাই এক হয়ে না খেয়ে গরিবদের খাবার বিলিয়ে দিই।” নরেন আগেই সকলকে বলে রেখেছিলেন, ‘একটা করে মা-মাসির কাপড় নিয়ে আসবি ফুটপাতের গরিব মানুষের জন্য।’
পরের দিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। নরেন কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। কয়েকদিন হল তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। বন্ধুরা ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলেন। সেখানে দেখেন নরেন হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। দিনের বেলা এখানেই তাঁর ডেরা। এখন তাঁর মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যাম-কুড়াকুড়। মন মন্দিরে তাঁর দুর্গা মন-দেশ ছাড়িয়ে, চলে গেছে অভাবির বাতাসে। পুজো বাড়িতে বন্ধুদের দেখেও কোনও কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে নরেন বাইরে চলে গেলেন। বন্ধুরা জানেন, তিনি এখন চাল-ডাল নিয়ে গরিব বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবেন। নরেন বলেন, ‘ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কী? আমি ওকে কতটুকু আর দিতে পারি?’
পরবর্তীতে তিনি ১৮৭১ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্থাপিত বিদ্যাসাগর ইনস্টিটিউট-এ পড়াশোনা শুরু করেন। সেখানে নরেন প্রতিবছর প্রথম স্থান অধিকার করতেন। পড়াশোনা চলাকালীন পিতার কর্মসূত্রে নরেনকে পরিবারসহ মধভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের রায়পুরে স্থানান্তরিত হতে হয়। কয়েক বছর পর তাঁরা কলকাতায় ফিরে আসেন এবং ১৮৭৯ সালে ষোলো বছর বয়সে মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
তিনি স্কুলে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে ছোটো থেকেই বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, দর্শন, বেদ, উপনিষদ ইত্যাদি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলা ও সামাজিক কাজকর্মে বিশেষভাবে অংশগ্রহণ করতেন।
স্বামী বিবেকানন্দ উত্তর কলকাতার এক কায়স্থ দত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই দত্ত পরিবারের আদি নিবাস ছিল অধুনা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার অন্তর্গত দত্ত-ডেরিয়াটোনা বা দত্ত-ডেরেটোনা গ্রামে। মুঘল শাসনকাল থেকেই দত্তরা উক্ত গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। গবেষকরা অনুমান করেন যে তাঁরাই ছিলেন ওই গ্রামের জমিদার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে দত্ত পরিবারের সদস্য রামনিধি দত্ত তাঁর পুত্র রামজীবন দত্ত ও পৌত্র রামসুন্দর দত্তকে নিয়ে গড়গোবিন্দপুর গ্রামে আসেন। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু হলে উক্ত এলাকার অন্যান্য বাসিন্দাদের সঙ্গে দত্তরাও সুতানুটি গ্রামে চলে আসেন। এখানে প্রথমে তাঁরা মধু রায়ের গলিতে একটি বাড়িতে বাস করতেন। ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটের যে-বাড়িতে বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই বাড়িটি নির্মাণ করেন রামসুন্দর দত্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামমোহন দত্ত। রামমোহন দত্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্গাপ্রসাদ দত্ত ছিলেন বিবেকানন্দের পিতামহ। তিনি সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। পঁচিশ বছর বয়সে একমাত্র পুত্র বিশ্বনাথ দত্তের জন্মের পর তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। বিশ্বনাথ দত্ত দুর্গাপ্রসাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কালীপ্রসাদ কর্তৃক প্রতিপালিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাটর্নি। বিশ্বনাথ দত্ত বাংলা, ফারসি, আরবি, উর্দু, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষা শিখেছিলেন। সাহিত্য, ইতিহাস ও ধর্মগ্রন্থ পাঠে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। ধর্ম বিষয়ে তিনি উদার ছিলেন। বাইবেল ও দেওয়ান-ই-হাফিজ ছিল তাঁর প্রিয় গ্রন্থ। তিনি ‘সুলোচনা’ ও ‘শিষ্টাচার-পদ্ধতি’ নামে দুইটি বই রচনা করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রথা প্রবর্তনের সমর্থনে তিনি প্রকাশ্যে মতপ্রকাশ করেছিলেন। দুর্গাপ্রসাদের সংসারত্যাগের পর কালীপ্রসাদের অমিতব্যয়িতায় দত্ত পরিবারের আর্থিক সাচ্ছল্য নষ্ট হয়েছিল। কিন্তু অ্যাটর্নিরূপে বিশ্বনাথ দত্তের সুদূর প্রসারিত খ্যাতি সেই সাচ্ছল্য কিয়দংশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। তাঁর স্ত্রী ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন সিমলার নন্দলাল বসুর মেয়ে। তিনি বিশেষ ভক্তিমতী নারী ছিলেন। প্রথম কয়েকটি সন্তানের মৃত্যু ও কন্যাসন্তানের জন্মের পর পুত্রসন্তান কামনায় তিনি তাঁর এক কাশীবাসিনী আত্মীয়াকে দিয়ে কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরে নিত্য পূজা দেওয়ার ব্যবস্থা করান। এরপরই স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম হওয়ায় তাঁর বিশ্বাস হয় যে, তিনি শিবের কৃপায় পুত্রলাভ করেছেন। পিতার প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও মায়ের ধর্মপ্রাণতা বিবেকানন্দের চিন্তা ও ব্যক্তিত্ব গঠনে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল।
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী